সাম্প্রদায়িক সংঘাতপূর্ণ ঢাকা ও বিশ্ববিদ্যালয়
বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান সম্পর্কে ইংরেজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক প্রফুল্ল কুমার গুহ আমাদের সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯২১ সালে স্থাপিত হয়। পনেরাে-ষােল বছরের মধ্যেই ইহা ভারতবর্ষের মধ্যে একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠানরূপে খ্যাতি অর্জন করে। কিন্তু প্রারম্ভে ইহাকে প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। ঢাকা শহরের বিদগ্ধ সমাজে এই নতুন বিশ্ববিদ্যালয়টিকে ঢাকার উচ্চশিক্ষার একটি অন্তরায় বলে মনে করলেন। ঢাকা নগরে রব উঠল : They have killed a good college (Dhaka College) to make a bad University, ওদিকে এই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের মূলে একটি গভীর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সরকারের মনে ছিল। সরকার চেয়েছিলেন যে মুসলমান শিক্ষক ও মুসলমান ছাত্রদের জন্য বিশেষ সুবিধার ব্যবস্থা করে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিকে একটি সাম্প্রদায়িক কলহকেন্দ্র Communal Cockpit-এ পরিণত করেন। কিন্তু ঢাকা শহরবাসীদের শত্রুতা ও সন্দেহ এবং সরকারের দুরভিসন্ধি উভয়ই চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রশাসকমণ্ডলীর জাদুস্পর্শে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সৌভাগ্য যে, এর প্রাথমিক কর্ণধারগণের প্রত্যেকেরই এমন একটি উদারচিত্ত ও সাম্প্রদায়িক সঙ্কীর্ণত হতে সম্পূর্ণ বিমুক্ত প্রকৃত শিক্ষকের বিশুদ্ধ একাডেমিক স্পিরিট ছিল, তাদের পরিচালনায় প্রথম হতেই নতুন বিশ্ববিদ্যালয়টি একটি পবিত্র বিদ্যামন্দিরে পরিণত হলো। তাদের চোখে হিন্দু ও মুসলমান ছাত্রদিগের মধ্যে কোনাে প্রভেদ ছিল না। তারা সব ছাত্রকেই সমান দরদ ও ভালবাসা দিয়ে নিরপেক্ষভাবে শিক্ষাদান করেন এবং তাদের এই মহৎ সঙ্কল্পে হিন্দু-মুসলমান ছাত্রদের মধ্যেও গড়ে উঠল এক প্রীতি ও বন্ধুত্বের বন্ধন । এ. এফ. রহমান, রমেশচন্দ্র মজুমদার, জ্ঞান ঘােষ, শহীদুল্লাহ, নরেশ সেনগুপ্ত তাদের ঔদার্য ও ব্যক্তিত্বের প্রভাবে এই অসম্ভবকে সম্ভব করলেন।…
হিন্দু শিক্ষকেরা একটি মিশনারি স্পিরিটে তাদের ব্রত পালন করলেন। মুসলমানদিগের মধ্যে উচ্চশিক্ষা প্রসারিত হয় নাই-মুসলমান ছাত্রদিগকে শিক্ষাদান করে তাদের দ্বারা মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি মিডল ক্লাস সৃষ্টি করার সহায়তা হিন্দু শিক্ষক ও প্রশাসকগণ একটি পুণ্যকার্য হিসেবে গ্রহণ করলেন। এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার আলােকপ্রাপ্ত মুসলমান ছাত্রগণই বর্তমান মুসলিম মিডল ক্লাস সৃষ্টির ভিত্তি স্থাপন করলাে। এদের পরবর্তীগণই শেখ মুজিবুর রহমানের পার্শ্বচর হয়ে স্বাধীন বাংলা স্থাপন করলেন। মুসলমান সমাজে পূর্বে কোনাে মিডল ক্লাস ছিল। এই মিডল ক্লাস সৃজন করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক কীর্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ববাংলার দরিদ্র কৃষক সন্তানদের উচ্চশিক্ষা লাভের মাধ্যমে, সরকারি চাকরিতে ক্রমবর্ধমান হারে নিয়ােগ লাভ, মুসলমান সমাজে শিক্ষার সম্প্রসারণ, ব্যবসা-বাণিজ্যে-রাজনীতিতে শিক্ষিত মুসলমানদের প্রবেশ অর্থাৎ বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের হর্তাকর্তা, বিধাতা এবং ঢাকা শহরের হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতাদের বিরােধিতা ও প্রতিকূলতা সত্ত্বেও থামানাে যায়নি। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে নানা রকম ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ও পরিহাস করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র ও শিক্ষক, কলকাতা ও আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. অমলেন্দু বসু অবিস্মরণীয়’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্বন্ধে যেমন ‘অক্সফোর্ড অফ দি ইস্ট’ নামক সংবাদপত্রী আখ্যা দেয়া হয়েছিলাে। তেমনি একই সঙ্গে ‘মেক্কা অফ দি ইস্ট’ অর্থাৎ এটি প্রধানত মুসলমানেরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান…ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দু শিক্ষক ও ছাত্রের সংখ্যা দীর্ঘকাল মুসলমানদের অনুপাতে বেশি ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অমুসলমান ছাত্রদের খেলাধুলা, বিদ্যাচর্চা, সামাজিক জীবন কোনাে রকমেই সঙ্কুচিত ছিল বলে আমি ১৯২৬-৪৮ সালের মধ্যে আমার ছাত্রজীবন ও শিক্ষক জীবনে দেখিনি, তবে মুসলমান ছাত্রদের বিদ্যোৎসাহী করার জন্য বিশেষ অর্থসাহায্য ছিল, যেমন ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী তপসিলিদের জন্য সাহায্য ।
আমার ছাত্রজীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলিম শিক্ষক মাত্র তিনজন ছিলেন বলে স্মরণ হয় (উর্দু, আরবি, ফার্সি বিভাগগুলাের শিক্ষকদের বাদ দিয়ে) ইতিহাসে এ. এফ. রহমান সাহেব (পরবর্তীকালে হয়েছিলেন স্যার ফজলুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর), ইংরেজি বিভাগের মাহমুদ হাসান সাহেব, বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগের মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সাহেব । এরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ অনস্বীকার্য মেধার বলে শিক্ষা কার্যের ও জ্ঞান জগতের উচ্চ পর্যায় অধিকার করেছিলেন, মুসলমানত্বের বলে না। যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে ‘মেক্কা অফ দি ইস্ট’ আখ্যায় শ্লেষােক্তি প্রয়ােগ করতেন, তাদের শ্রেষ যেমন স্কুল ছিল, তেমনি এই শ্লেষ প্রয়ােগে এ কথা প্রমাণ হয় যে তখনকার দিনে শিক্ষিত জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হিন্দু সমাজে সাম্প্রদায়িক ভেদজ্ঞান এবং স্বকপােলকল্পিত আত্মগরিমা এত অধিক ছিল যে তারা ভাবতেন সমাজের এক এক অংশের শ্রীবৃদ্ধি হলেই (অর্থাৎ তারা নিজেরা যে অংশের অন্তর্গত সে অংশের শ্রীবৃদ্ধি হলেই) সমগ্র সমাজের শ্রীবৃদ্ধি হয়ে যাবে। প্রথমে ছাত্র ও পরে শিক্ষক হিসেবে বাইশবছর আমার জীবন অত্যন্ত অন্তরঙ্গতায় জড়িয়ে গিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে। এই দীর্ঘকালের মধ্যে আমি দেখিনি যে ধর্মের কারণে কোনাে ছাত্রকে পরীক্ষার, ক্রীড়া প্রাঙ্গণের, ভাষণ কৃতিত্বের প্রতিযােগিতায় উচ্চ সম্মান দেয়া হয়েছে। কৃতিত্বের প্রতিযােগিতায় হিন্দু ছিল না, মুসলিম ছিল না-ছিল কৃতী তরুণ।
ঢাকা শহর বিশের দশক থেকেই হিন্দু-মুসলমান রায়ট বা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাপীড়িত। অথচ ১৯২১ থেকে ১৯৪৭ সালের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। বা ছাত্রদের নিয়ে মাত্র তিনটি সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটেছিল, যার দুটি ক্যাম্পাসের বাইরে। প্রথমটি ঘটে ১৯২৬ সালে সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগের অধ্যাপক প্রখ্যাত লিপি বিশারদ রাধাগােবিন্দ বসাককে নিয়ে। তিনি পুরাতন ঢাকার এক ব্যবসায়ী বসাক পরিবারের সন্তান এবং স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, ১৯২৮ সালে ঢাকা পৌরসভার নির্বাচনে নির্দলীয় প্রার্থীরূপে (সম্ভবত) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভােটে অমুসলমান প্রার্থীদের মধ্য থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোর্টের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ঢাকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় জড়িত থাকার অভিযােগে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। এ সম্পর্কে প্রফেসর সাঈদ-উর রহমান ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচ্যবিদ্যা পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যায় (জুলাই ২০০১) লিখেছেন, গত শতকের তৃতীয় দশকে ঢাকা শহরে হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা প্রায়ই ঘটতাে। ১৯২৬ সালের মাঝামাঝিতে সেটা তীব্র আকার ধারণ করেছিল। সে বছর সেপ্টেম্বর মাসের ১০ তারিখে নওয়াবপুর রােডের একজন ঘােড়ার গাড়ির ড্রাইভার। কয়েকজন আরােহীসহ আক্রান্ত হয়। আহতদের একজন পরে মৃত্যুবরণ করে। তাৎক্ষণিকভাবে ড্রাইভারের অভিযােগে যাদের ধরা হয়েছিল, তাদের একজন। উস্কানিদাতা হিসেবে রাধাগােবিন্দ বসাক নামক ব্যক্তির উল্লেখ করায় সূত্রাপুর থানার পুলিশ অধ্যাপক বসাককে দেড় মাস পরে ২৩ অক্টোবর গ্রেপ্তার করে। দুই হাজার টাকার জামিনে বন্দিদশা থেকে বেরিয়ে এসে তিনি ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট জনাব ফিলপট এবং কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং দীর্ঘ চিঠিতে উপাচার্যকে পুরাে ঘটনা জানান। অধ্যাপক রাধাগােবিন্দ বসাক ১৯৩৩ সালের ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক পদে যােগদান করেন। তার বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যাওয়ার সঙ্গে অবশ্য ১৯২৬ সালের সাম্প্রদায়িক ঘটনার কোনাে যােগ ছিল না।
ঢাকার হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ : অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক-এর আলাপচারিতা, সরদার ফজলুল করিমের গ্রন্থ থেকে মুসলমান অধ্যাপকের অভিজ্ঞতা ও মতামত পাওয়া যায়, তখন রায়ট কেনাে হতাে? রাজনৈতিক কারণে? ইট ওয়াজ হার্ডলি পলিটিক্যাল। জন্মাষ্টমী, মহররমের মিছিল, মসজিদের সামনে বাজনা বাজানো-এগুলােই ছিল উপলক্ষ। পহেলা রায়টটি ‘২৬ সালের দিকে হবে। তখন আমি এইট-নাইনে পড়ি। তারপরের এইটা ১৯৩১ সালে । আমি আইএ পড়ি। ঢাকা শহরের মুসলমানের সংখ্যা ছিল ২০ শতাংশ, মুসলমান ছাত্রসংখ্যাও সামান্য। মুসলমান। ছাত্রের প্রায় সবই ঢাকা শহরের বাইরের। দে ওয়েয়ার কমপুিটলি আনইন্টারেস্টেড । মারামারি হতাে লােকাল হিন্দু মধ্যবিত্ত ও মুসলমানের মধ্যে। কিন্তু এ রায়টের প্রভাব তখনাে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান ছাত্রদের দাঙ্গা হতাে না। ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে এর প্রভাব। দেখিনি। হিন্দু শিক্ষকদের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু তারা যে সাম্প্রদায়িক ভাব থেকে মুসলমান ছাত্রদের লেখাপড়ার ক্ষেত্রে “ভিকটিমাইজ করবে, তা ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান ছাত্রদের দাঙ্গা হতাে না। ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে এর প্রভাব দেখিনি। এমন কোনো রেকর্ড নেই। মুসলমান ছেলে বলে যে। ফাস্ট ক্লাসের যােগ্য হলেও সেকেন্ড ক্লাস করে দেবে, টু মাই নলেজ, এমন দৃষ্টান্ত আমি দেখি না। এটা তারা করতাে না। একদম না। এমনকি যারা খুব নাম করা কমিউনাল শিক্ষক ছিলেন, তারাও ছাত্রদের ব্যাপারে এটা করতেন না। তবে মুসলমান ছেলে ভাল করলে হিন্দু শিক্ষক অবশ্যই খুশি হতেন। তার কৃতিত্ব তারা স্বীকার করতেন। হরিদাস বাবু, মানে হরিদাস ভট্টাচার্য, দর্শনের অধ্যাপক ছিলেন। তার কমিউনাল বলে পরিচয় ছিল। টিকিধারী ব্রাহ্মণ । কিন্তু শিক্ষার ক্ষেত্রে, ছাত্রদের বিদ্যার বিচারে কখনাে তিনি কমিউনাল হননি। আমরা তবু একটা প্রচলিত অভিযােগের কথা উল্লেখ করলাম যে,.. মযহার সাহেবের কথা। আমি জানি। মযহার সাহেব (ম্যহারুল হক) এক নম্বরের জন্য ফার্স্ট ক্লাস পাননি। …হ্যা, দশ পর্যন্ত গ্রেস দিতে পারত। কিন্তু আমি বলছি সে যুগে সেকেন্ড ক্লাসফাস্ট ক্লাসের ব্যাপারটা কেবল এক নম্বরের বেশি-কম বলে মনে করা হতাে না।
যে ফাস্ট ক্লাস সে ফার্স্ট ক্লাস। ফার্স্ট ক্লাস থেকে এক নম্বর যদি তাকে কম দেয়া হয়ে থাকে, তবে তা চিন্তা করেই দেয়া হয়েছে। পরীক্ষকের জাজমেন্ট রং হতে। পারে। কিন্তু তাদের চিন্তার ভিত্তিটা এই ছিল। যে সেকেন্ড ক্লাসের ছাত্র, সে ভাল সেকেন্ড ক্লাস বলে তাকে আমি ২২৯ পর্যন্ত দিতে পারি, কিন্তু তাকে আমি ৩০০ দেবাে না। তখন এ চিন্তায় লাভ নেই যে, সে ফার্স্ট ক্লাসের ছাত্র, কেবল এক নম্বরের জন্য ফার্স্ট ক্লাস পাইল না । ১৯৩০ সালের বার্ষিক সমাবর্তন উৎসবে ভাইস চ্যান্সেলর জি, এইচ, ল্যাংলি। ঢাকায় সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক দাঙ্গা-হাঙ্গামার মধ্যেও গত সেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম অব্যাহত থাকায় এবং হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্প্রীতি বজায় রাখায় সন্তোষ প্রকাশ করেন। গত জানুয়ারিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০ জন হিন্দু ও ৪০ জন মুসলমান মােট ৮০ জন ছাত্র বিশেষ কনস্টেবল হিসেবে স্বেচ্ছায় যোগদান করেন। এবং তিন রাত পুলিশের নির্দেশে বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে শহরে টহল দেয়। তাদের এই কার্যক্রমের জন্য বাংলার গভর্নর চিফ সেক্রেটারির মাধ্যমে তাদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। দাঙ্গার সময় কায়েৎটুলী অঞ্চলের হিন্দু অধিবাসীদের জন্য ঢাকা হলে একটি আশ্রয় শিবির খােলা হয়, যেখানে ২৪ মে থেকে প্রায় ৭০০ হিন্দু অধিবাসী আশ্রয় গ্রহণ এবং ৩ থেকে ১৫ দিন পর্যন্ত অবস্থান করেন। | চল্লিশের দশকে পুরাতন ঢাকার হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক সংঘাত নতুন ঢাকায়। অর্থাৎ রমনা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও অনুপ্রবেশ করে এবং দুটি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ ও ত্রিশ দশকের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্যে কালিমা লেপন করে। এ প্রসঙ্গে সলিমুল্লাহ হল সুবর্ণ জয়ন্তী স্মরণিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়ের কৃতী ছাত্র আজীজ-উল হক ‘চল্লিশের দশকের গােড়ার দিকে সলিমুল্লাহ হল’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ১৯৪১ সাল থেকে সংঘটিত ঢাকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং যুদ্ধের ক্রম অবনতিশীল পরিস্থিতি বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনকে বিপর্যস্ত করে তােলে। দাঙ্গার শিকারদের মধ্যে ছিলেন সলিমুল্লাহ হলের ছাত্র জনাব মােতাহার হােসেন। জগন্নাথ হল ও এখনকার প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যবর্তী সদর রাস্তায় প্রকাশ্য দিবালােকে জনাব হােসেনের পিঠে ছুরিকাঘাত করা হয়। ফলে কিছুদিনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখা হয়।
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় খােলার পরও উত্তেজনা ও ভয় বিরাজ করতে থাকে। ১৯৪৩ সালের গােড়ার দিকে কার্জন হলে অনুষ্ঠিত ছাত্রীদের এক সভা উপলক্ষে পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করে। শ্রোতাদের মধ্যে কেউ কেউ স্টেজের সজ্জার একটি দিক নিয়ে আপত্তি তােলে। ফলে তুমুল লণ্ডভণ্ড ঘটে এবং অবশেষে সভায় অংশগ্রহণকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এর অব্যবহিত পরে কার্জন হলের ভেতরে ও বাইরে এবং ঢাকা হল (বর্তমান শহীদুল্লাহ হল) ও জিমন্যাসিয়ামের ভেতরে-বাইরে অবস্থানকারী ছাত্রদের মধ্যে ইষ্টক বর্ষণ হয়। উভয় পক্ষের ছাত্ররাই কম-বেশি আহত হয়। ফলে কয়েকদিনের জন্য ঢাকা। বিশ্ববিদ্যালয় আবার বন্ধ রাখা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় খােলার আগে ছাত্র পরিষদের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বিভিন্ন হলের প্রভােস্টগণ একাধিকবার আলােচনায় বসেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় যখন খুলল-১৯৪৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারির সেই বিষাদময় দিনটিতে-সলিমুল্লাহ হলের ছাত্র জনাব নাজির আহমদ ঘাতকের ছুরিতে। মারাত্মকভাবে জখম হলেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের দক্ষিণ গেটের কাছাকাছি এক স্থানে যে মারামারি চলছিল, জনাব আহমদ গিয়েছিলেন সেটা থামাতে । আর আঘাত হলাে তারই দেহে। তাকে যথাশীঘ্র সম্ভব মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলাে। কিন্তু তার অবস্থা দ্রুত অবনতির দিকে চলতে থাকে এবং শরীরে রক্ত দেয়ার প্রয়ােজন দেখা দেয়। কয়েকজন ছাত্র হাসপাতালে চলে যায় নিজেদের রক্ত দেয়ার জন্য। কিন্তু এরই মধ্যে খবর এসে গেলাে নাজির শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। যাই হােক, পুলিশের হস্তক্ষেপের ফলে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দাঙ্গা থেমে যায়। তবে ঘটনার গুরুত্ব তাতে কমলাে না। অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘােষণা করা হয়। সবাইকে অল্প সময়ের মধ্যে হল ছেড়ে চলে যেতে হয়। শহীদ নাজির আহমদ সাপ্তাহিক পাকিস্তান পত্রিকা চালাতেন এবং মুসলিম লীগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন।
তার নির্মম হত্যাকাণ্ডে স্বাভাবিকভাবেই তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, যার প্রভাব পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু-মুসলমান ছাত্রদের সম্পর্কে । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ বছরের ইতিহাসে এমন নৃশংস ঘটনা আর ঘটেনি। ফলে চল্লিশের দশকের প্রথমার্ধে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ এবং সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততার প্রভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি ও পরিবেশ শােচনীয় আকার ধারণ করে। ইতােমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পূর্ব রণাঙ্গনের হাসপাতাল কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তােলা হয়। নীলক্ষেত এলাকার ফাঁকা মাঠে বাঁশের তৈরি অসংখ্য ব্যারাকে গড়ে ওঠে ফিল্ড হসপিটাল। সলিমুল্লাহ হল, জগন্নাথ হল এবং সংলগ্ন এলাকা সেনাবাহিনী রিকুইজিশন করে হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহারের জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ভবন থেকে ফজলুল হক হলকে সরিয়ে আনা হয় বর্তমান ভবনে, যেটা আগে ঢাকা ইন্টারমেডিয়েট কলেজের হােস্টেল ছিলাে। সলিমুল্লাহ হলকে তিন ভাগে ভাগ করে এক ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় ভবনে, যেখানে ফজলুল হক হল ছিলাে সেখানে, এক ভাগ ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের অফিসে, এখন যেখানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আর এক ভাগ সেগুনবাগানের খান ম্যানসনে নেয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সঙ্কুচিত হতে হতে মূল ভবনের (বর্তমানে মেডিক্যাল কলেজ) একাংশে, আর ঢাকা হলে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হয়েছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের জন্য । চল্লিশের দশকে হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা বা রায়ট উপদ্রুত ঢাকা শহর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বেই অঘােষিত হিন্দুস্থান-পাকিস্তানে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
ত্রিশের দশকের আগে ঢাকা ছিল মােটামুটি হিন্দু-মুসলমান অধিবাসী মিশ্রিত শহর কিন্তু ১৯২৬ সাল থেকে হিন্দুমুসলমান দাঙ্গার ফলে ঢাকা শিহর ক্রমে ক্রমে হিন্দু ও মুসলমান এলাকায় ভাগ হয়ে যায়। পুরানা পল্টন, নবাবপুর, ঠাটারিবাজার, যুগিনগর, ওয়ারি, দক্ষিণ মৈশুন্দি, টিকাটুলি, হাটখােলা, নারিন্দা, লক্ষ্মীবাজার, বাংলাবাজার, গেন্ডারিয়া, সদরঘাট, পটুয়াটুলি, ফরাশগঞ্জ, শাঁখারি বাজার, তাঁতিবাজার, কায়েৎটুলি, রায়ের বাজার আরমেনিটোলা, নবাবগঞ্জ, হিন্দু এলাকা আর রায়সাহেবের বাজার, ইসলামপুর, মােগলটুলি, বড় ও ছােট কাটরা, চ্যাজার, মৌলবীবাজার, বেগমবাজার, মাহুতটুলি, বংশাল, নাজিরাবাজার, ফুলবাড়িয়া, দেওয়ানবাজার, উর্দুরােড, লালবাগ, খাজে দেওয়ান, সিদ্দিক বাজার, আলুরবাজার প্রভৃতি ছিল মুসলিম এলাকা। ফুলবাড়িয়ায় অবস্থিত পুরাতন ঢাকার রেল স্টেশনটিও বিভক্ত ছিল, নবাবপুর রােডের দিকের অংশ হিন্দু আর ফুলবাড়িয়া-নাজিরাবাজার দিকের অংশ মুসলমান যাত্রীদের ওঠা নামার জন্য। ব্যবহৃত হতাে। ঢাকার নােম্যানস্ ল্যান্ড’ ছিল রমনার বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস অঞ্চল। রমনা ও সেগুনবাগিচা ছিল বস্তুত মিশ্র এলাকা। হিন্দু ও মুসলমান সরকারী কর্মচারী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিক্ষকদের আবাস ছিল এই দুটি এলাকা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় রমনা মিত্রবাহিনীর ছাউনিতে রূপান্তরিত হলেও ঢাকা শহরের সাম্প্রদায়িক মানচিত্র পরিবর্তিত হয়নি।
সূত্র : স্বাধীনতা সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় – রফিকুল ইসলাম