You dont have javascript enabled! Please enable it! একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় - সংগ্রামের নোটবুক

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চেতনার উন্মেষ কেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।  তাই ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ বা ‘বাঙালি এথনিক ক্লিনজিং’ শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে । ওইদিন সকালবেলা একটি সামরিক হেলিকপ্টারে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল জানজুয়া, মেজর জেনারেল মিঠঠা খান, মেজর জেনারেল নজর হােসেন শাহ এবং মেজর জেনারেল ওমর রংপুর, রাজশাহী, যশাের, চট্টগ্রাম এবং কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে “অপারেশন প্ল্যান’ পাকিস্তানি কমান্ডারদের দিয়ে আসেন। ঢাকায় প্রধান টার্গেট ছিল ৩২ নম্বর ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা ইপিআর হেডকোয়ার্টার্স এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইন। জেনারেল ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট হাউস (পুরনো গণভবন) ত্যাগ করে যান বিকেল ৫টা ৪৫ মিনিটে। তিনি গােপনে বিমানযােগে কলম্বাে হয়ে সরাসরি করাচি যাত্রা করেন। এটাই ছিল তার শেষ ঢাকা সফর। ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ সম্পর্কে পাকিস্তানি পরিকল্পনার কথা জানা যায়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানে ইস্টার্ন কমান্ডের জনসংযােগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিক লিখিত “উইটনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থ থেকে। আমরা তার গ্রন্থ থেকে প্রাসঙ্গিক অংশ “মেজর জেনারেল খাদিম হােসেন রাজা ২৫ মার্চ রাজনৈতিক আলােচনার ফলাফল জানার জন্য উদগ্রীব হয়েছিলেন, সকাল প্রায় ১১টার সময় তার সবুজ টেলিফোন। বেজে উঠল, লে. জেনারেল টিক্কা খান লাইনে ছিলেন, তিনি বললেন : ‘খাদিম এটা আজ রাতে।’ এ খবর খাদিমের মনে কোনাে উন্মাদনার সৃষ্টি করল না, তিনি হাতুড়ির আঘাত পড়ার অপেক্ষায় ছিলেন। খাদিম তার অধীনস্থ মহলে আদেশটি বাস্তবায়নের জন্য নির্দেশ দিলেন। খবর যতই নিচের দিকে যাচিছল, ততই উত্তেজনা বাড়ছিল। 

আমি দেখলাম, কয়েকজন জুনিয়র অফিসার কয়েকটি অতিবিক্ত রিকয়েলেস রাইফেল (ট্যাংক বিধ্বংসী) ও অতিরিক্ত গােলাবারুদ সংগ্রহ এবং একটি ত্রুটিপূর্ণ মর্টার বদলানাের চেষ্টা করছে। কয়েকদিন আগে রংপুর থেকে আনীত ২৯ নং ক্যাভালরির ৬টি এম– ২৪ ট্যাংকে রাতে ব্যবহারের জন্য জ্বালানি বােঝাই করা হচ্ছে। ঢাকার রাস্তায় ভীতি প্রদর্শনের জন! ওই ট্যাংকগুলাে যথেষ্ট। ১৪শ ডিভিশনের সদর দপ্তর থেকে ঢাকার বাইরে অবস্থিত সব গ্যারিসনে আক্রমণের সময় বা এইচ আওয়ার’-এর কথা জানিয়ে দেয়া হয় একটি গােপন সংকেতের মাধ্যমে, যাতে সব গ্যারিসন একসঙ্গে অভিযান শুরু করতে পারে। এইচ আওয়ার নির্ধারিত হয়েছিল ২৬০১০০ ঘণ্টা অর্থাৎ রাত ১টা, ২৬ মার্চ। অনুমান করা হয়েছিল, ২৫ মার্চ রাত ১২টার পর অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে জেনারেল ইয়াহিয়া খান করাচি বিমানবন্দরে অবতরণ করেছেন। “অপারেশন সার্চ লাইটের জন্য দুটি সদর দপ্তর স্থাপন করা হয়েছিল। মেজর জেনারেল ফরমান ৫৭ নং বিগেড নিয়ে ব্রিগেডিয়ার ‘আরবাবের অধীনে ঢাকা শহরে অপারেশন করবেন। আর মেজর জেনারেল খাদিম প্রদেশের বাকি অংশের অপারেশন তদারক করবেন। লে. জেনারেল টিক্কা খান এবং তার স্টাফ দ্বিতীয় রাজধানীতে (শেরেবাংলা নগর) মার্শাল ল’ হেডকোয়ার্টারে ঢাকা ও বাইরের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য রাতভর অবস্থান করবেন।… …আমাদের মতাে জুনিয়র অফিসাররা দ্বিতীয় রাজধানীর মার্শাল ল’ হেড কোয়ার্টার্সে রাত ১০টা থেকে সমবেত হতে থাকি। আউটডোর ‘অপারেশন রুমের পাশেই ওয়্যারলেস ফিট করা একটি জিপগাড়ি রাখা ছিল। ওয়্যারলেস সেটটি রাত প্রায় ১১টা ৩০ মিনিটের সময় বেজে উঠল। ঢাকার স্থানীয় কমান্ডার ‘এইচ আওয়ার এগিয়ে আসার অনুমতি চাইল, কারণ প্রতিপক্ষ প্রতিরােধের জন্য দ্রুত তৈরি হচ্ছিল। সবাই ঘড়ির দিকে তাকাল। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তখনাে কলম্বো এবং করাচির মাঝামাঝি পথে । জেনারেল টিক্কা সিদ্ধান্ত দিলেন, ববিকে (আরবাব) বলাে যতক্ষণ সম্ভব সে যেনাে অপেক্ষা করে। নির্দিষ্ট সময়ে ব্রিগেডিয়ার আরবাবের ব্রিগেড নিম্নরূপ অ্যাকশনে। যাবে : ১৩ নং ফ্রন্টিয়ার ফোর্স ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে থাকবে রিজার্ভ বাহিনী হিসেবে এবং প্রয়ােজনবােধে ক্যান্টনমেন্ট রক্ষা করবে । ৪৩ নং লাইট অ্যান্টি এয়ারক্রাফট রেজিমেন্ট ঢাকা বিমানবন্দর এলাকায় মােতায়েন এবং দায়িত্বে থাকবে । ২২ নং বালুচ রেজিমেন্ট ইতােমধ্যে পিলখানা ইপিআর সদর দপ্তরে মোতায়েন রয়েছে, তারা ৫ হাজার ইপিআর জোয়ানকে নিরস্ত্র করবে এবং ওয়্যারলেস এক্সচেঞ্জ দখল করে নেবে। 

৪. ইকবাল (জহুরুল হক), জগন্নাথ, লিয়াকত (প্রকৌশল) হল দখল।

৫. রেল, নদীপথ বন্ধ করে দেয়া, নদীতে টহল দান।

৬. গাজীপুর অস্ত্র কারখানা এবং রাজেন্দ্রপুর অস্ত্রভাণ্ডার রক্ষা করা। দৃষ্টি আকর্ষণ : ১৪ নং ডিভিশনের প্রধান মেজর জেনারেল খাদিম হােসেন রাজা।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট’ বা জেনােসাইড বাংলাদেশ’ অভিযান পরিকল্পনার যতটুকু সিদ্দিক সালিকের ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থে ‘আই এসআই” বা পাকিস্তান ইন্টার সার্ভিস ইনটেলিজেন্স’-এর দ্বারা অনুমােদিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে, তা থেকে ৩২ নম্বর ধানমণ্ডি বঙ্গবন্ধু ভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, পিলখানা ইপিআর সদর দপ্তর এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণের পাকিস্তানি পরিকল্পনা এবং প্রস্তুতি সম্পর্কে মােটামুটি একটা ধারণা পাওয়া যায়। পাকিস্তানি জেনােসাইড, বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ম্যাসাকার নিয়ে বিশ্বের প্রচার মাধ্যমে যে তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়, তা অবমােচনের জন্যই সত্য-মিথ্যামিশ্রিত তথ্যে ভরপুর মেজর সিদ্দিক সালিকের ‘উইটনেস টু সারেন্ডার গ্রন্থটি প্রকাশ করা হয়েছিল। এই গ্রন্থ ছিল ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর গণহত্যা বা বাঙালি নিধনযজ্ঞের সাফাই গাওয়ার প্রয়াস। কিন্তু এই গ্রন্থের অর্ধসত্য বিবরণীতেও পাকিস্তানি অভিযানের ব্যাপকতা, নৃশংসতা। এবং বর্বরতা গোপন থাকেনি। সিদ্দিক সালিক তার গ্রন্থে ‘৭১-এর ২৫ মার্চ রাতের অভিযানের ফলাফল পাদিন অর্থাৎ ২৬ মার্চ সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। আমরা তার দেয়া বিবরণী সংক্ষেপে বাংলায় উদ্ধৃত কবছি, ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে পাক বাহিনী প্রথম প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় ফার্মগেটে, রাস্তায় পড়ে থাকা একটা বিশাল গাছ বাহিনীর গতিরােধ করে, রাস্তার পাশের এলাকা পুরনাে গাড়ি এবং স্টিমরােলার দিয়ে বন্ধ করা ছিল। ব্যারিকেডের শহরের দিক থেকে কয়েকশ’ আওয়ামী লীগার ‘জয়বাংলা’ স্লোগান দিচ্ছিল। আমি জেনারেল টিক্কা খানের সদর দপ্তরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেই উচ্চকিত স্লোগান শুনতে পাচ্ছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে জয়বাংলা স্লোগানের সঙ্গে রাইফেলের কয়েকটি গুলির আওয়াজ শুনলাম, একটু পর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গর্জন বাতাসে ভেসে এল।

তারপর গােলাবর্ষণ এবং শ্লোগানের মিশ্র শব্দ শোনা গেল। মাঝে মাঝে এলএমজির গুলির শব্দও শােনা যাচ্ছিল। ১৫ মিনিট পর শব্দ কমে এল এবং শ্লোগান মিলিয়ে গেল। সেনাবাহিনী শহরের দিকে অগ্রসর হতে লাগল। অস্ত্রের জয় হলাে। সুতরাং নির্দিষ্ট সময়ের আগেই অভিযান শুরু হয়ে যায়। এখন। আর এইচ আওয়ার’-এর জন্য অপেক্ষা করে লাভ নেই। কারণ ইতিমধ্যেই   নরকের দরজা খুলে গেছে ।…মুজিব যখন ক্যান্টনমেন্টে অবস্থিত আদিমজী স্কুলে বন্দি অবস্থায়, তখন ‘ঢাকা মহানগরী গৃহযুদ্ধের যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট | আমি টিক্কা খানের সদর দপ্তরের বারান্দায় দাড়িয়ে চার ঘণ্টা যাবৎ সেই ভয়াবহ দৃশ্য দেখেছি। সেই রক্তাক্ত রাতের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল । গােলাবর্ষণের ফলে আকাশে আগুনের। লেলিহান শিখা, এক এক সময় আগুনের হল্কা এবং ধােয়া তারার দিকে সম্প্রসারিত আকাশের মেঘকে গ্রাস করে ফেলছিল । চাদের আলাে আর তাবার ছটা মনুষ্যসৃষ্ট। নরকের আগুনের কাছে ম্লান হয়ে যাচ্ছিল। শহরের অন্যান্য অঞ্চলের, বিশেষত দৈনিক ‘পিপল’ পত্রিকার জ্বলন্ত রূপ ওই অগ্নিযজ্ঞে কম অবদান রাখেনি। রাত প্রায় ২টার সময় জিপগাড়ির ওয়্যারলেস সেটটি আবার বেজে উঠল। অপর প্রান্ত থেকে ক্যাপ্টেন জানালাে, তারা ইকবাল ও জগন্নাথ হলে তীব্র প্রতিরােধের সম্মুখীন হচ্ছে। ইতােমধ্যে একজন সিনিয়র স্টাফ অফিসার আমার হাত থেকে ওয়্যারলেসের মাউথপিসটি কেড়ে নিয়ে অপর প্রান্তকে জিজ্ঞেস করল, লক্ষ্যবস্তু আয়ত্তে আনতে কত সময় লাগবে? চার ঘন্টা! ননসেন্স, তােমাদের কাছে কী কী অস্ত্র আছে? রকেট লঞ্চার, রিকয়েলেস রাইফেল, মটার এবং… ঠিক আছে, সবগুলাে একসঙ্গে ব্যবহার করে এবং দুই ঘণ্টার মধ্যে ওই অঞ্চল দখল করাে। বিশ্ববিদ্যালয় ভবনগুলাে ভাের চারটার মধ্যে ‘দখল হয়ে যায়; কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শ, যা বেশ কয়েক বছর ধরে প্রচারিত হচ্ছিল, তা অবদমিত। হতে আরাে অনেক সময় লাগবে, কারণ আদর্শকে কখনাে জয় করা যায় না।…

২৬ মার্চ সকালে ভােরের আলাে ফুটে ওঠার আগে সেনাবাহিনী তাদের অভিযান শেষ হওয়ার খবর জানায়। জেনারেল টি খন ভাের পাঁচটায় তার সােফা ছেড়ে অফিসে ঢোকেন এবং কিছুক্ষণ পর চশমা সাফ করতে করতে বেরিয়ে আসেন। সমগ্র অঞ্চল পর্যবেক্ষণের পর তিনি বলেন, ‘না কোথাও কোনাে জনপ্রাণী নেই’ । বারান্দায় দাড়িয়ে আমি ওই কথা শুনতে পাই এবং চারদিকে তাকিয়ে আমি কেবল একটি নেড়ি কুত্তাকে লেজ গুটিয়ে শহরের দিকে চলে যেতে দেখি। ভােরের আলাে ছড়িয়ে পড়ার আগে সেনাবাহিনী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল (শেরাটন) থেকে বিমানবন্দরে নিয়ে গেলাে। প্লেনে ওঠার আগে তিনি গত রাতে ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৎপরতা সম্পর্কে তার ‘এসকর্ট ব্রিগেডিয়ার আরবাবকে বলেন, ‘আল্লাহকে ধন্যবাদ, পাকিস্তান বেঁচে গেছে।’ করাচি বিমানবন্দরে পৌছে তিনি তার ওই উক্তির পুনরাবৃত্তি করেন।  

জুলফিকার আলী ভুট্টো যখন ওই মন্তব্য করেছিলেন, তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গণকবরগুলাে জরিপ করছিলাম। সেখানে আমি তিনটি ঢিবি দেখতে পাই, যার প্রতিটি ৩ থেকে ১৫ মিটার ডায়ামিটারের ছিল, সেগুলাে নতুন মাটিতে ভরাট করা কিন্তু কোনাে অফিসার মৃতের প্রকৃত সংখ্যা জানাতে রাজি ছিল না। আমি দালানগুলাে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম, বিশেষত ইকবাল ও জগন্নাথ হলের, যেগুলাে। আমার মনে হলাে, অ্যাকশনের মাধ্যমে গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ইকবলি হলে ২টি এবং জগন্নাথ হলে ৪টি রকেটের আঘাত লাগে, ঘরগুলাে জ্বলে গেলেও অটুট ছিল, কয়েক ডজন আধপােড়া রাইফেল এবং কিছু কাগজপত্র তখনাে জ্বলছিল। ক্ষতির পরিমাণ ছিল ভয়াবহ; কিন্তু জেনারেল টিক্কার সদর দপ্তরের বারান্দা থেকে যে ভয়াবহ দৃশ্য দেখেছিলাম, ঠিক ততটা নয়। বিদেশি পত্রপত্রিকায় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় হাজার খানেক লােককে হত্যার কথা লেখা হলে ও অফিসাররা সেই সংখ্যা একশ’র কাছাকাছি নির্ধারণ করেছিল, তবে স্বীকার করা হয়েছিল ৪০ জনকে হত্যা করার কথা।

মেজর সিদ্দিক সালিকের সত্য, অর্ধসত্য ও অসত্যমিশ্রিত ১৯৭১ সালের ২৫২৬ মার্চের উপরােক্ত বিবরণী থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর আগ্রাসনের যে চিত্র পাওয়া যায়, তার সঙ্গে ২৫ থেকে ২৭ মার্চ ১৯৭১ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, রাজারবাগ পুলিশ লাইন প্রভৃতি এলাকা সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শী বাঙালিদের বিবরণী মিলিয়ে দেখলে মেজর সিদ্দিক সালিকের প্রচারণার ফাঁক-ফোকর। ও সাফাই ধরা পড়ে। প্রথমেই বিজ্ঞানী ড. মােজাম্মেল হােসেন কর্তৃক টেপে ধারণকৃত অ্যাকশনরত পাকিস্তান বাহিনীর ইউনিটগুলাের ওয়্যারলেস সংলাপ (দৈনিক বাংলা, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২)। রেডিও খুলে নিয়ে ডায়াল ঘোরাতে শুরু করলাম । ৯০ মিটারে পেয়ে গেলাম যা খুজছিলাম। হানাদার বাহিনীর দলগুলাের একে অপরের সঙ্গে কথাবার্তা । ইতােমধ্যে। বেডিওতে শুনেছি পাক কমান্ডারের গলা। জানাচ্ছে, “দি বিগ ফিশ হ্যাজ বিন কট।’ কার কথা বলছে, তা বুঝতে এক মুহূর্তও দেরি হয়নি। কিন্তু মন কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায়নি যে, বঙ্গবন্ধু বন্দি হয়েছেন। হঠাৎ কানে এলাে আবার কন্ট্রোলের গলা, ‘দেয়ার ইজ নাে কোশ্চেন অফ টেকিং প্রিজনার । দে আর শুটিং অ্যাট ইউ, সে ওয়াইপ দেম অফ । 

ধীরস্থির গলায় হুকুম দিচ্ছিল কমান্ডার-এতটুকু উত্তেজনা ছিল না কণ্ঠস্বরে। পরে জেনেছিলাম, ওই গলা ছিল ব্রিগেডিয়ার আরবাব খানের। ওই গলায় তিনি আনন্দে বিভিন্ন টার্গেট দখলের খবর দিচ্ছিলেন, সবাইকে জানাচ্ছিলেন যে, দৈনিক পিপল পত্রিকার অফিস উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কী সাংঘাতিক ক্রোধ ছিল পিপলের ওপর । ট্যাংক বিধ্বংসী কামান ব্যবহার করেছে পিপল অফিসের ওপর পাকসেনারা। এটি ছিল ২৬ নম্বর ইউনিট। পরে জেনেছি, এম ইমাম’ ছিল কর্নেল তাজ, যার হেডকোয়ার্টার প্রেসিডেন্ট হাউস। এই ২৬ নম্বর ইউনিট হত্যা করেছে লে. কমান্ডার মােয়াজ্জেমকে। ঠাণ্ডা মাথায় তাকে হত্যা করে জিপের পেছনে দড়িতে বেঁধে রাস্তায় টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তার মৃতদেহ। এই ২৬ নম্বর ইউনিট আক্রমণ করেছে রাজারবাগ পুলিশ লাইন। সবচেয়ে উল্লাস ছিল এই ২৬ নম্বর ইউনিটেরই । তার বীরত্বের পুরস্কার হিসেবে কর্নেল তাজকে করা হয়েছিল ডিএসএ, এমএল- ডেপুটি সাব অ্যাডমিনিস্ট্রেটর, মার্শাল ল’ । মাঝে মাঝে কন্ট্রোলের গলা শোনা যাচ্ছিল । “দ্যাট ইজ জলি গুড, ‘ দ্যাট ইজ একসেলেন্ট’ বা ‘হি ইজ ইউজিং এভরিথিং হি। হ্যাজ গট।’ সেই এভরিথিং ছিল ট্যাংক, রিকয়েলেস রাইফেল, রকেট লঞ্চার ইত্যাদি। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ঘিরে ছিল পশ্চিম দিক থেকে রেললাইন জুড়ে ৪১ নং ইউনিট। দক্ষিণ দিক থেকে ৮৮ নং ইউনিট ও উত্তর দিক থেকে ২৬নং ইউনিট। বাধা এসেছিল। জগন্নাথ হল, ইকবাল হল ও লিয়াকত হল থেকে। সবচেয়ে বেশি বাধা এসেছিল জগন্নাথ হল থেকে। ২৬ মার্চ সকালের দিকে কন্ট্রোল ও ৮৮ নং ইউনিটের মধ্যে যে কথােপকথন হলাে, তা মােটামুটি এরকম : কন্ট্রোল : বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আনুমানিক কতজন হতাহত হয়েছে? আমাকে  মােটামুটি সংখ্যাটা বললেই হবে। উত্তর এল তিন শ’য়ের মতাে। কন্ট্রোল : চমকার। তিনশ’ই মারা গেছে, না কেউ আহত বা বন্দি হয়েছে? উত্তর : ‘আমি এটাই পছন্দ করি। তিনশ’ই মারা গেছে। কন্ট্রোল; ৮৮ । আমিও তােমার সঙ্গে একমত। এই কাজটাই সহজ। কিছু জানতে চাইবে না। আবার বলছি চমৎকার।…

ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই উপরের কথাগুলাের। ওরা যে কোনাে ‘বন্দি’ নেয়নি, সে কথা এর চাইতে স্পষ্টভাবে জানাতে পারত না । শুনতে পেয়েছিলাম শহীদ মিনারের কথা। ওই রাতেই ডিনামাইট দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানাে হয়েছে মিনারের নিচের ঘরে। ওদের কথায় চারজন ছাত্র লুকিয়েছিল, তিনজনকে হত্যা করা হযেছে। একজন পালিয়ে গেছে।…দেখলাম ভাঙা কাচ, দেয়ালে রক্ত। শনিবার রাতে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে   অবশেষে শহীদ মিনার ধ্বংস করেছিল পকি বর্বররা। ২৫ মার্চের সেই কালরাত্রি যখন শেষ হয়ে আসছিল, হুকুম এল কন্ট্রোলের- যেখানে যত মৃতদেহ আছে সব সরিয়ে ফেলতে। সরিয়ে ফেলতে হবে দিন শুরু হওয়ার আগে । লোকচক্ষুর অন্তরালে। মৃতদেহ সরাতে ব্যবহার করা হয়েছিল বাঙালিদের’ । যে হতভাগ্যদের ব্যবহার করা হয়েছিল ওই কাজে, শেষে তাদেরও হত্যা করেছিল ওই নরপশুরা। মৃতদেহের হিসাব রেখেছিল ২৬ নং ইউনিট।

কন্ট্রোল জিজ্ঞেস করেছিল ২৬ নং ইউনিটকে রাজারবাগ পুলিশের মৃতদেহের সংখ্যা। উত্তর এসেছিল গােনা শেষ হয়নি । ২৬ মার্চ সারা দিন রেখে দেয়া হয়েছে। রেডিওতে শুনেছি, কমান্ডার গিয়ে দেখবেন, ছাত্রনেতা কেউ আছেন কি-না। সেটা দেখার পরই সরানাে হবে। তা-ই হয়েছিল। ২৭ মার্চ সকালে দেখেছিলাম ইকবাল হলের পেছনের পুকুর পারে সার দিয়ে রাখা দশটি মৃতদেহ। ইচ্ছে করেই সবাইকে দেখানাের জন্য ওভাবে রাখা হয়েছিল কিছু মৃতদেহ। যাতে বাঙালিরা ভয় পায়, নতি স্বীকার করে। দেখেছিলাম জগন্নাথ হলের সামনের মাঠে বুলডােজার দিয়ে গর্ত করে। দেয়া গণকবর। মাস খানেক পরে যখন দু-একজন বিদেশি সাংবাদিককে আসার অনুমতি দিয়েছিল পাক সরকার, তখন এক রাতে সেই গলিত দেহের অবশিষ্ট তুলে। নিয়ে যায় পাক সেনারা। বিজ্ঞানী ড. মােজাম্মেল হােসেনের ধারণকৃত পাকিস্তান বাহিনীর ঐ ওয়্যারলেস সংলাপের চাইতেও তাৎপর্যপূর্ণ জগন্নাথ হলের মাঠে ২৬ মার্চের সকালে যে মর্মস্পর্শী দৃশ্য দেখেছি, আমার জানালা থেকে টেলিস্কোপ লাগিয়ে মুভি ক্যামেরায় ধরে রেখেছি। শিরােনামে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, অষ্টম খণ্ডে মুদ্রিত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ কৌশল বিভাগের তদানীন্তন অধ্যাপক ড. নূরুলউল্লার বিশেষ সাক্ষাৎকারটি,

আপনি কি ২৫ মার্চের হত্যাকাণ্ডের ছবি নিজ হাতে তুলেছিলেন?

হ্যা, ২৬ মার্চের সকালে জগন্নাথ হলের মাঠে যে মর্মস্পর্শী দৃশ্য ঘটেছিল, আমি তার ছবি আমার বাসার জানালা থেকে টেলিস্কোপ লাগিয়ে মুভি ক্যামেরায় তুলেছিলাম ।

ক্যামেরাটি কি আপনার নিজস্ব?

ওটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন ভিডিও টেইপ ক্যামেরা। আপনি যে ক্যামেরা বসিয়েছিলেন, তা কি বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছিল না? এমনভাবে ক্যামেরা বসানাে হয়েছিল যে, বাইরে থেকে বােঝার কোন উপায় নেই। ক্যামেরা চালু করেন কখন? সকাল ৭টা থেকে ৮টার মধ্যবর্তী সময়ে । জানালা দিয়ে লক্ষ্য করলাম, জগন্নাথ হলের সামনের মাঠে কিছু ছেলেকে ধরে বাইরে আনা হচেছ এবং তাদের লাইনে দাঁড়  করান হয়েছে । তথনই আমার সন্দেহ জাগে এবং আমি ক্যামেরা অন করি। আমাদের ক্যামেরাটির একটি বিশেষ গুণ এই যে, এতে মাইক্রোফোন দিয়ে একই সঙ্গে শব্দ তুলে রাখা যায় । তাই আমি টেপের সঙ্গে মাইক্রোফোন সংযােগ করে ক্যামেরা চালু কলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলাম, ছেলেগুলোকে একধরছে গুলি করা হচ্ছে। এবং এক একজন করে পড়ে যাচ্ছে। আবার কিছুসংখ্যক লােককে ধরে নিয়ে এসেছে।…আবার লাইন করে দাঁড় করানাে হচ্ছে। আমি তখন আগের তােলা টেপটা। মুছে ফেলে তার ওপর আবার ছবি তােলা শুরু করলাম।

আপনি আগের তােলা ছবিটির টেপ কেনো মুছে ফেললেন?

আমার মনে হচ্ছিল, আমার আগের ছবিতে সবকিছু ভালভাবে আসেনি। আর নতুন ছবি তুলতে গিয়ে আমি হয়তাে আরাে মর্মস্পর্শী দৃশ্য ধরে রাখতে পারব। আর হাতের কাছে আমার টেপ ছিল না। মােট কথা, আমি ওইসব দৃশ্য দেখে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে পাগলের মত হয়ে গেলাম। যা হােক, দ্বিতীয়বার লাইনে দেখলাম একজন বুড়াে দাড়িওয়ালা লােক রয়েছে। সে বসে পড়ে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইছে। আমার মনে হচ্ছিলাে, সে তার বাড়ি দেখিয়ে বােঝাতে চেয়েছিল যে সে মুসলমান। কিন্তু বর্বর পাকবাহিনী তার কোনাে কথাই শুনতে চায়নি। তাকে গুলি করে মারা হলাে। মাঠের অপরদিকে অর্থাৎ পূর্বপাশে পাকবাহিনী একটা তাবু বানিয়ে ছাউনি করেছিল। সেখানে দেখছিলাম, ওরা চেয়ারে বসে বেশ কয়েকজন চা খাচ্ছে আর হাসিতামাশা ও আনন্দ-উল্লাসে ফেটে পড়ছে।

লােকগুলোকে হলের ভেতর থেকে কীভাবে আনা হচ্ছিলাে?

যাদের আমার চোখের সামনে করা হয়েছে ও যাদের মারার ছবি আমার ক্যামেরায় রয়েছে, তাদের দিয়ে প্রথমে ‘হলের ভেতর থেকে মৃতদেহ বের করে আনা হচ্ছিল। মৃতদেহগুলাে এনে সব এক জায়গায় জমা করা হচ্ছিল এবং এদের দিয়ে লেবারের কাজ করানাের পর আবার ওদেরকেই লাইনে দাঁড় করিয়ে এক সারিতে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। মনে হয়েছে একটা করে পড়ে যাচ্ছে।

জমা করা মৃতদেহের সংখ্যা আপনার ধারণায় কতগুলাে হবে বলে মনে হচ্ছিল? আমার মনে হয়, প্রায় ৭০/৮০টি মৃতদেহ এক জায়গায় জমা করা হয়েছিল।

আপনার কি মনে হয়, ওগুলাে সবই ছাত্রদের মৃতদেহ?

আমার মনে হয়, ছাত্র ছাড়াও হলের মালি, দারােয়ান, বাবুর্চি এদেরকেও একই সঙ্গে গুলি করা হয়েছে। তবে অনেক ভাল কাপড়পরা বয়সী লােকদেরও ওখানে লাইনে দাঁড় করিয়ে মারা হচ্ছিল। এদের দেখে মনে হয়, তারা ছাত্রদের গেস্ট হিসেবে হলে থাকছিল। 

প্রফেসর নূরুলউল্লাব ধারণকৃত জগন্নাথ হল গণহত্যার প্রামাণ্য তথ্যচিত্রটি স্বাধীনতার পর দেশে-বিদেশে বহুবার প্রদর্শিত হয় এবং ১৯৭১ সালের ২৫-২৬ মার্চের ‘অপারেশন সার্চলাইট’ বা ‘জেনােসাইড ঢাকা ইউনিভার্সিটির একমাত্র প্রামাণ্য দলিল, যার মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে পাকিস্তানিদের নৃশংসতা ও বর্বরতার পরিচয় উদঘাটিত হয়।

একাত্তরের মার্চ মাসে অসহযােগ আন্দোলনের দিনগুলোতে স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় ইকবাল হল তথা জহুরুল হক হল থেকে।

| বস্তুত উনসত্তরের গণআন্দোলনের সময় থেকে ওই ছাত্রাবাসটি ছিল স্বাধিকার তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের সদর দপ্তর বিশেষ । সত্তরের সাধারণ নির্বাচনের ঐতিহাসিক গণরায়কে নস্যাৎ করার জন্য একাত্তর সালের ১ মার্চ পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান বেতার ঘােষণার মাধ্যমে ৩ মার্চ ঢাকায় ‘আহূত জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত ঘােষণা করার প্রতিক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যে অভূতপূর্ব অসহযােগ আন্দোলন পরিচালিত হয়, স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ একাত্তরের মার্চ মাসে ধাপে ধাপে তা স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে নিয়ে যায় । এ সময় বঙ্গবন্ধু এক রাতে জহুরুল হক হলে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সঙ্গে এক অঘোষিত সভায় মিলিত হন বলে জানা যায়। ওই সময় আমার অবস্থান ছিল জহুরুল হক হল সংলগ্ন ২৪ নং বিশ্ববিদ্যালয় আবাসে। সেখানে ২২ মার্চ রাতে বিভিন্ন সংগঠনের ছাত্রনেতাদের মধ্যে এক জরুরি সভা হয়। আমি সেই সভায় যােগদান করিনি। কিন্তু পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে আমার দেখা হয় সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মণি, কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনাে, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ প্রমুখ ছাত্রনেতার। সঙ্গে। তারা আমাকে জানান যে, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান আলােচনার ধল্লা দিয়ে সামরিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করার সময় নিয়েছেন, ক্র্যাক ডাউন আসন্ন এবং প্রতিরােধ সংগ্রাম অনিবার্য। তাই শেষ মুহূর্তে সমঝােতার জন্য গত রাতভর তারা আলােচনা চালিয়েছেন। এই সভা থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামে জহুরুল হক হলের গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়। বিস্ময়ের কিছু নেই যে, পাকিস্তানি অপারেশন সার্চলাইটের অন্যতম প্রধান লক্ষ্যবস্তু ছিল জহুরুল হক হল। সৌভাগ্যবশত ২৫ মার্চ মধ্যরাতের আগে প্রায় সব ছাত্রনেতা ও কর্মী হল ছেড়ে চলে যান।

পঁচিশ মার্চ মধ্যরাত থেকে ২৭ মার্চ সকাল পর্যন্ত পাকিস্তান সশস্ত্রবাহিনী ট্যাংক, জিপে বসানাে রিকয়েললেস রাইফেল, মটার, ভারী ও হাল্কা মেশিনগান, রকেট লঞ্চার এবং চাইনিজ অটোমেটিক রাইফেল প্রভৃতি মারণাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে চারদিক থেকে জহুরুল হক হল আক্রমণ করে। দৈনিক আজাদ পত্রিকার ১৯৭২ সালের ১৪ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রথম দুর্গ ইকবাল হল প্রবন্ধ থেকে প্রত্যক্ষদর্শীব বিবরণ উদ্ধৃত করছি,  গ্যারেজের উন্মুক্ত ছাদে সটান হয়ে শুয়ে পড়লেন জিন্নাত আলী ও তার সঙ্গী তারেক, আবদুর রউফ ও তার ছােট ভাই জগন্নাথ কলেজের ছাত্র মােয়াজ্জেম হােসেন। আর ঘণ্টা খানেক পর অর্থাৎ একটা-দেড়টার দিকে শুরু হলাে পাক হানাদারদের আক্রমণ ! অন্ধকারের বুক চিরে ছুটছে বুলেট। স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রের ভয়াল গর্জনে সমস্ত এলাকা প্রকম্পমান। অক্টোপাসের মতাে হানাদাররা ঘিরে ফেলেছে হল এলাকা। কামান দাগছে, গ্রেনেড ছুড়ছে, এক ধরনের আগুনে বােমা। বােমাগুলাে ফস করে জানালা দিয়ে ঢুকে ঘরের ভেতরে পড়তেই ঘরে আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। সে আগুনে কাপড়-চোপড়, আসবাবপত্রসহ যত কিছু দাহ্য বস্তু, এমনকি দালানের আস্তর পর্যন্ত পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। প্রতিরােধকারী তরুণরাও বীর বিক্রমে প্রতিরােধ করে যাচ্ছে।

…থ্রি নট থ্রির আওয়াজ শুনেই তা বােঝা যাচ্ছে। কিন্তু যেভাবে আগুন জ্বলছে হালের সব ঘরে, তাতে কী করে বেশিক্ষণ আর ওদের পক্ষে প্রতিরােধ করা সম্ভব হবে? আগুনের লেলিহান শিখা ক্রমেই হিসহিস করে ছড়িয়ে পড়ছে। অ্যাসেম্বলি হল ও পাঠাগারে আগুন জ্বলে উঠল দাউদাউ করে । পাশের রেল সড়কের বস্তিও জ্বলছে। ওদিক থেকে ভেসে আসছে মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর মানুষের আর্তনাদ। আকাশে উড়ছে লাল-নীল রঙের অনুসন্ধানী ফানুস। এক বিচিত্র ভৌতিক পরিবেশ। সারা নগরী যেনাে জ্বলছে। প্রজ্বলন্ত আগুন, কামান, মর্টার, গ্রেনেড আর যতসব স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রের সম্মিলিত বীভৎস গন বির্ভাধিকার জন্ম দিয়েছে। ইকবাল হলের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে রেল সড়কের বৃস্থিতে যখন আগুন দেয় হানাদার বাহিনী, তখন বস্তিবাসী নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ, যুবক সবাই পাচিল ডিঙিয়ে ছুটছিল হলের ভেতরের দিকে আশ্রয়ের আশায়। যেমনি দলে দলে লাফ দিয়ে পাঁচিল ভিঙিয়েছিল, তেমনি দলে দলে মুখ থুবড়ে পড়ল স্বদেশে পবিত্র মাটিতে পাক হানাদারদের বুলেটবিদ্ধ হয়ে। ২৫ মার্চ বিভীষিকাময় কালরাতের অবসান হলাে; কিন্তু হানাদাররা সান্ধ্য আইন জারি করেছে সমস্ত দিন ধরে। কারণ হত্যাযজ্ঞ যা চালিয়েছে, তা সবটা জানতে চায় না বিশ্ববাসীকে। ইকবাল হলে ও আশপাশে যারা তখনাে বেঁচে ছিল, তারাও জীবনের তাগিদে বেরুচ্ছে যেদিকে সুযোগ পাচ্ছে। এতে হানাদাররা হলের প্রতিটি ঘরে তালা ভেঙে লুটে নিয়ে গেছে আর যাকে সামনে পেয়েছে, তাকেই হত্যা করেছে নির্মমভাবে। এর ষ্টাকে ফাকে দু-একজন বেঁচে গেছে নানা কৌশলে। যেমন বেঁচে গেছে তারেক, জিন্নাত আলী, রউফ, মােয়াজ্জেম গ্যারেজের ছাদে আশ্রয় নিয়ে। বেঁচে গেছে আরেকটি ছেলে হলের একটি কক্ষে থেকেও । সে লেপ জড়িয়ে নিঃসাড় দাড়িয়ে ছিল দেয়ালে হেলান দিয়ে। বেঁচে গেছে কয়েকজন হলের পেছনে সাধারণ কর্মচারীদের কোয়ার্টারে আত্মগোপন করে। ২৬ মার্চ ভােরে ইকবাল হলের যেখানেই দৃষ্টি পড়েছে, সেখানেই দেখা গেছে লাশ আর লাশ। স্বদেশের সােনার ছেলেদের গুলি খাওয়া লাশ। 

জহুরুল হক হল সংলগ্ন নীলক্ষেতে শিক্ষকদের আবাসিক এলাকার তিনটি (২৩, ২৪ ও ২৫নং) আসনে পাকিস্তানি সৈন্যরা সিড়িতে, ছাদে এবং ঘরে ঘরে ঢুকে শিক্ষক, আশ্রয়গ্রহণকারী বস্তিবাসী, প্রেসিডেন্ট হাউসে (পুরাতন গণভবন) প্রহরারত নিরস্ত্রীকৃত ইপিআর জোয়ান, যারা ২৩ নং বাড়ির ছাদে আশ্রয় নিয়েছিল, তাদের হত্যা কবে। শিক্ষকদের বাড়ির ঘরে ঢুকে পাকিস্তানি সৈন্যরা শিক্ষকদের হত্যা করবে, এমন ধারণা ছিল কল্পনারও অতীত। তাই জহুরুল হক হল সংলগ্ন নীলক্ষেত আবাসিক এলাকার শিক্ষকরা কেউ ২৫ মার্চ রাতে ক্যাম্পাস ছেড়ে যাননি। নীলক্ষেত এলাকার বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় বসবাসরত কর্মকর্তাকর্মচারীদের সম্পর্কেও একই কথা প্রযােজ্য। জহুরুল হক হল সংলগ্ন শিক্ষককর্মচারীদের আবাসিক এলাকা আর পুরনাে রেল লাইনের ওপর গড়ে ওঠা বস্তি এলাকায় পাকিস্তান সশস্ত্রবাহিনী ২৫ থেকে ২৭ মার্চ সর্বাত্মক সশস্ত্র অভিযান চালিয়ে যে গণহত্যা, অগ্নিসংযােগ, ধ্বংসযজ্ঞ এবং লুণ্ঠন চালায়, তা শুধু চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, চতম যুদ্ধাপরাধও বটে। পাকিস্তান সশস্ত্রবাহিনী নীলক্ষেত এলাকায় অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব, টিএসসি, রােকেয়া হলে ঢোকে এবং পরিবার-পরিজনসহ বহু বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারীকে হত্যা করে। এছাড়াও কুলার রােড আবাসিক এলাকায় ঢুকে শিক্ষকদের আসে হানা দেয়া এবং বাসা থেকে তাদের ধরে এনে দাঁড় করিয়ে হত্যা করে।

এই বাহিনী সলিমুল্লাহ হলের আবাসিক শিক্ষকদের বাসা এবং ব্রিটিশ কাউন্সিলে ঢুকে হত্যাযজ্ঞ চালায়। তারা ব্রিটিশ কাউন্সিলে প্রহরারত ইপিআর জোয়ানদের নৃশংসভাবে হত্যা করে। জগন্নাথ হল আক্রমণকারী পাকিস্তান বাহিনী জগন্নাথ হল ছাড়াও নিকটবর্তী শিববাড়ি ও শহীদ মিনার এবং জগন্নাথ হল মাঠে শিক্ষকদের আবাসিক এলাকায় হানা দেয়। যে পাকিস্তান বাহিনী শহীদ মিনার ও বাংলা একাডেমীতে গােলাবর্ষণ করে, তারা ঢাকা হল সংলগ্ন শিক্ষক আবাসন এবং কিংবদন্তির চরিত্র মধুদার বাড়িতে ঢােকে। মােট কথা ট্যাংক, ট্যাংক ক্যারিয়ার, ট্রাক, উইপন ক্যারিয়ার, পিকআপ, জিপ আরােহী মােবাইল পাকিস্তান বাহিনীর ১৮নং পাঞ্জাব, ২২ নং বালুচ এবং ৩২ নং পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সৈন্যরা স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, এলএমজি, মেশিনগান, মর্টার, ট্যাংক বিধ্বংসী রিকয়েললেস রাইফেল, রকেট লঞ্চার প্রভৃতি মার্কিন ও চীনা অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাত থেকে ২৭ মার্চ সকাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস চারদিক থেকে ঘেরাও করে প্রচণ্ড গােলাগুলি, বােমাবর্ষণ এবং হল ও শিক্ষককর্মচারীদের বাড়ি বাড়ি ঢুকে যে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ পরিচালনা করে, তাতে ১০জন শিক্ষক, বহু ছাত্র, পরিবার-পরিজনসহ বহু কর্মচারী নিহত হন। এছাড়া ২৩ নং নীলক্ষেত শিক্ষক আবাসনের ছাদে আশ্রয়গ্রহণকারী প্রায় ৩০ জনকে তারা নৃশংসভাবে হত্যা করে। পাকিস্তান বাহিনী নীলক্ষেতে অবস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ক্লাবে ঢুকে ক্লাব কর্মচারী সিরাজুল হক, আলী হােসেন, সােহরাব আলী গাজী এবং আবদুল   মজিদকে পৈশাচিকভাবে হত্যা করে। তাদের লাশ অপসারণ করা হয় অনেক পরে, যেদিন ২৩ নং নীলক্ষেত আবাসনের ছাদ থেকে ৩০ জনের লাশ সরানাে হয় সেদিন, এই ২৩ নং নীলক্ষেত আবাসনে নিহত হয়েছিলেন মৃত্তিকা বিজ্ঞানের অধ্যাপক ডক্টর ফজলুর রহমান ও তার দুজন আত্মীয়। তবে একই আবাসে বসবাসকারী বাংলার অধ্যাপক আনােয়ার পাশা ও ইংরেজির অধ্যাপক রশিদুল হাসান অলৌকিকভাবে বেঁচে যান ২৫ মার্চ রাতে পরিবার-পরিজন নিয়ে। তারা ঘরের সব বাতি নিভিয়ে অন্ধকারে খাটের নিচে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের বাড়িতে ঢুকে টর্চ ফেলে কোনাে ঘরে কাউকে দেখতে না পেয়ে এই বলে বেরিয়ে যায় যে, বাঙালি। কুত্তা ভাগ গিয়া’। একই দালানে সপরিবারে আক্রান্ত হয়েও আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে যান গ্রন্থাগারিক মৃধা সাহেব।

পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর রক্তপিপাসু হায়েনারা নীলক্ষেত এলাকার ২৪ নং বাড়িতে ঢােকে। ওই দালানে দোতলার একটি ফ্ল্যাটে আমি সপরিবারে থাকতাম। ২৫ মার্চ রাতে রেললাইন বস্তির্ব দুই মা পায়ে ও উরুতে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় কোলে সন্ত নিসহ আশ্রয় নিয়েছিল এখানে। তাদের রক্তে সিঁড়ি ভেসে যাচিছল। পাকিস্তানি সৈন্যদের। যে দলটি ২৪নং বাড়িতে হানা দেয়, তারা এই রক্ত দেখে মনে করে অপারেশন। কমপ্লিট। ফলে তারা আর বিল্ডিঙে ঢােকেনি। আমরা প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যেও শুলিবিদ্ধ ওই দুজনকে আমাদের ঘরে টেনে নিই । ডেটল দিয়ে গুলিবিদ্ধ জায়গা পরিষ্কার করে তুলা নিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিই! ২৭ মার্চ পর্যন্ত তারা জীবিত ছিলেন। তাদের তখনও জন ছিল। পরে ২৭ মার্চ সকালে ক্যাম্পাস ছাড়ার সময় ২৪নং বাড়ির অন্য তম বাসিন্দা গণিতের অধ্যাপক ড. সােহরাব ও তার স্ত্রী জ্যোৎস্না ওই দুই মাকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পৌছে দিয়ে গিয়েছিলেন। ২৭ মার্চ কারফিউ উঠে গেলে আমরা বেঁচে আছি কি-না, তা দেখতে আসেন একে একে আমার আব্বা, জহির রায়হান ও আলমগীর কবীর | আমাদের জীবিত দেখে তারা দ্রুত প্রস্থান করেন। পরে আমাদের বিভাগের সাবেক ছাত্রী জাহানারা ইমাম (প্রয়াত শহীদ জননী) এবং তার পুত্র রুমি (শহীদ মুক্তিযোদ্ধা) তাদের গাড়ি নিয়ে এসে আমাদের নীলক্ষেত আবাসিক এলাকা থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যান। পাকিস্তান বাহিনী টিএসসি বা ছাত্রশিক্ষক কেন্দ্রে ঢুকে কর্তব্যরত কর্মচারী আবদুস সামাদ, আবদুস শহীদ ও লাড়ু লালকে নির্মমভাবে হত্যা করে। রােকেয়া হল প্রাঙ্গণে কর্মচারীদের বাড়িতে ঢুকে পাকিস্তানিরা। খুন করে,

আহমদ আলী,

আবদুল খালেক, ননী,

মাে, সােলায়মান খান,

মাে. নুরুল ইসলাম,

মাে, হাফিজ উদ্দিন,

মাে. চুনু মিয়াকে

এবং তাদের পরিবার-পরিজনকে।

২৫ মার্চ রাতে ফুলার রােড আবাসিক এলাকায় ঢুকে পাকিস্তানি সৈন্যরা ১১ নং বাড়ির বাসিন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরি স্কুলের শিক্ষক মােহাম্মদ সাদেককে প্রথমে বেয়নেট চার্জ এবং পরে গুলি করে হত্যা করে। পাকিস্তানি নরপশুরা ১২ নং বাড়ির বাসিন্দা ভূতত্ত্বের অধ্যাপক মুহাম্মদ মুক্তাদিরকে তার স্ত্রী ও সন্তানের সামনে গুলি করে হত্যার পর লাশ টেনে নিয়ে যায়। পরে তার লাশ ব্রিটিশ কাউন্সিলে জমাকৃত অন্যান্য লাশের স্তূপ থেকে পাওয়া গিয়েছিল।

পাকিস্তানি সৈন্যরা সলিমুল্লাহ হলের তদানীন্তন হাউস টিউটর ইংরেজির অধ্যাপক মুনিমের বাড়িতে ২৫ মার্চ রাতে একাধিকবার হানা দেয় এবং তাকে হত্যা করতে উদ্যত হয় । একই ঘটনা ঘটে অর্থনীতির অধ্যাপক মাজা নুরুল হুদা এবং সলিমুল্লাহ হলের প্রভােস্ট অধ্যাপক মফিজুল্লাহ কবিরের ক্ষেত্রেও। জগন্নাথ হল মাঠের পাশে প্রফেসর মীর্জা নুরুল হুদার বাংলােয় প্রবেশ করে তাকে হত্যার জন্য দাঁড় করায় সৈন্যরা; কিছু পরিবারের মহিলা ও সন্তানদের বাকুতি-মিনতিতে তারা তাকে রেহাই দেয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা মুসলিম হলের প্রভােস্ট ইতিহাসের অধ্যাপক মফিজুল্লাহ, কবিরের শহীদ মিনার এলাকার বাসায় ২৫/২৬ মার্চ একাধিকবার প্রবেশ করে তাকে হত্যা করতে চায়, তিনিও অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী ২৫ থেকে ২৭ মার্চের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ও সংলগ্ন অঞ্চলে তিনটি ধর্মীয় স্থান ধ্বংস করে দেয়- কলাভবন সংলগ্ন শিখ গুরুদুয়ারা, শহীদ মিনারের বিপরীতে অবস্থিত শিবমন্দির আর রমনা রেসকোর্স মাঠের দুটি পুরনাে কালীমন্দির। স্মরণীয় যে, ২৬ মার্চ সকালে পাকসেনারা সায়েন্স ল্যাবরেটরি রােড মােড়ের মসজিদে ফজরের নামাজের আজান দানরত মুয়াজ্জিনকে এবং গুরুদুয়ারা, শিবমন্দির ও কালীমন্দিরে ঢুকে পুরোহিতদের নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। ১৯৭১ সালের ২৫-২৬ মার্চ পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে সামরিক অভিযানে সবচেয়ে নারকীয় ঘটনা ঘটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যালঘু ছাত্রাবাস জগন্নাথ হলে । জগন্নাথ হলের সাবেক প্রভাস উ. অজয় রায় এবং ড, রঙ্গলাল সেনের উদ্যোগে ড, রতন লাল চক্রবর্তী সংকলিত-সম্পাদিত ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণহত্যা : ১৯৭১ জগন্নাথ হল গ্রন্থে ‘অপারেশন সার্চ লাইটে’ জগন্নাথ হলে কী ঘটেছিল, তার বস্তুনিষ্ঠ পরিচয় পাওয়া যায় । গ্রন্থের ভূমিকা থেকে উদ্ধৃতি, ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়, বিশেষভাবে জগন্নাথ হল ও তৎসন্নিহিত এলাকায় কী ঘটেছিল, তা একটু আলােচনা প্রয়ােজন…রাত বারােটার সময় ইউওটিসির দিকের দেয়াল ভেঙে পাকবাহিনী ট্যাংক নিয়ে জগন্নাথ  হলের মধ্যে প্রবেশ করে এবং প্রথমেই মর্টার ছােড়ে উত্তর বাড়ির দিকে। সঙ্গে সঙ্গে অজস্র গুলিবর্ষণ শুরু হয়। উর্দু ও ইংরেজি মিশ্রিত ভাষায় আত্মসমর্পণ করে বেরিয়ে আসার নির্দেশ দেয়। এরপর জগন্নাথ হলের অভ্যন্তরে শুরু হয় নারকীয় কাণ্ড। উত্তর ও দক্ষিণ বাড়ির প্রতিটি কক্ষ অনুসন্ধান করে ছাত্রদের নির্বিচারে গুলি করে। এমনকি টয়লেটে, বাথরুমে ও ছাদে রক্ষিত জলের ট্যাংকের মধ্যে যেখানেই পাওয়া যায় লােকের সন্ধান, সেখানে চলে নির্বিচারে গুলি ও হত্যা । পশ্চিম দিকের টিনশেড অর্থাৎ পশ্চিম ভবন, ক্যান্টিন ও ‘ক্যান্টিন সংলগ্ন ছাত্রাবাসে ধরিয়ে দেয়া হয় আগুন ।

বিভিন্ন স্থানে ছাত্র-জনতা পালিয়েছিল, কিন্তু সর্বগ্রাসী আগুনের হাত থেকে বাচার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে আসতেই তাদের ওপর শুরু হয় নির্বিচারে গুলি। ক্রমশ আক্রান্ত হয় জগন্নাথ হলের প্রাক্তন প্রাধ্যক্ষ ড. গােবিন্দচন্দ্র দেবের বাসভবন। পাকবাহিনী মেরে ফেলে গােবিন্দ দেবকে এবং পালিত কন্যা রােকেয়ার স্বামীকে। পরে আক্রান্ত হয় জগন্নাথ হল সংলগ্ন বিশ্ববিদ্যালয় স্টাফ কোয়ার্টার, যেখানে পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক মুনিরুজ্জামান পুত্র ও আত্মীয়সহ নিহত হন। মারাত্মকভাবে আহত হন জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, পরে তিনি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। পাক মিলিটারি মধুসূদন দেব (মধুদা) বাস আক্রমণ করে হত্যা করে তার পুত্র, সদ্যবিবাহিত পুত্রবধূ, স্ত্রী যােগমায়া, যিনি ছিলেন দশ মাসের অন্তঃসত্ত্বা । গুলিতে মধুলাও মারাত্মকভাবে আহত হন। জঘন্যতম পদ্ধতি গ্রহণ করে পাকবাহিনী পরবর্তী ঘটনার অবতারণা করে। পলায়িত ও আতংকগ্রস্ত ব্যক্তিদের ধরে নিয়ে আসে এবং তাদের এইসব লাশ জগন্নাথ হলের। মাঠে জড় করার কাজে লাগায় । পাকবাহিনীর সতর্ক দৃষ্টি এড়িয়ে এদের মধ্যে দুএকজন লাশ ‘টানার কাজে যােগদান করেনি। কিন্তু অনেকেই রাইফেল ও বেয়নেটের নির্দেশে এ কাজ করতে বাধ্য হয়েছে। ছাত্ররা নিহত সহপাঠীদের লাশ, কর্মচারীরা গােবিন্দ দেব, মুনীরুজ্জামান ও মধুদার লাশ টেনে হলের অভ্যন্তরে জড়াে করে। এই কাজ সম্পন্ন হয় মিলিটারি পাহারায়। পরে যারা লাশ টানে তারা এবং বিভিন্ন স্থান হতে ধরে আনা লােকজনকে সারিবদ্ধ হবার নির্দেশ দেয় পাকবাহিনী। এদের মধ্যে শিববাড়ির কয়েকজন সাধু ছিলেন। মুখে ছিল তাদের দাড়ি, পরনে গেরুয়া । অন্য একজন ছিল টুপি পরিহিত মুসলমান। কিন্তু মানবতা ও ধর্ম কোনো জ্ঞানই ছিল না বর্বর পাকবাহিনীর।

লাইনে দাড়ানো ও সমবেত জনগণের ওপর তারা চালালাে মেশিন গান- এক নতুন লােমহর্ষক, হৃদয়বিদারক ও মর্মান্তিক দৃশ্যের সূচনা হলো। দূরে বস্তিতে পালিয়েছিল মহিলাগণ, যারা স্বজন হারানোর বেদনায় আর্তনাদ করে উঠল। জগন্নাথ হলের বাতাস একটু জল ও পানির আহাজাবিতে ভরে গেল। মরণ যন্ত্রণা ও প্রাণ বাঁচানাের এক করুণ দৃশ্য দেখা গেল । কিছু সময়ের জন্য পাকবাহিনী জগন্নাথ হল ও তৎসংলগ্ন এলাকা ত্যাগ করে। বস্তি হতে ছুটে আসেন মহিলাগণ। বুক চাপড়ে কাদতে থাকেন তাদের অনেকেই। যারা অপেক্ষাকৃত কম আহত ছিলেন, তাদের নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। কেউ কেউ  নিজের চেষ্টাতেই পালিয়ে যান জগন্নাথ হলের মাঠ থেকে। কিছুক্ষণ পর ফিরে আসে পাকবাহিনী বুলডােজার নিয়ে। একটা ছােট গর্ত করে ময়লা-আবর্জনার মতো মাটি চাপা দেয় জীবিত, মৃত, আহত-নিহত সবাইকে । মাটি চাপা দেবার কাজটাও এতাে অবহেলার সাথে সম্পাদনা হয়েছে যে বহুসংখ্যক নিহত ব্যক্তির হাত, পা, মাথা ও দেহের অংশ মাটির উপর ছিল। গণকবর হতে জেগে ওঠা মুষ্টিবদ্ধ হাত যেনাে স্বাধীনতা অর্জনের দৃঢ় প্রতিজ্ঞার প্রতীক।…যা হােক, সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার উষালগ্নে কেবলমাত্র ৩৪ জন ছাত্র জগন্নাথ হলেই শহীদ হয়। পরবর্তীকালে চট্টগ্রামে স্বপন চৌধুরী যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হয় এবং গণপতি হালদার তার জন্মভূমি মরবাড়িয়ায় পাকবাহিনীর হাতে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করে। উল্লেখ্য যে, গণপতি হালদার ২৬ মার্চ পাকবাহিনীর হাত থেকে বেছে যায়।…শিক্ষকদের মধ্যে প্রােক্তন প্রাধান্য G, গােবিন্দ চন্দ্রদেব, তত্বকালীন প্রাধ্যক্ষ ড, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ও সহকারী আবাসিক শিক্ষক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য শহীদ হন।…বৈদ্যুতিক মিস্ত্রী চিত্মী ও জনৈক রাজুকুমারী দেবী তথ্য প্রকাশ করেন যে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের কাছে সজনা গাছের নিচে খুব স্বল্প পবিসর গর্তে জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে হাসপাতালের চিকিৎসকগণ চিরদিনের জন্য শুইয়ে রেখেছেন। জগন্নাথ হলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক তিনজন, ছাত্র ৩৪ জন ও কর্মচারী ৪জন ২৬ মার্চেই শহীদ হন। কিন্তু এছাড়া ছিল জানা-অজানা অনেক লোক। এদের খুব কম অংশই আমরা জানি। সকলের পরিচিত মধুদা (মধূসদন দে) জগন্নাথ হলের মাটিতে মিশে আছেন । মিশে আছেন পরিসংখ্যান বিভাগের। অধ্যাপক মুনীরুজ্জামান তার কয়েকজন নিকট আত্মীয়সহ | দর্শন বিভাগের কর্মচারী খগেন দে ও তার পুত্র মতিলাল দে পিতা-পুত্র পাশাপাশি দাঁড়িয়ে মৃত্যুকে বরণ করেছেন।…মারা যায়,

বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী সুনীল চন্দ্র দে,

বােধিরাম,

দাসুরাম,

ভীর রায়,

মনিরাম, জহরলাল রাজভর,

ভরণ রায়,

শংকর কুৱী প্রমুখ।

নির্মলেন্দু গুণ ২৮ মার্চ জগন্নাথ হলে এসেছিলেন এবং তৎকালীন ঢাকার একাংশের একটি খণ্ডচিত্র তার এক কবিতায় বর্ণনা করেছেন। তার মতে, কবি আবুল কাসেম জগন্নাথ হলেই মারা যান, কেননা তার মৃতদেহ জগন্নাথ হলের পুকুরে ভাসতে  দেখেছেন তিনি। এছাড়া বহুসংখ্যক অতিথিও এই রাতে পাকবাহিনীর গণহত্যার শিকার হয়েছেন… ভৈরব কলেজের হেলাল, বাজিতপুর কলেজের বাবুল পাল, জগন্নাথ কলেজের বদরুদ্দোজা, নেত্রকোনার জীবন সরকার, মােস্তাক, বাচ্চু ও অমর প্রমুখ ছাত্র ও অতিথিদের নাম সাক্ষাৎকার দানকারীদের নিকট হতে জানা যায়, যারা ২৬ মার্চ জগন্নাথ হলের গণহত্যার নির্মম শিকার হয়েছিলেন ।…জগন্নাথ হলের কিছুসংখ্যক ছাত্র তখন মিনার কালীবাড়িতে থাকতাে, ২৬ মার্চ রমনা কালীবাড়িও পাকবাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হয়। সেখানে নিহত হয় ৫/৬ জন জগন্নাথ হলের ছাত্র। তাদের মধ্যে কেবল অর্থনীতির ছাত্র রমনী মােহন ভট্টাচার্য ব্যতীত আর কারাে নাম জানা যায়নি।

…উল্লেখ্য যে, শিববাড়ীর ৫জন সাধুকে ধরে এনে জগন্নাথ হলের মাঠে হত্যা করা হয়েছে। ২৬ মার্চ রাত ১২টার পর হতে ২৮ মার্চ সকাল পর্যন্ত জগন্নাথ হল ও তসন্নিহিত এলাকায় শতাব্দীর যে নিদারুণ নিষ্ঠুর ও মর্মান্তিক ঘটনার অবতারণা হয়েছিল, তা ছিল বিক্ষিপ্ত । ফলে এক বা দুজন লােকের পক্ষে এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করা সম্ভব নয় । একেকজন একেক স্থান থেকে ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেছেন।… ঢাকা হল সংলগ্ন শিক্ষকদের আবাসে পাকিস্তান বাহিনী আক্রমণ চালায়, যার ফলে নিহত হন হলের সহকারী হাউস টিউটর গণিত বিভাগের শিক্ষক শরাফত আলী। এবং, পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক এ, আর, খান খাদিম । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারি ইতিহাস ‘দি হিস্ট্রি অফ দি ইউনিভার্সিটি অফ ঢাকা’ গ্রন্থে ঐতিহাসিক এম. এ. রহিম লিখেছেন : হিসাবমতাে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ও ২৬ মার্চ সকালে ক্যাম্পাসে প্রায় তিনশ’ জন নিহত হয়, যার মধ্যে ১০ জন শিক্ষক, ২৯ জন কর্মচারী, বাকিরা ছাত্র ও অতিথি। শহীদ মিনার অঞ্চলের আবাসিক এলাকায় পাকিস্তানি সৈন্যরা ড. গােবিন্দচন্দ্র দেব ও তার মুসলমান পালক মেয়ের মুসলমান স্বামীসহ একই সঙ্গে তার বাসভবনে আর শহীদ মিনারের বিপরীতে অবস্থিত ৩৪ নং দালানের সিঁড়ির নিচে এক সঙ্গে গুলবিদ্ধ হয়ে নিহত হন প্রফেসর মনিরুজ্জামান, তার ছেলে, ছােটভাই, শ্যালক এবং প্রফেসর জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা। উভয় স্থানেই হিন্দু ও মুসলমানের রক্তের ধারা একই সঙ্গে মিলে যায়, পাকিস্তানিরা উভয় ক্ষেত্রে হিন্দুমুসলমান নির্বিশেষে নির্বিচারের গুলি চালায় কারণ তাদের কাছে ড়, দেব, ড. মনিরুজ্জামান, ড, গুহ ঠাকুরতার একমাত্র পরিচয় ছিল তারা বাঙালি। এ সম্পর্কে শহীদ আনেয়ার পাশা যিনি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ নীলক্ষেত আবাসে পাকিস্তানিদের হাত থেকে সপরিবারে বেঁচে গেলেও ১৪  ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনীর সেবা দাস আল-বদর বাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে পারেননি। তিনি একাত্তরের মার্চ-ডিসেম্বরের মধ্যে রচিত আত্মজৈবনিক উপন্যাস রাইফেল রােটি আওরাত’ গ্রন্থে ঐ ঘটনা নিয়ে লিখেছেন, ড. দেবকে ও তার পুত্রকে একই সারিতে দাড় করিয়ে দিয়ে ওরা গুলি করে । পাশাপাশি লুটিয়ে পড়ে দুটি দেহ । ওরা পিতা-পুত্র। কিন্তু রক্তের মিল ছিল কোথায়? ওদের রক্তের মিল হয়েছে ওদের মৃত্যুর পর। এমনি রক্তের মিল হয়েছিল আরাে দু’জনের। দু জন প্রখ্যাত অধ্যাপক পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যক্ষ মনিরুজ্জামান ও ইংরেজি বিভাগের বিভ্রার উ, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা। চৌত্রিশ নম্বর বিল্ডিংয়ের দুটি ভিন্ন ভিন্ন চ্যাটে তারা থাকতেন।

নিও নিজ ধর্মে দু’জনেরই নিষ্ঠা ছিল প্রবল। পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে দুজনকে গুলি করা হলে রক্তের ধারা মিশে গিয়েছিল। সিমেন্ট বাঁধানাে মেঝেতে সেই মিশে যাওয়া রক্তের জমাটবদ্ধতা অনেকে দেখেছিলেন। সে রক্তের কোন অংশ মুসলমানের আর কোনটুকুই বা হিন্দুর তা কি চেনা গিয়েছিল?…নিচের সেই দৃশ্য দেখে একটুও অবাক হননি বেগম মনিরুজ্জামান । তারা কারা? এ প্রশ্ন মনে না তুলে সেই মুহূর্তেই তিনি ছুটে গিয়েছিলেন উপরে। এক বােতল পানি চামচ নিয়ে এসেছিলেন। তার বুকের মাণিক বড় ছেলেটি তাকাচ্ছে এখনও। মাকে দেখে চোখ দুটো একটু বড় হলাে শুধু। তার পরেই সে চোখ বন্ধ করল আর তা খােলেনি কখনাে। না তাড়াতাড়ি এক চামচ পানি দিয়েছিলেন মুখে; কিন্তু খেতে পারেনি । কিন্তু ঐ ভদ্রলােকতাে বেঁচে আছেন নিচের তলার সেই হিন্দু অধ্যাপকটি জল ‘চাইলেন। পর্দানশীন মহিলা। কখনাে সামনে যাননি। কিন্তু এখন তাকে কত কালের চেনা ভাইয়েব মত মনে হল। কাছে গিয়ে চামচ দিয়ে জল দিলেন মুখে । কয়েক চামচ খাওয়ানাের পরই মনে হল এখনাে তো এর বাঁচার সম্ভাবনা আছে। তখনি গিয়ে কপাটে ধাক্কা দিলেন-দিদি বের হন। আপনার সাহেবকে ঘরে নিন। আমার সাহেব মারা গেছেন। আপনার সাহেব বেঁচে আছেন ।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নিবাস রােকেয়া হলে কি ঘটেছিল এ সম্পর্কে ঢাকাস্থ তদানিন্তন মার্কিন কনসাল জেনারেল মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট-এ যে বিপাের্ট পাঠিয়েছিলেন সে সম্পর্কে ‘দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকার ৩০ ডিসেম্বর ২০০২ সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠায় সাংবাদিক আহমদ নূরে আলম কিছুকাল আগে অবমুক্ত মার্কিন গোপন দলিল’ উদ্ধৃত কৱে ‘রােকেয়া হলে ফ্যানের সিলিংয়ে ঝুলিয়ে রাখা ছিল ধর্ষিত ছয় মেয়ের নগ্ন লাশ” শিরােনামে লিখেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রােকেয়া হলে ফ্যানের সিলিংয়ে ৬টি মেয়ের লাশ পা বাধা নগ্ন মৃতদেহ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে বলে এক ব্যবসায়ী (আওয়ামী লীগ সমর্থক  নন) জানিয়েছেন, প্রতীয়মান হয় মেয়েগুলোকে ধর্ষণ করার পর গুলি করে ফ্যানের সঙ্গে পা ঝুলিয়ে দেয় ।

১৯৭১ সালের মার্চ মাসে ঢাকার মার্কিন কনসাল আর্চার কে ব্রাড়, সম্প্রতি প্রকাশিত “দি ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ’ (ইউপিএল টাকা ২০০০) গ্রন্থে লিখেছেন, What was generally beleived was that the army plan of attack at the university was to take no prisoners and to kill all the students present in the dorms. We saw traees of two mass graves in the campus, one near Iqbal Hall, the other near Rokeya Hail. The students at Iqbal Hall, some of who had weapons, were either shot in their rooms or mowed down when they came out of the building in groups. Rokeya Hall, a dormatory, for girl students, was set ablaze and the girls were machine gunned as they lled the buildings. The attack seemed to be aimed at eliminating the female strdent leadership since many girl student leaders resided in that hall.

সাতসমুদ্র তের নদীর ওপার থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসা পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী বালুচিস্তানের কসাই জেনারেল টিক্কাখানের অধিনায়কত্বে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলির নিয়ন্ত্রণে, মেজর জেনারেল খাদিম হােসেন রাজার অধীনে ৫৭ নং ব্রিগেডের ১৮ নং পাঞ্জাব, ৩২ নং পাঞ্জাব, ২২ নং বালুচ, ১৩ নং ফ্রান্টিয়ার ফোর্স, ৩১ নং ফিল্ড রেজিমেন্ট, ১৩ নং বিমান বিধ্বংসী রেজিমেন্ট এবং তিনটি কমান্ডাে কোম্পানি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ঢাকায় ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে যে অভিযান পরিচালনা করে তার মধ্যে ১৮ ও ৩২ পাঞ্জাব এবং ২২ বালুচ লে. কর্নেল তাভের নেতৃত্বে ঢাকা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে এথনিক ক্লেনিসং’ এর উদ্দেশ্যে যখন রক্তগঙ্গা, ধ্বংসের তাণ্ডবলীল ও ‘ব্যাপক অগ্নি সংযােজনের মাধ্যমে প্রজ্জলিত নরকে পরিণত করেছিল তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল উপাচার্য বিহীন। তখনকার উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ১৯৭১ সালের ১ জানুয়ারিতে তিন বছরের জন্য জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৮ ফেব্রুয়ারি তিনি মানবাধিকার কমিশনের সম্মেলনে যােগ দেয়ার জন্য সপরিবারে জেনেভা যান । সে সময় তার বড় ছেলে লন্ডনে লেখাপড়া কবছিলেন। বিচারপতি চৌধুরী লন্ডন গিয়ে পরিবারের সবাইকে সেখানে রেখে জেনেভায় ফিরে গিয়েছিলেন। সে সময় তিনি দেশের নানা খবরাখবরে উদ্বিগ্ন হন। জেনেভার একটি পত্রিকায় ঢাকায় দুজন ছাত্রের মৃত্যুসংবাদ দেখে বিচলিত হয়ে তিনি ‘৭১ সালের ২৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান সরকারের শিক্ষা সচিবকে পাকিস্তান দূতাবাসের মাধ্যমে প্রেরিত এক পত্রে লেখেন,  তােমরা নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর গুলি চালনার পর আমার ভাইস চ্যান্সেলর থাকার কোনাে যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই ! তাই আমি পদত্যাগ করলাম (স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালি, আবদুল মতিন, রেডিক্যাল এশিয়া পাবলিকেশন্স, লন্ডন, এপ্রিল, ১৯৮৯)

এটা কি কাকতালীয় নয় যে, পাকিস্তান সশস্ত্রবাহিনী যেদিন রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আক্রমণ করে, সেদিন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জেনেভা থেকে পাকিস্তান দূতাবাসের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা সচিবের কাছে তার পদত্যাগপত্র পেশ করেন? ২৬ মার্চ বিবিসির খবর শুনে বিচারপতি চৌধুৰী খুবই অস্বস্তি বােধ করেন এবং অধিবেশন শেষে কমিশনের চেয়ারম্যান এগলারের অনুমতি নিয়ে লন্ডনে পরিবানের কাছে ফিরে যান। লন্ডনে তার কার্যক্রম সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, আমি যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তরের দুজন কর্মকর্তাকে চিনতাম-একজন হচ্ছেন ইয়ান সাদারল্যান্ড, তিনি ছিলেন দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের প্রধান; অপরজন এন.জে, ব্যারিংটন, তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড হিউসের ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পররাষ্ট্র ভবনে উপস্থিত হলে তারা আমাকে জানান, ঢাকা থেকে এখনাে ঠিক কোনাে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। এমন সময় সাদারল্যান্ডের একান্ত সচিব খবর দেন যে, ঢাকা থেকে একটি টেলেক্স আসছে। সাদারল্যান্ড পুরাে টেলেক্সটি পাওয়ার পর আমাকে বলেন : জাস্টিস চৌধুরী, আমি অত্যন্ত দুঃখিত, ঢাকার সংবাদ খুবই খারাপ। বহু ছাত্রকে হত্যা করা হয়েছে এবং আমরা আশংকা করছি যে, শিক্ষকরাও এই হত্যাযজ্ঞ থেকে বাদ পড়েননি। নগরে মৃত্যুর সংবাদ খুবই বেশি। সেই মুহূর্তে আমার মনে হলাে, গােটা বাংলাদেশ একটি বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থায় আমার পক্ষে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে কোনাে রকম সম্পর্ক রাখা অপমানজনক। যারা আমার ছাত্রদের মেরে ফেলেছে, আমি কীভাবে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে পারি? আমার মনে পড়লাে প্রালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের কথা। আমি তখনই লর্ড হিউমের সঙ্গে যােগাযােগের চেষ্টা করি। লার্ড হিউমের সঙ্গে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে সাক্ষাক্তারের বাবস্থা করা হয়। এই মধ্যবর্তী সময়ে আমি বিভিন্ন একাডেমিশিয়ান এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় প্রধানের সঙ্গে যোগাযােগের চেষ্টা করি।

এছাড়া বৃটিশ পার্লামেন্টের সদস্যদের সঙ্গেও দেখা করি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার এলেন বুলকের সঙ্গে দেখা করি। ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের লর্ড জেমস একটি মধ্যাহ ভোজের আয়োজন করেন এবং প্রায় বিশজন বিভাগীয় প্রধানকে ওই ভােজে দাওয়াত করেন। আমি তাদের কাছে বাংলাদেশের অবস্থা বর্ণনা করি। তারা গভীর সহানুভূতির সঙ্গে তা শোনেন। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকাকালে লর্ড জেমস ঢাকায় এসেছিলেন। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে, ছয়।  মাসের মধ্যে বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। পূর্ব পাকিস্তানকে কলোনি হিসেবে ব্যবহার করা আর সম্ভব হবে না। এরপর আমি স্যার হিউ স্ট্রিংগার (কমনওয়েলথ বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সাধারণ সম্পাদক)-এর সঙ্গে দেখা করি। তিনি বলেন, তিনি তখনই ইয়াহিয়া খানকে একটি টেলিগ্রাম করবেন বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যাযজ্ঞ বন্ধ রার জন্য। তারপর আমি আন্তর্জাতিক জুরিসট কমিশনের সাধারণ সম্পাদককে টেলিফোন করে পুরাে বিষয়টি জানাই। তিনি পাকিস্তান সরকারের। কাছে একটি তারবার্তা পাঠান। তাতে তিনি হত্যাযজ্ঞ বন্ধ এবং বঙ্গবন্ধুর মুক্তি কথা বলেন। ১০ এপ্রিল লর্ড হিউমের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। লর্ড হিউম। আমাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে বলেন, তিনি পাকিস্তানের হাই কমিশনারের সঙ্গে কথা বলেছেন। অবস্থা ঠিকই আছে; চিন্তার কোনাে কারণ নেই। আমি বলি, শুধু একজনের কথাতেই প্রমাণ মেলে না যে, অবস্থা ঠিক আছে। আমি আমার সম্পূর্ণ বক্তব্য পেশ করি এবং শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন বাঁচানাের জন্য অনুরোধ জানাই। তিনি বলেন, সুনির্দিষ্ট খবর আছে শেখ মুজিব ভালােই আছেন। এই সাক্ষাৎকারে লর্ড হিউমকে আমি জানাই, আমরা শান্তি ও শৃঙ্খলার সঙ্গে আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাবাে। তিনি তাতে কোনাে আপত্তি করেননি। সেদিক থেকে এটা অত্যন্ত সাফল্যজনক সাক্ষাত্তার ছিলাে। সেদিনই আমি। চারটার সময় বিবিসিতে যাই ।

মিস্টার পিটান গিল সেখানে আমার একটি একক সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। এই সাক্ষাত্তারে আমি পাকিস্তানের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা ঘােষণা করি। বিবিসিতে কর্মরত দুজন বাঙালি সিরাজুর রহমান ও শ্যামল ঘোষ আমার বিবৃতি নেন এবং প্রচার কবেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় থেকে বিবিসি ওয়ার্ল্ডে বাংলা বিভাগ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সহানুভূমিশীল অনুষ্ঠান প্রচার করতে থাকে । বস্তুত পাকিস্তান বিমানবাহিনীর হামলায় চট্টগ্রামের কালুরঘাট ট্রান্সমিটার ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান প্রচার সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। ২৫ মে ১৯৭১ (নজরুল জন্মবার্ষিকী) স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান নিয়মিতভাবে পুনরায় প্রচার শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত আকাশবাণী কলকাতা, আগরতলা, শিলিগুড়ি কেন্দ্র আর বিবিসির বাংলা অনুষ্ঠান ছিলো মুক্তিযুদ্ধের খাখবর প্রচারে প্রধান মাধ্যম। অবরুদ্ধ বাংলাদেশের মানুষ ওইসব বেতার কেন্দ্রের খবর শুনে আশায় বুক বাধতাে। ১৯৭১ সালের ২৫ থেকে ২৮ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নীলক্ষেত, ফুলার রােড, ঈশা খা রেজি, জগন্নাথ হল, শহীদ মিনার, ঢাকা ও ফজলুল হক হল এলাকার আবাসিক এলাকাগুলাে পরিত্যক্ত, ভুতুড়ে ও জনমানবহীন বিরাণভূমিতে পরিণত হয়। ১৯৭১ সাল থেকে গড়ে ওঠা রমনারি মনােরম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে পাকিস্তানি সৈন্যরা শুধু জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার বা রক্তাক্ত করেনি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম ক্যাম্পাস। 

থেকে সব মানুষকে উচ্ছেদ করে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের আকাশে তখন শুধু চিল, শকুন আর মাটিতে মাংস-লােলুপ কুকুর আর বিহারি রাজাকারদের ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর)-এর বাঙালি জোয়ান পিলখানায় পাকিস্তানি সৈন্যদের আক্রমণে হতাহত হন। এদের মধ্যে অনেকে পালিয়ে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেন। ইপিআরের বদলে তখন ‘ইপকাফ’ বা ‘ইস্ট পাকিস্তানি সিভিল আর্মড ফোর্স’ গঠিত হয় শুধু বিহারিদের নিয়ে। শূন্য বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে এই ফোর্স এবং রাজাকার বাহিনীর হাতে ছেড়ে দেয়া হয়, আর পাকিস্তান বাহিনী ক্যাম্পাসে মােবাইল পেট্রোল বজায় রাখে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ক্যাম্পাসে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শেষ কয়েকদিন যে প্রচণ্ড বোমাবর্ষণ করা হয়েছিলাে, সে সম্পর্কে পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি দৈনিক ডন পত্রিকায় ১৯৭২ সালের ১৩ নভেম্বর নিজস্ব প্রতিনিধির একটি বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিলাে। সেটির বাংলা অনুবাদ, ওই রাতে শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে গুলশান কয়েক মাইল দূরে থাকায় আমি ঘটনাস্থলের কাছে ছিলাম না, কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর আমি এমন গােলাবর্ষণের মাত্রা ও পরিমাণ দেখিনি। রাত প্রায় ১১টার সময় কামানের গর্জন শুরু হয়, পাশাপাশি মেশিন গান ও হালকা অস্ত্রের গুলি, যা সকাল পর্যন্ত অবিরাম চলতে থাকে। এর আগে কোনাে কারফিউ বা কোনাে রকম হুঁশিয়ারি দেয়া হয়নি। একটি জাতীয় সেনাবাহিনীকে জাতির একটি অংশকে জয় করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিলাে। ‘ডন’ পত্রিকার ওই প্রতিবেদন দেরিতে হলেও স্বীকারােক্তিমূলক ছিলাে। আবদুল মতিন রচিত ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালী’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১২ই এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী কলকাতা থেকে একটি টেলিফোন কল পান, তাজউদ্দিন আহমদের নির্দেশে ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম তার সঙ্গে যােগাযোগ করেন। ১০ই এপ্রিল বিচারপতি চৌধুরীর বি বি সি সাক্ষাৎকার অত্যন্ত আবেগপূর্ণ ভাষায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ও শিক্ষক হত্যার কথা বর্ণনা করেন। ঘােষণা করেন, এই হত্যাকাণ্ডের কথা তিনি বিশ্ববাসীকে জানাবেন এবং দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত দেশে ফিরবেন  তাঁর বক্তৃতা ভারতীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় এবং তা পড়ে প্রবাসী বাংলাদেশের নেতা কর্মীরা খুশী হন। ব্যারিস্টার আমিকল ইসলাম সে কথা বিচারপতি চৌধুরীকে জানান, তিনি বিচারপতিকে আরাে জানান শীঘ্রই প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে এবং তাজউদ্দিন আহমদ প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন, তিনি বিচারপতি চৌধুরীকে বিদেশে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি নিয়ােগ করতে চান, সে জন্যে তার সম্মতি প্রয়ােজন।

বিচারপতি চৌধুরী বলেন, ‘আপনাদের সঙ্গে কোনরূপ যােগাযােগ  হলেও আমি স্বাধীনতা আন্দোলনে ব্যক্তিগতভাবে কাজ করে যাচ্ছি। আমি ধন্যবাদের সঙ্গে বিশেষ প্রতিনিধিরূপে কাজ করার সম্মতি জানাচ্ছি।’ ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগরে (মেহেরপুর) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার শপথ নেয় । ২১ শে এপ্রিল বিচারপতি চৌধুরীর নিয়ােগপত্রে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্বাক্ষর দান করেন। এই নিয়ােধুপত্র সঙ্গে নিয়ে লন্ডন প্রবাসী বাঙালী ব্যবসায়ী রকিবউদ্দিন ২৩ শে এপ্রিল কলকাতা থেকে লন্ডনে পৌছান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ঘটনাক্রমে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে প্রবাসে থাকায় ঐ ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করার সুযোগ পান, ঢাকা। থাকলে যা সম্ভবপর হতাে না। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযােগ্য যে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. আজিজুর রহমান মল্লিক ২৫ শে মার্চের পর অন্যান্য অধ্যাপকদের নিয়ে দেশত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে অংশগ্রহণ করেন। সে সময়কার তিনটি প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ের অপর একটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হােসায়েনকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের কনভয়ে ঢাকা নিয়ে এসে ১৯৭১ সালের মে মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে বসায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্ত নি বাহিনী ড. আবদুল বারীকে ঐ পদে বসিয়েছিল। ১৯৭১ সালের ৮ই জুলাই লন্ডন টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত একটি পত্রে ড, সৈয়দ সাজ্জাদ হােসায়েন এবং ইতিহাসের অধ্যাপক ড. মােহর আলী, ‘পূর্ব পাকিস্তান বাঙালীদের জীবনের কোন নিরাপত্তা নেই এ কথার প্রতিবাদ জানান। বুদ্ধিজীবীদের পাইকারীভাবে হত্যা করা হয়েছে এ তথ্যও তারা অস্বীকার করেন। চিঠিতে অবশ্য তারা স্বীকার করেন যে, মার্চের ২৫ ও ২৬ তারিখে জগন্নাথ হল ও ইকবাল হলের আশেপাশের এলাকার যুদ্ধে (?) ঢাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ জন শিক্ষক প্রাণ হারিয়েছেন।

চিঠিতে তারা আরাে লেখেন, আমাদের ৩ জন সহযোগী প্রাণ হারাতেন না, যদি না তারা যে ভবনগুলিতে বসবাস করতেন সে গুলােকে আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সশস্ত্র সদস্যরা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ঘাটি হিসেবে ব্যবহার করতাে। ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হােসায়েন ১৯৭১ সালের ২৫/২৬ মে মার্চ ঢাকায় ছিলেন না, এপ্রিল মাস তিনি ছিলেন রাজশাহীতে, ড. মোহর আলী ঈসা খাঁ রোডের (স্যাভেজ রােড) আবাসিক এলাকায় জগন্নাথ হল মাঠ সংলগ্ন আবাস থেকে জগন্নাথ হলে গণহত্যা যত্ত প্রত্যক্ষ করেছিলেন। যে নারকীয় দৃশ্য তার সন্তানকে মানসিকভাবে অসুস্থ করে ফেলেছিল। অথচ ৬, সৈয়দ সাজ্জাদ হােসায়েন এবং ড, মােহর আলী ইকবাল হল ও জগন্নাথ হলের আশে-পাশের এলাকায় যুদ্ধের কথা বলেছেন। ১৯৭১ সালের ২৫/২৭ শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এলাকায় কোন যুদ্ধ হয়নি হয়েছিল একতরফা গণহত্যা। যখন এক পক্ষ ট্যাংক, আমর্ড ক্যারিয়ারে চেপে, মটার, ভারী মেশিনগান, এন্টি ট্যাংক রিকয়েললেস রাইফেল, রকেট, গ্রেনেড, চাইনিজ অটোমেটিক প্রভৃতি  সর্বাধুনিক মারণাস্ত্র নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের আবাসিক এলাকায় নিরীহ নিরস্ত্র অসহায় মানুষের ওপর আগ্রাসন, গণহত্যা, ধ্বংস ও লুণ্ঠন চালায় এখন। কি তাকে ‘যুদ্ধ’ বলা চলে? একতরফা আগ্রাসন যুদ্ধ নয়, যুদ্ধ হয় উভয় পক্ষের মধ্যে। ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর রমনায় ‘পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী। বনাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোন যুদ্ধ হয়নি যা হয়েছিল তা একটি দেশের সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক সে দেশের প্রাচীন এবং বৃহত্তম শিক্ষা কেন্দ্রকে আক্ষরিক অর্থে নিশ্চিহ্ন করার অভিযান।

ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হােসায়েন রাজশাহী থেকে স্থল পথে পাকিস্তান সেনা বাহিনীর সামরিক যানে ঢাকা আসার পথে নিশ্চয়ই চোখে ঠুলি আটা ছিল না, তিনি নিশ্চয়ই নাটোর, পাবনা, নগরবাড়ী, আরিচা, মানিকগঞ্জ, সাভার, মীরপুর অঞ্চলে পথের দু’পাশে পাকিস্তান বাহিনী কর্তৃক ধ্বংসস্তুপে পরিণত জনমানবশূন্য শ্মশানভূমি সমূহ দেখতে দেখতে দিনে দুপুরে ঢাকায় এসেছিলেন! ঢাকা এসে তিনি নিশ্চয় তাঁর ঘনিষ্ঠতম বন্ধু ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক কে এম মুনিমের কাছে শুনেছিলেন, কি ভাবে তিনি ২৫ শে মার্চ রাতে সলিমুল্লাহ হল আবাসিক শিক্ষক আবাসে কয়েকবার পাকিস্তানী সেনাদের উদ্যত মারণাস্ত্রের হাত থেকে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। অথচ ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন এবং ড. মােহর আলী দখলদার পাকিস্তানী কমান্ডারদের আদেশে লন্ডন টাইম পত্রিকায় চিঠি লিখে মিথ্যাচারে কুণ্ঠিত হননি যে চিঠি লন্ডনস্থ পাকিস্তান হাই কমিশন চেষ্টা চরিত্র করে লন্ডনের পত্রিকায় পত্রস্থ করেছিল। অধ্যাপক কে এম মুনিম অবশ্য তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হােসায়েনের প্রভাব সত্বেও সত্য প্রকাশে কুণ্ঠিত হননি, তিনি ১৯৭০-৭১ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদনে (১৯৭২ সালে প্রকাশিত) ইংরেজিতে যা লিখেছিলেন, তার বাংলা, সেনাবাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘তাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্যবস্তু বা নিশানা বানিয়েছিল, সেনাপ্রধানরা ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বাংলাদেশ আন্দোলনের কেন্দ্র রূপে বিবেচনা করেছিল এবং সে জন্যেই এটাকে একেবারে চিরদিনের জন্য নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল! মধ্যরাত্রিতে ট্যাংক নিয়ে সেনাবাহিনীর একটি বহর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে অগ্রসর হয়, তারা বৃটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরী দখল করেন। হল এবং আবাসিক এলাকা ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীদের … আক্রমণ চালানোর জন্য ঘাঁটি স্থাপন করে।

অনুমান করা হয় যে ইকবাল হলে (পরে জহুরুল হক হল) প্রায় দুইশত ছাত্র নিহত হয়েছিল। এদের অনেকের মৃতদেহ পাকিস্তানী সৈন্যরা সরিয়ে ফেলেছিল। দুদিন পরেও ত্রিশটি মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়, আশে পাশের অঞ্চলের এবং বস্তির বহু লোেক বিভিন্ন বাড়ির ছাদে আশ্রয় নিয়েছিল তাদের অধিকাংশকেই এ রাতে। হত্যা করা হয়েছিল? ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ রাতে শহীদ মিনার আবাসিক এলাকার অন্যতম বাসিন্দা সলিমুল্লাহ হলের প্রভােস্ট মফিজুল্লাহ কবিরও অধ্যাপক মুনিমের মতাে  দৈবক্রমে পাকিস্তানী সৈন্যদের আক্রমণ থেকে প্রাণে বেঁচে যান। তিনি ১৯৭০-৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদনে যা লিখেছেন, তার বাংলা অনুবাদ, অনুমান করা হয় দশ জন শিক্ষক এবং ছাব্বিশ জন অন্যান্য কর্মচারীসহ ২৫ শে মার্চ রাত এবং ২৬ শে মার্চ সকালে প্রায় ৩০০ জন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিহত হয়েছিলেন। জগন্নাথ হলের ভীষণ ক্ষতি সাধন করা হয়, এর সন্নিহিত টিনের চালাগুলো আগুন লাগিয়ে ছাই করে ফেলা হয়। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের প্রভূত ক্ষতি সাধিত হয়, এর পঞ্চাশ বছরের মূল্যবান দলিল পত্র পুড়িয়ে ফেলা হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের পাঞ্চাবী প্রধান সেনাবাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করার। জন্য যে সর্বাত্মক সামরিক অভিযান এবং ধ্বংসযজ্ঞ চালায় তার পরেও জেনারেল টিক্কা খানের আদেশে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের প্রধানদের ২১ শে এপ্রিল ১৯৭১ এবং শিক্ষকদের ১লা জুন কাজে যােগ দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। ২রা আগস্ট থেকে ক্লাস শুরুর নােটিশ ছিল। স্বাভাবিক অবস্থা দেখাবার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় খােলার আগে পরিষ্কার করার নামে ইকবাল হল, সলিমুল্লাহ হল এবং জগন্নাথ হলের শূন্য ঘরগুলিতে ছাত্রদের ফেলে যাওয়া বইপুস্তক, কাপড়চোপড়, বিছানাপত্রের বহ্নি উৎসব করা হয়েছিল। পূর্বাহ্নে ২৫ শে মার্চ রাতেও জগন্নাথ ও ইকবাল হলের বিভিন্ন ঘরগুলি পাকিস্তানী ‘ধীর’ সৈন্যরা আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছিল, তবে তারা ছাত্রদের মূল্যবান জিনিষপত্র লুট করতে ভােলেনি। লুণ্ঠন, ধর্ষণ এবং ধ্বংসযজ্ঞে অপরাজেয় পাকিস্তান বাহিনীর তুলনা পাওয়া ভার। এমতাবস্থায় সামরিক নির্দেশে বিশ্ববিদ্যালয় খােলা হলেও ছাত্রদের উপস্থিতি ছিল খুবই কম আর ছাত্রীদের উপস্থিতি প্রায় শূন্যের কোঠায় কারণ একাত্তরে ধর্ম সম্প্রদায় নির্বিশেষে বাঙালী মেয়েদের প্রতি। পাকিস্তানীদের লোলুপ দৃষ্টি ছিল তুলনারহিত।

১৯৭১ সালের সেপটেম্বর মাসের দিকে মুক্তিযুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্লাসে উপস্থিতির সংখ্যা রহস্যজনকভাবে বেড়ে যায় এবং প্রায় প্রতিদিনই মুক্তিযোদ্ধা ছাত্ররা কড়া সামরিক প্রহরার মধ্যেও কলাভবনে গ্রেনেড বিস্ফোরণের মাধ্যমে তাদের সশব্দ উপস্থিতির কথা জানিয়ে দিত। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় একবার খুলে তা বন্ধ করার মতাে অবস্থা সামরিক কর্তৃপক্ষের ছিল  বিশ্ববিদ্যালয় খােলা, ক্লাসের নামে প্রহসন, পরীক্ষা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ । ক্লাসে যােগ দেবার নাম করে যে সব ছাত্র কলাভবনে আসতাে তাদের অধিকাংশই ছিল মুক্তিযােদ্ধা। ক্লাস থেকে নীরবে বেরিয়ে গিয়ে গ্রেনেড় ফাটিয়ে আবার ক্লাসে ফিরে এসে সে পড়তাে। প্রতিটি গ্রেনেড বিস্ফোরণের পর সার্চ হলেও কাউকে ধরা যেত না। ক্লাস শেষে শিক্ষকের সঙ্গেই তারা নিরাপদে বেরিয়ে যেত। দিশেহারা পাকিস্তানী সৈন্যরা। কলা ভবন প্রাঙ্গণে বট গাছটি কেটে ফেলে এবং মধুর ক্যান্টিনটি ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করে। ঘটনাচক্রে মধুর ক্যান্টিনটি যে ভবনে অবস্থিত সেটি ছিল একটি ঐতিহাসিক ভবন, নবাব সলিমুল্লার বাগান বাড়ী ছিল সেটি, যেখানে ১৯০৬ সালে 

কাছে যান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রাণ রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরােধ জানান। ইতােপূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হত্যার সংবাদে বিশ্বে তােলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল, পাকিস্তানের নিন্দা ও সমালােচনার ঝড় উঠেছিল বিশ্বব্যাপী। নতুন ভাবে পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিধনের সম্ভাবনায় বিশ্ব আতঙ্কিত হয়ে ওঠে, সেনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি অবিলম্বে টেলিফোনে পাকিস্তানের নয়া পররাষ্ট্র মন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টোর সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন এবং গ্রেফতারকৃত শিক্ষকদের ভাগ্য সম্পর্কে জানতে চান, তিনি তাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দাবী করেন। | ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে আমাদের যে পাঁচজন, শিক্ষককে আটক করা হয়েছিল। তাদের পাকিস্তানের তথাকথিত আজাদী দিবস ১৪ই আগস্টের আগে একদিন গভীর রাতে বিভিন্ন বাড়িতে পাকিস্তানী সৈন্যরা হানা দিয়ে দাগী আসামীর মতো ধরে নিয়ে। যায় এবং বাকি রাত রমনা থানায় বসিয়ে রাখে। অধ্যাপক আহসানুল হককে সে রাতে। তারা খুঁজে বের করতে পারেনি, তাকে পরে ধরে আনা হয়। 

২৭ শে মার্চ থেকে আমি ঢাকায় বিভিন্ন এলাকায় লুকিয়ে ছিলাম, জাহানারা ইমামের ধানমণ্ডির মায়ের বাড়িতে আমি সপরিবারে অনেক দিন ছিলাম কিন্তু ইতিমধ্যে জুলাই মাসের শেষ দিকে এক রাতে যাত্রাবাড়ীর কাছে পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে মুক্তি বাহিনীর জোর লড়াই হয়। আমার বাবা ডা, জুলফিকার আলি থাকতেন নিকটেই রােজ গার্ডেনের পাশে আর কে মিশন রােডে নিজের বাড়ীতে। রাতে গােলাগুলির তাণ্ডবে অন্ধকারের মধ্যে তিনি খাট থেকে নেমে মাটিতে আশ্রয় নিতে গিয়ে পড়ে যান এবং মস্তিষ্কে রক্তক্ষরনে অচৈতন্য হয়ে পড়েন, তাঁকে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়, কিন্তু জ্ঞান ফিরে আসে না, কোমা’তে থাকা অবস্থাতেই তার জীবনাবসান ঘটে। বাবার দেখা শােনা করার জন্য আমি বিশ্ববিদ্যালয় নীলক্ষেত আবাসিক এলাকায় ফিরে আসতে বাধ্য হই। আমার বাবার আর জ্ঞান ফিরে আসেনি, তিনি যেদিন রাতে জ্ঞান হারনি সেদিন রাতেও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শেষ পর্যন্ত শুনে ছিলেন, তিনি অত্যন্ত ধর্মভীরু ছিলেন, তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে জিতবেই, স্বাধীন হবেই। আমাদের দুঃখ তিনি দেশের স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি।  যাই হােক, বাবার মৃত্যুর কয়েকদিনের মধ্যেই আমি ধরা পড়ে যাই। রমনা থানায় যখন আমাদের পাকিস্তানী সৈন্যরা ধরে নিয়ে যায় তখন থানার তদানিন্তন ওসি। সাহেব আমাদের দেখে আঁৎকে ওঠেন, তিনি ক্ষুব্ধ ভাবে আমাদের বলেন, আজ সকালেইতাে আমি আপনাদের গ্রেফতারের সিদ্ধান্তের কথা আপনাদের ভাইস চ্যান্সেলর এবং কেয়ারটেকারকে জানিয়ে এসেছিলাম যাতে তারা আপনাদের সরে যেতে বলেন। বলাবাহুল্য যে তদানিন্তন ভাইস চ্যান্সেলর ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হােসায়েন এবং কেয়ারটেকার এস ডি দলিলউদ্দিন সুযােগ থাকা সত্ত্বেও আমাদের সতর্ক করেননি। পরদিন সকাল বেলা যখন আমাদের পাকিস্তানী সামরিক জিপে উঠিয়ে থানা থেকে নিয়ে যাওয়া হয় তখন রমনা থানার ওসি সাহেব এবং অন্যান্য পুলিশ কর্মচারীরা দু’হাত তুলে পরম করুণাময় আল্লাহর দরবারে আমাদের প্রাণ রক্ষার জন্যে আকুলভাবে   মােনাজাত করেন, যাবার আগে জোর করে তারা আমাদের নাশতা খাইয়ে দেন। একাত্তরের আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের সেই কারফিউ ও ব্ল্যাক আউটের ভয়াবহ রাতে রমনা থানার বাঙালি পুলিশ অফিসার ও কর্মচারীদের সহৃদয়তার কথা আজও যখন মনে পড়ে তখন আমরা অশ্রু সম্বরণ করতে পারিনা। জানিনা আজ তারা কে কোথায়? শুনেছি ঐ সহৃদয় ওসি সাহেব পাক সেনাদের হাতে নিহত হন। রমনা থানার আর একটি ঘটনা উল্লেখের দাবী রাখে। ষাটের দশকে যখন নীলক্ষেতে বর্তমান “বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব ভবনটি নির্মিত হয় তখন পরপর তিন বছর প্রফেসর সৈয়দ সাজ্জাদ হােসায়েন ক্লাবের সভাপতি এবং আমি সাধারণ সম্পাদক ছিলাম, সেই সূত্রে আমাদের মধ্যে একটা সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ।

রমনা থানায় বন্দী অন্যান্য শিক্ষকরা সে কথা স্মরণ করে আমাকে অনুরােধ জানান, ভাইস চ্যান্সেলরকে আমাদের গ্রেফতারের খবর জানাতে। আমরা তখনও জানি না যে তিনি আগে থেকেই এ সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। আমি সেই গভীর রাত্রিতে ভাইস চ্যান্সেলর ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হােসায়েনকে টেলিফোন করলাম। তিনি নিজেই টেলিফোন ধরলেন, আমি বললাম, স্যার আমাদের গ্রেফতার করে রমনা থানায় নিয়ে আসা হয়েছে, সকালে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাবে। তিনি এ সংবাদে বিস্মিত হলেন বলে মনে হলাে না, তিনি শান্ত কণ্ঠে জানতে চাইলেন, কাকে কাকে ধরা হয়েছে? আমি একে একে নামগুলি বলতে লাগলাম, আমাকে ছাড়া। ইতিহাসের ড, খয়ের, সমাজ বিজ্ঞানের অধ্যাপক সাদউদ্দিন, গণিতের অধ্যাপক এ কে এম শহীদুল্লাহ…শেষ নামটি উচ্চারণের পর তিনি সঙ্গে সঙ্গে জানতে চাইলেন, “আর’ । তিনি সম্ভবত ইংরেজির অধ্যাপক আহসানুল হকের নামটি শােনার আশা করেছিলেন। আচ্ছা’ বলে তিনি টেলিফোনটি রেখে দিলেন। | সকাল বেলায় আমাদের একটি মিলিটারী জীপ গাড়ীতে পুরাতন সংসদের এম পি হােস্টেল ভবনে নিয়ে যাওয়া হল, সেখানে একাত্তর সালে ‘ঢাকা অঞ্চলের মার্শাল ল’ হেড কোয়ার্টার্স অবস্থিত ছিল। যে অফিসার আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি আমাদের জীপ ড্রাইভারসহ হেড কোয়ার্টার প্রাঙ্গণে বসিয়ে রেখে ভেতরে গেলেন, সে সময় আমরা এক বিচিত্র দৃশ্য অবলােকন করলাম । ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের সময় সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের প্রবীণ ছাত্র আখতারুউদ্দিনের কাছে ভাষা আন্দোলনের জন্যে সংগৃহীত অর্থ গচ্ছিত ছিল, যিনি সেই টাকার হিসাব না দিয়ে ব্যারিস্টারী পড়তে লন্ডন পাড়ি দিয়েছিলেন এবং কয়েকবছর পরে ব্যারিস্টার হয়ে ঢাকা ফিরে আইন ব্যবসা এবং দক্ষিণপন্থী রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন।

আমরা মার্শাল ল’ হেড কোয়ার্টার্সের প্রাঙ্গণে জীপে বসে কয়েকজন খাকি পােষাকধারী তরুণকে নিয়ে একটা ভােক্সওয়াগন মাইক্রোবাসে ব্যারিস্টার আখতারউদ্দিনকে মার্শাল ল হেড। কোয়াটার্সে আসতে দেখলাম। থাকি পােষাকধারীরা বারান্দায় অপেক্ষা করতে লাগলাে, ব্যারিস্টার আখতারউদ্দিন অফিসের ভেতরে গেলেন এবং কিছুক্ষণ পর একজন পাকিস্তানী সামরিক অফিসার সহ বারান্দায় বেরিয়ে এলেন, বারান্দায় থরে থরে বিভিন্ন প্রকার হাল্কা অস্ত্রশস্ত্র রক্ষিত ছিল। ব্যারিস্টার আখতারউদ্দিন তার সঙ্গীদের নিয়ে অস্ত্রশস্ত্র বাছাই 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সবচেয়ে গুরুতর ঘটনা ঘটে নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে রােকেয়া হলে। একাত্তরের পচিশে মার্চ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস প্রথমে অবরুদ্ধ ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী দ্বারা, পরে তার সঙ্গে যুক্ত হয় ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস’ এর পরিবর্তে বিহারীদের নিয়ে গঠিত ‘ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সে’র সশস্ত্র সদস্য আর শেষে সংযুক্ত হয় রাজাকার ও আল-বদর বাহিনী। শেষােক্ত বাহিনীটির অস্তিত্বের কথা আমরা অবশ্য বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের আগে পর্যন্ত জানতে পারিনি। ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস সম্পূর্ণ ভাবে হানাদার, দখলদার ও তাবেদার বাহিনী কবলিত, বিভিন্ন পয়েন্টে চেক পােস্ট, ভাইস চ্যান্সেলর ড. সৈয়দ হােসায়েনের এবং ড. হাসান জামানের স্যাভেজ রােডস্থ আবাস প্রায় দুর্গ। ক্যাম্পাসে অনবরত পাকিস্তান সামরিক টহল, সন্ধ্যার আগে থেকেই কারফিউ এবং ব্ল্যাক আউট আর রাজাকারদের রাজত্ব । এহেন পরিবেশে ১৯৭১ সালের ১০ই নভেম্বর গভীর রাতে রােকেয়া হলে সশস্ত্র পাকিস্তানী সৈন্য ও তাদের বিহারী সহযােগীরা প্রবেশ করে এবং হলে অবস্থানকারী মােট ত্রিশজন ছাত্রীর। ওপর নির্যাতন চালায়, সর্বস্ব অপহরণ করে, পরে কয়েকজন ছাত্রীকে জরুরী চিকিৎসার জন্য মেডিকেল কলেজের ইমারজেন্সিতে নিতে হয়েছিল। সশস্ত্র পাকিস্তানী দুবৃত্তরা। প্রভােস্টের বাড়িতেও প্রবেশ করে এবং তাণ্ডব চালায়। এই বর্বর ঘটনা তদানিন্তন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণ চেপে যায়। পরবর্তীকালেও সে রাতে হলে কর্তব্যরত প্রভােস্ট এবং হাউজটিউটরদের কেউই এ বিষয়ে মুখ খােলেননি। হয়তাে বা সে রাতে নিগৃহীত ছাত্রী এবং নিজেদের মানসম্মানের কথা ভেবেই তারা বিষয়টি চেপে যান।

কিন্তু অপরাধীদের অপরাধের চিহ্ন থেকেই যায়। তাই পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি দৈনিক ডন পত্রিকায় ১৯৭১ সালের ১১ই নভেম্বরে প্রকাশিত নিম্নোক্ত সংবাদটি থেকে ১০ই নভেম্বর রাতে সংঘটিত রােকেয়া হলের খবরটি জানা যায়, *Dacca hostel girls robbed’ শিরােনামে ‘DAWN’ পত্রিকায় সংবাদ, Dacca Nov, 10, misereants armed with revolver, stengun and other weapon, committed robbery in the Dacca university Roqaya Hall, late last night, according to police source They kept thirty girls under terrors for two hours, also provost house যার মর্মার্থ, টাকা ছাত্রীবাসে ‘ডাকাতি’ ঢাকা ১০ই নভেম্বর, পুলিশ সূত্র অনুযায়ী জানা যায়, দুস্কৃতিকারীরা রিভলবার, স্টেনগান এবং অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে গতকাল গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রােকেয়া হলে ডাকাতি করে। তারা ত্রিশ জন ছাত্রী ও প্রভােস্টের বাড়িতে দুই ঘণ্টা যাবত সন্ত্রাস চালায়।’ প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযােগ্য যে, রােকেয়া হলের প্রবেশ পথে একটি শক্তিশালি পাকিস্তানী সামরিক চৌকি ছিল । নিশ্চিদ্র ব্ল্যাক আউট, কারফিউ, মােবাইল পেট্রল এবং ভেতর থেকে   তালাবদ্ধ মেয়েদের হলে বা প্রভােস্টের বাড়িতে সশস্ত্র কোন দুস্কৃতিকারীরা ঢুকতে পারতাে তা সহজেই অনুমেয়। ১৯৭১ সালের ১০ই নভেম্বর গভীর রাতে পাকিস্তান বাহিনী কর্তৃক অবরুদ্ধ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের রােকেয়া হলের ভেতরে সশস্ত্র অবস্থায় প্রবেশ, দীর্ঘ দুই ঘণ্টা যাবত ত্রিশটি মেয়ের সর্বস্ব অপহৰণ কারা করেছিল তা বুঝতে অসুবিধা হয় না, তারা ছিল সশস্ত্র পাকিস্তানী সৈন্য ও ইপকাফ ও রাজাকার বাহিনীর বিহারী সদস্য। ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ মধ্যরাত্রে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি এথনিক ক্লেনসিং’ বা ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ শুরু হয়েছিল ‘বঙ্গবন্ধু ভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানায় ইপি আব সদর দফতর এবং বিভিন্ন সংবাদপত্র, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, বস্তি বাজার, ফায়ার সার্ভিস ও সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় আক্রমণ ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ও পাইকারী হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে।

ফলে ২৭ শে মার্চের মধ্যে আতঙ্কে প্রাণ বাঁচাতে ঢাকা নগৰী জনশূন্য হয়ে পড়েছিল, শহরের অগণিত মানুষ প্রাণের ভয়ে বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে জিঞ্জুিরায় আশ্রয় গ্রহণ করেছিল, তাদের ওপরেও ‘টাকা মহানগরীর মতাে সর্বাত্মক সামৰি অভিযান চালায় পাকিস্তান বাহিনী। তুরাগ নদী পার হয়ে যারা ঢাকা থেকে পালাচিছল তাদের ওপর আক্রমণ চালায় মােহাম্মদপুরমীরপুরের বিহারীরা। প্রতিক্রিয়ায় ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের মধ্যে ঢাকা মহানগর জনমানবশূন্য ধ্বংসস্তুপ ও ভূতুড়ে নগরীতে পরিণত হয়। কিন্তু এই আক্রমণ বাঙালিরা বিনা চ্যালেঞ্জে মেনে নেয়নি, দেশের বিভিন্ন স্থানে বাঙালীব প্রাথমিক প্রতিরােধ সংগ্রাম শুরু হয়, পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীও বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে থাকে সর্বাত্মক বাঙালি গণ হত্যা অভিযানে, শুরু হয় বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের মধ্যে বাঙালীর প্রতিরােধ সংগ্রাম ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে দেশের সর্বত্র সীমান্ত অঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্ব সশস্ত্র স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরােধ সগ্রাম সংগঠিত মুক্তিযুদ্ধের রূপ নিতে থাকে। ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ ‘গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠনের কথা ঘােষণা করেন। এবং ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগর আম্রকাননে দেশী বিদেশী সাংবাদিক প্রতিনিধি এবং জনতার সম্মুখে আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করেন। মুজিবনগর আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানসংগঠনে ছিলেন অধ্যাপক মো. ইউসুফ আলি, আব্দুল মান্নান, নুরুল কাদের খান, তৌফিক এলাহি চৌধুরী এবং মাহবুবউদ্দিন আহমদ, সকলেই টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র ।

প্রবাসী সরকার স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালির মরণপণ মুক্তিযুদ্ধ পৰিচালনা করে। এই সরকারের উপরাষ্ট্রপতি এবং ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম আর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ যথাক্রমে চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুখাের ছাত্রনেতা ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের একান্ত সচিব ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. ফররুখ আজিজ খান । 

সূত্র : স্বাধীনতা সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় – রফিকুল ইসলাম