You dont have javascript enabled! Please enable it!

বিদেশী চোখে পাক-অপারেশন  গৃহযুদ্ধের সূচনা

পাকিস্তান সেনাবাহিনী পঁচিশে মার্চ মধ্যরাতে প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকায় তাদের পূর্ব নির্দিষ্ট স্থানগুলােতে অর্থাৎ তাদের হিসাবে চিহ্নিত বাঙালি রাজনীতির শক্তিকেন্দ্রগুলাের ওপর আকস্মিক প্রচণ্ড হামলা চালায়। উদ্দেশ্য গােটা প্রদেশের রাজনৈতিক চেতনার স্নায়ুকেন্দ্র-শক্তিকেন্দ্র পুরােপুরি ধ্বংস করা (ওদের সামরিক পরিভাষায় ‘নিউট্রালাইজ’ করা) যাতে বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতি আর মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। তাদের হিসাবে বাঙালি জাতীয়তার উৎস ছিল বাঙালি ছাত্র-বুদ্ধিজীবী-শিক্ষিত শ্রেণী আর হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। ধারণাটা জেনারেল নিয়াজির মতাে অতি উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসারও গােপন করেন নি। পূর্বাঞ্চলীয় সেনাবাহিনীর দায়িত্বভার গ্রহণ করার সময় সামরিক অফিসারদের সঙ্গে আলােচনা প্রসঙ্গে কথাটা বলেই ফেলেন তিনি। পাক-সামরিক প্রশাসনের ঐ ধারণা পুরােপুরি সঠিক ছিল না। পূর্ববাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছিল বিস্ময়জনক দ্রুততায়। দীর্ঘস্থায়ী সামরিক শাসনের প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট বিরূপতা এবং বিশেষ করে উনসত্তর থেকে সংঘটিত আন্দোলন ও সংশ্লিষ্ট ক্ষুব্ধ রাজনীতির প্রভাবে বাঙালি জনমানসে আর্থ-রাজনৈতিক স্বশাসনের ইচ্ছা প্রবল হয়ে উঠতে থাকে। এ অবস্থায় একাত্তরের শুরুতে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে সামরিক শাসনের টালবাহানা রাজনীতি-সচেতন মানুষের সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। দেশব্যাপী মানুষ তখন অস্থির, বেপরােয়া। কিছু একটা ঘটানাের জন্য উপলক্ষ খুঁজে ফিরছে। জননেতা তাদের রাশ ধরে রাখছিলেন শান্তিপূর্ণ সম্ভাবনার প্রত্যাশা জাগিয়ে রেখে। এ বাস্তব অবস্থাটা উপস্থিত সামরিক শাসকদের কাছে খুব স্পষ্ট ছিল না, ছিল নাপ্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও তার আর্মি ইন্টেলিজেন্সের কাছেও। তাই সামরিক প্রশাসন শক্তি প্রয়ােগই সঠিক মনে করে ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর পরিকল্পনা ঢের আগেই চূড়ান্ত করে। সর্বাধিক গুরুত্ব আরােপ করে অপারেশন’ ঢাকার ওপর। কারণ ঢাকা জব্দ হওয়ার অর্থ গােটা প্রদেশ ও বাঙালি জনতার জব্দ হওয়া। ঢাকার বাইরে শহরগুলাে থেকে চটজলদি পালটা আঘাত আসতে পারে বলে তারা ভাবে নি। অবশ্য তাদের পরিকল্পনায় গােটা প্রদেশ জব্দ করার ব্যবস্থাই ছিল, এবং তা ঐ ২৫ মার্চে, একই সঙ্গে; অবস্থার ফেরে হয়তােবা সামান্য দেরিতে।

কিন্তু এর মধ্যেই দলত্যাগী বাঙালি সেনা বা ইপিআর ও পুলিশ যে যেখানে পেরেছে ঢাকাই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায়    পালটা আক্রমণ চালিয়ে শহর দখল করেছে। কিন্তু ধরে রাখতে পারে নি। শেষ পর্যন্ত পাক-প্রশাসনের হিসাবই মিলেছে, তবে অপ্রত্যাশিত ক্ষয়ক্ষতির বিনিময়ে। পরিস্থিতি বিচারে ভাবতে অবাক লাগে যে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল এতটা। জনসমর্থন সত্ত্বেও অবস্থার সঠিক মূল্যায়ন করতে পারে নি এবং সে অনুযায়ী যথাযথ ও সময়মাফিক সুযােগ নিতে পারে নি। বাঙালি সেনা সদস্য (ঈস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট), আধাসামরিক ইপিআর (ঈস্ট বেঙ্গল রাইফেলস), আনসার ও পুলিশ সমন্বয়ে এত বড় একটা শক্তি পূর্বাহ্বে সংগঠিত করার কথা কেউ ভাবে নি। যেটুকু করা হয়েছিল তাও খুব সীমাবদ্ধ বৃত্তেই ধরা ছিল। চেষ্টা চলেছে রাজপথে লাঠি বৈঠার মিছিল, ডামিবন্দুক কাঁধে মার্চ, জঙ্গি সমাবেশে উত্তেজক স্লোগানের সাহায্যে শক্তিপ্রদর্শন করার (যাকে বলে শাে অব স্ট্রেংথ)। না, ঐ শক্তিপ্রদর্শনে পাক-শাসন ভয় পায় নি। তবে ঐ শক্তির অতিমূল্যায়ন করেছে। তাই আক্রমণের আয়ােজনটাও ছিল বেশি। আঘাতের তীব্রতা ও ভয়াবহতা ছিল অতিরিক্ত মালার । হয়তাে এজন্যই তারা স্বদেশী জনতার ওপর তাদের আক্রমণের ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির সঠিক বিবরণ বিশ্ববাসীকে জানতে দিতে চায় নি। আর চায় নি বলেই ঢাকায় উপস্থিত বিদেশী সাংবাদিকদের অস্ত্রের হুমকিতে তাদের হােটেল কক্ষে আটকে রাখে, বেরােতে দেয় নি পঁচিশ মার্চ রাতে, এমন কি পরদিনও। এরপর সবাইকে জড়ো করে একসঙ্গে বিমানে তুলে দিয়ে করাচির পথে পাকিস্তানের বাইরে পাঠিয়ে দেয়। পাক-সামরিক শাসকদের বিশ্বাস ছিল এভাবে বিদেশী পত্রপত্রিকায় তাদের ‘অপারেশন’-বিষয়ক খবরাদি প্রকাশ বন্ধ করা যাবে। কারণ দেশে তখন সংবাদপত্রের ওপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা, যাকে বলা হয় প্রেস সেন্সরশিপ’। দেশী পত্রপত্রিকায় সামরিক তৎপরতার কোনাে খবরই ছাপা হবে না, হবে শুধু নিত্য-আরােপিত সামরিক আইনের বিধি, উপবিধিসমূহ, আর কর্তাব্যক্তিদের ভাষণ। প্রকৃতপক্ষে এমনটাই তখন ঘটেছে। তখনকার কাগজগুলাে উলটে দেখলে তা বােঝা যায়। সামরিক শাসকদের এ কার্যক্রমের মূল উদ্দেশ্য ছিল দুটো। এক, সেনাবাহিনীর অপারেশনের চালচিত্র বিশ্ববাসীকে জানতে না দেওয়া, যে কথা আগেই বলা হয়েছে। দুই, এই সূত্রে বিশ্বজনমতকে বিভ্রান্ত করা যে নিছক বিদ্রোহ থামাতে সামান্য শক্তিই প্রয়ােগ করা হয়েছে এবং এর দায় স্থানীয় রাজনীতিকদের, যাদের একগুয়েমিতে সমঝােতা সংলাপ ভেঙে পড়েছে।

দেশে নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা ও সংঘর্ষ সৃষ্টির জন্য ঐসব রাজনীতিকই দায়ী। সামরিক সরকার সেনাবাহিনীর সাহায্যে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ও বৈধ শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে। এ কথাগুলােই প্রেসিডেন্টের ২৬ মার্চের ভাষণে যুক্তিসঙ্গত করে তােলার চেষ্টা হয়েছিল। অর্থাৎ বিশ্বে ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীর একটি গ্রহণযােগ্য ও যুক্তিসঙ্গত ভাবমূর্তি তৈরি করাই ছিল এসব চাতুর্যের উদ্দেশ্য। কিন্তু সংলাপ সম্পর্কে ইয়াহিয়ার ভাবমূর্তি তৈরি করা সম্ভব হলেও, বিদেশী প্রেসকে প্রভাবিত করা গেলেও অপারেশনের চালচিত্র রচনার ক্ষেত্রে শেষ রক্ষা হয় নি। প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় নেওয়া রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকদের মাধ্যমে সংবাদ পাচার হওয়ার ফলে। বিদেশী সংবাদদাতাদের মধ্যে সাইমন ড্রিং ও প্রেস ফটোগ্রাফার মাইকেল  লরেন্ট পাক-সেনাদের চোখ এড়িয়ে হােটেলে থেকে যান প্রধানত হােটেলের বাঙালি কর্মচারীদের সহায়তায়। এরা দুজন হােটেল ইন্টারকনের ছাদে উঠে যদূর সম্ভব চারদিকের অবস্থা দেখে নেন, পরে কার্টু তুলে নেওয়ার সুযােগে শহর ঘুরে অপারেশনের আলামত লক্ষ্য করেন ও ছবি তােলেন। শেষপর্যন্ত বিমানযােগে করাচি হয়ে ব্যাংকক পেীছে ঐসব ঘটনার সচিত্র প্রতিবেদন কাগজে ছাপার জন্য পাঠান যা ‘দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এ প্রকাশিত হয়। এদের পাঠানাে সংবাদ প্রতিবেদনই ছিল পাক-সামরিক ‘অপারেশনের প্রথম তথ্য নির্ভর বিবরণ, যা পড়ে বিশ্ববাসী স্তম্ভিত হয়ে যায়।  ঐ প্রতিবেদনের শিরােনাম : ট্যাঙ্কের সাহায্যে পাকিস্তানে বিদ্রোহ দমন। ৭০০০ খুন : বাড়িঘর ভস্মীভূত’ (‘Tanks Crush Revolt in Pakistan/7000 slaughtered; Homes burned’)। প্রতিবেদনের সূচনাও বেশ চমকপ্রদ : আল্লাহর নামে, অখণ্ড পাকিস্তানের নামে ঢাকা আজ এক বিধ্বস্ত ও আতঙ্কিত নগরী। ঠাণ্ডা মাথায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্মম গােলাবর্ষণের ফলে ৭ হাজার মানুষ নিহত, বিশাল এলাকা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং পূর্ব-পাকিস্তানের স্বাধীনতা সংগ্রাম বর্বরতার সঙ্গে শেষ করা হয়েছে। (“In the name of God and united Pakistan, Dacca is today a crushed and frightened city. After 24 hours of ruthless, coldblooded shelling by units of the Pakistan Army as many as 7,000 people are dead, large areas of the city have been leveled and East Pakistan’s fight for independence has been brutally ended”) সাইমনের ভাষ্য মতে “ঠিক কতজন নিরীহ মানুষ এ পর্যন্ত প্রাণ দিয়েছে সে হিসাব করা খুবই কঠিন। তবে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে খবর আসা শুরু হয়েছে।

ঢাকাসহ চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও যশােরের হিসাব একত্র করা হলে মৃতের সংখ্যা ১৫ হাজারের মতাে দাঁড়াবে। সামরিক অভিযানের ভয়াবহতা যথাযথভাবে নির্ধারণ করা চলে ছাত্র বিছানায় মৃত, কসাই তার দোকানের পেছনে নিহত, নারীশিশু তাদের ঘরে জীবন্ত দগ্ধ আর হিন্দু ধর্মাবলম্বী পাকিস্তানিদের ঘর থেকে টেনে বের করে এনে একসঙ্গে গুলি করে মারার মতাে ঘটনায়। বহু বাড়িঘর রাজারহাট দোকানপাট আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং নগরীর প্রতিটি বাড়ির ওপর এখন পাকিস্তানি পতাকা উড়ছে।  ‘পচিশে মার্চ রাতে ঢাকার রাজপথে চলমান ট্যাঙ্ক বহরের প্রথম লক্ষ্য ছিল ছাত্র সমাজ। ঢাকা আক্রমণে তিন ব্যাটালিয়ান সৈন্য ব্যবহার করা হয় এর মধ্যে একটি সাঁজোয়া, একটি গােলন্দাজ ও একটি পদাতিক। …শেখ মুজিবকে টেলিফোনে সতর্ক করে বলা হয় শহরে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, কিন্তু তিনি গৃহত্যাগ করতে অসম্মতি জানিয়ে বলেন: আমি আত্মগোপন করলে ওরা আমার খোঁজে গােটা ঢাকা শহর জ্বালিয়ে দেবে’ (এ ধারণা কতটা ঠিক ছিল তা বিবেচনার বিষয়)।  ‘বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত আমেরিকার দেওয়া এম-২৪ ট্যাঙ্কের ছত্রছায়ায় মধ্যরাতের পর এক কলাম সৈন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রবেশ করে। সৈন্যরা ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি দখল করে সেখান থেকে কাছাকাছি ছাত্রাবাসগুলাের দিকে গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এ আকস্মিক অভাবিত হামলায় সরকার-বিরােধী জঙ্গি ছাত্র আন্দোলনের খাটি   হিসাবে পরিচিত ইকবাল হলে প্রায় ২০০ জন ছাত্র নিহত হয়। “দু’দিন পরও দেখা যায় অগ্নিদগ্ধ কক্ষে আধপােড়া লাশ, বারান্দায় ও মাঠে ইতস্তত পড়ে-থাকা লাশ, সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় লাশ ভাসছে নিকটস্থ পুকুরে। চিত্রকলার জনৈক ছাত্রের লাশ তার ইজেলের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে, ৭ জন শিক্ষক তাদের। বাসস্থানেই নিহত, আর আউটহাউসে লুকিয়ে-থাকা এক পরিবারের ১২ জন সদস্যকে গুলি করে মেরে ফেলে রাখা হয়েছে। …অন্য একটি ছাত্রাবাসে নিহতদের দ্রুত-খােড়া। গর্তে মাটি চাপা দিয়ে ট্যাঙ্কের সাহায্যে ওপরের মাটি সমান করে ফেলা হয়।’ (এ। বিবরণটি মেজর সালিকের বর্ণনার সঙ্গে মেলে)।

‘বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বাসিন্দা লােকজনও আক্রমণ থেকে রেহাই পায় নি। রেললাইন বরাবর ২০০ গজ এলাকার সব ঝুপড়ি পুড়িয়ে ফেলা হয়। কাছাকাছি একটা। বাজারেরও একই দশা। ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা দোকানের লােকজন গুলিতে প্রাণ হারায়। দুদিন পর বাইরে বের হওয়ার সুযােগে এসব দৃশ্য দেখা সম্ভব হয়েছিল। তখনাে ঐ (নিহত) অনেককে দেখা গেছে কাঁধ পর্যন্ত টানা কম্বলের ভেতর শুয়ে থাকতে, যেন তারা ঘুমিয়ে আছে।  ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর যখন আক্রমণ চলছে তখনই আরেক দল সৈন্য। শহরের অন্যপ্রান্তে অবস্থিত পূর্ব-পাকিস্তান পুলিশের সদর দফতর রাজারবাগের দিকে এগিয়ে গেছে। প্রথমে ট্যাঙ্ক থেকে গােলা বর্ষণ করা হয়, পরে সৈন্যরা ভেতরে ঢুকে আগুনে বােমা ছুড়ে ঘুমন্ত পুলিশ ব্যারাক মাটিতে মিশিয়ে দেয়। ঐ হামলায় ঠিক কতজন মারা যায় তা বিপরীত দিকে অবস্থিত বাড়ির বাসিন্দারাও সঠিক বলতে পারেন নি। মনে হয় সে সময় রাজারবাগে অবস্থানরত ১১০০ জন পুলিশের মধ্যে অল্পসংখ্যকই রেহাই পেয়েছিল।  রাত ১টার পর একটি ট্যাঙ্ক, একটি সাঁজোয়া গাড়ি এবং ট্রাকভর্তি সৈন্য গুলি। ছুড়তে ছুড়তে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি ঘেরাও করে। হাঁকডাক করে এক অফিসার তাকে নিচে নেমে আসতে বলে গ্রেফতারের জন্য। শেখ তৈরিই ছিলেন। তাকে নিয়ে ওরা দ্রুতই চলে যায়, এ খবর জনৈক প্রতিবেশীর। …শুক্রবার রাত দুটো নাগাদ (আমাদের বাংলা সময়ের হিসাবে বৃহস্পতিবার রাত দুটো) সারা ঢাকা শহরে আগুন জ্বলছে, সৈন্যরা বিশ্ববিদ্যালয় ও সংলগ্ন এলাকা দখল করে নিয়েছে। তারা তখন লুকিয়ে থাকা ছাত্রদের খুন করতে এবং (বাংলাদেশের স্বাধীনতার পতাকা বদলে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা উঠাতে ব্যস্ত। ‘ইন্টারকন্টিনেন্টাল হােটেলের উল্টো দিকে অবস্থিত ‘দ্য পিপল’ পত্রিকার শূন্য অফিসে এক প্লাটুন সৈন্য ঢুকে পড়ে এবং আশপাশের বাড়িসহ সব পুড়িয়ে দেয়। সেখানে উপস্থিত একজন নৈশপ্রহরীকে তারা খুন করে। ভোরের কিছুটা আগে গোলাগুলি বর্ষণ প্রায় বন্ধ হয়ে আসে। সূর্য ওঠার পর শহরে এক অদ্ভুত স্তব্ধতা নেমে আসে যেন।

এক পরিত্যক্ত, সম্পূর্ণ মৃত এক শহর। কাকের ডাক আর মাঝে মাঝে নির্মূল অভিযানে ব্যস্ত সৈন্যবােঝাই যানবাহনের চলাচল ও দু-তিনটে ট্যাঙ্কের ঝমঝম শব্দ ছাড়া চারদিকে স্তব্ধতাই বিরাজ করছিল।  কিন্তু চরম অবস্থার তখনও বাকি ছিল। বেলা ১২টা নাগাদ কোনাে সতর্কতা সঙ্কেত ছাড়াই আবার সারি সারি সৈন্য পুরনাে শহরের পথে নেমে পড়ে। সেখানে আঁকাবাঁকা সঙ্কীর্ণ অলিগলিতে দশ লক্ষাধিক লােকের বাস। পাকসেনারা পরবর্তী ১১ ঘন্টা ধরে ‘পুরনাে শহরের ব্যাপক এলাকায় হিসাব-নিকাশ করে তাদের ধ্বংসযজ্ঞের তাণ্ডব চালায়। BAR R IT ( 971): “It is impossible accurately to assess what all this has so far cost interms of innocent human lives, but reports begining to filter in from the outlying areas. Chittagong, Comilla and Jessore put the figure, including Dacca, in the region of 15,000 dead. Only the horror of the military action can be properly gauged the students dead in their beds, the butchers in the markets killed behind their stalls, the women and children roasted alive in their houses, the Pakistanis of Hindu religion taken out and shot enmasse, the bazars and shopping areas razed by fire and the Pakistani flag that now flies over every building in the city. “The first target as the tanks rolled into Dacca on the night of the 25th was the students.” An estimated three battalions of troops were used in the attack on Dacca- one armoured, one artillery and one infantry…. “Led by American-supplied M24 World War II tanks, one column of troops sped to Dacca University shortly after midnight. Troops tookover British Council Library and shell nearby dormitory areas. Caught completely by surprise some 200 students were killed in Iqbal Hall, headquarters of the militantly anti-Government Students’ Union.” ACE CORT ACT 14

আক্রমণ বা প্রতিরােধের কোনাে পূর্বপ্রস্তুতিই ছিল না। “Two days later, bodies were still smouldering in their burnt-out rooms, others were scattered outside, more floated in a nearby lake, an art student lay sprawled across his easel, seven teachers died in their quarters and a family of 12 were gunned down as they hid in an outhouse….At another hall, the dead were buried by the soldiers in a hastily dug massgrave and then bulldozed over by tanks. “People living near the University were caught in fire, too, and 200 yards of shanty houses along side a railway line were destroyed during the attack. Army patrol also razed a market area, running between the stalls killing their owners as they slept. Two days later, when it was possible to get out and see all this, some of the men were still lying as though asleep, their blankets pulled up over their shoulders. “By 2 a.m. on Friday morning fires were burning all over the city, troops had occupied the University and surrounding areas and were busy killing off students still in hiding and replacing independence flags with Pakistani national flags. … Shortly before dawn most firing had stopped and as the sun came up an eerie silence settled over the city, deserted and completely dead except for the noise of crows and occasional convoy of troops or two or three tanks rumbling on mopping up operations.  

শুধু ছাত্র এলাকা এবং তার আশপাশই নয়, সাইমন পুরাে ঢাকা শহরই যে ঘুরে। ফিরে দেখেছিলেন, এবং বিশেষ করে পুরনাে শহর এলাকাও তা তার বিবরণে স্পষ্ট, এবং এতে অতিরঞ্জন আছে বলে মনে হয় না। সে সময়কার ঢাকাবাসীদের অভিজ্ঞতা তার বিবরণের পক্ষেই সমর্থন যােগায়। তার ভাষায় “But the worst was yet to come. At 12 noon, again without warning, columns of troops poured into the old section of the city where more than a million people live in a sprawling maze of narrow winding streets. For next 11 hours they proceeded to systematically devastate large areas of the “Old Town.” One of the biggest massacres of the entire operation in Dacca took place in the Hindu area of the old town. There the soldiers made the people come out of their houses and then just shot them in groups. This too was evantually razed. The troops stayed on in the old city in force until about 11 p.m. on Friday, driving about with local Bengali informers. The soldiers would fire a flare and the informer would point out the houses of staunch Awami League supporters. The house would then be destroyed- either with direct tank or recoilless rifle fire or with a can of petrol.”

অস্বীকার করা যাবে না যে পাক-সেনাবাহিনীর হাতে ঢাকা ‘অপারেশনের অন্যতম প্রধান হত্যাযজ্ঞটি সম্পন্ন হয়েছিল পুরনাে ঢাকার হিন্দু মহল্লায়। যেমনটা আগে বলা হয়েছে, যেভাবেই হােক পাক-শাসকশ্রেণীর মধ্যে এমন ধারণা জন্মেছিল যে পূর্ববঙ্গের হিন্দুরাই প্রধানত বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা, আর তাদের সঙ্গে রয়েছে কিছু পথভ্রষ্ট মুসলমান ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী। তাই ওদের ঘৃণা ও আক্রোশের প্রায় সবটাই উপচে পড়ে ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর। আঘাতের বর্বরতা ঐ সম্প্রদায়ের ওপর দিয়ে গেছে সবচাইতে বেশি। স্বাধীনতার মাশুল পরবর্তী ন’মাসেও জীবন ও রক্ত দিয়ে তাদেরই দিতে হয়েছে অপেক্ষাকৃত বেশি।ট্র্যাজেডি যে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জনসংখ্যা এ ভয়াবহ সত্য স্বীকার করে কম, মনেও রেখেছে সামান্যই। | তাই সাইমনের বিবরণ অনুযায়ী (অন্য প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণও ভিন্ন নয়) দেখতে পাওয়া যায় শাখারিবাজার, তাঁতীবাজার এলাকায় পাকসৈন্যের নারকীয় তাণ্ডবলীলা। “সেখানে বাসিন্দাদের ঘর থেকে বের করে দলবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে স্রেফ গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। তারপর সেসব বাড়িঘর ধ্বংস করে দেওয়া হয়। পুরনাে ঢাকায় ওরা শুক্রবার রাত ১১টা পর্যন্ত ওদের কার্যকলাপ চালিয়েছে। সঙ্গে বাঙালি ‘ইনফর্মার’। সৈন্যরা আলােকবর্তিকা ছোড়ার পর ঐসব ইনফর্মার কট্টর আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বাড়িগুলােকে শনাক্ত করে দিয়েছে। তারপর সৈন্যরা ট্যাঙ্কের গােলায় বা রিকয়েললেস রাইফেলের গুলিতে অথবা টিন ভর্তি পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে ঐসব বাড়িঘর ধ্বংস করেছে।  “এসব এলাকায় রােববার সকাল পর্যন্ত গােলাগুলি চলেছে। তবে মূল ‘অপারেশন শুক্রবার মধ্যরাতের মধ্যেই শেষ করা হয়েছে, সুচনা-সময় থেকে ঠিক ২৪ ঘন্টার মধ্যে। এর মধ্যে তাদের অন্যতম শেষ টার্গেট বাংলাভাষিক দৈনিক পত্রিকা ইত্তেফাক’। চারশ’রও বেশি লােক আক্রমণ শুরু হওয়ার পর সেখানে আশ্রয় নিয়েছিল।

শুক্রবার  বিকেল ৪টার সময় চারটি ট্যাঙ্ক সেখানে রাস্তার পাশে এসে দাঁড়ায়। আর ঠিক সাড়ে চারটা নাগাদ ঐ ভবনটি জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়। শনিবার সকালে ঐ ভবনের পেছন দিককার কক্ষগুলােতে পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া গাদাগাদি মৃতদেহ ছাড়া আর কিছু ছিল না। পরদিন অবস্থা ভিন্ন। সাইমনের ভাষায় ; | ‘ভােজবাজির মতাে ত্রাসের নগরীতে যেন জীবন ফিরে এলাে। বেলা ১০টা নাগাদ রাস্তাগুলােতে শহর ছেড়ে পালানাে মানুষজনের ভিড়। তখনাে অবশ্য পুরনাে ঢাকার বহু এলাকা থেকে কালাে ধোঁয়া উঠছে, দেখা যাচ্ছে দূরে শিল্প এলাকায়। মানুষজন পালাচ্ছে গাড়িতে, রিকশায় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে পায়ে হেঁটে, সঙ্গে জিনিসপত্র। দুপুর নাগাদ দেখা গেল হাজার হাজার মানুষ ঢাকা ছেড়ে পালাচ্ছে। নির্বাক অভিব্যক্তিহীন মুখে যেতে যেতে তারা পাক-সেনাদের কীর্তিকলাপ দেখে নেয়। সেনাবাহিনীর কাজে কোনাে ফাক ছিল না। সযত্নে তৈরি পরিকল্পনা এবং নির্ভুলভাবে তা সম্পাদিত’ (দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ, ২৭ মার্চ, ১৯৭১)। | এ কথা ঠিক যে একমাত্র নিরপেক্ষ প্রত্যক্ষদর্শী ছাড়া কারাে পক্ষে ঘটনার সঠিক বিবরণ দেওয়া সম্ভব নয়। সত্য বলতে কি অপারেশনের ক্ষয়ক্ষতির সঠিক চিত্র একমাত্র সেনাবাহিনীরই জানা ছিল, কিন্তু তাদের পক্ষে ঘটনাবলীর যথাযথ বিবরণ দেওয়া স্বাভাবিক নয়। তাই পরবর্তীকালে পাক-সেনাবাহিনীর কারাে কারাে লেখায় প্রকাশিত বিবরণ। মিশ্ররূপ নিয়ে ফুটে উঠেছে। শুধু বিচার-বিশ্লেষণ বা মন্তব্যই নয় তথ্য পরিবেশনের ক্ষেত্রেও পূর্ণাঙ্গ নিরপেক্ষতা বজায় রাখা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় নি। পূর্ববর্তী অধ্যায়ে মােটামুটিভাবে তাদের পরিবেশিত তথ্যের ভিত্তিতে ছবিটা আঁকা হয়েছে। আর এ অধ্যায়ে বিদেশী সাংবাদিক ও ভাষ্যকারদের লেখা সংবাদ ও প্রতিবেদন, বিচার ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এবং মন্তব্যাদি পরিবেশিত। তবে এসব প্রতিবেদন ও খবরাদি সম্পর্কে একটি কথা বলে নেওয়া ভালাে যে পাকসামরিক প্রশাসন পরিকল্পিতভাবে বিদেশী সাংবাদিকদের হােটেলে আটক রেখে পরে ২৬ মার্চ সকালে বহিষ্কার করে দেয় বলে তাদের সবার পক্ষে ঘটনার প্রত্যক্ষ বিবরণ সংগ্রহ করা সম্ভব হয় নি।

বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যাদি থেকে তৈরি তাদের সংবাদ-ভাষ্য। তাদের মধ্যে একমাত্র সাইমন ড্রিং ও মাইকেল লােরেন্ট কৌশলে আত্মগােপন করে বাড়তি দুদিন ঢাকায় থেকে যে সচিত্র প্রতিবেদন তৈরি করেন তা মােটামুটি হিসাবে প্রামাণ্য বলা চলে। আশ্চর্য যে অন্যদের পরিবেশিত বিবরণ তুলনায় খুব একটা ভিন্ন নয়। তাই পাক-শাসকদের অভিযােগ ঠিক নয় যে বিদেশী সংবাদ বিবরণ সবই অতিরঞ্জিত। বরং তথ্যের বা সংখ্যার সামান্য হেরফের নিয়ে পাক-প্রশাসন প্রশ্ন তুলতে পারে, এর বেশি নয়। যেমন পঁচিশে মার্চ রাতে পাক-আক্রমণে নিহতের সংখ্যা ঠিক সাত হাজার বা দশ হাজার কি না? সংখ্যার হিসাব নিয়ে হেরফের এসব ক্ষেত্রে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা, এ বিতর্কের সমাধান মেলা কঠিন। হয়তাে পাক-বাহিনীও সঠিক হিসাব বলতে   পারবে না। এসব ক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং সম্ভাব্যতার ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু বড় কথা হলাে সংখ্যার সামান্য হেরফের সত্ত্বেও বাস্তব অবস্থাদৃষ্টে পাক-বর্বরতার বাস্তবতা কোনাে ক্রমেই লঘু করে দেখা যায় না। তথ্যগত কিছু হেরফের মেনে নিয়ে এ আলােকেই সংবাদ বিবরণের মূল্যায়ন করতে হবে। অন্য সাংবাদিক সহকর্মীদের সঙ্গে ঢাকা থেকে বিতাড়িত মার্টিন অ্যাডনি ২৬ মার্চের ‘গার্ডিয়ান পত্রিকায় তিন-তিনটি ছােট প্রতিবেদন প্রকাশ করেন, যা অতিরঞ্জন’ বলে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। প্রথমটিতে কার্টু শিথিল করা শীর্ষক শিরোনামে বলা হয় যে “ঢাকা আপাতদৃষ্টিতে শান্ত মনে হলেও সরকারি বিবরণীতেই এমন ইঙ্গিত রয়েছে যে বন্দরনগর চট্টগ্রাম ও খুলনা স্বাভাবিক নয়। খুলনায় বামপন্থী শক্তি খুবই সংহত। আর চট্টগ্রামের রাস্তায় জনতার স্থাপিত অবরােধের কারণে বুধবার রাতে সৈন্যরা আটকা পড়লেও সরকারি ভাষ্যে অবস্থা ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের দিকে যাচ্ছে। শেখ মুজিবুর রহমান সেনাবাহিনীর হাতে আটক যদিও জনরব এ সম্পর্কে ভিন্ন কথা বলছে।’  দ্বিতীয় প্রতিবেদনটির শিরােনাম ‘ছাত্রাবাসে গােলাবর্ষণ’ (‘Students Hostels were shelled’)। এ বিবরণ শুক্রবার ঢাকায় বসে লেখা এবং পরদিন পাকিস্তানের বাইরে। থেকে তারযােগে পাঠানাে। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে এগারােটায় বাঙালি বসন্তের পরিসমাপ্তি ঘটে যখন সারিসারি সশস্ত্রবাহিনীর কনভয় আগুন আর অস্ত্র নিয়ে ঢাকার রাস্তায় নেমে পড়ে।

মধ্যরাতের পর শহরের বিভিন্ন দিক থেকে আগুনের শিখা উপরে উঠতে দেখা যায়। বিশেষভাবে দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের দিক থেকে। এমন কি সেখানে রকেট লাঞ্চারও ব্যবহার করা হয় যেজন্য পরদিন সকালেও সেখান থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখা গেছে।  ‘রাত দুটোর পর অটোমেটিক আগ্নেয়াস্ত্র থেকে ব্যাপক গােলাগুলি বর্ষণের শব্দ শােনা যায়; ঘণ্টা খানেক পর কামানের গোলার আওয়াজে হােটেল ঘরের মেঝে কেঁপে ওঠে। এলাকাটা শান্ত বলেই আধ মাইল খানেক দূরের গুলিবর্ষণের আওয়াজও শােনা যাচ্ছিল। সবচেয়ে বেশি গােলাগুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল বিশ্ববিদ্যালয় ও ছালাবাসগুলোর দিক থেকে। আগুনের শিখাও ছিল সেদিকেই সবচেয়ে উঁচু। আরেকটি আগুনের শিখা দেখা যায় পুলিশ সদর দফতরের দিক থেকে। সেখান থেকেই কিছুক্ষণ আগেকার টেলিফোন বার্তায় জানা গিয়েছিল যে সৈন্যরা ভবনটি ঘিরে ফেলেছে। সেখানে নিহতের সংখ্যা যে কত সে হিসাব পাওয়া অসম্ভব, তবে তা হাজার ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা।  ‘সামরিক বাহিনীর বিশ্বাস তারা প্রদেশটিকে ভালােভাবেই নিয়ন্ত্রণে এনে ফেলেছে। এক ক্যাপ্টেনের কথায় তা বােঝা গেল। তার ভাষায় “এখন সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। এখন আর কেউ কথা বলতে বেরিয়ে আসবে না। শুরুতে আমরা বিষয়টাতে তেমন গুরুত্ব দেই নি। কিন্তু এখন খুবই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।” আরেকজনের বক্তব্য : “আমি যদি নিজ দেশের লােকজনকে মারতে পারি, তাহলে তােমাকেও মারতে পারি। এক সেকেন্ডের মধ্যে তােমাকে শেষ করে ফেলতে পারি।” ঐ ক্যাপ্টেন প্রসঙ্গত এক জনসংযােগ অফিসারের (সম্ভবত সিদ্দিক সালিক) বক্তব্য মনে করিয়ে দেয়।

আলােচনা ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই সেনাবহিনী দ্রুত বেরিয়ে পড়ে।  তবে বুধবার সকালে জেনারেলদের এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কাজেই বুঝতে পারা যায় যে সেনাবাহিনী সুসমন্বিত পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়েছিল (“The action came after a meeting of the generals in Dacca on Wednesday morning, Thus army appears to have acted according to a well-coordinated plan”) সামরিক বাহিনীর প্রধান তিন টার্গেট ছিল রাজনৈতিক গ্রুপ, অস্ত্রধারী বেসামরিক ব্যক্তিবর্গ এবং সংবাদপত্র।’ এতেও সেনাবাহিনীর পূর্ব-পরিকল্পনার প্রমাণ মেলে। করাচি বিমানবন্দরে মার্টিনকে জনৈক সামরিক মুখপাত্র জানায় যে তাদের সেনাবাহিনী অপারেশনে তেমন কোনাে বাধার সম্মুখীন হয় নি। রকেট লাঞ্চার প্রধানত ব্যারিকেড সরাতেই ব্যবহার করা হয়েছে।’ কিন্ত্র হোটেল থেকে বেরিয়ে আসার সময় মার্টিনের চোখে পড়েছে, পুরনাে ঢাকার বস্তি এলাকা থেকে উঠে-আসা বিশাল ধোয়ার কুগুলি তখনাে আকাশে স্থির জমাট বেঁধে আছে। ঐ মুখপাত্রটি আরাে জানায় : “সামরিক বাহিনীর কাছে খবর ছিল যে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবাসে প্রচুর গােলাবারুদ জমা করা হয়েছে। হয়তাে ঐ সব থেকেই বিস্ফোরণ ঘটেছে।’ তার অবশেষ বক্তব্য : ‘সামরিক বাহিনীর মূল উদ্দেশ্য ছিল সেখান থেকে একটি অবৈধ সরকার উৎখাত করা।’ মার্টিনের এ বিবরণ থেকে পাক-বাহিনীর আক্রমণের তীব্রতা সম্পর্কে কিছুটা আভাস। পাওয়া যায়। আরাে বােঝা যায় যে সামরিক বাহিনীর পূর্ব-পরিকল্পনা এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সংলাপ বিষয়ক সদিচ্ছা সম্পর্কে এদের কারাে কারাে পূর্বধারণার কিছুটা পরিবর্তন ঘটেছে, ঘটেছে ২৫ মার্চের ঘটনাবলীর পর থেকে। মার্টিনের তৃতীয় প্রতিবেদনের শিরােনাম “Troops Used ‘Shoot First’ Tactics” অর্থাৎ দেখামাত্র গুলিবর্ষণের কৌশল। | এখানেও মার্টিনের লেখায় বিদায় কালে কালাে ধোঁয়ার কুণ্ডুলির কথা উল্লেখিত যা স্থানীয় এক ভদ্রলােকের হিসাবে পুরনাে ঢাকার দিক থেকে উঠেছে বলে মনে করা যায়। বিমানবন্দরে যাওয়ার পথেও তার চোখে পড়ে কাচা দোকানপাট ও বাজারের আগুনপােড়া চেহারা। যতক্ষণ হােটেলে থাকা সারাটা সময় শুধু গোলাগুলির আওয়াজ, মাঝেমধ্যে ভারী গােলার আওয়াজ। সামরিক বাহিনীর হিসাবে সফল অপারেশন’ শেষ হওয়ার পরও অটোমেটিক আগ্নেয়াস্ত্রের শব্দ বন্ধ হয় নি।  “ফলে নিশ্চিতই বলা যায় যে সেনাবাহিনী শহর দখল করতে প্রয়ােজনের অনেক অনেক বেশি শক্তি ব্যবহার করেছে। এমন কি প্রতিশােধ পূহ নিয়ে বিশেষ বিশেষ টার্গেট যেমন- “পিপল’ পত্রিকা অফিসের ওপর হামলা চালিয়েছে। এসব ক্ষেত্রে তাদের সিদ্ধান্তই ছিল ‘প্রথমে গুলি করার, পরে জিজ্ঞাসাবাদের’ (“One can say with certainty that the army used vastly more force than was necessary to occupy the city, that it chose certain targets such as the “People’ newspaper for specific vindictive treatment, and that it decided to shoot first and ask few questions later”)

সেনাবাহিনীর নির্বিচার হত্যার নীতি বাস্তবিকই গণহত্যার (‘জেনােসাইডে’র) ইঙ্গিত দেয়। এরা হিসাব-নিকাশ করেই এ প্রক্রিয়া শুরু করে, উদ্দেশ্য বাঙালি জনতাকে ভয় পাইয়ে দেওয়া, যে কথা তাদের একাধিক ব্যক্তির মুখে শােনা গেছে। মার্টিনের মতে এ নির্বিচার বা অকারণ হত্যা বা আক্রমণের উদাহরণ শুধু দ্য পিপল পত্রিকাই নয়— যে  পত্রিকার প্রথম পাতায় মুদ্রিত নীতিবাক্য “তুমি সব সময় সকল লােককে বােকা বানাতে পারে না, কিংবা জনশূন্য বাজারের দোকানগুলােই নয়। অবশ্য বেসামরিক লােকজনের প্রতি তাদের আচরণ কেমন তা জানা সম্ভব নয়। তবে একজন রুশ সাংবাদিক সেনাবাহিনীর সদস্যদের বাড়িঘরের জানালার দিকে তাক করে নির্বিচারে মেশিনগানের গুলি ছুড়তে দেখেছে বলে জানায়। একজন ব্রিগেডিয়ারকে প্রশ্ন করা হয় : সৈন্যরা কি রাস্তায় উপস্থিত সবার দিকেই গুলি ছুঁড়ছে?’ ‘নারী ও শিশুদের দিকে নয়’— নির্বিকার জৰাৰ ব্রিগেডিয়ারের (দ্য গার্ডিয়ান, ২৬ মার্চ, ১৯৭১)। এর অর্থ খুব স্পষ্ট। মার্টিনের প্রতিবেদনে কোথাও অতিরঞ্জন আছে বলে মনে হয় না, অন্তত স্থানিক অভিজ্ঞতার আলােয়। পােড়া ঝুপড়ির ছাই তাে স্বচক্ষে দেখা। তেমনি দেখা পুরনাে ঢাকার শাখারিপট্টি বা তাঁতীবাজারের বিধ্বস্ত চেহারার বাড়িগুলো। আসলে পাক-বাহিনী বিদেশীদের কাছ থেকে গােপন করার মতাে অনেক কিছুই করেছিল। তাই রীতিমতাে ভয় ছিল সাংবাদিকদের নিয়ে। মিথ্যা নয় মার্টিনের কথা : “যে-সেনাবাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে দাবি করে তারা কেন আমাদের ভয় করতে যাবে? আমার ধারণা এর কারণ এরা বিশ্বকে জানতে দিতে চায় না পূর্ব-পাকিস্তানে আজ কি ঘটছে।”  এত চেষ্টা সত্ত্বেও পাক-সামরিক শাসন তাদের অপকীর্তির বিবরণ গোপন রাখতে পারে নি। কিছু সংখ্যক নির্ভীক ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকের চেষ্টায় তা প্রকাশিত হয় কাগজে, পেীছে যায় বিশ্ববাসীর কাছে। সাইমন বা মার্টিনের মতাে এতটা বিস্তারিত তথ্যনির্ভর বিবরণ না হলেও পঁচিশ মার্চের নারকীয় তৎপরতার কিছু কিছু বিবরণ ২৬ মার্চ দিল্লি থেকে টাইমস পত্রিকায় পাঠানাে হয় এবং তা প্রকাশ পায় ২৭ মার্চ (১৯৭১)। প্রতিবেদনের ভূমিকায় বলা হয়, গত রাতে প্রাদেশিক নেতা শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলকে স্বাধীন প্রজাতন্ত্র (‘রিপাবলিক) ঘােষণা করার পর সেখানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ সংগঠনকে বেআইনি। ঘােষণা করেছেন। সেই সঙ্গে শেখ মুজিবকে দেশদ্রোহী’ রূপে অভিযুক্ত করে বলেছেন যে তার অপরাধের শাস্তি সে এড়াতে পারবে না’। ‘পাকিস্তানের সর্বত্র রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ ঘােষণা করা হয়েছে, এবং সংবাদ প্রকাশের ওপর পূর্ণাঙ্গ নিষেধাজ্ঞা বলবৎ হয়েছে।

পূর্ব-পাকিস্তানের সঙ্গে অবশিষ্ট বিশ্বের সরকারি যােগাযােগ বন্ধ হয়ে গেছে। ঐ দিনের নাটকীয় ঘটনাবলীর একমাত্র খবর এসেছে ঢাকা থেকে গােপন বেতার-বার্তার সম্প্রচারের এবং সেখান থেকে ভারতে আসা পর্যটকদের প্রতিবেদনের মাধ্যমে। ‘ভারত-পূর্ব-পাকিস্তান সীমান্ত থেকে সংবাদ উদ্ধৃত করে ‘প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া (পিটিআই) জানিয়েছে যে “পূর্বাঞ্চলের রাজধানী ঢাকা এখন রণক্ষেত্র । উদ্ধৃত সংবাদে শেখ মুজিবুর রহমানের দাবি উল্লেখ করে বলা হয় যে পূর্ব-পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও পুলিশ ছয়টি শহরে পশ্চিম-পাকিস্তানি সৈন্যদের ঘিরে রেখেছে।’ গোপন বেতার বার্তা  থেকে উদ্ধারের কারণে এ সংবাদে কিছুটা অতিশয়ােক্তি থাকলেও মূল সংবাদ তথ্যে ভুল নেই। যেমন ভুল নেই শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘােষণায় কিংবা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বক্তব্যে এবং গােটা বিশ্বের সঙ্গে পূর্ব-পাকিস্তানের যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করে। দেওয়া বা প্রচারিত নিষেধাজ্ঞাগুলাে সম্পর্কে। ঢাকা রণক্ষেত্র’ ঠিকই, তবে একতরফা। পাক-বাহিনীই আক্রমণ চালিয়েছে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর। আর গৃহযুদ্ধ শুরু ঐ আক্রমণের পর থেকে। মূল ভাষায় ঐ বিবরণ নিম্নরূপ : “Civil war raged in the eastern region of Pakistan last night after the provincial leader, Sheikh Mujibur Rahman, had proclaimed the region an independent republic. President Yahya Khan outlawed the Sheikh’s Awami League and denounced the Sheikh himself as a traitor whose crime ‘would not go unpunished'”. “Political activity throughout Pakistan has been banned and total censorship has been imposed. Official communications between East Pakistan and the rest of the world have been cut. The news about the day’s dramatic developments came in a clandestine radio bulletin broadcast from Dacca and reports by travellers crossing into India.” “The Press Trust of India quoting reports from the East Pakistan-India border, said that Dacca, the capital of the Eastern wing, had become a ‘battlefield’. It also quoted Sheikh Mujibur’s claim that West-Pakistan troops had been surrounded by East-Pakistan troops and police in six cities.”

দিল্লি থেকে পাঠানাে উল্লিখিত প্রতিবেদনের মূল অংশে বলা হয় যে “শেখ মুজিবুর রহমান আজ রাতে পূর্ব-পাকিস্তানকে সার্বভৌম, স্বাধীন বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্র হিসাবে ঘােষণা করেছেন। এ ঘােষণা শেখ সাহেবের নয়, অন্য একজন অচেনা ঘােষকের।” মনে হয় চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত স্বাধীনতা ঘােষণার কথাই এখানে বলা হয়েছে। এ ছাড়াও ঐ প্রচারের বরাত দিয়ে বলা হয় যে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ঈস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এবং সমগ্র পুলিশ বাহিনী মিলে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, শ্রীহট্ট, যশাের, বরিশাল ও খুলনায় পশ্চিম-পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ঘিরে ফেলেছে এবং দু’পক্ষে ঘােরতর লড়াই চলছে। পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনী শেখ মুজিবুরের জন্য তল্লাশি চালাচ্ছে, কিন্তু সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর তিনি আত্মগােপন করেছেন।’ ঐ প্রচারে স্বাধীন বাংলাদেশের জনসাধারণকে শেষ শত্রু সৈন্যটি ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত স্বাধীনতার সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য আহ্বান জানানাে হয়।’ বলার অপেক্ষা রাখে না যে ঐ অজানা ঘােষণা-ভিত্তিক প্রতিবেদনে কিছুটা তথ্যগত ভুল-ভ্রান্তি রয়েছে; যেমন তা দুই পক্ষে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে তেমনি শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মগােপনের বিষয়ে। তখন অবশ্য ঢাকায় এ ধরনের খবর লােকমুখে বা জনরব হিসাবে প্রচারিত হয়েছিল, যেজন্য পাক-সামরিক শাসন শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেপ্তারের ঘটনা তথ্যসহকারে প্রচার করে। বাঙালি যে হুজুগে ও গালগল্পে ওস্তাদ তা নানান। উপলক্ষে দেখা গেছে। ষাটের দশকে গভর্নর আজম খানকে নিয়ে তাদের রসালাে গল্প ভুলে যাবার নয়। 

“টাইমস’-এর ঐ প্রতিবেদনে অবশ্য সেই সঙ্গে কলকাতা থেকে পাঠানাে তথ্যসূত্রে এমন খবরও ছিল যে ‘অন্ততপক্ষে হাজার দশেক পশ্চিম পাকিস্তানি ফৌজি সেনা পূর্বপাকিস্তানের বন্দরে এসে পৌছেছে। সাকুল্যে এখন প্রদেশে পাক-সেনার সংখ্যা দাড়াল ৭০ হাজারে।’ সিদ্দিক সালিকের জোরগলায় আপত্তি মিথ্যা হয়ে গেল। কারণ করাচি বন্দর থেকে তাে তখনকার বাধাবন্ধ পেরিয়ে দু-চার দিনে চট্টগ্রামে পৌছানাের কথা নয়। এ খবর ভুল ছিল না। কারণ চট্টগ্রামে জঙ্গিকর্মীরা যে ঐসব পাকিস্তানি ফৌজ ও তাদের রসদ নামাতে বাধা দিয়েছিল সে খবর অজানা থাকে নি। আর এ নিয়েই সংঘর্ষ। এছাড়াও টাইমস’ পত্রিকায় পরিবেশিত হয় ২৫ মার্চের প্রেক্ষাপট নিয়ে বিশ্লেষণ। এতে স্পষ্টই বলা হয়েছে যে পাকিস্তান গৃহযুদ্ধের অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে সত্তর হাজার সেনা সদস্য নিয়ে পাক-বাহিনী আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার চেষ্টা চালাবে ঠিকই, কিন্তু যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে এ স্থলবাহিনীর পক্ষেও অবস্থা নিয়ন্ত্রণে রাখা কষ্টকর হতে পারে, বিশেষ করে নদীমাতৃক বাংলাদেশে। এখানে ট্যাংক ও গোলন্দাজ বাহিনী নিয়ে সর্বত্র পেীছানাে কঠিন। এ অবস্থায়ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ভরসা যে গ্রামাঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী গেরিলাযুদ্ধ চালিয়ে যাবার মতাে প্রকৃতি বাঙালির নয়, তেমন ঐতিহ্যও তাদের নেই (দ্য টাইমস, ২৭ মার্চ, ১৯৭১)।  ঐ একই প্রতিবেদনে আরাে বলা হয় : “যদিও পূর্ববঙ্গকে সাময়িকভাবে দমিয়ে রাখা যায় তবু শেষ পর্যন্ত তাদের স্তব্ধ করে রাখা যাবে না। …ঘটনা শেষ পর্যন্ত শেখ মুজিবকে স্বাধীনতা ঘােষণার দিকে ঠেলে দিয়েছে। অন্যদিকে সেনাবাহিনীর ভেতর থেকে চাপই সম্ভবত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে সংঘাতের দিকে এগিয়ে দিয়েছে যা তিনি হয়তাে স্থগিত রাখতেন। ইতােমধ্যে জাতীয় পরিচিতি (আইডেনটিটি’) নিয়ে সংশ্লিষ্ট সবার মনেই প্রশ্ন প্রতিধ্বনিত হতে থাকবে, যে সব নিয়েই পাকিস্তানের জন্ম। এ প্রশ্ন রয়েছে ভারতেও। সঙ্কট ঘনীভূত হওয়ার প্রক্রিয়ায় ঢাকার রাজপথে মি, জিন্নাহর কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়েছে। এ আবেগ যে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা অনুমান করা কারাে পক্ষে সহজ নয়”।

(“Events have pushed Sheikh Mujib to his declaration of independence. Pressure within the army may have pushed President Yahya to action he would rather have deferred. Already all the questions of national identity with which Pakistan was surrounded at its birth will be echoing in the minds of those involved. And in India too. During the gathering crisis there were effigies of Mr. Jinnah burnt in the streets of Dacca. No one can foresee where these emotions will lead.”) | ঘটনার এ বিচার-বিশ্লেষণ ছিল যথার্থ। আমাদের হিসাব-নিকাশও বলে যে যুদ্ধটা। চাপিয়ে দেওয়া হয় বাঙালিদের ওপর। সহজে তুষ্ট বাঙালিদের স্বশাসনের দাবি থেকে ঠেলে দেওয়া হয় স্বাধীনতার দিকে—ছয় দফা থেকে এক দফায়। আর এ কথাও সত্য যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার সাময়িক স্বার্থের বিনিময়ে সমঝােতায় পৌছাতে ইচ্ছুক থাকা সত্ত্বেও ভুট্টো এবং বাজপাখি সেনানায়কদের চাপের মুখে সঙ্ঘাতের পথ বেছে নেন। অবশ্য সেই সঙ্গে তাকে এ কথাও বােঝানাে হয় যে স্বায়ত্তশাসনের অর্থ নিশ্চিত বিচ্ছিন্নতা। পঁচিশে মার্চের আগে বিদেশী সাংবাদিকদের মধ্যে সাধারণভাবে এমন ধারণাই  অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে ক্ষমতা হস্তান্তরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সদিচ্ছা যথেষ্ট তার প্রমাণ আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার রাজনৈতিক সংলাপ। কিন্তু ক্রমে অবস্থার পরিবর্তনে তাদের অনেকের মধ্যেই বােধােদয় ঘটেছে যে ইয়াহিয়াকে ঘিরে ঘটনা এতটা সহজ নয় যতটা তারা ভেবেছেন। এর পেছনে রয়েছে জটিলতা, রয়েছে পর্দার আড়ালে নানা কারসাজি। সবাই না হলেও কেউ কেউ তা বুঝেছেন। হয়তাে তাই গার্ডিয়ান’ পত্রিকার বৈদেশিক বিষয়ক সংবাদদাতার মতে ‘এমন প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলােচনার উদ্দেশ্যে গেলেও এর মধ্যে পূর্ব-পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে নয়া সৈন্য সংযােজনের কাজও চলেছে। আর সেই সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানে এবং অন্যত্র বাঙালিদের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ইয়াহিয়া খানের বহু-প্রচারিত সমঝােতা-চেষ্টার আগেই সেনাবাহিনীতে ‘বাজপাখি’ গ্রুপের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।’ অবশ্য ‘লন্ডনে বসবাসরত যেসব পূর্ব-পাকিস্তানির বিশ্বাস ইয়াহিয়া খানের সমঝােতা চেষ্টায় আদৌ আন্তরিকতা নেই তারা চটজলদি এমন ইঙ্গিতও রেখেছেন যে সংলাপ ভেঙে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব-পাকিস্তানে গতকাল (অর্থাৎ ২৬ মার্চ) কয়েক জাহাজ ভর্তি সৈন্য পৌছানাের ঘটনা অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ’ (অর্থাৎ কাকতালীয় নয়)।

(“There is some evidence that President Yahya Khan went to Dacca to keep Sheikh Mujibur Rahman talking while reinforcements made their way to EastPakistan and while Bengalis holding key positions in West-Pakistan and elsewhere were removed. The “hawks’ in the regime may infact have won before Yahya Khan set out for the highly published attempts at reconciliation. “East-Pakistanis in London who believe that Yahya Khan’s attempt at negotiations were insincere were quick to point out yesterday that the breakdown of talks coincided with the arrival of several shiploads of troops in East-Pakistan” (The Guardian, 27 March, 1971) এমন কি একই দিনের গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত সম্পাদকীয় পাকিস্তানের ট্র্যাজেডি (Tragedy in Pakistan’) বক্তব্যেও ছিল যুক্তি ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি, সেই সঙ্গে কিছুটা দূরদর্শী বিবেচনাও । তাদের ভাষায় ‘অবশেষে পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ দেখা দিয়েছে সম্ভাব্য জঘন্যতম পরিস্থিতিতে। এবার তারা অস্বীকার করেন নি যে দুই পক্ষ যখন সমঝােতার আশায় আলােচনা চালিয়ে যাচ্ছে তখন সংলাপ ভেঙে পড়ার পরই সন্দেহজনক দ্রততায় জাহাজে করে নতুন সৈন্য এসে পৌঁছেছে। এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া গতকাল শেখ মুজিবুর রহমানকে দেশদ্রোহিতার দায়ে অভিযুক্ত করে এবং সব রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ ঘােষণা করে তার উদ্দেশ্য স্পষ্ট করে দিয়েছেন। তিনি যে কোনাে মূল্যে পাকিস্তানের ঐক্য সংহতি বজায় রাখতে নিবেদিতপ্রাণ। প্রেসিডেন্টের এ অবস্থান শেখ মুজিব কর্তৃক কথিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা অবধারিত করে তুলেছে।’ তাদের ভাষায় “Pakistan’s civil war has finally erupted, and in the worst possible circumstances. While two sides kept talking some hopes of  compromise remained. But troop reinforcements arrived with suspicious speed by boat after talks brokedown, and President Yahya Khan yesterday made his intentions clear by accusing Sheikh Mujibar Rahman of treason and by banning all political activity. He is dedicated in keeping Pakistan united at all costs. The President’s stance made Sheikh Mujib’s reported declaration of independence for Bengal inevitable. The strains have been building up with increasing intensity ever since last December’s elections. The President’s intention to turn back the fact of Pakistan’s division may be unattainable. Whatever the outcome, it will mean more misery, bloodshed and economic dislocation” (The Guardian, 27 March, 1971)  আমরাও বলি গার্ডিয়ান-সম্পাদকীয়তে এ বিচক্ষণ ও দূরদর্শী বিশ্লেষণ বিরাজমান। বাস্তবতারই প্রতিফলন। সত্যই নির্বাচনের পর থেকে ক্রমশ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে চাপ ও সমস্যা তৈরি হচ্ছিল তার যথাযথ সমাধানে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া হয় নি। জেদ, একগুয়েমি এবং উচ্চাকাক্ষা সেখানে প্রাধান্য পেয়েছে। ‘বিরাজমান পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের ভাঙন রােধ করার ইচ্ছা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্টের পক্ষে তা যে অসম্ভব সে বিচারেও কোনাে ভুল ছিল না।

তবে এ বিশ্লেষণে এমন অভিযােগও তােলা হয়েছে যে বর্তমান বিকল্প পরিস্থিতির সম্ভাবনা সম্পর্কে প্রধান তিন রাজনৈতিক ব্যক্তিই (ইয়াহিয়া, শেখ ও ভূট্টো) হিসাবে ভুল করেছিলেন, নির্বাচনের ফলাফল পাকিস্তানের দুই ভৌগােলিক অংশের বিচ্ছিন্নতা (দূরত্বের মতাে রাজনৈতিক বিভাগও তুলে ধরেছিল। সম্ভবত বিষয়টির গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে তাদের কেউ যথেষ্ট মাত্রায় সচেতন ছিলেন না। ছয় দফা নিয়ে শেখ মুজিবুরের বিপুল বিজয় তার জন্য কোনাে সমঝােতা বা ছাড় দেওয়ার সুযোগ রাখে নি, বিশেষ করে তার দলেরই জঙ্গিদের চাপের মুখে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ তার মেজাজ ও সহজাত বােধের তুলনায় অনেক জোরে ও দ্রুত গতিতে তাকে ভাসিয়ে নিয়েছিল।’ অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তান রক্ষার ঘাের নিরপেক্ষভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে বিচ্ছিন্নতার সন্দেহবশে প্রাপ্য আসনে অধিষ্ঠিত হতে দিতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়েছে। তাই বারবার গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘােষণা যা তার দ্বিধা, সংশয়ের প্রমাণ। আর পশ্চিমে ভুট্টোর রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষার চেষ্টা বিভাজনের পরিস্থিতি তৈরি করে। তদুপরি মার্চের সপ্তাহ কয় ধরে পূর্ব-পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় শাসনের স্থলে শেখ মুজিবের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা প্রেসিডেন্টের পক্ষে হজম করা সম্ভব হয় নি বলে সমঝোতার পথ ছেড়ে অস্বাভাবিক শক্তির শাসন প্রতিষ্ঠাই তার কাম্য হয়ে ওঠে।’ এরপরও ‘গার্ডিয়ান’ সম্পাদকের প্রশ্ন : ‘শেখ মুজিবের মতাে একজন সমঝােতাচেতনার বা আপসচেতনার মানুষের পক্ষে বিপ্লবীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে দলের প্রবল উগ্রপন্থী ৰা বামপন্থী ন্যাপের বিরুদ্ধে আপন অবস্থান ধরে রাখা কি সম্ভব হবে? আপসমীমাংসার পরিসর আগেও ছিল ছােট এখন সে সুযােগ আরাে সঙ্কুচিত । গৃহযুদ্ধে অর্থনৈতিক অবস্থা বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।

ভারতীয় পশ্চিম বঙ্গ এ ভাঙন ও বিচ্ছিন্নতার প্রক্রিয়া আগ্রহভরে লক্ষ্য করবে। এ ট্র্যাজেডির ছাইচাপা আগুন উসকে দেওয়ার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের  প্রধান রাজনৈতিক নেতা সবারই হাত রয়েছে, অবদান রয়েছে। দুঃখের বিষয় যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বাঙালির স্বতন্ত্র জাতীয়তার বাস্তব সত্য বুঝে নিয়ে রক্তাক্তপথের বাইরে ভিন্নপথের সন্ধানে হাত বাড়াতে চান নি। “গার্ডিয়ান’-এর সংক্ষিপ্ত বাংলা ভাষ্যের মূল ভাষিক বিবরণে বলা হয় : “The three main political protagonists, the President, the Sheikh and the opposition leader-to-be, Mr. Zulfikar Ali Bhutto, all miscalculated and made certain that this alternative would never come about. The election produced a political division matching the geographical separation exactly. This clear-cut result ought in no way to have encouraged military intervention, as a fissiparous and impotent coalition might have done. The extent of the eastern and wester victories caught their leaders unaware. Sheikh Mujib was landed with an extreme Bengali six-point programme and a majority which made compromise unjustifiable to the more militant members of his Awami League. Bengali nationalism has swept him along faster than his temperament or instincts intended. President Yahya Khan’s dedication to a united Pakistan when faced with a fairly elected Prime Minister with separatist intention induced vacillation. The postponement of constituent Assembly became for the east as much the postponement of attainable sovereignty. Mr. Bhutto’s interests have been confined exclusibly to the westand this has compounded the split. The President appears unable to stomach the fact that Sheikh Mujib has for the past few weeks effectively been ruling Bengal independently of the central government. He has abandoned compromise and now seeks to store an unnatural order by force. ..

.”Can Sheikh Mujib, a congenial compromiser, caste in the role of revolutionary, sustain his position against the more militant members of his party or against the leftist National Awami Party, which boycotted the elections? He had little room in which to manoeuvre in the first place. He has even less now. Civil war will hamper further an economy which, before fighting started, was inadequate for its needs. Indias West Bengal will be watching the process of disintergration and separation with close interest. All of the Pakistan’s leading politicians have contributed to the slowburning fuse on this tragedy. The pity is that President Yahya Khan would not see his way to accept Bangal’s separate identity and to crystalise it in some blood-saving form.”  উল্লিখিত সম্পাদকীয় প্রতিবেদনে পঁচিশে মার্চের পূর্ববর্তী ও অব্যবহিত পরের রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিচক্ষণ বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন হওয়া সত্ত্বেও কেউ হয়তাে প্রশ্ন তুলতে চাইবেন। ভিন্নমত প্রকাশ করে যে শেখ মুজিবুর রহমান সত্যই কি সমঝােতাপন্থী বা আপসপন্থী? তাহলে তাে ছয় দফা প্রশ্নে বেশ কিছু ছাড় দিয়ে সমঝােতায় পৌছে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব হতাে। এক্ষেত্রে সম্পাদকীয় ধারণা এমন যে তার দলের জঙ্গিদের চাপে তা সম্ভব। হয় নি। তাছাড়াও ছিল দলের বাইরে থেকে চাপ। যেমন মওলানা ভাসানীর বিশাল। জনসভায় একদফার পক্ষে আগুনঝরা বক্তৃতা যে কারণে জনমত ক্রমশ স্বাধীনতার দিকে দ্রুত গতিতে সংহত হতে থাকে। এ অবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে ভিন্ন পথ বেছে নেওয়া সম্ভব ছিল না।  ‘অবজার্ভার” পত্রিকার বৈদেশিক বিষয়ের সংবাদদাতা অবশ্য ২৬ মার্চ করাচি বিমান। বন্দরে ভুট্টোর প্রতিক্রিয়া ধরতে পেরেছেন, এর বেশি খুৰ কিছু নয়। ভুট্টোর মতে ‘শেখ মুজিবের অবস্থানই সংলাপ ভেঙে পড়ার কারণ।’ অন্যদিকে “ইস্ট পাকিস্তান লীগ অব আমেরিকা’ নামক সংগঠনের সভাপতি জনাব কে, এস, আহমদ পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী পূর্ব-পাকিস্তানে যে গণহত্যা চালাচ্ছে তার বিরুদ্ধে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপের জন্য প্রেসিডেন্ট নিক্সনের প্রতি আবেদন জানিয়েছেন” (২৭.৩.৭১)। | ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এর সংবাদদাতা সিডনি শ্যানবার্গ ২৬ মার্চ ঢাকা থেকে পাক সেনাবাহিনীর দ্বারা বিতাড়িত হয়ে বােম্বাই থেকে পাঠানাে এক ডেসপাচে লেখেন : ‘পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পূর্ব-পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণে রাখতে গোলাগুলি বর্ষণের আশ্রয় নিয়েছে। নিরস্ত্র বেসামরিক জনতার বিরুদ্ধে কামান ও ভারী মেশিনগান ব্যবহার করছে, উদ্দেশ্য প্রদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন স্তব্ধ করে দেওয়া। বৃহস্পতিবার রাতে কোনাে সতর্কসংকেত ছাড়াই আক্রমণ শুরু করা হয়। | ‘মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল-এ আটকে রাখা বিদেশী সাংবাদিকদের সবারই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে আকাশেওঠা আগুনের বিশাল শিখা, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা এবং আধা-সামরিক সংগঠন (মূলত বাঙালি-প্রধান) ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এর সদর দফতরের দিক থেকে। কোথাও কোথাও আগুন পরদিন শনিবার সকালের দিকেও জ্বলতে দেখা গেছে, সেইসঙ্গে গােলাগুলির শব্দ। | “ঐ সকালেই ৩৫ জন বিদেশী সাংবাদিককে ঢাকা থেকে বহিষ্কার করা হয়।

কড়া সামরিক পাহারায় তাদের ট্রাকে তুলে নিয়ে যাবার সময় তারা দেখতে পায় সৈন্যরা রাস্তার ধারে গরিব বাঙালিদের ঝুপড়িতে আগুন লাগাতে ব্যস্ত। ওরা সবাই স্বাধিকার আন্দোলনের কট্টর সমর্থক। বিমানবন্দরে এক পাকিস্তানি সৈনিকের নির্বিকার মন্তব্য শােনা গেল : বাংলাদেশ শেষ। বহু লােক মারা গেছে।’ আন্দোলনের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্যে কি ঘটেছে তা এখনাে অনিশ্চিত। তবে সরকারি ভাষ্যমতে তাকে রাত দেড়টা নাগাদ গ্রেপ্তার করা হয়েছে” (দ্য টাইমস, ২৮ মার্চ, ১৯৭১)। শ্যানবার্গের এ রিপাের্ট আরেকটু বিস্তারিতভাবে নিউইয়র্ক টাইমস ছাপে (২৮ মার্চ, ১৯৭১)। একই দিনে বাল্টিমাের সান’-এ জন উডরাফের পাঠানাে আরাে দীর্ঘ রিপাের্ট ছাপা হয়, শেষ করা হয় ইয়াহিয়ার মন্তব্যে : “আমি পাক-সেনাদের জন্য গর্বিত’ (“I am proud of them”) | ‘টাইমস’ পত্রিকায় ২৮ মার্চের (১৯৭১) সম্পাদকীয় নিবন্ধটি ছিল আরাে ভারসাম্যপূর্ণ, মানবিক বােধ সম্পন্ন ও যুক্তি নির্ভর বক্তব্যে বিন্যস্ত। পূর্ব-পাকিস্তান থেকে বিশেষ সংবাদদাতার পাঠানাে প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করে লেখা সম্পাদকীয় কলামে।  বলা হয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রকাশিত পূর্ব-পাকিস্তানি বাঙালিদের স্বায়ত্তশাসনের ইচ্ছা বুলেটের সাহায্যে দমন করার পশ্চিম-পাকিস্তানি সিদ্ধান্তের ফলে এক ভয়াবহ রক্তপাতের ঘটনা দেখা দিয়েছে। ইচ্ছাকৃতভাবে বাঙালি জাতীয়তার সমর্থকদের কেন্দ্রীয় পাক-সরকারের পক্ষে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা বা মুছে ফেলার মতাে ঘটনা উপমহাদেশে বা অন্যত্র ইদানীং দেখা যায় নি। | জেনারেল ইয়াহিয়া খানের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের চেষ্টা ছিল প্রশংসনীয়। নির্বাচনােত্তর কালে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতার ঢেউ সামনে নিয়ে প্রধান হিসাবে তার দায়িত্ব নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রের ঐক্য-সংহতি রক্ষা করা। কিন্তু সংলাপ ভেঙে যাওয়ার পূর্বমুহূর্তেও মুজিব কখনাে বিচ্ছিন্নতার প্রস্তাব তােলেন নি, তার উগ্রপন্থী সমর্থকরা যত চিৎকার করুক না কেন?’ | প্রসঙ্গত একটি চমকপ্রদ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে আলােচ্য সম্পাদকীয় নিবন্ধে। তাদের মতে ‘পাক-সামরিক বাহিনীর আপাত-সাফল্য কখনােই বাঙালিদের দীর্ঘকালীন অভিযােগ, আকাক্ষার অবসান ঘটাতে পারবে না। বরং ইয়াহিয়া খানের এই দুর্ভাগ্যজনক সিদ্ধান্তের নিশ্চিত ফলাফল (রক্তপাত ছাড়াও) যে নতুন দিকনিশানা খুলে দেবে তা হলাে পূর্ব-পাকিস্তানে মাওবাদী, নকশালপন্থী ও অনুরূপ বিপ্লবীদের ঘােলাপানিতে মাছ শিকারের সুযােগ। ওদের পাশাপাশি মুজিব যুক্তিবাদিতার প্রতীক’অর্থাৎ সমর্থনযােগ্য। এই রাজনৈতিক সূত্রটি আরাে দু-একটি নিবন্ধে প্রকাশ পেয়েছে অনেকটা উদ্বেগ উকণ্ঠা নিয়ে। তাদের ধারণা, দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধ গেরিলা যুদ্ধে বিশেষ করে কৃষকগেরিলা যুদ্ধে পরিণত হলে শুধু যে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব হাস পাবে তাই নয় গােটা বিষয়টাই বিপ্লবীদের হাতে চলে যেতে পারে গণতমীদের একপাশে ঠেলে দিয়ে

বলাবাহুল্য পূর্ববঙ্গে গৃহযুদ্ধের এমন পরিণতি সাম্রাজ্যবাদী দেশ ব্রিটেন, আমেরিকা। কারােরই আকাক্ষিত হতে পারে না। তাই শেখ মুজিবুর রহমানের মাধ্যমেই পূর্বপাকিস্তানের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান কাম্য। | সে কারণেই ‘টাইমস’ সম্পাদকের অভিমত যে “ইসলামাবাদের আত্মপ্রসাদে খুশি থাকার কোনাে অবকাশ নেই। আর সে ক্ষেত্রে পরামর্শ হচ্ছে ব্রিটিশ সরকারের উচিত ঐ আত্মপ্রসাদের আবহ দূর হতে সাহায্য করা। স্যার ডগলাস হােমের এমন মন্তব্য যথেষ্ট নয় যে বর্তমানে সংঘটিত পূর্ব-পাকিস্তানি নাটক সেখানকার অভ্যন্তরীণ বিষয়’। অভ্যন্তরীণ বিষয়ও সময় বিশেষে, যেমন এক্ষেত্রে হয়েছে, ন্যায়বিচার ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হয়ে উঠতে পারে। | তাই সময় এসেছে পূর্ব-পাকিস্তানের ঘটনাবলী সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে প্রকাশ্যে জোরালাে ভাষায় অসন্তুষ্টি প্রকাশ করা এবং কূটনৈতিক পথে ইয়াহিয়া খানকে জানিয়ে দেওয়া দরকার যে তার অনুসৃত নীতি বিপজ্জনক ও ভ্রান্ত। প্রয়ােজনে পাকিস্তানে অর্থ সাহায্যদাতা দেশগুলাের এ বিষয়ে যৌথ উদ্যোগ নেওয়া দরকার, এমন কি এ ধরনের দুল সুবিচারের চেষ্টায় পশ্চিম-পাকিস্তানি সাধারণ মানুষ অসুবিধা পােহালেও তা। নেওয়া উচিত। পরিশেষে পশ্চিম-পাকিস্তানি কেন্দ্রীয় সরকার এবং পূর্ব-পাকিস্তানের  

জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে আলােচনা শুরু হওয়া জরুরি। এ সত্য জেনারেল ইয়াহিয়া যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করেন এবং মুজিবকে ফের ঢাকায় পাঠান, ততই মঙ্গল। | ‘পাকিস্তান সম্পর্কে বলার সময় হয়েছে’- ‘টাইমস’ পত্রিকায় প্রকাশিত উপরে উল্লিখিত সম্পাদকীয় নিবন্ধের (‘Pakistan: A Time to speak out’) নিতীক বক্তব্যের Becafe safe : … “a terrible communal bloodbath has been the result of the West-Pakistan decision to quell with bullets the democratically expressed wish of the East Pakistan Bengalis for a wide measure of autonomy. …There is no modern precedent in the sub-continent or elsewhere, for what can only be regarded as the deliberate intention on the part of the central Pakistani Government to wipe out, by killing, as many as possible of the adherents, present and future, of Bengali nationalism.

“General Yahya Khan, to do him justice, had a very difficult situation in his hands. It was due to his own, laudable desire to see democracy restored in Pakistan that general elections took place from which Sheikh Mujib emerged triumphant. Faced subsequently with the swelling tide of Bengali separatism, Yahya Khan’s duty as head of state, was clearly to seek to preserve the unity of the state. But Mujib, in the negotiations which preceded the final break, had never proposed secession, whatever his more fiery followers were shouting.

“Nor was it ever conceivable, whatever the present successes of West Pakistani forces, that a display of military strength could snuff out years of Bengali grievance and longing for a new deal. The one certain result of Yahya Khan’s fateful decision-other than the bloodshed-is that the way has now been opened, in East-Pakistan, to Maoists, Naxalites and other fishers in troubled waters, besides whom Mujib stands out as the epitome of reasonableness.

“A deplorable complacence now seems to be hanging over Islamabad. It is the duty of other governments, the British Government included, to help to dispel it. To say that the East-Pakistani drama is an internal affair”, as Sir Alec Douglas-Home has done, is not enough. Internal affairs can become, as this one has, crimes against justice and humanity.

“The time has come, it is indeed overdue for the British Government publicly to express its disgust in far stronger terms than it has yet done, at the course of events in East-Pakistan. Using the diplomatic channel, it needs to let Yahya Khan know just how dangerous and mistaken his policies are. If necessary concerted action among the suppliers of foreign aid to Pakistan should be considered even if it is rough justice to make the people of West-Pakistan suffer for the follies of their own non-elected military rulers. In the end some sort of discussion between the central Government in WestPakistan and the popular representatives in East-Pakistan is going to have to take place. The sooner General Yahya realises this, and send Mujib back to Dacca, so that there shall be some one responsible to talk to the better. 

সন্দেহ নেই উদ্ধৃত সম্পাদকীয় নিবন্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদ-ভিত্তিক গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার পক্ষে, স্বভাবতই পূর্ব-পাকিস্তানের পক্ষে মতামত প্রকাশ করা হয়েছে। এবং আরাে অনেকের মতােই সম্পাদকের ধারণা যে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান ভাঙার পক্ষে নন। স্বভাবতই এ নিবন্ধে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের শক্তি প্রয়ােগে সমস্যা সমাধানের সিদ্ধান্ত সমর্থন করা হয় নি। বরং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে গণতন্ত্রের রীতিনীতি মাফিক চলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে আবার রাজনৈতিক আলােচনা শুরু করতে। | কিন্তু একটু বিশদ বিচারে দেখা যায় যে এ পরামর্শের পেছনে একদিকে রয়েছে। পশ্চিমা ধাঁচের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা, অন্যদিকে পূর্ববাংলায় মাওবাদী উগ্রবাম রাজনীতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করা যা প্রতিবেশী দেশ পশ্চিম বঙ্গে তখন প্রবল ঢেউ তুলছে। এই দুই লক্ষ্য সামনে রেখে “টাইমস’ পত্রিকার রাজনৈতিক পরামর্শ ব্রিটিশ সরকার এবং সেই সঙ্গে পাকিস্তানের সামরিক সরকারের প্রতি উচ্চারিত হয়েছে। | এতটা স্পষ্ট ভাষায় না হলেও একই ধরনের চিন্তা মাথায় রেখে উল্লিখিত পাকিস্তানি সমস্যার বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন অন্য দু’একজন বিদেশী সাংবাদিক। তারা দিল্লিকলকাতা সম্পর্ক নিয়েও এ পরিপ্রেক্ষিতে ভেবেছেন। তবে সেটা সম্ভবত ছিল অতিভাবনা ও কষ্ট কল্পিত। তাদের আরাে বিশ্বাস বিভাজিত পাকিস্তান দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ভারসাম্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, তাই নানা উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে তাদের সৎ পরামর্শ দেওয়া। কিন্তু টাইমস’ বা অন্যদের এ জাতীয় পরামর্শ ব্রিটিশ বা মার্কিন সরকার কারাের মধ্যেই সাড়া জাগাতে পারে নি। আর জেনারেল ইয়াহিয়া তার সমরশক্তিতে এতই আস্থাবান ছিলেন যে কোনাে প্রকার সমঝােতার প্রস্তাব তার মনে ধরার কথা নয়, আপাত-সাফল্যের আনন্দে তিনি তখন আত্মহারা। পূর্ব-পাকিস্তান বনাম পশ্চিম-পকিস্তান অথবা পূর্ব-পাকিস্তান বনাম বাংলাদেশ যে রাজনৈতিক সমস্যা এবং সেখান থেকে সামরিক সমস্যা সৃষ্টি করে তা নিয়ে সংবাদ ভুবনে নানা কৌণিক বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে যে সূত্র বেরিয়ে আসে তার মধ্যে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল দুটো বিবেচনা। এক, অবিভক্ত পাকিস্তান এবং সেখানে গণতান্ত্রিক শাসনের নিশ্চয়তা দুই, যদি বিভাজন রাজনৈতিক ভুল ভ্রান্তির জন্য অনিবার্য হয়ে ওঠে সে ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে পাদপ্রদীপের আলােয় নিয়ে আসার চেষ্টা করা যাতে কোনাে উগ্র সমাজবাদী শক্তি প্রধান হয়ে উঠতে না পারে।

বিদেশী পত্রপত্রিকার সম্পাদকীয় ভাষ্যে, কখনাে সংবাদ-ভাষ্যে এ ধরনের রাজনৈতিক দিকনিশানার প্রকাশ দেখা গেছে। শুধু ‘টাইমস’ বা গার্ডিয়ান’ নয়, “অবজার্ভার’ পত্রিকার ২৮ মার্চ সম্পাদকীয় বিশ্লেষণেও এমনটা দেখা যায়। ঐ সম্পাদকীয় কলামে খুব স্পষ্ট ভাষাতেই বলা হয়েছে যে “অবিভক্ত পাকিস্তান নিয়ে বিশ্বভাবনা নেহাৎ কম নয়। কারণ এর বিভাজন এশিয়ার এই অস্থির অঞ্চলে অধিকতর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্ম দেবে। তাই বলে সামরিক জবরদস্তির মাধ্যমে কি এক বহুয়ি রাখা সম্ভব, না ঠিক? এতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উনানে। আরাে জ্বালানি সংযােজন করাই হবে, তাতে সমঝােতার কোনাে উপায়ই আর প্রেসিডেন্ট  ইয়াহিয়ার হাতে থাকবে না। কিন্তু পশ্চিম-পাকিস্তানের প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের চাপে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে ঐ আত্মঘাতী পদক্ষেপ নিতে হয়েছে।  ‘বর্তমান পরিস্থিতিতেও শেখ মুজিবকে দেশদ্রোহী’ হিসাবে অভিযুক্ত করা ইয়াহিয়ার পক্ষে চরম অর্বাচীনতার কাজ হবে। সমঝােতার আলোচনা যত কঠিনই হােক, কোনাে না কোনাে মীমাংসায় পৌছানাের ঐটাই একমাত্র উপায় । আর যদি ঐক্য বজায় রাখা নিতান্তই অসম্ভব হয়ে ওঠে তাহলে পূর্ব ও পশ্চিমের দুটো স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের মধ্যে শিথিল ঐক্য বন্ধনমূলক কনফেডারেশনও হতে পারে মঙ্গলজনক প্রস্তাব। গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে প্রচণ্ড ক্ষয়ক্ষতি ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের চেয়ে এ ব্যবস্থাই ভালাে” (দ্য অবজার্ভার, ২৮ মার্চ, ১৯৭১)। পঁচিশে মার্চ পাকিস্তানের স্বসৃষ্ট বিপর্যয় অর্থাৎ গৃহযুদ্ধের পরিণাম নিয়ে বিশ্বসংবাদ ভুবনে মাথাব্যথার অন্ত ছিল না। পাছে গৃহযুদ্ধের ফলে পূর্বাঞ্চলটাকে অন্য কোনো ভূতে পায়, সেটাও দুর্ভাবনার অন্য কারণ হতে পারে। ডেভিড হােল্ডেন সমস্যার দীর্ঘ আর্থরাজনৈতিক আলােচনায় উল্লেখ করেন যে পূর্ব-পাকিস্তানে আপাত বিচারে পাক-শাসকদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলেও মানসিক দিক থেকে পূর্ব-পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাও এক ধরনের প্রতিষ্ঠিত সত্য হয়ে উঠেছে। ‘পরিস্থিতি এমন দাড়িয়েছে যে সমঝােতা প্রায় অসম্ভব মনে হয়। এ পর্যায়ে শক্তি প্রয়ােগই স্বতঃসিদ্ধ হয়ে ওঠে। কিন্ত্র দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত পাকিস্তান তথা পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য অর্থনৈতিক বিপর্যয়ই টেনে আনবে। সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যাকে শক্তির দাপটে দমিয়ে রাখা সহজ কাজ নয়। তাছাড়া নদীমাতৃক বাংলাদেশে গেরিলা যুদ্ধের সুযােগও রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে নকশাল আন্দোলনের প্রভাব।

বর্ষীয়ান জননেতা মৌলানা ভাসানীর রাজনৈতিক সংগঠন ন্যাপ কৃষক বিপ্লবের ডাক দিয়ে গেরিলা যুদ্ধের সূচনা। ঘটালে অবাক হওয়ার কিছু নেই। দীর্ঘস্থায়ী সামরিক শাসন তাদের জন্য তেমন সুযােগ তৈরি করে দিতে পারে। | জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক বাহিনীতে উপস্থিত পাঞ্জাবি উগ্রপন্থীদের এমন ধারণা ঠিক নয় যে বাঙালি কৃষকদের লড়াইয়ের দিকে বড় একটা আগ্রহ নেই। ভারতীয় নকশাল আন্দোলন লড়াইয়ের বাস্তবতাই প্রমাণ করেছে। গণঅভ্যুত্থানের দৃষ্টান্তও সেখানে রয়েছে। তাই দীর্ঘস্থায়ী সামরিক দখলের প্রতিক্রিয়ায় সীমান্তের এপারে-ওপারে মাওবাদী বিপ্লবীদের মধ্যে সেতুবন্ধন অস্বাভাবিক নয়। আর তেমন সম্ভাবনা পিন্ডি, দিল্লি উভয়ের জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠতে পারে। অবশ্য স্বাধীন বাংলা যদি অবধারিতই হয়ে ওঠে তবে ভারতের দিক থেকে তা শেখ মুজিবের কর্তৃত্বে হওয়াই বাঞ্ছনীয়। তবে বিচ্ছিন্নতার উদাহরণ ভারতের জন্য স্বস্তিদায়ক হওয়ার কথা নয়। নির্বাচনে মিসেস গান্ধীর আপাত বিজয় সত্ত্বেও ভারতের একাধিক প্রদেশে বিচ্ছিন্নতার আন্দোলন দীর্ঘদিন। দমন করে রাখা কষ্টকর হতে পারে’ (দ্য সানডে টাইমস, ২৮ মার্চ, ১৯৭১)। | এ অস্বস্তি ভারতের জন্য বেশ অনেক দিনের। একাধিক ভাষিক-জাতিগত স্বাতঘের টানে বিচ্ছিন্নতার প্রবণতা ভারতের একাধিক প্রদেশে রাজনৈতিক সত্য হয়ে উঠলেও ভৌগােলিক সান্নিধ্য ও যােগাযােগের কারণে তা প্রবল হয়ে উঠতে পারছে না। তাছাড়া কেন্দ্রীয় শক্তি যথেষ্ট দৃঢ়ভিত্তিক। অন্যদিকে পূর্ব-পাকিস্তানের জন্য সবচেয়ে বড়  সুবিধাজনক অবস্থা হলাে কেন্দ্রীয় শাসনের সঙ্গে সীমান্তহীন ভৌগােলিক দূরত্ব যা কেন্দ্রকে অসুবিধাজনক অবস্থানে ফেলে দিয়েছে। বিচ্ছিন্নতার আন্দোলনে কেন্দ্রীয় শাসনের এ সমস্যা তাদের জানা থাকা সত্ত্বেও এবং ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের শত্রুতার সম্পর্কের প্রভাব এ ক্ষেত্রে পড়তে পারে এমন সম্ভাবনার পরও পাকিস্তানের সামরিক শাসন অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের জোরে সম্মাতের পথই বেছে নেয়।  পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলের মধ্যে এমনি ধারার ভৌগােলিক রাজনৈতিক আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভিন্নতার দিকগুলাে বিদেশী ভাষ্যকারদের আলােচনায় এসেছে, যদিও পাকিস্তানের সামরিক শাসকশ্রেণীর বিচারে এসব বিষয় ততটা গুরুত্ব পায় নি এজন্য যে তাদের মধ্যে এমন ধারণাই প্রবল যে সামরিক শক্তির সাহায্যে সব কিছু জয় করা চলে, সব সমস্যার সমাধান সম্ভব।

কিন্তু উল্লিখিত কারণগুলাে হিসাবের ফলেই সম্ভবত জনৈক বিদেশী ভাষ্যকারের কলমে এমন চমকপ্রদ বাক্যের প্রকাশ সম্ভব হয়েছে যে এক পাকিস্তানের নামে নিরস্ত্র জনতার ওপর সামরিক সরকারের সশস্ত্র আক্রমণ এটাই নিশ্চিত করেছে যে পাকিস্তান এক থাকতে পারে না। দু’বছর, পাঁচ বছর বা দশ বছরেই হােক দেশটা বিভক্ত হবেই’। এ বক্তব্য ঢাকা থেকে বিতাড়িত সাংবাদিক মার্টিন অ্যাডনির। ইয়াহিয়া-মুজিব সংলাপ উপলক্ষে ঢাকায় আসা এই সাংবাদিকই ১১ মার্চে লেখা তার প্রতিবেদনে বাঙালি জাতীয়তার ভবিষ্যৎ মেঘাবৃত বলে মন্তব্য করেছিলেন। আর পূর্বপাকিস্তানের অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় বিচ্ছিন্নতার ভবিষ্যৎও তার চোখে আশাপ্রদ মনে হয় নি। | হয়তাে এমন ধারণার কারণেই পাকিস্তানের বিভাজন নিশ্চিত’ এমন উক্তির পরও অ্যাডনি ঘটনার চুলচেরা বিচারে শেখ মুজিবের আইন অমান্য আন্দোলন, জাতিগত দাঙ্গা এবং জয়দেবপুর, সৈয়দপুর এবং সবশেষে চট্টগ্রামের অবাঞ্ছিত ঘটনাবলী পাক-বাহিনীকে আঘাতের সুযােগ করে দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। এ বিষয়ে ভুট্টোর ভূমিকা রয়েছে বলেও তার বিশ্বাস। তার আরাে বিশ্বাস, সামরিক শাসকদের সঙ্গে আলােচনায় সাফল্যের সম্ভাবনা না থাকাই মুজিবের দিক থেকে আপস মীমাংসায় ব্যর্থতার কারণ।  মার্টিনের ভাষায় “it is clear that the military were planning a military solution to Mujib’s political disobedience movement all the time the strike were continuing. The incidents at Joydebpur, Saidpur and finally Chittagong gave the army the outward excuse it coveted for the action it had decided to take and for which Mr. Bhutto, whose party dominates the Western provinces of Sind and Punjab, and has close army connections, has now publicly thanked God… Perhaps the secret to Mujib’s failure to compromise successfully was that he never expected to succeed… Certainly he saw himself as a martyr.” 

গৃহযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ অ্যাডনির চোখে ভিয়েতনাম নয়, সাইপ্রাস বলে মনে হয়েছে যেখানে সম্মত লেগেই আছে কিন্তু সফল পরিণতি ছাড়া। তেমনি সাত সংঘর্ষের কারণে এবং প্রাকৃতিক সমস্যা যেমন জনসংখ্যাচাপ, সাইক্লোন  বন্যা, আবহাওয়া ইত্যাদি বিরূপ পরিস্থিতির কারণেও পূর্ব-পাকিস্তানকে তার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহ রকম আশাভরসাহীন দেশ বলে মনে হয়েছে। তার আরাে ধারণা যে এসব সমস্যার সমাধান প্রায় অসম্ভব বলেই হয়তাে শেখ মুজিবের কাছে আপসের বদলে শাহাদৎ বরণই বাঞ্ছনীয় হয়েছিল। (“Objectively, natural problems-population pressure, vulnerability to cyclone and flood, climate-make East Pakistan one of the most frighteningly hopeless places in the world. If Sheikh Mujib had to grapple with the economic problems of what he calls ‘my wonderful land he might have become as disillusioned as his people. Perhaps that is why he preferred martyrdom to compromise”. The Guardian, 29 March, 1971). | মার্টিনের উল্লিখিত বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের সঙ্গে অনেকে একমত হতে চাইবেন না। কারণ কোনাে একপক্ষ মীমাংসা না চাইলে মীমাংসায় পৌছানাে যায় না। দু’পক্ষ থেকেই নমনীয়তার প্রয়ােজন হয়। ‘সালিশ মানি কিন্তু তালগাছ আমার এমন অযৌক্তিক মনােভাব। নিয়ে সমঝােতা বা মীমাংসা চলে না। আপস-মীমাংসা তাই বরাবরই চরিত্রবিচারে দ্বিপাক্ষিক। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যেমন সমঝােতার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না যা নানা ঘটনায় স্পষ্ট, তেমনি বিচ্ছিন্নতার প্রশ্নে তিনি শেখ মুজিবকে বুঝতে ভুল করেছিলেন। অন্যদিকে মুজিবের পক্ষে সম্ভব ছিল না জনসাধারণের ইচ্ছার বাইরে পা ফেলা। এসব কারণেই এমন এক সঙ্কট তৈরি হয়েছিল যেখান থেকে পরিত্রাণের কোনাে সহজ পথ। খােলা ছিল না।

তবু মুজিব সম্পর্কে এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে মার্টিনের বক্তব্য ভেবে দেখার মতাে। বিদেশী সাংবাদিকদের কারাে কারাে লেখায় কথাটা বারবার এসেছে যে ‘শেখ মুজিবের বিচ্ছিন্নতার প্রচেষ্টা বা বাঙালিদের বিদ্রোহ দমনের জন্যই পাক-সামরিক বাহিনী। আক্রমণের জন্য পথে নেমেছে।’ অথবা এমন কথা যে পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ বন্ধ করতে সামরিক বাহিনীর প্রচেষ্টা’। সাংবাদিকদের পক-সামরিক তৎপরতার বিবরণে বড় একটা। ভুল না থাকলেও উল্লিখিত প্রশ্নে কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব ছিল। কারণ বিচ্ছিন্নতার প্রচেষ্টা শেখ মুজিবের পক্ষ থেকে শুরু হয় নি যে সেনাবাহিনী নামিয়ে তা বন্ধ করতে হবে। পাক-সামরিক শাসকগণ নির্বাচিত বাঙালি জনপ্রতিনিধিদের হাতে কেন্দ্রীয় শাসন ক্ষমতা তুলে দিতে চায় নি। তাই একাধিক অজুহাত বা উপলক্ষ তৈরি করে পাক-বাহিনী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মাঠে নেমেছিল। স্বীকার্য যে আইন অমান্য আন্দোলনের অর্থ ছিল প্রকারান্তরে কেন্দ্রীয় শাসন অমান্য করা। কিন্তু এ পরিস্থিতি পুরােপুরি ইয়াহিয়াদেরই সৃষ্টি, তাই দায়টা তাদেরই।  ঢাকা থেকে রয়টারের প্রথম প্রত্যক্ষদর্শী সংবাদদাতার প্রতিবেদনে এ ধরনের কথাই বলা হয় যে পূর্ব-পাকিস্তানি নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিচ্ছিন্নতা-প্রচেষ্টা দমন করতে বৃহস্পতিবার পাক-সেনাবাহিনী এগিয়ে এসেছে’ (The Northern Echo, 29  March, 1971)।

কিন্তু এখানে কথাটা যে তাৎপর্যে বলা হয়েছে, এমন দৃষ্টিভঙ্গি সবার নয়। যেমন পিটার হ্যাজেলহাস্ট্রের (২৮ মার্চ) প্রতিবেদন শুরু হয় এই মর্মে যে সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তানিদের (অর্থাৎ বাঙালিদের) দমন করতে পাক-সেনাবাহিনী পূর্ব-পাকিস্তানে তৎপর হয়ে উঠেছে। উদ্দেশ্য শক্তিমান সংখ্যলঘুর স্বার্থরক্ষা।’ তেমনি ‘টাইমস’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলা হয় “পূর্ব-পাকিস্তানি বাঙালিদের বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের গণতান্ত্রিক ইচ্ছার প্রকাশ বুলেটে স্তব্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পশ্চিম পাকিস্তান”। আবার বিচ্ছিন্নতার আন্দোলন দমন করার কথা “গার্ডিয়ান’-এও বলা হয়েছে। আসলে ঘটনার মােটাদাগের মূল্যায়ন এ ধরনের ভ্রান্তির কারণ। আর এ নিয়ে ভিন্ন মতামত প্রকাশ পেয়েছে বিভিন্ন কাগজে। | যাই হােক হ্যাজেলহান্টের উল্লিখিত প্রতিবেদনে গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রাথমিক পদক্ষেপের যেমন প্রশংসা করা হয়েছে ঐতিহাসিক প্রচেষ্টা হিসাবে তেমনি ক্ষমতা হস্তান্তরে ব্যর্থতার জন্য মূলত ভুয়োকে দায়ী করা হয়েছে। বিশদ বিশ্লেষণে। এবং এ প্রসঙ্গে তার বক্তব্য স্পষ্ট যে ঘটনার সব দায় শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর চাপানাে যায় না। ভুট্টোর রাজনৈতিক চাপের কারণে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ভুল সিদ্ধান্তবশত সমস্যা সমাধানের সুযােগ নষ্ট করেছে। কিন্তু সেনাবাহিনীর পক্ষে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবল ঢেউ দমন করতে পারার সম্ভাবনা কম, বরং এর ফলে পূর্ব-পাকিস্তানে রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে এবং তা ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সীমান্তে ডেকে আনবে।’ | কথাটা মিথ্যা প্রমাণিত হয় নি। হ্যাজেলহাস্ট স্পষ্ট ভাষাতেই বলেছেন : “মি, ভুট্টো অস্বীকার করতে পারবেন না যে সঙ্কট দেখা দেওয়ার পূর্বপর্যন্ত ঘটনা বাংলাদেশে ঠিকঠাক মতােই চলছিল। শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম-পাকিস্তানি নেতাদের নিয়ে গণপরিষদে বসে সংবিধান রচনায় ইচ্ছুক ছিলেন। হয়তাে তা পাঞ্জাবিদের এবং মি, ভুট্টোর পছন্দসই হতাে না, কিন্তু দেশের ঐক্য বজায় থাকতাে। কিন্তু এরপর ভুট্টো এমন সব ঘটনা ঘটালেন যা বাঙালিদের ক্রুদ্ধ ও হতবাক করে, এবং চরম পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করে।…

পিটারের নিজের ভাষায় “But it is far more likely that the army will not be able to suppress the strong wave of Bengali nationalism and that the eastern province will be subjected to a blood bath that will bring Indian troops across the border. … One can hardly put all the blame on Sheikh Mujibur Rahman. Even Mr. Bhutto will have to recognise the fact that the things were moving along smoothly in Bengal until crisis arose last month. Sheikh Mujibur Rahman was quite prepared to enter the Constituent Assembly and frame constitution with the western leaders. Although the document might not have been acceptable to the Punjab and Mr. Bhutto, it would have kept the country together. But then Mr. Bhutto set in motion a course of events, which angered, bewildered and pushed the Bengalis towards the ultimate step.” 

শেখ মুজিবকে দায়ী করেছেন তার জেদ, যুক্তিহীনতা ও একগুয়েমির জন্য। অভিযােগ এনেছেন যে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের কোনাে ইচ্ছা তার ছিল না। কিন্তু প্রেসিডেন্ট জাতিকে জানাতে ব্যর্থ হয়েছেন যে শেখ মুজিব নিছক গণতান্ত্রিক পূর্ব উদাহরণই তুলে ধরেছিলেন এবং পূর্বাহ্নে কেন্দ্রীয় সরকার গঠনে রাজিও ছিলেন। তখন মি, ভুট্টোই জেদ ধরেন যে তার পার্টিকে নিয়ে যে কোনাে ধরনের অন্তর্বর্তী কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে হবে। একইসঙ্গে তিনি তার দাবির পক্ষে চাপ সৃষ্টির জন্য আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করেন। প্রেসিডেন্ট মি. ভুট্টোর চাপের মুখে নতি স্বীকার করেন। তার দ্বিধার ফাক দিয়ে মুহূর্তটি (সুযােগটি) শেখ মুজিবের হাত গলিয়ে বেরিয়ে গেল, সুযোেগ নষ্ট হলাে। এখন শেখ মুজিবকে দেশদ্রোহিতার দায়ে সামরিক আদালতে বিচার করতে গিয়ে প্রেসিডেন্টকে মনে রাখতে হবে যে এতে করে মি. ভুট্টো এবং প্রেসিডেন্ট প্রকৃতপক্ষে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির যৌথ ইচ্ছারই বিচার করবেন। কারণ গত নির্বাচনে তারা শেখকে ম্যান্ডেট দিয়ে সমর্থন জানিয়েছে।

এতটা স্পষ্ট ভাষায় ঘটনার সার-বিশ্লেষণ আগে কেউ করেন নি। পিটারের ভাষায় ; “The President told the nation that the Sheikh was obdurate, unreasonable and obviously had no desire to take part in the affair of a united Pakistan. One can fully understand the Presidents reasonable fears but he failed to tell the nation that the Sheikh had simply cited democratic precedents and had earlier said he was willing to form central government. It was Mr. Bhutto who insisted that his party must be included in any interim coalition government. At the same time, Mr. Bhutto mounted a civil disobedience movement in the Punjab to press his demand. The President gave way to Mr. Bhutto. He hesitated, the moment slipped out of Sheikh Mujib’s hands and the moment was lost.

“Now the Sheikh is to put to trial on a charge of treason at the military court and the President will have to remember that the East-Pakistanis showed at the last elections that they supported the Sheikh to a mandate. Mr. Bhutto and the President will ineffect be putting the collective will of 75 million Bengalis on trial” (The Times, 29 March, 1971)

একই দিনের ‘টাইমস’ পত্রিকায় প্রকাশিত সম্পাদকীয় নিবন্ধটির বক্তব্যও দু’একটি কারণে লক্ষ্য করার মতাে। নিবন্ধে বিদেশী সংবাদদাতাদের বাণ্ডিল বেঁধে ঢাকা থেকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া, পূর্ববঙ্গের গােপন বেতার-প্রচার, পশ্চিম-পাকিস্তান থেকে সরকারি খবর প্রচার এবং সেনাবাহিনীর দমন তৎপরতা এবং দেশজুড়ে তা নিশ্চিত করার সম্ভাবনা ইত্যাদি বিষয় বিচার করে অবশেষে বলা হয়েছে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর উভয় সঙ্কটের কথা। একদিকে প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের সঙ্গে রাষ্ট্রিক সম্পর্কের বিবেচনা অন্যদিকে পূর্ব-পাকিস্তানি বাঙালিদের দুর্গতিতে ভারতীয় বাঙালির আবেগ, যা অংশত সর্বভারতীয় ভিত্তিতেও মিথ্যা নয়। সম্পাদকীয় বক্তব্যে ভারত-পাকিস্তান উভয়কে স্থির ও সংযত পদক্ষেপ নেবার প্রচ্ছন্ন আহ্বান জানিয়ে আসল কথাটি বলা হয়েছে যে পূর্ব-পাকিস্তানে দীর্ঘস্থায়ী গেরিলা যুদ্ধ সেখানকার বিপ্লবী দলগুলাের তৎপরতার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। ওরা যেমন  নেতৃত্বের জন্য চীনের দিকে হাত বাড়াতে পারে তেমনি স্বাধীন পূর্ববাংলা সীমান্ত বরাবর পশ্চিম বঙ্গের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যােগসূত্র তৈরি করতে পারে। তখন যুক্তবঙ্গের স্বপ্ন নিশ্চিতই দেখা দেবে এবং সে ক্ষেত্রে ভারতকেও বিচ্ছিন্নতার সম্ভাবনার মুখােমুখি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। পূর্ব-পাকিস্তানি সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে মিসেস গান্ধীর সমস্যাও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার চেয়ে কম নয়। তবে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সতর্কতা থেকে মনে হয় এ বিপদ সম্পর্কে তিনি সচেতন। (“A prolonged guerilla struggle developing in the eastern province could expand the influence of those revolutionary parties in East- Pakistan that look to China for leadership. Alternatively there is the long-term prospect that an independent East Bengal… might want to foster closer links with West Bengal across the Indian frontier. The dream of a united Bengal would then certainly be floated, and India would have to face moves for secessation… such dangers exist irrespectively of any attitude adopted by China towards East-Pakistan or any action by China in support of guerilla-a long standing fear among some circles in India. Mrs. Gandhi’s problems are hardly less than those of President Yahha Khan. Her caution yesterday shows that she is well aware of the danges” (The Times, 29 March, 1971) 

সম্ভবত এমনি অহেতুক এক জুজুর ভয়ের কথা মনে রেখেই মার্কস-এঙ্গেলস প্রায় দেড়শ বছর আগে লিখেছিলেন ; “A spectre is haunting Europe the spectre of communism”. শুধু ইউরােপেই নয়, ঐ আতঙ্ক দ্রুতই সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। আর এর প্রভাব এত ব্যাপক হয়ে ওঠে এবং সাম্রাজ্যবাদী ও ধনবাদীদের মনে এমনই চমক সৃষ্টি করে যে এ আতঙ্ক জুজুর ভয়ের মতাে অনেক সময়ই অহেতুক আতঙ্ক হয়ে ওঠে। একাত্তরের মার্চ মাসের ঘটনাবলী বিদেশী সংবাদ ভুবনের কোথাও কোথাও এমনি অহেতুক আশঙ্কার জন্ম দিয়েছিল।  এর আগেও কয়েকটি প্রতিবেদনে এ ধরনের আশঙ্কা প্রকাশ করে পূর্ববঙ্গের জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে মন্দের ভালাে হিসাবে গ্রহণ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসনকে। আলােচ্য সম্পাদকীয় নিবন্ধে সেই সতর্কবাণী ভারতপাকিস্তান দুই প্রতিবেশী দেশের শাসকদের উদ্দেশ্যে উচ্চারিত  দীর্ঘস্থায়ী গেরিলাযুদ্ধের অবশেষ পরিণামের উল্লিখিত সম্ভাবনা খারিজ না করেও বলা চলে যে তখনকার বহুবিভক্ত বিপ্লবী দলগুলােকে সমন্বিত করার মতাে কোনাে নেতৃত্ব ছিল না। ছিল না তাদের মধ্যে তেমন মানসিকতা। দ্বিতীয়ত পূর্ব-পাকিস্তান সম্পর্কে চীনের আগ্রহ ছিল সামান্যই, যতটা ছিল কাশ্মিরকে কেন্দ্র করে, সিল্করুট, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সামরিক গুরুত্ব বিবেচনায় যতটা ছিল পশ্চিম-পাকিস্তানকে ঘিরে। এসব তথ্য তখন খুব একটা গােপন ছিল না।

আর স্বাধীন বাংলার পেছনে সক্রিয় রাজনৈতিক স্বার্থ, আদর্শ ইত্যাদি বিবেচনায় সেসময়ও জাতীয়তাবাদের প্রেরণা ছিল ভাষা ও ভূখণ্ড-ভিত্তিক, যে ভূখণ্ডকে বাঙালি মুসলমান একদা প্রবল আবেগে, প্রতিযােগিতামুক্ত আশ্রয়ের জন্য দেশবিভাগের মাধ্যমে বাস্তব সত্যে পরিণত করেছিল। সে স্বাতন্ত্র্যবাদী আবেগ পাকিস্তানি অনাচার ও আঘাতের মুখে চাপা পড়লেও হারিয়ে যায় নি। দুঃসময়েও ঐ মনােভাব কিছুটা শনাক্ত করতে পারা গেছে, যা স্বাধীনতার ঠিক পরপরই প্রকাশ পেয়েছে কথিত সংখ্যালঘুদের প্রতি  সংখ্যাগরিষ্ঠের আচরণে। নিদ্বিধায় বলা যায়, সাধারণ হিসাবে যুক্তবঙ্গের স্বপ্ন” তখন কেউ দেখে নি, আর পরে তাে নয়ই, বরং পরে স্বাতন্ত্র্যচেতনাই সিংহভাগ জনসংখ্যায় উপস্থিত। তাই অন্তত পশ্চিমবঙ্গের বিচ্ছিন্নতা নিয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্বিগ্ন হওয়ার মতাে কোনাে কারণ ছিল না, যদিও ছিল চীনকে নিয়ে, তবে তা উত্তর ও পশ্চিম সীমান্ত ঘিরে। সে জন্য তখনকার পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের গৃহযুদ্ধে যুক্তৰঙ্গ ও বাম বিপ্লবের আশঙ্কা অহেতুক ভয় হিসাবেই বিবেচ্য। অবশ্য নর্দার্ন ইকো’ পত্রিকায় প্রকাশিত রয়টারের পূর্বোক্ত প্রতিবেদনে বিচ্ছিন্নতার প্রচেষ্টার কথা বলা হলেও ঘটনার ভয়াবহতা সেখানে যথাযথ বাস্তবতা নিয়েই প্রকাশ পেয়েছে। বলা হয়েছে অন্যান্যদের সঙ্গে রয়টার্স প্রতিনিধিকেও বাণ্ডিল বেঁধে বিমান বন্দরে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা, বলা হয়েছে তাদের সঙ্গে সেনা-অফিসারদের অসৌজন্যমূলক, এমন কি আপত্তিকর আচরণের কথা (যা তারা অনেকে তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, বিশেষত মেজর সিদ্দিক সালিকের কথা), সেই সঙ্গে শহরের বিভিন্ন দিক থেকে আকাশে পাকিয়ে ওঠা ধোঁয়ার কুণ্ডলি এবং পথে যেতে যেতে দেখা ভস্মীভূত দোকান-বাজার ও ঝুপড়ির কথা। | আশ্চর্য যে রয়টার্স প্রতিনিধির প্রশ্নের জবাবে অর্থাৎ আগুন, ধোঁয়া, বিস্ফোরণের শব্দ, রকেট লাঞ্চার ব্যবহার ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্নের জবাবে মেজর সালিকের বক্তব্যও ছিল হুবহু করাচি বিমানবন্দরে সামরিক মুখপাত্রের বক্তব্যের মতােই। তাদের তােতাপাখি ভাষায় রকেট লাঞ্চারের ব্যবহার রাস্তায় ব্যারিকেড সরানাের উদ্দেশ্যে আর বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ভূপীকৃত গোলাবারুদে আগুন লাগার কারণেই যত সৰ বিস্ফোরণের বিকট আওয়াজ। সর্বোপরি তাদের মতে এ অপারেশনের একটাই উদ্দেশ্য : পূর্ব-পাকিস্তানে অবৈধ কর্তৃত্বের অবসান ঘটিয়ে বৈধ শাসনের প্রতিষ্ঠা’ (The Northern Echo, 29 March, 1971))। সত্যই সামরিক সদস্যদের প্রত্যেকেই বুঝি একই ভাষায় কথা বলে, মুখস্থ বুলির বাইরে যেতে পারে না। 

সূত্র : একাত্তরে পাকবর্বরতার সংবাদভাষ্য – আহমদ রফিক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!