You dont have javascript enabled! Please enable it! জিরাে আওয়ার  সন্ধানী আলােয় পাক ‘অপারেশন - সংগ্রামের নোটবুক

জিরাে আওয়ার  সন্ধানী আলােয় পাক ‘অপারেশন

‘জিরাে আওয়ার’—কথাটার মধ্যেই কেমন যেন একটা গা ছমছম-করা অশুভ আতঙ্কের ভাব রয়েছে। আবার এর সঙ্গে ‘অপারেশন’ (শল্যবিদের নয়, সমরবিদের) শব্দটা যুক্ত হলে পরিস্থিতির ভয়াবহতা সহজে অনুমান করা চলে। সচরাচর নিয়মে ঐ শূন্যমুহূর্ত মধ্যরাত থেকে শুরু হয়, তবে সময়ের কিছুটা হেরফের ঘটলেও এর ভয়াবহতা কমে না। “জিরাে আওয়ার প্রকৃতপক্ষেই “জিরাে আওয়ার’, এর তাৎপর্যই আলাদা।  ঐ ভয়াবহ তাৎপর্য নিয়েই ২৫ মার্চ (১৯৭১) মধ্যরাতে ঢাকায় এবং দেশের অন্যত্র শুরু হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শূন্য মুহূর্তের অভিযান। অভিযানের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল আক্রমণের ব্যাপকতা, তীব্রতা ও ভয়াবহতায় বাঙালি-চেতনা স্তম্ভিত ও স্তব্ধ করে দেওয়া। যাতে স্বাধিকারের কথা বা বিচ্ছিন্নতার কথা আর কখনাে বাঙালিদের মুখে বা মনে না আসে। এ ধরনের কথা সেদিন উচ্চারিত হয়েছিল একাধিক পাকিস্তানি সেনানায়কের কণ্ঠে। বিশেষ করে অপারেশন শেষ করার পর, বিজয়ের সাফল্য অর্জনের পর। এ সাফল্য যে শেষ সাফল্য নয় এ কথা তাদের মনে হয় নি।  একাত্তরের ২৫ মার্চ মধ্যরাত থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব-পাকিস্তানে যে ‘অপারেশন তথা গণহত্যার সূচনা ঘটায় তার সাংকেতিক নাম ছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট অর্থাৎ সন্ধানী আলােয় তৎপরতা। কথাটা বাংলায় খুব নিরীহ শোনায় কিছুটা রােমান্টিকও। কিন্তু এর পরিণাম মােটেই রােমান্টিক ছিল না। তার চেয়েও বড় কথা ঐ পরিকল্পনা মােটেই তাৎক্ষণিক ছিল না। রীতিমতাে ভেবে-চিন্তে হিসাব-নিকাশ করে ঘটনার প্রায় মাস দুই আগে এ সম্পর্কে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। হিসাবটা ছিল মােটামুটি এ ধরনের : পূর্ব-পাকিস্তানের স্থানিক রাজনীতি যদি সামরিক প্রশাসনের কথামতাে চলে তাে ভালাে কথা। তা না হলে তাদের শক্ত হাতে ঠাণ্ডা করার ব্যবস্থা আগেভাগেই তৈরি করে রাখা দরকার। কাজটা সেভাবেই হয়েছিল। আর এ কথাও সত্য যে জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকা সফরে এসেই বুঝে নেন যে আওয়ামী লীগ তাদের ছয় দফায় ছাড় দিতে রাজি নয়। তিনি আওয়ামী লীগ প্রধানের সঙ্গে আলােচনার সুবাদে বলেন : ‘আমি ছয় দফা মেনে নিচ্ছি। কিন্তু পশ্চিম-পাকিস্তান ছয় দফার প্রচণ্ড বিরােধী, তাদের তাে সঙ্গে নিয়ে চলতে হবে।’ পশ্চিম-পাকিস্তান বলতে তিনি ভুট্টো-পিপিপি’র কথা বলছিলেন। কাজেই তখন থেকেই  সামরিক শাসন সজ্ঞাতের পক্ষে। তবু চেষ্টা চলেছে যদি তাদের টেনে নামানাে যায়। কিন্তু প্রশ্ন অনেকের : কেন জনসাধারণের অর্থে লালিত সেনাবাহিনী দেশের একাংশের বিরুদ্ধে দখলদার বাহিনীর ভূমিকা পালন করবে? কেন সেই জনতার ওপর আঘাত হানবে? কারণ খুব স্পষ্ট। সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল সামরিক শাসনের পছন্দ হয় নি। পছন্দ হয় নি কোনাে কোনাে স্বার্থপর রাজনৈতিক মহলের, আমলাটেকনােক্র্যাটদের। তাদের ষড়যন্ত্রে, যৌথ উদ্যোগে নির্বাচনী ফলাফলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার সহজ গণিত জটিল হয়ে ওঠে। হয়ে ওঠে তাদের আদিপত্যবাদী স্বার্থের টানে। আঘাতের সিদ্ধান্ত তাই চুড়ান্ত বিবেচিত হয়।

‘অপারেশন সার্চলাইট’ পরিকল্পনা তাই ছিল গােটা প্রদেশভিত্তিক এবং বিশেষভাবে ঢাকা-ভিত্তিক, চট্টগ্রাম-ভিত্তিক। আঘাতের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল ছাত্র শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী, সেই সঙ্গে প্যারামিলিটারি (ইপিআর) ও পুলিশ। কারণ ওরা ছয় দফার প্রতি ওদের আনুগত্য প্রকাশ করেছিল। এছাড়া বিশেষ ‘টার্গেট’ ছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। নীতিগতভাবে অবশ্য আওয়ামী লীগ এবং তাদের সমর্থক দেশদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাই বলা হয়। বলা হয় রাজনৈতিক নেতা, উগ্রপন্থী শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের কথা।  তাই পরিকল্পনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ছাত্রাবাসগুলাে দখলের। কারণ সেগুলাে ছিল তাদের হিসেবে অস্ত্রাগার, উগ্রপন্থীদের শিক্ষার এবং স্বাধীনতা-স্লোগানের কেন্দ্রস্থল। একই সঙ্গে পিলখানায় বাঙালি ই.পি.আর, (ঈস্ট পাকিস্তান রাইফেলস’) সদস্যদের নিরস্ত্র করা, যাদের সংখ্যা কম করে হলেও হাজার পাঁচেক। একই কাজ রাজারবাগ পুলিশ লাইনে হাজার খানেক উদ্বুদ্ধ পুলিশ সদস্যের ক্ষেত্রে। আর পুরনাে ঢাকায় হিন্দু মহল্লাগুলােতে (যেমন নওয়াবপুর, ভাতিবাজার, শাঁখারিবাজার) পাঞ্জাবি সৈন্যদের লেলিয়ে দেওয়া। সবচেয়ে বড় কথা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা। সামরিক বাহিনীর পরিকল্পনায় ইপিআর ও পুলিশদের সম্পর্কে ব্যবহৃত পারিভাষিক শব্দটি ছিল ‘নিউট্রালাইজ করা, তাতে নিরস্ত্র করা থেকে নির্মূল করা সবই হয়তাে বােঝায়। তা না হলে পিলখানার সদস্যরা জান দেবে কেন, পালাবে কেন? একই ঘটনা দেখা গেছে রাজারবাগ পুলিশদের ক্ষেত্রে। ভাবতে অবাকই লাগে যে উল্লিখিত সংখ্যক দক্ষ আধা সামরিক ও পুলিশ শক্তিকে বিকল্প ব্যবস্থার আওতায় আওয়ামী লীগ সময়মতাে পুরােপুরি সংগঠিত করে নি, ব্যবহার করতে ও কাজে লাগাতে পারে নি। এদের অনেকে বেঘােরে প্রাণ দিয়েছে। যারা পেরেছে তারা ঐ ‘য পলায়তি’ প্রবাদবাক্য অনুসরণ করে পালিয়ে বেঁচেছে।

এ সম্পর্কে সামরিক খবর যাই বলুক না কেন।  প্রতিপক্ষের অর্থাৎ আওয়ামী লীগের উগ্রপন্থী সমর্থক এবং ছাত্রযুবাদের তর্জনগর্জন, হলগুলােতে অস্ত্রপ্রশিক্ষণ, রাস্তায় মেয়েদের “ডামি রাইফেল’ নিয়ে মার্চ মিছিলের বহর দেখে স্থানীয় সামরিক প্রশাসনের ধারণা জন্মেছিল যে সংঘর্ষ শুরু হলে হয়তাে ক্যান্টনমেন্ট আক্রান্ত হতে পারে। বিশেষ করে ইপিআর এবং বাঙালি সামরিক সদস্যরা যদি সংগঠিত হয়ে তাদের বিরুদ্ধে আক্রমণের পরিকল্পনা নেয়। সে অনুযায়ী তারা ক্যান্টনমেন্ট রক্ষার ব্যবস্থাও পুরােপুরি করে রেখেছিল, যদিও তার কোনাে দরকার ছিল  কারণ ওদের ধারণা ছিল ভুল। বাঙালিদের তরফ থেকে তেমন কোনাে সুসংবন্ধ পরিকল্পনা ছিল না। বৃথাই পাকিস্তানি শাসন এ ধরনের অভিযােগ এনেছিল। রবার্ট জ্যাকসন ঠিকই বলেছেন, অ্যান্থনি ম্যাসকার্নিয়াস ও ডেভিড লুসাকদের সঙ্গে তিনি একমত যে আওয়ামী লীগ বা বাঙালি জঙ্গিদের পক্ষ থেকে কোনাে আক্রমণাত্মক সামরিক পরিকল্পনা ছিল না। তাই পাকবাহিনী ঢাকায় কোনাে সংগঠিত সামরিক প্রতিরােধের সম্মুখীন হয় নি। তাই তারা অবাক হয়েছে। হয়তাে আশাহতও। | আওয়ামী লীগ প্রকৃতপক্ষেই তখন পর্যন্ত কোনাে সুসংগঠিত সামরিক আক্রমণ বা প্রতিরােধের ব্যবস্থা করে উঠতে পারে নি। কারণ তারা সমঝােতা প্রস্তাব বাস্তবায়িত হওয়ার প্রত্যাশাই করেছে। তাই সংলাপ ভেঙে গেছে এমন ধরনের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর স্বতঃস্ফূর্তভাবে জঙ্গি ছাত্রজনতা বা রাজনৈতিক কর্মী অনেকে সন্ধ্যার পর পথে বেরিয়ে পড়ে। উদ্দেশ্য সম্ভাব্য পাক আক্রমণ ঠেকাতে প্রতিরােধ তৈরি করা। তাই ক্যান্টনমেন্ট থেকে সেনাবাহিনীর বেরিয়ে আসার পথ জুড়ে বিভিন্ন স্থানে রাস্তার। জঞ্জাল জড়াে করে, গাছ কেটে পথে ফেলে তারা অবরােধ তৈরি করে। এরা ছিল বাস্তবিকই খুব আন্তরিক। তাই পাকসেনাদের সঙ্গে পয়লা মােলাকাতে এদের অনেকে স্লোগান মুখে নিয়ে জান দিয়েছে। আওয়ামী লীগ যে সামরিক প্রতিরােধের কোনাে প্রস্তুতি নেয় নি, কথাটা পরে সাইমন ড্রিং স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন (ডেইলি টেলিগ্রাফ, ১৬ এপ্রিল, ১৯৭১)।

অন্যদিকে রাজনৈতিক দলের কর্মী বা সদস্যরা সন্ধ্যার পর থেকে নেতার বাড়িতে ভিড় জমিয়েছে। এদের অনেকে রাস্তার জঙ্গি মিছিলে শামিল হয়েছে। আবার নিরাপত্তা নিয়ে ভাবিত অনেকেই নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যাবার ব্যবস্থা নিয়েছে অনেকটা আওয়ামী লীগের মূল নেতাদের মতাে। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’একটি ছাত্রাবাসে অতিসাহসী। জঙ্গি ছাত্ররা প্রতিরােধের কথা ভেবে সেখানে থেকে গেছে এবং প্রাণ দিয়েছে। সে। রাতেই নেতার পূর্বকৃত স্বাধীনতার ঘােষণা প্রচারিত হয় বলে একাধিক সূত্রে প্রকাশ। তাই বিদ্রোহ বা আঘাত কোনােটারই প্রস্তুতি তখন ছিল না, যা হয়েছে তা স্বতঃস্ফূর্ত। এমনকি ঢাকার বাইরেও। | তাই আক্রমণের পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে-আসা পাকবাহিনী প্রত্যাশিত প্রতিরােধের সম্মুখীন হয় নি, পায় নি তাদের হিসাবমতাে গােলাবারুদ ও আগ্নেয়াস্ত্র। তাদের ভাষ্য মতে প্রতিরােধ ছিল (তাও প্রবল নয়) প্রধানত ইকবাল হল ও জগন্নাথ হল থেকে। সৈন্যরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও কিছু সংখ্যক ছাত্রাবাসই প্রধান টার্গেট হিসাবে ধরে নিয়ে এগিয়ে ছিল। তাছাড়া পিলখানা, রাজারবাগ তাে আছেই। পাক সেনাবাহিনীর অভিযান তাদের পরিকল্পনা মাফিক ভােরের আগেই শেষ হয়ে যায়। টিক্কা খান ও তার প্রশাসনিক কর্মকর্তারা মার্শাল ল’ হেডকোয়ার্টারের লনে বসে রাতভর চা-কফিতে চুমুক দিতে দিতে অভিযান শেষ হওয়ার অপেক্ষা করেছে। রাত দশটা থেকে ভাের পাঁচটা পর্যন্ত অধীর উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা।

বাংলাদেশের ঋতুবিচারে তখন বসন্তকাল। হালকা ঠাণ্ডা হাওয়ার আমেজস্নিগ্ধ মনােরম জ্যোৎস্নাভরা বাসন্তী রাত সেদিনও (২৫ মার্চ) যথারীতি রােমান্টিক পরিবেশ সৃষ্টিতে ভুল করে নি। এমন মায়াবী রাতের আমেজই ভিন্ন। এ রাত যেমন রাজপথে ইটকাঠ জঞ্জাল জমা করে, পাশ থেকে গাছ কেটে রাস্তায় ফেলে অবরোধ তৈরির নয় তেমনি নয় ধাতব ট্যাংক সহযােগে আগুনে গােলা, বােমা, মর্টার, রকেট লাঞ্চার, মেশিনগান বা অটোমেটিক আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে রক্তাক্ত অভিযানের। তবু ঐ বাসন্তী রাতটা উত্তপ্ত, রক্তাক্ত নারকীয় সময়ে পরিণত হয়েছিল ঢাকায়। সামরিক ভাষ্যমতে সেদিন মধ্যরাতে তথা ‘জিরাে আওয়ারে সিদ্ধান্ত মাফিক আক্রমণ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও একাধিক কারণে তাদের যাত্রা শুরু হয় ঠিক রাত সাড়ে এগারটায়। প্রথমত রাস্তায় রাস্তায় তুমুল অবরােধ তােলার তৎপরতা, দ্বিতীয়ত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার আকাশপথে যাত্রার নিরাপত্তা বিবেচনা করে। অবশেষে নির্ধারিত সময়ের আধঘণ্টা আগেই প্রথম সেনাসারি রওয়ানা হয় গন্তব্যস্থলের দিকে। প্রথম বাধা ফার্মগেটের সামনে, রাস্তার ওপর বড় বড় গাছের প্রতিবন্ধকতা। এর একদিকে সেনাবাহিনীর সশস্ত্র যানবাহন, অন্যদিকে কয়েক শত ছাত্র-জনতার সমবেত স্লোগান। এ দুইয়ের পারস্পরিক তৎপরতায় মানবকণ্ঠের ধ্বনি একসময় স্তব্ধ হয়ে যায়; জয়ী হয় সশস্ত্র যন্ত্রদানব।

এক ঘণ্টার মধ্যেই কমান্ডাে বাহিনী ছুটে যায় শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ির দিকে, অপেক্ষমাণ নেতাকে তুলে আনা হয় সেনানিবাসে। অন্যদিকে তখন ঢাকার আকাশ জুড়ে আগুনে গােলার তাণ্ডব, বিভিন্ন দিক থেকে আকাশে ওঠা অগ্নিশিখার সঙ্গে কালাে ধোয়ার মেঘ আর তার মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্রের একটানা শব্দ গনগনে নরকের আবহ তৈরি করে। সবচেয়ে উঁচু আগুনে-ধোঁয়ার স্তর দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এলাকায়, তাছাড়া কোনাে কোনাে পত্রিকা অফিস (যেমন দ্য পিপুল) এলাকায়।  রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও পিলখানায় একই ধরনের তৎপরতায় নিরস্ত্রীকরণের কাজ চলে। আশপাশের কয়েকটি বাড়ি শেলের আঘাতে নষ্ট হয়, এই যা। নিরস্ত্রীকরণের নির্মূল অভিযান নিয়মতান্ত্রিক ভাবে চলে অর্থাৎ সামরিক নিষ্ঠার সঙ্গে। এই দুই এলাকার সংশ্লিষ্ট পাড়াগুলাের, যেমন নতুন পল্টন লাইন এবং চামেলিবাগ-শান্তিনগরের মানুষ আতঙ্কের অশান্তিতে স্তব্ধ ও স্থবির হয়ে থাকে। ওদের সাক্ষ্য-বক্তব্য তাই বলে।  সর্বাধিক আঘাত হানা হয় ছাত্র-এলাকায়, যা তাদের তথ্যমতে সর্বাধিক মাত্রার দুষ্ট ভূতের আখড়া ও বােমারুদের গুদাম। আর পুরানাে ঢাকার কিছু কিছু হিন্দু এলাকা ও দুটো কাগজের অফিস। জাতীয়তাবােধের উৎস শহীদ মিনার বােমার আঘাতে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। রেসকোর্স ময়দানে অবস্থিত পুরনাে আমলের নির্বিরােধ রমনা কালীবাড়ি বাসিন্দাদেরসহ পুড়িয়ে ফেলা হয়। আর প্রতিরােধের কেন্দ্রস্থল ছাত্রাবাসগুলােকে যথার্থ শিক্ষা দিতে সর্বশক্তি নিয়ােগ করা হয়। রকেটের আঘাতে ধসে পড়ে ছাত্রাবাস, মেশিনগান ও অটোমেটিক অস্ত্রের আঘাতে লুটিয়ে পড়ে ছাত্র।

ওদেরই জনৈক প্রত্যক্ষদর্শীর হিসাবে ১৫ মিটার ব্যাসের কয়েকটি গর্তে(কতটা গভীর জানা নেই) ছাত্রহত্যার আলামত চাপা পড়ে। কয়েক ডজন পােড়া রাইফেল   ছাত্রদের প্রতিরােধ চেষ্টার প্রতীক হয়ে পড়ে থাকে। সঙ্গে কিছু পােড়া কাগজ সেই আবছা ভােরেও বাতাসে গন্ধ ছড়িয়েছে। আর পুরনাে ঢাকার ধসে-পড়া বাড়িগুলোর আশপাশে ছড়ানাে-ছিটানাে মৃতদেহের সংখ্যা অবশ্য তুলনামূলক হিসাবে কম। রাজপথের এখানে সেখানে ফুটপাথে পড়ে ছিল কিছু সংখ্যক লাশ। এ পুরাে ছবিটাই ছিল সামরিক প্রত্যক্ষদর্শীর আঁকা। ছাব্বিশে মার্চ, শান্ত সকাল। গত রাতে পাক সেনাবাহিনী বেশ দক্ষতার সঙ্গে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই পরিকল্পনা মাফিক কাজ শেষ করে। বিদেশী স্থপতির আকর্ষণীয় নকশায় তৈরি সুদর্শন ভবনে (এখন সংসদ ভবন) স্থাপিত সামরিক শাসকের দফতরে দাড়িয়ে সূর্যহীন ভােরে সাফল্যের আমেজ উপভােগ করতে করতে জেনারেল টিক্কা খান তার চশমার কাচ মুছে দূরে নজর ছুঁড়ে দিয়ে আপন মনে বিড়বিড় করেন : “আঃ যদ্র দেখা যায়, একেবারে ফাকা, জনমানবহীন।’ অর্থাৎ এমনটাই আমি চেয়েছিলাম, হ্যা এমনটাই। অবশ্য তখনও বাতাসে পােড়াগন্ধ, মৃত্যুর ঘ্রাণ ভাসছে। রাস্তার পাশে ঝুপড়িগুলােতে ছাইচাপা আগুন। এদিকে ওদিকে লাশ। কুকুরগুলাে পর্যন্ত ভয়ে স্তব্ধ। ঐ ছাব্বিশে সকালেই সারারাতের সামরিক তৎপরতায় খুশি ভুট্টোকে সামরিক বাহিনীর লােক হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল (বর্তমানে শেরাটন) থেকে সামরিক প্রহরায় তুলে এনে সশ্রদ্ধ সৌজন্য সহকারে বিমানবন্দরে নিয়ে যায়। করাচির উদ্দেশে রওয়ানা হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে ঢাকা। বিমানবন্দরে মি, ভুট্টো তার প্রধান ‘এসকর্ট জনৈক ব্রিগেডিয়ারের সঙ্গে কথাচ্ছলে পাকবাহিনীর তৎপরতার প্রশংসা করে বলেন : ‘আল্লাহ পাকিস্তানকে রক্ষা করেছেন।’ করাচি বিমানবন্দরে পৌঁছেও তিনি একই মন্তব্য করেন। দুপুরে শ্রান্তক্লান্ত সামরিক অফিসারগণ স্বাদু লাঞ্চ খেতে খেতে স্নায়ুর শিথিল আরাম উপভােগ করছিলেন। টেনশনমুক্ত পরিবেশে আলােচনা জমে ওঠে। প্রায় সবারই মুখের রেখায় উদ্বেগহীন খুশির ছাপ।

সবার মুখে একই কথা : ‘কাজটা খুব চমৎকার ভাবে শেষ করা হয়েছে।’ কমলার খােসা ছাড়াতে ছাড়তে ক্যাপ্টেন চৌধুরী বলেন : ‘বাঙালিদের খুবই উচিত শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। অন্তত এক প্রজন্মে ওরা আর কথা বলবে না।’ শুনে পাশে দাঁড়ানাে এক মেজরের মন্তব্য : ‘হ্যা, ওরা শক্তির ভাষাই বােঝে, অন্য কিছু নয়, ওদের ইতিহাস তাই বলে।’ (“The Officers chatted in the officers’ mees with a visible air of relaxation. Peeling an orange, Captain Choudhury said, “The Bengalis have been sorted out well and properatleast for a generation.’ Major Malik added, ‘Yes, they only know the language of force. Their history says so.’ ” Salex, P. 781) লক্ষ্য করার বিষয় যে পাকবাহিনীর চোখে যুদ্ধটা কোনাে রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে ছিল না— এমনকি বিচ্ছিন্নতার অভিযােগ সত্ত্বেও ছিল না, ছিল গােটা বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে, রাজনৈতিক দলমত নির্বিশেষে।  ঢাকায় খুব সহজে সাফল্য অর্জিত হলেও প্রদেশের অন্যত্র কাজটা অত সহজে শেষ হয় নি। হয়তাে এর একটা কারণ সামরিক বাহিনী পুরাে নজর রেখেছিল ঢাকার ওপর। ঢাকা জয় করার অর্থ গােটা দেশ জয় করা। তাই অন্যত্র অবস্থা ছিল ভিন্ন রকম, বিশেষ করে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া, টাঙ্গাইল এবং অনুরূপ একাধিক শহরে, অর্থাৎ ঢাকার বাইরে সর্বত্র প্রধান প্রধান শহরগুলােতে বা সামরিক কেন্দ্রে। তাই সন্ধানী তৎপরতার দ্বিতীয় পর্যায় অর্থাৎ ঢাকার বাইরে তৎপরতার পর্যায় ‘অপারেশন সার্চলাইটদুই ঐ পঁচিশে মার্চ শুরু হলেও এর কার্যকারিতায় বেশ খানিকটা সময় লেগেছে। পঁচিশে মার্চের রাজনৈতিক তৎপরতা (সংলাপ) এবং সেই সূত্রে পরবর্তী সামরিক তৎপরতা এবং সেই সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের ধারণকৃত স্বাধীনতার ঘোষণা পূর্বপাকিস্তানের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে মােটেই দেরি হয় নি। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর প্রচার বিভাগ যাই বলুক ঘটনা প্রমাণ করে যে পাকিস্তানি বাহিনীর বাঙালি সশস্ত্র অংশ। পঁচিশে মার্চ আকস্মিক আঘাতের আগে বিদ্রোহ করে নি। তাদের কারাে কারো মধ্যে ছয় দফা, স্বায়ত্তশাসন, বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রভাব ছড়ালেও (যেমন চট্টগ্রামে পাক সামরিক বাহিনীর এক নম্বর ব্যক্তি ব্রিগেডিয়ার মজুমদার) তাদের কেউ ঐ ক্রান্তিকালীন ঘটনার পূর্বে সামরিক শৃঙ্খলা ভঙে নি। বাঙালি চেতনার ডাকেও ভান্ডে নি।

হয়তাে ভাঙলে বাঙালিদের পক্ষে ভালােই হতাে। রাজনৈতিক সঙ্কট যে সামরিক সঙ্কটে পরিণত হয়েছে সে কথা জানতে তাদের বাকি ছিল না। আর সে সঙ্কটের সমাধান সামরিক পদ্ধতির পথই ধরছে সে কথা বুঝে নিতেও তাদের কষ্ট হবার কথা নয়। তবু তারা হয়তাে সামরিক শৃঙ্খলা ও নীতির কথাই ভেবেছে, হয়তাে তাদের অনেকের মনে। পাকিস্তানি ঐক্যের কথাও বড় হয়ে ছিল— অর্থাৎ অখও পাকিস্তান-কাঠামােয় পূর্ববঙ্গে স্বায়ত্তশাসনের সুযােগ-সুবিধা অর্জন। সমস্যা, সঙ্কট, জটিলতা এবং রাজনৈতিক সামরিক সম্ভাবনা নিয়ে তাদের অনেকের সঙ্গে বাঙালিবাদীদের যােগাযােগ ও চিন্তা বিনিময় যে হয় নি তাও নয়। তা সত্ত্বেও বিরাজমান পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক সঙ্কটের তীব্রতার মধ্যেও বিদ্রোহের সম্ভাবনা দেখা। দেয় নি, আঘাতের পূর্ব পর্যন্ত দেয় নি। তাদের মধ্যেও হয়তাে ধারণা ছিল, প্রত্যাশা ছিল যে কোনাে একটা রাজনৈতিক সমাধান হবেই। | এ ধারণা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বেও ছিল। আর সে কারণেই তারা বাঙালি সামরিক সদস্যদের নিয়ে, আধা-সামরিক সদস্যদের নিয়ে সুসংগঠিত বিদ্রোহ ঘটানোর কোনাে উদ্যোগ নেয় নি, এমন কি সঙ্কট ঘনীভূত হয়ে ওঠার পরও নেয় নি। নিলে অবস্থার গুণগত পরিবর্তন ঘটতে পারতাে। দাবার ছকে প্রথম চাল দেবার সুযােগ মিলতাে বাঙালিদের এবং যা ঘটতেই যাচ্ছে সে ভবিতব্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে তারা অনেকটা সুবিধাজনক অবস্থানে দাঁড়াতে পারতাে বলে আমার বিশ্বাস।

প্রতিপক্ষ পাকবাহিনীই বরং সে সুযােগ নিয়েছিল। তবু ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, কুষ্টিয়া ইত্যাদি অঞ্চলে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সংখ্যাল্পতার কারণে, বিদ্রোহের পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক সদস্যদের   সাময়িক বিপর্যয় প্রসঙ্গে জেনারেল আবদুল হামিদ অভিযােগের সুরে বলেছিলেন যে রাজনৈতিক সমাধানের প্রত্যাশা নিয়ে জেনারেল ইয়াকুব খান যথেষ্ট সংখ্যায় পশ্চিমা সৈন্য ঢাকায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি না করলে ঢাকার বাইরে অবস্থা এতটা খারাপ হতাে না (সালিক)। অর্থাৎ আরাে বেশি সংখ্যায় সৈন্য আমদানি করা হলে মফস্বলের শহরগুলােতে যথেষ্ট সংখ্যায় অবাঙালি সৈন্য মােতায়েন করা যেতাে। | এটা ছিল তাদের দিককার হিসাব। অর্থাৎ তাদের স্বার্থের হিসাব-নিকাশ। একই ভাবে এদেশীয় অর্থাৎ বাঙালি স্বার্থের বিবেচনায় পূর্বোক্ত ব্যবস্থা ছিল অপরিহার্য এক পদক্ষেপ যা গ্রহণ করার মতাে বিচক্ষণতা বাঙালি রাজনীতিকদের ছিল না। তাই জেনারেল হামিদের পাল্টা ভাষায় বলতে হয়, ঐ ভুলের মাশুল বাঙালিদের দিতে হয়েছে। অনেকটাই বেশি মাত্রায়। আমার আরাে ধারণা ঐ সংগঠিত সুসংবদ্ধ পরিকল্পনার পরিপ্রেক্ষিতে জননেতাকেও স্বেচ্ছায় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর হাতে ধরা দেবার প্রয়ােজন ছিল না, তাতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার হাতে তুরুপের তাসটা ধরা পড়তাে না। নেতাকে না পেলে গােটা ঢাকা শহর জ্বালিয়ে দেবে- এমন ধারণার কোনাে বাস্তবভিত্তি ছিল না। | এ কথা বলার উদ্দেশ্য, মাত্র কয়েকদিনের ফারাকে ঢাকার বাইরে অবস্থিত বাঙালি সামরিক সদস্য ও ইপিআর সদস্যদের শেষ পর্যন্ত সামরিক শৃঙ্খলা নিয়মনীতি ভেঙে বিদ্রোহ করতে হয়েছিল, অন্য কোনাে বিকল্প তাদের ছিল না। বরং তাৎক্ষণিক, অসংবদ্ধ, অপরিকল্পিত বিদ্রোহের কারণে তাদের যেমন বেশি মূল্য দিতে হয়েছে তেমনি লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রেও অসুবিধা পােহাতে হয়েছে অনেক বেশি। তাই বিকল্প ব্যবস্থার প্রয়ােজন ছিল অপরিহার্য, যেমন সব ঠিকঠাক করে রেখেছিল পাকবাহিনী ক্রান্তিক্ষণের জন্য।  আবার গােড়ার কথায় ফিরে আসি।

ঢাকা আকস্মিক আঘাতে স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় চট্টগ্রামসহ মফস্বলের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলােতে বাঙালি সেনা সদস্যদের প্রাথমিকভাবে আত্মরক্ষার তাগিদে এবং সেই সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক প্রয়ােজন মেটাতে পাকিস্তানি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হয়, কোথাওবা বাহিনী থেকে নিজদের বিচ্ছিন্ন করে নতুন ভাবে সংগঠিত করে তুলতে হয়। এ কাজটা শুরু হয় চট্টগ্রামে ২৫ মার্চের পর পরই। পরে এক এক করে দেশের অন্যত্র।  ঘটনার কয়েকদিন আগে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে চট্টগ্রাম থেকে সেখানকার বাহিনী প্রধান ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে ঢাকায় নিয়ে এসে আটক করার পর সেখানকার দ্বিতীয় পদাধিকারী মেজর জিয়াউর রহমানকে অবস্থার প্রয়ােজনে নিয়ন্ত্রণ হাতে নিতে এবং কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের পক্ষে স্বাধীনতার ঘােষণা প্রচার করতে হয়। অবশ্য এর আগেই পরিস্থিতি অনুমান করে ঢাকা সেনানিবাস থেকে জি,ও,সি জেনারেল খাদিম পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে চট্টগ্রামের দিকে প্রয়ােজনীয় সেনাবাহিনী পাঠানাের ব্যবস্থা ঠিক করে রাখেন। বেশ কিছু ক্ষয়ক্ষতির মধ্য দিয়ে এবং বাঙালি সেনা, ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীকে পর্যুদস্ত করার পর মার্চের শেষে চট্টগ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রাথমিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহশেষে সেখানে সামরকি শাসন পূর্বাবস্থায় ফিরে আসে।  এ ধরনের ঘটনা শুধু যে চট্টগ্রাম, কুষ্টিয়া, পাবনা বা জয়দেবপুরেই ঘটেছে তা নয়, প্রদেশের সর্বত্র যেখানেই বাঙালি সেনাসদস্য বা ইপিআর সদস্যের নিয়মিত বা সামরিক অবস্থান ছিল সেসব ক্ষেত্রে প্রায় সর্বত্র এমনটা ঘটেছে। বাঙালি সামরিক সদস্যদের এপ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিজ নিজ উদ্যোগে অবাঙালি পাকিস্তানি সহকর্মীদের বিরুদ্ধে।

অ্যুত্থান ঘটিয়েছে শুরুতে ব্যাপক কোনাে সুসংবদ্ধ পূর্ব-পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত না হয়েই। যেজন্য তাৎক্ষণিক সাফল্য সত্ত্বেও তাদের পিছু হটতে হয়েছে, কোথাও বেশ চড়া মূল্যের। বিনিময়ে অবশেষে সংগঠিত হতে পেরেছে। যেমন জয়দেবপুর রাজবাড়িতে অবস্থিত বাঙালি সেনা ইউনিট ২৮ ফেব্রুয়ারিতে বিদ্রোহ করে এবং নিকটবর্তী বাঙালি ইউনিটগুলােকে ঘটনা অবহিত করে অবশেষে। অবস্থান ত্যাগ করে। অথচ ঢাকার প্রায় চল্লিশ কিলােমিটারের মধ্যে অবস্থান সত্ত্বেও দিব্যি দুটো দিন মাঝখানে কেটে যায়। কুষ্টিয়াতে ২৮ মার্চ উপস্থিত বাঙালি সেনা ও ইপিআর সদস্যরা সংগঠিত হয়ে ২৯ মার্চ সেখানকার ছােট্ট পাকিস্তানি সেনা ইউনিট খতম করে নিজদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু পরে যশাের থেকে আসা পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সংঘর্ষের মুখােমুখি হয়ে ১৬ এপ্রিল অবস্থান ত্যাগ করে। | প্রায় অনুরূপ ঘটনা পাবনায়ও। যেখানে রাজশাহী থেকে পাঠানাে পাকিস্তান বাহিনীর ছােট্ট ইউনিট অবস্থান করছিল। সেখানকার বিদ্রোহী ইপিআর ও পুলিশ ২৭ মার্চ তাদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে নিজদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে, কিন্তু রাজশাহী থেকে পাঠানাে পাকিস্তানি সৈন্যদের সুগঠিত ইউনিটের সঙ্গে এঁটে উঠতে না পেরে ১০ এপ্রিল অবস্থান ত্যাগ করে চলে যেতে বাধ্য হয়। এদের সঙ্গে কোনাে নিয়মিত বাঙালি সেনাসদস্যের গ্রুপ ছিল না। কিন্তু যেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সংখ্যায় যথেষ্ট সেখানে এরা সুবিধাজনক অবস্থায় দাড়াতে পারে নি বা অবস্থা নিজদের নিয়ন্ত্রণে আনতে বা ধরে রাখতে পারে নি। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকে ১১ মে’ (১৯৭১)-র মধ্যে পূর্ব-পাকিস্তানের প্রধান শহরগুলােতে পাক-বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবেই সন্ধানী আলােয় পাক তৎপরতার দ্বিতীয় পর্যায় শেষ হয়। সূচনা ঘটে বিশৃঙ্খল সংঘাত থেকে সংগঠিত প্রতিরােধের। দেখা দেয় প্রকৃত গৃহযুদ্ধ। পাকিস্তানি শাসক এবং তার সেনাবাহিনী যেমন তাদের আক্রমণ শুধু প্রধান টার্গেট আওয়ামী লীগের ওপরই সীমাবদ্ধ রাখে না, শুরু থেকে তা ছড়িয়ে দেয় বাঙালি মাত্রেরই ওপর, বিশেষ করে শিক্ষিত শ্রেণী এবং সম্প্রদায়বিশেষের ওপর, তেমনি এ সংঘাত আর দলীয় সংঘাত থাকে না, থাকে না ইয়াহিয়া বনাম শেখ মুজিবের সংঘাত।

বরং হয়ে ওঠে। পাকবাহিনী বনাম অসংগঠিত বাঙালি ছাত্রযুবা-জনতার সংঘর্ষ, যা ক্রমে সংগঠিত হতে থাকে বিভিন্ন রাজনৈতিক স্তরে। স্পষ্টই বিভাজন ঘটে যায় পাকিস্তানি বাঙালি ও পাকিস্তানি অবাঙালির মধ্যে। অবাঙালি পাকিস্তানিদের ঘৃণা বিদ্বেষ ও বিরূপতা যেমন পরিস্ফুট হয়ে ওঠে সাধারণভাবে বাংলাভাষী মানুষের বিরুদ্ধে তেমনি বাঙালিয়ানার সামরিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাঙালি মাত্রেরই ঘৃণা বিদ্বেষ বিস্ফোরক রূপ নেয় অবাঙালি তথা অবাংলাভাষীদের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সমর্থক বিহারিদের (স্থানীয় অবাঙালি জনসংখ্যা) বিরুদ্ধে। শেষােক্তরা ক্ষেত্রবিশেষে অযৌক্তিক বাঙালি ক্রোধের শিকার হয়েছে। পাকিস্তানি ও বাঙালি শব্দ দুটো এভাবেই বিভাজিত ও পৃথক হয়ে যায়। অন্তত একাত্তরের বাকি নয় মাস বাঙালি তার চেতনার দিক থেকে পাকিস্তানি ছিল না। প্রকাশ্যে বা সামরিক বাহিনীর উপস্থিতিতে যদিও নিজেকে পাকিস্তানি বলে পরিচয় দিতে হয়েছে। |রাজনীতি-সচেতন সাধারণ মানুষের মধ্যে এ মনােভাব তীব্র ও জোরালাে হয়ে ওঠে নির্বাচন-পরবর্তী দিনগুলােতে, বিশেষ করে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে মার্চের দিনগুলােতে। এটা ছিল প্রকৃতপক্ষে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক স্বার্থের দ্বন্দ্ব যার প্রকাশ। জনসাধারণের মধ্যে সঞ্চারিত হয় । হয় অতি দ্রুত অস্বাভাবিকতা নিয়ে। তাই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যেমন তাদের ‘অপারেশনে মানবিক হিসাব-নিকাশ বা যুক্তিন্যায়ের বিচারটা শিকেয় তুলে রাখে তেমনি তুলে রাখে জঙ্গি বাঙালিবাদীরা কিংবা বাঙালি সেনা, ইপিআর বা পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। মােটাদাগে পাকিস্তানি-অপাকিস্তানি, বাঙালি-অবাঙালি এ বিভাজনেই মানুষ পরস্পরের হিংস্রতার শিকার হয়। বিষয়টা কোনাে কোনাে বিদেশী লেখক বা সাংবাদিককে অনুধাবন করতে এবং সাদচোখে, নিরপেক্ষ বিচারে চিহ্নিত করতে দেখা গেছে। রবার্ট জ্যাকসনের লেখায় অনুরূপ বিশ্লেষণ প্রকাশ পেয়েছে : “Nearly every where there was widespread destruction and heavy casualties…. In the tumult which followed, the Pakistani army directed its fire against the Bengalis, and inturn the Bengalis wherever they could, murdered members of the Urdu speaking minorities, including both West Pakistanis and Biharis” (প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যার ঘটনা ঘটেছে।..

পরবর্তী পর্যায়ের প্রবল বিশৃঙ্খলার মধ্যে পাক-সেনাবাহনী বাঙালিদের ওপর আঘাত হেনেছে এবং পরিবর্তে বাঙালিরা যেখানে পেরেছে উর্দুভাষী সংখ্যালঘুদের পশ্চিম-পাকিস্তানি ও বিহারীদের খুন করেছে’ (পৃ. ৩৪)। এখানে ন্যায়-অন্যায় বা মানবিকতার বিচার-বিবেচনা কোনাে পক্ষেই ছিল না। কিন্তু পাকিস্তানি লেখক বা সাংবাদিকদের দৃষ্টিভঙ্গি এদিক থেকে ছিল একদেশদর্শী। তারা গােটা বিষয়টাকে তাদের পক্ষ থেকে বিচার করেছে, নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে নয়। তাই পাকিস্তান সরকারের প্রকাশিত পূর্বে উল্লিখিত শ্বেতপত্রে বিহারীসহ অবাঙালি হত্যার নিষ্ঠুর বিবরণ বিশেষ তালিকায় স্থান পেয়েছে, কিন্তু বাঙালিদের ওপর পাক-বাহিনীর নিষ্ঠুরতা বা বর্বরতার কোনাে উল্লেখ সেখানে নেই যা এদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ দেখেছে বা অনেকে সে নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েছে। অনুরূপ একদেশদর্শিতা ভুট্টো বা জেনারেল নিয়াজি’র লেখায় পরিস্ফুট। এমন কি পরিস্ফুট আপাত-নিরপেক্ষ বা নিরপেক্ষতার ভান-করা মেজর সালিকের লেখাতেও। তার লেখায় জনৈক পাকিস্তানি সুবেদারের পরিবার বা একাধিক অবাঙালি পরিবারের ওপর সংঘটিত নিষ্ঠুরতার বিবরণ মর্মস্পর্শী ভাষায় পরিবেশিত হয়েছে, তুলনায় সামান্যই প্রকাশ পেয়েছে বাঙালি পরিবার বা বাঙালি সদস্যদের ওপর সংঘটিত অন্যায়ের নিষ্ঠুরতা। অথচ  প্রায় ন’মাস স্বাধীনভাবে ঢাকায় ও দেশের অন্যত্র একজন পাকমেজরের চলাফেরার অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও মুদ্রার অপর পিঠটা তার চোখে পড়ে নি, যা সীমাবদ্ধবৃত্তে চলাচলের পরও পড়েছে। একাধিক বাঙালির চোখে পড়েছে কোনাে কোনাে বিদেশী সাংবাদিকের চোখে। এ প্রসঙ্গে আরাে একটি কথা। মেজর সালিকের লেখায় অভিযােগ : বিদেশী সংবাদ মাধ্যম পাক-বাহিনীর হত্যাকান্ত্রে বিবরণ অতিরঞ্জিতভাবে প্রকাশ করেছে, করেছে ২৬ মার্চ তাদের ঢাকায় বের হতে না দিয়ে এবং একসঙ্গে ঢাকা থেকে বিতাড়িত করার কারণে। তারা খুশিমতাে কল্পকাহিনী প্রকাশ করেছে। তার মতে এ সংঘাতে পাক-বাহিনীর হাতে নিহতের সংখ্যা চার অঙ্কে অর্থাৎ এক হাজারেও পৌঁছায় নি। অন্ধতা আর কাকে বলে।

যদি ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চের মধ্যবর্তী সময়ে নিহতের সংখ্যা হিসাবে না এনেও বিচার করা যায় তাহলেও ফার্মগেটে এবং অনুরূপ অবরোধের মুখে দাড়ানো কয়েকশত জঙ্গি কর্মীজনতা (তারই হিসাবে) কিংবা ছাত্রাবাসের গণকবরে এবং রাজারবাগ ও পিলখানায় পাকগুলিতে নিহতের সংখ্যার হিসাব নিতে গেলেই বােঝা যাবে সেটা চার অঙ্ক স্পর্শ করেছিল কি না। তা ছাড়া তাে রয়েছে ২৫ মার্চ রাত থেকে এপ্রিলের ১০ তারিখ পর্যন্ত দেশের অন্যত্র পাক-বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় সৃষ্ট আলামত। এমন কি ২৭ মার্চ দিশাহারা মানুষের ঢাকা থেকে পালানাের সময় বুড়িগঙ্গার বুকে নিছক মজা করতে পাক-জওয়ানদের (তারা তখন “ট্রিগার-হ্যাপি জওয়ান) গুলি চালানোর ফলে নিহতের সংখ্যা প্রত্যক্ষদর্শীদের চোখে পড়েছে, কিন্ত্র পড়ে নি পাক-মেজরের চোখে। এ ধরনের বহু ঘটনা তার চোখে পড়ে নি বলেই হিসাবের অঙ্কটা তার দিক থেকে সঠিক হতে পারে নি। তবে এ কথাও ঠিক যে বাঙালি-অবাঙালির পারস্পরিক সম্পর্কে যে ঘৃণা ও তিক্ততার জন্ম তারই প্রকাশ ঘটেছিল উভয় পক্ষ থেকে পরস্পরের প্রতি সংঘটিত নিষ্ঠুরতায়, যা কোনাে বিচারেই সঙ্গত বলে মেনে নেওয়া যায় না। ঢাকা, সৈয়দপুর বা চট্টগ্রামে স্থানিক অবাঙালিদের ওপর যেমন অন্যায় আক্রমণ চলেছে তেমনি মীরপুর-মােহাম্মদপুর বা সৈয়দপুরে এক পর্যায়ে নিরীহ নিরপরাধ বাঙালিও তাদের নিষ্ঠুর আক্রমণের শিকার হয়েছে। এককভাবে এর কোনাে একটি দিক কি গ্রহণযােগ্য হতে পারে?  উল্লিখিত পাক ‘অপারেশনের সার্বিক বিচারে কয়েকটি দিক যুক্তিসঙ্গতভাবেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেমন ঢাকায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার রাজনৈতিক আলােচনা শুরু এবং তা চালিয়ে যাওয়ার পেছনে তাদের কোনাে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছিল না, গােটা প্রক্রিয়াই ছিল সময় হরণের কৌশল।

যদিও এ বিষয়ে পাক-কর্মকর্তারা তাে বটেই অনেক বিদেশী সাংবাদিকও ভিন্ন ধারণা পােষণ করেছেন এবং তেমনটাই লিখেছেন। তাই দেখা গেছে আলােচনা শুরু করার অনেক আগে থেকে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি (১৯৭১) মাস থেকেই সাদা পােশাকে পশ্চিম-পাকিস্তান থেকে বিমানযােগে এবং জাহাজেও সৈন্য, অস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জাম ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আসতে থাকে। মার্চের শেষদিকে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ থেকে অস্ত্রসরঞ্জাম খালাস করায় বাঙালিদের আপত্তির মুখেই তাে এক দফা সংঘর্ষ। কাজেই পাক-বাহিনীর তথা জেনারেল ইয়াহিয়ার উদ্দেশ্যটা। বুঝতে কষ্ট হয় না।  তৃতীয়ত, ছাত্র ও জঙ্গিকর্মীদের তর্জনগর্জনে সামরিক কর্তাদের মনে ভয় জন্মেছিল যে আইন অমান্য আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে সংঘাতের প্রেক্ষাপট। পাক-সামরিক গােয়েন্দাদের এতই অদক্ষতা যে তারা ছাত্র-তৎপরতার গভীরতা পরিমাপ করতে ব্যর্থ। হয়েছিল। তাদের ধারণা হয়েছিল যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ছাত্রাবাসগুলােতে বিস্তর গােলাবারুদ জমা করা হয়েছে যা একটা যুদ্ধ শুরু করার উপযােগী। ‘ডামি রাইফেল নিয়ে মিছিল ওদের চোখে বাস্তবিক রাইফেল ওয়ে ওঠে। ওদের আরাে ভয় ছিল, বাঙালি সেনারা ইপিআর এবং পুলিশের সঙ্গে যােগ দিয়ে যুদ্ধাবস্থা তৈরি করতে পারে, ভারতের উস্কানি ও সাহায্যে পূর্ব-পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন বাংলাদেশের গােড়া পত্তনের চেষ্টা চালাতে পারে। এর কারণ জঙ্গি ছাত্র ও কর্মীদের উগ্র স্লোগান, জননেতার আইন অমান্য আন্দোলনের সাফল্য এবং ২৩ মার্চ ঘরে ঘরে বাংলাদেশী পতাকা উত্তোলনের মতাে ঘটনাবলী। কিন্তু এসব ঘটনা তাে অনেক পরের । বরং ৭ মার্চ নেতার ভাষণেরও ভুল মূল্যায়ন করেছিল পাক-সামরিক দফতর। সমঝােতার কোনাে প্রকার ইচ্ছা তাদের ছিল না। এ ছাড়া বাঙালি জাতীয়তার আবেগ নিয়েও তাদের মূল্যায়নে ভুল ছিল। তারা ধরেই নিয়েছিল যে ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী এবং সাধারণভাবে বাঙালি হিন্দুরাই বাঙালিয়ানার প্রবক্তা। বুঝতে পারে নি যে বাঙালি মুসলমান জনতাও এ নির্বাচনে আত্মশাসনের পক্ষে ম্যান্ডেট দিয়েছে। তাই রাগটা জমা হয়েছিল উল্লিখিত শ্রেণী ও সম্প্রদায়ের ওপর। সব মিলিয়ে একটি যুদ্ধাবস্থার জন্যই ওরা তৈরি হয়, সেজন্য ক্যান্টনমেন্ট রক্ষার চিন্তা মাথায় ছিল সর্বাগ্নে। ভাবতে পারে নি যে বাঙালিদের তরফে গােটা বিষয়টা ছিল রাজনৈতিক চাপ যাতে কেন্দ্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার গঠন করতে পারে। ভাবতে পারে নি সম্মাতের জন্য প্রস্তুত কোনাে জননায়ক স্বেচ্ছায় শত্রুপক্ষের হাতে ধরা দিতে পারে। সেটা ছিল তাদের জন্য এ অভাবিত জয়, তুরুপের তাস হাতে পাওয়া । ভুলটা জননায়কের। এ তুরুপের তাস পাওয়ার কারণেই সামরিক শাসক তার ইচ্ছামতাে পরবর্তী সময়ে ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। তারা বাংলাদেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সমঝােতা প্রস্তাবে রাজি হয় নি, প্রেসিডেন্ট নিকসনের ইচ্ছাতেও সায় দেয় নি (এনায়েতুর রহিম)। এমন কি সদর্পে পূর্ববঙ্গের ওপর সামরিক বর্বরতার চাপ অব্যাহত রেখেছে, বিশ্বজনমত অবহেলা করতে পেরেছে। 

সূত্র : একাত্তরে পাকবর্বরতার সংবাদভাষ্য – আহমদ রফিক