You dont have javascript enabled! Please enable it!

নির্বাচনী বিজয় থেকে রাজনৈতিক সঙ্কটে

সত্যি বলতে কি জন্মের ‘তেইশ বছরের মধ্যে পাকিস্তানে এই প্রথম সাধারণ নির্বাচন এমনটাই পশ্চিমা সংবাদপত্রের মতামত। প্রায় দুই দশকে দেশে রাজনৈতিক-সামাজিক পরিবর্তন কম হয় নি। মানুষ অনেক কিছু দেখেছে, অনেক শিখেছে। নির্বাচন ঘিরে তাদের প্রত্যাশা এবার ভিন্ন রকম; রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, সাধারণ মানুষ সবারই বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানে, যে-‘পূর্ব পাকিস্তানে’ সিংহভাগ বাঙালি শিক্ষিত শ্রেণীর মুখে অহরহ ‘বাংলাদেশ’ নামে উচ্চারিত হচ্ছে, লেখায়ও প্রায়শ তা প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। কিন্তু মানুষের ঐ প্রত্যাশা সফল হয় নি।  নির্বাচনের ঠিক দু’দিন পরই বিজয়ী জননেতা শেখ মুজিবুর রহমান এক ঘােষণায় জানান যে নির্বাচনে এ বিজয় জনগণের পক্ষে আওয়ামী লীগের ৬-দফা এবং ছাত্রদের ১১-দফা সমর্থনের ভিত্তিতে অর্জিত হয়েছে এবং এই ভিত্তিতেই অর্থাৎ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিতে দেশের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র রচিত হবে।’ (পাকিস্তান অবজার্ভার, ১০ ডিসেম্বর, ১৯৭০)। একই বক্তব্য প্রকাশ পায় করাচিতে “ডন” পত্রিকায় ১৮ ডিসেম্বর (১৯৭০)।  এ ঘােষণার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পেতে দেরি হয় নি। সম্ভবত আওয়ামী লীগে প্রধানের এ বক্তব্যের জবাব দেবার উদ্দেশ্যেই ২০ ডিসেম্বর লাহােরে পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন যে তার দলের সহযােগিতা ছাড়া পাকিস্তানে। শাসনতন্ত্র তৈরি করা যাবে না, কিংবা কেন্দ্রে কারাে পক্ষে সরকার গঠন বা সরকার পরিচালনা সম্ভব হবে না’ (পাকিস্তান টাইমসূ, ২১.১২,৭০)। রীতিমতাে চ্যালেঞ্জ, সেই সঙ্গে হুমকিও। এর অর্থ স্পষ্ট ; তােমরা যত সংখ্যাগরিষ্ঠই হওনা কেন পশ্চিম পাকিস্তানের সমর্থন ছাড়া কোনাে কিছুই চলবে না। (“Mr. Z.A. Bhutto, Chairman of the Pakistan People’s Party declared in Lahore that no constitution could be framed nor could any government at the centre be run without his party’s co-operation.”-The Pakistan Times, আশ্চর্য যে পশ্চিম পাকিস্তান বলতে জনাব ভুট্টো তার পিপলস পার্টির সমর্থক দেশই বুঝিয়ে এসেছেন। হিসাবে আনেন নি নির্বাচনের বাস্তব সংখ্যাতত্ত্ব যে পশ্চিম পাকিস্তানে তার বিরােধী দলগুলাের আসন সংখ্যা নেহাৎ কম নয়।

কথাটা সেখানকার  ভুট্টো-বিরােধী নেতাদের মুখেও উচ্চারিত হয়েছে যে তাদের বাদ দিয়ে ভুট্টোর পিপলস পাটি গােটা পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। তারাও জনগণের ভােটেই নির্বাচিত । তবু জনাব ভুট্টো একাই পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষ হয়ে কথা বলে থাকেন এবং সামরিক শাসন মনে হয় তা মেনেও নিয়েছে। ছয় দফা বা স্বায়ত্তশাসন নিয়ে আদপেই ভুট্টো বা সামরিক নেতাদের ভয়ের কোনাে কারণ ছিল না অন্তত দেশের ভালাে মন্দের পরিপ্রেক্ষিতে। তাদের মনে পাকিস্তান ভেঙে যাওয়া অর্থাৎ বিচ্ছিন্নতার যে-প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল তা ছিল নিতান্ত অমূলক। বিশদ বিচারে ছয় দফা ছিল আঞ্চলিক বৈষম্যের পরিপ্রেক্ষিতে আঞ্চলিক স্বার্থরক্ষার সনদ, সেই সঙ্গে প্রাদেশিক স্বার্থরক্ষারও বটে, অবশ্য যদি প্রদেশ তা চায়। ছয় দফা ছিল আঞ্চলিক স্বার্থ, প্রাদেশিক স্বার্থ তথা তাদের উন্নয়নের দাবি, বিচ্ছিন্নতার কোনাে বিষয়ই নয়। তাছাড়া ছয় দফার প্রবক্তা শেখ মুজিবুর রহমান তার ঘােষণা, বিবৃতি বা বক্তৃতায় স্পষ্ট করে একাধিক বার কথাটা বলেছেন। বলেছেন যে ছয় দফা অনিচ্ছুক কোনাে প্রদেশের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে না। তাছাড়া জাতীয় পরিষদে বিষয়টি নিয়ে বিশদ আলােচনার সুযােগও রয়েছে। তা সত্ত্বেও তাদের সন্দেহ, ভয় কাটে নি। বাস্তবিক ছয় দফা বা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কে পশ্চিম-পাকিস্তানি মহলবিশেষের সন্দেহ ও বিরূপতার পেছনে বিচ্ছিন্নতার আশঙ্কা নয়, বস্তুত অন্য কোনাে গঢ় কারণ প্রধান হয়ে উঠেছিল। এবং সেটা ভুট্টোর মতাে কিছুসংখ্যক রাজনৈতিক নেতা এবং সামরিক শাসকদের মধ্যে। তাদের উদ্দেশ্য তাদের গণ্ডির বাইরে থেকে অন্য কেউ এসে যেন পাকিস্তানের খাস আসনে বসতে না পারে, আর বাঙালি তাে নয়ই। ইসলামাবাদের সিংহাসন ইসলাম-পসঙ্গ পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতেই থাকবে। আর বাঙালি মুসলমানদের ওরা যে কখনই সাচ্চা মুসলমান মনে করতাে না তার বহু নজির রয়েছে। আশ্চর্য যে বাঙালি মুসলমানের একাংশ এই নিয়ে যথেষ্ট হীনম্মন্যতায় ভুগেছে, বােধহয় এখনাে ভােগে। স্বভাবতই কায়েমি স্বার্থের ঐসব প্রতিনিধিদের পক্ষে প্রয়ােজন হয়ে পড়ে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের অপব্যাখ্যা, পশ্চিম পাকিস্তানি জনগণের কাছে অগ্রহণযোগ্য স্পর্শকাতর ব্যাখ্যা দেওয়া যাতে জনমানস উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। তাই নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে ছয় দফা নিয়ে আওয়ামী লীগের অনমনীয়তার কথা তারা জোরেসোরে প্রচার করেছে কিন্তু উল্লেখ করে নি ভুট্টোর অনমনীয়তা বা অযৌক্তিক জেদের কথা। কারণটা স্বার্থের, বিশেষ করে গােষ্ঠী-স্বার্থের।

এ ধরনের বাঙালি-বিরােধী মনােভাব সামরিক বাহিনীর মধ্যে ব্যাপকভাবেই উপস্থিত ছিল যা তাদের কথাবার্তায় বা মন্তব্যেও প্রকাশ পেয়েছে। তাই জেনারেল ইয়াহিয়ার জনৈক ঘনিষ্ট জেনারেল ডিসেম্বরের (১৯৭০) শেষ দিকে ঢাকায় গভর্নমেন্ট হাউসে অনুষ্ঠিত এক ডিনার পার্টিতে ভুরিভোজন-শেষে মন্তব্য করেন : পূর্ব-পাকিস্তানের কালাআদমিদের আমাদের ওপর কর্তৃত্ব করতে দেওয়া হবে না’ (সিদ্দিক সালিক)। এ মন্তব্য সুরাপান-জনিত কারণে হয়ে থাকলেও ওটাই ছিল তাদের মনের কথা। জঙ্গি সেনানায়কদের প্রভুত্বপ্রিয়তা ও যে-কোনাে উপায়ে ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা পাকিস্তানি  সেনাবাহিনীর বরাবরের ঐতিহ্য। কথাটা যেভাবেই হােক শেখ মুজিবুর রহমানের কানে পৌছায়। তিনি এক বক্তৃতায় সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে আনুষ্ঠানিক ধন্যবাদ জানাতে গিয়ে তাকে সতর্ক করে দেন এই বলে যে তার অধীনস্থ কিছু উচ্চপদস্থ কুচক্রী ঢাকায় বসেই নির্বাচনী ফলাফল নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, তিনি যেন তাদের এ কাজ থেকে নিরস্ত করেন (পাকিস্তান অবজার্ভার, ৪.১,৭১)। কিন্তু কে কাকে নিরস্ত করবে যখন সর্ষের মধ্যে ভূত। প্রেসিডেন্ট নিজেও ছয় দফা সম্পর্কে নিঃসংশয় ছিলেন না। তাই ছয় দফা সামনে রেখে শাসনতন্ত্র রচনা নিয়ে সমস্যা তৈরি স্বার্থবাদীদের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে তৈরি-করা এ সমস্যা শুরুতে ত্রিপক্ষীয় হলেও পরে তা দ্বিপক্ষীয় চরিত্র অর্জন করে। একদিকে পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিতে পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি’)কে কেন্দ্র করে সদ্য আবির্ভূত সিন্ধি রাজপুত্র জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্রবল রাজনৈতিক উচ্চাকাক্সক্ষা এবং পাকিস্তানের একচ্ছত্র নায়ক হয়ে ওঠার অদম্য বাসনা। অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত পূর্ব-পাকিস্তানের স্বাধিকারের পক্ষে নির্বাচনী ‘ম্যান্ডেট’-পাওয়া ও নবজাগ্রত বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতিনিধি-স্থানীয় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং দলীয় প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান। মাঝখানে প্রভুত্বপ্রিয় সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও তার জঙ্গি জেনারেলগণ।  এর সঙ্গে যুক্ত ছিল আরাে কিছু সূত্র। যেমন ১৯৬৫ সালে সংঘটিত ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধশেষে সােভিয়েত ইউনিয়নের তাসখন্দে ফিল্ডমার্শাল প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খাঁ’র নতমস্তক রাজনীতি, আইয়ুবের মন্ত্রিত্ব ছেড়ে রাজনীতিক হয়ে-ওঠা ভুট্টোর ভারত-বিরােধী ভূমিকার বদৌলতে সামরিক বাহিনীতে নয়া প্রভাব, বিশেষ করে জঙ্গি জেনারেলদের সঙ্গে আঁতাত ইত্যাদি একাধিক ঘটনা উল্লিখিত সমস্যায় জটিলতা সৃষ্টির কারণ হয়ে ওঠে। 

তাই নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পর থেকেই জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের কারণে পশ্চিম-পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনে সংশয়, আশঙ্কা ও ষড়যন্ত্রের কালােছায়া ঘনিয়ে আসতে থাকে। প্রধানত পাঞ্জাব ও সিন্ধুর প্রতিনিধি হিসাবে ভুট্টোর পিপিপি দলের নির্বাচনী সাফল্য ঐ সমস্যা সৃষ্টি করে। পেছনে থাকে কাইউম খানের মতাে দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকের সমর্থন। পাকিস্তানি রাজনীতিতে ও সমরতন্ত্রে বরাবরই শক্তির উৎস পাঞ্জাব, আধিপত্যের দাপটও সেখান থেকেই। সাময়িক হলেও সিন্ধুর ভুট্টো ঐ শক্তির সঙ্গে একাত্ম হয়ে ওঠেন, বিশেষ করে আইয়ুব খাঁ’র পতন ও সত্তরের নির্বাচন উপলক্ষে। এই সূত্রেই ভূট্টোর রাজনৈতিক আকাক্ষা, পাকিস্তান শাসনের ইচ্ছা প্রবল হয়ে ওঠে। এভাবেই নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে সৃষ্ট সমস্যার ত্রিভুজ অর্থাৎ ত্রিপক্ষীয় চেহারা দ্বিপক্ষীয় হয়ে যায়। সামরিক শক্তির একটি প্রধান এবং নিয়ন্ত্রক অংশ ভুট্টোর পক্ষে চলে আসে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সেখানে নিমিত্ত মাত্র তাই তার পার্শ্বপরিবর্তনে বেশি সময় লাগে নি। কিন্তু ভুট্টো সাহেবের জানা ছিল না যে তখনকার পাকিস্তানি পরিস্থিতিতে ঐ উচ্চাকাঙক্ষা ছিল। ‘প্যান্ডােরার বাক্স আপাতদৃষ্টিতে বিস্ময়কর মনে হলেও অস্বীকারের উপায় নেই যে মৌ-লােভী ইয়াহিয়া  খান বারবারই সিন্ধি চাতুর্য ও চাপের কাছে নতি স্বীকার করেছেন। অবশ্য সাধারণ নির্বাচনের আগে এবং অব্যবহিত পরে তার কথাবার্তায় যে কারণেই হােক পূর্ব-পশ্চিম নিয়ে একধরনের নিরপেক্ষ মনােভাবই যেন প্রকাশ পেয়েছে। পেয়েছে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ইচ্ছা। যেজন্য সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হতে পেরেছিল। সেদিক থেকে পূর্ব-পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক লে, জে, সাহাবজাদা ইয়াকুব খান কিংবা গভর্নর ভাইস অ্যাডমিরাল এস, এম, আহসান তার ইচ্ছারই প্রতিনিধিত্ব করেছেন। যেজন্য সামরিক বাহিনীর জঙ্গিদের মনে হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক আইন প্রকৃতপক্ষে নখদন্তহীন সামরিক শাসনের নামান্তর মাত্র।’ | কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে বিরাজমান রাজনৈতিক উত্তাপের তাৎপর্য বুঝে বা না-বুঝে হােক দেশে একটা সুষ্ঠু সাধারণ নির্বাচন যথাযথভাবে শেষ করা যে ইয়াহিয়া খানের তাৎক্ষণিক উদ্দেশ্য ছিল তা বােঝা যায় নির্বাচনােত্তর তার বক্তব্যে ও ভূমিকায়। নির্বাচনের ফলাফল (আওয়ামী লীগ ১৬০, পাকিস্তান পিপল্স পার্টি ৮৩, মােট আসন ৩০০। আওয়ামী লীগ যেমন পশ্চিম পাকিস্তানে কোনাে আসন পায় নি, তেমনি ভুট্টোর পি.পি.পিও পূর্ব পাকিস্তানে কোনাে আসন পায় নি) দেখার পরও ইয়াহিয়া খান যথাযথভাবে নির্বাচন পরিচালনার জন্য পূর্ব-পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক ইয়াকুব খানকে ধন্যবাদ জানান। এবং সেই সঙ্গে জাতির উদ্দেশ্যেও অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন।

এমনকি ঢাকায় সংখ্যাগরিষ্ঠ। দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচনােত্তর আলােচনা শেষে করাচি ফেরার পথে ঢাকা ও করাচি বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানকে দেশের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসাবে আখ্যায়িত করেন (পাকিস্তান অবজার্ভার, ১৫,১.৭১)। (“Prior to his departure for Karachi on Thursday, President Yahya Khan told newsmen at the Dacca airport that he had useful discussion with Sheikh Mujibur Rahman and the Awami League leaders during his stay in Dacca for the last three days. … The president said that Sheikh Mujibur Rahman was going to be the future Prime Minister of the country. … When he comes and takes over I won’t be there. It is going to be his Government soon.”-The Pakistan Observer, January 15, 1971)। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার শেষ কথাটায় (আমি তখন থাকবাে না) যে একটু অশুভ ইঙ্গিত ছিল তা পূর্বীরা ধরতে পারে নি। | তবে এ কথাও সত্য যে এসব কোনাে কিছুই তার কাছে পাকিস্তানের সংহতির বিনিময়ে নয়। আর সে কারণেই ঢাকায় আওয়ামী লীগ প্রধানের সঙ্গে আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে সন্তোষ প্রকাশ করে লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কের (এল.এফ.ও.) অন্তর্গত তুরুপের তাসটা তিনি ধরে রাখেন। যাতে শাসন ব্যবস্থা বা সংবিধান পছন্দসই না হলে অনায়াসে তা বাতিল করে দিতে পারেন। অবশ্য সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন : অনুমােদনের (authentication) বিষয়টা আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। বিশেষ মহল থেকে প্রচারের কারণে ৬-দফা নিয়ে তার মনেও দ্বিধা ও আশঙ্কা ছিল। আর তা ক্রমশ নানা সূত্রে ঘন হয়ে কালাে ছায়া ফেলতে থাকে। বিশেষ করে জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে দফায় দফায় আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে, সম্ভবত জঙ্গি সমরনায়কদের মতামতের প্রভাবেও। 

অন্যদিকে ৬-দফা সম্পর্কে ভুঠেীর বিরূপতা ও বিরােধিতায় কোনাে রাখঢাক ছিল না। নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পর থেকেই ভুট্টোর উত্তেজক মন্তব্যে তা স্পষ্ট। রাজনীতির গণতান্ত্রিক রীতিনীতি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে তিনি লাহােরে ঘোষণা করেন, জাতীয় রাজনীতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতাই একমাত্র কথা নয়, বিশেষ করে পাকিস্তানের অভূত ভৌগােলিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে।’ (“Majority alone does not count in national politics”)। সর্বোপরি তার সুস্পষ্ট হুমকি ‘পিপিপি জাতীয় পরিষদে বিরােধী দলীয় বেঞ্চে বসতে রাজি নয়’ (পাকিস্তান টাইমস, লাহাের, ২১.১২.৭০)। কথাগুলাে তিনি এর পরও একাধিক বার উচ্চারণ করেন লাহাের, করাচি, হায়দ্রাবাদ এবং অন্যত্র তার বক্তৃতায় । তার মতে ‘পাঞ্জাব ও সিন্ধু পাকিস্তানে রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষমতার উৎস। এ দুটো প্রদেশের জনমত এখন তার পক্ষে। তাই পূর্ব-পাকিস্তান তার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে একা পাকিস্তান শাসন করতে পারে না। শাসন করতে চাইলে দরকার হবে পিপিপি’র সঙ্গে ক্ষমতার ভাগাভাগি, দরকার ঐকমত্যের সরকার গঠন। কিন্তু আওয়ামী লীগের পক্ষে এ প্রস্তাব মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। কারণ তারা গােটা পাকিস্তানের পরিপ্রেক্ষিতে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল। তার চেয়েও বড় কথা তাদেরও রয়েছে জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি এবং জনগণের কাছ থেকে পাওয়া ৬-দফা দাবির সমর্থন (ম্যান্ডেট’)।  এখানেই সমস্যার আরাে একটি বড় উৎস। আওয়ামী লীগ তাই ৬-দফার ভিত্তি থেকে সরে আসতে চায় নি। কিন্তু ভুট্টো পাকিস্তানের সংহতির প্রশ্ন তুলে ঐ দাবির সঙ্গে একমত হতে রাজি নন। তার ভাষায় ৬-দফার সব দফা মানা যায় না, তাতে কেন্দ্র দুর্বল হয়ে পড়বে।’ প্রভুত্বপ্রিয় সামরিক নেতাদেরও একই মত। তারা ভুট্টোর ভারতবিরােধী বক্তব্যের জাদুতে মুগ্ধ। সম্ভবত একই কারণে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াও এক পর্যায়ে তার পূর্ব-অবস্থান থেকে সরে গিয়ে এমন সিদ্ধান্তে পৌছান যে সংবিধানের মূলনীতি সম্পর্কে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনপ্রতিনিধিরা ঐকমত্যে না পেীছানাে পর্যন্ত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকা ঠিক হবে না, তাতে জটিলতাই বাড়বে। কিন্তু ইয়াহিয়ার এ ধারণা গণতন্ত্রসম্মত ছিল না। সংসদীয় গণতন্ত্রের বিধিবিধান মতে নির্বাচনে গােটা দেশের আসনসংখ্যার হিসাবে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দলই সরকার গঠন করার কথা।

সে হিসাবে প্রেডিডেন্ট ইয়াহিয়ার কর্তব্য হয়ে ওঠে আওয়ামী লীগকে কেন্দ্রে সরকার গঠনের জন্য আমন্ত্রণ জানানাে। কিন্তু ভুট্টোর দাবি, ৬-দফা নিয়ে সংশয় এবং সংবিধান রচনা নিয়ে আশঙ্কা ইত্যাদি কারণে তিনি গণতন্ত্রের বিধিসম্মত পথ এড়িয়ে যান। তার অযৌক্তিক দাবি ; সংখ্যালঘু দলের (যেহেতু পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ) সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সমঝোতায় পৌছানাে অপরিহার্য। বিষয়টাকে আরাে জটিল করে তােলার উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্ট সেখানে আরাে একটি শর্ত জুড়ে দেন (এটাও ছিল ভুট্টোর অন্যতম প্রধান দাবি), অনেকটা ঘােড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়ার মতাে করে। সেই শর্ত হলাে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন শুরুর আগে সাংবিধানিক মূল নীতির। ফয়সালা করে নিতে হবে।   এর অর্থ খুব স্পষ্ট। পূর্ব-পাকিস্তানের মতিগতির ওপর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বা তার সামরিক নেতৃত্বের যেমন বিশ্বাস ছিল না, তেমনি ছিল না নব্য রাজনীতিক জুলফিকার আলী ভুট্টো কিংবা কাইউম খান প্রমুখ রক্ষণশীল রাজনৈতিক নেতার। এরা ধরেই নিয়েছিল যে ৬-দফার অর্থ পশ্চিম থেকে পূর্বের বিচ্ছিন্নতা, স্বায়ত্তশাসন মানে পাকিস্তানের ভাঙন। সম্ভবত পূর্ব পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক দিক থেকে দুই যুগ ধরে | শােষণ-বঞ্চনার অপরাধবােধ থেকে এ ধরনের সন্দেহ-সংশয়ের জন্ম। কিন্তু বাস্তব অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্নই ছিল; সে আলােচনা পরে আসছে। | এ পরিস্থিতিতে প্রেডিডেন্ট ইয়াহিয়া তার নির্বাচন সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতি এবং নৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতা পূরণ করার উদ্দেশ্যে ভুট্টোর সঙ্গে কয়েক দফা আলােচনার পর ৩ মার্চ (১৯৭১) জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের দিন ধার্য করেন। সেই মর্মে ১৩ ফেব্রুয়ারি তার ঘােষণা : ‘ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য এ সংসদীয় অধিবেশনে দেশের ভবিষ্যৎ সংবিধান রচিত হবে’ (পাকিস্তান টাইমস, ১৪.২.৭১)। | এ ঘােষণায় ঢাকার রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আশার সঞ্চার হয়। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে এর প্রতিক্রিয়া ছিল মিশ্র। বালুচিস্তান, সীমান্তপ্রদেশের ভুট্টোবিরােধী রাজনীতিকদের প্রতিক্রিয়া এ ঘােষণার অনুকুলে হওয়া সত্ত্বেও পিপিপি-প্রধান হঠাৎ করেই বেঁকে বসেন, যদিও ধারণা করা হয় প্রেসিডেন্ট তার সঙ্গে আলােচনার পরই সংসদ অধিবেশনের তারিখ ঠিক করেছিলেন।

কোনাে কোনাে রাজনৈতিক ভাষ্যকারের মতে এর কারণ ‘হাওয়া তখন ভুট্টোর অনুকূলে। রাজনৈতিক ক্ষমতার টানাপােড়েনে মূলত সামরিক সমর্থনের শক্তিতে ভুট্টো অনেকটা সুবিধাজনক অবস্থানে, বিশেষ করে শেখ মুজিবের তুলনায়। কেননা অধিবেশন বর্জনের হুমকি দিয়ে তিনি জাতীয় পরিষদের সেই বিপজ্জনক কাজটিই করেছিলেন পিপিপি-প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো। প্রেসিডেন্টের ঘােষণার পরপরই ১৫ ফেব্রুয়ারি পেশােয়ারে জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে ভুট্টো ঢাকায় আসন্ন জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বর্জনের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেন। এমনকি তিনি এ-কথাও বলেন যে পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে ৬-দফার সংবিধান রচনার জন্য তিনি সংসদে যােগ দিতে পারেন না। এই বক্তব্যের ফাঁকেই মন্তব্য করে যে পূর্ব-পাকিস্তান এ তাবৎ অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদী শাসনের কারণে শােষণ ও বঞ্চনার শিকার হয়েছে, এর প্রতিকার হওয়া উচিত। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে একটা রাজনৈতিক বােঝাপড়া না হলে কেমন করে সংসদে বসা যায়’ (ডন, করাচি, ১৬.২.৭১)। ঐ দিনই সিন্ধুর রাজপুত্র তার সর্বাধিক তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক বােমাটি ফাটিয়ে সংসদের কার্যক্রম শুরু করা হলে বা সংবিধান রচিত হলে খাইবার থেকে করাচি পর্যন্ত আগুন জ্বলে উঠবে’ (ডন, করাচি, ১৬.২.৭১)। এর আগে তিনি সরসভঙ্গিতে এমন কথাও বলেন : “ভারত সরকারের সঙ্গে আমার যা রাজনৈতিক সম্পর্ক তাতে  ঢাকায় সংসদ অধিবেশনে যােগ দিতে গিয়ে জিম্মি হয়ে পড়াটাও বিচিত্র নয়। তাছাড়া আমার দলীয় সদস্যদের ওখানে নিয়ে গিয়ে দ্বিমুখী ক্ষতির মুখে তাে ফেলতে পারি না। আসলে তার কথাবার্তা, বক্তৃতা-বিবৃতিতে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে পাকিস্তানের সংহতির প্রশ্নটা নিছক উপলক্ষ মাত্র, তার মূল লক্ষ্য এবং একমাত্র লক্ষ্য কেন্দ্রে ক্ষমতার ভাগাভাগি। যে-প্রস্তাবে আওয়ামী লীগ একেবারেই রাজি ছিল না।  যাই হােক ভুট্টোর ঐ ১৫ ফেব্রুয়ারির হুমকিতে সত্যই দাবার ছকে আসীন রাজা নড়েচড়ে বসেন। মনে হয় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার হাতের তাসগুলাে নতুন করে ভিন্নভাবে ভেজে নিলেন। তার সিদ্ধান্তমূলক ভাবনায় এবং অবস্থানে দিকবদল ঘটে। অদ্রুিত তার বেসামরিক মন্ত্রীসভা বাতিল করে দিয়ে (২১ ফেব্রুয়ারি) প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পুরােপুরি সামরিক শাসন কায়েমের ব্যবস্থাই নিলেন। এসব কার্যক্রমে ভুট্টোর দাবির প্রতি তার সমর্থনই স্পষ্ট হয়ে ওঠে (রবার্ট জ্যাকসন)।

পিপিপির আবদুল হাফিজ পিরজাদা যখন প্রকাশ্যেই বলে দেন যে তাদের চেষ্টাতেই বেসামরিক মন্ত্রীসভা বাতিল করা হয়েছে তখন ভুট্টো ইয়াহিয়া আঁতাত আর গোপন থাকে না (দ্য পিপল, ২৩,২,৭১)। শুধু তাই নয়, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া প্রাদেশিক সামরিক গভর্নর, সামরিক আইন হন। ঢাকা থেকে উড়ে গেলেন ইয়াকুব খান ও এস,এম, আহসান। পরবর্তী ঘটনাক্রম থেকে মনে হয়, সম্ভবত ঐ গােপন বৈঠকে পূর্ব-পাকিস্তান সম্পর্কে চরম সিদ্ধান্তটি নেওয়া। হয়েছিল। যা ছিল ‘করাচি-পেশােয়ারে আগুন জ্বলা’র আশঙ্কা ঠেকাতে গিয়ে ঢাকা চট্টগ্রামসহ পূর্ববঙ্গের সর্বত্র আগুন জ্বেলে দেওয়ার বিকল্প ব্যবস্থার পক্ষে সিদ্ধান্ত। তাই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সংসদ অধিবেশন বিষয়ক পরবর্তী পদক্ষেপ, এমনকি পরের সংলাপও যে নিছক লােক-দেখানাে এবং সামরিক বাহিনীর জন্য প্রয়ােজনীয় সময় কেন, সংশ্লিষ্ট ঘটনাদি থেকে তা বুঝতে কষ্ট হয় না। দুই নানাদিক থেকে বিচারে ১৫ ফেব্রুয়ারি (১৯৭১) দিনটি ছিল পাকিস্তানের রাজনৈতিক জীবনে স্ফুলিঙ্গপাতের অশুভ সংকেতে পূর্ণ। এর টানেই ২২ ফেব্রুয়ারি রাজনৈতিক দিকবদলের সূচনা। আর সেখান থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারির বিস্ফোরক ঘােষণা এবং দাবানলের উস সৃষ্টি। সে আগুন শেষপর্যন্ত মানুষের জানমাল পুড়িয়েই ক্ষান্ত হয় নি, পাকিস্তানের অঙ্গচ্ছেদও ঘটিয়েছে। এবং তা মাত্র ৯ মাসের মধ্যে। ভুট্টো বা ইয়াহিয়া মুখে বিচ্ছিন্নতার কথা বললেও এই বিকল্প সম্ভাবনার কথা ভাবতে পারেন নি। সামনে আলামত থাকা সত্ত্বেও পরিণাম বুঝতে পারার রাজনৈতিক বিচক্ষণতা তাদের ছিল না। স্থানীয় কাগজে বিষয়টি যথাযথ গুরুত্ব নিয়ে ছাপা হয়েছিল। মনে পড়ছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ভবনে অপারেশন থিয়েটারের পুব পাশে টানা-বারান্দায় অধ্যাপক-চিকিৎসদের জটলা এবং ভুট্টোর বিস্ফোরক বিবৃতি নিয়ে ক্ষুব্ধ ও সরস মন্তব্যের আলােচনা। কেন জানি ভুট্টোর এ বিবৃতি এবং পরে ইয়াহিয়ার ঘােষণার সম্ভাব্য বিপজ্জনক  ইঙ্গিত কাউকে স্পর্শ করে নি। হতে পারে এর কারণ, দলমত-নির্বিশেষে বাঙালিচেতনার মানুষমাত্রেরই মন তখন আবেগ ও উদ্দীপনায় ভরপুর। চুলচেরা বিচক্ষণ বিশ্লেষণের দিকে কারাে মন যায় নি। অবস্থা সত্যি বিদ্যুতায়িত হয়ে ছিল।

মধ্যশ্রেণী, উচ্চ মধ্যশ্রেণী থেকে চতুর্থশ্রেণীর কর্মচারীদের মধ্যেও তার ছোঁয়া লেগেছিল। শেষােক্ত চত্বরেও সেদিন জটলা, উত্তাপ আর উত্তেজনা। বরং এক্ষেত্রে যেন উত্তাপ-উত্তেজনার প্রকাশ ছিল অপেক্ষাকৃত বেশি। আবেগের প্রাধান্য দূরদর্শী বিচারের চেতনা কিছুটা হলেও ঢেকে ফেলে ছিল। স্বচ্ছ বিচার একটু কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। সংবাদপত্রের ভুবন কিছুটা ভিন্ন হলেও প্রধানত একই রকম চেতনায় স্পন্দিত হতে দেখা গেছে। | ‘দ্য পিপল’ থেকে পাকিস্তান অবজার্ভার’, ইত্তেফাক’ থেকে ‘সংবাদ’ বা দৈনিক পাকিস্তান’-এর অন্দর মহলে শঙ্কাও আত্মবিশ্বাস, অস্থিরতা ও আবেগ-উত্তাপের বিচিত্র প্রকাশ ছিল লক্ষ্য করার মতাে। কোথাও কোথাও ৬-দফায় কিছুটা ছাড় দেবার বিষয়ও (যেমন মুদ্রা) গুরুত্বের সঙ্গে আলােচিত হয়েছে। তবে সব আলােচনাতেই সর্বাধিক গুরুত্ব আরােপ করা হয় প্রেসিডেন্টের ঢাকায় আসা এবং সুষ্ঠু রাজনৈতিক আলােচনার সুত্রপাত ঘটানাের ওপর। কারণ সবাই এ বিষয়ে একমত যে সর্বাধিনায়ক প্রেসিডেন্টের হাতেই সব ‘হাইস্টেক’ তাসগুলাে ধরা আছে। তাই প্রেসিডেন্টের আসা নিয়েই সবার প্রত্যাশা। কাগজে কাগজে সম্পাদকীয়গুলাে সেই সুরে লেখা।  নির্বাচনের পর থেকে জুলফিকার আলী ভুট্টোর বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য এবং পদক্ষেপ বিচার করে দেখলে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে সিন্ধুর এই হঠাৎ ক্ষমতাবান রাজনীতিক বিভিন্ন সময়ে কথার মারপ্যাচে তার অবস্থান পরিবর্তন করলেও মূল বিষয়টা তার হাতে ঠিকই ধরা থাকে—অর্থাৎ ক্ষমতা তার চাই-ই। এবং সেটা ঐ কথিত পাকিস্তান রক্ষার অজুহাতে। জনাব ভুট্টো ৬-দফার যেসব সূত্র নিয়ে বিচ্ছিন্নতার অভিযোগ তােলেন যুক্তিসঙ্গত বিচারে তার সে আপত্তি ধােপে টেকে না। কিন্তু যখন ৬-দফা প্রসঙ্গে পশ্চিমপাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসাবে ক্ষমতার প্রশ্ন তােলেন তখন ঠিকই ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে আসে। সে কালাে বিড়ালের নাম একজন রাজনীতিকের প্রবল উচ্চাকাক্ষা যা ভূটোবিরােধী পশ্চিম-পাকিস্তানি রাজনীতিকদের বিচারে এবং সমালােচনায়ও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঢাকার পত্রিকাগুলাের বিশ্লেষণেও একই বক্তব্য পরিস্ফুট হয়েছিল।

সংসদ অধিবেশনে যোগদান, ৬-দফা, সংবিধান ইত্যাদি প্রশ্নে পশ্চিম-পাকিস্তানের ভুট্টোবিরােধী রাজনীতিক অনেকেরই অবস্থান ও প্রতিক্রিয়া ছিল তুলনামূলক বিচারে স্বচ্ছ। পাখতুন নেতা ওয়ালি খান কিংবা বালুচ নেতা আকবর বুগতি থেকে বয়ােবৃদ্ধ সিন্ধি জাতীয়তাবাদী নেতা জি,এম, সৈয়দ এবং পিডিপি ও জামায়াত নেতারা সবাই ভূট্টোর অগণতান্ত্রিক ও একনায়ক-সুলভ মনােভাবের সমালােচনায় পিছিয়ে থাকেন নি। এরা পশ্চিম পাকিস্তানি সাংসদদের ঢাকা-অধিবেশনে যােগ দেওয়ারও আহ্বান জানান। | প্রাক্তন মুসলিম লীগ নেতা এবং পিডিপি’র সভাপতি নুরুল আমীন ভুট্টোর নেতিবাচক সিদ্ধান্ত দুঃখজনক’ আখ্যা দিয়ে বলেন : “পিপিপি সদস্যরা ঢাকায় গেলে জিম্মি হয়ে | যাবেন ভুট্টোর এমন কাল্পনিক অভিযােগ পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণের ওপর দুর্নাম চাপানাে  বই কিছু নয়।’ তিনি পাকিস্তানের জনপ্রতিনিধিদের জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যােগ দেবার আহ্বান জানান (পাকিস্তান অবজার্ভার, ১৭,২,৭১)। জামায়াতে ইসলামের আমির সৈয়দ আবুল আলা মওদুদি ‘সংসদের বাইরে শাসনতান্ত্রিক সমস্যার সমাধান খোঁজার অযৌক্তিক চেষ্টা এবং সে অজুহাতে ভূয়োর জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যােগ না দিয়ে অচলাবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা সঠিক নয় বলে মন্তব্য করেন (পাকিস্তান অবজার্ভার, ১৭,২,৭১)। পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক পার্টির পশ্চিমাঞ্চলীয় শাখার সভাপতি নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান ভুট্টোর সিদ্ধান্তে বিস্ময় প্রকাশ করে ঐ সিন্ধি রাজনীতিকের স্বভাবসুলভ বহুচারিতার সমালােচনা করেন (পাকিস্তান অবজার্ভার, ১৮,২.৭১)। আর সিন্ধুর বর্ষীয়ান নেতা জি, এম, সৈয়দ বলেন : ‘অন্যের ওপর চাপ সৃষ্টি করে আপন মতামত চাপিয়ে দেবার অধিকার মি. ভুট্টোর নেই’ (ইত্তেফাক, ১৯.২.৭১)।

অন্যদিকে পশ্চিমের তুলনায় পূর্ব-পাকিস্তানে ভুট্টোর সংসদ বর্জনের প্রতিক্রিয়া ছিল তীব্র ও ব্যাপক। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ থেকে শিক্ষক-সাংবাদিক-লেখক (ব্যাপক শিক্ষিত শ্রেণী) থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যেও এর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। দলমত নির্বিশেষে মানুষ তখন বাঙালি স্বার্থের এক অদ্ভুত জাদুর টানে একাট্টা হয়ে ওঠে। উচ্চশ্রেণী, মধ্যশ্রেণী থেকে শ্রমজীবী মানুষ সবাই একই সুরে কথা বলেছেন। সাময়িক হলেও শ্রেণীচেতনা ও জাতিচেতনা একাকার হয়ে যায়। ব্যুরােক্র্যাটটেকনােক্র্যাটরাও বাঙালি রাজনীতির প্রতি সমর্থন জানাতে এগিয়ে আসেন। | ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)-প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ভুট্টোর সংসদ অধিবেশনে যােগ দেওয়ার জন্য পূর্বশর্ত আরােপ পূর্ব-পাকিস্তানের প্রতি হুমকি ও ভীতিপ্রদর্শন’ বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন পূর্ব-পাকিস্তান ঐ হুমকির সামনে নতিস্বীকার করবে না’ (পাকিস্তান অবজার্ভার, ১৮,২.৭১)। এ পরিস্থিতিতে পূর্ব-পাকিস্তান জামায়াতের প্রধান গােলাম আযমও ভুট্টোর উল্লিখিত ভূমিকার সমালােচনা করেন। | শুধু ভাসানীই নন বা ওয়ালি ন্যাপের অধ্যাপক মােজাফফরই নন, রাজনৈতিক মতাদর্শের দিক থেকে আওয়ামী-বিরােধী ও চীনপন্থী হিসাবে পরিচিত সাপ্তাহিক ‘হলিডে’ (২১,২,৭১) ভুট্টোর উদ্দেশ্যমূলক ভূমিকার ধারালাে সমালােচনা করে তাদের মন্তব্য প্রতিবেদন ‘এনিগমা অব আ পােলিটিক্যাল প্রিস্ট’-এ। ‘হলিডে’র মতে ‘ভূট্টো তার বিশ্বাসমাফিক ৬-দফার সঙ্গে একমত না হতে পারেন, সে গণতান্ত্রিক অধিকার তার রয়েছে। কিন্তু যে পদ্ধতিতে তিনি সে অধিকার প্রয়ােগ করছেন তা মােটেই গণতান্ত্রিক নয়। নাটকীয়তা বরাবরই তার রাজনীতির বৈশিষ্ট্য, তার গিমিক্ তার রাজনৈতিক ভাবমূর্তিতে জেল্লা ধরাতে পারে কিন্তু তা অবশ্যই দেশকে এমন সংকটে পৌছে দিতে পারে না যেখান থেকে ফিরে আসা সম্ভব নয়।’ 

‘হলিডে’ নিশ্চিত যে ভুট্টো কথিত শক্তিশালী পাকিস্তান তথা আইয়ুবের শক্তিশালী কেন্দ্র বর্তমান অবস্থায় ভুট্টোর মতাদর্শ বিচারেও আপাত-বিরােধী বা উদ্ভট বলেই বিবেচিত হবে। আসলে তিনি পাঞ্জাব-সিন্ধুকে পাকিস্তানের রাজনৈতিক শক্তির দুর্গ হিসাবে গড়ে তুলতে চান, আঞ্চলিক সাবফেডারেশনের ধারণা বাতিল করে দেন, কিন্তু গােটা অঞ্চলের একচ্ছত্র রাজনৈতিক নেতা হিসাবে নিজেকে দেখতে চান।’ পত্রিকাটি ভুট্টোর দোলাচল  বৃত্তিরও সমালােচনা করে। এবং ৬-দফা বিরােধিতার সুবাদে ঘৃণা ও অবিশ্বাস প্রচারের জন্য তাকে অভিযুক্ত করে। ভুট্টোর উৎকট পাকিস্তান-প্রেম বিচ্ছিন্নতার অণুঘটক (‘ক্যাটালিস্ট’) হিসাবে কাজ করতে পারে বলে কাগজটিতে মন্তব্য করা হয়। (“Mr. Bhutto’s passionate love for a ‘strong Pakistan’, which in Ayubian vocabulary would mean a strong centre, would be a paradox even judged by Mr. Bhutto’s own political tenets. He wants Lahore and Karachi to continue as bastions of power. He rejects the idea of a zonal sub-federation in West Pakistan, but projects himself as the sole leader of a politically and geographically dead entity. … Without being too hursh one could as well be very objective about the political vacillation on the part of the PPP Chairman in his short political career. …Mr. Bhutto has a clear choice in not accepting a constitution that would be based on the six points of the Awami League. That however does not give him the freedom to preach a gospel of hatred and mistrust. … Why should he with his self-avowed passionate love’ for Pakistan prove to be the catalyst for a separation when what he needs to do is to practise ‘a fair moratorium’ till the transfer of power,”Holiday, Dacca, 21 February, 1971)। ‘হলিডে’র মন্তব্য ঠিকই ছিল। পাকিস্তান বিভাগের পেছনে জনাব ভুট্টো প্রবল বিভাজক শক্তির অণুঘটক হিসাবেই কাজ করেছেন। | আওয়ামী লীগ অবশ্য ঐ ১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত তাদের সকল সদস্য নিয়ে যৌথ সভায় মিলিত হয় এবং তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ৬-দফা বাস্তবায়নের পূর্ব-সিদ্ধান্তই ঘােষণা করে। তারা নির্বাচনবিষয়ক প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে ধন্যবাদ জানিয়ে পর্দার আড়ালে। সক্রিয় ষড়যন্ত্র সম্পর্কে তাকে সতর্ক করে দেয় যাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের সুষ্ঠু প্রক্রিয়ায় কোনাে প্রকার বিঘ্ন না ঘটে।

সংবাদপত্র ভুবনে ঠিক এই পথেই সদিচ্ছা ও সমঝােতার আহবান এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর করার পরামর্শ জানানাে হতে থাকে। সেই সঙ্গে চলে ভূট্টোর অগণতান্ত্রিক ও স্ববিরােধী ভূমিকার সমালােচনা, যে-ভূমিকা দেশের সার্বিক ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গলকর নয় বলে স্থানিক কাগজগুলাে মতামত ব্যক্ত করে। তাই ভূট্টোর সংসদ বর্জন ঘােষণার পরিপ্রেক্ষিতে ইত্তেফাক-এ (১৬.২.৭১) প্রথম পৃষ্ঠায় মােটা হরফে সংবাদ-শিরােনাম : “আগুন লইয়া খেলিবেন না। সেই সঙ্গে সম্পাদকীয় রচনা ‘ভুট্টোর গণতন্ত্র’। | পরদিনের ইত্তেফাক-এ সম্পাদকীয় লেখা হয় “ভুট্টো সাহেবের পূর্বশর্ত” এই শিরােনামে। সেখানে মন্তব্য করা হয় “১৫ ফেব্রুয়ারি ভুট্টোর ভাষণ বিচ্ছিন্ন ও বিপর্যস্ত চিন্তারই প্রতীক। এ ধরনের প্রতিবেদন বা সম্পাদকীয় প্রায়ই লেখা হতে থাকে। লেখার প্রেক্ষাপট ভুট্টোর আপাত-অসংলগ্ন ভাষণ, বক্তব্য ও বিবৃতি। যেমন ভুট্টোর ভাষায় “৬-দফার প্রথম ও শেষ দফা গ্রহণ করিয়া আমি আগাইয়া আসিয়াছি। কেন্দ্রীয় বিষয়াবলী ও মুদ্রাব্যবস্থা সম্পর্কেও আমি আশাবাদী। করধার্য ও বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পর্কেও আমি নিরাশ নই” (ইত্তেফাক,  তাহলে আর সমস্যা থাকে কোথায়? তবু ভুয়ো জানাচ্ছেন ; আদান-প্রদান ও বিনিময় ছাড়া ঢাকায় যাওয়ার অর্থ নাই। ঢাকা থেকে শূন্য হাতে ফিরিতে চাই না।’ (ইত্তেফাক, ১৭.২.৭১)। একই বিষয়ে ‘দ্য পিপল’ পত্রিকায় (১৭.২.৭১) মােটা মােটা শিরােনামে লেখা হয় : “কেন ভুট্টো (ঢাকায়) আসতে গররাজি” (“Why Bhutto Refuses to Come”)। পাশাপাশি এ সম্পর্কে সম্ভাব্য কারণের ঝলসানি : এর কারণ কি “ক্ষমতার জন্য দর কষাকষি, নাকি কোনাে অদৃশ্য শক্তির ক্রীড়নক হিসাবে কাজ করা”? ধারালাে এ প্রতিবেদনের পাশাপাশি ততােধিক তীক্ষ ভুট্টো-চেরা সম্পাদকীয় ‘ভুয়োর উদ্দেশ্য কি? প্রধানত ভুট্টোর ভূমিকায়, তার রাজনৈতিক জুয়াখেলার কারণে পরিস্থিতি তখন ক্রমে জটিল হতে শুরু করেছে।

পশ্চিম ও পূর্ব-পাকিস্তান মিলে দুই স্রোতের টানে, বলা যায় ক্ষমতায় আসীন হওয়া নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। মূলত ভুট্টোকে কেন্দ্র করেই ও পাকিস্তানমুখী প্রতিবেদন প্রকাশ করতে থাকে। অন্যদিকে ঢাকার কাগজগুলােতে চলে সেসবের চুলচেরা বিশ্লেষণ, বাঙালি জনতার প্রত্যাশার পটভূমিতে। এদিক থেকে স্থানিক কাগজগুলাের মধ্যে পার্থক্য ছিল সামান্যই। পার্থক্য বক্তব্যের ধারে, বিশ্লেষণের তীক্ষ্ণতায়। তবে জঙ্গিপনায় ‘দ্য পিপল’ ছিল সবার সেরা। ঐ কাগজে তখনই পূর্বপাকিস্তান-এর স্থানে বাংলাদেশ’ শব্দটি ব্যবহৃত হচ্ছিল। ১৮ ফেব্রুয়ারি ইত্তেফাক-এ সংবাদ পরিবেশিত হয় সরসভঙ্গিতে, মােটা হরফে ভুট্টোর উদ্ভট বক্তব্য উদ্ধার করে এই মর্মে যে (ভারতীয় আগ্রাসনের মুখে?) “পশ্চিম পাকিস্তান অরক্ষিত রাখিয়া ঢাকায় যাই কেমনে” বা “নিছক অনুমােদনের জন্য ঢাকায় যাইব না” এবং একই সঙ্গে সম্পাদকীয় রচনা “শুভ বুদ্ধির উদয় হেকি”, যা শিরােনামেই স্পষ্ট | অন্যদিকে ‘দ্য পিপল’-এ ঢাকা প্রসঙ্গে ভুট্টোর কথিত ‘কসাইখানা’র মন্তব্য উদ্ধার করে সমস্যার জন্য ভুট্টোকে দায়ী করে তীক্ষ্ণ সম্পাদকীয় লেখা হয় “ভুট্টোর বিপজ্জনক cret’ (‘Bhutto’s Dangerous Game’)  পরদিন (১৯.২.৭১) ঐ কাগজে খবর পরিবেশন করা হয় এই বলে যে “ভুঠো। কখনােই গণতন্ত্র চায় না” । সিন্ধু ইউনাইটেড ফ্রন্টের জাতীয়তাবাদী নেতা জি,এম, সৈয়দের বক্তব্য উদ্ধার করে বলা হয় “ভুট্টো একনায়কত্বের ফসল” । শাসনতন্ত্র ও ৬দফা সম্পর্কে জি,এম, সৈয়দের বক্তব্য স্পষ্ট ; পাঁচজাতি অধ্যুষিত পাকিস্তানে সিন্ধিস্বার্থের বিরােধী না হলে ৬-দফা অবশ্যই সমর্থন করবাে”। এয়ারমার্শাল নূর খানের বক্তব্যে সমঝােতার সুরই প্রতিফলিত হয়। তিনি ঢাকায় শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলােচনায় ইচ্ছুক বলে জানান।  একই সময় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ভুট্টোকে রাওয়ালপিভিতে তার সঙ্গে দেখা করার জন্য ডেকে পাঠান।

সম্ভবত ঘটনা আঁচ করে ইত্তেফাক-এ সম্পাদকীয় লেখা হয় তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে “আর বিলম্ব নয়”। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলাপশেষে ভুট্টো আবারও জানান যে তিনি তার সিদ্ধান্তে অটল। তবে সেই সঙ্গে পুরনাে কথাই নতুন করে জোর দিয়ে বলেন ‘শাসনতন্ত্র প্রণয়নে ভূমিকা গ্রহণ করিতে ১৬.২.৭১)।  দেওয়া হইলে ঢাকায় যাইব। বৈদেশিক বাণিজ্য ও সাহায্য সংক্রান্ত বিষয়গুলাে খুবই স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ’ (ইত্তেফাক, ২০,২.৭১)। একই বিষয়ের পরিবেশনায় ‘দ্য পিপল’-এ লেখা হয়, ‘ভুট্টো বলেন : আমরা পাকিস্তানের অর্ধেক অংশ, এই অংশের কথা অবশ্যই শুনতে হবে। শাসনতন্ত্র প্রণয়নে সুযােগ দিতে হবে। আর পরিষ্কার শ্লেট না হলে কিছু লেখা যায় না।’ দেখা যাচ্ছে ভুট্টোকে নিয়েই যত সমস্যা, বিরাজমান রাজনৈতিক সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু উচ্চাভিলাষী রাজনীতিক জনাব ভুট্টো। তাই পূর্ব-পাকিস্তানের কাগজগুলােতে পরিস্থিতির বিচার-বিশ্লেষণ মূলত ভুট্টোকেই ঘিরে, সেই সঙ্গে লেজ টানলে মাথা আসার মতাে প্রেসিডেন্টকে নিয়ে। তবে লক্ষ্য করার বিষয় যে সর্বাধিনায়ক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে নিয়ে বাঙালি কাগজগুলােতে সাবধানেই লেখাজোখা হয়েছে রাজা বলে কথা! তার ইচ্ছায় সামরিক শাসনের রাশ-হাল্কা পরিস্থিতিতে সাধারণ নির্বাচন, তার মর্জিতেই ক্ষমতার ভাগ-বাটোয়ারা, আবার তার পক্ষেই সম্ভব কড়া সামরিক শাসন আরােপও।  সে কারণে কাগজগুলাের লক্ষ্য মূলত ভুট্টো, যদি তার বােধােদয় ঘটে। তাই ২৩ ফেব্রুয়ারিতেও ভুট্টোকে উদ্দেশ্য করে ইত্তেফাক-এ সম্পাদকীয় নিবন্ধ : “পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করুন”।

পরিস্থিতি ইতােমধ্যে সত্যই গুরুতর হয়ে উঠতে শুরু করেছে। হাওয়ায় তার আভাস-ইঙ্গিত স্পষ্ট। ভুট্টোর সঙ্গে প্রেসিডেন্টের আলােচনার পর দেখা গেল দুটো ঘটনার নাটকীয় প্রকাশ যা ছিল যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। এক, প্রেসিডেন্ট কর্তৃক “লিগাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার’-এ সংশােধনী সূত্র সংযােজন এই মর্মে যে নির্বাচিত সংসদ যে কেউ ইচ্ছা করলে পদত্যাগ করতে পারেন।’ প্রবল গুজব যে পিপিপি’র সাংসদগণ একযােগে পদত্যাগ করতে পারেন’ (দ্য পিপল, ২১,২,৭১)। উদ্দেশ্য আওয়ামী লীগের ওপর চাপ সৃষ্টি। ভুট্টো সাহেব অবশ্য তার দলবল নিয়ে শেষপর্যন্ত পদত্যাগ করেন নি, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।।  দ্বিতীয়ত, হঠাৎই ২২ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কর্তৃক তার মন্ত্রীসভা তথা কেন্দ্রীয় কেবিনেট বাতিল ঘােষণা। কারণ, রাজনৈতিক পরিস্থিতির অস্বাভাবিকতা। ঐ দিনেরই সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ (বিপজ্জনকও বটে) ঘটনা হলাে গভর্নরদের নিয়ে ইয়াহিয়ার বৈঠক (দ্য পিপল, ২৩,২.৭১)। অবশ্য সেই সঙ্গে বৈঠক গুরুত্বপূর্ণ সেনানায়কদের নিয়েও। মনে হয় পরিস্থিতি এ সময়েই মেরুকরণের দিকে এগিয়ে গেছে, ঘটনার বিস্ফোরক বিন্দুটির পরিণতি নির্দিষ্ট হয়ে গেছে। ভাসানী সঠিকভাবেই ভুট্টোর উদ্দেশ্যে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন এই বলে যে পিপিপিপ্রধানের নেতিবাণী কার্যক্রম দেশকে নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দিতে পারে (দ্য পিপল, ২৪.২.৭১)। এ পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ প্রধান পশ্চিম পাকিস্তানকে আশ্বস্ত করতে গিয়ে বলেন যে ৬-দফা অনিচ্ছুক কারাের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে না’ (দৈনিক পাকিস্তান, ২৫,২.৭১)। ঘটনার এ সন্ধিক্ষণে আবিদুর রহমানের ‘দ্য পিপল’ কেবিনেট বাতিলের তাৎপর্য নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পাদকীয় লেখে ‘Cabinet Dissolution and Aftermath’ (২৫.২.৭১)। 

দিনটি ছিল ভয়াবহ পঁচিশে মার্চের ঠিক এক মাস আগেকার। বলা যেতে পারে এ মিল কাকতালীয়। ভুট্টোকে ‘প্রিন্স হ্যামলেট’ নামে আখ্যায়িত করে ঘটনার তাৎপর্য ও ভুট্টোর ভূমিকা বিশদ ব্যাখ্যা করে “দ্য পিপল’-এর সম্পাদকীয় স্তম্ভে অবশেষে লেখা হয়। এখন ‘সময় এসেছে, জনগণের ইচ্ছার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের। আর জাতীয় পরিষদেরই রয়েছে শাসনতন্ত্র (সংবিধান) রচনার একমাত্র অধিকার। বল এখন জেনারেল ইয়াহিয়ার কোর্টে, তার অধস্তন সামরিক কর্তাদের সামনে। (এ অবস্থায় প্রেসিডেন্টের নেওয়া পদক্ষেপই পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। আমাদের প্রত্যাশা তিনি। সঠিক সিদ্ধান্তই নেবেন। কারণ তার ঐ সিদ্ধান্তের ফলেই পাকিস্তান হয় রক্ষা পাবে, হয় ভাঙবে’ (অনুবাদ লেখকের)। মনে হয় ভবিতবাই সেদিন প্রকাশ পেয়েছিল ‘দ্য পিপল’-এর ঐ সম্পাদকীয় বক্তব্যে (২৫.২.৭১)। মূল ভাষায় ‘দ্য পিপল’-এর সম্পাদকীয় মন্তব্য : (“Time has come to show respect to the peoples’ desire and it is the National Assembly which must have the absolute power to frame a constitution. The ball is now at the court of general Yahya and his military subordinates, the step which he will take will decide the fate of Pakistan; we hope he takes a right decision, as his decision will make or break Pakistan.” 25.02.71) 1 সম্ভবত পরিস্থিতির তাৎপর্য কিছুটা আঁচ করেই শেখ মুজিবুর রহমান পিপিপিপ্রধানের উদ্দেশ্যে এক বিবৃতিতে বলেন : ‘শাসনতান্ত্রিক সমস্যা বা ইস্যুগুলো অনায়াসে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে বিতর্কের ও আলােচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা যেতে পারে’ (দ্য পিপল, ২৫,২,৭১)। ইত্তেফাক অবশ্য দু’দিন পর এই আলােকেই ৬-দফার ব্যাখ্যা’ শীর্ষক সম্পাদকীয়তে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত বিচার-বিশ্লেষণের পর মন্তব্য করা। হয় যে ‘জনাব ভুট্টো এ বিষয়ে জাতীয় পরিষদে বসে অনায়াসে আলোচনা করতে পারেন, বিতর্কের সৃষ্টি করতে পারেন।’ একুশে ফেব্রুয়ারি হালডে র প্রতিবেদনে এ সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়ে ছিল যে জাতীয় পরিষদে ভিন্নমত উপস্থাপনের বিভিন্ন পদ্ধতি। রয়েছে, ভুট্টো তা করতে পারেন, জানাতে পারেন ভিন্নমত (‘নােট অব ডিসেন্ট’)’ যা পরিষদে এবং বাইরে আলােড়ন তৈরি করতে পারে, এটাই গণতন্ত্রসম্মত পন্থা।’ কিন্তু ভুয়ো সেসব পথে যেতে চান নি। তিনি সব সমস্যা বা ইস্যু আগেই, অর্থাৎ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের আগেই ফয়সালা করে নিতে চেয়েছেন।

এভাবে প্রায় গােটা ফেব্রুয়ারি (১৯৭১) মাস জুড়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষা, অসন্তোষ বা বিধিসম্মত অধিকার প্রয়ােগের জেদ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে উভয়পক্ষে ছাইচাপা আগুন ধিকিধিকি করে জ্বলেছে আর উত্তাপ ছড়িয়েছে। এর কিছুটা আঁচ অনুভব করেই হয়তো পূর্ব-পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল ইয়াকুব (২২ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্টের আহুত বিস্ফোরক বৈঠকে যােগ দেওয়া সত্ত্বেও) প্রেসিডেন্টকে এক দীর্ঘ তারবার্তা পাঠান (২৫ ফেব্রুয়ারি) যাতে প্রেসিডেন্ট আর সময় নষ্ট না করে অবিলম্বে ঢাকায় আসেন এবং ঘটনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই এর মােড় ফেরাতে রাজনৈতিক ব্যবস্থা। নেন (সিদ্দিক সালিক)।   কিন্তু এর আগেই তাে পিন্ডিতে পাশার দান পড়ে গেছে। শেষ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে। যেজন্য পি,আই,এ, বিমানে সাদা পােশাকে ঢাকায় সৈন্য পাঠানাের কাজ শুরু করে দেওয়া হয়েছে। আর জাহাজ পথে আসতে শুরু করেছে অস্ত্র সম্ভার। অন্যদিকে ভুট্টোর চাপাচাপি, দাপাদাপির মুখে সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন সার্ভিসে বিরাজমান ত্রিধাবিভক্ত মতামতে— অর্থাৎ মধ্যপন্থী, দক্ষিণপন্থী ও উগ্রপন্থীদের মধ্যে এক ধরনের মেরুকরণ ঘটে যায়। দক্ষিণ ও উগ্রপন্থী ঐক্যবদ্ধ হয়ে ভুট্রোর পক্ষে দাঁড়িয়ে পড়ে। এবং বাঙালিদের কোনাে প্রকার রাজনৈতিক সুযােগ-সুবিধা দেওয়ার পরিবর্তে পূর্বপাকিস্তানে কড়া সামরিক শাসন প্রবর্তনের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় (রবার্ট জ্যাকসন)। পরবর্তী ঘটনাবলী তাই প্রমাণ করে। সেনাবাহিনীতে ‘মধ্য ‘দক্ষিণ’ ও ‘উগ্র’ তথা বাম পন্থার অনুসারী বলতে রবার্ট জ্যাকসন যথাক্রমে জেনারেল ইয়াহিয়া, গোঁড়া দক্ষিণপন্থী সিনিয়র অফিসার যারা একই সঙ্গে বাঙালি জাতীয়তা ও ভুট্টোর সমাজতান্ত্রিক স্লোগানের-বিরােধী এবং জুনিয়র অফিসার যারা কট্টর পাকিস্তানবাদী হয়েও ভুট্টোর বক্তৃতাবাজিতে মুগ্ধ ও ৬-দফা বিরােধী এই তিন গ্রুপকে বুঝিয়েছেন।

সেনাবাহিনীর এই বিচিত্র মতামতের মধ্যে রাজনৈতিক মেরুকরণ ঘটে মূলত পূর্ব-পাকিস্তান তথা বাঙালি রাজনীতি সামনে রেখে। রবার্ট জ্যাকসনের নিজ ভাষায় (“Within this constellation of ‘centre’, ‘right” and ‘left’ opinion in the services there consequently grew up a convergence between ‘right’ and ‘left’ elements which was opposed to concessions to the Bengalis, and which supported resolute action to restore the authority of the central government.” PP. 26-27) বুঝতে কষ্ট হয় না যে এই সামরিক আঁতাতের ফলেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কথিত রাজনৈতিক সংলাপের সূত্রপাত এবং আলােচনার নামে বাঙালিদের শায়েস্তা করার প্রস্তুতি। একই কারণে পূর্ববাংলায় সেনা-অভিযানের প্রক্রিয়ায় জুনিয়র ও মধ্যস্তরের সেনা অফিসার। সবার মধ্যেই উগ্র বাঙালি-বিরােধী আক্রমণাত্মক মনােভাব প্রকাশ পেতে দেখা গেছে। পশ্চিমা সাংবাদিকদের সঙ্গে আলােচনায়ও সে জঙ্গি মতামতই প্রকাশ পেয়েছে যা তারা নির্ধিধায় তাদের কাগজে ছেপে দিয়েছেন। ভুট্টোর রাজনৈতিক বিবৃতি বা মন্তব্যে এমন সত্ত্বেও কেমন করে ভুট্টো হুমকি দিতে পারেন, বলতে পারেন যে তাকে বাদ দিয়ে কেউ সরকার গঠন করতে পারবে না। তার খুঁটির জোর খুব শক্ত ছিল বলেই এ ধরনের স্পর্ধার প্রকাশ সম্ভব হয়েছিল।  আর সে পরিপ্রেক্ষিতে নিজদের নৈতিক অবস্থান সুদৃঢ় করে তুলতে ভুট্টোর কথাবার্তায় পূর্ব-পাকিস্তান তথা আওয়ামী লীগের ওপর বিচ্ছিন্নতার দায় চাপানাের ইঙ্গিত ফুটে উঠতে থাকে। এমন কি পরবর্তী পর্যায়ে প্রেসিডেন্টের একাধিক বক্তৃতায়ও এ ধরনের দূর-ইঙ্গিত প্রচ্ছন্ন থাকে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। আওয়ামী লীগের মূল স্বায়ত্তশাসনে বিশ্বাস রেখেছে। ছাত্রসমাজের একাংশ বিচ্ছিন্নতায় বিশ্বাসী এবং সেই পথে সক্রিয় হয়ে ওঠা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের তকালীন অবস্থান, বক্তব্য ও তৎপরতা বিচ্ছিন্নতার পক্ষে ছিল না। | তবু রাজনৈতিক অবস্থা ক্রমে ঘােরালাে হয়ে উঠেছে পশ্চিম-পাকিস্তানি রাজনৈতিক মহল বিশেষের অযৌক্তিক জেদ ও আকাক্ষার চাপে, সেই সঙ্গে প্রশাসনের ভ্রান্ত ও অপরিণামদর্শী ভূমিকার কারণে। অদ্ভুত সব ঘটনার চাপে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের। ধৈর্য স্থৈর্য ও সহিষ্ণুতার অভাৰ প্রাধান্য পায়! অবশেষ সিদ্ধান্তে তাই অদূরদর্শিতা প্রকাশ পায়। এ অবস্থাই বােধ হয় ভুট্টোর আকাক্ষিত ছিল যেজন্য তিনি নানাভাবে ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছিলেন। আকাক্ষিত ছিল হয়তাে ইয়াহিয়াদেরও যাতে বিচ্ছিন্নতার অপবাদ চাপিয়ে আঘাত হানার পক্ষে যুক্তি ও পটভূমি তৈরি করা যায়।

এবং বিশ্বের রাজনৈতিক-রাষ্ট্ৰিক মহলের সামনে তা তুলে ধরা যায়। কথাটা রবার্ট জ্যাকসনও বলেছেন তথ্য ও যুক্তি সহকারে, বলেছেন অন্য কেউ কেউ। কিন্তু মেনে নেন নি পাক সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক ভাষ্যকারগণ এবং পশ্চিম-পাকিস্তানি রাজনীতিকগণের অনেকেই। অথচ আওয়ামী লীগের বক্তব্যে বিষয়টা স্পষ্ট।  আওয়ামী লীগের ১৫ তারিখের সম্মেলন উপলক্ষে দলের অন্যতম প্রধান নেতা খন্দকার মােস্তাক আহমদ বলেন যে তার দল আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র ও এক পাকিস্তানে বিশ্বাসী। তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী অপবাদ দেওয়া অন্যায়। তার মতে পর্দার আড়ালে কিছু অদৃশ্য শক্তি ক্ষমতা হস্তান্তরের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বানচাল করার লক্ষ্যে কাজ করে। যাচ্ছে’ (পাকিস্তান অবজার্ভার, ঢাকা, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১)। অস্বীকারের উপায় নেই যে নির্বাচনে একতরফা বিজয়ের পর বাঙালি রাজনীতি যেন এক স্বপ্নের ঘােরে ছিল, অনেকটা ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নিরঙ্কুশ বিজয়ের মতাে (অবশ্য সে বিজয় ছিল প্রদেশে)। বাঙালির স্বপ্ন ছিল স্বশাসনের এবং সেই সঙ্গে কেন্দ্রীয় শাসনের তথা মূল পাকিস্তানি শাসনের লাগাম হাতে নিতে পারার। এ ঘােরের কারণে চারদিকে যথেষ্ট ইঙ্গিত ও সঙ্কেত সত্ত্বেও রাজনীতিকদের এ কথা মনে হয় নি যে সামরিক সর্বাধিনায়ক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যেখানে সংখ্যালঘু দলের প্রধান ভুট্টোর সঙ্গে সমঝােতায় পৌছে গেছেন বলে প্রতীয়মান সেক্ষেত্রে বাঙালির হাতে শাসনভার আসা কতটা সম্ভব? একই কারণে তারা দেখতে চান নি যে ভুট্টোর বক্তব্য, বিবৃতি ও ঘােষণা ক্রমেই কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। ঘটনার যথার্থ তাৎপর্য অনুধাবনের অভাব তখন কম বেশি সব দলেই দেখা গেছে। আর এ স্বাপ্নিক ঘােরের প্রভাবে ও অনুধাবনের অভাবে আওয়ামী লীগে নেতৃত্ব খুশি মনে সম্ভাব্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্বের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে হিসাব-নিকাশে বসতেও দ্বিধা করে নি (পাকিস্তান অবজার্ভার, ১৭.২.৭১)।

এটা ছিল পরিস্থিতির বিচারে বাস্তবিকই অবিচক্ষণতা। এমনকি পাক সামরিক শাসক যখন সমঝোতার বদলে আঘাতে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে তখনও আওয়ামী লীগ প্রধান ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধি অর্জনের কথা বলছেন। হতে পারে এটা কৌশলগত কারণে বলা। তেহেরান-ভিত্তিক দৈনিক ‘কেহান’-এর সংবাদদাতাকে দেওয়া সাক্ষাঙ্কারে  (১৯২৯.৭১) তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযােগ উড়িয়ে দিয়ে বলেন যে তাদের স্বায়ত্তশাসনের লক্ষ্য ফেডারেল কাঠামােয় পূর্ব-পাকিস্তানের পাশাপাশি পাঞ্জাব, সিন্ধু সীমান্ত প্রদেশ ও বালুচিস্তানের জনগণেরও অধিকার নিশ্চিত করা। তার দল যেমন বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে জোট নিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী তেমনি বিশ্বের সকল দেশের সঙ্গে সক্রিয় বন্ধুত্বের সম্পর্কে বিশ্বাসী যেমন ভারতের সঙ্গে তেমনি চীনের সঙ্গেও সমান বন্ধুত্ব-স্থাপনে আগ্রহী। তবে মুসলমান জাতি হিসাবে তারা কমিউনিজমের পক্ষপাতী নন’ (ডন, করাচি, ২০.২.৭১)। (“Speaking about his autonomy programme for East Pakistan, Sheikh Mujibur Rahman said ‘Our programme is not aimed only at East Pakistan We want provinces such as Punjab, Sind, Baluchistan and NWFP to secure their rights within the federal framework.” …The interview reports, “His foreign policy consists of ‘non-alignment’ combined with active friendship ‘with all nations of the World, Mujib would like to have the best of relations with India’ and … ‘friendship with China also… this forms part of his foreign policy. But this does not mean change of system or outlook; ‘we are a Muslim nation and shall never accept communism.” The Dawn, 20 February, 1971). ছয় দফা প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ প্রধান ঢাকায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে সুস্পষ্ট ভাষায় বলেন : ‘৬-দফা অনিচ্ছুক কারাের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে না। সেজন্য পশ্চিম-পাকিস্তানি নেতা মওলানা নুরানি থেকে মুফতি মাহমুদ পর্যন্ত অনেকের সঙ্গে মত-বিনিময় করা হয়েছে। সংসদে বসে এ বিষয়ে সবাই আলােচনা করে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারবেন। কিন্তু পিপিপি-প্রধান এ সুযােগ নিতে রাজি নন। বিপন্ন সংহতির প্রশ্নে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন : বাঙালিরা সন্দেহবাদীদের চেয়ে উত্তম পাকিস্তানি’ (পাকিস্তান টাইমস, ২৫.২.৭১)।

(“The Awami League chief said ‘we are ready to give the provinces of West Pakistan autonomy on the basis of six-point programme. But we do not want to impose anything on them. …In pursuance of this objective we met Maulana Noorani, Nawab Akbar Khan Bugti, Maulana Ghulam Ghaus Hazarvi and Maulana Mufti Mahmood and other leaders of West Pakistan.” When asked about the integrity of Pakistan the leader said “Bengalis are better Pakistanis than many of them who raised such bogeys.” -The Pakistan Times, 25 February, 1971). ইতােমধ্যে ফেব্রুয়ারির শেষদিকে যে খসড়া সংবিধান তৈরি করা হয় তাতে দেখা যায়, কেন্দ্রকে আগের তুলনায় খানিকটা ছাড় দেওয়া হয়েছে। ফলে কেন্দ্রীয় সরকারকে রাজস্ব, বৈদেশিক বাণিজ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রাদেশিক সরকারের ওপর নির্ভর করতে হবে  এ পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিম-পাকিস্তান এম.এন.এ.-দের তাদের ইচ্ছাকৃত খসড়া সংবিধানের অশেষ রূপ দিতে আহ্বান জানানাে হয়েছে। প্রসঙ্গত প্রতিটি বিবৃতিতে বা বক্তব্যে যড়যন্ত্রের কথা, ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া বানচাল করার পরিকল্পনা চক্রের কথা বলা হয়েছে। এমন উদ্দীপক ঘােষণাও এর মধ্যে উচ্চারিত হয়েছে আওয়ামী লীগ প্রধানের কণ্ঠে যে পাকিস্তান এসেছে, পাকিস্তান থাকবে যেমন থাকবে বাংলাদেশ  পাঞ্জাব সিঙ্গ সীমান্ত প্রদেশ ও বালুচিস্তান। এ ধরনের ঘােষণায় জনতরফে উল্লাসধ্বনিও শােনা গেছে (ডন, করাচি, ১.৩.৭১)।

(“The Awami League chief referred to the continued conspiracies being made to foil the transfer of power to the people and declared amidst cheers that Pakistan would continue to stay and so the Bangladesh, the Punjab, Sind, NWFP and Baluchistan.”–The Dawn, Karachi, March 1, 1971) কিন্তু এসব বক্তব্য, বিবৃতি পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিকদের মধ্যে কোনােরূপ প্রভাব ফেলে নি বা অনুকূল সাড়া জাগায় নি। রাজনৈতিক যৌক্তিকতার প্রকাশ ঘটায় নি। বরং জনাব ভুয়ো তার অবস্থানে আরাে কঠোর হয়েছেন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে বৈদেশিক বাণিজ্য ও সাহায্য এবং মুদ্রা ও কর ব্যবস্থা অবশ্যই কেন্দ্রের অধীনে রাখতে হবে।’ তার মতে বর্তমান সমস্যা সমাধানের উপায় তিনটি বিকল্প ব্যবস্থার যে কোনাে একটি গ্রহণ। এক, প্রেসিডেন্ট জাতীয় সংসদ বাতিল করে দিতে পারেন; দুই, ৩রা মার্চ অনুষ্ঠিতব্য সংসদ অধিবেশন স্থগিত করা যাতে তার পক্ষে পূর্ব-পাকিস্তানে গিয়ে রাজনৈতিক সংলাপ শুরু করা সম্ভব হয়; অথবা তিন, সংবিধান রচনার জন্য নির্ধারিত ১২০ দিনের সময়সীমা রহিত করা। তাতেও সংলাপের জন্য সময় ও সুযােগ। মিলবে। তার মতে শেষ দুই বিকল্পের যে কোনাে একটি গ্রহণ করা না হলে দেশে গণতন্ত্রের অপমৃত্যু ঘটবে (পাকিস্তান টাইমস, ১,৩,৭১)। (“Mr. Bhutto proposed three alternatives to resolve the present political crisis. The President could dissolve the National Assembly which would not be acceptable to him. The other alternative was the postponement of the Assembly session scheduled to be held on March 3, yet another alternative was that the time limit of 120 days for framing constitution should be removed. If not accepted that would mean the end of democracy in the country.”-The Pakistan Times, March 1, 1971)। প্রসঙ্গত “মি. ভুট্টো হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, তার পার্টিকে বাদ দিয়ে গণপরিষদের যথাসময়ে অধিবেশন শুরু হলে তিনি পশ্চিমপাকিস্তানের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত গণ-আন্দোলন শুরু করবেন।’ (“Mr. Bhutto warned that if the session of the Assembly was held on March 3 as scheduled without PPP’s participation he would launch a popular agitation from one end of West Pakistan to the other.”)। আশ্চর্য যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার পরবর্তী পদক্ষেপে দেখা যায়, ভুট্টোর আন্দোলনের ভয়ে তিনি তার দাবি মেনে নিয়ে অধিবেশন স্থগিত করে দিলেন। অথচ সেই অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে পূর্বপাকিস্তানে আন্দোলন শুরু হলে তিনি সেনাবাহিনীকে হুকুম দিলেন রক্তস্রোত বইয়ে সে। আন্দোলন দমন করতে।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে পূর্বে উল্লিখিত কারণে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া চাপের মুখে বা অন্য বিশেষ কোনাে তাড়নায় ভুট্টো-ঘােষিত দ্বিতীয় বিকল্পই গ্রহণযােগ্য মনে করে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য সংসদ অধিবেশন স্থগিত ঘােষণা করেন। পূর্বপাকিস্তানের সামরিক প্রশাসন ও গভর্নমেন্ট হাউসের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র যখন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে অধীর আগ্রহে প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে সমস্যা সমাধানের সূত্র  হিসাবে একটি সুসংবাদের জন্য অপেক্ষা করছিল ঠিক তখনই ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্টের প্রধান স্টাফ অফিসারের কাছ থেকে ফোনে অশুভ খবরটাই এলাে গভর্নর আহসানের কাছে যে সংসদ অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সবারই মনে হলাে, প্রেসিডেন্ট বুঝি একটা ‘বম্বশেল’ ফাটালেন। এ বিস্ফোরণের প্রতিক্রিয়া স্বভাবতই বহুমাত্রিক হতে বাধ্য। কিন্তু তার আগে দেখে নেওয়া যাক ঐ সমস্যা বিদেশী সংবাদ ভুবনে কি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। তারা বিষয়টিকে কিভাবে দেখেছেন। এবং দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানে সৃষ্ট এই জটিলতা তাদের কার কাছে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচিত হয়েছে। ইতােমধ্যে আমরা দেখে নিয়েছি উল্লিখিত সমস্যা নিয়ে পাকিস্তানে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি পক্ষ কিভাবে তাদের নিজস্ব যুক্তি ও পরিপ্রেক্ষিত মাফিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন যা ছিল কখনাে ক্ষেত্রবিশেষে স্ববিরােধী বা সত্যকার যুক্তিহীন। দীর্ঘকাল দেশে সামরিক শাসন এবং কথিত সামরিক গণতন্ত্রের শাসন-শেষে একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর মানুষ কম বেশি আশান্বিত হয়ে ওঠেন এই ভেবে যে এবার দেশে হয়তাে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল পাকিস্তানের দুই অংশেই এমন একদলীয় হয়ে দাঁড়ায়, বিশেষ করে পূর্ব-পাকিস্তানে (যেমন পশ্চিম-পাকিস্তানে ভুট্টোর পিপিপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আর পূর্ব-পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ একমাত্র নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল যা আবার গােটা পাকিস্তানের প্রেক্ষাপটেও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল) যাতে মনে হতে পারে যে নির্বাচনের ফলাফলই বুঝি সমস্যা, সংকট ও বিভাজনের পটভূমিও তৈরি করেছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক বিধিবিধানের প্রতি আস্থা থাকলে সমস্যা বা সঙ্কটের কোনাে কারণ ছিল না। আসল সমস্যা ছিল ঐখানে। | প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক লােভ এবং স্বার্থপরতাই সঙ্কটের জন্ম দিয়েছিল। দিয়েছিল। সঙ্কীর্ণতা ও অসহিষ্ণুতার কারণে।

তাই নির্বাচনের পর পূর্ব-পাকিস্তানে ৬-দফার পক্ষে বাঙালি জনসাধারণের সুস্পষ্ট ম্যান্ডেট’ সত্ত্বেও পশ্চিম-পাকিস্তানের রাজনৈতিক মহল বিশেষ তা মেনে নিতে পারে নি। এমন কি পরাক্রান্ত সেনানায়কদের প্রধান অংশেও তা অগ্রহণযোগ্য মনে হয়েছিল, যে মনোভাব ক্রমে প্রকাশ পেয়েছে। ফলে বাঙালি রাজনীতিক ও জনতার মনে এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। | এ পরিস্থিতিতে পিটার হ্যাজেলহাস্ট লন্ডনের ‘দ্য টাইমস পত্রিকায় (১৫.২.৭১) বিপজ্জনক ও কঠিন মুহুর্তের মধ্য দিয়ে পার হতে চলেছে।’ তার মতে এর কারণ জনগণের একাট্টা সমর্থন পাওয়ার পর আওয়ামী লীগের পক্ষে ৬-দফা থেকে সরে আসা সম্ভব নয়। অন্যদিকে পিপিপি’র প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোর অনমনীয় মনােভাব হচ্ছে— ৬-দফা মেনে নিলে দেশ দু’বছরও টিকবে না। আওয়ামী লীগ এবং পিপিপি এই দুই দলের একমত হওয়ার পক্ষে প্রধান বাধা ছয় দফার বিভিন্ন শর্ত, যেমন বৈদেশিক  বাণিজ্য, কর ব্যবস্থা, মুদ্রা ইত্যাদি কেন্দ্র না প্রদেশের হাতে থাকবে তাই নিয়ে। তেমনি সংবিধান ও শাসন ব্যবস্থার সম্ভাব্য রূপ নিয়েও এই দুই দলে মতভেদ যথেষ্ট। এসব বাধা অতিক্রম করা দুঃসাধ্য। (“Today Pakistan faces the most dangerous and difficult hours of its short history. …It is doubtful whether he (Sheikh Mujib) can retreat on the questions of foreign trade and tax (infact on six-points and autonomy). The Sheikh is adamant: ‘No compromise on the six-points’. But 1200 miles across India in West Pakistan Mr. Bhutto has other ideas: ‘I can not accept The Times, all of the six-points. The country would not last two years. 15 January, 1971)। আসলে যে কথাটা আগে বলা হয়েছে তার মধ্যে যে রাজনৈতিক সত্য ও বাস্তবতা রয়েছে পশ্চিমা ভাষ্যকারদের আলােচনায় তার ইঙ্গিত মেলে। সম্ভবত ঐ নির্বাচনী ফলাফলের জমিতেই ছিল সঙ্কটের বীজ। নির্বাচনী ফলাফল অনেকেরই হিসাব-নিকাশ। ভণ্ডুল করে দিয়ে পশ্চিম-পাকিস্তানে ভুট্টোর পিপিপি’কে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসাবে। প্রতিষ্ঠিত করে। অন্যদিকে পূর্ব-পাকিস্তানে নব-উদ্ভূত বাঙালি জাতীয়তার উদ্দীপনায় আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল প্রত্যাশিত।

বিশেষ করে ভাসানী ন্যাপের নির্বাচন বর্জনের পরিপ্রেক্ষিতে। আর এ দুই দল এবং দুই দল প্রধানের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মসূচি ছিল পরম্পর-বিরােধী। একদিকে শক্তিশালী কেন্দ্র, অন্যদিকে দুর্বলকেন্দ্র এবং প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন। সেক্ষেত্রে ঐ দুই নেতার মধ্যে সমঝোতার সম্ভাবনা সহজ নয়। এমনই ভাষ্য ছিল নির্বাচন-পরবর্তী টাইমস পত্রিকার প্রতিবেদনে (৯ ডিসেম্বর, ১৯৭১)।  ঐ পত্রিকার একই সংখ্যায় বিশেষ সংবাদদাতার এক প্রতিবেদনে উল্লিখিত দুই নেতার তুলনামূলক সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থানের যে ব্যাখ্যা তুলে ধরা হয় তাতেও উভয়ের মানসিক ও রাজনৈতিক পার্থক্যই বড় হয়ে ওঠে। অদ্ভুত যে পাকিস্তানের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার এক নম্বর আসামি হিসাবে) সেই মানুষটিই এখন ব্যাপক জনসমর্থনের জোরে সম্ভবত পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন। মূলত পশ্চিমঘেঁষা এই রাজনীতিক তার মতাে করে দিল্লির সঙ্গে এক ধরনের সমঝোতা গড়ে তুলতে চাইবেন। অন্যদিকে ভুট্টো ঘােরতর দিল্লি-বিরােধী রাজনীতিক। তিনি পাকিস্তানে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার গঠনেরও পক্ষে। (“Ironically, the man (Sheikh Mujibur Rahman) who was called a traitor two years ago, is the man who is most likely to become Pakistan’s next Prime Minister. He would certainly work for a rapprochment with Delhi if he has his way. Essentially, he is pro-western.” On the other hand “Mr. Bhutto advocates a direct confrontation with India. On internal matters he is an advocate of strong central government. The Times, 9 December, 1971)  কাজেই এ অবস্থায় রাজনৈতিক সঙ্কট অনিবার্য না হয়ে পারে না। টাইমস পত্রিকার। ২০ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় ‘বাংলার সঙ্কট’ (‘Crisis of Bengal’) শীর্ষক নিবন্ধে প্রকাশ পায়। ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতের কিছু তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য। যেমন শেখ মুজিবুর রহমান নিশ্চিতই  চাইবেন না যে একজন মুসলমান নেতার হাত দিয়ে পাকিস্তান বিভক্ত হয়েছে এমন কথা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হােক। কিন্তু ভুট্টো তাকে ক্রমাগত সেদিকেই ঠেলে দিচ্ছেন।’ পত্রিকাটির মতে ‘চাপের মুখে যদি এমনটাই সত্য হয়ে ওঠে তাহলে ভারত পাকিস্তান উভয়ের জন্য তা ঘােরতর সঙ্কটের কারণ হয়ে উঠবে’। (এর অর্থ কি যথারীতি দুই বিরূপ রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ– লেখক)।

(“Sheikh Mujibur Rahman almost certainly does not want history to identify him as the Muslim leader who broke Pakistan into two. Mr. Bhutto has pushed him to that corner. If his hand is forced,… grave crisis will face India and Pakistan.” -The Times, 20 February, 1971) . এ নিবন্ধে আরাে একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিকের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। একদিকে পূর্ব-পাকিস্তানেসদ্য জাগ্রত বাঙালি জাতীয়তাবাদের পটভূমিতে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, অন্যদিকে প্রতিবেশী পশ্চিম বঙ্গে আসন্ন নির্বাচনে কমিউনিস্টদের সম্ভাব্য বিজয় সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে, দিল্লির জন্য শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে উঠতে পারে, বিশেষত দুই বঙ্গের ভাষা সাহিত্য-সংস্কৃতির ঐতিহ্যগত ঐক্যের কারণে। পত্রিকার এ ভাষ্য বাস্তবতা-সম্মত ছিল বলে মনে হয় না। তা সত্ত্বেও দেখা যায়, ‘টাইমস পত্রিকার ভবিষ্যদ্বাণী ইন্ধিরা গান্ধীর রাজনৈতিক চাতুর্য ও নির্বাচনী কূটকৌশলের চাপে ও আঘাতে ভেস্তে গিয়েছিল। সি.পি.আই’র সমর্থন নিয়ে সামান্য গরিষ্ঠতা নিয়ে ইন্ধিরা কংগ্রেসই পশ্চিম বঙ্গের গদিতে বসে। কিন্তু এ নিবন্ধের অন্য দিকনির্দেশনাটি বাস্তবিকই ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে বলা হয়েছিল যে ‘আওয়ামী লীগের বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদ্দীপক আহ্বান যদি বাংলাদেশ পটভূমিতে পশ্চিম পাকিস্তানকে প্রত্যাখ্যান করতে চায় তাহলে তা বিপজ্জনক পরিণতি ডেকে আনবে। বিশেষ করে আঘাতটা আসবে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর।” (“The appeal of the Awami League to a fullscale ‘Bangladesh’ or Bengali nationalism, may still be fanciful. It is also too possible that the excitement and violence involved in the repudation of West Pakistan might boil over into attacks on the Hindu minority.”)।‘টাইমস’ পত্রিকার এ আশঙ্কা একাত্তরে সত্যে পরিণত হয়েছিল যদিও কথিত প্রত্যাখ্যান আওয়ামী লীগের দিক থেকে ছিল না। বিচ্ছিন্নতার মূলে যেসব ঘটনা তার সুতোগুলাে ধরা ছিল ভুট্টো ও জঙ্গি সামরিক শাসকদের হাতে। এ ছাড়াও ঐ নিবন্ধে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে চীন-পশ্চিম পাকিস্তান-কাশ্মির এবং চীন কিংবা ভারত-রাশিয়া-বাংলাদেশ বিষয়ক সমীক্ষা অংশত সঠিক প্রতিপন্ন হয়েছে । যা আমাদের বিবেচ্য বিষয় নয়।

‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় এস,আর, ঘােরি করাচি থেকে (২৪ ফেব্রুয়ারি) পাঠানাে প্রতিবেদনে বলতে চেয়েছেন যে “ভুট্টো এবং শেখ মুজিবুর দুজনেই তাদের দাবি নিয়ে। অনমনীয় অবস্থানে রয়েছেন, প্রধানত ৬-দফা দাবির পরিপ্রেক্ষিতে। ভুট্টো এ অবস্থায় ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যােগ দিতে চাইলে পাঞ্জাবে তার সমর্থকরা বিদ্রোহ করবে। অন্যদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধান অনুমােদিত হলে তা পাঞ্জাব ও সিন্ধুতে গ্রহণযােগ্য হবে না। এর বিকল্প সামরিক শাসন অব্যাহত থাকা যা আবার পূর্ব  পাকিস্তান কোনােমতেই মেনে নেবে না।’ (“If Mr. Bhutto decides to go to Dacca, Punbjab would revolt. If he stays away, any constitution passed by the Awami League, would be unacceptable to Punbjab and Sind and could not be enforced. Alternatively, the military regime would continue, a situation East Pakistan will not countenance.”The Guardian, 25 February, 1971)। সত্যি বলতে কি ঘােরি সাহেবের বক্তব্যেই সংকটের মূল সত্যটা বেরিয়ে এসেছে, আর তা হলাে পাঞ্জাব ও পাঞ্জাবি হিসাব-নিকাশের বাইরে পাকিস্তানে কোনাে কিছু ঘটতে পারে না। তার মতে পাকিস্তান এর আগে কখনাে এমন বিপর্যয়ের মুখােমুখি হয় নি। ভুট্টো যেমন ৬-দফা প্রত্যাখ্যান করেছেন, শেখ মুজিবুরও তেমনি ভুট্টো প্রস্তাবিত দ্বিকক্ষবিশিষ্ট শাসন ব্যবস্থা মেনে নিতে গররাজি। কারণ তার মতে এ ব্যবস্থায় পূর্ব-পাকিস্তান গুরুত্বহীন সংখ্যালঘুত্বে পরিণত হবে। তাই তার দাবি, প্রদেশগুলাের হাতে কর আরােপ, বৈদেশিক বাণিজ্য পরিচালনা এবং বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্য চুক্তির আলােচনার অধিকার থাকতে হবে। অবশ্য তা দেশের বিদেশনীতির কাঠামােয় । ভাষ্যকারের মতে এ অবস্থায় ইয়াহিয়া খানের সমঝােতা প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। কিন্তু এরা কেউ ভাবেন নি যে সংবিধান। অনুমােদন করা না-করার অবশেষ চাবিকাঠি তাে নিয়ম মাফিক প্রেসিডেন্টের হাতে। সেক্ষেত্রে শাসনতন্ত্র প্রণয়নে অসুবিধা কোথায়? আশ্চর্য যে ভাষ্যকারদের অনেকেই পাখতুন ও বালুচদের মতামত হিসাবের মধ্যে আনেন নি। তাদের বিচার্য ছিল পাঞ্জাব ও সিন্ধু, আর এ দুই প্রদেশে নির্বাচনে জয়ী ভুট্টোর মতামত। সংসদীয় গণতন্ত্রে স্বীকৃত সংখ্যাগরিষ্ঠের অধিকারও তাদের বিবেচ্য। ছিল না। ইতােমধ্যে সিন্ধু ও বুড়িগঙ্গায় অনেক পানি বয়ে গেছে, কিন্তু সমস্যার জটিলতা। কমে নি। পিটার হ্যাজেলহা তাই হতাশা প্রকাশ করেই লেখেন : ‘ভুট্টোর পক্ষ থেকে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বর্জনের সিদ্ধান্ত যে-সমস্যা তৈরি করেছে তাতে পূর্বপশ্চিমের মধ্যে সমঝােতার আশা নেই বললেই চলে। তার মতে ভুট্টো ও শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে মতপার্থক্য মূলত বৈদেশিক বাণিজ্য, করারােপের ক্ষমতা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে’—অর্থাৎ এগুলাে প্রদেশের হাতে না কেন্দ্রের হাতে থাকবে তাই নিয়ে ভিন্নমত (দ্য টাইমস, ২৮,২.৭১)।

পিটার হ্যাজেলহাস্টের ভাষায় (Thé decision of Mr. Zulfikar Ali Bhuitto and his People’s Party to boycott the country’s first popularly elected Constituent Assembly has brought Pakistan close to the point of no retum where the two distant provinces must part.” -The Times, 28 February, 1971) প্রতিবেদকের মতে ‘অবস্থা এখন সত্যই বিপজ্জনক পর্যায়ে। এক্ষেত্রে ভুট্টোর আপত্তির কারণটা খুব স্পষ্ট। উল্লিখিত ব্যবস্থায় পূর্ব-পাকিস্তান কতটা সুবিধা পাবে, পাবে অন্য প্রদেশগুলাের সঙ্গে সেটা ভুট্টোর জন্য মােটেই বিবেচ্য বিষয় ছিল না। তার দরকার শক্তিশালী কেন্দ্র। সিন্ধুর মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার জন্য তার রাজনীতি নয়। তার লক্ষ্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর মসনদ না হয় প্রেসিডেন্টের সিংহাসন, যেদিক থেকেই শিকে ছিড়ক না কেন। তাই আত্মস্বার্থে তথা পশ্চিম-পাকিস্তানি স্বার্থে  রাষ্ট্রশাসন বাঙালির হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় না। | মনে হয় বিচ্ছিন্নতার আশঙ্কার চেয়েও ভুট্টোর রাজনৈতিক উচ্চাকাক্ষার বিষয়ই পিপিপি বনাম আওয়ামী লীগ তথা পশ্চিম বনাম পূর্ব-পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমঝোতার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হয়ে ওঠে। সত্য বলতে কি সমঝােতা বা মীমাংসার কোনাে ইচ্ছা ভুট্টোর ছিল না। গােটা সময়টাতেই তার চেষ্টা ছিল সাদামাঠা সমস্যাটিকে ঠেলে সঙ্কটের এমন এক বিন্দুতে পৌছে দেওয়া যেখান থেকে উদ্ধার পাওয়া বা ফিরে-আসা সম্ভব। নয়। বস্তুত একাজটিই ভুট্টো সাহেব সাফল্যের সঙ্গে করতে পেরেছিলেন জঙ্গি সেনানায়কদের সহায়তায়। অথচ সমঝােতার অভাব, অনৈক্যের পরিণামে উদ্ভুত সঙ্কটের পরিণাম ভুট্টোর অজানা থাকার কথা নয় । তখনকার অধিকাংশ বিদেশী পত্রপত্রিকায় অনৈক্যের বিপজ্জনক পরিণাম সম্পর্কে বারবার স্পষ্ট ভাষায় হুশিয়ারি উচ্চারণ করে প্রায় একই কথা বলা হয়েছে। ‘দ্য টাইমস’ পত্রিকার পূর্বোক্ত প্রতিবেদকের মতে সমঝোতা না হলে দেশে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দেখা দেবার সমূহ সম্ভাবনা।

তা সত্ত্বেও সমঝােতার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। জাতীয় পরিষদে ভুট্টোর অনুপস্থিতিতে যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধান তৈরিও হয় তবু তা প্রেসিডেন্টের অনুমােদন পাবে না। সেক্ষেত্রে শেখ মুজিব বা মি, ভুট্টো কি এককভাবে স্বাধীনতা ঘােষণা করবেন? গােটা ফেব্রুয়ারি মাসটাই ছিল পাকিস্তানি রাজনীতির জন্য প্রবল টানাপােড়েনের যেখান থেকে মার্চের রক্তছায়ায় প্রবেশ। পনেরাে ফেব্রুয়ারি দিনটি নানাদিক থেকে অশুভ সঙ্কেত নিয়ে যাত্রা শুরু করে যা এক অমােচনীয় সঙ্কটের বৃত্তে পৌঁছে যায়। দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তিটি সঙ্কট মােচনের চেষ্টায় গণতান্ত্রিক বিধিসম্মত কোনাে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন না। পরিবর্তে শক্তিধর্মে বিশ্বাসী বিস্ফোরক সিদ্ধান্তেই পেীছান। পিন্ডিতে বসে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার নেওয়া সে সিদ্ধান্ত প্রচারিত হয় ১ মার্চ (১৯৭১)। প্রেসিডেন্টের ঐ ভাষণে (যদিও তার স্বকণ্ঠে নয়) দুঃখ প্রকাশ করে বলা হয় যে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতাগণ তার অনুরােধ সত্ত্বেও শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ও সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে সমঝােতায় পেীছাতে ব্যর্থ হয়েছেন। অন্যদিকে পশ্চিমের পাকিস্তান পিপলস দিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করায় এবং সেই সঙ্গে ভারতের সৃষ্ট অস্বাভাবিক উদ্বেগজনক পরিস্থিতির কারণে সংসদ অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত করতে হয়েছে’ (মর্নিং নিউজ, করাচি-ঢাকা, ২.৩.৭১) প্রেসিডেন্টের এ ঘােষণায় উপস্থাপিত তথ্যে ও যুক্তিতে যথেষ্ট ফাক ছিল, ছিল অসারতা। কারণ সমঝােতার গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মাফিক পুরাে দায়িত্বই ভুট্টোর কাধে পড়ে। পড়ে তার জেদ ও একগুঁয়েমির ওপর। পূর্ব-পাকিস্তানের তরফ থেকে বারবার বলা হয়েছিল যে মতভেদ গণতান্ত্রিক পদ্ধতির স্বীকৃত বিষয়। সংসদ অধিবেশনে বসে  আলােচনার মাধ্যমে সে মতভেদ যতটা সম্ভব কমিয়ে আনা যায়, অন্যথায় সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত গ্রহণই চিরাচরিত স্বীকৃত বিধি।

তাছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানের একাধিক দল (ভুট্টো কাইউমের দল বাদে) ঢাকা অধিবেশনে যােগ দিতে ইচ্ছুক ছিল, যে সম্পর্কে প্রেসিডেন্টের বক্তব্য সঠিক ছিল না। আর কাশ্মিরি মুজাহিদদের ছিনতাই করা ভারতীয় বিমান লাহােরে নামার অনুমতি দেওয়া (৩০ জানুয়ারি, ৭১), ভুট্টো কর্তৃক তাদের জাতীয় বীরের মর্যাদা দেওয়ার ঘােষণা এবং পরিশেষে বিমান ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য ভারতীয় অনুরােধ প্রত্যাখ্যান করে বিমানটি উড়িয়ে দেয়া (২,২.৭১) ছিল আন্তর্জাতিক রীতিনীতির বরখেলাফ। খবরে প্রকাশ ভুট্টো ঐ হাইজ্যাকার মুজাহিদদের সঙ্গে আলাপ করে বিমানটি উড়িয়ে দেবার জন্য তাদের পরামর্শ দেন (দ্য পিপল, ৩,২.৭১)। কিন্তু পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনাে ব্যবস্থা নেওয়া হয় নি। বরং তাদের রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া হয় এই অজুহাতে যে ওরা ভারতীয় নাগরিক নয়, পাকিস্তানের নাগরিক (দৈনিক পাকিস্তান, ৩,২.৭১)। ওরা যদি পাকিস্তানেরই হবে তাহলে রাজনৈতিক আশ্রয়ের প্রশ্ন আসে কিভাবে?   আরাে আশ্চর্য যে বিমান হাইজ্যাক বিষয়ে আন্তর্জাতিক রীতিনীতি লঙ্ঘন করে ভুট্টো প্রকাশ্যে বিমান ছিনতাইকারীদের পক্ষ সমর্থন করে বলেন যে তার পার্টি ঐ দুই কাশ্মিরিকে সব ধরনের সাহায্য সহযােগিতা দেবে, তারা তার অতিথি। পরিণামে ভারত কর্তৃক প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ— ভারতের ওপর দিয়ে পি,আই,এর সব বিমান। যাত্রা বাতিল করে দেওয়া হয়। ভারত আন্তর্জাতিক রীতিমাফিক বিমানের জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করে (দ্য পিপল, ৫.২.৭১)। এ বিষয়ে ভুট্টোর প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল পরিকল্পনা প্রসূত— যেমন ঢাকা থেকে আলােচনা স্থগিত রেখে অতি দ্রুত লাহােরে উড়ে যাওয়া, বিমান ধ্বংসের পরামর্শ ইত্যাদি, যাতে এমন একটি রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি হয় যা অধিবেশন স্থগিত করার অন্যতম উপলক্ষ হয়ে উঠতে পারে। | উল্লিখিত প্রতিটি ঘটনা ছিল ভুট্টো কিংবা সামরিক সরকারের সৃষ্ট। আর সেজন্যই অধিবেশন স্থগিত করা সম্পর্কে তাদের ষড়যন্ত্র বা পরিকল্পনার কথা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সবচেয়ে বড় কথা হলাে পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষ অধিবেশনের মাত্র তিন দিন আগে এ ধরনের আকস্মিক ঘােষণার জন্য একেবারে প্রস্তুত ছিলেন না।

এ ঘােষণা ছিল তাদের কাছে বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো। তার প্রেসিডেন্টের এ পদক্ষেপ গ্রহণের পক্ষে কোনাে যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে পান নি। প্রত্যাশা এভাবে ভেঙে পড়ায় তাদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া হয়ে ওঠে তীব্র ও ব্যাপক, আগুন ধরার মতাে। বিষয়টাকে তারা দেখেছেন পশ্চিম-পাকিস্তানি শাসক ও রাজনীতিকদের বাঙালিদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসাবে। এ সম্পর্কে অধিকাংশ পশ্চিমা ভাষ্যকারদের বিচার-বিশ্লেষণই সরকারি সিদ্ধান্তের পক্ষে দাঁড়ায় নি। তাদের অনেকের ধারণা— এ ঘটনা রাজনৈতিক অঙ্গনসহ পূর্বপাকিস্তানের সর্বত্র ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে বাধ্য। আর সে প্রতিক্রিয়া যে পূর্বপাকিস্তানকে বিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দিতে পারে সে আশঙ্কাও অধিকাংশ ভাষ্যকারেরই। স্বাধীনতাপন্থী ছাত্রদের চাপ সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের মূল নেতৃত্ব যে অখণ্ড পাকিস্তান। কাঠামাের মধ্যেই স্বায়ত্তশাসনে বিশ্বাসী এবং গণতান্ত্রিক রীতিনীতি অনুযায়ী শাসনতান্ত্রিক   সমঝােতার ফর্মুলা’ খুঁজে পেতে আগ্রহী— সে কথাও কেউ কেউ বলেছেন। তবে তা পূর্ব-পাকিস্তানের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে। সেদিকটা। নিশ্চিত করা গেলে বিচ্ছিন্নতা অনিবার্য হওয়ার কথা নয়। রাজনৈতিক পরিস্থিতির এ মূল্যায়নে ভুল ছিল না। শুরুতে আওয়ামী লীগের প্রধান। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব পশ্চিমা গণতন্ত্রের অনুরাগী হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী এবং তার অনুসারী সাংবাদিক তফাজ্জল হােসেন (মানিক মিয়া) থেকে কট্টর মার্কিনপন্থী খন্দকার। মােস্তাক বা আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমদ সবাই বিভিন্ন সময়ে অখণ্ড পাকিস্তানের ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্তশাসনের (তাদের কারাে কারাে ভাষায় পাকবাংলার) পক্ষে কথা বলেছেন।  শহীদ সাহেবের প্রিয় রাজনৈতিক ভাবশিষ্য শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক বিশ্বাস এদিক থেকে ভিন্ন হওয়ার কথা নয়।

তাদের হিসাবে পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনের মূল ভিত্তি ১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাব যাতে পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চল নিয়ে দুটো স্বতন্ত্র স্বশাসিত রাষ্ট্রের সমন্বয়ে গঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের কথা বলা হয়েছিল। পরবর্তী ভিন্ন অবস্থায় এর পরিবর্তিত রূপই তাদের চিন্তায় ছিল। মওলানা ভাসানীও বরাবর লাহাের প্রস্তাব-ভিত্তিক স্বশাসনের কথাই বলেছেন। বলেছেন বক্তৃতায় ঘােষণীয় বিবৃতিতে, তার কণ্ঠে স্বাধীনতার দাবি উচ্চারিত হওয়ার পূর্বপর্যন্ত। এ বিষয়ে মানিক মিয়ার একাধিক লেখায়, এমন কি তার বইতেও ঐ লাহাের প্রস্তাবের কথাই এসেছে। তার ভাষায় “আজ লাহাের প্রস্তাব-ভিত্তিক দুইটি পৃথক সর্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অবকাশ না থাকিলেও পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি বাস্তবায়নের অবকাশ রহিয়াছে। ৬-দফা কর্মসূচিতে এই দাবি চূড়ান্ত রূপ লাভ করিয়াছে। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে লাহাের প্রস্তাবের মর্মানুযায়ী পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও অস্তিত্ব বজায় রাখিবার গুরুত্ব উপলব্ধি করিয়া কেন্দ্রীয় শাসকবর্গ ও পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দকে দুই অঞ্চলে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তনের পথে সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করিতে হইবে।” মানিক মিয়ার ঐ বক্তব্যের পর তিন বছর পার হয় নি, স্বায়ত্তশাসন তথা ৬দফার দাবি ঘিরে রাজনৈতিক সঙ্কটের সূচনা। তবু অস্বীকার করা চলে না যে আওয়ামীপ্রধানসহ মূল নেতৃত্বের সবারই চেষ্টা ছিল এ অবস্থার মধ্যেই মানিক মিয়া কথিত ঐ অখণ্ডতা কোনােভাবে বজায় রেখে স্বশাসন অর্জন করা। কাজেই বলা চলে যে পশ্চিম পাকিস্তানিদের কথিত বিচ্ছিন্নতার আশঙ্কা ও অভিযােগের কোনাে বাস্তব ভিত্তি ছিল  হয়তাে তাই আওয়ামী লীগ প্রধানের সঙ্গে আলােচনার পর নিশ্চিত হয়েই গভর্নর আহসান ও সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল ইয়াকুব পিন্ডিতে এই মর্মে বার্তা পাঠাতে পেরেছিলেন যে জাতীয় সংসদের অধিবেশন বিশেষ প্রয়ােজনে স্থগিত করতে হলেও অবস্থার প্রয়ােজনে সেই সঙ্গে পরবর্তী বৈঠকের একটি নির্দিষ্ট তারিখ যেন প্রেসিডেন্টের ঘােষণায় থাকে। পূর্ব-পাকিস্তানের পরিস্থিতি, জনসাধারণের আবেগ-উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় অন্তত এটুকু দরকার বলে তারা মনে করে ছিলেন।

কিন্তু জবাবে পিভি  থেকে আসা পাল্টা তারবার্তায় এ প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে বলা হয় তােমাদের বার্তাভাষ্যের তাৎপর্য অনুধাবন করা হয়েছে’ (সিদ্দিক সালিক)। সে তাৎপর্য-অনুধাবন ছিল এমনই বিচক্ষণতার যে প্রেসিডেন্টের ভাষণে সঙ্কটের দায়টা কমবেশি বাঙালি রাজনীতিকদের ওপরই চাপানাে হয়, আর ভুট্টো-কাইউম প্রমুখ পশ্চিম-পাকিস্তানি রাজনীতিকদের অগণতান্ত্রিক ও একদেশদর্শী পদক্ষেপের প্রতি প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ই সেখানে ফুটে উঠে ছিল। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগসহ পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য রাজনীতিক দলই শুধু নয়, শিক্ষিত বাঙালি, বিশেষ করে ছাত্র সমাজের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে সেটাই ছিল স্বাভাবিক। এমন কি জনসাধারণের মধ্যে যে প্রেসিডেন্টের ঘােষণার বিরুদ্ধে ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল তার প্রমাণ ধরা রয়েছে তাদের তখনকার কথাবার্তায়, আলােচনায়, সভা-সমাবেশ-মিছিলে অংশগ্রহণের স্বতঃস্ফূর্ততায়। স্বভাবতই জননেতার ওপর চাপ হয়ে ওঠে প্রবল। সমস্যার এদিকটাই আহসান-ইয়াকুব বােঝাতে চেয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে। কিন্তু ইয়াহিয়া তা বুঝতে চান নি।

সূত্র : একাত্তরে পাকবর্বরতার সংবাদভাষ্য – আহমদ রফিক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!