You dont have javascript enabled! Please enable it!

আমজনতারও স্বপ্ন ছিল পাকিস্তান

১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট। পাকিস্তানের জন্মদিন। ঘটনাক্রমে সে সময় আমি গ্রামে, পরীক্ষা শেষে ছুটির অবসরে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার অন্তর্গত নবীনগর থানার শাহবাজপুর গ্রামে। ঠিক মেঘনাতীরে না হলেও মেঘনার সান্নিধ্যে, অর্থাৎ মেঘনার কোলঘেঁষা নাসিরাবাদের পরই শাহবাজপুর গ্রাম। বাড়ির উত্তর প্রান্তে দাড়ালে ফসলের ক্ষেত পার হয়ে দূরে দিগন্তরেখায় দেখা যায় মেঘনার অস্পষ্ট। নীলাভ আভাস। আকাশ-নদী মাটি-গাছপালা মিলে গ্রামবাংলার এক রােমান্টিক রূপ। পূর্ববঙ্গের সব গ্রামেরই কমবেশি একই চেহারা- তা রবীন্দ্রনাথের পদ্মাতীরবর্তী শিলাইদহ হােক কিংবা না হােক নাগর নদীতীরের পতিসর । শান্তিতে বসবাস একাধিক ধর্মবিশ্বাসী বাঙালির । কিন্তু রাজনীতি রােমান্টিকতা বােঝে না, বােঝে না কবিতা । বােঝে জীবনের রূঢ় বাস্তবতা- সেই সঙ্গে বােঝে ও জানে ব্যক্তিক অহমিকা ও দলীয় স্বার্থ, আর যতটা সম্ভব জনগােষ্ঠীর স্বার্থ নিয়ে ফাপা কথকতা। তবে সে স্বার্থ যতখানি জনসাধারণের তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি শ্রেণীবিশেষের, বিশেষ করে শিক্ষিত ও বিত্তবান শ্রেণীর । সে বহুমাত্রিক স্বার্থের টানে ছয়কে নয় করে ধর্মকে জাতি বানিয়ে তােলা যায়। ধর্মের নামে, সম্প্রদায়ের নামে অশিক্ষিত জনশ্রেণীকে খেপিয়ে তােলা যায়। যায় সচ্ছল জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে যে স্বপ্ন কখনাে বাস্তবের মুখ দেখতে পায় না। আর মধ্যবিত্ত শিক্ষিতশ্রেণী কখনাে অন্ধ রক্ষণশীলতার টানে, কখনাে সচেতন স্বার্থবুদ্ধির প্রভাবে নয়-ছয়’-এর অস্বাভাবিকতা সত্য বলে গ্রহণ করে । রাজনীতির এ ট্র্যাডিশন আমাদের দেশে দীর্ঘদিনের। | এমনটাই ছিল ব্রিটিশভারতে, বিশেষ করে বঙ্গদেশে চল্লিশের দশকে রাজনীতির খেলা, লীগ-কংগ্রেসের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আর মােহাম্মদ আলী জিন্নার তথাকথিত দ্বিজাতিতত্তের বাহারি পাকিস্তানি বেলুন যা দেখে মুগ্ধ বাঙালি মুসলমান। এ মুগ্ধতার পেছনে আসলে ছিল বিরাজমান আর্থ-সামাজিক বৈষম্য থেকে মুক্তির স্বপ্ন। মুক্তি অর্থনৈতিক সচ্ছলতার জন্য, সচ্ছলতা না হােক অন্ততপক্ষে অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য অর্জনের। তাই বাঙালি মুসলমান শ্রেণীনির্বিশেষে মুসলিম লীগপ্রধান জিন্নার পেছনে একাট্টা। প্রচারের মহিমায় 

অভিভূত বাঙালি মুসলমান জনতা রাজনীতির খেলায় শ্রেণীস্বার্থের ফাকিটা বুঝতে পারেনি, পারার কথাও নয়। বিষয়টা আরাে সহজ হয়েছিল হিন্দুপ্রধান জমিদার শ্রেণীর প্রজাপীড়নে ও প্রজাশােষণের কারণে। মুসলমান জমিদারও মুসলমান প্রজাপীড়নে-শােষণে যে ভিন্ন নয় তা ধর্মীয় প্রচারের গুণে বড় একটা চোখে পড়েনি মুসলমান প্রজার, কৃষক-জনতার। সামন্ত শোষণের সঙ্গে যুক্ত হয় ভয়ংকর মহাজনি শােষণ। মহাজনদের লাগামহীন অর্থনৈতিক শােষণ চরিত্র। বিচারে ছিল হাঙর কুমিরের মতাে। ঋণগ্রস্ত কৃষক, কারিগরের জমিজিরেত বা ভিটেমাটি ঋণের দায়ে গ্রাস করতে তাদের বিবেকে বাধে নি  মহাজনদের প্রায় সবাই হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত হওয়ায় সে ঐতিহাসিক ঘটনাও সাম্প্রদায়িক সমস্যা তৈরি করে। জমিদার-মহাজনের জাঁতাকলে তা অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে। নাভিশ্বাস ওঠে কৃষক প্রজার। এ ঘটনা লক্ষ্য করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আমাদের বাড়ির পশ্চিম দিকে সেজো চাচার বাড়ি । শ্রাবণ পেরিয়ে ভরা ভাদ্র । পাটের আঁশ ছাড়াচ্ছেন বাইরের আঙিনায় বাঁশঝাড়ের নিচে নিমবর্গীয় কয়েকজন পুরুষ ও মহিলা । একটু দূরে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনি- পাকিস্তান নিয়ে কথা, সােনালি আঁশ ছাড়াতে ছাড়াতে সে কথকতায় ফুটে ওঠে ভবিষ্যৎ স্বপ্নের সােনালি আঁকিবুকি । এগিয়ে গিয়ে তাদের একজনকে জিজ্ঞেস করি : ‘কেমন বােঝেন দেশ ভেঙে এই পাকিস্তান হওয়াটা’? মুখ ফিরিয়ে আমার দিকে তাকান মধ্যবয়সী ভূমিহীন দিনমজুর রেয়াজুদ্দিন (গ্রামের প্রচলিত ডাকে ‘রেজদ্দি’)। পরনে ভেজা গামছা, খালি গা । প্রশ্নের তাৎক্ষণিক জবাব : ‘জিন্না সারে আমরা বাসা (বাদশাহ) বানাইছি, পাকিস্তান আইছে। আমরার আর কষ্ট থাকব না।’ তার মুখে স্বাপ্নিক আলাের আভা। আমার পাল্টা জিজ্ঞাসা : ক্যামনে বুঝলেন, আপনাদের আর কষ্ট থাকব না। ‘জিন্না সাবে কইছে। হ্যার লাইগ্যাই তাে পাকিস্তান বাক্সে বুট (ছােট) দিছি । কণ্ঠে গভীর প্রত্যয়ের সুর। নিজদের ক্ষমতা সম্বন্ধেও সচেতন।

এর পর আর কথা চলে না। জিন্না সাহেবের ওপর তাদের অগাধ বিশ্বাস। শহর থেকে অনেক দূরে মেঘনাপারের প্রত্যন্ত গ্রাম শাহবাজপুরের শ্রমজীবী মানুষ রেয়াজুদ্দিন একেবারে ভূমিহীন নন। দু-তিন কানি (বিঘা) চাষের জমি থাকলেও তাতে পাঁচ-ছ’জনের সংসার চলে না। তাই দিনমজুরিই জীবনযাত্রার প্রধান নির্ভর। তার ছােট ভাই জৈনুদ্দিনেরও একই অবস্থা। এরা সবাই চেনা মানুষ । অবাক হই। দেখে যে, জিন্না সাহেবের রাজনৈতিক প্রভাব কত দূর প্রান্তে গিয়ে পৌঁছেছে।   এরা রাজনীতির আদ্যোপান্ত না বুঝলেও জীবনযাত্রার অর্থনৈতিক দিকটা ঠিকই বােঝে, অর্থাৎ বুঝতে হয়। মুসলিম লীগের ব্যাপক প্রচারের গুণে জিন্না সাহেবকে যে গ্রামের সাধারণ মুসলমান তাদের পরিত্রাতা মনে করেছে এ তথ্যটা শুধু তখনই নয়, বছর দুই আগে (১৯৪৫) মাস খানেকের জন্য গ্রামে এসে বিলক্ষণ বুঝতে পারি । প্রথম গ্রাম ছাড়ার সময়কার (১৯৩৭ সালের মাঝামাঝি) চেনা গ্রাম প্রায় এক দশকে অনেক পালটে গেছে। মানুষগুলাে বিশেষ করে গ্রাম্য যুবকদের কথাবার্তা, রাজনৈতিক আচার-আচরণ একেবারে অচেনা মনে হয়েছে। অবাক হয়েছি দেখে যে মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বার্তা এতদূর অজপাড়াগা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে । সে মুহূর্তে এর গুরুত্ব বুঝতে পারিনি, বুঝেছি বছর কয়েক পর ।

১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে শহুরে ছাত্র যুবকরা তাে বটেই, গ্রামের ছাত্র ও অশিক্ষিত যুবকরাও আবেগে-উদ্দীপনায় লীগের বাক্সে ভােট দেয়ার কাজে ব্যাপক সহায়তা করেছে। দল বেঁধে গ্রাম্য ভাষায় রচিত ভােটের গান গেয়েছে। তাতে ছিল রাজনৈতিক চেতনার পরিচয়। অবিশ্বাস্য তৎপরতায় চল্লিশের দশকের প্রথম দিকে মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ডাক মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে দূর গ্রামের মাটির দাওয়ায় পৌছে যায়। বাঙালি মুসলমান আমজনতাকেও সচ্ছল জীবনের স্বপ্ন দেখায় পাকিস্তান। এর পেছনে ছিল জিন্না সাহেবের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও তার কিছুসংখ্যক বিশ্বাসী অনুসারীর ভূমিকা। আর বাংলায় বিশেষভাবে সােহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, কামরুদ্দিন আহমদ প্রমুখ রাজনীতিকের সাংগঠনিক তৎপরতা এবং তাতে শেখ মুজিবুর রহমানের মতাে জাম-যুবাদের ব্যাপক অংশগ্রহণ । সত্যি বলতে কি দেশভাগের ভিত্তিতে পাকিস্তান অর্জিত হয় একদিকে মােহাম্মদ আলী জিন্নার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও চাতুর্যের গুণে, অন্যদিকে বাংলার মুসলমান তরুণ ও যুবকদের ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক তৎপরতায়। এর প্রতিফলন দেখা গেছে ১৯৪৬ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে বাংলায়। আমার অবাক লেগেছে যে প্রগতিবাদী ছাত্রযুবাদের অধিকাংশ পাকিস্তানি আকর্ষণ থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি। | এ অবস্থার হুবহু প্রতিরূপ দেখা যায় দুই যুগ পর ১৯৭০ সালের নির্বাচনে যদিও ঠিক বিপরীত রাজনৈতিক চরিত্রের প্রকাশ ঘটিয়ে। ছেচল্লিশের নির্বাচনে জিন্নার সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্ব বাঙালি মুসলমান শ্রেণী-নির্বিশেষে যে অন্ধ আবেগে গ্রহণ করেছিল সাম্প্রদায়িক হিংসা-বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে, সত্তরের নির্বাচনে সেই বাঙালি মুসলমানই অনুরূপ শ্রেণী-নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্বোক্ত দ্বিজাতিতত্ত্বের ধারণা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে জয়যুক্ত করতে পরবর্তী সময়ের পরিণতি যেমনই হােক না কেন। ঐ রাজনীতির প্রধান কারিগর আওয়ামী লীগ। 

সাধারণভাবে মনে করা হয় ১৯৪০ সালে লাহােরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের অধিবেশনে ভারতীয় মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র বাসভূমির যে প্রস্তাব গৃহীত হয়। তাতেই দেশবিভাগের ভিত তৈরি । ইতিহাসে লাহাের প্রস্তাব’ হিসাবে উল্লিখিত হলেও রাজনৈতিক আলােচনায় তা হয়ে ওঠে ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’। হিন্দু ও মুসলমান দুই ভিন্ন জাতি- জিন্নার এ তত্ত্বের ভিত্তিতেই লাহাের প্রস্তাব (মার্চ, ১৯৪০) দেশবিভাগের তাত্ত্বিক ভিত রচনা করে । | এ প্রস্তাব ঐতিহাসিক হিসাবে চিহ্নিত হলেও এতে ছিল অস্পষ্টতা, গণতান্ত্রিক চেতনার রাষ্ট্রনৈতিক প্রজ্ঞার অভাব যে জন্য দেশ ও দেশের বাইরে এ রাষ্ট্রধারণা অবাস্তব বিবেচিত হতে থাকে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও বিদেশি রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের কারাে কারাে মতে পাকিস্তান চিহ্নিত হয় এক উদ্ভট রাষ্ট্ররূপে (রুপার্ট এমার্সন)। কারণ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয় এমন এক রাষ্ট্ররূপে যার দুই অঞ্চলের মধ্যে কোনাে সীমান্তরেখা নেই এবং দুই অংশের মধ্যে হাজার মাইলের ব্যবধান- মাঝখানে অন্য একটি রাষ্ট্র। লাহাের প্রস্তাবে স্বতন্ত্রভূমির প্রসঙ্গে বলা হয়েছিল যে ‘ভৌগােলিক দিক। থেকে সন্নিহিত ইউনিটগুলাে নিয়ে এবং তার জন্য প্রয়ােজনবােধে আঞ্চলিক রদবদল করে ভারতকে এমন কয়েকটি অঞ্চলে ভাগ করতে হবে যাতে ভারতের উত্তর- পশ্চিম এবং পূর্বাঞ্চল যেখানে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠতা সেখানে স্বাধীন রাষ্ট্রগুলাে (ইংরেজিতে বলা ছিল’ স্টেটস) গড়ে উঠবে এবং সেসব রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত ইউনিটগুলাে হবে স্বশাসিত ও সার্বভৌম ।।  মূল প্রস্তাবটি উদ্ধৃত করে দেশবিভাগ বিষয়ক গবেষণাধর্মী বিশাল গ্রন্থ ‘দ্য গ্রেট ডিভাইড’-এর লেখক এইচ ভি হডসন মন্তব্য করেছেন যে, এ প্রস্তাবের বাক্যরীতি ও ব্যাক্যাংশের তাৎপর্য দুই-ই অস্পষ্ট (অবসকিউর)। কিন্তু প্রস্তাবের মূলনীতি অনুযায়ী এবং অঞ্চলগুলাে যাতে দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র, যােগাযােগ, কাস্টমস ও অন্য প্রয়ােজনীয় বিষয়ে সব কর্তৃত্ব লাভ করতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রেখে একটি সাংবিধানিক পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য ওয়ার্কিং কমিটিকে দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু সে কাজ ওয়ার্কিং কমিটি করেনি। এমন এক অস্বচ্ছ, অস্পষ্ট স্বতন্ত্রভূমির পরিকল্পনা নিয়ে দ্বিজাতিতত্ত্বভিত্তিক লাহাের প্রস্তাবের যাত্রা। এ প্রস্তাবের বড় স্ববিরােধিতা হলাে যেখানে মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র বাসভূমির দাবিতে দেশভাগ করা হচ্ছে সেই স্বতন্ত্ররাষ্ট্রে তথা পাক ভূমিতে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী। মানুষের উপস্থিতি। প্রস্তাবে আরাে বলা হয়, এই ইউনিট ও অঞ্চলগুলােতে। সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষার ব্যবস্থা শাসনতন্ত্রে থাকবে এবং সে ব্যবস্থা তাদের। সঙ্গে পরামর্শের মাধ্যমে করা হবে। এখানেও স্পষ্ট নীতিগত স্ববিরােধিতা । 

স্বভাবতই যুক্তি, বহুজাতিক বহুভাষিক ভারত ভূখণ্ড থেকে কেটে মুসলমান রাষ্ট্র যদি গঠিত হয় তাহলে সে রাষ্ট্রে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর অবস্থান দ্বিজাতিতত্ত্বের স্ববিরােধিতা ও দুর্বলতাই প্রমাণ করে। আর সংখ্যালঘু ভিন্ন সম্প্রদায় যদি থাকেই তাহলে একই যুক্তিতে তারাও এক সময় ওই স্বতন্ত্র রাষ্ট্র কেটে নিজেদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের দাবি তুলতে পারে। পরবর্তী সময় প্রমাণ করেছে যে জিন্নার পরিকল্পিত পাকিস্তানে সংখ্যালঘুর স্বার্থ দূরে থাক, নিরাপত্তাও নিশ্চিত ছিল না। এ ছাড়া একাধিক স্ববিরােধিতা ও অস্পষ্টতা রয়েছে ওই প্রস্তাবে। যেমন মুসলমানপ্রধান উল্লিখিত প্রদেশগুলাের প্রতিটি যদি আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বিবেচিত হয়, তবে সে ক্ষেত্রে তারা কি কোনাে ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত হবে, নাকি আঞ্চলিক ভিত্তিতে পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে গণ্য হবে। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. আম্বেদকরও এ প্রস্তাবের অস্পষ্টতা ও স্ববিরােধিতা নিয়ে অনুরূপ মন্তব্য করে ছিলেন। ওই একই সময়ে (১৯৪০) তার পাকিস্তান অর পার্টিশন অব ইন্ডিয়া’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। ড. আম্বেদকর পাকিস্তান প্রস্তাবের ধোঁয়াশার কারণে এ বিষয়ে নানা প্রশ্ন তুলেছিলেন এই ধারায় যে, প্রস্তাবিত পাকিস্তানে স্বাধীন রাষ্ট্রগুলাে কি স্বতন্ত্র থাকবে নাকি ফেডারেশনে অন্তর্ভুক্ত হবে? অন্তর্ভুক্ত হলে তাে তাদের সার্বভৌমত্ব থাকবে না। এতে রয়েছে দুটো পশুরবিরােধী ধারণা। তাহলে কি সামগ্রিক ব্যবস্থাটি একটি কনফেডারেশনে পরিণত হবে? একজন সংবিধান বিশেষজ্ঞের পক্ষে এ ধরনের বিভিন্ন সম্ভাবনার প্রশ্ন তােলা স্বাভাবিক। শুধু ড. আম্বেদকরই নন, আরাে কেউ কেউ একই প্রশ্ন তুলেছেন। | আমাদের বিস্ময় যে, জিন্না নিজে একজন আইন-বিশেষজ্ঞ হয়েও এ ধরনের একটি অস্পষ্ট, স্ববিরােধী প্রস্তাব উপহার দিলেন কী মনে করে। এ প্রশ্নের জবাব মেলা ভার। এমনকি যিনি এ প্রস্তাব উত্থাপন করেন সেই ফজলুল হকও একজন বিশিষ্ট আইনজীবী, সেই সঙ্গে খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ। তিনিইবা কীভাবে এমন একটি ধোয়াটে প্রস্তাব তুলে ধরলেন এর সবদিক না দেখে, না বুঝে? চার অস্পষ্ট হােক, ঝাপসা হােক কিংবা স্ববিরােধী হােক, লাহাের প্রস্তাবের (এরপর থেকে একে পাকিস্তান প্রস্তাব’-ই বলব) মূল উদ্দেশ্যে কোনাে অস্পষ্টতা ছিল না এবং তাহলাে ভারতীয় মুসলমানদের জন্য স্বাধীন স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের দাবি আর তা ভারত ভাগ করে। কারণ? কারণ একটাই । হিন্দু-মুসলমান নানা দিক থেকে এত ভিন্ন যে তারা এক সঙ্গে থাকতে পারে না। কথাটা জিন্নার । তাহলে প্রশ্ন ওঠে   বিগত শত শত বছর ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি বাস করে এলাে কীভাবে? মারামারি, কাটাকাটি করে? মধ্যযুগের ইতিহাস বা সুলতানি আমলের সেকুলার বাংলা তাে তেমন সাক্ষ্য দেয় না। দুই সম্প্রদায়ের কবিরা মিলেই তাে তখন শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন’ বা ‘রসুল বিজয়’-এর মতাে কাব্যকাহিনী লিখেছেন। তখনকার ইতিহাসে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা বড় একটা দেখা যায়না।

স্বতন্ত্র বাসভূমি কি সে ক্ষেত্রে আন্তঃসাম্প্রদায়িক সমস্যার একমাত্র সমাধান? তাহলে কয়েক কোটি মুসলমানকে ভারতে ফেলে আসা হল কেন? কেন পাকিস্তানে তাদের স্থান হল না? তাতে জিন্নার বিন্দুমাত্র বিকার দেখা গেল না। হতাশ সেই ভারতীয় মুসলমানগণ কি অভিশাপ দিয়ে ছিল তাদের প্রিয় কায়েদে আজমকে । মাওলানা আজাদ তার বইতে এ সম্বন্ধে স্ববিরােধিতার কথা তুলে ধরেছেন। এ প্রসঙ্গে একটি কথা অগ্রিম বলে রাখা ভালাে যে, মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্রভূমির ধারণা কিন্তু জিন্নার কোনাে মৌলিক উদ্ভাবনা নয়। কবি স্যার মােহাম্মদ ইকবাল থেকে রহমত আলী চৌধুরী গ্রুপ তিরিশের দশকেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের ধারণার জন্ম দেন। ‘সারে জাহাসে আচ্ছা হিন্দুস্তান হামারা’ পঙক্তির স্রষ্টা কবি ইকবাল ১৯৩০ সালে মুসলিম লীগ সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে বলেন, পাঞ্জাব, সিন্ধু, উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তান নিয়ে একটি ঐক্যবদ্ধ মুসলিম রাষ্ট্র দেখতে চাই আমি। স্বশাসিত সে রাষ্ট্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভেতরে বা বাইরে যেখানেই হােক।’ এখানে অবশ্য কবি স্পষ্ট করে ভারত বিভাগের কথা বলেননি। পূর্বোক্ত হডসন সাহেব অবশ্য মন্তব্য করেছেন যে, কবি ইকবালের দীর্ঘ বক্তব্যে স্বশাসিত রাষ্ট্র নিয়ে ফেডারেশন গঠনের কথা বলা হয়েছে । হডসনের ভাষায় এখানে দ্বিজাতিতত্ত্ব বা প্রকৃত পাকিস্তান রাষ্ট্রের কথা বলা হয়নি’। হ্যা, স্যার ইকবাল জিন্নার মতাে দ্বিজাতিতত্ত্বের ওপর নির্ভর করে পাকিস্তান চাননি, কিন্তু ভারতীয় মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র বাসভূমির দাবি তুলে ধরেছিলেন। অবশ্য বঙ্গদেশ বাদ দিয়ে। তবে রহমত আলী গ্রুপ পশ্চিমাঞ্চলের মুসলমানপ্রধান প্রদেশগুলাে নিয়ে নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের পরিকল্পনাই তুলে ধরে (১৯৩৩)।

তারা বিলেতে গােলটেবিল বৈঠকে মুসলমান প্রতিনিধিদের ফেডারেল সংবিধান ভাবনারও বিরােধী ছিলেন। ওই গ্রুপের মতে, স্যার ইকবালের ফেডারেল ধারণাটি ভারতীয় মুসলমানদের জন্য যথেষ্ট নয়। এদের কারাে দাবিতেই বঙ্গদেশ অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এ সময়ে একাধিক গ্রুপ বা ব্যক্তি এ বিষয়ে বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে এসেছে, কিন্তু কোনােটারই ভিত্তি রাজনৈতিকভাবে খুব মজবুত বা যুক্তিগ্রাহ্য ছিল না। এদের মধ্যে চমকপ্রদ ছিল পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী স্যার সিকান্দার হায়াত খানের  ত্রিস্তরীয় পরিকল্পনা প্রদেশ, অঞ্চল ও কেন্দ্র নিয়ে। প্রাদেশিক স্তরে বাংলা, সিকিম ও আসাম নিয়ে বৃহদ্বঙ্গের ধারণা সেখানে ছিল। ছিল পশ্চিমের প্রদেশগুলাে নিয়ে গ্রুপ গঠন। তার এ জটিল ফেডারেল পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল যাতে এর চেয়ে খারাপ কোনাে পরিকল্পনা রাজনৈতিক অঙ্গনে উঠে আসতে না পারে। খারাপ বলতে তিনি পাকিস্তান পরিকল্পনার কথাই বলতে চেয়েছিলেন। মজার ব্যাপার হলাে মাস কয়েক পর সিভিলিয়ান পেন্ডেরেল মুন প্রসঙ্গক্রমে স্যার সিকান্দারকে বলেন, পাকিস্তান পরিকল্পনাই তাে তার কাছে সবচেয়ে ভালাে মনে হয় । এ কথা শুনে সিকান্দার হায়াত জবাবে বলেন, এত দিন পাঞ্জাবে থেকেও এমন ধারণা তােমার কী করে হলাে? পাকিস্তান মানে। নৃশংস হত্যাযজ্ঞ (ম্যাসাকার)। এ সুযােগে পাঞ্জাবি মুসলমান হিন্দু বেনিয়াদের গলা কাটতে থাকবে। | পেন্ডেরেল মুন-এর লেখা বই ‘ডিভাইড অ্যান্ড কুইট’-এ রয়েছে এ কাহিনীর সরস বয়ান । অবাক হয়ে ভাবি, সিকান্দার হায়াত কি সম্ভাব্য ভারত বিভাগ ও পাকিস্তানের রক্তাক্ত ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছিলেন? যে জন্য ভারত বিভাগের পরিবর্তে ফেডারেল ভারতবর্ষের একটি জটিল পরিকল্পনার রূপরেখা তুলে ধরেন। তার পুস্তিকায় (আউটলাইনস অব এ স্কিম অব ইন্ডিয়ান ফেডারেশন)। এ পুস্তিকা তিনি জনসাধারণের মধ্যে বিতরণ করেছিলেন সবার অবগতির জন্য ।

বাস্তবিক পাকিস্তান পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পেশােয়ার থেকে পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ হয়ে বিহার বাংলায় যে বীতংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় তার তুলনা নেই  ভাগ্যিস ওই ভয়াবহতা দেখতে স্যার সিকান্দার হায়াত ততদিন বেঁচে ছিলেন  কিন্তু জিন্না এসব নিয়ে ভাবিত ছিলেন না। তিনি যে কোনাে মূল্যে ভারত বিভাগ ও পাকিস্তান গঠনের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। তাই দেশবিভাগের জন্য মরিয়া জিন্না ১৬ আগস্ট ১৯৪৬ ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ ঘােষণা করে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের পথ তৈরি করে রক্তস্রোতের বিনিময়ে দেশবিভাগ অনিবার্য করে তোলেন। যে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা-বিদ্বেষ ও বৈরিতার মধ্য দিয়ে পাকিস্তান অর্জনের পথ তৈরি হয় তার ভবিষ্যৎ পরিণাম নিয়ে তিনি ভাবেননি। তাৎক্ষণিক অর্জনই তার কাছে বড় হয়ে ওঠে। শীতল, নির্মোহ, আবেগহীন জিন্নার সঙ্গে সিকান্দারের অনেক তফাৎ।  কিন্তু কেন? এর একটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছেন কেউ কেউ । তার পারিবারিক জীবনে, ব্যক্তিজীবনে ওপরে ওঠার লড়াই ছিল তার প্রচণ্ড অহমবােধের সমান্তরাল। যে বােধ তার মধ্যে একনায়কী বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব। ঘটিয়েছে। তৈরি করেছে নিঃসঙ্গ ব্যক্তিত্ব। কামরুদ্দিন আহমদ তাকে মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত’রূপে চিহ্নিত করেছেন। এমনকি লিখেছেন, পাকিস্তানের জন্য তার। 

কোনাে অবসেশন’ ছিল না। ছিল রাজকোটের দেওয়ানের পুত্র এম.কে গান্ধি ও কাশ্মিরি বর্ণশ্রেষ্ঠ পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর ওপর গায়ের ঝাল ঝাড়া এবং ভারত ভেঙে প্রতিশােধ নেয়া। এমন এক মানসিকতার কারণে তার পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হওয়া । ঠিক মনে নেই কবে যেন একটা ইংরেজি লেখায় জিন্নার এ জাতীয় স্যাডিস্ট’ মানসিকতার কথাই পড়েছিলাম । এসব পড়ার আগে সেই স্কুল জীবনে যখন রাজনীতি নিয়ে বড় বেশি মাথা ঘামাতাম তখনাে আমার মনে হয়েছে এ স্ববিরােধী চিন্তার মানুষটি বুঝি ভারতীয় রাজনীতিতে সর্বনাশের দূত। কিন্তু কেন? বলছি আমার ভাবনার কথা। তার আগে একটা কথা বলে নিই । হডসনও অনেকটা কামরুদ্দিন আহমদের মতাে, তবে অনেকটা সহানুভূতির সুরে বলেছেন জিন্নার ব্যক্তিজীবনের ট্র্যাজেডির কথা, তার ‘অশান্ত, নিরানন্দ গার্হস্থ্য জীবনের কথা। তবে তা দু-এক বাক্যে। কামরুদ্দিন সাহেবের মতাে বিস্তারিতভাবে নয়। এ বিষন্নতার প্রভাব পড়েছে তার রাজনৈতিক জীবনে। সেখানে লক্ষ্য অর্জনে (যা প্রায়ই ব্যক্তিক) নির্মম হতে কিংবা অমানবিক হতে বাধা নেই । বাধেনি মি. জিন্নার। | তাই যে মানুষটি পােশাক-পরিচ্ছদে ও আচরণে বিলেতি কেতায় সপ্রতিভ ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটান, নাম মােহাম্মদ আলী (পিতৃদত্ত নাম) হলেও ধর্মে বা ধর্মাচরণে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই সে মানুষটি কী না ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিলেন যা স্ববিরােধিতারও চরম। আবার যে রাজনীতিক জিন্না এক সময় ভারতে হিন্দু-মুসলর্মনি ঐক্যের অগ্রদূত’ (সরােজিনি নাইডু) হিসেবে খ্যাতি কেনেন এবং ১৯২৪ সালেও মুসলিম লীগের একসভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেন, ‘ভারতে বিদেশী শাসনের স্থায়িত্বের পেছনে রয়েছে হিন্দু-মুসলমানের অনৈক্য, হিন্দু-মুসলমান এক হলেই স্বরাজ অর্জন সম্ভব’ সেই মানুষটিই এক যুগ পর ভিন্ন সুরে কথা বলেন।

দিল্লিতে ১৯৩৬ সালের মার্চে জিন্না বলেন, “নিজ সমপ্রদায়ের কথা আমাদের ভাবতে হবে। হিন্দু ও মুসলমানকে পৃথকভাবে সংগঠিত হতে হবে। এবার যেন তার চলার পথ ঠিক হয়ে গেছে সম্প্রদায়-চেতনার ভিত্তিতে। দেড় বছর পর লক্ষেতে এক বক্তৃতায় তার কণ্ঠে সাম্প্রদায়িক বিচ্ছিন্নতার সুর বেশ চড়া। তার মতে, মুসলমানের লড়াইটা হিন্দুর সঙ্গে। অর্থাৎ ভারতের স্বাধীনতা তার জন্য কোনাে অর্থবহ বিষয় নয় বলেই লড়াই বিদেশি রাজশক্তির বিরুদ্ধে নয়। বিস্মিত গান্ধি এ বক্তব্যকে চিহ্নিত করেন যুদ্ধ ঘােষণা হিসেবে। এর পরই ১৯৪০ সালের মার্চে ঐতিহাসিক (!) লাহাের প্রস্তাব । তালাক দিলেন হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের তত্ত্বকে, কিন্তু বর্জন করেননি হিন্দু নেতার দেওয়া খেতাব কায়েদে  আজম’ । এখন তার মাথায় টুপি, পােশাকের পরিবর্তন। এমএ জিন্না হয়ে ওঠেন। ‘কায়েদে আজম জিন্না”, কায়েদে আজম’ উপাধিটা অবশ্য যাদের বিরুদ্ধে তার জেহাদ তাদের কাছ থেকেই পাওয়া। এখন এটা হয়ে ওঠে ‘দ্য গ্রেট ডিকটেটরের প্রতীকী পরিচয়চিহ্ন। কয়েক পাতায় লাহাের প্রস্তাব ভিত্তিক দেশবিভাগের মূলকথার পর দেখা দরকার ভারতীয় রাজনীতির বিভাজক চিত্র চরিত্র। 

সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!