You dont have javascript enabled! Please enable it!

গণহত্যার নবপর্যায়  আদমি নেহি মাংতা হম্ মিট্টি মাংতা

পাক-সেনাবাহিনী তাদের পূর্ব-পাকিস্তানে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার নামে গণহত্যার উদ্দেশ্য নিয়েই যে ঢাকায় ও প্রদেশের অন্যত্র বাঙালি ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণ চালার তার প্রমাণ ধরা রয়েছে হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসলীলার ব্যাপকতা, তীব্রতা ও ভয়াবহতার অবিশ্বাস্য মাত্রায়। এক ধরনের বিজাতীয় ঘৃণার প্রকাশ ঘটে তাদের তৎপরতায়। সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন স্তর থেকে জওয়ান পর্যন্ত সবাই ছিল এ মনােভাবের কমবেশি অংশীদার। দু’চার জন ব্যতিক্রম বাদে সবার জন্য কথাটা সত্য। নিছক শাসনতান্ত্রিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য কেন গণহত্যার মতাে অপরাধমূলক তৎপরতা, সেই ‘কেন’র জবাব আলােচনায় স্পষ্ট হবে। পাকবাহিনীর নৃশংসতার ব্যাপকতা তথা গণহত্যা সম্পর্কে পশ্চিমা সংবাদভুবন পরে নিশ্চিত হলেও গােড়াতে পুরােপুরি নিঃসংশয় হতে পারে নি, যদিও সেনাবাহিনীর অতিমাত্রায় শক্তি প্রয়ােগের বিষয়ে তাদের মধ্যে বড় একটা ভিন্নমত দেখা যায় নি। তবে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলাে গণহত্যার বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্বে গ্রহণ করে নি, যারা করেছে তারাও অনেক পরে। এর কারণ বলাবাহুল্য রাজনৈতিক, স্বার্থভিত্তিক, পক্ষ-প্রতিপক্ষভিত্তিক। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক রাজনীতির ঘােরচৰূরে গণহত্যার মতাে যুদ্ধ-অপরাধও যথাযথ মূল্যে গৃহীত হয় নি, জাতিসংঘের স্বীকৃতি তাে দূরের কথা।  অথচ আমরা জানি ঢাকাসহ পূর্ববঙ্গের সর্বত্র পাক-সেনাবাহিনীর অভিযানে গণহত্যার অভিপ্রায়ও যে নিহিত ছিল নানা ঘটনার সাক্ষ্যপ্রমাণে তা পরিস্ফুট। তেমনি তা বােঝা যায় ২৫ মার্চ ঢাকায় হত্যা অভিযানে নিয়ােজিত পাক-সামরিক ইউনিটের সঙ্গে অধিনায়ক টিকা খাঁ-র সামরিক সদর দফতরের বার্তা-বিনিময়ের বেতার সংলাপে। শেষরাতের ঐ বেতার কথােপকথনের ধৃত প্রতিলিপি অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের হাতে আসে যা জাতিসংঘের মহাসচিব ও বিশিষ্ট রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে পাঠানাের ব্যবস্থা করা হয়। ঐ সংলাপের কিছু উদ্ধৃতি ‘টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত হয় যাতে পাকবাহিনীর ঐ অভিপ্রায় অস্পষ্ট থাকে নি। উদ্ধৃতি নিম্নরূপ : কন্ট্রোল : সাবাস! বিশ্ববিদ্যালয়ে নিহতের সংখ্যা কত বলে তােমার ধারণা? ৮৮ : আনুমানিক ৩০০ জন। কন্ট্রোল : চমৎকার। কেউ ধরা পড়েছে বা আহত হয়েছে? 

হয়ে উঠেছে তেমনি তাদের রক্তলােলুপতা ও ধর্ষমানসিকতাও প্রকাশ পেয়েছে। পঁচিশে মার্চ মধ্যরাতে ঢাকার ছাত্র-এলাকায়, পিলখানা ও রাজারবাগ এলাকায়, শহরের সর্বত্র ছড়ানাে ভাসমান শ্রমজীবী মানুষের আস্তানায় এবং পুরনাে ঢাকার হিন্দু মহল্লাগুলােতে যে গণহত্যা চালানাে হয় তার উদ্দেশ্য ছিল আইন অমান্য আন্দোলন একেবারে স্তব্ধ। করে দিয়ে সামরিক শাসনের কঠোরতা প্রতিষ্ঠিত করা, অন্যদিকে আক্রমণের নৃশংসতায় এমন এক আতঙ্ক ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা যাতে বাঙালির স্বশাসনের ইচ্ছা চিরতরে বিলুপ্ত হয়। পাকিস্তানি শাসকদের এ ইচ্ছা তাৎক্ষণিকভাবে পূর্ণ হয়েছিল, বলা যায় অংশত সফল হয়েছিল সামরিক শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে। কিন্তু শাসন-কর্তৃত্ব নিরঙ্কুশ ও নিরুপ্রব হয়ে ওঠেনি। কর্তত্ব ধরে রাখার কাজ তাদের পক্ষে ক্রমশ কঠিন হয়ে ছিল বাঙালিদের তরফে ক্রমবর্ধমান প্রতিরােধ গড়ে ওঠার কারণে। পঁচিশে মার্চ থেকে কয়েক সপ্তাহ ধরে ঢাকাসহ দেশের সর্বত্র পাকসেনাদের যে ‘অপারেশন’ চলে তা তুলনাহীন নৃশংসতায় সম্পূর্ণ হওয়ার পর হিসাব-নিকাশ করে দেখা গেল যে অপ্রত্যাশিত ক্ষয়ক্ষতির (প্রধানত সেনা-অফিসারদের মৃত্যুর) বিনিময়ে শহরগুলাের নিয়মণ ঠিকই হাতে এসেছে কিন্তু গ্রামাঞ্চলে শাসক-বিরােধিতা জন্ম নিয়েছে। গৃহযুদ্ধ নতুন চরিত্র অর্জন করছে। প্রতিরােধ যুদ্ধ আক্রমণ ও পালটা আক্রমণের মধ্য দিয়ে ভিন্ন পথে চলতে শুরু করেছে। পাকশাসকদের অবশেষ লক্ষ্য তখন আঘাতের সম্মুখীন যুদ্ধের অবসান সহসা ঘটছে না। অর্থাৎ পাক-সেনাবাহিনীর দখল থেকে দেশ উদ্ধারের জন্য বাহিনী-ত্যাগী বাঙালি যােদ্ধারাই সংগঠিত হচ্ছে না, তৈরি হতে চলেছে তরুণ যােদ্ধাদের নয়াবাহিনী। গণহত্যার ব্যাপকতা ও তীব্রতায় রাজনৈতিক অঙ্গনের বিভিন্ন মতাদর্শের মানুষ অর্থাৎ বাম, মধ্য ও উগ্র বামপন্থীদেরও (শেষােক্তদের অংশ বিশেষ প্রতিবেশী ভূখণ্ডে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় আশ্রয় নিতে হয়েছে। সীমান্ত অতিক্রম করছে তরুণ জনগােষ্ঠী দল, নির্দল নির্বিশেষে। উদ্দেশ্য অশ্বপ্রশিক্ষণ নেওয়া, উদ্দেশ্য প্রতিরােধ যুদ্ধের ব্যবস্থা গড়ে তােলা।

দুই পূর্ব-পাকিস্তানের দীর্ঘ সীমান্ত জুড়ে পাকিস্তানের জন্মশত্রু ভারতের অবস্থান। পূর্বপাকিস্তানে বিচ্ছিন্নতা তথা স্বাধীনতার প্রচেষ্টা ভারতের পক্ষে শত্রুকে শায়েস্তা করার এক সুযােগ। সে সুযােগ গ্রহণ তার পক্ষে স্বাভাবিক। পাকিস্তানি নীতির নির্বুদ্ধিতা এতটাই প্রকট ছিল যে রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট অধিকাংশ মানুষ, এমন কি চীনাপন্থী বলে কথিত ভাসানীকেও পাকিস্তানি আক্রমণের মুখে দলবলসহ ভারতে আশ্রয় নিতে হয়েছে। সেখানে প্রায়-নজরবন্দি অবস্থায় থাকা সত্ত্বেও ভাসানী পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধের আহ্বান জানিয়েছেন উদ্দেশ্যে পূর্ব-পাকিস্তানের স্বাধীনতা অর্জন। অবশ্য স্বল্পসংখ্যক উগ্রবামপন্থী তখন সীমান্ত-সংলগ্ন ‘পকেট’ এলাকায় পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছে, ছােটখাটো আক্রমণের মধ্যে দিয়ে গেরিলাযুদ্ধের বিস্তার ঘটাতে চেষ্টা করেছে। গেরিলাযুদ্ধের জন্যও দরকার নিরাপদ আশ্রয়স্থল, কখনাে  করিডাের। কিন্তু বামপন্থীদের সাংগঠনিক শক্তি ছিল কম, জনসমর্থনের সিংহভাগ তখন জাতীয়তাবাদীদের পেছনে। দক্ষিণপন্থী ইসলামপন্থীদের বাদে দেশের গােটা রাজনৈতিক শক্তি পাকিস্তানি শাসক ও তাদের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড়ায়।  অবস্থাদৃষ্টে পাক-সামরিক শাসকদের তরফে পরিস্থিতির নতুন মূল্যায়ন, নীতির সুস্পষ্ট দিক নিশানা : বিভ্রান্ত বাঙালিদের শায়েস্তা করতে ও শিক্ষা দিতে ‘জঙ্গ জারি রাখতে হবে মূলত বাঙালি জনগােষ্ঠী ও তাদের সহায়ক ভারতের বিরুদ্ধে। দ্বিতীয়ত। ‘পূর্বপাক’মাটি থেকে বাঙালি জাতীয়তার বীজ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উচ্ছেদ— হত্যা বা বিতাড়ন যে কোনাে পথে। তাতেই দেশের স্থিতিশীলতা রক্ষা পাবে। সীমান্ত এলাকা তাই গুরুত্বপূর্ণ বিধায় তা পরিষ্কার করে সেখানে স্থায়ী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’ নতুন করে গণহত্যার এই ছিল বিবেচনা। | কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পাকিস্তানের রণনীতি ও রণকৌশলের তাই কিছুটা দিকবদল ঘটে।

বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমন করতে প্রতিরােধ ও প্রতিআক্রমণ জোরদার করার পাশাপাশি দরকার পড়ে ভূমি-ভিত্তিক নির্মূল অভিযান নতুন করে ব্যাপকভাবে শুরু করা (পাকিদের ভাষায় “ক্লিনসিং অপারেশন’)। এর সামরিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্য দুইই ছিল তাদের চোখে গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য দরকার আগুন, গুলি ও বেয়ােনেট ব্যবহার বিশেষ করে ১০ থেকে ১২ শতাংশ সংখ্যালঘু জনগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে, যাতে শেষােক্তরা হয় শেষ হয়ে যাবে না হয় ভারতে স্থায়ী আশ্রয় নেবে। গণহত্যার এ পরিকল্পনা সফল করতে খুবই কাজে লেগেছিল পূর্বাহে জওয়ানদের মগজ ধােলাই এবং সেনা-অফিসারদের বাঙালি-বিরােধী, সম্প্রদায়বাদী রক্ষণশীল চিন্তার উগ্রতা। একমাত্র এমন এক অন্ধ উগ্রতাই বাস্তবায়িত করতে পারে ‘আদমি নেহি মাংতা, হম মিষ্টি মাংতা’ নীতি। আপাত বিচারে অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটা সত্য। সীমান্ত এলাকা জনশূন্য করা থেকে গ্রামাঞ্চলের বিশেষ বিশেষ এলাকায় গ্রাম পুড়িয়ে ছাই করে। ফেলা বা নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের বহু লিখিত অলিখিত ঘটনা সেনাবাহিনীর ঐ অবিশ্বাস্য। তৎপরতা প্রমাণ করে। অবশ্য এ তৎপরতা শুরু সেনা অভিযানের প্রথম রাউন্ড থেকেই যেমন প্রকাশ। পেয়েছে একাধিক পশ্চিমা পত্রপত্রিকায় তাদের ভাষায় যা ছিল ‘অর্থহীন হত্যাকাণ্ড, উন্মাদ বর্বরতা’ (“Senseless murder hysterical cruelty”—Editorial, The Times, April 3, 1971) এবং যা মানুষের মনে আতংকের হিম তৈরি করেছে তা-ই পরবর্তী পর্যায়ে পরিকল্পিত রূপ নিয়েছিল সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের পরিপ্রেক্ষিতে। 

আর ঐ উদ্দেশ্যের কারণেই বিদেশী কাগজে যতই ইয়াহিয়া খানকে তার সেনা। তৎপরতার জন্য অপরাধী হিসাবে চিহ্নিত করা হােক (“The crime of Yahya Khan in ‘provoking war is calculably appalling”- New Statesman, 2 April, 1971) কিংবা যত সজোরে বলা হােক ‘পূর্ব-পাকিস্তানে হত্যাকাণ্ডব বন্ধ করতে হবে’ (“The East-Pakistan holocaust must stop”— Editorial, The New Nation 6 April 1971) পাক-শাসকগণ তাদের সামরিক বর্বরতা ঠিকই সচল রেখেছে। অন্যদিকে কাগজগুলােও তাদের লেখা বন্ধ করে নি। মার্কিনি পত্রিকা ‘দ্য স্যাটারডে    রিভিয় পূর্ব-পাকিস্তানে গণহত্যা’ (“Genocide in East-Pakistan’) শিরােনামে প্রকাশিত নিবন্ধে পাকবাহিনীর বর্বরতার বিশদ বিবরণ তুলে ধরতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে নি (মে, ২২, ১৯৭১)। ব্রিটেনের ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় প্রকাশিত দুই খ্রিস্টান ধর্মযাজকের বিবরণ ছিল লােমহর্ষক। তাদের ভাষায় “দিনে বা রাতের যে কোনাে সময়ে গ্রাম ঘেরাও করে সেনাবাহিনী আতংকিত, পলায়নপর গ্রামবাসীদের খুঁজে বের করে খুন করেছে। স্ত্রীলােকদের ধর্ষণ, তরুণীদের সেনাব্যারাকে তুলে নিয়ে যাওয়া, নিরস্ত্র গ্রামবাসীদের পিটিয়ে বা বেয়ােনেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারা হাজারে হাজারে মারা’ এই ছিল পাকসৈন্যদের কাজ। নিবন্ধের শিরােনাম ‘পূর্ববাংলার ট্র্যাজেডি। (“Villages have been surrounded, at any time of the day or night, and the frightened villagers… have been slaughtered where they have been found…women have been raped, girls carried off to barracks, unarmed peasants battered or bayoneted by thousands”. ‘East Bengal tragedy, The Guardiar, 27 May, 1971)। | ‘নিউ স্টেটসম্যান’-এর সংশ্লিষ্ট শিরােনামও ছিল তাৎপর্যপূর্ণ (‘Corpses in the Sun”)। প্রতিবেদকের মতে পূর্ববাংলায় যা ঘটছে, তা না জানার দাবি করার কোনাে অবকাশ নেই। টিভির রঙিন পর্দায় পচনধরা মৃতদেহগুলােকে আকাশের নিচে পড়ে থাকতে দেখা গেছে।…অবশ্য শিগগিরই রােদে পড়ে-থাকা লাশগুলাে মৌসুমি ঢলে ভেসে যাবে। সাম্প্রতিক কলেরা মহামারী শুরু হওয়ার আগে ইতােমধ্যেই ৫ লক্ষ লােকের মৃত্যু ঘটেছে। পশ্চিমা সাহায্য নিয়ে ইয়াহিয়ার পক্ষে আরাে কয়েক মাস যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে’ (৪.৬.৭১)।

(“No one can claim not to know what is going on in East Bengal. The corpses rot in the sun on colour television…. Soon, the corpses now lying in the sun will be lapped by the monsoon. Half a million people had already died, before the present cholera epidemic. With Western aid, Yahya could afford to continue the war a few more months”. New Statesman, 4 June, 1971), এ সম্পর্কে ঐ প্রতিবেদনে আরাে বলা হয়েছে “ইয়াহিয়া বাঙালিদের শিক্ষা দেওয়ার আত্মতুষ্টিতে ভুগতে পারে, কিন্তু তাকেও হয়তাে অনেক কিছুই হারাতে হবে।’ (“…he may get the satisfaction of having taught the Bengalis a lesson’. But he has a lot to loose possibly”. New Statesman, 4 June, 1971) | ‘নিউ স্টেটসম্যান’-এর ভবিষদ্বাণী মিথ্যা হয় নি। ইয়াহিয়াকে একসময় গােটা পূর্ব-পাকিস্তানই হারাতে হয়েছে। যতই পশ্চিমা, বিশেষ করে মার্কিন সাহায্য নিয়ে নির্মূল অভিযান চালানাে হােক, নৃশংসতার মাশুল তাকে গুণতে হয়েছে। ঐ অভিযানের কারণেই ঘরছাড়া লক্ষ লক্ষ শরণার্থী যে ঘরে ফিরতে চাইছে না ‘ওয়াশিংটন পােস্ট’-এর বরাত দিয়ে কথাটা গার্ডিয়ান পত্রিকায়ও লেখা হয়েছে (৫ জুন, ১৯৭১)। কারণ সেনাবাহিনীর ওপর আস্থা রাখা একেবারেই অসম্ভব। এ আশংকা কয়েক সপ্তাহ পরই সত্যে পরিণত হতে দেখা গেছে। দেখা গেছে ‘নিউজ উইক’ (২ আগস্ট)সহ একাধিক কাগজের প্রতিবেদনে। কারাে বুঝতে বাকি থাকে নি যে এ পর্যায়ে গণহত্যার প্রধান  

লক্ষ্য হিন্দু সম্প্রদায় এবং সেই সঙ্গে কথিত বিচ্ছিন্নতাবাদী বাঙালি মুসলমান, ছাত্রযুবা ও বাঙালি যােদ্ধাদের দল। ইয়াহিয়া-বাহিনীর এ রাজনৈতিক-সামরিক হিসাব-নিকাশের অমানবিক দিকটা একাধিক বিদেশী সংবাদপত্র ও ভাষ্যকারের চোখে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। তাই পলায়নপর উদ্বাস্তুদের নিয়ে, সে সময়কার সমস্যা নিয়ে হয়েছে সর্বাধিক লেখাজোখা। এ বিষয়ে ‘গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত সম্পাদকীয় (৫ জুন, ১৯৭১) বা ‘দ্য টাইমস’-এর দীর্ঘ প্রতিবেদন (৬ জুন, ১৯৭১) ছাড়াও একাধিক কাগজে যেমন “টাইম’ ‘নিউজ উইক’, ‘লাইফ’ পত্রিকায় ঐ মানবিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয়ের প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে। ‘লাইফ’ ম্যাগাজিনের ১৮ জুন (১৯৭১) সংখ্যায় সচিত্র প্রতিবেদন যেমন মর্মস্পর্শী তেমনি মানবিক আবেদনে পরিপূর্ণ। সেখানে এক সমাজকর্মীর মন্তব্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ : “ওৱা এত দ্রুত বেশি সংখ্যায় মারা যেতে শুরু করেছে যে হিসাব রাখাও সম্ভব হচ্ছে না।” হ্যা, এভাবে এবং নানাভাবে ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীর ইচ্ছাপূরণের কাজ সম্পূর্ণ হচ্ছিল। পাশাপাশি এপ্রিলের পর থেকে বাঙালি যােদ্ধারাও সংহত এবং নয়া সদস্যদের নিয়ে সংগঠিত হয়ে পাকবাহিনীকে সাফল্যর সঙ্গে ব্যতিব্যস্ত করে তুলছিল। ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এর প্রতিবেদনে দেখা যায় যে পশ্চিম-পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকা অঞ্চলে নতুন করে আক্রমণের আশংকা করছে। ঢাকা বিমানবন্দরের চারপাশে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।

জোরদার করা হয়েছে। অন্যদিকে পশ্চিম-পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও সরঞ্জাম এনে পাকবাহিনীও নতুন করে আক্রমণ অভিযান চালানাের জন্য যথাযথভাবে প্রস্তুত’ (“Now, new attacks in Dacca area are feared by the West-Pakistan Army. Defences have been tightened round Dacca airport…Pakistan Army has continued to bring in troops and reinforcements from West-Pakistan and is well prepared for fresh attacks.” The Daily Telegraph, 12 June, 1971). | ‘ইকোনমিস্ট’ও এ নবপর্যায়ের ব্যাখ্যায় যথেষ্ট বাস্তবতানিষ্ঠ । তাদের বক্তব্যে বিষয়টা স্পষ্ট : ‘সেনাবাহিনী কি চায়? গ্রামগুলাে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, লােকজনদের গুলি করে মারা হচ্ছে। এবং মারা হচ্ছে সমস্ত সশস্ত্র প্রতিরােধের অবসান ঘটার অনেক পরে। এর একটাই ব্যাখ্যা যে মাত্র ৭০ হাজার সৈন্যের সাহায্যে পশ্চিম পাকিস্তান ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করতে চাইছে।’ (“What is the army upto? Villages seem to be being burned and men shot long after most of the armed reistance has come to an end. One explanation is that with 70,000 troops on the ground West-Pakistan can keep control only by judicious terror of this sort” (The Economist, 12 June, 1971). | এটাই সেনাবাহিনীর চিরাচরিত রীতি। আর সেই পথ ধরে ব্যাপক জনতাড়ানাের ব্যবস্থা গ্রহণ। প্রসঙ্গত এ ক্ষেত্রেও জওয়ানদের মগজধােলাইর কথা এসেছে। সেনাকর্মকর্তারা তাদের জওয়ানদের হত্যাকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ করতে এমন কথাই বলেছে যে তারা এক ধর্মযুদ্ধে (জেহাদে) লিপ্ত।’ (“In order to get the troops to shoot, the   army’s officers have told them they are fighting a holy war.”) এ কাজে মদত যােগাতে সেনাপ্রশাসন বিহারি ও দক্ষিণপন্থী মুসলিম লীগ সদস্যদের নিয়ে গ্রামে গ্রামে গঠন করেছে শান্তি কমিটি যারা হিন্দুদের সম্পত্তি জবরদখল করছে এবং তাদের বাড়িঘর। লুট করছে, পুড়িয়ে দিচ্ছে। তাই সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালানাের কোনাে বিকল্প নেই। প্রথম পর্যায়ে উদ্বাস্তুর সংখ্যাগত অনুপাত ছিল অর্ধেক মুসলমান, অর্ধেক হিন্দু। কিন্তু উদ্বাস্তুর স্রোত বিপুল হয়ে ওঠার পর্যায়ে, প্রধানত মে মাস থেকে সেখানে হিন্দুর সংখ্যাই হয়ে ওঠে 41′ (“At first the flow was roughly half Moslem, half Hindu. It was when the stream became a torrent in the early part of May that the Hindus began to predominate”) 

ছবিটা অদ্ভুতভাবে মিলে যায় পাকবাহিনীর বর্বরতার চিত্র-আঁকা অ্যান্থনি ম্যাসকার্নহাসের গণহত্যা বিষয়ক প্রতিবেদনের সঙ্গে। এমন কি ঐ খ্রিস্টধর্মাবলম্বী পাকিস্তানি সাংবাদিকের গণহত্যার ব্যাখ্যা বিচার বিশ্লেষণের সঙ্গেও যথেষ্ট মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ম্যাসকার্নহাস স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে “পূর্ববাংলায় অবস্থিত সামরিক শাসকদের নীতি এ বিষয়ে খুবই পরিষ্কার। তাদের মতে পূর্ববঙ্গীয় বাঙালিদের ইসলামি ধ্যানধারণায় নতুন করে শিক্ষিত করে তুলতে হবে। জনগণকে ইসলামে দীক্ষিত করার মধ্যে দিয়ে যেমন বিচ্ছিন্নতার প্রবণতা রােধ করা সম্ভব তেমনি সম্ভব পশ্চিমপাকিস্তানের সঙ্গে ধর্মীয় বন্ধন সুদৃঢ় করে তােলা। সেই সঙ্গে যখন হিন্দুদের হত্যা ও বিতাড়নের মাধ্যমে নির্মূল করা হবে তখন তাদের বিষয় সম্পত্তির লােভ দেখিয়ে সুবিধাবঞ্চিত মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে জয় করা সম্ভব হবে। ওরাই ভবিষ্যৎ শাসনতান্ত্রিক রাজনৈতিক কাঠামাে গঠনের ভিত cofa ‘ (“The Bengalis will have to be re-educated along proper Islamic lines. The ‘Islamisation of the masses’ is intended to eliminate secessionist tendencies and provide a strong religious bond with West-Pakistan. “When the Hindus have been eliminated by death and flight, their property will be used to win over the under-privilaged Muslim middle-class. This will provide the base for erecting administrative and political structures in future.”) এজন্যেই কি বর্তমান শিক্ষিত বাঙালির একাংশে পাকিস্তান-বন্দনার প্রকাশ? | পাক-সামরিক সরকারের এই নীতি একাত্তরের অবশিষ্ট মাসগুলােতে নিখুঁতভাবে মেনে চলা হয়। অন্তত তেমন চিন্তাই সেনা-অফিসারদের কথাবার্তায় পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। ওদের ভাষায় আমরা পূর্ব-পাকিস্তানে বিচ্ছিন্নতার সব হুমকি একেবারে নিকাশ করে ফেলতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তার জন্য ২০ লক্ষ লােক মেরে ফেলতে বা ৩০ বছর ধরে উপনিবেশ হিসাবে এ প্রদেশ শাসন করতে হলেও অসুবিধা নেই।” ঢাকা এবং কুমিল্লায় সিনিয়র সামরিক-বেসামরিক অফিসার সবাই আমাকে বারবার এ কথাই শুনিয়েছে। পূর্ববঙ্গে পশ্চিমা-পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভয়াবহ নৈপুণ্যের সঙ্গে ঠিক এ কাজটিই করেছে। (“We are determined to cleanse East-Pakistan once and for all of the threat of secession, even if it means killing off two million people and ruling the province as a colony for 30 years. I was repeatedly told by senior military and civil officers in Dacca and comilla. The West-Pakistan army in East Bengal is doing exactly that with a terrifying thoroughness.”)

যেমন প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে বা ধর্মান্ধতার তাড়নায় উন্মাদ হয়ে তেমনি। রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির উদ্দেশ্য নিয়ে পাকসেনা ও সেনানীরা পূর্বাপর গণহত্যার মাধ্যমে পূর্ববঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের ভিত তৈরি করতে চেষ্টা করেছে। আর সে মর্মান্তিক অভিজ্ঞতায় বিচলিত সাংবাদিক ম্যাসকার্নহাস তার মানসিক ক্যাথর্সিস ঘটিয়েছেন কিছু সত্য উচ্চারণে যা ছিল পাক-বাহিনীদের কাছে অবাঞ্ছিত । বিশ্ববাসীর কাছে গণহত্যা অস্বীকারের মিথ্যা বেলুনটা চুপসে যায় যখন ঐ সাংবাদিক বলেন : “কুমিল্লায় নবম ডিভিশন সদর দফতরের অফিসারদের সঙ্গে ৬ দিন ভ্রমণ করে খুব। কাছে থেকে আমি হত্যাকাণ্ডের মাত্র লক্ষ্য করতে পেরেছি। আমি দেখেছি গ্রাম থেকে গ্রাম, ঘর থেকে ঘরে খুঁজে নিয়ে হিন্দুদের খুন করতে। আমি শুনেছি কুমিল্লা ‘সার্কিট হাউস’ প্রাঙ্গণে গদার আঘাতে খুন-করা মানুষের আর্তনাদ। আমি দেখেছি কাফু ও অন্ধকারের আড়ালে ট্রাকভর্তি করে লােকজনকে এবং যারা ওদেরকে সাহায্য করার মানবিকবােধ প্রকাশ করেছেন তাদেরকেও শেষ করার জন্য (বধ্যভূমিতে) নিয়ে যেতে। আমি দেখেছি শহরে গ্রামে বিদ্রোহীদের তাড়িয়ে দেবার পর হত্যাকাণ্ড ও অগ্নিকাণ্ডের পবিত্র উদ্দেশ্য সাধনে (মিশনে) ব্যস্ত পাকসেনা ইউনিটের সংঘবদ্ধ বর্বরতা।” “For six days as I travelled with the officers of the 9th Division headquarters at comilla I witnessed at close quarters the extent of the killng. I saw Hindus haunted from villalge to village and door to door shot off hand… I have heard the screams of men bludgeoned to death in the compound of the. Circuit House in Comilla. I have seen truckloads of human targets and those who had the humanity to try to help them hauled off ‘for disposal’ under the cover of darkness and curfew. I have witnessed the brutality of ‘kill and burn mission’s as the army units, after clearing out the rebels, pursued the pogrom in the towns and the villages.”) | ঐ সাংবাদিক আরাে দেখেছেন কী ভাবে শাস্তিমূলক দগুদানের উদ্দেশ্যে পুরাে গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। শুনেছেন অফিসারদের মেসে নৈশ আহারের ফঁাকে দিনভর হত্যাকাণ্ডের বিষয় নিয়ে আলাপ করতে, একে অন্যকে প্রশ্ন করতে : “আজ কটা শিকার করেছাে।’ সেসব শ্রুতিবিদ্ধ ভয়াবহ স্মৃতি তার কাছে এখনাে সজীব। পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে তার অভিজ্ঞতার সারসংক্ষেপে ম্যাসকার্নহাস পাকবাহিনীর হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যা (জেনােসাইড’) ছাড়া অন্য কোনাে আখ্যা দিতে পারেন নি। তিনি ঘুরেছেন ঢাকা, চাঁদপুর, কুমিল্লা, লাকসাম, হাজিগঞ্জ, কসবা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মতাে একাধিক শহরে-গঞ্জে।

ঘুরেছেন এবং অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন মেজর রাখাের, কর্নেল নঈম, মেজর বশির, মেজর আগা, ক্যাপ্টেন আজমত, লে. কর্নেল আসলাম বেগ, ক্যাপ্টেন আজহার, মেজর ইফতিখার, ক্যাপ্টেন দুররানি প্রমুখ অফিসারের সঙ্গে থেকে, কারাের সঙ্গে আলােচনায় অভিজ্ঞতার বিনিময়ে। এমন কি কথা বলেছেন মেজর  জেনারেল শওকত রাজার সঙ্গে। এদের সবারই ছিল এক রা। শেষােক্ত ব্যক্তিটিকে তার প্রশ্ন ছিল ; “এ হত্যাযজ্ঞ কি বন্ধ হবে?’ (“Will the killing stop?”) এ প্রশ্নের মুখে সেনাবাহিনীর পক্ষে জবাব হিসাবে নবম ডিভিশনের কমান্ডিং অফিসার শওকত রাজা ১৬ এপ্রিল কুমিল্লায় ম্যাসকার্নহাসের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্যই করেন যে অর্থ ও জনবলের দিক থেকে যত ব্যয়বহুল। হােক না কেন তাদের হাতে রয়েছে কর্তব্য সম্পাদনের ভার। এটা শেষ করতেই হবে। এবং এমন ভাবে শেষ করা হবে যাতে তাদের দ্বিতীয় বার এ ধরনের অপারেশনে নামতে না হয়।’ | শুধু জেনারেল রাজাই নয়, প্রতিটি সেনা-অফিসারের ছিল একই মতামত। পরবর্তী ১০ দিন পূর্ববঙ্গে কর্মরত পাক অফিসারদের সঙ্গে কথা বলে এমন ধারণাই জন্মে অ্যান্থনি। ম্যাসকার্নহাসের যে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গণহত্যার কোনাে বিকল্প পাকসেনাদের জানা। নেই। কিন্তু এপথ ধরে চলতে গিয়ে পাকবাহিনীর বহুসংখ্যাক অফিসার নিহত হয়েছে। এবং তুলনায় সে সংখ্যা ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের ক্ষতির চেয়ে বেশি। তবু তারা স্থানীয় আদমিদের বিনিময়ে মিট্টির (মাটির) ওপর কর্তৃত্ব রক্ষার ‘মিশনটাই একমাত্র লক্ষ্য হিসাবে বিবেচনা করেছে।

সাংবাদিক ম্যাসকার্নহাসের অভিজ্ঞতলব্ধ ধারণা হলাে পাকিস্তান সরকার মুখে যাই বলুক না কেন পূর্ব-পাকিস্তানে তাদের কাজকর্ম থেকে এমন সিদ্ধান্তে পৌছাতে হয় যে তারা পূর্ব-পাকিস্তানকে নতুন করে উপনিবেশ বানাতে চেষ্টা চালাচ্ছে। এটা তার নিছক ধারণা নয়, ঘটনা এমন কথাই বলে, (“I think that in reality…East Bengal is being colonised. This is not an arbitrary opinion of mine. The facts speak for themselves.”) | হ্যা, ঘটনা তাে আর মিথ্যে বলে না। পাক-শাসকশ্রেণী ঐ বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই একাত্তরে পূর্ববাংলা চষে বেড়িয়েছে। নানা ধরনের অপারেশনের নামে নিরীহ অসহায় বাঙালিদের খুন করেছে। সম্প্রদায় বিশেষকে লক্ষ্য করে গণহত্যার বর্বরতা চালিয়েছে। ঠাণ্ডা মাথায়, ডাবের পানি খেতে খেতে তারা হত্যার, ঘরবাড়ি দোকানপাট বাজারঘাট জ্বালিয়ে দেবার হুকুম জারি করেছে অন্তত ম্যাসকার্নহাসের অভিজ্ঞতা তাই বলে। তার হিসাবে এদিক থেকে পাঞ্জাবি অফিসারদের নিষ্ঠুরতা ছিল তুলনাহীন। এক ধরনের উন্মত্ত প্রতিহিংসা যেন তাদের তাড়িয়ে নিয়ে ফিরেছে। পরিশেষে ম্যাসকার্নহাসের মন্তব্য : ‘সেনাবাহিনী হয়তাে পেশীর জোরে, অন্ত্রের দাপটে দেশটাকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারে। কিন্তু পূর্ববঙ্গে তারা যা করেছে তার ফলে পাকিস্তানে একজাতি, একতার সব সম্ভাবনা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। দীর্ঘ সময়ের প্রলেপেও পশ্চিমের পাঞ্জাবি এবং পূর্বের বাঙালি নিজেদের একই রাষ্ট্রের সহ-নাগরিক হিসাবে ভাবতে পারবে বলে মনে হয় না (দ্য সানডে টাইমস, ১৩ জুন, ১৯৭১)।  মাত্র দিন কয়েকের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা সাংবাদিক ম্যাসকার্নহাসের । অভিজ্ঞতা পাকিদের তৎপরতা ও মানসিকতা সম্পর্কে। এবং সেই সূত্রে উল্লিখিত উপলব্ধি। অন্যদিকে ২৫ মার্চ থেকে দীর্ঘ ন’মাস অনুরূপ অভিজ্ঞতার শরিক বাংলাদেশের মানুষ। 

তা সত্ত্বেও বর্তমান অবস্থায় একটি সঙ্গত প্রশ্ন সচেতন মানুষের : বাঙালি কি সে অভিজ্ঞতার মূল্য চেতনায় ধরে রাখতে পেরেছে? পেরেছে পরবর্তী প্রজননার মানুষ সেই ভয়াবহ ইতিহাস পাঠ করে? যেমনটা ইহুদিরা ধরে রেখেছে জাতিসত্তার ওপর ফ্যাসিস্ট আঘাতের প্রতিক্রিয়া? | পাকসেনাদের গণহত্যার বাস্তব বিবরণ ছিল এমনই বাস্তব, এমনই মর্মস্পর্শী যে ঐ তারিখেরই (১৩ জুন) ‘সানডে টাইমস’ সম্পাদকীয় প্রকাশ করে হত্যাকাণ্ড বন্ধ কর (“Stop the Killing’) শিরােনামে। কারণ এ গণহত্যার বিবরণ ছিল যেমন লােমহর্ষক, নিষ্ঠুর, ভয়াবহ তেমনি নির্ভুল (সানডে টাইমস-এর দাবি তারা ম্যাসকার্নহাসের প্রতিবেদনে পরিবেশিত ঘটনাবলীর সত্যতা যাচাই করে দেখেছেন)। আর এ ভয়াবহতা থেকে আত্মরক্ষা করতেই লক্ষ লক্ষ মানুষকে সীমান্ত অতিক্রম করে উদ্বাস্তু হতে হয়েছে, আশ্রয় নিতে হয়েছে শরণার্থী শিবিরের অস্থাস্থ্যকর, অমানবিক পরিবেশে। সঙ্গত কারণে সম্পাদকের প্রশ্ন : ‘যা কিছু পূর্ব-পাকিস্তানে ঘটেছে এর পর কি জাতীয় ঐক্য ধরে রাখা আদৌ সম্ভব? এখনও পাকসেনারা যে-ধরনের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে তাতে পশ্চিমা শক্তির কি পাকিস্তানকে অর্থ সাহায্য করা ঠিক হবে? সে ক্ষেত্রে বিশ্বজনমতের চাপই বরং পাকিস্তানি তৎপরতার ওপর কিছুটা প্রভাব ফেলতে পারে।’ সম্পাদকের আরাে অভিমত : বর্তমান যুদ্ধাবস্থা ও নিষ্ঠুরতার বিচারে একটি বিষয় খুবই স্পষ্ট যে ইয়াহিয়া খানের মারাত্মক ভুল এবং সে ভুলের ভয়াবহ পরিণতি এশিয়ায় এবং বিশ্বে নতুন করে অস্থিতিশীলতার জন্ম দিয়েছে যা স্থানীয় জনগণের জন্য দুঃখ দুর্দশাই বয়ে আনবে। | প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে শুধু ‘সানডে টাইমস-‘এ নয়, সাংবাদিক ম্যাসকার্নহাসের কাহিনী অর্থাৎ পূর্ব-পাকিস্তানে পাকবাহিনীর হাতে সংঘটিত গণহত্যার কিছু বিবরণ এবং সেই সঙ্গে প্রচণ্ড ব্যক্তিগত ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তান থেকে মে মাসের শেষ দিকে তার পলায়নের চমকপ্রদ কাহিনীও ১৩ জুন ‘দ্য টাইমস’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, স্তব্ধ করে দিয়েছে কাগজপড়া বিশ্ববাসীকে। পরে অবশ্য ওয়াশিংটন পােস্ট’ও সে বিবরণ তুলে নিয়েছে তাদের পাতায়।

চার বলতে হয় জয় হােক ‘সানডে টাইমস’-এর। অ্যান্থনি ম্যাসকার্নহাস পূর্ববাংলায় সংঘটিত পাক-বর্বরতার বােমা-ফাটানাে সংবাদ বিবরণ প্রকাশের পর এদিকে অনেকের নজর পড়ে। এক সপ্তাহের মধ্যে ঐ একই বিষয়ের ওপর আরেকটি নির্ভরযােগ্য দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ‘সানডে টাইমস’-এ (২০ জুন, ১৯৭১)। গণহত্যার নবপর্যায় সম্পর্কে আমাদের আলােচনার সমর্থনেই যেন ‘পাকিস্তানে সংঘবদ্ধ হত্যাকাণ্ড’ (“Pogrom in Pakistani’) শীর্ষক প্রতিবেদনটির প্রকাশ। নিবন্ধ শুরু আতঙ্কের আবহ সৃষ্টি করে। পূর্ব-পাকিস্তানে নতুন করে ত্রাসের অভিযান। শুরু হয়েছে। উদ্দেশ্য যে কোনাে বিচ্ছিন্নতাবাদী উথান বা রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের।   সম্ভাবনা নস্যাৎ করা যে-সম্ভাবনা রাষ্ট্রীয় সংহতি নস্যাৎ করতে পারে’ (“A new campaign of teror has begun in East-Pakistan. Its aim is to eliminate any possibility of another secessionist uprising or political challenge to the unity of the State”) আর এ উদ্দেশ্যে পাক-সরকার নয়া-সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়। সামরিক বাহিনীর ঐ ত্রাসের রাজত্বে নতুন সব বিধি বিধান আসতে শুরু করে। এর। মধ্যে অন্যতম বিষয় পাকিস্তানের প্রতি বিশ্বস্ততার পরীক্ষা-নিরীক্ষা। শিক্ষক, লেখক, সাংবাদিক, শিল্পপতিসহ সকল সরকারি কর্মকর্তা এ পরীক্ষার আওতায় আসবে। কেউ বিপজ্জনক মনে হলে তাকে গুলি করে মারা হবে। সামরিক গােয়েন্দা বাহিনী ইতােমধ্যেই অনেক প্রভাবশালী বাঙালিকে গ্রেফতার করতে শুরু করেছে। তাদের শ্রেণীবিন্যস্ত করা। হচ্ছে তিন পর্যায়ে সাদা, ধূসর ও কালাে। কালােদের সরাসরি গুলি করে মারা হবে, ধূসরদের কপাল ভালাে হলে চাকরিচ্যুতি, অন্যথায় কারাবাস। একমাত্র সাদারাই কাজ করতে পারবে।’ | ‘সিভিল সার্ভিসে এর মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়ে গেছে। ছত্রিশজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেই ও মহকুমা অফিসারকে হয় গুলি করে মারা হয়েছে অথবা তারা ভারতে পালিয়ে গেছে। সেনাবাহিনী যখন কুমিল্লা, রংপুর, কুষ্টিয়া, নোয়াখালী, ফরিদপুর এবং সিরাজগঞ্জ শহরে প্রবেশ করে তখন স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ সুপারদের তাৎক্ষণিক ভাবে গুলি করে মারা হয় ।….এই ত্রাসের রাজত্বে নয়া সংযােজন হল ‘গেস্টাপাে কায়দায় তুলে নেওয়া। যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে তাদের কাউকে সরাসরি গ্রেফতার করা হয়েছে, অন্যদের সেনানিবাসে ডেকে নেওয়া হয়েছে। তাদের অধিকাংশই ফিরে আসে নি।

যারা এসেছে তাদেরও অনেককে রাজাকারদের মতাে গোপন এজেন্টরা তুলে নিয়ে গেছে। রাতে বা দিনে ঢাকার এলাকা বিশেষ ঘেরাও করে সেনাবাহিনী হিন্দু, আওয়ামী লীগের সদস্য এবং ছাত্রদের জন্য তল্লাশি চালায়।’ বলার অপেক্ষা রাখে না ধরা পড়লে এদের ভাগ্যে কি ঘটবে। | এ সময় দেশে দ্বিতীয় স্তরে রাজাকারদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এবং তা সেনাবাহিনীকৃত হত্যা, পীড়ন, লুণ্ঠন ও ধর্ষণের ব্যাপকতর পর্যায় মাত্র। ‘সানডে টাইমস’এর প্রতিবেদনে তার তথ্যভিত্তিক সমর্থন মেলে, যা বেশ কিছু ক্ষেত্রে ঢাকাবাসী মানুষের জানা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে : “নিরুদিষ্ট লােকজনের আত্মীয়স্বজন মনে করেন রাজাকার ও জুনিয়র সেনা অফিসারগণ অবাঙালিদের সঙ্গে যােগসাজশে স্বাধীনভাবে কাজ করছে।… রাজাকারগণ এখন খুন, জবরদস্তি অর্থ আদায় থেকে পতিতাবৃত্তি পর্যন্ত তাদের কর্মকারে বিস্তার ঘটিয়েছে। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে তারা তরুণীদের নিয়ে ক্যাম্প পরিচালনা করছে এবং সিনিয়র অফিসারদের ভােগের জন্য প্রতিরাতে ঐসব মেয়েদের পাঠানাে হয়। ঐসব পার্টির জন্য এরা মেয়ে অপহরণের কাজও করছে।’ (“Relatives of missing persons believe that the Razakars and Junior army officers are working independently in league with non-Bengalis….The Razakars have now extended their operation from murder and extortion to prostitution. In Agrabad in Chittagong, they run a camp of young girls who are allocated nightly to senior officers. They have also kidnapped girls for their parties”)  

দীর্ঘ এ প্রতিবিদনটিতে নাম উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট একাধিক বর্বর হত্যাকাণ্ডের বিবরণ প্রকাশ করা হয়েছে এর মধ্যে রয়েছে একাধিক পরিচিত নাম, আবার প্রকাশিত হয় নি। এমন অনেক নাম যাদের নৃশংস হত্যার কথা সবাই জানি। ঐ নিবন্ধে গুরুত্ব দেওয়া। হয়েছে রাজাকারদের বর্বর কর্মকাণ্ডের ওপর, বিহারিদের জিঘাংসাবৃত্তির ওপর। এদের হাতে নিরীহ বাঙালিদের মৃত্যুর ঘটনা কিংবা অসহায় বাঙালি ললনাদের ইজ্জতহানি ও হত্যার কাহিনী মনে হয় বাঙালি কখনাে যথাযথ মূল্যে গ্রহণ করে নি। | তাই যেমন অতি সহজে তাদের ক্ষমা করা হয়েছে তেমনি সামাজিক পর্যায়ে সেসব অপরাধ শনাক্ত করা ও অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার চেষ্টাও করা হয় নি। একদিকে বিজয়ের আবেগে ভেসে চলা হয়ে উঠেছিল চড়াদামের স্বাধীনতাযুদ্ধ শেষের করণীয়। অন্যদিকে লুষ্ঠিত সম্বম ও নিগৃহীত নারীদের ফাকা সান্ত্বনার প্রলেপে চৰ্চিত করে অভিহিত করা হয়েছিল ‘বীরাঙ্গনা’ নামে। এ তালিকায় সঙ্গত কারণে বহু গৃহবধূ বা তরুণী নাম লেখাতে যান নি। সমাজ চেষ্টা করে নি যুদ্ধাপরাধের ওপর জরিপ চালিয়ে শনাক্তকরণের তালিকা তৈরি করতে। তখন বাঙালিদের মনে আবেগের ‘অতিশয্যে এ-উপলব্ধি জন্মায় নি যে রাজাকারদের অপরাধ ছিল ক্ষমার অযোগ্য। বৃথাই ১৬ ডিসেম্বরের পর হিসাব-নিকাশ না করে যেমন খুশি বিহারিদের খতম করা হয়েছে এবং সেই সালে কিছু সংখ্যক রাজাকারদের। দরকার ছিল অপরাধী রাজাকারদের খুঁজে বের করে বিচারের জন্য দাঁড় করানাে।  পাক-সেনাবাহিনী এবং তাদের সহযােগী বাঙালি-অবাঙালি রাজাকার, বিহারি ও কথিত শান্তি কমিটির সদস্য যেভাবে গণহত্যায় এবং ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও ঘরবাড়ি দোকানপাট ভস্মীভূত করার কাজে লিপ্ত ছিল দ্বিতীয় পর্যায়ে তা আর বিশ্বজনমতের অগােচর ছিল। যে জন্য বিবেকবান বিদেশী কর্মকর্তা, সংবাদদাতা এবং অনুরূপ পেশার বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ তাদের লেখায়, বক্তব্য-বিবৃতিতে তা নিন্দ্বিধায় প্রকাশ করেছেন। তাই বিশ্বব্যাংকের তত্ত্বালীন দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের পরিচালক পিটার কারগিল পাকিস্তানকে অর্থ সাহায্য দানের বিরােধিতা করতে গিয়ে পূর্ব-পাকিস্তান পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি মারাত্মক রিপাের্ট পেশ করেন।

ওয়াশিংটন পােস্ট’-এর প্রতিবেদন (২৭ জুন) অনুযায়ী কারগিল রিপাের্টের ভিত্তিতে পূর্ব-পাকিস্তানে সংঘটিত গণহত্যার বিষয়টি সত্য প্রতিপন্ন হয়। সে বিচারে স্বীকার করা হয় যে পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত ৭০ হাজার পশ্চিম-পাকিস্তানি সৈন্য সেখানে অব্যাহত আসের রাজত্ব চালিয়ে যাচ্ছে। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিকেশ করতে সেনাবাহিনীকে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে’ (“A continuing reign of terror in the East Wing conducted by the 70,000 West-Pakistani troops stationed there, the army has been given a freehand to deal with the ‘secessionists.”) * সরেজমিনে অবস্থা পরিদর্শনে আসা ব্যাংক মিশন দলের জনৈক সদস্যকে জানানাে হয় যে ৫০ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে ঐ সদস্যের শহরে পৌছানাের মাত্র একদিন আগে খুন করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। নিমজ্জনের কাজ অসম্পূর্ণ হওয়ার দরুন দুটো লাশ জনৈক ড্রাইভারের সহায়তায় ঐ সদস্যের পক্ষে দেখা সম্ভব হয়’ (“One   team member was told of 50 Hindus who had been slaughtered, their corpses had been pushed into a river the day before his arrival in a town. A driver led him to two corpses whose submersion was incomplets”) যাংক পরলশ দল আরো লক্ষ্য করেন নাগরিক জীবনের ভেঙে পড়া অবস্থা লক্ষ্য করেন শহরে জনসংখ্যার স্বল্পতা। তাদের হিসাবে সিংহভাগ নাগরিক জনসংখ্যা নিজ নিজ গ্রামে বা ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে, বাকি সব পাকসেনাদের হত্যাযজ্ঞের শিকার। সৈন্যরা শেলের আঘাতে জনভবন গুঁড়িয়ে দিয়েছে। বাণিজ্যিক জীবন বিপর্যস্ত। এক কথায় ধ্বংসপ্রায়, মৃতপ্রায় অবস্থাই পূর্ব-পাকিস্তানের জন্য সত্য। হয়ে উঠেছে। (দ্য গার্ডিয়ান, ২৮ জুন, ১৯৭১)।  পূর্ব-পাকিস্তানে বিরাজমান ভয়াবহ পরিস্থিতি সম্পর্কে কারগিল রিপাের্টে যে-চিল তুলে ধরা হয় তা ‘সানডে টাইমস’-এ প্রকাশিত হয়ে বিশ্বজনসাধারণের গােচরে আসে। ঐ বক্তব্যের এককথায় সারসংক্ষেপ হলাে ‘পূর্ব-পাকিস্তানে সেনাবাহিনী এক ভয়ঙ্কর ত্রাসের রাজত্ব চালাচ্ছে, অর্থনীতি স্থবির আর নাগরিক জীবন ভেঙেচুরে একাকার। রিপাের্টে আরাে বলা হয়েছে যে বাঙালি ‘গেরিলা বাহিনী ইয়াহিয়া সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে চলেছে, আর বিশ্বজনমত এবং পূর্ব-পাকিস্তান পরিস্থিতি সম্পর্কে ইয়াহিয়া সরকার মনে হয় অবহিত নয়” (সানডে টাইমস, ১১ জুলাই, ১৯৭১)। 

মনে হয় বিশ্বসংবাদ-ভুবন ইয়াহিয়া সরকারকে নর-নারী হত্যা ও নির্যাতনের অভিযােগে কাদাপানিতে নামিয়ে দিয়েছে। অধিকাংশ পশ্চিমা পত্রপত্রিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকগণ নানাভাবে পূর্ব-পাকিস্তানে সংঘটিত গণহত্যার মর্মস্পর্শী বিবরণ সগ্রহ করে যে হারে তাদের কাগজে প্রকাশ করতে শুরু করেছেন তাতে ইয়াহিয়া সরকারের ভাবমূর্তিতে শুধুই কালাে কালির টান পড়েছে। সাংবাদিকদের কেউ কেউ আবার পূর্বপাকিস্তানে ঘুরে যাবার অভিজ্ঞতার ওপর ভর করে লিখেছেন এবং অব্যাহত হত্যা, অগ্নিসংযােগ ও বিতাড়নের কারণ সম্পর্কে নিজ নিজ ব্যাখ্যাও হাজির করেছেন।  ঢাকা থেকে মাইকেল হর্নসূবি ‘টাইমস’ পত্রিকায় প্রকাশিত (৯ জুলাই, ১৯৭১) নিবন্ধে পূর্ব-পাকিস্তানে গণহত্যার ঘটনাবলী আত্মপরাজয়ের তৎপরতা হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। তার নিবন্ধে (‘Self-defeating slaughter in East-Pakistan’) মাইকেল হর্নসবি বলেন, “এ বিষয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই যে গত তিন মাসে পূর্ব-পাকিস্তানে প্রধানত হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষই পাক-সেনাবাহিনীর আক্রমণের অব্যাহত শিকার। সেনবাহিনী যেখানে গেছে সেখানেই এর বাস্তব প্রমাণ মিলবে। (“There is no longer any serious dispute that the Hindus of East Pakistan have been the most consistent targets of army action in the past three months. Viable evidence for this is to be found where the army has been”) | বাঙালি মুসলমানদের ক্ষেত্রে তারা লক্ষ্য নির্বাচনে বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণ করেছে। তারা শুধু আওয়ামী লীগ নেতাদেরই নয়, অধ্যাপক ছাত্র আইনজীবী ও সরকারি কর্মজীবী (যেমন পুলিশ) যারা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সমর্থন যুগিয়েছে তাদের সবাইকে “লক্ষ্য’ হিসাবে ধরে নিয়েছে। অন্যদিকে সেনাবাহিনী যেসব শহরে প্রবেশ করেছে প্রতিটি ক্ষেত্রে হিন্দুসম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি বিসদৃশভাবে ব্যাপক সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও  

দোকানপাট পােড়ানাে ও লুট করা হয়েছে। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে বন্দুকের মুখে অহিন্দু লােকজনদের লুটপাটে বাধ্য করা হয়েছে। (‘The damage to Hindu property in almost all towns where the army left its marks is disproportionately severe. This can be seen in systematic burning and looting of Hindu shops and homes. In some cases the non-Hindu population have been compelled of gunpoint to do the work of pillage.”) আর গ্রামাঞ্চলে প্রায়শ হিন্দু গ্রাম বা হিন্দুপ্রধান গ্রামগুলাে সেনাবাহিনী ধ্বংস করার জন্য বেছে নেয়। এমন কি বাঙালি গেরিলা যােদ্ধাদের তৎপরতার, যেমন সেতু উড়িয়ে দেওয়ার মতাে কর্মকাণ্ডের অজুহাতে নিকটস্থ হিন্দু প্রধান গ্রামে ধ্বংসযজ্ঞ চালানাে হয়। ধর্ষণ ও লুণ্ঠনের ঘটনা ছিল নিয়মিত ও ব্যাপক। এসব কারণে বর্তমান পর্যায়ে উদ্বাস্তুদের মধ্যে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশই হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত। | এর পেছনে সামরিক বাহিনীর যে চিন্তা কাজ করেছে হর্নসবি’র বিবেচনায় তা হলাে হিন্দু মুসলমানের ঐতিহাসিক বিভেদ ও ঘৃণার পটভূমি সক্রিয় করে তুলে কাজে লাগানাে। তাছাড়া এমন ভ্রান্ত ধারণাও কাজ করেছে যে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের পেছনে হিন্দুরাই অনিষ্টকর শক্তি হিসাবে সক্রিয় ছিল এবং এজন্য তাদের কঠোর শিক্ষা দেওয়া দরকার” (“Hindus were the imalign forces behind the secessionist movement and had to be taught a savage lesson”.) | এমন ধারণার বশবর্তী হয়েই সেনাবাহিনী হিন্দু বিতাড়নে মত্ত হয়েছে। হসৰি ব্যক্তিসূত্রেও জেনেছেন যে সামরিক শাসকগণ চায় উদ্বাস্তু হিন্দুরা আর এদেশে ফিরে না আসুক। তাদের মতে এরাই যত নষ্টের মূল দেশদ্রোহিতা, অশান্তি ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী বিচ্ছিন্নতার মতাে বহুবিধ বিষয়ে। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকশ্রেণীর নিশ্চিত বিশ্বাস যে বাঙালিদের (অর্থাৎ মুসলমানদের) মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী উচ্চাকাক্ষার কোনাে প্রকৃত ভিত্তি নেই’ (“The rulers in West-Pakistan are immovably convinced that separatist aspirations among the Bengalis are without genuine foundation”.) i এখানে বাঙালি বলতে বাঙালি মুসলমানের কথা বলা হয়েছে।

পাকশাসকদের ধারণা যে বিচ্ছিন্নতার ভাবনা কৃত্রিমভাবে বাঙালি মুসলমানের মধ্যে জাগিয়ে তােলা হয়েছে। এজন্য হিন্দুদের সঙ্গে অতি ঘনিষ্ঠ কিছুসংখ্যক উগ্রপন্থী আওয়ামী লীগ সদস্য, ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী ও ভারতীয় বেতারের অর্থপুষ্ট ঘূণ্য প্রচারকরা। দায়ী, দায়ী বিবিসি ও ব্রিটিশ সংবাদপত্রভুবন। কাজেই কড়া ওষুধের শক্ত এক ডােজ ঠিক মতাে পড়লে তা অচিরেই চপলমতি ও লঘুচিত্ত বাঙালিদের সঠিক পথে ফিরিয়ে WA I’ (“They see them as the product of agitation artificially incited by a few extremists in the Awami League ‘working hand in glove’ with Hindus, Indian infiltrators and malicious propagandists on the pay of All-India Radio, the BBC and the British press… a dose of harsh medicine, firmly administered, will soon bring the fickle and volatile Bengalis back into line.”) পাক-সামরিক শাসক শ্রেণী এবং তাদের সেনাবাহিনী এমনই এক মূর্খের স্বর্গে বরাবর বাস করেছে প্রধানত ধর্মান্ধতা ও ধর্মীয় রক্ষণশলীতার কারণে। দুই যুগ ধরে   তারা ভেবে এসেছে বাঙালি মুসলমান তার আর্থ-সামাজিক স্বার্থ নিয়ে বিভাগপূর্বকালে হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে লড়াই করলেও সমধর্মী পাঞ্জাবিদের সঙ্গে করবে না। দেশবিভাগের পরপর বাঙালি মুসলিম লীগ নেতাদের ভূমিকা পশ্চিমাদের মনে এমন ধারণা। বন্ধমূল হতে সাহায্য করেছিল। | তাই তারা জাতীয়তাবােধের দায়, জাতীয় স্বার্থের আকাক্সক্ষা ইত্যাদি সব কিছুর দায় প্রধানত বাঙালি হিন্দুদের কাধে চাপিয়ে দিয়ে নরহত্যার আয়ােজন করেছে। একদিকে হিন্দুসম্প্রদায়ের সদস্যদের যেখানে সম্ভব হত্যা করেছে, সেই সঙ্গে নির্বিচারে ঘরবাড়ি পুড়িয়ে তাদের দেশছাড়া করেছে, হত্যা করেছে জাতীয়তাবাদী সন্দেহে বাঙালি। মুসলমানদের, আর হিন্দুর বিষয় সম্পত্তি বন্টন করে মুসলমানদের বশে আনতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু শেষােক্ত কাজটিতে পুরােপুরি সফল হওয়া সম্ভব ছিল না।গণহত্যার এ পর্যায়ে হত্যাকারীদের সাম্প্রদায়িক চরিত্র প্রকট হয়ে উঠেছিল শুধু সেনাবাহিনীর সাম্প্রদায়িক অন্ধতার জন্যই নয়, সেই সঙ্গে আইন শৃঙ্খলা ভেঙে নিয়মনীতি নষ্ট করে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টির উপযােগী ধর্মান্ধ আততায়ী শক্তি সংগঠিত করে তােলার কারণেও। ধর্মান্ধ পাকিস্তান সমর্থক রাজাকার, শান্তিকমিটি এবং বিহারিদের নিয়ে গঠিত তথাকথিত পাকিস্তান-রক্ষাকারী এই শক্তি প্রকৃতপক্ষে সামাজিক স্তরে সন্ত্রাসী শাসন কায়েম করেছিল। যাকে খুশি ধরে এনে অর্থ আদায়, সন্দেহক্ৰমে যাকে খুশি হত্যার অধিকার বেসরকারি ভাবে তারা ভােগ করেছে। আর এ কারণে আনুষঙ্গিক অপরাধ যেমন ধর্ষণ, লুণ্ঠন, রাহাজানিতে তারা অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। এসব কাজের জন্য।

জবাবদিহিতার কোনাে দায় তাদের ছিল না।  শহর ঢাকার মানুষ এমন বহু ঘটনার সাক্ষী, তেমনি গ্রামাঞ্চলের মানুষও। বহির্বিশ্বের মানুষের পক্ষে এতটা খুঁটিনাটি জানা বা বােঝা খুব একটা সহজ ছিল না, বিশেষ করে সামরিক শাসন যখন খবর গােপন রাখতে চেয়েছে। কিন্তু সানডে টাইমস’-এর ম্যাসকার্নহাসের লেখা দীর্ঘ প্রতিবেদনে পূর্ব-পাকিস্তানে হত্যা ধর্ষণ পীড়নের ভয়ংকর ঘটনাবলী প্রকাশের পর পশ্চিমা সাংবাদিকদের পক্ষে চোখ-কান বন্ধ করে চুপচাপ বসে থেকে সরকারি ভাষ্য মেনে নেওয়া আর সম্ভব ছিল না। কাজেই তারা পাকিস্তানি শাসকদের প্রচারিত স্বাভাবিক অবস্থা যাচাই করে দেখতে চেয়েছেন, যে কোনাে সুযােগে বা কৌশলে পূর্ব-পাকিস্তানে এসে পরিস্থিতি সরেজমিনে মূল্যায়নের চেষ্টা করেছেন। ‘সানডে টাইমস’-এর আরেকটি প্রতিবেদন (‘খুনি ও ধর্মান্ধদের শাসন) অনেকাংশেই ছিল পূর্বোক্ত নিবন্ধের মতই বিস্ফোরক চরিত্রের। পূর্ব-পাকিস্তানে আইন-শৃঙ্খলার শাসন প্রতিষ্ঠার দাবি যে নিতান্তই বিশ্ববাসীর চোখে ধুলাে দেওয়ার চেষ্টা সেটাই আলােচ্য প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে।  খুলনা জেলার বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন অফিসার, রাজাকার ও অন্যান্যদের সঙ্গে আলাপ করে এবং এদের সার্বক্ষণিক শ্যেনচক্ষু ফাকি দিয়ে স্থানীয় লােকজনের সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদক শান্তি ও নিরাপত্তার পরিবেশ সম্পর্কে ভিন্ন। ধারণা গড়ে তােলেন। প্রতিবেদনে একাধিক ঘটনা উল্লেখ করে সিদ্ধান্তে আসেন যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ঘােষণায় শরণার্থীদের ঘরে ফেরার আমন্ত্রণ সত্ত্বেও স্পষ্টতই পরিস্থিতি এমন যে একমাত্র অতিসাহসী বা অতিশয় নির্বোধ উদ্বাস্তুই ফিরে আসার চেষ্টা করতে পারে। পরবর্তী আলােচনায় দেখা যাবে যে এ মূল্যায়ন আশ্চর্যরকম নির্ভুল। 151 1(“…it is clear that only a very brave or very foolish refugees would try to return as things are.”) | তিনি আরাে সিদ্ধান্তে আসেন, এবং স্থানিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই সিদ্ধান্তে আসেন যে পূর্ব-পাকিস্তানে এখন শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের নিয়ে দুই সমান্তরাল সরকারের উপস্থিতি আরাে আতংকজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।’ (Even more alarming is the development, with Peace Committees and Razakars, of two parallel governments in East-Pakistan’) উল্লিখিত দ্বৈত শাসনের একটি নিয়মতান্ত্রিক বেসামরিক ব্যবস্থা যা অতি পুরােপুরি অচলাবস্থায় পৌছে গেছে; অন্যটি ভাড়াটে গােপন সংবাদদাতা, ধর্মান্ধ ও খুনিদের এক শাসন যা পূর্ব-পাকিস্তানে যেটুকু আইন অবশিষ্ট আছে আপাত বিচারে তার উর্ধ্বে এবং কারাে কাছে জবাবদিহিতায় দায়বদ্ধ নয় ।…

হিটলার মুসােলিনির রাজনৈতিক পদ্ধতির প্রবর্তন সমর্থনযােগ্য হতে পারে না। (One is normal civil administration…now approaching complete impotence, the other a regime of paid informers, bigots and thugs answerable to no one and apparently above whatever law is left in East Pakistan…The introduction of the political method of Hitler and Mussolini even less defensible.) ‘নিউজউইক’ কাগজের লােরেন জেনকিনস, যিনি ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় সেনাআক্রমণের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেছিলেন, মাস কয় পরে ঢাকায় এসে ভিন্ন ধরনের কোন খবর পাঠাতে পারেন নি। পত্রিকাটির মতে সময়ের টানে হত্যাকাণ্ডের ব্যাপকতা কমে এলেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরতা এতটুকু কমেনি’ (“With the passing of time the magnitude of the slaughter has dimished, but there has been no lessening in the brutality of the Pakistani Army”.) | জেনকিনসের ভাষায় চার মাস আগে প্রথম রক্তস্রোত বইয়ে দেবার পর পূর্বপাকিস্তান এখনও ভয়ের রাজত্বে বাস করছে।” (Four months after the first flush of bloodletting, East-Pakistan still lives in fear”.) ঢাকায় স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলােচনার সূত্রে তিনি জানান যে তারা এক আতংকের রাজত্বে বাস করছে, কখন মধ্যরাতে কার ঘরের দরজায় আঘাত পড়বে কেউ জানে না। বহু লােক নিহত হয়েছে। এ পর্যন্ত আরাে অনেক নিখোঁজ। প্রতিরাতেই অনেকে নিখোজ হচ্ছে।”  প্রসঙ্গত জেনকিনস জনৈক পশ্চিমা কূটনীতিকের মন্তব্য উদ্ধার করে লেখেন : “ইয়াহিয়া আর নিজের মধ্যে নেই। সেনাবাহিনী যে কি কাণ্ড করেছে এখনাে তা বুঝে ওঠার অবস্থা তার নেই। তার ধারণী সেনাবাহিনী কয়েক লাখ লােক মেরে ফেলে জোর করেই শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনৰে’ (“Yahya is simply out of his mind. He still does   not understand what army has done. He thinks they can kill a couple of hundred thousand people, force a return to order.”) বস্তুত এই গণহত্যার ওপরই ছিল ইয়াহিয়ার ভরসা যে জন্য বিশ্বজুড়ে সমালোচনার চাপ তাকে কাবু করতে পারে নি। বাস্তব অবস্থার ভেতরে নজর ফেলার মতাে বাস্তববুদ্ধিও তার অবশিষ্ট ছিল না। গােটা পূর্ব-পাকিস্তানের গ্রামাঞ্চল জুড়ে ও সীমান্ত এলাকায় যখন রক্তপাত হত্যা আর নির্যাতন চলছে, চলছে ব্যাপক নারী ধর্ষণের মতাে নারকীয় তাণ্ডব তখনাে ইয়াহিয়া চোখ বুজে বিজয়ের স্বপ্ন দেখেছে, বিজয় অসামরিক ভীরু বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে পাক-সেনাবাহিনীর।

কিন্তু অবস্থা তখন আর তার পক্ষে নেই। মিত্রদেশ, পরিত্রাতা দেশের কোথাও সংবাদজগত তার পক্ষে কথা বলছে না। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’-এর মত কইর মার্কিনি কাগজেও ছাপা হচ্ছে গণহত্যার কাহিনী। “নিউজউইক’, ‘টাইম’, ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ বা নিউইয়র্ক টাইমস’-এর মতাে কাগজে তাে বটেই। “ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’-এ পিটার কান সংকটের বিবরণ দিয়ে জানাচেছন লক্ষ লক্ষ বাঙালি, বিশেষ করে হিন্দু এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মুসলমান গ্রামাঞ্চলে লুকিয়ে রয়েছে। এখনাে প্রতিদিন প্রায় ৫০,০০০ উদ্বাস্তু ভারতে পালিয়ে যাচ্ছে ।’ (“Millions of Bengalis, particularly Hindus and middle class Moslems are still hiding in the countryside. About 50,000 refugees are still fleeing to India each day.” July 23, 1971) | কিন্তু গ্রামাঞ্চলে লুকিয়ে থেকেও জান বাঁচানাে সম্ভব হয় নি অনেকের, বিশেষ করে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের পক্ষে। পাকবাহিনীর হিসাবে ওরা সবাই দুষ্কৃতকারী’ (‘miscreants’)। দুষ্কৃতকারী হিসাবে একবার চিহ্নিত হলে তার আর রক্ষা নেই। পিটার কান লিখেছেন : যারাই সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কথা বলে তাদের সবাই দুষ্কৃতকারী।’ (“Miscreant is the term the Pakistan army applies to all who opposes it”) ঘটনা ছিল দখলদার বাহিনীর হাতে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানি বাহিনী, রাজাকার বা বিহারিদের চোখে সন্দেহভাজন বাঙালি মাত্রেই ছিল দুষ্কৃতকারী অর্থাৎ ‘মিসক্রিয়েন্ট’। আর তাদের পরিণাম একটাই— মৃত্যু। এ ধরনের খবর বিশেষ করে শরণার্থীদের চরম দুর্দশা ও তাদের জন্য মানবিক সাহায্যের আবেদন প্রকাশ পেয়েছে কানাডার পত্রিকা ‘ভ্যানকুভার সান’-এর একাধিক সংখ্যায় ।  চার মাসেরও বেশি সময় ধরে পূর্ববাংলায় পাকবাহিনীর তৎপরতা চলেছে; তৎপরতা হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নি সংযােগের ।

তবু তারা লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে নি। তাই চলছে নয়া উদ্যমে তৎপরতা। এখন তৎপরতা শহরের চেয়ে মূলত গ্রামাঞ্চলেই বেশি। আগস্টের প্রথম দিনে দুটো নিবন্ধ দুই ভিন্ন কাগজে এ কথাই যথেষ্ট তাৎপর্য নিয়ে প্রকাশিত। তাৎপর্য পূর্ববাংলায় বিরাজমান পরিস্থিতি নিয়ে, বিচার-বিশ্লেষণ ও পরিণাম নিয়ে। ‘সানডে টাইমস’-এর সম্পাদকীয় নিবন্ধের বক্তব্য হলাে : ‘ছ’সপ্তাহ আগে এ কাগজেই ইয়াহিয়ার ভ্রান্তনীতির কারণে সৃষ্ট ট্র্যাজেডির কথা বুলেটের সাহায্যে পূর্ব    পাকিস্তানের বাঙালিদের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিস্ফুট আকাক্ষা দমনের কথা বলা হয়েছিল। সে কথা তখন যেমন সত্য ছিল এখন তা আরও ভয়াবহ রূপ নিয়ে সত্য হয়ে উঠেছে। আতংক ক্রমেই বেড়ে চলেছে বিশেষ করে যখন ভারতের আশ্রয় শিবিরে শরণার্থীদের মধ্যে রােগের প্রকোপও দেখা দিয়েছে এবং বর্ষা ঋতুও এগিয়ে আসছে। (“An appalling error has led to an appalling tragedy. That is how the Sunday Times, six weeks ago, described the Pakistan Government’s decision to quell with bullets the democratically expressed wish of the East Pakistan Bengalis… True then, the words are even more gruesomely true today. The horror mounts steadily as discose grips the Pakistani refugees in India and the onset of monsoon draws nearer” i August, 1971) | এ ট্র্যাজেডির জন্য ইয়াহিয়া ও তার সেনাবাহিনী দায়ী বলেই পত্রিকাটি পাকিস্তানকে বৈদেশিক ঋণ সাহায্য দেওয়ার বিরুদ্ধে। বরং মানবিক বিবেচনা মাথায় রেখে শরণার্থীদের। সাহায্য করাই তাদের বিবেচনায় সঠিক কাজ। দ্বিতীয় মন্তব্যটি যুক্তরাষ্ট্রের জনৈক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার। পূর্ব-পাকিস্তানের বিরাজমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন : “পােলান্ডে নাৎসী তৎপরতার দিনগুলাের পর এটাই হচ্ছে সবচেয়ে অবিশ্বাস্য, হিসাব-নিকাশ করা (নিকাশের) ঘটনা (“It is the most incredible, calculated thing since the days of the Nazis in Poland.” St. Louis Post-Dispatch, 1, August, 1971) এ সময়ের বিলেতি কাগজগুলােতে তাে বটেই, মার্কিনি কাগজগুলােতেও গণহত্যার পরিপ্রেক্ষিতে বাঙালি শরণার্থীর (প্রধানত হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত) দুঃখকষ্ট নির্যাতনের মর্মস্পর্শী কাহিনী স্থান পেয়েছে।

এর কারণ, আমরা আগেই বলেছি, পাক-সামরিক শাসনকর্তাদের নয়ানীতির প্রভাব। এ সময় তারা আরাে চেষ্টা করেছে অর্থের লােভ বা বুলেটের ভয় দেখিয়ে বাঙালি রাজাকার সংস্থা গঠন করতে। এতে কিছুটা সাফল্যও পেয়েছে। আরাে চেষ্টা করেছে ধর্মীয় প্রভাব বাড়িয়ে সম্প্রদায়গত ভেদচেতনা বাড়িয়ে তুলতে। পরিত্যক্ত হিন্দু সম্পত্তি বিতরণ করেছে রক্ষণশীল, পাকিস্তানপন্থী স্থানিক বাঙালিদের মধ্যে। কখনাে হিন্দুপাড়া পুড়িয়ে বেয়নেটের মুখে নিরীহ মুসলমান গ্রামবাসীদের বাধ্য করেছে পড়শীদের বাড়ি লুট করতে।  “টাইম ম্যাগাজিনে ২ আগস্ট (১৯৭১) সােনার বাংলার ক্ষতবিক্ষত’ রূপের দীর্ঘ সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে গণহত্যা থেকে শরণার্থী পর্যন্ত বিষয়ের আলােচনা নিয়ে। সেখানে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সােনার বাংলা গানের কয়েক পঙক্তির ইংরেজি ভাষান্তর। করুণ রােমান্টিক বেদনা ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছে এ প্রতিবেদনের কোনাে কোনাে স্তবকে। শ্রমে ক্লান্ত, মানসিকভাবে বিপর্যন্ত ঘরছাড়া ঘরহারা শরণার্থীর ভারতসীমান্ত অভিমুখে দীর্ঘ ধূসর কাফেলার ছবিও এ লেখায় পরিস্ফুট। প্রতিবেদকের হিসাবে শরণার্থীর সংখ্যা ৭৫ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে। সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে অনাহার, দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনা, বর্ষা আর বন্যার আশংকা। | শরণার্থী শিবিরের জনৈক জার্মান চিকিৎসকের বরাত দিয়ে জানানাে হয়েছে পাকসেনাদের বর্বরতার কাহিনী— এসব কাহিনীতে ভিন্নতা নেই। সেই উপর্যুপরি ধর্ষণ, হত্যা আর ঘরে ঘরে আগুন দেওয়ার কাহিনী সব কিছু ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছে। 

প্রতিবেদকের ভাষায় পূর্ব-পাকিস্তানের সর্বত্র রক্তস্নানের সাক্ষ্য প্রমাণ ছড়ানাে'(“The evidence of the bloodbath is allover East-Pakistan.”) খুলনা, খালিশপুর, যশাের চট্টগ্রাম প্রভৃতি অঞ্চলে সংঘটিত হত্যা আর ধ্বংসের বিবরণ তুলে আনা হয়েছে এখানে।  ‘টাইম’ প্রতিবেদকের হিসাব অনুযায়ী সেনাবাহিনীর আক্রমণে মৃতের সংখ্যা আনুমানিক ২ লক্ষ থেকে ১০ লক্ষ পর্যন্ত হতে পারে। অপেক্ষাকৃত কম সংখ্যা ব্যাপকভাবে স্বীকৃত হলেও মৃত্যুর সঠিক সংখ্যা হয়তাে কখনােই জানা যাবে না। কারণ অসংখ্য লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে, নিক্ষেপ করা হয়েছে কূয়ায়, মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে 5 26′ (“Estimates of death toll in the army crackdown range from 200,000 all the way upto a million The lower figure is more widely accepted, but the number may never be known. For one thing, countless corpses have been dumped in rivers, wells and massgraves.”) | এ প্রতিবেদনেও পূর্বে উল্লিখিত মার্কিন কর্মকর্তার পােলান্ডে নাৎসী বর্বতার সঙ্গে। পাক বর্বরতার তুলনামূলক মন্তব্যটি উদ্ধার করে বলা হয়েছে যে শরণার্থীদের মধ্যে তিন চতুর্থাংশ এবং নিহতের সিংহভাগই হিন্দু। তারাই মােসলেম সেনাবাহিনীর ঘৃণার আঘাতটা বহন করছে।’ (“The Hindus, who account for three-fourths the refugees and a majority of the dead, have bome the brunt of the Moslem military’s hatred.”) এ সংখ্যার প্রচ্ছদচিত্রটিও বিষয়ানুগ অর্থাৎ পূর্ববাংলার দুঃখযন্ত্রণার প্রতীক। 

একই দিনের (২ আগস্ট, ১৯৭১) “নিউজউইক’-এর বিশেষ নিবন্ধটিও প্রচছদচিত্র নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। ‘টাইম ম্যাগাজিনের তুলনায় হত্যাকাণ্ড ও শরণার্থী-বিপর্যয়ের। অধিকতর মর্মস্পর্শী ছবি ছেপে ‘নিউজউইক’-এর এ সংখ্যাটি মনে হয় পূর্ব-পাকিস্তানে। সংঘটিত নৃশংস বর্বরতার প্রতি বিশ্বমানবিকতার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছে। নিবন্ধের শিরােনাম ‘বাংলা: এক জনগােষ্ঠী হত্যা’ (‘Bengal: The Murder of a People’) | গুরুত্বপূর্ণ এ নিবন্ধে সমস্যার আদ্যোপান্ত আলােচনা করা হয়েছে বিচার-বিশ্লেষণসহ। পাকিস্তানের দুই অংশে দুই সংস্কৃতির ভিন্নতা ও দুই অঞ্চলের অর্থনৈতিক বৈষম্যসহ রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত এবং পাক-সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের পরিকল্পনা, উদ্বাস্তু কাফেলা, গেরিলা প্রতিরােধ ও দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনা ইত্যাদি বিচিত্র বিষয়। নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, তবে সেখানে মানবিক দিকটাই প্রাধান্য পেয়েছে। সমালােচিত হয়েছে নিক্সন প্রশাসনের শীতল ও একদেশদর্শী ভূমিকা যেমনটা সমালােচিত হয়েছে ‘টাইম’ ম্যাগাজিনের নিবন্ধেও। উভয় কাগজেই সেনেটর এডােয়ার্ড কেনেডির অভিযোগও উল্লেখিত যে নিক্সন প্রশাসন ‘বাঙালি ট্র্যাজেডির বিশালতা (ব্যাপকতা) ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে (“Kennedy’s clear implication was that the Nixon Administration was seeking to cover up the magnitude of the Bengali tragedy”) | উল্লেখ্য যে পাক-সেনাবাহিনীর চরম অমানবিক নিষ্ঠুরতার বিবরণ দিয়ে নিউজউইক’এর নিবন্ধটি শুরু।

ময়মনসিং-এর হালুয়াঘাট গ্রামে এক পাক-মেজর তার ‘আহত জওয়ানদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে রক্তদানের আবেদন জানিয়ে কেমন চাতুর্যের সঙ্গে স্থানীয় যুবকদের দেহ থেকে সব রক্ত টেনে নিয়ে তাদের মৃতদেহগুলাে পেছনে ফেলে রেখে যায় সেই   গল্পসদৃশ বীভৎস ঘটনার বিবরণ নিয়ে নিবন্ধের সূচনা। (“Assembling the young men of the village of Haluaghat in East-Pakistan, a Pakistani Army major informed them that his wounded soldiers urgently needed blood. Would they be donors? The young men lay on makeshift cots, needles were inserted in their veins and then slowly the blood was drained from their bodies until they died”) 4WORST সঙ্গে কি নাৎসী পাশবিকতার সাদৃশ্য কম? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদিদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অনুরূপ নাৎসী বর্বরতার কাহিনী অনেকেরই জানা।  এর চেয়ে কম পৈশাচিক নয় দ্বিতীয় ঘটনাটি। আন্তর্জাতিক মতামতের চাপে পড়ে শেষ পর্যন্ত ইয়াহিয়া লােক দেখানাে এক সাধারণ ক্ষমা ঘােষণা করে। আহ্বান জানানাে হয় শরণার্থীদের ঘরে ফিরে আসতে। সীমান্তে শরণার্থী ক্যাম্পও খােলা হয়। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বিদ্রোহীদেরও বিশ্বস্ততার বিনিময়ে ক্ষমা ও পুনর্বাসন করা হবে বলে আশ্বাস দেওয়া হয়। কিন্তু গেরিলা যােদ্ধারা ইয়াহিয়ার পাতা ফাঁদে পা দেয় নি। শরণার্থী ক্যাম্পগুলােও সাধারণত শরণার্থী শূন্যই থেকেছে। এর মধ্যে যারা ইয়াহিয়ার মানবিক আশ্বাসে প্রতারিত হয়ে ক্যাম্পে প্রবেশ করেছে তাদের কেউ আর ঘরে ফিরে নি, ফিরতে পারে নি। এমন সংবাদ তখন মুখে মুখে ফিরেছে, যেজন্য চেষ্টা চলেছে শরণার্থীদের ঘরে ফেরা সম্পর্কে সতর্ক করে দেবার।  কিন্তু সাদামাঠা দেহাতি মানুষ, অশিক্ষিত মানুষ কেউ কেউ রাষ্ট্রপ্রধানের ঘােষিত অঙ্গীকার অবিশ্বাস করতে পারে নি। প্রধানত ঘরে ফেরার তাগিদে সেই আশ্বাসে ভর করে দেশে ফিরতে গিয়ে ভুলের মাশুল গুনেছে তারা । গুনেছে ইয়াহিয়ার বর্বর জওয়ানদের হাতে জান দিয়ে, আর নারী দিয়েছে ইজ্জত ও জান দুইই। এ ধরনের কয়েকটি ঘটনা সেময় বিদেশী কাগজে ছাপা হয়েছিল। তেমনি একটি মর্মান্তিক ঘটনা ছাপা হয়েছে নিউজউইক’-এর আলােচ্য সংখ্যায় নিবন্ধের শুরুতে।

গােবিন্দচন্দ্র মন্ডল ঐ হতভাগ্যদের একজন যে শরণার্থীদের প্রতি ইয়াহিয়ার ক্ষমাঘােষণার কথা শুনে তক্ষুনি পায়ে হেঁটে তার গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। সঙ্গে দুই কিশােরী কন্যা। দীর্ঘপথের যাত্রায় পরিশ্রান্তি গােবিন্দ মন্ডল জলাভূমি, আগুনেপােড়া গ্রাম পার হয়ে তার বাড়ির কাছে পৌঁছতেই পাকসেনারা তাকে বাধা দেয়। এরপর অসহায় হতাশা নিয়ে তাকে দেখতে হয়, পাকসেনারা তার কিশােরী কন্যাদের ধর্ষণ করছে, ধর্ষণ করছে, ধর্ষণ করেই চলেছে।’ | নিউজ উইকের ঐ বিশেষ সংবাদদাতার ভাষায় (“Govinda Chandra mandl forgets who told him first, but when heard that an amnesty had been pledged to all refugees, he immediately set off on the long walk home. With his two teen-age daughters by his side, Chandramandle trudged through monsoondrenched swamplands and past burned-out villages. When he neared his scrap of land, soldiers stopped him. As he watched in helpless anguish, his daughters were raped again and again and again”) | এ মর্মান্তিক ঘটনার অবশেষ পরিণাম অবশ্য বলার অপেক্ষা রাখে না। নয় মাস ধরে পূর্ব-পাকিস্তানে এই ছিল ইয়াহিয়ার শাসন, অঙ্গীকার এবং তার সেনাবাহিনীর – দৈনন্দিন কাজের নমুনা।।  

সূত্র : একাত্তরে পাকবর্বরতার সংবাদভাষ্য – আহমদ রফিক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!