বাংলার বাণী
ঢাকা: ৮ এপ্রিল রোববার, ২৫শে চৈত্র, ১৩৭৯
গণমুখী চিকিৎসা
স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। একথা সর্বজন-স্বীকৃত। দেহের সঙ্গে রয়েছে মনের গভীর সংযোগ। একে অন্যের পরিপূরক। যে কোন দেশে যে কোন সময়ই স্বাস্থ্যকে এ কারণেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও জীবিকার সংস্থানের মত স্বাস্থ্য যে কোন রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়নের শর্ত।
গতকাল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পঁচিশতম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপিত হয়েছে। এ উপলক্ষে প্রদত্ত বাণীতে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, বাংলাদেশের গণমুখী চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রবর্তন করার জন্য বাংলাদেশ সরকার স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে প্রত্যেক থানায় ডাক্তার পাঠানো হচ্ছে। ঘরে ঘরে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের কর্মীদের পাঠানো হচ্ছে। তারা যুগপৎ রোগ-ব্যাধির চিকিৎসা ও জন্ম-মৃত্যু নিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন।
সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশ গণমুখী চিকিৎসা প্রবর্তনের চেষ্টা যে সরকার করছেন এতে কোন সন্দেহ নেই। ইতিপূর্বে এ সম্পর্কিত পরিকল্পনা পেশ করা হয়েছে। তবু এ প্রসঙ্গে বলতে হয় যে, বিগত চব্বিশ বছরের পাকিস্তানি শাসন ও শোষণের ফলে এদেশের মানুষের জীবনে যে দারিদ্রের অভিশাপ নেমে এসেছে তারই প্রভাবে সামগ্রিকভাবে আমাদের সমাজ জীবনে সৃষ্টি হয়েছে বিপর্যয়। অশিক্ষা কুশিক্ষা অনাহার আর রোগ-শোক-জরা-ব্যাধি হয়েছে আমাদের নিত্যসঙ্গী এমনতো অবস্থায় সহজে পর্বত প্রমাণ প্রতিবন্ধকতাকে অপসারণ করা যাবেনা।
সেজন্য চাই সুষ্ঠু ও বাস্তবসম্মত সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও কর্মসূচি। প্রথমেই প্রয়োজন ডাক্তারের সংখ্যা বৃদ্ধি। যারা শহর ছাড়িয়ে গ্রামবাংলার অন্ত-প্রত্যন্তে যাবেন। অসুস্থ রুগ্ন অবহেলিত গ্রাম বাংলার মানুষ রোগব্যাধির হাত থেকে যাতে রেহাই পায় সে চেষ্টা চালাতে হবে। এক কথায় চিকিৎসা ব্যবস্থা কে করতে হবে সহজলভ্য। সহজে যাতে বিনামূল্যে গ্রাম বাংলার মানুষ চিকিৎসার সুযোগ পায় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, শতকরা আশি ভাগ মানুষই গ্রামবাংলার অধিবাসী। যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে খাদ্য ফলায়। তাদের এই ঘামের বিনিময়ে অর্জিত হয় বৈদেশিক মুদ্রা। পাকিস্তানি আমলে এই গ্রাম বাংলার মানুষই বঞ্চিত হয়েছে সবচেয়ে বেশী। গণমুখী চিকিৎসার প্রথম ও প্রধান শর্তই হবে সেইসব অবহেলিত কৃষক শ্রমিক ভাইদের চিকিৎসার ব্যবস্থা কে সুনিশ্চিত করা। আমরা জানি একদিনে বা দুদিনে তা সম্ভব নয়। সেজন্য সময়ের প্রয়োজন। ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে আমাদের এগোতে হবে একথা সত্যি কিন্তু সে জন্য প্রয়োজন সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা এবং সে পরিকল্পনা যে কাগজপত্র মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে বৈকি। কবির ভাষায় বলতে হয়, সেই সব মূঢ় ম্লান মুখে যেমন ভাষার যোগান দিতে হবে তেমনি তাদের স্বাস্থ্যোজ্জ্বল পরমায়ুর জন্য আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে এবং তা যদি হয় তাহলে গণমুখী চিকিৎসা পরিকল্পনা সার্থক হবে, অন্যথায় নয়।
একলা চলার নীতি পরিহার করতে হবে
মিশরের প্রভাবশালী সাংবাদিক হাসানায়েন হেইকল সম্প্রতি তাঁর সম্পাদিত কায়রোর আধা-সরকারি দৈনিক আল-আহরামের এক সাপ্তাহিক কলামে মন্তব্য করে বলেছেন যে, আরব দেশগুলো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের প্রশ্নে কেন বিলম্ব করছে তার কোনো যৌক্তিক কারণ তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। আল আহরাম সম্পাদক তার নিবন্ধে আরো প্রকাশ করেছেন যে, তিনি কিছুদিন পূর্বে যখন পাকিস্তান সফর করেন, তখন সেখানকার সংবাদপত্র সম্পাদকদের সঙ্গে এক বৈঠকেও জনাব হেইকল মন্তব্য করেছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিল আরব দেশগুলো স্বীকৃতি না দেয়ার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে। তিনি তার নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ধর্মীয় দিক থেকেও বাংলাদেশ আরব দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। আরব দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের ধর্মের দিক থেকে মিল থাকা সত্ত্বেও আরবদেশগুলো বাংলাদেশকে স্বীকৃতির প্রশ্ন গড়িমসি করছে বলে জনাব হেইকল মন্তব্য করেছেন। আল-আহরাম সম্পাদক জনাব হেইকল সুস্পষ্ট ভাষায় অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, আরব দেশগুলোকে বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দান করা উচিত। তিনি বলেছেন আমরা প্যালেস্টাইনের জনসাধারণকে যেভাবে সমর্থন করছি বাংলাদেশের বাস্তবতাকেও ঠিক সেইভাবেই স্বীকৃতি জানানো উচিত।
কিছুদিন পূর্বে আল-আহরাম সম্পাদক হাসানায়েন হেইকল বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান সফর করে গেছেন। তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহ অন্যান্য নেতৃবর্গের সাথে আলাপ আলোচনা করেছেন। এবং বাংলাদেশ ত্যাগ করার প্রাক্কালে তিনি স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়ে গিয়েছিলেন, আরব দেশগুলো যাতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য অনতিবিলম্বে এগিয়ে আসে সেজন্য তিনি আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবেন। জনাব হেইকল পাকিস্তান সফরের সময় মন্তব্য করতে দ্বিধা করেননি যে, বাংলাদেশের বাস্তবতাকে আরব দেশগুলোকে মেনে নেয়া দরকার।
আল আহরাম সম্পাদক হাসানায়েন হেইকল তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছেন। তিনি বাংলাদেশকে আরব রাষ্ট্রগুলোর যাতে অবিলম্বে স্বীকৃতি প্রদান করে, সেজন্য কলম ধরেছেন। বাংলাদেশের বাস্তবতাকে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করার পরে জনাব হেইকলের মত জাঁদরেল সাংবাদিক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানানোর জন্য আরব রাষ্ট্রগুলোর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন। এই আহবান এর মধ্যে বিবেক এবং শুভবুদ্ধির পরিচয় নিহিত রয়েছে বলেই আমাদের বিশ্বাস। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ইরাক, ইয়েমেন ও লেবানন দেশ ইতিমধ্যেই বাংলাদেশকে সানন্দে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু অন্যান্য আরব রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবো দিচ্ছে করে নানা রকম টালবাহানা অবতারণা করে চলেছে। কিন্তু এই টালবাহানা ব্যাপারে যে কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই, তা জনাব হেইকল নিবন্ধের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। আমরা আশা করি জনাব হেকলের যুক্তিবক্তার প্রতি লক্ষ্য করলে আরব রাষ্ট্রগুলোর চৈতন্যদয় হবে এবং আরব দেশগুলো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রশ্নে অনতিবিলম্বে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। জনাব হেইকলের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরাও উচ্চারণ করতে পারি যে, স্বীকৃতির প্রশ্নে কোনো রকম হেরফের থাকা উচিত নয়। তাছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেখানে বাংলাদেশের বাস্তবতাকে মেনে নিয়েছে, সেখানে আরব রাষ্ট্রগুলোর ‘একলা চলার নীতি বিশ্বভ্রাতৃত্ব’ বন্ধনে ব্যাপারে রীতিমত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। বাংলাদেশ টিকে থাকার জন্যই জন্ম নিয়েছে। অতএব, আজ হোক, কাল হোক আরব রাষ্ট্রগুলোকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানাতে হবেই তবে স্বীকৃতির কাজটা যত তাড়াতাড়ি সমাধান করা সম্ভব, ততই মঙ্গল।
খোলা বাজারে টি সি বি’র কাপড়
খোলা বাজারে টি সি বি’র কাপড় বিক্রি হচ্ছে। এ সম্পর্কিত একটি সংবাদ গতকালের বাংলার বাণীতে প্রকাশিত হয়েছে। খবরে প্রকাশ, বস্ত্র সংকট নিরসনের উদ্দেশ্যে জনগণের কল্যাণে জরুরী ভিত্তিতে টিসিবি কতৃপক্ষ যে কাপড় আমদানি করেছিল তার এক চতুর্থাংশ কাপড় সাধারণ মানুষের ভাগ্যে জোটেনি। কোন এক অশুভ মহলের তৎপরতায় পেছনের দরজা দিয়ে টিসিবি’র কাপড় উধাও হয়ে কাপড়ের দোকানগুলোতে স্থান পেয়েছে।
টিসিবি’র বস্ত্র কেলেঙ্কারি ও অভাব অভিযোগ সম্পর্কে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ইতিপূর্বে সংবাদ প্রকাশিত হওয়া সত্বেও কর্তৃপক্ষের আজও চৈতন্যেদয় হয়নি, বরং কেলেঙ্কারির মাত্রা চক্রবৃদ্ধিহারে বেড়েছে। ফলে ন্যায্যমূল্যে প্রাপ্য কাপড়তো জনগনের ভাগ্যে জোটেইনি উপরন্ত সেই কাপড় খোলা বাজারে সাত-আট টাকা গজের কাপড় তিরিশ টাকা গজে এবং চার টাকা ও ছয় টাকা গজের কাপড় সতেরো এবং আঠারো টাকায় করে কিনতে হচ্ছে।
কালোবাজারি, অধিকমুনাফালোভী ব্যবসায়ীর সংখ্যা সমাজে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সরকার এদেরকে দমন করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সরকারের এই সিদ্ধান্তকে জনগণ আশ্বাস পায়-ভবিষ্যত সুখের আশায়। কিন্তু সরকারের বক্তব্য যখন মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়, সরকার নিয়ন্ত্রিত দ্রব্য যখন প্রকাশ্যে খোলাবাজারে অধিক মূল্যে বিক্রি হতে দেখা যায় তখন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রতি জনগণের কিরূপ মনোভাব সৃষ্টি হয়? টি সি বি’র কাপড় খোলা বাজারে কি করে গেল? এ ব্যাপারে সরকারি কর্মকর্তাদের কোনো যোগাযোগ নেই বললে কি সরকার কর্মকর্তাদের ঢাকা পড়বে?
বিধ্বস্ত বাংলাদেশ আজ অন্ন-বস্ত্রের দারুণ অভাব। এই অভাব পূরণের জন্য বঙ্গবন্ধু ও তার সরকার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তার সহকারী অধঃস্তন কিছু সংখ্যক কর্মকর্তার স্বজনপ্রীতি এবং অনিয়মতান্ত্রিক কার্যকলাপের জন্য জনগণ সঠিকভাবে তাদের প্রাপ্য পাচ্ছেন না। আর এরই ফলে বঙ্গবন্ধুর সরকারের ভাগ্যের জুটছে কলঙ্কের কালিমা এবং এমনিতর কর্মকর্তাদের জন্য সরকারের অন্যান্য প্রকল্প হচ্ছে ব্যাহত। সুতরাং অধিক মুনাফালোভী, কালোবাজারি ব্যবসায়ীদের সাথে সাথে তাদের প্রতি সহযোগিতা প্রদানকারী সরকারি কর্মকর্তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। তা না করা হলে সমাজ থেকে সকল কলুষতা দূর হবে না। যে সর্ষে দিয়ে ভুত ছাড়ানো হবে সেই সর্ষে যাতে ভূত না থাকে সরকারকে সেইদিকে আরো অধিক মনোযোগ দিতে হবে, আরো কঠোর হতে হবে। জনগণের সাথে আমাদেরও বঙ্গবন্ধুর সরকারের কাছে সেই প্রত্যাশা।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক