You dont have javascript enabled! Please enable it!

জাতীয় গান জাতির কথা- সব দেশেই

বিশেষ প্রতিনিধি 

“আমার সােনার বাংলা” তারপরে আরও কথা। আরও সুর। পুরাে উদ্ধৃতির প্রয়ােজন নেই। রবীন্দ্রনাথের এই গান প্রত্যেক বাঙালির মুখস্থ। যিনি সব কথা জানেন না, তিনিও গানটি জানেন। অর্থাৎ এই গানের ভাবটি। পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধারা নাকি এটিকেই গ্রহণ করেছেন জাতীয় সংগীত হিসাবে। ইকবালের কবিতা, নয়, বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত বাংলার কবি রবীন্দ্রনাথের “আমার সােনার বাংলা!”

সােনার বাংলায় হানাদার নেমেছে। তাদের হাতে খােলা তলােয়ার, জ্বলন্ত মশাল। রুখে দাঁড়িয়েছেন বাঙালি। শুধু রণধ্বনি নয়, এই মুহূর্তে চাই তার হৃদয়ের গান, জাতীয় সংগীত।পৃথিবীর সব মানুষেরই ধর্ম তাই। জাতির মনের আবেগ ভাষা পায় জাতীয় সংগীতে। জাতীয় সংগীতের জন্ম তাই অনেক সময় আকস্মিক, তাৎক্ষণিক। আনন্দের মূহুর্তে হাসির মতাে, যন্ত্রণার মুহূর্তে কান্নার মতাে জাতীয় সংগীতের জন্ম জাতির বিশেষ ভাব-মুহূর্তে। বিপ্লবের কালের কথা। স্ট্রাসবারগ-এর মেয়র আক্ষেপ করে বলছিলেন- আহা, এসময়ে ফরাসীদের যদি একটা জাতীয় সংগীত থাকত! কথাটা ইঞ্জিনীয়ার বাহিনীর একজন ক্যাপটেন-এর কানে গেল। নাম তাঁর-ক্লড রজেট। এক রাত্রি জেগে তিনি রচনা করলেন বিখ্যাত সেই গান- “মার্সাই” ১৭৯২ সনের এপ্রিলে এক রাত্তিরে সেই সংগীত রচিত। সূরও আমেচার সেই ইঞ্জিনীয়ারের!

ঠিক তেমনই আমেরিকার জাতীয় সংগীত “দি স্টার স্পেঙ্গলড ব্যানার ও একজন অ্যামেচারের রচনা। এই গানের রচয়িতা ফ্রানসিস স্কট কে পেশায় একজন আইনজীবী। ১৮১৪ সনে অত্যন্ত আকস্মিকভাবে তাঁর মাথায় আসে এই গান। ইংরাজদের সঙ্গে আলােচনার জন্য তিনি তাদের একটি রণতরীতে গিয়েছিলেন। সেই রাত্র সেই জাহাজ থেকেই প্রবল গােলাবর্ষণ। কে পরদিন সকালে তাকিয়ে দেখেন এত গােলাগুলি সত্ত্বেও দূরে উড়ছে তারকা খচিত মারকিন পতাকা। জন্ম নিল এই গান। অনেক জাতীয় সংগীতের ইতিবৃত্ত এখনও রহস্যে ঘেরা। রাশিয়ার জাতীয় সংগীত “ইনটার ন্যাশনাল”-এর রচয়িতা আমরা জানি ই পােটিয়ার কিন্তু কার লেখা ইংরাজের বিখ্যাত সঙ্গীত “গড সেভ দি কিং”? দাবিদার একাধিক। তর্ক, যতদূর জানি এখনও অমীমাংসিত।

সেদিক থেকে আমরা ভাগ্যবান জাতি। আমরা ভারতীয়েরা, এবং বাংলাদেশের সন্তানেরা। বিরাট তহবিল আমাদের স্বদেশী গানের। বঙ্কিমচন্দ্র বন্দে মাতরম” রচনা করেন ১৮৭৫ সনে। এই অপূর্ব সংগীত “আনন্দমঠে” প্রকাশিত হয় ১৮৮২ সনে। তার পর থেকে বাংলায় অজস্র স্বদেশী কবিতা আর গান। তবে স্বদেশী গানের সুবর্ণ যুগ বলা চলে- বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের বছরগুলাে। বাংলা ১৩১২, খ্রীষ্টীয় ১৯০৫ সনের অক্টোবরে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সূচনা। কিন্তু স্বদেশী যুগ কার্যত শুরু হয়ে গেছে আরও কমাস আগে, সে বছরই আগস্ট মাসে বয়কট আন্দোলন। সে ঝড়ের অন্যতম কেন্দ্র জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি। আর সেই প্রবল ঝঞ্জার গীতিকার-রবীন্দ্রনাথ। তাঁর কলমের ডগায় স্বদেশী গানের প্লাবন। প্রভাতকুমার মুখােপাধ্যায় লিখেছেন- “রবীন্দ্রনাথ এই আন্দোলনের মধ্যে আসিয়া বাঙালি যুবককে নৃতন শক্তিদান করিলেন- জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়া। এই মাসে ‘ভাণ্ডারে’র (ভাদ্র-আশ্বিন সংখ্যার প্রথম ভাগ ১৩১২) যে-কবিতা ও গানগুলি প্রকাশিত হইয়াছিল, আমরা কেবলমাত্র তাহার তালিকাটি দিলাম। সে তালিকায় এবার তাের মরা  গাঙে বান এসেছে”, “যদি তাের ডাক শুনে কেউ না আসে” থেকে শুরু করে “আজ বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি এবং বাংলার মাটি বাংলার জল প্রকাশিত হয়েছিল অন্যত্র। তবে রচনা একই কালে, বাঙালি জাতীয়তার ভােরে। 

 জাতীয় সংগীতে জাতির গৌরব-কাহিনী প্রকাশিত হয় (যথা-এক-কালের জারমান জাতীয় সংগীত“ডয়েসল্যানড! ডয়েসল্যানস!…” বা নরওয়ের জাতীয়-সঙ্গীত যার প্রথম ছত্রের ইংরাজী অনুবাদ- “ইয়েস, উই লাভ দিস কাট্রি!”)। জাতীয়-সংগীত কখনও কখনও আবার রণ সংগীত। বলা নিপ্রয়ােজন, “আমার সােনার বাংলা” সে-জাতীয় রণ সংগীতের পর্যায়ে পড়ে না। এগান ভালবাসার গান। দেশকে ভালবাসার। শান্তিদেব ঘােষের মতে এই গানটি বাউল কবি “গগন হরকরা”র “আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে”-গানটির আদলে লেখা। তিনি আরও লিখেছেন- “খাটি বাউল ও অন্যান্য পল্লী গানে জাতীয় সংগীতের মতাে উন্মাদনার বাণী থাকে না। তাদের আদর্শ সম্পূর্ণবিপরীত।…গুরুদেবই প্রথম পল্লীগান এ ধারার পরিবর্তন ঘটিয়েছেন।”

“আমার সােনার বাংলা বাংলার নিজস্ব গান। সুরে স্বদেশী। জন্মে স্বদেশী। ভাবে স্বদেশী। “আমার সােনার বাংলা” তাই বাংলাদেশের জাতীয় গান।

আনন্দ বাজার : ২.৪.১৯৭১

Reference:

গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – মুনতাসীর মামুন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!