You dont have javascript enabled! Please enable it! লীগের গায়ে জোয়ারি হাওয়া বঙ্গ-পাঞ্জাবের দাক্ষিণ্যে - সংগ্রামের নোটবুক

লীগের গায়ে জোয়ারি হাওয়া বঙ্গ-পাঞ্জাবের দাক্ষিণ্যে

সত্যি, বঙ্গে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিপর্যয়ের কারণ যেমন ফজুলল হকের কিছু ভুল পদক্ষেপ তেমিন কংগ্রেসের রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা আর লীগপ্রধান মােহাম্মদ আলী জিন্নার রাজনৈতিক চাতুর্যের কূটকৌশল। এক্ষেত্রে বুদ্ধির দৌড়ে কংগ্রেসের তথা গান্ধি-নেহরুর হার জিন্নার কাছে। জিন্না খুবই সুকৌশলে উপঢৌকন সামনে রেখে ‘শেরে-বঙ্গাল’কে খাচায় পুরেছিলেন। রাজনৈতিক টানাপড়েনে ক্ষুব্ধ, বিভ্রান্ত, সর্বোপরি উচ্চাকাঙ্ক্ষী ‘শের’ সেটা বুঝতে পারেননি। ফলে যা ঘটার তাই ঘটেছে। এভাবে বঙ্গীয় রাজনীতিতে বিপরীত ধারায় ইতিহাস তৈরি হয়। তাই বলতে হয় রাজনীতির ক্ষেত্রে সুবিধাবাদ ফজলুল হকের যতটা ক্ষতি করেছে অন্য কিছু ততটা করতে পারেনি। পারেনি অন্য কোনাে রাজনৈতিক মহাজনের এতটা ক্ষতি করতে । বরং কেউ কেউ সুবিধাবাদের সিঁড়িতে পা রেখে দ্রুত উপরে উঠে গেছেন । হক সাহেবের রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল মুসলিম লীগে যােগদান এবং তার রাজনৈতিক অস্তিত্বের ভিত কৃষক প্রজাপার্টিকে মুসলিম লীগের সঙ্গে একাকার করে দেয়া। একই ভুল করেন আরেক মুসলমানপ্রধান প্রদেশ পাঞ্জাবের জাতীয়তাবাদী। নেতা সিকান্দার হায়াত খান। একইভাবে মুসলিম লীগে যােগ দিয়ে তার পার্টিকে লীগের সঙ্গে একাকার করেন। সিকান্দার হায়াত কিন্তু মুসলিম লীগের চরিত্র জানতেন যা তার কিছু কথাবার্তা থেকে বােঝা যায়। জানতেন একনায়ক জিন্নাকেও। তবু কিসের টানে চতুর জিন্নার পাতা ফাঁদে পা দিলেন? পাঞ্জাব প্রদেশে তার তাে একচেটিয়া বিজয়, হক সাহেবের মতাে মন্ত্রিসভা গঠনের সমস্যা তার ছিল না। তবু কেন জেনেশুনে বিষপান? এসব হলাে রাজনৈতিক অঙ্গনের বিচিত্র ঘটনাবলীর রহস্য, যে রহস্যের জবাব কখনাে মেলে, কখনাে মেলে না।

পাঞ্জাবের ঘটনা সত্যি দুর্বোধ্য । কারণ সিকান্দার হায়াতের ইউনিয়নিস্ট পার্টির ছিল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা। আর জিন্নার মুসলিম লীগ নির্বাচনে সেখানে  ভালাে ফল দেখাতে পারেনি। পারেনি ধর্মের জিগির তুলেও। তবু জাতীয়তাবাদী চেতনার অর্জন কেন জিন্না- লীগের ধর্মীয় রক্ষণশীলতার হাতে তুলে দিলেন সিকান্দার? এর একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন এইচ ভি হডসন। তার মতে, সেসময় ভারতীয় রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক চেতনার ক্রমবর্ধমান উত্থান এবং পাঞ্জাবে তার অনুসারীদের মধ্যে আলােড়ন লক্ষ্য করে ভবিষ্যৎ বিপর্যয়ের আশঙ্কায় নিজের মুখ্যমন্ত্রিত্ব ও দলের জনপ্রিয়তা রক্ষার জন্যই সিকান্দার হায়াত দলের সবাইকে মুসলিম লীগে যােগ দিতে আহ্বান জানান। এ ব্যাখ্যা স্যার পেন্ডেরেল মুন নামীয় সিভিলিয়ানের লেখা দেশবিভাগ বিষয়ক “ডিভাইড অ্যান্ড কুইট’ গ্রন্থে মিলবে। এ ব্যাখ্যায় মূল প্রশ্নের জবাব মেলে না। ভাবতে অবাক লাগে, সিকান্দার হায়াতের মতাে একজন বুদ্ধিমান রাজনীতিক নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েও ভবিষ্যৎ আশঙ্কায় এভাবে আত্মহত্যার দলিলে বা সর্বনাশের দাসখতে সই করবেন কেন? অবশ্য একথাও। ঠিক যে তখন হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলােতে কংগ্রেস মন্ত্রিসভার একনায়কী আচরণ নিয়ে অভিযােগ উঠতে থাকে এবং জিন্নার ক্রমাগত প্রচারণায় ভারতীয় শিক্ষিত মুসলমান সমাজে এর প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। কিন্তু তাই বলে দলের অস্তিত্ব নাশ?

শুধু কংগ্রেস সভাপতি জওহরলাল নেহরুই নন, গান্ধির বক্তব্যেও ভারতে কংগ্রেসদলীয় একনায়কত্বের আভাস মেলে, যেখানে বলা হয় ভারতে ব্রিটিশ রাজ’ রাজনৈতিক বিষয়ে আলােচনা করতে পারে তেমন একটি দলই রয়েছে আর তা হলাে জাতীয় কংগ্রেস (গান্ধি সেবাসংঘে বক্তৃতা, ২৫ মার্চ, ১৯৩৮)। একই কথা লেখেন হরিজন’ পত্রিকায়ও। গান্ধির মতাে দূরদর্শী রাজনীতিবিদ যে কেন ও কী ভেবে বাস্তবতা অস্বীকার করেন তা বােঝা কঠিন। সত্যি ভারতীয় রাজনীতির দুর্ভাগ্য যে রাজনৈতিক দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ দুই দুটো সময়পর্বে নেহরু কংগ্রেসের সভাপতি। এবং সভাপতির একাধিক বক্তব্য ও পদক্ষেপ ভারতবর্ষকে বিভাজনের দিকে ঠেলে দেয়। দ্বিতীয় সময়পর্ব সম্বন্ধে আজাদ তার বইতে স্পষ্টই বলেছেন যে সেসময় সভাপতির পদ গ্রহণ। করতে অস্বীকৃতি জানানাে তার পক্ষে ছিল বিরাট ভুল । সেকুলার রাজনীতি সে ভুলের মাশুল গুনেছে । গুনেছে উপমহাদেশের মানুষ রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে, নির্যাতনের শিকার হয়ে। এমন কি ছিন্নমূল উদ্বাস্তু হয়ে।  কংগ্রেসের এ জাতীয় কিছু ভুল পদক্ষেপে ভারতীয় রাজনীতির জল ঘােলা হতে থাকে। শুধু বিবৃতিতে নয়, কাজেকর্মেও। যেমন হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তরপ্রদেশ ও বােম্বাইয়ে মুসলিম লীগের সঙ্গে ‘কোয়ালিশন সরকার গঠনের প্রস্তাব কংগ্রেস পক্ষ থেকে এমনভাবে নাকচ করা হয় যাতে রাজনৈতিক  অসৌজন্যই প্রকাশ পেয়েছে। প্রস্তাবের জবাবে কংগ্রেস পক্ষ থেকে অনেক শর্তের মধ্যে আরাে বলা হয় যে সে ক্ষেত্রে মুসলিম লীগকে তার দলীয় সত্তা বিসর্জন দিয়ে মন্ত্রিসভায় যােগ দিতে হবে। এ কার্যক্রমের সমালােচনা করেছিলেন শরৎ বসু। | ফজলুল হক, সিকান্দার হায়াত যা করতে পারেন জিন্না নিজ স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে তা করতে পারেন না। তার ধাতই আলাদা। দরকার হলে সুসময়ের জন্য তিনি দীর্ঘকাল অপেক্ষা করবেন, কিন্তু কোনাে আত্মঘাতী পদক্ষেপ নয়। তবে এটাও ঠিক যে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও স্বার্থসিদ্ধির জন্য জিন্নার মুসলিম লীগ যে কোনাে ধরনের যুক্তিহীন, অনৈতিক কাজও করতে পারত। পারত নয়, করেছেও, যেমন বিহারে কংগ্রেস শাসনের অভিযােগ সংবলিত ‘পীরপুর রিপাের্ট’। এ বিষয়ে নানা মত রয়েছে। তবে কংগ্রেস তাে বটেই, মাওলানা আজাদ ‘ভারত স্বাধীন হলাে’ শীর্ষক আত্মজৈবনিক রচনায় এ রিপাের্ট সঠিক নয় বলে মতামত প্রকাশ করেছেন।

আর একথাও ঠিক যে, নির্বাচনী জয়ে উৎফুল্ল কংগ্রেস সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে তার পায়ের নিচে জমি কতটা প্রশস্ত,কতটা শক্ত তা ঠিকঠাক মতাে মেপে নিতে পারেনি। পারেনি বলেই যত ভুলপ্রদক্ষেপ, যত অঘটন। সেজন্যই মুসলমান প্রতিক্রিয়া ও মুসলিম লীগের জনসমর্থন, অন্ততপক্ষে জনসমর্থনের সম্ভাবনা পরিমাপে মস্ত ভুল করে বষে কংগ্রেস। ধর্মীয় প্রতীক, ধর্মীয় অনুষঙ্গ মুসলিম লীগের মতােই কংগ্রেসের মতাে সেকুলার সংগঠনে স্থান করে নেয়। বিশেষ করে ‘বন্দেমাতরম’ স্লেগান, উর্দুর স্থলে হিন্দির ভাষিক প্রভাব ইত্যাদিও নানাভাবে প্রভাব ফেলে। | এ সবের সুযােগ নেন জিন্না। রাজনীতি মন্থনে অমৃতের বদলে যে গরল উঠে। আসে তা ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা চালাতে থাকেন। সত্য-মিথ্যার ব্যাপক প্রচারণা তার কৌশল হয়ে ওঠে। পীরপুর রিপাের্টি, শরীফ রিপাের্ট” যে অতিরঞ্জিত তার প্রমাণ মেলে কংগ্রেস-বিরােধী ইংরেজ গভর্নরদের এমন মতামতে যে কংগ্রেস মন্ত্রিসভার কার্যক্রম মূলত সাম্প্রদায়িকতামুক্ত। তবে কংগ্রেসের জেলা ও গ্রামপর্যায়ের সদস্যদের মধ্যে কর্তৃত্বপরায়ণতার ঝোঁক ছিল যথেষ্ট (হডসন)। তা সত্ত্বেও আশ্চর্য যে এ জাতীয় রিপাের্টের ভিত্তিতে উত্তেজিত ফজলুল হক কংগ্রেস শাসনে মুসলিম দুর্দশার বিবরণ তুলে ধরে বক্তৃতায় সম্প্রদায়বাদী। চেতনার আবহ তৈরি করেন (ডিসেম্বর, ১৯৩৯)। অথচ এই কংগ্রেসের সঙ্গে (অবশ্য বঙ্গীয় কংগ্রেসের উদারপন্থীদের সঙ্গে) তার ওঠাবসা, হাঁটা চলা (যে মনােভাব বিভাগােত্তর সময়েও সজীব দেখা গেছে)। হডসনের লেখায়ও উল্লিখিত ঘটনাবলীকে অতিরঞ্জিত বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। 

অস্বীকার করা কঠিনই হবে যে ভারত বিভাগের পটভূমি বা পরিপ্রেক্ষিত রচনায় জাতীয় কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব বিশেষ করে গান্ধি-নেহরু-প্যাটেলের অবদান কম নয় । অন্য ভাষায় বলা যায়, এ পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় রাজনীতির দাবা খেলায় একক জিন্নার কাছে গান্ধি-নেহরুর হার এবং সেটা যতটা দেশবিভাগের বাস্তবায়নে তার চেয়ে বেশি সম্প্রদায়গত বিচ্ছিন্নতার কারণ তৈরিতে। সেক্ষেত্রে জিন্নাকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের ভুল চালের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলা ও পাঞ্জাবের মতাে দুটো বড়োসড়াে মুসলমানপ্রধান প্রদেশে লীগের প্রভাব বিস্তার। সেক্ষেত্রে যদি খলনায়ক নাও বলি, বলব বিভ্রান্ত দুই নায়ক একে ফজলুল হক ও সিকান্দার হায়াত খান। এ দুই ব্যক্তি ও রাজনীতিকের মধ্যে যথেষ্ট মিল তাদের রাজনৈতিক পদক্ষেপে। তেমনি মিল রাজনৈতিক সাংগঠনিক চরিত্রে। বলা হয়ে থাকে ভারত বিভাগে এ দুই প্রদেশের ভূমিকা সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। বাস্তবিকই তাই। এ দুই প্রদেশ ভারত বিভাগের দায় বহন করে বিভক্ত হয়েছে। হয়েছে সর্বাধিক রক্তস্নানের মধ্য দিয়ে। এবং ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিককার রাজনৈতিক বিবেচনায় এ দুইয়ের মধ্যে যথেষ্ট সাদৃশ্য। অথচ ভূ-প্রকৃতি, ভাষা-সংস্কৃতি ও জাতিগত বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় এ দুই প্রদেশ ও অধিবাসীর মধ্যে প্রভেদ সম্ভবত সর্বাধিক।  বঙ্গদেশ যদিও প্রধানত হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের জনগােষ্ঠী অধ্যুষিত, পাঞ্জাবে সে ক্ষেত্রে তিন প্রধান সম্প্রদায় মুসলমান, হিন্দু ও শিখ। সংঘাতে মুসলমান ও শিখ কেউ কারাে চেয়ে কম যায় না। সে প্রমাণ ইতিহাসে ধরা আছে- অতীত ইতিহাস ও আধুনিক ইতিহাস এ দুয়েরই পাতায়। মধ্যিখানে শিক্ষিত ও মূলত বেনিয়া শ্রেণীর হিন্দু সম্প্রদায়। এতদসত্ত্বেও বিশের দশকে স্যার ফজল-ই-হােসেনের চেষ্টায় এ তিন সম্প্রদায়কে পরস্পরমুখী করার। তাগিদে গঠিত হয় সেকুলার রাজনৈতিক দল ইউনিয়নিস্ট পার্টি। বাস্তবিকই ইউনিয়নিস্ট পার্টি এই তিন সম্প্রদায়ের কম-বেশি প্রতিনিধিত্ব করেছে। করেছে প্রধানত গ্রামীণ জনশ্রেণীর বিশেষত কৃষকদের অর্থনৈতিক স্বার্থরক্ষার ক্ষেত্রে। এদিক থেকে যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে ফজলুল হক ও তার কৃষক প্রজাপাটির সঙ্গে। উভয় ক্ষেত্রে অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রভাব রয়েছে। সেই সঙ্গে গ্রামীণ স্বার্থ ও গ্রামীণ অর্থনীতি উদ্ধার । সর্বশেষ মিল জিন্না-লীগের কাছে আত্মসমর্পণে। তাতে ওই দুই পার্টির সর্বনাশা বিলুপ্তি । তবে সিকান্দারের অকাল মৃত্যুর (ডিসেম্বর, ১৯৪২) পর তার উত্তরসূরি খিজির হায়াত খান তার পাকিস্তান-বিরােধিতা নিয়ে ব্যর্থ লড়াই চালিয়ে গেছেন, সে কাহিনী পরে বিবেচ্য। সর্বভারতীয় পরিপ্রেক্ষিতে কংগ্রেসের কিছু ভুল আচরণ এবং জিন্নার ধর্মীয় চেতনাবাদী (আসলে সম্প্রদায়বাদী) প্রচারে রাজনৈতিক হাওয়ায় উল্টো টান দেখা দিতে থাকে। অথচ ভারতীয় রাজনৈতিক ইতিহাসের বিশ্লেষক প্রায় সবাই একমত যে ১৯৩৭-এর প্রাদেশিক নির্বাচনের তাত্ত্বিক ফল অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির আলােকরেখা হিসেবেই দেখা দিয়েছিল।

অনেকটা এমন মতামতই লক্ষ করা যায় বিজেপি নেতা যশবন্ত সিং-এর লেখা দেশবিভাগ ও জিন্না বিষয়ক ঢাউস বইটিতে। তিনি অবশ্য ১৯৩৭ সালের নির্বাচনকে চিহ্নিত করেছেন ‘গণতান্ত্রিক রাজনীতির সন্ধিক্ষণ’ হিসেবে (জিন্না ইন্ডিয়া-পার্টিশন-ইন্ডিপেন্ডেন্স’, পেপারব্যাক, পৃ. ২২৩)। বাস্তবিক সেটা সন্ধিক্ষণই ছিল এবং আমি এক্ষেত্রে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি’ কথাটার ওপর গুরুত্ব আরােপ করব এ কারণে যে ভারত বিভাগের বীজমন্ত্র উচ্চারিত হয়েছিল সাম্প্রদায়িকতা ঘিরে। যদিও পাকিস্তান দাবির পেছনে আর্থ-সামাজিক উন্নতির প্রেক্ষাপট ছিল প্রধান কিন্তু সেখানে দ্বিজাতিতত্ত্ব আমদানি করে, ধর্মীয় সম্প্রদায়কে জাতি হিসেবে চিহ্নিত করে, সাম্প্রদায়িকতার শ্লোগান তুলে ও উন্মাদনা সৃষ্টি করে ব্যাপক কাটাকুটি ও জিঘাংসার মধ্য দিয়ে ভারত বিভাগসহ) বাংলা-পাঞ্জাব বিভাগ ও পাকিস্তান। প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করা হয়। এর দায় প্রধানত মুসলিম লীগ ও জিন্নার । আর লক্ষণীয় বিষয় যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক উন্মাদনাকে হাতিয়ার করে তােলা হলেও বঙ্গদেশের ক্ষেত্রে এর পেছনে আরাে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের তুলনায় আর্থ-সামাজিক দিক থেকে বিশাল ব্যবধানে পিছিয়ে থাকা বাঙালি মুসলমান সমাজ, বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক-কারিগর শ্রেণী, যারা ছিল সামন্তবাদী শােষণের শিকার। অন্যদিকে উঠতি মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত শ্রেণী প্রতিযােগিতায় পিছু হটে ক্ষুব্ধ। তারাও পদ-মানমর্যাদার ভাগ চায়। এদের জন্যই স্বতন্ত্র ভুবন অর্থাৎ পাকিস্তান মুক্তির নিশানা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। কিন্তু ভারতের একাধিক প্রদেশের মুসলমান সম্প্রদায়ের আর্থসামাজিক অবস্থা ছিল বঙ্গীয় মুসলমান সম্প্রদায় থেকে উন্নত । কারণটা প্রধানত ঐতিহাসিক। বর্তমান উত্তরপ্রদেশ (তখনকার ইউপি অর্থাৎ যুক্তপ্রদেশ), পাঞ্জাব, এমনকি বােম্বাই প্রেসিডেন্সিতে নিম্নবর্গীয়দের অবস্থা যেমনই হােক শিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত ও সচ্ছল মধ্যবিত্ত ও বিত্তবান শ্রেণীতে মুসলমান সংখ্যা তুলনামূলকভাবে খুব কম ছিল না। এমনকি পেশাজীবীশ্রেণী সম্পর্কেও কমবেশি একই কথা খাটে। এখানেই ছিল বঙ্গীয় মুসলমানদের সঙ্গে অবাঙালি ভারতীয় মুসলমান সম্প্রদায়ের বিশেষ ফারাক, সুস্পষ্টভাবে শিক্ষিত ও বিত্তবান শ্রেণীর (পেশাজীবীসহ) বিবেচনায়। তাই বঙ্গীয় মুসলমানের জন্য ভারত বিভাগ ও স্বতন্ত্র ভুবন প্রতিষ্ঠা হয়ে ওঠে জীবন-মরণ প্রশ্ন। যে জন্য জিন্নার সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক প্রচারে বঙ্গীয় মুসলমান সবচেয়ে বেশি বিভ্রান্ত হয়। সর্বশেষ নির্বাচনে (১৯৪৬) সে বিভ্রান্তির প্রকাশ ঘটে। অথচ ওই নির্বাচনের ফল অন্যত্র ছিল কিছুটা ভিন্ন।

অনেকটা ১৯৩৭-এর নির্বাচনী ধারায়। প্রায় এক দশকের ব্যবধানে ভেসে যায় গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির চারাগাছ। সেটা যায় মূলত মুসলমানপ্রধান দুই প্রদেশ বঙ্গদেশ ও পাঞ্জাবের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির টানে। তার সঙ্গে যােগ দেয় আসামসেখানকার মুখ্যমন্ত্রী স্যার মােহাম্মদ সাদুল্লার হাত ধরে। বিভ্রান্ত এ তিন মুখ্যমন্ত্রী ১৯৩৭-এর নির্বাচনপরবর্তী সময়ে একের পর এক ঘােষণা দেন তাদের রাজনৈতিক অনুসারীদের মুসলিম লীগে যােগ দিতে। এভাবে আল্লাহ ও ইমানের টানে অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রী ওয়াটারশেড’ ভেসে যায়। বিপন্ন মুসলিম লীগ পরিপুষ্ট জিন্না-লীগে পরিণত হয়। পায়ের নিচে শক্ত মাটি পেয়ে, ঘর গােছাতে শুরু করেন জিন্না। বুঝে নেন সাম্প্রদায়িকতার প্রচারই রাজনৈতিক বিজয়ের ধারালাে অস্ত্র। এর ব্যাপক ব্যবহার প্রয়ােজন।  জিন্না হয়ে ওঠেন মুসলিম লীগের এমন একজন একনায়ক, যার ইঙ্গিত ছাড়া মুসলিম লীগ নামক রাজনৈতিক ক্ষটির একটি পাতাও নড়বে না। অথচ সেকুলার মুসলিম রাজনীতি, বিশেষ করে বাংলা পাঞ্জাব ১৯৩৭-এর নির্বাচনী ফলের পরিপ্রেক্ষিতে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশ ঘটাতে পারত। আসাম তাদের সঙ্গী হতে পারত। কিন্তু সেই বিকাশ ও বিস্তার কেন ঘটেনি তার কিছুটা ইতিপূর্বে বলা হয়েছে। পূর্বোক্ত দুই প্রধানের দেখানাে পথ ধরে নিখিল ভারত মুসলিম লীগে মুসলিম ঐক্যের যে উদ্দীপনা ও উন্মাদনা দেখা দেয় তার নাভিকেন্দ্র কিন্তু পাঞ্জাবের পাশাপাশি উত্তরপ্রদেশ। হডসন লিখেছেন নির্বাচনের ফল ঘােষণা ও মন্ত্রিসভা গঠন এবং লক্ষৌ সম্মেলনের (অক্টোবর, ১৯৩৭) তিন মাসের মধ্যেই মুসলিম। লীগের ১৭০টি নতুন শাখা গঠিত হয় এবং এদের ৯০টিই উত্তরপ্রদেশে । নতুন সদস্য সংখ্যা ১ লাখ । এই যে ঢেউ উঠল এর জোয়ারি প্রভাব ক্রমে অন্যান্য প্রদেশেও আছড়ে পড়ে। তবে বঙ্গদেশে সবচেয়ে দেরিতে, চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। অবশ্য সূচনা চল্লিশের দশক থেকেই যখন হক সাহেবের রাজনৈতিক শক্তি প্রায় নিঃশেষিত। অথচ এই ফজলুল হকই মুসলিম লীগের লাহাের অধিবেশনে স্বতন্ত্র ভুবনের প্রস্তাব (লাহাের প্রস্তাব / পাকিস্তান প্রস্তাব) উত্থাপন করেন। 

 

সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক