পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূচনা
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগ এবং পাকিস্তান ডােমিনিয়ন সৃষ্টির আগে চল্লিশের দশকের প্রথমার্ধের বছরগুলাে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য দুঃসময়। ঢাকা শহরের হিন্দুমুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রভাবে ১৯২১ সালের পর চল্লিশ দশকের প্রথমার্ধে দুজন মুসলমান ছাত্র মােতাহার হােসেন এবং নাজির আহমদ ক্যাম্পাসে ছুরিকাবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ ভবন সেনাবাহিনীর হুকুম দখলে চলে যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে ঢাকা ও ফজলুল হক হল এবং কার্জন হল এলাকার ভবনগুলােতে। তেতাল্লিশের মন্বন্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংখ্যা সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসে। দুর্ভিক্ষ শেষ হয়, যুদ্ধ থামে কিন্তু সাম্প্রদায়িক সংঘাত বাড়ে। এরই মধ্যে ১৯৪৫ সালের শেষদিকে কেন্দ্রীয় আইনসভা আর ১৯৪৬ সালের প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনে পাকিস্তান ইস্যুর ভিত্তিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মুসলিম লীগ অবিভক্ত বাংলায় আশাতীত সাফল্য অর্জন করে। যার মূলে ছিলাে মুসলমান ছাত্রসমাজের ভূমিকা আর তার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম কর্তৃক ঢাকার ১৫০ নং মােগলটুলিতে ১৯৪৪ সালের ৯ এপ্রিল স্থাপিত মুসলিম লীগ কর্মীশিবির। ১৯৪৫-৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচন ও সিলেটের গণভােটের ফলাফল নির্ধারণে ওই কর্মীশিবিরের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বলা বাহুল্য, ওই কর্মীশিবিরের কর্মীদের অধিকাংশই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক বা তৎকালীন ছাত্রনেতা ও কর্মী। পাকিস্তান রাষ্ট্র স্থাপিত হওয়ার পর সরকারবিরােধী সংগঠন, আন্দোলন ও টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনে বিজয়ের মূলে ছিল ওই কর্মীশিবির। অবিভক্ত ভারত ও বাংলার শেষ সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগের সাফল্যের পেছনে কাজ করেছিল অবিভক্ত বাংলার শেষ প্রধানমন্ত্রী হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী এবং মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিমের সংগঠন-শক্তি; কিন্তু দেশবিভাগ এবং নবসৃষ্ট পূর্ববাংলার চিফ মিনিস্টার করা হলাে ঢাকা নবাব পরিবারের খাজা নাজিমউদ্দিনকে।
দেশবিভাগের প্রাক্কালে তিনি ঢাকায় চলে আসেন এবং ১৯৪৭ সালের ১৪-১৫ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কার্জন হলের সামনে একটি অনুষ্ঠানে পাকিস্ত েিনর প্রথম ‘আজাদী দিবস’ উদযাপন করেন। তিনি কার্জন হল প্রাঙ্গণে ১৫ আগস্ট সকালে (করাচিতে অনুষ্ঠান হয় ১৪ আগস্ট রাত বারােটা এক মিনিটে সিন্ধু প্রাদেশিক ভবনে) মুসলিম লীগের সবুজ চাদ-তারা মার্কা পতাকা (পাকিস্তানের পতাকা তখনাে তৈরি হয়নি) উত্তোলন করেন। গার্ড অফ অনার প্রদান করে একজন ব্রিটিশ সামরিক অফিসারের কমান্ডে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একদল শিখ সেনা (তখনাে ভারতে প্রেরিত হয়নি)। পাকিস্তানের পূর্ববাংলা প্রদেশের রাজধানী হলাে ঢাকার রমনায় ঢাকা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও আশে পাশের এলাকা জুড়ে। ঢাকা রমনায় পূর্ববাংলা প্রদেশের রাজধানী স্থাপিত হওয়ার ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ভবন হাতছাড়া হয়ে যায় । জগন্নাথ হল মিলনায়তনে স্থাপিত হয় পূর্ববাংলা ব্যবস্থাপক সভা বা আইন পরিষদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্ট ভবনে। পূর্ববাংলার হাইকোর্ট। ছাত্রাবাস বর্ধমান হাউসে চিফ মিনিস্টার বা মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন আর ইডেন কলেজ ভবনে পূর্ববাংলা সেক্রেটারিয়েট। ক্যাম্পাস সংলগ্ন নীলক্ষেতপলাশি ব্যারাকে স্থাপিত হয় কলকাতা থেকে আসা সেক্রেটারিয়েটের কেরানিদের আবাস। সেক্রেটারিয়েটের কাছের বাংলােগুলাে মন্ত্রীদের বাসভবন করার জন্য রিকুইজিশন করা হয়। মােটকথা, ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের এবং ঢাকা রমনায় পূর্ববাংলা প্রদেশের রাজধানী স্থাপনের চাপ সম্পূর্ণভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ওপর এসে পড়ে। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট থেকে পূর্ববাংলা সরকারের আইনসভা, সচিবালয়, হাইকোর্ট, মুখ্যমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীর বাসভবন, সচিবালয়ের কর্মচারীদের আবাস সবকিছুই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বা সংলগ্ন এলাকায়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার লগ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সরকারের চাপ তেমন টের পায়নি। কারণ বাঙালি মুসলমান মথ্যবিত্ত সমাজ তখন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আনন্দে ও ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিভাের।
বাঙালি মুসলমান সমাজের এই স্বপ্নভঙ্গ বা মােহ কাটতে কিছু সময় লাগলেও তা দীর্ঘ ছিল না। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশের মানুষ প্রথম হোঁচট খেয়েছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে। ভারতে যে হিন্দি রাষ্ট্রভাষা হবে তা ছিল অবধারিত। ওই প্রেক্ষাপটে ভবিষ্যৎ পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে যখন আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুর নাম প্রস্তাব করেন, তখন কিন্তু কলকাতার খুব একটা প্রতিক্রিয়া হয়নি। কলকাতার পুর্ব পাকিস্ত নি রেনেসাঁ সােসাইটি এবং দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকায় আবদুল হক, আবুল মনসুর আহমদ যথাক্রমে পূর্ববাংলার সরকারি ভাষা’ ও ‘পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাভাষার নাম যুক্তিতর্কসহ উপস্থাপন করেন। কিন্তু ড. জিয়াউদ্দিনের প্রস্তাবের যথাযথ জবাব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই দেয়া হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র এক মাস আগে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য। ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ প্রস্তাব করেন, ভারতে যেমন হিন্দি রাষ্ট্রভাষা হতে চলেছে, পাকিস্তানে তেমনি উর্দু রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত।
ড. জিয়াউদ্দিনের ওই বক্তব্যের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় উপযুক্ত প্রতিবাদ জানান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি লেখেন, অধিকাংশ জনসংখ্যার ভাষা হিসেবে বাংলাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত, যদি দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা গ্রহণ করার প্রয়ােজন হয় তখন উর্দুর কথা বিবেচনা করা যেতে পারে। বস্তুত কলকাতাবাসী বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সােসাইটির সদস্যরা যেখানে ১৯৪৪ সালে পূর্ববাংলার সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলার নাম প্রস্তাব করেছিলেন, সেখানে দেশবিভাগের প্রাক্কালে কলকাতার দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকায় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপক বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তুলেছিলেন। ১৯৪৪ থেকে ১৯৪৭-মাত্র তিন বছরে কী অভিনব রূপান্তর! পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক মাসের মধ্যে ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রাষ্ট্রভাষা ও পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা-সমস্যা’ নামক একটি দীর্ঘ প্রবন্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার তরুণ অধ্যাপক কাজী মােতাহার হােসেন লিখেছিলেন, কোনাে দেশের লােকে যে ভাষায় কথা বলে, সেইটিই সে দেশের স্বাভাবিক ভাষা। প্রশ্ন উঠতে পারে, তবে আবার পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা সম্বন্ধে সমস্যা ওঠে কি করে?…পাঠান রাজত্বে রাজভাষা ছিল পশতু আর মােগল আমলে ফার্সি। মােগল পাঠানেরা বিদেশী হলেও এ দেশকেই জন্মভূমিরূপে গ্রহণ করেছিলেন এবং দেশের অবস্থা জানবার জন্য দেশীয় ভাষাকে যথেষ্ট উৎসাহ দিয়েছিলেন। …ভাষার বাধা একটি জাতিকে কিভাবে পঙ্গু করে রাখতে পারে তার উদাহরণ তাে আমরাই। অর্থাৎ ভারতের হিন্দু-মুসলমান এবং বিশেষ করে পূর্ববাংলার মুসলমানেরাই ।…
ভারতের হিন্দু-মুসলমানের এই সাধারণ পঙ্গুতার উপরেও, বিশেষ করে পূর্ববাংলার মুসলমানের আড়ষ্টতার আরাে দুটি কারণ ঘটেছিল। প্রথমটি মাতৃভাষা বাংলার প্রতি অবহেলা, আর দ্বিতীয়টি ধর্মীয় ভাষা সম্পর্কিত মনে করে বাংলার পরিবর্তে উর্দুর প্রতি অহেতুক আকর্ষণ বা মােহ।…এই দৈন্য ও হীনমন্যতার আসল কারণ, আমরা মাতৃভাষা বাংলাকে অবহেলা করে ফাকা ফঁাকা অস্পষ্ট বুলি আওড়াতে আরম্ভ করেছি।…শিক্ষার বাহন অবশ্যই মাতৃভাষা হবে। জগতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হলে হয়তাে ইংরেজি ভাষাই আমাদের পক্ষে সবচেয়ে সুবিধাজনক হবে। কিন্তু এর ওপর অত্যধিক জোর দেয়া এখন। সম্পূর্ণ অনাবশ্যক । রাষ্ট্রের ভিন্ন প্রদেশীয় লােকদের বা প্রতিবেশীদের সঙ্গে যােগ রাখতে হলে আমার বিবেচনায় পণ্ডিতি ও মৌলভী-উর্দুর মাঝামাঝি ধরনের উর্দুই সবচেয়ে বেশি উপযােগী হবে। এদিক দিয়ে বর্তমানে উর্দুভাষারও সংস্কার করা আবশ্যক ।…সমগ্র পাকিস্তান রাষ্ট্রের বাংলা ভাষাভাষী হিন্দু-মুসলমানই সংখ্যায় গরিষ্ঠ । তবু আমরা পশ্চিম পাকিস্তানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষপাতী নই। কারণ তাতে পশ্চিম পাকিস্তানের জনসাধারণের স্বাভাবিক বিকাশে বাধার সৃষ্টি হবে। সুতরাং পশ্চিম পাকিস্তানে উর্দু বা পশতু এবং পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাই রাষ্ট্রভাষা হবে।…রাশিয়ার পরস্পর-সংলগ্ন ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রে যদি একাধিক রাষ্ট্রভাষা হতে পারে, তাহলে পাঞ্জাব ও পূর্ববাংলার মতাে হাজার-দেড় হাজার মাইল ব্যবধানে অবস্থিত পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানে অবশ্যই দুটি রাষ্ট্রভাষা হতে পারে এবং তাই স্বাভাবিক।…বর্তমানে যদি গায়ের জোরে উর্দুকে বাঙালি হিন্দুমুসলমানের ওপর রাষ্ট্রভাষারূপে চালাবার চেষ্টা হয়, তবে সে চেষ্টা ব্যর্থ হবে। কারণ ধূমায়িত অসন্তোষ বেশিদিন চাপা থাকতে পারে না। শীঘই তাহলে পূর্বপশ্চিমের সম্বন্ধে অবসান হওয়ার আশঙ্কা আছে।… লক্ষণীয় যে, কাজী মােতাহার হােসেন ভাষার প্রশ্নে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সম্পর্কের অবসানের কথা বলেছিলেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক মাসের মধ্যেই। কোনাে প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি প্রথম উত্থাপন করে তমদুন মজলিশ। ১৯৪৭ সালের ১লা সেপ্টেম্বর। তমদুন মজলিশের প্রতিষ্ঠাতা এবং বাংলাভাষা আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ অধ্যাপক আবুল কাশেম ছিলেন ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক। তমদুন মজলিশের সক্রিয় সদস্যদের অধিকাংশই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা ছাত্র, অফিস ছিল পুরনাে কলাভবন সংলগ্ন রশীদ। বিল্ডিং-এ। তমদুন মজলিশের পক্ষ থেকে প্রচারিত প্রস্তাব ১লা সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ ছিল সংক্ষেপে নিম্নরূপ,
১. বাংলাভাষাই হবে।
(ক) পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন; (খ) পূর্ব পাকিস্তানের আদালতের ভাষা;
(গ) পূর্ব পাকিস্তানের অফিসাদির ভাষা।
২, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের রাষ্ট্রভাষা হবে দুটি-উর্দু ও বাংলা।
৩. (ক) বাংলাই হবে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা বিভাগের প্রধান ভাষা;
(খ) উর্দু হবে দ্বিতীয় ভাষা বা আন্তঃপ্রাদেশিক ভাষা; (গ) ইংরেজি হবে পূর্ব পাকিস্তানের তৃতীয় ভাষা বা আন্তর্জাতিক ভাষা ।…ঠিক
একই নীতি হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলােতে সেখানকার স্থানীয় ভাষা ও উর্দু প্রথম ভাষা, বাংলা দ্বিতীয় ভাষা আর ইংরেজি তৃতীয় ভাষার স্থান অধিকার করবে।
৪. শাসনকার্য ও বিজ্ঞান শিক্ষার সুবিধার জন্য আপাতত কয়েক বছরের জন্য ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই পূর্ব পাকিস্তানের শাসনকার্য চলবে। ইতিমধ্যে প্রয়ােজন অনুযায়ী বাংলা ভাষার সংস্কার সাধন করতে হবে। কিন্তু পাকিস্তানের আদর্শে বিশ্বাসী ঢাকার তমদুন মজলিশের ওই গঠনমূলক প্রস্তাব যা নবগঠিত পাকিস্তানের সুষ্ঠু ভাষানীতির ভিত্তি হতে পারত, পাকিস্তানের উর্দু বা পাঞ্জাবিভাষী কেন্দ্রীয় শাসকদের কর্ণকুহরে তা প্রবেশ করেনি বা দৃশ্যমান হয়নি; অন্যথায় কীভাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র তিন মাস পরে ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানের রাজধানী করাচিতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব গৃহীত হয়? স্মরণীয় যে, পাকিস্তানের। প্রথম শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন বঙ্গসন্তান ফজলুর রহমান, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্র থেকেই প্রথম অবিভক্ত বাংলার আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষেই শুধু নয়-সঙ্গে সঙ্গে আরবি প্রকারান্তরে উর্দু হরফে বাংলা লেখার সবচেয়ে বড় প্রবক্তা ছিলেন। পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনের ওই সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অর্থাৎ উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব গ্রহণের সংবাদ ১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ইংরেজি দৈনিক মর্নিং নিউজ পত্রিকায় প্রকাশিত হলে ঢাকা শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ওইদিন দুপুরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অধ্যাপক আবুল কাশেমের সভাপতিত্বে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বক্তৃতা করেন বামপন্থী ছাত্রনেতা মুনীর চৌধুরী এবং প্রস্তাব পাঠ করেন ডাকসুর তদানীন্তন সহ-সভাপতি ফরিদ আহমদ। উভয়েই তখন কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠন ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তথা পূর্ববাংলায় এটাই প্রথম সভা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট আর তার ঠিক ১২২ দিন বা ৪ মাস ৭ দিন। পর ১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পুরনাে কলাভবন আমতলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্ররা প্রকাশ্য সভা করে বাংলাভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করেন। ওই সভা ছিল ঐতিহাসিক। কারণ ওই সভার সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাশেম ইসলামি আদর্শে বিশ্বাসী আর প্রধান বক্তা মুনীর চৌধুরী, প্রস্তাবক ফরিদ আহমদ বামপন্থী ছাত্রনেতা হওয়া সত্ত্বেও বাংলাভাষার প্রশ্নে ঐকমত্য পােষণ করেছিলেন। ওই সভার পর ছাত্ররা মিছিল করে সচিবালয়, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন (বর্ধমান হাউস) এবং মর্নিং নিউজ পত্রিকা অফিসের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ভাষার প্রশ্নে পাকিস্তানে প্রথম প্রকাশ্য সভা, শােভাযাত্রা ও বিক্ষোভ ডিসেম্বর ১৯৪৭ সালে অনুষ্ঠিত হয় আর পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা প্রশ্ন প্রথম পাকিস্তান গণপরিষদে আলােচিত হয় ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে। প্রসঙ্গটি উত্থাপিত হয়েছিল, পাকিস্তান গণপরিষদের আইনবিধি সংক্রান্ত কমিটির দ্বিতীয় বৈঠকে, (২৪ ও ২৫ ফেব্রুয়ারি এবং ২ মার্চ ১৯৪৮ সালে) ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন বিধির উনত্রিশ নং উপ-ধারা সংশােধনের জন্য ইংরেজি ভাষার সঙ্গে ‘উর্দু ভাষার নাম যুক্ত করার সরকারি প্রস্তাবে গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সংশােধনী প্রস্তাব ছিল, “That in sub-rule 29, after the word English’ in line 2, the words, or Bengali’ be inserted”। ওই প্রস্তাবে পাকিস্তান গণপরিষদে সদস্যরা যেসব ভাষা ব্যবহার করতে পারবেন তাতে বাংলা ভাষাকে যুক্ত করতে চাওয়া হয়েছিল। ওই সংশােধনী প্রস্তাবের সমর্থনেই প্রসঙ্গক্রমে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। পাকিস্তান গণপরিষদে সর্বপ্রথম নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নের উত্থাপন করেন, তিনি তার ভাষণে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে যে সারগর্ভ যুক্তি উত্থাপন করেন তার অংশবিশেষের উদ্ধৃতি, What should be the language of the state? The state language of the state should be the language which in used by the majority of the people of the state, and…I consider that Bengali language is a lingua franca of our state…if English can have an honoured place in rule 24the proceedings of the assembly should be conducted in Urdu or English, why Bengali, which is spoken by four crores fourty lakhs people should not have an honoured place…and therefore Bengali should not be treated as a provincial language. It should be treated as the language of the state and therefore…I suggested the after the word English’ the words for Bengali’ be inserted in rule 29.
ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের উক্ত সংশােধনী প্রস্তাবটি প্রবল সরকারি বিরােধিতার সম্মুখীন হয়, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নবাবজাদা লিয়াকত আলি খান ওই সংশােধনীর বিরােধিতায়। জ্বালাময়ী ভাষায় যুক্তিহীন এক ভাষণে বলেন, Pakistan has been created because of the demand of hundred million muslims in this sub-continent and the language of a hundred million muslims is Urdu and…Pakistan is a muslim state and it must have as its lingua franca the language of the muslim nation…Urdu can be the only language which can keep the people of East Bengal or Eastern zone and the people of Western zone joined together, it is necessary for a nation to have one language and that language can only be Urdu and no other language. প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের “The language of a hundred million muslims is Urdu’ এই যুক্তি ছিল হাস্যকর, কারণ ১৯২১ সালের ভারতীয় সেন্সস রিপাের্ট অনুযায়ী বাংলা ভাষাভাষী মুসলমানের সংখ্যা ছিল অবিভক্ত ভারতে মুসলমানদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি,
বাংলা ২৩,৯৯৫,০০০
উর্দু-হিন্দি ২০,১৯১,০০০
পাঞ্জাবি ৭,৭০০,০০০
সিন্ধি ২,৯১২,০০০
কাশ্মীরি ১,৫০০,০০০
পুশতু ১,৪৬০,০০০
বালুচি ২,২৪,০০০
ব্রাহুই ১,২২,০০০ জন।
পাকিস্তানে বিভিন্ন ভাষাভাষীর সংখ্যা ছিল ১৯৫১ সেন্সস রিপাের্ট অনুযায়ী,
বাঙালি ৫৪.৬,
পাঞ্জাবি ২৮,৪,
উর্দুভাষী ৭.২,
সিন্ধি ৫.৮,
পশতু ৭.১,
ইংলিশ ১.৮ শতাংশ।
পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সংশােধনী প্রস্তাবটি অগ্রাহ্য হয়, কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম লীগ দলীয় সদস্যরা, যাদের মধ্যে আবার সংখ্যায় বেশি ছিলেন পূর্ব বাংলা থেকে নির্বাচিত বাংলাভাষী সদস্য, ওই সংশােধনীর বিরুদ্ধে ভােট দেন; প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যক্ষ বাংলা ভাষা আন্দোলন সৃষ্টি হয়।
১৯৪৮ সালের বাংলা ভাষা আন্দোলনের প্রাক্কালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক প্রথম ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয় পুরনাে কলা ভবন সংলগ্ন রশীদ বিল্ডিংয়ে তমদুন মজলিসের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের সভায়। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম ইতিহাসকার বশীর আলহেলাল এ সম্পর্কে গাজীউল হকের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন,
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এটিই সর্বপ্রথম সংগ্রাম পরিষদ…পরিষদের আহ্বায়ক নিযুক্ত হন অধ্যাপক নুরুল হক ভূইয়া। তিনি তমদুন মজলিসের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। এ কমিটিতে অধ্যাপক আবুল কাশেম, তােয়াহা, নঈমুদ্দীন আহমেদ, জনাব শওকত, ফরিদ আহমদ এবং সম্ভবত আখলাকুর রহমান, আব্দুল মতিন খান চৌধুরী ও আজিজ আহমদ ছিলেন।…এ কমিটি বাংলা ভাষা আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে কতােগুলাে কর্মসূচি গ্রহণ করে।
(একুশের সঙ্কলন, স্মৃতিচারণ ১৯৮০)
অধ্যাপক নুরুল হক ভূইয়ার উদ্ধৃতি দিয়ে বশীর আলহেলাল আরাে জানিয়েছেন, অধ্যাপক ভূইয়া সদস্য হিসেবে আরাে কয়েকজন সদস্যের নাম উল্লেখ করেছেন, শামসুল আলম, আবুল খয়ের, আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী, অলি আহাদ।… সরদার। ফজলুল করিম সাহেব যদিও কমিটির সদস্য ছিলেন না, তবু তিনি সভায় উপস্থিত থাকতেন, মতবিনিময় করতেন।…পরে সলিমুল্লাহ হলের সহ-সভাপতি হিসেবে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে এবং ফজলুল হক হলের সহ-সভাপতি হিসেবে তােয়াহা। সাহেবকে সংগ্রাম পরিষদে নেয়া হয়। পরিষদের কাজকর্ম সব গােপনে করতে (একুশের সঙ্কলন, স্মৃতিচারণ ১৯৮০) পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সংশােধনী প্রস্তাব অগ্রাহ্য হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় পূর্ববাংলায় যে ভাষা আন্দোলনের সৃষ্টি হয় সে সম্পর্কে ভাষাসৈনিক আহমদ রফিক ভাষা আন্দোলন : ইতিহাস ও উত্তর প্রভাব’ (সময় প্রকাশন, বইমেলা ২০০২) গ্রন্থে লিখেছেন, স্বভাবতই লীগ নেতৃত্বের ভাষাবিষয়ক মনােভাবের প্রতিক্রিয়ায় ঢাকাসহ গােটা দেশে প্রতিবাদ বিক্ষোভ দেখা দেয়। মূলত ছাত্রসমাজ এতে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদও নতুনভাবে গঠিত হয় (২ মার্চ)। নয়া আহ্বায়ক হন শামসুল আলম । পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাভাষার দাবিতে ছাত্র এলাকায়। নতুন তৎপরতা দেখা দেয়। তমদুন মজলিস ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের ভাষা বিষয়ক যৌথ কমিটির এক সভায় বাংলা ভাষা সম্পর্কে পাকিস্তান গণপরিষদ ও লীগ নেতৃবৃন্দের ভূমিকার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তুলতে ১১ মার্চ দেশব্যাপী ধর্মঘট ও অন্যান্য কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সভায় বাংলাকে অবিলম্বে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি ভাষা হিসেবে ঘােষণার দাবি জানানাে হয় এবং ঘােষিত আন্দোলন সফল করে তােলার জন্য সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি আহ্বান জানানাে হয় ।
(দৈনিক আজাদ, ২ মার্চ ১৯৪৮)
আহমদ রফিক আরাে জানিয়েছেন,
প্রকৃতপক্ষে ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে প্রতিদিন ছাত্র এলাকায় ভাষার দাবিতে বিভিন্ন ধরনের তৎপরতা পরিলক্ষিত হতে থাকে। ক্লাস বর্জন, সভা, সমাবেশ, মিছিল, বিবৃতি প্রচার, ইশতেহার বিলি ইত্যাদি কর্মকাণ্ড তার প্রমাণ। এ ছাড়াও মুসলিম ছাত্রলীগের মহিলা সংগঠন-সম্পাদিকা এক বিবৃতিতে পাকিস্তান গণপরিষদের বাংলা ভাষা বিষয়ক ভূমিকার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান এবং দেশের ছাত্রসমাজের প্রতি বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আপােষহীন সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আবেদন জানান। (আনন্দবাজার পত্রিকা, ৫ মার্চ ১৯৪৮) … ৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত ছাত্র সভায় ইনসাফ, ফরিয়াদ পত্রিকা এবং কমিউনিস্ট পার্টি অফিসে পুলিশি হামলার নিন্দা করা হয় এবং সেই সঙ্গে ১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট পালনের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ এবং যুব ও ছাত্রসমাজের প্রতি আহ্বান জানানাে হয় ।
১১ মার্চ ১৯৪৮ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালন এবং হাইকোর্ট, সেক্রেটারিয়েট প্রভৃতি সরকারি স্থাপনার সামনে পিকেটিং এবং বিক্ষোভ মিছিল হয়। এই আন্দোলনে সচিবালয় ও হাইকোর্ট সংলগ্ন ফজলুল হক হল এবং মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্ররা প্রধানত রাজপথের প্রত্যক্ষ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন, সংগ্রাম পরিষদের ছাত্রনেতারা প্রায় সকলেই সকাল থেকে পিকেটিংয়ে যােগ দেন। পুলিশ বেপরােয়া লাঠিচার্জ এবং ব্যাপক গ্রেপ্তারের মাধ্যমে আন্দোলনরত ছাত্রদের পিকেটিং ভেঙে দেয়ার চেষ্টা করে। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চের ঘটনাবলী সম্পর্কে ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন গ্রন্থে বিবরণী রয়েছে, তার পুনরাবৃত্তি না করে আহমদ রফিকের ‘ভাষা আন্দোলন : ইতিহাস ও উত্তর প্রভাব’ গ্রন্থ থেকে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় ১২ মার্চ ঢাকা থেকে প্রেরিত প্রতিবেদনটি উদ্ধৃত করছি। এখানে এমন কিছু তথ্য আছে যা ভাষা আন্দোলন সম্পর্কিত অনান্য গ্রন্থে নেই, সেক্রেটারিয়েট ও বিভিন্ন সরকারি অফিসের সম্মুখে পুলিশের ব্যাটন চার্জের ফলে বাংলার ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী মি, এ. কে. ফজলুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের ভাইস প্রেসিডেন্ট মি, মােহাম্মদ তােয়াহা ও ‘তমদুন মজলিসের সম্পাদক অধ্যাপক এ. কাশেম সহ প্রায় পঞ্চাশজন আহত হইয়াছে। …সকাল হইতেই মুসলমান ছাত্ররা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হইয়া সেক্রেটারিয়েট, হাইকোর্ট, পােস্ট অফিস, টেলিগ্রাফ অফিস প্রভৃতি সরকারি অফিসগুলাের সম্মুখে পিকেটিং করিতে আরম্ভ করে। সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী আসিয়া তাহাদিগকে ছত্রভঙ্গ করিয়া দেয় এবং কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে। সেক্রেটারিয়েটের সম্মুখে পুলিশের ব্যাটন চার্জের ফলে পিকেটিংরত বহু ব্যক্তি আহত হয়। যে সকল সরকারি কর্মচারী সেক্রেটারিয়েটে পূর্বেই প্রবেশ করিয়াছিল, তাহারা লাঠিচার্জের সংবাদ শুনিয়া বাহিরে আসে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বায়ক মি. নঈমুদ্দিনের সভাপতিত্বে ছাত্র ও পিকেটারদের একটি সভা হয়। সভায় পুলিশ জুলুমের তীব্র প্রতিবাদ করিয়া মন্ত্রীমণ্ডলীর কার্যের নিন্দা করা হয়। গণপরিষদের (পূর্ব পাকিস্তানের সদস্যদের) পদত্যাগের দাবি জানাইয়া প্রস্তাব গৃহীত হয়। সভার পর ধর্মঘটীরা মন্ত্রী-বিরােধী শ্লোগান দিতে দিতে পােস্টার কাধে করিয়া শােভাযাত্রা বাহির করে বাংলা ভাষা স্বীকার করিয়া লইবার দাবি তাহারা জানায়। বহুসংখ্যক সশস্ত্র পুলিশ হাইকোর্টের নিকট শােভাযাত্রাকারীদিগকে বাধা দেয় । কিন্তু শােভাযাত্রাকারীদের মধ্যে একদল লােক কোনক্রমে সেক্রেটারিয়েটের উত্তর ফটকের নিকট চলিয়া আসে। সশস্ত্র পুলিশের লাঠি চালাইয়া, বন্দুকের কুঁদা মারিয়া তাহাদিগকে ‘তাড়াইয়া দেয়। প্রায় ২০ জন ছাত্র আহত হইয়াছে। ধর্মঘটের ফলে বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। পুলিশেরা বিভিন্ন সরকারি অফিসগুলিতে পাহারা দেয় । অপরাহ্ন ৩টা পর্যন্ত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৪০ জন আহতকে ভর্তি করা হয়। মি, ফজলুল হক ও আরাে অনেককে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ছাড়িয়া দেওয়া হয়। সকালে ১০০ লােকের একটি জনতা রেলওয়ে শ্রমিক ইউনিয়নের অফিস, কমিউনিস্ট পার্টির পূর্ব পাকিস্তান আঞ্চলিক অফিস ও জেলা কমিউনিস্ট পার্টির ইউনিয়নের অফিসে হানা দিয়া আসবাবপত্র ও কাগজের ফাইলে অগ্নিসংযােগ করে। ‘ন্যাশনাল বুক এজেন্সি’ নামক পুস্তকের দোকানে হানা দিয়া প্রায় ৫ হাজার টাকা মূল্যের পুস্তক লুট করিয়াছে ও নগদ ২০০ টাকা লইয়া গিয়াছে। বলিয়া প্রকাশ।
এইসব হামলাকারীরা ছিল প্রধানত ভারত থেকে আগত বিহারী মােহাজের এবং কিছু ঢাকার উর্দুভাষী আদিবাসী । আনন্দবাজার পত্রিকা কলকাতা থেকে প্রকাশিত হলেও পত্রিকার ঢাকাস্থ প্রতিনিধি ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবসে সংঘটিত ঘটনাবলীর যে বিবরণ দিয়েছেন তা বস্তুনিষ্ঠ এ কথা প্রত্যক্ষদর্শী মাত্রই স্বীকার করবেন । জিন্নাহ সাহেব ঘােষিত ভারতের দশ কোটি মুসলমানের মাতভূমি পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকায় ভাষার প্রশ্নে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকার এবং পাকিস্তান আন্দোলনের ভ্যানগার্ড’ বাঙালি মুসলমান ছাত্রসমাজের এই প্রথম মােকাবেলা ছিল বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। গ্রেপ্তারকৃত ছাত্রনেতা শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, শওকত আলী, কাজী গােলাম মাহবুব প্রমুখ। ছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী। বলা চলে, যে ছাত্রসমাজের জন্য ১৯৪৫/৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে অবিভক্ত বাংলায় পাকিস্তান ইস্যুকে ভিত্তি করে নিরঙ্কুশ বিজয় এবং পাকিস্তান অর্জন সম্ভবপর হয়েছিল সে ছাত্রনেতাদের সঙ্গে বাংলা ভাষার দাবি উচ্চারণের অপরাধে খাজা নাজিমুদ্দিনের মুসলিম লীগ সরকার পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ৬ মাস পরেই যে আচরণ করে তা অভিনব বটে। আশ্চর্যের কিছুই নেই যে, লাহাের প্রস্তাবের উত্থাপক এবং পরবর্তীকালে মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কৃত বাঙালি মুসলমান সমাজে এক কালের কিংবদন্তীর এবং পরে অপাংক্তেয় নেতা শেরে বাংলাকেই ১৯৪৮ সালের ১৩ মার্চ আজাদ পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে ১১ মার্চের দমননীতির প্রতিবাদ জানাতে হয়েছিল, ‘এইসব ঘটনার প্রতিবাদ আমাদের ক্ষোভ প্রকাশের উপযুক্ত ব্যবস্থা।
যদি সরকার না করেন তাহা হইলে ইহার প্রতিবাদে পরিষদের সকল সদস্যের পদত্যাগ করা উচিত, আমি সর্বসাধারণ্যে ঘােষণা করিতেছি যে, ঢাকার নিরীহ ও নির্দোষ ছাত্রদের উপর পুলিশ আক্রমণের প্রতিবাদে আমিই প্রথম পদত্যাগ করিব।’ কিন্তু তখন পর্যন্ত মুসলিম লীগের বা সরকারের বিরােধিতা করার মতাে কোনাে রাজনৈতিক, যুব বা ছাত্র সংগঠন গড়ে ওঠেনি। মূলত ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা ও কর্মীদের নিয়ে পুনর্গঠিত ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বেই ১৯৪৮ সালের ১১ থেকে ১৫ মার্চ অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রাজপথে প্রথম সরকারবিরােধী আন্দোলন হয়েছিলাে। ১৯৪৮ সালে বাংলাভাষা আন্দোলন ১১ মার্চে ঢাকা শহরেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ঢাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতাদের পরিচালনায় প্রদেশব্যাপী বিস্তার লাভ করে। যদিও শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, শওকত আলী, কাজী গােলাম মাহবুব প্রমুখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা ১১ মার্চ পিকেটিংরত অবস্থায় গ্রেপ্তার এবং ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি হন, তবু আন্দোলন চলতে থাকে। ১৫ মার্চ পর্যন্ত ছাত্রনেতারা একটানা ধর্মঘটের ঘােষণা দেন। ওদিকে ১৫ মার্চ পূর্ববাংলা ব্যবস্থাপক সভার অধিবেশন শুরু হওয়ার কথা, তখন আইনসভা বসতাে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থিত জগন্নাথ হল মিলনায়তনে। এছাড়াও পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকা সফরে আসার কথা। ফলে আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে পূর্ববাংলার চিফ মিনিস্টার খাজা নাজিমউদ্দিন বিপাকে পড়ে যান। আন্দোলনকে থামানাের জন্য তিনি কূটকৌশলের আশ্রয় নেন। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পর তিনি পিছু হটেন, সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে আট দফা চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হয় ১৫ মার্চ। চুক্তির শর্তাবলী ঢাকা জেলে বন্দি ছাত্রনেতা শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, শওকত আলী, কাজী গােলাম মাহবুবের কাছ থেকে অনুমােদন করিয়ে নিয়ে আসেন সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে কামরুদ্দিন আহমদ। পূর্ববাংলা সরকারের পক্ষে চিফ মিনিস্টার খাজা নাজিমউদ্দিন আর সংগ্রাম। পরিষদের পক্ষে কামরুদ্দিন আহমদ যে চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করেন, তার আট দফা ছিলাে,
১, ২৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮ হইতে বাংলাভাষার প্রশ্নে যাহাদিগকে গ্রেফতার
করা হইয়াছে, তাহাদিগকে অবিলম্বে মুক্তিদান করা হইবে;
২. পুলিশ কর্তৃক অত্যাচারের অভিযােগ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং তদন্ত করিয়া
এক মাসের মধ্যে এ বিষয়ে একটি বিবৃতি প্রদান করিবেন;
৩. ১৯৪৮-এর এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে পূর্ববাংলা সরকারের ব্যবস্থাপক সভার বেসরকারী আলােচনার জন্য যে দিন নির্ধারিত হইয়াছে, সেই দিন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করিবার এবং তাহাকে পাকিস্তান গণপরিষদ ও কেন্দ্রীয়
সরকারের পরীক্ষা দিতে উর্দুর সমমর্যাদা দানের জন্য একটি বিশেষ প্রস্তাব উত্থাপন করা হইবে;
৪. এপ্রিল মাসে ব্যবস্থাপক সভায় এই মর্মে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হইবে।
যে, প্রদেশের সরকারী ভাষা হিসাবে ইংরেজি উঠিয়া যাওয়ার পরই বাংলা তাহার স্থলে সরকারী ভাষারূপে স্বীকৃত হইবে । ইহাছাড়া শিক্ষার মাধ্যমও হইবে বাংলা। তবে সাধারণভাবে স্কুল-কলেজগুলিতে অধিকাংশ ছাত্রের মাতৃভাষার মাধ্যমেই শিক্ষাদান করা হইবে;
৫, আন্দোলনে যাহারা অংশগ্রহণ করিয়াছেন, তাহাদের কাহারাে বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে না;
৬. সংবাদপত্রের ওপর হইতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হইবে;
৭. ২৯ শে ফেব্রুয়ারি হইতে পূর্ববাংলার যে সকল স্থানে ভাষা আন্দোলনের | জন্য ১৪৪ ধারা জারী করা হইয়াছে, তাহা প্রত্যাহার করা হইবে; ৮, সংগ্রাম পরিষদের সহিত আলােচনার পর আমি এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হইয়াছি যে এই আন্দোলন রাষ্ট্রের দুশমন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় নাই। ওই চুক্তির শর্তগুলাে ১৬ মার্চ ১৯৪৮ কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে এ সংবাদও ছাপা হয় যে, ভাষা সম্পর্কিত আপােষ প্রস্তাব স্বাক্ষরিত হওয়া সত্ত্বেও আজ প্রায় এক হাজার লােক পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদের সম্মুখে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। চুক্তি অনুসারে ১৫ মার্চ সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্দি ছাত্রনেতাদের মুক্তি দেয়া হয়; কিন্তু ১৬ মার্চেও বিক্ষোভ অব্যাহত থাকে। ১৬ মার্চ সদ্য কারামুক্ত ছাত্রনেতা শেষ মুজিবের সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠের পুকুর পাড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের এক সাধারণ সভার পর তারই নেতৃত্বে ছাত্ররা শােভাযাত্রা সহযােগে পরিষদ। ভবনে যায় এবং পরিষদ ঘেরাও ও সন্ধ্যা পর্যন্ত বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এই বিক্ষোভকারীদের ওপরও পুলিশি হামলা চলেছিল।
ওই আন্দোলনের তীব্রতা কেমন ছিল, তার পরিচয় পাওয়া যায় পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তদানীন্তন জিওসি ব্রিগেডিয়ার আইয়ুব খানের বিবরণী থেকে। তার ফ্রেন্ডস নট মাস্টার্স’ গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ প্রভু নয় বন্ধু’ (পৃ. ৩৮) গ্রন্থে তিনি লিখেছেন : তিনি মেজর পীরজাদার নেতৃত্বে একদল পদাতিক সৈন্য নিয়ােগ করেন এবং স্বয়ং পরিষদে গিয়ে চিফ মিনিস্টার খাজা নাজিমউদ্দিনকে পরিষদ ভবনের (জগন্নাথ হলের পুরনাে মিলনায়তন) বাবুর্চিখানার মধ্য দিয়ে বাইরে পাচার করেন। যা-ই হােক, খাজা নাজিমউদ্দিন এবং কামরুদ্দিন আহমদ স্বাক্ষরিত চুক্তিপত্রের পাঠ থেকে স্বীকৃতি মেলে যে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন রাষ্ট্রের দুশমনদের দ্বারা অনুপ্রাণিত ও প্রচলিত-এই সরকারি প্রচারণা বাংলাভাষা আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করার জন্যই করা হয়েছিল। পূর্ববাংলার চিফ মিনিস্টার খাজা নাজিমউদ্দিন ও রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের মধ্যে চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হওয়ার মাত্র চারদিন এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সাত মাস পর পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ পূর্ববাংলার রাজধানী ঢাকায় তসরিফ আনেন। জিন্নাহ সাহেব ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ রমনার রেসকোর্স ময়দানে এক বিরাট জনসভায় বক্তৃতা করেন। জিন্নাহ। সাহেব চালচলনে ছিলেন রীতিমতাে সাহেব এবং ইংরেজি ছিল তার মাতৃভাষার মতো; কিন্তু ঢাকা রেসকোর্স ময়দানের বিরাট জনসভায় অপ্রতুল মাইক্রোফোন ব্যবস্থায় তিনি জিন্নাহ টুপি ও শেরওয়ানি পরে উর্দুভাষায় বক্তৃতা করেন, যা তার মাতৃভাষা ছিল না। রমনার মাঠে বিশাল জনসভায় হৈ-চৈয়ের মধ্যে উপস্থিত শ্রোতারা তার বক্তব্য কতটা অনুধাবন করতে পেরেছিল, সন্দেহ রয়েছে। আহমদ রফিক, জিন্নাহর রেসকোর্স ময়দানের ভাষণ সম্পর্কে লিখেছেন, প্রায় এক ঘণ্টা (আনন্দবাজার পত্রিকার হিসাবে ৫০ মিনিট) স্থায়ী দীর্ঘ বক্তৃতায় মি. জিন্নাহ দেশবিভাগের সময়ে পাঞ্জাবে সংঘটিত হিংসাত্মক ঘটনা, শরণার্থী সমস্যা, পূর্ব পাকিস্তানের সম্ভাব্য উন্নয়ন, পূর্ববঙ্গ সরকারের প্রশাসনিক দক্ষতা, সংখ্যালঘু সমস্যা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কথা বলেন।…তার বক্তৃতার বড় অংশ জুড়ে থাকে প্রাদেশিকতা, আন্দোলন, বিচ্ছিন্নতাবােধ, দেশে ভারতীয় চর, কমিউনিস্ট ও পঞ্চম বাহিনীর উপস্থিতি, রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গ এবং সেই সঙ্গে মুসলমান। জাতি ও জাতীয়তা এবং ইসলামি সংস্কৃতির কথা। থাকে মুসলিম লীগ দলের অপরিহার্য প্রয়ােজনের কথা এবং সর্বশক্তি দিয়ে মুসলিম লীগের খেদমত করার কথা । পরবর্তী বক্তৃতাগুলাের সুর (কার্জন হলে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ও পূর্ব পাক বেতারে) কিছুটা সংক্ষিপ্ত হলেও একই তারে বাঁধা ছিল। তিনটি বক্তৃতারই মূল কথা ছিল তিনটি-উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা হবে; কমিউনিস্ট ও বিদেশী অর্থপুষ্ট চর এবং পঞ্চম বাহিনীর বিরুদ্ধে পাকিস্তান রক্ষার উদ্দেশ্যে সতর্কতা ও ব্যবস্থা গ্রহণ এবং মুসলিম লীগে যােগ দিয়ে জাতি ও রাষ্ট্রের খেদমতে নিবেদিতপ্রাণ হওয়া।
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও উত্তর প্রভাব, সময় : বইমেলা ২০০০ যারা আশা করেছিলেন ভাষার প্রশ্নে জিন্নাহ সাহেব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ। অধিবাসী বাঙালির মাতৃভাষার প্রতি সহানুভূতিশীল হবেন, তারা পাকিস্তানের স্থপতি কায়েদে আজমের বক্তব্য শুনে যে চরমভাবে হতাশ হয়েছিলেন, তা বলাই বাহুল্য। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে জিন্নাহ সাহেব রমনা ময়দানের উর্দু ভাষণে যা বলেছিলেন তার বাংলা অনুবাদ, …এটা আপনাদের কাছে স্পষ্ট করে বলে দেয়া যাচ্ছে যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। হবে উর্দু, অপর কোনাে ভাষা নয়। যদি আপনাদের কেউ বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেন, তিনি হবেন পাকিস্তানের প্রকৃত শক্র। একটি রাষ্ট্রভাষা ছাড়া কোনাে জাতিই দৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ ও টিকে থাকাতে পারে না। সুতরাং রাষ্ট্রভাষার ব্যাপারে উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।
রমনার জনসভাতেই জিন্নাহ সাহেবের ওই ঘােষণার প্রতিবাদে ঢাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ছাত্রকর্মীরা ‘নাে’ ‘নাে’ শ্লোগান দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ ২৪ মার্চ ১৯৪৮ কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনী ভাষণে তার বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করে ইংরেজি ভাষায় যা। বলেছিলেন, তার সারমর্ম, কেবল একটি রাষ্ট্রভাষাই থাকতে পারে। যদি এই রাষ্ট্রের গঠনকারী ইউনিটসমূহ ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে সেই ভাষা, আমার মতে কেবল উর্দুই হতে পারে। পাকিস্তানের জনক কায়েদে আজম মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঘােষণা সমাবর্তনে অংশগ্রহণকারী ছাত্রদের প্রতিবাদসূচক ‘না’ ‘না’ ধ্বনি দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। তবু শেষ চেষ্টা করার জন্য রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতা, যাদের মধ্যে ছিলেন কামরুদ্দিন আহমদ, শামসুল হক, আবুল কাশেম, তাজউদ্দিন আহমদ, নঈমুদ্দিন আহমদ, শামসুল আলম, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, অলি আহাদ, অরবিন্দ বসু প্রমুখ জিন্নাহ সাহেবের সঙ্গে দেখা করেন এবং বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে একটি স্মারকলিপি দেন। জিন্নাহ সাহেব যথারীতি তাদের দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। ডাকসু সহ-সভাপতি অরবিন্দ বসু প্রতিনিধি দলে থাকায় প্রথমে জিন্নাহ সাহেব এই প্রতিনিধি দলের সঙ্গে কথা বলতে চাননি কারণ তিনি হিন্দু। কিন্তু ডাকসু ভিপি ছাড়া। ছাত্র প্রতিনিধি দল জিন্নাহ সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাতে রাজি না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত তিনি। রাজি হন এবং দেখা করেন। রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর ওই সুস্পষ্ট ঘােষণার পর রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পূর্ববাংলার চিফ মিনিস্টার খাজা নাজিমউদ্দিনের সঙ্গে যে ৮-দফা চুক্তি করেছিল, তা কার্যত অর্থহীন হয়ে পড়ে। যেখানে চুক্তিপত্রের ৩ ও ৪ ধারার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বাংলাকে উর্দুর সঙ্গে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার, সেখানে ১৯৪৮ সালের ৮ এপ্রিল পূর্ববাংলা ব্যবস্থাপক সভায় গৃহীত দুটি প্রস্তাবে বাংলাকে নির্ভেজাল প্রাদেশিক ভাষা হিসেবে গণ্য করার সুপারিশ ছিল, (ক) পূর্ববাংলা প্রদেশে ইংরেজির স্থানে বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হবে এবং বাস্তব অসুবিধাসমূহ যখন দূর করা যাবে, তখন এটা কার্যকর করা যাবে; (খ) পূর্ববাংলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষার মাধ্যম হবে যথাসম্ভব বাংলা অথবা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাগরিষ্ঠের মাতৃভাষা। ব্যবস্থাপক পরিষদের ওই প্রস্তাব ছিল রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে খাজা। নাজিমউদ্দিনের চুক্তির বরখেলাপ। সর্বোপরি ৯ মার্চ ১৯৪৯ পূর্ববাংলা সরকার নিয়ােজিত ‘পূর্ববাংলা ভাষা কমিটি’র ৭ ডিসেম্বর ১৯৫০ সালে পেশকৃত রিপাের্টে সুপারিশ করা হয়েছিল, পূর্ব পাকিস্তানের মাধ্যমিকও উচ্চতর স্তরে উর্দু দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে পঠিত হওয়া উচিত, যাতে আমরা পাকিস্তানের দুই অংশের ভাষাতাত্ত্বিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধন দৃঢ় করতে পারি।
বাংলাভাষার প্রশ্নে বঞ্চনা ও প্রতারণার ইতিহাস এখানেই শেষ নয়, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান ১৯৪৯ সালে নিখিল পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনে ইসলামি আদর্শের খাতিরে বাংলাভাষার ঐতিহাসিক ও বিজ্ঞানসম্মত লিখন প্রণালী বা বর্ণমালার পরিবর্তন এবং আরবি তথা উর্দু হরফ প্রবর্তনের প্রস্তাব করেন। তদনুযায়ী ১৯৪৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ‘কেন্দ্রীয় পাকিস্তান শিক্ষা উপদেষ্টা বাের্ড’ পাকিস্তানের সব ভাষার জন্য আরবি হরফ প্রচলনের সুপারিশ করে। যেহেতু বাংলা ছাড়া আর সব পাকিস্তানি ভাষার বর্ণমালা আগে থেকেই আরবি বা ফারসি বা উর্দু বর্ণমালা ছিল! সুতরাং ওই প্রস্তাব শুধু বাংলার জন্যই প্রযােজ্য ছিল! ১৯৪৯ সালের ১২ মার্চ গঠিত পাকিস্তান গণপরিষদের শাসনতান্ত্রিক মূলনীতি কমিটি ১৯৫০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর পেশকৃত রিপাের্টে উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ করলে ১৯৫০ সালের ৪ ও ৫ নভেম্বর তারিখে ঢাকায় অনুষ্ঠিত গঠনতন্ত্র বা সংবিধান সম্পর্কে জাতীয় মহাসম্মেলন পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র সম্পর্কে পাল্টা প্রস্তাবসমূহ করা হয়েছিল, একই প্রশ্নে ১৯৫১ সালে ১৬ ও ১৭ মার্চ কুমিল্লায় অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ শিক্ষকদের সম্মেলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তার ভাষণে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ছাড়া অপর কোনাে ভাষা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, কারণ তা হবে ‘বাঙালিদের গণহত্যার শামিল। ওই প্রেক্ষাপটে ১৯৫১ সালের ১১ মার্চ পূর্ববাংলার সর্বত্র রাষ্ট্রভাষা দিবস’ পালিত হয়েছিল। ১৯৪৮ সালের বাংলাভাষা আন্দোলনের ফলে বাংলা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি পায়নি বটে, তবে বাংলাভাষার দাবি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার।
ছয় মাসের মধ্যেই গণপরিষদ থেকে শুরু করে রাজপথ পর্যন্ত ধ্বনিত এবং প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আটচল্লিশ সালের বাংলাভাষা আন্দোলনের নেতাকর্মী ও অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশই ছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। পাকিস্তান রাষ্ট্র স্থাপিত হওয়ার আগে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সভাপতি মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলমান ছাত্রদের বলেছিলেন, “তােমরা আমাকে একটি বছর দাও, আমি তােমাদের পাকিস্তান এনে দেবাে। অবিভক্ত ভারতের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলাের মধ্যে একমাত্র অবিভক্ত বাংলার মুসলমান ছাত্ররা ঐ ডাকে সাড়া দিয়ে দলে দলে ‘পাকিস্তান ইস্যু’র ভিত্তিতে ১৯৪৫-৪৬ সালের প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সংসদের নির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রার্থীদের সমর্থনে ব্যাপক নির্বাচনী প্রচারণা চালায়। ফলে অবিভক্ত ভারতের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলা, পাঞ্জাব, সিন্ধু, বালুচিস্তান এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মধ্যে একমাত্র বাংলায় মুসলিম লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং কেবল অবিভক্ত বাংলায় হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। পাঞ্জাবে ইউনিয়নিস্ট পাটি, সিন্ধুতে জাতীয়তাবাদী মুসলিম, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে খান আবদুল গফফর খানের নেতৃত্বাধীন ‘রেড শার্টের (লাল কোর্তা দল) প্রাধান্য থাকার ফলে মুসলিম লীগ এককভাবে প্রথমে মন্ত্রিসভা গঠন করতে পারেনি। বাংলায় এটা সম্ভবপর হয়েছিল প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিমের পরিচালনায় কলকাতার ওয়েলেসলি স্ট্রিট এবং ঢাকার চক মােগলটুলির মুসলিম লীগ কর্মীশিবিরের ছাত্রকর্মীদের জন্য। দেশবিভাগের আগে প্রতিষ্ঠিত ঢাকার মােগলটুলির কর্মীশিবির ছিল মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ। কর্মীদের নিয়ে গঠিত। দেশবিভাগের পর কলকাতার ওয়েলেসলির কর্মী প্রশিক্ষণ। কেন্দ্রের মুসলিম ছাত্রলীগ কর্মীরা ঢাকায় এসে মােগলটুলি কর্মীশিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। এই কর্মীশিবিরের ছাত্রনেতা ও কর্মীদের জন্যই মুসলিম লীগ পঁয়তাল্লিশ – ছেচল্লিশের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী এবং বাংলায় মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভা গঠিত হতে পেরেছিল। ফলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পথ সুগম এবং কায়েদে আজম মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ, কায়েদে মিল্লাত নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান এবং নবাবজাদা খাজা নাজিমউদ্দিন যথাক্রমে নবপ্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের গভর্নর জেনারেল, প্রধানমন্ত্রী এবং পূর্ববাংলার চিফ মিনিস্টার হতে পেরেছিলেন।
নিয়তির কী পরিহাস, যাদের ত্যাগ ও তিতিক্ষায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিল, নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানে গদিনসীনরা তাদেরকেই বাংলাভাষার দাবি উচ্চারণের জন্য শিশুরাষ্ট্রের দুশমন, পঞ্চম বাহিনী, ভারতের চর, কমিউনিস্ট, হিন্দু প্রভৃতি বিশেষণে ভূষিত, গ্রেপ্তার এবং জেলখানায় নিক্ষেপ করতে একটুও কুণ্ঠাবােধ করেননি। প্রতিক্রিয়ায় ফল ফলেছিল ভাষা আন্দোলনের অব্যবহিত পর। অবিভক্ত ভারতের “নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের অঙ্গসংগঠন শাহ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বাধীন ‘নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের উত্তরসূরি নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ছিল খাজা নাজিমউদ্দিনের মুসলিম লীগ সরকারের খয়ের খা এবং আটচল্লিশের ভাষা আন্দোলনে এই প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকা ছিল মুসলিম লীগের মতােই ন্যাক্কারজনক। প্রথম ভাষা আন্দোলনের সময় বস্তুতপক্ষে মুসলিম লীগ সরকারবিরােধী কোনাে রাজনৈতিক বা ছাত্র সংগঠন ছিল না, আটচল্লিশের ভাষা আন্দোলনের সময় ওই অভাব তীব্রভাবে অনুভূত হয়। ওই প্রেক্ষাপটে ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসেই ‘পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি আবেদন’ নামে একটি প্রচারপত্র প্রকাশিত হয়। এই আবেদনপত্রে বলা হয়,
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হইবার পর হইতে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ও জনগণ যে সমস্ত সমস্যার সম্মুখীন হইয়াছেন, তাহার আশু সমাধানের জন্য সুষ্ঠু ছাত্র আন্দোলন একান্ত প্রয়ােজনীয়…এই ছাত্র আন্দোলন পরিচালনা করিবার জন্য পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নামে একটি নতুন ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠনে সহায়তা করিবার জন্য আমরা আপনাদের সহযােগিতা কামনা করি।…মন্ত্রিসভা বা বিরােধী দলের হস্তে ক্রীড়া পুত্তলী হওয়া আমাদের নীতি নয় বরং দলীয় রাজনীতির ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও সম্পর্কহীন থাকিয়া পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্নমুখী প্রতিভা সৃষ্টি এবং উদ্ভূত জাতীয় সমস্যাগুলির ওপর গঠনমূলক আন্দোলন সৃষ্টি করাই আমাদের উদ্দেশ্য।
আবেদনকারীদের মধ্যে ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ অস্থায়ী অর্গানাইজিং কমিটির নিম্নোক্ত সদস্যবৃন্দ, যাদের প্রায় সবাই ছিলেন ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা বা কর্মী,
নঈমুদ্দিন আহমদ (রাজশাহী) আহ্বায়ক,
আবদুর রহমান চৌধুরী (বরিশাল),
আবদুল কুদ্স চৌধুরী (চট্টগ্রাম),
শেখ মুজিবুর রহমান (ফরিদপুর),
আজিজ আহমদ (নােয়াখালী),
আবদুল আজিজ (কুষ্টিয়া),
সৈয়দ নুরুল আলম (ময়মনসিংহ),
আবদুল মতিন (পাবনা),
দবিরুল ইসলাম (দিনাজপুর),
মফিজুর রহমান (রংপুর),
অলি আহাদ (ত্রিপুরা),
নওয়াব আলী (ঢাকা),
আবদুল আজিজ (খুলনা) এবং
নুরুল কবির (ঢাকা শহর)।
উপরােক্ত ছাত্র নেতারাই হলেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা। ওই ছাত্রনেতাদের আবেদনপত্রটি দেশব্যাপী ছাত্রসমাজের মধ্যে প্রচারিত হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে সাংগঠনিক কমিটির সদস্য ও অন্যান্য কর্মীর এক সাধারণ সভায় পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম সরকারবিরােধী প্রকাশ্য ছাত্র সংগঠন ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ গঠিত হয়। উল্লেখ্য যে, ওই সময় মুসলিম। লীগ সরকারের প্রচণ্ড দমন নীতির জন্য কমিউনিস্ট পার্টি এবং ছাত্র ফেডারেশন। ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’ থেকে গােপনে সীমিত কার্যকলাপ চালাতে বাধ্য হয়। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রথম আহ্বায়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নঈমুদ্দিন আহমদ ১৯৪৯ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ছাত্রলীগের প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র দবিরুল ইসলাম ও খালেক নেওয়াজ খান ছাত্রলীগের প্রথম সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং ১৯৫০ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫০ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র খালেক নওয়াজ খান ও কামরুজ্জামান আর ১৯৫২-৫৩ সালে কামরুজ্জামান ও এম, এ, ওয়াদুদ। ১৯৫৪ সালে ছাত্রলীগ অসাম্প্রদায়িক সংগঠনে পরিণত হয়। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কোনো একক প্রতিষ্ঠাতা নেই। ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা একদল সমমনা ছাত্রনেতা ও রাজনৈতিক কর্মী।
সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে দেশবিভাগের পর পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ পূর্ববাংলার রাজধানী ঢাকায় পূর্ববাংলা সরকারের তদানীন্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহারের উদ্যোগে ১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর এবং ১৯৪৯ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে প্রথম পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনের উদ্দেশ্য ছিল ইসলামি তাহজীব ও তমদুন অনুসারে পাকিস্তান তথা পূর্ববাংলার ভাষা, সাহিত্য তথা সংস্কৃতির বিনির্মাণ কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনের আয়ােজকদের সব উদ্দেশ্য ভেস্তে যায় সম্মেলনের মূল সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর যুগান্তকারী ভাষণের ফলে। তিনি বলেন, আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চাইতে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোনাে আদর্শের কথা নয়, এটি বাস্তব কথা। মা প্রকৃতি নিজের হাতে। আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ রেখে দিয়েছেন যে মালাতিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকবার জো নেই। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯৪৬ সালে দেশবিভাগের প্রাক্কালে ভবিষ্যৎ পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি উত্থাপন করে যেমন ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন, তেমনি আবার পাকিস্তানের প্রথম সাহিত্য সম্মেলনে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক বাংলা ভাষাভাষীদের বিস্মৃত জাতিসত্তার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে এক বৈপ্লবিক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। বিস্ময়ের কিছু নেই যে পূর্ববাংলা সরকারের শিক্ষা সচিব অবাঙালি আমলা ফজলে আহমদ করিম ফজলী ওই সভাতেই বলেছিলেন, “আজ এখানে যেসব প্রবন্ধ পড়া হলাে সেগুলাে শােনার পর আমি ভাবছি- ‘আমি কি ঢাকাতে আছি না কলকাতায়। দেশবিভাগের আগের ইংরেজ সরকারের সেবাদাস মুসলমান আমলাদের অধিকাংশ পাকিস্তান সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ ও বড় বড় পদগুলাে দখল করেছিলেন, যাদের অধিকাংশ ছিলেন ভারতের উত্তর প্রদেশের বা পাস্রাবের উর্দুভাষী সিভিল সার্ভেন্ট। পাঞ্জাবি মুসলমান আমলারা বরাবর পাঞ্জাবি সাহিত্যিক আল্লামা ইকবাল বা ফয়েজ আহমদ ফয়েজের মতাে মাতৃভাষা পাঞ্জাবি ছেড়ে উর্দুভাষার সেবা করেছেন।
স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তান সরকারের আমলাতন্ত্র ছিল উর্দুভাষার পৃষ্ঠপােষক এবং বাংলাভাষার দুশমন। কিন্তু ঢাকার তমদুন মজলিসের মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকায় ১৯৪৯ সালের ৯ জানুয়ারি ড. শহীদুল্লাহর ভাষণের সমালােচনা করে যা লেখা হয়, তাতে আশ্চর্য না হয়ে পারা যায় না কারণ তমদুন মজলিসই প্রথম। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন করেছিল । সৈনিকে লেখা হয়, মূল সভাপতি পণ্ডিতপ্রবর শহীদুল্লাহ সাহেব তাে নতুন কথা কিছু আমাদের শুনিয়েছেন…মিস্টার জিন্নাহ আর তার চেলাফেলাদের এই এতদিনকার পুরানাে দুই জাতিত্বের রক্তক্ষয়ী চিৎকারের পর এবং পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পরও মুসলমানের চাইতে আমাদের বাঙালি পরিচয়টাই খাটি সত্য, এর চাইতে অভিনব কথা আর কী হতে পারে! বস্তুত যে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান কায়েম হয়েছিল ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সেই দ্বিজাতি তত্ত্বের অসারতাই নির্দেশ করেছিলেন মাত্র। কিন্তু পাকিস্তান যে একটি বহুজাতিক, বহুধার্মিক ও বহু সাংস্কৃতিক দেশ ছিল, সে বাস্তব চেতনা পাকিস্তানি শাসকদের ছিল না। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে বা পরে সমাজের নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মানুষের রুটি রুজির প্রথম সংগ্রামে বাঙালি মুসলমান ছাত্রসমাজের যােগদান থেকে নেতৃত্ব পর্যন্ত দিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকর্মীরা ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর বা নিম্ন কর্মচারীরা তাদের চাকরি সংক্রান্ত দাবি-দাওয়া আদায়ের উদ্দেশ্যে ১৯৪৯ সালের ৩ মার্চ ধর্মঘট করে। তাদের সমর্থনে ওইদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা ধর্মঘট করেছিল । ছাত্রলীগের আহ্বানে পুনরায় ৫ মার্চ ছাত্র ধর্মঘট ও সভা এবং কর্মচারীদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত লাগাতার ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র পরিষদ অর্থাৎ বিভিন্ন হল ইউনিয়ন এই আন্দোলন পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিল । ৯ মার্চ তারিখে ছাত্র ও কর্মচারীদের এক যৌথ সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মৌখিক আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে ১০ মার্চ থেকে ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কর্মচারীদের কাজে যােগদান করতে বাধা দেয় এবং অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘােষণা করা হয়। পাকিস্তানে এই প্রথম কোনাে বিশ্ববিদ্যালয় ‘সাইনে ডাই’ ঘােষণা। প্রতিক্রিয়ায় আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়, ১২ মার্চ বিক্ষোভ মিছিল বের হয় এবং পূর্ববাংলা ব্যবস্থাপক সভার বাজেট অধিবেশনের সময় বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়। সেখানে কয়েকজন ছাত্র গ্রেপ্তার হন। এই প্রথম শ্রমিক-কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া আদায়ের সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কারাবরণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করেই ক্ষান্ত হয়নি, ২৭ জন ছাত্রছাত্রীর বিরুদ্ধে নিম্নরূপ শাস্তি মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে,
চার বছরের জন্য বহিষ্কৃত হন,
দবিরুল ইসলাম (অস্থায়ী আহ্বায়ক, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ),
আবদুল হামিদ,
অলি আহাদ,
আবদুল মান্নান,
উমাপতি মিত্র ও
সমীর কুমার বসু।
হল থেকে বহিস্কৃত হয়েছিলেন,
আবদুর রহমান চৌধুরী (সহ-সভাপতি, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্র সংসদ),
জালালউদ্দিন আহমদ,
দেওয়ান মাহবুব আলী,
আবদুল মতিন,
আবদুর রশিদ ভূইয়া,
হেমায়েত উদ্দিন আহমেদ,
আবদুল মতিন খাঁ,
নুরুল ইসলাম চৌধুরী,
সৈয়দ কামাল কাদেরী,
আবদুস সামাদ,
সিদ্দিক আলী,
আবদুল বাকি,
জে পাত্রনবিশ,
অরবিন্দ বসু (সহ-সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ)।
পনেরাে টাকা জরিমানা ধার্য করা হয় নিম্নোক্তদের, শেখ মুজিবুর রহমান, কল্যাণ দাসগুপ্ত (সাধারণ সম্পাদক, ‘ঢাকা হল ছাত্র সংসদ), নঈমুদ্দিন আহমদ (আহ্বায়ক, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ), নাদিরা বেগম ও আবদুল ওয়াদুদ। দশ টাকা জরিমানা করা হয় লুলু বিলকিস বানুকে। ওই ছাত্রদের মধ্যে বৃত্তিধারীদের বৃত্তি কেটে নেয়া এবং সদাচরণের মুচলেকা দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়। শেখ মুজিবুর রহমান ওই জরিমানা বা মুচলেকা না দেয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত এবং পুনরায় কারারুদ্ধ হন। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পর্যন্ত এই আদেশ প্রত্যাহৃত হয়নি। | ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নশ্রেণীর কর্মচারীদের রুটি রুজির আন্দোলনে নেতৃত্ব দানের অভিযােগে ২৭ জন ছাত্রের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিবাদে ১৯৪৯ সালের ১৭ এপ্রিল পূর্ববাংলাব্যাপী ছাত্র ধর্মঘট পালিত এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সর্বত্র সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী মােতায়েন করা হয়। ১৭, ১৮, ১৯ এপ্রিল ছাত্র বিক্ষোভ অব্যাহত থাকে এবং বেশ কয়েকজন ছাত্র গ্রেপ্তার হন। ১৯ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল সচিবালয়ের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে প্রথমে ঢাকা হলের কাছে এবং পরে সচিবালয়ের প্রবেশপথে মিছিলের ওপর বেপরােয়া লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করা হয়। সেদিনকার গ্রেপ্তারকৃত ছাত্রনেতাদের মধ্যে ছিলেন। খালেক নওয়াজ খান, আজিজ আহমদ, বাহাউদ্দিন চৌধুরী, আবদুল মতিন, এনায়েত করিম ও নিতাই গাঙুলি । ২৫ এপ্রিল ১৪৪ ধারা থাকলেও ছাত্র কর্মপরিষদ আহূত সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয় ঢাকা শহরে, নীলক্ষেত ও পলাশী ব্যারাকের সরকারি কর্মচারী আর পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা এই ধর্মঘটে যােগ দেন।
১৯৪৯ সালের ২৫ এপ্রিল প্রথম ছাত্র-জনতা ঐক্যবদ্ধভাবে সরকারবিরােধী আন্দোলনে যােগদান করে; ওইদিন বিকেলে আরমানিটোলা ময়দানে ছাত্রনেতা তাজউদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে প্রতিবাদ সভার পর এক বিশাল শােভাযাত্রা সচিবালয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। সশস্ত্র পুলিশ নাজিরাবাজার এবং নবাবপুর রেলক্রসিঙে শােভাযাত্রার পথ রােধ করে এবং ভেঙে দেয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৪৯ সালের ২৬ এপ্রিল ছাত্র কর্মপরিষদ ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেয় এবং আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে। এই আন্দোলনের অভিজ্ঞতা ছাত্রকর্মীদের জন্য ছিল খুবই শিক্ষণীয়। ১৯৪৮ সালের বাংলা ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৪৯ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিম্নকর্মচারী আন্দোলন ছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রথম সরকার বিরােধী আন্দোলন, ওই দুটি আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা ছিলেন মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র ও কর্মচারী। যারা পাকিস্তান আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী বা সমর্থক ছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার তিন বছরের মধ্যে তারাই আবার পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে ভাষা ও রুটি রুজির প্রশ্নে আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালনে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছিলেন কারণ তারা বিশ্বাস করতেন যে, নবপ্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের সংখ্যাগুরু নাগরিক বাঙালিদের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার উপেক্ষা বা অবহেলা করলে পাকিস্তান একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র রূপে গড়ে উঠতে পারবে না। কিন্তু গুজরাটের কাথিওয়ারে জন্মগ্রহণকারী মােহাম্মদ আলি জিন্নাহ বা ভারতের উত্তর প্রদেশের নবাবজাদা লিয়াকত আলি খান কিংবা ঢাকা নবাব পরিবারের উর্দুভাষী খাজা নাজিমুদ্দিনের সে বােধ ছিল বলে মনে হয় না। ফল যা হওয়ার তা-ই হয়েছিল, জন্মের পর থেকেই পাকিস্তান রাষ্ট্র বিভাজন ও অনৈক্যের পথে অগ্রসর হয়েছিল।
সূত্র : স্বাধীনতা সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় – রফিকুল ইসলাম