You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.01.26 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | গ্রীসে গণতন্ত্র | হুমকি দিয়ে সমস্যার সমাধান হবে না | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা: ২৬শে সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার, ৯ই আশ্বিন, ১৩৮১

গ্রীসে গণতন্ত্র

অকমিউনিস্ট রাজনৈতিক সংগঠনই শুধু নয়, গ্রীসের সাংগঠনিক কমিউনিস্ট পার্টির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়েছে। প্রায় তিন দশক কালের মধ্যে গ্রীসের রাজনৈতিক ইতিহাসে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সাতষট্টি সালের একুশে এপ্রিল সামরিক অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক সংগঠনের তৎপরতা ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলেও কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছিল সাতচল্লিশ সালে। এরপর থেকেই শুরু হয় সেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা। সাতচল্লিশ থেকে একান্ন সাল পর্যন্ত তেরোটি মন্ত্রিসভার পতন ঘটে। অবশেষে ক্ষমতায় আসেন দক্ষিণ মন্ত্রী সমর নায়ক ফিলড মার্শাল পাপা গ্রোস।
বিশ্বের গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনায় গ্রীসের অবদান সবচাইতে প্রাচীন এবং দেশি হলেও ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার এই দেশের জনসাধারণ বিশ শতকের গণতান্ত্রিক বিকাশের সাথে সুষ্ঠুভাবে পরিচিত হতে পারেননি। তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ‘সট্রং গভর্মেন্ট’ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হলেও গণতান্ত্রিক বিকাশের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তুলতে পারেননি। আর তাই তার মৃত্যুর পর তাঁর মন্ত্রিসভার এই সাবেক সদস্য করমনলিসকে রাজপ্রাসাদের সঙ্গে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে পদত্যাগ করতে হয়। এরপর বেশ ক’টি মন্ত্রিসভা গঠিত হলেও সরকার এবং রাজপ্রাসাদের সম্পর্ক ক্ষেত্রে কেউই কোন সীমানা টেনে কার্যকরী করতে সক্ষম হন না। সবশেষে সাতষট্টিতে যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল সেই নির্বাচনে সম্ভাব্য ফলাফল আগেভাগেই অনুমান করতে পেরে সামরিক বাহিনী সরাসরি ক্ষমতা মঞ্চে আবির্ভূত হয়।
ইতিহাসের স্বাভাবিক নিয়মে সে সামরিক জান্তাকেও সরে যেতে হয়েছে। স্বনির্বাচিত করমনলিসকে ডেকে আনা হয়েছে গ্রীসে রাজনীতি এবং অর্থনৈতিক কাঠামো পুনঃবিন্যাস করতে। নির্বাসন জীবন কাটিয়ে ফিরেছেন করমলিসের এককালীন প্রতিদ্বন্দ্বি পাপান্দ্রিও। তিনি তার পুরানো সেন্টার ইউনিয়ন পার্টির স্থলে নতুন রাজনৈতিক সংগঠন এর নামকরণ করেছেন ‘প্যান হেলেনিক সোসালিষ্ট মুভমেন্ট।’ সকল রাজনৈতিক তৎপরতার উপর থেকে বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খুব শীঘ্রই গ্রীসে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারি সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছে। দুনিয়ার তাবৎ গণতন্ত্রনামা মানুষের সঙ্গে সঙ্গে আমরা গ্রীসের এই নব যাত্রাপথে অভিনন্দন জানাচ্ছি। দীর্ঘ সাত বৎসর সামরিক জান্তার শক্ত বেল্টের পেষণে পিষ্ট গ্রীসের সাধারণ মানুষ যে অবশেষে গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ এবং প্রয়োগ করতে যাচ্ছে তাতে স্বভাবতই আনন্দলাভ করবার কথা।
গ্রীসের রাজনীতিতে আরেকটি গুণগত পরিবর্তনের দিকে আমাদের দৃষ্টি আবদ্ধ হয়েছে সেখানে রাজতন্ত্রের যে অবশেষ টুকুর যবনিকা টেনে এনেছিলেন প্রাক্তন সামরিক জান্তা তা অনুমোদন লাভ করেছেন সাধারণ মানুষের। রাজা কনষ্ট্যানটাইনের ফিরে আসার সম্ভাবনা নিয়ে কেউ আর সেখানে মাথা ঘামায় না।
গ্রিসের জনগণ দীর্ঘদিন পর ধাপে ধাপে বিজয়ের দিকে এগিয়ে চলেছেন। এই বিজয় যাত্রায় ধারণ সে জাতির নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন এবং আগামী দিনে যারা নেতৃত্ব দেবেন তাদের প্রতি রয়েছে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ শুভেচ্ছা।

হুমকি দিয়ে সমস্যার সমাধান হবে না

আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের নয়া প্রেসিডেন্ট মিঃ জেরালড ফোর্ড গত তেইশ তারিখে বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে ভাষণ দিতে গিয়ে তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর প্রতি কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছিলেন। তিনি ভাষণে বলেছিলেন, যে সকল দেশ তেল উৎপাদন করে তারা যদি তেলের দাম না কমায় বা নির্ভরশীল দেশগুলোর সাথে তেলসম্পদ ভাগাভাগি করে না নেয় তাহলে তাদেরকে ভয়াবহ পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে। কৃত্রিম সংকট এবং পণ্য বাজারে সার্বভৌম দেশগুলোর নীতি নির্ধারণ করা কোন দেশই সহ্য করবে না। তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর যদি তাদের প্রাকৃতিক সম্পদ মানব সমাজের কল্যাণে ভাগ দিতে অস্বীকৃতি জানায় তবে যে ধ্বংস এবং ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে তা সকলের কল্পনাতীত।” প্রেসিডেন্ট জেরালড ফোর্ড তার হুঁশিয়ারি কি পরিমান গুরুত্বপূর্ণ সে সম্পর্কেও বলেছেন-প্রলয়ের ভাষা ব্যবহার করা ছাড়া জ্বালানি সংকট সম্পর্কে আলোচনা করা দুঃসাধ্য। আমাদের সামনে সুস্পষ্ট ও মারাত্মক বিপদ। এদিকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভাষণ দিতে গিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব ডঃ হেনরি কিসিঞ্জারও তেল উৎপাদনকারী দেশ সমূহের প্রতি তেলের দাম কমানোর আহ্বান জানিয়েছেন। তেলের মূল্যবৃদ্ধি সম্পর্কে মার্কিন নেতৃবৃন্দ যখন হুঁশিয়ারি এবং আবেদন জানাচ্ছিলেন ঠিক তখনই ভিয়েনা থেকে ওপেক এর সেক্রেটারি জেনারেল আবদুর রহিম খান প্রেসিডেন্টে ফোর্ডের হুমকির জবাবে বলেছেন-তেলের দাম রেকর্ড পর্যায়ে রাখা হবে। ইতিমধ্যেই ওপেক এর বাড়তি তেল উৎপাদনকারী দেশ যারা বিশ্বের শতকরা পঁচাশি ভাগ তেল সরবরাহ করে থাকে তারা পূর্বেই শতকরা চারশত ভাগ দাম বাড়ানোর পরেও আবার শতকরা ৩.৫ ভাগ বাড়ানোর সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেছে। সর্বশেষ এই বাঁধের ফলে প্রতি ব্যারেল তেলের দাম হবে ৯.৭৪ ডলার। ওপেক সেক্রেটারি জেনারেল আরো বলেছেন-মার্কিন নেতারা শুধু নিজেরাই বিভ্রান্ত হচ্ছেন না গোটা বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করছেন। তারা মনে করছেন চাপ সৃষ্টি করে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটানো যাবে। ওপেক সেক্রেটারির মতে ক্রয় ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য তেলের দাম বাড়ানো হচ্ছে। একথা সত্য যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট মিঃ জেরাল্ড ফোর্ড তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর প্রতি যে হুমকি দিয়েছেন তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। তার প্রত্যক্ষ হুমকির জবাবে তেলের মালিক দেশগুলোর পক্ষ থেকে যে কথা বলা হয়েছে তাতে করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আরও ভয়াবহ। তেলের দাম বাড়লে ধনী দেশ সমূহের চাইতে দরিদ্র এবং উন্নয়নমুখী দেশগুলোর অর্থনীতিতে মারাত্মক বিপর্যয় নেমে আসবে। মিঃ ফোর্ড হুমকি দিয়ে তার দায়িত্ব শেষ করতে পারেন কিন্তু তাতে করে সমস্যা সমাধান হতে পারে না। আরব দেশ সমূহ ইতিপূর্বেই তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি করেছিল তাদের যতোটুকু ক্ষতি হয়েছে নির্দেশে তার চাইতে বেশী ক্ষতি হয়েছে দরিদ্র দেশগুলোর। বিবাদ টিকিয়ে রেখে অথবা বিরোধ তীব্র করে সমস্যা সমাধান করা যাবে না-একটি সমন্বিত উপায় উদ্ভাবন করতে হবে তেল সংকটের প্রশ্নে। যারা এটাকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছেন তাদেরও সংকটাপন্ন উন্নয়নশীল দেশগুলোর কথা বিবেচনা করে তেলের রাজনীতি বন্ধ করা উচিত। ওপেক নেতৃবৃন্দ সমস্যার একটি উপায় উদ্ভাবন করতে গিয়ে এগিয়ে আসবেন বলে আমাদের আরও বিশ্বাস রয়েছে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন