ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন
কালের প্রেক্ষাপটে বিশ শতকের তৃতীয় দশকে, পূর্ববাংলার ঐতিহ্যবাহী ঢাকা নগরীতে একটি আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ইতিহাস পর্যালােচনা করলে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা হলাে, এক ঐতিহাসিক ঘটনার আবর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টি। বিশ শতকের প্রথম দশকে বঙ্গভঙ্গ রদের প্রসঙ্গটি অনিবার্যভাবেই ওই প্রসঙ্গে এসে পড়ে। ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ ও মােগল সুবার সাবেক রাজধানী জাহাঙ্গীরনগর তথা ঢাকাকে রাজধানীরূপে নতুন পূর্ববাংলা ও আসাম প্রদেশ সৃষ্টির প্রতিক্রিয়ায় বঙ্গভঙ্গ তথা স্বদেশী আন্দোলন ও সশস্ত্র বিপ্লববাদের অভ্যুত্থান ঘটলেও বঙ্গভঙ্গ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের সমর্থন পেয়েছিল। এ সমর্থন শুধু সাম্প্রদায়িক বা রাজনৈতিক কারণেই ছিলাে না, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক কারণেও বঙ্গভঙ্গ এ অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন পায়। কিছু পরিসংখ্যানের সাহায্যে বিষয়টি তুলে ধরা যায়। বঙ্গভঙ্গের প্রথম বছরেই নবসৃষ্ট পূর্ববাংলা ও আসাম প্রদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য ২ কোটি ৯৮ লাখ ২৭ হাজার ৩৯৭ টাকা থেকে ৩ কোটি ১৭ লাখ ৭৭ হাজার ৮৪৬ টাকায় উন্নিত অর্থাৎ ১৯ লাখ ৫০ হাজার ৪৪৯ টাকায় বর্ধিত হয়। চট্টগ্রাম বন্দরে ১৯০১-০২ সালে বৈদেশিক বাণিজ্যের যে পরিমাণ ছিল, ১৯০৫-০৬ সালে তা চারগুণ বৃদ্ধি পায়। তবে বঙ্গভঙ্গের ফলে শিক্ষার ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদ পূর্ববাংলা ও আসাম প্রদেশে উন্নতি ঘটে সবচেয়ে বেশি । ১৯০৬ সালে এ প্রদেশে ছাত্রের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৬৯৮ জন এবং খরচ ১ লাখ ৫৪ হাজার ৩৫৮ টাকা, যা বর্ধিত হয়ে ১৯১২ সালে। দাঁড়ায় ২ হাজার ৫৬০ জনে এবং খরচ ৩ লাখ ৮৩ হাজার ৬১৯ টাকা। ১৯০৫ থেকে ১৯১০-১১ সালের মধ্যে প্রাদেশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলােতে ছাত্রসংখ্যা ৬ লাখ ৯৯ হাজার ৫১ থেকে বর্ধিত হয়ে ৯ লাখ ৩৬ হাজার ৬৫৩ জনে দাঁড়ায়। প্রাদেশিক সরকারের শিক্ষা খাতে রাজস্ব ব্যয় ১১ লাখ ৬ হাজার ৫১০ টাকা থেকে ২২ লাখ ৫ হাজার ৩৩৯ টাকায় এবং শিক্ষার জন্য স্থানীয় খরচ ৪৭ লাখ ৮১ হাজার ৮৩৩ টাকা থেকে ৭৩ লাখ ৫ হাজার ২৬০ টাকায় বর্ধিত হয়।
১৯০৮-০৯ সালের মধ্যে প্রদেশে ৮১৯টি নতুন বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হওয়ায় ছাত্রীসংখ্যা বেড়ে যায় ২৫ হাজার ৪৯৩ জন। ১৯১০-১১ সালের মধ্যে নবগঠিত প্রদেশে ৪ হাজার ৫৫০টি মেয়েদের স্কুলে ছাত্রীসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৯ হাজার ১৩৯ জনে। সুফিয়া আহমেদের ‘মুসলিম কমিউনিটি ইন বেঙ্গল’ (১৮৮৪-১৯১২) গ্রন্থ থেকে প্রাপ্ত এসব পরিসংখ্যান বিবেচনা করলে বােঝা যায়, কেনাে বঙ্গভঙ্গ ও পূর্ববাংলা-আসাম প্রদেশ মুসলমানদের সমর্থন পেয়েছিল। প্রথম বঙ্গভঙ্গের সময় প্রদেশে প্রাইভেট স্কুল ছাড়া একটিও প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল না । নবগঠিত প্রদেশে প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তি স্থাপিত হয়। জেলা ও লােকাল বাের্ডসমূহ গ্রামাঞ্চলে বহু প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করে । মক্তবের সংখ্যা ১৯০৭০৮ সালের ১ হাজার ২৯৯ থেকে ১৯১১-১২ সালে ১ হাজার ৫৮৪-তে এবং পাচ বছরে মক্তবের ছাত্র ৪০ হাজার ১৮৮ থেকে ৫৪ হাজার ৭০৩ জনে বৃদ্ধি পায়। পূর্ববাংলা ও আসাম সরকার শিক্ষা-দীক্ষায় অনুন্নত মুসলমান ছাত্রদের জন্য বিশেষ বৃত্তির ব্যবস্থা এবং সংখ্যা বৃদ্ধি করে। প্রায় প্রতিটি কলেজ ও স্কুলে হােস্টেল স্থাপিত হয়। বঙ্গভঙ্গের সময় মুসলমান শিক্ষক ও সাব-ইন্সপেক্টরের সংখ্যা ছিল প্রায় শূন্য অথচ ১৯১২ সালে মুসলমান সাব-ইন্সপেক্টরের সংখ্যা দাঁড়ায় ১১৪ এবং শিক্ষকের সংখ্যা ১৪ হাজার ৩৫৯ জনে। ১৯১১ সালের ১ নভেম্বর ও ১২ ডিসেম্বর দিল্লির দরবারে ঘােষণার মাধ্যমে বঙ্গভঙ্গ এবং পূর্ববাংলা ও আসাম প্রদেশ রদ হয়ে যায় । অন্যথায় নবগঠিত পূর্ববাংলা ও আসাম প্রদেশে শিক্ষাক্ষেত্রে যে অগ্রগতি হয়েছিল, তার পরিণতি হতাে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন। বঙ্গভঙ্গ রদের পর ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১২ সালের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে পূর্ববাংলা ও আসাম সফরে আসেন। তিনি ৩১ জানুয়ারি ঢাকায় একটি প্রতিনিধি দলের কাছে ঘােষণা করেন, বিগত কয়েক বছরে শিক্ষাক্ষেত্রে পূর্ববাংলায় যে অগ্রগতি হয়েছে, তাতে ভারত সরকার আনন্দিত হয়েছে এবং ভারত সচিবের কাছে তারা ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন ও পূর্বাংলায় শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতির জন্য একজন বিশেষ অফিসার নিয়ােগের সােপারেশ করবে। লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকা সফর শেষে কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করলে ১৯১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ড. রাসবিহারী ঘােষের নেতৃত্বে কলকাতার বিশিষ্ট অমুসলমান নেতাদের এক প্রতিনিধি দল তার সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং টাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের তীব্র বিরােধিতা করে একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। উত্তরে লর্ড হার্ডিঞ্জ ওই প্রতিনিধি দলকে জানান, ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে ও তা মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় হবে না, তা হবে একটি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় ।
বঙ্গভঙ্গ এবং পূর্ববাংলা ও আসাম প্রদেশ রদের প্রেক্ষাপটে এ অঞ্চলের মুসলমান জনসাধারণের মধ্যে যে হতাশা ও ক্ষোভের সঞ্চার হয়, তা খানিকটা হলেও প্রশমনের জন্য ক্ষতিপূরণস্বরূপ ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। বলা চলে, বঙ্গভঙ্গ রদ না হলে যেমন পরিণতিতে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন অনিবার্য ছিল, তেমনি আবার বঙ্গভঙ্গ রদের পরেও সে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন অপরিহার্য হয়ে পড়ে । সুতরাং বলা যায়, প্রথম বঙ্গভঙ্গ এবং তা রদের ফলেই ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রয়ােজনীয়তা দেখা দিয়েছিল, এ কথাও বলা যায় যে বঙ্গভঙ্গ না হলে হয়তাে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হতাে না। কি লর্ড হার্ডিঞ্জের ওই আশ্বাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে শুধু কলকাতা নয়, এমনকি ঢাকায় অমুসলমান সমপ্রদায়ের বিরােধিতা বা প্রতিকূলতা দূর করতে পারেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাবনা থেকেই এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য ১৯১২ সালের মে মাসে গঠিত হয়েছিল নাথান কমিটি। যে কমিটি মােট ২৫টি সাব-কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে রিপাের্ট পেশ করে। এই রিপাের্টে বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের জন্য ৫৩ লাখ টাকা এবং বাৎসরিক খরচের জন্য ১২ লাখ টাকা ধরা হয়েছিল। নাথান কমিটি রমনা অঞ্চলে অধুনালুপ্ত পূর্ববাংলা ও আসাম প্রদেশের রাজধানীর পরিত্যক্ত ৪৫০ একর জমির ওপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস স্থাপনের সুপারিশ করে। এই রিপাের্ট ১৯১৩ সালে ভারত সচিব কর্তৃক অনুমােদিত হয় । কিন্তু সৃষ্টির লগ্ন থেকে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বৈরিতার শিকার । প্রথম মহাযুদ্ধের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সংকোচিত বাজেট পেশ করতে বলা হয় ১১ লাখ ২৫ হাজার টাকার মধ্যে। ফলে ঢাকা ও জগন্নাথ হল এবং মেহামেডান ও নতুন আর্টস কলেজ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুরুর সংশােধিত পরিকল্পনা পেশ করা হয়; কিন্তু তা-ও কার্যকর হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন দেরি হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই পূর্ববাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ক্ষুব্ধ হয়।
১৯১৭ সালের মার্চ মাসে ‘ইমপেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী অবিলম্বে সরকারের প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিল। পেশের আহ্বান জানিয়ে বলেন, পূর্ববাংলাকে বঙ্গভঙ্গ রদের ক্ষতিপূরণস্বরূপ একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল; কিন্তু যুদ্ধের কারণে সেই প্রতিশ্রুতি পালনের বিলম্ব হেতু বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি বা স্থগিত রাখার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত ১৯১৭ সালে বাংলার গভর্নর ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর লর্ড চেমসফোর্ড কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা তদন্তের জন্য নিয়ােজিত স্যালারি কমিশনের ওপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা সম্পর্কে পরামর্শী দানের দায়িত্ব প্রদান করেন। কমিশনের সদস্যদের মধ্যে টাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রয়ােজনীয়তা স্বীকৃত হলেও তা আবাসিক না এফিলিয়েটিং হবে, তা নিয়ে মতভেদ দেখা দেয় । ভারত সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে মূলত আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় করার পক্ষপাতি ছিল। পক্ষান্তরে পূর্ববাংলার মুসলমান নেতারা পূর্ববাংলার কলেজগুলােকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার পক্ষে ছিলেন, যাতে পূর্ববাংলার উচ্চশিক্ষার্থী মুসলমান ছাত্ররা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রদায়িক বৈষম্যের হাত থেকে রেহাই পায়। বাংলার অমুসলমান জনমত ঢাকায় এফিলিয়েটিং বা মজুরি প্রদানের ক্ষমতাযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ঘােরতর বিরােধী ছিল। স্যাডলার কমিশন মধ্যপথ অবলম্বন করে, পূর্ববাংলার বিভিন্ন কলেজের পরিবর্তে ঢাকার বিভিন্ন আবাসিক হলকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিটরূপে গণ্য করার সুপারিশ করে আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কাউন্সিল হাউসের পাঁচ মাইল ব্যাসার্ধ এলাকাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাভুক্ত এলাকারূপে গণ্য করার পরামর্শ দেয়। ওই কমিশনে প্রদত্ত ১৩টি সুপারিশ কিছু রদবদলসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯২০’ ভারতীয় আইনসভায় গৃহীত হয় এবং গভর্নর জেনারেল ১৯২০ সালের ২৩ মার্চ তাতে সম্মতি দেন। | ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দেরির কারণ শুধু প্রথম মহাযুদ্ধ বা ভারত সরকারের লালফিতার দৌরাত্ম নয়, অবিভক্ত বাংলার দ্বিতীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরােধিতা ও প্রতিকূলতা তার জন্য বিশেষভাবে দায়ী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বড় বাধা ছিলেন স্যার আশুতােষ মুখােপ্যাধায় এবং সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার ঢাকার স্মৃতি’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ আশুতােষ মুখােপাধ্যায়ের কাছে জানতে চেয়েছিলেন। কী মূল্যে অর্থাৎ কিসের বিনিময়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরােধিতা থেকে বিরত থাকবেন। বাংলার বাঘ’ নামে খ্যাত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য চারটি নতুন প্রফেসর পদের বিনিময়ে তার বিরােধিতার অবসান ঘটিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত ১৯২১ সালের জুলাই মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব বাস্তবায়িত হয়েছিল এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের। একাডেমিক রেজিস্ট্রার ফিলিপ হার্টগ প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর নিযুক্ত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয় ১৯২১ সালের ১ জুলাই। ১৯১১ সালের ডিসেম্বর মাসে বঙ্গভঙ্গ রদ, ঢাকাকে রাজধানীরূপে পূর্ববাংলা ও আসাম প্রদেশ বাতিল হওয়ার প্রায় দশ বছর পর বিলােপকৃত রাজধানীর জন্য নির্মিত নতুন বাগিচা শহর রমনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক যাত্রা শুরু হয় মুসলিম হল, ঢাকা হল ও জগন্নাথ হলের যথাক্রমে ১৭৮, ৩৮৬ ও ৩১৩ মােট ৮৭৭ জন ছাত্র নিয়ে । ১৯২১ সালে রমনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়, তার ছাব্বিশ বছর পর ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ঢাকা রমনাতেই পাকিস্তানের পূর্ববাংলার রাজধানী আর ১৯২১ সালের পঞ্চাশ বছর পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রমনাতেই স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাজধানী স্থাপিত হয়। ১৯২১ থেকে ১৯৭১ মাত্র পঞ্চাশ বছর, একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি স্বাধীন জাতি রাষ্ট্র বা নেশন স্টেটের সৃষ্টি; কিন্তু এই পঞ্চাশ বছরের ইতিহাস খুবই ঘাত-প্রতিঘাতময় ! ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হওয়ার পরেও তা অবিভক্ত বাংলা সরকার এবং ঢাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রভাবশালী মহলের নিরন্তর বাধার সম্মুখীন ছিল । এ প্রসঙ্গে ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন, ১৯১৯ সালের নতুন আইন অনুসারে বাংলার প্রথম শিক্ষামন্ত্রী হন পশ্চিমবঙ্গের সন্তান প্রভাসচন্দ্র মিত্র। তিনি মন্ত্রী হয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন কমানাের নির্দেশ দেন।
প্রতিষ্ঠালগ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজার্ভ ফান্ডে ৫০ লাখ টাকা গচ্ছিত ছিল, বাংলা সরকার বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রদত্ত ভবনগুলাের জন্য সে টাকা কেটে নেয়। বাংলা সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রতি বছর মাত্র ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ করে। ফলে শিক্ষকদের বেতন কমিয়ে দিতে হয়। উ. রমেশচন্দ্র মজুমদার ১৯৭৪ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রদের পুনর্মিলনী উপলক্ষে প্রকাশিত ‘আমাদের সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্মরণিকায় ঢাকার স্মৃতি প্রসঙ্গে আরাে লিখেছেন, এই সমুদয় গোলমালের মূল কারণ হিন্দুরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরােধী এবং শিক্ষামন্ত্রী পশ্চিমবঙ্গের লােক হওয়ায় তার পূর্ববঙ্গের প্রতি সহানুভূতির যথেষ্ট অভাব ছিল। ঢাকাবাসী হিন্দু শিক্ষিত সম্প্রদায় কোনদিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সুনজরে দেখেননি। যেসব হিন্দু প্রফেসর ও রিডার ছিলেন, সকলেই ঢাকার বাইরে থেকে এসেছিলেন-তারা এতাে মােটা মাইনে পাবে, এতাে বড় বড় বাড়িতে থাকবে এটা কোনদিনই তারা সহ্য করতে পারেননি। একজন অধ্যাপক একবার ঢাকার এক বিশিষ্ট হিন্দু নেতাকে বলেছিলেন যে, আমরা এসব বাড়ি দখল না করলে কি গভর্নমেন্ট আপনাদের এসব বাড়িতে থাকতে দিত? তবে আপনারা আমাদের হিংসা করেন কেনাে? মুসলমানরা হিন্দু শিক্ষকদের বিরােধিতা করেননি। তবে তারা চাইতেন লেকচারারের পদে যথাসম্ভব বেশি মুসলমান নিযুক্ত করতেঅধিকতর যােগ্য হিন্দু থাকলেও; কিন্তু প্রফেসর ও রিডারের বেলায় মােটামুটি যােগ্যতা অনুসারে নির্বাচন করারই পক্ষপাতি ছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অনেকে পদানুসারে কোটের সভ্য ছিলেন, অন্য অনেক হিন্দুও এর সভ্য ছিলেন, তাদের বিরােধী দল বললে বিশেষ অতিরঞ্জন করা হবে না। শিক্ষক সদস্যদের মুখপাত্র ছিলেন ড. নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত। তারপর আমাকেই বিরােধী হিন্দুদের সঙ্গে কোর্টের সভায় লড়াই করতে হয়। এ জন্য ঢাকার হিন্দু জননায়কেরা আমার ওপর খুশি ছিলেন না। তবে কোর্টসভায় মুসলমানেরা হিন্দু শিক্ষকদের পক্ষে থাকায় শিক্ষকদের বা শিক্ষা সম্বন্ধে অনিষ্টকর কোনাে প্রস্তাব পাস করা সম্ভব হতাে না। ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হওয়াতে পূর্ববাংলার কৃষিনির্ভর দরিদ্র মুসলমান সমাজের ছাত্রদের উচ্চশিক্ষার দ্বার প্রসারিত হয়েছিল। কৃষক পরিবারের সন্তানদের পক্ষে কলকাতায় গিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সঙ্গতি ছিল না, তবে অভিজাত শ্রেণীর মুষ্টিমেয় মুসলমান ছাত্র কলকাতা, আলিগড় বা লন্ডন গিয়ে উচ্চশিক্ষার সুযােগ গ্রহণ করতেন। ঢাকা শহরের আদিবাসী ঢাকাইয়া মুসলমান সমাজে শিক্ষার আগ্রহ ছিল কম, তবে তারা ঢাকার বাইরে থেকে আগত ছাত্রদের নিজেদের বাড়িতে জায়গীর রাখতেন। ফলে অনেক দরিদ্র ছাত্র জায়গীর থেকে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশােনার খরচও ছিল কম। যদিও দেশ বিভাগের আগে পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অমুসলমান ছাত্ররাই ছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ । তবু ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হওয়ায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযােগ সম্প্রসারণের কারণে মুসলমান মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ ত্বরান্বিত হয়েছিল।
সূত্র : স্বাধীনতা সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় – রফিকুল ইসলাম