বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের সূদুরপ্রসারী প্রভাব
৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সূদুরপ্রসারী প্রভাব পড়েছিল আমাদের জাতীয় জীবনে। বস্তুত ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশবিভাগের পর আশ্চর্যজনকভাবে বাংলা ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল। অবিভক্ত বাংলায় উনিশ শতকে তথাকথিত বাংলার নবজাগরণ বা রেনেসার মাধ্যমে যে জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ঘটেছিল, তা ছিল বাঙালি হিন্দু জাতীয়তাবাদ, যার চরম বিকাশ দেখা দেয় বিশ শতকের প্রথম দশকে ‘বন্দেমাতরম’ মন্ত্রে উদ্দীপিত প্রথম বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকেন্দ্রিক স্বদেশী আন্দোলনে। বলা বাহুল্য, ওই জাতীয়তাবাদী। জাগরণে বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সম্প্রদায়ের ভূমিকা বা অংশগ্রহণ ছিল খুবই সীমিত। রেনেসাঁ বা নবজাগরণের প্রাথমিক শর্ত ‘ইহলৌকিকতা’ অথচ কলকাতাকেন্দ্রিক উনিশ শতকের নবজাগরণের প্রধান শর্ত ছিল ‘পারলৌকিকতা’। রাজা রামমােহন রায়, স্বামী বিবেকানন্দ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। সবাই অধ্যাত্মবাদী ছিলেন। ব্যতিক্রম শুধু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ডিরােজিও এবং মাইকেল মধুসূদন দত্ত । কিন্তু উনিশ শতকের বাঙালি হিন্দু সমাজের মূলধারার অন্তর্গত। তারা ছিলেন না। তারা ছিলেন ‘ডিসিডেন্ট’ বা ‘ভিন্নমতাবলম্বী’ । তুলনায় বিশ শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ঢাকার বাংলা ভাষা আন্দোলনভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদী। চেতনা ছিল ধর্মনিরপেক্ষ এবং গণতান্ত্রিক। একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষাভিত্তিক চেতনা ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, শ্রেণী, পেশা, সম্প্রদায় নির্বিশেষে এক আধুনিক জাতীয়তাবাদী চেতনা, যার পরিণতি একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের উদ্ভব । দুর্ভাগ্যবশত ‘৭৫-এর নৃশংস রক্তাক্ত প্রতিবিপ্লবের ফলে এবং আন্তর্জাতিক মৌলবাদের উত্থানের কারণে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ অবরুদ্ধ। বিশ শতকের শেষ সিকি শতাব্দী বিশ্বব্যাপী প্রগতিশীল আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে প্রতিক্রিয়াশীল। উগ্র সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তির অভ্যুথানে শান্তি, সভ্যতা ও প্রগতির যাত্রাপথ। আজ বিভ্রান্ত এবং দিশেহারা। সমাজতান্ত্রিক সােভিয়েত ইউনিয়নের অবলুপ্তিতে বিশ্বে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়, পাশ্চাত্য পরাশক্তির দাপটে আজ সেই শূন্যস্থানে ঠেলে দেয়। হচ্ছে ইসলাম ধর্মাবলম্বী মুসলমান সম্প্রদায়কে । রবীন্দ্রনাথের ‘শ্যামা নৃত্যনাট্যে। কোটালের একটি সংলাপ, চুরি হয়ে গেছে রাজকোষে, চোর চাই যে করেই হােক, চোর চাই। হােক না সে যে কোনাে লােক, চোর চাই। নইলে মােদের যাবে প্রাণ।
আজ শত্ৰু চাই । তাই সম্ভবত আজ ক্রুসেড’-এর শিকার দেশ, জাতি, বর্ণ নির্বিশেষে বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায়, এর পরিণতি কারাে অজানা নেই। তবে বর্তমানে আমরা বাংলাদেশে এর চরম শিকার। ওই প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন দেশে মুসলমান সম্প্রদায়ের একাংশ উগ্র ইসলামি মৌলবাদীদের খপ্পরে পড়ছে। যেসব মৌলবাদী দল বা গােষ্ঠীকে একসময় পাশ্চাত্যে শক্তি সৃষ্টি করেছিল কমিউনিস্ট ঠেকানাের জন্য, এখন সেগুলােই ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হয়ে উঠেছে। এই সুযােগে ইঙ্গ মার্কিন পরাশক্তি আফগানিস্তান ও ইরাক দখল, প্রাচীন সভ্যতা ধ্বংস আর সম্পদ লুণ্ঠন করছে। বিশ্বায়ন, মুক্তবাজার অর্থনীতি আর মৌলবাদ একুশ শতকে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদের সবচেয়ে বড় ‘৫২ সালে মাতৃভাষার জন্য বাঙালির রক্তদান এবং তার প্রতীক শহীদ মিনার যে বিস্মৃত জাতিসত্তার প্রতীক হয়ে উঠেছিল, তার পেছনে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিল সাংস্কৃতিক জাগরণ, যার প্রথম স্ফুরণ ঘটেছিল কুমিল্লায় অনুষ্ঠিত ১৯৫২ সালের ২২২৪ আগস্ট সংস্কৃতি সম্মেলনে। যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল দেশবিভাগের পরপর। প্রসঙ্গক্রমে ১৯৪৮ সালে পূর্ববাংলা মুসলিম লীগ সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাবীবুল্লাহ বাহারের (১৯০৬-৬৬) উদ্যোগে ৩১ ডিসেম্বর থেকে দুদিনব্যাপী অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনের মূল সভাপতির ভাষণে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর (১৮৮৫১৯৬৯) দুঃসাহসী উক্তির মাধ্যমে, আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোনাে আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব সত্য। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছে যে, মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙি-দাড়িতে ঢাকবার জো-টি নেই। (সাঈদ-উর-রহমান, পূর্ববাংলার সাংস্কৃতিক আন্দোলন, পৃ. ১৮) ১৯৫১ সালের ১৬ মার্চ চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান সাংস্কৃতিক সম্মেলনে মূল সভাপতি মনীষী আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ (১৮৭১-১৯৫৩) তার ভাষণে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ঐতিহ্যের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে বলেছিলেন, ঐতিহ্য সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একটি ধ্রুব নক্ষত্রবিশেষ। ঐতিহ্যের অনুসরণও সেই স্রোত ধারাকে চির বহমান করিয়া তােলাই সংস্কৃতিসেবীদের কাজ।…
ঐতিহ্যের পটভূমির সহিত যাহাদের যােগ নাই, তরুলতার ক্ষেত্রে যেমন পরভােজী শব্দ ব্যবহার করা হয়-এখানে ঐ জাতীয় ব্যক্তিদের জন্য তেমনি বিশেষণ আরােপ করা চলে। (সাঈদ-উর-রহমান, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৬) ১৯৫২ সালের ২২ থেকে ২৪ আগস্ট কুমিল্লায় ‘৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারির ঠিক ছয় মাস পরে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান সাংস্কৃতিক সম্মেলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপক এবং সংস্কৃতি সংসদ যােগদান করে। এই সম্মেলনেও সভাপতি ছিলেন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। তিনি সভাপতির ভাষণে বলেন, আজ বােধহয় তাহারা দেশকে পাপে ডুবাইতে চাহেন, যাহারা প্রশ্ন তুলিয়াছেন বাংলা ভাষা আমাদের সংস্কৃতির বাহন হইতে পারে না ।…সংস্কৃতি ধ্বংসের অনেক পথ আছে। জনসাধারণবিরােধী ও সমাজ-বিরােধী গোয়ারনীতি তার অন্যতম উপায় বটে। কিন্তু তার পরিণাম ফল পারস্যে আরবদের ভাগ্যের মতই হইতে হইবে। (সাঈদ-উর-রহমান, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৮) বলা হয়ে থাকে, আরবরা পারস্য জয় করেছিল রাজনৈতিকভাবে আর পারস্য আরব জয় করেছিল সাংস্কৃতিকভাবে। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে তা ঘটেছিল বলা চলে না, কারণ পশ্চিম পাকিস্তান চেয়েছিল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক-সবদিক থেকে পূর্ববাংলাকে পদানত করতে। তাই পাকিস্তান সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই সংঘাত বেধে গিয়েছিল। উর্দু তাে কোনাে পাকিস্তানি ভাষা ছিল না, পাকিস্তানের ভাষা ছিল বাংলা, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, পশতু, বালুচ। উর্দু ছিল ভারতের উত্তর প্রদেশের ভাষা, পরে হয় পাকিস্তানের মােহাজেরদের ভাষা; অবিভক্ত ভারতে বাংলাভাষী মুসলমানরা ছিলেন অন্যান্য ভাষাভাষীদের চাইতে সংখ্যায় অনেক বেশি, পাকিস্তানেও তা-ই। কিন্তু যেভাবে গুজরাটের কাথিওয়ারে জন্মগ্রহণ করা গভর্নর জেনারেল মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ, উত্তর প্রদেশের নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান বা ঢাকা নবাববাড়ির উর্দুভাষী খাজা নাজিমউদ্দিন উর্দুকে ভারতীয় ১০ কোটি মুসলমানের মাতৃভাষা আর ইসলাম ধর্মের ধারক-বাহকরূপে বর্ণনা করে বাংলা ভাষাকে ধ্বংসের চেষ্টা করছিলেন, তার প্রতিক্রিয়ায় যা ঘটেছিল তা খুবই স্বাভাবিক।
অন্যথায় ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বা আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের মত ধর্মভীরু মুসলমান তাদের মাতৃভাষা বাংলা তথা বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য তথা অস্তিত্ব রক্ষার জন্য জেহাদ করতেন না। সাধে কী ১৯৫৪ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট বহুদিনের গােলামির পর যখন আমাদের আজাদীর সুপ্রভাত হলো, তখন প্রাণে আশা জেগেছিল যে, এখন স্বাধীনতার মুক্ত বাতাসে বাংলা সাহিত্য তার সমৃদ্ধির পথ খুঁজে পাবে। ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় যে সাহিত্য সম্মিলনীর অধিবেশন হয়েছিল, তাতে বহু আশাতেই বুক বেঁধে আমি অভিভাষণ দিয়েছিলুম । কিন্তু তারপর যে প্রতিক্রিয়া হয় তাতে হাড়ে হাড়ে বুঝেছিলুম, স্বাধীনতার নূতন নেশা আমাদের মতিচ্ছন্ন করে দিয়েছে । ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র এবং অন্যান্য পশ্চিমবঙ্গের কবি ও সাহিত্যিকগণের কাব্য ও গ্রন্থ আলােচনা, এমনকি বাঙালি নামটি পর্যন্ত যেনাে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে কেউ কেউ মনে করতে লাগলেন।…তারই পাকিস্তান ধ্বংস করবে। (সাঈদ-উর-রহমান, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩২) বস্তুত ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ছিল আমাদের জাতীয় জীবনে মােড় ফেরার দিন। তারপর ১৯৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস’ পালনের যেসব কর্মসূচি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা ও ইডেন কলেজ থেকে গ্রহণ করা হয়, তার মধ্য দিয়ে এক নতুন বাঙালি জাতীয়তাবাদের অভিযাত্রা শুরু হয়। যার মধ্যে ছিল সকালে কালাে পতাকা উত্তোলন, কালাে ব্যাজ ধারণ, নগ্নপদে প্রভাতফেরি, কণ্ঠে গান। ‘ভুলবাে না ভুলবাে না একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলবাে না’, আজিমপুরে ভাষা শহীদদের কবরে এবং মেডিক্যাল কলেজ হােস্টেল প্রাঙ্গণে ধ্বংস করা শহীদ মিনারের স্থানে কালাে কাপড়ঘেরা প্রতীকী শহীদ মিনারে পুষ্প অর্পণ । ১৯৫৩ সালের শহীদ দিবসে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল পুরনাে রেলওয়ে স্টেশনের পেছনে অবস্থিত সিদ্দিক বাজারে ঢাকা কলেজ প্রাঙ্গণে ঢাকা কলেজের ছাত্র আতিকুল ইসলাম (প্রয়াত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী) এবং ইডেন কলেজের বিজ্ঞানের ছাত্রী হালিমা খাতুন (প্রয়াত)এর নেতৃত্বে ঢাকা।
কলেজের ছাত্র ও ইডেন কলেজের ছাত্রীদের ‘শহীদ মিনার নির্মাণ। ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর শামসুজ্জামান চৌধুরী, ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ মিসেস ফজিলতুন্নেসা জোহা এবং ঢাকা কলেজের উর্দুর অধ্যাপক কবি আহসান আহমেদ আশকের নেতৃত্বে পুলিশ বাহিনী অবশ্য নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গেই শহীদ মিনারটি গুড়িয়ে দিয়েছিল। সেদিন সন্ধ্যায় আবার ঢাকা কলেজের ছাত্ররা পল্টনে তদানীন্তন ব্রিটানিয়া সিনেমা হল মিলনায়তনে শহীদ দিবস উপলক্ষে আয়ােজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আতিকুল ইসলামের নেতৃত্বে আবদুল লতিফের সুর ও পরিচালনায় ঢাকা কলেজের তদানীন্তন ছাত্র আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানাে একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ গানটি প্রথম পরিবেশন করে। ওইসব অপরাধে আতিকুল ইসলাম, আবদুল গাফফার চৌধুরী, ইকবাল আনসারী খান, এনাম আহমদ চৌধুরী প্রমুখ বেশ কয়েকজন ছাত্র ঢাকা কলেজ থেকে বহিস্কৃত হয়েছিলেন। ১৯৫৩ সালের শহীদ দিবসের অপর ঐতিহাসিক ঘটনা-ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজবন্দি ঢাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী রচিত ‘কবর’ নাটক রাজবন্দিদের দ্বারা অভিনীত হওয়া। এছাড়াও ১৯৫৩ সালের শহীদ দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় একুশের প্রথম সঙ্কলন একুশে ফেব্রুয়ারি। একুশে ফেব্রুয়ারি’ সংকলনটির মাধ্যমেই বাংলাদেশের সাহিত্যের যাত্রা শুরু । সাতচল্লিশ সালে দেশ বিভাগের আগে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও বাঙালী সংস্কৃতিচর্চার মূল কেন্দ্র ছিল কলকাতা, ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ঢাকায় বাংলা ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার দ্বিতীয় কেন্দ্র স্থাপিত হলেও ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারির পূর্ব পর্যন্ত যা ছিল কলকাতা কেন্দ্রিক সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার সম্প্রসারণ । ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় নতুন সংস্কৃতি চর্চার সূত্রপাত হয়। ওইসব ঐতিহাসিক কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে ১৯৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি প্রথম শহীদ দিবস থেকেই একুশে ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক রূপ পায়-যা ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশের সূচনাপর্ব ।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির মধ্যে যেসব ঘটনা ঘটে, তার ফলে পাকিস্তানের বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মন-মানসিকতা ও চেতনার মধ্যে এক গুণগত পরিবর্তন আসে। বদরুদ্দিন উমর যেটাকে বলেছেন বাঙালি মুসলমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’ । এতদিন বাংলার মুসলমান বাংলাদেশের কুটিরে থেকে দূর আরবের স্বপ্ন দেখেছে, ইরান তুরানের খােয়াবে বিহ্বল হয়ে রয়েছে। দিল্লি, আগ্রা, লাহােরের গল্পে বিভাের থেকেছে। বাঙালি মুসলমান বিশ শতকেও তর্ক করেছে তার মাতৃভাষা উর্দু না বাংলা, বিতর্ক চালিয়েছে যুগ যুগ ধরে তাদের পূর্বপুরুষ আরব, তুরস্ক, পারস্য থেকে এসেছে না বাংলারই আদি বাসিন্দা। অমর একুশে বাঙালি মুসলমানকে তার বিস্মৃত জাতিসত্তা, মাতৃভাষা, মাতৃভূমি, স্বদেশ ফিরিয়ে দিয়েছে। এ সবকিছুর জন্য তাকে আনন্দ, বেদনা, গৌরব ও অহঙ্কার দিয়েছে, আর দিয়েছে শৃঙ্খল মােচনের দুর্দমনীয় আকাক্সক্ষা। এই চেতনাগত রূপান্তরের প্রথম প্রতিফলন ১৯৫৩ সালে নতুন গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ডাকসু ও বিভিন্ন হল ইউনিয়নের নির্বাচনে গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্ট গঠনের তাগিদ। ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের পর গঠিত ‘ছাত্রলীগ’ এবং ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর গঠিত ছাত্র ইউনিয়নের গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্ট গঠন, ১৯৫৪ সালের পূর্ববাংলার সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এবং কৃষক শ্রমিক পার্টির যুক্তফ্রন্ট গঠনের পথপ্রদর্শক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়ন বা ডাকসু এবং হল ইউনিয়ন গঠন ও নির্বাচনের ইতিহাস সম্পর্কে সৈয়দ রেজাউর রহমান গৌরবােজ্জ্বল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (মউর, ঢাকা, জুন ২০০১) গ্রন্থে যে তথ্য দিয়েছেন, তা থেকে জানা যায়, ১৯২২-২৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে ছাত্র সংসদ কার্যক্রম শুরু হয়। তখনকার তিনটি হলের প্রতিটি থেকে একজন শিক্ষক ও তিনজন ছাত্র এবং ভিসি কর্তৃক নির্বাচিত একজন শিক্ষক নিয়ে এই ছাত্র সংসদ নিয়ন্ত্রিত হত ।
১৯২৪-২৫ সালে প্রফেসর ডব্লিউ এ জেনকিন্স ইউনিয়ন কমিটির প্রেসিডেন্ট এবং খগেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত সেক্রেটারি ছিলেন।…১৯২৫ সালের ৩০ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)-এর নতুন গঠনতন্ত্রে সভাপতি, সহ-সভাপতি ও সম্পাদকের পদ সৃষ্টি করা হয়। সে অনুসারে ১৯২৫-২৬ শিক্ষাবর্ষে প্রথম সভাপতি ছিলেন ড. আর.সি মজুমদার। মমতাজউদ্দিন আহমেদ ও এ.কে. মুখার্জি ছিলেন সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। …১৯৩৯ সাল পর্যন্ত ডাকসু সংগঠনের এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে। ১৯৩৯ সালের মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা কর্তৃপক্ষের প্রভাবমুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের দাবিতে তিনটি হলে অনশন করে । পরিস্থিতি উপলব্ধি করে তৎকালীন উপাচার্য ড, আর, সি, মজুমদার ছাত্রদের দাবি মেনে নেন। এ সময় ছাত্র প্রতিনিধিরা নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করেন। সে মােতাবেক প্রথম সভাপতির মনােনয়ন পান নেপালচন্দ্র রায় । কিন্তু অল্প কয়েকদিনের মধ্যে সেই নতুন গঠনতন্ত্র অকার্যকর হয়ে পড়ে। অবশেষে ভিসি শিক্ষক-প্রতিনিধি ও ছাত্র-প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি খসড়া গঠনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য বাের্ড গঠন করে দেন। বাের্ড ১৯৪৪ সালে গঠনতন্ত্র প্রায় চূড়ান্ত করে আনে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছাত্রশিক্ষকদের মতদ্বৈধতায় এ বাের্ডের কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। ১৯৫৩ সালের জুলাই মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী পরিষদ ছাত্র সংসদের গঠনতন্ত্র পুনঃপ্রণয়নের জন্য একটি কমিটি গঠন করে দেয়। কমিটি কর্তৃক নতুন নাম দেয়া হয় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) এবং ভাইস চ্যান্সেলরকে সভাপতি রেখে ১৬ জন ছাত্র-প্রতিনিধির মধ্য থেকে ১০ জন কর্মকর্তা নির্বাচনের ব্যবস্থা রাখা হয়। এতে কোষাধ্যক্ষ রাখার নিয়ম চালু করা হয়। বিভিন্ন হল থেকে ছাত্রপ্রতিনিধিদের পরােক্ষ ভােটে ছাত্রদের মধ্য থেকে সহ-সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, সাহিত্য সম্পাদক, প্রকাশনা সম্পাদক, সমাজসেবা সম্পাদক ও কমনরুম সম্পাদকের তিনটি পদে নির্বাচনের ব্যবস্থা গৃহীত হয়।
১৯৫৩-৫৪ বর্ষের নির্বাচিতদের হাতে প্রথম ডাকসুর দায়িত্ব দেয়া হয় ‘৫৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি। ডাকসুর প্রথম ভিপি ছিলেন এস. এ. বারী এটি এবং জিএস ছিলেন জুলমত আলী খান এবং শেষ ভিপি ছিলেন তােফায়েল আহমেদ এবং জিএস ছিলেন নাজিম কামরান চৌধুরী। ১৯৭০ সালে দেশের সার্বিক অবস্থা এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে গঠনতন্ত্রে আবার সংশােধনী আনা হয়। পদ ও প্রতিনিধির সংখ্যা বাড়িয়ে ছাত্রছাত্রীদের সরাসরি ভােটে কর্মকর্তা নির্বাচনের বিধান রাখা হয়। ‘৭০ সালের নির্বাচনে ভিপি হিসেবে আ, স, ম, আবদুর রব এবং জিএস পদে আবদুল কুদুস মাখন নির্বাচিত হন। এর পরপরই ডাকসুতে রাজনৈতিক প্রচারণার অনুপ্রবেশ ঘটে। রাজনৈতিক আদর্শ প্যানেলভুক্ত ছাত্রনেতাদের প্রভাবিত করে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে প্রথম নির্বাচন হয়। নির্বাচনে ভিপি ছিলেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও জিএস ছিলেন মাহবুব জামান। এ বছর সম্পাদকীয় পদ ৯ থেকে ১০-এ উন্নীত হয়। ১৯৭৩ সালে ডাকসু নির্বাচন ‘৭৮ সাল পর্যন্ত বন্ধ ছিল। এরপর ১৯৭৯ সালের ২৪ জুলাই নির্বাচন হয়। আবার পরের বছরগুলােতে নিয়মিত নির্বাচন হয়। ১৯৮২ সালের ২৩ জানুয়ারি নির্বাচন হয় কিন্তু সামরিক শাসন জারি হয় এবং ডাকসু বাতিল করে দেয়া হয়। তখন দীর্ঘদিন নির্বাচন বন্ধ থাকে। ১৯৮৯ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি আবার নির্বাচন হয়। তখন সম্পাদকীয় পদ ১০ থেকে ১১-তে উন্নীত করা হয় । তার পরের বছর ‘৯০ সালের ৬জুন সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ডাকসুর ওই ইতিহাস থেকে বােঝা যায়, স্বাধীনতার আগের ও পরের ‘ডাকসু’র। গঠন ও ভূমিকার পরিবর্তন। ১৯৫৩-৫৪ সালের ডাকসু ভিপি এস,এ, বারী এটি ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের আর জি, এস, জুলমত আলী খান ছাত্রলীগের, গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্টের ব্যানারে। ওই নির্বাচন জাতীয় রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছিল। ২১ ফেব্রুয়ারির প্রতীক ২১-দফার ভিত্তিতে হক-ভাসানী-সােহরাওয়ার্দী যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয় এবং পূর্ববাংলায় ‘৫৪ সালের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগ শােচনীয়ভাবে পরাজিত এবং পূর্ববাংলা থেকে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় । এই নির্বাচনে বেশ কজন ছাত্রনেতা যুক্তফ্রন্টের টিকেটে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং বিজয়ী হন। ১৯৪৮ সালের বাংলা ভাষা আন্দোলনের অন্যতম নেতা এবং পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র খালেক নেওয়াজ খান পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনকে ময়মনসিংহের নান্দাইল নির্বাচন কেন্দ্র থেকে পরাজিত করেন।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি গুলি চালিয়ে ছাত্রহত্যার জন্য নুরুল আমীন কুখ্যাত হয়েছিলেন। সে কারণে ওই নির্বাচনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রকর্মী নান্দাইলে গিয়ে নুরুল আমীনের বিরুদ্ধে নির্বাচনী প্রচারণা চালান। ১৯৫৪-৫৬ সালে ডাকসুর ভিপি এবং জিএস ছিলেন নিরােদ বিহারী নাগ এবং আবদুর রব চৌধুরী, ১৯৫৬-৫৭ সালে ভিপি একরামুল হক আর জি এস শাহ আলী হােসেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে ৯২-ক ধারা জারি অর্থাৎ কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত এবং মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা পূর্ববাংলার গভর্নর তথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর নিযুক্ত হন। যদিও তিনি ১৯৫৪ সালের ৩০ মে থেকে ২১ ডিসেম্বর মাত্র সাত মাসের মতাে গভর্নর ছিলেন; কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ছিলাে তার মাথাব্যথার কারণ । ১৯৫৪ সালের জুলাই মাসের শেষদিকে পূর্ববাংলার গভর্নর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা পাকিস্তানের তদানীন্তন গভর্নর জেনারেল গােলাম মােহাম্মদের কাছে প্রেরিত গােপন প্রতিবেদনে জানান, It is for this reason I have so far desisted from taking harsh measures against the students. Nobody will be more unhappy than me if I had to shoot, but if Pakistan’s integrity is endangered. I will shoot and shoot till the last round. (Shamsul Huda Harun, The Making of the Prime Minister, H.S. SUHRAWARDY, Appendix-15)
পাকিস্তানের সংহতির জন্য যে মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা ছাত্রদের ওপর শেষ রাউন্ড পর্যন্ত গুলি চালাতেও কুণ্ঠিত নন বলে তার ‘বস’ গভর্নর জেনারেল সাবেক আমলা গােলাম মােহাম্মদকে জানিয়েছেন, সেই মীর্জা মুর্শিদাবাদের মীরজাফরের বংশধর। তার বাবা ছিলেন অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ. কে, ফজলুল হকের নিরাপত্তায় নিয়ােজিত পুলিশের একজন ডিএসপি। ওই পুলিশের ডিএসপির পুত্র ইস্কান্দার মীর্জা যে পূর্বাহ্নে বৃটেনের স্যান্ডহ্যাস্টে সামরিক শিক্ষার জন্য যেতে পেরেছিলেন, তা শেরে বাংলার জন্যই। ১৯৫৪ সালে শেরে বাংলার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বরখাস্ত হওয়ার পর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা পূর্ববাংলায় গভর্নর হয়ে আসেন। তখন তিনি গভর্নর জেনারেলকে লিখে পাঠান: Mr. Fazlul Huq-corrupt, unreliable and out & out enemy of Pakistan. He had ideas of declaring the independence of East Pakistan and in the resultant chaos to invite West Bengal to march in face the world with a united Bengal. (Shamsul Huda Harun, Appendix-22) শেরে বাংলা সম্পর্কে জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জার এবংবিধ রিপাের্ট বিশ শতকের মীরজাফরের পক্ষেই প্রদান করা সম্ভবপর ছিল।
জেনারেল আইয়ুব খান প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই পাকিস্তানের মােহাজের প্রধানমন্ত্রী নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর পাকিস্তানের সামরিক সদর দপ্তর রাওয়ালপিণ্ডি ক্যান্টনমেন্ট শহরে এক জনসভায় আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। এরপর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন খাজা নাজিমউদ্দিন আর গভর্নর জেনারেল পাকিস্তানের এক মােহাজের আমলা গােলাম মােহাম্মদ, শারীরিকভাবে যিনি ছিলেন পঙ্গু কিন্তু বুদ্ধিতে ধূর্ত। ১৯৫৩ সালের ১৭ এপ্রিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত মােহাম্মদ আলী (বগুড়া) পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত আর খাজা নাজিমউদ্দিন হন পদচ্যুত। ১৯৫৪ সালের মে মাসে পূর্ববাংলায় শেরে বাংলার নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বরখাস্ত এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা পূর্ববাংলার গভর্নর নিযুক্ত হয়ে আসেন। ১৯৫৪ সালের ৪ অক্টোবর প্রধান সেনাপতি আইয়ুব খান প্রধানমন্ত্রী মােহাম্মদ আলী। এবং আইনমন্ত্রী স্যার জাফরুল্লার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান। যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাদের প্রত্যাবর্তনের পর ১৯৫৪ সালের ২৪ অক্টোবর পাকিস্তান গণপরিষদ ভেঙে দেয়া হয়। মােহাম্মদ আলী (বগুড়া) পাকিস্তানে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করেন। এই মন্ত্রিসভায় দেশরক্ষা মন্ত্রী হন প্রধান সেনাপতি জেনারেল আইয়ুব খান। ওই বছরই ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তান ‘সিয়াটো’ এবং ‘সেন্টো’ এই দুই সামরিক চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত। হয়ে পুরােপুরি মার্কিন সামরিক বলয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে।
ইতােমধ্যে পূর্ববাংলায় যুক্তফ্রন্টে ভাঙন দেখা দেয়, যুক্তফ্রন্টের প্রধান দুটি শরীক আওয়ামী লীগ এবং কৃষক শ্রমিক পার্টির বিরােধ প্রকাশ্য হয়ে পড়ে। ১৯৫৪ সালের ১৪ নভেম্বর পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গােলাম মােহাম্মদ ঢাকা সফরে এলে কার্জন হল প্রাঙ্গণে তাকে মালা প্রদানের জন্য কে এসপির শেরে বাংলা ফজলুল হক এবং আওয়ামী লীগের আতাউর রহমান খানের মধ্যে প্রকাশ্যে প্রতিযােগিতা হয়। পূর্ববাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে সে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। ১৯৫৪ সালের ২০ ডিসেম্বর হােসেন শহীদ সােহরাওয়াদী বগুড়ার মােহাম্মদ আলী মন্ত্রিসভায় আইনমন্ত্রী হিসেবে যােগদান করেন । এখানে স্মরণীয় যে, অবিভক্ত বাংলার রাজনীতিতে বাংলার শেষ প্রধানমন্ত্রী হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক অনুসারী ছিলেন মােহাম্মদ আলী (বগুড়া)। নিয়তির পরিহাস যে পাকিস্তানের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে সােহরাওয়ার্দীকে সেই মােহাম্মদ আলীর অধীনে সাধারণ মন্ত্রী হতে হয়েছিল। এ সময় গণপরিষদের পরিবর্তে কনভেনশনের মাধ্যমে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচনার জন্য আইনমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর প্রস্তাব প্রচণ্ড বিতর্কের সৃষ্টি করে। ১৯৫৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তার স্বেচ্ছানির্বাসন শেষে কলকাতা থেকে দেশে ফিরে আসেন। শেষ পর্যন্ত ১৯৫৫ সালের জুন মাসে পাকিস্তান গণপরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় আর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন। পাকিস্তানের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের ফলে কৃষক শ্রমিক দলের সমর্থনে পাকিস্তানের অপর এক আমলা চৌধুরী মােহাম্মদ আলী কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী আর তার বদৌলতে আবু হােসেন সরকার পূর্ববাংলায় কেএসপি মন্ত্রিসভা গঠন করেন। এ মন্ত্রিসভা ১৪ মাস স্থায়ী হয়েছিলাে। এ সময় আওয়ামী লীগ ছিল বিরােধী দলে। পশ্চিম পাকিস্তানী বিচারপতি মােহাম্মদ শাহাবুদ্দিন ১৯৫৪ সালের ২২ ডিসেম্বর থেকে ১৯৫৫ সালের ১৪জুন পর্যন্ত পূর্ববাংলার গভর্নর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর ছিলেন। ১৯৫৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস পালনে বাধা সৃষ্টি করা হয় । শহীদ দিবস পালনের আয়ােজনে বাধা দেয়ার জন্য ২১ ফেব্রুয়ারির আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু এবং বিভিন্ন হল ইউনিয়নের নির্বাচিত ভিপি-জিএসদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ১৯৫৫ সালের শহীদ দিবসে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনার প্রায় পুনরাবৃত্তি ঘটে, যদিও এবার কেউ নিহত হননি, তবু পুলিশি হামলা ও দমন নীতি ১৯৫২ সালকেও ছাড়িয়ে যায়।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় ভুবনে প্রবেশ করেনি, রাস্তা থেকে এবং রাস্তায় লাঠি, গুলি, টিয়ারগ্যাস ছুড়েছিলাে। ১৯৫৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশ পুরাতন কলাভবন প্রাঙ্গণে এবং ভবনের লাইব্রেরি, ক্লাসরুম ও শিক্ষকদের কমনরুমে প্রবেশ করে বেধড়ক লাঠিচার্জ, টিয়ারগ্যাস এবং গ্রেপ্তার চালায় । সহস্রাধিক ছাত্রছাত্রী আহত এবং গ্রেপ্তার হয়। গ্রেপ্তারকৃত ছাত্রদের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আর ছাত্রীদের লালবাগ পুলিশ হেড কোয়ার্টার্স প্রাঙ্গণে তাবু খাটিয়ে অস্থায়ী জেলখানায় রাখতে হয়েছিল । ৰন্দি ছাত্রীদের জেলখানায় রাখার মত জায়গা ছিল না। ১৯৫৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস পালনে বাধাদানের তীব্রতা আগের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। আজিমপুরে শহীদদের কবরে যেতে দেয়া হয়নি। মেডিক্যাল কলেজ হােস্টেল প্রাঙ্গণে ধ্বংসকৃত শহীদ মিনারের স্থানে কালাে কাপড় ঘেরাও করা প্রতীকী শহীদ মিনারে ফুল দিতেও বাধা দেয়া হয়। শহীদ দিবসের প্রতি এই উম্মা ছিলাে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসক চক্রের। বাংলা ভাষা, সাহিত্য, লিপি এক কথায় বাঙালি সংস্কৃতিবিরােধী মনােভাবের নগ্ন বহিঃপ্রকাশ; কিন্তু ১৯৫৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহসী ছাত্রছাত্রীরা পুলিশ ও ইপিআরের সব বাধা অতিক্রম করে শহীদ দিবস পালনের। চ্যালেঞ্জ মােকাবেলা করেছিল। ফলে পাকিস্তান গণপরিষদ বাধ্য হয়েছিল ১৯৫৬ সালে প্রণীত পাকিস্তান সংবিধানে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি প্রদানে । | বর্তমানে শহীদ মিনারের স্থান নির্বাচন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় আবু হােসেন সরকারের মুখ্যমন্ত্রিত্বের আমলে ‘৫৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। ১৯৫৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার শেষ পৃষ্ঠায় সংবাদটি প্রকাশিত হয় : এপিপি প্রকাশিত এক খবরে বলা হইয়াছে যে, পূর্ত সচিব (মন্ত্রী) মেডিক্যাল কলেজ হােস্টেল প্রাঙ্গণে ‘শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের জন্য চূড়ান্ত ভাবে একটি স্থান নির্বাচন করিয়াছেন এবং পরিকল্পনা প্রণয়ন করিয়া উহা। যত সর সরকারের নিকট পেশ করার জন্য সরকারী স্থপতিকে নির্দেশ দিয়াছেন ।
ওই সংবাদে প্রচার হয়ে পড়ে । রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় মেডিক্যাল কলেজ হােস্টেলের যে স্থানটিতে পুলিশের গুলিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবুল বরকত নিহত হইয়াছিলেন সেখানে সরকার রাতারাতি একটি শহীদ মিনার’ গড়িবার আয়ােজন করিতেছেন। খবরটি প্রচারিত হইবার সঙ্গে সঙ্গে এক বিরাট জনতা ঘটনাস্থলে ভিড় জমাইয়া দেখিতে পায় যে জনৈক মন্ত্রী প্রস্তাবিত মিনারটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের জন্য প্রস্তুত হইতেছেন। জনতা ইহাতে প্রবল আপত্তি জানায়। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম শহীদ। রিকশাচালক আওয়ালের ৬ বছর বয়স্কা কন্যা বশিরনকে দিয়া জনতা ইহার । ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করায় ।( ইত্তেফাক) এদিকে ১৯৫৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সংবাদপত্রে একটি প্রেসনােট প্রকাশিত। অদ্য ৯টায় মুখ্যমন্ত্রী আবু হােসেন সরকার মন্ত্রিসভা পূর্ববাংলায় ‘সরকারীভাবে ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ‘প্রথম শহীদ দিবস পালন এবং ‘শহীদ দিবসকে সরকারী ছুটির দিন ঘােষণা করেন। ১৯৫৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে বর্তমান শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর আনুষ্ঠানিকভাবে স্থাপন করা হয় এবং তা করেন পূর্ববাংলার তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী আবু হােসেন সরকার, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং শহীদ আবুল বরকতের মাতা হাসিনা বেগম । এ প্রসঙ্গে দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় ১৯৫৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত প্রতিবেদন : সকাল ৯টায় কোরান তেলােয়াতের পর মেডিক্যাল কলেজ হােস্টেলের পার্শ্বে মওলানা ভাসানী, প্রধানমন্ত্রী জনাব আবু হােসেন সরকার ও শহীদ বরকতের মাতা যুক্তভাবে শহীদ মিনারের পার্শ্বে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের উদ্দেশ্যে জনাব আবু হােসেন সরকার জুতা পায়ে আগমন করিলে উপস্থিত ছাত্র-জনতার মধ্যে দারুণ বিক্ষোভ ও উত্তেজনা দেখা দেয় এবং শেষ পর্যন্ত জনাব সরকার জুতা খুলিতে বাধ্য হন।
কৃষক শ্রমিক দলের মুখ্যমন্ত্রী আবু হােসেন সরকারের আমলে বর্তমান শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হলেও শুইদি মিনার নির্মাণের পরিকল্পনা প্রণয়ন বা নির্মাণকার্য বাস্তবায়নের সুযােগ সে সরকার পায়নি। ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে আবু হােসেন সরকারের মন্ত্রিসভার পতন ঘটে। ১৯৫৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আতউর রহমান খান পূর্ববাংলায় প্রথম আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেন। আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৫৮ সালের মার্চ মাসের শেষ পর্যন্ত প্রায় ১৪ মাস ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই শহীদ মিনারের পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের কাজ অনেক দূর অগ্রসর হয়। এই সরকারের আমলেই ১৯৫৬ সালের ৩ এপ্রিল পূর্ববাংলা আইনসভায় ‘বাংলা একাডেমী অ্যাক্ট ১৯৫৭’ পাস হয়। পূর্ববাংলার প্রথম দুই মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন ও নুরুল আমিনের সরকারি বাসভবন ‘বর্ধমান হাউসে ২১-দফার অন্যতম দফা অনুযায়ী ১৯৫৭ সালের ১০ আগস্ট ‘বাংলা একাডেমী প্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্যেও ‘শহীদ দিবস’, ‘শহীদ মিনার’ এবং ‘বাংলা একাডেমী’ সরকারিভাবে স্বীকৃত, চালু বা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তবে শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ ১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে পাকিস্তানে সামরিক স্বৈরতন্ত্রের উত্থান কাল পর্যন্ত সময়েও শেষ হয়নি, তা সংক্ষেপে সমাপ্ত হয়েছিল ১৯৬৩ সালে ।
সূত্র : স্বাধীনতা সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় – রফিকুল ইসলাম