You dont have javascript enabled! Please enable it! কংগ্রেসে নীতিগত অন্তর্বিরােধ : যথারীতি গান্ধি-প্রাধান্য - সংগ্রামের নোটবুক

কংগ্রেসে নীতিগত অন্তর্বিরােধ : যথারীতি গান্ধি-প্রাধান্য

তিরিশের দশকের শেষ দিকে বঙ্গীয় মুসলিম রাজনীতিতে অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী চেতনার যে ইতিবাচক সম্ভাবনার প্রকাশ ঘটে তার মধ্যমণি হতে পারতেন এ কে ফজলুল হক। কিন্তু নানা প্রতিকূল ঘটনার প্রভাব এবং হক সাহেবেরও কিছু ভুল পদক্ষেপ সে সম্ভাবনা চিরতরে নষ্ট করে দেয়। কথাটা প্রসঙ্গেক্রমে ইতিপূর্বে একাধিক সূত্রে উল্লিখিত । তবু স্মরণ করার মতাে, ওই নির্বাচন উপলক্ষে প্রজাপার্টির লাঙল মার্কা বাক্সে ভােট দেয়ার জন্য নজরুলের কবিতা সামান্য পালটে নিয়ে বঙ্গবাসী চাষিদের কষে লাঙল ধরে জেগে ওঠার গান সত্যই ছিল নবজাগরণের সম্ভাবনাময়। এ সুত্রে আমরা স্মরণ করতে পারি হক সাহেবের রাজনৈতিক পত্রিকা ‘নবযুগ’ ও তার সম্পাদক কবি নজরুলের উদ্দীপনার কথা। আমাদের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের আসনে প্রজাপার্টির প্রার্থী সৈয়দ আবদুল ওয়াহেদ বিশেষ কার্যকারদেপরাজিত হলেও ওই অজপাড়াগাঁয় লাঙল সাড়া ফেলেছিল। সেই বাঙালি মানসিকতার হক সাহেবকে কি না অবস্থা-বিপাকে মুসলিম লীগে যােগ দিয়ে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে নামতে হলাে? অবশ্য এর জন্য কংগ্রেসের দায়ও কম ছিল না। একটা কথা মানতেই হয় যে, কংগ্রেসের তাত্ত্বিক বক্তব্যে ও কাজে যথেষ্ট ফারাক দেখা গেছে বিভিন্ন সময়ে, বিশেষ করে ক্রান্তিকালে। কথাটা পরােক্ষে স্বীকার করেছেন মাওলানা আবুল কালাম আজাদ তার। আত্মজৈবনিক গ্রন্থে।

১৯৪০ সালের মার্চে রামগড়ে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস। অধিবেশনে দলের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর তার ভাষণের মর্মার্থ ছিল খুবই আদর্শবাদী ধারার । যেমন সেখানে বলা হয়, ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সমতা ও সমঝােতা সৃষ্টি করতে না পারলে সাম্প্রদায়িক সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করা যাবে না। সংবিধান অবশ্যই… জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে রচিত কিন্তু জাতীয় ঐক্য কংগ্রেস তৈরি করতে পারেনি। কখনাে নিজের ভুল পদক্ষেপে, কখনাে জিন্নার গোঁয়ার্তুমিতে। এসব নিয়ে কংগ্রেস শিবিরেও যে মতভেদ ছিল তা স্পষ্টই বােঝা যায় আজাদের স্বীকারােক্তিতে। মতভেদ  আদর্শগত বিচারে ডান-বামে, কখনাে গান্ধি-নেহরু, গান্ধি-চিত্তরঞ্জন, কখনাে গান্ধি-সুভাষের মধ্যে। মুসলিম লীগে জিন্নার মতাে গান্ধিও ছিলেন কংগ্রেসে অঘােষিত একনায়ক যদিও একটু ভিন্নধারায় উদ্ধত, জেদি ভঙ্গিতে নয় নম্র কিন্তু নিজস্ব কায়দার দৃঢ়তায় । ফলাফল একই। অহিংসা নিয়ে গান্ধির ‘অবসেশন’ অনেক সময় সমস্যা তৈরি করেছে। যেমন ১৯৪০ সালে বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তিকে সমর্থন জোগানাে নিয়ে গান্ধির অপরিবর্তনীয় মতামত। যুদ্ধটা ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে হওয়ার কারণে ব্রিটেনকে নিয়ে ভারতের যে প্রগাঢ় সমস্যা সে সমস্যা নিয়ে কংগ্রেসের বিপর্যস্ত অবস্থায় তার সমাধানে মাওলানা আজাদের বক্তব্যে ছিল বাস্তবধর্মী দূরদর্শিতা। যেমন, তার ভাষায়, ‘আমার মতে স্বাধীনতার জন্য অভ্যন্তরীণ সংগ্রাম এবং আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাইরের সংগ্রাম মূলত আলাদা।’ অর্থাৎ আলাদাভাবে দুটো সংগ্রামে অংশ নেয়া।

বাস্তবিক এ দুটো সংগ্রাম উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আলাদা ধরনের ছিল। দুটোই দুভাবে চলতে পারে। কিন্তু তখন আমাদের মতাে তরুণদের ও সাধারণ কংগ্রেস সমর্থকদের ঝোক ছিল ব্রিটিশবিরােধী সর্বাত্মক লড়াইয়ের। যে নীতির প্রয়ােগ চলেছে বিশ্বযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতেও। যেমন-নেহরুর রােমান্টিক আবেগপূর্ণ বক্তব্যের উদ্দীপনায়, তেমনই সুভাষের তেজোদৃপ্ত স্বাধীনতার আহ্বানে। বিশ্বযুদ্ধের বাস্তবতায় কর্মসূচি নির্ধারণের চেষ্টা সে ক্ষেত্রে কংগ্রেসের ছিল না । ছিল না গান্ধির প্রভাবে। এমনকি আঁজাদও অহিংসপন্থার অনুসারী হন, সম্ভবত সহকর্মীদের ঐকমত্যের কারর্গে বা চাপে। মনে পড়ছে মহকুমা শহরে আমাদের ছাত্রবন্ধুদের মধ্যে গান্ধি-কংগ্রেস ও সুভাষপস্থার বিভাজনের কথা । মৃণাল খুব আবেগভরে বক্তৃতার ঢঙে বলেছিলমাওলানা আজাদও বাপুজির সঙ্গে একমত।’ বাপুজি মানে গান্ধিজী। বাঙালি সন্তানের কী অসীম ভক্তি গান্ধির প্রতি! আজাদের চেষ্টা ছিলাে দলের সঙ্গে মানিয়ে চলা । যখন পারেন নি, নীরব থেকেছেন । তবু ভিন্নমতের প্রকাশ ঘটেছে কোনাে কোনাে ক্রান্তিক্ষণে। আজাদের ভিন্নমত কী নেহরুর, কী গান্ধির বিপরীতে হালে পানি পায়নি। এসব কারণেই বুঝি তার আত্মজীবনীর অংশবিশেষ দীর্ঘকাল প্রকাশের অপেক্ষায় অন্ধকার কুঠুরিতে বন্দি থাকে। সেটা প্রধানত নেহরুর কিছু ভুল রাজনৈতিক পদক্ষেপের বিপরীতে ভিন্নমতের কারণে।  তবে আত্মজীবনীতে প্রকাশ্যে আজাদ লিখেছেন, ‘আগে আমাদের (গান্ধি ও আজাদ-লেখক) মধ্যে শুধু নীতিগত প্রশ্নেই মতানৈক্য ছিল, কিন্তু এখন দেখা গেল, ঘটনাবলী বিশ্লেষণের ব্যাপারেও তার আর আমার মধ্যে মতবিরােধের  আদর্শগত বিচারে ডান-বামে, কখনাে গান্ধি-নেহরু, গান্ধি-চিত্তরঞ্জন, কখনাে গান্ধি-সুভাষের মধ্যে। মুসলিম লীগে জিন্নার মতাে গান্ধিও ছিলেন কংগ্রেসে অঘােষিত একনায়ক যদিও একটু ভিন্নধারায় উদ্ধত, জেদি ভঙ্গিতে নয় নম্র কিন্তু নিজস্ব কায়দার দৃঢ়তায় । ফলাফল একই।

অহিংসা নিয়ে গান্ধির ‘অবসেশন’ অনেক সময় সমস্যা তৈরি করেছে  যেমন ১৯৪০ সালে বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তিকে সমর্থন জোগানাে নিয়ে গান্ধির অপরিবর্তনীয়। মতামত। যুদ্ধটা ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে হওয়ার কারণে ব্রিটেনকে নিয়ে ভারতের যে প্রগাঢ় সমস্যা সে সমস্যা নিয়ে কংগ্রেসের বিপর্যস্ত অবস্থায় তার সমাধানে মাওলানা আজাদের বক্তব্যে ছিল বাস্তবধর্মী দূরদর্শিতা। যেমন, তার ভাষায়, ‘আমার মতে স্বাধীনতার জন্য অভ্যন্তরীণ সংগ্রাম এবং আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাইরের সংগ্রাম মূলত আলাদা।’ অর্থাৎ আলাদাভাবে দুটো সংগ্রামে অংশ নেয়া। বাস্তবিক এ দুটো সংগ্রাম উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আলাদা ধরনের ছিল । দুটোই দুভাবে চলতে পারে। কিন্তু তখন আমাদের মতাে তরুণদের ও সাধারণ কংগ্রেস সমর্থকদের ঝোক ছিল ব্রিটিশবিরােধী সর্বাত্মক লড়াইয়ের । যে নীতির প্রয়ােগ চলেছে বিশ্বযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতেও। যেমন নেহরুর রােমান্টিক আবেগপূর্ণ বক্তব্যের উদ্দীপনায়, তেমনই সুভাষের তেজোদৃপ্ত স্বাধীনতার আহ্বানে। বিশ্বযুদ্ধের বাস্তবতায় কর্মসূচি নির্ধারণের চেষ্টা সে ক্ষেত্রে কংগ্রেসের ছিল না । ছিল না গান্ধির প্রভাবে। এমনকি আজাদও অহিংসপন্থার অনুসারী হন, সম্ভবত সহকর্মীদের ঐকমত্যের কারণে বা চাপে। মনে পড়ছে মহকুমা শহরে আমাদের ছাত্রবন্ধুদের মধ্যে গান্ধি-কংগ্রেস ও সুভাষপস্থার বিভাজনের কথা। মৃণাল খুব আবেগভরে বক্তৃতার ঢঙে বলেছিল‘মাওলানা আজাদও বাপুজির সঙ্গে একমত।’ বাপুজি মানে গান্ধিজী। বাঙালি সন্তানের কী অসীম ভক্তি গান্ধির প্রতি! আজাদের চেষ্টা ছিলাে দলের সঙ্গে মানিয়ে চলা। যখন পারেন নি, নীরব থেকেছেন। তবু ভিন্নমতের প্রকাশ ঘটেছে। কোনাে কোনাে ক্রান্তিক্ষণে। আজাদের ভিন্নমত কী নেহরুর, কী গান্ধির বিপরীতে হালে পানি পায়নি। এসব কারণেই বুঝি তার আত্মজীবনীর অংশবিশেষ দীর্ঘকাল প্রকাশের অপেক্ষায় অন্ধকার কুঠুরিতে বন্দি থাকে। সেটা প্রধানত নেহরুর কিছু ভুল রাজনৈতিক পদক্ষেপের বিপরীতে ভিন্নমতের কারণে।

তবে আত্মজীবনীতে প্রকাশ্যে আজাদ লিখেছেন, ‘আগে আমাদের (গান্ধি ও আজাদ-লেখক) মধ্যে শুধু নীতিগত প্রশ্নেই মতানৈক্য ছিল, কিন্তু এখন দেখা গেল, ঘটনাবলী বিশ্লেষণের ব্যাপারেও তার আর আমার মধ্যে মতবিরােধের  সৃষ্টি হয়েছে। এ উপলক্ষে ‘টাইমস’ ও ‘ডেইলি নিউজ’ পত্রিকার মন্তব্য : ‘গান্ধীজীর সঙ্গে কংগ্রেস নেতৃত্বের মতবৈষম্য ঘটেছে’ (ভারত স্বাধীন হলাে)। বিষয়টা যুদ্ধবিষয়ক। গান্ধির বিশ্বাস ‘যুদ্ধপরিস্থিতি এমন ঘােরালাে যে ভারতের সহযােগিতা পেতে তাকে স্বাধীনতা দেয়া ছাড়া ব্রিটিশ সরকারের অন্য কোনাে পথ নেই’। কিন্তু গান্ধির এ ধারণা যে সঠিক ছিল না পরবর্তী রাজনৈতিক ঘটনাবলী তার প্রমাণ। বাস্তবিক বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতি সমস্যাসঙ্কুল হলেও ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তখনাে সমঝােতামূলক স্বাধীনতার পক্ষে খুব একটা অনুকূল ছিল না। এর প্রধান কারণ ভারতবর্ষের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল লীগ-কংগ্রেসের মধ্যে ছিল প্রবল রাজনৈতিক বিরূপতা এবং সে সুবাদে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ঐক্যের অভাব। এ বাস্তবতা গান্ধি-কংগ্রেস পুরােপুরি বুঝতে না পারলে বা বুঝতে না। চাইলেও তকালীন কংগ্রেস সভাপতি মাওলানা আবুল কালাম আজাদ অনুধাবন করেছিলেন বলে মনে হয়। তাই তার বিশ্বাস জন্মে যে ইংরেজ ওই মুহূর্তে ভারতকে বড়জোর কিছু রাজনৈতিক সুযােগ-সুবিধা দিতে পারে, কিন্তু স্বাধীনতা কোনােমতেই নয় । অন্তত বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে তাে নয়ই।

এ কথার প্রমাণ মেলে যখন দেখা যায় দুবছর পর গান্ধির আহ্বানে সূচিত। ‘ভারত ছাড়’ (কুইট ইন্ডিয়া) আন্দোলনের প্রবলতা ভারতীয় ইংরেজ সরকার অবিশ্বাস্য পীড়নে দমন করে। ব্যাপক ধরপাকড়, নির্যাতন ও গুলি ফাঁসির সাহায্য নিতে সরকার পিছপায়নি। এমনকি আপস-আলােচনার ভিত্তিতে, এরপর ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অর্থাৎ ভারতকে কথিত স্বাধীনতা দিতে পুরাে পাঁচ বছর সময় লেগেছে। সময় ও ঘটনাবলী তখন শাসকশক্তির পক্ষেও ছিল না। পরে দেশজোড়া প্রবল নৈরাজ্য, চরম বিশৃঙ্খলা, নৌবিদ্রোহ, ভারতজুড়ে শ্রমজীবী ধর্মঘট এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচার নিয়ে হিন্দু-মুসলমান-নির্বিশেষে প্রবল সরকারবিরােধিতা সরকারের জন্য সঙ্কট তৈরি করেছিল। অবশ্য এর বিপরীতে ছিল ১৯৪৬ সালে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রক্তস্নান যা সামাজিক নৈরাজ্য। সৃষ্টির কারণ হয়ে ওঠে। এ উথাল-পাথাল অবস্থা বিশ্ববাসীরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কিন্তু ১৯৪০ সাল তেমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারেনি যে-কারণে শাসক ব্রিটিশরাজ পরাধীনতা থেকে ভারতকে মুক্তি দিতে পারে। সত্যি বলতে কী ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের বিপক্ষে বড় কারণ ছিল হিন্দুমুসলমান সম্প্রদায়ের পরস্পর বিরােধিতা, যা রাজনৈতিক অঙ্গনে বিশাল বাধা হয়ে দাড়ায়। ভাবতে অবাক লাগে, কংগ্রেসের বিদগ্ধ নেতাদের মধ্যে এই বাধার বিষয়টি যথাযথ গুরুত্ব পায়নি। তারা জিন্না-লীগের পেছনে অধিকাংশ  ভারতীয় মুসলমান জনতা, বিশেষ করে ছাত্রসমাজের ব্যাপক সক্রিয় সমর্থনের গুরুত্ব অনুধাবন করতে ব্যর্থ হন। এটা ছিল কংগ্রেসের জন্য পর্বতপ্রমাণ। রাজনৈতিক ভুল যে ভুলের খেসারত দিতে হয়েছে দেশবিভাগের মাধ্যমে। এ বিষয়ে তাদের অন্ধতা এমনই ছিল যে, যখন ব্রিটিশরাজের কল্যাণে ভারত বিভাগ ও পাকিস্তান সৃষ্টি নিশ্চিত, তখনাে কংগ্রেসের শীর্ষনেতাদের বিশ্বাস, পাকিস্তান গঠিত হলেও তা টিকবে না। এ ধরনের মতামত তাদের কারাে কারাে প্রকাশ্য বিবৃতিতে উচ্চারিত হয়েছে। সম্ভবত সেই জন্যই ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টে ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান গঠিত হওয়ার পর নানা প্রসঙ্গে পাকিস্তানের শীর্ষ নেতাদের নিয়মিত বলতে শােনা গেছে। পাকিস্তান টিকে থাকতেই এসেছে’ (পাকিস্তান হ্যাজ কাম টু স্টে)।

পাকশাসকদের মুখে এটা ছিল বাঁধা বুলি, বলা চলে আত্মবিশ্বাস জাগানিয়া জপমন্ত্র । এসব তাে অনেক পরের কথা। আমাদের উপলব্ধি হচ্ছে- কংগ্রেসে নীতিগত প্রশ্নে অন্তর্বিবাদ ও গান্ধিপ্রভাব এ দলের যতটা ক্ষতি করেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি করেছে ভারতীয় রাজনীতির। এক্ষেত্রে হিন্দিভাষী ভারতীয় বলয়ের প্রভাবই ছিল প্রধান। মাঝে মধ্যে বঙ্গীয় কংগ্রেস তাতে বাতাস দিয়েছে। বিশ্বযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সরকারকে সমর্থন করা না-করা বিষয়ে কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বে মতবিরোধ বিষয়টিকে জটিল করে তােলে। গান্ধি মনে হয় এ সময় তার চিন্তায় সুষ্ঠু সামঞ্জস্যবােধে ছিলেন না। থাকলে তিনি খােলাচিঠিতে ব্রিটিশরাজকে লিখতে পারতেন না যে, হিটলারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ পরিত্যাগ করে ইংরেজের উচিত আধ্যাত্মিক শক্তির সাহায্যে জার্মান ফ্যাসিস্টদের মােকাবেলা করা। কারণ অহিংসার মাধ্যমে প্রকৃত জয় সম্ভব । হাস্যকর এ চিঠি নিয়ে যশবন্ত সিং তার জিন্না বিষয়ক বইতে বেশ সরস ভঙ্গিতে আলােচনা করেছেন। মন্তব্য করেছেন মাওলানা আজাদও।

কংগ্রেস সভাপতি আজাদের মতামত ছিল এমন যে অহিংসা পন্থা হিসেবে ভালাে। কিন্তু প্রয়ােজনে বিকল্প সশস্ত্র যুদ্ধের পথও গ্রহণযােগ্য। এখানেই গান্ধির সঙ্গে তার গভীর মতবিরােধ ঘটে। এবং আশ্চর্য যে গান্ধির প্রভাবে কংগ্রেস হাইকমান্ডের নেতারা যেমন বল্লভভাই প্যাটেল, রাজাগােপালাচারি, রাজেন্দ্রপ্রসাদ প্রমুখ ডাকসাইটে নেতা গান্ধির যুদ্ধবিরােধী অহিংসনীতিতে মাথা মুড়িয়ে কংগ্রেস সভাপতিকে বিপাকে ফেলে দেন। এমনকি নির্বাহী কমিটি থেকে পদত্যাগের হুমকি দেন।  এটা গান্ধিবাদীদের চিরাচরিত পন্থা অর্থাৎ অসহযােগিতার মাধ্যমে বিজয়ীকে বা শক্তিমানকে পরাজিত করা । বিজয়ী সুভাষের বিরুদ্ধে তারা একসময় একই পদ্ধতি গ্রহণ করে তাকে পদত্যাগে বাধ্য করেছিলেন। তবে বর্তমান ক্ষেত্রে আজাদ কিছুটা কৌশলে, কিছুটা আপসে সঙ্কট থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে নিতে পেরেছিলেন। তাকে সুভাষের মতাে পদত্যাগ করতে হয়নি। এ ঘটনা জুলাই। ১৯৪০ সাল এবং পরবর্তী সময়ের। ভাইসরয় লিলিথগাের আগস্ট প্রস্তাবে আসলে কংগ্রেসের জন্য কোনাে ইতিবাচক উপকরণ ছিল না। বরং তাতে অঢেল সুবিধা ছিল জিন্না-লীগের জন্য। ভিন্নমতের পরিপ্রেক্ষিতে ভেটো দেয়ার ক্ষমতাও দেয়া হয় মুসলিম লীগকে, বিশেষ করে ভবিষ্যত সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে। এমন পরিস্থিতিতে কংগ্রেস ভাইসরয়ের আগস্ট প্রস্তাব অগ্রহণযােগ্য বলে ঘােষণা দেয়। শুধু তা-ই নয়, নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি যুদ্ধবিষয়ক ব্রিটিশ সহযােগিতা সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব গান্ধির হাতে তুলে দেয়। গান্ধি কংগ্রেসের শক্তি সঞ্চয়ের উদ্দেশ্যে শেষ পর্যন্ত তার একমাত্র অস্ত্র শান্তিপূর্ণ আইন অমান্য আন্দোলনের আশ্রয় নেন। তার ভাষায় এর লক্ষ্য, ভারতের স্বাধীনতা অর্জন নয়, বাকস্বাধীনতার অধিকার আদায়, এবং সে জন্য সত্যাগ্রহীর ব্যক্তিগত কারাবরণ যা অতীতে তার নির্দেশে কংগ্রেসকর্মী ও নেতারা করে এসেছেন। ডড নন   রপ্ প  ও এ ঘােষণা ৫ অক্টোবর, ১৯৪০ সালের। ব্যক্তিগত পর্যায়ে নেতাকর্মীদের আইন অমান্য ও কারাবরণ, যা গান্ধিবাদী বিনােবাভাবেকে দিয়ে শুরু। এরপর নভেম্বরে নেহরুর কারাবরণ । যুদ্ধকালীন জরুরি অবস্থায় বাকস্বাধীনতার ওপর। নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে গান্ধিবাদী সত্যাগ্রহ কংগ্রেসে শক্তি সঞ্চারে আদৌ সহায়তা করেছিল কি না তা ভেবে দেখার মতাে বিষয়। এভাবে ঘটনাবহুল ১৯৪০ সাল আপন তাৎপর্য নিয়ে শেষ হয়। 

সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক