You dont have javascript enabled! Please enable it!

উনসত্তরের গণআন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি, নগ্ন সামরিক শাসন ব্যবস্থা এবং তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্রী ব্যবস্থায় ১৯৬৫ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের ক্ষমতা আইনানুগ করার উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানকে পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বব্যাপী সামরিক নেটওয়ার্কের অন্তর্ভুক্তি আর সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের ক্ষমতার বাইরে রাখার নীলনকশী কার্যকর করা। সেই কঠোর সামরিক শাসনের মধ্যেও পূর্ববাংলায় রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকীকে কেন্দ্র করে সাংস্কৃতিক আন্দোলন, শরীফ কমিশনের শিক্ষা সংস্কার বিরােধী ছাত্রদের শিক্ষা আন্দোলন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা রুখে দাঁড়ানাের আন্দোলন আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কনভােকেশন হাঙ্গামাকে কেন্দ্র করে ছাত্র ও সংবাদপত্র নির্যাতনবিরােধী আন্দোলন, অর্থনৈতিক বৈষম্য-বিরােধী দুই অর্থনীতির জন্য আন্দোলন ছিল। প্রকৃত প্রস্তাবে সামরিক স্বৈরাচার ও পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদ-বিরােধী আন্দোলন, যেসব। আন্দোলনের উৎসকেন্দ্র ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের মূলধারা ছাত্র। আন্দোলনের নেতারা ষাটের দশকে সামরিক শাসনের আবরণে পশ্চিম পাকিস্তান। তথা পাঞ্জাবি শাসন-শােষণ অবসানের জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতাকেই লক্ষ্যস্থির করে, স্বাধিকার আন্দোলন করছিল। ‘৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের উন্মাদনা ও ভারতবিরােধী প্রচারণা যখন তুঙ্গে, তখন এটাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণ অরক্ষিত এবং ভারতের দয়ার ওপর নির্ভরশীল । ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় বাজেটের সিংহভাগ খরচ হয়েছে সামরিক খাতে । মার্কিন সামরিক সহায়তা এবং পাকিস্তানের সামরিক বাজেটের শতকরা নব্বই ভাগের বেশি পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করা হয় ।  পাকিস্তান সশস্ত্রবাহিনীর সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল পাঞ্জাবি, তার পরে পাঠান ও বালুচরা । পাক বাহিনীতে বাঙালি ও সিন্ধিদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে মেজর গনির উদ্যোগে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠিত হলেও ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত এ রেজিমেন্টের ব্যাটালিয়ন সংখ্যা দশটিতেও পৌঁছায়নি। পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীতে বাঙালি সৈনিক ও অফিসাররা ছিলেন উপেক্ষিত ও লাঞ্ছিত । দেশ বিভাগের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে আগত অফিসারদের মধ্যে মেজর জেনারেল মজিদ ছিলেন প্রবীণতম। এই বাঙালি অফিসার যাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চিফ অফ স্টাফ না হতে পারেন, সে জন্য তাকে রাওয়ালপিণ্ডি ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িয়ে বরখাস্ত করা হয়।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বৃদ্ধ বয়সে তাকে নয় মাস শেরেবাংলা নগরে ‘ভিআইপি কেজ’ নামক পাকিস্তান বাহিনীর বন্দিশিবিরে আটক রাখা হয়। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে লাহােরের কাছে বেদিয়া সেক্টরে মােতায়েন প্রথম ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়ন লে. কর্নেল এ.টি. কিউ, হকের কমান্ডে যথার্থ ব্যাঘের শৌর্যবীর্য নিয়ে লড়াই করে সুনাম অর্জন করেছিল। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে যে ব্যাটালিয়নের সৈনিকরা সবচেয়ে বেশি বীরত্বের পদক লাভ করে, সেটি ছিল বেঙ্গল টাইগার্সের প্রথম ব্যাটালিয়ন। এই ব্যাটালিয়নে অফিসারদের মধ্যে ছিলেন মেজর মংশােয়া ও ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমান প্রমুখ। অথচ যুদ্ধশেষে প্রচলিত রীতিতে ওই ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল এ. টি. কিউ. হককে সরাসরি ব্রিগেডিয়ার পদে উন্নীত না করে কর্নেল পদ দিয়ে সেনাবাহিনীর বাইরে রেঙ্গুনে সামরিক অ্যাটাশে নিয়ােগ করা হয়। ফলে দুঃখ-বেদনায় ওই বীর সেনাপতি শেষ পর্যন্ত ইন্তেকাল করেন, যার কবর রয়েছে বনানী সামরিক গােরস্থানে। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পরে পাকিস্তান সশস্ত্রবাহিনীতে বাঙালিদের বিরুদ্ধে এই বৈষম্য দূর করার কিছু পদক্ষেপ নেয়া হলেও ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মােট ব্যাটালিয়নের সংখ্যা দশটির বেশি হয়নি। পাকিস্তান নৌবাহিনীর প্রবীণতম অফিসার রিয়ারএডমিরাল রশীদকে বাঙালি বিধায় নৌপ্রধান করা হয়নি। বিমান। বাহিনীতেও একই অবস্থা ছিল।  ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানে কাগজপত্রে ‘ফোরটিন্থ ডিভিশন’ যা চতুর্দশ ডিভিশন’ নামে একটি ডিভিশন থাকলেও আসলে পাকিস্তান। বাহিনী পুরাে এক ডিভিশন ছিল না, বিমানবাহিনীতে স্যাবারজেট বিমান পুরাে এক স্কোয়াড্রনও ছিল না, উপকূল রক্ষার জন্য বস্তুতপক্ষে কোনাে যুদ্ধজাহাজ ছিল না। মােটকথা ১৯৪৭-৬৫ সাল পূর্ব পাকিস্তান ছিল সম্পূর্ণ অরক্ষিত। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান রক্ষার দায়িত্ব ছিল মূলত থ্রি-নট-থ্রি রাইফেলধারী ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের কয়েক হাজারের মতাে জোয়ান আর মার্কিন ও চীনা সাহায্যপুষ্ট পাকিস্তান সশস্ত্রবাহিনীর লাখ লাখ সৈনিক, নাবিক, বৈমানিক এবং আধুনিক সাজোয়া, গােলন্দাজ, নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রায় পুরােটাই মােতায়েন ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে ।

পাকিস্তানি সামরিক কর্তাদের তত্ত্ব ছিল এই যে, এ স্ট্রংওয়েস্ট পাকিস্তান ইজ দি বেস্ট ডিফেন্স ফর ইস্ট পাকিস্তান।’ পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হওয়ামাত্র নাকি আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে ভারতের রাজধানী দিল্লির পতন ঘটবে! হয়তাে ওই অলীক তত্ত্বে বিশ্বাসী। হওয়ার কারণেই জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তানের সিন্ধু আর ভারতের গুজরাট সীমান্তবর্তী কচ্ছের রানে আকস্মিক অভিযান চালিয়ে কিছু বিতর্কিত সীমান্ত এলাকা দখল করে নিজেকে নিজে ফিল্ড মার্শাল’ পদোন্নতি দিয়েছিলেন। কচ্ছের সাফল্যে উল্লসিত আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী রূপে ছােটখাটো মানুষ গান্ধীটুপি ও ধুতিপরা লালবাহাদুর শাস্ত্রীকে দেখে ফিল্ড মার্শাল আয়ুব খান কাশ্মীরে অনুরূপ অ্যাডভেঞ্চার  করার জন্য মুজাহিদ নামে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়মিত সৈন্য পাঠিয়ে সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী ঘােষণা করেন, ভারত তার পছন্দমতাে যুদ্ধক্ষেত্র বেছে নেবে। কার্যত তা-ই ঘটে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে ভারত লাহাের আক্রমণ করে। | ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান পাঞ্জাব ও সিন্ধু সীমান্ত অরক্ষিত রেখে পাকিস্তান সশস্ত্রবাহিনীর প্রায় পুরােটা আজাদ কাশ্মীরে নিয়ােগ করেছিলেন জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কমান্ডে। ভারত প্রতি-আক্রমণ চালায় পাঞ্জাব ও সিন্ধু সীমান্তে। লাহােরে ভারতীয় বিমানবাহিনী বােমাবর্ষণের মাধ্যমে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হয়। ভারতীয় বাহিনী লাহাের সীমান্তে বিআরবি খাল অতিক্রম করে শালিমার গার্ডেন পর্যন্ত অগ্রসর হয়েও শেষ পর্যন্ত বিআরবি খালের ওপারে অবস্থান নেয়। ভারতীয় বাহিনী শিয়ালকোট শহরতলি পর্যন্ত ঢুকে পড়ে এবং চউইন্ডা রেলস্টেশন দখলে নিয়ে লাহাের-শিয়ালকোট রেল যােগাযােগ বন্ধ করে দেয় । লাহােরের বেদিয়া সেক্টরে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়ন ভারতীয় বাহিনীর অগ্রযাত্রা প্রতিরােধে সক্ষম হলেও পাকিস্তান সর্বাধুনিক মার্কিন প্যাটন ট্যাংক বহর নিয়ে গঠিত ‘থার্ড ক্যাভালরি’ নিয়ে কাসুর সেক্টরে অগ্রসর হয়। উদ্দেশ্য ছিল খেমকারান দিয়ে পিনসার মুভমেন্ট করে পেছন দিক থেকে অমৃতসর দখল করা; কিন্তু পাকিস্তানের প্যার্টন ট্যাংক বহর সীমান্ত অতিক্রম করতে গেলে কাসুর-খেমকারান সীমান্তে ভারতীয়রা ইরিগেশন ক্যানেল বা সেচ খালগুলাে খুলে দিলে পুরাে থার্ড ক্যাভালরি’র সলিল সমাধি ঘটে এবং ওই ট্যাংক বহরের জলমগ্ন হওয়ার স্থানটির নাম হয়ে যায় ‘প্যাটন নগর’।

শিয়ালকোট রণাঙ্গনে জেনারেল টিক্কা খান শিয়ালকোট নগরী রক্ষা করতে সক্ষম হলেও চউইন্ডা রেলস্টেশন ভারতীয়দের দখলেই থেকে যায় । কাশ্মীর ফ্রন্টে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের বাহিনী আখনুর পর্যন্ত অগ্রসর হলেও শ্রীনগর-জম্মু-পাথানকোট সড়ক যোগাযােগ বিছিন্ন করতে অক্ষম হয়। অপরদিকে সিন্ধু-রাজস্থান সীমান্তের মরুভূমির যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানের লাইফ লাইন এ্যান্ড ট্যাংক রােড বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার উপক্রম করে। যুদ্ধের ওই নাজুক পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুরােধে সােভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানকে শােচনীয় পরাজয় থেকে রক্ষার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করে। তাসখন্দে ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া ১৭ দিনের পাক-ভারত যুদ্ধ। বন্ধের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের বৈঠকের ফলে যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্পাদিত হয়। পাকিস্তানের জন্য সৌভাগ্যবশত তাসখন্দ চুক্তি স্বাক্ষরের পর সেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। জাতিসংঘ ও সােভিয়েত নেতাদের সঙ্গে ফিল্ড মার্শাল আয়ুব খানও লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মরদেহ বহন করে বিমানে কফিন উঠিয়ে দেন। পাকিস্তান বেঁচে গেলেও পূর্ব পাকিস্তান যে সম্পূর্ণ অরক্ষিত, তা স্পষ্ট হয়ে যায়। সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানকে তাে দূরের কথা, নিজেকে রক্ষা করতেও অক্ষম। আর যুদ্ধ শুরুর আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে  দিল্লি দখলের দিবাস্বপ্ন ভেঙে যায় অমৃতসর দখল করতে গিয়ে কাসুর-খেমকারান সেক্টরের প্যাটন নগরে সেচখালের পানিতে। যুদ্ধের উন্মাদনা উবে যায়। পূর্ববাংলা বুঝতে পারে, পশ্চিম পাকিস্তান তাকে রক্ষা করতে পারবে না, তাকে নিজেকে নিজে রক্ষা করতে হবে। এই প্রেক্ষাপটে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের শুরুতে লাহােরে ৬-দফা বা পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকারের দাবি উত্থাপন করেন, যে ৬-দফার ভিত্তি ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদদের ‘টু ইকোনমি থিউরি’ বা পাকিস্তানের দুই অংশের জন্য দুটি স্বতন্ত্র অর্থনীতি ব্যবস্থা চালু এবং পাকিস্তানকে একটি কনফেডারেশনে পরিণত করা, যাতে পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার লাভ করতে পারে। কিন্তু পাকিস্তানের সরকার বা বিরােধী দল তা অগ্রাহ্য করে । ফিল্ড মার্শাল আয়ুব খান অস্ত্রের ভাষায় শেখ মুজিবের ছয় দফার জবাব দেবার হুমকি দেন। 

১৯৬৫ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ এবং বৃহৎ শক্তিবর্গের প্রচেষ্টায় পাকভারত যুদ্ধ থেমে গেলেও উপমহাদেশের দুটি রাষ্টের মধ্যে ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৫ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত চালু অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং জল-স্থল-আকাশপথে যােগাযােগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ফলে পাকিস্তানের পূর্ব অংশের সঙ্গে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসাম রাজ্যের যােগাযােগ একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। পূর্ব পাকিস্ত নি অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও যােগাযােগের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ১৯৬৫ সালের আগে পর্যন্ত চালু কলকাতা ও ঢাকার মধ্যে পত্রপত্রিকা, বই, গ্রামােফোন। রেকর্ড আদান-প্রদান ও যাতায়াত সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়, পূর্ব পাকিস্তানে এক সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্ব দেখা দেয়। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় থেকে ঢাকা বেতার ও টেলিভিশন কেন্দ্র থেকে সমস্ত ভারতীয় অনুষ্ঠান প্রচার নিষিদ্ধ। যুদ্ধের আগে যেখানে কলকাতার রবীন্দ্র ও নজরুল সঙ্গীতের রেকর্ড ঢাকা বেতার থেকে বাজানাে হত, শুধু তা-ই নিষিদ্ধ হয় না-সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা বেতার ও টেলিভিশন কেন্দ্র থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীতসহ বাংলা। সাহিত্যের ক্লাসিক রচনাবলী, যেমন নাটক ইত্যাদির প্রচারও বন্ধ থাকে। যুদ্ধের পর পাকিস্তানের তথ্য সচিব আলতাফ গওহর ঢাকা বেতার কেন্দ্রে স্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় প্রসঙ্গটি উত্থাপিত হয়। তিনি বাংলাভাষা ও সাহিত্যের দেশ বিভাগ-পূর্ববর্তী রচনাবলী পঠন-পাঠন এবং সম্প্রচারের বিষয়ে নীতিগতভাবে একমত হন।

ফলে ঢাকা বেতারের তদানীন্তন বাঙালি কর্মকর্তাদের বিরােধিতা সত্ত্বেও সীমিতভাবে স্থানীয় শিল্পীগণ কর্তৃক রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার শুরু হয়; কিন্তু পাকিস্তান। সরকারের তথ্যমন্ত্রী ঢাকা নবাব পরিবারের খাজা শাহাবুদ্দিন এবং তার জামাতা। পাকিস্তান পুলিশ সার্ভিসের প্রবীণ সদস্য এবং বিএনআর বা জাতীয় পুনর্গঠন সংস্থার সাবেক কর্মকর্তা ও পূর্ব পাকিস্তানের তত্ত্বালীন তথ্য সচিব মুসা আহমদের প্ররােচনায় রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধকরণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। | ১৯৬৭ সালের ২৩ ও ২৪ জুন পাকিস্তানের বিভিন্ন সংবাদপত্রে নিম্নোক্ত সংবাদটি প্রকাশিত হলে পূর্ব পাকিস্তানের তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় : ‘রেডিও পাকিস্তান থেকে। রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার করা হবে না।’ 

কেন্দ্রীয় তথ্য ও বেতারমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন গতকাল জাতীয় পরিষদে বলেন : ভবিষ্যতে রেডিও পাকিস্তান থেকে পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক মূল্যবােধের পরিপন্থী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান প্রচার করা হবে না এবং এ ধরনের অন্যান্য গানের প্রচারও কমিয়ে দেয়া হবে। রাজশাহী থেকে নির্বাচিত বিরােধীদলীয় সদস্য জনাব মুজিবুর রহমান চৌধুরীর এক অতিরিক্ত প্রশ্নের উত্তরে খাজা শাহাবুদ্দিন উপরােক্ত মন্তব্য করেন।

(দৈনিক পাকিস্তান, ২৪ জুন ১৯৬৭)

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জার্মানির একনায়ক হিটলার নাৎসি জার্মানি এবং দখলকৃত অঞ্চলসমূহে ইহুদি সঙ্গীতজ্ঞদের অমর সৃষ্টিসম্ভার নিষিদ্ধ করেছিলেন। একই পন্থায় পাকিস্তানে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান পাকিস্তানে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করেন। এর আগে ১৯৬১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনে বাধা দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান সরকার ব্যর্থ হয়েছিল। এবারে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের অজুহাতে রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধ করা হলাে। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের উদ্যোগেই সরকারি বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনের সূচনা হয়েছিল, সেবারেও মুসা আহমদ শত চেষ্টা করেও রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন বন্ধ করতে পারেননি। এবারেও পাকিস্তান সরকারের রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তে প্রথম প্রতিবাদ জানাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ। বাংলা বিভাগের কয়েকজন শিক্ষকের তাৎক্ষণিক প্রয়াসে ঢাকার সমস্ত দৈনিক সংবাদপত্রের ২৫ জুন ১৯৬৭, সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠায় রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তে র প্রতিবাদে ১৮ জন বুদ্ধিজীবীর বিবৃতি’ শিরােনামে নিম্নোক্ত বিবৃতিটি প্রচারিত হয়, স্থানীয় এক দৈনিক পত্রিকায় ২৩ শে জুন ১৯৬৭ তারিখে মুদ্রিত একটি সংবাদের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। এতে সরকারী মাধ্যম হতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রচার হ্রাস ও বর্জনের সিদ্ধান্ত প্রকাশ করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত আমরা অত্যন্ত দুঃখজনক বলে মনে করি। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য বাংলাভাষাকে যে ঐশ্বর্য দান করেছে, তার সঙ্গীত আমাদের অনুভূতিকে যে গভীরতা ও তীক্ষ্ণতা দান করেছে, তা রবীন্দ্রনাথকে বাংলাভাষী পাকিস্তানীদের সাংস্কৃতিক সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করেছে।

সরকারী নীতিনির্ধারণের সময় এই সত্যের গুরুত্বকে মর্যাদা দান করা অপরিহার্য।  (দৈনিক পাকিস্তান, ২৫ জুন ১৯৬৭) বুদ্ধিজীবীদের ঐ সংক্ষিপ্ত বিবৃতি পাকিস্তান সরকারের জন্য ছিল প্রায় একটি বােমার শেল। গভর্নর মােনেম খান অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে 

এই বিবৃতিটি দিয়েছিলেন :

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ সাজ্জাদ হােসায়েন (ইংরেজি বিভাগ)

অধ্যাপক কে, এম. এ. মুনিম (আইন বিভাগ)

অধ্যাপক এ. শাহাবুদ্দীন (ইতিহাস বিভাগ)

অধ্যাপক মােহর আলী (ইতিহাস বিভাগ)

অধ্যাপক এ. এফ. এম. আবদুর রহমান (গণিত বিভাগ)

১৮ জন বুদ্ধিজীবীর বিবৃতির সমালােচনা করে দ্বিতীয় বিবৃতিটি দেন ৪০ জন দালাল বুদ্ধিজীবী, যারা পরে খাজা শাহাবুদ্দিন ও চল্লিশ চোর’ নামে খ্যাত হয়েছিলেন। পাকিস্তান সরকার ও তার পূর্ব পাকিস্তানি সহযােগীদের তৎপরতায় এভাবেই বেতার ও টেলিভিশন থেকে ১৩৭৪ সনের ২২ শ্রাবণ রবীন্দ্র মৃত্যুবার্ষিকীর আগে। (আগস্ট ১৯৬৭) রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের আগে পূর্ব পাকিস্তানের বেতার বা টিভি থেকে আর রবীন্দ্রসঙ্গীত বা সাহিত্য প্রচারিত হয়নি। কিন্তু সামরিক স্বৈরাচার, গভর্নর মােনেম খান, তথ্য সচিব। মুসা আহমদ এবং প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবীদের সমস্ত বিধিনিষেধ, প্রতিকূলতা ও হুমকি উপেক্ষা করে ১৩৭৪ সনের ২২ শ্রাবণ বিভিন্ন প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংস্থা, বিশেষত ছায়ানট, বুলবুল ললিতকলা একাডেমী এবং ঐকতান সমবেতভাবে ইঞ্জিনিয়ার্স। ইনস্টিটিউটে মহাসমারােহে তিন দিনব্যাপী রবীন্দ্র মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপন করে। অনুষ্ঠানের শেষ দিন দ্বিতীয় বা শেষ শােতে ছিল বুলবুল ললিতকলা একাডেমীর নৃত্যনাট্য। ‘শ্যামা’ । প্রথম শােতেও শ্যামা নৃত্যনাট্য যথারীতি পরিবেশিত হয়েছিল। প্রথম প্রদর্শনীর পর খবর আসে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এনএসএফের সশস্ত্র ক্যাডাররা রমনা রেস্তে। রায় অবস্থান নিয়েছে। ‘শ্যামা’র দ্বিতীয় প্রদর্শনী শুরু হলে ওরা ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের মঞ্চ ও গ্রিন রুম আক্রমণ এবং নৃত্যশিল্পীদের অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে। এই সংবাদ পাওয়া মাত্র ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্যের পরিচালক। আতিকুল ইসলাম একটি ভক্সওয়াগন মাইক্রোবাসযােগে মহিলা শিল্পীদের নিয়ে চলে। যান। আর বাফার সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আহমদ হােসেন মঞ্চে এসে ঘােষণা দেন। যে, অনিবার্য কারণবশত ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্যের দ্বিতীয় প্রদর্শনী বাতিল ঘােষণা করতে হচ্ছে। দর্শকরা ব্যর্থ মনােরথ হয়ে হল ত্যাগ করার পরপরই এনএসএফের সশস্ত্র ক্যাডাররা মঞ্চ ও গ্রিন রুম ঘেরাও করে। তাদের সঙ্গে কয়েকটি গাড়ি ছিল নৃত্যশিল্পী। মেয়েদের অপহরণের জন্য। মঞ্চে বা গ্রিন রুমে কাউকে না পেয়ে তারা হলে ভাঙচুর করে বিদায় নেয়। সেদিন একটা মহাবিপর্যয় থেকে এভাবেই রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ও নৃত্যশিল্পীরা অল্পের জন্য রেহাই পেয়েছিলেন।

রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদে পূর্ব বাংলা জুড়ে সাংস্কৃতিক প্রতিরােধ। আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে, ডাকসু এবং সংস্কৃতি সংসদ প্রতিবাদ সভা এবং বিক্ষোভ শােভাযাত্রার আয়ােজন করে। ঢাকা প্রেসক্লাবে বিভিন্ন প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠনের উদ্যোগে বেগম সুফিয়া কামালের সভাপতিত্বে প্রতিবাদ সভায় রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং বাংলা নববর্ষকে পাকিস্তানের বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ ঘােষণা করা হয়। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে বুদ্ধিজীবীরা প্রতিবাদ সভা করেন। কবি জসীমউদ্দীনের কমলাপুর বাসভবনে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সভায় বাঙালি সংস্কৃতি ধ্বংসের ষড়যন্ত্র প্রতিরােধে কমিটি গঠিত হয়। বস্তুত রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধকরণের প্রতিরােধ আন্দোলন বাপক বাঙালি সাংস্কৃতিক আন্দোলনে রূপ নেয়, যা ‘৬৯-এর গণআন্দোলন, ‘৭০-এর মহাপ্রলয়, ‘৭১-এর অসহযোগ আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। | ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের পাঠ্যসূচির ওপরও ষাটের দশকে বিভিন্ন সময়ে আঘাত আসে। ১৯৬৪ সালে বাংলা একাডেমীতে অনুষ্ঠিত নাট্য সপ্তাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘কৃষ্ণকুমারী নাটক ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভ্রান্তি বিলাস (শেক্সপিয়রের কমেডি অফ এররস-এর ‘বাংলা রূপান্তর) মঞ্চস্থ করেছিলেন । মধুসূদন দত্তের কৃষ্ণকুমারী নাটক বাংলা সাহিত্যের প্রথম ট্রাজেডি। ওই নাটকে মহারাজা ভীম সিং তার কন্যা কৃষ্ণকুমারীর হাতে গোলাপ ফুল দেখে বলেছিলেন, এ পুষ্প আগে এদেশে ছিল না, যবনরা এ পুষ্প এদেশে আনয়ন করে। নাটকের সংলাপে ‘যবন’ শব্দটি থাকায় গভর্নর মােনেম খান বাংলা বিভাগের সিলেবাস চেয়ে পাঠান এবং ওই নাটক পাঠ্যসূচি থেকে বাদ দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। বৈষ্ণব কবিতাও পাঠ্যসূচি থেকে বাদ দেয়ার নির্দেশ আসে। তখন ‘মধ্যযুগের গীতি কবিতা’ নামে বৈষ্ণব কবিতা পড়তে হয়। ষাটের দশকে বাংলাভাষা সংস্কারের সরকারি প্রয়াস অব্যাহত থাকে।

১৯৬৮ সালের ৩ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক কাউন্সিলের এক সভায় বাংলাভাষা সংস্কারের জন্য বাংলা একাডেমীর সুপারিশমালা গৃহীত হয়, যদিও একাডেমিক কাউন্সিলের ওই সিদ্ধান্তে প্রফেসর এনামূল হক, প্রফেসর মুহম্মদ আবদুল হাই, প্রফেসর মুনীর চৌধুরী এবং প্রফেসর কবীর চৌধুরী বাংলাভাষা সংস্কার প্রস্তাবের তীব্র বিরােধিতা করেন এবং প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেন। ‘৬৯-এর গণআন্দোলন পর্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের ওইসব অপপ্রয়াস অব্যাহত ছিল। পরে ‘৬৯-এর গণআন্দোলনের জোয়ারে বাংলাভাষা, সাহিত্য, সঙ্গীত তথা বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সব ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত ও প্রয়াস আবর্জনার মত ভেসে যায়। তবে ‘৭১-এর। মুক্তিযুদ্ধের সময় আবার সাংস্কৃতিক রাজাকাররা সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। মুক্তিযুদ্ধে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে তারা ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত নিক্ষিয় ছিলাে। ১৯৭৫ সালের পর সাংস্কৃতিক রাজাকাররা ধীরে ধীরে মৌলবাদীরূপে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৬৭ সাল থেকে পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন সামরিক-আমলা-শিল্পপতি শাসক ও শোষক চক্র বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আগ্রাসন শুরু করে। এই বাঙালি শায়েস্ত । অভিযান পাকিস্তানি ফ্যাসিস্ট চক্র শুরু করেছিল শেখ মুজিবের ৬-দফাভিত্তিক পূর্ববাংলার স্বাধিকার অর্জনের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে। স্মরণ করা। যেতে পারে, শেষ মুজিবের ৬-দফা দাবির উত্তরে পাকিস্তানের স্বৈরশাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ‘অস্ত্রের ভাষায় জবাব দেয়ার কথা বলেছিলেন। সেই অষের ভাষার প্রথম বহিঃপ্রকাশ ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ । সর্বক্ষমতার অধিকারী ডিক্টেটররা যখন তাদের সব বিরােধী শক্তিকে স্টিম রােলার চালিয়ে স্তব্ধ করে দেয়, তখন তারা নিজেরাই নিজেদের পতনের পথ সৃষ্টি করে। যেমন নাৎসি জার্মানির ডিক্টেটর হিটলার দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সমগ্র ইউরােপ জয় করার পর ইংল্যান্ড অভিযান না করে শান্তি চুক্তি থাকা। সত্ত্বেও সােভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের মাধ্যমে নিজের পতনকে সুনিশ্চিত করেছিল । স্বৈরশাসক আইয়ুব খান তার সেবাদাস মােনেম খান বা অপর কোনাে খানের বুদ্ধিতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শুরু এবং তাতে শেখ মুজিবকে জড়িয়ে উনসত্তরের গণআন্দোলন তথা গণঅভূত্থান বা গণবিস্ফোরণের পথ রচনা করে দিয়েছিলেন। আইয়ুব খান নিজের পতনের পথ নিজেই নির্মাণ করেছিলেন। ১৯৬৭ সালের শেষ দিকে পাকিস্তানে আইয়ুব সরকার তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্ত “নের কয়েকজন সামরিক অফিসার ও সিভিল সার্ভেন্টের বিরুদ্ধে এবং পাকিস্তান নৌবাহিনীর অন্যতম উর্ধ্বতন বাঙালি অফিসার লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হােসেনকে প্রধান আসামি হিসেবে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শুরু করে ।

আসামিদের বিরুদ্ধে ভারতের সঙ্গে আগরতলার মাধ্যমে যােগসাজশ, সশস্ত্র বিদ্রোহ ও পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্নতার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ ছিল। মামলা শুরু হওয়ার কয়েকদিন পর অনেক আগে থেকে আটক শেখ মুজিবকে ওই মামলার সঙ্গে জড়িয়ে প্রধান আসামি করা হয়। ১৯৬৬ সালের ৮ মে থেকে শেখ মুজিব আটক ছিলেন। প্রায় ১১ মাস পরে ১৯৬৮ সালের ১৭ জুন রাতে শেখ সাহেবকে ‘ঢাকা জেল থেকে মুক্তিদানের সঙ্গে সঙ্গে জেল গেট থেকে আবার গ্রেপ্তার এবং ‘টাকা সেনানিবাসে বন্দি করা হয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শুনানি শুরু হয় ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন। এই তারিখটিকে একটি লালকালি চিহ্নিত দিবস হিসেবে গণ্য করা যায়। কারণ ওইদিন থেকেই পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ ভাঙন প্রক্রিয়ার শুরু । এই মামলার অন্যান্য আসামি ছিলেন লে. কমান্ডার মােয়াজ্জেম হােসেন ছাড়াও পাকিস্তান সশস্ত্রবাহিনীর কর্পোরাল আমীর হােসেন, এল, এস, সুলতান উদ্দিন আহমদ, কামাল উদ্দিন আহমদ, স্টুয়ার্ট মুজিবুর রহমান, ফ্লাইট সার্জেন্ট মাহফুজুল্লাহ, সার্জেন্ট জহুরুল হক প্রমুখ। আর পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের তিনজন প্রবীণ অফিসার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের সাবেক ছাত্র ‘শামসুর রহমান খান, আহমদ ফজলুর রহমান, রুহুল কুদুস। আগরতলা মামলার শুনানি চলে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। শুনানির বিবরণ ফলাও করে ঢাকার সব দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে আর দেশ ক্রমবর্ধমান ক্ষোভে, ক্রোধে, উত্তেজনায় ফেটে পড়ে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বুমেরাং হয়ে যায় । কিন্তু ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানকে তার সেবাদাস মােনেম খান, সবুর খান, ওয়াহিদুজ্জামান গং বােধহয় বুঝিয়েছিল যে, আগরতলা ষড়যল মামলার শুনানি শুরু এবং তা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হলে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানরা শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ঘৃণা-বিদ্বেষে ফেটে পড়বে আর  আইয়ুব খানের জয়ধ্বনি দেবে। তাদের অনুমান সঠিক ছিল, সত্যি সত্যি পাকিস্তানের বাঙালিরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে, তবে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ও তার সেবাদাসদের বিরুদ্ধে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রামী ছাত্রসমাজের নেতৃত্বে। 

‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রতিক্রিয়ায় আইয়ুব-বিরােধী গণবিক্ষোভে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান উত্তাল হয়ে ওঠে। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয় ১১-দফার ভিত্তিতে। গঠিত ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’। এই পরিষদের ১০জন সদস্য ছিলেন-পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক আবদুর রউফ এবং খালেদ। মােহাম্মদ আলী, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের এক গােষ্ঠীর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সাইফউদ্দিন আহমদ মানিক ও শামসুদ্দোহা, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের অপর গােষ্ঠীর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মােস্তফা জামাল হায়দার ও মাহবুবউল্লাহ। এবং এনএসএফের জুলফিকার আলী ভুট্টোর সমর্থক অংশের মাহবুবুল হক দোলন ও ইব্রাহিম খলিল, ডাকসুর সহ সভাপতি ও ছাত্রলীগ নেতা তােফায়েল আহমেদ এবং ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক ও এনএসএফ (দোলন) নেতা নাজিম কামরান চৌধুরী। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন ডাকসু সহ-সভাপতি তােফায়েল আহমেদ। স্মরণীয় যে, একই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানেও জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বে। আইয়ুব-বিরােধী আন্দোলন চলছিল। ফলে ষাটের দশকে পাকিস্তানের সরকারি দালাল ছাত্র সংগঠন ‘ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন’ বা এনএসএফের মধ্যেও বিভাজন আসে। ষাটের দশকজুড়ে যে এনএসএফ ক্যাডাররা আইয়ুব-মােনেমের দাসত্ব করেছে, তাদের একাংশ জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্রভাবে পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুববিরােধী সংগ্রামে যােগ দেয়। পূর্ব পাকিস্তানে মাহবুবুল হক দোলন, ইব্রাহিম খলিল, নাজিম কামরান চৌধুরী সে কারণেই উনসত্তরের গণআন্দোলনে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে অংশ নিয়েছিল। তবে আয়ুব খানের পতনের পর ‘৭০ ও ‘৭১ সালে এনএসএফ (দোলন) গােষ্ঠীর ভূমিকা ছিল তাদের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর আজ্ঞাবাহকের। সংগ্রামী ছাত্রসমাজের নেতৃত্বে ঐতিহাসিক ১১-দফার ভিত্তিতে এক নজিরবিহীন গণআন্দোলন গড়ে ওঠে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা উঠিয়ে নেয়ার দাবিতে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা ছিল পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরাচার কর্তৃক পূর্ববাংলাকে পশ্চিম পাকিস্তানের স্থায়ী উপনিবেশে পরিণত করার চক্রান্তের বিরুদ্ধে এক মরণপণ সংগ্রাম। যে ঐতিহাসিক ১১-দফার ভিত্তিতে ওই অভূতপূর্ব গণআন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল, তার প্রথম তিনটি দফা ছিল ছাত্রসমাজের দাবি-দাওয়া সংবলিত।

চতুর্থ দফাটি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের। বিভিন্ন প্রদেশ নিয়ে সাব-ফেডারেশন গঠন ও স্বায়ত্তশাসন প্রদান প্রসঙ্গ । পঞ্চমটি ব্যাংক-বীমা-ইন্দুরেন্স ও বৃহৎ শিল্প জাতীয়করণ সংক্রান্ত। ষষ্ঠ ও সপ্তম দফা যথাক্রমে কৃষক ও শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া সংবলিত | অষ্টম, পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নবম, সব ধরনের জরুরি, নিরাপত্তা ও কালাকানুন বাতিল, দশম, সমস্ত পাশ্চাত্য সামরিক জোট ও চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসা আর একাদশ ছিল আন্দোলনে  গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তি ও হুলিয়া প্রত্যাহার সম্পর্কিত। ১১-দফার ১১ নম্বর ধারায় ছিল। ‘আগরতলা মামলাসহ সকল রাজনৈতিক কারণে জারিকৃত মামলা প্রত্যাহার করিতে হইবে।’  ঐতিহাসিক ১১-দফা সম্পর্কে ১৯৬৭-৬৮ সালে ডাকসুর সহ-সভাপতি এবং ১৯৬৯ সালের মহান গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছাত্রলীগ নেতা তােফায়েল আহমেদ লিখেছেন, ১৯৬৮ সালের ২৪ শে ডিসেম্বর আমাকে ভােলা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং এখান থেকে আমি পালিয়ে যেতে সক্ষম হই। ২৬শে ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি এবং ডাকসুর ডিএস ‘নাজিম কামরান চৌধুরী মিলে কালাে পতাকা উত্তোলন করি লাহােরে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে । একই রাতে আমরা মিটিং করি ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া), ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) এবং এনএসএফ (দোলন)-এই চার সংগঠনের নেতৃবৃন্দ মিলে। এরপর ১লা জানুয়ারী ১৯৬৯ আমার সভাপতিত্বে ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয় এবং আমরা ঐতিহাসিক ১১-দফা কর্মসূচী ঘােষণা করি । সে সময়ের জাতীয় আন্দোলন, বিশেষত ‘৬৯-এর গণঅভূত্থানের পুরােভাগে। ‘ডাকসু’ তথা ছাত্রসমাজই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।  (বিচিত্র, ১৩ ডিসেম্বর ১৯৮৫) ঐতিহাসিক ১১-দফার ভিত্তিতে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক ও সাধারণ মানুষের অভূতপূর্ব গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল, এ অঞ্চলের ইতিহাসে তার আগে কখনাে এমনটি হয়নি। বলা যেতে পারে, ‘৬৯-এর মহান গণঅভ্যুথান। ছিল পূর্ববাংলার স্বাধিকার আন্দোলনের চরম পর্যায় এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রকাশ্য সূচনা, যার সফল পরিণতির নেতৃত্বে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রামী ছাত্রসমাজ।

১১-দফার ভিত্তিতে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজের নেতৃত্বে ১৯৬৯ সালের শুরুতে যে গণআন্দোলনের অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়, তা চরম পর্যায়ে পেীছায় ‘৬৯-এর জানুয়ারি মাসের মধ্যেই। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রতিক্রিয়ায় স্বতঃস্ফুর্ত গণআন্দোলন থেকেই এদেশে প্রথম ধ্বনি ওঠে ‘আমার দেশ তােমার দেশ বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’, ‘জাগাে জাগাে বাঙালি জাগাে’। এই আন্দোলনের চরম পর্যায়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার চরম অভিব্যক্তি ঘটে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ধ্বনিত হওয়ার মাধ্যমে। এ সময় ন্যাপ নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মনােভাবেরও পরিবর্তন ঘটে। ষাটের দশকে আইয়ুব খানের চীনপন্থী পররাষ্ট্রনীতির কারণে পিকিংপন্থী বামপন্থী রাজনীতিকরা আইয়ুব খানের প্রতি নমনীয় এবং শেখ। মুজিবের ৬-দফার বিরােধী ছিলেন। ফলে চীনপন্থী বামপন্থী রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা জেল থেকে ছাড়া পান। যাদের বিরুদ্ধে হুলিয়া ছিলাে সেগুলাে তুলে নেয়া হয় । কিন্তু ‘৬৯-এর গণআন্দোলনের ফলে পূর্ব বাংলার বামপন্থী রাজনীতিতেও পরিবর্তন আসে। স্মরণীয় যে, পিকিংপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন), মস্কোপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) উভয় গােষ্ঠীই ১১-দফার ভিত্তিতে গঠিত সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্তর্ভুক্ত এবং আইয়ুব-বিরােধী সংগ্রামের নেতৃত্বে সক্রিয় ছিল। ‘৬৯-এর গণআন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী ১৯৬৮ সালের ৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সংঘটিত হয়। ১৯৬৮ সালের ৬ ডিসেম্বর পল্টন ময়দানে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর এক বিরাট জনসভায় জনতা শপথ গ্রহণ করে, ‘জেলের তালা ভাঙবাে শেখ মুজিবকে আনবাে’ । তারপর মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে জঙ্গি জনতা প্রথমে লাটভবন ঘেরাও করে এবং পরে ক্যান্টনমেন্ট প্রবেশ পথ পর্যন্ত শােভাযাত্রা সহকারে গিয়ে ‘আগরতলা মামলা তুলে নেয়ার দাবি জানায়। পূর্ব বাংলায় ঘেরাও আন্দোলনের শুরু এ সময় থেকেই। ১৯৬৮ সালের ৭ ডিসেম্বর ঢাকায় এক সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। পুলিশ, ইপিআর, মিলিটারির গুলি সেদিন জনতাকে থামাতে পারেনি। সেই হরতালে অনেকে হতাহত হয়েছিলেন। পরের দিন সামরিক নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তার অনুগামীদের নিয়ে বায়তুল মােকাররম প্রাঙ্গণে আগের দিন। হরতালে নিহতদের গায়েবি জানাজা পড়েছিলেন।

১৯৬৯ সালের ১৯ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন দুঃসাহসী ছাত্র সামরিক বাহিনীর কলাভবন ঘেরাও এবং সমাবেশ ও মিছিলের ওপর জারিকৃত নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করে আমতলায় জমায়েত শেষে শােভাযাত্রা বের করে। সেদিন উপাচার্য ভবনের সামনে মােতায়েন সামরিক বাহিনী। তাদের ওপর হিংস্র জন্তুর মতাে ঝাপিয়ে পড়ে। সেই সাহসী তরুণ ছাত্রদের প্রত্যেকেই সেদিন গুরুতরভাবে আহত অবস্থায় বন্দি হয়েছিল। ২০ জানুয়ারি হাজার হাজার ছাত্র-যুবক আবার সমবেত হয় কলাভবনের সামনে। তারপর আবার শােভাযাত্রা। এদিন কিন্তু ঘটনা একতরফা ছিল না, হাজার হাজার নিরস্ত্র ছাত্র-যুবক সাহসের সঙ্গে। লড়েছিল শত শত সশস্ত্র পুলিশ, ইপিআর আর সেনাবাহিনীর সদস্যের সঙ্গে। সশস্ত্রবাহিনী সেদিন পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল। অকেজো হয়ে গিয়েছিল গভর্নর মোনেম খানের আমদানিকৃত লাল গরম পানি ছিটানাের গাড়িটি। সেটি দখল করে নেয় ছাত্রজনতা। সব বাধা অতিক্রম করে বিরাট বিক্ষোভ শােভাযাত্রা কলাভবন থেকে রমনার রাজপথে বেরিয়ে গিয়েছিল। শহীদ মিনার হয়ে মিছিলটি মেডিক্যাল কলেজের সামনের রাজপথে পৌছলে অন্যতম নেতৃত্বদানকারী বামপন্থী ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামানকে। ঠাণ্ডা মাথায় অত্যন্ত কাছ থেকে গুলি করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এটা ছিল আন্দোলন দমনের জন্য টার্গেট করা হত্যাকাণ্ড। ওই নির্মম হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণ রণাঙ্গণে পরিণত হয়। শহীদ আসাদের লাশ পাওয়ার জন্য ‘আসাদের রক্তাক্ত শার্ট নিয়ে উন্মত্ত ছাত্র-জনতা পুলিশ-ইপিআরের সঙ্গে হাতাহাতি লড়াই করেছিল। ২৪ জানুয়ারি প্রতিবাদ দিবস ঘােষণা করা হয়; কিন্তু দিবসটি পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থান দিবসে। দেশব্যাপী হরতাল, বিক্ষোভ আর জঙ্গি মিছিল, ‘জনতার। ওপর নিরাপত্তা বাহিনীর বারবার গুলিবর্ষণের ফলে ঢাকাতেই সেদিন অন্তত ৬জন ছাত্র-জনতা নিহত হয়। সচিবালয়ের এক নম্বর গেটের সামনে বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর গুলিবর্ষণে শহীদ হন শেখ রুস্তম আলী, মকবুল আর নবকুমার স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র মতিউর রহমান। বিক্ষুব্ধ জনতা শহীদ মতিউরের লাশ নিয়ে ঢাকায় বিশাল বিক্ষোভ ও শােক শােভাযাত্রা বের করে। সেদিনই বিক্ষুব্ধ জনতার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সরকারি ট্রাস্ট পত্রিকা দৈনিক পাকিস্তান ও মর্নিং নিউজ অফিস। আৱাে পুড়ে যায়। আগরতলা মামলার প্রধান বিচারপতির অস্থায়ী আবাস সরকারি অতিথি ভবন (বাংলা একাডেমীর পাশে অবস্থিত)। এছাড়া পরীবাগে অবস্থিত ঢাকার নবাব হাসান আসকারী এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধকারী কেন্দ্রীয় মন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দীনের বাসভবন। জনতা রেডিও পাকিস্তান আর পাকিস্তান টেলিভিশন কেন্দ্রেও হানা দিয়েছিল। মােহাম্মদপুরে প্রবেশ পথের দেউড়ি ‘আইয়ুব গেট’ এর নাম জনতা বদলে দেয় ‘আসাদ গেট’। জনতার রুদ্ররােষ যতােই তেতে উঠছিল, ষড়যন্ত্রকারীর চক্রান্তও ততাে গভীর হচ্ছিল। এ সময় আগরতলা মামলার বিচারাধীন বন্দিদের হত্যার ষড়যন্ত্র চলে। ১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সকালে সার্জেন্ট জহুরুল হককে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বন্দিশালায় নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় । এই বীর সৈনিক নিজের জীবন দিয়ে আসন্ন ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালি সৈনিকদের কর্তব্যকর্মের দিকনির্দেশনা দিয়ে যান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা কবি আল্লামা ইকবালের (যার পাকিস্তান পরিকল্পনায় বাংলাদেশ ছিল না, ছিল পাঞ্জাব, সিন্ধু, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ আর বেলুচিস্তান) নামে প্রতিষ্ঠিত ছাত্রাবাস ‘ইকবাল হলে’ব নাম পরিবর্তন করে “জহুরুল হক হল’ নামকরণ করে। এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। এদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর টাকা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র ও বায়ান্নোর অকুতোভয় ভাষাসৈনিক ডক্টর শামসুজ্জোহা কর্তব্যরত অবস্থায় পাকিস্তান বাহিনীর বুলেট আর বেয়নেটবিদ্ধ হয়ে পৈশাচিকভাবে নিহত হন। এই মর্মান্তিক সংবাদ বেতার ও টেলিভিশনের রাতের ‘বুলেটিনে প্রচারিত হওয়া মাত্র ১৮ ফেব্রুয়ারি রাতে কারফিউ ও মােতায়েনকৃত সশস্ত্রবাহিনীর প্রহরার মধ্যেও প্রবল গণজাগরণ পরিণত হয় গণবিস্ফোরণে। আসাদুজ্জামানের হত্যাকাণ্ডে যে আগুন জ্বলে উঠেছিল, সার্জেন্ট জহুরুল হকের হত্যায় সে আগুন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে, ‘ড, শামসুজ্জোহার হত্যায় তা দাবানলে পরিণত হয়। দেশের মানুষ কোনাে অবস্থাতেই একজন বিজ্ঞানী ও বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকের হত্যাকাণ্ডকে মেনে নিতে পারেনি। ফলে দিকে দিকে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। ক্ষুব্ধ উত্তেজিত জনতা ১৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় কারফিউ ভঙ্গ করে সারা রাত পাগলের মতাে পাকিস্তান সশস্ত্রবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করে। বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের চরম পর্যায়ে এভাবেই পাকিস্তানি সশস্ত্রবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হয় বাংলার সাধারণ মানুষ। কিন্তু তখন পর্যন্ত বাঙালি নিরস্ত্র। ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে রক্তের স্রোত বয়ে যায়। ড, শামসুজ্জোহার শাহাদাত উনসত্তুরের গণআন্দোলনকে  চরম পর্যায়ে উন্নীত এবং মহান পণঅভ্যুত্থানে পরিণত করেছিলাে। যার ফলে শুধু আগরতলা মামলাই বন্ধ হয়ে যায়নি, পাকিস্তানের স্বৈরশাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানেরও পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে। শেখ মুজিবুর রহমান এবং আগরতলা মামলার সব আসামি মুক্তি পান ২২ ফেব্রুয়ারি। ১৯৬৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রক্তাক্ত শহীদ দিবস পালিত হয় ‘৬৯-এর মহান গণআন্দোলনের বিজয় দিবস রূপে। ২৩ ফেব্রুয়ারি রমনার জনসমুদ্রে বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে ডাকসুর ভিপি তােফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবুর বহমানকে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্মান বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। শেখ মুজিবের বঙ্গবন্ধু’ শিরােপা “৬৯-এর মহান গণআন্দোলনের ফসল, এটা কোনাে দিলীয় পুরস্কার বা সম্মাননা নয়। উনসত্তরের গণআন্দোলন হয়েছিল ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রতিক্রিয়ায়। ওই মামলার শুনানির সময় সারা দেশের স্লোগান ও দেয়াল লিখন ছিল ‘জেলের তালা ভাঙবাে শেখ মুজিবকে আনবাে।’ জনতা ওই সংকল্প অপরিমেয় রক্তের বিনিময়ে বাস্তবায়ন করেছিল, পতন ঘটেছিল আয়ুব-মােনেম স্বৈরশাহীর । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন ভাইস চ্যান্সেলর নিযুক্ত হয়েছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী।

১৯৬৪ সালে গভর্নর-চ্যান্সেলর আবদুল মোনেম খানের কনভােকেশন ভণ্ডুল হয়ে যাওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর বার্ষিক সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়নি। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ১৯৭০ সালে দুটি সমাবর্তন উৎসবের আয়ােজন করেন। ১৯৭০ সালের প্রথম সমাবর্তনে চ্যান্সেলরের ভাষণ দেন ভাইস অ্যাডমিরাল এস, এম. আহসান, সমাবর্তন অতিথির ভাষণ দেন ড. মাহমুদ হােসেন আর ভাইস চ্যান্সেলরের ভাষণ দেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী । দ্বিতীয় সমাবর্তনেও চ্যান্সেলর ছিলেন অ্যাডমিরাল আহসান, সমাবর্তন অতিথি ড. মুহাম্মদ কুদরত-ই-খুদা, ভাইস চ্যান্সেলর বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হওয়ার পর ১৯২৩ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত নিয়মিত বা বিশেষ সমাবর্তন উৎসবে ভাষণ দেয়া হয়েছে ইংরেজি ভাষায়। ১৯৭০ সালের দুটি সমাবর্তনেই ভাইস চ্যান্সেলর বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এবং সমাবর্তন অতিথি ড. কুদরত-ই-খুদা প্রথম তাদের ভাষণ বাংলা ভাষায় দিয়ে নতুন ঐতিহ্য স্থাপন করেন। বলা বাহুল্য, এটা সম্ভব হয়েছিল ‘৬৯-এর মহান গণআন্দোলন ও তার বিজয়ের ফলেই । লাংলাদেশের ইতিহাসে বাঙালি বিজয়ের আনন্দে ভেসেছিল প্রথম ‘৫২-এর ভাষা আন্দোলন-পরবর্তী ৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়েঃ তারপর দ্বিতীয়বার উনসত্তরের গণআন্দোলন-পরবর্তী ‘৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ের পরবর্তী সময়ে, যদিও দুটির একটি সময়ও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে নিরংকুশ বিজয়ের পরেও ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে সেই অবিসংবাদিত রায় পদদলিত হওয়ার পর অভূতপূর্ব অসহযােগ আন্দোলনে বাঙালিকে অপরিমেয় রক্ত প্রদান করতে হয়েছিল।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৪৮-১৯৭১ সালের ইতিহাস ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন, উনসত্তরের গণ আন্দোলন, সত্তরের সাধারণ নির্বাচন ও  মহাপ্রলয়ে গণতন্ত্র ও মানবতার সেবায় ঝাপিয়ে পড়া আর একাত্তরে অসহযােগ আন্দোলন ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ও প্রাক্তন ছাত্রশিক্ষকদের নেতৃত্ব প্রদানের ইতিহাস। ঐ সব ঐতিহাসিক সংগ্রামের প্রতিটিতে বাঙালি জয়ী হয়েছিল যে জয়যাত্রার সংগ্রামে ভ্যানগার্ড বা অগ্রসৈনিক ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহসী ছাত্রছাত্রী আর শিক্ষকবৃন্দ। উনসত্তরের গণ আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের অসহযোগ ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ একই সূত্রে গাঁথা, যে রক্তাক্ত মালার মালাকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সূত্র : স্বাধীনতা সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় – রফিকুল ইসলাম

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!