রাজনৈতিক টানাপড়েনে বিপর্যস্ত ফজলুল হক
তিরিশের দশকের শেষ দিক থেকে বঙ্গীয় রাজনীতিতে, বিশেষ করে বঙ্গীয় মুসলিম রাজনীতিতে আবুল কাসেম ফজলুল হক একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম । তার হাত ধরে (ডান হাত বাঁ হাত যে হাতই হােক) বঙ্গীয় রাজনীতির পালাবদলের সূচনা। এবং বঙ্গীয় রাজনৈতিক নিয়তির স্ববিরােধী যাত্রা যা পরিণামে নানামাত্রিক ভারতীয় বিভাজনের নেপথ্য শক্তি হয়ে ওঠে। জওহরলাল নেহরুর কাব্যভাষায় সেই ভয়াবহ বিভাজন-সন্ধিক্ষণ যেন ‘নিয়তির সঙ্গে অভিসার (ট্রিস্ট উইথ ডেসটিনি)। সত্যি বলতে কি সে অভিসারের আয়ােজনে নেহরুজিও তাে শতরঞ্জ কা খিলাড়ি’- অবশ্য অন্যতম প্রধান খেলােয়াড় জিন্না এবং গান্ধি, সঙ্গে ব্রিটিশ রাজ’। তবে এদিক থেকে বঙ্গীয় রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে সে সময়কার অন্যতম প্রধান চরিত্র এ কে ফজলুল হক তার ভূমিপুত্র ও স্থানীয় সমর্থকদের ভাষায় ‘মােগাে হক সাব’। তাকে নিয়ে একাধিক সিভিলিয়ান ও ক্রমফিল্ডের মতাে রাজনৈতিক লেখক যত মস্করা করুন না কেন ফজলুল হক তৎকালীন রাজনীতিতে এমনই এক ব্যক্তিত্ব যে পরিস্থিতি বাগড়া না দিলে তার হাত ধরেই হয়তাে বঙ্গীয় রাজনীতির যাত্রাপথ ভিন্ন হতাে, ঘটত ভারতীয় রাজনীতিরও অন্য এক পালাবদল । কিন্তু কংগ্রেস, নেহরু তা হতে দেননি। পরে তা সম্পূর্ণ করেন মুসলিম লীগ অধিনায়ক জিন্না। রাজনীতি থেকে ক্রান্তিকালে ছিটকে পড়েন। ফজলুল হক। ব্যক্তি ফজলুল হক, রাজনীতিবিদ ফজলুল হক প্রকৃত অর্থেই গ্রামবাংলার প্রতিনিধি, যতই হােন না কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী, শহরবাসী আইনজীবী। সেই সঙ্গে একথাও ঠিক যে ব্যক্তি ফজলুল হক রাজনীতিবিদ ফজলুল হকের তুলনায় অনেক বেশি বাঙালি, অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী চেতনার বাঙালি। রাজনৈতিক স্বার্থে, ব্যক্তি স্বার্থে কখনাে কখনাে তিনি বিপরীত পথে হেঁটেছেন, কিন্তু নান্দনিক বিচারে তার মনটা ছিল হিন্দু-মুসলমান অধ্যুষিত ‘রূপসী বাংলা’য়। ছিল মাটির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক, তেমনি ছিলেন ভূমিপুত্রদের কাছে কিংবদন্তিতুল্য স্বজন। যে জন্য ১৯৪৬-এর নির্বাচনে প্রবল পাকিস্তানি জোয়ার একমাত্র তাকেই ভাসিয়ে নিতে পারেনি। অথচ উপড়ে নিতে পেরেছিল টাঙ্গাইলের আবদুল হালিম গজনভি, যশােরের সৈয়দ নওশের আলী, কুমিল্লার আশরাফউদ্দিন চৌধুরী বা ফরিদপুরের হুমায়ূন কবির প্রমুখ অশথ বটগুলােকে ।
একমাত্র ব্যতিক্রম বরিশালের ফজলুল হক এ রহস্য দুর্জেয় নয় অথচ এমন এক ফজলুল হক কি না কালাে পানিতে নৌকা বাইলেন যা হয়তাে ছিল তার চেতনা-বিরােধী কাজ। তবু এমনটাই তার ভবিতব্য হয়ে ওঠে। আর সে ভবিতব্যের পেছনে সক্রিয় তার ব্যক্তিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং প্রতিকূল ঘটনাক্রম। এটাই কি সবার বহু পরিচিত হক সাহেবের প্রকৃত পরিচয়? কিন্তু বেশ কিছু ঘটনা তা বলে না। জন ব্রুমফিল্ড অক্সফোর্ড-কেমব্রিজের রাজনৈতিক বিচারের ধারায় তাকে কথিত ‘হিন্দু ভদ্রলােক’ রাজনীতিকের কাতারে মুসলিম ভদ্রলােক রাজনীতিক হিসেবে দাঁড় করালেও তার মধ্যে ছিল দ্বৈত সত্তা-মাটি ও রাজপথের । একদিকে তিনি যেমন তৃণমূল রাজনীতির পথেই গ্রামবাংলার হিন্দুমুসলমান প্রজাস্বার্থের প্রতিনিধি, তেমনি জাতীয় রাজনীতির অঙ্গনে ক্ৰমফিল্ডের মতে ‘হিন্দু-মুসলমান সহযােগিতার প্রবক্তা’ । সেই সঙ্গে কংগ্রেসী ঘরানার মিলে সাধারণ শত্রু ব্রিটিশরাজের বিরােধী’ সম্মিলিত বিরােধিতার পথেই বাঙালি মুসলমানের আকাক্ষিত ভবিষ্যৎ নিহিত এমনই ছিল তার বিশ্বাস । কিন্তু কংগ্রেস রাজনীতি তার জন্য সর্দিা পরিচ্ছন্ন তথা ধােয়া তুলসীপাতা ছিল না, যে জন্য ফজলুল হককেও কখনাে ডাইনে কখনাে বাঁয়ে মােড় নিতে দেখা গেছে । কখনাে কংগ্রেস, কখনাে মুসলিম লীগের সঙ্গে লেনদেনে। সেসব পদক্ষেপ ছিল কখনাে ঠিক, কখনাে বেঠিক। এমন সব টানাপড়েনের মধ্যেও ১৯১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে ফজলুল হক বলেন যে হিন্দু প্রকৃতিগভাবে মুসলমানের শত্রু- হিন্দুমুসলমান সম্পর্ক বিষয়ে এমন ধারণা নিন্দনীয় ভুল। আবার এই ফজলুল হকই বিশ শতকের বিশের দশকে গান্ধিসূচিত অসহযােগ আন্দোলনের ধারায় আইনসভা বয়কটের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। কারণ তার মতে তাতে ইংরেজ শাসকেরই লাভ হবে। প্রসঙ্গত এক পর্যায়ে চিত্তরঞ্জনের স্বরাজ্য দলেরও অনুরূপ ভূমিকা স্মরণ করা যেতে পারে। তখনাে তিনি অর্থাৎ হক সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সমর্থক নন এবং স্বতন্ত্র নির্বাচনের (মন্টেগু-চেমসফোর্ড সামপ্রদায়িক আইন) পক্ষপাতী নন।
এ জন্য তিনি রক্ষণশীল বা সম্প্রদায়বাদী মুসলিম মহলে সমালােচিত। প্রকৃতপক্ষে ১৯২৯ সালে তার হাতে গঠিত প্রজাস্বার্থের কৃষক প্রজাপাটিই ছিল তার জন্য সঠিক সংগঠন যা অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী চেতনার ধারক, সেই সঙ্গে বিপুল সংখ্যক দরিদ্র মুসলমান কৃষক-প্রজার স্বার্থরক্ষার বাহক। এমন এক রাজনৈতিক পরিচিতি নিয়ে অল্প সময়ে তিনি কলকাতা করপােরেশনের মেয়র এবং ১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে লীগের সঙ্গে প্রতিযােগিতায় দলেবলে জয়ী । অর্থাৎ মুসলিম লীগের (১৯০৬) তুলনায় মাত্র বছর সাতেক বয়সী প্রজাপার্টির আসন সংখ্যা বৃহত্তর জনশ্রেণীতে তার জনপ্রিয়তার পরিচায়ক। মুসলিম লীগের মতাে সবকটি আসনে প্রার্থী দিতে পারেন নি হক। নির্বাচনের ফলাফলে লীগের চেয়ে কয়েকটি আসন কম পেলেও কৃষক প্রজাপার্টির পক্ষে মােট ভােটের শতকরা সংখ্যা ছিল মুসলিম লীগের চেয়ে বেশি (৩১ বনাম ২৭)। স্বল্প সময়ের পার্টি হিসাবে সাংগঠনিক অর্থনৈতিক দুর্বলতার কারণে ওই নির্বাচনে হক নিরুঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা পান নি । স্বতন্ত্র প্রার্থীর সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি (৪৩)। অন্যদিকে প্রজাপার্টি ও মুসলিম লীগ যথাক্রমে ৩৬ এবং ৩৯ আসনে জয়ী । সাধারণ আসনে কংগ্রেস ৫২, স্বতন্ত্র ৩৯, হিন্দু জাতীয়তাবাদী ৩, হিন্দু মহাসভা ২ এবং ইউরােপীয় গ্রুপ ২৫। সাধারণ আসনেও স্বতন্ত্র বেশি, তবে নিয়ন্ত্রক শাসকদের পেয়াদা ইউরােপীয় গ্রুপ। তারা একাই একাধিকবার বাংলার হিসাব নিকাশ পাটে দিয়েছে। ফজলুল হক ও তার কৃষক প্রজাপাটি শহুরে আসনে ভালাে ফল করতে না পারলেও (এটাই স্বাভাবিক) বঙ্গীয় মুসলিম জনৈতিক অঙ্গনে স্বতন্ত্র নির্বাচন সত্ত্বেও যে অসম্প্রদায়বাদী ধারার জন্ম দিয়েছিল তা সুস্থ রাজনীতির জন্য ছিল যথেষ্ট সম্ভাবনাময়। কয়েকটি ঘটনা থেকে বুঝতে পারা যায় যে অশিক্ষিত গ্রামীণ মানসে ধর্মীয় প্রচারণা কোনাে কাজে আসেনি।
অর্থাৎ অর্থনৈতিকরাজনৈতিক চেতনার প্রভাব ছিল ধর্মীয় চেতনার ওপরে (অথচ রাজনীতির বিভ্রান্তিকর যাত্রায় ওই চেতনা ঠিক বিপরীত পথ ধরে ১৯৪৬-এর নির্বাচনে)। এছাড়াও ওই নির্বাচনে ফজলুল হকের ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি ও জনপ্রিয়তারও উজ্জ্বল প্রকাশ ঘটে। বিশেষভাবে তা স্পষ্ট হয় পটুয়াখালী আসনে খাজা নাজিমুদ্দিনকে বিশাল ভােটের ব্যবধানে পরাজিত করার ঘটনায়। কারণ ওই নির্বাচন ছিল ওই দুই ব্যক্তিত্বের মর্যাদার লড়াই। তাত্ত্বিক বিচারে জয়ের পাল্লা নাজিমুদ্দিনের দিকেই ভারী ছিল। প্রথমত পটুয়াখালী ঢাকাই নবাবদের জমিদারির অন্তর্গত। তাছাড়া ফুরফুরার খ্যাতিমান পীরসাহেব শাহ সুফি মাওলানা আবু বকরসহ তার সাগরেদ মােল্লামৌলবী সবাই নাজিমুদ্দিনের পক্ষে প্রচারণায় নামেন। এমনকি ঢাকার গদ্দিনশীন নবাব হাবীবুল্লাহ পর্যন্ত নির্বাচনী প্রচারে যােগ দিতে পটুয়াখালীতে আসেন। সবচেয়ে বড় বিস্ময় স্বয়ং বাংলার লাটবাহাদুর নাজিমুদ্দিনের পক্ষে প্রচার চালান, যা ছিল এক অনৈতিক পদক্ষেপ । জয়ের জন্য প্রচার কাজে নেমেছিল পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ ও অন্যান্য স্থান থেকে আগত বহু সংখ্যক মুসলমান ছাত্র । সবাই মিলে ইসলামের ধুয়া তােলে নাজিমুদ্দিনকে জয়ী করতে । অর্থাৎ মুসলিম লীগ তার সর্বশক্তি নিয়ােগ করে পটুয়াখালী আসনটি হাতের মুঠোয় নিতে। কিন্তু কৃষক, শ্রমজীবী ও সাধারণ মানুষ তাতে ভােলেনি। নির্বাচনের ফলাফল ফজলুল হক ১৩,৭৪২ ভােটে জয়ী, নাজিমুদ্দিনের পক্ষে ভােট মাত্র ৬,৩০৮। অবিশ্বাস্য ওই বিজয় । আমার ধারণা উর্দুভাষী খাজাদের পক্ষে উর্দুভাষী ছাত্র ও স্বয়ং লাটবাহাদুরের প্রচারই সবকিছু গুবলেট করে দেয়। মাটির মানুষ তাদের বহু চেনা মানুষটিকে ভােটে জয়ী করে দেন।
সত্যি বলতে কি ১৯৩৭-এর নির্বাচন তার অনিশ্চিত রাজনীতির প্রকাশ নিয়ে বঙ্গে সুষ্ঠু, সুস্থ রাজনৈতিক বাঁক ফেরার সম্ভাবনা তৈরি করে। কিন্তু সে সম্ভাবনা নষ্ট করার পেছনে দাবার ছকের গুরুত্বপূর্ণ ঘুটি অর্থাৎ খেলুড়ে সংগঠন তিনটির কম-বেশি দায় ঠিকই ছিল। যেমন ফজলুল হকের আগ্রহে কংগ্রেস-প্ৰজাপার্টি মন্ত্রিসভা গঠনের প্রক্রিয়ায় নিম্নতম কর্মসূচি, যেমন একদিকে বন্দিমুক্তি অন্যদিকে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির মতাে কৃষক স্বার্থ বিষয়ক এজেন্ডা নিয়ে মতের অমিল হক-কংগ্রেসের আলােচনা অচল করে দেয়। প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থানে ও দাবিতে অনড়। এ ক্ষেত্রে যুক্তি, রাজনৈতিক ঔদার্য এবং বৃহত্তর স্বার্থের প্রতি অগ্রাধিকার বিবেচনা কাজ করেনি। পরিস্থিতির অবনতি ঘটে যখন ফজলুল হক তার স্বভাবসুলভ কূটনৈতিক চাতুর্য প্রকাশে ব্যর্থ হন, অন্যদিকে ফরােয়ার্ডসহ (২২/২, ১৯৩৭) একাধিক পত্রিকায় অপরপক্ষের ওপর দায় চাপিয়ে কংগ্রেস তরফে বিবৃতি প্রকাশিত হয়। তাতে ক্ষুব্ধ হন ফজলুল হক। শুরুতেই এমন কাণ্ড! অন্যদিকে প্রজাপার্টির বক্তব্যে যুক্তি ছিল যে প্রথমে প্রতিশ্রুত কৃষকস্বার্থ বিষয়ক কিছু আইন পাসের পর বন্দিমুক্তির বিষয়টি বিল হিসাবে আনা ও পাস করানাে হবে, সে ক্ষেত্রে গভর্নর ভেটো দিলে এবং মন্ত্রিসভাকে পদত্যাগ করতে হলেও কৃষকদের কাছে জবাবদিহির সুযােগ থাকবে। কিন্তু কংগ্রেস এ যুক্তি মানতে চায়নি যদিও তাদের অজানা ছিল না যে গভর্নর তথা ইংরেজ শাসক কংগ্রেস ও ফজলুল হককে একই মানদণ্ডে অপছন্দ করে। এরপরও সমস্যা ছিল নলিনীরঞ্জন সরকারকে নিয়ে কংগ্রেস ও প্রজাপাটির ভিন্নমতের কারণে। | সবচেয়ে বড় কথা হলাে এ দরকাকষিতে উভয় পক্ষই বৃহত্তর রাজনৈতিক স্বার্থ বা জাতীয় স্বার্থের প্রতি অগ্রাধিকার দিতে ব্যর্থ হয়। সঙ্গত কারণে শীলা সেনের মন্তব্য যে, নানা কারণে বঙ্গীয় কংগ্রেস নেতারাও ফজলুল হককে সমর্থন দানের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারেননি। তাই কংগ্রেস হাইকমান্ডকে সিদ্ধান্তহীনতা থেকে মুক্ত করার চেষ্টা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না’ (বঙ্গে মুসলিম রাজনীতি)। কিন্তু এ বিষয়ে কিছুটা ভিন্ন মতও রয়েছে ।
বসু পরিবারের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক সদস্য শরৎ বসুর পত্রাবলীতে দেখা যায় যে কংগ্রেস যখন সংগ্রামের পথ ছেড়ে নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে মন্ত্রিসভা গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় তখন যেসব প্রদেশে কংগ্রেস সংখ্যালঘু, যেমন বঙ্গদেশের মতাে প্রদেশ, সেসব স্থানে সম্মিলিত (কোয়ালিশন) মন্ত্রিসভা গঠনের ওপর গুরুত্ব আরােপ করেছিলেন শরৎ বসু। কিন্তু তার মতামত কংগ্রেস হাইকমান্ডে গৃহীত হয়নি। তাই তিনি লেখেন, ‘১৯৩৭ সালে গান্ধি যদি বঙ্গে সম্মিলিত মন্ত্রিসভা গঠনে রাজি হতেন তাহলে জিন্না ও তার সমর্থকরা সন্তুষ্ট হতেন এবং হিন্দু-মুসলমান মতপার্থক্য অনেক কমে যেত।’ | শুধু মতপার্থক্য কমা নয়, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সম্প্রীতির সুবাতাস বইতে শুরু করত এবং তাতে উভয় পক্ষই লাভবান হতাে। হয়তাে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাবে হিংসার রক্তে ভারতবিভাগের (বাংলাবিভাগেরও) তরবারি রঞ্জিত হতাে না। কিন্তু কংগ্রেস যেমন বাংলার রাজনীতি ক্ষেত্রে দূরদর্শিতা, প্রজ্ঞা ও উদারতার পরিচয় দিতে পারেনি, তেমনি পারেনি সম্পূর্ণ বিপরীত পরিস্থিতিতে যুক্তপ্রদেশ (উত্তর প্রদেশ) বা বােম্বাইয়ে অনুরূপ প্রজ্ঞার পরিচয় রাখতে। বিষয়টি পরে আলােচনায় আসবে। কংগ্রেসের শাসনে ও আচরণে যে কর্তৃত্বপরায়ণতা ও ক্ষমতা-কেন্দ্রিকতার অভিযােগ তুলেছেন সুনীতিকুমার ঘােষ) একই অভিযােগ উত্থাপন করেছেন। এইচ ভি হডসন তার ‘দ্য গ্রেট ডিভাইড’ বইতে। তবে বঙ্গদেশের ক্ষেত্রে ফজলুল হক দরকষাকষিতে বৃহর রাজনৈতিক স্বার্থের কথা ভেবে আরাে কিছু মাত্রায় নমনীয় হতে পারতেন বলে আমার ধারণা। কিন্তু তার ব্যক্তিগত প্রয়ােজন এ ক্ষেত্রে প্রাধান্য পেয়েছিল, যে জন্য একটি সুস্থ রাজনৈতিক সম্ভাবনার অপমৃত্যু ঘটল। শুধু তা-ই নয়, তার সম্ভাবনাময় সংগঠন ‘কৃষক প্রজা পার্টিকেও তিনি নিজ হাতেই ছিন্নবিচ্ছিন্ন করেছেন। তাও তার রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার তাড়নায়, যে তাড়নায় তিনি চতুর গুজরাতি বুদ্ধির ফাঁদে পা দিলেন। সম্ভবত সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে কেন্দ্রীয় নেতা হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষায়। কিন্তু জিন্নার মুসলিম লীগে তা সম্ভব ছিল না। কারণ এক আসনে দুই পীরের সহাবস্থান সম্ভব নয়। তাছাড়া বাঙালি-অবাঙালি দ্বন্দ্বের বিষয়টির গুরুত্ব তার পক্ষে বুঝতে না পারার কথা নয়। কিন্তু বুঝতে পারেননি হক, তাই তিনি স্বত্থাত সলিলে ।
সেসব অবশ্য পরবর্তী। সময়ের কথা। নিরুপায় ফজলুল হক যখন বন্ধুপ্রতিম নলিনীরঞ্জন অর্থাৎ বিতর্কিত মি. সরকারের দৌত্যে মন্ত্রী পরিষদ গঠনের জন্য মুসলিম লীগের দ্বারস্থ হন এবং লীগ তাকে সব দাবিসহ সাদরে বরণ করে নেয়। তখনাে তিনি বুঝতে পারেননি কেমন এক অন্ধকার গহরে তিনি পা রেখেছেন, যেখানে রাজনীতিক ফজলুল হককে কেউ সমর্থন জোগাবে না বিশেষ করে তার কৃষক স্বার্থের কর্মসূচি বাস্তবায়নে। আসলে রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অস্তিত্ব রক্ষার জন্য তার এ জাতীয় আপসবাদিতা পরেও দেখা গেছে। কিন্তু তিনি তাে জানতেন মুসলিম লীগ জমিদার নবাব নাইট প্রধান দল। তার এ দুর্বলতা বরাবরের। যেমন অখণ্ড বঙ্গে তেমনি বিভাগােত্তর পূর্ববঙ্গে, পূর্ব পাকিস্তানে। এ পর্যায়ে তার জন্য বড় ট্র্যাজেডি হলাে রাজনৈতিক চিন্তায় অসমমনাদের ওপর নির্ভর করে চলেছে তার রাজনৈতিক জীবন বিশেষ করে যারা তার খুব অপছন্দের যেমন কট্টর লীগপন্থিরা, তার চেয়েও বেশি অপছন্দের ইউরােপীয় সদস্যগণ, সংখ্যায় তারা কম নয়। ভুল পদক্ষেপ যেমন ফজলুল হকের, তেমনি কংগ্রেসেরও। তা না হলে স্পিকার নির্বাচনে এমন ভুল কেউ করে? লীগ ও ইউরােপীয় ব্লকের পছন্দসই প্রার্থী খান বাহাদুর আযিজুল হকের বিরুদ্ধে প্রজাপার্টির তমিজুদ্দিন খানকে সমর্থন না করে কংগ্রেস কিনা সেখানে নিজস্ব তৃতীয় প্রার্থী দাঁড় করায়? ফলে লীগ প্রার্থী জিতে যায়। শীলা সেনের বিবেচনায় এটা কংগ্রেসের পক্ষে “হিমালয়সম গুরুতর ভুল’ (হিমালয়ান ব্লান্ডার)। কংগ্রেসের এ রকম ভূমিকা মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হকের জন্য সমস্যা ও ব্রিতকর অবস্থা সৃষ্টি করে। অন্যদিকে নিজ দলে বিদ্রোহ। এর দায় অবশ্য চাপেপড়া বাঘ ফজলুল হকেরই পার্টির সেক্রেটারি শামসুদ্দিন আহমদকে মন্ত্রী পদে মনােনীত করে পরে তা বাতিল করার ঘটনা কেন্দ্র করে উল্লিখিত বিদ্রোহ এবং শেষ পর্যন্ত দলে ভাঙন। একের পর এক সমস্যায় বিপর্যস্ত হক এর কিছু তার নিজের সৃষ্টি। অথচ রাজনৈতিক বিচারে এ ধরনের দুর্ভোগ তার। প্রাপ্য ছিল না। প্রাপ্য ছিল না অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী চেতনায় বিশ্বাসী রাজনীতিক ফজলুল হকের। দীর্ঘকাল পর দেশবিভাগ ও ক্ষমতা হস্তান্তর বিষয়ক গ্রন্থে (Transfer of Power in India) ভিপি মেনন তার সম্বন্ধে যথার্থই বলেছেন, বাংলায় ফজলুল হকই একমাত্র মুসলমান নেতা যিনি প্রদেশের পর্যাপ্ত সংখ্যক হিন্দু-মুসলমান বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষমতা রাখেন’ । অথচ আশ্চর্য, সেই নেতাকেই কি না অব্যাহত দুর্যোগের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। কিন্তু কেন? এর জবাব মিলবে হকের ব্যক্তিভাবনা ও বঙ্গীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপট বিচারে ।
সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক