You dont have javascript enabled! Please enable it!

পাকিস্তানী সামরিক স্বৈরাচার আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়ার পর ৯২-ক ধারা জারি এবং জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জাকে পূর্ববাংলার গভর্নর নিয়ােগ ছিল পূর্ব পাকিস্তানে মার্শাল ল’ বা সামরিক শাসন জারির রিহার্সাল । পাকিস্তানের পাঞ্জাবি ও উত্তর প্রদেশের সামরিকআমলা চক্র কোনাে অবস্থাতেই পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি নাগরিকদের নির্বাচিত সরকারকে বরদাশত করতে প্রস্তুত ছিল না। অবিভক্ত ভারতের সেনাবাহিনীর পাঞ্জাবি। মুসলমান অফিসার এবং প্রশাসনের যুক্ত প্রদেশ থেকে আগত আমলারা ছিল ইংরেজ সরকারের পদলেহি আর পাকিস্তান আন্দোলন-বিরােধী। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তারাই পাকিস্তানের ক্ষমতা দখলকারী ছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে ভারতের জামাতে ইসলামী নেতা আবুল আলা মওদুদী পাকিস্তানের বিরােধী ছিলেন; কিন্তু পাকিস্তান কায়েমের পর পূর্ব পাঞ্জাব থেকে পশ্চিম পাঞ্জাবে হিজরত করে তিনি ইসলামি প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানে ইসলাম’-এর প্রবক্তা রূপে পাঞ্জাবে ‘কাদিয়ানি” সম্প্রদায়কে অমুসলমান ঘােষণার দাবিতে সহিংস আন্দোলন শুরু করেন। ফলে পাঞ্জাবে সামরিক আইন জারি এবং সেনাবাহিনীকে মসজিদে পর্যন্ত ঢুকে হাঙ্গামা দমন করতে হয়েছিল । পশ্চিম পাকিস্তানে একাধিকবার আঞ্চলিকভাবে সামরিক আইন জারি এবং স্থানীয় অভ্যুত্থান দমন করা হয়। বেলুচিস্তানে অভূত্থান দমনে জেনারেল টিক্কা খান যে নৃশংসতার পরিচয় দিয়েছিলেন, সে জন্য তিনি বেলুচিস্তানের কসাই’ নামে খ্যাত ছিলেন। জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের উপজাতীয় এলাকার পলিটিক্যাল রেসিডেন্ট অফিসার বা প্রশাসক ছিলেন। তিনি পাঠানদের অভ্যুত্থান দমন করে হাত পাকিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৫৮ সালের আগে সমগ্র পাকিস্তানে কখনাে সামরিক শাসন প্রবর্তিত হয়নি। যা করেছিলেন জেনারেল ইসকান্দার মীর্জা। ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারি করা হয়েছিল, যাতে ১৯৫৬ সালে গৃহীত শাসনতন্ত্র অনুসারে পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে না পারে এবং নির্বাচিত সরকার ‘পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি,’ ‘বাদদাদ চুক্তি,’ ‘সিটো’, ‘সেন্টো’ প্রভৃতি পাশ্চাত্য সামরিক জোট থেকে বেরিয়ে না যায় সে জন্য । দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ-পরবর্তী ঠাণ্ডা বা স্নায়ুযুদ্ধে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রবক্তা হয়ে পড়ায় 

কমিউনিস্ট রাশিয়া ও চীনের বিরুদ্ধে দক্ষিণ এশিয়ায় পাশ্চাত্য মিত্র দেশ ছিল পাকিস্তান। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জার ছেলের সঙ্গে পাকিস্তানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত কন্যার শাদী পর্যন্ত হয়েছিল; কিন্তু জেনারেল মীর্জা ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর শাসনতন্ত্র বাতিল এবং সামরিক আইন জারি করে নিজেই আউট হয়ে যান, পাকিস্তানের সর্বময় কর্তৃত্ব জেনারেল আইয়ুব খানের কুক্ষিগত হয়। পাকিস্তান ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত জেনারেল তথা ‘স্বঘােষিত ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান কর্তৃক প্রথমে প্রত্যক্ষ সামরিক আইনে এবং পরে তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্র পদ্ধতির দ্বারা শাসিত হয়; যখন দেশবাসীর প্রাপ্তবয়স্ক ভােটাধিকারও ছিল না। জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তানের ক্ষমতা দখলের কিছুদিনের মধ্যেই ঢাকা সফরে আসেন এবং ঢাকা স্টেডিয়ামে এক জনসভায় ভাষণ দেন। এছাড়া তার সামরিক সরকারের দুজন সদস্য জেনারেল বার্কি এবং জেনারেল শেখ পূর্ব পাকিস্তান সফরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সভা ডাকেন কার্জন হলে। এ সভায় জেনারেলরা পাকিস্তানের শিক্ষানীতি এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচি কী হওয়া উচিত, সে সম্পর্কেও বক্তব্য রাখেন। কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সভায় সমবেত শিক্ষকবৃন্দ নীরবে জেনারেলদের নসিহত শুনছিলেন, কারাে প্রশ্ন করার মতাে বুকের পাটা ছিল না। জেনারেলরা যখন শিক্ষকদের কাছ থেকে প্রশ্ন আহ্বান করেন, তখন একমাত্র বাংলা বিভাগের প্রধান প্রফেসর মুহম্মদ আবদুল হাই দাড়িয়ে পরিস্কার ইংরেজিতে জেনারেলদের কাছে জানতে চান, অপাকিস্তানি বা অমুসলমান রবীন্দ্রনাথ বা মাইকেলকে বাদ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে কীভাবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পড়ানাে যাবে? সভায় যেনাে বােমা বিস্ফোরিত হয়, জেনারেলরা এ প্রশ্নের উত্তর ধানাইপানাই করে,এড়িয়ে যান। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামরিক বাহিনীর দালাল শিক্ষকরা ভেবেছিলেন, এবারে প্রফেসর মুহম্মদ আবদুল হাইর দফারফা হবে। তবে বাংলা সিলেবাসের ওপর আক্রমণ ষাটের দশক জুড়ে চলেছিল।

জেনারেল আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে ক্ষমতায় এসেছিলেন আর বছর শেষ না হতেই ৩১ ডিসেম্বর পাকিস্তানের সব ভাষার জন্য রােমান হরফ প্রবর্তন এবং একটি সাধারণ বা পাকিস্তানি ভাষা সৃষ্টির প্রস্তাব দিয়েছিলেন। জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হওয়ার আগে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে একজন কর্নেল ছিলেন, পরে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে ১৪শ ডিভিশনের জিওসি পদে নিযুক্ত এবং ব্রিগেডিয়ার পদে উন্নীত হন। তার পিতা ছিলেন ব্রিটিশ ভারতীয় বাহিনীর একজন রিসালদার এবং পাঞ্জাব ও সীমান্ত প্রদেশের সীমানা হাজারা অঞ্চলের মানুষ, সীমান্ত প্রদেশের পাঠান তিনি ছিলেন না। ১৯৪৮ সালে বাংলা ভাষা আন্দোলন ঢাকায় পুরাতন হাইকোর্ট সংলগ্ন ১৪শ ডিভিশনের সদর দপ্তরে বসে শুধু প্রত্যক্ষই করেননি, এক পর্যায়ে পুরনাে জগন্নাথ হল মিলনায়তনে পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের অধিবেশনরত বাংলা ভাষার দাবিতে ঘেরাও ছাদের হাত থেকে মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনকে বাবুর্চিখানার মধ্য দিয়ে পাচার করে নিয়ে এসেছিলেন। তবু তিনি পাকিস্তানের বাংলা, পাঞ্জাবি, সিন্ধি,  বাচি ও উর্দু ভাষার জন্য রােমান হরফের প্রস্তাব করেছিরেন কেনাে? ব্রিটিশ ভারতীয়। সেনাবাহিনীতে পাঞ্জাবি, পাঠান, বেলুচ, রাজপুত, মারাঠি, জাঠ, গুর্খা, বিহারি প্রমুখ। জাতির হিন্দু, মুসলমান, শিখ ও এ্যাংলাে হিলড্ৰেথ ইন্ডিয়ান সৈনিক ও অফিসার ছিলেন। তাদের নানা ভাষা ছিল, তবে ব্রিটিশ ভারতীয় বাহিনীর জওয়ানদের সরকারি ভাষা ছিল রােমান হরফে লেখা হিন্দুস্থানি (যা দেবনাগরী হরফে হিন্দি এবং আরবি বা ফার্সি হরফে উর্দু) ভাষা। সম্ভবত রােমান হরফে লেখা হিন্দুস্থানি ভাষার অভিজ্ঞতা থেকেই পাকিস্তানের জন্য এক অভিন্ন হরফ ও খিচুড়ি ভাষার উদ্ভট পরিকল্পনা তার মাথায় আসে। সর্বোপরি ব্রিটিশ ভারতীয় এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অফিসারদের ভাষা ছিল ইংরেজি। সুতরাং রােমান হরফের প্রতি তার আকর্ষণ বােধগম্য। কিন্তু তার এই প্রস্তাব বাংলা ও উর্দু উভয় ভাষার সাহিত্যিকদের মধ্যে তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ১৯৫৯ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে ইস্কান্দার মীর্জা হলের (ইঞ্জিনিয়ার্স। ইন্সটিটিউট) সেমিনার কক্ষে আইয়ুব খানের ওই প্রস্তাব নিয়ে একটি আলােচনা সভায়।

বাংলা সাহিত্যিকদের পক্ষ থেকে প্রফেসর মুহম্মদ আবদুল হাই এবং প্রফেসর মুনীর চৌধুরী আর উর্দু সাহিত্যিকদের তরফ থেকে ড. আন্দালিব শাদানী তীব্র ভাষায় সমালােচনার মাধ্যমে ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। পাকিস্তানের উর্দু সাহিত্যিকরাও। ওই প্রস্তাব নাকচ করে দেন। ফলে রােমান হরফের অলীক স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। অপরদিকে বাংলা ভাষা সংস্কারের জন্য পূর্ববাংলা সরকার কর্তৃক ১৯৪৮ সালে মওলানা আকরম খাঁর নেতৃত্বে গঠিত কমিটির রিপাের্ট, যা এতদিন প্রকাশ করা হয়নি তা সামরিক আইন জারির পর প্রকাশ করা হয়। এই রিপাের্ট কার্যকর হলে বাংলা ভাষার প্রকৃতি সম্পূর্ণ বদলে যেতাে । বাংলা একাডেমীতে অনুষ্ঠিত এক সভায় অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী এই রিপাের্টটি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিশ্লেষণ এবং তার অসারতা প্রমাণ করেন। ফলে এই প্রয়াসও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। কিন্তু বাংলা ভাষার হরফ পরিবর্তনের প্রয়াস একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। ইতােমধ্যে ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী এসে যায়। বিশ্বজুড়ে বিশ্বকবির শতবার্ষিকী যথাযােগ্য মর্যাদায় উদযাপনের আয়ােজন চলতে থাকে আর পাকিস্তানে চলে বিপরীত প্রয়াস। বিএনআর বা জাতীয় পুনর্গঠন সংস্থার পূর্ব পাকিস্তানের পরিচালক ঝানু পুলিশ অফিসার মুসা আহমদ, যিনি আবার তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবেরও দায়িত্বপ্রাপ্ত, ওই মন্ত্রণালয়ের একজন ডেপুটি ডিরেক্টরের (যিনি একজন আধুনিক কবিও বটে) মাধ্যমে জোর প্রয়াস চালান, যাতে পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালিত না হয়।

সংস্কৃতিসেবীদের মধ্যে ভীতি সঞ্চারের জন্য সাহিত্যিক আলাউদ্দিন আল আজাদকে গ্রেপ্তার করা হয় । এই পরিস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের ছাত্র আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এবং জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ পালন আয়ােজনের জন্য অধ্যাপক গােবিন্দ চন্দ্র দেবের বাসভবনে সাংস্কৃতিক কর্মীদের এক সভা আহ্বান করেন। সভায় বিচারপতি মাহবুব মােরশেদকে সভাপতি এবং অধ্যাপক খান সারওয়ার। মুরশিদকে সাধারণ সম্পাদক করে একটি রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন কমিটি  গঠন করা হয় । শতবার্ষিকীর আয়ােজন শুরু হয়ে যায়। একাধিক সাক্ষাত্তারে অধ্যাপক সজিদা খাতুন জানান, অধ্যাপক মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর উদ্যোগে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী উদযাপিত হয়েছিল—এ তথ্য যথার্থ নয়। কারণ অধ্যাপক চৌধুরী তখন দেশে ছিলেন না, তিনি উচ্চ শিক্ষার্থে ইংল্যান্ডে ছিলেন । যা হােক, সমস্ত সরকারি বাধা ও প্রতিকূলতা অগ্রাহ্য করে ১৯৬১ সালের মে মাসে ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে বিচারপতি মাহবুব মােরশেদের সভাপতিত্বে মহাসমারােহে চার দিন ধরে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপিত হয়। এ উপলক্ষে আলােচনা সভাসমূহ অনুষ্ঠিত হয় ফজলুল হক হল মিলনায়তনে, যাতে অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল হাই, অধ্যাপক সৈয়দ সাজ্জাদ হােসায়েন, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক হাসান জামান প্রমুখ অংশগ্রহণ করেন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলাে অনুষ্ঠিত হয় ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে। এছাড়া প্রেস ক্লাব এবং গােপীবাগকেন্দ্রিক দুটি কমিটির উদ্যোগেও মােট প্রায় এক মাসব্যাপী রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী যথাযােগ্য মর্যাদায় পালিত হয়। বস্তুত রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন ছিল পাকিস্তানি জান্তার চ্যালেঞ্জ মােকাবিলায় বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক কর্মীদের বলিষ্ঠ সংগ্রাম, যা ছিল বাঙালি সাংস্কৃতিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বাঙালি সংস্কৃতি ধ্বংসের জন্য যে আগ্রাসন চালিয়েছিল, তার প্রথম চ্যালেঞ্জ বাঙালি শিল্পী, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা যথার্থভাবে মােকাবিলা করেছিলেন। সামরিক আইন জারির তিন বছরের মধ্যে তিনটি ঘটনা- রােমান হরফ প্রচলন প্রয়াস বানচাল, বাংলাভাষা সংস্কার প্রচেষ্টা নস্যাত এবং রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনে বাঙালি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের জয়যাত্রার সূচনা করেছিল।

ষাটের দশক পাকিস্তান তথা পূর্ববাংলা, বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস সামরিক স্বৈরাচারবিরােধী সংগ্রামের কাল। ষাটের দশকের শুরুতে পূর্ববাংলার অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতাকর্মী ছিলেন কারাবন্দি অথবা গ্রেপ্তারি পরােয়ানা বা হুলিয়া মাথায় ফেরারি । ১৯৬২ সালের ৩১ জানুয়ারি করাচিতে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে গ্রেপ্তারের পরের দিন ১লা ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ঢাকা সফরে আসেন। সােহরাওয়ার্দীর গ্রেপ্তারের খবর ঢাকা পৌছামাত্র ‘তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয় আর জেনারেল আইয়ুব খান যেদিন ঢাকায়, সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ বিক্ষোভে ফেটে পাড়ে। সামরিক শাসনের সমস্ত বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহসী ছাত্ররা সেদিন বিক্ষোভ মিছিল করে। ১৯৫৮ সালের অক্টোবরের পর রমনার রাজপথে সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে এই প্রথম বিক্ষোভ, তিন বছরেরও অধিক সময়ের অবরুদ্ধ ক্ষোভ আর ঘৃণা সেদিন ফেটে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ আর রমনার রাজপথে । সামরিক বিধি নিষেধ উপেক্ষা করে বিক্ষুব্ধ ছাত্র মিছিল বেরিয়ে যায় পুরাতন কলাভবন থেকে এবং তা প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণে পৌছে এক সমাবেশে পরিণত হয়, সে সমাবেশে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে একক বক্তা ছিলেন হায়দার আকবর খান রনাে। তারিখ ছিল ১লা ফেব্রুয়ারি ১৯৬২। এ ঘটনাটি ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ সামরিক শাসন প্রবর্তিত হওয়ার পর এনএসএফ’ বা ‘জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন’ নামে একটি দালাল ছাত্র প্রতিষ্ঠানের দৌরাত্ম্য ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। এনএসএফের ক্যাডাররা ১৯৫৯, ৬০, ৬১-তিন বছরই ২১ ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনার দখল করে। স্বতঃস্ফূর্ত শহীদ দিবস পালনে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের বাধা দেয়, যদিও প্রতিবারই তাদের শহীদ মিনার ছাড়তে বাধ্য করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক এনএসএফের সন্ত্রাসী কর্মে মদদ জোগান। ইতােমধ্যে ১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল শেরে বাংলা এ, কে. ফজলুল হক ইন্তেকাল করেন, তার মরদেহ নিয়ে ঢাকায় স্মরণকালের সর্ববৃহৎ শােক শােভাযাত্রা ছিল আসলে বাঙালির দুঃখ-বেদনার বহিঃপ্রকাশ। কারণ সামরিক শাসনে বাঙালিকে গােলামের জাতে পরিণত করার প্রয়াস চলছিল। ইতােপূর্বে আইয়ুব খান ১লা মার্চ তার মৌলিক গণতন্ত্রী শাসনতন্ত্র প্রচারের মাধ্যমে মানুষের মৌলিক অধিকার অর্থাৎ প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটাধিকার কেড়ে নিয়ে দুই পাকিস্তানের আশি হাজার ইউনিয়ন কাউন্সিল চেয়ারম্যানের ভােটে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন। এই শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের নয় জন জাতীয় নেতা।

এক যুক্ত বিবৃতিতে তা প্রত্যাখ্যান করেন, সর্বোপরি অসুস্থতার জন্য হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ৬ মাস ২০ দিন পর কারামুক্ত হয়ে ১৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা আগমন করেন। সেদিন তাকে ঢাকায় ছাত্রজনতার অভূতপূর্ব সংবর্ধনা এবং তাকে নিয়ে যে বিশাল। শােভাযাত্রা হয়েছিল, তা ছিল সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বাংলার মানুষের ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ। জেনারেল আইয়ুব মৌলিক গণতন্ত্রী শাসনতন্ত্র জারির পর পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজ্ঞ মনজুর কাদের ঢাকা সফরে আসেন। তার ঢাকা আগমনের উদ্দেশ্য ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষকদের সঙ্গে আইয়ুবি। শাসনতন্ত্র সম্পর্কে মতবিনিময় এবং তাদের সমর্থন আদায় । তিনি কলাভবনে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে এক দুঃসাহসী কাজ করেছিলেন সন্দেহ নেই, বিশেষত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়া। কলাভবনে ছাত্র সভায় তিনি উত্তেজিত ছাত্রদের হাতে দৈহিকভাবে নিগৃহীত হন। কয়েকজন প্রবীণ শিক্ষক ছাত্রনেতাদের হাত থেকে নাজেহাল মনজুর কাদেরকে উদ্ধার করে শিক্ষক কমনরুমে নিয়ে আসেন। কলাভবন প্রাঙ্গণ তখন ছাত্র ছাত্রময়, এ পরিস্থিতিতে সংলাপ সম্ভব নয়। সুতরাং শিক্ষকরা তাকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে নিয়ে যান। তখনাে বর্তমান কলাভবন বা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ক্লাব নির্মিত হয়নি, ক্লাব ভবন তখন ছিল উপাচার্য ভবনের বিপরীত দিকে নীলক্ষেত রােডের পাশে একটি লাল দোতলা দালানে। সেখানে পৌছে মনজুর কাদের হাত-মুখ ধুয়ে, স্যুট-টাই ঠিকঠাক করে লাউঞ্জে শিক্ষক পরিবেষ্টিত হয়ে সংলাপে বসেন। শিক্ষকদের পক্ষ থেকে সংলাপে মূলত অংশ নেন প্রফেসর আবু মােহাম্মদ হাবিবুল্লাহ, প্রফেসর আবদুর রাজ্জাক, প্রফেসর রেহমান সােবহান প্রমুখ।

এখানে উল্লেখ্য যে প্রফেসর রাজ্জাক, রেহমান সােবহান। ছিলেন সামরিক শাসনামলে উত্থাপিত দুই পাকিস্তানের উন্য টু ইকোনমি থিওরি’ বা  “দ্বৈত অর্থনীতি তত্ত্বের প্রধান প্রবক্তা । সুতরাং এই সুযােগ তারা পূর্ণভাবে গ্রহণ করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আইনস্তন মনজুর কাদের ছাত্রদের হাতে নাজেহাল হওয়ার পরেও বেশ ধীরস্থির এবং শান্ত ছিলেন, একজন বিজ্ঞ আইনজ্ঞের মতই তিনি আইয়ুব খানের শাসনতন্ত্রের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে শুরু করেন এবং শিক্ষক প্রতিনিধিদের তীক্ষ্ম প্রশ্নবানের সাধ্যমত জবাব দিতে থাকেন। তিনি ব্যাখ্যা করেন, কীভাবে। ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানদের প্রথমে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে এবং কীভাবে তারা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবেন । তিনি সীমিতসংখ্যক চেয়ারম্যানের ভােটে পরােক্ষভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পদ্ধতির পেছনে অনেক যুক্তি উত্থাপন করতে থাকেন। প্রফেসর রেহমান সােবহান ভােটের আগে প্রশিক্ষণের বিষয়টি নিয়ে তাকে প্রায় নাস্তানাবুদ করে ফেলেন। আলােচনা চলতে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। মনজুর কাদের একটার পর একটা এনগেজমেন্ট বাতিল করে সন্ধ্যার পর পর্যন্ত শিক্ষকদের সঙ্গে সংলাপ চালিয়ে যেতে থাকেন । এখানে উল্লেখ্য যে, মনজুর কাদের কোনাে এক দুরারােগ্য অসুখের কারণে গরম সহ্য করতে পারতেন না। সে জন্য তিনি পাকিস্তানে গরমের সময় ছয় মাস ইউরােপে জুরিখে গিয়ে থাকতেন আর পাকিস্তানে থাকলে শৈলাবাস নাথিয়াগালিতে; কিন্তু সেদিন ফাল্গুন-চৈত্র মাসের গরমেও তিনি স্যুট পরিহিত অবস্থায় সিলিং ফ্যানের গরম বাতাসের মধ্যে নাছােরবান্দার মতাে শিক্ষকদের বােঝাতে চেষ্টা করেন আইয়ুবি শাসনতন্ত্রের মাহাত্ম । ওই সংলাপকে ঐতিহাসিক আখ্যা না। দিয়ে উপায় নেই।

কারণ জেনারেল আইয়ুব খানের ‘ব্রিফ’ নিয়ে বিশ্বস্ততার সঙ্গে তিনি মৌলিক গণতন্ত্রী শাসনতন্ত্রের পক্ষে একের পর এক খােড়া যুক্তি উত্থাপন করে। যাচ্ছিলেন আর প্রফেসর হাবিবুল্লাহ, প্রফেসর রাজ্জাক, প্রফেসর রেহমান সােবহান প্রমুখ তার যুক্তিগুলােকে ফুটো করে দিচ্ছিলেন। ওই সংলাপ ছিল মূলত পাকিস্তানের ফৌজি শাসকদের মুখপাত্রের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামরিক শাসন-বিরােধী শিক্ষকদের মুখােমুখি সংলাপ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মনজুর কাদের সেদিন ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের শিক্ষকদের খােলাখুলি ও স্পষ্ট বক্তব্য থেকে বাংলার মানুষের মনােভাব পরিষ্কারভাবে। জানতে পেরেছিলেন। আমাদের জানা নেই, মনজুর কাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের হাতে নাজেহাল হওয়ার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে কূটতর্কের তিক্ত অভিজ্ঞতাকে কীভাবে গ্রহণ করেছিলেন, ফিরে গিয়ে জেনারেল আইয়ুব খানকেই বা কী রিপাের্ট করেছিল। তবে মৌলিক গণতন্ত্রী চেয়ারম্যানদের ভােটেই আইয়ুব খান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন মিস ফাতেমা জিন্নাকে পরাজিত করে। যদিও ফাতেমা জিন্নাকে সব বিরােধী দল সমর্থন জানিয়েছিল এবং তিনি পূর্ব পাকিস্তানে বেশি ভােট পেয়েছিলেন।  জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তানের ক্ষমতা দখলের সঙ্গে সঙ্গে শাসনতান্ত্রিক সংস্কার অর্থাৎ সীমিত ভােটে পরােক্ষ নির্বাচন পদ্ধতি প্রচলন এবং প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটাধিকার বাতিল ইত্যাদির পাশাপাশি শিক্ষা সংস্কারের জন্য পাকিস্তানের শিক্ষা। সচিব এস. এম. শরীফের নেতৃত্বে ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একটি শিক্ষা কমিশন। 

গঠন করেন। ১৯৬২ সালে শরীফ কমিশনের রিপাের্টটি প্রকাশিত হলে পূর্ব পাকিস্তানে। তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। রিপাের্টে সুপারিশ ছিল, ষষ্ঠ থেকে ডিগ্রি পর্যায় পর্যন্ত ইংরেজি বাধ্যতামূলক, উর্দু ও বাংলা ভাষার সম্পর্ককে ঘনিষ্ঠ করা, পাকিস্তানের জাতীয় ভাষার জন্য একটি সাধারণ অর্থাৎ আরবি বর্ণমালা প্রচলন, বাংলা ও উর্দু বর্ণমালার সংস্কার এবং রােমান বর্ণমালায় পাকিস্তানি ভাষাসমূহের লিখন প্রণালী উদ্ভব, বিশেষভাবে উর্দু ও বাংলার জন্য একটি রােমান বর্ণমালা নির্ধারণ। শরীফ কমিশন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আরবি বা রােমান বর্ণমালায় পাকিস্তানের ভাষাগুলাে লেখার কথা বলেছিল । উর্দু, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, পশতু, বালুচ, কাশ্মীরি ভাষার জন্য আগে থেকেই আরবি হরফ প্রচলিত ছিল। সুতরাং ফাদটা ছিল বাংলার জন্য। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আরবি হরফের নামে উর্দু হরফে বাংলা লেখানাের যে গভীর ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত চলছিল, শরীফ কমিশন প্রকারান্তরে সামরিক প্রশাসনের ছত্রছায়ায় তা-ই করতে চাচ্ছিলাে। শরীফ কমিশন দুবছরের ডিগ্রি পাস কোর্সকে তিন বছরে সম্প্রসারিত করে শিক্ষা সংকোচের সুপারিশও করেছিল । শরীফ কমিশনের রিপাের্ট প্রকাশিত হলে স্বাভাবিকভাবেই কলেজগুলােতে প্রথম প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় বিশেষত ডিগ্রি তিন বছর মেয়াদি করার বিষয়টি নিয়ে; কিন্তু অচিরেই আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সম্প্রসারিত হয়। ১৯৬২ সালের ১০ আগস্ট ঢাকা কলেজের এক সভায় ১৫ আগস্ট সারা দেশে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়। ১৫ আগস্ট পুরাতন কলাভবন আমতলায় বিরাট ছাত্র সমাবেশ এবং পরে বিশাল বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। সভা, সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল চলতে থাকে একটানা ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, যাতে যােগ দেয় স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে। ১৭ সেপ্টেম্বর হরতালের ডাক দেয়া হয়। ইতােমধ্যে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী করাচিতে অসুস্থতার জন্য মুক্তি পেয়ে ১৬ সেপ্টেম্বর ঢাকায় আসেন এবং তেজগাঁও বিমানবন্দরে তাকে বিপুল সংবর্ধনা জানানাে হয়। ১৭ সেপ্টেম্বর হরতালের দিন ছাত্রসমাজ ঢাকায় রাজপথে ব্যাপক পিকেটিং করে, কার্জন হলের সামনের রাস্তায় ঢাকার গদিনসীন নবাব হাসান আসকারীর বিলাসবহুল মার্সিডিজ রেঞ্জ গাড়িটি ছাত্র-জনতা পুড়িয়ে দেয় ।

ঢাকার রাজপথ ছাত্রজনতার দখলে চলে যায়, নবাবপুর রােড়ে পুলিশ ও ছাত্র-জনতার ধাওয়া পাল্টাধাওয়া চলতে থাকে। কলাভবন থেকে জঙ্গি মিছিল বের হয় সিরাজুল আলম খান, মহিউদ্দিন আহমদ, হায়দার আকবর খান রনাে, রাশেদ খান মেনন, আইয়ুব রেজা। চৌধুরী, রেজা আলী প্রমুখ ছাত্রের নেতৃত্বে। শােভাযাত্রাটি হাইকোর্ট অতিক্রম করে সেক্রেটারিয়েট রােডে প্রবেশকালে পেছন থেকে পুলিশ গুলি চালায়। নিহত হন বাবুল, গােলাম মােস্তফা এবং পরে হাসপাতালে ওয়াজিউল্লাহ। তবু মিছিল থামে না, এগিয়ে যেতে থাকে নবাবপুর রােড দিয়ে । রথখােলা মােড়ে পুলিশ ব্যরিকেড সৃষ্টি করে বাধা দেয়। অপরদিকে জগন্নাথ কলেজ থেকে আগত আরেকটি বড় মিছিলও ব্যারিকেডে পড়ে। দুই মিছিল মিলিত হওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ ও ইপিআর ব্যাপক গুলি ও টিয়ারগ্যাস ছুঁড়তে থাকে। ফলে অসংখ্য ছাত্র-জনতা আহত হয়। প্রায় আড়াইশ’জনকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল। পুলিশি জুলুমের প্রতিবাদে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা এক যুক্ত বিবৃতি দেন । এদের মধ্যে ছিলেন হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, নুরুল আমিন, আতাউর রহমান খান, আবু হােসেন সরকার, শেখ মুজিবুর রহমান, ইউসুফ আলী চৌধুরী (মােহন মিয়া), মাহমুদ আলী, পীর মােহসেন উদ্দিন আহমদ (দুদু মিয়া), সৈয়দ আজিজুল হক (নান্না মিয়া) এবং শাহ আজিজুর রহমান। ১৯৬২ সালের মধ্য আগস্টে শিক্ষা আন্দোলন রাজপথে নেমে আসে এবং তা। চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৭ সেপ্টেম্বর, যেদিন আবদুল গণি রােড ও নবাবপুর রােডে পুলিশইপিআরের লাঠি, গুলি ও টিয়ারগ্যাসে শত শত ছাত্র-জনতা হতাহত হয়। পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন প্রত্যক্ষ সংগ্রামের রূপ নেয় ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর, যে রক্তাক্ত দিনটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে শিক্ষা দিবস’ নামে পরিচিত। ১৯৬২ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর সকালে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে গায়েবি জানাজা শেষে বিরাট শােক মিছিল বের হয়। ২৩ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে আন্দোলনরত একজন স্কুল ছাত্র পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিল। ২৪ সেপ্টেম্বর পল্টন ময়দানে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের উদ্যোগে এক ছাত্র-জনসভা সরকারকে চরমপত্র দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ড. মােহাম্মদ হাননান বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস দ্বিতীয় খণ্ড ১৯৫৩-১৯৬৯ গ্রন্থে (আগামী প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৪) লিখেছেন, শহীদ সােহরাওয়ার্দী ইতােমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর গােলাম ফারুকের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন।

তারই পরামর্শে ছাত্র অভ্যুত্থানের তৃতীয় দিনের মধ্যে সরকার শরীফ শিক্ষা কমিশন রিপাের্ট বাস্তবায়ন স্থগিত রাখার ঘােষণা দেন। একই সঙ্গে এক উদ্ভট সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ১৯৬৩ সালের জন্য যেসব ছাত্র স্নাতক পরীক্ষার ফরম পূরণ করেছিলেন, পরীক্ষা না দিয়েই তাদের সবাইকে পাস করিয়ে দিয়ে ডিগ্রি প্রদান করার কথা ঘােষণা করা হয়। সরকারের ওই সিদ্ধান্ত শিক্ষা আন্দোলনের তীব্রতার পরিচায়ক। সামরিক সরকার ছাত্র আন্দোলনের ব্যাপকতায় দিশেহারা হয়ে না পড়লে ওই রকম সিদ্ধান্ত নিতে পারত না। ওই বছর একটি শিক্ষাবর্ষে মাত্র ২৭ দিন ক্লাস হয়েছিল। অথচ বিনা পরীক্ষায় বিএ পরীক্ষার্থীরা ডিগ্রি পেয়ে গেল, যদিও পরবর্তীকালে ওই আইয়ুবি ডিগ্রিধারীদের অনেক সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন সম্পর্কে একটি ঐতিহাসিক ভ্রান্ত ধারণা দূর করে ড. মােহাম্মদ হাননান পূর্বোল্লিখিত গ্রন্থে লিখেছেন, অনেকে মনে করেন, এমনকি বাষট্টির ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন ছাত্রনেতাও আমার কাছে বলেছেন, বাষটির ছাত্র আন্দোলন হয়েছিল হামুদুর রহমান কমিশনের  বিরুদ্ধে। অথচ হামুদুর রহমান কমিশন গঠিত হয়েছিল ১৯৬৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর। প্রকৃতপক্ষে বাষট্টির ছাত্র আন্দোলনের কারণ অনুসন্ধান ও শরীফ কমিশনের মূল্যায়ন করার জন্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, প্রতি বছর আমাদের দেশের সংবাদপত্রগুলাে পর্যন্ত ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবসের সংবাদ ছাপাতে। গিয়ে হামুদুর রহমান কমিশনের কথাই লিখে থাকেন।

বস্তুত স্মৃতি যে মানুষকে কীভাবে বিভ্রান্ত এবং ইতিহাস বিকৃত ঘটায়, জেনারেল আইয়ুব খানের শরীফ কমিশন ও হামুদুর রহমান কমিশনের মধ্যে বিভ্রান্তি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। শিক্ষা আন্দোলনের সময় পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি আমলা গােলাম ফারুক (১১ মে ১৯৬২ থেকে ২৫ অক্টোবর ১৯৬২)। শিক্ষা আন্দোলনের আগে লে. জেনারেল আজম খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন ১৯৫৯ সাল থেকে ১৯৬২ সালের মে মাস পর্যন্ত। জেনারেল আজম খান গভর্নর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হিসেবে এবং ড. মাহমুদ হােসেন ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে মােটামুটি জনপ্রিয় ছিলেন, ফলে উভয়কেই বিদায় নিতে হয়। জেনারেল আইয়ুব খানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী আবদুল মােনেম খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত হন ১৯৬২ সালের ২৮ অক্টোবর। তিনি ঢাকা কলেজে শিক্ষা সপ্তাহ উদ্বোধন করতে গেলে ছাত্ররা তাকে কালাে পতাকা প্রদর্শন করে । মােনেম খান গভর্নর ও চ্যান্সেলর নিযুক্ত হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. মাহমুদ হােসেনকেও বিদায় নিতে হয় (১৫ ডিসেম্বর ১৯৬০ থেকে ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৩)। কারণ তিনি ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে পুলিশের ভূমিকা পালনে অস্বীকৃতি জানান। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হয়ে আসেন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. মাে. ওসমান গনি । তিনি পূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। ষাটের দশকের অধিকাংশ সময় জুড়ে গভর্নর মােনেম খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর (২৬ অক্টোবর ১৯৬২ থেকে ২২ মার্চ ১৯৬৯) এবং ড. এম. ও গনি ভাইস চ্যান্সেলর (২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৩ থেকে ১ ডিসেম্বর ১৯৬৯) ছিলেন, যে সময়কালের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলাে ঘটেছিল । ইতােমধ্যে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীরও মৃত্যু ঘটে। ১৯৬৩ সালের মার্চ মাস থেকে ভগ্ন স্বাস্থ্য উদ্ধার এবং চিকিৎসার জন্য তিনি বিদেশে ছিলেন। ৫ ডিসেম্বর সকালে বৈরুতের এক হােটেলে রহস্যজনকভাবে তার মৃত্যু হয়। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে করাচি ফিরে ৭ ডিসেম্বর তার ঢাকায় আসার কথা ছিল ।

নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট ফ্লাইটে তার মরদেহ ঢাকায় এসে পৌছায়। তার মরদেহ বিমানবন্দর থেকে বিশাল শােক শােভাযাত্রা সহযােগে রমনার মাঠে এনে জানাজা শেষে হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে শেরে বাংলার কবরের পাশে দাফন করা হয়। সােহরাওয়ার্দীর রহস্যজনক মৃত্যু জনমনে অনেক প্রশ্নের সৃষ্টি করেছিল; কিন্তু সামরিক শাসনামলে তা  উত্থাপনের উপায় ছিল না। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর আকস্মিক মৃত্যুর পর ১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ। পুনরুজ্জীবিত হয় এবং বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন সুনির্দিষ্ট পথে এগিয়ে যায় । ১৯৬৪ সারে সামরিক স্বৈরাচার-বিরােধী আন্দোলন বিপথগামী করার জন্য অবাঙালি গুণ্ডাদের দিয়ে ঢাকা ও আশপাশের অঞ্চলে এক ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা বা এথনিক ক্লিনসিং’ শুরু করা হয়। উল্লেখ্য যে, ১৯২৬ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত ঢাকায় নিয়মিত হিন্দু-মুসলমান ‘রায়ট” বা ‘দাঙ্গা’ হলেও দেশ বিভাগের পর আর ঢাকাইয়ারা দাঙ্গা করেনি। ১৯৫০ সালে বিহারিদের দিয়ে দাঙ্গা বাধানাে হয়েছিল নবাবপুর-পাটুয়াটুলী বাণিজ্য এলাকা থেকে বাঙালি হিন্দু ব্যবসায়ীদের বিতাড়ন এবং তাতে ভারত থেকে আগত অবাঙালি ব্যবসায়ীদের দখল দেয়ার জন্য। ১৯৬৪ সালে সুপরিকল্পিতভাবে ঢাকার বিভিন্ন বিহারি অধ্যুষিত এলাকা, যেমন ঠাটারি বাজার, নীলক্ষেত, মােহাম্মদপুর ও মিরপুর থেকে দলে দলে সশস্ত্র গুণ্ডারা ট্রাকে করে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, জিঞ্জিরা, সাভার প্রভৃতি অঞ্চলের হিন্দুপাড়া ও গ্রামগুলােতে বাঙালি এথনিক ক্লিনসিং অভিযান চালাতে থাকে। কয়েকদিন ধরে যখন বিনা বাধায় এই অভিযান চলছিল, তখন গভর্নর মােনেম খান শুক্রবার মােহাম্মদপুর বা মিরপুর এলাকার কোনাে মসজিদে বাদ জুমা ‘শান্তির ললিত বাণী’ প্রচার করছিলেন। ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় অবাঙালি গুণ্ডারা ১৯৬৪ সালের ৭ জানুয়ারি থেকে বাঙালি হিন্দু নিধন ও বিতাড়ন অভিযান শুরু করে, যা চরম পর্যায়ে পৌছায় ১০ জানুয়ারি। পরিণতিতে স্বাভাবিকভাবেই ওই তাণ্ডব বাঙালি-অবাঙালি দাঙ্গায় পরিণত হয়।  এই দাঙ্গার সময় ১৯৬৪ সালের ১৫ জানুয়ারি আক্রান্ত হিন্দুদের বাঁচাতে গিয়ে নবাবপুর রেলওয়ে ক্রসিঙের কাছে আন্তর্জাতিক নজরুল ফোরামের সভাপতি কবি আমির হােসেন চৌধুরী আর ১৬ জানুয়ারি নটরডেম কলেজের অধ্যাপক ফাদার নােভাক একই কারণে। নারায়ণগঞ্জের কাছে অবাঙালি গুণ্ডাদের অস্ত্রাঘাতে নৃশংসভাবে নিহত হন। মােহাম্মদপুরের বিহারি গুণ্ডারা ফিজিক্যাল ট্রেনিং কলেজ হােস্টেল এবং হাটখােলার একটি হােস্টেলে বাঙালি মেয়েদের ওপর আক্রমণ চালায়। ওইসব ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সারা দেশ জেগে ওঠে। আইয়ুব-মােনায়েম বিরােধী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ ‘দাঙ্গা প্রতিরােধ কমিটি’ গঠন এবং ১৭ জানুয়ারি নিম্নোক্ত ঐতিহাসিক আবেদনপত্রটি তদানীন্তন তিনটি প্রধান বাংলা দৈনিক ইত্তেফাক, আজাদ ও সংবাদ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়।

পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও

সাম্প্রদায়িক দুবৃত্তদের ঘৃণ্য ছুরি আজ ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও অন্যান্য স্থানে শান্ত ও পবিত্র পরিবেশ কলুষিত করিয়া তুলিয়াছে। ঘাতকের ছুরি হিন্দুমুসলমান,নির্বিশেষে পূর্ববাংলার মানুষের রক্তে লাল হইয়া উঠিয়াছে। দুবৃত্তদের হামলায় ঢাকার প্রতিটি পরিবারের শান্তি ও নিরাপত্তা আজ বিপন্ন। হিন্দু-মুসলমান  উভয় সম্প্রদায়ের নিরীহ মানুষের ঘরবাড়ি পােড়ানাে হইতেছে, সম্পত্তি বিনষ্ট করা হইতেছে, এমনকি জনাব আমির হােসেন চৌধুরীর মত শান্তিকামী মানুষদেরও দুবৃত্তদের হাতে জীবন দিতে হইতেছে। তাহাদের অপরাধ কি ছিল একবার চিন্তা করিয়া দেখুন  গুণ্ডারা মুসলমান ছাত্রীনিবাসে হামলা করিয়াছে এবং হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে আমাদের মা-বােনের সম্রম আজ মুষ্টিমেয় গুণ্ডার কলুষ স্পর্শে লাঞ্ছিত হইতে চলিয়াছে। এই সর্বনাশা জাতীয় দুর্দিনে আমরা মানবতার নামে, পূর্ব পাকিস্তানের সম্মান ও মর্যাদার নামে দেশবাসীর নিকট আকুল আবেদন জানাইতেছি, আসুন সর্বশক্তি লইয়া গুণ্ডাদের রুখিয়া দাঁড়াই, শহরে শান্তি ও পবিত্র পরিবেশ ফিরাইয়া আনি। পূর্ববাংলার মানুষের জীবনের ওপর এই পরিকল্পিত হামলার বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইতে আমরা পূর্ববাংলার সকল মানুষকে আহ্বান জানাইতেছি।

* প্রতি মহল্লায় প্রতিরােধ কমিটি গঠন করুন

* গুণ্ডাদের শায়েস্তা করুন, নির্মূল করুন *

* পূর্ব পাকিস্তানের মা-বােনের ইজ্জত ও নিজেদের ভবিষ্যৎকে রক্ষা করুন। | বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্রছাত্রীসহ বুদ্ধিজীবী এবং প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা দাঙ্গা প্রতিরােধে ঝাপিয়ে পড়েন। উপদ্ৰত অঞ্চল থেকে দাঙ্গাপীড়িতদের। উদ্ধার করে এনে আশ্রয় শিবিরে রাখা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের বাড়িতে বিপদগ্রস্ত হিন্দু পরিবারদের আশ্রয় দেন। বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী ও শিক্ষকরা। দলে দলে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ডেমরা, জিঞ্জিরা, কেরাণীগঞ্জ, সাভারের উপদ্রত অঞ্চলগুলাে পরিদর্শন এবং প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থাদি গ্রহণ করেন। বস্তুত ১৯৬৪ সালে। বাঙালি হিন্দু এথনিক ক্লিনসিং যে ১৯৫০ সালের দাঙ্গার মতাে সমগ্র পূর্ববাংলায় ছড়িয়ে পড়তে পারেনি, সে কৃতিত্ব সাংবাদিক তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়া ও রাজনীতিবিদ শেখ মুজিবুর রহমানের সাম্প্রদ্রায়িকতা-বিরােধী সংগ্রামে নেতৃত্বের প্রাপ্য। সামরিক শাসনের পূর্ব পাকিস্তানি সেবাদাসদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়। ১৯৬৪ সালের ২৯ মার্চ প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের দাবিতে দেশব্যাপী সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। পল্টন ময়দানে লক্ষাধিক মানুষের সমাবেশে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ ও শেখ মুজিবুর রহমান সামরিক স্বৈরাচারের অবসানের দাবিতে বক্তব্য রাখেন। সভাশেষে এক বিরাট শােভাযাত্রা নগর পরিভ্রমণ করে। এরপর সামরিক স্বৈরাচার-বিরােধী আন্দোলনে নতুন মাত্রা সংযােজিত হয় । সমাবর্তন হাঙ্গামা ১৯৬২ সালের ২৮ অক্টোবর জেনারেল আইয়ুব খানের পাকিস্তান কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার স্বাস্থ্যমন্ত্রী ময়মনসিংহের উকিল আবদুল মােনেম খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এবং পদাধিকার বলে ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর নিযুক্ত হন। এ  সময় থেকে সরকার সমর্থক ‘জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন’ বা ‘এনএসএফ’-এর সশস্ত্র ক্যাডারদের উৎপাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও শিক্ষাজীবন চরমভাবে বিপর্যস্ত হয় এবং সরকার-বিরােধী ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন ও মতিয়ার নেতৃত্বাধীন দুটি ছাত্র প্রতিষ্ঠান) এবং ছাত্রলীগের সরকার-বিরােধী তৎপরতাও শক্তিশালী এবং জোরদার হয়ে উঠতে থাকে, ওই তিনটি ছাত্র সংগঠন ঐক্যবদ্ধভাবে সরকারি ছাত্র প্রতিষ্ঠান ‘এনএসএফ’-এর সন্ত্রাসী কার্যক্রম এবং চ্যান্সেলর মােনেম খানের বিশ্ববিদ্যালয় কার্যক্রমে সরাসরি হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ায়। গভর্নর ও চ্যান্সেলর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাৎসরিক সমাবর্তন উৎসবে প্রধান অতিথিরূপে যােগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে ছাত্রসমাজের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।

কড়া পুলিশ প্রহরায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে যােগদান করতে সক্ষম হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে চ্যান্সেলর মােনেম খানের যােগদানের সিদ্ধান্তে অবস্থার অবনতি ঘটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের তারিখ ঘােষিত হয় ১৯৬৪ সালের ২২ মার্চ রােববার; কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটরা চ্যান্সেলর মােনেম খানের হাত থেকে ডিগ্রি নিতে অস্বীকৃতির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ডাকসুর ভিপি ও জিএস রাশেদ খান মেনন ও মতিয়া চৌধুরী, ইকবাল হলের (পরবর্তী সময়ে জহুরুল হক হল) ভিপি ও জিএস মুঈদ চৌধুরী ও আলী হায়দার খান, এসএম হলের ভিপি ও জিএস ফরাসউদ্দিন ও মােহাম্মদউল্লাহ ভূইঞা, ঢাকা হলের ভিপি বজলুর রহমান। এবং ফজলুল হক হলের জিএস আবদুর রাজ্জাক এক যুক্ত বিবৃতিতে ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিকে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের চ্যান্সেলর নিয়ােগের দাবি জানান। ১৯৬৪ সালের ২১ মার্চ তারিখে পুরাতন কলাভবন প্রাঙ্গণে অবস্থিত ডাকসু অফিসে কনভােকেশন বয়কট করার বিষয় নিয়ে যখন সর্বদলীয় ছাত্র প্রতিনিধিদের সভা চলছিল, তখন এনএসএফের ক্যাডাররা সেই সভায় হামলা চালায়। অভিযােগ যে, এই হামলা ছিল পূর্বপরিকল্পিত, পুরাতন কলাভবন সিংহদ্বারে অবস্থিত প্রক্টর ও ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি সার্ভিস’ অফিসে আগে থেকে মজুদ রড, হকিস্টিক নিয়ে তারা ছাত্রনেতাদের আক্রমণ করেছিল। এ ঘটনায় পরিস্থিতির আরাে অবনিত ঘটে এবং চ্যান্সেলর আবদুল মােনেম। খানের প্রধান আতিথ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠান অসম্ভব হয়ে ওঠে। ঐ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও ডব্লিউ ইউ এস প্রধান ছিলেন ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ওয়াদুদুর রহমান। কার্জন হল প্রাঙ্গণে কনভােকেশনের জন্য নির্মিত প্যান্ডেলে সমাবর্তন অনুষ্ঠান শুরু হয় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে ।

কনভােকেশন প্যান্ডেল, সমগ্র কার্জন হল, ফজলুল হক হল ও ঢাকা হল ঘিরে রেখেছিল হেলমেটধারী সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী। অতিথি ও ডিগ্রি গ্রহণের জন্য ছাত্রছাত্রীরা যথারীতি কনভােকেশন প্রাঙ্গণে আসন গ্রহণ করেন। চ্যান্সেলর আবদুল মােনেম খান, ভাইস চ্যান্সেলর ড, এম, ও, গণি, সিন্ডিকেট, অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ সমাবর্তন শােভাযাত্রা সহযােগে যথারীতি প্যান্ডেলে প্রবেশ এবং নির্ধারিত আসন গ্রহণ করেন। মঞ্চে   চ্যান্সেলর, ভাইস চ্যান্সেলর, রেজিস্ট্রার, বিভিন্ন ফ্যাকাল্টির ডিনগণ আসীন হন, মঞ্চে তাদের পেছনে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী মােতায়েন ছিল। আপাতদৃষ্টিতে সবই স্বাভাবিক এবং নিয়মমাফিক মনে হচ্ছিল। পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে সমাবর্তন কার্য শুরু হয় । ভাইস চ্যান্সেলর ড. এম.ও. গণি তার সমাবর্তন ভাষণ প্রদান করেন। এবং একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সমাবর্তনের গুরুত্ব ও ঐতিহ্য সম্পর্কে বলেন। কিন্তু তারপরই যখন চ্যান্সেলর মােনেম খান তার আসন থেকে ভাষণ ও ডিগ্রি প্রদানের জন্য উঠে দাড়ান, তখন ভােজবাজির মত কনভােকেশন প্যান্ডেলের দৃশ্যপট সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে যায় । ডিগ্রি গ্রহণের জন্য আগত ছাত্র এবং অতিথিরূপে আগত ডাকসু ও বিভিন্ন হল ইউনিয়নের নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধিরা একযােগে উঠে দাঁড়ান এবং ‘মােনেম খান ফিরে যাও’ ধ্বনি দিতে দিতে প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়েন।

সঙ্গে সঙ্গে কনভােকেশন প্যান্ডেলের চারদিকে মােতায়েন সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী প্যান্ডেলে ঢুকে সমাবর্তন গাউন পরিহিত বিক্ষোভ প্রদর্শনরত ছাত্রছাত্রীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয় প্রচণ্ড লাঠিচার্জ ও কাদানে গ্যাস প্রয়ােগ। ছাত্ররা বসার চেয়ার তুলে নিয়ে পুলিশি হামলা প্রতিরােধের চেষ্টা করে। কনভােকেশনে আগত বিশিষ্ট দেশি-বিদেশি অতিথি আর শিক্ষকরা মাটিতে বসে বা শুয়ে পড়ে মাথা বাঁচানাের চেষ্টা করতে থাকেন। বেশ কিছুক্ষণ ধরে কনভােকেশন প্যান্ডেলে ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ চলতে থাকে, মাথার উপর দিয়ে পুলিশের লাঠি আর ছাত্রদের চেয়ার মিসাইলের মতাে ছুটতে থাকে। কনভােকেশন প্যান্ডেল রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। কনভােকেশন মঞ্চ সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী। ঘেরাও করে রেখেছিল, যাতে উত্তেজিত ও বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা মঞ্চে উঠতে বা মঞ্চের দিকে চেয়ার ছুড়ে মারতে না পারে। বিক্ষুব্ধ ছাত্রছাত্রীরা কনভােকেশন ভাষণ ও অনুষ্ঠানসূচি সংবলিত স্মরণিকা ছিড়ে মঞ্চের দিকে ছুঁড়ে মারছিল । চ্যান্সেলর মােনেম খান নিরুদ্বেগে মঞ্চ থেকে ওই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে তার কর্তব্য সমাপ্ত করেননি, তিনি পুলিশের কাছ থেকে একটি হেলমেট নিয়ে কনভােকেশন হুডের পরিবর্তে তা মাথায় দিয়ে পুলিশ বাহিনীকে হাত তুলে নির্দেশ দিতে থাকেন প্যান্ডেলের কোনদিকে অভিযান চালাতে হবে। শেষ পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের প্রচণ্ড বিক্ষোভের মুখে সমাবর্তনের কাজ চালিয়ে যাওয়া আর সম্ভবপর হয়নি, অ্যাকাডেমিক গাউন ও হেলমেট পরিহিত চ্যান্সেলর মঞ্চে উপবিষ্টদের নিয়ে পুলিশ পরিবেষ্টিত অবস্থায় শােভাযাত্রা করে সমাবর্তন প্যান্ডেল। পরিত্যাগ করে চলে যান। কনভােকেশন ভণ্ডুল হয়ে যায়। পরের দিন ঢাকার তদানীন্ত ন ইংরেজি ও বাংলা দৈনিক পত্রিকাগুলাের প্রথম পৃষ্ঠায় হেলমেট পরিহিত চ্যান্সেলরের বিচিত্র ছবি প্রকাশিত হয়।

কনভােকেশন ভন্ডুল হলেও ঘটনার শেষ সেখানেই হয়নি, মােনেম খান কার্জন হল প্রাঙ্গণ পরিত্যাগ করতে না করতেই কার্জন হল, ফজলুল হক হল ও ঢাকা হলে বিশাল পুলিশ বাহিনীর হিংস্র আক্রমণ শুরু হয়ে যায়, পুলিশের প্রচণ্ড লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাসের প্রকোপে বহু ছাত্রছাত্রী আহত এবং কাউন হল এলাকার বিভিন্ন বিজ্ঞান ভবন এবং ফজলুল হক ও ঢাকা হল থেকে এই ছাত্রকে গ্রেপ্তার করা হয়। ছাত্রদের  ওপর এই বেপরােয়া হামলার প্রতিবাদে ছাত্রনেতারা পরিস্থিতির ওপর একটি বিবৃতি প্রদান করেন। ১৯৬৪ সালের ৩০ মার্চ নিম্নোক্ত ছাত্রনেতাদের ওপর গ্রেপ্তারি পরােয়ানা জারি ও আত্মসমর্পণের নির্দেশ জারি হয়; রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনাে, রেজা আলী, কে, এম, ওবায়দুর রহমান, এন. এম. সিরাজুল আলম খান, শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন, গিয়াসুদ্দিন কামাল, এ. কে. বদরুল হক এবং আইয়ুব রেজা। চৌধুরী। এ হাঙ্গামার ফলে প্রদেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলন ঠেকানাের জন্য ১৪শ’ স্কুল ও ৭৪ টি কলেজ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। গ্রেপ্তার করা হয় মোট ১২শ’ ছাত্রকে। সরকার সংবাদপত্রের কণ্ঠরােধের জন্য দৈনিক আজাদ, সংবাদ এবং ইত্তেফাকের ওপর কারণ দর্শাও নােটিশ এবং ৩০ হাজার টাকা করে জামানত তলব করে । সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণের প্রতিবাদে ওইসব পত্রিকায় সম্পাদকীয় কলাম শূন্য। রেখে ‘সংবাদপত্রের মুখ বন্ধ করা চলবে না’, ‘গলাটিপা প্রেস অর্ডিন্যান্স বাতিল কর’, ‘বাক স্বাধীনতা দিতে হবে’ ইত্যাদি শ্লোগান প্রতিদিন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতে থাকে। ওইসব পত্রিকা হাইকোর্টে রিট করলে দীর্ঘ শুনানির পর মামলায় পত্রিকাগুলাে জয়ী হয়। ওই সময় বিচারপতি মাহবুব মাের্শেদের নেতৃত্বে ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতিগণ বলিষ্ঠ অবস্থান গ্রহণ করেন। সরকার ছাত্র আন্দোলন সম্পর্কিত সব রকম সংবাদ প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করলে এক মাস পর্যন্ত কোনাে সংবাদপত্রে ছাত্র আন্দোলন সম্পর্কে কোনাে সংবাদ প্রকাশিত হতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত হাইকোর্টের রলিঙের ফলে ওই বাধা অপসারিত হলে ১৯৬৪ সালের ২৮ মে। বিভিন্ন সংবাদপত্রে পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্র নির্যাতনের ৩০ দিনের খতিয়ান প্রকাশ করা হয়। দৈনিক আজাদ থেকে উদ্ধৃতি,

পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্র নির্যাতনের গত ৩০ দিনের মােটামুটি খতিয়ান

কোন বিশেষ কারণে গত এক মাস যাবৎ ছাত্রদের সম্পর্কে কোনাে সংবাদ আজাদে প্রকাশ করা যায় নাই। এমনকি গত ৩রা এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন ছাত্রের এমএ ডিগ্রী প্রত্যাহার, বিশ্ববিদ্যালয় হইতে ৫ বৎসরের জন্য ৪ জন, ৩ বৎসরের জন্য ৬জন এবং ২ বৎসরের জন্য ১৪ জনকে রাস্টিকেট করার সংবাদও আজাদে প্রকাশ করা যায় নাই। ইহা ছাড়া আরও ২০ জন ছাত্রকে সদাচরণের গ্যারান্টি দানের নির্দেশও দেওয়া হয়। উপরােক্ত নির্দেশ জারীর পর কর্তৃপক্ষ ঢাকাসহ প্রদেশের বিভিন্ন স্থান হইতে ১৯ জন ছাত্রনেতাকে গ্রেপ্তার করিয়াছেন। সরকারী কলাভবনের (আর্ট ইন্সটিটিউট) ৩ জন এবং ঢাকা কলেজের আরও ৯জন ছাত্রের বিরুদ্ধে কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে না, তাহার কারণ দর্শাইবার জন্য নির্দেশ দান করা হইয়াছে। যে দুইজন ছাত্রের এমএ ডিগ্রি প্রত্যাহার করা হইয়াছে, তাহারা হইতেছেন শেখ ফজলুল হক মণি এবং ইসমত আলী (আসমত আলী শিকদার)। 

ঢাকা হাইকোর্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের শাস্তিমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জাকির আহমদ ও আহমদ ফারুক রিট আবেদন করেন। বিভিন্ন সংবাদপত্রের তরফ থেকেও সরকারের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে আবেদন করা হয় । ঢাকা হাইকোর্টের স্পেশাল বেঞ্চ ১৯৬৪ সালের ৮ জুলাই এক ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী রায়ে ছাত্র বহিষ্কার এবং সংবাদপত্রের জামানত ‘তলব অবৈধ ঘােষণা করেন। হাইকোর্টের রায় প্রকাশিত হওয়ার পর ছাত্ররা শােভাযাত্রা বের করলে পুলিশ ছাত্র মিছিলের ওপর লাঠিচার্জ করে। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘটী ছাত্রদের ওপর পূর্বাহে ১৮ জুন পুলিশের লাঠিচার্জের ফলে বহু ছাত্র আহত ও গ্রেপ্তার হয়। একটি পরিসংখ্যান অনুসারে, নিরাপত্তা আইনে ১৯৬৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২২ জুন প্রতি ৪২ ঘণ্টায় একজন করে ছাত্র বা রাজনৈতিক কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।

১৯৬৬ সালেও এনএসএফ ক্যাডারদের সন্ত্রাসী তৎপরতী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অব্যাহত ছিল। ওই বছর জানুয়ারি। মাসে অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আৰু মাহমুদ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে একটি মামলায় জেতার কারণে এনএসএফ ক্যাডারদের দ্বারা নিজ বাসায় আক্রান্ত, প্রহৃত এবং গুরুতররূপে আহত হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্ররা ওই ঘটনার প্রতিকার। চেয়ে তীব্র আন্দোলন গড়ে তােলেন। ড. আবু মােহাম্মদ হাবিবুল্লাহর নেতৃত্বে প্রবীণ শিক্ষকদের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা সফরে আগত প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অপরাধীদের শাস্তি দাবি করেন। কিন্তু দোষীদের বিরুদ্ধে সরকার কোনাে প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। শােনা যায়, শিক্ষক প্রহারের জন্য দায়ী এনএসএফ ক্যাডাররা ওই সময় গভর্নর ভবনে নিরাপদ আশ্রয় লাভ করে। বস্তুত ষাটের দশকে আবদুল মােনেম খান পূর্ব পাকিস্তানে গভর্নর নিযুক্ত হয়ে আসার পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষক সমাজ সরকারের বিশেষ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। সামরিক স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলনকে দমন করার জন্য গভর্নর মােনেম খান একদিকে দালাল উপাচার্য, রেজিস্ট্রার, প্রক্টর, প্রভােস্ট, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও ছাত্রদের ব্যবহার অপরদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্র ও শিক্ষক এবং ছাত্র সংগঠনগুলাের ওপর দমন নীতির যে স্টিমরোলার চালায়, তা কার্যত বুমেরাং হয়ে পড়ে। তারা সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে সগ্রামে সংগঠিত হয়ে ওঠে । আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হলে ঐতিহাসিক ১১ দফার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধভাবে ছাত্রসমাজ যে গণআন্দোলনের সূচনা করে, তা মহান গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়ে আইয়ুব-মােনেম খানের পতনকে নিশ্চিত করে তােলে। জেল-জুলুম, লাঠি-গুলি-টিয়ার। গ্যাস, অনুগত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, ভাড়াটে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের সন্ত্রাস, কোনাে নিপীড়ননির্যাতন ও দমন নীতি যে গণআন্দোলন এবং গণজাগরণকে দমিয়ে রাখতে পারে না, বিশ শতকের ষাটের দশকের বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস সে শিক্ষাই দেয়।

 

সূত্র : স্বাধীনতা সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় – রফিকুল ইসলাম

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!