বিদেশী সংবাদভাষ্যের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক
রাজনৈতিক অঙ্গন সাধারণত সংবাদভুবনকে হিসাব করেই চলে। বিশেষত এ জন্য যে রাজনীতিতে বরাবরই স্বচ্ছতার খুব অভাব। কূটকৌশল, স্বার্থপরতা, ভােলবদল থেকে চক্রান্ত, মুখে রঙ ফেরানাের মতাে অনেক কিছুই তাদের রাজত্বে সচল। যেভাবেই হােক আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এমন একটা ঐতিহ্য তৈরি হয়ে গেছে। তাই ঘরেবাইরে এসব বিষয় নিয়ে হিসাব করে চলাই দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে। না হলে ঐ ‘ওয়াটার গেট” থেকে ইরান-কন্ট্রা’ কেলেংকারির মতাে একাধিক সমস্যায় নাজেহাল হতে হয়, জাদরেল মার্কিন প্রেসিডেন্টদের? একাত্তরের ভয়াবহ ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যতম আন্তর্জাতিক নায়ক নিক্সন সাহেবকেও তাই ব্যক্তিগত বিপদে পড়তে হয়েছিল, যেমন তার চেয়েও ধুরন্ধর মার্কিন রাষ্ট্রপতি রেগানকে, বাদ যান নি জার্মান চ্যান্সেলর বা বিশ্বের রাজা-মন্ত্রী কেউ কেউ। এসব ভেবে, না ভেবে ‘তালে ঠিক ইয়াহিয়ার সামরিক উপদেষ্টাদের সিদ্ধান্ত ছিল, “অপারেশনের আগে সব বিদেশী সাংবাদিকদের একজোটে ঢাকা-ছাড়া করার। যাতে তাদের অন্ধকার অপারেশন’-এর কোনাে খবর আলােয় না আসতে পারে। যাতে বিশ্বজনমতের চোখ ফাকি দিয়ে নির্বিবাদে কাজটা শেষ করে ফেলা যায়। কিন্তু এ সিদ্ধান্তে নিহিত বিপদের সম্ভাবনা তাদের সামরিক-মাথায় ধরা পড়ে নি। যথারীতি তা ববিদ্যুতের রূপ নিয়ে দেখা দিয়েছিল এবং মূলত রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে ইয়াহিয়াকেই এর জন্য খুব চড়া মাশুল দিতে হয়। দিতে হয় একাত্তরের নৃশংসতার জন্য। সামরিক শাসকদের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেই বােধ হয় সংবাদভুবন বিষয়টাকে পেশাগত অনমনীয়তা ও দৃঢ়তার সাথে গ্রহণ করে। পঁচিশে মার্চ রাতে লুকিয়ে থেকে একজন সাংবাদিক ঘটনার যতটা সম্ভব তথ্যচিত্র তৈরি করেন তেমনি পরে তাদের অনেকে নানাপথে তথ্য সংগ্রহ করেন নিজ নিজ কাগজের জন্য। ফলে ঘটনার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সারা বিশ্ব জানতে পারে পূর্ব-পাকিস্তানে পাক-বর্বরতার কাহিনী। সংবাদপত্রপাঠক, বেতারশ্রোতা সবাই ঘটনার অভিঘাতে স্তব্ধ হয়ে যায়, যদিও আন্তর্জাতিক রাজনীতির নায়কদের অধিকাংশই এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় নড়েচড়ে বসার প্রয়ােজন বােধ করেন নি। তবু সংবাদ-ভুবন মতাদর্শ-নিরপেক্ষভাবে ঘটনার তথ্যচিত্র ও চালচিত্র রচনা এবং সে সবের বিচার-বিশ্লেষণে পেশাজীবীসুলভ শ্রম ও নৈতিকতার প্রকাশ ঘটায়।
আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিভেদ বা মেরুকরণ তাদের বড় একটা স্পর্শ করে না, করে না মতাদর্শগত ভিন্নতা সত্ত্বেও। সম্ভবত মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও পেশাগত সততা এর কারণ। সত্যের প্রকাশই ছিল তাদের একমাত্র লক্ষ্য, মতাদর্শের বিচার পরে। সব কিছু মিলিয়ে লন্ডন টাইমস’-এর সঙ্গে মার্কিনি ‘টাইম’ কিংবা ‘সানডে টাইমস’এর পাশাপাশি নিউইয়র্ক টাইমস’ ‘সান’-এর বিপরীতে ‘বাল্টিমাের সান’-এর মতাে কাগজ ছাড়াও গার্ডিয়ান’ টেলিগ্রাফ, ‘অবজার্ভার’ বা ‘নিউজউইক’, ওয়াশিংটন পােস্ট’এর মতাে পত্রপত্রিকা কেউ দ্রুত, কেউ ধীরে একাত্তরের সংবাদভাষ্য রচনায় ও ঘটনা। বিশ্লেষণে এগিয়ে আসে। আসে সত্য উদঘাটন ও বস্তুধর্মী তথ্যচিত্র রচনার দায় মাথায় নিয়ে। হয়তােবা পরস্পরের মধ্যে সুস্থ প্রতিযােগিতার অদৃশ্য তাগিদও কাজ করে। সেখানে। তাই সেখানে দেখা যায় বাংলাদেশ ট্রাজেডির নানা কৌণিক রূপচিত্রণ ও বিচার-বিশ্লেষণ, বিশ্বের বিশিষ্ট রাষ্ট্রনায়কদের ভূমিকা বিশ্লেষণ যৌক্তিকতা, নৈতিকতা ও ন্যায়বিচারের মানদণ্ডে। তাই অনেক ক্ষেত্রে বিশ্লেষণ ও পরিবেশনার সাদৃশ্য দেখে অবাক হতে হয়। ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এ (২৭ মার্চ) সাইমন ড্রিং যখন লেখেন ‘আল্লাহর নামে এবং অখও পাকিস্তানের নামে (পাক-বাহিনীর তৎপরতায়) ঢাকা আজ এক নিষ্পেষিত ও আতংকিত নগরী’ (অনুরূপ বিবরণ প্রকাশ পায় ৩০ মার্চ ‘ওয়াশিংটন পাের্ট’-এ), তখন প্রায় একই সময়ে (৩১ মার্চ) নিউইয়র্ক টাইমস’ সম্পাদকীয় নিবন্ধ লেখে প্রায় একই ভাষায়। শেষােক্তের ভাষায় “আল্লাহর নামে ও অখণ্ড পাকিস্তানের নামে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের পশ্চিম পাকিস্তান-প্রধান সামরিক সরকারের সেনাবাহিনী পূর্বাঞ্চলের স্বায়ত্তশাসন-প্রার্থী সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের ওপর নিষ্ঠুর আক্রমণ চালিয়ে ঐ দুই নামেরই অবমাননা করেছে।
(“Acting” in the name of God and a united Pakistan’ forces of the West Pakistan-dominated military government of President Yahya Khan have dishonoured both by their ruthless crackdown on the Bengali majority seeking a large measure of autonomy for their homeland in country’s Eastern region”.)। সম্পাদকীয় ভাষ্যে বলা হয় : পশ্চিমা সৈন্য তাদের পূর্বাঞ্চলীয় মুসলমান ভাইদের ওপর যে বর্বরতার প্রকাশ ঘটিয়েছে তাতে বাংলাদেশের বিচ্ছিন্নতার যুক্তিই প্রমাণিত হয়।’ ( প্রসঙ্গত ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ তাদের সরকারকে মনে করিয়ে দিতে দ্বিধা করে নি যে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রসম্ভারে সজ্জিত করার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা নিয়েছে বলে এখন তাদের বিশেষ দায়িত্ব ইয়াহিয়া সরকারকে অস্ত্র সাহায্য স্থগিত করা। উপসংহারে বলা হয় ; পাক-সেনাবাহিনী বিদ্রোহ দমনের উদ্দেশ্যে তৎপরতা চালায় নি, হিসাব-নিকাশ করে বিনা প্ররােচনায় হত্যার উদ্দেশ্য নিয়ে আঘাত করেছে।” (“The United States, having played a major role in training and equipping Pakistan’s armed forces, has a special obligation now to withhold any military aid to the Yahya Government…. The army, which is to say the West Pakistani army, did not act to suppress an uprising. It struck calculatedly, dealing death beyond all immediate provocation.” 31 March, 1971)
ঐ দিনেই (৩১ মার্চ) লন্ডনে প্রকাশিত ‘গার্ডিয়ান পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধে (‘পাকিস্তানে হত্যাকাণ্ড) একই সুরে পাক-সেনাবাহিনীকে অস্ত্রসজ্জিত করার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের ভূমিকার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলা হয়েছে যে তাদের বােঝা উচিত কি কাজে তাদের দেওয়া অস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে।…আর ব্রিটেন ও অন্যান্য যাদের ঐ অঞ্চলে কিছুটা মর্যাদাব্যঞ্জক প্রভাব রয়েছে তাদের ঐ প্রভাব প্রকাশ্যে জোরের সঙ্গে ব্যবহার করা উচিত। (“Those like America who stock the Pakistan army, must realize to what use their weaponary is put… Those like Britainwho retain some prestige of influence in the area, should spend it openly and forcefully”. ‘A Massacre in Pakistan’.)
গার্ডিয়ান’ বলতে দ্বিধা করে নি যে ঐক্য হত্যার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না, এবং তা অসহায় জীবনের মূল্যমানের সমানও নয়। পূর্ব-পাকিস্তান এখন এক দখলীকৃত এবং শােষিত অঞ্চল।’ (“…unity can never come through murder and it is not worth the price of incocent lives. East Pakistan survives today only as occupied and exploited territory.”)। পরিশেষে এক করুণ উচ্চারণ : ‘ঢাকার ভাগ্যে রয়েছে মানবতা ও মানবিক আকাক্ষার বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ। আর এ অপরাধ যে পাক-শাসকদের এক সামগ্রিক পরিকল্পনা একটি ভয়ংকর প্রাণঘাতী খেলার অংশবিশেষ তা একজন সাদামাঠা পাক-বিমানবালার জানা থাকলেও পশ্চিমা সাংবাদিকদের অনেকেরই শুরুতে জানা ছিল না। অবস্থাদৃষ্টে তাদের ধারণা হয়েছিল যে ২৫ মার্চ পাক-সেনাদের আক্রমণ এক আকস্মিক ঘটনা। কারণ মুজিবইয়াহিয়া সংলাপের ক্ষেত্রে শেষােক্তের রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর তাদের যে কারণে হােক আস্থা জন্মেছিল। | কিন্তু পরে গােটা পরিস্থিতির উপলব্ধি তাদের ভিন্ন রকম সত্যের অনুধাবনে সাহায্য করে। বুঝতে কষ্ট হয় না যে গােটা আলােচনা অনুষ্ঠানটাই ছিল এক হিসেবে খেলা। অবস্থা অনুকুলে না আসায় দাবার ছক উল্টে দিতে তাদের এক মুহুর্ত দেরি হয় নি। তেমনি দেরি হয় নি কাজে নেমে পড়তে। কাজ মানে নির্বিচার হত্যা ও ধ্বংস। পাক সেনাদের এই হত্যা ও ধ্বংস, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযােগের বর্বরতা ইঙ্গ-মার্কিন সাংবাদিকদের সবাই প্রচণ্ড নিষ্ঠার সঙ্গে নিজ নিজ কাগজে প্রকাশ করেন। তাদের সংবাদভাষ্যে ফুটে ওঠে ঐ অমানবিকতার বিরুদ্ধে পেশাগত প্রতিবাদ। এ ক্ষেত্রে মতাদর্শের ভিন্নতা কোনাে অবাঞ্ছিত ছায়া ফেলে নি। | উল্লিখিত খেলার ছক নিশ্চয়ই পাকিস্তানের বন্ধুরাষ্ট্রগুলাের বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের অজানা ছিল না। তাদের শক্তিতেই পাকিস্তানের যত হাঁকডাক।
সঙ্গে জুটেছিল ছােটোতরফ চীন। তবু মার্কিনি কাগজগুলােই ঐ রাজনৈতিক খেলার চক্রান্ত প্রথম বিশ্ববাসীর গোচরে আনে। সেই সঙ্গে অবশ্য ব্রিটিশ সংবাদজগতের প্রতিনিধিরাও। মার্চ মাসের ৩০ তারিখে ‘বাল্টিমাের সান’ এমন সন্দেহ প্রকাশ করে যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ইচ্ছাকৃতভাবে ঢাকাই আলােচনা দীর্ঘায়িত করে যাতে পূর্ববঙ্গের মানুষের মনে এমন বিশ্বাস জন্মে যে সমঝােতা আসন্ন, তারপরই কোনাে সতর্কতা সংকেত ছাড়া আক্রমণ।” (“…President Yahya Khan’s regime was deliberately prolonging Dacca talks to lull East Beagal into believing a compromise imminent, and then would attack without warning”.) | ‘ওয়াশিংটন পােস্ট’-এর এস, এস, হ্যারিসন আরাে এক পা এগিয়ে সংঘাতের মূলে পেীছাতে গিয়ে বলেন ; ঢাকায় মুজিবুর রহমানের সঙ্গে প্রাথমিক আলােচনার পর থেকে (সমস্যার) সমাধান সম্পর্কে জেনারেল ইয়াহিয়ার মনে সামান্য আশাই অবশিষ্ট ছিল তবু সামরিক প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করতে প্রয়ােজনীয় সময়ের জন্যই তিনি আলােচনা চালিয়ে যাওয়ার ভান করেছেন। এ খবর ছিল পশ্চিম-পাকিস্তানি সূত্রে সমর্থিত (“West Pakistan sources confirmed the view that General Yahya had entertained little hope of a settlement after his initial talk with Mujibur in Dacca but kept up the pretense of talks to allow time for military preparations:” 4 April, 1971) কথাটা যেমন পশ্চিমা শাসকশ্রেণীর জানা ছিল তেমনি ঢাকায় রাজনীতি সচেতন মানুষের মধ্যেও আলােচিত হয়েছে। তবে আলােচনার নামে পাক-সামরিক শাসকদের ভয়ঙ্কর খেলার সত্যটা প্রকৃত অর্থে তুলে ধরেন নিউইয়র্ক টাইমস-এর সংবাদ-প্রতিনিধি সিডনি শানবার্গ (৪ এপ্রিল, ১৯৭১)। ঢাকা থেকে বিতাড়িত হওয়ার পথে তাকে শুনতে হয় পশ্চিম-পাকিস্তানি এক বিমানবালার বক্তব্য— “এসবের দরকার ছিল, অবশ্যই দরকার ছিল। …..এ সব তাে খেলার অংশ বিশেষ”(“All of it’s necessary, albsolutely necessary. It’s all part of the game”) কথাগুলি উদ্ধৃত করে সেই প্রসঙ্গে শ্যানবার্গ বলেন : “এখন এটা স্পষ্ট যে পশ্চিম-পাকিস্তানিরা কখনােই চায় নি যে আলােচনা সফল হােক। তারা আলােচনা চালিয়ে নিয়ে গেছে আক্রমণের উপযােগী পর্যাপ্ত সৈন্য-সরঞ্জাম পশ্চিম-পাকিস্তান থেকে আনার মতাে সময় কেনার উদ্দেশ্যে।’
(“It is now clear that the West Pakistanis never meant the talk to succeed, that they dragged them out only to buy time to get enough troop reinforcents from West Pakistan to launch the attack.”)। কিন্তু আলােচনা চলাকালে সাংবাদিককূটনীতিক সবারই এমন ধারণা ছিল যে মীমাংসা একটা হবেই। তাই সামরিক পরিকল্পনার আলামত উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও সবাই মঙ্গলকর পরিণামই আঁকড়ে ধরতে চেয়েছে। আলামতগুলাে ছিল ‘সংলাপ চলাকালে বিমানযােগে ও জাহাজপথে সৈন্য নিয়ে আসা, অতিশয় উদারপন্থী সামরিক আইন প্রশাসক (ইয়াকুব খান)কে বরখাস্ত করা এবং পূর্ব-পাকিস্তানিদের বয়কট আন্দোলনের মুখে সেনাবাহিনীর অস্বাভাবিক নীরবতার মতাে ঘটনাবলী।’ (“But while the talks went on, nearly every observer, form newsmen to diplomats resisted the ugly thought that this might be true, The signs were all there- troops coming in by air and sea, the dismissal of a martial law administrator who was too lenient and the uncharacteristic silence of the army.”)। শ্যামবার্গ এ প্রতিবেদনে স্বীকার করেছেন যে চোখের সামনে লক্ষণগুলাে উপস্থিত থাকা এবং সেসব খবর কাগজে পাঠানাের পরও সাংবাদিকরা বুঝতে ভুল করেছেন, অর্থাৎ অবশেষ ঘটনার পরিণাম বুঝতে ভুল করেছেন, এবং সহজেই ইয়াহিয়া বাহিনীর চতুর প্রতারণার শিকার হয়েছেন, তারা খেলার ছকটা ঠিক ধরতে পারেন নি। কিছু সময়ের জন্য হলেও ইয়াহিয়ার চাতুর্যের কাছে তাদের হার মানতে হয়েছে।
হিসেৰী ব্রিটিশ কাগজগুলােরও কোনাে কোনােটিতে ইয়াহিয়া খানের তথা তার সামরিক চক্রের দ্বিচারিতার বিষয়টি সংক্ষেপে উল্লেখিত হয়েছে। যেমন ৩১ মার্চ (১৯৭১) ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এ ‘পাকিস্তানে হত্যাকাণ্ড’ শীর্ষক পূর্বোক্ত সম্পাদকীয় নিবন্ধে ইয়াহিয়া। সম্পর্কে বলা হয় : ‘মুজিবের সঙ্গে যখন তার রাজনৈতিক সংলাপ চলছে তখন তার জেনারেলগণ হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনায় ব্যস্ত। তার (ইয়াহিয়ার) দাম্ভিক আস্ফালনে তার। সদিচ্ছা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। (“While he negotiated with Mujib, his generals planned carnage. His vaunted bluff sincerity lies tattered.”) লন্ডনের ইকোনমিস্ট’ পত্রিকা অবশ্য দুদিক ছুঁয়েই কথা বলেছে। যেমন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সদিচ্ছা নিয়ে ঢাকায় সংলাপ চালিয়ে ছিল, নাকি সামরিক প্রস্তুতির জন্য কালক্ষেপ করাই ছিল তার উদ্দেশ্যে এ প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে ইকোনমিস্ট-এর বক্তব্য : ‘সাক্ষ্যপ্রমাণে মনে হয় ইয়াহিয়া দুটো কাজই একসঙ্গে করেছে।’ (“…whether president Yahya was negotiating at Dacca in good faith or just buying time for military preparations. There is evidence that he was doing both”. April 3, 1971) অর্থাৎ আপাত বিচারে মেদঙ্গুল চেহারার ইয়াহিয়া ততটা নির্বোধ নয় যতটা অনেকের। ধারণা। তবে ইকোনমিস্ট এর অনুসরণে বলা চলে : ইয়াহিয়া অবশ্যই চতুর কিন্তু সেই সঙ্গে নির্বোধও। চতুর বলেই সংলাপের মাদকে আচ্ছন্ন করে পূর্ববাংলার রাজনীতিকদের ওপর দিয়ে একহাত খেলে নিতে পেরেছে তাদের বুঝতে না দিয়ে। আর নির্বোধ বলে সে খেলার পরিণাম নিয়ে পূর্বাহে বিচার করে দেখে নি। অথবা সে দেখা একেবারে বস্তুনিষ্ঠ ছিল না। জেনারেল-প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ভণ্ডামি, প্রতারণা ও চালবাজি নিয়ে মােকাবেলার পর যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সংবাদভাষ্যে প্রতিফলিত তা হলাে পূর্ব-পাকিস্তানে সংঘটিত তাণ্ডব সম্পর্কে পাকিস্তানের বন্ধুরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক শক্তিপরাশক্তির প্রতিক্রিয়া। নিঃসন্দেহে বিষয়টি ছিল সাংবাদিকদের জন্য অতীব গুরুত্বের, তবু সবাই সেদিকে সমান মনােযােগ দেন নি। ইতিপূর্বে ব্রিটেন, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশের রাষ্ট্রিক প্রশাসনের বাংলাদেশে গণহত্যা সম্পর্কে শীতল প্রতিক্রিয়ার কথা আলােচনায় উল্লেখিত হয়েছে। চীনসহ এদের প্রত্যেকের ছিল একই কথা : বিষয়টা পাকিস্তানের ঘরােয়া সমস্যা। কোনাে স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সমস্যায় হস্তক্ষেপ অধিকার-বহির্ভূত কাজ। তাই ঘটনার গতি প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ এবং মানবিক ত্রাণসাহায্য ছাড়া কিইবা করার আছে?
যেমন ২৯ মার্চ কমন্স সভায় ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব স্পষ্টই বলেন : ‘পূর্ব-পাকিস্তানে প্রাণহানির জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে ‘হাউসের’ সবাই নিশ্চয় একমত হবেন, তবে এ কথাও ঠিক যে এটা নিতান্তই পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়। সরকার অবশ্য পরিস্থিতির ওপর গভীর দৃষ্টি রাখছে এবং পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যােগাযােগ রক্ষা * ETCR I’ (“The whole House will join me in regretting the loss of life in Pakistan…. The House will appreciate this is an internal matter….. Government are however watching the situation very closely and we remain in constant touch with the Pakistan authorities.”) | একই ধরনের অর্বাচীন মন্তব্য ছিল ফরাসি প্রশাসনের এবং বিশেষভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। দুর্ভাগ্যজনক যে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরােপের প্রধান রাষ্ট্রগুলােতে তখন চলছে রক্ষণশীলদের শাসন। একমাত্র সােভিয়েত প্রেসিডেন্ট ঘটনার পরপরই পাক-প্রেসিডেন্টের কাছে এ দুঃখজনক ঘটনার অবসান ঘটানাের জন্য অনুরােধ জানিয়ে চিঠি পাঠান। এ চিঠিতে ইয়াহিয়ার প্রতিক্রিয়া ছিল অসন্তোষের। ফলে সােভিয়েত-ভূমিকা স্বল্পকালের জন্য হলেও নিরক্ষবিন্দুতে চলে আসে। তবে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরােধী দলীয় সদস্য ও সাংসদ বা সেনেটরদের অনেকে তাদের সরকারের ভূমিকা নিয়ে সমালােচনায় দ্বিধা করেন নি, এমন কি তাদের নীতি পরিবর্তনের জন্য ইতিবাচক পরামর্শও রাখেন। জন স্টোনহাউস থেকে এডােয়ার্ড কেনেডির মতাে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সমালােচনা সত্ত্বেও ব্রিটেন বা যুক্তরাষ্ট্র সরকার।
পূর্ব-পাকিস্তান সম্পর্কে তাদের নীতি পরিবর্তনের কোনাে প্রয়ােজন বােধ করে নি। ঐ সব সমালােচনার সূত্রে এবং সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে এ বিষয়ে। সংবাদপত্রে যথেষ্ট মন্তব্য ও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ইতােপূর্বে ৩১ মার্চ নিউইয়র্ক টাইমস-এর সম্পাদকীয় নিবন্ধে মার্কিন প্রশাসনের বিরুদ্ধে সমালােচনার কথা উল্লেখিত হয়েছে। কদিন পর (৪ এপ্রিল, ‘৭১) ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিতে গিয়ে প্রসঙ্গক্রমে সিডনি শ্যানবার্গ নিউইয়র্ক টাইমস’-এ হতাশ কণ্ঠে মন্তব্য করেন যে এ বিষয়ে এক ভারত ছাড়া পৃথিবীর অন্যান্য সরকারের অধিকাংশই নির্বাক রয়েছে’ (“Most of the other governments of the world have remained silent”.)। একইভাবে ১০ এপ্রিল ‘নিউজ উইক’-এ ভারতের উদাহরণ তুলে বলা হয় যে যুক্তরাষ্ট্র সতর্কভাবে পাকিস্তানের ঘটনাবলী থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছে।’ | কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত এই নিরপেক্ষতার মুখােশ খুলে ফেলা হয়েছে নিউইয়র্ক টাইমস’-এর নিবন্ধে (১৫ এপ্রিল)। সেখানে বলা হয় : পাকিস্তানের করুণ অভ্যন্তরীণ সংঘাত সম্পর্কে ওয়াশিংটনের হস্তক্ষেপ না করার (নিরপেক্ষতার) ভান স্টেট ডিপার্টমেন্টের এ সপ্তাহের বক্তব্যে ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। স্টেট ডিপার্টমেন্ট স্বীকার করেছে যে যুক্তরাষ্ট্রে অত্যাচারী পাকিস্তান সরকারের কাছে সামরিক সাজ সরঞ্জাম বিক্রি করে আসছে এবং তা নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব ক্রমাগত অস্বীকার করে চলেছে। এমন কি স্টেট ডিপার্টমেন্ট বলছে যে পাকিস্তানে এসবের শেষ চালান করে দেওয়া হয়েছে কিংবা নতুন করে পাঠানাের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে কিনা সে সম্পর্কে তারা কিছু জানে না।’ (“Washington’s pretense of non-intervention in Pakistans tragic internal conflict has been shattered this week by State Department’s acknowledgement that the United States has been selling ammunition and other military equipment to the repressive Pakistani Government and by the Adminstraion’s persisting refusal to impose a ban on such sales….the State Department says it does not know when the last arms deliveries were made to Pakistan or what is being prepared for shipment.”)
নিউইয়র্ক টাইমস’ ‘বুলেট না রুটি (Bullets or Bread’) শীর্ষক এই প্রতিবেদনে শুধু নিক্সন প্রশাসনের মিথ্যাচারের বেলুনটি ছিদ্র করে দিয়েই ক্ষান্ত হয় নি, তাদের অমানবিক নীতির সমালােচনা প্রসঙ্গে পূর্ব-পাকিস্তানের জন্য নির্দিষ্ট গম পাঠানাে স্থগিত করাকে ‘দুর্গত বাঙালিদের ওপর নিষ্ঠুরতম আঘাত’ (“the cruelest blow of all to the miserable Bengalis”) হিসাবে চিহ্নিত করেছে। প্রশ্ন তুলেছে মার্কিন প্রশাসনের কথিত নিরপেক্ষতা নিয়ে বিশেষ করে মানবিক সাহায্যের প্রসঙ্গে তাদের উল্লিখিত আচরণ নিয়ে, যে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ প্রাধান্য পাওয়া উচিত নয়। | ইভনিং স্টার’ অবশ্য কিছুটা সতর্কতার সঙ্গে কথা বলেছে পূর্ব-পাকিস্তান বিষয়ক মার্কিন ভূমিকা সম্পর্কে। নিউইয়র্ক টাইমস-এর সংবাদদাতার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বিবরণ উল্লেখ করে কাগজটিতে বলা হয়, “বিবরণের অতিরঞ্জন বাদ দিয়েও পূর্বপাকিস্তানে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড হৃদয়বিদারক বলে মনে হয়। খাদ্যাভাব, বন্যা ও দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে অবশেষে তাতে বলা হয় : মার্কিন যুক্তরাষ্ট এ মুহূর্তে যন্ত্রণাক্লিষ্ট দর্শকের ভূমিকা ছাড়া প্রকাশ্য কোনাে ভূমিকা নিতে পারে না। তবে তার উচিত নিঃশব্দ কূটনীতির মাধ্যমে পাকিস্তানকে হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে রাজি করানাে, যেহত্যাকণ্ডের ব্যাপকতা গণহত্যায় পরিণত হতে যাচ্ছে’ (১৭ এপ্রিল, ১৯৭১)। | বিস্ময়কর যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা যেখানে পূর্ব-পাকিস্তানে গণহত্যা সম্পর্কে নীরব দর্শকের এবং পাকিস্তানি শাসকদের মদতদান ও সাহায্যকারীর (অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করে) সেখানে মার্কিনি পত্রপত্রিকা জগতের অধিকাংশ প্রভাবশালী সদস্যই যুক্তিনিষ্ঠ ন্যায়নীতির ভিত্তিতে পাক-সরকার ও মার্কিন নীতির তীব্র সমালােচনা করেছে, পরামর্শ দিয়েছে সঙ্গত আচরণের, ইভনিং স্টার’-এর মতাে নম্র বা মধ্যবর্তী অবস্থান নেয় নি। ব্রিটিশ কাগজগুলাের ধীরস্থির হিসেৰি ন্যায়নীতির তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের উল্লিখিত কাগজগুলাের ভূমিকা ছিল অধিকতর স্পষ্ট, ইতিবাচক এবং কথার মারপ্যাচহীন।
তাই পূর্ব-পাকিস্তানে গণহত্যায় পাক-সেনাদের মার্কিনি অস্ত্র ব্যবহার প্রসঙ্গে কূটনীতিক চেষ্টার বােলস কড়া বিরুদ্ধবাদী মনােভাব প্রকাশ করে নিউইয়র্ক টাইমস’-এ যে প্রতিবেদন পাঠান তাতে স্পষ্টভাষায় বলা হয় যে মার্কিন সরকারের উচিত অবিলম্বে পাকিস্তান সরকারের কাছে মার্কিনি অস্ত্রশস্ত্রের অপব্যবহার সম্পর্কে কঠোর প্রতিবাদ জানানাে এবং খাদ্য ও ওষুধ ছাড়া সব সাহায্য আশু বন্ধ করা। এশিয়ার শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের উচিত নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক আহ্বান করা। কিন্তু মার্কিন সরকারের মুখপাত্র এসব পরামর্শ অগ্রাহ্য করে বলেছেন যে পূর্ব-পাকিস্তানের যুদ্ধ তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। সেখানে হস্তক্ষেপ করার অধিকার আমাদের নেই। ক্ষুব্ধ নিবন্ধকার স্বভাবতই প্রশ্ন তুলেছেন কঙ্গোতে যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতা সম্পর্কে, তুলেছেন দক্ষিণ আফ্রিকা, রােডেশিয়া ও সাইপ্রাস সম্পর্কে মার্কিন ভূমিকা নিয়ে। অর্থাৎ সেসব কি অভ্যন্তরীণ বিষয় ছিল না? তা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র সেসব দেশে হস্তক্ষেপ করেছে কেমন করে? তার ভাষায় (Two actions, it seems to me, should be taken at once. First, we should lodge a strong protest with the West-Pakistan Government over the misuse of U.S. military equipments and all aid except medical supplies and food should promptly be stopped. Second, we should call for a meeting of the Security Council of the United Nations to consider appropriate steps to deal with the threat to the peace of Asia which this conflict has become. ne US Government spokeman have already ignored the first suggestion and rejected the second on the ground that the fighting in East-Pakistan is an ‘interal question in which we have no right to interfere. But what about U.S. action in Congo? What about South Africa, Rhodesia, Cyprus?”)
এরপরও নিউইয়র্ক টাইমস’ দিনের পর দিন পাকিস্তান-বিষয়ক মার্কিন-নীতির নানামুখী সমালােচনার নিবন্ধ ছেপেছে, সম্পাদকীয় লিখেছে, প্রধানত পাকিস্তানে মার্কিনি অস্ত্ৰসরবরাহ ও নৈতিক সমর্থনের বিরুদ্ধে। বলা যায় নিক্সন প্রশাসনকে কখনাে কখনাে অসুবিধায় ফেলেছে, “নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও পাকিস্তানে মার্কিন-অস্ত্র প্রেরণ’ (২২ জুন), “অস্ত্র যখন ধর্মতাত্ত্বিক সমস্যা’ (২৭ জুন) পাকিস্তানকে সাহায্য দেওয়া কেন’ (৩০ জুন), দক্ষিণ এশিয়া : দুর্যোগের পদধ্বনি’ (৫ জুলাই) ইত্যাদি তথ্যনির্ভর, সমালােচনামূলক প্রতিবেদন বা সম্পাদকীয় নিবন্ধাদি ছেপে। | বাংলাদেশ প্রশ্নে সত্যই নিউইয়র্ক টাইমস’-এর দেখা গেছে সঙ্গতিপূর্ণ ও ইতিবাচক। সমর্থনের ভূমিকা, যেমন পাকসেনাদের গণহত্যার বিরুদ্ধে তেমনি নিকান প্রশাসনের অনৈতিক ভূমিকার সমালােচনায়। তবে অন্যরাও এ দিক থেকে পিছিয়ে থাকে নি। যেমন বাঙালি নিধনে নিক্সন নীতির পরােক্ষ সহায়ক ভূমিকার নম্র সমালোচনা করেছে “ওয়াশিংটন ডেইলি নিউজ (৩০ জুন), আবার চড়া ভাষায় পাকিস্তানে মার্কিন সামরিক TRICUS STITC16H1 (“U.S. Arms for Pakistan : A Shameful Record = পাকিস্তানের জন্য মার্কিন-অন্ত্র : এক গ্লানির ইতিহাস”) করেছে ওয়াশিংটন পােস্ট’ (৫ জুলাই) যে-সমালােচনা নিন্দার অধিক। পরিশেষে নিক্সনের প্রতি তির্যক আহ্বান : ‘অন্ত্র সরবরাহ এখনাে চলছে। একমাত্র প্রেসিডেন্টই তা বন্ধ করতে পারেন।’ এরই মধ্যে ‘বাল্টিমাের সান ওয়াশিংটন স্টার’ ফিলাডেলফিয়া বুলেটিন” ‘পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে প্রেরিত অস্ত্রভর্তি জাহাজের যাত্রা প্রতিরােধ করার চেষ্টার খবর ছাপে মার্কিনি নীতির দ্বিচারণা উদঘাটিত করে (১৬ জুলাই)। ওয়াশিংটন পােস্ট আবারও মার্কিন নীতি ‘দুঃখজনক’ বলে অভিহিত করে মার্কিন প্রশাসনকে নীতি। পরিবর্তনের এবং পাকিস্তানকে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ বন্ধের পরামর্শ দিয়েছে সেই সঙ্গে এ কথা উল্লেখ করে যে “বিশ্ব পাকিস্তানে এক ধ্বংসযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করছে, হিটলারের পর যার তুলনা মেলে না” (“In Pakistan the world is witnessing holocaust unmatched since Hitlar.” July 30, 1971) ‘নিউজ উইক’ বা ‘টাইম’-এর মতাে স্বনামখ্যাত সাপ্তাহিকও গণহত্যা ধর্ষণ ও ধ্বংসের মর্মস্পর্শী বিবরণ নিয়মিত প্রকাশের পাশাপাশি তাদের মতাে করে পাকিস্তানবিষয়ক মার্কিন নীতির সমালােচনা করেছে মূলত মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে। ‘সর্বোত্তমবন্ধু (“The very Best Friend) শীর্ষক প্রতিবেদনে (২৩ আগস্ট) ‘নিউজউইক’ ক্ষুব্ধ ভাষায় মার্কিননীতির সমালােচনামূলক মন্তব্য প্রকাশ করেছে একাধিক পদস্থ কর্মকর্তার প্রসঙ্গে।
শেষ পর্যন্ত ওয়াশিংটন পােস্ট অভিযােগ এনেছে যে শান্তির প্রতি হুমকির প্রতীক পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র এক কাতারে দাঁড়ানাে (২২ অক্টোবর)। ডিসেম্বরে সংকটের শেষলগ্নে পৌছেও মার্কিনি কাগজগুলাে বিশেষ করে নিউইয়র্ক টাইমস “টাইম’ ওয়াশিংটন পােস্ট’ দক্ষিণ এশিয়ার এই অভাবিত সংকটের ওপর অসাধারণ বক্তব্য রেখেছে, শেষমুহূর্তেও মার্কিননীতির সমালােচনা করে নিন প্রশাসনের উদ্দেশ্যে সুপরামর্শ রেখেছে। এর মধ্যে উল্লেখযােগ্য ৯ ডিসেম্বর নিউইয়র্ক টাইমস’-এ প্রকাশিত বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব জে, পি, লিউয়িস-এর ‘নিক্সন ও দক্ষিণ এশিয়া’ নিবন্ধ এবং “টাইম ম্যাগাজিনে বাংলাদেশ : যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে একটি জাতির জনা’ শীর্ষক দীর্ঘ প্রতিবেদন (১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১)। | শেষােক্ত নিবন্ধটিতে উপমহাদেশে মার্কিন-নীতির ব্যর্থতার জন্য ব্যক্তি নিক্সন ও নিক্সন প্রশাসনকে দায়ী করে অভিযােগ আনা হয়েছে স্কুল, অপরিণামদর্শী পদক্ষেপের জন্য। তাদের ভাষায় মার্কিন প্রশাসনের নির্বোধ ভুলের জন্য যুক্তরাষ্ট্র আলােচ্য দক্ষিণ এশীয় সংঘাতে নিরপেক্ষ থাকার সুযােগ নষ্ট করেছে: রুশ-ভারত ও পাক-চীন সম্পর্ক এগিয়ে দিয়েছে। নিজেকে নৈতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে একটি নিষ্ঠুর, পরাজয়ের সম্মুখীন সরকারের সঙ্গে যুক্ত করেছে; সর্বোপরি উপমহাদেশে মার্কিন অবস্থান বিশৃঙ্খল অবস্থায় পৌছে দিয়েছে।’ | উল্লিখিত মার্কিনি কাগজগুলাে মূলত মার্কিন নীতির প্রশ্নেই কথা বলেছে, প্রাসঙ্গিকভাবে এসেছে রাশিয়া ও চীনের ভূমিকার কথা, কৃচিত ব্রিটেন প্রসঙ্গ। অথচ দক্ষিণ এশিয়ার এত বড় একটি তাৎপর্যপূর্ণ (মর্মান্তিকও) রাজনৈতিক ঘটনা সম্পর্কে ব্রিটিশ কাগজগুলাে চমকপ্রদ ভূমিকা রেখেও ব্রিটিশ প্রশাসনের রক্ষণশীল নীতি সম্পর্কে গভীর সমালোচনায় মনােযােগ দেয় নি। যা বলেছে অনেকটা গতানুগতিক ধারায় বা আনুষ্ঠানিক সাংবাদিকতার ভঙ্গিতে । অথচ একটি কমনওয়েলথভূক্ত রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে জাতিগত সংঘাতের বিষয় নিয়ে ব্রিটেনের পক্ষে সুযােগ ছিল নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নেওয়ার। যে কারণেই হােক ব্রিটিশ কাগজগুলাে ব্রিটিশ সরকারের ভূমিকা সম্পর্কে তাদের মতাে করেই কথা বলেছে। যেমন ২৮ মার্চ ‘দ্য টাইমস’ পত্রিকায় সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়েছে যে এখন সময় কথা বলার।
পূর্ব-পাকিস্তানের ঘটনা অভ্যন্তরীণ বিষয়’ হিসাবে চিহ্নিত করলে চলবে না, যেমনটা ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব বলেছেন। ব্রিটিশ সরকার এবং অন্যদেরও পূর্ব-পাকিস্তানে সংঘটিত ঘটনাবলী সম্পর্কে প্রকাশ্যে কড়া ভাষায় ‘বিরাগ প্রকাশ করা দরকার। ইয়াহিয়াকে বােঝানাে দরকার যে তার অনুসৃত নীতি ল’। | ব্রিটিশ পত্রপত্রিকা তাই ঘটনার যথাযথ বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছে, সমস্যার যৌক্তিক বিশ্লেষণ করেছে, বিভিন্ন রাষ্ট্রিক তৎপরতার বিবরণ ও ব্যাখ্যা দিয়েছে কিন্তু মার্কিন সাংবাদিকদের কারাে কারাে মতাে স্বদেশী সরকারের নীতি সম্পর্কে চুলচেরা বিচার করতে বসে নি বা করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ দিতে চায় নি। তবে ‘সানডে টাইমস’-এ মাঝে মাঝে আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপট নিয়ে বিশিষ্ট রাজনীতিক বা কূটনীতিক তাদের নিজস্ব বিচার-ব্যাখ্যা হাজির করেছেন। যেমন ১১ জুলাই সংখ্যায় রেগ প্রেন্টিসের নিবন্ধ, যেখানে স্পষ্টই বলা হয়েছে পাকিস্তানে চীন-মার্কিন সামরিক সরবরাহ বন্ধের কথা, প্রধান রাষ্ট্রগুলাের পাকিস্তানি গণহত্যার নিন্দা করার কথা। তবে কি মার্কিনি কি ব্রিটিশ সাংবাদিক সবাই উষ্ণ মানবিক আবেগ নিয়ে শরণার্থীদের দুঃখ-দুর্দশা, আতংক-মৃত্যু ও তাদের অন্ধকার ভবিষ্যৎ নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ বিবরণের পাশাপাশি যথাযথ বিচার-বিশ্লেষণ হাজির করেছেন নিজ নিজ কাগজের পাতায়। জাতিসংঘের প্রতি আবেদন রেখেছেন এ মানব-ট্রাজেডির মানবিক সমাধানে দ্রুত, সর্বতােমুখী ত্রাণসাহায্যের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য। তেমনি বিশ্বের প্রধান রাষ্ট্রগুলাের উদ্দেশ্যেও তাদের আহ্বান ছিল সাহায্যের উদার হাত বাড়িয়ে দেবার জন্য। আবার এর মধ্যে কেউ কেউ সমস্যার উৎসের দিকে নজর দেবার জন্য তাদের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছে। পাশাপাশি বাঙালি যােদ্ধাদের বিবরণও অকুস্থল থেকে সংগ্রহ করে সংবাদদাতাগণ অনেক ক্ষেত্রে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাঠিয়েছেন যার যার কাগজে। তারা আন্তর্জাতিক রাজনীতির নায়কদের বারবার হুশিয়ার করেছেন তাদের প্রতিবেদনে যে দক্ষিণ এশিয়ায় আরেকটি যুদ্ধ আসন্ন। বলেছেন : এখনাে সময় আছে তাদের প্রভাব বিস্তার করে। পাকিস্তানে একটি রাজনৈতিক সমাধান নিশ্চিত করার।
অবশ্য অধিকাংশই এমন মত প্রকাশ করেছেন যে পূর্ববাংলার মাটিতে এত রক্ত ঝরেছে যে তার পক্ষে অখও পাকিস্তানের মধ্যে পূর্ব-পাকিস্তান হয়ে থাকা এক অবাস্তব চিন্তা– যতই স্বায়ত্তশাসনের কথা এখন বলা হােক না কেন। যারা রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলেছেন তাদের উদ্দেশ্য ছিল আরাে একটি পাক-ভারত যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানাে। কারণ যুদ্ধে সাধারণ মানুষেরই কষ্ট সবচেয়ে বেশি। তবে সংবাদ-ভাষ্যকারদের দক্ষিণ-এশীয় সংকট ও স্বাধীনতা-যুদ্ধ নিয়ে সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক বিশ্লেষণ ছিল পূর্ব-পাকিস্তানে দীর্ঘস্থায়ী গেরিলাযুদ্ধের সম্ভাবনা নিয়ে এবং সে ক্ষেত্রে মাওবাদী বা বিপ্লবী কমিউনিস্টদের প্রভাববৃদ্ধির আশংকা নিয়ে, এমন কি এ পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব ও পশ্চিম বঙ্গের পারস্পরিকতা নিয়ে। তাদের এ বিচার-বিশ্লেষণ ও তার বাস্তবতা নিয়ে ইতােপূর্বে যথাস্থানে আলােচিত হয়েছে। একাত্তরে পাকবর্বরতা ও তার প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বিশ্বের সংবাদ ভাষ্যকারগণ তাদের বিচার-বিশ্লেষণে উল্লিখিত বিশেষ কয়েকটি দিকের প্রতি গুরুত্ব আরােপ করেছিলেন। বলাবাহুল্য এর কিছু না কিছু সুফল বাংলাদেশের পক্ষে ইতিবাচক পরিণাম বহন করেছে। বর্তমান আলােচনায় তাদের সংবাদ-ভাষ্যের ঐ গুরুত্বপূর্ণ ধারা ক’টি চিহ্নিত করা হয়েছে। অবশ্য এর বাইরে পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা নিঃসন্দেহে অসামান্য। আর অসামান্য বলেই তাদের বিশ্লেষণ, সতর্কবাণী অনেক ক্ষেত্রে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর ১২ জুলাই তারিখে জনৈক কূটনীতিকের মন্তব্য উদ্ধার করে নিউজউইকে প্রকাশিত বাক্যটি : পাকবাহিনী যেদিন পূর্বাঞ্চলে প্রবেশ করেছে সেদিনই পাকিস্তানের মৃত্যু ঘটেছে” (“Pakistan died the day the army entered in the Eastern region.”)
সূত্র : একাত্তরে পাকবর্বরতার সংবাদভাষ্য – আহমদ রফিক