You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাদেশের অগ্রগতি ১৯৭৩ | বঙ্গবন্ধুর সরকার কর্তৃক প্রকাশিত দালিলিক বই

উপক্রমণিকা

এই গ্রন্থে দেশের সার্বিক অগ্রগতি প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা। হয়েছে নানাবিধ সমস্যার মধ্য দিয়ে সরকার যে, জাতীয় প্রচেষ্টার মাধ্যমে অগ্রগতির পথে এগিয়ে চলেছেন গ্রন্থে পরিবেশিত তথ্যাবলী সে কথাই প্রমাণ করে। অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যাদির উৎপাদন বৃদ্ধি, খাদ্য ঘাটতি পূরণ, যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি রোধ, সামাজিক ব্যাধির বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সম্পর্ক স্থাপন-এসবই সরকারকে মোকাবেলা করতে হয়েছে। জনগণের সরকার নিরলস প্রচেষ্টায় সমস্যাগুলি কেবল সঠিক অনুধাবন করেন নি; সে সবের সমাধানের কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন।
স্বাধীনতার পর আমাদের যাত্রা শুরু হয় বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে। স্বাধীনতা উত্তর কালে অধিকাংশ সময় কেটেছে যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পুর্ণগঠনে। একথা সত্য যে, ১৯৭১ সালের যুদ্ধের ফলশ্রুতি অনেক সমস্যা সমাধান করা হয়েছে; এবং প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সত্যিকারের অগ্রগতি অবশ্যম্ভাবী।
পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ব্যয়ের পরিমাণ ধরা হয়েছে ৪৪৫৫ কোটি টাকা। বর্তমানে শতকরা ৩ ভাগ হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য হলো জনসংখ্যা বৃদ্ধি হার এর পরিপ্রেক্ষিতে মোট দেশজ উৎপাদন বার্ষিক শতকরা ৫’৫ ভাগে উন্নীত করা। অধিকন্তু, কৃষির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। কারণে দেশের শতকরা ৮০ জনেরও বেশী লোকের প্রধান অবলম্বন কৃষি।
‘বাংলাদেশের অগ্রগতি, ১৯৭৩’ সরকারি কার্যক্রম এক বৎসরের একটি খতিয়ান মাত্র। এ-গ্রন্থ তথ্যসূত্র হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে।

প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা

প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা হচ্ছে জাতীয়তাবাদ গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার চারটি মৌলিক রাষ্ট্রনীতি ব্যাপক কাঠামোর ভিত্তিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির রূপান্তর সাধনের পথে প্রথম পদক্ষেপ। ১৯৭৩ সালের শেষভাগে এই পরিকল্পনা শুভ সূচনা করা হয়। পরিকল্পনার লক্ষ্য গুলি হল:-
(ক) আয় এবং ভোগের সুষ্ঠু বন্টন এর নিশ্চয়তা বিধানের উদ্দেশ্য কর্মসংস্থান ও অন্যান্য ব্যবস্থা দ্রুত সম্প্রসারনের জন্য জাতীয় আয় বৃদ্ধির যুক্তিসংগত উচ্চহার রক্ষা করে দারিদ্র্য হ্রাস করা;
(খ) শতকরা ৩ ভাগ হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি-যা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেয়ে শতকরা ২’৮ ভাগে দাঁড়াবে, তার প্রেক্ষিতে মোট জাতীয় উৎপাদন বার্ষিক শতকরা ৫’৫ ভাগ হারে বৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন এবং বর্তমানের তুলনায় শ্রমজীবীর সংখ্যা ৩৯ লক্ষ বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে সার্বক্ষণিক কর্মের সংখ্যা ৪১ লক্ষ বৃদ্ধি করা;
(গ) মূল্যমানের সাধারণ স্তরকে স্থিতিশীল করা;
(ঘ) বৈদেশিক মুদ্রা আয় ও ব্যয়ের মধ্যকার ব্যবধান কমানোর ব্যাপক ব্যবস্থা গ্রহণ করে বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করা। এই নীতির প্রধান প্রধান দিক হচ্ছে : (১) খাদ্যশস্য ও বস্ত্রের এবং উৎপাদকের দ্বারা ব্যবহৃত বেশ কিছুসংখ্যক দ্রব্যের আমদানি বিকল্প ব্যবস্থা ও (২) উৎপাদন কাঠামোর পুনঃবিন্যাস এবং যথাযথ উৎসাহদানের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন করে নতুন ও পুরাতন রপ্তানির সম্প্রসারণ।
পরিকল্পনার অন্যান্য লক্ষ্যের মধ্যে রয়েছে কৃষির প্রথাগত ও কারিগরিগত ক্ষেত্রের রূপান্তর সাধারণের উদ্দেশ্যে অধিকতর দক্ষতা সৃষ্টির দ্বারা অর্থনীতির সমাজতান্ত্রিক সংহত করা, জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উন্নতি সাধন এবং দেশের সর্বত্র উন্নয়নের নিশ্চয়তা বিধান।
পরিকল্পনায় ব্যয়ের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৪৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ ধরা হয়েছে ১৭৫৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ।
কৃষির বিকাশ সাধনের লক্ষ্য অর্জনের জন্য উন্নয়ন ব্যয় হিসাবে কৃষিতে পরিকল্পনায় অন্য সকল বিষয় থেকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। পল্লী সংস্থা, সেচ এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ সহ কৃষি এবং পানি খাতে পরিকল্পনাকালে ব্যয় হবে ১০৬৭ কোটি টাকা। এটা পরিকল্পনার সর্ব মোট ব্যয়ের এক-চতুর্থাংশ। কৃষি উন্নয়ন কর্মসূচির প্রধান লক্ষ্য হল খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন। এটা করা

হবে খাদ্যশস্যের উৎপাদন ১ কোটি ১৩ লক্ষ টন থেকে ১ কোটি ৫৪ লাখ টনে বৃদ্ধি করে। অর্থাৎ সমগ্র পরিকল্পনা কালে খাদ্যশস্যের উৎপাদন শতকরা ৩৪ ভাগ এবং প্রতি বছরে শতকরা ৬’৪ ভাগ বৃদ্ধির পরিকল্পনা করা হয়েছে।
দেশের পরিবহন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও বিকাশ সাধনের ওপরও যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এ খাতে বরাদ্দের পরিমাণ হচ্ছে ৬০৮ কোটি টাকা।
পরিকল্পনায় এই মর্মে সুপারিশ করা হয়েছে যে, শিক্ষার মাধ্যমে সামাজিক প্রয়োজন বহুলাংশে মেটানো হবে। এই সঙ্গে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষার সুযোগ সুবিধার মৌলিক সর্বনিম্ন মানের সুবিধাদির ব্যবস্থা করবার ওপরও জোর দেওয়া হয়েছে। সকল উপযুক্ত স্তরে বিজ্ঞান শিক্ষা ও পেশামূলক কারিগরি প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষার গুণগত উৎকর্ষ বিধানের উপর প্রয়োজনীয় গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। পরিকল্পনা কালে শিক্ষা ও জনশক্তি উন্নয়নে জন্য ৩১৬ কোটি টাকার নির্দিষ্ট করে রাখা হয়েছে।
স্বাস্থ্য সমাজ কল্যাণ এবং পরিবার পরিকল্পনা বাবদ পরিকল্পনাকালে ব্যয় বরাদ্দের পরিমাণ হচ্ছে ২৯০ কোটি টাকা। পল্লী অঞ্চলে স্বাস্থ্য মৌল কাঠামো সৃষ্টির জন্য স্বাস্থ্য খাতের পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। থানা স্বাস্থ্য প্রকল্প এবং ইউনিয়ন কেন্দ্রের মাধ্যমে স্বাস্থ্য রক্ষার সমন্বিত এবং ব্যাপক ব্যবস্থা করাই এই মৌল কাঠামোর লক্ষ্য। জনসংখ্যা পরিকল্পনা কর্মসূচিকে অধিক মাত্রায় অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস করাই এর মুখ্য উদ্দেশ্য। হিসাব মতে বর্তমানে এই হার হচ্ছে শতকরা ৩ ভাগ। পরিকল্পনা কালের শেষ দিকে এই হার অন্ততপক্ষে শতকরা ০’২ ভাগ করা হবে।

এক নজরে
* পরিকল্পনা কালের ব্যয় বরাদ্দ ৪৪৫৫ কোটি টাকা

* কৃষি ও পানি খাতের ব্যয় বরাদ্দ ১০৬৭ কোটি টাকা

* যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন ও উন্নতি সাধনের জন্য ব্যয় বরাদ্দ ৬০৮ কোটি টাকা

* শিক্ষা ও জনশক্তি খাতের ব্যয় বরাদ্দ ৩১৬ কোটি টাকা

* স্বাস্থ্য সমাজকল্যাণ ও পরিবার পরিকল্পনার জন্য ব্যয় বরাদ্দ ২৯০ কোটি টাকা
(পৃ:-২)

খাদ্য ও বেসামরিক খাদ্য সরবরাহ

খাদ্য ও বেসামরিক খাদ্য সরবরাহ মন্ত্রণালয়ের কাজ হল দেশ ও বিদেশ থেকে খাদ্যশস্য সংগ্রহ ও রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত রেশনিং পদ্ধতিতে সেসব সুষ্ঠুভাবে বিতরণ করা।
বাংলাদেশ মূলত; কৃষিপ্রধান দেশ। তা সত্বেও বাংলাদেশকে বিদেশ থেকে প্রতিবছর প্রায় ৩০ লক্ষ টন খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়। ১৯৭৩ সালের দেশে প্রায় ২৯ লক্ষ ৫০ হাজার টন খাদ্যশস্য আমদানি করার প্রয়োজন দেখা দেয়। সরকার স্থানীয়ভাবে খাদ্যশস্য ক্রয় এবং বৈদেশিক সাহায্যের দ্বারা প্রয়োজন মেটাবার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। জুন মাস পর্যন্ত বিদেশ থেকে ১৪ লক্ষ টন খাদ্যশস্য পাওয়া যায়। সরকার কেবলমাত্র খাদ্যশস্যের জন্যই ১৯৭৩-৭৪ সালে বাজেটে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেন এবং ১৯৭৩ সালের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত ১১ লক্ষ ৪৮ হাজার টন খাদ্যশস্য বিতরণ করেন। তাছাড়া, বৈদেশিক সাহায্য এবং দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে ব্যয়ে আরও খাদ্যশস্য সংগ্রহের জন্য আলাপ-আলোচনা চলছে।
বিশ্বের বাজারে খাদ্যশস্যের স্বল্পতা ও অতিরিক্ত মূল্য বৃদ্ধির দরুন বিদেশ থেকে খাদ্যশস্য সংগ্রহ করা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। এজন্য ইতিমধ্যেই সরকার দেশের চাষীদের যথেষ্ট আকর্ষণীয় দাম দিয়ে তাদের নিকট থেকে ১০ লক্ষ টন চাল সংগ্রহের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন।

চিনি

হিসাব অনুযায়ী ১৯৭৩ সালে দেশের চিনি চাহিদা ছিল এক লক্ষ ২০ হাজার টন। এর মধ্যে পূর্ববর্তী বছরের উন্মুক্ত হিসাবে ২০ হাজার টন চিনি পাওয়া যায়। ১৯৭৩ সালে চিনিকলগুলো ১৯ হাজার টন চিনি উৎপাদন করে। তাই এ বছর বিদেশ থেকে ৮১ হাজার টন চিনি আমদানি করা প্রয়োজন দেখা দেয়।
বাংলাদেশ বাণিজ্য সংস্থা খাদ্য ও বেসামরিক খাদ্য সরবরাহ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ১৯৭৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত ৩৬ হাজার ১ শত টন চিনি আমদানি করে। বাংলাদেশে চিনি কল সংস্থা ১৯৭৩-৭৪ সালে এক লক্ষ টন চিনি উৎপাদিত হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে।

খাবার তেল

রেশনিং ব্যবস্থার মাধ্যমে বিতরনের জন্য ১৯৭৪ সালে ১ লক্ষ ৫০ হাজার টন খাবার তেল আমদানি করার প্রয়োজন ছিল। বাংলাদেশ সরকার এক লক্ষ টন সরিষা আমদানি করার জন্য বিদেশে অর্ডার দেন। এছাড়া, কানাডা থেকে
(পৃ:-৩)

পাম্প, গভীর ও অগভীর নলকূপ ইত্যাদি সরবরাহের জন্য একটি কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়।
১৯৭১ সালে মোট ৩৫৮৩১ টি শক্তি চালিত পাম্পের ব্যবস্থা করে তার মধ্য থেকে ৩২৮৯৬ টি পাম্প বসানো হয়। গভীর নলকূপ বসানো হয় ৮৩৫ টি। এ-বৎসর মোট ২১৮৭ টি গভীর নলকূপ চালু ছিল। ঋণ বাবদ কৃষকরা মোট ৩৬ কোটি টাকা পায়। এর মধ্যে ১৬ কোটি টাকা দেওয়া হয় বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক থেকে, ১৪ কোটি টাকা সমবায় থেকে এবং ৬ কোটি টাকা তাকাভি ঋণ হিসেবে।

কীটনাশক ঔষধ

ফসলের চারা সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশে ৪৭০০ টন দানাদার কীটনাশক ঔষধ এবং ১০৩০০ টন সাধারণ কীটনাশক ঔষধের প্রয়োজন হয়। পূর্বনির্দিষ্ট ও অনির্দিষ্ট মোট ২২ লক্ষ একর জমির জন্য ৬২৫ টন কীটনাশক ঔষধ বিতরণ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।

পানিসেচ

১৯৭২-৭৩ সালে মোট ১৩ লক্ষ ৬০ হাজার একর জমিতে পানি সেচ করা হয়। কিন্তু ১৯৭৩-৭৪ সালে ৪০ হাজার শক্তিচালিত দো-লিফুট পাম্প এবং ২৯০০ টি গভীর ও ৩০০০ অগভীর নলকূপ বসানোর ফলে সেচের জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

যান্ত্রিকীকরণ

দখলদার বাহিনী হালের গরুর ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। এই ক্ষতির আশু পূরণ ছিল কঠিন। সমস্যাটি সমাধানের জন্য ১৯ টি জেলায় নির্বাচিত এলাকার ১৯ টি আদর্শ প্রকরের মাধ্যমে যান্ত্রিক চাষের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। ১৯৭৩ সালে এর জন্য অতিরিক্ত ৫০০ ট্রাক্টর ও ৭৫০ টি শক্তিচালিত লাঙ্গল এর ব্যবস্থা করা হয়।
স্বল্প সময়ের মধ্যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এক বিরাট ব্যাপার। তবে, ১৯৭৩ সালে এক্ষেত্রেও কিছু অগ্রগতি সাধিত হয়। এ সময়ে অধিক ফলনের ধান ও গম চাষের জমির শতকরা ৭৫ ভাগ বৃদ্ধি পায়। অধিক ফলনের স্থানকে কেন্দ্র করে খাদ্যশস্য উৎপাদনে যে নতুন কলাকৌশল গৃহীত হয়েছে তা বাংলাদেশের দৃঢ়সংকল্প ও নিষ্ঠাবান কৃষকদের জন্য সম্ভাবনার পথ খুলে দিয়েছে। নানাবিধ প্রচন্ড বাধা-বিপত্তি ও অসুবিধা সত্তেও আধুনিক কলাকৌশল গ্রহণে বিশেষ করে অধিক ফলনের বীজ ও সেচের পানি ব্যবহারে এবং ফলন সংস্করণে তারা আশ্চর্যজনক বুদ্ধিমত্তার পরিচয় এবং বিস্ময়করভাবে সাড়া দিয়েছে। জনসাধারণের খাদ্য ও পুষ্টি গত প্রয়োজন নিভৃতের দিকে লক্ষ রেখে কৃষির উৎপাদন কর্মসূচিতে ১৯৭৩-৭৪ সালে ১ কোটি ২১ লক্ষ্য টন খাদ্যশস্য উৎপাদনের ব্যবস্থা
(পৃ:-৬)

করা হয়। এ বৎসর পাট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্দিষ্ট করা হয় ৭২ লক্ষ্য থাঁট আলু উৎপাদনে ৮ লক্ষ ৩৩ হাজার টন এবং তামাক উৎপাদনে ৯০ লক্ষ ৬ হাজার পাউন্ড।

সম্প্রসারণ

কারিগরি বিষয়ক সাহায্য কৃষকদের দ্বারে পৌছিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্পের অধীনে থানা পর্যায়ে একজন কৃষি ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করে কৃষি সম্প্রসারণ সংগঠন সুদৃঢ় করা হবে। সম্প্রসারণ কর্মীদের প্রশিক্ষণ দানের জন্য এ বৎসর ৮ টি নতুন কৃষি সম্প্রসারণ প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট স্থাপন করা হবে।

গবেষণা

গবেষণার ক্ষেত্রে সমন্বয় সাধন ও নীতি নির্ধারণের জন্য কৃষি গবেষণা পরিষদ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়েছে। এর দায়িত্ব হলো গবেষণার মাধ্যমে কৃষি উন্নয়নের জন্য দেশের সম্পদাদির যথাসম্ভব সর্বাধিক ব্যবহারের ব্যবস্থা করা।

বিশেষ বিশেষ ফসলের উন্নয়ন

বিশেষ বিশেষ ফসলের উন্নয়নের জন্য উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড, তুলা উন্নয়ন বোর্ড ও তামাক উন্নয়ন বোর্ড নামে তিনটি বোর্ড গঠিত হয়েছে। এদের দায়িত্ব হলো নিজ নিজ ক্ষেত্রে সার্বিক উন্নয়ন সাধন।

খাদ্যশস্য বীজ প্রকল্প

খাদ্য শস্য বীজ প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার মধ্যে একটি ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশে ৭৫ লক্ষ ডলার উন্নয়ন ঋণ পাবে। জয়দেবপুরের ধান গবেষণা কেন্দ্রের সম্প্রসারণ, বিভিন্ন বীজ উৎপাদন খামার এর মাধ্যমে উন্নত ধরনের ধান ও গমের বীজ উৎপাদন এবং একটি বীজ অনুমোদন সংস্থা স্থাপন এই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত।

তামাক উন্নয়ন

১৯৭৩ সালে ১০ হাজার একর জমিতে সিগারেটে ব্যবহৃত তামাকের চাষ করা হয়। এই জমি থেকে এ বছর প্রায় ৮৫ লক্ষ পাউন্ড শোধিত তামাক পাতা পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়। ১৯৭২ সালের ৭ হাজার একর জমিতে তামাকের চাষ করে ৬০ লক্ষ পাউন্ড শুকনো তামাক পাতা পাওয়া গিয়েছিল। ইতিমধ্যে বীজের উতপাদন বৃদ্ধি ও মান উন্নয়নের জন্য চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এছাড়া, উন্নত মানের তামাক উৎপাদন বৃদ্ধিতে চাষীদের সাহায্য করবার জন্য দুটি আঞ্চলিক কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে।
(পৃ:-৭)

কৃষিদ্রব্যের বাজারজাতকরণ ও শ্রেণীবিন্যাস

বারোটি পণ্য দ্রব্যের মান গুণাবলী উন্নত রাখবার জন্য ১৯৭৩ সালের প্রথমদিকে বাধ্যতামূলক শ্রেণীবিন্যাস এর ব্যবস্থা করা হয়।
শ্রেণীমান, শ্রেণি বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি মূল্যায়নের জন্য এ বৎসর বিভিন্ন ধরনের রপ্তানিযোগ্য কৃষিদ্রব্য এবং পশু-পাখি ও মৎস্যজাত দ্রব্য সম্পর্কে গবেষণা চালানো হয়। এছাড়া গুড়, মধু, মোম, মৎস্যজাত দ্রব্য ইত্যাদি ধরনের অন্য কয়েকটি পণ্যদ্রব্য সম্পর্কিত গবেষণার কাজও হাতে নেয়া হয়। এ কাজ এখন এগিয়ে চলেছে।

মৃত্তিকা জরিপ

প্রাথমিক নিরীক্ষা কাজ হিসাবে ১৯৭৩ সালে কৃষির দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ৭৯২১ বর্গমাইল জমির জরিপ কাজ সমাধা করা হয়। জরিপকৃত এলাকার দুটি বিবরণী প্রকাশিত হয়েছে এবং ৬ টি বিবরণী প্রকাশ পথে রয়েছে। এছাড়া ১৯৭২-৭৩ সালের জরিপ মৌসুমে জরিপকৃত এলাকাগুলি সম্পর্কে ৩ টি বিবরণী তৈরি হচ্ছে। ২৭৬২ টি মৃত্তিকা নমুনা নিয়ে মোট ১৪২৮৩ টি বিশ্লেষণমূলক নিবারণী এবং ৬৩৮ টি মৃত্তিকা নমুনা নিয়ে মাটির আর্দ্রতা পরীক্ষার উদ্দেশ্যে ২৭৮৬ টি বাস্তব বিশ্লেষণ এর কাজ চালানো হয়েছে। এ বছর ৬০৬৬ মানচিত্রের উপর ৯০৩ টি মানচিত্রাংকন সম্পর্কিত কাজ সম্পাদন করা হয়। এছাড়া, সংশ্লিষ্ট সংস্থা সমূহের সুবিধার্থে জরিপ সম্বন্ধীয় বিবরণীর ৬ টি বাখ্যামূলক কাজও করা হয়।

এক নজরে

* ধান ও গমের উৎপাদন ৯৭ লক্ষ টন

* পাট উৎপাদন ৬৬ লক্ষ গাঁট

* অধিক ফলনের বীজ ধান বিতরণ ১৬,১৫২ টন

* পাট বীজ বিতরণ ৪৫৪ টন

* গম বীজ বিতরণ ১০৩৭ টন

* আলু বীজ বিতরণ ৪১৩৫ টন

* সার বিতরণ ২,৭৩,৬৭১ টন

* ফসল সংরক্ষণ ব্যবস্থা আওতাধীন এলাকা ১ কোটি ১৭ লক্ষ একর

* শক্তি চালিত পাম্প স্থাপিত ৩২,৮৯৬ টি

* গভীর নলকূপ স্থাপিত হয় ৮৩৫ টি

* কৃষকদের ঋণ দেওয়া হয় ৩৬ কোটি টাকা
(পৃ:-৮)

বন, মৎস্য ও পশুসম্পদ

বাংলাদেশ প্রকৃতির দানে ঘন সবুজ বনরাজি, অগণিত নদী-নালা এবং অসংখ্য সবুজ প্রান্তরে ভরা। প্রকৃতির এই সমস্ত অবদান দেশটিকে বন, মৎস্য ও পশু পাখির জন্য এক আদর্শ স্থানে পরিণত করেছে। স্বাধীনতা-উত্তরকালে সরকার এই সব সম্পদের উন্নয়নের দিকে যথাযথ দৃষ্টি দিয়েছেন।

বন

বাংলাদেশ মৌসুমী এলাকাভুক্ত বলে বিপুল স্বাভাবিক বর্ণ সম্পদে সমৃদ্ধ। সম্পদের সুষ্ঠু সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য সরকার বনাঞ্চল থেকে বেসরকারিভাবে বনজ সম্পদ সংগ্রহ নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন এবং ২০ হাজার একর জমিতে নতুন সৃষ্টি করেছেন। আমাদের বনাঞ্চলে প্রচুর পশুপাখি আছে। সরকার এই সমস্ত পশুপাখি শিকার করাও নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। স্পষ্টতই দেশের বন্য পশু পাখি সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
১৯৭২-৭৩ সালে সরকার আনুমানিক ৫২ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ৮ টি বন উন্নয়ন কর্মসূচির বাস্তবায়নে হাত দেন। এগুলির বাস্তবায়নের প্রধান উদ্দেশ্য হল জ্বালানি কাঠ এর উৎপাদন বৃদ্ধি, পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম চাষ নিয়ন্ত্রণ, ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস থেকে উপকূল অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য সমুদ্রতীরে বন সৃষ্টি, মধুপুর গড়ে জাতীয় উদ্যান নির্মাণ, চট্টগ্রামে বন গবেষণার উন্নয়ন, বন সমূহের জরিপ ও বনাঞ্চলের সীমা নির্ধারণ এবং বন কর্মচারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
সরকার বন সৃষ্টিতে উৎসাহ দিয়ে থাকেন। তারা নামমাত্র মূল্যে ১০ লক্ষেরও বেশি চারা গাছ বিতরণ করেছেন। কৃষি উন্নয়ন সংস্থাও বন সৃষ্টিতে উৎসাহ দানের উদ্দেশ্যে বিপুল সংখ্যায় চারা গাছ বিতরণ করেছেন। সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন বড় বড় বন থেকে যথেষ্ট রাজস্ব আসে। স্বাধীনতা-উত্তরকালে বন থেকে সরকারের ১ কোটি ৮৫ লক্ষ টাকা আয় হয়েছে।

মৎস্য

নদীমাতৃক বাংলাদেশে ব্যাপক মৎস্য সম্পদে পূর্ণ। বাংলাদেশের প্রতিটি নদী, উপনদী, খাল-বিল-হাওরে, দীঘি-পুষ্করিণীতে ও সমুদ্রের মাছ পাওয়া যায়। মাছ বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান প্রোটিন জাতীয় খাদ্য এবং অর্থকরী সম্পদ। বর্তমানে ১০ লক্ষেরও বেশি লোক মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।

মৎস্য সম্পদ

স্থলভূমিতে জৈব প্রোটিনের উৎপাদন সীমিত হয়ে পড়েছে। তাই মাছই এখন বাংলাদেশে অতি প্রয়োজনীয় জৈব প্রোটিনের প্রধান উৎস। এ বিষয়টির
(পৃ:-৯)

দিকে লক্ষ রেখে যথাসম্ভব উচ্চ এবং অব্যাহত উৎপাদন নীতির ভিত্তিতে ও বৈজ্ঞানিক পন্থায় বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহার করতে হবে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এই বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে এবং দেশের সমগ্র অর্থনীতিতে মৎস্য সম্পদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সম্বন্ধে অত্যন্ত সচেতন। মাছ বাংলাদেশের মানুষের জন্য কেবল একটি সুস্বাদু খাদ্যই নয়, বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের একটি সম্ভাব্য উৎসও বটে। এই সহজবোধ্যতার নেই মৎস্য সম্পদের উন্নয়নের রক্ষার জন্য ব্যাপক ও আশু বাস্তবায়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
অতীতে মৎস্য পরিদপ্তরের কর্মসূচি সীমাবদ্ধ ছিল কেবল সীমিত (অস্পষ্ট) নিয়ে আভ্যন্তরীণ মৎস্য খামারের উন্নয়ন সাধনে। কিন্তু সমগ্র প্রতিষ্ঠানটিকে ব্যাপকভিত্তিক ও কর্মদক্ষ করে তোলার উদ্দেশ্যে সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ শাখাকে এর সঙ্গে যুক্ত করার ফলে এর কর্ম ক্ষেত্র প্রসারিত হয়েছে।
স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্যজীবীদের পুনর্বাসনের জন্য গৃহীত ৫ কোটি ২০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে একটি কর্মসূচি বাস্তবায়নের কাজ যথেষ্ট এগিয়ে গেছে। এই কর্মসূচি মোতাবেক তাদের মধ্যে কাঠ, নাইলনের সুতা ও দড়ি, ডিজেল ইঞ্জিন, পালের কাপড় ইত্যাদি বিতরণ করা হচ্ছে।
ডিজেল ইঞ্জিন চালিয়ে দেশি মাছ ধরা নৌকা যান্ত্রিকীকরণ এবং বিদেশ থেকে আরও ৮ টি ট্রলার সংগ্রহের জন্য একটি কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে। এর লক্ষ্য হল আভ্যন্তরীণ জলাশয় ও সমুদ্র উভয় স্থানেই উন্নততর পন্থা ও অর্থনৈতিক দিক থেকে সুবিধাজনক উপায় মাছ বরাবর ব্যবস্থা করা।

মৎস্য চাষে পতিত জলাশয়ের ব্যবহার

১৯৭১-৭২ সালে গৃহীত এবং মোট ৩৭ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ের একটি প্রকল্পের বাস্তবায়ন ইতিমধ্যেই শেষ হয়েছে। এর লক্ষ্য ছিল ৮৩৩ একরেরও বেশি পতিত জলাশয়ের উন্নতি সাধন।
১৯৭৩-৭৪ সালের নতুন মৎস্য উন্নয়ন কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ১২ টি পরিকল্পনা। এই ১২ টি পরিকল্পনার মধ্যে ৬ টি হচ্ছে চালু ও বাকি ৬ টি নতুন। পরিকল্পনাগুলির বাস্তবায়নের জন্য ১ কোটি ৪০ লাখ ৯০ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।
মৎস্য উৎপাদনের উদ্দেশ্যে পতিত জলাভূমি উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার জন্য গৃহীত একটি পরিকল্পনার অধীনে প্রায় ১৫০০০ একর জলাভূমি উন্নয়ন শুরু করা হয়। এর কাজ এখন এগিয়ে চলেছে। এই সমস্ত জলাভূমি থেকে ১৯৭৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত প্রায় ৩৪০ টন মাছ পাওয়া যায়। এছাড়া অনেক জায়গায় মৌসুমী মাছ ধরা শুরু হয়েছে। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা কালে প্রায় ১৩ হাজার একর পতিত জলাভূমি উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার জন্য একটি প্রকল্প রয়েছে। এতে ব্যয় হবে ২ কোটি টাকা। প্রকল্পটির কাজ এগিয়ে চলেছে।
(পৃ:-১০)

উৎপাদন

এছাড়া ইতিপূর্বে স্থাপিত ৮১ টি পোনা উৎপাদন খামারের ১৯৭৩ সালে ৯৪ লক্ষ ১৬ হাজার ৭ শত ২৪ টি পোনা ও ১ কোটি ১৩ লক্ষ ৩০ হাজার ৪ শত ৫০ টি ডিম উৎপাদিত হয়। এ বৎসর দেশের বিভিন্ন স্থানে ২৭ টি পোনা পালন কেন্দ্র ও ২৬ টি ডিম উৎপাদন কেন্দ্র চালু ছিল। আরও ৪টি বীজ উৎপাদন খামার ও ৩ টি মৎস্য খামারের কাজ এ বৎসর সম্পূর্ণ হয়। আরো ১৬ টি খামার নির্মাণের কাজ চলছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ১৪ টি মৎস্য খামারে ডিম উৎপাদন ও অল্প বয়স্ক মাছ পালনের স্থান হিসেবে রাখা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হলো এই সমস্ত স্থানের সাথে সংযুক্ত জলাভূমিতে পুনরায় মাছের চাষ করার জন্য পালিত মাছগুলি মোটাতাজা এবং তাদের বংশ ও সংখ্যা বৃদ্ধি করা।

প্রশিক্ষণ

সংশ্লিষ্ট কর্মীদের প্রশিক্ষণ দানের জন্য চাঁদপুরে একটি মৎস্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া, পেশাগত শিক্ষার জন্য কুলিয়াচর, চাঁদপুর, সিরাজগঞ্জ ও বরিশালের বেশ কিছুসংখ্যক প্রশিক্ষণ গ্রহণকারীকে ভর্তি করা হয়। জনসাধারণকে আধুনিক মৎস্য চাষের পদ্ধতি শেখানো, মৎস্য চাষের উদ্দেশ্যে পুষ্করিণী জরিপ চালানো এবং মৎস্য চাষীদের জন্য পণ্য সরবরাহ ও সংশ্লিষ্ট কাজকর্মের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য ব্যাপক চেষ্টা চলছে। এ বৎসর প্রায় ১০ হাজার পুষ্করিণীর জরিপ কাজ সমাধা করা হয় এবং প্রায় ৩৫০০ পুষ্করিণী মৎস্য চাষের অধীনে আনা হয়। অকুস্থল এর কর্মীদের পরামর্শে ৭২ টি আদর্শ মৎস্য খামার স্থাপন করা হয়েছে।

গবেষণা

মৎস্য চাষের ব্যাপারে গবেষণার জন্য চাঁদপুরের দুটি গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে ।একটি হচ্ছে মিষ্ট পানির মৎস্য গবেষণা কেন্দ্র, অপরটি কলা কৌশলগত গবেষণা কেন্দ্র। এছাড়া কক্সবাজারের সামুদ্রিক জৈব গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে। চাঁদপুরের কৌশলগত গবেষণা কেন্দ্রটি পুষ্করিণীতে কাতলা ও মাগুর জাতীয় মাছের চাষ সম্পর্কে গবেষণা চলছে। এক্ষেত্রে ইতিমধ্যে কিছু লাভজনক ফল পাওয়া গেছে। চাঁদপুরের মিষ্ট পানির মৎস্য গবেষণা কেন্দ্রের গবেষণা কর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কৃত্রিম পন্থায় স্থানীয় কাতলা জাতীয় মাছের ডিম উৎপাদন, প্রজননের মাধ্যমে মাছের চাষ করে পুকুরে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি, দেশের বিভিন্ন ধরনের মাছের আঙ্গিক প্রতিক্রিয়া সম্পর্কিত গবেষণা, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের আবর্জনা এবং কৃষি ক্ষেত্রে কীটনাশক ঔষধ ব্যবহারের ফলে পানি দূষিত হওয়া সম্পর্কে গবেষণা, মাছের বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা, কর্ণফুলী হ্রদের সংস্থান বিন্যাস পরীক্ষা, কৃত্রিম উপায়ে মুক্তা চাষ সম্পর্কিত গবেষণা, ব্যবসায়িক
(পৃ:-১১)

ভিত্তিতে ব্যাঙ পালন ইত্যাদি। কলাকৌশল গত গবেষণা কেন্দ্রে বর্তমানে নিম্নলিখিত বিষয়ে গবেষণা চলছে :- (১) সংক্ষিপ্ত বায়ুশূন্য পথে পাতন পদ্ধতিতে হাঙ্গরের বকৃৎজাত অপরিশোধিত তৈল থেকে ‘এ’ ও ‘বি’ ভিটামিন পৃথকীকরণ; (২) বিভিন্ন ধরনের মাছের তৈলের মিশ্রণ; (৩) মাছের তৈলে মিশ্রিত চর্বিজাতীয় এসিড নির্ধারণ; (৪) শুশুকের তৈল; (৫) রাঁধা এবং অরাঁধা অবস্থায় ইলিশ মাছ টিনজাতকরণ এবং (৬) ইলিশ মাছের ডিমের প্রক্রিয়াজাতকরণ।
দেশের মৎস্য সম্পদের যথাযথ উন্নয়ন ও বৃদ্ধির মাধ্যমে মৎস্যজীবীদের অধিকতর আয় সুনিশ্চিত করা এবং মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি, মাছ ধরবার কলাকৌশল ও বাজারজাতকরণ ব্যবস্থার উন্নতি সাধনের উপায়াদি পরীক্ষা ও সুপারিশ করবার জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠিত হয়েছে।
ভারতে মাছ রপ্তানি করবার জন্য সে দেশের সাথে একটি বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে।
প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় মৎস্য সম্পর্কিত গবেষণার জন্য ১৫ টি ও উন্নয়নের জন্য ২২ টি কর্মসূচি রয়েছে। এগুলোর জন্য ব্যয় হবে ২০ কোটি টাকা।

পশুসম্পদ

যে দেশে শিল্পের ভিত্তি শক্ত নয় এবং যাকে ব্যাপকভাবে কৃষি ও কৃষিজাত দ্রব্যের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতে হয়, সেখানে পশুসম্পদ উন্নয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশও এর ব্যতিক্রম নয়। যে সমস্ত প্রধান দ্রব্য বাংলাদেশের পল্লী অঞ্চলের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে বাঁচিয়ে রাখে, পশুসম্পদ সে সবের অন্যতম। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই সরকার তাই পশুসম্পদের গুণগত ও সংখ্যাগত উন্নতি সাধনের জন্য কতগুলি সুনিশ্চিত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ইতিমধ্যেই এসব ব্যবস্থার সুফল দেখা দিতে শুরু করেছে।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাদেশ সরকার যে সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন সেগুলির একটি হলো পশু সম্পদের জন্য আর্থিক পরিকল্পনা বহুগুণে সম্প্রসারিত করা। ১৯৭২-৭৩ সালে সরকার পশু সম্পদ সংরক্ষণ ও তার উন্নতি সাধনের কর্মসূচির জন্য ৩ কোটি ৬ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা বরাদ্দ করেন। বিভিন্ন প্রকল্পের বাস্তবায়নের এই টাকা থেকে ইতিমধ্যে ২ কোটি ১ লক্ষ টাকা ব্যয় করা হয়েছে।
রোগাক্রান্ত পশু চিকিৎসার সুযোগ সুবিধা অনেক বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং প্রতিবিধান যোগ্য কারণে পশুসম্পদের ধ্বংসের উদ্দেশ্যে থানা পর্যায়ের পশু ঔষধালয় স্থাপিত হয়েছে। বর্তমানে দেশে ২৭২ টি থানা পশু ঔষধালয় রয়েছে। শীগগীরই আরও ১৭ টি থানা পশু ঔষধালয় স্থাপন করা হবে। তাছাড়া বর্তমানে ৩৮ টি মহাকুমা পশু হাসপাতাল এবং ঢাকায় একটি জেলা পশু হাসপাতাল কাজ করছে।
(পৃ:-১২)

পশুচিকিৎসা সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ ভবন

এসব ছাড়াও ময়মনসিংহ পশুচিকিৎসা সম্পর্কিত একটি প্রশিক্ষণ ভবন করেছে। এখানে অকুস্থল এর কর্মী থানা পশু বিভাগীয় কর্মী এবং কম্পাউন্ডাররা প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকেন। পশু হাসপাতাল ও পশু ঔষধালয় গুলির জন্য প্রতি বছর ২০ লক্ষ টাকার ঔষধ ও সরঞ্জাম সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাবার উদ্দেশ্যে সরকার প্রসবের জন্য বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধির কথা বিবেচনা করছেন।
উন্নত শ্রেণীর গবাদি পশুর সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত ১৫ টি কেন্দ্রে কৃত্রিম প্রজননের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। আরও ২ টি কেন্দ্র স্থাপনের কাজ খুব শিগগিরই শেষ হবে।

সাভার দুগ্ধশালা

বর্তমানে সাভারের দুগ্ধ শালা ও গবাদি পশু উন্নয়ন খামার এর সম্প্রসারণ করা হচ্ছে এবং প্রজনন, গবেষণা ও পশুখাদ্য চাষের একটি কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়েছে। বিদেশি পরিচালনায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে দুধ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ এর কাজও চলছে। এর জন্য এখন ১৪ জন জার্মান বিশেষজ্ঞ কাজ করছেন। প্রজনন সম্পর্কিত গবেষণার জন্য সাভারের খামারে আমদানি করা উন্নত জাতের গবাদি পশু পালন করা হচ্ছে। ফ্রান্সি ও ক্রিমিয়ান নামে পরিচিত এই সমস্ত গরু অস্ট্রেলিয়া থেকে পাওয়া গেছে। পশ্চিম জার্মান সরকারের সাহায্যে বোতলের পরিবর্তে প্লাস্টিকের থলে ব্যবহার করে ঢাকাশহর দুধ সরবরাহে প্রভূত উন্নতি সাধন করা হয়েছে। খামারটি এখন প্রতিদিন ২০০০ লিটার দুধ উৎপাদন করতে পারে।

চিড়িয়াখানা

ঢাকার উপকণ্ঠে মিরপুরে একটি চিড়িয়াখানা স্থাপিত হচ্ছে। নির্মাণকাজ শেষ হলে এটি হবে দেশের জাতীয় একমাত্র শিক্ষা মূলক প্রতিষ্ঠান। এখানে উন্নত জাতের গবাদিপশু প্রদর্শনের জন্য রাখা হবে।
নোয়াখালীতে একটি ভেড়া প্রজনন খামার স্থাপিত হয়েছে। এখানে খুব শিগগিরই কাজ শুরু হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। দেশের হাঁস-মুরগি সম্পদের উন্নতি সাধনের দিকেও সরকার যথাযথ দৃষ্টি দিয়েছেন। বর্তমান সরকারের পরিচালনায় ২ টি হাঁস-মুরগী পালন খামার রয়েছে। এছাড়া, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন সংস্থার পরিচালনাধীনে রয়েছে ৯ টি খামার।
মহামারীর হাত থেকে গবাদিপশু হাঁস-মুরগী কে প্রতিসরণের জন্য ঢাকায় পশু গবেষণা ভবন ও কুমিল্লার পশুপালন গবেষণার ভবনে বিভিন্ন ধরনের টিকা এবং সিরাপ প্রস্তুত করা হয়।
(পৃ:-১৩)

এক নজরে

* বন উন্নয়ন প্রকল্পসমূহের আনুমানিক ব্যয় ৫২ লক্ষ টাকা

* স্বাধীনতা-উত্তরকালে বন বিভাগ থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব ১ কোটি ৮৫ লক্ষ টাকা

* স্বাধীনতা সংগ্রামে ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্যজীবীদের পুনর্বাসন কর্মসূচির ব্যয় ৫ কোটি ২০ লক্ষ টাকা

* প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা কালে মৎস্য চাষের জন্য পতিত জলাভূমি উন্নয়ন ১৩০০০ একর

* পোনা উৎপাদন খামার ও মৎস্য খামার স্থাপিত হয়েছে যথাক্রমে ৪টি ও ৩টি
(আরও ১৬টি স্থাপিত হচ্ছে)

* পশু সম্পদের উন্নতি সাধন ও উন্নয়নের জন্য মোট ব্যয় বরাদ্দ ৩ কোটি ৬ লাখ ৩১ হাজার টাকা

* পশুপাখির ঔষধ ও পশু পালনের সরঞ্জামের জন্য বার্ষিক ব্যয় ১০ লক্ষ টাকা

* থানা পশু ঔষধালয় ২৭২টি
(আরও ১৭টি স্থাপিত হবে)

* কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র ১৫ টি
(পৃ:-১৪)

সমবায় ও পল্লী উন্নয়ন

সভা সমাজে সমবায় সব সময়ই সকল প্রকার উন্নয়ন কাজে অন্তর্মুখী শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। ধ্বংস ও লুটতরাজের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশকেও সমবায় আন্দোলন ও সমবায় ব্যবস্থার মাধ্যমে উন্নয়নের পথে অগ্রসর হতে হবে।
এই নতুন দেশের শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশি লোক গ্রামে বাস করে। এজন্য সমবায়ের মত পল্লী উন্নয়নে এদেশের উন্নয়নমূলক কার্যকলাপে অগ্রাধিকার লাভ করেছে।

সমবায়

অল্প এবং মাঝারি আয়ের মানুষ উৎপাদন বৃদ্ধিতে যে সমস্ত সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকে, সেসবের একটি প্রাতিষ্ঠানিক সমাধান দেয়। কিন্তু আমাদের জাতীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অন্যান্য শাখার মতো এটিও আগেকার উপনিবেশিক দের কাছে যথাযথ গুরুত্ব লাভ করেনি। স্বাধীনতার পর স্বাভাবিক কৃষিকার্য শুরু করবার জন্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন ও পুর্নবাসনের আশু প্রয়োজন দেখা দেয়। এইসময় সরকার পল্লীর জনসাধারণের ভাগ্যোন্নয়নের পন্থা হিসেবে সমবায় আন্দোলন চালানোর নীতির কথা ঘোষণা করেন।
১৯৭৩ সালে সমবায়ের ক্ষেত্রে যেসব উল্লেখযোগ্য কাজ হয়, নিচে সে গুলির বিবরণ দেওয়া হলো।

কৃষিঋণ

সমবায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি হলো কৃষি উৎপাদনে অর্থযোগ আবার জন্য স্বল্প ও মাঝারি মেয়াদের ঋণের ব্যবস্থা করা। আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য আউ, আমন, বোরো ও আখ চাষে অর্থ যোগবার জন্য গ্রাম ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ২৫০০০ প্রাথমিক ঋণদান সমিতির মাধ্যমে কৃষকদের মোট ৫ কোটি ২০ লক্ষ টাকার স্বল্পমেয়াদি ঋণ দেওয়া হয়। উক্ত সমিতিগুলি মধ্যে ২২০০০ টি গঠিত হয় লো-(অস্পষ্ট) পাম্প ও গভীর নলকূপ ব্যবহারকারীদের নিয়ে। প্রাথমিক ঋণদান সমিতি গুলি ছিল ৬২ টি কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংক ও প্রায় সমসংখ্যক থানা সমবায় ফেডারেশন এর সাহায্যে পুষ্ট।
পাট চাষীদের ঋণ দেওয়া হয় মোট ১১ লক্ষ টাকা এবং হালের গরু কেনার জন্য কৃষকরা উপরোক্ত প্রাথমিক ঋণদান সমিতি গুলির মাধ্যমে মাঝারি মেয়াদের ঋণ পায় মোট ১ কোটি ৩৮ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা।
বোরো ধান ও আখ চাষের জন্য সহজ শর্তে ঋণ দানের উদ্দেশ্যে ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর অবধি ৪ কোটি টাকার ব্যবস্থা রাখা হয়।
বাংলাদেশ জাতীয় সমবায় ব্যাংক জাতীয় পর্যায়ের সমগ্র ঋণদান কর্মসূচি সমন্বয় সাধন করে। এই ব্যাংক সরকারি জামানতের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে
(পৃ:-১৫)

সমবায় সমিতি সমূহের জন্য প্রয়োজনীয় স্বল্পমেয়াদী ও মাঝারি মেয়াদে ঋণের অর্থ সংগ্রহ করে।

বাংলাদেশ বাণিজ্য সংস্থার মাধ্যমে অত্যাবশ্যক দ্রব্যাদি বিতরণ

বাংলাদেশ সমবায় বাজারজাতকরণ সমিতিকে বাংলাদেশ বাণিজ্য সংস্থার (টিসিবি) কর্তৃক আমদানিকৃত বেশকিছু কাপড় ও অন্যান্য অত্যাবশ্যক ভোগ্যপণ্য বিতরনের ভার দেওয়া হয়। এই সমিতি দেশে বাজারজাতকরণ ও পণ্য ভোগীদের সমবায় সমিতি সমূহের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান। বাজারজাতকরণের শীর্ষ সমিতি সরকার কর্তৃক মনোনীত ১১৭৪ টি পণ্যভোগী সমবায় দোকান, ডিলার ও এজেন্টের মাধ্যমে মোট ৯ কোটি টাকার কাপড় ও অন্যান্য ভোগ্য পণ্য বিতরণ করেন।

তাঁতী সমবায়

স্থানীয় বস্ত্র ও বয়ন কারখানাসমূহ উৎপাদিত এবং আমদানিকৃত সুতোর শতকরা ৭৫ ভাগ ১৯৭৩ সালের জানুয়ারি মাস থেকে তাঁতী সমবায় সমিতি সমূহের মাধ্যমে বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়। বাকি ২৫ ভাগ বিতরণের ভার দেওয়া হয় বাংলাদেশ ক্ষুদ্র শিল্প সংস্থা কে। তারা এগুলো বিতরণ করেন বয়ন কারখানা, হোসিরারি ও এক্ষেত্রে অন্যান্য বিশেষ ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠান মাধ্যমে।
একপর্যায়ে তাঁতী সমবায় সমিতি সমূহের ভুয়া সদস্যরা অসৎ উপায়ে সরকারের এই উদার নীতির সুযোগ নিতে থাকে। তারা অসৎ উদ্দেশ্যেই তাঁতী সমবায় সমিতির সদস্য হয়। এজন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা চালিয়ে সাড়ে ৩ লক্ষ ভুয়া তাঁতসহ ৩ লক্ষ ভুয়া সদস্য বাদ দেওয়া হয়।
আলোচ্য সময়ে শেষ অব্দি বাংলাদেশ জাতীয় শিল্প সমিতি কে ৫০ কোটি টাকা মূল্যের ৮৮১৩৯ গাঁট সুতো বরাদ্দ করা হয়। তারা এই সুতোর ৩৬ টি সমবায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ২৮০০ টি প্রাথমিক তাঁতী সমবায় সমিতি ও মৎস্যজীবীদের শীর্ষ সমবায় সমিতির মাধ্যমে বিতরণ করে। শীর্ষ সমিতির ভাগে ছিল ৫৫৩০ গাঁট সুতো। ২ কোটি টাকা মূল্যের এই সুতো বিতরণ করা হয় উক্ত সমিতির সাথে সঙ্ঘবদ্ধ কেন্দ্রীয় ও প্রাথমিক সমিতিসমূহের মাধ্যমে।
যে সমস্ত তাঁতী সদস্য নিয়ন্ত্রিত মরলে সুতো পায়, তাদের দ্বারা উৎপাদিত দ্রব্য সংগ্রহ ও বাজারজাতকরণের জন্য তাঁতীদের শীর্ষ সমবায় সমিতি ও ৩৬ টি শিল্প ইউনিয়ন একটি কর্মসূচি গ্রহণ করে। এই কর্মসূচির অধীনে মোট ২ কোটি টাকা মূল্যের দ্রব্যাদি সংগৃহীত হয় এবং এগুলি ন্যায্যমূল্যের দোকান এর মাধ্যমে সস্তায় অল্প ও মাঝারি পণ্য ভোগীদের কাছে বিক্রি করা হয়।
১০টি শিল্প ইউনিয়নের মাধ্যমে মোট 45 লক্ষ টাকা ব্যয়ে একটি কর্মসূচি ও বাস্তবায়িত করা হয়। এর লক্ষ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন। এজন্য তাদের ৩৪১৬ টি ক্ষতিগ্রস্ত তাঁত বদলে এবং মেরামত করে দেওয়া হয়।
(পৃ:-১৬)

মৎস্যজীবি সমবায়
মাছ ধরবার ১০ হাজারেরও বেশি জায়গায় ফলপ্রদ ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনার জন্য স্বাধীনতার অল্প কাল পরেই সরকার নীতিগতভাবে স্থির করেন যে, ভবিষ্যতে এগুলি কেবল মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি সমূহকে ইজারা দেওয়া হবে। এটিও ছিল অবিবেচক ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্বভোগীদের শোষণ থেকে মৎস্যজীবীদের রক্ষা করবার একটি ব্যবস্থা। এজন্য মৎস্যজীবি সমবায় সমিতির মাধ্যমে নিজেদের সংগঠিত করবার ব্যাপারে যথেষ্ট উৎসাহ জাগে। এর ফলে ১৯৭৩ সালে ১২ টি কেন্দ্রীয় কমিটি নিয়ে মৎস্যজীবীদের ২০২ টি সমবায় সমিতি গঠিত হয়। এতে এ ধরনের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৭৩১ টি। সমিতি গুলির মোট সদস্য সংখ্যা ছিল ৩ লক্ষ ৬ হাজার। এ বৎসর কেন্দ্রীয় সমিতি ছিল ৫২ টি। তারা মাছ ধরবার ৯৩৮ টি জায়গা ইজারা নেয়।
১৯৭৩ সালে মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি গুলির কাজকর্মের মধ্যে ছিল ৩০ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা মূল্যের নাইলনের ট্রোন সুতোর, নাইলনের দড়ি ও কৃত্রিম ভেলা, ৪৫ লক্ষ টাকা মূল্যের কার্পাস সুতো এবং মাছ ধরার নৌকা যান্ত্রিকীকরণের উদ্দেশ্যে ২১ লক্ষ ২৬ হাজার টাকা মূল্যের ৩০১ টি মেরিন ইঞ্জিন সংগ্রহ ও বিতরণ।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্ষতিগ্রস্ত ২৫০০ মৎস্যজীবীর মধ্যে বিতরণের উদ্দেশ্যে এ বৎসর মাছ ধরার ৭০০ টি নৌকো তৈরীর ব্যবস্থাও করা হয়। এছাড়াও তাদের ৩৭ লক্ষ টাকার নাইলনের টন দড়ি এবং কৃত্রিম ভেলা দেওয়া হয়। এ সমস্ত ব্যবস্থার লক্ষ্য ছিল মৎস্যজীবীদের যৌথ কাজ ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তাদের পুনর্বাসন।
এ বৎসর মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি সমূহের জন্য ৬টি বরফ কারখানা স্থাপনের কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে আসে। মৎস্যজীবীদের শীর্ষ সমবায় সমিতি ৪ লক্ষ ৮৬ হাজার টাকা ব্যয়ে একটি মৎস্য হিমায়ন যন্ত্র আমদানির ব্যবস্থা করে। মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি গুলি এ বৎসর মাছ ধরে প্রায় ১ লক্ষ ৮ হাজার ৩ শত ২৮ টন-যার মূল্য ছিল ১২ কোটি ১২ লক্ষ টাকা। তারা যেসব মাছ ধরে, তার মধ্যে ১৮ লক্ষ ১৯ হাজার টাকার বাগদা চিংড়ি ছিল। মাছগুলি শীর্ষ সমিতির কারখানায় প্রক্রিয়াজাত করা হয়।

পরিবহন সমবায়

মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবহন ব্যবস্থার পুনর্বাসনের জন্য ১৯৭৩ সালে সরকার বাংলাদেশ বাণিজ্য সংস্থার মাধ্যমে ২০০০টি অটোরিকশা আমদানি ও যেগুলি যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত এবং সমবায়ের মাধ্যমে সংগঠিত অটোরিকশা চালকদের মধ্যে বিতরণের একটি কর্মসূচি গ্রহণ করেন। এই কর্মসূচি অনুযায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ করে একটি কেন্দ্রীয় সংগঠনসহ অটোরিকশা চালকদের সমবায় সমিতি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্য সংখ্যা ২ হাজারেরও বেশি।
(পৃ:-১৭)

এই প্রকল্পের একটি লক্ষ্য ছিল ধারে ক্রয় ব্যবস্থায় এবং ব্যক্তিগত মালিকানার ভিত্তিতে ১০ টি সমিতির মাধ্যমে সদস্য চালকদের মধ্যে ১৯০০ টি অটোরিকশা বিতরণ এবং দ্বিতীয়টির লক্ষ্য ছিল যৌথ ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনার জন্য ৪ টি চালক সমবায় সমিতি কে একশটি অটোরিকশা দেওয়া। শেষোক্তোটি ছিল আদর্শ প্রকল্প। বাংলাদেশ বাণিজ্য সংস্থা এ পর্যন্ত সমস্ত অটোরিকশা আমদানি করেছে সেগুলির মধ্যে ১০৬৯ টি নেয় কেন্দ্রীয় সভাপতি। তারা ৬২৫ টি অটোরিকশার কাঠামো তৈরি করে প্রাথমিক সমিতি গুলির মাধ্যমে ধারে ক্রয়ের ভিত্তিতে সদস্যদের মধ্যে বিতরণ করে। অটোরিকসা গুলি এখন ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লার রাস্তায় চলাচল করছে। অটোরিকশা ক্রয়ের জন্য সমবায় সমিতি গুলিকে টাকা দেয় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের একটি সংঘ। এক-একখানি অটোরিক্সার দাম সাড়ে ৮ হাজার টাকার কিছু বেশি। প্রত্যেক প্রতিদিন গাড়ি চালিয়ে যা আয় করবে, তার থেকে সে ৩০ মাসের তার ব্যবহারের অটোরিক্সার দাম পরিশোধ করবে বলে স্থির করা হয়েছে। এই সময়ে পড়ে চালক অটোরিকশাটির মালিক হবে। আদর্শ প্রকল্পটির আরো একটি উদ্দেশ্য ছিল। যদি এর কাজ সুষ্ঠুভাবে চলবে তাহলে ভবিষ্যতে পরিবহনের অন্যান্য ক্ষেত্রে এর আওতা সম্প্রসারিত করা হবে।

দুগ্ধশালা উন্নয়ন

দেশের বিশেষ কতকগুলি দুগ্ধ প্রসিদ্ধ অঞ্চলে প্রচুর দুধ পাওয়া যায়, কিন্তু কোন সংগঠিত বাজারজাতকরণের সুযোগ সুবিধা না থাকায় সেখানকার দুগ্ধ উৎপাদনকারী ফরিয়াদের দ্বারা শোষিত হয়। দুগ্ধ। ও দুগ্ধজাত দ্রব্য এর প্রধান বাজার হল শহর অঞ্চল কিন্তু সেখানকার দুগ্ধ ব্যবহারকারীরা সাধারণতঃ কেবল ভেজাল মেশানো দুধই পেয়ে থাকে। তারা যে দুধ পায় তার পরিমাণও পর্যাপ্ত নয়। এর কারণ পরিবহনের সহজ ব্যবস্থার অভাব। সংরক্ষণের সুযোগ সুবিধার অভাবেও প্রতিবছর বাজারজাতকরণের আগেই প্রচুর দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্য নষ্ট হয়ে যায়।
এই সমস্ত সমস্যার সমাধানের জন্য সমবায় এর আওতায় বর্তমানে ঢাকা ও লাহিড়ী মোহনপুরে অবস্থিত ২ টি দুগ্ধশালা সম্প্রসারণ, আধুনিকীকরণ ও উন্নয়ন এবং ফরিদপুর টাঙ্গাইল ও মানিকগঞ্জের ৩ টি নতুন দুগ্ধশালা (নির্বীজিত ও শীতলীকরণ কারখানা)স্থাপনের উদ্দেশ্যে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অধীনে আনুমানিক ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প চালু করা হয়েছে। এ সমস্ত কাজের (অস্পষ্ট) ঢাকাবাসীদের জন্য প্রতিদিন ১৫০০ মণ দুধের সরবরাহ সুনিশ্চিত করা। দুগ্ধশালাগুলির মালিক ও পরিচালক হবে ৪টি দুগ্ধ প্রসিদ্ধ অঞ্চলের সংঘটিত প্রায় ১ লক্ষ সদস্যবিশিষ্ট দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতির একটি সংঘ। দুগ্ধ শালায় ৩ কোটি টাকা মূল্যের যন্ত্রপাতি সরবরাহ এবং স্থাপনের জন্য বাংলাদেশ সরকার এবং একটি খ্যাতনামা ড্যানিশ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। প্রথম ডেনিস ঋণ থেকে যন্ত্রপাতি
(পৃ:-১৮)

ও সরঞ্জাম আমদানি এবং স্থাপনের ব্যয় হিসেবে ইতিমধ্যেই ৯২ লক্ষ টাকার ঋণ পাওয়া গেছে এবং এই টাকা উক্ত প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কর্মসূচিটির ব্যয় বহনের জন্য আরও সাহায্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে সাহায্যকারী সংস্থা গুলির সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করা হয়েছে।
বর্তমান দুর্দশার গুলির সম্প্রসারণ ও নতুন দুর্দশা গুলির স্থাপনের জন্য জমি সংগ্রহের কাজ শেষ হয়ে এসেছে। দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতি গঠন ও এগিয়ে চলেছে। ২০৩ টি সমিতি ইতিমধ্যে গঠিত হয়েছে। এগুলোর সদস্যসংখ্যা ৬ হাজার। আলোচ্য বৎসরের বর্তমান দুটি প্রায় ১০ লক্ষ টাকা মূল্যের ২৫০০০ মণ দুধ সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাত ও বাজারজাত করে।

প্রশিক্ষণ ও সম্প্রসারণ

সমবায় প্রতিষ্ঠানগুলি আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সরকারি ও বেসরকারি খাতের মধ্যবর্তী একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জাতীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উন্নয়নে সমবায় আন্দোলন বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবশ্যই একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করবে। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা কালে বাস্তবায়নের জন্য ওপরে আলোচিত সফল ক্ষেত্রের জন্য ৯ টি উন্নয়নমূলক পরিকল্প রয়েছে। এগুলোর জন্য ব্যয় হবে প্রায় ২৫ কোটি টাকা। বর্তমানে একটি সমবায় মহাবিদ্যালয় ও ৮ টি আঞ্চলিক ইনস্টিটিউট এর মাধ্যমে বিভিন্ন শ্রেণীর সমবায় কর্মী ও সর্বপ্রকার সমবায় প্রতিষ্ঠান সদস্যদের জন্য প্রশিক্ষণের যে সমস্ত সুযোগ সুবিধা রয়েছে, পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে সেসবের সম্প্রসারণ করতে হবে। এজন্য কেবল উক্ত মহাবিদ্যালয় ইনস্টিটিউট এর প্রশিক্ষণের সুযোগ সুবিধা সম্প্রসারণই নয়, এই প্রশিক্ষণের মান উন্নত করে তাকে বর্তমান ও ভবিষ্যতের সমবায় আন্দোলনের উপযোগী করে তুলবারও প্রস্তাব করা হয়েছে।
১৯৭৩ সালে সমবায় মহাবিদ্যালয় ও ইনস্টিটিউট গুলি থেকে বিভিন্ন শ্রেণীর ৫০০ জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী বেরোয়। এর পূর্ববর্তী বছরের বেরিয়েছিল ৩২০০ জন। প্রাথমিক সমবায় সমিতির ১০ হাজার ৬ শত সদস্যকে নীতি ও তার ব্যবহার সম্পর্কে শিক্ষাদান করা হয়। এছাড়া, বিভিন্ন কারিগরি ও দ্বিপাক্ষিক সাহায্য কর্মসূচি অনুযায়ী 20 জন সমবায় কর্মীকে সমবায় উন্নত প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও পর্যবেক্ষণের জন্য বিদেশে পাঠানো হয়। জাতীয় সমবায় ইউনিয়ন বাংলাদেশ সমবায় আন্দোলনের ৬ জন নেতাকে সমবায় আন্দোলনের শীর্ষ স্থানীয় নেতৃবৃন্দের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য টোকিওতে পাঠায়।

পল্লী উন্নয়ন

কুমিল্লার বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী ও তার পৃষ্ঠপোষক সংস্থাসমূহ জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়নে মানুষের শক্তিকে কাজে লাগানোর এক নতুন
(পৃ:-১৯)

পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে। বস্তুত এই পদ্ধতির লক্ষ্য হলো পল্লী উন্নয়ন সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে জনগণের অংশগ্রহণ। পল্লী উন্নয়ন একাডেমী এমন একটি সংস্থা, যাকে কেন্দ্র করে দেশের অর্থনীতি, কৃষি ও শিক্ষা ক্ষেত্রে একের পর এক সংস্কার সাধিত হচ্ছে। এই একাডেমী’ এখন বিভিন্ন ধ্যান-ধারণার এক ভান্ডার রূপে বিবেচিত হয়। এসমস্ত ধ্যান-ধারণা সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের সর্বাধিক মঙ্গল সাধন এর সম্ভাবনার রূপে গড়ে ওঠে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঘোষিত এবং বর্তমানে দেশের সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার অনুসরণে সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য একাডেমি বেশকিছু পরিকল্পনা ও কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। পল্লী উন্নয়নের ক্ষেত্রে সমন্বিত ফল লাভের জন্য সামন্ততান্ত্রিক নীতির সাথে হাত মিলিয়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কাজ চলছে।
বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী একটি বিশেষ ধরনের প্রতিষ্ঠান। এখানে তিনটি বিশেষ রকমের কাজ হয়। এগুলি হল পল্লী উন্নয়ন সম্পর্কে প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও পরীক্ষামূলক কার্য। এগুলি পরস্পরের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত এবং এগুলির সমন্বয় একাডেমীর সমগ্র কার্যপদ্ধতি গড়ে উঠেছে। প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও পরীক্ষা মূলক কাজ একাডেমীর ফ্যাকাল্টির সদস্যরাই চালিয়ে থাকেন। তারা এখানে এসেছেন সমাজবিজ্ঞান ও ফলিত বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে। প্রশিক্ষণ ও গবেষণার দায়িত্ব ছাড়াও তারা একাডেমির বিভিন্ন আদর্শ প্রকল্পের নির্দেশনা ও পরিচালনার সাথে জড়িত রয়েছেন। প্রকল্পগুলি একাডেমীর সামাজিক গবেষণার ক্ষেত্রে যেমন কুমিল্লা কোতোয়ালি থানায় পরিচালিত হয়ে থাকে। এসব প্রকল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে স্থানীয়ভাবে নতুন নতুন ধ্যান-ধারণা পরীক্ষা এবং পল্লী উন্নয়নের নানাবিধ কর্মসূচির আদর্শ তৈরি করা।
ক্রমাগত গবেষণা ও পরীক্ষামূলক কাজ চালিয়ে একাডেমী বেশ কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন কর্মসূচির আদর্শ প্রস্তুত করেছে। এগুলি ইতিমধ্যেই সরকার কর্তৃক গৃহীত এবং বাংলাদেশের পল্লী অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়নের জন্য জাতীয় কর্মসূচি হিসেবে চালু করা হয়েছে। এগুলি হল থানা প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কেন্দ্র, পল্লীপূর্ত কর্মসূচি থানা সেচ কর্মসূচি এবং সমপর্যায়ের দুই স্তর বিশিষ্ট একটি নতুন সমবায়পদ্ধতি। কৃষির উন্নয়ন বৃদ্ধি এবং পল্লী উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি মৌল কাঠামো গড়ে তোলার কাজে এগুলোই মূল কর্মসূচী।

সাফল্য

১৯৭৩ সাল ছিল একাডেমির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী বৎসর। সাধারণ প্রশিক্ষণ ও গবেষণা মূলক কাজ চালানো এবং চালু কর্ম মূলক গবেষণা প্রকল্প পরিচালনা করা ছাড়াও একাডেমি এ বছর নতুন জাতীয় নতুন জাতির প্রয়োজন মেটানোর জন্য তার কার্যকলাপ সম্প্রসারিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় কর্মী, গ্রামিণ নেতৃবৃন্দ ও পল্লী উন্নয়ন এর সাথে জড়িত সরকারি কর্মচারীদের জন্য
(পৃ:-২০)

১৯৭৩ সালে বেশকিছু প্রশিক্ষণ কোর্সের ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া, সমবায় কৃষি খামার চালনায় পরীক্ষা নিরীক্ষা করবার জন্য একটি নতুন আদর্শ প্রকল্প চালু করা হয়। বাংলাদেশের পল্লী উন্নয়নের পরিকল্পনা ও কর্মসূচি প্রণয়নের উদ্দেশ্যে একাডেমী কর্মসূচি পর্যবেক্ষণ করার জন্য বিদেশ থেকে অনেক উপদেষ্টা ও পরামর্শদাতা এসেছেন একাডেমি তাদের নানা রকম সুযোগ সুবিধা দিয়েছে।

প্রশিক্ষণ ও তত্ত্বজ্ঞান দান অর্জন

১৯৭৩ সালে মোট ১৩৬ টি প্রশিক্ষণ ও তত্ত্ব জ্ঞান দান কোর্সের আয়োজন করা হয় এবং এগুলিতে মোট ২২৩৭ লোক অংশ নেয়। এ বৎসর পল্লী উন্নয়নে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্র সম্পর্কে আলোচনা সভা ও সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এছাড়া, বিশ্ব ব্যাংক, ফাও, ইউনিসেফ, আই সি আর সি সিতা, ফোর্ড ফাউন্ডেশন, ইউ এস এইচ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইত্যাদির মতো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে আগত বহু বিদেশি পন্ডিত ও বিশেষজ্ঞকে এবং সরকারের অনেক বিদেশী পরামর্শদাতা কে একাডেমী থেকে গবেষণা ও পর্যবেক্ষণের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। বিভিন্ন উপলক্ষে মন্ত্রিসভার সদস্য ও বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশি দূতাবাসের কূটনীতিকদের মতে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা একাডেমি পরিদর্শন করেন।

গবেষণা ও মূল্যায়ন

একাডেমির ফ্যাকাল্টির সদস্যরা এ বৎসর পল্লীর বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের জীবন ও কাজকর্ম সম্পর্কিত কতগুলি জরিপ ও গবেষণা পরিচালনা করে যান। এছাড়া, সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তা সংস্থাসমূহের অনুরোধে একাডেমি দুইটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় কর্মসূচি মূল্যায়নে হাত দেন। এগুলি হল থানা সেচ কর্মসূচি ও সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচি। এ বৎসর একাডেমীর হাতে গবেষণা জরিপ ও মূল্যায়নের আরো ৩১ টি প্রকল্প ছিল।

গবেষণা সম্পর্কিত প্রকাশনা

একাডেমি প্রতি বৎসর তার গবেষণা ও আদর্শ প্রকল্প সম্পর্কিত কতকগুলি বিবরণী ও প্রবন্ধ প্রকাশ করে থাকে। এ বৎসর একাডেমিতে কাজে ব্যবহারের উপযোগী এজাতীয় ১৩ টি পুস্তক-পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছে (এর মধ্যে ১০ টি নতুন ও ৩ টি পুনর্মুদ্রণ)। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থা এবং দেশি-বিদেশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে এসব পুস্তক-পুস্তিকা পাঠানো হয়। এছাড়া, ১৯৭৩ সালে বিভিন্ন সংগঠন, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে ৯৫২৪ খানি বই দেওয়া হয় (এর মধ্যে বিনামূল্যে ৩১৯৪ খানি ও নগদ মুল্যে ৬৪০০ খানি)। বই বিক্রি করে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত একাডেমির আয় হয় টাকা ১৩৭৪৯৩৮।
(পৃ:-২১)

আদর্শ প্রকল্প

পরীক্ষামূলক কাজ বা আদর্শ প্রকল্প হচ্ছে একাডেমী সবচেয়ে বৈশিষ্ট্য মূলক কাজ। একাডেমি তার গবেষণা এলাকা কুমিল্লা কোতোয়ালি থানায় যে সমস্ত আদর্শ প্রকল্প পরিচালনা করছে, সেগুলি হল পল্লী প্রশাসন, পল্লীপূর্ত কর্মসূচি সমবায় (তদারককৃত ঋণ, প্রশিক্ষণ, বাজারজাতকরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ) সেচ ও কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, কৃষি সম্প্রসারণ, পল্লী বিদ্যুতায়ন, পল্লী শিক্ষা নারী, কর্মসূচির যুবক কর্মসূচি ও পরিবার পরিকল্পনা।
চালু আদর্শ প্রকল্পের নির্দেশনা ও সাহায্য দেওয়া ছাড়াও একাডেমি এ বছর সমবায় ভিত্তিক খামার পরিচালনার একটি নতুন পরীক্ষামূলক প্রকল্প হাতে নেয়। এছাড়া ‘ড্যানিডা’র সহযোগিতায় গবেষণা এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে দুইটি ধান শুকানোর কল বসানো হয়েছে। বর্তমানে গবাদিপশু ও মৎস্য সম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে আরো কয়েকটি নতুন প্রকল্প চালু করবার জন্য কর্মসূচি তৈরি করা হচ্ছে।

এক নজরে

* কৃষকদের স্বল্পমেয়াদি ঋণ দান ৬ কোটি ৭০ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা

* বাজারজাতকরণ শীর্ষ সমিতির মাধ্যমে বিলিকৃত কাপড়ের মূল্য ৯ কোটি টাকা

* বিলিকৃত কার্পাস সুতোর ৮৮১৩৯ গাঁট

* যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত তাঁতীদের পুনর্বাসন ব্যয় ৪৫ লক্ষ টাকা

* মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি সংগঠন ২০২টি

* মাছ ধরা নৌকা বিতরণ ৭০০ খানি

* বিলিকৃত নাইলনের টোন সুতা ও দড়ি এবং কৃত্রিম ভেলার মোট মূল্য ৩৭ লক্ষ টাকা

* দুধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতি গঠন ২০৩ টি

* প্রাথমিক সমবায় সমিতির সদস্যদের প্রশিক্ষণ দান ১০৬০০ জন

* বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমীতে প্রশিক্ষণ ও তত্ত্বজ্ঞান দান কোর্স আয়োজিত হয় ১৩৬ টি

* পল্লী উন্নয়ন একাডেমীর বিভিন্ন প্রশিক্ষণে অংশ গ্রহণ করে ২২৩৭ জন

* পল্লী উন্নয়ন একাডেমী গবেষণা জরিপ ও মূল্যায়ন সম্পর্কিত প্রকল্প বাস্তবায়িত হয় ৩১ টি

* পল্লী উন্নয়ন একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত পত্রিকার সংখ্যা ১০ টি
(পৃ:-২২)

শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া

দেশ শত্রু কবলমুক্ত হওয়ার পরপরই নতুন জাতির জন্য একটি নতুন ও অর্থবহ শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে সরকার কতগুলি ফলপ্রসূ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সময়পোযোগী নীতি অনুসরণ এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সমূহকে নতুন রূপ দান ও তাদের ক্ষয়ক্ষতি পূরণ করে সরকার ১৯৭৩ সালে শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি ও তাকে সংহত করার চেষ্টা করেন।

শিক্ষা কমিশন

ছাত্র সমাজকে উপযুক্ত শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে দেশের অতি পুরাতন শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্গঠন ও তাতে নবজীবন সংসারের জন্য সরকার একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। কমিশনের অন্তর্বর্তীকালীন রিপোর্ট ইতিমধ্যেই মন্ত্রী পরিষদের নিকট পেশ করা হয়েছে। চূড়ান্ত রিপোর্ট ১৯৭৪ সালের মে মাসের মধ্যে পেশ করা হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়

রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কিত জরুরি আইনের (অর্ডিন্যান্স) পরিবর্তে এ বৎসর তিনটি নতুন আইন পাশ করা হয়। এগুলি হল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯৭৩, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯৭৩ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯৭৩।
বাংলাদেশ কারিগরি ও প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যও নতুন আইন প্রণয়নের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
১৯৭৩-৭৪ সালের বাজেট বরাদ্দ অনুযায়ী এ বছরের প্রথম ও দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক মঞ্জুরি (পৌনঃপুনিক ও উন্নয়নমূলক উভয়ই) বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের হাতে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা এই অর্ধশত সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দিয়ে দেবেন। এছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের উদ্দেশ্যে গঠিত বিশেষ কতগুলি নির্বাচন কমিটির সদস্য গ্রহণের জন্য আচার্যের মনোনয়ন দেয়া হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন

ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন গঠন সম্পন্ন করা হয়েছে এবং ১৯৭৩-৭৪ সালের বাজেট বরাদ্দ অনুযায়ী তাদের আভ্যন্তরীণ প্রশাসন অন্যান্য ব্যয় নির্বাহের জন্য মঞ্জুরীকৃত অর্থ দিয়ে দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় বোর্ড

১৯৭৩-৭৪ সালের বাজেট বরাদ্দের ভিত্তিতে ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় বোর্ডকে এ বৎসরের প্রথম ও দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক মঞ্জুরি দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
(পৃ:-২৩)

সংযোজক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা

সরকার দুইটি সংযোজক (এ্যাফিলিয়েটিং) বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব বিবেচনা করে দেখেছেন। প্রস্তাবটির উদ্দেশ্য হলো বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপর স্নাতক মহাবিদ্যালয়কে সংযোজন দান ও এ জাতীয় অন্যান্য কাজের ভার রয়েছে, তা লাঘব করা।

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা পরিষদ

এ বৎসর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা পরিষদ গুলি বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুল সমূহের ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠনের বিধি প্রণয়ন করে। বিধিগুলি তাদের আওতাধীন সকল বেসরকারি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিশ্ববিদ্যালয় পাঠানো হয়েছে এবং এই সমস্ত বিধি অনুযায়ী তাদের ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ বিদ্যালয়েপাঠ্য পুস্তক পরিষদ (টেক্সট বুক বোর্ড)

১৯৭৪ সালের বিদ্যালয় পাঠ্য পুস্তকাদি প্রকাশ করবার জন্য পরিষদ ১৯৭৩ সালের আগস্ট মাস থেকে সেগুলি মুদ্রণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এ সমস্ত ব্যবস্থার মধ্যে অন্যান্য বিষয় ছিল প্রয়োজনীয় সংযোজন ও সংশোধনের জন্য বিশেষজ্ঞদের দিয়ে পাঠ্যপুস্তক গুলি পরীক্ষা করানো।

প্রাথমিক শিক্ষা

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সরকারি কর্মচারী হিসেবে গণ্য করা এবং তাদের সরকারি চাকরির আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা দানের কথা ঘোষণা করার ফলে প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে এক বিরাট অগ্রগতি সাধিত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। বেসরকারি ব্যবস্থায় পরিচালিত ৬৫০৯ টি নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারি ব্যবস্থাধীনে নিয়ে আসার পর প্রয়োজন বিবেচনা করে অতিরিক্ত ২৬০৩৬ জন শিক্ষক নিযুক্ত করা হয়েছে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ইতিমধ্যেই ২৫ কোটি ৪৫ লাখ ৩৭ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। এর ফলে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন বাবদ ব্যয় হবে ৪৫ কোটি টাকা।
১৫১০ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রকাশিত উন্নয়ন এবং ৭৫০০ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে আসবাবপত্র ক্রয়ের জন্য মঞ্জুরি দানের কাজও এ বৎসর হাতের নেয়া হয়। এ সমস্ত কাজের ব্যয় নির্বাহ করা হবে ৬ কোটি ৬৮ লক্ষ টাকার একটি বরাদ্দ থেকে।
এ বৎসর ৪৭ টি চাল প্রাথমিক শিক্ষক প্রতিষ্ঠান উন্নয়নের জন্যও একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। অপর একটি পরিকল্পনা অনুযায়ী বেসরকারি মাদ্রাসা সমূহের উন্নতি সাধনের জন্য ৪ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়েছে।
(পৃ:-২৪)

উন্নয়ন কর্মসূচি

এ বৎসর পরিকল্পনা কমিশনের চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন সম্পর্কিত ১৭ টি পরিকল্প করা হয়। এছাড়া, সরকার বেসরকারি বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয় সমূহের শিক্ষক ও অন্যান্য কর্মচারী কল্যাণ এর জন্য মঞ্জুরি হিসাবে ৩ কোটি ১৭ লাখ ৬০ হাজার টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।

বাংলাদেশ ইউনিসেফ এর শিক্ষা কর্মসূচি

দেশের অভ্যন্তরে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দান এর ব্যয় বহনের উদ্দেশ্যে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের ইউনিসেফ দপ্তরকে ৩২ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয় সমূহের পুনর্নির্মাণের জন্য দেওয়া হয় ৪৯ লক্ষ টাকা। এছাড়া, অধিক প্রোটিন যুক্ত খাদ্য ব্যবস্থাপনা ও পরিবহনের জন্য ৫০ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়।

ইউ এস এইভ পুনর্বাসন কর্মসূচি

এই কর্মসূচির অধীনে মেরামত ও পুনর্নির্মাণের জন্য ১৮০০ টি জুনিয়র উচ্চ বিদ্যালয় উচ্চ বিদ্যালয় নির্বাচন করা হয় নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলছে। মেরামত ও নির্মাণের জন্য ২৪৫ টি সরকারি মহাবিদ্যালয়ের ভার নেয়া হচ্ছে।
কতকগুলি বেসরকারি মহাবিদ্যালয় এর জন্য ভারত থেকে ১৬ লক্ষ টাকার বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম ক্রয় করা হয়েছে।
মুজিবনগরে প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য বৃটেনের কমনওয়েলথ শিক্ষক সমিতির কিছু অর্থ দান করেন। এছাড়া পোল্যান্ড বাংলাদেশের মহাবিদ্যালয় সমূহের জন্য ৫৭ হাজার ডলার মূল্যের বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম দান করে। জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য প্রায় ২০ লক্ষ টাকা মূল্যের লেখার সরঞ্জামাদি পাওয়া যায়।

কারিগরি শিক্ষা

বুলগেরিয়া ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পাদিত দ্বিপাক্ষিক পণ্য বিনিময় চুক্তির অধীনে বাংলাদেশ সরকার চট্টগ্রাম প্রকৌশল মহাবিদ্যালয় এবং রাজশাহী, যশোর ও কুষ্টিয়ার কারিগরি শিক্ষা দানের জন্য ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকার যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামের অর্ডার দিয়েছে।
সরকার কারিগরি শিক্ষা দানের ছাত্রদের প্রকৌশলী মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ দানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষকে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

ছাত্রবৃত্তি, সদস্যবৃত্তি ও প্রশিক্ষণ সুবিধা

নির্বাচন ও মনোনয়নের মাধ্যমে ১৯৭৩ সালে মোট ৪৪২ জন ছাত্রকে বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য বিভিন্ন ধরনের ৩৪৭ টি বৃত্তি প্রদান করা হয়। এর জন্য মঞ্জুর করা হয় মোট ৯০ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা এছাড়া, ৯ জন বিশ্ব-
(পৃ:-২৫)

বিদ্যালয়ের শিক্ষক কে কমনওয়েলথ একাডেমিক স্টাফ এর ছাত্র বৃত্তি বা সদস্য বৃত্তি দেওয়া হয়েছে। কমনওয়েলথ স্টাডি ফেলোশিপ পরিকল্পনার অধীনে ১৮ টি ছাত্রবৃত্তির সদস্য বৃত্তি প্রদানের জন্য নির্বাচনে মনোনয়ন দান করা হয়।

সাংস্কৃতিক কার্যাবলী

সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ বৃদ্ধি ১৯৭৩ সালে ৩৩ টি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এগুলোর মধ্যে ছিল জলপানি দান, বিদেশে সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দল প্রেরণ, সাংস্কৃতিক প্রদর্শনী, শিক্ষার সম্প্রসারণ, শিক্ষা সম্মেলন এবং সাহিত্যিক সাংবাদিক ও ক্রীড়াবিদদের আর্থিক সাহায্য দান।

ইউনেস্কো

ইউনেস্কোর গিফট কুপন পরিকল্পনা অধীনে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়কালীন আশ্রয়যুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহ সুদৃঢ় করার জন্য ইউনেস্কোর কাছে ১০ লক্ষ ডলার চাওয়া হয়। প্রস্তাবটির গৃহীত হয়েছে। এ বৎসর ইউনেস্কোর কর্মসূচি অনুযায়ী অন্যান্য কাজকর্ম সহ বিভিন্ন শ্রেণীর শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি বিদেশে পাঠানো হয় এবং এ ধরনের কিছু প্রতিনিধিদল এদেশে আসেন।

ক্রীড়া

দেশে ক্রীড়ার উন্নতি সাধনের জন্য সরকার এখানে রাশিয়ার বিচিত্রানুষ্ঠান ও ফুটবল খেলা এবং ভারতীয় খেলোয়াড়দের কাবাডি খেলার ব্যবস্থা করেন এবং বাংলাদেশের কয়েকটি খেলোয়ার দল ও প্রতিনিধি বিদেশে পাঠান। খেলাধুলার উন্নতি সাধনের জন্য প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ব্যাপক কর্মসূচী রাখা হয়েছে।

এক নজরে

* প্রাথমিক বিদ্যালয় অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ ২৬০৩৬ জন

* বেসরকারি পরিকল্পনা থেকে সরকারি পরিকল্পনাধীনে আনীত নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৫০৯ টি

* উন্নয়নের জন্য নির্বাচিত প্রাথমিক বিদ্যালয় ১৫১০ টি

* শিক্ষক কল্যাণ পরিকল্পনার অধীনে মঞ্জুরি ৩ কোটি ৯৭ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা

* ১৮০০ টি জুনিয়র উচ্চ বিদ্যালয়ের মেরামত ও পুনর্নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলেছে

* দুইটি সংযোজক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কাজ চলছে

* প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সরকারি চাকুরে বলে ঘোষণা করা হয়েছে
(পৃ:-২৬)

যোগাযোগ

যে কোনো দেশেরই অর্থনৈতিক অগ্রগতির পূর্বশর্ত সুষ্ঠু যোগাযোগ ব্যবস্থা। আমাদের জাতীয় জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রটি মুক্তিযুদ্ধের সময় ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই কথা বিবেচনা করে সরকার অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে যত দ্রুত গতিতে সম্ভব যোগাযোগ ব্যবস্থার পুনর্গঠন ও তাকে নবজীবনের চেষ্টা করেন।

বাংলাদেশ রেলওয়ে

মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ রেলওয়েই ছিল এককভাবে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান। স্বাধীনতার পর পরই রেলওয়ে প্রশাসন তাদের কাজকর্মের জন্য অপরিহার্য সকল বিধ্বস্ত সেতু এবং অন্যান্য সম্পত্তি পুনর্নির্মাণের কাজ শুরু করে। এ সময় পুনর্বাসন কর্মসূচির সহ অন্যান্য উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৩০০ টি সেতু বিধ্বস্ত হয়। পরে এগুলি পুনর্নির্মিত হয়েছে। স্বাধীনতার পর পরই (অস্পষ্ট) সেতুর মেরামত করা হয়। আলোচ্য বৎসরে আরো একটি বড় সেতুর মেরামত করা হয়েছে। এটি হলো ভৈরবে শহীদ হাবিলদার আব্দুল হালিম সেতু। এর মেরামতের ব্যয় হয় ১ কোটি ৩৪ লাখ ২৫ হাজার টাকা। ১৪৮৪ টি রেলওয় ওয়াগণ, ৩৬৭ টি যাত্রীবাহী বগি, ৩ খানি স্টিমার ও অনেকগুলি ট্রাম দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বর্তমানে এগুলি আবার চালু করা হয়েছে।

ফরিদপুর-বরিশাল রেলপথ প্রকল্প

এই রেলওয়ে প্রকল্পের কাজ ১৯৬৭ সালে হাতে নেয়া হয়। কিন্তু আসলে এর বাস্তবায়ন শুরু হয় স্বাধীনতার পর। এসময় ফরিদপুর থেকে তালমা পর্যন্ত ১০ মাইল রেল লাইন বসানোর কাজ শেষ হয়েছে এবং ১৯৭৩ সালের জুন মাস থেকে এতে গাড়ি চলাচল করছে।

ঈশ্বরদী-নগরবাড়ি রেলপথ

ঢাকা এবং দেশের উত্তরাংশের মধ্যে সংক্ষিপ্ততর বিকল্প ব্রডগেজ লাইন বসানোর জন্য এই প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। কিন্তু প্রাথমিক কাজ ইতিমধ্যে সমাপ্ত হয়েছে। যমুনা সেতুর পরিকল্পনা চূড়ান্ত রূপ নির্ধারণের পর এই প্রকল্পের চূড়ান্ত রূপ দেয়া হবে।

সড়ক পরিবহন

সড়ক পরিবহন সংস্থা মাত্র কয়েকটি বাস নিয়ে ১৯৬১ সালে ঢাকায় প্রথম কাজ শুরু করে। বর্তমানে এই সংস্থা রাজধানীকে অধিকাংশ জেলা শহর ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা কালে সংস্থা নতুন বাস সংগ্রহের মাধ্যমে সারাদেশে এর কার্যক্রম সম্প্রসারিত করার প্রস্তাব করেছে।
(পৃ:-২৭)

মুক্তিযুদ্ধের সময় সংস্থার বহু গাড়ি হারিয়ে যায় এবং নষ্ট হয়। এই পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সংস্থা ভারত থেকে ১৬১ খানি এবং জাপান থেকে ২৪৯ খানি বাস আমদানি করেছে। স্বাধীনতার পর সংস্থা ২৫ টি মাতাদোর কোচও সংগ্রহ করে। এছাড়া, গুরুত্বপূর্ণ জংশন গুলোতে বাস ডিপোও নির্মাণ করা হয়েছে।

সড়ক ও জনপথ

সড়ক ও জনপথ গুলিতে এখনো পুননির্মাণের কাজ চলছে। এ ক্ষেত্রে উন্নয়ন কাজের মধ্যে রয়েছে সেতু নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ, বিকল্প সড়ক নির্মাণ ও ফেরি প্রবর্তন। এছাড়া, সম্প্রসারণের কাজ সহ নতুন পরিকল্পনার বাস্তবায়নও চলছে। ১৯৭২-৭৩ আর্থিক বৎসরে ১৩৪’৯৩ মাইল মাটি কাটার কাজ, ১২২’৮৩ মাইল শান বাঁধানোর কাজ, ৫৩’৯৩ মাইল রাস্তার উপরিভাগের কাজ এবং ১৫৩৮’৫৫ মাইল সেতু নির্মাণের কাজ সমাপ্ত হয়।
এছাড়া, ১৯৭৩-৭৪ আর্থিক বৎসরে একটি ব্যাপক কর্মসূচির কাজ চলে। ইতিমধ্যে সরকার প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন। এতে সড়ক ও জনপথের জন্য পরিকল্পনায় বর্তমান আর্থিক বছরে বৈদেশিক মুদ্রাসহ ৭ কোটি ১০ লাখ টাকাও বেশি ব্যয় বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

চালনা বন্দর

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ১১ খানি জাহাজ বিধ্বস্ত হয়। এ গুলির ধ্বংসাবশেষ সাজিয়ে বন্দরকে পুরোপুরি কার্যোপযোগী করে তোলা ছিল চালনা বন্দর পরিদপ্তরের প্রথম ও প্রধান কাজ। বন্দরে পুরোদমে কাজ চালানোর জন্য এর প্রয়োজন ছিল। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭৩ সালের জানুয়ারি মাসে ধ্বংসাবশেষ অপসারণের কাজ শুরু হয় এবং তা শেষ হয় ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বরে। এছাড়া, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং বন্দরের জন্য বিভিন্ন যান সংগ্রহের কাজ ও জোরদার করা হয়েছে।

বন্দরের কাজ

এবছর বহু প্রতিবন্ধকতা এবং অসুবিধার মধ্যে বন্দরের কাজ চলছে। অসুবিধা গুলির মধ্যে ছিল বন্দরের বিভিন্ন যানের খুচরা যন্ত্রাংশ অভাব, বৈদেশিক মুদ্রা বরাদ্দের স্বল্পতা। জ্বালানি সংকট এবং বিশেষ করে অফিসার ও পাইলটের স্বল্পতা। ১৯৭৩ সালের চালনা বন্দরে সর্বমোট ৫৭৮ খানি জাহাজ আসে।
এ বৎসরে মোট ১৫৭২৮৩৩ টন মাল ওঠানামা করে এবং বন্দরের রাজস্ব আয় হয় ৭৭ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা।

উন্নয়ন ও পুননির্মাণ

১৯৭৩ সালের বন্দরের যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা জিনিসের পুনঃ নির্মাণ কাজ চলতে থাকে। এছাড়া একটি স্থায়ী বন্দর প্রকল্প (আনুমানিক ব্যয় ৬০ কোটি টাকা) হাতে নেয়া হয়েছে।
(পৃ:-২৮)

এই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ৭ টি জেটি নির্মাণ (প্রতিটির বিস্তার ৬০০ ফুট), বন্দর যান মেরামতের জন্য একটি বার্থ ট্রানজিট শেড, গুদামঘর, বন্দরের কপিকল, আঁকশি কপিকল, একটি বিপণি কেন্দ্র, একটি অতিথি ভবন, একটি প্রশাসনিক ভবন, আবাসিক গৃহাদি, আনুষঙ্গিক সংস্থাপন এবং বিভিন্ন ধরনের অন্যান্য সুবিধাদি ব্যবস্থা। দ্রুত মাল পরিবহনের জন্য স্থায়ী বন্দরটিকে রেল ও সড়ক দ্বারা সংযুক্ত করা হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রাথমিক কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। কারিগরি কাজ ও জেটি নির্মাণের জন্য ঋণ চুক্তির অধীনে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। নির্মাণ সরঞ্জাম আনা-নেয়ার শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে ইস্পাতের ভিত্তিস্তম্ভ পোঁতার কাজ শুরু হয়েছে। সমগ্র প্রকল্পের বাস্তবায়ন তিন বছরে সমাপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
স্বাধীনতার সংগ্রাম কালে ছোট বন্দর শহর মংলা দারুণভাবে বিধ্বস্ত হয়। শহরটির পুনর্নির্মাণ ও উন্নয়নের প্রয়োজন বিশেষ ভাবে অনুভূত হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিক নকশা আনুমানিক হিসাব এবং বিন্যাস পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। দুই কোটি টাকার সরকারি সাহায্য ও পুনর্বাসন মঞ্জুরীর ভিত্তিতে কাজে হাত দেওয়া হয়েছে। এখন কাজ এগিয়ে চলছে। মঙ্গলা শহরের উন্নয়নে ব্যয় হবে ৫৭ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা।

এই সমস্ত কাজ ছাড়াও হিরণ পয়েন্টে পাইলট বেস উন্নয়ন (ব্যয়ের আনুমানিক পরিমাণ ২৩ লক্ষ ১২ হাজার টাকা), ৫ টি আলোক স্তম্ভ নির্মাণ (আনুমানিক ব্যয় এর পরিমাণ ২৯ লক্ষ ৬১ হাজার টাকা), চালনা বন্দরমুখী খাল গভীরকরণ (আনুমানিক ব্যয় এর পরিমাণ ৬ কোটি ৬২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা), রুঙ্গভেন্ট জেটির সংস্কার ও উন্নয়ন (আনুমানিক ব্যয় এর পরিমাণ ২৪ লক্ষ ৯৯ হাজার টাকা) এবং মুরিং বয়া পরিবর্তনের (আনুমানিক ব্যয় এর পরিমাণ ৭২ লক্ষ টাকা) কাজ এগিয়ে চলছে।

এক নজরে

* জাপান ও ভারত থেকে আমদানিকৃত বাসের সংখ্যা ৪৩৫ খানি

* চালনা বন্দরের রাজস্ব আয় ৭৭ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা

* হাই চালনা বন্দর পরিকল্পনার আনুমানিক ব্যয় ৬০ কোটি টাকা

* ভৈরবের শহীদ হাবিলদার আব্দুল হালিম সেতুর পুনর্নির্মিত হয়েছে

* ফরিদপুর-বরিশাল রেলপথ প্রকল্পের অধীনে ফরিদপুর-তালমা রেললাইন নির্মিত হয়েছে
(পৃ:-২৯)

জলযান ও বিমান

উন্নয়নশীল দেশে সুষ্ঠু যোগাযোগব্যবস্থা যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে সে সম্পর্কে বেশি কিছু বলতে যাওয়ার নিষ্প্রয়োজন। এজন্য বাংলাদেশ সরকার যথাযথ আগ্রহ সহকারে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে হাত দেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। এ কারণে জাহাজ চলাচল, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন ও বিমান চলাচলে উন্নয়ন নতুন সরকারের জন্য অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। তা সত্ত্বেও তারা সাহসিকতার সঙ্গে এই সমস্যার মোকাবেলা করেন। এ সময় কয়েকটি কর্মসূচি গ্রহণ করে যথাযথভাবে বাস্তবায়িত করা হয়। সাম্প্রতিক কালে এক্ষেত্রে ধ্বংসস্তূপের পটভূমিতে যে অগ্রগতি সাধিত হয়েছে তা প্রশংসার যোগ্য।

বাংলাদেশ বিমান

বিমান চলাচলের জগতে বাংলাদেশ বিমান একটি নতুন নাম। ১৯৭২ সালের ৪ঠা জানুয়ারি এই বিমানপথ এর জন্ম হয়। তিন হাজার প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ব্যক্তি নিয়ে এই সংস্থা কাজ শুরু করে। উক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন ৭০ জন কার্যনির্বাহক, ৬০ জন বিমান চালক ও ১৩০ জন ইঞ্জিনিয়ার। এছাড়া, সংস্থার সকল শাখায়ই তত্ত্বাবধায়ক শ্রেণীর বেশ কিছু দক্ষ কর্মী ছিলেন। তবে সংস্থার কোন বিমান ছিলো না। এ কারণে বিমানপথ এর কাজ শুরু করার উদ্দেশ্যে বিমান সংগ্রহের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালানো হয়। এখন এই বিমানপথের একখানি বোয়িং ৭০৭-৩২০ সি এবং ফোকার এফ-২৭ বিমান রয়েছে। এর মধ্যে নেদারল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া থেকে দুই শ্রেণীর দুখানি করে বিমান উপহার হিসেবে পাওয়া গেছে।

বিমান চলাচল

বাংলাদেশ বিমানের ঢাকার সঙ্গে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের এবং দেশের অভ্যন্তরে ৩টি প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র যোগাযোগ স্থাপন করেছে। এছাড়া ঢাকার সঙ্গে কলকাতা, কাঠমুন্ডু ও লন্ডনেরও যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে এবং অদূর ভবিষ্যতে ব্যাংকক পর্যন্ত তা সম্প্রসারিত করার পরিকল্পনা রয়েছে। ১৯৭৩ সালে এই সংস্থা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পথে ৭২৭৩১ জন যাত্রী, ১০৮১৪১৫ পাউন্ড এবং ৪৭৫৪১ পাউন্ড চিঠিপত্র বহন করে। আভ্যন্তরীণ পথে ৪২৫৫০৩ জন যাত্রী, ৭০৪৪১৪৫ পাউন্ড মাল এবং ১৬৬৮৩১ পাউন্ড চিঠিপত্র বহন করা হয়। প্রসঙ্গতঃ এই সংস্থার আভ্যন্তরীণ পথের ভাড়ার হার অত্যন্ত অল্প। এত অল্প ভাড়া পৃথিবীর আর কোন দেশের নেই।
(পৃ:-৩০)

রক্ষণাবেক্ষণ

সংস্থা এফ-২৭ বিমান সংরক্ষণের জন্য ঢাকায় তার নিজস্ব কারখানা গড়ে তুলেছে। এর প্রকৌশল বিভাগে এফ-২৭ বিমান মেরামতের জন্য কিছু পরীক্ষামূলক কাজ চলে। এজাতীয় কাজের পূর্ণ সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ বিমান আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহন সংস্থার সদস্য নয়, কিন্তু তার সকল নিয়ম কানুন ও (অস্পষ্ট)-রীতি মেনে চলে। এছাড়া, বাংলাদেশ বিমান আন্তর্জাতিক সংস্থার বেশ কয়েকটি সদস্যের সাথে আন্তঃ লাইন চুক্তি সম্পাদন করেছে। ঢাকা হয়ে বর্তমানে যে সমস্ত আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থার বিমান চলাচল করে তাদের সবাইকেই এই বিমানবন্দরে ব্যবস্থাপনা এবং খাওয়া-দাওয়ার সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। বাংলাদেশ বিমানের একটি আধুনিক রন্ধনশালার রয়েছে। সেখান থেকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সুস্বাদু খাবার সরবরাহ করা হয়।
বোয়িং বিমানের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ বিমানের বোম্বে, দুবাই, ফ্রাঙ্কফুর্ট সৈকত এবং উপসাগরীয় এলাকার কয়েকটি জায়গায় স্টেশন খোলার পরিকল্পনা রয়েছে। বাংলাদেশ বিমান দিল্লি, সিঙ্গাপুর, রেঙ্গুন, হংকং এবং দূরপ্রাচ্যের কয়েকটি জায়গায় যাতায়াত করবে।

প্রশিক্ষণ

বাংলাদেশ বিমান তার কর্মচারীদের জন্য ব্যাপক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এর লক্ষ্য বিশ্বের বিমান চলাচল ক্ষেত্রে উন্নততম মানের পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছানো।

বেসামরিক বিমান পরিবহন

মুক্তিযুদ্ধের সময় বেসামরিক বিমান পরিবহন সংস্থা প্রচন্ড অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছিল। এ সময় ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, যশোর, কুমিল্লা, ঈশ্বরদী, কক্সবাজার, শমশের নগর এবং ঠাকুরগাঁয়ের বেসামরিক বিমান বন্দর মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরই এগুলি পুনর্নির্মাণ করে কার্যোপযোগী করা হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর দেশে ২৩ খানি ক্ষতিগ্রস্ত বিমান পড়েছি। এগুলির মধ্যে ৫ খানিকে প্রয়োজনীয় পরীক্ষার পর চালানোর উপযোগী করা হয়। ৬ খানি বিমানের জন্য বড় রকমের মেরামত কাজের দরকার পড়ে। মেরামতের পর সেগুলি বেসরকারি বিমান পরিবহন কর্তৃপক্ষ কে দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে নিয়ে চালানোর উপযোগী করা হয়েছে। এছাড়া, বাংলাদেশ বিমান কর্তৃক সংগৃহীত ৯ খানি বিমান রেজিস্ট্রি করে সে গুলির জন্য রেজিস্ট্রেশনের ও উড্ডয়ন যোগ্যতার অনুমোদন পত্র দেওয়া হয়। ক্ষতিগ্রস্ত বিমানবন্দর গুলির মেরামত ছাড়াও যশোর বিমানবন্দরে একটি নতুন টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়েছে। এসবের ফলে সীমিত সম্পদ নিয়ে ও বেসামরিক বিমান পরিবহন কাজকর্ম আবার স্বাভাবিক হয়ে ওঠে।
প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার আমলে ১৯৭৩-৭৪ সালের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে ১০ কোটি ২০ লক্ষ টাকা ব্যয় করা হবে। এর জন্য পরিকল্পনা
(পৃ:-৩১)

কমিশন ইতিমধ্যেই ৪ কোটি ৯০ লক্ষ টাকা মঞ্জুর করেছেন। ১৯৭৩-৭৪ সালে কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে বরিশাল-রাজশাহী কুর্মিটোলা (ঢাকার সন্নিকটে) এবং সৈয়দপুর বিমানবন্দরের উন্নয়ন। এই বিমানবন্দর গুলিতে আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা থাকবে। এছাড়া ১২ টি নতুন পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ জাহাজ চলাচল সংস্থা

বাংলাদেশে পানির দেশ। এ কারণে বিদেশি জাহাজে উপর নির্ভর না করেই বাংলাদেশে ব্যাপককারে আমদানি-রপ্তানির কাজ চালানোর জন্য একটি বাণিজ্য নৌবহর গড়ে তুলতে পারে।
দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় জাহাজ চলাচলের গুরুত্ব অনুধাবন করে সরকার একে রাষ্ট্রায়ত্ত করেছেন এবং বাংলাদেশ জাহাজ চলাচল সংস্থা নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করেছেন। বর্তমানে সংস্থায় ১০ খানি সমুদ্রগামী জাহাজ রয়েছে। এগুলোর ডেডওয়েট ৭৮৮৪৭ টন। ৫ খানি জাহাজ যুক্তরাজ্য উপসাগরীয় পথে এবং বাকি ৫ খানি বাংলাদেশ ও ভারতের পূর্ব উপকূলের মধ্যে চলাচল করে। সংস্থা যুক্তরাজ্য উপমহাদেশীয় কনফারেন্স এবং ভারত, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, বার্মা কনফারেন্স লাইনের সদস্য। এ কারণে আন্তর্জাতিক পথে পরিবহনের জন্য তাঁর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মাল পাওয়া সুনিশ্চিত হয়েছে।
১৯৭৩ সালের শেষদিক পর্যন্ত বাংলাদেশ জাহাজ চলাচল সংস্থা তার নিজস্ব ভাড়া করা জাহাজে রপ্তানিকৃত ১১৯৯৮৪ টন এবং আমদানিকৃত ২৩৭৫৭১ টন মাল পরিবহন করে। এছাড়া সংস্থা এজেন্সি জাহাজের মাধ্যমে রপ্তানিকৃত ১৮৬৪৯৯ টন মাল এবং তেলসহ আমদানিকৃত ১৫৮৯৩৫৮ টন মাল পরিবহন করে।

পরিকল্পনায় বরাদ্দ

প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা কালের সংস্থা শুকনো মাল বহনের জন্য ২০ খানি সমুদ্রগামী মালবাহী জাহাজ এবং দুইখানি তেলবাহী জাহাজ সংগ্রহ করবে। এর জন্য পরিকল্পনায় ৩১ কোটি ৩১ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। ১৯৭৩-৭৪ সালের অর্থবছরে সংস্থা ৬ খানি জাহাজ সংগ্রহ করবে বলে আশা করেন।

অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৮ সালে। এর লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন এর উন্নয়ন, রক্ষণাবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু স্বাধীনতার আগে এ ব্যাপারে বিশেষ কোনো অগ্রগতি হয়নি। স্বাধীনতার পর পরই যুদ্ধের ক্ষতিপূরণের এবং নৌ-পরিবহনের স্বাভাবিক সুযোগ-সুবিধার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ এ সময় পুনর্বাসন এবং পুনর্নির্মাণ কর্মসূচির সূচনা করেন। এতে ৪ কোটি ৩৬ লাখ ১০ হাজার টাকার বৈদেশিক মুদ্রাসহ মোট ব্যয় হবে ৭ কোটি ৭০ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা।
(পৃ:-৩২)

এ কর্মসূচি অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্রিটিশ পুনর্বাসন মঞ্জুরীর মাধ্যমে নৌ চলাচলের সুযোগ-সুবিধা, চট্টগ্রামে যুদ্ধ বিধ্বস্ত ঢাকা চেইন স্টেশনের মেরামত এবং নৌ-চলাচলের প্রথম জরিপ ব্যবস্থাকে নৌচলাচল অবস্থায় রূপান্তরিত করার জন্য প্রয়োজনীয় সাজ-সরঞ্জাম ও খুচরা যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করেছে। তারা বিধ্বস্ত বন্দর এবং ফেরি টার্মিনাল জেটি এবং ভেলা মেরামতের কাজে হাত দেয়। ওলন্দাজ পুনর্বাসন মঞ্জুরীর মাধ্যমে হল্যান্ড থেকে দুটি ড্রেজার পাওয়া যায় গেছে এবং এগুলি কাজে লাগানো হয়েছে।
কতৃপক্ষ খুলনায় একটি সংযোগ সাধনকারী খাল (মংলা-ঘষিয়াখালি) খননের কাজে হাত দিয়েছে এবং তালতলা খালের সম্প্রসারণ ও গভীরতা বৃদ্ধির কাজ শুরু করেছে। মংলা-ঘষিয়াখালি খাল ১৯৭৩ সালের শেষের দিকে উদ্বোধন করার কথা রয়েছে। এই খাল ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ এবং মংলা ও খুলনার মধ্যকার দূরত্ব কমিয়ে দেবে। তালতলা প্রকল্প শেষ হলে পদ্মা, ধলেশ্বরী এবং বুড়িগঙ্গা নদীর মধ্যে সারাবছর জাহাজ চলাচলের সুবিধা হবে।
অন্যান্য পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে-(১) ফেঞ্চুগঞ্জের উদ্যানে কুশিয়ারা নদীতে একটি খাল খনন, (২) লঞ্চ ভেড়াবার ৪০ টি স্টেশনের উন্নয়ন সাধন, (৩) ১৬ টি স্থানে খাদ্যদ্রব্য পরিবহনের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা, (৪) পটুয়াখালীতে মাধ্যমিক পর্যায়ে একটি নদী বন্দরের উন্নয়ন, (৫) নারায়ণগঞ্জকে মাস্টার স্যারেং এবং ডেক কর্মীদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের উন্নয়ন, (৬) আরিচা গোয়ালন্দ নারায়ণগঞ্জ দাউদকান্দি, নগরবাড়ী, পোড়াবাড়ি এবং সিরাজগঞ্জের খেয়াঘাটের উন্নতি সাধন, (৭) দেশি নৌকার যান্ত্রিকীকরণ, (৮) উপকূলবর্তী দ্বীপগুলোতে বন্দরের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা, (৯) ৫ টি বড় নদী বন্দরে খাদ্যদ্রব্য ওঠানো-নামানোর জন্য ব্যবহৃত যুদ্ধবিধ্বস্ত কাঠের জেটির পরিবর্তে কংক্রিটের পাকা জেটি স্থাপন, (১০) দশটি ড্রেজার সংগ্রহ এবং (১১) বাংলাদেশের নদী পথের উন্নয়নের সাথে সম্পর্কিত জরিপ অনুসন্ধান ও গবেষণা চালানো।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের ১৯৯৭৩-৭৪ সালে আর্থিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে মোট ব্যয়ের পরিমাণ ধরা হয়েছে ১১ কোটি ২৭ লক্ষ টাকা। তার মধ্যে ৩ কোটি ৩১ লক্ষ টাকা পুনর্বাসন এবং পুনর্নির্মাণ কর্মসূচিতে, ৫ কোটি ৭৬ লক্ষ টাকা চালু পরিকল্পনা কল্পনা গুলির জন্য এবং ২ কোটি ২০ লক্ষ টাকার নতুন পরিকল্পনা গুলির কাজে ব্যয় করা হবে। নতুন পরিকল্পনা গুলির মধ্যে রয়েছে সিলেট ও ময়মনসিংহে সুরমা ও কুশিয়ারা এবং তাদের সাথে সংযুক্ত জনপদগুলোর উন্নয়ন, লঞ্চ ভেড়াবার ৭৫ টি স্টেশনের ব্যবস্থা, খুলনা, চাঁদপুর, বরিশাল ও গোপালগঞ্জে আভ্যন্তরীণ নদী বন্দরের উন্নয়ন, শেরপুর, বালাগঞ্জ এবং সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে বন্দরের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা, ফেরিঘাটের উন্নতি সাধন, লোগা ও সিমেন্টের নৌকা নির্মাণের একটি আদর্শ প্রকল্প, নৌযানের নকশা ও গবেষণা নৌকার ব্যবস্থা, একটি ড্রেজার সংস্থা স্থাপন, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের জন্য সমুদ্র জাহাজ সংগ্রহ এবং খানপুরে আর-বি-সি জেটি নির্মাণ।
(পৃ:-৩৩)

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন সংস্থা

১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির ২৮ নং আদেশ মোতাবেক বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন সংস্থা গঠন করা হয়। এর লক্ষ্য হলো উপকূলীয় আভ্যন্তরীণ জাহাজ চলাচল এবং নৌ-পরিবহনের উন্নয়ন বিকাশ সাধন ও পরিচালন। প্রাক্তন পূর্ব পাকিস্তান জাহাজ চলাচল সংস্থা বেঙ্গল রিভার (অস্পষ্ট) লিঃ এবং দেশের অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন এর কাজে জড়িত আরও কয়েকটি পরিত্যক্ত কোম্পানি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সম্প্রদায় এই সংস্থার হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বেশ কয়েক খানি নৌ-যান বিধ্বস্ত হয়। এগুলি পরে মেরামত করা হয়েছে। সরকার দান হিসাবে এবং ক্রয় করে আরও ১২৩ খানি নৌযান পেয়েছেন। এগুলির মধ্যে রয়েছে ৬৮ খানি সি-ট্রাক এবং ৯ খানি তৈলবাহী নৌযান।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন সংস্থার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে আরও ৬ খানি নৌযান সংগ্রহ। এছাড়াও প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা কালে ১৪২ খানি নৌ-যান সংগ্রহের পরিকল্পনা রয়েছে।

বাংলাদেশ জাহাজ নির্মাণ একাডেমি

বাংলাদেশ জাহাজ নির্মাণ একাডেমি মাত্র ১৬ জন ইঞ্জিনিয়ার নিয়ে ১৯৭২ সালে কাজ শুরু করে। এখন একাডেমি রেডিও অফিসার ও রাডার তত্ত্বাবধায়কদের জন্য পাঠ্যক্রম চালু করেছে। বাস্তব প্রশিক্ষণ দানের জন্য একখানি সমুদ্রগামী জাহাজ সংগ্রহ করা হয়েছে এবং কর্মীদের প্রশিক্ষণ দানের জন্য একটি কোর্স চালু করা হয়। ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে একাডেমিকে বরাদ্দ করা হয় ১৩ লক্ষ টাকা।

এক নজরে

* বেসামরিক বিমান পরিবহণের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য ব্যয় বরাদ্দ ১০ কোটি ২০ লক্ষ টাকা

* বেসামরিক বিমান পরিবহণের জন্য গৃহীত নতুন উন্নয়ন পরিকল্পনা ১২টি

* সমুদ্রগামী জাহাজ ও তৈলবাহী জাহাজ সংগ্রহের জন্য ব্যয় বরাদ্দ ৩১ কোটি ৩১ লক্ষ টাকা

* বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ব্যয় নির্ধারণ ১১ কোটি ২৭ লক্ষ টাকা

* বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের চালু এবং নতুন পরিকল্পনা সমূহের জন্য ব্যয় বরাদ্দ ৭ কোটি ১৬ লক্ষ টাকা
(পৃঃ-৩৪)

ডাক, তার ও দূরালাপনি

স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী দেশের ডাক ব্যবস্থার বিপুল ক্ষতি সাধন করে। ফলে বিভিন্ন পদ্ধতির ডাক চলাচল ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে পরবার পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায়। স্বাধীনতার পর তাই সরকার ডাক ব্যবস্থাকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে একটি কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হন। কিন্তু তারা দ্রুততার সঙ্গে সে সমস্যার মোকাবিলা করেন। এইরূপে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই ডাক ব্যবস্থা আগেকার অবস্থায় ফিরে আসে এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্রম অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এর উন্নতি হতে থাকে। দ্রুত প্রেরণ এবং বিনা কালক্ষেপে প্রাপকদের নিকট পৌঁছে দেওয়ার জন্য এখন আভ্যন্তরীণ মানি অর্ডারও অতিরিক্ত মাশুল ছাড়াই বিমানযোগে প্রেরণ করা হচ্ছে।
১৯৭৩ সালে ২৬১ টি নতুন ডাকঘর স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে সারাদেশে মোট ডাকঘরের সংখ্যা হচ্ছে ৬৪১৫ টি। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অধীনে আরো ৩৭২৫ টি নতুন ডাকঘর স্থাপনের একটি বড় কর্মসূচি রয়েছে। এগুলোর শতকরা ৯৭ ভাগই খোলা হবে পল্লী এলাকায়।

বৈদেশিক ডাক

পাকিস্তান ও ইসরাইল ছাড়া অন্যান্য সকল দেশের সঙ্গে ও রেজিস্ট্রিকৃত পত্র ডাক চলাচল ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। এখন ১০ টি দেশের সঙ্গে মানিঅর্ডার, ৪০ টি দেশের সঙ্গে ডাক পার্সেল এবং ১১ টি দেশের সঙ্গে সার্ভিস চালু রয়েছে। বিশ্বের অপরাপর দেশের সঙ্গে (অস্পষ্ট) ধরনের সার্ভিস চালু করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

ডাক বিভাগের কাজ চালানোর বাড়ী

১৯৭৩ সালে ডাক বিভাগের কাজ চালানোর জন্য ৬ টি বাড়ি ও ১৬ টি বাসাবাড়ির নির্মাণকার্য শেষ হয়। এই সময়ে কাজকর্ম চালানোর জন্য ৪৭ টি বাড়ি ও ২৯ টি বাসা বাড়ি মেরামত করা হয়েছে। বর্তমানে কাজকর্ম চালানোর বাড়ির সংখ্যা অত্যন্ত অপ্রতুল। এজন্য প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা কালে আনুমানিক ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৮৫ টি নতুন ঘরবাড়ি নির্মাণের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমানে ডাক কর্মচারীদের জন্য দেশের বিভিন্ন শহর এলাকায় ২০০০ টি বাসাবাড়ি রয়েছে। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় আরো ২৩০০ টি বাসা বাড়ি নির্মাণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

ডাক গাড়ী

দ্রুত ডাক গ্রহণ ও বিলি এবং বিভিন্ন ডাকঘরে টাকা-পয়সা আনা নেয়ার জন্য বর্তমানে ৮৮ খানি মোটরগাড়ি ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা কালে এর জন্য আরও ২০০ খানি মোটর ভ্যান ও স্কুটার সংগ্রহের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
(পৃঃ-৩৫)

শিল্প

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা মূলত কৃষিভিত্তিক। কিন্তু নয়া সরকার কৃষির পাশাপাশি শিল্পের একটি মৌল কাঠামো গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। তাদের এই চেষ্টার লক্ষ্য হলো বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর সাথে পা মিলিয়ে চলা। এই লক্ষ্য সামনে রেখে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের শিল্প কেন্দ্রের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ১৯৭৬ সালে কতগুলো ব্যাপক এবং কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

শিল্পে পুঁজি বিনিয়োগ

১৯৭৩ সালের ৮ ই জানুয়ারী সরকার শিল্পে পুঁজি বিনিয়োগ নীতি ঘোষণা করেন। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার কাঠামোর মধ্যে তারা একটি ব্যাপক শিল্প তফসিল প্রণয়ন করেন। এই তফসিলে ১১৭ প্রকার শিল্পের উন্নয়নের জন্য ৭২ কোটি ৮৮ লক্ষ টাকার বৈদেশিক মুদ্রাসহ ১২১ কোটি ৬০ লক্ষ টাকার পুঁজি বিনিয়োগের লক্ষ্য স্থির করা হয়। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্রথম বছরে শিল্পের উন্নয়নের জন্য একটি অগ্রাধিকার তালিকাও ঘোষণা করা হয়েছে। তাতে পুঁজি বিনিয়োগের লক্ষ্য করা হয়েছে ৩০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ হচ্ছে ১৮ কোটি ১৪ লক্ষ টাকা।

শিল্পে পুঁজি বিনিয়োগ
শিল্পে পুঁজি বিনিয়োগের তফসিল প্রণয়নের সময় নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর দিকে লক্ষ রাখা হয়ঃ (১) ভারসাম্য বিধান আধুনিকীকরণ এবং জীর্ণ যন্ত্রপাতির পরিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমান শিল্প ইউনিটগুলির পুনর্বাসন, (২) ক্ষুদ্র এবং আর্থিক শ্রমিক নির্ভর শিল্পগুলির অগ্রাধিকার ভিত্তিক উন্নয়ন, (৩) ভারসাম্য বিশিষ্ট উন্নয়ন সাধনের জন্য দেশের সকল অঞ্চলে শিল্প প্রতিষ্ঠান ছড়িয়ে দেওয়া, (৪) ভোগ্য পণ্যের ওপর জোর দেওয়া এবং (৫) দেশজ কাঁচামালের সদ্ব্যবহার ও (অস্পষ্ট) কৃষিভিত্তিক শিল্পের উন্নয়ন সাধন।

বিনিয়োগ তফসিল

দেশের সুষম উন্নয়ন সাধন এর উদ্দেশ্যে তফসিলে অঞ্চলভিত্তিক অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। যেমন, ১৯৭৩-৭৪ সালের জন্য বরাদ্দকৃত ৩০ কোটি টাকার মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনা শিল্পপ্রতিষ্ঠান গুলিতে ৬ কোটি টাকার বেশি ব্যয় করা হবে না বলে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দেশের যে সমস্ত শিল্পাঞ্চল কে উন্নয়নের প্রধান লক্ষণ ধরা হয়েছে তাদের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ নিচে দেয়া গেল:-

(১) শিল্পোন্নত এলাকায় (ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা)
স্থাপিত শিল্প অঞ্চলসমূহ……………শতকরা 20 ভাগের বেশি নয়।
(পৃ:-৩৮)

(২) স্বল্প উন্নত এলাকায় স্থাপিত শিল্পাঞ্চল
(অন্য সমস্ত শিল্পাঞ্চল)…………শতকরা ৫০ ভাগের বেশি নয়।

(৩) বিক্ষিপ্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান (শিল্পাঞ্চলের বাইরেকার শিল্পপ্রতিষ্ঠান ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনা কে বাদ দিয়ে)…………শতকরা ৩০ ভাগের বেশি নয়।

বিনিয়োগে উৎসাহ

শিল্পখাতে বেসরকারি পুঁজি বিনিয়োগ আকর্ষণ করার জন্য সরকার কিছু উৎসাহ মূলক ব্যবস্থা গ্রহন করেছেন। এগুলি হলঃ-

(১) নতুন স্থানীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠান উৎপাদন শুরু করবার পর পুঁজি বিনিয়োগের জন্য পাঁচ বৎসর পর্যন্ত কর মওকুফ পাবে। তবে, তার কর হার শতকরা ৬০ ভাগ সরকারি ঋণপত্র ক্রয়ের জন্য শিল্পে পুনর্বিনিয়োগ করতে হবে। কিন্তু উক্ত পুনর্বিনিয়োগ ৩৫ লক্ষ টাকার বেশি হতে পারবে না।

(২) যন্ত্রপাতির জন্য দেয় শুল্কের শতকরা ৫০ ভাগের পরিশোধ সেগুলি আমদানির তারিখ থেকে ৬ বছর পর্যন্ত স্থগিত রাখা যেতে পারে।

(৩) শিল্প প্রতিষ্ঠান উৎপাদন শুরু হওয়ার পর তার মূলধন রূপে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির জন্য দেয় শুল্কের শতকরা ৫ ভাগ হিসাবে ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত বাট্টা দেওয়া যেতে পারে। বর্তমানে এর উর্ধ্বসীমা ৫ লক্ষ টাকা।
ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম এবং খুলনা শিল্প এলাকা ছাড়া অন্যান্য এলাকায় যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হবে সেগুলোর জন্য কিছু অতিরিক্ত উৎসাহ দান মূলক ব্যবস্থা এবং বিশেষ আর্থিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে :

(১) ঋণ পরিশোধের অনুগ্রহ মূলক মেয়াদ উর্ধ্বপক্ষে আরো পাঁচ বছর বাড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে।

(২) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন শুরু হওয়ার পর পাঁচ বছর পর্যন্ত কর মওকুফ করা যেতে পারে। তবে, করমুক্ত মুনাফার হার শতকরা ৩০ ভাগ পুনর্বিনিয়োগ সরকারি ঋণপত্র থরিদের জন্য ব্যয় করতে হবে।

(৩) শিল্পোন্নত এলাকাসমূহে দেওয়ার জন্য যে হারে সুবিধাদি দেওয়া হয়, তার থেকে বেশি সুবিধা দেওয়া যেতে পারে।
আয়কর এবং অন্যান্য আইন অনুসারে বর্তমানে যে সমস্ত বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়ে থাকে এগুলি তার অতিরিক্ত। সম্পূর্ণরূপে বা প্রধানত; দেশজ কাঁচামাল ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত শিল্প গুলি কে উৎসাহ দানের উদ্দেশ্যে সরকার আরও কিছু উৎসাহদান মূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বিবেচনা করে দেখতে পারেন।
(পৃ:-৩৯)

বিনিয়োগ নীতিতে বেসরকারি খাতে লাইসেন্স ও পেটেন্টের আকারে বিদেশি সহযোগিতার সুযোগ রয়েছে। তবে, সমমর্যাদায় বিদেশিদের অংশগ্রহণ চলবে না। সরকারি খাতে বিদেশি সহযোগিতাকে কিছুটা স্বাগতম জানানো হবে। এই খাতের জন্য আপাতত ৩৮৫ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রাসহ ৭৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি পৃথক কর্মসূচি তৈরি হচ্ছে।

বাংলাদেশ কুটির শিল্প সংস্থা

কুটির শিল্প এবং হস্তচালিত তাঁত শিল্পের উন্নয়ন ও বিকাশ সাধনের জন্য এবং আমাদের দেশের বিশেষ করে পল্লী অঞ্চলের চারু ও কারুশিল্প সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে সরকার বাংলাদেশ কুটির শিল্প সংস্থা নামে একটি নতুন প্রতিষ্ঠান গঠন করেছেন। এই সংস্থার স্থাপনের ফলে, বিভিন্ন ধরনের কুটির শিল্পের উপর নির্ভরশীল এই ধরনের শিল্পে নিয়োজিত জনসাধারণের বেশ বড় একটি অংশ অর্থনৈতিক কল্যাণ সাধনের অনেক সুবিধা হবে বলে মনে হয়।

মুজিব প্রত্যাহার বোর্ড

শিল্পমন্ত্রীর সভাপতিত্বে গঠিত এই বোর্ড ইতিমধ্যেই সরকারি পরিচালনায় আনীত ১০৬ টি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান পুঁজি প্রত্যাহারের জন্য বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। এই সমস্ত প্রতিষ্ঠান থেকে পুঁজি প্রত্যাহার করতে গিয়ে এগুলিকে বেসরকারি মালিকানায় দেওয়ার সময় সরকার শ্রমিক সমবায় গুলিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। মোট এক কোটি টাকারও বেশি মূল্যের ২২ টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান সেনা কল্যাণ সংস্থা এবং ৪ কোটি টাকারও বেশি মূল্যের ১১ টি প্রতিষ্ঠান নবগঠিত মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের হাতে দিয়ে দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড ইনস্টিটিউশন

শিল্প মন্ত্রণালয়ের শিল্প বিভাগের আওতাধীন বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড ইনস্টিটিউট মুখ্যাত; শিল্পের উৎপাদন ও গুণগত নিয়ন্ত্রণের বিকাশের উদ্দেশ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভিত্তিতে সকল কৃষি ও শিল্পের মান নির্ণয়ের কাজে নিযুক্ত রয়েছে। গত একবছরে ইনস্টিটিউশন বিশেষ কয়েকটি কৃষিজাত দ্রব্য এবং পাট, মাছ, চা, চামড়া, পেট্রোলজাত ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ মান নির্ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে। এই মান নির্ধারণ শিল্পের উৎপাদনে সহায়তা করবে এবং বিদেশের ক্রেতাদের আস্থা অর্জনের মাধ্যমে রপ্তানি বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে।
ইনস্টিটিউশন সরকারের সার্টিফিকেশন মাকিং অর্ডিন্যান্সের আওতায় মান প্রয়োগ করে যথাযথ ভাবে নিজের দায়িত্ব পালন করবার উদ্দেশ্যে তার প্রাতিষ্ঠানিক পূনর্গঠনের জন্য জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। উক্ত অর্ডিন্যান্সের রপ্তানিযোগ্য দ্রব্যাদির জন্য বাধ্যতামূলক ভাবে অনুমোদনপত্র গ্রহণের এবং নিম্নমানের দ্রব্যাদির রপ্তানির অনুমোদিত বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এর লক্ষ্য হলো বিদেশের বাজারে দেশের সুনাম রক্ষা করা।
(পৃ:-৪০)

উল্লিখিত কাজকর্ম ছাড়াও ইনস্টিটিউশন বিভিন্ন দ্রব্যের মান নিয়ন্ত্রণ এবং শিল্পক্ষেত্রের অন্যান্য উন্নয়ন সম্পর্কিত কারিগরি দ্রব্যাদি বিনিময়ের উদ্দেশ্যে ব্রিটেন, ভারত, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি প্রভৃতি দেশের জাতীয় দ্রব্য মান নির্ধারণ সংস্থাগুলির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছে।
জাতিসংঘের সাহায্যে দেশে-বিদেশে কারিগরি কর্মীদের প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য ইনস্টিটিউশনের কয়েকটি কর্মসূচি রয়েছে। তার অন্যান্য কাজের মধ্যে রয়েছে দ্রব্যমান এবং বাজারজাতকরণ ব্যবস্থার সার্বিক উন্নতি সাধন।

বাংলাদেশে পুঁজি বিনিয়োগ উপদেষ্টা কেন্দ্র

যে কোন পুঁজি বিনিয়োগ প্রস্তাব পরীক্ষা করে দেখাবার জন্য পেশাদার উপদেষ্টাদের পরামর্শ গ্রহণ অপরিহার্য। সম্পদে বিনিয়োগ পূর্ব বিশ্লেষণ এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানের সাফল্যের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য এসবের প্রয়োজন রয়েছে।
বাংলাদেশে পুঁজি বিনিয়োগ উপদেষ্টা কেন্দ্র এই ধরনের পরামর্শ দিয়ে থাকে। ১৯৭৩ সালে কেন্দ্রটি চামড়া, চিনি এবং পাট শিল্প সম্পর্কে খাতভিত্তিক পর্যালোচনা পরিচালনা করা এবং বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক রনিত সম্ভাব্যতা রিপোর্ট পরীক্ষা করে। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পগুলিতে উৎপাদিত দ্রবাদির মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি পরীক্ষা ও বাজার পর্যালোচনা এবং রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানের কাজকর্মের ও পরিত্যক্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলির মূল্যায়ন। পরিত্যক্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানের মূল্যায়নের উদ্দ্যেশ ছিল পুঁজি প্রত্যাহার।
প্রয়োজনীয় সাধারণ পরামর্শদানের জন্য প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা কালে উপরি-উক্ত উপদেষ্টা কেন্দ্রকে স্নায়ুকেন্দ্র হিসেবে রেখে প্রাথমিক পর্যায়ে একটি জাতীয় পরামর্শদান প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হবে। প্রথম পরিকল্পনাকালে পর বিশেষ ধরনের পরামর্শদানের জন্য উক্ত প্রতিষ্ঠানের আওতা আরও সম্প্রসারিত করা হবে।

এক নজরে

* প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা কালে পুঁজি বিনিয়োগের লক্ষ সীমা ১২১ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা

* প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্রথম বৎসরে পুঁজি বিনিয়োগের লক্ষ্যসীমা ৩০ কোটি টাকা

* সেনা কল্যাণ সংস্থার হাতে ন্যস্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের মূল্য ১ কোটি টাকারও বেশি

* মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের হাতে ন্যস্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের মূল্য ৪ কোটি টাকারও বেশি
(পৃ:-৪১)

পাট

বাংলাদেশের সোনালী আঁশ পাট বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের একটি বড় উৎস। কার্যত: পাট সাবেক পাকিস্তান সরকারের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস ছিল। এই বোধগম্য কারণেই পাট শিল্পের চাবিকাঠি ছিল অবাঙালিদের হাতে। স্বাধীনতার পর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কালবিলম্ব না করে পাট সম্পর্কে উপযুক্ত ও গতিশীল নীতি গ্রহণ এবং সমগ্র পাট শিল্পের পূনর্গঠনের জন্য কতকগুলি ব্যবস্থা নেন। তারা পাট শিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত করেন এবং বিভিন্ন পাটকলের ব্যবস্থাপনা, উৎপাদন ক্ষমতা, বিক্রয় ও রপ্তানির প্রতি দৃষ্টি রাখার দায়িত্ব দিয়ে পাটকল সংস্থা নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করেন।

উৎপাদন ও রপ্তানি
সংস্থাটি গঠিত হওয়ার ফলে ১৯৭২ সালের প্রথমদিকে পাটকলগুলোর প্রশাসন জোরদার হয় এবং উৎপাদন ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাটের উৎপাদন ব্যবসা এবং শিল্পে যে প্রাথমিক পর্যায়ের অসুবিধার সৃষ্টি হয়েছিল তাও বহুলাংশে দূর করা হয়েছে। সূচনাতে অনাবৃষ্টি ও প্রতিকূল আবহাওয়ার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় সত্বেও পাটের উৎপাদনের লক্ষ্য পূর্ববর্তী বছরের ৪২ লক্ষ ৮৬ হাজার গাঁট থেকে ৬৬ লাখ ২৫ হাজার গাঁটে উন্নীত হয়। ১৯৭২-৭৩ সালে পাটজাত দ্রব্যের সার্বিক উৎপাদন ছিল ৪ লক্ষ ৪৬ হাজার টন। ১৯৭১-৭২ সালে উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৩ লক্ষ টন এবং ১৯৭০-৭১ সালে ছিল ৪ লক্ষ ৬৯ হাজার টন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ থেকে ১৪০ কোটি টাকা মূল্যের ৪ লক্ষ ১১ হাজার টন পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি করা হয়। ১৯৭১ সালে রপ্তানি করা হয় ২ লক্ষ ২৪ হাজার টন পাটজাত দ্রব্য, যার মূল্য ছিল ৪৩ কোটি ২৭ লক্ষ টাকা।
ইতিমধ্যে সরকার দেশের এবং বিদেশের চাহিদা পূরনের উদ্দেশ্যে পাটের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। ব্যাপক পাট চাষের একটি প্রকল্প প্রণয়ন করা হচ্ছে। অধিকন্ত সরকার উৎপাদন ব্যয় হ্রাসের পরিকল্পনাও গ্রহণ করেছেন। কেবল কৃত্রিম আঁশ নয়, অন্যান্য দেশ কতৃক উৎপাদিত পাট ও তৎসংশ্লিষ্ট মোকাবেলায় আরও প্রতিযোগিতামূলক করবার জন্য এই পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
(অস্পষ্ট) সেতু এবং ভৈরব সেতু (সরকারিভাবে যার নতুন নাম দেওয়া হয়েছে শহীদ হাবিলদার আব্দুল হামিদ সেতু) পুনরায় চালু করার ফলে আভ্যন্তরীণ বাজারে পাট পরিবহনের প্রাথমিক প্রতিবন্ধকতা গুলি অনেকাংশে দূর হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে পাট পরিবহন যানবাহনের স্বল্পতার দরুন অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে ছিল। কিন্তু বর্তমানে এই পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে।
(পৃ:-৪২)

আভ্যন্তরীণ বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা

আভ্যন্তরীণ বাজারজাতকরণ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সূচনাতেই সরকারকে একটি গুরুতর সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এটি হলো পাটের যথাযথ বাজারজাতকরণ। এই সমস্যার সমাধানের জন্য এ সময়ে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন ছিল দেশের সর্বত্র বাজারজাতকরণ ব্যবস্থার পুনর্গঠন। পাট শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গুলি ছিল অবাঙালীদের হাতে। তাদের দেশ ত্যাগের ফলে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয় সরকারি ও বেসরকারি খাতের যৌথ উদ্যোগের ফলে তা পূরণ করা হয়েছে। পরিত্যক্ত প্রতিষ্ঠানগুলির দায়িত্ব সরকার গ্রহণ করেছেন এবং এখন সরকার কর্তৃক নিযুক্ত প্রশাসকরা এগুলির পরিচালনায় নিয়োজিত রয়েছেন।

নূন্যতম মূল্য

বর্তমান উৎপাদন-ব্যয়ের কথা ভেবে পাটের আভ্যন্তরীণ সর্বনিম্ন মূল্য বৃদ্ধি করে মণ প্রতি (৮২ পাউন্ড) ৫০ টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। পাট উৎপাদনকারীরা যাতে এই সর্বনিম্ন মূল্য পায়, তার নিশ্চয়তা বিধানের উদ্দেশ্যে সরকার তাদের কাজের আওতা সম্প্রসারিত করেছেন। ১৯৭২-৭৩ সালে ৩০০ পাট ক্রয় কেন্দ্র খোলা হয়। এ গুলির মধ্যে ২৬০ টি কেন্দ্র পরিচালনা করে তিনটি প্রতিষ্ঠান-পাট ব্যবসায় সংস্থা, পাট বাজারজাতকরণ সংস্থা ও পাট মূল্য স্থিতি সাধন সংস্থা। বাকি কেন্দ্রগুলি পরিচালিত হয় বিভিন্ন পাটকল কর্তৃক এবং বাংলাদেশ রপ্তানি সংস্থার বেসরকারি রপ্তানি এজেন্টদের দ্বারা।

রপ্তানি বাণিজ্য

১৯৭২ সালের জুলাই মাসে সরকার পাটের রপ্তানি বাণিজ্য রাষ্ট্রায়ত্ত করেন। ১৯৭১-৭২ সালে পাটের রপ্তানি ১৯ লক্ষ ৭১ হাজার গাঁটে নেমে এসেছিল। এর মূল্য ছিল ৬২ কোটি ৪৫ লক্ষ টাকা। কিন্তু ১৯৭২ সালে রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়ে ২৮ লক্ষ ২৬ গাঁটে উন্নীত হয়,-যার মূল্য ছিল ১০৪ কোটি ৭০ লক্ষ টাকা। বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও কাঁচা পাট রপ্তানি অর্জিত হয়েছে।

এক নজরে

* ১৯৭২-৭৩ সালের রপ্তানিকৃত পাটজাত দ্রব্যের মূল্য ১৪০ কোটি টাকা

* পূর্ববর্তী বৎসরের থেকে পাটের উৎপাদন বৃদ্ধি ২৩ লাখ ৩৯ হাজার গাঁট

* পাট ক্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে ৩০০ টি

* পূর্ববর্তী বৎসরের থেকে পাটের রপ্তানি বৃদ্ধি ৮ লক্ষ ৫৫ হাজার গাঁট
(পৃ:-৪৩)

ব্যবসায় ও বানিজ্য

১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে স্বাধীনতা অর্জনের পর কয়েক মাস বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল অত্যন্ত সংকট পূর্ণ। ব্যবসা-বাণিজ্যের সমগ্র ক্ষেত্রটাই যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর পুনরুদ্ধারের জন্য পরিস্থিতির উন্নতি সাধন প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এর জন্য দরকার ছিল প্রধানত; দুটি জিনিসের। একটি হল আভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ একটি নতুন নীতি প্রণয়ন এবং দ্বিতীয়টি হলো বিদেশের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা,- যা আভ্যন্তরীণ উন্নয়নে সহায়তা করবে।
১৯৭৩ সালে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সরকারের কার্যকলাপ ছিল উপরিউক্ত নীতি ও ব্যবস্থাবলীর সম্প্রসারণ। বলা বাহুল্য এই সম্প্রসারণ স্বাধীনতা উত্তরকালে পরিস্থিতির বিভিন্ন সময়ের পরিবর্তনের দিকে লক্ষ্য রেখেই করা হয়।

বৈদেশিক বাণিজ্য

১৯৭৩-৭৪ সালের অর্থবছরে রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয় ৩২৪ কোটি টাকা। এ বছরের প্রথম তিন মাসে বাংলাদেশে বিদেশি পণ্য রপ্তানি করে ৫৬ কোটি ৮৪ লক্ষ টাকা অর্জন করে।
১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত বাংলাদেশে জাপানসহ মোট ৮টি দেশে তার বাণিজ্য মিশন স্থাপন করে। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের সম্প্রসারণ এবং আমদানি বাণিজ্য তত্ত্বাবধান কমিশন গুলির কাজ বাংলাদেশ সোভিয়েত ইউনিয়নসহ ৯ টি সমাজতান্ত্রিক দেশের পণ্য বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষর করে। এ সমস্ত চুক্তির মাধ্যমে ১০০ কোটি টাকার পণ্য বিনিময় বাণিজ্য চালানো হবে।

বিতরণ ও মূল্য নিয়ন্ত্রণ

জনসংখ্যা ও চাহিদা অনুযায়ী অত্যাবশ্যক দ্রব্যাদির পর্যাপ্ত ও সুষ্ঠু সরবরাহ নিশ্চিত করাই হলো বিতরণ নীতির প্রধান লক্ষ্য। এই নীতি অনুসারে ভোগ্য পণ্য সরবরাহ সংস্থাকে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ থেকে বাণিজ্য বিভাগের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। সংস্থার কাজ হল কতগুলি ন্যায্যমূল্যের দোকান এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত মূল্যে কাপড়, দুগ্ধ, খাদ্য ইত্যাদি প্রকৃত ব্যবহারকারীদের মধ্যে বিতরণ করা।
দ্রব্যমূল্য স্থিতিসাধক সংস্থাকেও শিল্প বিভাগ থেকে বাণিজ্য বিভাগের নিয়ন্ত্রণে এনে, অত্যাবশ্যক দ্রব্যাদির মূল্য নির্ধারণের জন্য উচ্চ ক্ষমতা বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
বিতরণ ব্যবস্থা থেকে দুর্নীতি পরায়ন ব্যক্তিদের বাদ দেওয়ার জন্য অত্যাবশ্যক দ্রব্যাদির ডিলারদের একটি জরিপ করা হয়। এছাড়া, বিতরণ ও মূল্য নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত আইন ও আদেশগুলো জোরদার করা হয়েছে। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের
(পৃ:-৪৪)

উন্নয়নের জন্য অন্যান্য সরকারী ও বেসরকারী সংস্থা গুলি পরস্পরের সাথে সহযোগিতা করে এবং এতে সাফল্য অর্জন করে।

যৌথ কোম্পানির রেজিস্ট্রি

আলোচ্য বছরে অনেকগুলি কোম্পানির রেজিস্ট্রি করা হয়। এ গুলির মধ্যে ছিল ১৩ টি সরকারি ও ২১০ টি বেসরকারি কোম্পানি, ১৮ টি সমিতি, একটি সীমাবদ্ধ গ্যারান্টিযুক্ত কোম্পানি, ১৩৬২ টি অংশীদারি প্রতিষ্ঠান এবং ১৭ টি বিদেশী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এ সমস্ত কোম্পানির অনুমোদিত মূলধন ছিল ৩৯ কোটি ৩২ লক্ষ টাকা। রেজিস্ট্রিকৃত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল যৌথ কোম্পানির ক্ষেত্রে শতকরা ২৪’৫০ ভাগ, অংশীদারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে শতকরা ২১’৫০ ভাগ ও সমিতির ক্ষেত্রে শতকরা ১৫৭ ভাগ। প্রাপ্ত ফি’র পরিমাণও আনুপাতিকভাবে বৃদ্ধি পায়।

পেটেন্ট

পেটেন্ট অফিস বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ৫০০ টি দরখাস্ত পায়। এর মধ্যে ১০০ টিরও বেশী দরখাস্ত গৃহীত এবং বিজ্ঞাপিত হয়। এছাড়া, ৫০ টিরও বেশি পেটেন্ট (অস্পষ্ট) করা হয়। নতুন শিল্প নকশা সংক্রান্ত দরখাস্ত গুলির মধ্যে ৩০ টিরও বেশী ছিল বাংলাদেশের। নিয়মিতভাবে বাংলায় মুদ্রিত। পেটেন্ট (অস্পষ্ট) বহুসংখ্যক কপি বিতরণ করা হয়।

বাণিজ্য সংস্থা (ট্রেডিং কর্পোরেশন)

স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে বাংলাদেশের আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্য একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। এই সময়ে বাংলাদেশ বাণিজ্য সংস্থা গঠন করা হয়। বহু কঠিন বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও এই সংস্থা বাংলাদেশের আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যের কিছুটা সূচনা করে। ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা ৫ কোটি ৭৪ লক্ষ টাকার পণ্য রপ্তানি করে এবং ১৫৮ কোটি টাকার ঋণ পত্র খোলে। ১৯৭২-৭৩ অর্থ বছরে সংস্থার হাত দিয়ে যে সব জিনিস আমদানী করা হয় তার মোট পরিমাণ ছিল ৭ লক্ষ ২০ হাজার টন। ১৯৭৩ সালেরই জুন-ডিসেম্বর বাণিজ্য মৌসুমের আমদানিকৃত পণ্য ইতিমধ্যে বাংলাদেশ পৌঁছাতে শুরু করেছে।
এছাড়া, ১৯৭৩ সালে ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ড এর কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সাথে ৪ টি বিশেষ বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এসমস্ত চুক্তির অধীনে ২৬ কোটি ২২ লক্ষ টাকার পণ্য পাওয়া যাবে।
বাণিজ্য সংস্থা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ যেসব জিনিস আমদানী করে সেগুলির মধ্যে ছিল সিমেন্ট, সি-আই শীট, দুগ্ধজাত খাদ্য, চিনি, তৈলবীজ, কাপড়, সুতা, কাঁচা তুলা, ওষুধপত্র, গাড়ি এবং টায়ার ও টিউব।
(পৃ:-৪৫)

সংস্থার নগদ মূল্যে এবং ধারে ও বিনিময়ের ভিত্তিতে পণ্য আমদানি করে থাকে। ১৯৭৩ সালে তারা অনেকগুলি পণ্যদ্রব্য আমদানির প্রস্তাব করে। এগুলির মধ্যে ৬৩ টি পণ্যদ্রব্য জানুয়ারি-জুন মৌসুমে আমদানি করা হয় এবং জুলাই-ডিসেম্বর মৌসুমে আসে বাকি ৩২ টি পণ্যদ্রব্য।

বীমা

স্বাধীনতার পর দেশের বীমা শিল্প রাষ্ট্রায়াত্ত করা হয়। এরপর বীমা শিল্পে সুষ্ঠু পরিচালনা এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে নিরাপদ করবার জন্য সরকারকে পুনর্গঠিত করবার সিদ্ধান্ত নেন। এই উদ্দেশ্যে ১৯৭৩ সালের মে মাসে বীমা সংস্থা অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়। পরে জাতীয় সংসদ অর্ডিন্যান্স সংস্থা আইন নামে আইনে পরিণত করেন। এই আইন মোতাবেক জাতীয় বীমা শিল্পের ৪ টি অঙ্গ-সংস্থা নিয়ে গঠিত বাংলাদেশ জাতীয় বীমা সংস্থা ভেঙে দিয়ে জীবন বীমা সংস্থা ও সাধারণ বীমা সংস্থা নামে ২ টি নতুন সংস্থা গঠন করা হয়।
নবগঠিত জীবনবীমা সংস্থা ও সাধারণ বীমা সংস্থাকে যথাক্রমে জীবন বীমা সাধারণ বীমা সম্পর্কিত কাজ কারবার দেখা শোনা করবার ভার দেওয়া হয়েছে।

শুল্ক কমিশন

শুল্ক কমিশন স্বাধীনতার পর গঠিত হয়। এর কাজ হল (ক) বিভিন্ন শিল্পের জন্য রক্ষা মূলক শুল্ক ও অন্যান্য ধরনের সাহায্য দানের কথা বিবেচনা সুপারিশ করা এবং (খ) শিল্প প্রতিষ্ঠানের কাজকর্ম, একচেটিয়া অবস্থায় অপব্যবহার, উৎপাদন মূল্যের থেকে অল্প মূল্যে পণ্য রপ্তানি ও রপ্তানির সম্ভাবনা সম্পর্কে অনুসন্ধান চালানো।
কমিশন যাতে তার দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করতে পারে, তার জন্য খুঁটিনাটি বিষয় সহ সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি শিল্প-যেমন-পাট সুতোর কার্টিম, জি আই তার, পেরেক তার এবং ফাউন্টেন পেনের কালি-রক্ষামূলক ব্যবস্থার জন্য দরখাস্ত পেশ করেছে। কমিশন এসব দরখাস্ত সম্বন্ধে তদন্ত বিবরণী সংগ্রহের ব্যবস্থা করে। তারপর ব্যবসায় শিল্প ও সরকারি মহলের সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য ও দলিলাদি সংগ্রহের কাজ শুরু হয়। তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি কে নতুন রূপ দেওয়ার ব্যাপারে কমিশন কিছু ফলপ্রদ কাজ করছে।

পর্যটন কর্পোরেশন

বাংলাদেশ পর্যটন সম্ভাবনায় পূর্ণ। মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলিতে সমৃদ্ধ এই দেশের এমন কিছু আকর্ষনীয় বস্তু আছে যা তুলে ধরে সহজেই পর্যটকদের আকর্ষণ করা যায়। পর্যটনকে বলা হয় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী অদৃশ্য রপ্তানি, যার ফলে অর্থনৈতিক দিক থেকে অধিকতর শক্তিশালী করে তোলা সম্ভব এক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। এর
(পৃ:-৪৬)

সমুদ্র উপকূল, বনভূমি, নদী-নালা, পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন, ঐতিহাসিক কীর্তি, সর্বত্র ছড়ানো হস্তশিল্প সবই দেশ-বিদেশের পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় বস্তু।
গত বছর ৩৩৮ জন বিদেশী ও ৭৭৯ জন দেশী পর্যটককে বাংলাদেশ বিভিন্ন দ্রষ্টব্য স্থান দেখাবার সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয় এবং ৩২৫ জন পর্যটক কে পরিচালিত সফরে কতকগুলি দ্রষ্টব্য স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। পর্যটকদের নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে মোট ১৫৩৪৩ টাকা পাওয়া যায়। মস্কোর (অস্পষ্ট) ইয়ুথ টুরিস্ট ব্যুরোর পৃষ্ঠপোষকতায় কয়েকজন রুশ পর্যটক বাংলাদেশ ভ্রমণে আসেন। তাদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে মোট ১৩০৯ মার্কিন ডলার অর্জন করা হয়।
১৯৭৩ সালের ২৪ শে সেপ্টেম্বর থেকে ১লা অক্টোবর পর্যন্ত ব্যাংককে ইকাফের পর্যটন সম্পর্কিত সাব-কমিটির যে প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় তাতে বাংলাদেশের প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। সম্মেলনের একটি সুপারিশ অনুযায়ী বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে গঠিত উপ-অঞ্চল এর জন্য ঢাকায় একটি উপ-আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ ভবন স্থাপিত হবে। এখানে পর্যটন ও হোটেলকর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে।

সদস্য পদ

১৯৭৩ সালের ১ লা অক্টোবর থেকে ১০ ই অক্টোবর পর্যন্ত ভেনিজুয়েলার কারাকাস শহরে সরকারি পর্যটন সংস্থা আন্তর্জাতিক ইউনিয়নের সাধারণ পরিষদের ২৩ তম সভা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশে এতেও অংশগ্রহণ করে। এর আগে বাংলাদেশ সংস্থার পূর্ণ সদস্যপদের জন্য আবেদন পেশ করে। সংস্থার কার্যনির্বাহী কমিটি কর্তৃক ১৯৭৩ সালের জুন মাসে ওয়ারসতে তা অনুমোদিত হয়। কারাকাসের সভায় এই আবেদন পত্র গৃহীত হয় এবং তার ফলে বাংলাদেশ সংস্থার পূর্ণ সদস্যপদ লাভ করে। এছাড়া ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ভারত, নেপাল ও বহিঃ মঙ্গোলিয়া কে নিয়ে গঠিত দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক কমিশনেও বাংলাদেশ সদস্য হয়েছে।
পর্যটনের জন্য প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় একটি রূপরেখা প্রস্তুত করা হয়েছে। এতে ২০ কোটি টাকা ব্যয় বরাদ্দ করা হয়েছে। এই অর্থ দিয়ে ঢাকায় ১৫০ কক্ষ বিশিষ্ট একটি পাঁচতলা হোটেল ও একটি ১০০ কক্ষ বিশিষ্ট তিনতলা হোটেল স্থাপন করার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া, কক্সবাজারে একটি ১০০ কক্ষ বিশিষ্ট পাঁচতলা হোটেল; কক্সবাজার, সিলেট, রাজশাহী, দাউদকান্দি, রাঙ্গামাটি ও পাহাড়পুরে ২৭৫ টি হোটেল কক্ষ; কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি ও সুন্দরবন এ ৩৩ টি এবং কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, কুয়াকাটা ও রামসাগরে ছুটি ভোগের উপযোগী ২৫০ কক্ষ বিশিষ্ট ডর্মিটরি শ্রেণীর বাড়ি তৈরি; প্রায় ২০০টি গাড়ি, ২৫ টি জলযান ও বিভিন্ন ধরনের ৩০০ খানি নৌকা এবং ঢাকায় একটি সভা ভবন ও গ্রহ মন্ডলীর নকশাযুক্ত একটি ভবন এবং রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে গলফ খেলার একটি মাঠ তৈরীর ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।
(পৃ:-৪৭)

ট্রেড মার্কস রেজিস্ট্রি

ট্রেডমার্ক রেজিস্ট্রির কাজ শুরু হয় স্বাধীনতার পর। এর লক্ষ্য হচ্ছে অধিকারক্ষুন্নকারী এবং প্রতারকের দুষ্কর্ম থেকে ব্যবসায়ী ও অন্য ভোগীদের রক্ষা করা।
১৯৭৩ সালে ট্রেডমার্ক সম্পর্কিত প্রায় ৫০০ খানি আবেদনপত্র পাওয়া যায়। অধিকাংশ আবেদনপত্রই আসে বিদেশ থেকে। এগুলির জন্য আবেদন ফি নবীকরণ ইত্যাদি বাবদ বৈদেশিক মুদ্রায় দেশের বেশ কিছু আয় হয়। ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রপতির একটি আদেশ জারি হওয়ার পর সংক্ষিপ্ত রেজিস্ট্রেশনের জন্য প্রায় ২৫০০ আবেদনপত্র আসে।
বর্তমানে ঢাকায় এই রেজিস্ট্রির সদরদপ্তর এবং চট্টগ্রামে একটি শাখা দপ্তর কাজ করছে। রাজশাহীতে একটি শুনানি কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়েছে।

পরিত্যক্ত সম্পত্তির বিলি বন্দোবস্ত

সরকার তাদের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণাধীন পরিত্যক্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বিলি বন্দোবস্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পূর্ব গঠিত জাতীয় পরিচালনা কমিটি এবং জেলা ও নগর কমিটি ভেঙে দিয়ে সমস্ত জেলা ও পরিচালনা পরিষদ গঠন করা হয়। পরিষদ গুলির অন্যতম কাজ হল নিজ নিজ এলাকার পরিত্যক্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা।
চা বোর্ড সরকারের নীতি নির্দেশ অনুযায়ী এখনও পরিত্যক্ত চা প্রতিষ্ঠানগুলি ব্যবস্থাপনা পরিষদ রূপে কাজ করে যাচ্ছে।
পরিত্যক্ত সম্পত্তির পরিচালনা নিয়ন্ত্রণ ও বিলি বন্দোবস্তের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি ক্ষুদ্র বিভাগ গঠনের কথা বিবেচনা করা হচ্ছে।

এক নজরে

* ১৯৭৩ সালের প্রথম তিন মাসে রপ্তানি থেকে আয় ৫৬ কোটি ৮৪ লক্ষ টাকা

* বাণিজ্য দপ্তর খোলা হয়েছে ৮ টি দেশে

* রপ্তানিকৃত পণ্যের মূল্য ৫ কোটি ৭৪ লক্ষ টাকা

* ঋণপত্র খোলা হয়েছে ১৫৮ কোটি টাকার

* ১৯৭৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত ট্রেডিং কর্পোরেশন কর্তৃক আমদানিকৃত দ্রব্যের পরিমাণ ৭ লক্ষ ২০ হাজার টন

* রেজিস্ট্রিকৃত যৌথ কোম্পানি, অংশীদারি প্রতিষ্ঠান ও সমিতির সংখ্যা ১৬২১ টি
(পৃ:-৪৮)

অর্থ

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাজ হলো দেশের আর্থিক বিষয়াদি দেখাশোনা করা। সকল সরকারের কাছেই এর গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। এজন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর আর্থিক বিষয় এর সাথে জড়িত সকল সংস্থা ও সংগঠনের পুনর্গঠন ও পুনরুজ্জীবনের জন্য উদ্যোগে যথোপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। প্রশাসন ব্যবস্থার বাধা-বিপত্তির কাজকর্ম এবং উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ভিত্তি স্থাপনের জন্য আর্থিক বিষয়াদির সাথে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলির নির্মাণ কাজ চালানোর অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল।

ব্যাংকিং

গত স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা মারাত্মক বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হয়। কিন্তু স্বাধীনতার পর ব্যাঙ্কগুলি সম্পূর্ণরূপে পুনরুজ্জীবিত এবং শক্তিশালী হয়েছে এবং এখন তারা জাতীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় যথাযথ ভূমিকা পালন করছে। বর্তমানে ব্যাংকিংয়ের সুযোগ-সুবিধা দেশের দূর-দূরাঞ্চলেও সম্প্রসারিত করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হলো : (ক) অব্যবহৃত সম্পদের ব্যবহার, (খ) ছোট ব্যবসা ও শিল্প এবং কৃষি খাতকে ঋণের সুযোগ-সুবিধা দান এবং (গ) ইউনিয়ন পর্যায়ে সমবায় আন্দোলনের প্রয়োজন মেটানো। বর্তমানে প্রতি থানা সদরে অন্ততপক্ষে একটি করে ব্যাংক শাখা খোলা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে ভ্রাম্যমাণ ব্যাংকের সুযোগ সুবিধা আদায়ের চেষ্টা চলছে।
১৯৭৩ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্কগুলির ১৫০ টি নতুন শাখা খোলা হয়। এর ফলে ১৯৭৩ সালের শেষদিকে দেশে ব্যাংক শাখার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ১৩৬৫ টি তে দাঁড়ায়। ১৯৭১ সালে ব্যাংক শাখার সংখ্যা ছিল ১১৯১ টি।
বৈদেশিক বাণিজ্য এবং বিদেশে কর্মরত বাঙ্গালীদের দেশে টাকা পাঠানোর ব্যাপারে সুযোগ-সুবিধা দানের উদ্দেশ্যে বিদেশে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্কগুলির ৫ টি শাখা খোলা হয়েছে এবং আরো কিছু শাখা শিগগিরই খোলা হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
১৯৭৩ সালে ব্যাংকে গচ্ছিত টাকার পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পায়। এ বৎসরের নভেম্বর মাস পর্যন্ত তফসিলি ব্যাংক গুলির মোট জমা বৃদ্ধি পায় ১৫৬ কোটি ৮৬ লক্ষ টাকা। এ সময় ব্যাংক কর্তৃক প্রদত্ত ঋণ ও বিনিয়োগকৃত অর্থের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। ত্রাণ পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন ব্যয়ের দরুন ১৯৭২ সালে অর্থ সরবরাহ এবং ব্যাংক কর্তৃক বিনিয়োগকৃত অর্থের পরিমাণ দ্রুততর হারে বৃদ্ধি পেয়েছিল। তা সত্ত্বেও সরকার নির্বাচন মূলক ঋণ নিয়ন্ত্রণ এবং মুদ্রাস্ফীতির ব্যবস্থা গ্রহণ করায় ১৯৭৩ সালে ব্যাংক কর্তৃক অর্থ বিনিয়োগ বৃদ্ধির হার মাঝারি পর্যায়ের নেমে আসে।
(পৃ:-৪৯)

মুদ্রা

সমস্ত পাকিস্তানি নোট বাজার থেকে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার করে সেসব এর পরিবর্তে বাংলাদেশের নোট চালু করা হয়েছে। বাংলাদেশের নতুন ৫ পয়সা, ১০ পয়সা, ২৫ পয়সার মুদ্রাও বাজারে ছাড়া হয়েছে। এছাড়া, বাংলাদেশের বিভিন্ন বিষয়বস্তু সম্বলিত নন পোস্টাল টিকেট এবং সিকিউরিটি কাগজ মুদ্রিত করে ব্যবহার করা হচ্ছে।

রাজস্ব

রাজস্ব সম্পর্কিত সকল সমস্যার সমাধান ও কর প্রশাসন দেখাশোনা করার জন্য প্রতিষ্ঠিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে ১৯৭৩ সালে আরও সক্রিয় করা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল প্রধান পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদের ব্যবহার। উন্নয়নের জন্য অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন ক্রমশ: বৃদ্ধি পাওয়া স্বত্তেও সাধারণ মানুষের মৌলিক প্রয়োজনের উপর করার চেষ্টা করা হয়।

হিসাব ও হিসাব পরীক্ষা

১৯৭৩ সালে বিভিন্ন দপ্তর থেকে প্রেরিত ৩৮৪ জন পরীক্ষার্থী ঢাকার হিসাব ও হিসাব পরীক্ষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র সরকারি হিসাব ও হিসাব পরীক্ষার নিয়ম কানুন ও পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে।

জাতীয় সঞ্চয়

জাতীয় সঞ্চয় একটি প্রচলিত ব্যবস্থা এবং আন্দোলন স্বরূপ আমাদের জনসাধারণের সুখ-সমৃদ্ধি বিধানে এর গৌরবজনক ভূমিকা রয়েছে। জাতীয় সঞ্চয়ের লক্ষ্য হচ্ছে দেশের জনগণের মধ্যে সঞ্চয়ের মনোভাব সৃষ্টি করা ও তাঁদের সঞ্চিত অর্থ লাভজনকভাবে সরকারের বিভিন্ন সঞ্চয় পরিকল্পনায় বিনিয়োগ করা এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার উন্নতি বিধান।
বাংলাদেশের জাতীয় পরিদপ্তরের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হচ্ছে দেশের জনগণের ক্ষুদ্র সঞ্চয় ব্যবহার করে তা বাংলাদেশ সঞ্চয় পত্র, ডাকঘর, সেভিংস ব্যাংক এর সাধারণ ও স্থায়ী জমা, মুনাফাসহ বোনাস, একাউন্ট, প্রাইস বন্ড, ডাক জীবন বীমা ও ডাক বিভাগে অ্যানুইটির মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন প্রকল্পসমূহের জন্য অর্থ যোগানো। ১৯৭৩ সালে উপরি-উক্ত খাতগুলোতে মোট জমার পরিমাণ ছিল প্রায় ৪১ কোটি টাকা। সঞ্চয় প্রকল্প কে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য এ বৎসর জুলাই মাসে এক সপ্তাহ উদযাপন করা হয়। এ সময়ে বক্তৃতা ও বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে আন্দোলনের বাণী
(পৃ:-৫০)

জনসাধারণের নিকট পৌঁছে দেওয়া হয়। এছাড়া, জাতীয় সঞ্চয় সম্পর্কিত একখানি পত্রিকা প্রকাশের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
১৯৭৪-৭৪ সালে জনসাধারণের সঞ্চয় থেকে প্রাপ্ত অর্থ বিভিন্ন সঞ্চয় পরিকল্পনার অধীনে বিনিয়োগের জন্য লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয় ৫১ কোটি টাকা।

এক নজরে

* স্বাধীনতার পর থেকে নতুন ব্যাংক শাখা স্থাপন ১৭৪ টি

* তফসিলি ব্যাংক সমূহের গচ্ছিত অর্থ বৃদ্ধি পায় ১৫৬ কোটি ৮৬ লক্ষ টাকা

* জাতীয় সঞ্চয় খাতে সঞ্চিত টাকার পরিমাণ ১৪০ কোটি টাকা

* ১৯৭৩-৭৪ সালে সঞ্চয় থেকে প্রাপ্ত অর্থ বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রার ৫১ কোটি টাকা

* পাকিস্তানি নট বাজার থেকে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার ও তার পরিবর্তে বাংলাদেশের নতুন নোটের প্রচলন

* বাংলাদেশের নতুন ৫ পয়সা, ১০ পয়সা ও ২৫ পয়সার মুদ্রা চালু, বাংলাদেশের বিভিন্ন বিষয়বস্তু সম্বলিত নন পোস্টাল স্টাম্প ও সিকিউরিটি কাগজের মুদ্রা প্রচলন।

(পৃ:-৫১)

গণপূর্ত ও নগর উন্নয়ন

হানাদার বাহিনী গণহত্যার সাথে সাথে সম্পত্তি, ঘরবাড়ি এবং সাজ-সরঞ্জামের যে বেপরোয়া ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে ছিল ইতিহাসে তার নজির নেই। বাংলাদেশ সরকারকে তাই স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীনতার অল্পকাল পরই অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সরকারি প্রতিষ্ঠান পুনর্নির্মাণ ও মেরামতের কাজে হাত দিতে হয়।
গত অর্থবছরে চালু গৃহনির্মাণ কর্মসূচি গুলির জন্য বাজেট বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৫২ লক্ষ টাকা। এই বরাদ্দের সবটাই খরচ হয়ে যায়। মুখ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং যশোরের আবাসিক এলাকা সমূহের গৃহ নির্মাণ প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জরুরি কর্মসূচি এবং জমির মূল্য পরিশোধের জন্যই এই টাকা ব্যয় করা হয়।

গৃহনির্মাণ গবেষণা

ঢাকায় একটি গৃহনির্মাণ গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপনের জন্য গৃহীত একটি প্রকল্পের বাস্তবায়ন চলছে। এর জন্য ইতিমধ্যেই ১০ লক্ষ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এদের মধ্যে ছিল জমির মূল্য পরিশোধ, সীমানা বেষ্টনী নির্মাণ, বিভিন্ন বিদেশি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সদস্যপদের জন্য দেয় চাঁদা পরিশোধ এবং পুস্তক ও গবেষণার দ্রব্যাদির ক্রয়।

ফ্ল্যাট নির্মাণ

সারাদেশে ৩৫ হাজার ফ্ল্যাট নির্মাণের একটি পরিকল্পনার কাজে ১৯৭৩ সালে চালু ছিল। ফ্ল্যাটগুলির নির্মাণে মোট ব্যয় হবে আনুমানিক ৮৪ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেটের মধ্যে ২৫ হাজার নির্মিত হবে ঢাকায়, ৫ হাজার চট্টগ্রামে, ৩ হাজার খুলনা এবং ২ হাজার রাজশাহীতে।

রক্ষী বাহিনীর সদরদপ্তর নির্মাণ

অপর একটি কর্মসূচি অনুযায়ী মিরপুরে রক্ষীবাহিনীর সদরদপ্তর এবং আঞ্চলিক সদর দপ্তর নির্মাণের কাজ চলছে এবং এ কাজে যথেষ্ট অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। কর্মসূচিতে আনুমানিক ব্যয় এর পরিমাণ হচ্ছে ১৩ কোটি ২০ লক্ষ টাকা।

যুদ্ধবিধ্বস্ত আবাসিক এলাকার মেরামত ও পুনর্নির্মাণ

দেশের যুদ্ধবিধ্বস্ত সরকারি আবাসিক এলাকা সমূহের মেরামত ও পুনর্নির্মাণের উদ্দেশ্যে প্রণীত পরিকল্পনার জন্য চলতি অর্থবছরের বাজেটে ৮৫ লক্ষ টাকার ব্যবস্থা রয়েছে। এর মধ্যে ৪২ লক্ষ টাকা ইতিমধ্যেই খরচ করা হয়েছে। আলোচ্য বৎসরে রাস্তা, বৈদ্যুতিক লাইন, পয়ঃপ্রণালী, পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, দোকান ও মেরামতের কাজে ব্যাপক ভাবে চালানো হয়।
(পৃ:-৫২)

ফ্ল্যাট ও আধা পাকা বাড়ি তৈরি

মিরপুরে ৩৬ টি বহুতলাবিশিষ্ট ভবনে ১১৫২ টি ফ্ল্যাট নির্মাণের একটি প্রকল্প রয়েছে। এতে ব্যয় হবে ১ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। ফ্ল্যাট নির্মাণের কাজে যথেষ্ট অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। ছিন্নমূলদের গৃহ সমস্যার মোকাবেলার জন্য মিরপুরে প্রায় ৪ হাজার আধ-পাকা বাড়ি তৈরি করা হয়েছে এতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৮৮ লক্ষ টাকা।

স্মৃতিফলক

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতিতে মিরপুরে একটি স্মৃতি ফলক নির্মাণ করা হয়েছে। এতে ব্যয় হয়েছে ২ লক্ষ ২৬ হাজার টাকা।

নগর উন্নয়ন

নগর উন্নয়নের ক্ষেত্রে ১৯৭৩ সালের কার্যকলাপের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ ছিন্নমূলদের পুনর্বাসন সম্পর্কের রিপোর্ট প্রণয়ন, উপদেষ্টা সার্ভিস, পরিকল্পনা প্রণয়ন প্রভৃতি।
গৃহ নির্মাণের পরিবেশ দেশের প্রয়োজন ও চাহিদা, ঢাকা নগরীর সীমানা চিহ্নিতকরণ, জমি বন্দোবস্ত সমস্যা সম্পর্কে প্রাথমিক জরিপ ঢাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পয়ঃপ্রণালী প্রকল্প বাস্তবায়নের সম্ভাব্যতা এবং সমবায়ভিত্তিক গৃহনির্মাণে অর্থের সংস্থান সম্পর্কে আলোচনা রিপোর্ট তৈরি করা হয়। এছাড়াও বিভিন্ন সরকারী আধা-সরকারী এবং সাহিত্য শাসিত সংস্থাকে বাস্তব পরিকল্পনা প্রণয়ন ও পরিসংখ্যান সম্পর্কে পরামর্শ দেওয়া হয়। অধিকন্তু ভৈরব-আশুগঞ্জ, সাভার, রংপুর, সিলেট, (অস্পষ্ট) শিল্প এলাকা এবং হাতিয়া শহরের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন সমাপ্ত করা হয়েছে।
প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা আমলের জন্য গৃহীত কর্মসূচি গুলির মধ্যে রয়েছে ঢাকা মহানগরীর আঞ্চলিক উন্নয়ন পরিকল্পনা, জেলা ও থানা পরিকল্পনা, দ্রুত উন্নয়নশীল শহর এলাকাসমূহের পরিকল্পনা, ছিন্নমূলদের বাস্তব ও সামাজিক অর্থনৈতিক এবং ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনা জন্য অপর তিনটি উন্নয়ন প্রকল্প।

বাংলাদেশ সচিবালয়

আলোচ্য বৎসরে জাতীয় সচিবালয়ের বেশকিছু নির্মাণ কাজ করা হয়। স্বাধীনতার পর দেখা যায় সচিবালয় তৎকালীন স্থান পর্যাপ্ত নয়, আরও ২ লক্ষ বর্গফুট অতিরিক্ত জায়গার প্রয়োজন রয়েছে। এজন্য স্বাধীনতার পর পরই একটি ভবনে অতিরিক্ত একতলা তৈরীর কাজে হাত দেওয়া হয়। আলোচ্য সময়ে নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ হয়ে যায়।
(পৃ:-৫৩)

সংস্কৃতি-ভবন স্মৃতিসৌধ

উন্মুক্ত স্থানের রঙ্গমঞ্চবিশিষ্ট একটি সাংস্কৃতিক ভবন নির্মাণসহ সোহারাওয়ার্দী উদ্যান এর সার্বিক উন্নয়নের একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। এখন এর বাস্তবায়ন এগিয়ে চলছে।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতিতে নির্মিত শহীদ মিনার ভেঙ্গে ফেলে। মিনারটি অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে মেরামত করা হয়েছে।
শহীদদের জন্য সাভারে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে এবং এর বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে।

আবাসিক ঘরবাড়ি

স্বল্প বেতনভুক্ত কর্মচারীদের বিশেষ করে নীলক্ষেত পলাশী ব্যারাক বাসিন্দাদের জন্য মিরপুরে বাসা বাড়ি এবং বিভিন্ন জেলা ও বিভাগীয় শহরে কর্মচারীদের বাসা বাড়ি নির্মাণের কাজও এগিয়ে চলেছে।

উপকূল অঞ্চলে আশ্রয়স্থল নির্মাণ

৬টি উপকূলীয় জেলার জনসাধারণের জন্য ১৯৭৫ সালের মধ্যে ২৬০ টি আশ্রয়স্থল নির্মাণের একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ১৮০ টি আশ্রয়স্থল নির্মাণের কাজ ইতিমধ্যে বেশ কিছুদূর এগিয়ে গেছে।

অন্যান্য নির্মাণ কাজ

আলোচ্য বছরে কয়েকটি মেডিকেল কলেজ এবং ৩৫৬ টি সমন্বিত থানা স্বাস্থ্য প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়। এ সমস্ত কাজে যথেষ্ট অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।

ঢাকা উন্নয়ন সংস্থা

১৯৭৩ সালে ঢাকা উন্নয়ন সংস্থা বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করে এখন কতকগুলি কাজ চলছে। এগুলির মধ্যে রয়েছে ৮টি পুনর্বাসন অঞ্চলে গৃহহারা পরিবারদের বাসগৃহ সংস্থানের জন্য গৃহীত একটি প্রকল্প, সব প্রকার আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত এবং এক লক্ষ লোকের বাসোপযোগী উত্তর উপশহর নির্মাণ, বৃহত্তর ঢাকার মধ্যে ১০০০ একর জমি উন্নয়ন, ঢাকা উন্নয়ন সংস্থার কর্মচারীদের আবাসিক গৃহ সমূহের সম্প্রসারণ, গুলশান আদর্শ শহরের উন্নয়ন এবং ৫ টি বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকার জন্য জমির উন্নয়ন।
এছাড়া আলোচ্য বৎসরে ৯ টি বড় রাস্তার বিস্তার বৃদ্ধি ও উন্নতি সাধন এবং ৩ টি নতুন রাস্তা তৈরির কাজে হাত দেওয়া হয়। ১০০০ দোকান সম্মিলিত
(পৃ:-৫৪)

৩ টি বাজার নির্মাণের একটি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। এর জন্য জরিপ, পরিকল্পনা ও নকশা তৈরি এবং সম্ভাব্যতা পর্যালোচনা কাজ যথেষ্ট এগিয়ে গেছে। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা কালে ঢাকা উন্নয়ন সংস্থা ২১ টি নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করবে। এর মধ্যে ৪ টি প্রাথমিক কাজ ইতিমধ্যেই শুরু করা হয়েছে। এগুলি হচ্ছে বুড়িগঙ্গা নদীর পর্যন্ত উত্তর-দক্ষিণ সড়ক নির্মাণ, বাকল্যান্ড বাঁধ এর উন্নয়ন, শ্যামবাজার থেকে শুরু করে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ জনপথের পোস্তগোলা মোর অবধি ১০০ ফুট চওড়া সড়ক নির্মাণ এবং চিত্তবিনোদনের স্থান হিসেবে বুড়িগঙ্গার বরাবর জমির উন্নয়ন। পরিকল্পনার কাজ শেষ করতে আনুমানিক ১২ কোটি ৬২ লক্ষ টাকা ব্যয় হবে।

খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ

খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের লক্ষ্য হল খুলনা শহর এবং তদসংলগ্ন কয়েকটি এলাকার উন্নয়ন, উন্নতি সাধন ও সম্প্রসারণ। এই লক্ষ্য সাধনের জন্য একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। মহাপরিকল্পনার রূপরেখা অনুযায়ী বিভিন্ন ক্ষেত্রে মৌল কাঠামো উন্নয়নের জন্য বেশ কয়েকটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
এ পর্যন্ত ৬ টি পরিকল্পনার কাজ শেষ হয়েছে। এতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৭০ লক্ষ টাকা। পরিকল্পনাগুলি হলো রুপসা বাজার, খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অফিস ভবন, নিউমার্কেট (নিচতলা), মোটর গাড়ি রাখার ছাউনি, নিউমার্কেটের চারপাশের এলাকা এবং ৭৫ টি স্বল্প ব্যয়ের গৃহনির্মাণ।
বর্তমানে ১৯ টি পরিকল্পনার বাস্তবায়ন চলছে। খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে দুটি বাজার নির্মাণের কাজ শেষ করেছে। এগুলিতে ৫ শতেরও বেশি দোকান রয়েছে। প্রত্যেকটি বাজার নির্মাণের পর তার পাশে শাক-সবজি, মুদিখানা, মাছ, মাংস ইত্যাদির জন্য ছোট ছোট বাজার নির্মাণ করা হচ্ছে। দৌলতপুরে একটি বাজার নির্মাণের কাজ চলতি বছরের শুরু করা হবে। এতে ব্যয় হবে ১৪ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। এই বাজারের জন্য ইতিমধ্যেই পাঁচ একর জমি হুকুম দখল করা হয়েছে।
প্রাথমিক পর্যায়ে খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ দুটি আবাসিক এলাকার উন্নয়নের জন্য দুটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এই দুটি এলাকা হচ্ছে মুজগুন্নী (১২৩ একর) এবং দৌলতপুর। প্রথমটির জন্য ব্যয় হবে ৪২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা এবং দ্বিতীয়টির জন্য ৪২ লক্ষ টাকা। মুজগুনিতে ৪৯ একর জমি ইতিমধ্যেই হুকুম দখল করা হয়েছে এবং বাকি ৭৪ একর হুকুমদখলের পর্যায়ে রয়েছে।
দৌলতপুরে সর্বমোট ১০০ একর জমির মধ্যে কেবল ৫ একর জমি হুকুম দখল করা হয়েছে এবং বাকি 95 একর হুকুম দখলের পর্যায়ে রয়েছে।
খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ শহর অঞ্চলের মধ্যে প্রায় ১০ মাইল সড়ক নির্মাণের ছয়টি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
(পৃ:-৫৫)

খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ শিরোমনি তে মাঝারি ধরনের একটি শিল্প এলাকার উন্নয়নের জন্য একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এতে ব্যয় হবে ৩ কোটি ১২ লক্ষ টাকা।
এছাড়া, গিলাতলীতে ৪৯ টি এবং খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কর্মচারীদের জন্য বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে।

ঢাকা ওয়াসা

ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়ঃ প্রণালী কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা শহরের অধিবাসীদের পানি সরবরাহ ও পয়ঃ প্রণালীর (ওয়াসা) প্রয়োজন মেটাবার জন্য। ঢাকায় পানি সরবরাহের প্রধান উৎস হলো বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত চাঁদনী ঘাটের ঢাকা ওয়াটার ওয়ার্কস এবং শহরের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত প্রায় ৬৩ টি গভীর নলকূপ। বর্তমানে নগরীর প্রতিদিনের পানি উৎপাদনের পরিমাণ হচ্ছে প্রায় ৪ কোটি ৬০ লক্ষ গ্যালন। আবর্জনা নিষ্কাশন এর কাজ করা হয় কেন্দ্রীয় পয়ঃপ্রণালী পাম্পিং স্টেশন এর মাধ্যমে। এটি নারিন্দায় অবস্থিত। স্টেশনটি নগরীর বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত কতগুলি মধ্যবর্তী স্টেশন এর সাথে যুক্ত।
ঢাকা ওয়াসার প্রকল্প গুলি অনেকাংশেই আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার সাহায্যে বাস্তবায়িত হয়। কিন্তু ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে এই সাহায্য বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে ওয়াসার প্রকল্প গুলির বাস্তবায়নের কাজ বাধাপ্রাপ্ত হয়। পরবর্তী পর্যায়ে যতদিন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার ঋণদান চুক্তি মোতাবেক তাদের সাথে নতুন ঋণদানের চুক্তির না হয়, ততদিন এর জন্য সরকার ঢাকা ওয়াসা কে ১০ লক্ষ ২০ হাজার ডলার দেন। এই অর্থ বরাদ্দ করা হয় অন্তবর্তীকালীন থেকে। ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এক্ষেত্রে যে সার্বিক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, তা হলো:-
(ক) নগরীর কয়েকটি চালু কুপের উন্নতি সাধনসহ ৩৭ টি নতুন নলকূপ স্থাপন; (খ) পানি সরবরাহের জন্য মোট ১৫০ মাইল দীর্ঘ মূল ও শাখা পাইপ লাইন স্থাপন; (গ) মোট ১২ মাইল দীর্ঘ মূল পয়ঃপ্রণালী এবং ৪৪ মাইল পার্শ্ববর্তী পয়ঃপ্রণালী স্থাপন; (ঘ) ক্রেতাদের ১৪৬০০ নতুন পানি সরবরাহকারী সংযোগ প্রদান এবং ৯৩০০ টি মিটার স্থাপন; (ঙ) শহর বাসীদের জন্য ২৯৭১ টি পয়ঃপ্রণালী সংযোগ দান, আরও সংযোগদানের কাজ চলছে; (চ) ফকিরাপুল, লালমাটিয়া ও গুলশানে ১০ লক্ষ গ্যালন পানি ধারণক্ষমতা সম্পন্ন ৩ টি নতুন ইস্পাত ট্যাংক নির্মাণ; (ছ) ঢাকার কয়েক মাইল পূর্বে আবর্জনা পরিশোধনের একটি কারখানা নির্ণীয়মান রয়েছে এবং উপদ্রব লিফট স্টেশন ও পাম্পিং স্টেশন স্থাপনের কাজ চলছে; (জ) চাঁদনীঘাটে অবস্থিত ঢাকা পানি ওয়ার্কাসের বর্তমান পানি শোধন উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য নব রূপায়ন চলছে।
(পৃ:-৫৬)

প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৭৩-৭৮) অনুযায়ী যে সকল নতুন প্রকল্প গ্রহণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে সে গুলির নাম ও ব্যয়ের পরিমাণ নিচে দেওয়া গেল।

প্রকল্পের নাম স্থানীয় মুদ্রার ব্যয় বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয়
টাকা (লক্ষের হিসাবে)

(ক) শেরেবাংলা নগর শহর নতুন ও পুরাতন ঢাকায় পানি সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি সাধন ৪০৫’০০ ১৮০’০০

(খ) শেরেবাংলা নগর ও পুরাতন বিমানবন্দর এলাকাসহ নতুন ও পুরাতন ঢাকায় আবর্জনা নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নতি সাধন ৪৪২’১০ ১৭৯’৯০

(গ) মিরপুরের পানি সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি সাধন ও সম্প্রসারণ ৭৭’৫০ ২৭’৫০

(ঘ) ওয়াসার অফিস ভবন ও কর্মচারীদের বাড়ি বাসা বাড়ি নির্মাণ ১৩৫’০০ ১০’০০
মোট ১০৫৯’৬০ ৩৯৭’৪০

ঢাকা নগরী আগে ছিল একটি প্রাদেশিক রাজধানী। কিন্তু বর্তমানে এটি বাংলাদেশের রাজধানী নগরীতে পরিণত হয়েছে। এখন এর জনসংখ্যা যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। এজন্য এখানে পানির উৎপাদন বৃদ্ধি এবং ব্যাপকভিত্তিতে আবর্জনা নিষ্কাশন এর সুযোগ সুবিধা সম্প্রসারনের জন্য একটি ব্যাপক ও বৃহৎ পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে অতি দ্রুত একটি সম্ভাব্যতা রিপোর্ট প্রদানের জন্য ইতিমধ্যেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম ওয়াসা

চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ ও পয়ঃ প্রণালী সংস্থার সংশোধিত পানি সরবরাহ প্রকল্প ১৯৬৬-৬৭ সালে অনুমোদিত হয় এবং ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত তার বাস্তবায়ন চলে। তারপর আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার ঋণচুক্তি সাময়িকভাবে বাতিল হয়ে যায়। ১৯৭৩ সালের জুন মাসে উক্ত সংস্থার ঋণচুক্তি আবার কার্যকর হয়। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ১৯৭৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত প্রকল্পটির জন্য বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবস্থা করা হয় সিডা-র অন্তর্বর্তীকালীন তহবিল থেকে।
(পৃ:-৫৭)

১৯৭২-৭৩ সালের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় ৮৯ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়। তার মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ ছিল ১৯ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। ১৯৭৩-৭৪ সালের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে ১ কোটি ৮০ লক্ষ টাকার বৈদেশিক মুদ্রাসহ ৬ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়। ১৯৭২ সালের ১০ লক্ষ টাকা (সাময়িক হিসাব)। ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ব্যয় হয় ৩ কোটি ৮৮ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা।
১৯৭৩ সালে নিম্নলিখিত কাজগুলো সম্পন্ন করা হয়ঃ-
(ক) ইঞ্জিনিয়ারিং কনসালটেন্ট নামক একটি প্রতিষ্ঠান সঙ্গে চূড়ান্তরূপে চুক্তি সম্পাদন; (খ) আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার ঋণচুক্তির পুনরুজ্জীবন; (গ) পানি শোধন কারখানা অভিমুখী সড়কের জন্য ৫ একর জমি হুকুম দখলের কাজ সমাপ্ত; (ঘ) সর্বমোট প্রায় ৪ লক্ষ ৭৩ হাজার ১৭৯ ফুট পাইপ লাইন স্থাপন; ৪ থেকে ২৪ ব্যাসের প্রায় ৩০০০ হাজার ফুট পাইপ স্থাপন; ৪৭৩১৭৯ ফুট স্থাপিত পাইপের মধ্যে প্রায় ৪৬৩৫৯০ ফুট পাইপ পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে;
(ঙ) গৃহাদিতে পানি সরবরাহের জন্য প্রায় ২৮৫০ টি সংযোগ লাইন দান (১৩১১ টি সংযোগ লাইন আগে থেকেই ছিল); নতুন লাইন গুলির মধ্যে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেওয়া হয় প্রায় ৬৬০ টি।
(চ) ৫ টি কুপ পাম্প হাউজ এর মধ্যে দুটি নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়েছে এবং দুটি পাম্প হাউজ এর নকশা তৈরির কাজ চলছে; (ছ) বাটালি পাহাড় জলাধারের (৬০ লাখ গ্যালন ধারণক্ষমতা সম্পন্ন) স্থান পরিবর্তন; সংশ্লিষ্ট চুক্তির সংশোধিত দলিলাদি তৈরি করা হচ্ছে; (জ) মোহড়ায় পানি শোধন কারখানার নির্মাণ স্থানের নকশা প্রণয়নের শতকরা ৮০ ভাগ কাজ এবং কারখানার নকশা প্রণয়নের শতকরা ৫০ ভাগ কাজ সমাপ্ত; এগুলির কাজকর্মের নকশা পর্যালোচনা ও অনুমোদনের জন্য আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার নিকট প্রেরণ করা হয়েছে; কালুরঘাট অপসারণ কারখানার নকশা অংকন এর শতকরা ৬০ ভাগ কাজ সমাপ্ত; (ঝ) পাইপ ও বিশেষ বিশেষ দ্রব্যের জন্য আন্তর্জাতিক টেন্ডার আহ্বান এবং তার মূল্যায়ন ও সিদ্ধান্ত দান; (ঞ) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যান ওয়াটার কোম্পানির নিকট গবেষণাগারের সরঞ্জাম ও রাসায়নিক দ্রব্যাদি সরবরাহের জন্য অর্ডার পেশ; (ট) অনেক লেখালেখির পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বি. আই. এফ. কোম্পানি থেকে কালুরঘাট বুস্টার স্টেশনের জন্য চুক্তিকৃত ক্লোরিনেটর গুলি জাহাজে পাঠিয়েছে ; এগুলি তারা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাঠাতে পারেনি; (ঠ) একটি শুগার সাপ্রেসর পাওয়া গেছে এবং এটি লৌহ অপসারণ কারখানায় ব্যবহার করা হবে।
(পৃ:-৫৮)

এক নজরে

* ঢাকা চট্টগ্রাম ও যশোরের জমির মূল্য পরিশোধ এবং আবাসিক এলাকা নির্মাণের ব্যয় ৫২ লক্ষ টাকা

* ৩৫ হাজার ফ্ল্যাট নির্মাণের জন্য নির্ধারিত ব্যয় ৮৪ কোটি টাকা

* ছিন্নমূলদের জন্য ৪ হাজার আধা পাকা বাড়ি তৈরির নির্ধারিত ৮৮ লক্ষ টাকা

* খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ৬ টি উন্নয়ন পরিকল্পনা সম্পন্ন বাস্তবায়নে ব্যয় হয়েছে ৭০ লক্ষ টাকা

* ঢাকা ওয়াসার ৮টি প্রকল্পের সম্পূর্ণ বাস্তবায়নে ব্যয় হয় ১০ লক্ষ ২০ হাজার ডলার

* ১৯৭২-৭৩ এবং ১৯৭৩-৭৪ সালে চট্টগ্রাম ওয়াসার উন্নয়ন কর্মসূচিতে ব্যয় হয় ৪ কোটি ৩৩ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা

* উপকূলবর্তী অঞ্চলের লোকজন দের জন্য ১৮০ টি আশ্রয়স্থল নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলেছে

* ৩৫৬ টি সমন্বিত থানা স্বাস্থ্য প্রকল্পের নির্মাণ কাজ সমাপ্তির পথে

(পৃ:-৫৯)

গজা বাধ প্রকল্প

কুষ্টিয়া, যশোর, বরিশাল, পটুয়াখালী, খুলনা, ফরিদপুর, পাবনা এবং রাজশাহী জেলা এই প্রকল্পের আওতাভুক্ত। এর লক্ষ্য হলো গজায় উপর বাঁধ নির্মাণ করে এবং তার তীর বরাবর কতকগুলি খাল কেটে ২৪ লক্ষ ৪০ হাজার একর জমিতে সেচের পানি দেওয়া। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের আড়াই মাইল ভাটিতে গঙ্গা (পদ্মা) নদীর উপর বাঁধ নির্মাণ করা হবে। এই দুই প্রান্তের মধ্যবর্তী স্থানে দৈর্ঘ্য হবে ৭০০ ফুট। ১৯৮১ সালে এই প্রকল্পটির নির্মাণকাজ শেষ হবে এবং এতে ব্যয় হবে আনুমানিক ৩৮৬ কোটি ৯৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা।

ভূ-গর্ভস্থ পানি জরিপ

সমগ্র বাংলাদেশ এই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত। এর লক্ষ্য দেশের ভূগর্ভস্থ পানির সম্ভাবনাদির মূল্যায়নের উদ্দেশ্যে এ-জাতীয় প্রাণী সম্পর্কে অনুসন্ধান চালানোর ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন। ১৯৭০ সালে প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়। বর্তমানে এর কাজ চলছে। এগুলির মধ্যে নারায়ণগঞ্জে ড্রেজার ব্যবহারের উন্নতিসাধন বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যবহৃত সরঞ্জাম এর মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ এর সুযোগ সুবিধা দানের জন্য নানান এলাকায় কারখানা নির্মাণ এবং পানির ব্যবহার, খামার ব্যবস্থাপনা এবং সার বীজ ও যান্ত্রিক চাষাবাদ সম্পর্কে কৃষকদের প্রশিক্ষণ প্রকল্প গুলি গুরুত্বপূর্ণ। তরুণ কৃষকদের নতুন চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে কুষ্টিয়ায় একটি প্রকল্প চালু করা হয়। এছাড়া, আলোচ্য সময়ে বাংলাদেশের নদী সমস্যা সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক পর্যালোচনায় সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি ও দামের উদ্দেশ্যে একটি গবেষণাগার স্থাপন করা হয়েছে।

পানি অনুসন্ধান সংস্থা

পানি অনুসন্ধান সংস্থার কার্যাবলী মুখ্যতা ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমিশনের কার্যাবলী সাথে জড়িত। সংস্থা বাংলাদেশ উক্ত কমিশন সচিবালয়রূপে কাজ করছে। ভারত বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশন নিম্নলিখিত লক্ষ্য নিয়ে স্থাপিত হয়েছেঃ
(১) উভয় দেশের সাধারন নদীমালা থেকে সর্বাধিক সুযোগ সুবিধা লাভের জন্য সর্বাধিক কার্যকর যৌথ ব্যবস্থার নিশ্চয়তা বিধানের উদ্দেশ্যে কমিশনের অন্তর্ভুক্ত দেশ দুটির মধ্যে যোগাযোগ বজায় রাখা;
(২) বন্যা নিয়ন্ত্রণের কাজ নির্ধারণ করা এবং যৌথ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সুপারিশ করা;
(৩) বন্যা সম্পর্কে আগাম সতর্কবাণী, বন্যার পূর্বাভাস এবং ঘূর্ণিবার্তার সতর্ক বাণী প্রচার সম্পর্কে বিস্তারিত প্রস্তাব প্রণয়ন;
(৪) উভয় দেশের পারস্পরিক মঙ্গলের জন্য সময় ভিত্তিতে পানি সম্পদ ব্যবহারের উদ্দেশ্যে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ প্রকল্প সমূহের পর্যালোচনা।
(৫) বাংলাদেশ ও ভারতের বন্যা নিয়ন্ত্রণ সমস্যা সম্পর্কে সমন্বিত গবেষণা পরিচালনার জন্য প্রস্তাবাবলি প্রণয়ন।
(পৃ:-৬২)
কাজটি জটিল। এজন্য যৌথ নদী কমিশন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন যে, নদী উন্নয়নের একটি সমন্বিত ও ব্যাপক পরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্দেশ্যে পানি অনুসন্ধান জমি ও পানি উন্নয়ন এবং নদীমালা সম্পর্কিত সংশ্লিষ্ট প্রকল্প গুলি সম্বন্ধে সর্ব প্রকার তথ্য ও পরিসংখ্যান সংগ্রহ করা হবে। এছাড়া, কিছু ছোট পরিকল্পনাও থাকবে। এগুলোর মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত অল্প সময়ের মধ্যে উভয় দেশের জনসাধারণ উপকৃত হবে।

কমিশন আরও স্থির করেছেন যে, উভয় দেশের সাধারণ নদীমালা জন্য পরিকল্পিত প্রকল্প গুলি তারা পরীক্ষা করে দেখবেন এবং প্রয়োজন হলে, এক দেশে অপর দেশের প্রকল্পের বিরূপ প্রতিক্রিয়া পরিহারের জন্য এসব প্রকল্পে কারিগরি দিক গুলি পুনর্বিন্যাস করবেন। তারা পানি নিষ্কাশন এবং সীমান্তে নদীসমূহের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন।

ভারত বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যে সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, সেগুলোর কয়েকটি সম্পর্কে আলোচনা করা হল।

বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কিত সতর্ক বাণী প্রচারের সমন্বিত ব্যবস্থা

বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের ফলে যে ক্ষতি হয়, সময়মতো পূর্বাভাস ও আগাম সতর্কবাণী প্রচার করে তা ন্যূনতম পর্যায়ে নিয়ে আসা যেতে পারে। কমিশন সর্বপ্রথম যে সমস্ত বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দেন, সেগুলির মধ্যে একটি হলো বন্যা এবং ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে সতর্ক বাণী প্রচারের জন্য একটি সমন্বিত ব্যবস্থা করে তোলা। নদীর জলের স্ফিতি ও নির্গমন করবার জন্য অনেক গুলি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন এবং বেতার ব্যবস্থার মাধ্যমে ভারতে অবস্থিত নির্বাচিত কয়েকটি কেন্দ্র থেকে বন্যা সম্পর্কে সতর্ক বানী প্রচার এর আয়োজন করা হয়েছে। ১৯৭২ সালের বন্যা মৌসুমী থেকে এই প্রথা চালু করা হয়। বিভিন্ন অঞ্চলের সম্ভাব্য বন্যার পূর্বাভাস দানের একটি ব্যবস্থা করার জন্য পর্যবেক্ষণমূলক কাজ চালানো হচ্ছে।

বন্যার পূর্বাভাস দান ও সতর্কতা বাণী প্রচার সম্পর্কে এ পর্যন্ত যেসব কাজ করা হয়েছে, কমিশনের পঞ্চম বৈঠকের তার পর্যালোচনা করা হয়। এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় নয়াদিল্লিতে, ১৯৭৩ সালের ১৯ শে জুলাই থেকে ২১ শে জুলাই এর মধ্যে। বর্তমান টেলিযোগাযোগ সুযোগ-সুবিধার উন্নতি সাধনের উপায় সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য একটি পৃথক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বন্যার পূর্বাভাস ও সম্পর্কের তথ্য বিনিময় পর্যালোচনা করে দেখাবার জন্য উভয় দেশের বিশেষজ্ঞরা পুনরায় বৈঠকে মিলিত হবেন এবং বিভিন্ন পর্যায়ের পারস্পারিক সম্পর্ক বর্ণনা চিত্রসহ এবং সাম্প্রতিকতমকরণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
(পৃ:-৬৩)

সিলেট, কাছাড় ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলের বন্যা সমস্যা

এই প্রকল্প টি হবে বহুমুখী। এর লক্ষ্য হলো ভারতে পানি সংরক্ষণের বাঁধ এবং বাংলাদেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ, পানি নিষ্কাশনের নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা ও স্থান উন্নয়ন, যৌথ অনুসন্ধানসহ প্রকল্প প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যে একটি বিশেষ সংস্থা গঠনের জন্য কমিশন উভয় দেশের সরকারের নিকট সুপারিশ করেছেন। বিশেষভাবে এই কাজের জন্য একটি বিভাগের ভার দিয়ে বাংলাদেশ সরকার একজন সর্বক্ষণিক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নিয়োগ করেছেন।
সিলেট, কাছাড় ও তৎসংলগ্ন এলাকার বন্যার সমস্যা সম্পর্কে বাংলাদেশ ও ভারতের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর যৌথভাবে যে কাজ করবেন, কমিশন তার কাগজপত্রের খসড়া অনুমোদন করেছেন। বিভিন্ন পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য এটি নির্দেশ হিসেবে ব্যবহার করা হবে।
কমিশন আরও জানিয়েছেন যে, মেঘনা নদীর পানি সংরক্ষণের সম্ভাব্যতা ও এবং মোহনা নিয়ন্ত্রণের পর্যালোচনা ওপর জোর দেওয়া উচিত।

গঙ্গা নদীর যৌথ জরিপ

কমিশন ফারাক্কার ভাটি থেকে গড়াই এর উৎপত্তিস্থল পর্যন্ত গঙ্গা নদীর একটি যৌথ জরীপ কার্য পরিচালনা করেন। এই কাজ বিমান থেকে এবং বৈজ্ঞানিক বিষয় নিয়ে চালানো হয়। গঙ্গা নদীর জড়িপকৃত অংশের দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ১২০ মাইল এবং এর মধ্যে দুই দেশের সাধারন সীমা ছিল ৯০ মাইল।
বিমান থেকে তোলা আলোকচিত্রে প্রায় ২ হাজার বর্গমাইল এলাকা অন্তর্ভুক্ত হয়। সংশোধিত ফটো মোজাইক এবং চূড়ান্ত মানচিত্র প্রণয়নের উদ্দেশ্যে বিস্তারিত পরীক্ষা ও সমতা সাধনের সহ ভূমি থেকে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা সম্পন্ন হয়েছে।
সমাপ্ত কাজগুলি নির্দিষ্ট মান অনুযায়ী অকুস্থলে পরীক্ষা করে দেখা এবং সংশোধন করা ও শেষ হয়ে গেছে।
১৯৭২-৭৩ সালে যে যৌথ অবৈজ্ঞানিক জরিপ চালানো হয়, তার চূড়ান্ত রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে এবং এখন তা ছাপা হচ্ছে।
১৯৭৩ সালের ৮ ই নভেম্বর থেকে ১০ ই নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকা কমিশনের ষষ্ঠ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে স্থির করা হয় যে ১৯৭৩-৭৪ সালের কাজের মৌসুমে যৌথ উদ্যোগে ফারাক্কার পর থেকে গড়াইয়ের উৎপত্তিস্থল পর্যন্ত গঙ্গা নদীতে অন্তর অন্তর জলবৈজ্ঞানিক জরিপ চালানো হবে।

সাগরখালির বন্যা সমস্যা

একটি যৌথ পর্যবেক্ষক দল গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্পের সাগরখালি এলাকার বন্যার সমস্যা সম্পর্কে তদন্ত করে বন্যা জনিত অতিরিক্ত পানি নিয়ন্ত্রণের
(পৃ:-৬৪)

জন্য একটি পরিকল্পনার সুপারিশ করেছে। যে সমস্ত জিনিসের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ এর কাজ চালানো হবে, সেগুলি হল:-
(১) মাথাভাঙ্গা নদীর উৎপত্তিস্থল এর একটি রেগুলেটর স্থাপন;
(২) গঙ্গার তীর বরাবর প্রান্তিক বাঁধ নির্মাণ;
(৩) গতি পরিবর্তনকারী খাল যেখানে মাথাভাঙ্গা নদীতে পড়েছে, তার কাছে থাকা অপর একটি রেগুলেটর স্থাপন (এই রেগুলেটর মাঝে মাঝে পানির বেগ বৃদ্ধিও করতে পারবে); এবং
(৪) গঙ্গা-কপোতাক্ষ এলাকা দিয়ে পানি নির্গমন ব্যবস্থার উন্নতি সাধন।
প্রকল্পটির জন্য প্রয়োজনীয় জরিপ সমাপ্ত হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের প্রকৌশলীরা ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এক বৈঠকে মিলিত হয়ে ভূগর্ভের পানির অনুসন্ধান এবং জরিপ সংক্রান্ত অন্যান্য তথ্য সংগ্রহের অবস্থা পর্যালোচনা করেন।

খুলনার দাঁতভাঙ্গা বিল

কমিশনের একটি যৌথ পর্যবেক্ষক দলের সুপারিশের ভিত্তিতে সরকার বাংলাদেশের মধ্যে ক্রস বাঁধের মেরামত কাজ সমাপ্ত করেছেন।

তিস্তা বাঁধ জরিপ

দুই দেশের বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ ও ভারতের উত্তরাঞ্চলের বন্যা সমস্যা যৌথভাবে পর্যালোচনা করে সুপারিশ করেছেন যে, (১) দুই দেশ এই অঞ্চলে আপন আপন এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি নিষ্কাশনের মহাপরিকল্পনা সমাপ্ত করবে; (২) সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ কাজের পরিকল্পনা প্রণয়ন করবে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী যৌথ পর্যবেক্ষণ ও পারস্পারিক পরামর্শের মাধ্যমে সমন্বিত তা বাস্তবায়িত করতে হবে; (৪) বাংলাদেশের যে সমস্ত অঞ্চলে পানি নিষ্কাশন বিঘ্নিত হয় সেখানে পানি নিষ্কাশনের খাল গুলিকে নতুন নতুন শাখায় বিভক্ত বা নদীতে খাল তৈরি এবং অন্যান্য উন্নয়ন মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
পর্যবেক্ষক দলের রিপোর্ট বিবেচনা করে কমিশন সুপারিশ করেছেন যে, ভারতে তিস্তা নদীর ডান দিকে নির্মিত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ এর সঙ্গে বাংলাদেশের এই নদীর ডান দিকে নির্মিত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ কে সংযুক্ত করতে হবে। বাম তীর সম্পর্কে বলা হয়, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণের উদ্দেশ্যে ভারত ও বাংলাদেশে একটি যৌথ জরিপ পরিচালনা করা হবে। উত্তরাঞ্চলের অন্যান্য নদীর জন্য পর্যালোচক দল সমস্যাগুলি জেনে নিয়ে সে সবের যৌথ সমাধান খুঁজে বের করবেন।
পানি নিষ্কাশন খালের পুনর্বিবাহ উন্নতি সাধনের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের নদীর ধারা গুলি পর্যবেক্ষণের জন্য যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, কমিশন তার একটি বিবরণী চেয়েছেন।
(পৃ:-৬৫)

তিস্তা বাঁধ প্রকল্পের নকশা

বাংলাদেশ বা ভারতে ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া পরিহারের নিশ্চয়তা বিধানের উদ্দেশ্যে দুই দেশের বিশেষজ্ঞরা তিস্তা বাঁধ এর নকশার বিভিন্ন পরীক্ষা করে দেখেছেন। কমিশন তাদের রিপোর্ট বিবেচনা করে সুপারিশ করেছেন যে, প্রয়োজনীয় নদীর ধারা অনুসরণকারী দ্বিমুখী খাল বন্ধ করে দিতে হবে এবং দুই দেশ তাদের নিজ নিজ এলাকার পরিকল্পিত জলপ্রবাহের বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখবে।
এরপর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তিস্তা বাঁধ প্রকল্পের পরিকল্পিত বন্যা জল নিষ্কাশন ক্ষমতা পুনরায় পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। দেখা গেছে, গৃহীত তথ্য পরিকল্পনাই বাঁধটির পানি নিষ্কাশনের জন্য যথেষ্ট।

শীতকালে নদীর পানি প্রবাহ বৃদ্ধি

কয়েকটি নদীর শীতকালীন পানি প্রবাহ বৃদ্ধির সম্ভাব্যতা পরীক্ষা করে দেখবার উদ্দেশ্যে গঠিত যৌথ পর্যবেক্ষক দল গুলি কমিশনের বিবেচনার জন্য তাদের রিপোর্ট পেশ করেছেন। শুকনো মৌসুমে এই সকল নদীতে সেচের জন্য পানি থাকে খুব কম।
যৌথ নদী কমিশন পর্যবেক্ষক দলগুলির সুপারিশসমূহ অনুমোদন করে জানিয়েছেন, দলগুলিকে শিগগিরই একটি বৈঠকে মিলিত হয়ে সংশ্লিষ্ট নদী গুলির উজান দিকে পানি সংরক্ষণের সম্ভাব্যতা পরীক্ষা এবং পুনরায় কমিশনের নিকট রিপোর্ট পেশ করতে হবে।

নদীধারা নিয়ন্ত্রণ কাজের অভিজ্ঞতা পর্যবেক্ষণ

ভারত ও তার এলাকা দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা এবং মেঘনার অববাহিকার নদী ধারা নিয়ন্ত্রণের অভিজ্ঞতা সম্পর্কিত তথ্যাদি সরবরাহ করেছে। বাংলাদেশও তার এলাকা দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলির ধারা নিয়ন্ত্রণের অভিজ্ঞতা সম্পর্কিত তথ্য সরবরাহ করে। গঙ্গা অববাহিকা নিয়ন্ত্রণের কাজ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য মহাপরিকল্পনা প্রণীত হলে তা কমিশনের নিকট পেশ করা হবে।

বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি সম্পদ উন্নয়নের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা

যৌথ নদী কমিশন গঙ্গা এবং ব্রহ্মপুত্র পানি সম্পদ উন্নয়নের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়নের সূচনা ভাগের রূপরেখা তৈরি প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। এর জন্য পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধানের কর্মসূচি প্রণয়নের বিষয়টিও তারা আলোচনা করে দেখেছেন।
সিলেট ও কাছাড় অঞ্চলের (মেঘনা নদীর অববাহিকার অন্তর্ভুক্ত) বন্যা সমস্যার জন্য বিশেষ বিভাগ গঠন করা হয়। বিভাগগুলি কর্মপরিকল্পনার নির্দেশ মালা অনুমোদিত হয়েছে। গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার জন্যও ব্যবস্থা নেয়া হয়। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র উজান অংশে পানি সংরক্ষণের সম্ভাবনা
(পৃ:-৬৬)

সম্পর্কিত বিস্তারিত কথা বলি শিগগিরই তৈরি করা হবে। এর উদ্দেশ্য হলো অনুসন্ধান ও জরিপ কাজের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ দেওয়া।

নদীর ধারা পথের উন্নতিসাধন

যৌথ নদী কমিশন বন্যা জলের উন্নততর নিষ্কাশনের জন্য বাংলাদেশের নদী ধারা গুলির উন্নতি সাধনের সম্ভাবনা পরীক্ষা করে একটি রিপোর্ট পেশ করেছেন। পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণের জন্য রিপোর্টটি পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।

সীমান্ত নদী সমস্যা

কমিশন (অস্পষ্ট) সালদা, কাকবি এবং মুঞ্জরী নদীর স্রোতধারার প্রতিবন্ধক এবং খোয়াই নদীর রক্ষণ ব্যবস্থার কাজ লক্ষ্য করেছেন। বিষয়টির দিকে বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে বলে স্থির করা হয়েছে। এই সঙ্গে অভিমত প্রকাশ করা হয়েছে যে, সংশ্লিষ্ট জেলাগুলির বেসামরিক ও প্রকৌশলী অফিসাররা বৈঠকে মিলিত হয়ে নিজের নিজের সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা এবং পর্যালোচনা করেছেন।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন

দেশের বিদ্যুত্ সম্পদ কাজে লাগানোর জন্য ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড গঠন করা হয়।
স্বাধীনতার পর থেকেই বোর্ড বিধ্বস্ত বিদ্যুৎ ব্যবস্থার দ্রুত পুনরুজ্জীবনের জন্য প্রাপ্ত সুযোগ সুবিধা কাজে লাগানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতার অনতিকাল পরেই পুনর্বাসন ও নির্মাণের একটি কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয় এতে ১৩ কোটি ১২ লক্ষ ৫১ হাজার টাকার বৈদেশিক মুদ্রাসহ মোট ব্যয় হবে ২৭ কোটি ৬২ লক্ষ ১৫ হাজার টাকা ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও জিনিসপত্রের অধিকাংশই এখন সংগ্রহ করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ ব্যবস্থার পুনর্নির্মাণ কর্মসূচিকে বাস্তবায়ন ৫৫০ সালের জানুয়ারি মাসের মধ্যে সমাপ্ত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

পশ্চিম অঞ্চল

অতীতে বিদ্যুৎ উন্নয়ন ছিল অবহেলিত বিষয়, বিশেষ করে বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে। উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ অনিয়মিতভাবে এবং অসময়ে দেওয়া একটি নিয়মিত ব্যাপারে দাঁড়িয়ে যায়। এর ফলে অধিকাংশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব ঘটে। স্বাধীনতার অল্প কাল পরই বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বাংলাদেশের সমগ্র বিদ্যুৎ ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করে দেখা এবং লক্ষ্য করে যে, পশ্চিমাঞ্চল প্রকৃতপক্ষে একটি বিদ্যুৎ সংকটের এলাকা বিদ্যুৎ সংকটের দরুন এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক জীবনের ওপর প্রচণ্ড বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
এই পরিস্থিতি থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন।
(পৃ:-৬৭)

উপরোক্ত সমস্ত প্রকল্পের কাজই প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা সালের শেষ দিকে শেষ হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এই প্রকল্প গুলি সম্পন্ন হলে বাংলাদেশ নিজস্ব উৎপাদনের দ্বারা সিমেন্ট ও অন্যান্য সামগ্রী ঘাটতি যথেষ্ট পরিমাণে পূরণ করতে সক্ষম হবে এবং এর ফলে প্রতিবছর প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচানো যাবে।
দেশের তৈল খাদ্য সম্পদ আহরণের উদ্দেশ্যে গঠিত বাংলাদেশে তৈল ও দেশ উন্নয়ন সংস্থা চট্টগ্রামের সেমুতাংয়ে গ্যাসের একটি ছোট্ট খনি আবিষ্কার করেছে। সংস্থা বরিশালে ড্রিলিংয়ের জন্য কতগুলি নতুন জায়গা নির্বাচন করে। এসব জায়গায় ১৯৭৪ সালের প্রথম দিকে কাজ শুরু হবে। চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকায় পেট্রোলিয়াম আবিষ্কারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
বাংলাদেশের খনিজ দ্রব্য ও খনি সমূহের প্রশাসন কার্য পরিচালনার জন্য খনিজ দ্রব্য উন্নয়ন ব্যুরোর নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়। এই ব্যুরো সিমেন্ট, চুনাপাথর এবং ময়মনসিংহে চিনা মাটি ও ডেলা মাটি আহরণের উদ্দেশ্যে লাইসেন্স প্রদান করে। সিমেন্টের চুনাপাথর আহরণের জন্য দুইটি পারমিট এবং চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে চুনাপাথর ব্যবহারের জন্য একটি ইজারাপত্র দেওয়া হয়।

পেট্রোলিয়াম বিতরণ

স্বাধীনতার পর পরই বাংলাদেশ সরকার পেট্রোলিয়াম উৎপাদন ও বিপুল ঘাটতি এবং দেশব্যাপী পেট্রোলিয়াম বিতরণ অনেক অসুবিধার সম্মুখীন হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের অভ্যন্তরে অবস্থানরত সকল তৈলবাহী যান ভয়ানক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত রেল ও সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়। তাই পেট্রোলিয়াম জাতীয় পদার্থ সরবরাহে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনার জন্য সরকার বিতরণ ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস করেন। পরিবহনের জন্য অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধারও ব্যবস্থা করা হয়। ভারত দান হিসেবে এক লক্ষ মেট্রিক টন পেট্রোলিয়ামজাত দ্রব্য দেয়। এছাড়াও, বিভিন্ন সূত্র থেকে ৬৭ হাজার টন দ্রব্য আমদানি করা হয়।
অন্যদিকে দেশব্যাপী বিভিন্ন এজেন্ট ও রেশন দোকানের মাধ্যমে তৈলজাত দ্রব্য দেশের অভ্যন্তরে যথাযথভাবে বিতরণের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এছাড়া, বাজারে স্বাভাবিক ক্রয়-বিক্রয় ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রিত মূল্যে সরবরাহ ও অব্যাহত থাকে। জাতিসংঘের বাংলাদেশ স্বাস্থ্য সংস্থা বিশেষ ইজারা ব্যবস্থার যে চারখানি তৈরি বাহিনী নিয়ে আসে, তাতেও পরিবহনের সমস্যা কিছুটা দূর হয়। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজকর্ম সন্তোষজনকভাবে চলে। বর্তমানে দেশের রাজ্য ও নিয়ন্ত্রিত মূল্যে পাওয়া যাচ্ছে।

কারিগরি সাহায্য ও গবেষনা

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কারিগরি সাহায্য ও গবেষণা সংক্রান্ত একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই চুক্তি সাধারণভাবে বিজ্ঞান ও কারিগরি ক্ষেত্রে এবং বিশেষভাবে আণবিক শক্তি শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সাহায্য ও
(পৃ:-৭০)

সহযোগিতা সুনিশ্চিত করে। অস্ট্রেলিয়ার সাথেও একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই চুক্তির অধীনে অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশকে একটি আদর্শ প্রকল্পের বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় বাবদ ১ লক্ষ ৪৫ হাজার মার্কিন ডলারের কারিগরি সাহায্য দেবে। প্রকল্পটি স্থাপিত হবে কক্সবাজারে এবং এর লক্ষ্য হচ্ছে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে বালি থেকে ভারী খনিজ সম্পদ আহরণ।
রূপপুর আণবিক শক্তি প্রকল্পের কারিগরি ও অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতার পুনর্মূল্যায়নের জন্য একটি পর্যবেক্ষণ দল গঠন করা হয়। দলটি ইতিমধ্যে সরকারের নিকট তাদের রিপোর্ট পেশ করেছে। বর্তমানে রিপোর্টটি সরকারের সক্রিয় বিবেচনাধীন রয়েছে।

আনবিক শক্তি কমিশন

বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশন কৃষি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। বিকিরণ পদ্ধতি প্রয়োগ করেন নতুন নতুন জাতের ধান ও পাট উদ্ভাবিত হয়েছে।
সম্প্রতি ইরাটম ২৪ নামে নতুন এক ধরনের ধান উদ্ভাবিত হয়। ফলন ক্ষমতায় এবং স্বল্প সময়ে পাকবার ব্যাপারে এটা বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধান বলে বিবেচিত হয়েছে। যথাযথ বৈজ্ঞানিক উপায়ে চাষ করা হলে বর্তমানে বাংলাদেশের যেসব ইরি ধানের চাষ করা হয় সেগুলির মধ্যে ইরি-৮ এর ফলন প্রতি একরে ১০০ মণ পর্যন্ত হতে পারে।
কমিশন কর্তৃক উদ্ভাবিত ইরাটম ২৪ ও ইরাটম ৩৮ নামক নতুন জাতের ধান কেবল উচ্চ ফলন যুক্ত ও দ্রুত পরিপক্কতা লাভের ক্ষমতাসম্পন্নই নয়, এগুলিতে প্রোটিনের পরিমাণও থাকে অন্যান্য ধানের তুলনায় বেশি। এই দুই ধরনের ধান ইরি-৮ এর আদি রূপ এবং আউশ ও বোরো মৌসুমে বপন করা যায়। এগুলির ফলন ইরি-৮ এর সমান বা তার চেয়েও বেশি এবং এসব ধান ইরি-৮ থেকে ৩ হতে ৫ সপ্তাহ আগে পাকে।
প্রাকৃতিক দ্রব্য ও চামড়া গবেষণাগারের বিজ্ঞানীরা ‘জুটন’ নামে এক প্রকার দ্রব্য তৈরি করে তুলো তুলো আংশিক বিকল্প তৈরীর প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করেছেন। ‘জুটেরা’ নামে অপর একটি দ্রব্য সম্প্রতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এটিও ‘জুটন’ এর মত ‘জুটেরা’ প্রস্তুত করা হয়েছে পাট ও বিশেষ ধরনের পলিস্টারের সংমিশ্রণে।

এক নজরে

* প্রাকৃতিক সম্পদ আবিষ্কার ও উন্নয়নের জন্য গঠিত কর্পোরেশন ২ টি

* পেট্রোলিয়াম জাতীয় দ্রব্য আমদানি ১ লক্ষ ৬৭ হাজার মেট্রিক টন

* ইরাটম ২৪ নামে নতুন ধরনের ধান উদ্ভাবন

স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা

স্বাধীনতা সংগ্রাম কালে স্বাস্থ্য রক্ষা ও তৎসম্পর্কিত সেবামূলক কাজ কর্ম দারুন ভাবে বিপর্যস্ত হয়। এক্ষেত্রে পুনর্বাসনের কাজ এখনও চলছে। ১৯৭২-৭৩ সালের বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় স্বাস্থ্যসংক্রান্ত ৪৯ টি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ১২ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা ব্যয় করা হয়। ১৯৭৩-৭৪ সালের অর্থবছরে ৩৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচি ও পরিবার পরিকল্পনার ব্যয় বরাদ্দ ও ব্যয় বরাদ্দ অন্তর্ভুক্ত নয়। এ দুটির জন্য পৃথক ব্যয় বরাদ্দ রাখা হয়েছে-ম্যালেরিয়া নির্মূলে কর্মসূচির জন্য ৩ কোটি ৮০ লক্ষ টাকা এবং পরিবার পরিকল্পনার জন্য ৭ কোটি টাকা।

স্বাস্থ্য

৯১৭৩ সালে বাস্তবায়িত করার জন্য গৃহীত উন্নয়ন প্রকল্প গুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল থানা স্বাস্থ্য প্রকল্প। এই প্রকল্প অনুযায়ী দেশের ৩৫৬ টি পল্লী থানার একটি করে থানা স্বাস্থ্য কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। প্রত্যেকটি কেন্দ্রে ৩১ টি বেডবিশিষ্ট হাসপাতাল এবং একটি পল্লী স্বাস্থ্য কেন্দ্র থাকবে। এর সাথে সংযুক্ত থাকবে ইউনিয়ন উপকেন্দ্র। ৩ কোটি ৯৩ লক্ষ ৩৮ হাজার টাকার বাজেট বরাদ্দ নিয়ে ২১৫ টি থানায় উক্ত প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু করা হয়েছে। অধিকাংশ প্রকল্পের কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গেছে।

প্রতিষেধক স্বাস্থ্য কার্যক্রম

আলোচ্য বৎসরে দেশের স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে প্রতিষেধক কাজকর্ম সরকারের আওতায় আনা হয়। এর জন্য সরকারকে ব্যয় করতে হয়েছে প্রায় ২১ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা। ১০৭ টি থানা ঔষধালয়ের পরিচালনার ভার সরকার নিজের হাতে গ্রহণ করেছেন। এগুলি আগে জেলা বোর্ড কর্তৃক পরিচালিত হতো। ১১৪ টি ঔষধালয় এর মান উন্নত করা হয়েছে। এর জন্য সরকারের ব্যয় হয় ৮৭ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা।
দেশের নার্সের তীব্র অভাব রয়েছে। এই সংকটের সমাধানের জন্য প্রতিবছর ১১০০ জন নার্সকে প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে ৮ টি মেডিকেল কলেজ এবং ১১ টি জেলা হাসপাতাল জরুরি কর্মসূচি চালু করা হয়েছে। মহিলা স্বাস্থ্য পরিদর্শক ও যাত্রীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্যও অনুরূপ কর্মসূচি চালু করা হয়।
বিদেশে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য ৩৩ জন ডাক্তার ও নার্স কে ফেলোশিপ প্রদান করা হয়েছে। ইউনিসেফ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক রেডক্রস এর সাহায্যে সরকার (অস্পষ্ট) ভেনাস ফ্লুয়িড তৈরীর কারখানা স্থাপন করেছেন। এটি বাংলাদেশ এ জাতীয় প্রথম প্রতিষ্ঠান। কারখানাটি দেশের সমগ্র ফ্লুয়িড চাহিদা মেটাতে পারবে।
(পৃ:-৭২)

ম্যালেরিয়া

ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচি চালু করা হয় ১৯৭৪ সালের মধ্যে দেশকে ম্যালেরিয়া মুক্ত করার উদ্দেশ্যে। কর্মসূচিটি চারটি স্তরে বিভক্ত-প্রস্তুতি স্তর, আক্রমণ স্তরে, দৃঢ়ীকরণ স্তর ও রক্ষণাবেক্ষণ স্তর। বর্তমানে দেশে মোট ৬ কোটি ৭৩ লক্ষ ৬০ হাজার পল্লী বাসের মধ্যে ২ কোটি ৮৫ লক্ষ ৯০ হাজার লোক ম্যালেরিয়া মুক্ত অঞ্চলে বাস করছে। ৩ কোটি ৩ লক্ষ ৭০ হাজার অধিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় ম্যালেরিয়া সংক্রমণ ঘটে না। ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচি বাস্তবায়নে ৩ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছে।

পরিবার পরিকল্পনা

পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির লক্ষ্য হলো বছরে জন্মহার শতকরা ০’০৪ ভাগ অর্থাৎ জন্মের সংখ্যা প্রায় ২ লক্ষ ৯৬ হাজার হ্রাস করা। এর ফলে সন্তান পালনে সামাজিক ব্যয় ৫৬ কোটি ২৪ লক্ষ টাকা হ্রাস পেয়ে জাতীয় সঞ্চয় বৃদ্ধি পাবে। লক্ষ্য অর্জনের জন্য সরকার ১৯৭৩-৭৪ অর্থ বছরে ৭ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় মোট ৭০ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে।
সন্তান জন্মদানে অক্ষম যেসব দম্পতি পরিবার পরিকল্পনা সংক্রান্ত সাহায্যের প্রয়োজন রয়েছে, তাদের খুঁজে বের করা এবং তাদের চাহিদার ধরন ও অগ্রাধিকার নির্ধারণের উদ্দেশ্যে সারাদেশে একটি পূর্ণাঙ্গ রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি চালু করা হবে। পরীক্ষামূলকভাবে টাঙ্গাইল, নোয়াখালী ও খুলনাতে একটি আদর্শ প্রকল্প চালু করা হয়েছে এবং এ পর্যন্ত উক্ত জেলাগুলিতে ৪ লক্ষ ২৬ হাজার দম্পতিকে রেজিস্ট্রি ভুক্ত করা হয়েছে। দেশের মোট জনসংখ্যার অন্ততপক্ষে এক-তৃতীয়াংশকে এই কর্মসূচির আওতামুক্ত করা হবে।

এক নজরে

* সারাদেশের প্রতিষেধক স্বাস্থ্য কার্যক্রম রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়েছে

* পল্লী অঞ্চলের ২১৫ টি থানায় সম্বন্ধিত থানা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে

* ঢাকার জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে একটি ইনট্রা-ভেনাস ফ্লুয়িড উৎপাদন কারখানা স্থাপিত হয়েছে

* সমন্বিত স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা প্রকল্পের ফল পুরুষ বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে জেলা ও থানা স্বাস্থ্য প্রশাসকদের প্রশিক্ষণ দানের দেশব্যাপী কর্মসূচি চালু করা হয়েছে

* ১৯৭৩-৭৪ সালের বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার পরিবার পরিকল্পনা খাতের ব্যয় বরাদ্দ ৭ কোটি টাকা

* দুই কোটি পঁচাশি লক্ষ নব্বই হাজার অধিবাসী অধ্যুষিত পল্লী এলাকা ম্যালেরিয়া মুক্ত করা হয়েছে
(পৃ:-৭৩)

শ্রম ও সমাজ কল্যাণ

আধুনিক বিশ্বে শ্রমিকরা দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে। এজন্য শ্রমিক ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের স্বার্থ রক্ষা এবং কল্যাণের জন্য গৃহীত সরকারি নীতি জাতি গঠনের কাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনুরূপভাবে দুস্থ মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘবের জন্য সরকার যেসব কল্যাণমূলক কাজকর্ম করে থাকেন সেগুলি সুখী জাতি গঠনে সহায়তা করে। এ সমস্ত কথা বিবেচনা করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৩ সালে শ্রম ও সমাজকল্যাণের কতগুলি সময়পোযোগী নীতি ও ব্যবস্থা গ্রহণ এবং বাস্তবায়িত করেন।

শ্রম

শ্রমিকদের মধ্যে তাদের প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পর্ক বোধ জাগ্রত করবার জন্য ব্যবস্থাপনায় তাদের বক্তব্য প্রকাশের অধিকার স্বীকার করে নেয়া হয়। শ্রমিকদের জন্য বিভিন্ন সময়ে বিচ্ছিন্নভাবেও কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। পরবর্তীকালে সেগুলি সম্বন্ধে করে ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে একটি নীতি ঘোষিত হয়। এই নীতি প্রশাসনযন্ত্রকে আরো প্রেরণা যোগায়। তার ফলে, ১৯৭৩ সালে দেশের শিল্প শ্রমিক সম্পর্ক রক্ষা ব্যবস্থার গতি সহজ হয়ে যায়। এ-সময় জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রয়োজন অনুযায়ী আইনগত ব্যবস্থাগুলি পরীক্ষা এবং পুনঃবিন্যাস চলতে থাকে। সেই সঙ্গে প্রচলিত ব্যবস্থা গুলি কে সক্রিয় করে নীতিগত লক্ষ্য অনুধাবনের উপযোগী করা হয়। সংশ্লিষ্ট লক্ষ্য অর্জন এবং নীতির সহজ বাস্তবায়নের জন্য সরকার শ্রমিক এবং কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে থাকেন। এ ব্যাপারে সবসময়ই শ্রমিক ও কর্তৃপক্ষের মধ্যে সুস্থ সম্পর্কের উন্নয়ন এবং শ্রমিকদের জন্য ভালো শ্রম বাজার সংগঠনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এর লক্ষ্য হলো শিল্পক্ষেত্রের শান্তি এবং জনসম্পদের সদ্বব্যবহারের মাধ্যমে সর্বাধিক পরিমাণে দ্রব্যাদি ও কাজকর্ম পাওয়া এবং দেশের সকল মানুষের কাছে উপরিউক্ত ব্যবস্থাগুলির সুফল পৌঁছে দেওয়া।

শ্রমিক সম্পর্ক

১৯৭৩ সালে ৭১৫ টি বিরোধ দেখা দেয়। সালিশি সংস্থার প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই সমস্ত বিরোধীদের মধ্যে ২৪৫ টির মীমাংসা করা হয়। সালিশি সংস্থা ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা এবং রাজশাহী বিভাগীয় দপ্তর সিলেট ও নারায়ণগঞ্জের দুটি আঞ্চলিক দফতর এবং ঢাকার সদরদপ্তর নিয়ে গঠিত।
সদর দপ্তরের ভবনটি পর্যায়ক্রমে ছয়তলা করবার জন্য ১৯৭২ সালের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে ১ লাখ ৯৫ হাজার টাকা মঞ্জুর করা হয়। ইতিমধ্যেই পঞ্চম তলার নির্মাণ কাজে যথেষ্ট অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।
(পৃ:-৭৪)

সরকার শ্রমিক প্রতিনিধিদের ব্যবস্থাপনা বোর্ড এবং ব্যবস্থাপনা পরিষদ নিয়ে আসতে চান। এর জন্য শ্রমিকদের শিক্ষার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া হয়। এই সঙ্গে ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী, মালিকদের প্রতিনিধি ও সরকারি কর্মচারীদের প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে সরকার টঙ্গী শিল্প শ্রমিক সম্পর্ক ইনস্টিটিউটে ও অন্যত্র সকল সম্পদ সংগঠিত করেন। প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের বিভিন্ন দিক নিয়ে আয়োজিত স্বল্পমেয়াদী কোর্সের মাধ্যমে। এছাড়াও খুলনা এবং রাজশাহীতে শিল্প শ্রমিক সম্পর্ক ইনস্টিটিউট স্থাপনের দুটি প্রকল্প ইতিমধ্যেই সরকার অনুমোদন করেছেন। প্রকল্পটির জন্য জমি হুকুম দখল করা হয়েছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে এসবের জন্য ১৯৭৩ সালে ৪ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা বরাদ্দ রাখা হয়।
এ বৎসর সারাদেশে চিকিৎসা এবং চিত্ত বিনোদনের সুযোগ সুবিধা সম্বলিত বিভিন্ন ধরনের শ্রমিক কল্যাণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। এগুলির লক্ষ্য হলো ব্যবস্থাপকদের শিক্ষাদান এবং শ্রমিকদের প্রয়োজন মেটানো। সুশিক্ষিত ডাক্তার ও নার্স শহর ভ্রাম্যমান চিকিৎসা কেন্দ্র এবং শিক্ষামূলক চলচ্চিত্রসহ ভ্রাম্যমাণ সিনেমা ব্যবস্থাও করা হয়েছে। সরকারি পরিচালনায় আসার পর শ্রমিক কল্যাণ কেন্দ্র গুলির সঙ্গে সংযুক্ত ঔষধালয় গুলি শ্রমিকদের স্বাস্থ্য রক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বর্তমানে সারা দেশে ১৭ টি শ্রমিককল্যাণ কেন্দ্র রয়েছে।

জনশক্তি

জনশক্তির ক্ষেত্রে দক্ষতার উন্নয়ন এবং প্রশিক্ষিত জনশক্তি গড়ে তোলার ওপর জোর দেওয়া হয়। মানব সম্পদের সদ্ব্যবহার ও শ্রম বাজার সংগঠনের জন্য করণীয় কেন্দ্র এবং যুব কর্মসংস্থান কার্যক্রমের দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, নারায়ণগঞ্জ এবং খুলনায় অবস্থিত কারিগরি কেন্দ্রগুলিতে প্রশিক্ষণ গ্রহণকারীদের জন্য ১৯৭৩ সালে অধিকতর সংখ্যার বৃত্তি, যন্ত্রপাতি এবং সাজ-সরঞ্জামের ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনার শিক্ষানবিশ প্রশিক্ষণ দপ্তর গুলিতে শিক্ষানবিশ প্রশিক্ষণ দান পূর্বের মতোই চলতে থাকে। এই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় বিশেষ করে প্রকৌশলগত ব্যবসার জন্য। আলোচ্য বৎসরে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গুলোতে ৩০৫ জন প্রশিক্ষার্থী ভর্তি হয় এবং ২০৫ জন পাশ করে বের হয়। বর্তমানে কেন্দ্রগুলিতে ১৯৯ জন ছাত্র রয়েছে। এখন শিক্ষানবিশ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে ৪৫১ জন। ১৯৭৩ সালে ৭৭ জন শিক্ষার্থীকে ভর্তি করা হয় এবং ৪৬ জন শিক্ষানবিশ প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করে।
স্বাধীনতার পর প্রভুর চাকরী-সন্ধানী কর্ম নিয়োগ কেন্দ্রে নিজেদের নাম তালিকাভুক্ত করে। ১৯৭৩ সালে ৫৫০৭৭ জনের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়। এদের মধ্যে ১০৬১৪ জনকে চাকরি দেওয়া হয়েছে।
(পৃ:-৭৫)

যুব কর্মসংস্থান কার্যক্রম এ বছরেও স্কুল ছেড়ে বেরোনোর ছেলেমেয়েদের পেশাগত নির্দেশনা দেয়। ১১০৫ টি ছেলে-মেয়ে দলগতভাবে এবং ১৪৭৩ জন ব্যক্তিগতভাবে নির্দেশনা পায়। এ সমস্ত নির্দেশনা দেওয়া হয় ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা এবং রাজশাহীর চারটি ইউনিটে।

মজুরি

দেশের শিল্পক্ষেত্রে শান্তির নিশ্চয়তা বিধানের উদ্দেশ্যে সরকার শিল্প শ্রমিক মজুরি কমিশন গঠন করেছেন, যাতে এই কমিশন রাষ্ট্রায়াত্ত, পরিত্যক্ত এবং সরকারি পরিচালনাধীনে আনীত শিল্পপ্রতিষ্ঠান গুলিতে কার্যরত শ্রমিকদের জন্য যুক্তিসংগত মজুরি কাঠামোর সুপারিশ করে। কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে মজুরি কাঠামো ঘোষণা করা হয়েছে।
শ্রম সম্পর্কিত আইন গুলির চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো উৎপাদন বৃদ্ধি। এসবের সার্থক বাস্তবায়ন ও প্রয়োগের জন্য পরিদর্শন ব্যবস্থা অরিহার্য। উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ১৯৭৩ সালে ২৩১৫৫ টি ফ্যাক্টরি, দোকান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করা হয়। এছাড়া, বাংলাদেশ ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ কোর্স সংগঠন ও পরিচালনা করে। ৬১৭ জন শিক্ষার্থী অংশ নেয়।

সমাজকল্যাণ

মুক্তিযুদ্ধের ফলে দেশের সমাজ কল্যাণ সংস্থা গুলি কে সংগঠিত করবার বিশেষ প্রয়োজন দেখা দেয়। দখলদার সেনা বাহিনীর অত্যাচারে মানুষ যে দুঃখ-দুর্দশায় পড়েছিল, তা লাঘব করার জন্য স্বাধীনতার পর সমাজকল্যাণ ক্ষেত্রের কার্যকলাপ জোরদার করা হয়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরই সরকার কালবিলম্ব না করে সমাজ কল্যাণ এর ক্ষেত্রে পরিকল্পিত কর্মসূচি প্রবর্তন করেন। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতায় অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে দুস্থ এতিম এবং উন্নয়নের কাজে হাত দেওয়া হয়।
জনসাধারণকে গুরুত্বপূর্ণ সমাজকল্যাণমূলক সুযোগ-সুবিধা দানের জন্য ৫২ টি নগর সমাজ উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়।
এসময়ের টাঙ্গাইল ছাড়া অন্যান্য সমস্ত জেলা স্বদেশে একটি করে অর্থাৎ মোট ১৬ টি যুব কল্যাণ কেন্দ্র পুনরায় চালু করা হয়। এগুলি যুবসমাজের জন্য কল্যাণ মূলক ব্যবস্থা করা। যুবকদের শিক্ষামূলক সফরের জন্য সিলেট-চট্টগ্রাম পাহাড়পুর এবং খুলনায় চারটি যুব হোস্টেল পুনরায় খোলা হয়েছে। (অস্পষ্ট) ছেলে-মেয়েদের জন্য ঢাকা, খুলনা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর এবং ফরিদপুরে ৬ টি স্কুল স্থাপিত হয়। এছাড়া, অন্ধ ছেলেমেয়েদের জন্য ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা এবং বরিশালে প্রতিষ্ঠিত ৫ টি স্কুল পুনরায়
(পৃ:-৭৬)

চালু করা হয়েছে। স্কুলের যে সমস্ত ছেলে-মেয়ের আচার-আচরণ অসঙ্গতিপূর্ণ তাদের কল্যাণ সাধনের জন্য ঢাকা-চট্টগ্রাম, জামালপুর, ফেনী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ভোলা, বাগেরহাট, রাজবাড়ী, নবাবগঞ্জ এবং গাইবান্ধায় বিদ্যালয় গত সমাজকর্মের ১০ টি ইউনিট সংঘটিত হয়।
রোগীদের সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক সাহায্য দানের ব্যবস্থা করার জন্য বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সঙ্গে যে ১৮ টি মেডিকেল সামাজিক ইউনিট সংযুক্ত রয়েছে, সেগুলিকে আরও জোরদার করা হয়। সিলেট, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর এবং ঢাকায় সদ্য (অস্পষ্ট) রোগীদের সেবা শুশ্ররার শিক্ষানবিশির জন্য যে ১৪ টি ইউনিট রয়েছে, অপ্রাপ্তবয়স্ক অপরাধীদের সম্ভাব্য সাহায্য দেওয়ার জন্য সেগুলিও পুনরায় সংগঠিত করা হয়েছে।
টঙ্গীতে অপ্রাপ্তবয়স্ক অপরাধীদের চরিত্র সংশোধনের জন্য একটি যৌগিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়েছে। এতে রয়েছে বিচারাধীন অপরাধীদের জন্য একটি হাজত, একটি আদালত ও একটি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট। ৩১৪০ জন বালক বালিকার পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার জন্য সিলেট, বাবুর হাট, ছাগলনাইয়া, ফরদাবাদ, বরিশাল, মূলবাট, ঝিকরগাছা, কুষ্টিয়া, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, বগুড়া, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মাদারীপুর এবং ফরিদপুরে অবস্থিত ১৭ টি এতিমখানা পুনরায় চালু করা হয়েছে।
ঢাকায় একটি চাকুরীকালীন সমাজকল্যাণ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু রয়েছে। এখানে বিভিন্ন সমাজ কল্যাণমূলক কাজের কর্মী গড়ে তোলবার ব্যাপারে সহায়তা করা হয়।
নিম্নআয়ের কর্মজীবী মা তাদের ছেলেমেয়েদের কল্যাণার্থে ঢাকার আজিমপুরে স্থাপিত ডে-কেয়ার কেন্দ্র পুনরায় চালু করা হয়েছে।
পরিত্যক্ত এবং বেওয়ারিশ শিশুদের আসু সেবা যত্নের জন্য ঢাকার একটি শিশু সনদ চালু করা হয়েছে।
ঢাকা জেলার পুবাইলে এবং ময়মনসিং জেলার বন্যায় ভবঘুরেদের জন্য প্রতিষ্ঠা আশ্রম দুটি পুনরায় খোলা হয়েছে। এগুলোতে ৭৫০ জন ভবঘুরেকে রাখা হবে।
দেশব্যাপী বিভিন্ন নগর সমাজ উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে ভিক্ষাবৃত্তির উচ্ছেদের জন্য ১১ টি ইউনিট রয়েছে। ভিক্ষাবৃত্তি নিরোধের জন্য এগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে।
৫ হাজারেরও বেশি রেজিস্ট্রিকৃত স্বেচ্ছামূলক সমাজ কল্যাণ সংস্থা সারাদেশে স্বেচ্ছামূলক সমাজকল্যাণের কাজ করছে।
যুদ্ধের ক্ষতিগ্রস্ত বাঙালি মহিলাদের পুনর্বাসনের জন্য একটি জাতীয় বোর্ড গঠন করা হয়েছে। এই বোর্ড বাংলাদেশ মহিলা পুনর্বাসন কর্মসূচি পরিচালনা করে সংগঠনটি শ্রম ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সাথে সংযুক্ত। যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থ
(পৃ:-৭৭)

মহিলাদের পুনর্বাসন সেবাযত্ন এবং সুযোগ-সুবিধা দানের জন্য জাতীয় বোর্ড ইতিমধ্যেই আশু কর্মসূচির ব্যবস্থা করেছে।
সংশ্লিষ্ট মহিলাটা যাতে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে লাভজনক কাজকর্মে অংশ গ্রহণ করতে পারে, তার জন্যও উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি ব্যবস্থা করে।

এক নজরে

* শ্রমিক বিরোধের নিষ্পত্তি হয় ২৪৫ টি

* শ্রমিক বিরোধ নিষ্পত্তি কারি সংস্থার সদর দপ্তর নির্মাণের জন্য ব্যয় বরাদ্দ ১ লক্ষ ৯৫ হাজার টাকা

* বিভিন্ন শিল্প শ্রমিক সম্পর্ক ইনস্টিটিউট নির্মাণের জন্য ব্যয় বরাদ্দ ৪ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা

* কর্ম নিয়োগ কেন্দ্রের মাধ্যমে কর্মসংস্থান ১০৬১৪ টি

* প্রশিক্ষণ কোর্স পরিচালিত হয় ২১ টি

* নগর সমাজ উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়া হয় ৫২ টি

* যুব কল্যাণ কেন্দ্র পুনরায় চালু করা হয় ১৮ টি

* সরকারি এতিমখানা পুনরায় চালু করা হয় ১৭ টি

ত্রাণ ও পুনর্বাসন

স্বাধীনতার সংগ্রাম কালে বাংলাদেশের যে কি ঘটেছিল তা বিশ্বের কাছে অজানা নয়। দখলদার বাহিনী এ দেশে গণহত্যা চালায় এবং বিভিন্ন সম্পত্তির ক্ষতি সাধন করে। এর ফলে বাধ্য হয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। এসব ছিন্নমূল মানুষের কোন আশ্রয় ছিলনা ছিলনা।
স্বাধীনতার পর এইসব নিরাশ্রয় মানুষের পুনর্বাসন নতুন সরকারের কাছে এক বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু সীমিত সম্পদ নিয়ে সরকার যথাযথভাবে এর মোকাবেলা করেন। ভারত প্রত্যাগত শরণার্থীদের এবং যারা দেশের ভেতর থেকে আশ্রয়হীন হয়েছিল তাদের খাদ্য ও আশ্রয়দানের বিষয়টিকে সরকার সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। তারা এর জন্য যে কি বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেন আলোচক বৎসরের গত ৬ মাসের ব্যয় বরাদ্দের পরিমাণ থেকেই তা অনুমান করা যাবে। টেস্ট রিলিফ, গৃহনির্মাণ মজুরি ইত্যাদি বাবদ ১ কোটি ৮১ লক্ষ ৭৬ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়।
এছাড়া, সরকার আলোচ্য সময়ে সাহায্য মজুরি হিসাবে নগদ টাকা দেন এবং বিনামূল্যে বিপুল পরিমাণে খাদ্যশস্য ও সি আই শীটি বিতরণ করেন।
১৯৭২ সালের জুলাই মাস থেকে ১৯৭৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত গৃহনির্মাণ, টেস্ট রিলিফ, অনাথ ও পঙ্গুদের জন্য অস্থায়ী আশ্রয়, পেশাজীবী ব্যক্তিদের কারখানা, খাদ্যশস্য, কৃষি পুনর্বাসন, শিক্ষায়তন ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ইত্যাদির জন্য ১৮ কোটি ১৭ লাখ ৬ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়। এছাড়া, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট ও পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য স্থাপিত সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল এবং যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত মহিলাদের পুনর্বাসনের জন্য সরকার ২ কোটি ১০ লক্ষ ১ হাজার টাকার ব্যবস্থা করেন।
দরিদ্র ও গৃহহীন ব্যক্তিদের পুনর্বাসন এর জন্য সরকার বিভিন্ন জেলায় স্বল্প ব্যয়ে ২৯৭৬১০৯ টি গৃহনির্মাণের কর্মসূচি গ্রহণ করেন। এই কর্মসূচি অনুযায়ী ১৯৭৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত স্বল্পব্যয়ে ১২৫৪০০ টি গৃহ নির্মাণ করা হয়। বাকি গৃহগুলির নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলেছে।

প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল

১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল নামক একটি তহবিল খোলা হয়। স্বাধীনতা আন্দোলনের শহীদদের পরিবারবর্গ এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী ও পঙ্গু এবং আহত মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার-পরিজনকে আর্থিক সাহায্য দান এর উদ্দেশ্যে এই তহবিলের বন্দোবস্ত করা হয়েছে।
১৯৭৩ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর পর্যন্ত উপরি-উক্ত ব্যক্তিদের পরিবারবর্গের নিকট থেকে ১৬৯০০০ খানি দরখাস্ত পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৮৭৬০০ টি পরিবারকে আর্থিক সাহায্য দেওয়া হয়। এই উদ্দেশ্যে ১০ কোটি ৪৮ লক্ষ
(পৃ:-৭৯)

৭১ হাজার টাকা মঞ্জুর করা হয়। যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ও নিহত ব্যক্তিদের পরিবার বর্গ কে মাঝে মাঝে আরও আর্থিক সাহায্য দেওয়া হচ্ছে। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা, দুস্থ মহিলাদের পুনর্বাসন ইত্যাদির জন্য প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে কিছু অর্থ দেওয়া হয়। এই অর্থের পরিমাণ ৩২ লক্ষ ৬৫ হাজার টাকা।

এক নজরে

* গৃহনির্মাণ, টেস্ট রিলিফ, খাদ্যশস্য, আহত ও পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্থায়ী আশ্রয়, কৃষি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির জন্য বরাদ্দ ১৮ কোটি ১৭ লাখ ৬ হাজার টাকা

* মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ও দুস্থ মহিলাদের জন্য বরাদ্দ ২ কোটি ১০ লক্ষ ১০ হাজার টাকা

* স্বল্প ব্যয়ের গৃহনির্মাণ ১২৫৪০০ টি

* যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ও নিহত ব্যক্তিদের পরিবার বর্গ কে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে আর্থিক সাহায্য দান ১০ কোটি ৪৮ লক্ষ ৭১ হাজার টাকা

* আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা ও দুস্থ মহিলাদের পুনর্বাসনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে ব্যয় ৩২ লক্ষ ৬৫ হাজার টাকা
(পৃ:-৮০)

ভূমি প্রশাসন ও ভূমি সংস্কার

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। স্বাধীনতা পূর্বকালে বিভিন্ন সরকার কর্তৃক কতকগুলি ভূমি সংস্কার বিষয়ক আইনও পাশ হয়েছিল। তা সত্ত্বেও গরিবদের ভাগ্য অনিশ্চিতই থেকে যায়। জনসংখ্যার প্রচন্ড বৃদ্ধির দরুন পরিবার পিছু জমির পরিমাণ ২ একরেরও নিচে নেমে আসে। এ কারণে জনসাধারণের বৃহত্তর অংশ কে রক্ষা করবার জন্য এক্ষেত্রে এক বড় রকমের পরিবর্তনের প্রয়োজন দেখা দেয়।

জমির পরিমাণ নির্ধারণ

ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে এবং যাদের জমির পরিমাণ অর্থনৈতিক দিক থেকে লাভজনক নয়, তাদের ভেতর বিতরণের জন্য পর্যাপ্ত জমি আমাদের ছিল না। এজন্য সরকার পরিবর্তে জমির সর্বোচ্চ পরিমাণ নির্ধারণ করেন ১০০ বিঘা। এর লক্ষ্য হলো বড় বড় জোতদারের নিকট থেকে বাড়তি জমি নিয়ে নেয়া। ১৯৭৩ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর ছিল বাড়তি জমি সংক্রান্ত ঘোষণাপত্র তারিখ শেষ তারিখ। ৫৩৭১ টি পরিবার ৭৬৪১২ একর জমি উদ্বৃত্ত দেখিয়ে তাদের ঘোষণা পত্র দাখিল করে। খেলাপকারীদের শনাক্ত করার জন্য এখন ঘোষণাপত্র গুলি পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।

সহকারী মৎস্য খামারের ব্যবস্থাপনা

১৯৬৫ সালে জমিদারি উচ্ছেদ আইন অনুযায়ী সরকার ১০৪২১ টি মৎস্য খামারের মালিক হন। আগে বেসরকারি মালিকরা এগুলি নিলাম করে দিত। নিলাম প্রথা বাতিল করে সরকারের মৎস্য জীবীদের সমবায় সমিতি কে ইজারা দেন। মৎস্য খামারের ইজারা দানের উদ্দেশ্য প্রকৃত মৎস্যজীবি সমবায় সমিতির নির্বাচন এবং এই সমস্ত সম্পর্কিত বিরোধ ও অন্যান্য প্রশ্নের মীমাংসার জন্য মহকুমা (অস্পষ্ট) কমিটি ও জেলা (অস্পষ্ট) কমিটি নামে ২ টি কমিটি গঠিত হয়েছে।

হাট-বাজারের উন্নয়ন

পল্লীর অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একটি মৌল কাঠামো তৈরি করবার জন্য হাট-বাজারের যথাযথ উন্নয়ন অপরিহার্য। এজন্য ভূমি প্রশাসন ও ভূমি সংস্কার মন্ত্রণালয় হাট-বাজারের সার্বিক উন্নয়নের একটি প্রকল্প প্রণয়ন করেন। এই পরিকল্পের লক্ষ্য হচ্ছে গ্রামের হাট বাজার কে এমন আদর্শ বাজার হিসেবে গড়ে তোলা, যেগুলি কালক্রমে স্থানীয় জনসাধারণের কর্মসংস্থানের সুযোগ বিশিষ্ট চট্টগ্রাম শহরে পরিণত হবে। বর্তমানে বহু পল্লীবাসী শহরে চলে আসছে এবং তার ফলে বস্তি সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। উক্ত ব্যবস্থার ফলে প্রবাসীদের শহর অঞ্চলের ভিড় জমানো বন্ধ
(পৃ:-৮১)

হয়ে যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে হাট-বাজার উন্নয়নের একটি কর্মসূচি রাখা হয়েছে। ১৯৭২-৭৩ সালে উক্ত উদ্দেশ্যে ২ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। ১৯৭৩ অর্থ বছরে আরও ৩ কোটি টাকা ব্যয় হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

খাস জমির বন্দোবস্ত

স্বাধীনতার পূর্বে সাবেক সরকারের নীতি ছিল, যেসব পরিবারে নিজস্ব জমির পরিমাণ ৩ একর এর কম, অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে তাদের মধ্যে সরকারি খাস জমির বন্দোবস্ত দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে অবশ্য একটি শর্ত ছিল। চর এলাকায় এ জাতীয় কোন পরিবারের জমির ৮ একর এবং অন্যত্র ৫ একরের বেশি হতে পারবে না। এরকম বন্দোবস্তের জন্য প্রজাদের খাজনা এবং সালামি দিতে হতো। সালামির পরিমাণ ছিল সংশ্লিষ্ট জমির বাজার দরের শতকরা ৫০ ভাগ এবং তা ঊর্ধ্ব পক্ষে বার্ষিক কিস্তিতে পরিশোধ করতে হতো।
রাষ্ট্রের সমাজতান্ত্রিক নীতির কথা বিবেচনা করে বর্তমান সরকার খাস জমি বন্দোবস্তের জন্য নতুন নীতি প্রণয়ন করেন। তারা সিদ্ধান্ত নেন, অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এবং খাজনা ও সালামি ছাড়াই ভূমিহীন বা দেড় একরের কম জমির মালিক, এরূপ পরিবারকে সরকারি খাস জমি দেওয়া হবে। নতুন নীতি অনুযায়ী জমির প্লট ও ৫০ একরের কম জমির ব্লকগুলি উপরোক্ত সাধারণ নীতিতে এক একটি উপযুক্ত পরিবারকে দেওয়া হবে।

সমবায় খামার

কৃষির উন্নতির সাধন ও তার উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সমবায় ভিত্তিক চাষবাস অপরিহার্য। সরকারি কৃষি জমির বন্দোবস্তের সময় সমবায়ভিত্তিক চাষাবাদের ওপর বিশেষ জোর দেয়া হয়। খাস জমির যে সমস্ত ব্লকে ৫০ একর বা তার চেয়ে বেশি কিন্তু ৫০০ একর জমি আছে, সেগুলির উপরোক্ত নীতি অনুযায়ী একটি পরিবারকে বন্দোবস্ত দেয়া হবে। কিন্তু ইজারা দলিলে শর্ত থাকবে যে, সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলির এলাকার কৃষি সমবায় সমিতি গঠিত হলে তারা তাতে যোগদান করবে; অন্যথায় তাদের ইজারা বাতিল করে দেওয়া হবে। এই নীতির মূল কথা হলো কালক্রমে উপরোক্ত শ্রেণীর গুলিকে সমবায় খামারের নিয়ন্ত্রণে আনা।

একত্রিত পল্লী পরিকল্প

যে সমস্ত ব্লকে ৫০০ একর বা তার চেয়ে বেশি জমি আছে, সমবায়ভিত্তিক চাষাবাদের জন্য সেগুলি একত্রিত পল্লী পরিকল্পনা মত একটি পরিকল্পক অনুযায়ী বন্দোবস্ত দেওয়া হবে। এটা সাধারন ভাবে করা হবে উপকূলীয় অঞ্চলে। এই পরিকল্পনায় প্রত্যেকটি পরিবার আড়াই একর জমি
(পৃ:-৮২)

পাবে (বসতবাড়ির জন্য ০’৩০ একর এবং কৃষির জন্য ২’২০ একর)। এছাড়া, প্রতি পরিবারের জন্য সরকার আরও ৩০ শতাংশ জমি ছেড়ে দেবেন। এই জমি পুষ্করিণী কমিউনিটি সেন্টার ও প্রদর্শনী খামার এর মত সাধারণ জনকল্যাণমূলক বিষয়ের জন্য ব্যবহৃত হবে। তবে, এ জমি ডেপুটি কমিশনারের খতিয়ানে কৃষি সমবায় সমিতির ব্যবস্থা দিন খাস জমি হিসাবে রেকর্ডকৃত থাকবে।
এটি হচ্ছে একটি উচ্চাভিলাষী পরিকল্প। নোয়াখালী জেলার চর এলাকায় এইরূপ একত্রিত পল্লীর জন্য ইতিমধ্যেই ৬ টি স্থান নির্বাচন করা হয়েছে এবং এগুলির মধ্যে ৪ টি স্থানের কাজ শুরু হয়ে গেছে। এগুলি হবে একটি অনুমোদিত পরিকল্পনা মোতাবেক সৃষ্টি। আদর্শ পল্লী এবং সরকার এসবের জন্য ঋণ ও নির্মাণ কাজের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদির ব্যবস্থা করবেন।
সারাদেশে একত্রিত পল্লী গড়ে তুলবার জন্য একটি বৃহৎ পরিকল্প রয়েছে। উপরোক্ত পরিকল্পটি তার কেন্দ্র।
একত্রিত সমবায় পল্লী পরিকল্প বিস্তর জমি বা বসত ভূমি ও আনুষঙ্গিক জায়গা জমি রূপে নষ্ট হচ্ছে তা উদ্ধার করবে। এছাড়া, পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত হলে আধুনিক কলাকৌশল এর মাধ্যমে উন্নতি সাধন করা যাবে, অনেক ছোট ছোট শিল্প জন্ম নেবে এবং কালক্রমে এমন একটি নতুন সমাজ গড়ে উঠবে, যেখানে জীবনযাত্রা শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য রক্ষা ব্যবস্থার মান হবে উন্নততর এবং দৃষ্টিভঙ্গি হবে আধুনিক।

ভূমিহীন কৃষক ও একত্রিত পল্লীর লোকজনের মধ্যে এ পর্যন্ত ৯০০ একর জমি বিতরণ করা হয়েছে।

এক নজরে

* মৎস্যজীবি সমবায় সমিতিতে ইজারা দেওয়া সহকারী মৎস্য খামার ১০৪২১ টি

* ১৯৭২-৭৩ সালে হাট-বাজারের উন্নয়ন বাবদ ব্যয় ২ কোটি টাকা

* ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে জমি বিতরণ ৯০০ একর
(পৃ:-৮৩)

স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন

স্থানীয় স্বায়ত্ত শাসন ব্যবস্থার পুনর্গঠন এর উদ্দেশ্যে ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে জারিকৃত প্রেসিডেন্টের নির্দেশে সকল মৌলিক গণতন্ত্র সংস্থা বাতিল করে দেওয়া হয়। স্বাধীনতার পূর্বে ১৯ টি জেলায় ৪০৪৩ টি ইউনিয়ন ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর উন্নততর প্রশাসনের জন্য এবং জনসাধারণের সুযোগ সুবিধার কথা ভেবে ইউনিয়নের সংখ্যা বৃদ্ধি করে ৪৩৪০ টি করা হয়। স্মরণ করা যেতে পারে যে, একনায়ক তত্ত্বমূলক সরকারের আমলে প্রবর্তিত মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থা ছিল অগণতান্ত্রিক এবং সে কারণে এই ব্যবস্থা জনগণের নিকট গ্রহণযোগ্য হয়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই পদ্ধতি জনগণের সমর্থন লাভ করতে পারেনি মৌলিক গণতন্ত্র ও জনগণের অপ্রিয় ছিলেন।

ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন

প্রবল প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে এগিয়ে চলতে হয়। বর্তমান সরকার গঠনের লক্ষ্যে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলাদেশ স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন (ইউনিয়ন পরিষদ পৌরসভা) নির্দেশ, ১৯৭৩ এবং ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা (নির্বাচন) বিধি, ১৯৭৩ মোতাবেক নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তারপর সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশনারকে প্রয়োজনীয় ক্ষমতা ও দায়িত্ব দেন। ১৯৭৩ সালের ১৭ ই ডিসেম্বর থেকে ২৭ শে ডিসেম্বর পর্যন্ত ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জনসংখ্যা এবং ভৌগোলিক অবস্থানের ভিত্তিতে প্রতিটি ইউনিয়নে ৩ টি করে ওয়ার্ডে বিভক্ত করা হয়। প্রতিটি ওয়ার্ড থেকে তিনজন করে সদস্য নিয়ে এই তিনটি ওয়ার্ড থেকে মোট ৯ জন সদস্য প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন।
অধিকন্তু সমগ্র ইউনিয়নের নির্বাচকরা প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদের জন্য একজন চেয়ারম্যান ও একজন ভাইস-চেয়ারম্যান সরাসরি নির্বাচিত করেন। এ জাতীয় সংসদের (পার্লামেন্ট) নির্বাচনের জন্য প্রণীত ভোটার তালিকাই ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের জন্য ব্যবহার করা হয়।

পৌরসভা নির্বাচন

পৌরসভা গুলি নির্বাচন ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের পরে অনুষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতার পূর্বে দেশে ৩০ টি পৌরসভা এবং ৩৮ টি শহর কমিটি ছিল। বর্তমান সরকার সকল শহর কমিটিকে পৌরসভায় উন্নীত করেছেন। অধিকন্তু দুটি নতুন পৌরসভা গঠন করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের ৭০ টি পৌরসভা রয়েছে। ঢাকা এবং গুলশান পৌরসভা প্রস্তাবিত ঢাকা কর্পোরেশনের অন্তর্ভুক্ত হবে। এজন্য এই দুইটি পৌরসভার নির্বাচন সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হয়েছে। অবশিষ্ট ৬৮ টি পৌরসভার নির্বাচন ১৯৭৩ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত
(পৃ:-৮৪)

৬৮ টি পৌরসভার মধ্যে ২৮ টি হচ্ছে সাবেক ইউনিয়ন কমিটি। নির্বাচনকালে এই সকল ইউনিয়ন কমিটির এলাকা নির্বাচনী এলাকায় ঘোষিত হয় এবং জনসংখ্যার ভিত্তিতে এই সকল নির্বাচনী এলাকার সদস্যসংখ্যা স্থির করা হয়। অবশিষ্ট ৪০ টি পৌরসভা নির্বাচন ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের ভিত্তিতেই অনুষ্ঠিত হয়। এই ৪০ টি পৌরসভার প্রত্যেকটির একটি করে নির্বাচনী এলাকা বিভক্ত করা হয়। প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে প্রতিটি পৌরসভার প্রত্যেকটি নির্বাচনী এলাকা থেকে ৩ জন করে কমিশনার নিয়ে ৯ জন সদস্য (কমিশনার) নির্বাচন করা হয় এবং প্রত্যেকটি পৌরসভা এলাকা থেকে জনসাধারণের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে একজন চেয়ারম্যান এবং একজন ভাইস-চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

থানা ও জেলা পরিষদের নির্বাচন

থানা এবং জেলা পরিষদের নির্বাচন যথা শীঘ্র অনুষ্ঠানের প্রস্তাব করা হয়েছে। এই সকল পরিষদের ক্ষেত্রে যে নিয়ম-কানুন ও নির্বাচনী কার্যক্রম করা হবে, তা বর্তমানে সরকারের সক্রিয় বিবেচনাধীন রয়েছে।

উন্নয়নমূলক কার্য

স্বাধীনতার পর ঢাকা ও চট্টগ্রাম পৌরসভা দুটি আধুনিক কসাইখানা নির্মাণের কাজে হাত দেয়। বর্তমানে নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলছে।
স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রের চারটি মৌলনীতি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলো পুনর্গঠন এর প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে অনুভূত হয়। এ কারণে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন সংস্থায় সংশ্লিষ্ট কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
জনসাস্থ প্রকৌশল অধিদপ্তর পল্লী অঞ্চলে ১৬০০০০ নলকূপ স্থাপন ও মেরামত এবং উপকূলীয় অঞ্চলে ১২০৯ গভীর নলকূপ স্থাপনের কাজে হাত দেয়। ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৩ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়ে কয়েকটি এলাকায় এই প্রকল্পে প্রথম পর্যায়ের কাজ শুরু করা হয়। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ পর্যন্ত সর্বমোট ১৮৫০০ টি নতুন এবং ২৬৩০০ টি পুরাতন নলকূপ স্থাপিত ও পুনঃস্থাপিত হয়। প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও পুরাতন গভীর নলকূপ স্থাপনের কাজ পুরোদমে শুরু হয়। ৯১৭৩ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রস্তাবিত ১২০০ টি গভীর নলকূপ থেকে ১১২৫ টি নলকূপ বসানো হয়। এছাড়া, নোয়াখালী জেলার রামগতি থানায় ৫০০ টি অগভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ ও দিনাজপুরের কীর্তিপাশায় এবং আরও কয়েকটি জায়গায় পানি সরবরাহ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। স্বাধীনতার পর এই সকল এলাকায় পানি সরবরাহ পুনরায় শুরু করা হয়েছে। ঢাকা
(পৃ:-৮৫)

জেলার বেকারি বাজারের দক্ষিণাংশের পানি সরবরাহের কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গেছে।
চট্টগ্রাম জেলার সাতকানিয়াতেও পুনরায় পানি সরবরাহের প্রধান কাজ সমাপ্ত হয়েছে। আলোচ্য বৎসরে উপকূলীয় অঞ্চলে বিশেষ করে হাতিয়া, সন্দ্বীপ, কুতুবদিয়া এবং মহেশখালীতে পানি সরবরাহের জন্য গৃহীত পাম্প এবং পাইপ লাইন বসানোর কাজ প্রায় শেষ হয়ে গেছে।
ঢাকায় বৃষ্টি সময়ে জমা পানি নিষ্কাশনের জন্য একটি ব্যাপক পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার কাজে যথেষ্ট অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।
শহরাঞ্চলে পানি সরবরাহের পরিপূরক হিসাবে নারায়ণগঞ্জ এবং কুমিল্লায় দুটি বড় নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে।

আলোচ্য বৎসরে অন্যান্য উন্নয়নমূলক কার্যের মধ্যে ছিল:
(ক) বাগেরহাটে পানি সরবরাহের জন্য ৮৯০০ ফুট পাইপ লাইন স্থাপন;
(খ) টাঙ্গাইলে পানি পরিশোধন কারখানা নির্মাণ;
(গ) খুলনায় পানি সরবরাহের জন্য ১৮ হাজার ফুট পাইপলাইন এবং ৩টি বড় নলকূপ স্থাপনের কাজ সমাপ্তি;
(ঘ) কুষ্টিয়া, যশোর, কুমিল্লা, মুন্সিগঞ্জ এবং গোপালগঞ্জের ৭ টি বড় নলকূপ স্থাপন;
(ঙ) ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ৩ হাজার ফুট পাইপলাইন এবং একটি বড় নলকূপ স্থাপন কাজের সমাপ্তি;
(চ) ভূগর্ভস্থ পানি সম্পদ জরিপের জন্য ৩৫ টি পরীক্ষামূলক নলকূপ স্থাপন;
(ছ) বিদেশ থেকে প্রাপ্ত ১০ অশ্বশক্তি বিশিষ্ট ২০ টি পাম্প এর মধ্যে সাতটি দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাপন; এবং
(জ) পঞ্চাশটি পাম্প মেরামত ও পুনঃস্থাপন।

এক নজরে

* সকল শহর কমিটি পৌরসভার পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে

* পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন সমাপ্ত হয়েছে

* ঢাকা ও চট্টগ্রামের দুইটি আধুনিক কসাইখানার নির্মিত হয়েছে

* গ্রামাঞ্চলে নলকূপ বসানো হয়েছে ১৬০০০০ টি

* উপকূলীয় অঞ্চলে গভীর নলকূপ বসানো হয়েছে ১১২৫ টি

* উপকূলীয় অঞ্চলে পানি সরবরাহের জন্য পাম্প ও পাইপ লাইন বসানো হয়েছে
(পৃ:-৮৬)

আইন ও সংসদীয় বিষয়

স্বাধীনতার পূর্বে বর্তমানে বাংলাদেশ নামে পরিচিত এলাকাটি পাকিস্তানের ১৯৬২ সালের কিছু সাংবিধানিক আইন ও সেইসঙ্গে সামরিক আইন কর্তৃক জারীকৃত বিধিব্যবস্থা বলে শাসিত হতো। স্বাধীনতা অর্জনের পর জাতীয় সরকারের প্রথম প্রয়োজন ছিল একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান চালু করা। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত জাতীয় সংসদ (পার্লামেন্ট) তাই ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর দেশের প্রথম সংবিধান সংশোধন আইন পরিষদ হিসেবেও কাজ করছিল। সংবিধান গৃহীত হওয়ার ফলে রাষ্ট্রের চার মৌলনীতি গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র নিশ্চয়তা বিধান করে। পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর ১৯৭২ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর থেকে এই সংবিধান চালু হয়েছে।

সাধারণ নির্বাচন

নতুন সংবিধান অনুযায়ী প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালের ৭ ই মার্চ। এতে মোট ৪টি দল ৩০০ টি সাধারন আসনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ২৯৩ টি আসন লাভ করে বিপুল সংখ্যাধিক্যে জয়ী হয়।
সাধারণ নির্বাচনের পর ১৯৭৩ সালের ১৭ ই ডিসেম্বর থেকে ৩১ শে ডিসেম্বরের মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

প্রধান প্রধান আইন

সরকারের পরামর্শক্রমে আইন ও সংসদ সম্পর্কিত বিষয়ক মন্ত্রণালয় রাষ্ট্রপতি ৩৭ টি আদেশ ও ১৪ টি জরুরি আইন জারি করেন। আলোচ্য বৎসরে সংসদের তিনটি অধিবেশন বসে এবং ৩১ টি আইন পাশ হয়।
আইন সম্পর্কিত প্রধান প্রধান কাজ সম্বন্ধে আলোচনা করা হলো।

বাংলাদেশ গৃহনির্মাণ ঋণদান সংস্থা আদেশ, ১৯৭৩

এই আদেশ বলে বাংলাদেশের বিভিন্ন ছোট বড় শহরে ঘরবাড়ি তৈরি, মেরামত ও পুনর্বিন্যাসের উদ্দেশ্যে আর্থিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ গৃহনির্মাণ ঋণ দান সংস্থা নামে একটি সংস্থা গঠন করা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ, ১৯৭৩

প্রাক স্বাধীনতা কালে একনায়কত্বের আমলে ছাত্র দের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণের দোহাই দিয়ে কতগুলি জরুরি আইনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার খর্ব করা হয়। এই সমস্ত আইন ছিল বাংলাদেশের ছাত্র ও শিক্ষকদের স্বাধীনতার পরিপন্থী। তাঁরা তাই এধরনের দমনমূলক আইন প্রত্যাহারের দাবি জানান।
(পৃ:-৮৭)

এই গণদাবি পূরনের উদ্দেশ্যে রাজশাহী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য দুটি পৃথক আদেশ জারি করে তাদের প্রশাসনকে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেওয়া হয়। এছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন গঠিত হওয়ার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির শাক্ত শাসনের অধিকার আর্থিক ক্ষেত্রে সুনিশ্চিত হয়।

বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) আদেশ, ১৯৭৩

এক সময়ে বাংলাদেশ বন্য প্রাণীর আদর্শ বাসভূমি ছিল। কিন্তু নির্বিচার শিকারের ফলে অনেক বিরল শ্রেণীর বন্যপ্রাণী হয় ইতিমধ্যেই অদৃশ্য হয়ে গেছে, নয়তো এখন লুপ্ত হওয়ার পথে। উপরোক্ত আদেশটি জারি করা হয় বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের ব্যবস্থাপনা করবার জন্য।

পাবলিক সার্ভিস কমিশন আদেশ, ১৯৭৩

সংবিধানের ১৩৭ নং ধারায় এক বা একাধিক পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠন করা ব্যবস্থা রয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী দুটি পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠন করা হয়।

বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশন আদেশ, ১৯৭৩

দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য যে বৈপ্লবিক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে, তা অনুধাবনে সরকারের বিলম্ব হয়নি। তারা তাই আণবিক শক্তি কমিশন নামে একটি সংস্থা স্থাপনের জন্য উপযুক্ত আদেশ জারি করেন। এই সংস্থা স্থাপনের উদ্দেশ্য হলো আণবিক শক্তি শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের উন্নতিসাধন, আন্তর্জাতিক দায় দায়িত্ব পালন, গবেষণা এবং আনবিক শক্তি উৎপাদন কেন্দ্র সম্পর্কিত উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন।

বাংলাদেশ রেডক্রস সমিতি আদেশ, ১৯৭৩

জনসাধারণের জন্য প্রাপ্ত দান সামগ্রী ও অর্থের ব্যবস্থাপনার জন্য উপযুক্ত আদেশবলে বাংলাদেশ রেডক্রস সমিতি গঠিত হয়। পাকিস্তান রেডক্রস সমিতি থেকে বাংলাদেশের অংশ হিসেবে প্রাপ্ত অর্থ ও জিনিসপত্রের ব্যবস্থাপনার কাজও এর অন্তর্ভুক্ত।

বীমা কর্পোরেশন আইন, ১৯৭৩

পূর্বের দেশের চারটি বীমা কর্পোরেশন ছিল। বিভিন্ন সংগঠনের উন্নততর প্রশাসন এবং সেগুলির মধ্যে সমন্বয় সাধনের উদ্দেশ্য উপরোক্ত আইন পাশ করা হয় এবং এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য জীবন বীমা কর্পোরেশন ও সাধারণ বীমা কর্পোরেশন নামে দুটি সংস্থা গঠিত হয়। উক্ত আইন জাতীয় বীমা কর্পোরেশন ভেঙে দেয়।
(পৃ:-৮৮)

সংবিধান (প্রথম সংশোধনী) আইন, ১৯৭৩

পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর যে সমস্ত ব্যক্তি গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং আন্তর্জাতিক আইন মোতাবেক অন্যান্য অপরাধে অপরাধী, তাদের বিচার করবার এবং শাস্তি দেওয়ার জন্য উপরোক্ত আইন বলে সংবিধান সংশোধন করা হয়।

আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনাল) আইন, ১৯৭৩

সংবিধান (প্রথম সংশোধনী) আইন পাশ হওয়ার পর আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনাল) আইন, ১৯৭৩ পাশ হয়। এই আইনের উদ্দেশ্য হলো, যে সমস্ত ব্যক্তি গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং আন্তর্জাতিক আইন মোতাবেক অন্যান্য অপরাধে অপরাধী, তাদের আটক, বিচার ও শাস্তি দানের ব্যবস্থা করা। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি পদে অধিষ্ঠিত উক্ত পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার যোগ্য ব্যক্তিদের সভাপতি ও সদস্য করে বিভিন্ন ট্রাইবুনাল গঠন প্রসিকিউটর নিয়োগ ও তদন্তকারী সংস্থা গঠনের জন্য উক্ত আইনের সরকারকে ক্ষমতা দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন আইন, ১৯৭৩

মাছ আমাদের প্রধান খাদ্যের এক অপরিহার্য অঙ্গ। এর থেকে যথেষ্ট পরিমাণে প্রোটিন পাওয়া যায়। আমাদের নদী এবং পুকুরগুলি ভরাট হয়ে যাওয়ায় ইতিমধ্যেই মাছ দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়েছে। তবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মাছের চাষ ও সংরক্ষন করে এবং উন্নত পন্থায় মাছ ধরে মাছের উৎপাদন বাড়ানোর অবকাশ রয়েছে। এই সকল কথা ভেবেই উপরোক্ত আইনটি পাশ করা হয়। এই আইন মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন নামে একটি সংস্থা স্থাপনের ব্যবস্থা করে। সংস্থার বিভিন্ন কাজ কর্মের মধ্যে রয়েছে মৎস্য খামার ও মৎস্য শিল্পের উন্নয়ন, মৎস্য শিল্প প্রতিষ্ঠা, মৎস্য সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিতরণের জন্য ইউনিট স্থাপন, মৎস্য ও মৎস্যজাত দ্রব্যাদি বাজারজাতকরণ, মৎস্য শিল্প কে ঋণ প্রদান এবং মৎস্যজীবি সমবায় সমিতির স্থাপনে উৎসাহদান।

ছাপাখানা ও প্রকাশনা (ঘোষণা ও রেজিস্ট্রেশন) আইন, ১৯৭৩

১৯৬০ সালে জেনারেল আইয়ুব খান কর্তৃক জারীকৃত সংবাদপত্র ও প্রকাশনা অর্ডিন্যান্স সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়। তখন সংবাদপত্র ও জনসাধারণ এই কালা-কানুন বাতিলের জন্য আন্দোলন চালায়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকারের নীতি হয় দেশের সংবাদপত্র গুলি কে তাদের যথাযোগ্য ভূমিকা পালন করতে দেওয়া। এই নীতি অনুসরণেই তারা উপরিউক্ত আইনটি পাশ করেন। এই আইনের বলে পূর্বোক্ত অর্ডিন্যান্স বাতিল করে সংবাদপত্রগুলোকে বহু প্রয়োজনীয় স্বাধীনতা দানের মাধ্যমে আবার কাজকর্মের সুযোগ দেওয়া হয়।
(পৃ:-৮৯)

সংবিধান (দ্বিতীয় সংশোধনী) আইন, ১৯৭৩

এই আইনটি পাশ করে জাতীয় সংসদকে নিবর্তনমূলক আটক আইন পাশ করবার ক্ষমতাও দেওয়া হয়। এতে সংবাদ দুটির অধিবেশনের মধ্যবর্তী কালের দৈর্ঘ্য ৬০ দিন থেকে বাড়িয়ে ১২০ দিন করা এবং রাষ্ট্রপতিকে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। যুদ্ধ বা বাইরের আক্রমণ অথবা আভ্যন্তরীণ গোলযোগের দরুন দেশের নিরাপত্তা বা অর্থনৈতিক জীবন বিপন্ন হলে রাষ্ট্রপতি এই আইনের বলে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারবেন।

বাংলাদেশ পাট কর্পোরেশন আইন, ১৯৭৩

এই আইনে বাংলাদেশ পাট করপোরেশন নামে একটি সংস্থা স্থাপনের ব্যবস্থা করা হয়। এর লক্ষ্য হলো পাট চাষীদের ন্যায্যমূল্য দানের নিশ্চয়তা বিধানের উদ্দেশ্যে দেশে পাটের মূল্য স্থিতিশীল করা এবং পাট চাষীদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি সাধন। যে সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান পাট চাষের উন্নতি সাধনের জন্য কাজ করছে এবং এক্ষেত্রে গবেষণা চালাচ্ছে, কর্পোরেশন তাদের আর্থিক সাহায্য দিয়ে থাকে।

বাংলাদেশ কুটির শিল্প আইন, ১৯৭৩

এই আইন বাংলাদেশ কুটির শিল্প করপোরেশন নামে একটি সংস্থা স্থাপনের ব্যবস্থা করে। কর্পোরেশনের লক্ষ্য হলো কুটির ও তাঁত শিল্পের বিকাশ সাধন এবং উন্নয়ন, ঐতিহ্যবাহী চারু ও কারু শিল্প সংরক্ষণ, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন এর কতিপয় দায়িত্ব গ্রহণ এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ কর্ম সম্পাদন।

মেডিকেল পরিষদ আইন, ১৯৭৩

এই আইন বাংলাদেশ মেডিকেল পরিষদ পুনর্গঠনের এর ব্যবস্থা করে। এর লক্ষ্য হলো ঔষধ এবং দুস্থ চিকিৎসার ক্ষেত্রে মৌলিক ও উচ্চতর যোগ্যতার একই ধরনের মান প্রতিষ্ঠা করা।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের (সরকারাধীন) অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৩

এই অর্ডিন্যান্স সরকারকে যে কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় নিজ অধীনে আনার ক্ষমতা দেয়। যে সমস্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় আর্থিক সংকটে এবং বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থায় পড়েছে, সেগুলি সরকারাধীনে আনার জন্যই অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়।

রাষ্ট্রায়ত্ত মুনাফ্যাকচারিং কল কারখানার শ্রমিক (চাকরির শর্তাবলী) অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৩

শিল্প প্রতিষ্ঠান শ্রমিকদের মজুরি কমিশনের সুপারিশ সমূহ কার্যকর করার উদ্দেশ্যে এই অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়। সরকারি মালিকানাধীন, জাতীয়করণ
(পৃ:-৯০)

বা সরকার যার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, এরূপ মুনাফ্যাকচারিং কারখানা শ্রমিকদের দেয় বাফ দেওয়ার যোগ্য মজুরি, বোনাস, চিকিৎসার সুযোগ সুবিধা, বাড়িভাড়া, (অস্পষ্ট) খরচ ও ছুটি নির্ধারণের জন্য অর্ডিন্যান্স সরকারকে ক্ষমতা দেয়।

পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৩

এই অর্ডিন্যান্স পাট চাষ ও পাট সম্পর্কিত কারিগরি গবেষণা চালানোর দায়িত্ব দিয়ে পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপনের ব্যবস্থা করে।

পরামর্শ দান

১৯৭৩ সালে আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ১৩৯৩ টি বিষয়ে আইনগত মতামত দান করে। এই বিষয়গুলি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তর থেকে তাদের নিকট পাঠানো হয়। এছাড়া, আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ২৬৯ টি বিজ্ঞপ্তি ও বিধি অনুমোদন করে।

আইন ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক সংস্থা

আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ঢাকায় বাংলাদেশ আইন ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক সংস্থা (ল’ ইনস্টিটিউট এন্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স) প্রতিষ্ঠিত হয়। সংস্থার লক্ষ্য হলো পৌর ও আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রে গবেষণার সুযোগ-সুবিধা দান। যারা জ্ঞানের সন্ধানে গবেষণা চালাতে এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক আইন প্রতিষ্ঠানের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখতে চান, সংস্থা তাদের কাজে লাগবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
(পৃ:-৯১)

স্বরাষ্ট্র

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রধান কাজ হলো সীমান্ত রক্ষা, চোরাচালান রোধ এবং আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও দেশে আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার ব্যবস্থা করা। বাংলাদেশ রাইফেলস, পুলিশ, আনসার, দমকল ও বেসামরিক প্রতিরক্ষা বিভাগ ইত্যাদির মারফত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্মশক্তি পরিচালিত হয়। জরিপ বিভাগ, পাসপোর্ট বিভাগ, কারা বিভাগ ও আদমশুমারি বিভাগ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রশাসন নিয়ন্ত্রণাধীন।

নিরাপত্তা বাহিনী

মুক্তিযুদ্ধের সময় নিরাপত্তা বাহিনী দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীকে সাহসিকতার সঙ্গে এবং দৃঢ়ভাবে বাধা দেয়। এসময় বাংলাদেশ রাইফেলস এর ১০০০ জন এবং পুলিশের ৭০০ জন বীর যোদ্ধা শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধের শহীদরা বীরত্বের সঙ্গে জালেমের রক্ত দিয়ে স্বাধীনতার বুকে (অস্পষ্ট) করেন এবং নিজেদের বুলেট জর্জরিত লাশ দিয়ে এই নতুন প্রজাতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করে যান। স্বাধীনতার পর নিরাপত্তা বাহিনী সমগ্র জাতির সহযোগিতায় সে সব শহীদের স্বপ্ন ও আশা-আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করবার জন্য কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ রাইফেলস

নবজাত রাষ্ট্রের প্রয়োজনের দিকে লক্ষ রেখে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ রাইফেলস কে পুনর্গঠিত ও শক্তিশালী করা হয়। কার্যকরভাবে চোরাচালান রোধ করার জন্য সীমান্ত ফাঁড়ির সংখ্যাবৃদ্ধি ব্যবস্থাও করা হয়েছে। বাংলাদেশ রাইফেলস ১ কোটি ৫৩ লাখ ২১ হাজার টাকার চোরাচালানকৃত দ্রব্য আটক এবং ১০০৯২ জন চোরাচালানীকে গ্রেফতার করে। ৬২৯৫ জন চোরাচালানকারীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। মাঝে মাঝে বাংলাদেশ রাইফেলস অভ্যন্তরীণ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা গুলির সাহায্যেও এগিয়ে এসেছে এবং বিভিন্ন জায়গায় দুষ্কৃতিকারীদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণে বেআইনি অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে।

পুলিশ

বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর প্রধান কাজ আইনশৃঙ্খলা ও আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বজায় রাখা। মুক্তিযুদ্ধের সময় পুলিশ বীরত্বের সঙ্গে সংগ্রাম করে তারা। এখন সদা সতর্ক এবং কষ্টাদিতে স্বাধীনতা সুদৃঢ় করার কাজে তাদের যথাযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছে।
(পৃ:-৯২)

প্রথমদিকে দেশে আইন শৃংখলার পুনঃপ্রতিষ্ঠা সহজ কাজ ছিল না। কেননা তখন লোকের হাতে বেআইনিভাবে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ ছিল এবং দুষ্কৃতিকারী ও অপরাধীরা এসব অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ জনগণের জীবন ও নিরাপত্তার জন্য ব্যবহার করত। কিন্তু পুলিশ অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহযোগিতায় মাঝে মাঝে দেশে সুসংবদ্ধ চেষ্টা ও তল্লাশি অভিযান চালিয়ে অল্পকালের মধ্যেই তাদের খুঁজে বার করে এবং নির্মূল করে ফেলে। এসবের ফলে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার হয় এবং বহু দুষ্কৃতিকারী অপরাধী ধরা পড়ে।
রেলওয়ে সম্পত্তি রক্ষা ও রেল যাত্রীদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধানের জন্য রেলওয়ে পুলিশ রা প্রশংসনীয় ভাবে কাজ করে। তারা ডাকাতি ও লুটতরাজের কয়েকটি সাহসিকতার সঙ্গে প্রতিহত করে এবং দুষ্কৃতিকারীদের নিকট থেকে বিপুল পরিমাণে চোরাচালানকৃত দ্রব্য এবং অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করে। সম্প্রতি তারা টিকেট বিহীন রেলযাত্রীদের বিরুদ্ধে সাফল্যের সঙ্গে কতকগুলি অভিযান পরিচালনা করেছেন।

পুলিশ প্রশিক্ষণ

স্বাধীনতার আগে থেকেই একটি পুলিশ একাডেমি রয়েছে। এছাড়াও, রংপুর, খুলনা, টাঙ্গাইল ও নোয়াখালীতে চারটি আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। এ সমস্ত প্রতিষ্ঠানে এখন বছরে প্রায় ১০ হাজার পুলিশ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে পারবে। এছাড়া, সি আই ডি-র একটি বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান আছে। গোয়েন্দা প্রশিক্ষণের নামে পরিচিত এই প্রতিষ্ঠান পুলিশ অফিসারদের জন্য আদালত সমৃদ্ধির বিজ্ঞান যেমন পায়ের ছাপ, আঙ্গুলের ছাপ এবং অপরাধ সম্পর্কিত তদন্তের অন্যান্য বৈজ্ঞানিক পন্থা সম্পর্কে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। ঢাকার ট্রাফিক প্রশিক্ষণ শিক্ষালয় পুলিশদের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের আধুনিক পন্থা সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পুলিশ বাহিনীর টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার অর্ধেকেরও বেশি ধ্বংস হয়ে যায়। একে সুদৃঢ় করে আবার চালু করা হয়েছে। বর্তমানে সকল জেলা ও মহাকুমা সদরদপ্তরের সাথে পুলিশ বাহিনীর বেতার যোগাযোগ রয়েছে। টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা কে থানা পর্যায়ের অবধি সম্প্রসারিত করার চেষ্টা চলছে।

পুলিশ কল্যাণ

স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ পুলিশদের পরিবারবর্গ এবং এই যুদ্ধে আহত পঙ্গু পুলিশদের পুনর্বাসনের জন্য পুলিশ কল্যাণ তহবিল মারফত একটি ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এছাড়া, দুষ্কৃতিকারীদের সাথে মোকাবেলা করার সময় নিহত পুলিশদের পরিবারবর্গ কে সাহায্য করবার জন্য একটি কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে।
(পৃ:-৯৩)

শহীদ ও আহত পুলিশদের দেশপ্রেমের স্বীকৃতিস্বরূপ এইসব কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য মজুরি হিসাবে যথেষ্ট অর্থ দেওয়া হয়েছে।

আনসার

আনসার বাহিনীর জন্য ১৯৭৩ সাল ছিল একটি ঘটনাবহুল বৎসর। আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখবার জন্য এবৎসর বহু আনসারকে পুলিশ বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আনসার নিজস্ব উদ্যোগে চোরাচালানরোধী অভিযান চালিয়ে বহু মাল আটক করে। এ ছাড়া দুষ্কৃতিকারীদের কাছ থেকে তারা বহু অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে। সামাজিক ও জাতিগঠনমূলক কার্যকলাপেও আনসার বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। বৃক্ষ রোপণ, সড়ক, পুল ও বাঁধ মেরামত এবং নির্মাণ, জঙ্গল ও কচুরিপানা পরিষ্কার, টিকা ও ইনজেকশন দান অভিযান, পতিত জমিতে চাষাবাদ, কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ, ক্লাব ও নৈশ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, নিরক্ষর বয়স্কদের শিক্ষাদান, মাছের চাষ এবং বন্যা ও সাইক্লোনের পর ত্রাণ ও পুনর্বাসন এর কাজেও আনসার বাহিনী অংশগ্রহণ করে। এসবের অধিকাংশ কাজেই আনসাররা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয় এবং নিজেদের উদ্যোগে।
১৯৭৩ সালে ত্রাণকার্য ত্বরান্বিত করার জন্য দেশের সর্বত্র আনসার বাহিনীর অফিসারদের নিয়োগ করা হয়। গত সাইক্লোনের সময় রেডক্রস থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আনসাররা দেশের উপকূলীয় জেলা ও উপকূলবর্তী অঞ্চলে দুর্যোগপূর্ণ ও দুর্যোগ পরবর্তী ত্রাণ কাজে নিয়োজিত ছিলেন।

দমকল বাহিনী

সম্প্রতি দমকল বাহিনীর দ্রুত উন্নতি সাধিত হয়েছে। এসময়ে এক একে একটি সার্থক জনকল্যাণ সংস্থা রূপে পুনর্গঠিত করা হয়। এর ফলে দেশের দূর দূর অঞ্চলের কর্মক্ষেত্র যুক্তিসঙ্গতভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে।
১৯৭৩ সালে দমকল বাহিনী ২২ টি ল্যান্ড রোভার জীপ, ৬ টি বহনযোগ্য পাম্প, ৬ টি পানিবাহী ছোট গাড়ি ও পানির ৭৫ হাজার ফুট নল, খুচরা যন্ত্রাংশ, সাজ-সরঞ্জাম ইত্যাদি পায় এবং এগুলোর জন্য দমকল বাহিনীর কর্মদক্ষতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। তারা আলোচ্য বৎসরে সর্বমোট ২০৪২ টি অগ্নি নির্বাপণী কাজে অংশ নেয় এবং ৬ কোটি ৫৪ লাখ ৭০ হাজার টাকার জিনিসপত্র সম্পত্তি রক্ষা করে।
দমকল সংস্থার আরো উন্নতি সাধনের জন্য ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে চালু অনুমোদিত পরিকল্পনা সমূহের জন্য ৬২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা এবং নতুন অনুমোদিত পরিকল্পনা সমূহের জন্য ১০ লক্ষ টাকা অর্থাৎ মোট ৭২ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়। এর মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ ছিল ২৪ লক্ষ টাকা। এছাড়া কতগুলি নতুন কর্মসূচি বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (১৯৭৩-৭৮) ৩ কোটি ৮০ লক্ষ ৯০ হাজার
(পৃ:-৯৪)

ঢাকার বৈদেশিক মুদ্রাসহ মোট ৬ কোটি ১১ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। কর্মসূচির লক্ষ্য হচ্ছে দেশে দমকল সংস্থাকে আরো কার্যকর এবং শক্তিশালী সংগঠনে পরিণত করা।

বেসামরিক প্রতিরক্ষা

স্বাধীনতার পর ত্রাণকার্যে জন্য বেসামরিক প্রতিরক্ষা বিভাগের কর্মচারীদের ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের অধীনে দিয়ে দেওয়া হয়। ত্রাণ নিয়ন্ত্রণ কক্ষ সম্পূর্ণতঃই প্রতিরক্ষা বিভাগের অফিসার ও কর্মচারীদের দ্বারা চালিত হচ্ছে। এই বিভাগের কর্মচারীরা বিভিন্ন জেলা ও মহানগর বাসনের কাজ করেছেন।

বিদেশবাসন ও পাসপোর্ট বিভাগ

পাসপোর্ট রাখবার অধিকার নাগরিকত্বের অধিকার। তাই স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই বিদেশ বাসন ও পাসপোর্ট বিভাগ বাংলাদেশের নতুন পাসপোর্ট মুদ্রণের জন্য আন্তরিক ও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং বাংলাদেশের যে সমস্ত নাগরিক ব্যবসা, সরকারি কাজ, চিকিৎসা ও উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যেতে ইচ্ছুক তাদের এই নতুন পাসপোর্ট দেয়।
১৯৭৩ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ১৫ ই ডিসেম্বর পর্যন্ত বিদেশ বাসন ও পাসপোর্ট বিভাগ বাংলাদেশের নাগরিকদের ৩৬০১৫ টি আন্তর্জাতিক পাসপোর্ট এবং ১৬৪১০০ টি বিশেষ পাসপোর্ট দেয়।

কারা বিভাগ

কারাগারে বন্দীদের মৌলিক ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দানের উদ্দেশ্যে ১৯৭৩ সালে বেশ কয়েকটি ব্যবস্থা নেয়া হয়। অতিরিক্ত বাড়িঘর তৈরি ও পানি সরবরাহের উপযুক্ত ব্যবস্থা করে দেশের বিভিন্ন কারাগারে বাসযোগ্য পরিবেশের যথেষ্ট উন্নতি সাধিত করা হয়। এছাড়া, কারাগার উন্নয়নের আরো একটি পরিকল্পনা কাজ এগিয়ে চলেছে। এগুলির মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন কারাগারে ৪৯ টি চালা ঘর নির্মাণ এবং ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় একটি বিশেষ কারাগার স্থাপন।

জরিপ

জরিপ বিভাগের প্রধান কাজ হচ্ছে দেশের সামরিক বাহিনী সরকারি বিভাগসমূহ, আধা সরকারি সংস্থা ইত্যাদির জন্য দেশের ভূপৃষ্ঠের মানচিত্র তৈরি করা, এছাড়া, এই বিভাগ দেশের চাহিদা অনুযায়ী জাতীয় উন্নয়ন সম্পর্কিত কাজে ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন মাপের কিছু বিশেষ ধরনের মানচিত্রও তৈরি করে থাকে।
১৯৭৩ সালে জরিপ বিভাগ ঢাকা, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, পাবনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, খুলনা, সিলেট, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জেলার প্রায় ৮৩৪০ বর্গমাইল
(পৃ:-৯৫)

এলাকার মূল ও সংশোধনী জরিপ কাজ সমাধা করে। অধিকন্ত ৮৭০ রৈখিক এলাকার সমতা সাধন ও অনুপ্রস্থগত কাজ সম্পূর্ণ করা হয়। প্রায় ৯৭০ বর্গমাইল এলাকা স্থানিক পরীক্ষা এবং ভারত-বাংলাদেশ নদী কমিশনের জন্য গঙ্গা/পদ্মার যৌথ জরিপকাজ এর আওতাভুক্ত প্রায় ৪৩৬৫ রৈখিক এলাকার সমতা সাধন ও অনুপ্রস্থগত কাজ শেষ হয়েছে। এখন তথ্য ও মানচিত্রের প্রক্রিয়াগত কাজ চলছে। এছাড়াও ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন সংস্থা, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ ও পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং বাংলাদেশ বেতারের জাতীয় উন্নয়ন প্রকল্পসমূহের জন্য কিছু বিশেষ জরিপ চালানো হয়।
আলোচ্য বৎসরে জরিপ বিভাগ ভূপৃষ্ঠের ১০০টি এবং প্রকল্প সম্পর্কিত ১৭ টি মানচিত্রের চূড়ান্ত নকশা প্রণয়ন শেষ করে এ বৎসর ৮৬টি বিভাগীয় এবং ৭৪ টি বহির্ভূত মানচিত্র মুদ্রিত হয়। এগুলো ছাড়াও বিভিন্ন সরকারি, আধা সরকারি সংস্থার জন্য নানা ধরনের নকশা এবং ৫৭১১ টি সংশোধিত ছাপ ও শূন্য থেকে গৃহীত আলোকচিত্রের ফিল্ম পজেটিভ এবং সেসবের পরিবর্তিত রূপ ছাপানো হয়।

শুমারি

দেশের জনসম্পদ ও বস্তুগত সম্পদ সম্পর্কিত নির্ভুল তথ্যের স্বল্পতার কথা চিন্তা করে সরকার নতুন জাতির প্রথম শুমারি ব্যাপকভিত্তিতে পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নেন। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শুমারি উপদেষ্টা কমিটির সুপারিশের ওপর ভিত্তি করে একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয় এবং স্থির করা হয় যে, ১৯৭৩-৭৪ সালে একাদিক্রমে কয়েকটি পরিচালনা এবং যথাশীঘ্র সংশ্লিষ্ট তথ্যের প্রক্রিয়াকরণের কাজ শেষ করা হবে।
১৯৭৩ সালের জুলাই মাসে তাঁত শিল্পের একটি বিশদ শুমারি শেষ করা হয়। তাঁতের সংখ্যা ও অবস্থান, তাঁতের শ্রেণী, এসব তাঁতে তৈরি কাপড়ের গুনাগুন ও পরিমাণ, ব্যবহৃত সুতোর শ্রেণি, উৎপাদিত কাপড় এর শ্রেণীবিভাগ, শ্রমিকের সংখ্যা (নারী-পুরুষ ও বয়সগত) সংশ্লিষ্ট সমূহের উপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের সংখ্যা ইত্যাদি সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ এবং প্রণালীবদ্ধ করা হয়। ১৯৭৩ সালের নভেম্বর মাসে দেশে একই সঙ্গে প্রায় এক লক্ষ গণনাকারী গৃহ নির্মাণ ও প্রতিষ্ঠান সমূহের ব্যাপক শুমারি পরিচালনা করেন। এই শুমারির প্রধান লক্ষ্য ছিল দেশে গৃহ নির্মাণের পরিবেশ, গৃহনির্মাণের জন্য ব্যবহৃত উপকরণাদির শ্রেণী, গৃহের আকার, বাসিন্দা সংখ্যা ইত্যাদি সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করা। প্রতিষ্ঠান শুমারির লক্ষ্য ছিল কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন শ্রেণীর বাণিজ্যিক ও শিল্প ভবন সম্পর্কে যথেষ্ট ব্যাপকভিত্তিতে তথ্যাদি আহরণ। এই শুমারিতে যে সমস্ত তথ্য সংগৃহীত হয়, সেগুলির মধ্যে বাণিজ্যিক ও শিল্পভবন সম্পর্কে যথেষ্ট ব্যাপকভিত্তিতে তথ্যাদি মালিকানা উৎপাদিত দ্রব্যাদির শ্রেণী, মালিকানা, উৎপাদিত দ্রবাদির শ্রেণী, কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা ইত্যাদি সম্পর্কিত তথ্যও ছিল।
(পৃ:-৯৬)

১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিতব্য আদমশুমারির প্রস্তুতি পর্বের কাজ আলোচ্য বৎসরে শেষ হয়েছে। গণনার কাজ শেষ হলে সংগৃহীত তথ্যাদি, কম্পিউটার সহ অন্যান্য আধুনিক যান্ত্রিক পদ্ধতির সাহায্যে প্রণালীবদ্ধ করা হবে। আশা করা যাচ্ছে, সংগৃহীত ও প্রণালীবদ্ধ তথ্যগুলি সর্বাধিক নিখুঁত হবে এবং এসবের মাধ্যমে শুমারির আওতাভুক্ত ক্ষেত্রগুলির একটি স্পষ্ট ছবি ফুটে উঠবে।

এক নজরে

* মূল সংশোধনী জরিপ ৮৩৪০ বর্গ মাইল

* বাড়িঘর ও প্রতিষ্ঠান এবং তাঁতশিল্প শুমারির কাজ শেষ হয়েছে

* দমকল বাহিনীর উন্নয়নের জন্য ব্যয় বরাদ্দ ৭২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা
(পৃ:-৯৭)

পররাষ্ট্র

বাংলাদেশ যেদিন বিশ্বের মানচিত্রে আবির্ভূত হয়, তারপর থেকেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায় জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে এদেশের পররাষ্ট্র নীতির লক্ষ্য নির্ধারণ এবং সে লক্ষ্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তুলে ধরা। এর ফলে পরিস্থিতির পরিবর্তন এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন এবং তার বাস্তবায়ন পর্যায়ক্রমে নতুন নতুন রূপ নিতে থাকে।
মুক্তিযুদ্ধের সময়, যখন আমাদের মাতৃভূমি এক তীব্র সংগ্রামে লিপ্ত ছিল, তখন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির প্রধান লক্ষ্য ছিল এদেশের স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত করা। স্বাধীনতার পর আমাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব ছিল একদিকে দেশের স্বাধীনতা রক্ষা ও সুসংহত করা, অপরদিকে জন্মলগ্নেই নতুন জাতিকে শ্বাসরুদ্ধ করে মারবার সকল প্রতিহত করা। পরবর্তী পর্যায়ে বাংলাদেশের প্রধান চেষ্টা হয় মূলত এই নতুন দেশের জন্য বিশেষ স্বীকৃতি আদায় এবং যত শীঘ্রই সম্ভব দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক স্থাপন করা। যাতে আমরা আন্তর্জাতিক সাহায্যের মাধ্যমে আমাদের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নতুন করে গড়ে তুলতে এবং ত্রাণ, পুনর্বাসন ও জাতীয় পুনর্গঠন এর দায়িত্ব কার্যকরীভাবে পালন করতে পারি।

সাফল্য

নানাবিধ অসুবিধা সত্তেও পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় বিশ্বের বিভিন্ন জাতির সৌহার্দ্য মূলক স্বীকৃতি অর্জনে এবং জাতিসংঘের প্রায় সকল আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভের বাংলাদেশকে তার ন্যায় সঙ্গত আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। যে কোন পরিমাণ দাঁড়ায় বিচার করা হোক না কেন, এটা বাস্তববিকই এক বিরাট সাফল্য যে, আলোচ্য বছরে বাংলাদেশ বিশ্বের অধিকাংশ দেশের স্বীকৃতি লাভ করে। বিশ্বের দেশ সমূহের স্বীকৃতি লাভের পর বাংলাদেশে তাদের যথাসম্ভব অধিকাংশ সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করতে চেষ্টা করেছে। এই চেষ্টার ফলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ পর্যন্ত ২৯ টি দেশের দূতাবাস স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। এসব দেশের নিযুক্ত আমাদের রাষ্ট্রদূতরা একই সঙ্গে আরও দশটি দেশে কাজ চালাচ্ছেন। এছাড়া, চারটি দেশে অর্থনৈতিক কনসাল নিয়োগ করা হবে বলে স্থির করা হয়েছে। তারা সংশ্লিষ্ট দেশগুলিতে ব্যবসা-বাণিজ্য ও দূতাবাসের স্বার্থ দেখাশোনা করবে। বর্তমানে ঢাকায় ৩১ টি বিদেশী কূটনৈতিক মিশন কাজ করছে।
এই সময়ে বহু আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তি এবং সরকারি নেতা বাংলাদেশ সফর করেছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য জাতিসংঘের মহাসচিব ডঃ কুর্ট ওয়াল্ডহাইম, যুগোস্লাভিয়ার প্রধানমন্ত্রী মিঃ জামাল বিয়েদিচ, মিশরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ হাসান আল জায়রাত, ফ্রান্সের মঁসিয়ে আঁদ্রে মালরোঁ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর উইলিয়াম (অস্পষ্ট) এবং জাপানের জেনারেল ফুজিওয়ারা ও মিঃ হায়াকাওয়া। পালাক্রমে, আমাদের প্রধানমন্ত্রী সরকারিভাবে যুগোস্লাভিয়া এবং
(পৃ:-৯৮)

জাপান সফর করেন এবং দুটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। সম্মেলন দুটি হল অটোয়ায় কমনওয়েলথ রাষ্ট্রপ্রধানদের বৈঠক এবং আলজিয়ার্সে জোট নিরপেক্ষ দেশ সমূহের শীর্ষ সম্মেলন।
আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ অনুযায়ী প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে যথাসম্ভব ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, এবং উত্তর ভিয়েতনামসহ দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলি সরকারিভাবে সফর করেন। এই সময়ে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠানের সুযোগ লাভ করে। এতে ৩০ টি দেশের প্রায় ১০০ জন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। এই শান্তি সম্মেলনে বাংলাদেশ এক বিরাট সম্মান লাভ করে। এতে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বিশ্ব শান্তি পরিষদের সর্বোচ্চ পুরস্কার জোলিও কৃষি শান্তি পদক প্রদান করা হয়। বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য, বিমান চলাচল, শিক্ষা, বিজ্ঞান এবং সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ৪১ টি আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদন করতে সক্ষম হয়েছেন। আলোচ্য বৎসরে বাংলাদেশে সাফল্যজনকভাবে একটি কূটনৈতিক অভিযান চালায়, তাতে উপমহাদেশের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে বাংলাদেশের মতামত ব্যাখ্যা করা এবং তার প্রতি সমর্থন গড়ে তোলা যায়। এ উদ্দেশ্যে আফগানিস্থান, আলজিয়ার্স, ইউরোপ ও আমেরিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া দূরপ্রাচ্য ও আটলান্টিক তীরবর্তী দেশ সমূহ এবং মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় প্রধানমন্ত্রীর ৬ জন বিশেষ দূত প্রেরণ করা হয়। সর্বশেষে ১৯৭৩ সালের আগস্ট মাসে ভারত ও পাকিস্তান সরকারের মধ্যে সম্পাদিত দুটি চুক্তির প্রতি বাংলাদেশ সরকার সমর্থন জানান। উপমহাদেশের দেশগুলির সম্পর্ক স্বাভাবিক করা এবং মানসিক সমস্যা সমাধানের জন্য এই চুক্তি ছিল সঠিক বাস্তব পদক্ষেপ।

বাংলাদেশের মৌলিক পররাষ্ট্র নীতি

বাংলাদেশের মৌলিক পররাষ্ট্র নীতির লক্ষ্য হলো সকলের সাথে মৈত্রী এবং কারো প্রতি বিদ্বেষ পোষণ নয়। এই নীতির উৎস হচ্ছে আমাদের প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক প্রবর্তিত এবং বর্তমানে দেশের সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত চারটি মূলনীতি-জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। শান্তির প্রতি দৃঢ় রূপে আস্থাশীল বলে বাংলাদেশ বিশ্বের সকল দেশের সাথে মৈত্রী ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি অনুসরণে ওয়াদাবদ্ধ। স্বাধীনতার উত্থান লগ্নেই এদেশ জাতিসংঘ সনদের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানায় এবং জেনেভা সম্মেলনের প্রতি তাঁর আনুগত্য প্রকাশ করে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, সামরিক চুক্তি বিশ্বশান্তির পরিপন্থী। এই বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে বাংলাদেশ নিষ্ঠা সহকারে জোট নিরপেক্ষতা ও বাস্তব নিরপেক্ষতা নীতি অনুসরণ করছে। এ কারণে বাংলাদেশ সবসময়ই শক্তি ও ক্ষমতার রাজনীতি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখে এবং সকল দেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে তাদের শুভেচ্ছা কামনা করে। এভাবে বাংলাদেশ নিজের জন্য এমন একটি পথ তৈরি করে নিয়েছে, যার লক্ষ্য হলো
(পৃ:-৯৯)

সার্বভৌম সমতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং অপরের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নীতির ভিত্তিতে সকল দেশের সঙ্গে মৈত্রীর সম্পর্ক উন্নয়ন।

উপমহাদেশে সাফল্য

জোট নিরপেক্ষতা বাস্তব নিরপেক্ষতা এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি অনুসরণে বাংলাদেশে আরও একটি বিষয় ওয়াদাবদ্ধ। এটি হলো সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর প্রত্যক্ষ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে, বাইরের হস্তক্ষেপ পরিহার করে এবং সার্বভৌম ক্ষমতার ভিত্তিতে উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি ও স্বাভাবিক অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত করা। সবচেয়ে প্রত্যক্ষ যে সমস্যাটি উপমহাদেশের শান্তি স্বাভাবিকীকরণের পথে বাধা শুরু হয়েছিল, সেটি হল ১৯৭১ সালের হত্যাকান্ড থেকে অদ্ভুত মানবিক সমস্যাবলীর সমাধান। এক্ষেত্রে একটি মীমাংসায় পৌঁছানোর এবং পাকিস্তান থেকে আটক বাঙ্গালীদের মুক্তি সুনিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশকে অত্যন্ত কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়। কারণ, পাকিস্তানের শত্রুতাপূর্ণ মনোভাব এবং অনিশ্চিত আচরণ আলাপ আলোচনার পথে দীর্ঘকাল বাধাস্বরূপ হয়ে থাকে। পাকিস্তান কেবল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে ক্ষান্ত থাকেনি, এদেশে তার যেসব নাগরিক আটকা পড়ে রয়েছে তাদের দায়িত্বও অস্বীকার করে। অমীমাংসিত মানবিক সমস্যাবলীর সমাধান এবং উপমহাদেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিকীকরণের জন্য ১৯৭৩ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ ও ভারত যৌথভাবে একটি সমাধানের প্রস্তাব করে। প্রস্তাবটি পাকিস্তান ছাড়া বিশ্বের সর্বত্র অভিনন্দিত হয়। পাকিস্তানের মনোভাব তখনও ছিল আপোঘবিমুখ। ১৯৭৩ সালের এপ্রিল মাসের বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ ঘোষণা প্রকাশিত হয়, তার ভিত্তিতে ১৯৭৩ সালের ১৮ ই আগস্ট থেকে নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা ক্রমে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়। এর ফলে ভারত ও পাকিস্তান বাংলাদেশ সরকারের সম্মতি ক্রমে শেষ পর্যন্ত ১৯৭৩ সালের আগস্ট মাসেই একটি চুক্তি সম্পাদন করে। এই চুক্তিতে একই সময়ে যুদ্ধবন্দীদের (যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচারের জন্য নির্দিষ্ট ১৯৫ জন ব্যতীত) এবং পাকিস্তানে আটক অবাঙালি ও বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে যেতে ইচ্ছুক এমন বেশ কিছু অবাঙালির স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করা হয়। চুক্তিটিতে সার্বভৌম ক্ষমতার ভিত্তিতে তিনটি দেশের মধ্যে সরাসরি আলোচনার মাধ্যমে অন্যান্য বিষয়ে সমাধানের ব্যবস্থার কথাও থাকে। জাতিসংঘ ও বিভিন্ন দেশের সহযোগিতায় ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ত্রিমুখী বিনিময়ের বিরাট কাজ শুরু হয় এবং ১৯৭৩ সাল শেষ হওয়ার আগেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের শতকরা ২৫ ভাগেরও বেশি আপন আপন দেশে প্রত্যাবর্তন করে।

মধ্য প্রাচ্য

আলোচ্য বৎসরে মধ্যপ্রাচ্যের আরও আরব দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করেন। ১৯৭২ সালে মাত্র ২টি আরব দেশ ইরাক ও ইয়ামেন গণতান্ত্রিক
(পৃ:-১০০)

প্রজাতন্ত্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৩ সালে আরব জগতে বিপুল সাড়া পড়ে যায় এবং আরও ১১ টি আরব রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।
আমাদের নীতি হলো বিশ্বের সকল দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার সম্পর্ক স্থাপন। এই নীতির অঙ্গ হিসাবে বাংলাদেশ সফর বিনিময় ও বিশেষ দূত প্রেরণ এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে তার মতামত ব্যক্ত করার এবং তুলে ধরবার জন্যে অবিচলভাবে চেষ্টা চালায়। মিশরের বিশিষ্ট সাংবাদিক জনাব হাসনাইন হাইকেল বাংলাদেশ সফরে আসেন। এরপর মিশরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের দেশ সফর করেন তিনি আমাদের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করেন। আলজিরিয়ার একজন বিশেষ দূত আমাদের প্রধানমন্ত্রীর জন্য তাদের রাষ্ট্রপতির একটি বাণী নিয়ে আসেন। পরবর্তী পর্যায়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দুজন বিশেষ দূত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে শুভেচ্ছা সফরে যান। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আলজিয়ার্সে জোট নিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান করেন। এই সম্মেলনে উপস্থিত আরব ও আফ্রিকার নেতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ স্থাপন এবং মতামত বিনিময়ের সুযোগ দেয়।
বাংলাদেশ সবসময়ই প্যালেস্টাইনের জনসাধারণ এবং অন্যান্য আরব জাতির ন্যায়সঙ্গত দাবি ও আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। সংশ্লিষ্ট জাতিসংঘ প্রস্তাব অনুযায়ী অধিকৃত আরব অঞ্চলগুলো থেকে ইসরাইলের অপসারণের পর মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান হোক, এটাও বাংলাদেশ কামনা করেছে। ১৯৭৩ সালের ৬ ই অক্টোবর মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথেই বাংলাদেশ ইসরাইলি হামলার বিরুদ্ধে যুদ্ধরত আরব বিশ্বের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ও তার সাথে সংহতি প্রকাশ করে। আমাদের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর আরব নেতৃবৃন্দের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে এবং ইসরাইলি হামলার নিন্দা করে কয়েকটি বাণী প্রেরণ করেন। এছাড়া, প্রীতি ও মৈত্রীর নিদর্শন স্বরূপ বাংলাদেশ মিশরকে ৭৫ হাজার পাউন্ড চা দেয় এবং সিরিয়ায় ২৮ সদস্যবিশিষ্ট একটি চিকিৎসক দল প্রেরণ করে। আরব বিশ্বে বাংলাদেশের এই সমস্ত কাজ ভুয়সী প্রশংসা লাভ করে এবং তাদের সঙ্গে আমাদের যে মৈত্রীর সম্পর্ক রয়েছে, তা আরও দৃঢ় করে।

বাংলাদেশ ও কমনওয়েলথ সম্মেলন

কমনওয়েলথই প্রথম আন্তর্জাতিক সংস্থা, যাতে বাংলাদেশ সদস্য হয় এবং আমাদের প্রধানমন্ত্রীও সরকার প্রধান হিসাবে সেই প্রথম একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান করেন। ১৯৭৩ সালের আগস্ট মাসে অটোয়ায় অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ সরকারপ্রধানদের এই সম্মেলনে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতির গুরুত্ব সুস্পষ্টভাবেই দেখা দেয়। এখানে আমাদের প্রধানমন্ত্রী অন্যান্য সরকার প্রধানের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ স্থাপনের সুযোগ পান। আফ্রিকান নেতাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত যোগদান ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ,
(পৃ:-১০১)

আফ্রিকার অধিকাংশ রাষ্ট্রেই আমাদের কোনো কূটনৈতিক প্রতিনিধি নেই। বাংলাদেশের আবির্ভাবের এর মূলে যে পরিস্থিতি ছিল, কমনওয়েলথের দেশগুলো বিশেষ করে আফ্রিকার দেশ গুলি তা ভালোভাবে বুঝতে পারে। বাংলাদেশের নীতি ও তার অর্থনীতির পুনর্গঠন আর উন্নয়ন প্রচেষ্টা কথাও তারা পূর্বের তুলনায় বিশদভাবে অনুধাবন করে। আমরা বিদেশ থেকে যে অর্থনৈতিক সাহায্য পাই তার একটি বড় অংশ আসে কানাডা, বৃটেন, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড থেকে। এই সব দেশের নেতাদের সঙ্গে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ এর ফলে তারা বাংলাদেশের সঙ্গে উন্নয়ন সহযোগিতা এবং ব্যবসা বাণিজ্য বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার কথা আরো ভালভাবে উপলব্ধি করেন।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রশ্নে বাংলাদেশ যে ভূমিকা গ্রহণ করেছে, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমস্যা’ সম্পর্কের মতবিনিময় ফলে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে কমনওয়েলথ সম্মেলনে তা ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়েছিল। তাঁর ব্যক্তিগত যোগাযোগ বিভিন্ন কমনওয়েলথ দেশের সঙ্গে আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নে যথেষ্ট সহায়তা করবে। ৩২ টি দেশের সমন্বয়ে গঠিত কমনওয়েলথ আমাদের নীতি ও প্রতিষ্ঠানসমূহ এখন পূর্বের থেকে আরও ভালোভাবে বুঝতে পারে। বাংলাদেশ কমনওয়েলথ এর প্রায় সকল সংস্থারই সদস্য হয়েছে। বর্তমানে আমরাই কমনওয়েলথের কারিগরি উন্নয়ন তহবিলের বাজেট থেকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য পাই। আন্তঃসম্পর্কের অন্যান্য ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ কমনওয়েলথ কর্মসূচিসমূহের সুবিধা পাচ্ছে।

জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগোষ্ঠীর সদস্য পদ লাভ

আলোচ্য বৎসরের আর একটি তাৎপর্যপূর্ণ সাফল্য হচ্ছে বাংলাদেশ পূর্ণাঙ্গ সদস্য হিসাবে জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্র গোষ্ঠী তে যোগদান। ১৯৭৩ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর আলজিয়ার্স শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশ সর্বসম্মতিক্রমে জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্র গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হয়। ঐ বৎসরের সেপ্টেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্রসমূহের চতুর্থ শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান করেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের নেতা। সম্মেলনে তিনি আন্তর্জাতিক শান্তির জন্য আকুল আবেদন জানান এবং জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্র সমূহের মধ্যে অধিকতর সহযোগিতা ও সমঝোতার বিকাশ সাধনের জন্য তিনি তার ধ্যান ধারণা ব্যাখ্যা করেন। শীর্ষ বৈঠক জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির জন্য দৃঢ় কণ্ঠে সুপারিশ করে। এর ফলে বাংলাদেশ সম্মেলনে তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক সাফল্য অর্জন করে সম্মেলনে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান এবং পদাধিকার বলে খসড়া প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়। এছাড়াও, বাংলাদেশকে একটি বিশেষ সম্মান দেওয়া হয়েছিল। সম্মেলনের সভাপতি অধিবেশনে বক্তৃতা দেয়ার জন্য সরকার প্রধান রাষ্ট্রপতি কে বেছে নেয়া হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তাদের অন্যতম।
(পৃ:-১০২)

তথ্য ও বেতার

দেশে এবং বিদেশে আমাদের জাতীয় কার্যকলাপ, বিশেষ করে সরকার কর্তৃক গৃহীত নীতি ও ব্যবস্থাপনা এবং আমাদের উত্তরাধিকার, সংস্কৃতি ইত্যাদির প্রচারের দায়িত্ব তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের। বিভিন্ন তথ্য পরিবেশন ছাড়াও এই মন্ত্রণালয়ের প্রচারযন্ত্র সরকার ও জনগণের মধ্যে সর্বদা যোগাযোগ রক্ষা করে এবং সেই সঙ্গে বিভিন্ন পন্থায় জনমত সংগ্রহ করে থাকে। অন্য কথায় এক ধরনের সামাজিক হিসাব রক্ষণের মাধ্যমে এই প্রচারযন্ত্র জনগণকে বিভিন্ন বিষয়ে অবহিত ও অনুপ্রাণিত এবং তাদের গতিশীলতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এ কাজে সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও সংস্থাগুলিকে তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয় যথারীতি সরকারি নির্দেশ দিয়ে থাকে।

বাংলাদেশ বেতার

বেতার হলো জাতীয় জীবন এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে জনগণের চিন্তা ভাবনা ও আশা-আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরবার অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। এই ইলেকট্রনিক যোগাযোগ মাধ্যম এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণের মধ্যে তাদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য একটি গতিশীলতা সৃষ্টি করা।
১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ বেতার মাঝে মাঝেই গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদ এই চারটি রাজস্ব নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জাতীয়তাবাদী ও গণমুখী অনুষ্ঠান প্রচার করে। বিগত বছরগুলোতে হতে বাংলাদেশ বেতারের অনুষ্ঠান প্রচারের সময় ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে এর কেন্দ্র গুলির মোট দৈনিক প্রচার কাল ৮৭ ঘণ্টা ১০ মিনিট। (রবিবারের এই প্রচারণা কাল আরও চার ঘন্টা বেশি হয়।) চট্টগ্রাম ও রাজশাহী কেন্দ্রদ্বয় প্রতিদিন ১৫ ঘণ্টা এবং খুলনা, সিলেট ও রংপুর কেন্দ্রসমূহ ১১ ঘণ্টা করে চালু থাকে। বাংলাদেশ বেতারের ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, সিলেট ও খুলনা কেন্দ্র থেকে ৩০ মিনিট করে সংবাদ পরিবেশিত হয় (প্রত্যেকটি সংবাদ পর্ব পাঁচ মিনিটের)।

বহির্বিশ্ব কার্যক্রম

বাংলাদেশ বেতারের বহির্বিশ্ব কার্যক্রমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া ও আরব ও ইউরোপীয় দেশ সমূহের শ্রোতাদের জন্য আটটি ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। এইসব অনুষ্ঠানের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে ইংরেজি, বাংলা, নেপালি, হিন্দি, পাঞ্জাবি, উর্দু এবং আরবি ভাষাভাষীদের নিকট বাঙ্গালীদের চিন্তা-ভাবনা ও আদর্শ সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য তুলে ধরা। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও বার্মার শ্রোতারাও যাতে এই অনুষ্ঠান শুনতে পান, তার জন্য এর আওতা সম্প্রসারিত করার ব্যবস্থা হচ্ছে।
(পৃ:-১০৩)

বাংলাদেশ বেতারের অনুলিপি বিভাগ (ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস) আমাদের সমৃদ্ধ লোকসংস্কৃতি, সংগীত ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও উন্নয়নের কাজে নিয়োজিত রয়েছে। এছাড়া, অনুলিপি বিভাগে সংরক্ষিত দেশাত্মবোধক গান, লোকগীতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ সমূহ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সাংস্কৃতিক বহির্বিশ্বেও সম্পদ সরবরাহ করা হয়।
বাংলাদেশ বেতারের সমীক্ষণ শাখা (মনিটরিং সেকশন) সংঘটিত হয় স্বাধীনতার পর। বিদেশি বেতার কেন্দ্র সমূহ বাংলাদেশ সম্পর্কে যে সমস্ত অনুষ্ঠান প্রচার করে সেগুলি এখানে রেকর্ড করা হয়। বাংলাদেশ বেতারের ঢাকা কেন্দ্রের বাণিজ্যিক অনুষ্ঠানও সুদৃঢ় করা হয়েছে। ১৯৭২ সালে বিজ্ঞাপন বাবদ আয়ের পরিমাণ ছিল ৬ লক্ষ ২০ হাজার টাকা এবং ১৯৭৩-৭৪ সালের জন্য এই আয়ের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৮ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। চট্টগ্রাম কেন্দ্র ও বাণিজ্যিক অনুষ্ঠান চালু করেছ। বিগত পাঁচ মাসে যেখানে বিজ্ঞাপন বাবদ আয় হয় এক লক্ষ টাকা।
নবপ্রতিষ্ঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য এক সবুজ বিপ্লবের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এর জন্য বাংলাদেশ বেতার ‘দেশ আমার মাটি আমার’ নামে একটি নিয়মিত অনুষ্ঠান প্রচার করেন। এই অনুষ্ঠানটি কৃষকদের জন্য অত্যন্ত কার্যকর হয়েছে। এর মাধ্যমে তারা ফলন ও উৎপাদন বৃদ্ধির অধিকতর বৈজ্ঞানিক ও উন্নত চাষ পদ্ধতির কথা জানতে পারে।
বেতার ব্যবস্থার আধুনিকীকরণের জন্য ব্যাপকভাবে উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্মসূচি গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঢাকায় ১০০ কিলো ওয়াট এর একটি ট্রান্সমিটার স্থাপন (স্বাধীনতা প্রাপ্তির এক বছরের মধ্যেই সমাপ্ত) ও ১০০০ ওয়াটের একটি ট্রান্সমিটার স্থাপনের ব্যবস্থা (বর্তমানে কাজ চলছে), বহিবিশ্ব ও অনুলিপি অনুষ্ঠানের জন্য ঢাকায় একটি নতুন বেতার ভবন নির্মাণ (কাজ সমাপ্ত হয়েছে), খুলনায় ১০০ কিলো ওয়্যাট ও সিলেটে ২০ কিলোওয়াটের ট্রান্স মিটার স্থাপন (কাজ চলছে) এবং সাইক্লোনের বিপদ সংকেত দেওয়ার জন্য চট্টগ্রামে ও রাজশাহীতে ১০০ কিলোওয়াট এর একটি করে ট্রান্সমিটার স্থাপন। এছাড়া, আগামী কয়েক বৎসরে বর্তমানের কয়েকটি বেতার কেন্দ্রের নতুন ভবন নির্মিত হবে। ইতিমধ্যে কয়েক জায়গায় বিশেষ করে ঢাকায় কিছু সম্প্রসারণ কার্য সাধিত হয়েছে।

টেলিভিশন

বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্য জন্ম হয় ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বর মাসে। এই প্রতিষ্ঠানটি সবসময়ই ছিল সাবেক ঔপনিবেশিক সরকার কর্তৃক অবহেলিত। প্রাথমিক অসুবিধা থাকা সত্বেও প্রচারযন্ত্রের এই শাখাটি স্বাধীনতার পর প্রগতিশীল রূপ নিতে থাকে। এখন এর নব রূপায়ণের জন্য উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে।
(পৃ:-১০৪)

গত কয়েক বৎসর যাবৎ বাংলাদেশ টেলিভিশন রাষ্ট্রীয় মূলনীতি সমূহের ভিত্তিতে অনুষ্ঠান প্রচার করছে। এছাড়াও রয়েছে নিরক্ষরতা দূরীকরণ, সমবায় আন্দোলন, সবুজ বিপ্লব এবং জাতীয় জীবনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করার উপযোগী অনুষ্ঠানে।
দেশের শিল্পী, গায়ক, কবি, সাহিত্যিক ও অন্যান্য প্রতিভা সম্পন্ন ব্যক্তিদের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়ে বাংলাদেশ টেলিভিশন সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান প্রচার করে টেলিভিশনের মাধ্যমে শিক্ষার সম্প্রসারণ এর একটি পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। এই উদ্দেশ্যে এবং জাতীয় উন্নয়ন কে তুলে ধরবার জন্যে একটি চলচ্চিত্র ইউনিট প্রতিষ্ঠার কাজ এগিয়ে চলছে। আশা করা যায় খুব শীঘ্রই এই কাজ সম্পন্ন হবে। ইউনিটটি প্রতিষ্ঠিত হলে টেলিভিশনের মাধ্যমে চিত্ত বিনোদনের ক্ষেত্রে নতুন নতুন দিক উন্মোচিত হবে। এই ইউনিট থেকে ফলদায়ক ফিচার ও প্রামাণ্য চিত্রের সাথে সাথে শিল্প চিত্রও পরিবেশিত হবে।
ঢাকার সন্নিকটে রামপুরায় একটি বড় ও স্বয়ং সম্পূর্ণ ভবনে টেলিভিশন কেন্দ্র স্থানান্তরিত করার ব্যবস্থা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আধুনিক যন্ত্রপাতি তে সজ্জিত এই নতুন টেলিভিশন কেন্দ্রটি হবে এশিয়া মহাদেশের সর্বাধুনিক টেলিভিশন কেন্দ্র গুলির অন্যতম। সর্বপ্রকার সুযোগ সুবিধা ছাড়াও দুটি বড় স্টুডিও ও মঞ্চ সম্মিলিত একটি বড় মিলনায়তন নির্মাণ করা হয়েছে। মিলনায়নটি রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান এবং বিভিন্ন নাট্যগোষ্ঠী, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সুযোগ দিতে পারবে। নির্মাণকাজ শেষ হলে এটি যে দেশের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
বাংলাদেশ টেলিভিশনের কার্যকলাপের উন্নয়নের জন্য জাপানি বিশেষজ্ঞরা একটি জরিপ কাজ চালিয়েছেন। তাদের অন্তর্বর্তীকালীন রিপোর্টে দেশের ছয়টি উপকেন্দ্র ও তিনটি সম্প্রচার কেন্দ্র স্থাপনের সুপারিশ করা হয়। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় নাটোর, চট্টগ্রাম, খুলনা, যশোর ও সিলেটে উপকেন্দ্র স্থাপনের জন্য ২ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এছাড়া উক্ত পরিকল্পনায় ১ কোটি ৬৫ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ময়মনসিংহ ও হবিগঞ্জে (কুমিল্লা) উপকেন্দ্র এবং রাঙ্গামাটি, কক্সবাজার ও হিলিতে তিনটি সম্প্রচার কেন্দ্র স্থাপনের ব্যবস্থা রয়েছে। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পর বাংলাদেশের শতকরা ৯০ জন লোক টেলিভিশন কার্যক্রমের আওতায় আসবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
(পৃ:-১০৫)

প্রকাশনা

প্রকাশনা বিভাগ সরকারের নীতি কার্যকলাপ ও অগ্রগতির প্রচার সংক্রান্ত নানাবিধ কাজ করে থাকে। এছাড়া জাতীয় সংস্কৃতি ও আদর্শ দেশ বিদেশের মানুষের সম্মুখে তুলে ধরাও এই বিভাগের অন্যতম লক্ষ্য। এই সমস্ত লক্ষ্য সাধনের জন্য প্রকাশনা বিভাগ নিয়মিত সাময়িক পত্রপত্রিকা এবং পুস্তিকা প্রকাশ ও প্রদর্শনীর আয়োজন করে এবং পোস্টার, ছোট-বড় পুস্তিকা, প্রচারপত্র ও (অস্পষ্ট) মুদ্রিত করে থাকে।
প্রকাশনা বিভাগের তিনখানি নিয়মিত পত্রিকা আছে। এগুলি হল ‘পূর্বাচল’ (সাহিত্য মালিক), ‘নবারণ’ (কিশোর মালিক) এবং ‘বাংলাদেশ সংবাদ’ (সাপ্তাহিক)। এগুলির প্রতিটি সংখ্যাতেই দেশের প্রখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, পন্ডিত, গবেষক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের বিভিন্ন ধরনের রচনা প্রকাশিত হয়।
ইংরেজি ভাষায় পুস্তকাদি প্রকাশের মাধ্যমে বিদেশে বাংলাদেশকে তুলে ধরার একটি কর্মসূচি রয়েছে। এ জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় ‘বাংলাদেশ’ নামে একটি স্মারক গ্রন্থ প্রকাশ করা হয়। সম্প্রতি ‘বাংলাদেশ ফোর্জেল (অস্পষ্ট), ‘ইন কোয়েষ্ট অব ফ্রিডম’, ‘বাংলাদেশ দা ইয়ংগেস্ট রিপাবলিক’, ‘বাংলাদেশ প্রগ্রেস, ১৯৭২’, ‘বাংলাদেশ ল্যান্ড এন্ড দি পিপল’ ইত্যাদি পুস্তক পুস্তিকা এবং চা, চিনি ও মৎস্য সম্পদের ওপর পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। জাতির পিতার জীবন ও কার্যাবলী সম্পর্কে বিদেশিদের অবহিত করার জন্য ‘বঙ্গবন্ধু’ নামে একখানি বিশেষ পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়েছে।
১৯৭৩ সালে জাতীয় দিবস (১৬ ই ডিসেম্বর, বাংলাদেশের মুক্তির দিন) উপলক্ষে একটি বিশেষ প্রকাশনা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। আলোচ্য বৎসরে বিভিন্ন ধরনের ৫০ টি বিভাগীয় প্রকাশনার ২৪,৯৭,৩১৪ টি কপি বিদেশী দূতাবাস তথ্য কেন্দ্র এবং এজেন্ট ও গ্রাহক সহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট স্থানে বিলি করা হয়। এ বৎসর মূল্য ধার্যকৃত প্রকাশনা সমূহের অর্থ ও বিজ্ঞাপন বাবদ আয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩০৩১৩ টাকা।
এই বিভাগের প্রদর্শনী সেল জাগরের আন্তর্জাতিক মেলায় প্রদর্শনের জন্য বই পত্র প্রেরণ করে। এই সেল বিভিন্ন পুস্তিকার ১১০০ টি কপি দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রদর্শনের জন্য পাঠায় এবং বিনামূল্যে পুস্তিকার প্রায় দশ লক্ষ কপি বিভিন্ন উপলক্ষে জনসাধারণের মধ্যে বিতরণ করে। আলোচ্য বৎসরে ঢাকা নগরী ও তার আশপাশে এবং বিভিন্ন জেলার শিক্ষা কেন্দ্র ও শিল্প এলাকায় বিভিন্ন পত্রিকার বিশেষ করে পোস্টারের ৩১৫০০ টি কপির সরাসরি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেন।
(পৃ:-১০৬)

তথ্য

তথ্য বিভাগ সংবাদপত্র ও অন্যান্য জনসংযোগ মাধ্যমের সাহায্যে সরকার ও জনগণের মধ্যে যোগসূত্র হিসাবে কাজ করে এবং বাংলাদেশে তার জনসাধারণ ও সরকারি কার্যকলাপ সম্বন্ধে সঠিক তথ্য সংগ্রহে দেশের ও বিদেশের সাংবাদিকদের সাহায্য করে থাকে।
আলোচ্য বছরে তথ্য বিভাগ দেশের দৈনিক সংবাদপত্র এবং সাপ্তাহিক, অর্ধ সাপ্তাহিক ও অন্যান্য সাময়িক পত্র পত্রিকার জন্য প্রতি মাসে গড়ে ১৫০ টি ইশতেহার, ৯০ টি বেসরকারি ইশতেহার, তিনটি বিশেষ প্রবন্ধ রচনা, ২০০ টি আলোকচিত্র সরবরাহ করে। এছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাজকর্মের প্রচার ছিল তাদের নিয়মিত কাজ। তথ্য বিভাগ এ বছরে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর ৩৬ টি সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করে। দেশ ও বিদেশের ২৮৪ জন সাংবাদিক এবং ৭৫ জন টেলিভিশন, চলচিত্র ও স্থির আলোক চিত্রের ক্যামেরাম্যান এই বিভাগের সহায়তা পান। বিশিষ্ট বিদেশি অতিথিদের বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তাদের সফরের আলোকচিত্র সম্মিলিত অনেকগুলি অ্যালবাম উপহার দেওয়া হয়। ১৬ ই ডিসেম্বর জাতীয় দিবসের প্রাক্কালে তথ্য বিভাগ সংবাদপত্রগুলি কে ৩৬ টি বিশেষ নিবন্ধন দেয় এবং ঢাকাস্থ চারু ও কারু মহাবিদ্যালয়ে সপ্তাহব্যাপী এক আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে। প্রদর্শনীতে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, গণহত্যা, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পুনর্গঠন এবং এদেশের জীবন ও সংস্কৃতির ওপর ২৮ জন সুপরিচিত আলোকচিত্র শিল্পীর প্রায় ২৫০ টি আলোকচিত্র প্রদর্শনী হয়।

জনসংযোগ

জনসংযোগ বিভাগের কাজ হচ্ছে জাতীয় স্বার্থের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি উপর সেমিনার ও আলোচনা সভার আয়োজন, সরকারি ঘোষণা ও সিদ্ধান্ত সমূহ প্রচার, সরকারি কাজকর্মের প্রচার সম্পর্কিত হ্যান্ডবিল এবং প্রদর্শন ও বিতরণ এবং গুরুত্বপূর্ণ সরকারি নীতি ও বিষয় সম্পর্কে বক্তৃতা মূলকথা তৈরি ও প্রচার করা। এছাড়া, এই বিভাগ বিভিন্ন তথ্য কেন্দ্রে জনসাধারণকে পড়াশোনার সুযোগ সুবিধাও দিয়ে থাকে।
১৯৭৩ সালে জনসংযোগ বিভাগ সারাদেশে জাতীয় বিষয়াদির ওপর ২৩,৩৩৭ টি বিশেষ আলোচনা সভার আয়োজন করে এবং বিভাগীয় কর্মকর্তাগণ বিভিন্ন স্থানের মোট ৩১৬৮ টি জনসভায় বক্তৃতা দেন। এছাড়া, বিভিন্ন জনসভায় এবং গ্রামাঞ্চলে ৪৩৮৭ টি ঘোষণা প্রচার করা হয়। আলোচ্য বৎসরে এ বিভাগ প্রকাশনা বিভাগ থেকে সরবরাহ কৃত পুস্তিকা ও পোস্টারের ৬,৩৫০২৪ কপি জেলা ও মহকুমাসমূহে বিতরণ ও প্রদর্শন এবং ২১টি বিষয়ের ওপর বক্তৃতার মূলকথা তৈরি করে সারাদেশে প্রচার করে।
(পৃ:-১০৭)

১৯৭৩ সনে এই বোর্ড এ দেশে নির্মিত ৬৩ টি চলচ্চিত্র সেন্সর করে। এগুলির মধ্যে ছিল বাংলা, ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় নির্মিত ফিচার, ট্রেইলার এবং প্রচারমূলক চলচ্চিত্। এছাড়া, বাংলাদেশে অবস্থিত ৭টি বিদেশী দূতাবাসের ১৫৯ টি চলচ্চিত্রও এই বোর্ড পরীক্ষা ও অনুমোদন এবং অবাণিজ্যিক ও অপ্রেক্ষামূলক রূপে প্রদর্শনের জন্য অনুমোদন প্রদান করে। এগুলির মধ্যে ছিল ফিচার, প্রামাণ্য ও সংবাদচিত্র। অধিকন্তু, ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শনের জন্য প্রেরিত ৪৬ টি বিদেশী ফিচার, প্রামাণ্য চিত্র ইত্যাদি সেন্সর করে। সেন্সর ফী, প্রদর্শন ফী, ইত্যাদি বাবদ বোর্ডের আয় হয় ৮১,৫৭৪ টাকা। এছাড়া, বোর্ড লাইসেন্স দানের প্রতিষ্ঠার রূপে তার নিয়মিত কাজ হিসাবে সারা দেশের সিনেমা হল ও অপারেটর লাইসেন্স প্রদান ও নবায়ন করে।

চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন

চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৭ সনের চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন আইনের বলে। এই উদ্দেশ্য ছিল বর্তমানে বাংলাদেশ নামে পরিচিত এ অঞ্চলে চলচ্চিত্র শিল্পের বিকাশ ও উন্নয়ন সাধন।
১৯৫৮ সালে কর্পোরেশনের প্রথম স্টুডিও নির্মিত হয় এবং ফিচার চিত্র মুক্তি পায় ১৯৫৯ সালে।
তারপর থেকে চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন এর সুযোগ সুবিধা যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে আভ্যন্তরীণ শুটিংয়ের জন্য কর্পোরেশনে ৪টি আধুনিক সাউন্ড স্টেজ, সংগীত ও তার ব্যঞ্জনার রেকর্ডিং ও পুনঃ রেকর্ডিং এবং চলচ্চিত্র প্রদর্শনের জন্য ২টি সাউন্ড স্টুডিও এবং সম্পাদনা সংগ্রামের বিভিন্ন প্রক্রিয়া সাধন, রঙিন ও সাদাকালো উভয় ধরনের চিত্রের আলোক সংক্রান্ত কাজ (অপটিক্যালস) ইত্যাদির জন্য আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। সাউন্ড স্টেজ গুলি বি-এন-সি এবং এন-সি মিচেল ক্যামেরা ও এ্যারিফেক্স ক্যামেরা দ্বারা সজ্জিত। এ্যারিফেক্স ক্যামেরা সজ্জিত পাঁচটি বহি দৃশ্যধারণ ইউনিটও রয়েছে। এছাড়াও আছে চিত্রের পশ্চাৎ প্রক্ষেপণ ও ১৬ মিলি মিটার এ রুপান্তরিত করবার সুযোগ সুবিধা। ১৬ মিলিমিটারে শুটিং পরিচালনার সাজ-সরঞ্জামও স্টুডিওতে রয়েছে। স্টুডিওর সুযোগ-সুবিধা আরও বৃদ্ধি করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থার বর্তমান উৎপাদনক্ষমতা হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ টি পূর্ণাঙ্গ ফিচার ও প্রামাণ্য চিত্র।
এই সংস্থার স্টুডিও গুলির সর্বাধিক বার্ষিক উৎপাদনশীল বছরে ৪০ টি পূর্ণাঙ্গ ফিচার চিত্র। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর ২ বৎসরে সংস্থার স্টুডিও গুলি থেকে ৫০ টি পূর্ণাঙ্গ ফিচার চিত্র নির্মিত হয়। ১৯৭৪ সালে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

মুদ্রণে : এ্যাবকো প্রেস

ইউনিকোড – সংগ্রামের নোটবুক, ২০২১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!