You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.11.02 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | বৃহৎ ত্রি-শক্তির ভেটো | চিনি থেকেও নেই | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা : ২রা নভেম্বর, শনিবার, ১৯৭৪, ১৫ই কার্ত্তিক, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ

বৃহৎ ত্রি-শক্তির ভেটো

আগে থেকেই আঁচ করা গিয়েছিল এমনটি হবে। অঙ্কের চিরাচরিত নিয়মে দুয়ে দুয়ে চারই হয়। শেষ পর্যন্ত হয়েছেও তাই। জাতিসংঘ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকাকে বর্ণবৈষম্যবাদী নীতি অবলম্বনের জন্য বহিষ্কারের দাবীকে সামাল দেবার জন্য বৃহৎ ত্রি-শক্তি একযোগে নিরাপত্তা পরিষদ ভেটো প্রয়োগ করেছে। ত্রি-শক্তিটি হলো-যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন ও ফ্রান্স। জাতিসংঘের ইতিহাসে তিনটি বৃহৎ শক্তিকে একযোগে ভেটো প্রদানের নজির অতীতে ছিল না। সেদিক থেকে তিনটি দেশ ইতিহাস স্থাপন করলো।
কথায় বলে গরজের নাম বাবাজী। মুখে যতই ন্যায়নীতি ও মানবতার কথা বলা হোক না কেন, স্বার্থে আঘাত লাগলে সব কিছুই ভুলুষ্ঠিত হয়। দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতকায় সরকার বিগত ২৬ বছর ধরে কৃষ্ণাঙ্গ অধিবাসীদের উপর যে অকথ্য নির্যাতন, নিপীড়ন চালিয়েছে তার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। ‘নীলরক্ত সাদা চামড়া’র দোহাই দিয়ে সেখানকার কৃষ্ণাঙ্গ অধিবাসীদের সকল রকম অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। জেল, জুলুম, পুলিশী হামলা তো নিত্যদিনকার ঘটনা। সাদা আর কালোর মধ্যে এমন এক দেয়াল নির্মাণ করেছে ভোরস্টার সরকার যে দেওয়ালে মাথা ঠুকে মরছে অগণিত কালো মানুষ। একমাত্র অপরাধ তাদের গায়ের রং কালো। রবেন আইল্যান্ডের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে দশ হাজারেরও বেশী রাজনৈতিক বন্দীকে আটক করা হয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের নেতা মিঃ নেলসন মান্ডেলা ও মিঃ ওয়াল্টার সিসুলু। যাবজ্জীবন কারান্তরালে এদের থাকতে হবে। ১৯৭৩ সালে একশ’ পঞ্চাশ জন দক্ষিণ আফ্রিকাবাসীকে ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলানো হয়। সত্তর হাজারকে বেত মারা হয় এবং নয়শ’ জনকে কারাগারে অথবা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানো হয়। দৈহিক নির্যাতনের ফলে ১৯৭২ সালে দু’শ পঁয়ষট্টি জন বন্দী মারা গেছেন। সেখানে সভা-সমিতি বা জমায়েত হবার কোনো অধিকার নেই। অধিকার নেই শ্রমিক সংগঠন করার, অধিকার নেই বেতন বৃদ্ধির দাবী তোলার। এক কথায় দক্ষিণ আফ্রিকা হলো বিভীষিকার রাজ্য। এই নজিরবিহীন নির্যাতন ও নিপীড়নের কথা বিশ্ববাসীর অজানা নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এমনকি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্যবাদী নীতির তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে। এমনকি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিনিধির পরিচয়পত্র প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। চলতি বছরের মে মাসে জাতিসংঘের বিশেষ কমিটি দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্যবাদের উপর আলোচনা করার জন্য বার্লিনে এক বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। বৈঠকে সম্মিলিতভাবে অভিমত প্রকাশ করা হয় যে, বর্ণবৈষম্যবাদ বিশ্বশান্তির পক্ষে হুমকিস্বরূপ।
দক্ষিণ আফ্রিকাকে বহিষ্কারের বিষয় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ একমত হলেও নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন প্রয়োজন ছিল। কেনিয়া, ক্যামেরুন, মৌরিতানিয়া ও ইরাক যুক্তভাবে প্রস্তাবটি উত্থাপন করে। দক্ষিণ আফ্রিকাকে বহিষ্কারের প্রশ্নে পরিষদের ১৫টি দেশের মধ্যে ১০টি দেশই ভোট দান করে। কাজেই প্রস্তাবটিকে বানচাল করার জন্য একযোগে যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন ও ফ্রান্সকে ভেটো প্রয়োগ করতে হয়।
যারা জেগে ঘুমায় তাদের জাগানো মুশকিল এক্ষেত্রে হয়েছেও তাই। তবে দক্ষিণ আফ্রিকাকে বহিষ্কারের প্রশ্নে যাই করা হোক না কেন একদিন না একদিন জাতিসংঘ থেকে বিদায় নিতে হবেই। বিশ্ব জনমত, সত্য, ন্যায়নীতি ও মানবতাকে উপেক্ষা করে টিকে থাকা যায় না। ইতিহাস এমন কথা বলে না।

চিনি থেকেও নেই

পর্যাপ্ত চিনি মওজুত আছে অথচ জনসাধারণ হা—চিনি, হা—চিনি করছেন। ‘বাংলার বাণী’র প্রতিবেদন সূত্র জানাচ্ছে—বাংলাদেশ চিনিকল সংস্থার চৌদ্দটি গুদামে গত নভেম্বর মাস থেকে ১৭ হাজার ৫শত ৪৮ টন চিনি পড়ে আছে। দীর্ঘদিন পড়ে থাকায় পোকায় বস্তা কেটে ফেলেছে আর অনেক বস্তা ফেটে প্রায় ৭শত টন চিনি নষ্ট হয়ে গেছে। এবং বাংলাদেশ চিনিকল সংস্থার চেয়ারম্যান ঐ বিপুল পরিমাণ চিনি পড়ে থাকা ও নষ্ট হবার কথা স্বীকারও করেছেন।
দেশের ব্যাপক চিনি চাহিদার প্রেক্ষিতে এত চিনি নষ্ট হবার কারণস্বরূপ প্রতিবেদন সূত্রে খাদ্য বিভাগকেই দায়ী করা হয়েছে। কারণ গুদামে রক্ষিত উৎপাদনজাত চিনি বিলি-বন্টনের দায়িত্ব খাদ্য বিভাগেরই বটে। তাঁরা সে দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেননি। এবং বিভাগীয় কর্মকর্তাদের চূড়ান্ত গাফিলতির ফলেই তাই দেশে আজ পর্যাপ্ত চিনি থাকা সত্ত্বেও কচি দুধের বাচ্চারা একদানা চিনির মুখ দেখতে পায় না। কি অমানবিক ব্যাপার।
চিনি বন্টনের অন্য ব্যবস্থা হলো জেলাভিত্তিক খাদ্য বিভাগ ছাড়াও হোলসেল। গত একমাসে খাদ্য বিভাগ বিভিন্ন জেলা খাদ্য বিভাগের হোলসেলারদের নামেও ১০ হাজার টন চিনি বরাদ্দ করেছিল। এই বরাদ্দের কথা কাগজে-কলমে স্বীকৃতি থাকা সত্ত্বেও গত এক মাসে বিভিন্ন জেলা খাদ্য বিভাগ গুদাম থেকে মাত্র ২ হাজার টন চিনি উঠিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই বাকী চিনি গুদামে অযত্নে পড়ে থাকে, অস্বাভাবিক চিনি সংকট সৃষ্টি হয় এবং জনগণের ভোগান্তি বাড়ে।
অতঃপর অস্বাভাবিক চিনি সংকট ভয়াবহ আকার নেওয়ায় সেই পরিস্থিতি মোকাবেলা করার উদ্দেশ্যে খাদ্য বিভাগের তরফ থেকেই সরাসরি খুলনা থেকে ৮ হাজার মণ চিনি দ্রুত ঢাকায় আনার জন্য ১৭ই অক্টোবর একটি জাহাজ ঢাকার পথে রওয়ানা করে দেয়। পথিমধ্যে জাহাজখানা আকস্মিক যান্ত্রিক গোলযোগের জন্য ১০ দিন আটকে থাকে। ফলে নগরীতে চিনি সংকট চূড়ান্ত হয়। রেশনের দোকানে তো বটেই, খোলাবাজারেও টাকা দিয়ে চিনি সংগ্রহ করা কয়েকদিন সম্ভব হয়নি বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়।
অনেকের ধারণা চিনি সংকটের জরুরী মোকাবেলার মুখে খুলনা থেকে ঢাকাগামী চিনি ভর্তি জাহাজ পথিমধ্যে ১০ দিন আটকে থাকার কারণটা ঠিক যান্ত্রিক নয়। তা বিশেষ মহলেরই ষড়যন্ত্র। যদিও অনুমানের উপর নির্ভর করে কথা বলা অনুচিত, তবু প্রতিবেদনভিত্তিক সন্দেহকে একেবারে উড়িয়ে দেয়া হয়তো যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ গুদামজাত দ্রব্যাদি সরবরাহ ও যথাস্থানে পৌঁছুতে না দিয়ে দেশের বিভিন্ন খাতে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির করার সংবাদ আমরা আগেও পেয়েছি এবং তথ্যাদি সহ সে সকল খবর পত্রিকান্তরের পৃষ্ঠায় ছাপাও হয়েছে।
এরই প্রেক্ষিতে খাদ্যমন্ত্রীর বক্তব্য আরও ঘোলাটে। তিনি বলেছেন যে—জাহাজ, ওয়াগন ও ট্রাকের অভাবেই গুদাম থেকে চিনি যথাস্থানে আনা-নেয়া করা সম্ভব হয় না। কিন্তু এই অজুহাতে দুর্ভিক্ষাবস্থাকালে হাজার হাজার টন চিনি গুদামজাত হয়ে পড়ে থাকবে এবং জনগণের দুর্দশা ও ভোগান্তি চূড়ান্ত পর্যায়কেও ছাড়িয়ে যাবে—এটা প্রশংসা বা শ্লাঘার কথা নয়। বিশেষ করে যেখানে দেশকে চিনি উৎপাদনে স্বয়ম্ভর করার কথা এমনকি উৎপাদনকে লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করিয়ে তা থেকে বিদেশে চিনি রপ্তানী করার কথা সেখানে চিনি নিয়ে এত হেলা-ফেলা কেন? পরিবহন ব্যবস্থার তুচ্ছ প্রসঙ্গই বা কেন।
ঐ প্রতিবেদন সূত্রই আরো জানাচ্ছে—দেশে চৌদ্দটি চিনি কলে যে চিনি গুদামজাত হয়ে পড়ে আছে—তা থেকেই ১০ হাজার টন চিনি বিদেশে রপ্তানী করার কথা ছিল। সেই চিনিও রপ্তানী হয়নি। এ ব্যাপারে নাকি সরকারী তৎপরতার অভাবই দায়ী। আমাদের বক্তব্য হলো—কে দায়ী বা কে নির্দোষ তা নিয়ে আমাদের মাথা ব্যথা নেই। সময়োচিত কাজগুলো না হবার জন্য যখন আর পরিস্থিতি সামলানো যায় না—তখনকার নির্লজ্জ ঠেলাঠেলি দেখতেও আমরা ইচ্ছুক নই। আমরা চাই কাজ। সংশ্লিষ্ট দপ্তর নিজের কাজ যে কোনো মূল্যে করে যাবেন। দেশের স্বার্থের আবেদন তাঁদের কাছে না থাকলেও কর্তব্যপরায়ণতার দোহাই মানতেই হবে। বিকল্পে ভয়ানক পরিণতি দেখতে চাই না আমরা।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন