You dont have javascript enabled! Please enable it!

ঢাকার বাইরে গৃহযুদ্ধ  যেমনটা দেখেছেন বিদেশী সাংবাদিক

পঁচিশে মার্চ (১৯৭১) মধ্যরাতে ঢাকায় ছাত্র-জনতার ওপর পাক-সেনাবাহিনীর হঠাৎ আক্রমণ এবং তার প্রতিক্রিয়ায় দেশের বিভিন্ন স্থানে যে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরােধ বা পাল্টা আক্রমণ দেখা দেয় পশ্চিমা পত্রপত্রিকার দৃষ্টিতে তা হয়ে ওঠে গৃহযুদ্ধ (‘সিভিলওয়ার’)। নির্মোহ বিচারে অস্বীকার করা যাবে না যে এ যুদ্ধ ছিল পুরােপুরি আরােপিত, অর্থাৎ বাঙালি জনগােষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ। চাপিয়ে দেওয়া পাক-সামরিক শাসনের পক্ষ থেকে। বাঙালি রাজনীতিকদের যদি সশস্ত্র গৃহযুদ্ধের পরিকল্পনাই থাকবে তাহলে তার জন্য প্রয়ােজনীয় সামরিক পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি থাকার কথা। কিন্তু ছােটখাটো গ্রুপের কথা বাদ দিলে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের যে তেমন পরিকল্পনা বা প্রস্তুতি কোনােটাই ছিল না এ কথা সবারই জানা। সমঝোতার জন্য তারা ২৫ মার্চ শেষ বেলা পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সংলাপের যােগসূত্র বজায় রাখে। আর দিনশেষে অপ্রস্তুত হয় জেনে যে পাক-সেনাবাহিনী আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করার জন্য বিমানবন্দরে হাজির। এ খবর একাধিক সূত্রে জননেতার কাছে পৌছায়। তখন আর করার মতাে কিছু নেই, জরুরি দলীয় বৈঠকে বসারও সময় নেই।  এ আক্রমণের জন্য ঢাকা প্রস্তুত ছিল না। তাই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল অস্বাভাবিক রকম বেশি। তড়িঘড়ি করে ছাত্র-অছাত্র কর্মীরা সেদিন সন্ধ্যার পর শুধু রাস্তায় অবরােধই তৈরি করতে পেরেছিল। তবে ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীসহ ছাত্রজনতার ওপর সংঘটিত আক্রমণের খবর বাইরে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাক-বাহিনীর বাঙালি সদস্য, ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর সদস্য সবাই দেশের বিভিন্ন স্থানে যে যার মতাে প্রতিরােধ গড়ে তােলে, প্রয়ােজনে আক্রমণের প্রস্তুতিও নেয়। তাদের সঙ্গে যােগ দেয় স্থানীয় ছাত্র, রাজনৈতিক কর্মী, কৃষক বা শ্রমজীবী মানুষ।  প্রতিরােধ বা পালটা আক্রমণের জন্য সংগঠিত হওয়ার পেছনে আরেকটি কারণ ছিল স্বাধীনতার ঘােষণা। বলাবাহুল্য যে এ ঘােষণা সর্বসাধারণের কাছে পৌছাতে সময় লেগেছে।

কিন্তু সময় লাগে নি ২৬ মার্চ বেতারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ভাষণ জনগণের কাছে যেতে। সেখানেও পরােক্ষে ছিল স্বাধীনতার উল্লেখ  ছিল পাকিস্তান-দ্রোহিতার  কারণে কঠোর শাস্তিদানের হুমকি। সব কিছু মিলে এবং বিশেষভাবে ঢাকায় পাকবাহিনীর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন শ্রেণীর বাঙালি জনসাধারণ আত্মরক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়েছে। চেষ্টা করেছে প্রতিরােধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে । আশ্চর্য যে চট্টগ্রাম, কুষ্টিয়া, পাবনা, যশোর, সিলেট, দিনাজপুর, এমন কি ঝিনাইদহের মতাে একাধিক মহকুমা শহরেও অতিদ্রুত প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, যদিও তা ছিল পাক-সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এক অসম যুদ্ধের প্রস্তুতি। যদিও পশ্চিমা পত্রপত্রিকায় ঘটনাটিকে ‘গৃহযুদ্ধ’ নামেই অভিহিত করা হয়েছে তবু তাদের লেখা থেকে এ কথা স্পষ্ট যে পাক-সেনাবাহিনীর লক্ষ্য ছিল নিরস্ত্র জনসাধারণ।’ GOS T3… “the army began its military assaults on an almost unarmed population” (দ্য গার্ডিয়ান, ২৬ মার্চ, ১৯৭১)। ‘দ্য টাইমস পত্রিকায় বরং কথাটা যথাযথ ভাবে পরিবেশিত এই বলে যে অবস্থা যদিও অস্পষ্ট ও বিশৃঙ্খলাপূর্ণ তবু গৃহযুদ্ধের মতাে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে বলেই মনে হয় “Though the situation is confused, it does seem possible that something like civil war might result’. (24.0.4) | ‘দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার সম্পাদকীয়তে (২৭ মার্চ) অবশ্য স্পষ্টই বলা হয় যে সম্ভাব্য জঘন্যতম পরিস্থিতিতে শেষপর্যন্ত পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধই শুরু হয়ে গেছে (“Pakistan’s civil war has finally erupted, and in the worst possible circumstances”)। উপরে উল্লিখিত পরিস্থিতিতে প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ দেখা দেয়। দেখা দেয় সুশৃঙ্খল পাক-সেনাবাহিনী এবং অসংগঠিত বাঙালিদের মধ্যে। পূর্বপ্রস্তুতি থাকার কারণে এদের সংগঠিত হতে সময় লেগেছে। এ জন্যই ‘দ্য অবজার্ভার’-এ বলা হয় যে “ঈস্ট পাকিস্তান রাইফেল্স’ এবং বাঙালি পুলিশ সদস্যগণ শেখের আহ্বানে বিদ্রোহে যােগ দিয়েছে বলে জানা গেছে’ (২৮ মার্চ, ১৯৭১)। ‘যুদ্ধটা যে সত্যই পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের আরােপিত ছিল তা শুধু ঢাকায় ছাত্র-জনতার ওপর হঠাৎ আক্রমণেই নয়, ঢাকার বাইরে বিভিন্ন স্থানে মুখােমুখি সংঘাতের চরিত্র বিচার করে দেখলেও বােঝা যায়। বােঝা যায় পশ্চিমা ভাষ্যকারদের বক্তব্যে, এমন কি পরবর্তীকালে কোনাে কোনাে লেখকের ঘটনা বিশ্লেষণে ও মূল্যায়নে। ছাব্বিশে মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণের পর প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘাত সম্পর্কে রবার্ট জ্যাকসন বলেন যে পাক-সেনাবাহিনীর আক্রমণের পর ‘ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ও পরস্পর থেকে বিচ্ছিা’ সামরিক ও আধাসামরিক বাঙালি ইউনিটগুলাে বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন পরিস্থিতির মােকাবেলা করেছে। 

যেখানে তারা আক্রান্ত হয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে প্রাতরােধের চেষ্টা করেছে, আবার এখানে সেখানে সংঘাত এড়িয়ে হয়তাে ঢাকার পথে এগিয়ে গেছে। এদের অনেকে আবার পাক-বাহিনীর সঙ্গে প্রথাসিদ্ধ পদ্ধতিতে লড়াই করতে গিয়ে চড়া মাশুল দিয়ে শেষপর্যন্ত পেছন ফিরে সীমান্তের দিকে চলে গেছে।’ এভাবেই একটি অসংবদ্ধ, অসমযুদ্ধের মুখোমুখি হয়ে বাঙালিযােদ্ধা প্রাণ দিয়েছে, দিয়েছে বহুসংখ্যক ছাত্রযুবা, প্রশিক্ষণহীন কর্মী বা উদ্বুদ্ধ কৃষক শ্রমজীবী মানুষ। প্রস্তুতিহীন যুদ্ধের পরিণাম যেমনটা হয় এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।  রবার্ট জ্যাকসনের নিজের ভাষায় “Scattered, separated from one another, the surviving Bengali military and para-military units responded in many different ways to the various situations in which they found themselves. Those attacked tried to resist; and here and these units which had got away set themselves to march on Dacca. A number of them faught costly textbook engagements before they began to withdraw towards the borders.” | তাই শুরুতে কথিত যুদ্ধটা ছিল একতরফা। তবে চট্টগ্রাম, কুষ্টিয়া, পাবনা, দিনাজপুর বা অনুরূপ যেখানে ঐসব যােদ্ধাসদস্য সংখ্যায় বেশি বা সংগঠিত ছিল তারা খানিকটা প্রতিরােধ সৃষ্টি করতে পেরেছে কিংবা পালটা আক্রমণে পাক-বাহিনীর বেশ কিছু ক্ষয়ক্ষতি ঘটাতে পেরেছে। কিন্তু সবাইকেই শেষ পর্যন্ত ঘাঁটি ছেড়ে আত্মরক্ষার জন্য পালাতে হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে এরা কোনাে প্রকার ভারতীয় সামরিক সাহায্য পায় নি। যে কথা রবার্ট জ্যাকসনও বলেছেন : “There is no evidence that Indians played anypart in this stout resistance | এর মধ্যেই সীমান্ত বরাবর কোনাে কোনাে স্থানে বেশ শক্তসমর্থ প্রতিরােধ গড়ে উঠেছিল। যেমন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিপরীত দিকে মেজর শফিউল্লাহ ও মেজর খালেদ মােশাররফ তাদের প্রতিরােধ ঘাটি তৈরি করে অবস্থান নেন, অন্যদিকে নােয়াখালীর বেলােনিয়া সীমান্তে মেজর জিয়াউর রহমান। উত্তরবঙ্গে ভুরুঙ্গামারি, পঞ্চগড়, এমন কি দিনাজপুর অঞ্চল বেশ কিছুদিন বাঙালি যােদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। তবে এপ্রিল মাসের মধ্যে সব অঞ্চলই পাক-সেনাদের দখলে চলে যায়। ভারী ও ব্যাপক আক্রমণের মুখে বাঙালি যােদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। বিভিন্ন এলাকার মধ্যে চট্টগ্রামেই প্রথম সংঘর্ষের সূচনা। এবং তা শুরু হয় পঁচিশে মার্চের আগে করাচি থেকে আসা জাহাজের সামরিক সাজসরঞ্জাম খালাস করা উপলক্ষে। তখনাে অসহযােগ আন্দোলন চলছে, তখনাে বাঙালি সেনাসদস্যরা পাক-বাহিনী ছেড়ে আসে নি।

সাধারণ শ্রমিক, রাজনৈতিক কর্মী বা বন্দর শ্রমিক কেউ জাহাজ থেকে মাল খালাস করতে বা দিতে রাজি নয়। তাদের আশঙ্কা ছিল, এগুলাে তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করা হবে। বাতাসে তখন গুজব, পাক-বাহিনী প্রস্তুতি নিচ্ছে অসহযােগী বাঙালিদের ওপর আক্রমণের। রাজনৈতিক নেতাদের আশ্বাস এবং সংলাপের সম্ভাবনা খুব একটা বিশ্বাসযােগ্য হয়ে উঠছে না। | এর মধ্যে গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট রাজনৈতিক উগ্রতায় শুরু হয় অবাঞ্ছিত জাতিগত দাঙ্গা, বিহারিদের ওপর আক্রমণ। চট্টগ্রামের রাজনৈতিক অবস্থা ছিল অনেকটা ঢাকার মতােই থমথমে আর অস্বাভাবিক, তদুপরি পাক-সেনাদের সঙ্গে জাহাজ খালাস নিয়ে মুখােমুখি অবস্থান। আর ঐ উপলক্ষে বন্দরে আসা-যাওয়ার পথে ২৪ মার্চ সন্ধ্যায় ব্যাপক অবরােধ, শহর জুড়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ হবার মতাে অবস্থা। পরদিন ২৫ মার্চ তারিখেও একই অবস্থা, ঢাকার সংযােগ রাস্তা কেটে যান চলাচলের অনুপযোগী করে ফেলা হয় (দ্য গার্ডিয়ান, ২৯ মার্চ, ১৯৭১)।  ঢাকা পাক-সেনাদের মতলব টের না পেলেও চট্টগ্রাম সম্ভবত তার আভাস পায় বলেই ঠিক পূর্বাহ্নে স্থল যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য রাস্তা কেটে ফেনীর কাছাকাছি   গুরুত্বপূর্ণ শােভাপুর সংযােগসেতু উড়িয়ে দেয়। যে কারণে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে ২৫ মার্চ রাতে চট্টগ্রামমুখী সেনাবাহিনীর যাত্রা বাধার সম্মুখীন হয়। ইতােমধ্যে বাঙালি যােদ্ধারা কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র দখল করে নিয়ে স্বাধীনতার ঘােষণা সম্প্রচারের ব্যবস্থা করে, ঘিরে রাখে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের বৃহৎ অংশ।  কিন্তু আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ও সুশিক্ষিত পাক-সেনাবাহিনীর সঙ্গে হালকা অস্ত্রশস্ত্র ও মরচেপড়া সরঞ্জাম নিয়ে যুদ্ধ চলে না। চলে না অনভিজ্ঞতার ভার নিয়ে। চট্টগ্রামমুখী পাক-বাহিনী তাই সেতু এড়িয়ে, মাঠ পথে, আকাশী প্রহরায় ঠিকই অকুস্থলে। পেীছে যায়। তাদের সাহায্যে উড়ে আসে কমান্ডাে বাহিনী। কুমিল্লা থেকে আসা ভারী মর্টার আর অস্ত্রশস্ত্রের সাহায্যে পাক-বাহিনীর পক্ষে প্রাথমিক সাফল্য অর্জিত হয় ২৯ মার্চের মধ্যে।

তাদের পরবর্তী সাফল্যে প্রধান সহায় হয়ে ওঠে নৌবাহিনীর ভারী দূরপাল্লার কামান, ডেস্ট্রয়ার ও গানবােট, আর জাহাজ থেকে খালাস করা ৯ হাজার টন সামরিক সরঞ্জাম। স্থানীয় পাকিস্তানি সেনা এবং ট্যাংকও তাদের সহায়তায় আসে। অন্যদিকে কমান্ডাে। বাহিনীর একাধিক চেষ্টা এবং জেট বিমানের তৎপরতায় বেতার কেন্দ্রটি পাকিস্তানি বাহিনীর দখলে আসে। দখলে আসে বাঙালি ইপিআর সদর দফতর প্রধানত পদাতিক বাহিনী, ট্যাংক, নৌবাহিনী এবং ভারী মর্টারের ধ্বংসাত্মক সহায়তায়। দু’দিনের অসম যুদ্ধে বিস্তর ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে দিয়ে ইপিআর যােদ্ধাদের ৩১ মার্চ তাদের অবস্থান ছেড়ে পিছু হটতে হয়। | এর পর পুলিশ লাইনের রাইফেল-প্রতিরােধ আর কতক্ষণ টিকতে পারে, বিশেষ করে ভারী কামান ও ট্যাংকের দুর্ধর্ষ আঘাতের মুখে। তারাও অবস্থান ছেড়ে কাপ্তাই সড়ক ধরে পিছু হটতে থাকে। এ পরিস্থিতিতে শহরের অবশিষ্ট প্রতিরােধ সহজেই ভেঙে পড়ে। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ শেষ হওয়ার মুখে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে পাকসেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। মনে রাখা দরকার যে এ সময়ে পূর্ব-পাকিস্তানে পাক-সেনাবাহিনীর সদস্য সংখ্যা ৭০ হাজার, ভিন্নমতে ৮০ হাজার। এত বড় সুসংগঠিত ও আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত বাহিনীর সঙ্গে অনভিজ্ঞ, অস্ত্রশস্ত্রহীন বাঙালি যােদ্ধাদের মােকাবেলা নেহাৎ অস্তিত্ব রক্ষার উদ্দীপনাতেই সম্ভব, সাফল্য অর্জন খুবই কঠিন। | বলার অপেক্ষা রাখে না যে ২৫ মার্চ মধ্যরাতের আক্রমণের মধ্য দিয়ে পাক সেনাবাহিনী দখলদার বাহিনীর ভূমিকাই গ্রহণ করে। নিজবাসভূমে কথিত স্বদেশী সেনাবাহিনীর সঙ্গে চলে মুষ্টিমেয় বাঙালি সেনা ও যুদ্ধে অনভিজ্ঞ ছাত্রজনতার লড়াই। বিদেশীদের চোখে এ লড়াই হয়ে ওঠে গৃহযুদ্ধ। প্রতিপক্ষ পাক-বাহিনী তখন আর স্বদেশী সেনাবাহিনী নয়, ওরা শত্রুবাহিনী; যেমন ওদের চোখে বাঙালি মাত্রেই হয়ে ওঠে শত্রু। এ দিক থেকে পাক-বাহিনীর মগজ ধােলাইয়ের কাজ এমন নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করা হয় যে বাঙালিদের মােকাবেলায় তারা অবিশ্বাস্য রকম ঘৃণী, বিদ্বেষ আর নিষ্ঠুরতার প্রকাশ ঘটায়; যে নিষ্ঠুরতা সম্প্রদায় বিশেষের প্রতি বর্বরতা রূপে প্রকাশ পায়। 

বন্দরনগরী চট্টগ্রাম স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘােষণা দিয়ে বাংলাদেশে সূচিত গৃহযুদ্ধে প্রথম সারিতে নাম লেখালেও পূর্ববাংলার একাধিক শহর পঁচিশে মার্চের পরপরই প্রতিরোধ লড়াইয়ের ইতিহাসে বীরত্বপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ছােট্ট শহর কুষ্টিয়া এদের মধ্যে অন্যতম। মার্কিনি সাপ্তাহিক “টাইম ম্যাগাজিনের কল্যাণে (১৯ এপ্রিল, ১৯৭১) কুষ্টিয়ার লড়াই (‘দ্য ব্যাটু অব কুষ্টিয়া”)র বিবরণ বিশ্ববাসীর কাছে পৌছে যায়। ‘টাইম’ পত্রিকায় প্রকাশিত ঐ প্রতিবেদনের লেখক সংবাদদাতা ড্যান কগিন্স। ড্যান ভারত থেকে গােপনে সীমান্ত অতিক্রম করে কুষ্টিয়া শহরে আসেন এবং শহরে বাঙালি বাসিন্দা এবং বন্দি পশ্চিমপাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে কথা বলে কুষ্টিয়ায় সংঘটিত লড়াইয়ের শব্দচিত্র তৈরি করেন ‘টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশের জন্য। সে বিবরণ নিম্নরূপ : | “গত সপ্তাহে পূর্ব-পাকিস্তানে যে প্রচণ্ড লড়াই শুরু হয়েছে তাতে পাকিস্তান ‘দখলদার। বাহিনী’র ৮০ হাজার সৈন্যের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ তৈরি করেছে শহুরে ও কৃষক শ্রেণীর বাঙালি জনতা। খবরে প্রকাশ, ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পশ্চিম-পাকিস্তানি সৈন্যরা দুই লাখ খানেক বেসামরিক মানুষকে খুন করেছে। তবে ক্ষুব্ধ কৃষক-জনতার হাতে সৈন্যদের ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে বিস্তর।” (“Fierce fighting raged last week in East-Pakistan as Bengali townspeople and peasants resisted the occupation army’ of 80,000 West-Pakistani soldiers. Reports have indicated that as many as 200,000 civilians have been killed. But soldiers have also suffered severe casualties at the hands of irate peasants.) | ‘ছােট্ট শান্ত শহর কুষ্টিয়া। পঁচিশে মার্চ রাতে কোনাে সতর্কতা সংকেত ছাড়াই ১৩টি জিপ ও ট্রাক কুষ্টিয়ার পুলিশ স্টেশনের সামনে এসে দাঁড়ায়। ঐ রাতেই সাড়ে দশটায় যুদ্ধ শুরু। যশাের সেনানিবাসের মূল ঘাঁটি থেকে ২৭ বালুচ রেজিমেন্টের ডেল্টা কোম্পানি এখানে এসে হাজির।

এ কোম্পানির ১৪৭ জন সৈন্য অতি দ্রুত কোনাে প্রকার প্রতিরােধের সুযােগ না দিয়ে ৫০০ জন বাঙালি পুলিশকে নিরস্ত্র করে ফেলে। এরপর তারা আরাে চারটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র দখল করে নেয়।’  ‘পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টা কুষ্টিয়া ছিল শান্ত। তখন কাফু চলছে। এর মধ্যে না সাতেক লােক এদের প্রায় সবাই কৃষক, অবস্থা আঁচ করতে না পেরে শহরে এসে পড়েছিল। পাক-সৈন্যরা এদের সবাইকে রাস্তায় বের হওয়ার অপরাধে গুলি করে মারে। কার্ফ তুলে নেওয়া হয় ২৮ মার্চ সকালে, এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে শহরের লােকজন মিলে প্রতিরােধ গড়ে তুলতে শুরু করে। (“Kushtia, a quiet town… fell to a restless sleep on the night of March 25. Without warning, 13 Jeeps and trucks came to a halt outside Kushtia’s police station. It was 10:30 on the night the war broke out, Delta company of the 27th Baluch Regiment had arrived from its base at Jessore cantonment. The 147 men of the company quickly disarmed some 500 Bengali policemen without meeting any resistance and occupied four additional key points.) (“Kushtia remained calm for 48 hours while the curfew was in effect, although seven persons-mostly peasants who arrived in town unaware of   what happened were shot to death for being found in the streets. The curfew was lifted on the morining of March 28, and the townspeople began to organise a resistance immedately.”) | ‘সে রাতেই ৫৩ জন পূর্ব-পাকিস্তানি পুলিশ ঐ স্টেশনে অবস্থিত মুষ্টিমেয় পাকিস্তানি। সৈন্যদের বন্দি করে ফেলে। এর পর তারা নিকটবর্তী গ্রামগুলােতে ছড়িয়ে পড়ে এবং তাদের সব ০.৩০৩ (থ্রি নট থ্রি) এনফিল্ড রাইফেল ও বহনযােগ্য অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করছে এমন শ’খানেক কলেজ ছাত্রের সঙ্গে মিলিত হয়। ছাত্ররা স্থানীয় কৃষকদের গেরিলাযুদ্ধের প্রাথমিক কায়দা-কানুন শেখাতে থাকে।… দু’দিনের মধ্যে ঐসব পুলিশ ও ছাত্র কয়েক হাজার স্বেচ্ছাসেবক ও ইপিআর সেনা সদস্যদের সংগঠিত করে এবং কুষ্টিয়ায় পাক-সেনাদের পাঁচ পাঁচটি অবস্থানের ওপর একযােগ আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে।

(“That night 53 East-Pakistani policemen easily over-powered a handfull of soldiers at the police station. Then tarining out to nearby villages with all the 303 Enfield rifles and ammunition they could carry, the policemen joined forces with 100 college students who were already working for Bangladesh. The students were teaching the rudiments of guerilla warfare to local peasants. …Within two days, the police and students had organised several thousand volunteers and militiamen of the East-Pakistan Rifles and laid plans for simultaneous attacks on the five army positions in Kushtia”)

এ বিবরণ থেকেও বােঝা যায় যে প্রথম আক্রমণ শুরু হয় অপ্রত, অসংগঠিত বাঙালি ছাত্রজনতা এবং পুলিশ ও ইপিআর সদস্যদের ওপর। আক্রান্ত হয়ে তারা আত্মরক্ষার জন্য প্রতিরােধ লড়াই সংগঠিত করে যা বিদেশীদের চোখে গৃহযুদ্ধ শপে প্রতিভাত হয়ে ওঠে। আর এ গৃহযুদ্ধই ক্রমে স্বাধীনতা যুদ্ধের চরিত্র অর্জন করে। করে অবস্থার চাপে, পাক-বাহিনীর জিঘাংসা এবং পাক-শাসকদের অর্বাচীন নীতির কারণে। কুষ্টিয়ায় ছাত্র কৃষক পুলিশ ও সেনাদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে সংগঠিত হওয়ার প্রতিরূপ অধিকাংশ শহর বা প্রতিরােধ কেন্দ্রগুলােতে দেখা যায়। কুষ্টিয়ায় এভাবে সংগঠিত হয়ে প্রায় ৫০০০ কৃষক ও পুলিশ ৩১ মার্চ ভাের সাড়ে চারটায় কুষ্টিয়া মুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। হাজার হাজার শহরবাসী ‘জয়বাংলা’ ধ্বনিসহ রাস্তায় জমায়েত হয়। পাক-সৈন্যরা হাজার হাজার বাঙালি জনতার দ্বারা ঘেরাও হবার অপতি ভাবনায় আতংকিত হয়ে পড়ে। বন্দি হবার পর নায়েক সুবেদার মােহাম্মদ আইয়ুব হতাশ কণ্ঠে জানায় ; আমরা খুব বিস্মিত হয়ে পড়ি। আমাদের ধারণা ছিল বাঙালিদের বাহিনী আমাদের মতই এক কোম্পানির সমান। আমাদের জানা ছিল না যে তারা প্রত্যেকেই আমাদের বিরুদ্ধে। (“At 4:30 a.m. on March 31, a force of some 5,000 peasants and policemen launched a campaign to liberate Kushtia. Thousands of townspeople thronged the streets shouting ‘Joi Bangla’ (victory to Bengal!). The soldiers apparently panicked at the thought of being engulfed by so many thousands of furious Bengalis. ‘We were very surprised’, 

Bengali forces were about the size of one company like ourselves. We did not know everybody was against us”.)  ‘দুপুর নগাদ প্রধান জেলা দফতরগুলোর পতন ঘটে। পাকসেনাদের বেপরােয়া চেষ্টার মুখে তাদের অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়। কেউ কেউ পালিয়ে যায়, কিন্তু পরে স্থানীয় জনতার হাতে ধরা পড়ে মৃত্যুবরণ করে। পাক-সেনাদের ১৪৭ জনের মধ্যে মাত্র ১৩ জন বেঁচে থাকে। এ লড়াইয়ে ৫০ জন বাঙালিও পাকদের গুলিতে প্রাণ হারায়। কুষ্টিয়ার পাঞ্জাবি জেলা প্রশাসকও প্রাণ হারায়।’ ‘পরদিন যশাের থেকে এক কোম্পানি পদাতিক সেনা কুষ্টিয়ায় পাল্টা আঘাত হানার জন্য পাঠানাে হয়। মাঝপথে বিষখালি গ্রামের কাছে এই নতুন সেনা কোম্পানি বাঙালি বাহিনীর পাতা ফাঁদে আটকে পড়ে। সেনা কনভয়ের দুটো জিপ বাঙালি সেনাদের কাটা খাদে পড়ে যায় এবং ৭৩ জন সৈন্য ঘটনাস্থলে মারা যায়, কয়েক ডজন পালিয়ে গিয়েও আত্মরক্ষা করতে পারে নি। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের লাল সবুজ ও সােনালি। রঙের পতাকা কুষ্টিয়ায় বাড়ির ছাদে, ট্রাকে, এমন কি রিকশাতেও উড়তে দেখা যায়। (Time, April 19, 1971)। পরে অবশ্য ১৬ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনীর প্রবল চাপে কুষ্টিয়ার পতন ঘটে। পাবনায়ও সংঘর্যের ধরন ছিল অনেকটা কুষ্টিয়ার মতােই। এখানে রাজশাহী থেকে পাঠানাে পাঞ্জাবি সেনাদের সঙ্গে ইপিআর, পুলিশ ও স্থানীয় কর্মীদের সম্মিলিত বাহিনীর লড়াই শুরু হয় ২৭ মার্চ সন্ধ্যায়। স্থানীয় বাহিনী তাদের ঘিরে ফেলে এবং দুই পক্ষে গােলাগুলি বিনিময় হতে থাকে। পাক-বাহিনী সংখ্যায় অপেক্ষাকৃত অল্প হওয়ার কারণে বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। রাজশাহী থেকে ছােটখাটো সাহায্য আসা সত্ত্বেও শেষ রক্ষা হয়  পাকবাহিনীর বিপুল ক্ষয়ক্ষতির মুখে পাবনা ১০ এপ্রিলের পূর্ব পর্যন্ত বাঙালি যােদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। | ‘টাইমস’ পত্রিকায় ৪ এপ্রিল পিটার হ্যাজেলহা যশাের থেকে যে বিবরণ পাঠান।

তাতে রয়েছে যশােরের নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক একটি অসমযুদ্ধের ছবি, যা গােটা পূর্ব-পাকিস্তানের জন্যই ছিল সত্য। আসলে আত্মরক্ষার দায়ে, অস্তিত্ব রক্ষার দায়ে এ লড়াইয়ের বাধ্যবাধকতা— কথাটা একাধিক বার উচ্চারিত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন প্রসঙ্গে। যশাের সম্পর্কে পিটারের বক্তব্য “এমন একটি যুদ্ধের কথা ভাবা যায় না। আমার বাম পাশে ব্যারাকে আবদ্ধ এক ডিভিশন সৈন্য, এদের ঘিরে রয়েছে ২০০০ সাদামাঠা চেহারার মুক্তিযােদ্ধা এবং ইপিআর-এর ৫০০ জন সদস্য। (“Jessore city, April 4. This is a war that no one can imagine. On my left, is an Army division, holed up in their barracks and surrounded by 2000 nondescript freedom fighters and about 500 members of the East-Pakistan Rifles.”) এর পর পিটার দুই পক্ষেরই ভয়, শংকা, আশা, সম্ভাবনার কথা লিখেছেন। পশ্চিম-পাকিস্তানি বাহিনী আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত, কাজেই যুদ্ধের সুযােগ তাদের যথেষ্ট। কিন্তু তারা এ বিষয়ে সচেতন যে প্রকৃতপক্ষে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি তাদের ঘিরে রেখেছে। অন্যদিকে স্থানীয় বাহিনীর মনে বরাবরের ভয় কখন সমররসদ ফুরিয়ে যায়— তখন সামনে পরাজয় ও মৃত্যু।  

তাৎক্ষণিকভাবে পাকবাহিনীকে যশাের সেনাবিনাসে অবরুদ্ধ করে রাখা হয় ঠিকই। যে কারণেই হােক ঐ মুহূর্তে তারা বেরিয়ে আসছে না বা আসতে চাইছে না। সঠিক মুহূর্তটির জন্য হয়তাে অপেক্ষা করছে। অথবা খাদ্য সঞ্চয়ে ঘাটতি পড়লে ঝুকি নিয়ে হলেও তারা সর্বশক্তি ব্যবহার করে বের হয়ে আসবে। বাস্তবিকই তারা চুপচাপ বসে থাকে নি। তাদের বহুমুখী আক্রমণে স্থানীয় বাহিনীকে একসময় পিছু হটতে হয়েছে। পিটার হ্যাজেলহাস্ট যেমন ৪ এপ্রিল যশাের এবং ৫ এপ্রিল উত্তরাঞ্চলের হিলি থেকে স্থানীয় প্রতিরােধের চিত্র তুলে ধরেছেন তেমনি দিনাজপুরের পরিস্থিতি সম্পর্কে ঐ ‘টাইমস’ পত্রিকাতেই প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন নিকোলাস টোমালিন। হাল্কা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত মাত্র ৩৫০ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হয় দিনাজপুরের প্রতিরক্ষা বাহিনী। এদের অধিকাংশই যুদ্ধে অনভিজ্ঞ, সমরসরঞ্জামও তাদের অপ্রতুল এবং তা প্রধানত দিনাজপুরের ইপিআর অস্ত্রগুদাম থেকে সংগৃহীত। একেবারেই সাদামাঠা সরঞ্জাম। বাহিনীর প্রাণপুরুষ সার্জেন্ট-মেজর আবদুর রবের অজানা নয় যে যে-কোনাে মুহূর্তে তার ছােট্ট বাহিনী নিকটবর্তী সৈয়দপুর এবং রংপুর থেকে আসা পাক-বাহিনীর আক্রমণে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। অবশ্য তখনও পর্যন্ত তাদের অবস্থান ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। দুই পক্ষে সংঘর্ষ হয়েছে, গােলাগুলি বিনিময়ও চলেছে। অবস্থা স্তব্ধ শান্ত। | ‘ছােট্ট বাহিনীটি সনাতন গেরিলা কায়দায় বিন্যস্ত করা হয়েছে যাতে আঘাত করেও পিছিয়ে যাওয়া চলে।’ দৃঢ়চেতা সার্জেন্ট-মেজর রবকে চে গুয়েভারার অসম্ভব এক প্রতিচ্ছবি বলেই মনে হয়েছে প্রতিবেদকের। তার মতাে সংগ্রামী পূর্ব-পাকিস্তানে যথেষ্ট সংখ্যায় থাকলে গৃহযুদ্ধ দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকবে বলে টোমালিনের ধারণা। তা সত্ত্বেও এ কথা সত্য যে দিনাজপুরের গায়ে যদিও এ পর্যন্ত অপেক্ষাকৃত বড় ধরনের আঁচড় লাগে নি, তবু বর্তমান অবস্থায় একে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও অন্যান্য প্রধান কেন্দ্রগুলাের পরিণামই বরণ করতে হবে। ইতিমধ্যে যশােরের পতন ঘটেছে। দিনাজপুর এখন আসন্ন আক্রমণের মুথে। লড়াইয়ের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে চূড়ান্ত প্রশ্ন হলাে : সার্জেন্টমেজর রবের গেরিলা কৌশল কি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত করা সম্ভব হবে? তাদের পক্ষে রয়েছে স্থানীয় জনতার একাট্টা সমর্থন এবং ইয়াহিয়া খানের ওপর বিশ্বজনমতের চাপ। তাদের বিপক্ষে রয়েছে বাঙালিদের অসামরিক চরিত্র এবং সমরসরঞ্জাম ও সাধারণ সরবরাহের চরম স্বল্পতা।’

(“Only 350 lightly-armed soldiers were dug in around the town, the centre of Bangladesh resistance… Most were untried in battle and their supplies of ammunition from the East-Pakistan Rifles armoury in Dinajpur were down to half-a-dozen crates of mortar shells, rockets and machine gun bullets.) (“Several hundred troops of West-Pakistan Frontier force regiment were at Saidpur nearby and there were hundreds more at the garrison town of Rangpur. They were heavily armed… Sgt- Major Rab and his forces have no illusions about what will happen when the enemy do attack.) (“…It was a classic guerilla war deployment… This is Sgt-Major Rab’s basic strategy…Jessore has fallen; Dinajpur is now under assault. The crucial question about the future at struggle is whether Sgt.-Major Rab’s guerilla tactics can be properly put into practice. In their favour is the overwhelming support of the local population and the pressure of world opinion on Yahya Khan. Against them is the un-military character of the Bengalis and their shortage of ammunition and general supplies.) (“Dinajpur had escaped relatively unscratched so far. But now it must suffer the fate of Dacca, Chittagong and other major centres… But if there are many like him (Sgt.- Major Rab) in East-Pakistan the civil war is going to continue for a long time”. The Times, 11 April, 1971.”) | এখানে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে পারে বিশেষত একাধিক ভাষ্যকারের এ জাতীয় মন্তব্যের কারণে যে সত্যই কি বাঙালি অসামরিক জাতি, সমস্পৃহা যাদের রক্তে ৰা। ঐতিহ্যে নেই? পরবর্তী কয়েক মাসে সংঘটিত সামরিক কার্যকলাপ এমন ধারণার পক্ষে দাড়ায় না।

দ্বিতীয়ত এ কথা সত্য যে গৃহযুদ্ধ থেকে স্বাধীনতাযুদ্ধের চাবিকাঠি হলাে দীর্ঘস্থায়ী গেরিলা কায়দার যুদ্ধ যা বাংলাদেশের জন্য ছিল অপরিহার্য। বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিত ও যুদ্ধের পরিণাম বিবেচনা করে একাধিক সাংবাদিক এ প্রশ্ন তুলেছেন এবং এ বিষয়ে আলােচনা করেছেন। অবশ্য সে আলােচনা এখানে অবান্তর। বাংলাদেশের সর্বত্র পঁচিশে মার্চের পর থেকে সূচিত বা আরােপিত গৃহযুদ্ধের অবস্থা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছিল অসংগঠিত, সমর-সরঞ্জামের স্বল্পতায় বিপর্যস্ত। এক কথায় অভিজ্ঞ জনশক্তির অভাব, যুদ্ধ উপকরণের অভাব; একমাত্র পুঁজি স্বাধীন। বাংলাদেশ অর্জনের উদ্দীপনা। এমন পরিস্থিতিতেই পূর্ব-পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ চলেছে এবং পরে তা সংগঠিত স্বাধীনতা যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়েছে। ঢাকা থেকে বিতাড়িত হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিমা সংবাদ-প্রতিনিধিদের কেউ কেউ ভারতীয় সীমান্ত অতিক্রম করে অনেক ঝুঁকি নিয়ে ও পূর্ববঙ্গের একাধিক অঞ্চলে যাতায়াত করেছেন। উদ্দেশ্য বাংলাদেশে সূচিত গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি মূল্যায়ন এবং তা বিশ্ববাসীকে জানানাে। যশাের থেকে কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা হয়ে উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুর, হিলি থেকে সিলেট পর্যন্ত পেীছে ছিল সাংবাদিকদের বিপদসঙ্কুল পদচারণা।  ‘এক্সপ্রেস’ পত্রিকার প্রতিনিধি ডােনাল্ড সিম্যান গৌহাটি হয়ে সিলেট শহরে। পৌছানাের পথে দেখতে পান শুধু ধোঁয়ার কুণ্ডলি আকাশে উঠছে, পাতায় ছাওয়া ছােট ছােট ঘর আগুনে পুড়ে ছাই। কীর্তিটা ইয়াহিয়ার পাঞ্জাবি সৈন্যদের। কিছুক্ষণ পর পর পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান নিচু হয়ে বােমা বর্ষণ করে চলেছে। বােমা বর্ষণের লক্ষ্য আপাতত সুর্মা নদীর ওপর সেতু যা বিভক্ত সিলেট শহরের দুই অংশের মধ্যে সংযােগ রক্ষা। করছে, এবং যা গেরিলাদের দখলে। দু’পক্ষেরই চেষ্টা বর্ষার আগেই শহরের নিয়ন্ত্রণ হাতে নেওয়া, আর সেজন্য চলছে লড়াই। ডােনাল্ডের চোখে পড়ে তিন ইঞ্চি আকারের মর্টার-গােলার সাহায্যে পাঞ্জাবিরা চেষ্টা করছে সংযােগ রাস্তা ধ্বংস করে ফেলতে যাতে বিদ্রোহীদের জন্য কোনাে প্রকার সাহায্য আসতে না পারে। এর মধ্যেই শুরু হয়ে গেছে মৌসুমি বৃষ্টির প্রবল বর্ষণ। ডােনাল্ডের জবানিতে : “রাস্তার ধারে দুই নম্বর’ নামে পরিচিত যােদ্ধাটির সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছি। তার হাতে স্টেনগান। কট্টর মাওপন্থী এই প্রাক্তন রাজনৈতিক বন্দিটি ছ’দিন।  

আগে সিলেট জেল থেকে পালিয়ে এসেছে। দুই দেহরক্ষীর মতাে তার পিঠে জেলখানায় এঁকে দেওয়া চাবুকের ফোস্কা চিহ্ন। এর সঙ্গে দেখা করার জন্যই কলকাতা থেকে আসামের পার্বত্য অঞ্চল হয়ে প্রায় হাজার মাইল আকাশ ও স্থলপথে পাড়ি দিতে দিতে আমার এখানে আসা। যেমন জঙ্গলাকীর্ণ এ অঞ্চল তেমনি এখানকার যুদ্ধও যশাের ও চুয়াডাঙ্গার সমতল ভূমিতে যেমন দেখেছি তার থেকে ভিন্ন।”  ডােনাল্ডের আপন ভাষায় “When I reached the area, columns of somke pillared into the sky as President Yahya’s Punjabi troops set fire to the palmthatched hut housing. At intervals Sabre jets swooped down to rocket and bomb the vital bridge over the Surma river that form the only link between the two halves of Sylhet town, currently in guerrila hands, As I neared Sylhet both sides were fighting for control of the town before the Monsoon.

…”I stood on the roadside with the man known as “Number Two’. He had a sten-gun. He was a fanatical Maoist and former political prisoner who had escaped from Sylhet jail only six days earlier. Like his two-man bodyguard, his back was covered in wheals from whippings in jail before they made their escape. To reach him I journeyed nearly 1000 miles by air and road from Calcutta through mountains of Assam…. This is a wild country, and a different war from the fight in open country I saw round Jessore and Chuadanga fronts.” | মৌসুমি বৃষ্টির ঢলে শিগগিরই রাস্তাঘাট সেতু গ্রাম প্লাবিত হয়ে গেলে ইয়াহিয়ার সিলেট বাহিনী যখন সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে তখন আমরা তাদের ওপর আঘাত হানব এবং তাদের শেষ করব।” এই ছিল গেরিলা যােদ্ধার বক্তব্য। ডােনাল্ডের বয়ানে “আমি ঐ যােদ্ধাদের সঙ্গে ঈস্টার পর্যন্ত ছিলাম । মাত্র কয়েকটি স্টেনগান, পুরনাে এনফিল্ড রাইফেল, শটগান, বাঁশ দিয়ে তৈরি বর্শা বা তীরধনুক তাদের যুদ্ধ উপকরণ। “তাদের হাতে অর্থ নেই, ওষুধপথ্য নেই; ইউনিফর্ম, ওয়াটারপ্রুফ কাপড়চোপড় কিছুই নেই।” অর্থাৎ অভাব আর অভাব। এর মধ্যেই অন্য একজন গেরিলা যােদ্ধার কথায় অস্ত্রশস্ত্র পেলে এই পাঞ্জাবিদের আমরা সরাসরি যুদ্ধে সিলেট থেকে তাড়িয়ে ya” (“They have no money, no medicine, no uniform, no waterproof clothing…. I shook hands with the army commander in Sylhet (on the Bangadesh side). He said: “Given the guns we could drive these Punjabis right out of Sylhet in one straight fight”. The Daily Express, 15 April, 1971).

ডােনাল্ডের বিবরণ থেকে বুঝতে কষ্ট হয় না বাংলাদেশের পক্ষে অর্থাৎ বাঙালিদের দিক থেকে গৃহযুদ্ধে অংশগ্রহণের অবস্থাটা কেমন ছিল। বহুকথিত এদিকটা স্পষ্ট যে পাকিস্তানি সামরিক শাসকগণ তাদের পূর্ব-পাকিস্তানকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। সহজ জয়ের আশায়। আর ঢাল-তলােয়ারহীন বাঙালি সেই গৃহযুদ্ধ থেকে একটু একটু করে সামলে উঠে স্বাধীনতাযুদ্ধের জন্য তৈরি হয়েছে। কথাটি আমরা আগেই বলেছি, ২৫ মার্চ ঢাকায় ছাত্র-জনতার ওপর বীভৎস। আক্রমণের মধ্য দিয়ে পাকবাহিনী যে গৃহযুদ্ধ তথা প্রতিরােধ যুদ্ধের সূচনা ঘটায় দেশের  বিভিন্ন অঞ্চলের লড়াই থেকে তা বােঝা যায়। ঢাকার প্রতিক্রিয়ায় তাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিরােধ যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ‘অবজার্ভার পত্রিকায় প্রকাশিত কলিন স্মিথের প্রতিবেদন। থেকে যশাের সীমান্ত দিয়ে ঢাকায় আসার পথে পােড়া বাড়িঘর দোকানপাট দেখতে দেখতে কলিন স্মিথ ও তার সঙ্গী ঝিনাইদহ মহকুমা শহরে এক প্রাক্তন সহকারী পুলিশ সুপারের দেখা পান যিনি সেখানে প্রতিরােধ সংগঠিত করেছেন। ঢাকায় পাকসেনাদের আক্রমণের খবর শােনার পর পরই তিনি পুলিশ অস্ত্রের গুদামখানা খুলে রাইফেল বিতরণের ব্যবস্থা করেন। | তার লােকদের হাতেও দেখা গেল ১২ বােরের শটগান, এ, কে, অ্যাসাল্ট রাইফেল ইত্যাদি অস্ত্র। আর থ্রি-নট-থ্রি তাে বটেই। ‘এল’-(L) আকৃতির ট্রেঞ্চ কেটে আকাশি আক্রমণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তার কথায় মাওবাদী উগ্র বাক্যবন্ধ এবং এ দেশে দুশাে বছরের সাম্রাজ্যবাদী শাসন-শােষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী তিক্ততা স্পষ্ট (দ্য। অবজার্ভার, ১৮ এপ্রিল, ১৯৭১)। এভাবেই আত্মরক্ষার স্বতঃস্ফূর্ত তাগিদে প্রতিরােধ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। তৈরি হয় গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি। সঙ্গত কারণে সিদ্ধান্তে আসা যায় যে গৃহযুদ্ধের সূচনা ও বিস্তার সবটাই ছিল আরােপিত অর্থাৎ পাক-সামরিক বাহিনীর সৃষ্টি। শুরুতে না হলেও অবস্থার অবনতি এবং চরিত্র বিচারে পরবর্তী সময়ে একাধিক পশ্চিমা ভাষ্যকার এমন মতামতই প্রকাশ করেছেন যে বাঙালিদের তরফ থেকে কোনাে বিদ্রোহের পরিকল্পনা ছিল না, সংগঠিত বিদ্রোহের কোনাে আভাসও দেখা যায় নি (যেমন ইকোনমিস্টের বিশেষ সংবাদদাতার মন্তব্য “…there was no planned uprising” ১২-৬-১৯৭১)। গােটা বিষয়টাই ছিল আকস্মিক আক্রমণের বিরুদ্ধে যতটা সম্ভব প্রতিরােধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ। এবং পক্ষ-প্রতিপক্ষ যেখানে চিহ্নিত সেখানে প্রতিরােধের পাশাপাশি পালটা আক্রমণও অস্তিত্ব রক্ষার স্বীকৃত পদ্ধতি। এভাবেই গৃহযুদ্ধ পরিণত হয় স্বাধীনতা যুদ্ধে। আর মেনে নিতে হয় যে বাঙালি যুদ্ধ-ভীরু জাতি নয় যেমনটা ভেবে ছিল পাক শাসকশ্রেণী।

সূত্র : একাত্তরে পাকবর্বরতার সংবাদভাষ্য – আহমদ রফিক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!