You dont have javascript enabled! Please enable it!

পঁচিশে মার্চের পটভূমিতে ঢাকাই নাগরিকের একদিন  প্রতিদিন

পূর্ববঙ্গে তথা পূর্ব-পাকিস্তানে একাত্তর সালটা শুরু হয়েছিল মুঠোমুঠো উত্তাপ, উত্তেজনা আর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে। অবশ্য উনসত্তরের আন্দোলন, গুলি, মৃত্যু আর গণআন্দোলনের পটভূমি ছিল এ ঘটনার পেছনে চালচিত্রের মতাে। সাধারণ নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা চট্টগ্রামসহ বড়াে বড়াে শহরে তাে বটেই, গ্রামাঞ্চলের গায়েও লেগেছে রাজনৈতিক উত্তেজনার হাওয়া। রাজনৈতিক দলগুলাের নিজস্ব মতাদর্শ প্রচারের মধ্যেও পূর্ববঙ্গের তথা বাঙালি জনগণের শ্রেণী-নির্বিশেষ স্বশাসনের আকাঙ্ক্ষাই বড় হয়ে ওঠে, অন্য সব কিছু ছাপিয়ে প্রাধান্য পেতে থাকে। জাতীয়তার সচেতন সামাজিক ভিত্তি গড়ে না উঠলেও বাঙালিয়ানার আবেগ তখন প্রচণ্ড । হাওয়ায় ভাসছে বাঙালি জাতীয়তার আবেগ। এ আবেগে প্রবল আঘাত পড়ে ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ঢাকায় পাক-সেনাবাহিনীর আক্রমণে। মধ্যরাতের স্তব্ধতা ভেঙে যায়, শহরবাসী মানুষের ঘুম হারাম হয়ে যায় গুম গুম শব্দের প্রবল ঝাকুনিতে, কট কট শব্দের ধাতব তীক্ষতায়। সেই সঙ্গে পটাস পটাস শব্দের আগুনে ঝলসানিতে। এ নারকীয় তাণ্ডবের সম্ভাব্য ব্যাখ্যা সে মুহূর্তে সবার কাছে স্পষ্ট ছিল।  মনে হয়েছে, যা-ই ঘটে থাকুক না কেন, কিছুক্ষণের মধ্যে এ তাণ্ডব শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু না। রাতভর চলেছে শব্দবাজির অত্যাচার। ভােরের আজানও ওদের বিরত করতে পারে নি। ওদের কাজ চলেছে সকাল পর্যন্ত, লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত। ঢাকার বাসিন্দা কেউ এমন একটি ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিল না। ভাবতেও পারেনি। তেমন কিছু। পচিশে মার্চ সারা ঢাকা শহর ছিল উত্তেজনায় টানটান। শেষ পর্যন্ত কি হবে আলােচনার ফলাফল তাই নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। রাজপথে শুধু মিছিল আর স্লোগান। শেষ বিকেলেও রাস্তাভরাট মিছিল। তেমন একটি মিছিল শেষ বিকেলে তৎকালীন ইপিআর গেট বায়ে রেখে সাতমসজিদ রােড ধরে এগিয়ে চলেছে। হাজার কয়েক লােকের মিছিল। প্রত্যেকের হাতে আকাশমুখাে বাঁশের লাঠি। স্লোগানের ভাষা সেনাবাহিনীর মোকাবেলায় তীব্র, তীক্ষ।  এদের অধিংকাশই শ্রমজীবী মানুষ, সম্ভবত ঢাকার বস্তি ও ঝুপড়ির বাসিন্দা। কিছুটা দূরে সম্পূর্ণ ভিন্ন চেহারার একটি মিছিল। কয়েকশ তরুণী মার্চের পছন্দে কদম কদম এগিয়ে চলেছে সাতমসজিদ রােড ধরে উত্তর দিকে, হাতে-কঁাধে কাঠের ডামি রাইফেল। কণ্ঠে স্লোগান ততটা ভরাট না হলেও চলার ছন্দে সে এক রীতিমতাে দৃষ্টিনন্দন। 

মিছিল। অন্যদিকে ছাত্র এলাকায়, বিশেষ করে রমনাপার্ক এলাকায় ছাত্র ও কর্মীদের ঘামেভেজা মুখের ক্রুদ্ধ-অভিব্যক্তিভরা, স্লোগানদৃপ্ত মিছিল। পরিবেশ এমনই উত্তাপময় যে তা পথচারীদেরও স্পর্শ করছে। এমনি উত্তাপ, উত্তেজনা, গুজব ও বিশৃঙ্খলার পরিবেশে দিন শেষ হয়। জননেতার বাড়ির সামনে জনতার ভিড়, ভেতরেও বিশিষ্টদের ভিড়, নিরন্তর আসা-যাওয়ার স্রোত। নানা মুখে নানা মন্তব্য। খবর রটে গেছে যে সংলাপের মৃত্যু ঘটেছে। এবার চূড়ান্ত পরিণামের জন্য অপেক্ষা। আবার কারাে মন্তব্য : ‘সংঘাতটা আর এড়ানাে গেল না। রাজনীতির প্রধান স্রোতের সঙ্গে জড়িত তরুণ বা পরিণত বয়সী সবাই যে যার পথে রওয়ানা হয়েছেন। অতি-অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় ছাত্র বা কর্মীরা নিজ নিজ অবস্থানে নির্বিকার। সক্রিয় বা প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন এমন সবাই নিজ নিজ বাসস্থানে। ঝুপড়িবাসী, বস্তিবাসীদেরও একই অবস্থা। কেউ তাদের কোনাে আশংকার কথা বলে সতর্ক করে দেয় নি। নগরীর ভাসমান বাসিন্দা ওরা। শেষ পর্যন্ত পচিশে মার্চের তাণ্ডবে ভেসেই গেছে।  এমন একটি টানটান উত্তেজনাপূর্ণ দিন পেরিয়ে মধ্যরাতে শুরু হয় পাকসেনাবাহিনীর হত্যার উৎসব। ভয়াল শব্দের তাড়নায় সেদিন ঢাকার মানুষ সারাটা রাত নিঘুম কাটিয়েছে। সকালে (২৬ মার্চ) বিদেশী খবরের জন্য রেডিও সেটের ‘নব” ঘােরাতে ঘােরাতে হঠাৎ করেই কানে আসে অচেনা কণ্ঠের দ্বিপাক্ষিক সংলাপ, বুঝতে কষ্ট হয় নি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে পাক-সেনাদের আক্রমণে ব্যবহৃত গােলাগুলির হিসাব-নিকাশ নিয়ে কথাবার্তা। সে কাজ শেষ করতে গিয়ে বাড়াবাড়ির জন্য যে অতিরিক্ত গােলাগুলির খরচ তার জন্য কর্তাব্যক্তির কণ্ঠে সস্নেহ মৃদু ধমক (কণ্ঠস্বরে গাম্ভীর্য ও অধিপত্যবাদী ভারের জন্য কর্তাকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছিল)। সঙ্গে সঙ্গে অন্যপ্রান্ত থেকে আর্দ্রকণ্ঠে গতির জন্য ‘মাফি মেঙ্গে’ নেওয়া। বিস্তারিত খরচের হিসাব যথাসম্ভব ধরা ছিল কাগজে, কিন্তু ঐ ন’মাসের ডামাডােলে হারিয়ে যায়। হয়তাে এভাবেই বড়ো কর্তা টিক্কার সংঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সংলাপ ধরা পড়ে টেপবদ্ধ হয়ে যা পরে বিদেশী কাগজে প্রকাশ পায়।  রাজারবাগে বাড়াবাড়ির আলামত সংলগ্ন কয়েকটি বাড়ির বাসিন্দারা ভালােভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর আতঙ্ক লালন করে।

যেমন বুঝতে পারেন রাতভর তেমনি সকালে যখন কাফুর মধ্যে সংলগ্ন এবং রাস্তার উল্টোদিকের বাড়িতে পালিয়ে-যাওয়া পুলিশের জন্য তল্লাসি চলে। চোস্ত উর্দু ও ভাঙাভাঙা পাঞ্জাবি জবানজানা এক প্রৌঢ় ঢাকাই মহিলার সপ্রতিভ বয়ানে অপ্রস্তুত কয়েকজন পাক জওয়ান শেষ পর্যন্ত নিরাশ হয়ে ফিরে যায়। মুখে খুব একটা দাপটের সুর ফোটে না। | রাজারবাগে পুলিশদের ওপর আক্রমণের আরাে কিছু আলামত মেলে সংলগ্ন পাড়া চামেলিবাগ থেকে উদভ্রান্তের মতাে ছুটে আসা দুই দম্পতির অভিজ্ঞতার বয়ানে। পঁচিশে রাতের তাণ্ডবের পর ছাব্বিশে মার্চ কাফু জারি করা হয়েছে। বােধ হয় সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্য ছাব্বিশের ২৪ ঘণ্টায় আর কাজের বাকিটা শেষ করে ফেলা। বেলা একটু বাড়তেই কাফুর বিপজ্জনক চোখ ফাকি দিয়ে চামেলিবাগ থেকে কোনােমতে একছুটে বড় রাস্তা পেরিয়ে সিদ্ধেশ্বরীর ঝােপঝাড়, গাছগাছালির আড়াল নিয়ে যে দুইজন জান   হাতে নিয়ে খবর নিতে ও দিতে আসেন তাদের মুখেও জানা গেল রাতভর ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা। ওদের ছােট্ট পাড়ার প্রতিটি বাড়িতে মানুষ আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে সারারাত বসে কাটিয়েছে ছােট ছেলে-মেয়েদের খাটের নিচে শুইয়ে দিয়ে।  কিন্তু এর মধ্যে সবচেয়ে অদ্ভুত অভিজ্ঞতা সম্ভবত খালিগায়ে বা গেঞ্জিগায়ে জান বাঁচাতে ছুটে আসা পুলিশের একটু আশ্রয়ের জন্য কাতর মিনতি। পরনে লুঙ্গি জনাকয় পুলিশ সে রাতে রাজারবাগ থেকে কোনােমতে পালাতে পেরেছিল, রাতটার জন্য আশ্রয়ের চেষ্টা করেছিল নিকটবর্তী চামেলিবাগ ও শান্তিনগরের কোনাে কোনাে বাড়িতে। সতর্ক ডাকে গৃহকর্তা জানালা খুলে মুখােমুখি হতেই করুণ আবেদন : “আমি পুলিশ, রাজারবাগে ওরা আক্রমণ চালিয়েছে, রাতটার মতাে আমাকে একটু থাকতে দিন।’ সবার ঐ একই মিনতি। ওদের সেই চেহারা (কারাে কারাে গা নাকি কাদামাখা), সেই উদভ্রান্ত দৃষ্টি, প্রাণ বাঁচানাের জন্য প্রবল আকুলতার মুখে চুপ করে থাকা কঠিন। ওদের মুখে শোনা গেল ট্যাংক প্রহরায় রাজারবাগের ঘুমন্ত পুলিশদের ওপর পাক-সেনাবাহিনীর আকস্মিক হামলার বর্বর কাহিনী ।

ওরা কেউ জানে না কতজন পালাতে পেরেছে, কতজন জান দিয়েছে। কেউ কেউ দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে পাঁচিল টপকেছে বা সামনের পুকুরে ঝাঁপ দিয়েছে। কিন্তু পুকুরে ঝাপ দিয়ে কি জান বাঁচানাে যায়? | ওরা জানে না সঙ্গীদের অবস্থা। সে রাতে পুলিশ তার পুলিশ হারিয়ে জাতীয় আশা-আকাক্ষার প্রতীক হয়ে ওঠে। সুশাসনের লক্ষ্যে প্রাণিত মানুষের সঙ্গে তাড়িত পুলিশের কোনো প্রভেদ চোখে পড়ে না পাড়ার বাসিন্দাদের। পুলিশের প্রতি সাধারণ বীতরাগ সে রাতে মানবিকবােধের উত্তাপে গলে উবে গিয়েছিল। রীতিমতাে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে তখনকার মতাে তাদের আশ্রয় দিতে হয়েছিল। | সেদিন অর্থাৎ ছাব্বিশে মার্চ সকালে ঢাকা রেডিওর নিয়মিত অধিবেশনে খবর পড়ার জন্য নির্দিষ্ট পাঠক-পাঠিকারও বােধ হয় অভাব পড়েছিল। হয়তাে তাই কোনাে মাদ্রাসা শিক্ষক বা ছাত্রকে ধরে আনা হয় সংবাদ পাঠের জন্য। পাঠকের উচ্চারণ-ভঙ্গি শুনে এমনটাই মনে হওয়ার কথা। অনভ্যস্ত, কাপাকাপা কষ্ঠে সামরিক আইনের প্রতিটি ধারার বর্ণনা, সামরিক নির্দেশ অমান্য করার কঠোর শাস্তি পুতস্বরে ঘােষণা এবং কিসে কিসে আইন লাগু হইবে এবং কিসে লাগু হইবে না’ সেই সব অদ্ভুত বাক্যবন্ধ থেকেও সংবাদপাঠককে বুঝে নিতে কষ্ট হয় নি।  নিউমার্কেটের উল্টো দিকে অবস্থিত ঈস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের সদর দফতর পিলখানার (নবাবী আমলের হাতিশালের) অবস্থাও রাজারবাগ থেকে খুব একটা ভিন্ন ছিল না। কারণ পাক-বাহিনীর অন্যতম প্রধান টার্গেট ছিল শহরের পশ্চিম প্রান্তের পিলখানা থেকে পূর্বপ্রান্তের রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স। ঠিক এ দুইয়ের মাঝখানে দাঁড়ানাে ছাত্র এলাকা ছাত্রাবাসসহ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। আর এর বাইরে টার্গেট ছিল পুরনো ঢাকার সংখ্যালঘু মহল্লা। পিলখানার বাঙালি ইপিআর সদস্যরা আকস্মিক আক্রমণ সত্ত্বেও অনেকেই সরে পড়তে পেরেছিলেন। পুলিশদের মতাে এতটা করুণ হয়ে ওঠে নি তাদের অবস্থা।

তবু এর মধ্যেও ব্যতিক্রমীরা হঠাৎ আক্রমণে জান দিয়েছে, কেউ  কেউ দক্ষিণে নতুন পল্টন লাইনের ঘিঞ্জি মহল্লায় আশ্রয় নিয়েছে। পিলখানার গেটের মুখে ঢাকাইয়া চা-দোকানি উর্দুভাষী বয়স্কা লালুর মা তার সাক্ষী। তাকে সন্দেহ করে নি পাকসেনারা তার উর্দুজবানের জন্য। সারারাত যে-মানুষটি স্ত্রী ও শিশু কন্যাসহ খাটের নিচে শুয়ে শুয়ে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের ওপর অবিশ্রাম গােলাগুলি বর্ষণের আওয়াজ শুনে অস্থির মুহূর্তগুলাে কোনােমতে পার করেছেন পরদিন সকাল থেকে তার প্রথম ও শেষ চিন্তা— এই ঢাকায় বসবাস কতক্ষণ নিরাপদ, বিশেষ করে স্ত্রী-কন্যা নিয়ে। ঢাকা ছেড়ে কোথাও যাওয়া মানে তাে দূরে পিতাপিতামহের গ্রামে। সেখানে যাওয়ার পথই বা কতটা নিরাপদ। এক প্রবল ভূমিকম্প যেন এক আঘাতেই ঢাকার বাঙালি জনসংখ্যার অস্তিত্ব কেন্দ্রচ্যুত করে ফেলেছে। যেমন প্রচণ্ড অসহায়তা ও নিরাপত্তার অভাব তেমনি সিদ্ধান্তেরও অনিশ্চয়তা। কমবেশি ঢাকার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর এমনটাই ছিল তাৎক্ষণিক মনােভাব। কিন্তু যাদের হিসাব-নিকাশের বালাই নেই, পিছুটানও নেই, তারা ঠিকই পথে বেরিয়ে এসেছে, সিদ্ধান্ত নিতে এতটুকু দেরি হয় নি, দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে হয় নি। কাফুর বন্দিদশা শেষ হবার পরমুহূর্তেই ২৭ মার্চ সকাল থেকে প্রথম সুযােগে ছুটতে শুরু করেছে ঢাকার বিশেষ শ্রেণীর মানুষ প্রধানত নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীন শহরতলির মানুষ। ভারী জিনিসপত্র ফেলে রেখে হালকা ও জরুরি কিছু জিনিস আর জানটা সঙ্গে নিয়ে ওরা সপরিবারে ঢাকা ছেড়ে পালাতে শুরু করে। সম্ভবত একমাত্র ভরসা গ্রামের উদ্দেশে। ওদের চোখে-মুখে আতংকের ছাপ। কারাে হাতে কোনাে রকমে দড়ি দিয়ে বাঁধা বিছানা-কাপড়, কারাে হাতে জংধরা টিনের বাক্স। ময়লা ফ্রকপৱা, নাকে নােলক ছােট একটি মেয়ের হাতে ঝােলানাে একটা লাল মােরগ (হয়তাে তারই আদরের পােষ্য)। কেন জানি মােরগটার গলায় রা নেই, বিভীষিকার ছায়া কি তাকেও স্পর্শ করেছিল।

এদের পেছনে অন্য একটি মেয়ের বগলে তেল-চিটচিটে বালিশ, বালিশটা ওর হাঁটার টানে কেবলি বগল থেকে পিছলে বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করছে। আর মেয়েটিও প্রাণপণে ওটাকে আঁকড়ে ধরে পথে চলছে। সেদিন সারাক্ষণ প্রায় একই ধরনের ছবি ঘরছাড়া আতংকিত মানুষের নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটে চলার ছবি। হয়তাে কারাে মনে পড়ে যেতে পারে পঞ্চাশের দাঙ্গার পর অনেকটা একই ধরনের ঘরছাড়া পলায়নপর অসহায় মানুষের কাফেলার কথা। তবে এসব নারীপুরুষ-শিশুর অধিকাংশই ছিল নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর।  কিন্তু পঁচিশে মার্চের তাণ্ডব থেকে জান বাঁচাতে পারা মানুষের সবাই যে সেদিন ২৭ মার্চের যাত্রায় গন্তব্য স্থলে পৌছাতে পেরেছিল তাই বা কে বলবে; তখনও পথে পথে নানা বাকে দাড়িয়ে ছিল মৃত্যুর দূত। সদরঘাট, ওয়াইজঘাট বা বাদামতলী ঘাটে শুধু ভয়ার্ত মানুষের ভিড়। নৌকোয় ওঠা নিয়ে কী ধ্বস্তাধ্বস্তি, কোনােমতে শহর ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষা। বুড়িগঙ্গায় মাঝনদীতে মানুষভর্তি নৌকোগুলাে দুলছে। আর সেদিকে লক্ষ্য করে প্রহরারত পাকজওয়ানদের দু’একজন নিছক রসিকতার ছলে গুলি করে নৌকা ডুবিয়ে দিয়ে দেখতে চেয়েছে লােকগুলাে সাতরে ওপারে পৌছাতে পারে কিনা। সত্যি দুঃস্বপ্নের শহর থেকে পালাতে গিয়ে সবাই ঘরে পৌছাতে পারে নি। আর নৌকাডুবির ঘটনাও গল্প নয়, প্রত্যক্ষদর্শীর অভিজ্ঞতা থেকে তুলে আনা।  

ছাত্র এলাকায় পাকবাহিনীর ছবিটা অনেক বিদেশী সংবাদদাতার লেখায় ফুটে উঠেছে। জগন্নাথ হলের সামনে গণকবর, ইকবাল হলের ধ্বস্ত চেহারা, কিন্তু আসে নি বাঙালির ভাষিক জাতীয়তাবােধের প্রতীক শহীদ মিনারের ভূলণ্ডিত করুণ ছবি হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে কংক্রিটের মানুষই যেন। হিসাব-নিকাশ করা আঘাতে বিধ্বস্ত হয় শহীদ মিনার। কদিন পর সেখানে তুলে দেওয়া হয়েছে এক উদ্ভট চালা ঘর গায়ে আঁকাবাঁকা উর্দুহরফে লেখা ‘মসজিদ’। সে মসজিদ অবশ্য টেকে নি। হয়তো শহীদ মিনারের প্রতিরূপ বলেই টেকে নি। কিন্তু হলুদ করবী আর পলাশ গাছে ঢাকা রমনা মাঠের কালীবাড়ি পাকবর্বরতার আঘাতে ঠিকই অদৃশ্য হয়ে গেছে, আর উঠে দাঁড়ায় নি। ঐ ন’মাসের মধ্যে অবশ্য নতুন করে গড়ে ওঠে নি রেল লাইনের ধারে, ফুটপাথের পাশে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া ঝুপড়িগুলাে। সাতাশে মার্চ ওদের দেখতে গিয়ে কারো। মুখে কথা ফুটবে না। চোখে পড়বে একরাশ ছাই, এখানে-সেখানে আগুনের মুখ থেকে রক্ষা পাওয়া ঘরগেরস্থালির দু’একটা আলামত ভাঙা টিনের মগ, একপাটি স্পঞ্জের স্যান্ডেল, এমনি দু’একটি ব্যবহৃত জিনিস। এছাড়া বসবাসের কোনো চিহ্ন নেই। ওরা পালিয়েছে, না পুড়ে ঝরেছে তারও কোনাে হদিস পাওয়া সম্ভব নয়। অবশ্য হদিস মিলেছিল হঠাৎ করে বায়তুল মােকাররম প্রাঙ্গণে দুস্থ চেহারার এক উদভ্রান্ত লােকের দেখা পেয়ে। পায়ে দগদগে পোড়া ঘাসহ মসজিদে আশ্রয় নিয়েছে। ওর জানা ছিল না যে মসজিদও পাক-সেনাদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার মতাে নিরাপদ আশ্রয় নয়। মসজিদে ঢুকে গুলি চালানাের একাধিক উদাহরণ ওরা রেখেছে। লােকটি বেরিয়ে এসেছিল চারপাশের অবস্থা খতিয়ে দেখতে এবং কিছু খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করতে।

ওর কাছেই জানা গেল ঝুপড়ি পােড়ানাের কাহিনী। জানা গেল পাক জওয়ানরা একদিক থেকে ঘুমন্ত ঝুপড়িতে আগুন দিয়েছে আর অন্যদিকে পঁড়িয়ে ছুটে বেরিয়েআসা লােকগুলাের ওপর গুলি চালিয়েছে নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিচারে। গ্রাম্য পদ্ধতিতে গর্তে আগুন ধরিয়ে দিয়ে সজারু মারার মতাে করে মেরেছে। | হ্যাঁ, ওরাই পাক-বাহিনীর ‘ট্রিগার হ্যাপি জওয়ান, পূর্বাহেই যাদের মগজ ধােলাইর কাজ শেষ করা হয়, এবং পরে যথাসময়ে অর্থাৎ পঁচিশে মার্চ রাতে শিকারি কুকুরের মতাে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মসজিদে আশ্রয় নেওয়া লােকটি নেহাৎ কপালগুণে বেঁচে আসে। কিন্তু লাশগুলাের কি হলাে? পােড়া ঝুপড়ির আশপাশে একটি লাশও তো দেখা গেল না।” সে খবর তার জানা নেই। সে শুধু জান বাঁচাতে ঝুপড়ির পেছন দিক দিয়ে ওদের নজর এড়িয়ে উদভ্রান্তের মতাে কোনােমতে ছুটে পালিয়েছে; পেছন ফিরে দেখার অবস্থা তার ছিল না। হয়তাে লাশ তুলে নিয়েছে ট্রাকে, এমন তাে ওরা হরদম করে থাকে। অবাক হওয়ার মতাে দৃশ্য সেদিন কম ছিল না ঢাকায়। যেমন ঝুপড়ি পােড়া ঘটনা। তেমনি কোনাে কোনাে ঘর-বাড়ি বা মহল্লার অবস্থা দেখেও মানুষ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। একমাত্র বিজাতীয় স্মৃণার আক্রমণে এমনটা সম্ভব। সিদ্ধেশ্বরী থেকে হাটখােলা রােড। পথে ‘ইত্তেফাক অফিসের দিকে তাকিয়ে মনে হতে পারে যেন বাজেপােড়া বাড়ি। (পরে অবশ্য ক্ষতিপূরণে ওদের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু সবার কি আর তেমন ভাগ্য হয়!)। সেখানে থেকে পুরনাে ঢাকার শাঁখারিবাজার, তাঁতীবাজার মহল্লার তস্য গলিতে।   

সেখানে এক অনুপ্ৰতিমের খোজখবর নিতে গিয়ে দেখা গেল পাক-সেনাদের সাম্প্রদায়িক জিঘাংসার রূপ। শেলের আঘাতে গায়ে গায়ে লাগানাে শাখারি পঠির ঘিঞ্জি বাড়িগুলাের কী বিধ্বস্ত চেহারা! কে যেন অবস্থার তুলনা টেনেছিলেন সাজানাে ঘরবাড়ি ও বাগানের ওপর দিয়ে পাগলা হাতির ছুটে যাওয়ার পরিণতির সঙ্গে। কিন্তু পাগলা হাতিও একলক্ষ্য ধরে চলে, নানান দিকে চলে না। পাক উন্মাদের দল পাড়ার কোনাে দিকে ছাড় দেয় নি। | এখানে চেহারাটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। কোনাে বাড়ির দেয়াল ভেঙে পড়েছে, কোনােটার অর্ধেক ছাদ ভেঙে অসহায় ভঙ্গিতে ঝুলে রয়েছে। বিসদৃশ বাকি অংশে লােহালক্কড় হাড়গােড়ের মতাে করুণ চোখে তাকিয়ে রয়েছে। ইট-রাবিশের তূপের নিচে সম্ভবত দু’একটি লাশও চাপা পড়ে আছে, দুর্গন্ধ থেকে যা অনুমান করা চলে। সব কিছু দেখে ক্ষয়ক্ষতিরও আন্দাজ করা সম্ভব। লাশ না থাকলেও এখানে সেখানে রক্তের দাগ, গুলির দাগ চোখে পড়ে, পড়ে কোনাে কোনাে বাড়িতে আগুনের সর্বনাশা চিহ্ন।  এমন ধ্বংসস্তুপের সামনে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা চলে না, দাঁড়ানাে নিরাপদ নয়। কে জানে পাক জওয়ানদের কাজ পুরােপুরি শেষ হয়েছে কিনা। সব কিছু দেখা না হলেও কিছু কিছু দেখেই উপলব্ধি করা চলে যে এতদিনকার চেনাজানা শহরটা কেমন হঠাৎ করেই দুঃস্বপ্নের শহরে পরিণত হয়ে গেছে। এমন দুঃস্বপ্নের রাজ্যে বাস করা কঠিন।

দু-একদিনের মধ্যেই বুঝতে পারা গেছে আপাত-শান্ত ঢাকা শহর এক সামরিক ছাউনিতে পরিণত হতে চলেছে, অনিশ্চয়তা, ভয় আর আশংকার সঙ্গে প্রতিদিন ঘর করা যেন ঢাকাবাসীদের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।  হয়তাে তাই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ অনেকেই এর মধ্যে শহর ছাড়তে শুরু করে। মার্চ মাস শেষ হতে হতে আর এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে নতুন ঢাকার একটি বড় অংশ গ্রামে উঠে যায়। গ্রামের মানুষ আড় চোখে চেয়ে দেখেছে দলে দলে দীর্ঘকাল পর গ্রামে আসা শহুরে মানুষগুলােকে সম্পন্ন, আধা-সম্পন্ন, হাফগেরস্ত মানুষজন সব। গৈ-গেরামের মানুষ ঐ তীর্থর্যাত্রা যে খুব একটা পছন্দ করেছে তা নয়— কে জানে ওদের পেছনে পেছনে পাক-বাহিনী গ্রামে এসে পৌছায় কিনা।  তবু ওরা নয়া অতিথিদের মেনে নিয়েছিল। অতিথিদের অনেকেরই গ্রামে ঘরবাড়ি রয়েছে পরিত্যক্ত সম্পদের মতাে। আবার অনেকে এসেছে ব্যক্তিগত পরিচয়ে, বন্ধুসুবাদে বা দূর আত্মীয়তার সুবাদে। একাত্তরের রাজনৈতিক ঘটনার মতাে প্রকৃতির আচরণও ছিল সেবার উদ্ভট। বাসন্তী চৈত্র হঠাৎ করেই প্রচণ্ড শীত নামিয়ে এনেছিল। গ্রামের ঘরে ঘরে ঐ শীতে লেপ-কম্বলের বদলে গরম চাদর মুড়ি দিয়ে রাত কাটানাের কষ্টও শহুরে উদ্বাস্তুদের কাছে স্বস্তিকর মনে হয়েছে। ঐ অস্বাভাবিকতার টানেই বােধহয় কিছুদিন পর নামে অকাল বর্ষা, মৌসুমি বর্ষণ আর ঢল। এভাবে কিছুদিনের জন্য হলেও ঢাকা শহর অনেকটাই ফাকা হয়ে যায়। কোনাে কোনাে বাড়িতে এক আধজন মানুষ, আবার কোনাে কোনােটি একেবারে জনহীন, ঘরের বাইরে তালা। বারান্দায় বা নিচে এক চিলতে উঠানে পােষা কুকুর পেটের জ্বালায় কুইকুই করে, কখনাে উদাস চোখে পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। যারা শহর ছেড়ে যায় নি বা যেতে পারে নি, তাদের জীবনযাত্রা যেন কাঁটাতারের ওপর দিয়ে হেঁটে চলা। ঘর থেকে বের হলে ফেরার নিশ্চয়তা নেই। সামরিক শাসনের ঘােষণায় ঢাকা সুশৃঙ্খল শহর, জীবন।  

যাত্রায় স্বাভাবিক। কিন্তু পথে বেরােলে প্রায়ই চোখে পড়ে ধাবমান সামরিক ট্রাকে বা পিকআপ-ভ্যানে দাঁড়ানাে চোখবাধা মানুষ যে ঐ ভাবে যায় সে আর ফিরে আসে না।  দিনটা তবু কোনােভাবে কাজকর্মে চলে যায়, কিন্তু রাতগুলাে বড় দীর্ঘ, বড় ভয়ঙ্কর। বাড়ির পাশে রাস্তায় জিপের আওয়াজ বা গাড়ি থামার শব্দে চমকে উঠতে হয়। এই বুঝি সবুট পদধ্বনি বারান্দায় এসে থামবে। তারপর কর্কশ কষ্ঠে দরজা খােলার জন্য নির্দেশ। এর পরের ঘটনা জানা, তবু জানা নেই। কোন বাড়িতে কোন জওয়ান যে কোন উপলক্ষে ঢুকে পড়বে তার ঠিকানা নেই। কখনাে মেয়ের খোঁজে, কখনাে সন্দেহভাজন তরুণের খোজে ওদের আসা-যাওয়া।  চাকরির মায়া ছাড়তে না-পারা বয়স্ক এক বাঙালি সজ্জন কি এক কাজে গিয়েছিলেন বুড়িগঙ্গার ধারে। জায়গাটা নির্জন। হঠাৎ তার চোখে পড়ে জড়াজড়ি করে বাঁধা পাঁচ ছয়টি লাশ, গুলিতে ঝাঁঝরা শরীর নিয়ে নিঃশব্দে ভেসে চলেছে। মনে হচ্ছিল লাশগুলাে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সম্ভবত সদ্য হত্যা করা লাশ, তাই প্রায় অক্ষত, শকুনি তখনাে খবর পায়নি।  কেমন যেন চেনা-চেনা মুখ। কোনােমতে ছুটেপালিয়ে আসেন সেখান থেকে। ঘরে ফিরেই অসুস্থ। ভাবেন : এবার পালাতে হবে। কিন্তু কোথায় পালাবেন, কদিনের জন্য পালাবেন। প্রবল অশান্তি নিয়ে প্রতীক্ষা—কবে এ বন্দিশিবিরে বসবাসের দিন শেষ হবে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ যারা শহর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন তাদের অনেকে ফিরতে শুরু করেছেন। না ফিরে উপায়ই বা কি, কতদিন কাজকর্মহীন গ্রামে পড়ে থাকা যায়। কিন্তু ফিরেও শান্তি নেই। অফিসে গিয়েও শান্তি নেই, স্বস্তি নেই। প্রতিদিনই একটা না একটা ঘটনার খবর কানে আসে আর ভয়ে শিউরে উঠতে হয়। প্রতিদিনই নির্যাতন বা মৃত্যু খবর হয়ে উঠতে শুরু করেছে। বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট মানুষ, সামাজিক মর্যাদার মানুষের অকারণ হত্যার খবর আসছে মুখে মুখে। শাসকদের আপাতআশ্বাসে ভর করে তাদের মধ্যে যারা এ মাটির টানে থেকে গিয়েছিলেন, উদ্বাস্তু হতে চান নি, তারা জীবনের বিনিময়ে ভুলের মাশুল গুনেছেন। যেমন কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের অধ্যক্ষ নতুন বাবু’র মতাে অনেকে। এ ছাড়াও সম্প্রদায়-নির্বিশেষে বাঙালি চেতনার মানুষজনকেও নানাভাবে দাম দিতে হচ্ছে। দিতে হচ্ছে স্থানীয় অবাঙালিদের প্রতিহিংসা-স্পৃহার কারণে। তারা এবার পালটা আঘাতে ক’মাস আগেকার অন্যায়ের প্রতিকার খুঁজে নিতে শুরু করেছে। নিচ্ছে বাকা পথেই। তাদের সহায় হয়ে উঠেছে পাক-সেনাদের অনুকম্পা, ভাষিক সহমর্মিতা। কাজে। লাগছে তাদের মগজ ধােলাই-করা মন্ত্র । এই পাকিস্তানে তাদের মূলমন্ত্র ছিল— ‘আমি নেহি মাংতা, মিষ্টি মাংতা’।

কাজেই এখানে পশ্চিম-পাকিস্তানের প্রতি অনুগত-বিশ্বস্তরাই বসবাস করবে, অন্যেরা অর্থাৎ বিরােধীরা নয়।  এমন অবস্থা কি দিনের পর দিন চলতে পারে? বাইরের পৃথিবী যতই বলুক অবস্থা এখন স্বাভাবিক (অবশ্য অধিকাংশ বিদেশী পত্রিকায় ভিন্নমত, ভিন্ন চিত্র প্রকাশিত হচ্ছে—  শুধু সাম্রাজ্যবাদী সরকারগুলােরই যা পাক-সমর্থক সুর), ঢাকাবাসী বাঙালি ঐ স্বাভাবিকতার চরিত্র প্রতিমুহূর্তে বুঝে নিচ্ছে। তাই পাক-বর্বরতার প্রতিক্রিয়া দ্রুতই দেখা দিতে শুরু করে। সে প্রতিক্রিয়া পাক-শাসনের প্রতি ঘৃণার ও ক্রোধে, প্রতিরােধ ও প্রতিকারের শপথে দৃপ্ত মূলত এ প্রতিক্রিয়ার সক্রিয় প্রকাশ তারুণ্যে। | তাই পাড়ার ছেলেগুলাের চোখে অচেনা চাহনি ফুটে উঠতে থাকে, চোয়ালে ধাতব কাঠিন্য। তারপর হঠাৎ একদিন ওদের আর দেখা যায় না। কোথায় গেল ওরা। ছাউনিতে, বধ্যভূমিতে? না, অচেনাপথের দুর্গম রক্তঝরা যাত্রায়? বলা কঠিন। কারণ কদিন আগে সিদ্ধেশ্বরী অশথ তলার ঠিক পাশের বাড়ি থেকে নিছক সন্দেহবশত, বিশেষ কারাে উস্কানিতে (অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিহারি বা বাঙালি জামাত) তিন তিনজন তরুণকে পাক-সেনারা ধরে নিয়ে গেল। গাড়িটা নিঃশব্দে এসে দাড়িয়ে ছিল বাড়ির সামনে, ওরা বুঝতে পারে নি। পারলেও কিছু করার ছিল না। ঐ বাড়ি থেকে লুকিয়ে বেরিয়ে যাবার দ্বিতীয় পথ নেই। সেই যে নিয়ে গেল ওরা আর ফিরে আসে নি। ওদের মা উদভ্রান্ত, মাত্র তিনটেই ছেলে তার  একসঙ্গে সব কজনকে হারিয়ে মা দেয়ালে মাথা কুটেছেন, চিৎকার করে কেঁদেছেন, এরপর নিঃশব্দ কান্না, ভেতরে রক্তক্ষরণ। কদিন পর মায়ের মস্তিষ্কবিকারের লক্ষণ দেখা দিয়েছে। এই হলাে স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ঢাকা। অবস্থা দেখে-শুনে পাড়ার অবশিষ্ট কজন তরুণ উধাও। বেঘােরে প্রাণ দেবার কোনাে অর্থ হয় না। বরং এ মাটির অধিকার রক্ষার জন্য প্রাণ দিতে পারায় রয়েছে এক ধরনের সার্থকতা। ঢাকাবাসীদের এভাবেই কাটে দুঃসময়ের দিন। প্রতিদিন কিছু না কিছু ঘটছে। জানে শুধু ঢাকাবাসীরাই।

কেমন করে যেন মুখে মুখে খবরগুলাে প্রত্যেকের কাছে পৌছে যায় । এখন বাঙালি-চেতনার মানুষের মধ্যে সংহতি বড় গভীর হয়ে দেখা দিতে শুরু করেছে। এসবই প্রতিক্রিয়ার ফল। অন্যদিকে তারুণ্যে জন্ম নিতে শুরু করেছে প্রতিরােধ ও প্রতিকারের অদম্য ইচ্ছা। কথিত গৃহযুদ্ধ এভাবেই বাঁক নিতে চলেছে স্বাধীনতা যুদ্ধের দিকে। শুধু ঢাকাই নয়, সর্বত্র দেশের স্নায়ুতন্ত্রীতে পরিবর্তনের সূচনা, দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের দিকে বাঁকফেরার মতাে চরিত্রবদলের ইঙ্গিত পশ্চিমা পত্রপত্রিকার দূরদর্শী ভাষ্যকারদের লেখায় দেখা দিতে শুরু করেছিল । বিষয়টাকে যত সহজ ও স্বতঃসিদ্ধভাবে জেনারেল ইয়াহিয়া ও তার সামরিক বাহিনী নিয়েছিল আসলে তা যে এত সহজ নয় এবং সমাধানও যে খুব সহজলভ্য নয় সে কথা জেনারেল ইয়াহিয়া বুঝতে না চাইলেও চোখ যাদের আছে তাদের দৃষ্টিতে ঠিকই ধরা পড়ছিল। একাধিক কাগজে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে চরমপথ ছেড়ে বিচক্ষণ পদক্ষেপ নেবার পরামর্শ দেওয়া হচিছল। এবং তা ২৫ মার্চের দিন কয় পর থেকেই। কারণ দূর থেকে সমস্যা-সংকটের আগপাশতলা ঠিকই বিশ্লেষকদের নজরে আসছিল।  ‘গার্ডিয়ান পত্রিকায় ২৯ মার্চ এক প্রতিবেদনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার উদ্দেশ্যে বলা হয় : ‘সেনাবাহিনীর পক্ষে কি ৭৩ মিলিয়ন জনসংখ্যাকে স্থায়ীভাবে দাবিয়ে রাখা সম্ভব, যেখানে দুই অঞ্চলের হাজার মাইল ব্যবধানের মধ্যে বসে আছে ভারত? এমন ভাবনা বােকামি।…সংক্ষেপে, ইয়াহিয়ার সিদ্ধান্ত ভুল হিসাব-নিকাশ ও মিথ্যাভয় থেকে উদ্ভূত।’ “Can the army hold 73 millions in check permanently across a thousand   miles of India? It is imbecile to consider it…. Yahyas decision, in short, stems from miscalculations and misapprehensions.” পরিস্থিতির এ ধরনের বিশ্লেষণের কারণ, তারা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন যে গােটা বাঙালি জাতি এখন স্বশাসনের দাবির পক্ষে। তাই পূর্ববঙ্গকে দমন করতে সাত বা সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যাকে দমন করার প্রশ্ন উঠবে। ‘দ্য টাইমস’ পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধেও একই ধরনের সন্দেহ প্রকাশ করে বলা হয়েছে, যে আপাতত শহরগুলাে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হলেও গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা বা তা ধরে রাখা। খুব একটা সহজ হবে না সেনাবাহিনীর পক্ষে। তাছাড়া রয়েছে গ্রামাঞ্চল-ভিত্তিক দীর্ঘ স্থায়ী গেরিলা যুদ্ধ শুরু হওয়ার সম্ভাবনা (২৯ মার্চ, ১৯৭১)। 

এমন কি এ পরিস্থিতির অর্থনৈতিক মূল্যায়ন করে ভাষ্যকারদের অনেকে কালাে রেখাই টেনেছেন। ‘সানডে টাইমূস’-এর ভাষায় এ যুদ্ধ প্রতিদিন লক্ষকোটি টাকা। ধ্বংস করছে। মাত্র দুই কোটির মতাে (১৭০ লক্ষ) ভিয়েতনামীকে দমন করতে গিয়ে। মার্কিন অর্থনীতি যদি বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে থাকে তাহলে সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে দমন করতে দুর্বল পাকিস্তানি অর্থনীতিকে কী পরিমাণ মাশুল গুণতে হবে? বৈদেশিক ঋণ ইতিমধ্যেই শেষ হয়ে গেছে। বর্তমান বিশৃঙ্খল অবস্থায় কোনাে দেশই পাকিস্তানকে অর্থ সাহায্য দিতে এগিয়ে আসবে না’ (১৮,৪,৭১)। | আবার এর মধ্যে দেখা দিয়েছে পাকিস্তানের জন্য নতুন সমস্যা। অর্থাৎ ক্রমশ সংগঠিত বাঙালি যােদ্ধাদের আক্রমণ, অনেকটা গেরিলা কায়দায়। আঘাত কর এবং পালিয়ে যাও’ পদ্ধতিতে। এর ফলে পাক-সেনাবাহিনী ক্রমশ বৃহত্তর সমস্যার মুখে পড়তে পারে। এমনি একাধিক কারণে পশ্চিম পাকিস্তান কয়েক মাসের মধ্যেই যে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে যাচ্ছে সে বিষয়ে সবাই একমত’ (সানডে টাইমস)। ঐ ‘সানডে টাইমস’-এরই নিজস্ব ভাষায় “The war is using up millions of rupees daily. If the cost of holding down 17 million Vicetnamese nearly ruined the American economy, what will the cost of holding down 75 million Bengalis do to the fragile Pakistan economy? The foreign loans…. have dried up, because, no one will hand over money to a country half in chaos.”

এর সঙ্গে যােগ দিয়েছে গােদের ওপর বিষফোঁড়া। সেনাবাহিনীর বিভিন্ন শাখায়। বিশেষ করে বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীতে কর্মরত বাঙালি সদস্যদের নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে। সমস্যা। তাদের মধ্যে বিদ্রোহের পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সব দিক বিচার করে ‘সানডে টাইমস-এর সিদ্ধান্ত : “For these and many other reasons, it is generally agreed that West-Pakistan is headed for virtual economic collapse within months.” এ ভবিষদ্বাণী অচিরে সত্য হয়ে ওঠে।  পাকিস্তানের যুদ্ধ ও অর্থনৈতিক সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমা সংবাদ ভুবনের অনেকেই অবস্থা সরেজমিনে দেখে নিতে ঢাকায় আসতে শুরু করেন। পাকিস্তান সরকারও আর আগের মতাে হুমকি দিয়ে পথ রুখে দাঁড়ানাের মতাে অবস্থায় নেই। এ অবস্থায় একদিন বর্তমান দোয়েল চত্বরের কাছে দেখা গেল নাকয় বিদেশী নারী-পুরুষ উৎসুক চোখে এদিক-ওদিক দেখছে। ওদের পরনে জিনস, কাধে মুভি ক্যামেরা। পরিচয় দিল  ওরা সিবিসির (কলম্বিয়া ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের) সাংবাদিক।  ওরা গৃহ যুদ্ধ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মতামত জানতে চায়, জানতে চায় মার্কিনভূমিকা সম্পর্কে তারা কি ভাবে? এমন কি জানতে চাইল, বর্তমান সংঘাতের অবশেষ পরিণতি সম্পর্কে এদেশীয় মানুষজনের ধারণা? আলােচনা ও সমালােচনার পরিপ্রেক্ষিতে ওরা কিছু নােটস নিয়ে ও ছবি তুলে বিদায় নিল। এবং শেষ মুহূর্তে জানাতে দ্বিধা করে নি যে এ খেলায় পাকিস্তানের জেতার সম্ভাবনা কমই। আসলে বিষয়টা বােধহয় ওদের কাছে গােপন ছিল না যে প্রথম পর্বের সাফল্য ঘরে তােলার পর প্রতিরােধ ও পালটা আঘাতের মুখে পাকিস্তানের অবস্থান ক্রমে নড়বড়ে হতে শুরু করেছে। ক্রমশ আরাে হবে বাঙালি তরুণযােদ্ধাদের সংগঠিত হবার পরিপ্রেক্ষিতে। এর মধ্যেই একদিন শােনা গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদা-ছাত্রি যে যুবাটি মাস্তান হিসাবে স্বনামখ্যাত ছিল সে একটি জিপের মধ্যে সাব-মেশিনগান বসিয়ে ঢাকা। শহরে যেখানে-সেখানে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে ছােটখাটো “অ্যামবুশ’ চালিয়ে তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে উঠেছে। আর নিঃশব্দ বাহবা কুড়িয়ে চলেছে ঢাকার অধিকাংশ বাঙালির। কিন্তু এ অ্যাডভেঞ্চার টেকে নি। দুঃসাহসী সে যুবা পাক-সেনাদের হাতে ধরা পড়ে সেনাছাউনিতে অকথ্য নির্যাতনের শিকার। ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। | তাই পাক-সামরিক প্রশাসন যতই দাবি করুক, বিশ্ববাসীর কাছে যতই প্রমাণ করতে চেষ্টা করুক ঢাকা (এবং পূর্ব-পাকিস্তান) স্বাভাবিক আর পাঁচটা নগর বা দেশের মতাে, আসলে তা মােটেই সত্য ছিল না।

ঢাকার আপাত-শান্তরূপের অন্তরালে তখন বয়ে চলেছে স্রোতের সংঘাত, সেখানে স্থিরতার কোনাে লক্ষণ নেই। মানুষের আপাতস্থির অভিব্যক্তির পেছনে রয়েছে অস্থিরতা, ক্ষোভ আর ক্রোধের অস্তিত্ব রয়েছে যে কোনাে মূল্যে লক্ষ্য অর্জনের ইচ্ছা সে লক্ষ্য স্বশাসন প্রতিষ্ঠা।  মানুষ তাই দুই অস্তিত্ব নিয়ে জীবনযাপন করেছে। তার আপাত-শান্তরূপের ভেতরে। অন্য এক কাপের অস্তিত্বই প্রধান। সে পাকিস্তানি শাসকশ্রেণীকে বিশ্বাস করে না, পাকবেতারের প্রচার বিশ্বাস করে না, তাই শহরবাসী সাধারণ মানুষও পাকিস্তান বেতারের ভাষ্য শুনতে নারাজ। ঘরে ঘরে মানুষ সংগােপনে বিবিসি আর দূরদর্শনের খবরের ওপর নির্ভর করে, শােনে সন্তর্পণে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদাদি। এগুলােই তাদের দিন যাপনের খােরাক, জীবনযাত্রায় ও জীবনধারণে শক্তি-সাহসের উৎস। পঁচিশে মার্চের অন্ধকার পটভূমিতে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এভাবে ঢাকার পরিবর্তন। ঘটতে শুরু করে, পরিবর্তন ঘটতে থাকে গােটা দেশেরও চারিত্রভিত্তিতে। সিংহভাগ মানুষ ভাবছে দুঃসময়ের এবং দুঃস্বপ্নের ঢাকা ক্রমশ দিনবদলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে প্রধানত দেশের তারুণ্য ও যৌবশক্তির ওপর নির্ভর করে। বাকি মানুষজন তাদের সহায়ক শক্তি যা সম্ভাব্য গেরিলা যুদ্ধের পক্ষে অনুকূল বাস্তবতা তৈরি করবে। গেরিলা যুদ্ধের সম্ভাবনা বাস্তবে ধরা দিক বা না-দিক সেদিকে তাকিয়ে রয়েছে মানুষের প্রত্যাশা। বন্দিশিবির ঢাকায় একজন বা অন্য যে কোনাে জন নাগরিকের ২৫ মার্চ-পরবর্তী অভিজ্ঞতা এমন উপলব্ধিরই প্রকাশ ঘটায়, এমন আকাঙক্ষা নিয়েই সে বেঁচে থাকে, থাকে একদিন। থেকে প্রতিদিন।  

সূত্র : একাত্তরে পাকবর্বরতার সংবাদভাষ্য – আহমদ রফিক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!