সাম্প্রদায়িক রােয়েদাদ লীগ কংগ্রেস প্রজাপার্টি
কংগ্রেস ও লীগ দুই পরস্পর-বিরােধী রাজনৈতিক শক্তি হলেও কিংবা গান্ধিজিন্না দুই বিপরীত চারিত্র-বৈশিষ্ট্যের রাজনীতিবিদ হলেও বিশ শতকের প্রথম দুই দশকে লীগ (জিন্নার) নেতৃত্বে কংগ্রেসের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝােতা ও ভারতীয় ফেডারেশনের সম্ভাবনা নিয়ে কিছু দরজা অবশ্যই ভােলা ছিল। কিন্তু ওই দুই দল তার সুযােগ নিতে পারেনি, কাজে লাগাতে পারেনি সম্ভাবনাগুলােকে। মনে হয় সম্ভাবনা তারা কাজে লাগাতে চায়নি ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থের টানে। বৃহত্তর রাজনৈতিক দল হিসেবে এদিক থেকে কংগ্রেসের দায়িত্ব ছিল কিছুটা বেশি। কিন্তু কংগ্রেসের উচ্চমন্যতা’মুসলিম লীগকে বিশেষ করে জিন্নার প্রাথমিক প্রস্তাবগুলােতে গুরুত্ব না দেয়ার ফলে সব সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যায়। কংগ্রেস মুসলিম স্বাতন্ত্রবাদী চেতনা ও জিন্নার অবমূল্যায়ন করেছিলাে। এটা কংগ্রেস নেতৃত্বের অদূরদর্শিতা ও অপরিণামদর্শিতার পরিচায়ক। অথচ নওরােজি, গােখলে, ভাবশিষ্য জিন্না তার চল্লিশ বছর বয়সে (জন্ম : ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দ) লঙ্গেী প্যাক্টের প্রধান সহযােগিতাকারী (১৯১৬)। এবং জাতীয় কংগ্রেসে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা জিন্না তখনাে ভারতের রাজনৈতিক মঞ্চে হিন্দুমুসলমান ঐক্যের ওপর গুরুত্ব দিতে দ্বিধা করছেন না। ১৯২৪ সালে (মে মাসে) লাহােরে আয়ােজিত মুসলিম লীগের এক সভায় তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ভারতে ইংরেজ শাসনের স্থায়িত্বের কারণ হিন্দু-মুসলমানের অনৈক্য। হিন্দু-মুসলিম ঐক্যবদ্ধ হলেই ভারতে ‘ডােমিনিয়ন-ভিত্তিক সরকার গঠিত হতে পারে (হডসন)। এমনকি এরপরও সাইমন কমিশনের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে জিন্নার চৌদ্দ দফার মধ্যেও এক সঙ্গে হাঁটার কিছুটা সম্ভাবনা বজায় ছিল। কিন্তু কলকাতায় অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় সম্মেলনে (১৯২৮) জিন্নার দাবি কংগ্রেসে বিবেচিত হয়নি। আমাদের বিশ্বাস লীগের এসব দফা নিয়ে আলােচনার অবকাশ ছিল। কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্বের গোঁড়ামিতে তা হয়নি। হতাশা নিয়ে কলকাতা থেকে ফিরে যান জিন্না। তার যাত্রা শুরু হয় রাজনীতির ভিন্ন পথ ধরে । ক্রমে সে পথে কঠিন। থেকে কঠিনতর রাজনৈতিক ভাবনায় তার স্থিত হওয়া যা শেষ পর্যন্ত (১৯৪০/৪৭) সাম্প্রদায়িক চেতনার সমার্থক হয়ে দাঁড়ায়।
আর এর মধ্যে ইংরেজ শাসননীতিও পাকাপাকিভাবে সাম্প্রদায়িক তথা হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্বের সহায়ক হয়ে ওঠে। ভেবেচিন্তেই ব্রিটিশরাজের ১৯৩২ সালে ভারতে সাম্প্রদায়িক রােয়েদাদ’ (কমিউনাল অ্যাওয়ার্ড’) প্রস্তাব যা হয়ে ওঠে ভারতবিভাগ সম্ভাবনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। সবকিছু দেখে শুনে জিন্না লন্ডনে তার স্বােচ্ছানির্বাসন পরিকল্পনায় ইতি টেনে দিয়ে স্থায়ীভাবে ভারতে ফেরেন মুসলিম লীগ প্রধান হিসাবে নেতৃত্বের হাল ধরতে (১৯৩৪)। প্রদেশগুলােতেও হিন্দু-মুসলমানের জন্য স্বতন্ত্র নির্বাচন ব্যবস্থা তার জন্য নয়া সম্ভাবনার ভিত তৈরি করে। ১৯৩৫-সনে এ প্রস্তাব ভারতশাসন আইনে পরিণত। তখনাে মুসলমান রাজনীতি মুসলিম লীগের বাইরে বিভাজিত। শুধু কংগ্রেস প্রভাবিত জাতীয়তাবাদী মুসলমান নামীয় মঞ্চই নয়, সিন্ধুর জাতীয়তাবাদী নেতা আল্লাবকশ ও পাঞ্জাবের ইউনিয়নিস্ট নেতা সিকান্দার হায়াত খান প্রমুখ উদারনৈতিক নেতা তখনাে জিন্না বা মুসলিম লীগ রাজনীতির বাইরে। তাছাড়া ছিল মােমিন ও আহরার সমাজের অসাম্প্রদায়িক নেতৃত্ব এবং সীমান্ত প্রদেশের লালকুর্তা নেতা গাফফার খান। আর বাংলায় ফজলুল হকের নেতৃত্বে কৃষক প্রজা পার্টি। এদের প্রভাবে ১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগ মুসলমান আসনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পানি, বিশেষ করে বাংলা এবং পাঞ্জাবে। সীমান্তে তাে লাল কুর্তাদের একচেটিয়া বিজয়। সিন্ধুতে আধাআধি। ট্র্যাজেডি যে কংগ্রেস বিচক্ষণতার সঙ্গে এ পরিস্থিতির সদ্ব্যবহার করতে পারেনি। বরং তাদের কাজে ও বক্তব্যে পরিস্থিতিকে বিপরীত দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রতিষ্ঠার পথ পরিহার করেছে নির্বাচনে ভালাে ফলাফলের অপরিণামদর্শী বিবেচনা থেকে। প্রসঙ্গত মনে করা যেতে পারে নেহৰু কমিটির (মতিলাল নেহরুর নেতৃত্বে) অদূরদর্শী প্রতিবেদনের কথা যা লীগ কংগ্রেসের মধ্যে অধিকতর ব্যবধান তৈরি করে। তাতে ইন্ধন জোগায় জওহরলাল নেহরুর অপরিণামদর্শী বক্তব্য (মার্চ, ১৯৩৭) যে ভারতীয় রাজনীতিতে এখন একমাত্র দুটো পার্টিই রয়েছে, যথা কংগ্রেস ও ব্রিটিশরাজ (আর জে মুর, ইন্ডিয়া’স পার্টিশন’ সংকলন গ্রন্থ, সম্পাদনা মুশিরুল হাসান)। সঙ্গে সঙ্গে জিন্না উত্তর ছুঁড়ে দেন এই বলে যে মুসলিম লীগ তৃতীয় দল হিসাবে কংগ্রেসের যুক্তিসঙ্গত সমান পার্টনার’ । একথা বলার কারণ ভারত শাসন আইন (১৯৩৫) মাফিক গােটা ভারতের এক-তৃতীয়াংশ আসন মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত, আরেক তৃতীয়াংশ দেশীয় রাজন্যবর্গের প্রতিনিধিদের জন্য। স্বভাবতই বাকি তৃতীয়াংশ কংগ্রেসের ।
নেহরুর এ ধরনের অদূরদর্শী, অরাজনৈতিক মন্তব্য প্রায় এক দশক পরেও দেখা যায় কংগ্রেস সভাপতিরূপে, যে মন্তব্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অকার্যকর হওয়ায় সাহায্য করে, কেবিনেট মিশন পরিকল্পনায় ব্যর্থতার প্রভাব ফেলে এবং ভারত-বিভাগ অনিবার্য করে তােলে। এ বিষয়ে পরবর্তী পর্যায়ে দেখা যাবে। মাওলানা আজাদের ক্ষুব্ধ মন্তব্য নেহরুকে সমালােচনা করে (‘ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম’)। এ দুই মন্তব্যের সময় নেহরু কংগ্রেস সভাপতি। নেহরু এ ধরনের অদূরদর্শী মন্তব্য আরাে করেছেন। কখনাে করেছেন গান্ধিও (১৯৩৮)। ১৯৩৫ সালের ‘সাম্প্রদায়িক রােয়েদাদ যেমন ভারতীয় রাজনীতিতে। বিচ্ছিন্নতার যাত্রায় মাইলফলক তেমনি ওই আইনের ভিত্তিতে ১৯৩৭-এর প্রাদেশিক নির্বাচন জিন্না-মুসলিম লীগের জন্য সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বীজতলা। যদিও নির্বাচনে মুসলমান-প্রধান প্রদেশগুলােতে মুসলিম লীগের একাট্টা বিজয় সূচিত হয় নি। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কংগ্রেসি নীতি পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে জিন্নার চোখ খুলে দেয়। তখন থেকেই নেতৃত্বের প্রশ্নে মুসলিম লীগ বলতে জিন্না এবং জিন্না মুসলিম লীগ একাকার। তখন জিন্নার একটাই লক্ষ্য, যে কোনাে মূল্যে মুসলিম লীগকে ভারতীয় মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধিত্বমূলক সংগঠন হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। বিচ্ছিন্ন মুসলিম রাজনৈতিক শক্তিগুলােকে লীগের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে।
তা না হলে হিন্দুপ্রধান কংগ্রেস রাজনীতির দিকে চোখে চোখ রেখে কথা। বলা যাবে না। এটা বুঝিয়ে দিতে হবে ইংরেজ শাসকদেরও। প্রয়ােজনে ধর্মীয় শ্লোগানে মুসলমান জনশ্রেণীকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। রাজনৈতিক স্বার্থে সাম্প্রদায়িকতাকে এভাবে কাছে টেনে নেন জিন্না। প্রদেশগুলােতে তখন জাতীয় কংগ্রেস মন্ত্রিসভা গঠনে অনেক এগিয়ে ছিল, হিন্দুপ্রধান প্রদেশগুলােতে এককভাবে, মুসলমান-প্রধান কয়েকটিতে সম্মিলিতভাবে। বরাবরের সমস্যা পাব জাতীয়তাবাদী ইউনিয়নিস্ট নেতা। সিকান্দার হায়াত খানের বদৌলতে সমস্যাহীন। সিন্ধু টানাপড়েনের মধ্যেও শত্রুক্যাম্পে নয় । আসামও তাই। তবে বঙ্গদেশেই সব হিসাব পাল্টে যায়। আর এই বঙ্গদেশই প্রায় এক দশক পর (১৯৪৬) জিন্নার নেতৃত্বে সাম্প্রদায়িক বিচ্ছিন্নতা তথা ভারতবিভাগের সিংহদরজাটা খুলে দিতে সবচেয়ে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তাই ১৯৩৭ সালের নির্বাচন বাস্তবিকই বিভাজন রাজনীতির অনুঘটক। এর পেছনেও রয়েছে কংগ্রেসের অনিশ্চয়তা ও কর্মসূচিগত দ্বিধাদ্বন্দ্ব। বঙ্গদেশের নির্বাচনে কোনাে দলই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। মন্ত্রিসভা গঠন করতে চাই অন্য দলের সমর্থন । আসন বিচারে কংগ্রেস ৫২, বঙ্গীয় মুসলিম লীগ ৩৯, কৃষক প্রজাপার্টি ৩৬, স্বতন্ত্র ৪৩ এবং ত্রিপুরা কৃষক সমিতি ৫। কৃষক প্রজাপার্টির প্রধান এ কে ফজলুল হক প্রথমে কংগ্রেসের সঙ্গে মিলে সরকার গঠন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রাদেশিক কংগ্রেসের ইচ্ছা সত্ত্বেও হাইকমান্ডের পিছুটান এবং কিছু নীতি ও কর্মসূচি নিয়ে যখন হিসাব-নিকাশের টানাপড়েন। চলছিল সে সুযােগে জিন্না হক সাহেবকে কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলােতে মনােনীত করার (এবং বাংলার মুখ্যমন্ত্রিত্ব তাে বটেই) বিনিময়ে তার রাজনৈতিক সর্বনাশের পথে টেনে নেন। কারণ জিন্নার ভালােভাবেই জানা ছিল যে বঙ্গীয় মুসলিম রাজনীতিতে ফজলুল হকই লীগের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী, সত্যিকার অর্থে শেরে বঙ্গাল । এমন কি গােটা বঙ্গদেশের রাজনীতিতে লীগ কংগ্রেস বিচারে হকের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক খ্যাতি (‘ক্যারিশমা’ও বলা চলে)। কাজেই এই শের হত্যা জিন্নার জন্য জরুরি। আর দ্বিতীয় কোনাে উপায় না দেখে ফজলুল হকও আত্মঘাতী পথে পা বাড়ালেন।
শুধু ব্যক্তিক রাজনীতি নয় প্রজাপার্টির সর্বনাশ ঘটল একই ধারায় । জিন্নার চাতুরীর সঙ্গে পেরে ওঠেননি ফজলুল হক এবং সেটা সম্পূর্ণ হয় তার মুসলিম লীগে যােগদানের মাধ্যমে। এ যোগদানে বাংলায় শুধু যে মুসলিম লীগের ব্যাপক শক্তিবৃদ্ধি ঘটে তাই নয়, বাংলার মুসলিম রাজনীতিতে অসাম্প্রদায়িক চেতনার অপমৃত্যু, লীগের প্রবল বিজয় যা দেশভাগ নিশ্চিত করার দিকে বড় একটা পদক্ষেপ। এক কথায় বাংলাদেশে রাজনীতির ভারসাম্য পরিবর্তিত হয়। (অমলেন্দু দে-পাকিস্তান প্রস্তাব ও ফজলুল হক’)। বঙ্গীয় রাজনীতির বড়সড় এক ভিন্ন মেরুকরণ। লক্ষণীয় যে ফজলুল হক ও প্রজাপার্টিকে কেন্দ্র করে বঙ্গীয় মুসলমানদের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির যে সুস্থধারা বিকশিত হচ্ছিল তা কংগ্রেসের চিত্তরঞ্জন-সুভাষপন্থী ধারার সঙ্গে মিলে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী ধারার বিকাশ ঘটাতে পারত। আর তা শুধু বঙ্গীয় রাজনীতিরই নয় সর্বভারতীয় রাজনীতির জন্য ভিন্ন পথনির্দেশ করতে পারতাে। বলা যায় চিত্তরঞ্জনের অকালমৃত্যু ও ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ বাতিল এবং পরবর্তী সময়ে কংগ্রেস থেকে সুভাষের বহিষ্কার বঙ্গের সেকুলার গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য যে অশুভ ধারার সৃষ্টি করে (যাতে কংগ্রেস ও লীগ উভয়েরই অবদান রয়েছে) সে অশুভ ধারা পূর্ণতা পেল ফজলুল হকের লীগে যােগদানে ও প্রজাপার্টির অস্তিত্ব বিনাশে। জিন্নার চাতুরীর কাছে ফজলুল হকের হার, বলা। চলে গুজরাতি বুদ্ধির কাছে বাংলার পরাজয়। কারণ সময় বুঝে জিন্না ফজলুল হককে ঠিকই লীগ রাজনীতি থেকে ঝেড়ে ফেলে হক-রাজনীতির অবসান ঘটান। তাই আমরা অবাক হয়ে দেখি যে ভারতীয় ইংরেজ শাসকগােষ্ঠীও এ বিষয়ে জিন্নাকে সাহায্য করেছে, পরে ফজলুল হকের বিরুদ্ধে বাংলার গভর্নর হার্বার্ট সাহেব সরাসরি মাঠে নেমেছেন হকের আসনে (মুখ্যমন্ত্রিত্বে) নাজিমুদ্দিনকে বসাতে । সে প্রসঙ্গ পরে আসছে। আপাতত দেখা যাক কী দুঃখজনকভাবে প্রজাপার্টির বিভক্তি ও পতন ঘটল ত্রিশক্তির কার্যক্রমে- অর্থাৎ লীগ, ব্রিটিশরাজ এবং খােদ প্রজাপার্টি প্রধান হক সাহেবের ভুল পদক্ষেপে।
সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক