পাক-সহিংসতার পরিণামে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
পঁচিশে মার্চ থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অব্যাহত গণহত্যা ও ধ্বংসলীলার ফলে পূর্ববাংলার শহর, গ্রামাঞ্চল যে রক্তে ভেসেছে তাই নয়, দিশাহারা মানুষ হিসাব-নিকাশ। করে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রধানত ত্রিপুরা, পশ্চিম বঙ্গ, মেঘালয় প্রভৃতি রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছে। পশ্চিমা সংবাদভুবনের ভাষায় এ হল “হিউম্যান ট্র্যাজেডি’। পাকসেনাদের উন্মত্ত আক্রমণের সপ্তাহ খানেক সময় পশ্চিমা সংবাদভুবন স্তব্ধ হয়েই ছিল, তারপর ধীরে ধীরে জেগে উঠে লিখতে থাকে জাতিগত হত্যাকাণ্ডের কথা, ক্রমে জেনােসাইড’ তথা গণহত্যার কথা। সংবাদ নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও নানাভাবে তারা খবর সংগ্রহ করেছেন, ঘুরে গেছেন পূর্ব-পাকিস্তানে। বিবরণ ছেপে প্রকাশ করেছেন পাকবাহিনীর হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন ও অগ্নিসংযােগের ব্যাপকতার কথা। ঘটনাবলী কাগজে পড়ে সাধারণ মানুষ হতবাক ও বিহ্বল হয়েছেন, কেউ কেউ কাগজে প্রতিবাদপত্র পাঠিয়েছেন। সমালােচনা করেছেন নিজদেশের প্রশাসন এবং বিশ্বের শক্তিমান রাষ্ট্রগুলাের অদ্ভুত নীরবতা বা শীতলতার জন্য। মানবতার বিরুদ্ধে যখন অপরাধ সংঘটিত হয় তখন নীরবতার অর্থ যে পাপ এ বােধ সাধারণ মানুষের থাকলেও কিংবা একদা প্রগতিবাদী বুদ্ধিজীবীদের কণ্ঠে উচ্চারিত হলেও স্বার্থের হিসাব-নিকাশে আবদ্ধ বিশ্বের পরাক্রান্ত রাষ্ট্রপ্রধানদের বিবেক টলে নি। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, কিন্তু প্রতিকারের মতাে শক্তিতে নয়। জাতিসংঘ নামক ক্লীব সংস্থা একেবারেই নির্বাক রয়েছে। | তাই পূর্ব-পাকিস্তানে রক্ত ঝরেছে, প্রাণের ভয়ে মানুষ পালিয়েছে; পালিয়েছে অন্য এক ট্র্যাজিক পরিণামের দিকে। কাগজগুলাে মৃত্যুর মুখ থেকে পালিয়ে যাওয়া মানুষের করুণ পরিণতি অর্থাৎ অনাহার, মহামারী (বিশেষত কলেরা)র মতাে ভিন্নতর বিপর্যয়ে আক্রান্ত অসহায় শরণার্থীদের মৃত্যুর বিবরণ প্রকাশ করেছে। আবেদন জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে মানবিক সাহায্যের জন্য। তাদের দবি ; পাকসেনাদের বর্বরতার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের সামরিক সরকারকে অস্ত্র, অর্থ বা অন্য প্রকার সাহায্য যেন দেওয়া না হয় যা মানবট্র্যাজেডি’ বাড়াতেই শক্তি যােগাবে। কেউ কেউ এমন দাবিও করেছেন যে পাকিস্তানমুখী নিয়মিত আন্তর্জাতিক সাহায্য বন্ধ করে এর সিংহভাগ হতভাগ্য শরণার্থীদের দুর্দশা লাঘবের জন্য ব্যয় করা হােক।
ইতােপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে বিশ্বব্যাংকের অন্যতম পরিচালক পিটার কারগিল তার অকুস্থল পরিদর্শনের অভিজ্ঞতায় ভর করে লেখা রিপাের্টে মতামত প্রকাশ করেছেন। পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের অর্থ সাহায্য না পাঠাতে। কিন্তু নিক্সন-কিসিঞ্জার প্রশাসন এ জাতীয় রিপাের্টে প্রভাবিত হয় নি। সম্ভবত ভিয়েতনাম যুদ্ধের অমানবিক চেতনাই তাদের বিচারবুদ্ধি পরিচালনা করেছে। তাদের স্বার্থপর রাজনীতি একদেশদর্শী অন্ধ রাষ্ট্রনীতিই অনুসরণ করেছে। তাই পূর্ববাংলায় গণহত্যার তাণ্ডব তাদের রাজনৈতিক বােধে আঘাত করে নি, কোনাে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে নি মানবিক বােধে। পাকবাহিনীর আক্রমণের হাত থেকে জান বাঁচাতে, মান বাঁচাতে পূর্ববাংলা থেকে ভয়ার্ত মানুষের যে কাফেলা সীমান্ত অতিক্রম করেছে প্রথম দিকে তাতে ছিল মুসলমানহিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ। পরে সে সংখ্যা যেমন বেড়েছে তেমনি ঘটেছে তার। চরিত্রবদল। পাকশাসকদের নীতি পরিবর্তনের ফলে শরণার্থীদের সিংহভাগ তখন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। দেশের ভেতরে সাম্প্রদায়িক ভেদনীতি চালু করে পাক-শাসকশ্রেণী সাফল্য পেতে চেয়েছিল, কিন্তু মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ার পরও শেষ রক্ষা হয় নি। দেশের ভেতর থেকেই প্রতিরােধ জন্ম নিয়েছে।
আর পাক-সেনাবাহিনীর হিংসার উন্মত্ততা ঐ প্রতিরােধের প্রতিক্রিয়ায় অধিকতর কুদ্ধ হিংসার জন্ম দিয়েছে। সে আঘাত পড়েছে প্রধানত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরীহ নরনারী ও শিশুদের ওপর। পাকবাহিনীর ঐ বর্বরতার ছবি ভাষা পেয়েছে বিদেশী। সংবাদপত্রে, ধরা পড়েছে সাংবাদিকের ক্যামেরায়। সে ছবি দেখেছে বিশ্বের তাবৎ মানুষ, বিবরণ পড়ে বিচলিত হয়েছেন তারা। কিন্তু ঐ বহুকথিত ‘মানব ট্র্যাজেডি বিশ্বের শক্তিমান রাষ্ট্রনায়কদের যুক্তিসঙ্গত মাত্রায় স্পর্শ করে নি। তাদের কারাে কারাে প্রতিক্রিয়া ছিল বড় স্থূল ও অদ্ভুত। নিক্সন-কিসিঞ্জার প্রশাসনের শীতলতা সত্ত্বেও পূর্ব-পাকিস্তানে গণহত্যা ভিন্ন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে মার্কিনি রাজনীতিকদের একাংশে। লন্ডনের টাইমস’ পত্রিকার ওয়াশিংটনস্থ সংবাদদাতার ভাষ্যে জানা যায়, বেশ কয়েকজন রিপাবলিকান ও ডেমােক্র্যাট সেনেটর সেনেটে প্রস্তাব রাখেন যে পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধের অবসান না ঘটা পর্যন্ত সেখানে সামরিক সাহায্য বন্ধ রাখা হােক’ (“A Senate resolution urging the United States to suspend all arms assistance to Pakistan until civilwar has ended was proposed by Republican and Democratic sponsors.”— The Times, 21 April, 1971) অবশ্য পাকবাহিনীর আক্রমণ শুরু হওয়ার এক সপ্তাহ পর (২ এপ্রিল) সােভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পােদগর্নি পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে চিঠি লিখে অনুরােধ জানান যাতে পূর্ব-পাকিস্তানে রক্তপাতের অবসান ঘটে এবং উদ্ভুত সঙ্কটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ গ্রহণ করা হয়। সােভিয়েত পত্রপত্রিকায় এ আবেদন গুরুত্ব সহকারে ছাপা হয়। কিন্তু পাকিস্তানি শাসক শ্রেণী এ বার্তা প্রসন্নমনে গ্রহণ করে নি। মনে রাখা
দরকার যে পূর্ববাংলায় পাক-সেনাবাহিনীর সৃষ্ট সঙ্কট সম্পর্কে বিশ্বে এটাই ছিল রাষ্ট্রিক পর্যায়ে প্রথম বিরূপ প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ। পােদগনি আরাে বলেছিলেন; ‘এ ঘটনা সােভিয়েত ইউনিয়নে প্রবল আতঙ্ক সৃষ্টি CICE I (“Soviet newspapers today (4 April) gave prominence to President Podgory’s apeal to President Yahya Khan of Pakistan calling for an end to bloodshed in East-Pakistan and a peaceful settlement of the crisis. “This had caused “great alarm” in the Soviet Union, President Podgorny said. It was the first official comment on the East-Pakistan crisis since the army was used there,”—The Times, 5 April, 1971)। কিন্তু ইয়াহিয়া এ আবেদনে সাড়া দেবার প্রয়ােজন বােধ করেন নি, হয়তাে পশ্চিমা বিশ্বের নীরবতা তার কাছে। সমর্থন বলেই মনে হয়েছিল। অবশ্য প্রশ্ন উঠেছিল অস্ট্রেলিয়ার প্রতিনিধি সভায় এই মর্মে যে পূর্ব-পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক সরকারের হাতে সংঘটিত গণহত্যা সম্পর্কে তাদের প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যে প্রতিবাদ জানান নি কেন? জবাবে প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম ম্যাকমােহন বলেন যে তারা রক্তপাত সম্পর্কে দুঃখ প্রকাশ করার পাশাপাশি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বেসামরিক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংকল্প ঘােষণা স্বাগত জানিয়েছেন। অস্ট্রেলীয় প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক কূট জবাব পশ্চিমা রাজনীতিরই চরিত্র প্রকাশ করে। এর মধ্যে ক্রমে অবস্থার আরাে অবনতি ঘটে, দেশত্যাগের হিড়িক পড়ে যায় আক্রান্তদের মধ্যে। সীমান্ত অতিক্রম করে প্রতিদিন বহুসংখ্যক শরণার্থী ওপারে এক অমানবিক অবস্থার মুখােমুখি হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধে হস্তক্ষেপের জন্য ব্রিটিশ সাংসদদের ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে বিদেশ-সচিব স্যার অ্যালেক ডগলাসহােম পূর্ব-পাকিস্তানে অন্ততপক্ষে জরুরি ভিত্তিতে সাহায্যের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের সরাসরি উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি জাতিসংঘের মহাসচিব উ. থানের সঙ্গে গােপনে কথাবার্তা বলেন।
তিনি সমস্যাটি নিয়ে মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট উইলিয়াম রজার্সের সঙ্গে আলােচনা করেন।’ কিন্তু দেখা গেল যে পূর্ব-পাকিস্তানে বাঙালিদের ট্র্যাজেডি সম্পর্কে গভীর অনুধাবন সত্ত্বেও স্যার অ্যালেক জেনারেল ইয়াহিয়া খা’র সরকারের সঙ্গে ব্রিটেনের সুসম্পর্ক নষ্ট করা নিয়ে উদ্বিগ্ন’ (অর্থাৎ সম্পর্ক নষ্ট করতে চান না)। একেই বলে ব্রিটিশ রাজনীতির f (“Faced by growing pressure among British MP’s for intervention in Pakistan’s civil war, Sir Alec Douglas Home, the foreign secretary has taken a direct initiative to obtain international support at least for getting urgent relief supplies into East-Pakistan. He held confidential talks with U. Thant, United Nations Secretary General, and he has discussed the problem with the US Secretary of State Mr. William Rogers. (“Sir Alec, is known to feel very strongly about the tragedy of the East Bengalis, but he is anxious not to disrupt Britain’s good relations with General Yahya Khan’s Government.”–The Guardian, 2 May, 1971) আশ্চর্য! পাকবাহিনী তাদের কথিত স্বদেশে মানুষ হত্যায় অর্থাৎ বাঙালি জনগােষ্ঠীকে
ঘিরে গণহত্যায় মেতেছে তবু গণতন্ত্রী বলে কথিত ইঙ্গ-মার্কিন মহাপ্রভুদের চেতনায় আঘাত পড়ছে না। নিক্সন প্রশাসন চরম ভারতবিদ্বেষী এবং একই সঙ্গে পরম পাকিস্তানপ্রেমিক বলেই বােধ হয় বাংলাদেশের সমস্যায় চোখ-কান বন্ধ করে স্থবির হয়ে আছেন— কিন্তু ব্রিটিশ প্রশাসন। কিছুটা ভিন্ন অবস্থান সত্ত্বেও তাদের বিবেকেও আঁচড় কাটছে না। পাকবাহিনীর হত্যাকাণ্ড আর অমানবিক অনাচার! কারণটা স্যার অ্যালেক বলেই ফেলেছেন, থলে থেকে বেড়াল বেরিয়ে এল। সাংসদদের চাপে। পাক-সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক নষ্ট করতে তারা নারাজ। তবে হ্যা, মানবিক সাহায্যটা করতেই হয়, না হলে নিজেদের ন্যায়নীতির সুনাম টেকে না। তাই শরণার্থীদের জন্য মানবিক সাহায্যের আবেদন জানানাে হয়েছে ব্রিটিশ সরকারের তরফ থেকে, সাহায্যও বরাদ্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু সংখ্যক ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য তৎপর হয়ে উঠেছেন আসন্ন প্যারিস বৈঠকের ওপর প্রভাব রাখতে যাতে পাকিস্তানকে আপাতত সাহায্য দেওয়া না। হয়, বিশেষ করে ব্রিটিশ সাহায্য। কারণ এ অর্থ যে পাকিস্তান সমরসজ্জায় ব্যয় করবে, এ বিষয়ে সন্দেহের কোনাে কারণ নেই। অন্যদিকে শরণার্থীদের জন্য সাহায্যের প্রচেষ্টাও অব্যাহত রাখা হয়েছে। ওয়র অন ওয়ান্ট’ ‘অক্সফ্যাম’ প্রভৃতি সেবা সংস্থা উদ্যোগী হয়ে উঠেছে বাঙালি শরণার্থীদের জন্য মানবিক সাহায্যের হতি বাড়িয়ে দিতে। কিন্তু পাকিস্তান পূর্ববঙ্গে আন্তর্জাতিক সাহায্য কর্মকাণ্ডের ঘাের বিরােধী (“Pakistan remains adamantly opposed to international relief services working in East Bengal”. –The Guardian, 2 May, 1971)
ইঙ্গ-মার্কিন সরকার সরাসরি পাকিস্তানি বর্বরতার প্রতিবাদ না কলেও সেখানকার রাজনৈতিক অঙ্গনের মানুষ ব্যক্তিগতভাবে প্রতিবাদে এগিয়ে এসেছেন। বিবিসি’র সঙ্গে ২৭ এপ্রিল এক সাক্ষাঙ্কারে ব্রিটিশ সাংসদ (লেবার পার্টির) জন স্টোনহাউস (২৭ এপ্রিল) বলেন যে পূর্ববঙ্গে ভয়াবহ যা কিছু ঘটেছে বিগত যুদ্ধের পর এমন আর দেখা যায় নি (“Labour MP John Stonehouse was interviewed on the programme of BBC on April 27. Stonehouse said that ‘terrible’ things had happened in East Bengal, things which have not been seen since the last war.”-The Daily Mirror, 28 April, 1971)। প্রাক্তন বিদেশ সচিৰ পিটার শাের আরাে তীব্র ভাষায় ঘটনার নিন্দা করেন, সমালােচনা করেন পাক-সরকারের কর্মকাণ্ডের । তার ভাষায় ‘ঘটনা এমনই ভয়াবহ, বর্বর এবং ইচ্ছাকৃত বল প্রয়ােগ যে বিষয়টা উপেক্ষা করা লজ্জাজনক’ (“…an outrage, an act of savage and deliberate repression that it would be shameful to ignore”-The Spotsman, 3 May, 1971) প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বিশেষ দূত এম,এম, আহমদ ভিক্ষাপাত্র হাতে পশ্চিমা দেশ সফরে বেরিয়েছেন। গার্ডিয়ান’-এর মতে যুক্তরাষ্ট্র হয়ে লন্ডনেও তিনি একই শীতল অভ্যর্থনা পেয়েছেন। প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও মহাসচিব উ-থান-এর সঙ্গে কথা শেষ করে দূত লন্ডনে এসেছেন,যাতে অর্থ সাহায্য ত্বরান্বিত করা যায়। তবে বিশ্বব্যাংকে ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, পশ্চিম জার্মানি এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সরকারের প্রতিনিধি সবারই বক্তব্য বিশ্বব্যাংকের অর্থ সাহায্য পেতে হলে পাকিস্তানকে সমরখাতে ব্যয় কমাতে হবে (“Britain and United States supported by Canada, West Germany and other Governments in the World Bank aid consortium are saying that Pakistan must reduce expenditure on troops in East Pakistan…if she expects assistance.” –The Guardian, 20 May, 1971)।
অন্যদিকে নিউইয়র্ক থেকে উ-থান আবেদন জানিয়েছেন ভারতে বিপুল সংখ্যক পূর্ব-পাকিস্তানি শরণার্থীর জন্য ব্যাপক সাহায্যের উদ্যোগ নিতে। কলকাতায় মানবতার সেবাকার্যে নিবেদিতপ্রাণ আলবেনীয় ধৰ্ম্যাজিকা মাদার তেরেসার তারবার্তা অক্সফ্যাম-এর কাছে : শরণার্থী ক্যাম্পে কলেরা, জলদি স্যালাইন পাঠান।’ বর্বর গণহত্যার প্রতিক্রিয়ায় তখন প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক উদ্বাস্তুর সীমান্ত অতিক্রম, শরণার্থী শিবিরগুলাে অসহায় মানুষে মানুষে সয়লাব। কিন্তু বিশ্বের শক্তিমান রাষ্ট্রগুলাের পক্ষ থেকে মানবিক আবেদনে সাড়া দিতে, নড়ে চড়ে বসতে সময় লেগেছে। (“Unfortunately, the World’s governments have not been in a hurry to form a human chain themselves. More than three weeks ago, U Thant made an urgent appeal for special contributions to the United Nation’s refugee committee. So far only four countries have made or pledged contributions.” -The Times, 6 June, 1971)। বিশ্বশক্তিগুলাে যে কারণেই হােক জেনারেল ইয়াহিয়াকে গণহত্যা বন্ধ করার জন্য ফলপ্রসূ চাপ দিতে ব্যর্থ হয়েছে, এমন কি পাকসেনাদের বর্বরতায় সৃষ্ট মানবিক সমস্যার প্রশমন ঘটাতেও অহেতুক সময় নষ্ট করেছে। ইতােমধ্যে যা ঘটার তাই ঘটেছে, বহু অসহায় মানুষকে ক্যাম্পে জীবন দিতে হয়েছে। তবে এর মধ্যেও কিছু কিছু ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা অব্যাহত থেকেছে। ব্রি
টিশ সাংসদ জন স্টোনহাউস ‘লন্ডন টাইমস-এ লেখা চিঠিতে পাকিস্তান সরকারের। মানবতা-বিরােধী অপরাধের নিন্দার পাশাপাশি শরণার্থী সমস্যায় ভারত সরকারকে আশু সাহায্যের জন্য আবেদন জানিয়েছেন। এমন কি বিশ্ববিবেকের কাছে আহবান জানিয়েছেন সমস্যার মূলে অর্থাৎ গণহত্যা বন্ধ করার ক্ষেত্রে দৃঢ় পদক্ষেপ নেবার জন্য । (“The evidence that the military Government of West Pakistan has committed on appalling crime against humanity in East Bengal is incontrovertible. Indeed the constant stream of refugees fleeing from terror confirms that the crimes continue. “It is right that the world should help the Indian Government to cope with the immense problems caused by this influx. …How much longer the world community salve its conscience by merely dabbing at the sores rather than acting firmly to stop the genocide. Talk of cutting off aid to Pakistan and diverting this towards the refugees is commendable but not sufficient.” – The London Times, 8 June, 1971) | শক্তিমান বিশ্বরাষ্ট্রগুলাে ঠিকই শরণার্থীদের সাহায্য করার ধীরস্থির নীতি গ্রহণ করে। তাদের বিবেকের ওপর স্বস্তি ও শাস্তির মলম লাগানাের কাজই করেছে। মানবতাবিরােধী যে অপরাধ প্রামাণ্য এবং বিতর্কের উর্ধ্বে, তা বন্ধ করার জন্য কোনাে কার্যকর পদক্ষেপ এইসব রাষ্ট্র গ্রহণ করে নি। রাষ্ট্রনৈতিক স্বার্থ এমনই বালাই যে তা অসহায় দুর্বলের পক্ষে দাঁড়াতে সাহায্য করে না। বাংলাদেশের সঙ্কটে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলাে ঐ স্বার্থবাদী সঙ্কীর্ণ ভূমিকাই গ্রহণ করেছিল।
সাংসদ স্টোনহাউস বা পিটার শাের ছাড়াও একাধিক বিশিষ্ট ব্যক্তি পূর্ববাংলার সঙ্কট নিয়ে নিজ নিজ সরকারের সঙ্গে কথা বলতে চেষ্টা করেছেন। আরেক শ্রমিক দলীয় ব্রিটিশ সাংসদ মাইকেল বার্নস কলকাতায় পূর্ববঙ্গের শরণার্থীদের দুর্গতি দেখে মন্তব্য করেন যে বিশ্বের উচিত এ ট্র্যাজেডি সমাধানের জন্য এগিয়ে আসা।’ তার মতে পূর্ববঙ্গে যা ঘটেছে তা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলার মতাে নির্বুদ্ধিতা আর নেই।’ তিনি প্রতিশ্রুতি দেন বিষয়টি তার সরকারের মাধ্যমে উত্থাপন করার । (“Mr. Michel Barnes, British Labour MP said the world must help to find a solution to the tragedy.’ He said it was ‘nonsense’ to call what happened in East Bengal was an internal affair of Pakistan. He promised to take it up with his Government to raise the issue before the United Nations.” Indian Express, 2 June, 1971) ব্রিটেনের ‘War on Want’ সংস্থার চেয়ারম্যান ডােনাল্ড চেসওয়র্থও সাংসদ বার্নসের সঙ্গে অভিন্নমত প্রকাশ করেন। | শেষপর্যন্ত দাতাগােষ্ঠীর প্যারিস বৈঠকের সিদ্ধান্ত ঠিকই পাকিস্তান সরকারের পক্ষে যায় নি। পশ্চিমা শিল্পোন্নত শক্তি ও জাপান মিলে নয়া সাহায্য সংক্রান্ত আলােচনা স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। যতদিন পূর্ব ও পশ্চিম-পাকিস্তানের সংঘাত রাজনৈতিক সমাধানে না পৌছায় ততদিন পর্যন্ত পাকিস্তানকে নতুন অর্থ সাহায্য দেওয়ার বিষয়টি স্থগিতই থাকবে। এ সিদ্ধান্তের পেছনে মূল প্রভাবক কারণ বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ-এশীয় বিভাগের পরিচালক পিটার কারগিলের অকুস্থল ঘুরে-আসাভিত্তিক প্রতিবেদন’ (‘দ্য গার্ডিয়ান, ২২ জুন, ১৯৭১)।
(“Paris, June 21. Delegates of Western Industrial powers and Japan today postponed discussion of fresh aid for Pakistan until a political settlement of the conflict between East and West Pakistan is in sight. … The consortium heard a report by Mr. Peter Cargill, South Asia Director of the World Bank who has just visited both parts of Pakistan for talks with country’s economic and political leaders.”–The Guardian, 22 June, 1971) | কিন্তু সবাই কি বহুদর্শীর নিরপেক্ষ ভূমিকা নিতে পারেন? আর পারেন না বলেই বােধহয় জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান ভারতে অবস্থিত শরণার্থীদের সম্পর্কে বিতর্কিত মন্তব্য করে প্রবল সমালােচনার সম্মুখীন হন। সমালােচকদের মতে হাইকমিশনার ইয়াহিয়া সরকারের বর্বরতার সাফাই গাইতে চেয়েছেন (‘দ্য গার্ডিয়ান, ২২ জুন, ১৯৭১)। অর্থাৎ অভিযােগ সত্য হলে তিনি তার মর্যাদাসম্পন্ন পদটির অমর্যাদা করেছেন। প্রথম আক্রমণের দিন থেকে তিন মাসের বেশি সময় পার হয়ে গেছে, তবু পূর্ববাংলায় শান্তি ফিরে আসে নি। শহরগুলাে আপাতদৃষ্টিতে চুপচাপ। এখন আক্রমণের শিকার গ্রামাঞ্চল ও সীমান্ত এলাকা। পাকবাহিনীর পদ্ধতি কিন্তু একই রকম— খুন, ধর্ষণ, নির্যাতন, অগ্নিসংযােগ ও লুটপাট। তাই সম্ভাব্য আক্রমণের শিকার সবাই সীমান্ত অতিক্রম করছে। চাপ বাড়ছে ভারতের ওপর, চাপ বিশ্বজনমতের ওপর। তবু ইয়াহিয়ার বােধােদয়। ঘটছে না। আবার কয়েকজন ব্রিটিশ সাংসদ পূর্ব-পাকিস্তান ও শরণার্থী শিবির পরিদর্শন শেষে নিশ্চিত হন যে ‘পূর্ব-পাকিস্তানে এখনাে সেনাবাহিনীর অত্যাচার চলছে, সেখানে আতঙ্কের কারণ বিদ্যমান এবং শরণার্থীদের জন্য আরাে সাহায্য দরকার।’ চার সদস্যের প্রতিনিধি দলের পক্ষে যুক্ত ঘােষণায় আর্থার বটমলি বলেন যে ‘জনপ্রতিনিধি হিসাবে তার সমগ্র কর্ম জীবনের এটাই সবচেয়ে হৃদয়বিদারক দৌত্যকর্ম। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান একজন সম্মানীয় ব্যক্তি, কিন্তু পূর্ব-পাকিস্তানে যা ঘটছে তা তার জানা আছে বলে মনে হয় না।” কথাগুলাে হিসাবী রাজনীতিকের মতাে মাপজোখ করে বলা কিন্তু বাস্তবতা-বর্জিত নয় ।
(“Mr. Arthur Bottomley made an agreed statement on behalf of the fourmember delegation. He emphasized three aspects of the situation: the element of fear existing in East Bengal, the continuing atrocities there and the need for further assistance to the refugees. “Mr. Bottomley said this had been the most harrowing mission he had undertaken in his entire public life. He found President Yahya Khan an honourable man who did not seem to know what was happening in East Bengal.”—Statesman, 5 July, 1971)। ব্রিটিশ সাংসদ প্রেন্টিসও একই ভাষায় বলেন : “মানবিক দুর্গতির এমন ভয়াবহ ও ব্যাপক ঘটনা এর আগে কখনাে দেখি নি” (“This is the most terrible thing I have ever seen both in terms of human suffering and the scale of this thing.” The Guardian, 30 June, 1971) | কিন্তু শরণার্থীদের জন্য বরাদ্দ সাহায্য যে পর্যাপ্ত নয়, সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। টাইমস পত্রিকার জেনিভা সংবাদদাতা। অন্যদিকে কারিতাস’ নামীয় সেবাসংস্থার প্রাক্তন পরিচালক পিটার কুহন দাবি করেন যে, শরণার্থীদের কাছে যে আন্তর্জাতিক সাহায্য পৌছাচ্ছে তা তাদের প্রয়ােজনের ২০ শতাংশ মাত্র। (“International aid reaching the East Pakistan refugees is no more than 20 per cent of what is needed, according to Mr. Peter Kuhn, former director of Caritas,” The Times, 29 June, 1971)। | সাংসদ প্রেন্টিস অবশ্য সানডে টাইমস-এ লেখা নিবন্ধে তার পাকিস্তান সফরের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কড়া ভাষায় কিছু মন্তব্য করেছেন। তার মতে ‘রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া পূর্ব-পাকিস্তানের সঙ্কট আরো অবনতির দিকে বাঁক নেবে’ (“In the absence of a political solution the crisis thrown up by the events in East Pakistan can only get worse.”)। শরণার্থী বিষয়ে তার পরামর্শ হলাে ‘এ বােঝার সিংহভাগ ভার বিশ্বকেই বইতে হবে’ (“The World must take a larger share of this burden.”)। |
তার মতে “তিনটি উপায়ের মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করে রাজনৈতিক সমাধান অর্জন সম্ভব। এক, পশ্চিমা শক্তিবর্গকে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে পাকিস্তানকে নতুন কোনাে অর্থনৈতিক সাহায্য দেওয়া চলবে না। দুই, যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। ওয়াশিংটনস্থ সেনেটর ও কংগ্রেস সদস্যদের পক্ষ থেকে মার্কিন প্রশাসনের নীতি পরিবর্তনের কথা যা বলা হয়েছে বিশ্বজনমতকে তা সমর্থন। করতে হবে। তিন, সব সরকার, পার্লামেন্ট ও প্রভাবশালী ভাষ্যকারদের পক্ষ থেকে অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাষায় (পাকিস্তান বাহিনীর কর্মকাণ্ডের) নিন্দা প্রকাশ করতে হবে। বিশ্বজনমত ও সরকারগুলােকে বাঙালি জনগণের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে একাত্ম হতে হবে।’ (“…there are three ways in which pressure can be maintained in favour of a political solution. First, the Western Powers must stand firmly by their decision not to renew economic aid… Second, there should be an immediate end to the shipment of arms from the USA to Pakistan. World opinion should back those senators and congressmen in Washington who have urged the Administration to reverse its policy. …Third, there should be the most explicit condemnation from governments, parliaments and influential commentators of all kinds. It must be made clear that the governments and the peoples of the world identify themselves with the aspirations of the people of Bangladesh.”-The Sunday Times, 11 July, 1971) | কিন্তু এ ধরনের রাজনৈতিক পরামর্শ মেনে নেওয়ার সুবুদ্ধি ব্রিটেন বা যুক্তরাষ্ট্র কারােরই ছিল না। আর সেজন্যই যুক্তরাষ্ট্রের বশংবদ বিশ্বব্যাংক তাদেরই পরিচালকের তৈরি রিপাের্ট ধামাচাপা দেয় পাকিস্তানের প্রতি অনুরাগৰশত। এ কীর্তির নায়ক বিশ্বব্যাংকের প্রধান (মার্কিন প্রশাসনের খাস লােক) রবার্ট ম্যাকনামারা। কিন্তু রিপাের্ট চাপা দেবার খবর কাগজগুলােতে ঠিকই পৌছে যায়। ঐ রিপাের্টে দাবি করা হয় যে ‘সরকারি সেনাবাহিনী পূর্ব-পাকিস্তানে এখনাে সন্ত্রাসের রাজত্ব চালিয়ে যাচ্ছে।’ (“World Bank board members received copies of an outspoken report on the situation in East Pakistan. …Robert McNamara, the World Bank’s president had decided to withdraw it (report) and expunge it from the official record. McNamara’s decision… had leaked to newspapers that the report had been suppressed. …The report claims that the reign of terror by Government troops continues in East Pakistan.” -The Sunday Times, 11 July, 1971) | এমনি অদ্ভুত ঘটনা থেকেও পূর্ব-পাকিস্তান ট্র্যাজেডি সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা নিক্সন প্রশাসনের নীতির স্পষ্ট পরিচয় মেলে।
পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন যােগাতে গিয়ে নিক্সনগােষ্ঠী শুধু অমানবিকতার নয়, সামাজিক বর্বরতারও সমর্থক হয়ে ওঠে। হয়তাে সে কারণেই ইয়াহিয়ার গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্বের বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিবাদ উচ্চারিত হতে থাকে, আর সমালােচিত হতে থাকে পাকিস্তানপন্থী মার্কিনি নীতি। তাই দেখা যায় কলিন জ্যাকসনের নেতৃত্বে গঠিত বিচিত্র পেশার দশজন মানুষের এক গােষ্ঠী ওমেগা’ কর্মকাণ্ডের নামে বাঙালি শরণার্থীদের জন্য ব্যাপক তৎপরতা চালিয়েই ক্ষান্ত হয় না, জীবনের ঝুঁকি নিয়েও তাদের চেষ্টা চলে সামরিক বাধা অগ্রাহ্য করে পূর্বপাকিস্তানে প্রবেশ করার জন্য। উদ্দেশ্য সেখানে নিরস্ত্র অসহায় মানুষজনদের সাহায্য করা। জ্যাকসনের ভাষায় অসহায় মানুষজনদের তাদের আপন ভূমিতে সাহায্য করতে পারার সুবিধা অনেক’ (দ্য অবজার্ভার, ২৫ জুলাই, ১৯৭১)। এখানেই শেষ নয়। ওমেগা’ গ্রুপের রােমান্টিকতা পেরিয়ে বাঙালি শরণার্থীদের দুর্দশা লাঘবের চেষ্টায় এগিয়ে আসেন খাস মার্কিনি বিট কবি-গায়ক জর্জ হ্যারিসন এবং রিঙ্গো স্টার। এ জুটি সিদ্ধান্ত নেন নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে
কিন্তু চতুর মার্কিন প্রশাসন সাফল্যের সঙ্গে এসব অভ্যন্তরীণ সমালােচনা মােকাবেলা করে ঠিকই পাকিস্তানে অর্থনৈতিক সাহায্য অব্যাহত রাখে। এমন কি মার্কিনি অস্ত্রশস্ত্রের চালানও বন্ধ হয় না। অবশ্য সেই সঙ্গে তাদের নির্দেশে পূর্ব-পাকিস্তানের জন্য জাতিসংঘের ব্যাপক ত্রাণ কর্মসূচির ভিত তৈরি হতে থাকে। এমনি দ্বিমুখী ছিল মার্কিন প্রশাসন। এ বিষয়ে আরাে অনেকের মতাে তখনকার মার্কিনি নীতি সম্পর্কে রবার্ট জ্যাকসনের মন্তব্যও অনুধাবনযােগ্য : “In the United States the administration was successfully resisting criticism from within the Congress of the continuance of American economic aid to Pakistan. American arms sales to Pakistan were still going on. Within the United Nations the ground work was being laid for an extensive relief programme in East-Pakistan” (P. 54) মার্কিন প্রশাসনের পাকিস্তান তথা পূর্ব-পাকিস্তান বিষয়ক নীতি এভাবে দ্বিচারণার মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেলেও এর মূল ভূমিকা ছিল ভারত বিরােধিতার পটভূমিতে বাংলাদেশ বিরােধিতা। মার্কিনি জনমত ও অভ্যন্তরীণ চাপের মুখে আপাত নমনীয় কিছু পদক্ষেপ নিলেও নিক্সন-কিসিঞ্জারের নীতি তাদের মূল ভূমিকা থেকে খুব একটা সরে আসে নি। যেমন প্রতিনিধি পরিষদের বিদেশ বিষয়ক কমিটির সভায় ১৫ জুলাই ১৭-৬ ভােটে পাকিস্তানে মার্কিন অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য স্থগিত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়া সত্ত্বেও নিক্সন প্রশাসন তাদের পাকিস্তান-সমর্থনের নীতি থেকে সরে আসে নি। পূর্ব চুক্তি ও আরাে নানা অজুহাতে অর্থনৈতিক সাহায্য তারা অব্যাহত রেখেছে। | এমন কি তাদেরই ইঙ্গিতে ও উপদেশে ইয়াহিয়া নানা যুক্তিতে সীমান্তে পরিদর্শক হিসাবে জাতিসংঘ বাহিনী মােতায়েনের চেষ্টা চালিয়ে গেছে। তার আপাত-যুক্তি যে তাতে শরণার্থী পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া বাধামুক্ত হবে। তাদের জানা ছিল যে এর ফলে বাঙালি মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা বন্ধ করার সুযােগও তৈরি হবে। ভারতের পক্ষে সম্ভব হবে না সরাসরি বাংলাদেশ বাহিনীর প্রতি সব ধরনের সমর্থন যােগানো।
কিন্তু মধ্য জুলাই-এ নিক্সনের আসন্ন চীন সফরের ঘােষণা পরিস্থিতি একেবারে পালটে দেয়, সে প্রসঙ্গ পরে আলােচিত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থাৎ নিক্সন প্রশাসনের মতাে এতটা কট্টর পাকিস্তানপন্থী না হলেও গুরুত্বপূর্ণ পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলাের অনেকেরই ভূমিকা বাংলাদেশের পক্ষে ছিল না। তবে পাকবাহিনীর গণহত্যা আর শরণার্থীদের দুর্গতি তাদের অনেকে মানবীয় দৃষ্টিতে দেখেছে বা দেখতে চেয়েছে। যেমন ১৬ জুন হাউস অব কমন্স-এ কানাডার বিদেশ-বিষয়ক সচিব মিশেল শার্প তার বিবৃতিতে সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের ওপর গুরুত্ব আরােপ করে বলেন যে তা না হলে শরণার্থী সমস্যা আকাক্ষিত শান্তির ক্ষেত্রে কাটা হয়েই থাকবে।’ (“…all of us are pressing for a political solution. It is the only possible way of dealing with the present situation. Unless there is a political settlement in Pakistan the refugees are going to remain in India and continue to be a thorn in the side of peace.” Hansard, 16 June, 1971)। কিন্তু পাক সামরিক সরকার তখন তাে বটেই, পরেও রাজনৈতিক সমাধানের দিকে ফিরে তাকায় নি। পরবর্তী সময়েও মিশেল শার্প একাধিকবার তার বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করেছেন। চিলির প্রেসিডেন্ট ড, স্যালভাদোর আলেন্দে জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে পূর্বপাকিস্তানের জনগণের দুর্দশা সম্পর্কে তার ও চিলির জনগণের পক্ষ থেকে সমবেদনা এবং পূর্ব-পাকিস্তানের জন্য সুদিনের প্রত্যাশা করে বার্তা পাঠান (জুন ২৬, ১৯৭১)। এ অবস্থা অবসানের জন্য মহাসচিবকে উদ্যোগ নিতে আহ্বান জানান। ঘটনা তার বিচারে একধরনের বৈশ্বিক দুর্যোগ এবং সমগ্র মানবজাতির জন্য ট্র্যাজেডি বিশেষ (“a universal Catastrophe and a tragedy for all mankind”. Bangladesh Documents, P. 505) ফরাসি বিদেশমন্ত্রী ১২ জুন ভারতীয় বিদেশমন্ত্রীর সঙ্গে আলােচনায় বিপুল সংখ্যক শরণার্থী সমস্যার ওপর গুরুত্ব আরােপ করে মানবিক সাহায্যের কথা যেমন বলেন তেমনি পূর্ব-পাকিস্তান সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের প্রতিও দিকনির্দেশ করেন।
তেমনি নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পূর্ব-পাকিস্তানের ঘটনা সম্পর্কে নির্বাক থাকেন। নি। কিছুটা দেরিতে হলেও ঘটনার মানবিক দিকের প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি অবিলম্বে রক্তপাত বন্ধ করার জন্য যেমন পাকিস্তানের সামরিক সরকারের প্রতি আবেদন জানান তেমনি ত্রাণসাহায্যের বিষয়েও তার সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতির কথা জানান (বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, পৃ. ৫০৫-৫০৬)। তবে পাক ভারতীয় উপমহাদেশের একদা-শাসক ব্রিটেন এ ভূখণ্ডের সঙ্গে নানাভাবে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সত্ত্বেও মােটামুটিভাবে দর্শকের ভূমিকাই গ্রহণ করে বেশ কিছু সময় ধরে যে কথা ইতােপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে এবং এর কারণও ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কমন্স সভায় ১৪ মে (১৯৭১) বিবৃতি দেবার সময়ও স্যার অ্যালেক ডগলাস শরণার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্যের কথাই প্রধানত উল্লেখ করেন। তবে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি পাকিস্তানের জনগণের জন্য রাজনৈতিক সমাধানের প্রশ্নে মতামত প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন যে সেটা বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া চলে না। সপ্তাহ কয় পর অর্থাৎ ২১ জুন ভারতীয় বিদেশমন্ত্রীর সঙ্গে আলােচনা প্রসঙ্গে তিনি শরণার্থীদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা ও দুরবস্থার গুরুত্ব উপলব্ধি করে ভারতীয় মন্ত্রীর সঙ্গে একমত হন যে সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান অবশ্যই পেতে হবে এবং তা পূর্বপাকিস্তানের জনগণের পক্ষে অবশ্যই গ্রহণযােগ্য হতে হবে।’ (“In their discussions Sir Alec Douglas-Home and Mr. Swaran Singh agreed that it was important to that the flow of refugees into India from East-Pakistan should cease… and a political solution must therefore be found which was acceptable to the people of East-Pakistan.”–Bangladesh Documents, P. 508.) অবশ্য ২৩ জুন কমন্স সভার অধিবেশনে স্যার অ্যালেক জানান যে শরণার্থীদের দুরবস্থা লাঘবের জন্য ব্রিটিশ সরকার যথাসাধ্য অর্থ সাহায্যের ব্যবস্থা নিচ্ছে এবং বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ থেকে পাকিস্তানকে নয়া অর্থ সাহায্য দানের বিষয়টি স্থগিত করা হয়েছে। বিশেষ করে পূর্ব-পাকিস্তানে সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের সম্ভাবনা। সুস্পষ্টভাবে পরিস্ফুট না হওয়া পর্যন্ত।
কিন্তু শরণার্থীদের ত্রাণ সাহায্যের কাজ যথারীতি অব্যাহত থাকবে (বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, পৃ. ৫০৮-৫০৯; রবার্ট জ্যাকসন, পৃ. ৬৩)। আগেই বলা হয়েছে যে ব্রিটিশ সরকারের এটুকু পদক্ষেপ গ্রহণের কারণ ছিল আন্তর্জাতিক জনমত ও তাদের কিছু সংখ্যক পার্লামেন্ট সদস্যের চাপ। | লক্ষ্য করার বিষয় যে অবস্থার ভয়াবহতা সত্ত্বেও পাক-সামরিক সরকারের স্বদেশে ‘মাটি পোড়ানাে নীতি অব্যাহত রাখার বিরুদ্ধে কোনাে কঠোয় রাজনৈতিক ভূমিকা গ্রহণ করে নি ব্রিটিশ সরকার বা তার সমপর্যায়ের পাশ্চাত্য দেশগুলাে। ভারতীয় বিদেশমন্ত্রীর সফরের পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিম জার্মান চ্যান্সেলর (উদারনৈতিক দলের) উইলি ব্র্যান্ডট ১৪ জুন মূলত শরণার্থী সাহায্য বিষয়ক আলােচনাই করেন এবং এক মাসের পর ২৩ জুন। এক সাংবাদিক সম্মেলনে মানবিক ত্রাণ সাহায্যের কথাটাই বড় করে বলেন, বাঙালিদের দুর্গতিতে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন যে শরণার্থীদের ঘরে ফিরে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতেই একটা সন্তোষজনক সমাধান সম্ভব’ (“A satisfactory solution is possible only when the refugees have the possbility of returning to their country.” Bangladesh Documents, PP. 514-515.) পশ্চিমা শাসকদের কমবেশি সবার ভূমিকাই ছিল এমনি পরােক্ষ, সমস্যার দূর দিয়ে হাঁটার। তারা মানবিক চেতনার কথা বলেছেন, কিন্তু ভুলেও ফিরে তাকিয়ে দেখেন নি যে তাদের এই ধীর স্থির কালক্ষেপণের মধ্য দিয়ে কী পরিমাণ রক্তস্রোত বয়ে গেছে বাংলার মাটিতে, কত অসহায় প্রাণ সৈন্যদের ‘আক্রোশের শিকার হয়েছে। মানবিকতার প্রসঙ্গ আসলেই ছিল কথার কথা। কোনাে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সংঘটিত অমানবিক ভয়াবহতা সহজে তাদের স্পর্শ করতে চায় নি মূলত রাজনৈতিক সাধারণ নিয়মের কারণে, হােক তা যুক্তিসঙ্গত জাতিগত সংঘাত। তাই উদারনৈতিক রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে পরিচিত জার্মান চ্যান্সেলর ঘটনা সম্পর্কে বিশদ অবহিত হওয়ার পাঁচ সপ্তাহ পর তার প্রতিক্রিয়া পরোক্ষভাষায় ব্যক্ত করেন।
অবশ্য এর মধ্যে তারা যা করেছেন তা হলাে (প্রধানত ভারতীয় যােগাযােগের কারণে এবং সাংবাদিকদের প্রচণ্ড লেখালেখির প্রভাবে) পাকিস্তানকে অর্থ সাহায্যদানের বিষয়টি স্থগিত করা। পাকিস্তানের জন্য এটা ছিল চরম বিপর্যয়ের। কারণ নিজদেশে যুদ্ধ চালাতে গিয়ে পাক-সরকার অর্থনৈতিকভাবে সঙ্কটের মধ্যে পড়েছিল। তাই ব্রিটেনের পর একে একে সুইডিশ, ডাচ এবং পশ্চিম জার্মান আর্থিক সাহায্য পরিকল্পনাও স্থগিত হয়ে যায়। ক্ষুঝ পাকিস্তান সরকার ব্রিটিশ ও অন্যান্য সরকারের এহেন ভূমিকার বিরুদ্ধে প্রতিবাদও জানায়। তবে মার্কিন সরকার শেষ অবধি পাকিস্তানের পক্ষেই থেকেছে। সরাসরি না হলেও পরােক্ষভাবে তাদের সাহায্য সহযােগিতা করেছে। করেছে রাজনৈতিকভাবে এবং যতটা সম্ভব অর্থনৈতিক দিক থেকে। বাংলাদেশের এ সঙ্কটে চীনা নীতিও ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতােই পাকিস্তানের পক্ষে, বাঙালি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে। ঘটনার শুরুতে ১৩ এপ্রিল চৌ-এন-লাইয়ের বিবৃতি থেকে শেষ অবধি চীন যুক্তরাষ্ট্রের মতাে পাকিস্তানপন্থী নীতিই অব্যাহত রেখেছিল। চৌ-এর প্রথম বিবৃতিতে স্পষ্টই বলা হয় যে পাকিস্তানে এখন যা ঘটছে তা একান্তভাবেই পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ সমস্যার সমাধান বিদেশী হস্তক্ষেপ ছাড়া পাকিস্তানি জনগণের হাত দিয়েই হওয়া উচিত’ (“What is happening in Pakistan at present is purely the internal affair of Pakistan, which can only be settled by Pakistan people themselves and which brooks no foreign interference whatsoever.”-Pakistan Horizon, XXIV No. 2 PP. 153-154) চীন তার রাজনৈতিক স্বার্থনির্ভর নীতির পরিপ্রেক্ষিতে তাদের ভারত-বিরােধী ভূমিকা এবং সেই সঙ্গে সােভিয়েত-বিরােধী ভূমিকার কারণে পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেয়। জনগণের ইচ্ছায় সমস্যা সমাধানের কথাটা ছিল নিছক রাজনৈতিক চতুর উক্তি। তাই তাদের মনে হয় নি যে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ বাঙালিদের স্বশাসনের ম্যান্ডেটের বিরুদ্ধে ছিল পাক-সামরিক বাহিনীর আক্রমণ। আক্রমণের পর ঐ জনগণের মুখেই এক দফা তথা স্বাধীনতার স্লোগান উচ্চারিত হয় । তাই জনগণের ইচ্ছার কথা বলা এবং সেই সূত্রে পাক-সামরিক সরকারের অমানবিক কর্মকাণ্ড সমর্থন করাতে প্রতিফলিত হয়। গণইচ্ছার বিরােধী তাদের ভূমিকা। | সােভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা অবশ্য শুরুতে পাক সেনাবাহিনীর হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধেই ছিল যা সােভিয়েত প্রেসিডেন্টের লেখা চিঠিতে (পূর্বে উল্লেখিত) স্পষ্ট। কিন্তু তাদেরও লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক-রাষ্ট্রনৈতিক কারণে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলা। যেজন্য তাদের সরকারি বিবৃতিতে একাধিক বার ‘তাসখন্দ চেতনার শান্তি ও সৎ, প্রতিবেশীসুলভ সহাবস্থানের নীতির ওপর গুরুত্ব আরােপ করা হয়।
এরপর জুন মাসে সােভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিনের এক বক্তৃতায় সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের (“peaceful solution of all problems”) কথা বলা হয়। অবশ্য। সেই সঙ্গে লক্ষ লক্ষ বাস্তুহারা মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথা, শরণার্থীদের সৃষ্ট রাজনৈতিক সমস্যার কথা বলা হয়। বলা হয় এসব বিষয়ে সােভিয়েত সরকারের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কথা। প্রসঙ্গত ঐ বিবৃতিতে পাকিস্তান সরকারকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে অনুরােধ জানানাে হয় যাতে তারা শরণার্থীদের নিরাপদে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের ও নির্ভয়ে বসবাসের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তাদের ভাষায় (“The situation in East-Pakistan has forced millions of people to leave their land, homes and property and seek refuge in neighbouring India. The masses of refugees, despite the aid given to them, are in an extremely grave position. “All who treasures the principle of humanism must demand that conditions be created for the refugees returning to their homes, that their personal safety and opportunity to live in East-Pakistan be guarnteed. It is our opinion such measures be immediately taken by the Pakistani authorities.” Pravda, 10 June, 1971)।। কিন্তু দুই দিকে ভারসাম্য রক্ষা করে চলার নীতি সােভিয়েত ইউনিয়ন বেশিদিন চালিয়ে যেতে পারে নি। কারণ পাকিস্তান সরকার যেমন তাদের ‘পােড়ামাটি’ নীতি বন্ধ করে নি, তেমনি তারা রাজনৈতিকভাবে পুরােপুরি নির্ভর করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ওপর, তাদের বৈষয়িক ও ঐ নৈতিক সাহায্যের ওপর। এমন কি ভারতের সঙ্গে সম্ভাব্য যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে ঐ দুই মিত্রের বাস্তব সাহায্যই ছিল ইয়াহিয়ার একমাত্র ভরসা। তাই ভারতের প্রতি নমনীয় সােভিয়েত ইউনিয়নের পরামর্শ পাকিস্তান গ্রহণযােগ্য মনে করে নি।
তাছাড়া বিশ্বরাজনীতিতে নতুন ঘটনা অর্থাৎ চীন-আমেরিকা সম্পর্কের সম্ভাবনা রাজনৈতিক হাওয়া ও মেরুকরণ পালটে দেয়। পাকিস্তানের ওপর চীন-মার্কিন প্রভাব নতুন মাত্রা অর্জনের পরিপ্রেক্ষিতে আগস্ট মাসে সম্পাদিত ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তি মেরুকরণের কাজ সম্পূর্ণ করে । তবু সােভিয়েত ইউনিয়ন বরাবর চেয়েছে যাতে পাক-ভারত পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়ে এবং এ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও ছিল অভিন্ন মত । প্রসঙ্গত ৩০ জুন মার্কিন বিদেশ-সচিব উইলিয়াম রজার্স এবং সােভিয়েত বিদেশমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকোর মধ্যে এ বিষয়ে আলােচনা ‘ডন’ পত্রিকায় ২ অক্টোবর বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য যে পাকিস্তানি সঙ্কট সম্পর্কে ফরাসি নীতি ছিল যথেষ্ট অস্পষ্ট। সেখানেও চীনাদের মতাে ‘অভ্যন্তরীণ বিষয় জনগণের মতামত’ ইত্যাদি বক্তব্যই প্রধান হয়ে থাকে। ফরাসি বিদেশমন্ত্রী সুম্যান-এর এ ধরনের কথাবার্তা ‘লা মোদে’ পত্রিকায় প্রকাশ পায়। এবং পাকিস্তানি পত্রিকা ডন’-এ তা ছাপা হয় (৮ অক্টোবর, ১৯৭১)। অবশ্য মাস খানেক পর ‘ব্রেজনেভ-পমপিদু’ বিবৃতিতে শরণার্থী সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে “পূর্ব-পাকিস্তান সঙ্কটের রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলা হয়। গুরুত্ব আরােপ করা হয় যাতে শরণার্থীরা অতিদ্রুত স্বদেশে নিজ ঘরে ফিরে যেতে পারে’ (পাকিস্তান হরাইজন)। তবু ফ্রান্স ইয়াহিয়াকে “মিরাজ’ বিমান ও হেলিকপ্টারসহ বহু অস্ত্রশস্ত্র নিয়মিত সরবরাহ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের মতােই। বিস্ময়কর যে পশ্চিমা পত্রপত্রিকায় পূর্ববঙ্গের জনগণের ওপর পাক-সেনাবাহিনীর বর্বরােচিত আক্রমণ এবং সেই নীতির অব্যাহত প্রয়ােগের নির্ভরযােগ্য বিবরণ এবং সাংবাদিক-ভাষ্যকারদের রাজনৈতিক বিচার-বিশ্লেষণ নিয়মিত প্রকাশিত হওয়ার পরও পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলাে বিষয়টিকে যথাযথ রাজনৈতিক গুরুত্বে গ্রহণ করতে চায় নি। শরণার্থী সমস্যাই তাদের চোখে বড় হয়ে থেকেছে। ঐ সমস্যার উৎসে যেতে কারােরই কোনাে আগ্রহ দেখা যায় নি। কারণ উৎসে যেতে চাইলেই রাজনৈতিক স্বার্থের প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়ায়। | তাই শরণার্থীদের চাপে বিপর্যস্ত ভারতকেই গােটা সমস্যার রাজনৈতিক দায়ভার গ্রহণ করে ছুটে যেতে হয়েছে এক রাষ্ট্র থেকে অন্য রাষ্ট্রে, যাকে বলে বাধ্যতামূলক রাজনৈতিক গণসংযােগ। লন্ডন, ওয়াশিংটন, প্যারিস, বন, মস্কো, নিউইয়র্ক এবং কোথায় নয়। যােগাযােগ করতে হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ মার্কিনি সেনেটরদের সঙ্গে। অবশ্য সেই সঙ্গে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিগণ এবং বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও তাদের শুভাকাক্ষী বন্ধুরাও বিষয়টি নিয়ে বিশ্বজনমত গড়ে তােলার চেষ্টা করেছেন।
আরব দেশগুলাে অবশ্য এ বিষয়ে পাকিস্তান সরকারের সমর্থক হিসাবে তাদের পক্ষেই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। এর মূল কারণ ধর্মীয় রক্ষণশীলতা। ইসলামী বলয়ের বাইরে একাধিক দেশ যেমন অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, যুগােস্লাভিয়া, ফিলিপিনস, চিলি, কানাডা ইত্যাদি দেশ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সমস্যার রাজনৈতিক গুরুত্ব স্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছে। এদের কেউ কেউ মৃদুকণ্ঠে সমস্যা সমাধানের জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার। উদ্দেশ্যে আহ্বান জানিয়েছে। অন্যদিকে সমস্যার মানবিক সমাধানের জন্য আবেদন জানিয়েছে রােমান ক্যাথলিক চার্চের মতাে প্রতিষ্ঠানও। একই ধরনের বিবৃতি প্রকাশ করেছে বিশ্ব ধর্মীয় পরিষদ। | যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন প্রশাসন পূর্ববাংলায় সংঘটিত অমানুষিক ঘটনা সম্পর্কে অবাঞ্ছনীয়। মনােভাব গ্রহণ করলেও সেখানকার কাগজগুলাের কল্যাণে দ্রুত বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গড়ে ওঠে। সেনেটর সমাজকর্মী ও পেশাজীবী মানুষ যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অনুসৃত নীতির সমালােচনায় মুখর হয়ে ওঠে। প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে একাধিক সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংস্থা। তেমন একটি সংস্থার নাম পাকিস্তানের আমেরিকান বন্ধুবৰ্গ’ (‘American Friends of Pakistan’)।
এ সংস্থা পাক-প্রেসিডেন্টের কাছে ১২ এপ্রিল এক আবেদন জানায়। তাতে বলা হয় : ‘পাকিস্তান সরকার শান্তিপূর্ণ সংলাপ ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পরিত্যাগ করে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকদের সামরিক শক্তিতে বশীভূত করার চেষ্টা করছে। এ উদ্দেশ্যে তারা আধুনিক সমরাস্ত্রের যেমন ট্যাঙ্ক, গোলন্দাজ বাহিনী, বিমান ইত্যাদির সাহায্যে হাজার হাজার নিরস্ত্র মানুষজনকে হত্যা করে চলেছে। …মানবতার নামে, আপনার দেশের প্রতি ভালবাসার স্বার্থে সব কিছু শেষ হয়ে যাওয়ার পূর্বেই শান্তিচুক্তি সম্পাদনের জন্য আপনাকে সনির্বন্ধ অনুরােধ জানাই। এবং অনুরােধ জানাই যত দ্রুত সম্ভব পূর্ব-পাকিস্তানে আইনসঙ্গত সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য (ওয়াশিংটন পােস্ট, ১২ এপ্রিল, ১৯৭১)। (“Reports that have reached this country leave no room to doubt that the Government of Pakistan has abandoned peaceful negotiations and democratic procedures in East-Pakistan and is seeking to subjugate a majority of its own citizens by military force. To this end, it has loosed the terrors of modern warfare, including tanks, planes and artillery against unarmed people killing literally thousands. (“We urge you, in the name of humanity and out of love for your country. to arrange for a truce before all is lost, and to restore legitimate and responsive government in East-Pakistan with all possible haste.”- Washington Post, 12 April, 1971)। এছাড়া একাধিক মানবাধিকার সংস্থাও অনুরূপভাবে ইয়াহিয়া প্রশাসনের কাছে আবেদন জানিয়েছে যুক্তিসঙ্গত রাজনৈতিক সমাধানের পথে মানব দুর্দশার অবসান ঘটানাের জন্য। কিন্তু ইয়াহিয়া সরকার এসব আবেদনে সাড়া দেয় নি, দেয় নি “সব কিছু শেষ হয়ে যাওয়ার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত। এ অর্বাচীন অমানবিকতার মাশুল ইয়াহিয়াকে দিতে হয়েছে যেমন রাজনৈতিকভাবে তেমনি ব্যক্তিগত দিক থেকেও।
সূত্র : একাত্তরে পাকবর্বরতার সংবাদভাষ্য – আহমদ রফিক