মার্চের রক্তঝরা দিনলিপি প্রতিবাদ-প্রতিক্রিয়ার ছবি
একাত্তরের ১ মার্চ বাঙালি জাতির জীবনে এক দুর্যোগের সঙ্কেত নিয়ে দেখা দিয়েছিল। হঠাৎ করেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণী সব শ্রেণীর মানুষের মনে অভাবিত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। সে প্রতিক্রিয়ার বিস্ফোরণ ঘটতে দেরি হয় নি। বেতার ঘােষণার পরপরই মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে আসে, অফিস-আদালতের চত্বরে এক অশুভ ছায়া নামে। এ প্রতিক্রিয়া ছিল ব্যাপক ও স্বতঃস্ফূর্ত। কোনাে রাজনৈতিক দলের ঘােষণা ছাড়াই ঐ অভাবিত ঘটনার প্রকাশ। বুঝতে কষ্ট হয় না যে বিষয়টি কী স্পর্শকাতরই না ছিল বাঙালি জনমানসের জন্য। এ সত্য পাকিস্তানি শাসকশ্রেণী ঠিক বুঝতে পারে নি। ঘােষণার প্রতিক্রিয়ায় হােটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগ সংসদীয় (‘পার্লিয়ামেন্টারি’) পার্টির এক অনির্ধারিত বৈঠক বসে। সেখানে জনগণের অধিকার রক্ষার জন্যে লড়াইয়ের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। বৈঠক-শেষে এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপের ওপর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান বলেন : “এটা দুঃখজনক যে একটি সংখ্যালঘু দলের আবদার রাখতে গিয়ে জাতীয় সংসদের অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসাবে এ অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেই হবে। | তিনি আরাে বলেন : “শেষপর্যন্ত ষড়যন্ত্রকারীদেরই জয় হয়েছে। তবে অশেষ জয় আমাদের। দেশে সামরিক আইন বহাল থাকা সত্ত্বেও পিপিপি’র চেয়ারম্যান জাতীয় সংসদের অধিবেশনে যােগদানে ইচ্ছুক পশ্চিম-পাকিস্তানি সাংসদদের প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছেন। জনাব ভুট্টো আইন হাতে তুলে নিয়েছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সামরিক আইন শুধুমাত্র বাঙালিদের জন্য। কিন্তু আমরা যে কোনাে প্রতিকূল অবস্থার জন্য তৈরি রয়েছি।’ সাংবাদিক সম্মেলনেই তিনি এর প্রতিবাদ হিসাবে দেশব্যাপী অহিংস ও শান্তিপূর্ণ আইন অমান্য আন্দোলনের আহ্বান জানান। আন্দোলনের কর্মসূচি হিসাবে ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ থেকে দেশব্যাপী পূর্ণ হরতাল পালনের ডাক দেওয়া হয়। এ কর্মসূচি ৬ দিনের জন্য। এরপর ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসভা, সেখানে পরবর্তী কর্মসূচি ঘােষণা করা হবে। ষড়যন্ত্রকারীরা সাবধান না হলে এ অবস্থা থেকেই ইতিহাস তৈরি হবে। স্বাধীনতা ঘােষণা প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে নেতার জবাব “অপেক্ষা করুন” (দ্য পিপল, ২ মার্চ, ১৯৭১)।
কিন্তু জনসাধারণ, বিশেষ করে ছাত্রযুব সমাজ শান্তিপূর্ণ অসহযােগ আন্দোলন মেনে নিতে রাজি ছিল না। উত্তেজিত জনসাধারণ বেতার-ঘােষণার সঙ্গে সঙ্গে রাজপথে নেমে পড়ে, স্লোগান ও মিছিলের পদচারণায় পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। প্রতিবাদ তখন আর অহিংস বা শান্তিপূর্ণ থাকে না। স্থানীয় সামরিক প্রশাসন অবস্থা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেয়। জঙ্গি প্রতিবাদের বিরুদ্ধে গুলি চলে। রক্ত ঝরে ঢাকার রাজপথে এবং দেশের অন্যত্র। ঢাকা স্টেডিয়াম মাঠে পাকিস্তান একাদশ বনাম আন্তর্জাতিক একাদশ ক্রিকেট খেলা পণ্ড হয়ে যায়। লাশ কাঁধে নিয়ে মিছিল বের হয়। সে মিছিল জনমনে উত্তেজনা ছড়ায়। তা সত্ত্বেও চেষ্টা চলে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সঙ্কট থেকে উত্তরণের । চেষ্টা প্রধানত আওয়ামী লীগের। স্থানীয় সামরিক সূত্রের ভাষ্য যদি সত্য হয় তাহলে বলা চলে যে সে দিনই আওয়ামী লীগ প্রধান গভর্নরের সঙ্গে দেখা করে ভবিষ্যৎ সংসদ অধিবেশনের নির্দিষ্ট তারিখ ঘােষণার জন্য চাপ দেন। ফলে ঢাকা থেকে পিন্ডিতে এই মর্মে যােগাযােগও করা হয় কিন্তু রাওয়ালপিন্ডি-ইসলামাবাদের কর্তাদের কাছ থেকে কোনাে সদুত্তর মেলে নি। বরং এসব তৎপরতার পরিণাম হিসাবে পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্নর ভাইস-অ্যাডমিরাল আহসানকে তার দায়িত্বভার সামরিক প্রশাসক জেনারেল ইয়াকুবের কাছে বুঝিয়ে দিয়ে চলে আসতে বলা হয়। | গুলি, সংঘর্ষ, রক্তপাত ও মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে সংবাদপত্রে দেওয়া এক বিবৃতিতে শেখ মুজিবুর রহমান নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলিবর্ষণের তীব্র নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে সংঘাতের পথ পরিহারের আহ্বান জানান। তার মতে নিরস্ত্র জনতাকে গুলি করে মারা গণহত্যার শামিল এবং তা মানবিকতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসাবে গণ্য হওয়া উচিত। পরিস্থিতির বিচারে তিনি অবিলম্বে সামরিক শাসন তুলে নেওয়ার দাবি জানান। সেই সঙ্গে অসহযােগ আন্দোলন ও হরতাল সচল রাখার কথাও ঘােষণা করেন এবং ৭ মার্চ জনসভায় নতুন কর্মসূচি ঘােষণার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন (দ্য পিপল, ৩ মার্চ, ১৯৭১)।
জননেতা অবশ্য আইন অমান্য আন্দোলনের বিস্তারিত নির্দেশ জারি করে সব কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে ও শৃঙ্খলার সঙ্গে পালনের আহ্বানও জানালেন। একই দিনে করাচিতে পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো পূর্ব-পাকিস্তানে সংঘটিত ঘটনাবলীর ওপর তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন : “এটা দুঃখজনক যে অধিবেশন স্থগিত রাখার মতাে গুরুত্বপূর্ণ ঘােষণার প্রতিক্রিয়া আওয়ামী লীগ অসঙ্গত মাত্রায় দেখিয়েছে। তবু এখনও সব কিছু শেষ হয়ে যায় নি। পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেলে সব পার্টির ঐকমত্যের ভিত্তিতে এখনও শাসনতন্ত্র রচনা সম্ভব। পিপিপি শক্তিশালী কেন্দ্র চায় নি, চেয়েছে ফেডারেল কেন্দ্র ও রাষ্ট্র যাতে দেশের সংহতি বজায় তাকে (দ্য পাকিস্তান টাইমস, ৩ মার্চ, ১৯৭১)। (“It is most unfortunate that a necessary postponement of the National Assembly session should have incited a disproportionate reaction in the East Pakistan Awami League. Surely nothing is lost if the promise of United Pakistan is accepted, by the delay of a few days to enable the major parties of the whole of Pakistan to come to an agreement upon the nature of constitution. …we did not demand a strong centre, but only a Federal Centre that would have the character of keeping the country United.” The Pakistan Times, Lahore, March 3, 1971)। ভুট্টোর এ বক্তব্যেও দেখা যায় তার কথার মারপ্যাচ, অতীৰ চাতুর্য। তার কথায় বারবার এসেছে অখণ্ড পাকিস্তানের কথা এবং এমন সুস্পষ্ট ইঙ্গিত যে আওয়ামী লীগ পাকিস্তান ভাঙতে এক পায়ে খাড়া। অথচ এ অভিযােগ গৃহযুদ্ধের পূর্বে যে সত্য ছিল না, ছিল ভুট্টোর আরােপিত তা পূর্ববর্তী আলােচনায় যথেষ্ট স্পষ্ট।
ভূট্টোর স্ববিরােধী বিবৃতি পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক মহলে কোনাে দাগ কাটে নি। যাচ্ছে দেখে জেনারেল ইয়াকুব পিন্ডির সামরিক কর্তাদের আবারও অনুরােধ জানালেন যাতে ঢাকায় আর সৈন্য পাঠানাে না হয় এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যাতে অবিলম্বে ঢাকায় এসে অবস্থার হাল ধরেন অর্থাৎ আলােচনা শুরু করেন। হতে পারে জেনারেল ইয়াকুবের বারবার অনুরােধে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া একবার রাজিও হলেন ঢাকায় আসতে। পরে আবার মত বদলে ৫ মার্চ জেনারেল ইয়াকুবকে জানিয়ে দিলেন : ‘না, ঢাকায় যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়।’ ক্ষুব্ধ, বিরক্ত ইয়াকুব তার বর্তমান দায়িত্ব থেকে ইস্তফা দিয়ে আনুষ্ঠানিক বার্তা পাঠিয়ে দিলেন। আর মধ্যরাতে পাঠিয়ে দিলেন মেয়র জেনারেল রাও ফরমান আলীকে পিন্ডিতে। কিন্তু মজাটা হলাে, পদত্যাগ বার্তা বা ফরমান পেীছাবার আগেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পাঞ্জাবের সামরিক আইন প্রশাসক লে,জে, টিক্কা খানকে জেনারেল ইয়াকুবের আসনে বসানাের সিদ্ধান্ত নেন (সিদ্দিক সালিক)। এক্ষেত্রে উদ্দেশ্যটা খুবই স্পষ্ট। টিক্কা জঙ্গি জেনারেলদের একজন। তার হাত দিয়ে বাঙালিদের শায়েস্তা করাই ছিল ইয়াহিয়া খানের উদ্দেশ্য। হয়তাে এ কাজে ইয়াকুবের ওপর তিনি পুরােপুরি নির্ভর করতে পারেন নি। মার্চ মাস ঢাকায় গাছে গাছে কৃষ্ণচূড়ার লাল রঙ, আর রাজপথে প্রতিবাদের জঙ্গি পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিদিন রক্তঝরার লাল রঙ। মৃতের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। বাঙালি জনতার চোখে ও শহীদ। সামরিক প্রশাসন কেন্দ্রের হুকুম মেনে চলছে, চেষ্টা চালাচ্ছে অবস্থা আয়ত্তে আনতে। সরকারি হিসাবে ৩ মার্চ একদিনেই আহতের সংখ্যা ১৫৫, নিহতের সঠিক হিসাব মিলছে না। এ অবস্থায় ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে জনসভায় আওয়ামী লীগ প্রধান সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে শাসনক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে সামরিক সরকারের প্রতি আহ্বান জানান আর জনসাধারণকে শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে, শৃঙ্খলার সঙ্গে হরতাল পালনের অনুরােধ করেন। করেন তাদের দিক থেকে সদিচ্ছার অভাব দেখিয়ে (ডন, করাচি, ৪,৩,৭১)। ইতােমধ্যে পিডিপি-প্রধান নুরুল আমিনও গােল টেবিল বৈঠকের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য প্রেসিডেন্টকে অনুরােধ জানান (দ্য টাইমস, ৫.৩.৭১)। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানি সংখ্যালঘু নেতাদের কণ্ঠে ভুট্টো-বিরােধী। সুর স্পষ্ট হয়ে ওঠে। লাহােরে ৩ মার্চ পাঞ্জাবি পাকিস্তানি হন্ট সামরিক আইন প্রত্যাহার করে গণতন্ত্রের খাতিরে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানায়।
ভুট্টোর রাজনীতিকে দায়িত্বজ্ঞানহীন, উচ্চাভিলাষী ও মারাত্মক বলে বর্ণনা করা হয়। (ডন, রাচি, ৪,৩,৭১)। করাচিতে প্রাক্তন এয়ারমার্শাল আসগর খানও এক সাংবাদিক সম্মেলনে দেশের বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে অবিলম্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানান। তিনিও ভুট্টোর ভূমিকার সমালােচনা এবং আইয়ুবী ধরনের গােল টেবিল বৈঠক আহ্বান অর্থহীন বলে অভিমত প্রকাশ করেন (ডন, করাচি, ৫.৩.৭১)। এছাড়াও জামিয়াতুল উলেমা-ই-ইসলামের সেক্রেটারি মওলানা হাজারভি, বালুচিস্তানে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ওয়ালি গ্রুপ) একই অভিমত প্রকাশ করে। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানে সর্বস্তরে জনমত ও স্থানীয় শাসন শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে সংঘবদ্ধ হতে থাকে (ডন, করচি, ৫,৩,৭১)। (“The organising Committee of the Punjab Pakistan Front…recorded its deep concern and sense of dismay at the ‘unfortunate decision’ to postpone indefinitely the first session of the National Assembly which had been called at Dacca this month. The committee was of the opinion that the decision was ‘completely unwarranted, uncalled for and unjustifiable.” The Dawn, Karachi, March 4, 1971)। (“Air marshal (Rtd.) Asghar Khan advocated immediate transfer of power to the majority party in the country in order to retrieve the present close-todisaster situation.”…”Maulana Ghulam Ghaus Hazarvi endorsed the decision of Sheikh Mujibur Rahman not to attend the proposed conference (RTC) and criticised Mr. Bhutto of talking in the language of ultimatum. Meeting of Baluchistan Provincial National Awami Party (Wali Group) termed indefinite postponement of national Assembly session at Dacca on March 3 as ‘deplorable and undemocratic.” The Dawn, March 5, 1971) এ কয়েক দিন স্থানিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরে, প্রতিবেদনে, সম্পাদকীয় বক্তব্যে পরিস্থিতির উত্তাপ ছিল উপলব্ধি করার মতাে। পারিপার্শ্বিক বাস্তবতায় তখন আগুন-জ্বালা ব্রত। জনসাধারণের মধ্যে রাজনৈতিক মতভেদ তখন অনেকটাই বাঙালিয়ানার টানে উড়ে গেছে। এ কটা দিন যদি কেউ নিছক ঘটনার অভিনবত্বের টানে পথে বেরিয়ে থাকেন তারও চোখে পড়বে জনচেতনায় রাজনৈতিক উত্তাপ, নাড়িতে স্বাধিকার-উত্তেজনার স্পন্দন।
মানুষ যেন ঠাণ্ডা মাথায় স্থির বুদ্ধিতে বিষয়টা হিসাবনিকাশ করে দেখতে ভুলে গিয়েছিল। কেবল উত্তেজনা আর উত্তাপে তরল তার চৈতন্য, এক মায়াবী ঘােরে আচ্ছন্ন। রাজপথে, সমাবেশে, মিছিলে বা সভায় তখন স্লোগান উঠতে শুরু করেছে ছয় দফা নয়, এবার এক দফা।’ স্বতঃস্ফূর্ত স্লোগান। এক শ্লোগানের উদ্দীপনায় আওয়ামী লীগের ৬-দফা, ছাত্রদের ১১-দফা ক্রমে পিছে হটতে শুরু করেছে। যেমন ছাত্রসমাজ তেমনি জনসাধারণ, বিশেষভাবে জনসাধারণই এ স্লোগানের জন্মদাতা। ছাত্রদের একাংশে। এ স্লোগানের ভিত্তিতে জনগণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্রে পৌছানাের দাবিও উঠছে। কিন্তু এক দফা বর্জন করে নয়। এদিক থেকে মওলানা ভাসানী তাে এক পায়ে খাড়া। সঙ্কট দেখা দেবার আগেই ভাসানীর উক্তি : তােমার পথ তােমার, আমার পথ আমার’। অর্থাৎ পূর্ব ও পশ্চিমের আর এক পথে চলার মতাে অবস্থা নেই। মওলানা ভাসানীর এ প্রবণতা লক্ষ্য করে ইত্তেফাকে সম্পাদকীয় শিরােনাম : ‘ভাঙায় কোন বাহাদুরী নাই’। ইত্তেফাকের মালিক-সম্পাদক প্রয়াত মানিক মিয়ার ‘অখও পাকিস্তান কাঠামােয় স্বায়ত্তশাসনের মূলনীতি অনুসরণ করে এ সম্পাদকীয় স্তম্ভে মওলানা ভাসানীর বিরুদ্ধে মন্তব্য করা হয় : “এক কথায় পাকিস্তানকে ভাঙিয়া টুকরা-টুকরা করার জন্য এই জীবন-সায়াহ্নেও মওলানা সাহেবের চেষ্টার ত্রুটি নাই” (৩.২.৭১)। বাস্তবিকই আওয়ামী লীগের মূল নেতৃত্ব ভাঙন নয় তখনাে সংহতির পক্ষেই, যদিও ভুট্টো সাহেবের বিবৃতিতে ভাঙনের অভিযােগ স্পষ্ট। কিন্তু সে অভিযােগের বাস্তব ভিত্তি ছিল না। এবার দেখে নেওয়া যেতে পারে ঢাকার সংবাদভুবনে তখনকার উত্তেজনাপূর্ণ বিস্ফোরক দিনগুলাের ছবি কিভাবে আঁকা হয়েছিল, ঘটনা কিভাবে প্রতিবেদন, সম্পদকীয় বা মন্তব্যে পরিস্ফুট হয়েছিল। ঢাকা থেকে প্রকাশিত পাকিস্তান প্রেস ট্রাস্টের বাংলা পত্রিকা দৈনিক পকিস্তান’-এর (বলা চলে প্রায়-সরকারি পত্রিকা) খবরে ও প্রতিবেদনে (২,৩,৭১) দেখা যায়, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার ঘােষণা শােনার সঙ্গে সঙ্গে অফিস-আদালত থেকে ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ মানুষ পথে বেরিয়ে আসে। অবিশ্বাস্য দ্রুততায় মানুষ নানাদিক থেকে ছুটে আসে প্রতিবাদ জানানাের উদ্দেশ্যে। তারা যেমন জমায়েত হয় পথে পথে তেমনি পল্টন ময়দানে অনির্ধারিত সভায় । আবার এদের অংশবিশেষ হােটেল পূর্বাণীর সামনে সমবেত হয় তাদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটাতে। ঐ হােটেলে তখন আওয়ামী লীগ সাংসদদের জরুরি বৈঠক চলছিল। জনতার উদ্দেশ্য ছিল নেতাকে তাদের মনােভাব জানানাে।
এ দৃশ্য যেমন অভাবিত তেমনি স্বতঃস্ফূর্ত, না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। পল্টন ময়দানের অনির্ধারিত জনসভায় ছাত্র নেতাদের উপস্থিতিতে পরদিনের কর্মসূচি ঘােষণা করা হয়, বিশেষ করে সভা-সমাবেশের ঘােষণা, যেমন পরদিন ২ মার্চ বটতলায় প্রতিবাদ সভা, বেলা সাড়ে তিনটায় পল্টন ময়দানে ওয়ালি ন্যাপের জনসভা ইত্যাদি। ঐ দিনের জনসভার রায় ছিল : ‘এ লড়াই যে কোনাে ত্যাগ স্বীকারের মাধ্যমে চালিয়ে যাবাে।’ ঐ পত্রিকার খবরে প্রকাশ : ‘বিক্ষোভ মিছিলে’ (বড় বড় হরফে ছাপা) শুধু যে চাকরিজীবী বা কর্মজীবী সাধারণ মানুষ সমবেত হন তাই নয়, ছাত্রসহ সর্বশ্রেণীর মানুষ তাতে যােগ দেন। এসব বিক্ষোভ মিছিলের বৈশিষ্ট্য ছিল রাজনৈতিক দলমত-নির্বিশেষে সবার উপস্থিতি। ঢাকা হাইকোর্ট বারের সদস্যগণও প্রতিবাদ জানাতে রাজপথে নেমে আসেন। মুসলিম লীগপন্থী শাহ আজিজুর রহমান থেকে ভিন্নমতের শওকত আলী বা জুলমত আলী, মওদুদ আহমদ ও ইশতিয়াক আহমদ প্রমুখ ব্যারিস্টার, অ্যাডভােকেট মিছিলে যােগ দেন। তাদের প্রতিবাদ মিছিল নগরীর প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে। ঢাকা তাৎক্ষণিকভাবেই “মিছিলের নগরে পরিণত হয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ঢাকায় এবং দেশের অন্যত্র প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড় বইতে থাকে। দৈনিক পাকিস্তান-এর প্রতিবেদকের ভাষাও ছিল আবেগে সিক্ত। তার ভাষ্যমতে “বিক্ষুব্ধ জনতা বাঁধভাঙা জলরাশির ন্যায় চারিদিক হতে স্লোগান দিতে দিতে শহরের প্রধান সড়কগুলাে প্রদক্ষিণ করতে থাকে। দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে যায়। বাস চলাচল বন্ধ হয়। বাসের যাত্রীরা নেমে মিছিলে শরিক হয়। রাস্তার মােড়ে মোড়ে মানুষের জটলা কিছুক্ষণের মধ্যে জঙ্গি মিছিলে পরিণত হয়। ক্রুদ্ধ জনতা এক পর্যায়ে কতিপয় দোকান ও একটি প্রেক্ষাগৃহের একাংশে আগুন ধরিয়ে দেবার চেষ্টা করে। কিন্তু জনতার অন্য অংশ তখন চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি আয়ত্তে আনে।” আমাদের অভিজ্ঞতাও বলে, এ বিবরণে অতিরঞ্জন ছিল না। তার চেয়েও তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলাে এসব বিক্ষোভ, প্রতিবাদ মিছিল সবই শুরুতে ছিল স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভের ও ক্রোধের প্রকাশ।
“বিক্ষুব্ধ ছাত্রসমাজ”-এর প্রতিক্রিয়া ছিল আরাে জঙ্গি। সােমবার বেলা ১টায় ঘােষণা শােনার পর ছাত্ররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মিছিল ও সমাবেশের আয়ােজন করে। ছাত্রলীগ তাে বটেই, চীনপন্থী বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন, পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (‘এপসু’) বাংলা ছাত্রলীগ, ছাত্রশক্তি (তমদুন মজলিসের ছাত্র সংগঠন), মুসলিম ছাত্রী সঙ্ প্রভৃতি ছাত্র সংগঠন প্রতিবাদ, নিন্দা ও মিছিলে অংশ নেয়। এমন কি আশ্চর্যের হলেও সত্য যে নিখিল পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের (জামাতি ইসলামের ছাত্রসংগঠন) সভাপতি মতিউর রহমান নিজামীও সংসদ অধিবেশন মুলতুবি ঘােষণার তীব্র নিন্দা করেন। বাদ যায় না জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়া’র মতাে মাদ্রাসাপন্থী ছাত্র সংগঠন। আওয়ামী লীগের বাইরেও “পূর্ববাংলার নেতৃবৃন্দের তীব্র প্রতিবাদ” আলােচনার বিষয় হয়ে ওঠে। মওলানা ভাসানী, অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ থেকে পাকিস্তানপন্থী নুরুল আমীন (পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক পার্টির প্রধান) প্রমুখ বিভিন্ন মতাদর্শের রাজনৈতিক নেতা সবাই প্রতিবাদে অংশ নেন; কেউ জঙ্গি কেউ নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাইউম) প্রধান আবদুল কাইউম স্থান অধিবেশন স্থগিত করার ঘােষণা স্বাগত জানানাের প্রতিবাদে ঐ পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল সবুর খান দলের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে বিবৃতি দেন। আরাে বিস্ময়কর যে জামায়াতে ইসলামের নেতা গােলাম আযম ‘অধিবেশন স্থগিত ঘােষণা অযৌক্তিক’ বলে মতামত প্রকাশ করেন। দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকদের উল্লিখিত ভূমিকা অবিশ্বাস্য মনে হলেও তা ছিল বস্তুত ব্যাপক গণপ্রতিবাদের প্রতিফলন। দেশব্যাপী স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের মুখে এরা বিপরীত ভূমিকা নিতে সাহস পান নি। জনরােষের শিকার হতে চান নি। প্রমাণ, ২৫ মার্চের পর অবস্থার পরিবর্তন এবং কড়া সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এরা ঠিকই রাজনৈতিক ডিগবাজিতে বিপরীত ভূমিকা গ্রহণ করেন। সমর্থন করেন সামরিক শাসন, পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার অজুহাতে। সমর্থনই নয় সহযােগিতায় এগিয়ে আসেন সামরিক বর্বরতার তৎপরতায়। নরহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযােগ বা লুটপাটের মতাে সব অপকর্মেই এদের। অনেকে অংশ নেয়। এসব পরের ঘটনা।
পরদিনের কাগজে (দৈনিক পাকিস্তান) মােটা মােটা শিরােনামে ঝলসে ওঠে কাব্যিক শব্দমালা ‘বিক্ষুব্ধ এই বাংলায়’। সেই সঙ্গে সংগ্রামী চেতনার রােমান্টিক পক্তি : “কলকারখানায় বাজছে না বাশী। মানুষ নেই অফিস-আদালতে। অগ্নিগর্ভ দেশ আজ পথে নেমেছে। পাশাপাশি খবর : স্বাধিকার আন্দোলনে প্রাণ দিয়েছে মানুষ রংপুর, খুলনা, চট্টগ্রাম, ঢাকায় ।… চট্টগ্রামে ১২০ জন নিহত । খুলনায় ৭ জন নিহত। ঢাকায় বেসামরিক শাসন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। …রংপুরে জারি হয়েছে সান্ধ্য আইন।’
দৈনিক পাকিস্তানে একই দিনের সম্পাদকীয় কলামের শিরােনাম ‘জরুরি সমাধান চাই।’ পত্রিকার মতে ‘গােলটেবিল বৈঠক নয়, অবিলম্বে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানই সঙ্কট মােচনের উপায়।’ খবরে প্রকাশ কাউন্সিল লীগনেতা প্রাক্তন এয়ার মার্শাল নুর খান বলেছেন, “গােলটেবিল বৈঠক নয়, এই মুহুর্তের দাবি জাতীয় পরিষদের সভা ডাকতে হবে” (লাহাের, ৩ মার্চ/এপিপি, পিপিআই)’। অন্যদিকে প্রেসিডেন্টের কাছে মওলানা ভাসানীর তারবার্তা’ । তারবার্তায় ভাসানী অধিবেশন স্থগিত করার প্রতিবাদ জানিয়ে অবিলম্বে প্রেসিডেন্টকে ঢাকায় আসার আহ্বান জানিয়েছেন। এছাড়া স্থানীয় পত্রপত্রিকায় পাঠানাে বিবৃতিতে ভাসানী সামরিক সরকারকে অবিলম্বে ৭ কোটি বাঙালির দাবি ঐতিহাসিক লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে মেনে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এই দিনের বহু ঘটনার একটি স্বাধিকার আন্দোলনে শহীদ আবুজর গিফারি কলেজের ছাত্রনেতা ফারুক ইকবালের সমাধিস্থলে জঙ্গি স্মরণ সভা’। (মৌচাক মার্কেটের ঠিক উত্তরে রাস্তার মােড়ে বড় অবহেলায় বিস্মৃতিতে ধূলি-ধূসর হয়ে আছে ফারুকের রক্ত ভেজা স্থানটি)। সব মিলিয়ে ছবিটা খুবই স্বচ্ছ, খুবই স্পষ্ট। যেমন স্বতঃস্ফূর্ত তেমনি জঙ্গিপনায় রক্তাক্ত । জনপত্রিকা “ইত্তেফাক’-এও এ ছবি ভিন্ন নয়, আবেগের টানে বলিষ্ঠ হয়েও কাব্যিক। প্রেসিডেন্টের ঘােষণার প্রতিক্রিয়া হিসাবে লেখা সম্পাদকীয় (২,৩,৭১) ‘জাতির জীবনে বিষাদের ছায়া দিয়ে ইত্তেফাকের মার্চ-পরিক্রমা শুরু হলেও পরদিনের কাগজে বিশাল আকার হরফে শিরােনাম “বিক্ষুব্ধ নগরীর ভয়াল গন”। স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ মিছিল ও সমাবেশ-সভার বিশদ বিবরণ শেষে জাতীয় নেতার নির্দেশ পরিবেশিত ; “সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল পালন এবং রাতে লুঠতরাজ ও অগ্নিসংযােগের মত অপ্রীতিকর ঘটনা যাহাতে না ঘটে তৎপ্রতি কড়া নজর রাখার জন্য আমি জনগণের প্রতি আহ্বান জানাইতেছি।” অন্যত্র “বাংলার মাটিতে যেন স্থানীয়-অস্থানীয় ৰা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা না হয়।” তা সত্ত্বেও দীর্ঘদিন লালিত ক্ষোভ অনাচারী প্রকাশের পথ ঠিকই খুঁজে নিয়েছিল। একাধিক অবাঙালি পরিবারের ওপর আক্রমণ বন্ধ করা যায় নি। অন্যদিকে ক্রুদ্ধ জনতার সঙ্গে সেনা-জওয়ানদের সংঘর্ষে অনেক প্রাণ নষ্ট হয়েছে, প্রধানত তরুণদের ছাত্রঅছাত্রদের। ইত্তেফাক-এ (৪,৩,৭১) স্বাধিকার আন্দোলনে নিহতদের এক সারি ছবি ছাপা হয় প্রথম পৃষ্ঠার শীর্ষে, আর সময়ােপযােগী সম্পাদকীয় নিবন্ধ ‘ক্ষান্ত হউন। বক্তব্য ইত্তেফাকের নিজস্ব ঢং-এ শীতল যুক্তি ও আবেগের সমন্বয়ে পরিবেশিত । অন্যদিকে সুস্পষ্ট অক্ষরে নেতার নির্দেশ মুদ্রিত : ক্ষমতা হস্তান্তর না করা পর্যন্ত কর-খাজনা বন্ধ।”
পরদিনের কাগজেও শান্তিপূর্ণ অসহযােগ আন্দোলন তথা আইন অমান্য আন্দোলনের বিশদ বিবরণ প্রকাশ পেয়েছে। সেই সঙ্গে সংঘর্ষ, মৃত্যু, রাজনৈতিক নেতাদের বিবৃতি আর পূর্ব-পশ্চিমের প্রতিক্রিয়া। পূর্ব-পাকিস্তানি রাজনীতিক নুরুল আমীনের সুস্পষ্ট বিবৃতি ‘গােলটেবিলে নয়, জাতীয় পরিষদেই আলােচনা দরকার।’ আর প্রথম পৃষ্ঠায় বড় বড় হরফের শিরােনামে বাঙালিয়ানার আবেগ প্রতিফলিত ; “জয় বাংলার জয়।” | জনতা-সেনাবাহিনী সংঘর্ষ তখনাে চলছে। টঙ্গীতে শ্রমিক ও পরে জনতার সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে কমপক্ষে ১৮ জন হতাহত। চট্টগ্রামে নিহতের সংখ্যা ২২২ জন। যশােরে একজন নিহত।’ বিস্ফোরক ঐ পরিস্থিতিতে “লেখক শিল্পী সাহিত্যিকদের শপথ গ্রহণ। স্বাধিকার আন্দোলনের পক্ষে। এর আগে সাংবাদিকদেরও ঐ একই ঘােষণা। পথে পথে জনতার লাঠি মিছিল। পরিস্থিতির প্রতিফলন ঘটিয়ে সম্পাদকীয় লেখা হলাে ‘তুলি। কলম কাস্তে কোদাল এক হও’ (দৈনিক পাকিস্তান, ৬,৩,৭১)। বাস্তবিকই অবস্থা হয়ে ওঠে অনেকটাই গণজাগরণের মতাে যা গণঅভ্যুত্থানের পথ ধরতে ইচ্ছুক। | ইতােমধ্যে ইয়াহিয়া-ভুট্টো সাক্ষাৎকার’ (পিন্ডি, ৫ মার্চ/এপিপি), বলা যেতে পারে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক সংলাপ, বােঝাপড়া। করাচিতে বালুচ নেতা গউস বক্স বেজেঞ্জে ভুঠোর একমুখী জেদি ভূমিকার নিন্দা করেন প্রকাশ্য বিবৃতিতে। এর মধ্যে ভুট্টোর নিন্দা করেছেন একাধিক ভিন্ন স্রোতের নেতা। তা সত্ত্বেও ভুট্টো ও উগ্রপন্থী সমরনায়কদের পরামর্শই ইয়াহিয়া খানের কাছে গ্রহণযােগ্য মনে হয়েছে। আর সেজন্যই স্বাধিকার আন্দোলন, অহিংস আইন অমান্য আন্দোলন দমন করতে জঙ্গি ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্তই নেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া। ইয়াকুব খানের স্থলে জঙ্গি জেনারেল টিক্কা খানকে নিয়ােগের সিদ্ধান্তও নেন একই কারণে। মেজর সিদ্দিক সালিকের বিবরণেও তা স্পষ্ট। জেনারেল ইয়াকুবের দূত হিসাবে পাঠানাে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী পিন্ডিতে প্রেসিডেন্টকে পূর্ব-পাকিস্তানের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে অবস্থা অনুকূলে নিয়ে আসার পক্ষে আশু সিদ্ধান্ত গ্রহণের আবেদন জানালে ইয়াহিয়ার জবাব ছিল খুবই স্পষ্ট : বাপুহে, পশ্চিম পাকিস্তানই আমার ভিৎ। আমি কোনাে কারণেই এ ভিৎ নষ্ট করতে পারি না।’ অর্থাৎ সাত তারিখে রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় শেখ সাহেবের ভাষণের আগেই ইয়াহিয়া ও তার জেনারেলগণ পূর্ব-পাকিস্তান সম্পর্কে শেষ সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছেন। কাজেই এরপর স্বাধীনতা ঘােষণা না করার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে পাঠানাে ইয়াহিয়ার বার্তা বা পরদিন তার ভাষণে ২৫ মার্চ নতুন করে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের সিদ্ধান্ত ঘােষণা সময় নেবার চতুর কৌশল ছাড়া কিছু নয়।
আসলে জেনারেল ইয়াহিয়ার নিরীহ কথাবার্তা, নির্বাচন-পূর্ব পর্যায়ে তার ভূমিকা কিংবা তার মুখের মেদস্নিগ্ধ অভিব্যক্তির কারণেও হয়তােবা বিদেশী বিশ্লেষকদের কেউ কেউ যেমন তাকে ঠিকমত বুঝতে পারেন নি, ধরতে পারেন নি তার গভীর চতুর খেলা, তেমনি বাঙালি রাজনীতিকদেরও অনেকে সম্ভবত টেনশনবিদ্ধ সমস্যার চাপে তার চাতুর্যের গভীরতা নির্ধারণ করতে পারেন নি। তাকে বুঝতে পারেন নি বাঙালি সাংবাদিকদেরও অনেকেই। হয়তাে এসব কারণেই বিদেশী সাংবাদিক পিটার হ্যাজেলহার্ট ‘দ্য টাইমস’ পত্রিকায় (৬.৩.৭১) প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সম্পর্কে এমন মসৃণ মতামত প্রকাশ করতে পেরেছেন যে ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক গােলযােগ সম্পর্কে অ্যাডমিরাল আহসানের সঠিক মূল্যায়ন ও সুপরামর্শ না শুনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যে ভুল করেছিলেন ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বিষয়ক নতুন তারিখ ঘােষণার মধ্য দিয়ে তিনি তা শুধরে নিয়েছেন।’ | সাংবাদিক প্রবরের এ মূল্যায়ন সঠিক ছিল না। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার হিসাবটা তিনি ধরতে পারেন নি, হয়তাে ভেতরের কিছু ঘটনা জানা না-থাকার কারণে। তবে এ বিষয়ে তার অবশেষ বিশ্লেষণ ঠিকই ছিল। তাই নির্দ্বিধায় লিখতে পেরেছেন : “মি, ভুট্টো, শক্তিমান পাঞ্জাবি ‘লবি’ এবং সামরিক নেতাদের কাছে গ্রহণযােগ্য নয় এমন খসড়া সংবিধান অনুমােদন করার সাধ্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নেই। সেক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলনেতার পক্ষে এমন ঘােষণার কোনাে বিকল্প নেই যে পশ্চিমাঞ্চলই গােটা পাকিস্তান থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছে এবং পূর্ব ও পশ্চিমের বিভাজন নিশ্চিত করে দিয়েছে।’ | পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রের খেলা সম্পর্কে অবহিত থাকা এবং সে সম্পর্কে কথাবার্তা বলার পরও রাজনৈতিক নেতাদের অনেকে ষড়যন্ত্রের গভীরতা অনুমান করতে পারেন নি, অথবা সে সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারেন নি। অবশ্য সন্দেহবাদীদের কেউ কেউ ঠিকই ভেবেছেন যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার হাত দিয়ে বর্তমান অবস্থায় কোনাে ন্যায্য সমাধানের সূত্র বেরিয়ে আসবে না। বলেছেন যেমন কোনাে কোনাে ছাত্রনেতা, তেমনি মওলানা ভাসানী বা মােজাফফর আহমদ। দু-একটি স্থানীয় দৈনিকেও মাঝেমধ্যে বিচক্ষণ মন্তব্য বা বিচার-ব্যাখ্যা প্রকাশ পেয়েছে, আশঙ্কা প্রকাশ করে সম্পাদকীয় লেখা হয়েছে। যেমন দৈনিক সংবাদ-এর সম্পাদকীয় নিবন্ধ আর বিলম্ব নয়’ (৬,৩.৭১) যেখানে স্পষ্টই বলা হয় : ‘সময় দ্রুত চলিয়া যাইতেছে।’ অর্থাৎ অতিদ্রুত সমস্যার ন্যায্য সমাধান চাই।
তিনদিন আগে দৈনিক পাকিস্তান-এর সম্পাদকীয় নিবন্ধে একই সুরে বলা হয়েছিল : অবিলম্বে জননেতাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরই সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায়।’ অন্যদিকে নতুন করে সংসদ অধিবেশন আহ্বান সম্পর্কে ওয়ালি ন্যাপ প্রধান মােজাফফর আহমদের বক্তব্য ছিল বাস্তব বােধের পরিচায়ক। তার মতে এ সব ঘােষণা “কোনাে উপকারে আসিবে না।” লক্ষ্য করার বিষয় যে পশ্চিম পাকিস্তানের ভুট্টো-বিরােধী নেতৃবৃন্দ যেমন ওয়ালি খান, গউস বঙ্গ বেজেগো, সি,আর, আসলাম, আসগর খান, এমন কি মুফতি মাহমুদের মতাে অনেকে স্পষ্টভাষায় বলেছেন, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর বা শেখ মুজিবুর রহমানের দাবি মেনে নেওয়াই বর্তমান রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায়।’ কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তাদের কথায় কোনাে গুরুত্ব দেন নি। সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ভুয়ো এবং পর্দার আড়ালে দাঁড়ানাে তার সামরিক সতীর্থদের পরামর্শ অনুযায়ী। স্বভাবতই সে সিদ্ধান্ত একদেশদর্শী হয়েছে, সমরশক্তির সাহায্যে সঙ্কট নিরসনের চেষ্টাই তাদের কাছে সঠিক মনে হয়েছে। আর এটাও ঠিক যে পূর্ব-পাকিস্তানের সংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দ পাকিস্তান কাঠামােয় সমাধান খুঁজে পাওয়ার চেষ্টায় অবস্থার স্বরূপ বুঝেও অবস্থার মােকাবেলায় যতটা সম্ভব পালটা প্রস্তুতি গ্রহণের ওপর গুরুত্ব আরােপ করেন নি। আঘাতের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত বুঝে নাবুঝে সংলাপ চালিয়ে গেছেন। রেসকোর্স ময়দানের ভাষণে মুক্তির সংগ্রাম ও স্বাধীনতার সংগ্রামের’ ঘােষণা দিয়েও সেই সংগ্রামের সাংগঠনিক দিকে নজর দেন নি। এমন কি “গ্রামেগঞ্জে সর্বদলীয় সগ্রাম কমিটি গঠনের (সংবাদ, ১১.৩.৭১) মতাে একটি গুরুত্বপূর্ণ। প্রস্তাব বাস্তবায়নের চেষ্টা কেউ করেন নি। তাতে যে শেষরক্ষা হতাে তা নয় তবে ভবিষ্যৎ সংঘাত মােকাবেলার কাজ কিছুটা সুশৃঙ্খল ও সুবিধাজনক পথ ধরতে পারতাে। হঠাৎ আঘাতের ধাক্কায় বিশাল অবস্থার মধ্যে পড়তে হতাে না, কয়েক মাস সময় নষ্ট হতাে না ঘর গুছিয়ে নিতে এবং নিজদের সুবিন্যস্ত ও সুশৃঙ্খল করে তুলতে। এ পর্যায়ে অর্থাৎ ১ মার্চ অধিবেশন মুলতবি ঘােষণার কারণে সৃষ্ট সমস্যা-সংকট থেকে ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বাঙালি জনতার ওপর পাক সেনাবাহিনীর আক্রমণের পূর্ব পর্যন্ত স্থানীয় দৈনিকগুলাের সংবাদ-পরিবেশন এবং সম্পাদকীয় নিবন্ধের বিচারবিশ্লেষণের চরিত্র ছিল মিশ্র। এতে যেমন বাঙালিয়ানার রােমান্টিক আবেগ প্রকাশ পেয়েছে তেমনি কোনাে কোনাে প্রতিবেদনে বা সম্পাদকীয় কলামে অবস্থার বাস্তব বিশ্লেষণ, এমন কি অবাঞ্ছিত আশঙ্কার আভাসও ফুটে উঠেছে। যেমন, ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ওপর গুরুত্ব আরােপ করে দৈনিক পাকিস্তান-এ ১০ মার্চ সংবাদ শিরােনাম : ‘মুজিব ভাসানী এক হবে। একই দিনে দৈনিক সংবাদ-এ বাস্তবধর্মী সম্পাদকীয় এই সঙ্কটময় মুহর্তে’। এতে শাসকশ্রেণীর প্রতি আহ্বান : “সঙ্কট নিরসনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যদি শেখ মুজিবের দাবিগুলি মানিয়া নেন তবেই তাহার গণতন্ত্রের প্রতি বিঘােষিত আস্থা বাস্তব রূপ লাভ করিবে এবং দেশ একটি সমূহ বিপর্যয় হইতে রক্ষা পাইবে।…এখনও বলিতেছি সময় অতিদ্রুত চলিয়া যাইতেছে।” | অন্যদিকে ৯ মার্চ (৭১) ইত্তেফাক ছবি ছেপেছে ‘অস্থানীয়দের ঢাকা ত্যাগের হিড়িক এই মর্মে, সেই সঙ্গে সম্পাদকীয় শিরােনাম এখনও সময় আছে। অবশ্য ‘২৬৫ জন বিদেশী নাগরিক ঢাকা হইতে অপসারিত’ শিরােনামে খবর ছাপার দিনই সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশ পেয়েছে আর সময় নাই’ (১৪ মার্চ, ৭১)।
বিষয়টা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল তাদের কাছে। তবু বাস্তবতার পাশ কাটিয়ে ২৩ মার্চ লেখা হয়েছে : ‘জানা গিয়াছে যে শেষ মুহূর্তে ব্যক্তিবিশেষের কারণে অতিনাটকীয় কিছু না ঘটিলে: “মুজিবের দাবি অনুযায়ী সামরিক আইন প্রত্যাহারের পরই নয়া সরকারের রূপরেখা নির্দিষ্ট হইবে।” আবার পরদিনই চিরাচরিত বাঙালি রােমান্টিসিজমের প্রকাশ ঘটিয়ে মােটা মােটা হরফের শিরােনামে লেখা হয়েছে : “আমরা শুনেছি ঐ, মাভৈঃ মাভৈঃ মাভৈঃ।” একই ধারায় দৈনিক পাকিস্তান-এ (২৪ মার্চ) এনা’ পরিবেশিত খবর উল্লেখ করে বলা হয় : “আজ অথবা আগামীকাল যে কোনাে সময় সামরিক শাসন প্রত্যাহার সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট ঘােষণা দিতে পারেন। তিন মাসের জন্য অন্তবর্তী সরকার কায়েম হবে। এসময় উভয় অংশের এম,এন,এ,গণ শাসনতান্ত্রিক ফর্মুলা উদ্ভাবনের জন্য প্রথমে আলাদা ভাবে, পরে একসাথে বৈঠকে বসবেন। শাসনতন্ত্র প্রণীত হওয়ার পর সরকার গঠন করা
হবে।…আইন বিশেষজ্ঞরা ইতােমধ্যে একটি দলিল প্রণয়ন করেছেন।” মনে হয় এ খবর সামরিক দফতর থেকেই উদ্দেশ্যমূলকভাবে সংবাদ মাধ্যমে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল যাতে আশাবাদী ঘােরের মধ্যে থাকা রাজনীতিক ও জনসাধারণের ওপর অপ্রস্তুত অবস্থায় হঠাৎ আঘাত হানা যায়। বাস্তবে তাই ঘটেছিল ২৫ মার্চ মধ্যরাতের আক্রমণে। আর সে আক্রমণের প্রস্তুতিও নেয়া হয়েছিল কয়েক মাস ধরে, সে হিসাবেই আক্রমণের নীল নকশা তৈরি করা হয়েছিল। অবশ্য দৈনিক সংবাদ ২১ মার্চ ‘অগ্রসর! সংগ্রামী জনগণ!’ শিরােনামে রােমান্টিক সম্পাদকীয় লিখেও ২৩ মার্চ ‘আত্মজিজ্ঞাসার দিন’ (সম্পাদকীয়) হিসাবে চিহ্নিত করে। ২৫ মার্চ ‘সগ্রামের ২৪ দিন গত হওয়ার হতাশাব্যঞ্জক খবর পরিবেশন করে। ঠিকই সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশ করে ‘অসহনীয় অনিশ্চয়তা’ শিরােনামে। শাসক পক্ষের ধীরগতি ও বিলম্বিত পদক্ষেপ তাদের চোখে শুভ সম্ভাবনা বলে মনে হয় নি। বরং মনে হয়েছিল। সন্দেহজনক। তা মনে হওয়ারই কথা। রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণের পর তাৎপর্যপূর্ণ। কয়েকটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সমঝােতার কথা ভাবাই ছিল অদূরদর্শিতার পরিচায়ক। পল্টন ময়দানে ৯ মার্চ মওলানা ভাসানীর উত্তপ্ত বক্তৃতা “ইয়াহিয়াকে বলি, অনেক হইয়াছে আর নয়, তিক্ততা বাড়াইয়া লাভ নাই। ‘লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালিয়া দ্বীন’-এর নিয়মে পূর্ববাংলার স্বাধীনতা স্বীকার করিয়া লও” কিংবা ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদের জরুরি সভায় ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ঘােষণার প্রস্তাব অনুমােদন’ (ইত্তেফাক, ১০,৩,৭১) এবং “কুর্মিটোলা মার্শাল-ল অফিস ছাড়া আর কোথাও পাকিস্তানি পতাকা উড়িতে দেখি নাই” আসগর খানের এবংবিধা মন্তব্য (ইত্তেফাক, ১২.৩,৭১); সর্বোপরি ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস উপলক্ষে সর্বত্র নয়া বাংলাদেশী পতাকা ওড়ানাের পরও কি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বাঙালিদের হাতে দেশের সংবিধান রচনা ও শাসন ভার তুলে দিতে পারেন? বিশেষ করে যখন ২৫ মার্চ সংসদ অধিবেশনের তারিখ নির্দিষ্ট করে দেবার সময় প্রেসিডেন্টের কণ্ঠে কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারিত : “যে কোনাে মূল্যে দেশের অখণ্ডতা রক্ষা করিব’; সেক্ষেত্রে ভাবালুতার কোনাে সুযােগ ছিল না। কিন্তু বাঙালি রাজনীতিক ও জনসাধারণ সাদাচোখে পরিস্থিতির মূল্যায়ন করতে পারেন নি। আবেগ ও ভাবালুতাই তখন তাদের সঙ্গী। তাই মাশুলটা দিতে হয়েছে বেশি। বিদেশী প্রেস যদিও অনেক ক্ষেত্রেই অবস্থার বাস্তব মূল্যায়ন করতে পেরেছে।
কিন্তু সেসব আমাদের যুক্তি ও দূরদর্শিতায় আঁচড় কাটতে পারে নি। বাস্তবিকই বিদেশী সংবাদভুবনে সমস্যা-সঙ্কটের খবর ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ছিল অনেক বেশি বাস্তব এবং ইঙ্গিতধর্মী। করাচি থেকে পিটার হ্যাজেলহার্স্ট টাইমস’ পত্রিকায় ৪ মার্চ এই মর্মে মন্তব্য করেন যে ‘অবিলম্বে পাকিস্তানের দ্রুত অবনতিশীল অবস্থা সামাল দেওয়া না হলে এশিয়াবাসী তথা বিশ্ববাসী এক অকল্পনীয় সঙ্কটের মুখােমুখি হবে’ (অর্থাৎ সঙ্কট প্রত্যক্ষ করবে)। প্রতি মুহূর্তে পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটছে এবং দেশটি এক সংঘাতময় বিচ্ছিন্নতার বিন্দুতে এসে দাঁড়িয়েছে। পূর্ব ও পশ্চিমের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী নেতাকে ঐকমত্যে পৌছানাের জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।’ (“Unless something is done quickly to defuse the rapidly deteriorating situation in Pakistan, Asia and the World will be faced with a problem of unimaginable dimensions. The relation between the eastern and western provinces are growing worse every hour, and the country is poised on the brink of a violent secession. …President Yahya Khan’s last-minute attempt to bring together the obdurate leaders of the Eastern and Western provinces has failed”. The Times, 5 March, 1971) | প্রতিবেদক আরাে বলেন : “পিপলস পার্টির প্রধান জনাব ভুট্টো সংসদ বর্জন করে এ সঙ্কট সৃষ্টি করেছেন। তবে তিনি প্রেসিডেন্টের আহূত গােলটেবিল বৈঠকে যােগ। দিতে রাজি, কিন্তু পূর্ব-পাকিস্তানি নেতা শেখ মুজিবুর এ ধরনের ছেলেখেলায় আগ্রহী নন। তিনি স্পষ্টই বলেছেন, ঢাকায় যখন সৈন্যসামন্ত অস্ত্রশস্ত্র জড়ো করা হচ্ছে তখন বন্দুকের মুখে এ গােলটেবিল বৈঠক অর্থহীন। তিনি সম্ভাব্য বিচ্ছিন্নতার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানকেই দায়ী করছেন। ভুট্টোকে উদ্দেশ্যকে করে তিনি বলেন: যদি যৌথ সংবিধান তার পছন্দ না হয় তাহলে যে-যার মতাে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করলেই হয়। (নেতার এই শেষ কথাটি ছিল পশ্চিমাদের হাতে আকাক্ষিত হাতিয়ার, অভিযােগের বস্তুসত্য এগিয়ে দেওয়া। এতে রাজনৈতিক বিচক্ষণতা-চাতুর্য প্রকাশ পায় নি)। ওদের সমরসজ্জার পাল্টা কোনাে ব্যবস্থার কথা জননেতা ভাবেন নি– এটাই আশ্চর্য। | এর মধ্যেই ঢাকায় সংগঠিত মিছিল শােভাযাত্রার প্রতিবাদ-বিষয়ক খবর এ #তিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে। পেয়েছে সাত ও মৃত্যুর খবর। বলা হয়েছে যে এ পরিস্থিতিতেও পশ্চিম-পাকিস্তানি নেতা তার নিজস্ব শর্তের বাইরে সংসদ অধিবেশনে যােগ দেবেন না বলে জানিয়েছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের ইচ্ছামতাে শাসনতন্ত্র প্রণয়নে তিনি রাজি নন। তার মতামত না নিয়ে সংসদ অধিবেশন ডাকা হলে তিনি দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করবেন বলে জানান।
পরদিনই অন্য একটি প্রতিবেদনে পিটার হ্যাজেলহাস্ট মন্তব্য করেন : “সন্দেহ নেই যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের তৎপরতা উগ্র পাঞ্জাবি শােভিনিস্টদের প্রভাবের ফল। তাদের পরামর্শেই প্রেসিডেন্ট সমঝােতার পথ এড়িয়ে যাচ্ছেন, পূর্ব-পাকিস্তানের জনপ্রিয় গভর্নর ভাইস অ্যাডমিরাল এস,এম, আহসানকে ঢাকা থেকে সরিয়ে এনেছেন এবং সামরিক চাপের মাধ্যমে পূর্ব-পাকিস্তানিদের জঙ্গি প্রতিবাদ থামিয়ে দিতে পারবেন বলে ভাবছেন। কিন্তু ঘটনা প্রমাণ করেছে যে উগ্রপন্থী জেনারেলদের নয়, সমঝােতাবাদী আহসানের মতামতই সঠিক ছিল। (“So it is clear why elements from the Punjabi-led Army are advising the President to take measures to frustrate the process of the Constituent Assembly. … The popular Governor of East Pakistan, Vice-Admiral S.M. Ahsan, who subsequently resigned, advised the President against his decision to postpone the Assembly earlier this week. But President Yahya acted on the advice of the hawks. The upsurge of trouble in Bengal has proved Admiral Ahsan to be right.” The Times, 6 March, 1971)। একদিনের ব্যবধানে হ্যাজেলহাস্টের বক্তব্যে ভিন্নসুর লক্ষ্য করার মতাে। হতে পারে নতুন কোনাে তথ্য এই ভিন্নতার কারণ। | ‘অবস্থাদৃষ্টে ইয়াহিয়া-প্রশাসনের কেউ কেউ ভাবতে শুরু করেন যে গায়ের জোরে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবল ঢেউ চাপা দেওয়া যাবে না। সে অবস্থায় প্রেসিডেন্টকে হয়তাে একপা পিছিয়ে সংসদ অধিবেশনের নতুন তারিখ ঘােষণা করতে হতে পারে। কিন্তু বর্তমান সঙ্কট সমাধানের বিষয় অনেকটাই মি, ভুট্টোর মতিগতির ওপর নির্ভর করছে। যদি তিনি আবারও অধিবেশনে যােগ দিতে অসম্মত হন তাহলে যে আঞ্চলিক সংঘাত দেখা দেবে তাতে পাঞ্জাব ভুয়োর পাশে থাকলেও সীমান্ত বালুচিস্তান ও অংশত সিন্ধু পূর্বপাকিস্তানের সঙ্গে থাকবে।
শেষােক্তরা মিলে চাই কি শাসনতন্ত্র তৈরি করে ফেলতে পারে।” পূর্বোক্ত প্রতিবেদনে আরাে বলা হয়েছে যে (“Military observers within Yahya Khan’s own Administration admit that it would be impossible to suppress the strong wave of Bengali nationalism…and the President has now had to back down and announce a new date for the Assembly session. …In the present crisis much depends on what Mr. Bhutto decides to do. If he refuses to accept the President’s new invitation to attend the Assembly session there could be serious regional conflict in Pakistan, with the Punjab alligned against a regional combination of East Pakistan and the minority provinces of West Pakistanthe North-West frontier, Baluchistan and the Sind-who could frame a constitution without the Punjabi’s consent.”–The Times, 6 March, 1971) | কিন্তু সে সুযােগ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠদের দিতে চান নি, এমন কি চান নি সংখ্যালঘু পশ্চিম-পাকিস্তান সাংসদদের উপস্থিতিতেও। তুরুপের তাসটা তিনি জুলফিকার আলী ভুট্টোকেই ধরে রাখতে দিয়েছেন। পরিস্থিতি যদি এ অবস্থান থেকে সরে না আসে তাহলে হ্যাজেলহাস্টের মতে তা আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে এবং সেক্ষেত্রে শেখ মুজিবের পক্ষে কোনাে বিকল্প থাকবে না এ কথা বলা ছাড়া যে পশ্চিমই পাকিস্তানের অবশিষ্ট অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এবং সে বিচ্ছিন্নতা হবে স্থায়ী (দ্য টাইমস, ৬,৩,৭১)। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার একটি মাত্র সিদ্ধান্ত এবং নিঃসন্দেহে ভুল সিদ্ধান্ত বাস্তবিকই পাকিস্তানের জন্য এমন এক রাজনৈতিক সঙ্কট তৈরি করেছিল যেখান থেকে ফিরে আসা ছিল খুবই কঠিন। একমাত্র প্রেসিডেন্টের হাতেই ছিল সে সঙ্কটের সমাধান। কিন্তু সঙ্কট থেকে উত্তীর্ণ হবার মতাে তাসটি ব্যবহার করা তার পক্ষে বােধহয় সম্ভব ছিল না। সঙ্কটের চাপটা ছিল তাই প্রধানত পূর্ব-পাকিস্তানের কাঁধে। সেক্ষেত্রে হ্যাজেলহাস্টের মতে “উত্তরণের জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের সামনে মাত্র দুটো পথই খােলা ছিল। এক, পূর্ব-পাকিস্তানের একতরফা স্বাধীনতা ঘােষণী, অথবা জাতীয় সংসদের অধিবেশন ডেকে পশ্চিম-পাকিস্তানি সাংসদদের তাতে যােগ দিতে আহ্বান জানানাে এবং যারা যােগ দেবেন তাদের নিয়ে সংবিধান রচনা করা।’ কিন্তু এ দুটোর কোনােটাই তার জন্য সহজ ছিল না।
তাছাড়া সংবিধান/শাসনতন্ত্র অনুমােদনের পুরাে এখতিয়ার তাে ছিল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার হাতে। কাজেই সঙ্কট থেকেই যায়। আর সব পথ শেষ পর্যন্ত একবিন্দুতেই এসে দাঁড়ায় স্বাধীনতা ঘােষণা। ‘দ্য অবজার্ভার’ পত্রিকায় সিরিল ডান হঠাৎ-সৃষ্ট ঐ রাজনৈতিক সঙ্কট নিয়ে আলােচনা প্রসঙ্গে ৭ মার্চ লেখেন : বাঙালি জাতীয়তাবাদের ক্ষুব্ধ কেন্দ্রস্থল ঢাকায় আজ এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে যার ফলে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়। হয়তাে এ ধরনের জনরবের (অর্থাৎ স্বাধীনতা ঘােষণার) কথা মনে রেখেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া গতকাল প্রচারিত এক বেতার বক্তৃতায় বিচ্ছিন্নতার মতাে যেকোনাে পদক্ষেপের বিরুদ্ধে। কড়া হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। যেকোনাে মূল্যে পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সংহতি রক্ষার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। আবার একই সঙ্গে ২৫ মার্চ জাতীয় সংসদ অধিবেশনের নতুন তারিখও ঘােষণা করেছেন। তাছাড়া অবিলম্বে সমস্যা সমাধানের জন্য ঢাকায় যাবার সাহসী সিদ্ধান্তও নিয়েছেন প্রেসিডেন্ট।’ | সঙ্কট প্রসঙ্গে সিরিল ডান আরাে লেখেন : ঢাকা থেকে পাওয়া সংবাদে যত দূর জানা যায়, সেখানকার জনমতের প্রচণ্ড চাপ সত্ত্বেও শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সংঘর্ষে মৃতের সংখ্যা যদিও ২০০’র। কাছাকাছি তবু শান্তিপূর্ণ ও অহিংস হরতাল পালনের জন্য শেখ সাহেবের আহ্বানে এবং সেনাবাহিনীর তরফ থেকে কিছুটা নমনীয় আচরণের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মৃতের সংখ্যা সম্ভাব্যতার তুলনায় কম’ (৭.৩.৭১)। (“Sheikh Mujibur is still staggering to keep Pakistan as one country’ but is under ‘enormous pressure from almost the entire populace. …Our correspondent puts the death toll at ‘about 200 and says this relatively lowfigure is due to the restraint so far shown by the Army. … The Sheikh has appealed to his people to calm down and to do nothing to aggravate the crisis”The Observer, 7 march, 1971)। পূর্ব-পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক জেনারেল ইয়াকুব খানের ঐ নমনীয় নীতিই তার জন্য কাল হয়ে উঠেছিল। হয়তাে ঐ নমনীয় নীতির কথা আঁচ করেই জেনারেল ইয়াহিয়া জেনারেল ইয়াকুবকে সরিয়ে তার স্থানে বালুচিস্তানের কসাই জেনারেল টিক্কা খানকে নিয়ােগের সিদ্ধান্ত নেন। যাতে উদ্ধত বাঙালিদের সহজে ঢিট করা যায়।
এটাই ছিল এ পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার নেওয়া সব কটি সিদ্ধান্তের গভীরে নিহিত সত্য। তাই প্রেসিডেন্টের ঢাকায় যাবার ‘সাহসী সিদ্ধান্ত’ সদিচ্ছা প্রণােদিত বলা চলে না। সংবাদ ভাষ্যকারের কাছে সামরিক শাসকদের ষড়যন্ত্র বিষয়ক তথ্যাদি উপস্থিত ছিল না বলেই হয়তাে এই প্রতিবেদনে এমন মন্তব্য করা বা ইয়াহিয়া খানের ইতিবাচক পদক্ষেপের প্রশংসা করা হয়েছে। এটা ছিল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার অবশেষ সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ সম্পর্কে সিরিল ডানের ভ্রান্ত মূল্যায়ন। প্রেসিডেন্টের আপাত-সদিচ্ছামূলক আচরণ সম্পর্কে এ ধরনের ভুল আওয়ামী লীগ। নেতৃত্বের হিসাব-নিকাশেও দেখা গেছে। হতে পারে, সাধারণ নির্বাচন দেওয়া সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সদিচ্ছার কথাটাই তাদের কাছে বড় হয়ে ছিল তাই তার। পরবর্তী পরিবর্তনের হিসাব-নিকাশটা ভালােভাবে কষা হয় নি। তা না হলে খবর তাে চাপা ছিল না যে প্রতিদিন পি,আই,এ, বিমানে সাদা পােশাকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য আসছে ক্যান্টনমেন্ট শক্তিশালী করতে, অস্ত্রসরঞ্জাম আসছে জাহাজে। এর অর্থ তাে পরিষ্কার, উদ্দেশ্য স্পষ্ট। তবু তারা রাজনৈতিক সমঝােতার আশায় দিনের পর দিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলােচনায় অংশ নিয়েছেন, এমন কি নিয়েছেন পঁচিশে মার্চ কালাে রাত্রির দিনটিতেও। মার্চের প্রথম সপ্তাহে জেনারেল ইয়াকুবের সিদ্ধান্তমাফিক (৫ মার্চ থেকে) সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরে গেছে, কাফু অংশত তুলে নেওয়া হয়েছে। স্থানীয় সামরিক প্রশাসনের ভাষ্য মতে ‘শেখ সাহেবের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার ডাকে কিছুটা সাড়া মিলেছে এবং গত চব্বিশ ঘণ্টায় অবস্থার উন্নতি ঘটায় সেনা অপসারণের সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়েছে। তবে এর মধ্যেই টঙ্গিতে বিক্ষোভরত শ্রমিকদের ওপর সেনাবাহিনীর গুলিতে কয়েকজন হতাহত। তেমনি রাজশাহীতে গুলিবর্ষণের ঘটনায় কয়েকজনের মৃত্যু ঘটে। তা সত্ত্বেও মিছিল সমাবেশ বিক্ষোভ পুরােদমে চলছে (ডন, করাচি, ৬,৩,৭১)। অবশ্য চেষ্টা চলেছে আইন অমান্য আন্দোলন যথাসম্ভব শান্তিপূর্ণভাবে সংগঠিত করার। কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন শান্তিপূর্ণ রাখা সত্যই কঠিন ছিল। পরিস্থিতি যে মীমাংসার অনুকূল নয় এবং সামরিক শাসনেরও যে তেমন ইচ্ছা নেই। এ সহজ অপ্রিয় সত্য রাজনীতিকগণ অনেকেই অনুধাবন করতে পারেন নি অথবা চান নি। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাজে ও ঘােষণায় (৬.৩.৭১) যে দুই বিপরীতের প্রকাশ ছিল। স্পষ্ট সেদিকে কারাে নজর ছিল বলে মনে হয় না।
যেমন একদিকে তিনি জেনারেল ইয়াকুবকে সরিয়ে জঙ্গি সেনানায়ক জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব-পাকিস্তানে সর্বক্ষমতাধর প্রশাসক হিসাবে নিয়ােগ করেন, অন্যদিকে ২৫ মার্চ জাতীয় সংসদের অধিবেশন শুরুর ঘােষণা দিয়ে পূর্ব-পাকিস্তানিদের সামনে সম্ভাবনার মুলাে ঝুলিয়ে রাখেন। আশপাশে যা ঘটছিল সবই ছিল উদ্বেগ আশঙ্কার প্রতীক। ঢাকার বিদেশী দূতাবাসগুলাে থেকে সেখানকার কর্মকর্তাদের পরিবারবর্গকে নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানাের বিষয়টি ছিল রীতিমতাে অশুভ সঙ্কেত। একদিকে করাচি বিমানবন্দরে বিপুল সংখ্যক উদ্বিগ্ন বাঙালির ঘরে ফেরার জন্য উদ্বাস্তু-জটলা, অন্যদিকে ঢাকা বিমানবন্দরে অবাঙালি (“বিহারি’) জনতার পশ্চিম-পাকিস্তানে যাওয়ার জন্য সৃষ্ট কাফেলা এর কোনােটাই স্বাভাবিক বা তাৎপর্যহীন ঘটনা ছিল না। | মার্চ মাস বাংলা বছরের হিসাব ফাল্গুনের দ্বিতীয়ার্ধ– অর্থাৎ বসন্ত ঋতু। কিন্তু বসন্তের প্রতিটি দিন পার হয়েছে কমবেশি রক্তের রঙ ছিটিয়ে। এমন বসন্ত কেউ আশা করে নি। তবু মানুষ মনে করেছে হয়তাে ঘটনা অন্য দিকে বাঁক নেবে, নতুন কিছু ঘটবে। তারা ভাবতে পারে নি পরিস্থিতি আরাে রক্তপাত, আরাে মৃত্যু, আরাে দুর্যোগের দিকে মােড় নেবে। আবার কেউ কেউ ঠিকই ভেবেছেন সম্ভাব্য ভয়াবহতার কথা। বিশেষ করে পাকিস্তানের রাজনীতির সঙ্গে যাদের ভালাে পরিচয় আছে। কিন্তু এ অবস্থায় ৮ মার্চ ঢাকা থেকে পল মার্টিন লিখছেন : “পাকিস্তানের রাজনৈতিক সঙ্কট এখন ‘সজ্ঞাত না সমঝােতা’– এই অনিশ্চয়তার পর্যায় পার হয়ে কিছুটা শ্বাস ফেলার ও সমঝােতার অবকাশ তৈরি করেছে। অনেক জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের দিকনির্দেশক ভাষণে জননেতা শেখ মুজিবুর রহমান বহু কথিত স্বাধীনতা ঘােষণার বদলে ২৫ মার্চ সংসদে যােগ দেবার জন্য ৪-দফা শর্ত আরােপ করেছেন। তবু গত এক সপ্তাহে সৃষ্ট টেনশন এখনাে অনেকটাই রয়ে গেছে মনে হয়।” পল মার্টিনের অবশেষ ধারণা : সমঝােতা না আঘাত এ বিষয়ে পাকিস্তান এখনাে মনস্থির করতে এবং শেষ সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারে নি (দ্য টাইমস, ৮,৩,৭১)।(“The crisis in Pakistan moved into a new phase as both sides faced the choice of political compromise or a head-on collision. That some room for compromise still existed was shown in yesterday’s long-awaited speech by Sheikh Mujibur Rahman, the East Pakistan leader. He set out four demands which must be met by the military regime before he will agree to enter the Constituent Assembly.”-The Times, 8 March, 1971)
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চতুরতা ও পরিকল্পনার মারপ্যাচ বােঝা যে কত কঠিন উপরে উল্লিখিত সাংবাদিকের বিচার-বিশ্লেষণ থেকে তা অনুমান করা যায়। তাদের আপাত-স্বচ্ছ বক্তব্য বা পদক্ষেপের গভীরে কত যে কালােছায়ার খেলা, ষড়যন্ত্রের জটিলতা তা সহজে ধরা পড়ে না। এক্ষেত্রে অবশ্য কিছু কিছু আলামত ইতােমধ্যেই প্রকাশ পেয়েছে তবু পল মার্টিন ধরতে পারেন নি যে পাকিস্তানি সামরিক সরকার শেষ সিদ্ধান্ত ও নীলনকশা সম্পূর্ণ করে নিয়েই সমঝােতামূলক ঘােষণা সবার সামনে ছুঁড়ে দিয়েছে। চেয়েছে পূর্ণশক্তিতে আঘাতের উপযােগী সমরসজ্জা সম্পূর্ণ করে তােলার জন্য কিছু সময়। সেই সময় কেনার উদ্দেশ্যেই ২৫ মার্চ সংসদ অধিবেশনের ঘােষণা এবং ঐ সূত্রে সংলাপ শুরু করা। ডেভিড লুশাক অবশ্য বুঝতে ভুল করেন নি। ঢাকা থেকে ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এ পাঠানাে প্রতিবেদনে তিনি ঠিকই লিখেছেন : মনে হয় না রক্তপাত ছাড়া বর্তমান সঙ্কটের সমাধান সম্ভব। পাকিস্তান সম্পর্কে এখন বড় সত্য হলাে এটা সুস্পষ্ট দুই জাতির রাষ্ট্র। এই দুইয়ের মধ্যে যেমন পারস্পরিক স্বার্থ-নির্ভরতা নেই তেমনি নেই ভাষা খাদ্য এবং অনুরূপ বিষয়ে ঐক্য—এমন কি ইসলাম ধর্মও তাদের এক সূত্রে বেঁধে রাখতে পারছে না। যেমন পারে নি মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমান রাষ্ট্রগুলােকে এক কাঠামােয় আবদ্ধ করতে।’ (“It could be, though it looks unlikely, that the present crisis… will somehow be resolved without bloodshed. …For the simple truth about Pakistan now is that it is two nations. There is no common self-interest, no interdependence, no common language or diet, not even Islam to hold them together….Islam is not a cementing force. It has not proved so in the Middle East, it is not so here. The Daily Telegraph. 10 march, 1971) সত্য বলতে কি ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর থেকে পূর্ব-পাকিস্তান পশ্চিমাঞ্চলের উপনিবেশ হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। বর্তমান নির্বাচনের ফলাফল তাকে আকাক্ষিত অবস্থানে পেীছে দিয়েছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসাবে কেন্দ্রে সরকার গঠনের সুযােগ সৃষ্টি করেছে। আপন স্বার্থরক্ষা করতে এবং উপনিবেশধৰ্মী শােষণ বন্ধ করতে আওয়ামী লীগ
ফেলার ও সমঝােতার অবকাশ তৈরি করেছে। অনেক জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের দিকনির্দেশক ভাষণে জননেতা শেখ মুজিবুর রহমান বহু কথিত স্বাধীনতা ঘােষণার বদলে ২৫ মার্চ সংসদে যােগ দেবার জন্য ৪-দফা শর্ত আরােপ করেছেন। তবু গত এক সপ্তাহে সৃষ্ট টেনশন এখনাে অনেকটাই রয়ে গেছে মনে হয়।” পল মার্টিনের অবশেষ ধারণা : সমঝােতা না আঘাত এ বিষয়ে পাকিস্তান এখনাে মনস্থির করতে এবং শেষ সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারে নি (দ্য টাইমস, ৮,৩,৭১)।
(“The crisis in Pakistan moved into a new phase as both sides faced the choice of political compromise or a head-on collision. That some room for compromise still existed was shown in yesterday’s long-awaited speech by Sheikh Mujibur Rahman, the East Pakistan leader. He set out four demands which must be met by the military regime before he will agree to enter the Constituent Assembly.”-The Times, 8 March, 1971) | পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চতুরতা ও পরিকল্পনার মারপ্যাচ বােঝা যে কত কঠিন উপরে উল্লিখিত সাংবাদিকের বিচার-বিশ্লেষণ থেকে তা অনুমান করা যায়। তাদের আপাত-স্বচ্ছ বক্তব্য বা পদক্ষেপের গভীরে কত যে কালােছায়ার খেলা, ষড়যন্ত্রের জটিলতা তা সহজে ধরা পড়ে না। এক্ষেত্রে অবশ্য কিছু কিছু আলামত ইতােমধ্যেই প্রকাশ পেয়েছে তবু পল মার্টিন ধরতে পারেন নি যে পাকিস্তানি সামরিক সরকার শেষ সিদ্ধান্ত ও নীলনকশা সম্পূর্ণ করে নিয়েই সমঝােতামূলক ঘােষণা সবার সামনে ছুঁড়ে দিয়েছে। চেয়েছে পূর্ণশক্তিতে আঘাতের উপযােগী সমরসজ্জা সম্পূর্ণ করে তােলার জন্য কিছু সময়। সেই সময় কেনার উদ্দেশ্যেই ২৫ মার্চ সংসদ অধিবেশনের ঘােষণা এবং ঐ সূত্রে সংলাপ শুরু করা। | ডেভিড লুশাক অবশ্য বুঝতে ভুল করেন নি। ঢাকা থেকে ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এ পাঠানাে প্রতিবেদনে তিনি ঠিকই লিখেছেন : মনে হয় না রক্তপাত ছাড়া বর্তমান সঙ্কটের সমাধান সম্ভব। পাকিস্তান সম্পর্কে এখন বড় সত্য হলাে এটা সুস্পষ্ট দুই জাতির রাষ্ট্র। এই দুইয়ের মধ্যে যেমন পারস্পরিক স্বার্থ-নির্ভরতা নেই তেমনি নেই ভাষা খাদ্য এবং অনুরূপ বিষয়ে ঐক্য—এমন কি ইসলাম ধর্মও তাদের এক সূত্রে বেঁধে রাখতে পারছে না। যেমন পারে নি মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমান রাষ্ট্রগুলােকে এক কাঠামােয় আবদ্ধ করতে।’ (“It could be, though it looks unlikely, that the present crisis… will somehow be resolved without bloodshed. …For the simple truth about Pakistan now is that it is two nations. There is no common self-interest, no interdependence, no common language or diet, not even Islam to hold them together….Islam is not a cementing force. It has not proved so in the Middle East, it is not so here. The Daily Telegraph. 10 march, 1971) সত্য বলতে কি ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর থেকে পূর্ব-পাকিস্তান পশ্চিমাঞ্চলের উপনিবেশ হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। বর্তমান নির্বাচনের ফলাফল তাকে আকাক্ষিত অবস্থানে পেীছে দিয়েছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসাবে কেন্দ্রে সরকার গঠনের সুযােগ সৃষ্টি করেছে। আপন স্বার্থরক্ষা করতে এবং উপনিবেশধৰ্মী শােষণ বন্ধ করতে আওয়ামী লীগ ৬-দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের দাবির ওপর গুরুত্ব আরােপ করছে। এর ফলে পাকিস্তানের প্রদেশগুলাে অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে পাবে। (“East Pakistan had been treated as a virtual colony of the West wing since independence in 1947. Now for the first time, it achieved its rightful place in the system of government. It was the majority wing. … To safeguard its status and prevent further colonisation, East Pakistan insisted on almost total autonomy, embodied in Awami League’s ‘Six-Points’. Under these, the province would have sole control over…vital matters.” -The Daily Telegraph, 10 March, 1971)। কিন্তু দ্বিতীয় প্রধান পার্টি পিপিপি’র প্রধান মি, ভূট্টোর কাছে এ ব্যবস্থা গ্রহণযােগ্য। নয়।
শুধু তার উচ্চাকাঙ্কার বিরােধী বলেই নয়, আরাে একাধিক কারণে ভূয়া প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন স্বীকার করে নিতে অনিচ্ছুক। পাকিস্তানে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার ভুঠোর আকাক্ষার ধন, কারণ তাতে করে ভারতের সঙ্গে হাজার বছর ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া। সম্ভব হবে। | ‘শুধু ভুট্টোই নন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছেও প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন গ্রহণযােগ্য নয়, বিশেষ করে পাকিস্তানের সংহতি ও অখণ্ডতা রক্ষার প্রয়ােজনে। তেমনি এ ব্যবস্থা পাঞ্জাবি-প্রধান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছেও গ্রহণযােগ্য নয়। বিশেষ করে এই জন্য যে এর ফলে নিছক সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে বেসামরিক চরিত্রের বাঙালি জাতির কর্তৃত্ব মেনে নিতে হবে, তাদের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে। তার চেয়েও বড় কথা পূর্বপাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের অর্থ হবে পশ্চিমের চার প্রদেশের জন্যও স্বায়ত্তশাসন যা পরিণামে বিচ্ছিন্নতার দরজা খুলে দিতে পারে’ (১০.৩.৭১)। ডেভিড লুশাকের ভাষায় : (“It was unacceptable to Mr. Bhutto, not only for the considerable reason of his own overweening ambition, but because a strong central government is essential to his vision of a thousand year war with India. (“Is was unacceptable, too, to Yahya, pledged to defend the intergrity of Pakistan. It was unacceptable to the predominantly Punbjabi army, which could never go so far as to acquiesce in a system which made it permanently dependent on the non-martial Bengali majority for its appropriations. And it was unacceptable, because a corollary of autonomy for East Pakistan would be equal autonomy for the four provinces of the West wing, a recipe for disintegration.” -The Daily Telegraph, 10 March, 1971) 1 | এ পর্যন্ত ডেভিড লুশাক ঠিকই বলেছেন। এমন কি এটাও ঠিক বলেছেন যে ৭ মার্চের ভাষণে শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘােষণার কাছাকাছি এসেও যে থেমে গেছেন তার কারণ সেনাবাহিনী বিচ্ছিন্নতার যে কোনাে চেষ্টা নির্মম হাতে দমন করবে, আর এর অর্থ রক্তপাত। কিন্তু সংসদ অধিবেশন বিষয়ক ইয়াহিয়ার ভাষণ ভুল বােঝা হয়েছে ডেভিডের এমন ধারণা ঠিক নয়। নয় এ কারণে যে প্রেসিডেন্ট ঐ ঘােষণার ক্ষেত্রে সৎ ও স্বচ্ছ ছিলেন না (যে কথা এ পর্যন্ত একাধিক বার ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে)।
পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচনের পর রাজনৈতিক চত্বরে যে সমস্যা ও সঙ্কট সৃষ্টি হয় দক্ষিণ-এশিয়ার রাজনৈতিক পটভূমিতে এর গুরুত্ব অসামান্য বলেই হয়তাে প্রতিদিন এ বিষয়ে পশ্চিমা সংবাদপত্রে ঘটনার ব্যাখ্যা-বিচার নিয়ে নিবন্ধ বা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টডিজ’ (‘সােয়াস)-এ কর্মরত প্রভাষক ড, জেড,এইচ, জায়দি উল্লিখিত সঙ্কট সম্পর্কে আলােচনা করতে গিয়ে প্রথমেই যথারীতি প্রশ্ন রেখেছেন : পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা কি অনিবার্য?’ উল্লিখিত সঙ্কট দেখা দেওয়ার পর থেকে সর্বত্র এটাই ছিল সর্বাধিক আলােচিত বিষয়, কি দেশে কি বিদেশে। | সঙ্কটের বহুকথিত কারণ জনাব ভুট্টোর জাতীয় সংসদ বর্জনের অদূরদর্শী পদক্ষেপ। এবং সেই সূত্রে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কর্তৃক সংসদের অধিবেশন স্থগিত ঘােষণা। জনাব জায়দির মতে এ ধারণার পেছনে রয়েছে পূর্ব-পশ্চিমের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং আর্থ-রাজনৈতিক বঞ্চনার কারণে পূর্ব-পাকিস্তানি জনগণের মধ্যে সৃষ্ট অসন্তোষ। জনাব জায়দির যুক্তি এক্ষেত্রে একদেশদর্শী তাই বলতে পেরেছেন যে পূর্ব-পাকিস্তানের সব অভিযােগ বাস্তবধর্মী নয় । এক দেশে দুই অর্থনীতি এবং বৈদেশিক সাহায্যের বৈষম্যমূলক ব্যবহার বিষয়ক বিদেশী লেখকের সংগৃহীত বহু তথ্য থেকে পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যকার বৈষম্য প্রমাণ করা চলে। প্রমাণ করেছেন দেশী-বিদেশী একাধিক লেখক। আসলে এ ধরনের সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিই ছিল সঙ্কটের মূল কারণ। জনাব ভুট্টো তার বক্তৃতায় (১৫ ফেব্রুয়ারি) পূর্ব-পাকিস্তানের শোষণ-বঞ্চনার কথা স্বীকার করেও অন্যায্য কর্তৃত্ব ও আধিপত্য কিছুতেই ছেড়ে দিতে পারেন নি বলে সঙ্কটের উদ্ভব। সমস্যার মূল এখানে। আর সঙ্গে ছিল ভুট্টোর প্রবল ব্যক্তিগত উচ্চাকাক্ষা । নিবন্ধকার বৃথাই বিভাগপূর্ব বঙ্গীয় রাজনীতির ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমে পূর্ববঙ্গের বর্তমান পশ্চাদবর্তিতা যুক্তিগ্রাহ্য করে তুলতে চেষ্টা করেছেন। তবে এ কথা ঠিক যে বিরাজমান সঙ্কটের একমাত্র সমাধান হিসাবে দুটো বিকল্পই বাস্তব সত্য— এক, পূর্ব-পাকিস্তানের পূর্ণ স্বাধীনতা; দুই, পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে শিথিল ইউনিয়ন গঠন। পূর্ব-পাকিস্তানি নেতৃত্ব স্বাধীনতার বড় একটা পক্ষপাতী নন, তাদের মূল দাবি স্বশাসন (অটোনমি)। অর্থাৎ দুর্বল কেন্দ্রবিশিষ্ট ফেডারেল সরকার যা দুই অঞ্চলের প্রদেশগুলাে নিয়ে গঠিত হতে পারে” (দ্য টাইমস, ১০.৩.৭১)।
টাইমস পত্রিকার ভাষায় (“The only alternatives open to East Pakistan are complete independence or a loose union with West Pakistan. As for independence. the present leadership in East Pakistan does not seem to be too keen. What East Pakistanis desire urdently is to be able to govern themselves complete autonomy with West Pakistan. Once assured they are masters of their home, the East Pakistanis, according to all indications would be willing to take part in a federal government but with a very weak centre.” The Times, 10 March, 1971)। এতদসত্ত্বেও পাকশাসকশ্রেণী, সামরিক বাহিনী পূর্ব-পাকিস্তানের কাধে বিচ্ছিন্নতার দায় চাপিয়ে দিয়েছিল। আসলে তাদের উদ্দেশ্য ছিল বরাবর পূর্বপাকিস্তান শাসন করা, উপনিবেশ হিসাবে যতটা সম্ভব শােষণ করা।তাই মজার বিষয় হলাে জায়দি কথিত (আরাে বহুজনা কথিত) ঐ দুই বিকল্পের কোনােটাই ভুট্টো বা সামরিক শাসকদের কাছে গ্রহণযােগ্য ছিল না। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিমা শাসকশ্রেণীর (সামরিক, বেসামরিক উভয়েরই) স্বার্থ ও আধিপত্য রক্ষা করা। আর সেই মনােভাবের জেদই সঙ্কটের কারণ। তা সত্ত্বেও দেখা যায়, এত রক্ত, এত মৃত্যুর পর, এত রক্তঝরার পরও শেখ মুজিবুর রহমান সাদামাঠা চার দফার শর্তে (৭ মার্চে ঘােষিত) সংসদে যােগ দেবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। দফাগুলাে ছিল সামরিক আইন প্রত্যাহার, সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া, জনহত্যার বিচার-বিভাগীয় তদন্ত এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর। পশ্চিম পাকিস্তানের একাধিক রাজনৈতিক নেতা– যেমন মিয়া নিজামুদ্দিন হায়দার, নসরুল্লাহ খান, সর্দার শওকত হায়াৎ খান প্রমুখ রাজনীতিক চার দফা প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জানান (ডন, ৮,৩,৭১)। পাখতুন নেতা ওয়ালি খান ঢাকায় এক বিবৃতিতে শেখ মুজিবের সঙ্গে ঐকমত্যে অবিলম্বে সামরিক শাসন প্রত্যাহার এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান” (দৈনিক পাকিস্তান, ১৪,৩,৭১)। | কিন্তু জনাব ভুট্টো বা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কেউই ঐ চার দফা প্রস্তাব পুরােপুরি মেনে নিতে রাজি হন নি। তাতেও বােঝা যায় সমস্যা, সঙ্কট বা রাজনৈতিক অচলাবস্থা। সৃষ্টির দায় প্রকৃতপক্ষে কার বা কাদের।
গার্ডিয়ান পত্রিকায় এস.আর, ঘােরি সঙ্কট সৃষ্টির জন্য ভুট্টোকে দায়ী করেও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এবং শেখ মুজিবের আলােচনা। গুরুত্বপূর্ণ বলে চিহ্নিত করেন। তার মতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও শেখ মুজিবের মধ্যে আলােচনা ছাড়া সঙ্কট নিরসনের অন্য কোনাে উপায় নেই (দ্য গার্ডিয়ান, ১২.৩.৭১)। | কিন্তু যে কথা এদের কেউ কেউ বুঝতে চান নি তা হলাে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার। সদিচ্ছা ও সততা। প্রেসিডেন্ট কি আদৌ সঙ্কটের রাজনৈতিক সমাধান চেয়ে ছিলেন? আমার তা মনে হয় না। অন্তত তার কিছু কথা, কিছু ক্রিয়াকলাপ দেখে তা মনে হয় না। তার সদিচ্ছা থাকলে ঠিকই সঙ্কটের সমাধান মিলতাে। কারণ, বিভিন্ন ঘটনা পর্যালােচনায় এটা স্পষ্ট যে পাকিস্তান কাঠামাের মধ্যেই শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করে দেশে জনপ্রতিনিধিত্বমূলক বেসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠাই ছিল আওয়ামী লীগ প্রধানের উদ্দেশ্য। আর সে উদ্দেশ্যে ছয়-দফায় কিছু ছাড় দিতেও তিনি প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যে কারণেই হােক সে পথে দেবার সদিচ্ছা প্রমাণ করেন নি। আর সদিচ্ছা তার ছিল না বলেই জেনারেল ইয়াকুবকে সরিয়ে তিনি জেনারেল টিকাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন, যে-টিক্কা ঢাকায় ছিলেন অবাঞ্ছিত । অবাঞ্ছিত বলেই ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বি.এ. সিদ্দিকির মতাে মুসলিম লীগপন্থী বিচারকও বিরাজমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে জেনারেল টিক্কার পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্নর হিসাবে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনায় অস্বীকৃতি জানান। কোনাে বাঙালি বিচারকই এ কাজে রাজি হন নি (দৈনিক পাকিস্তান, ১১.৩,৭১)। পঁচিশে মার্চে রক্তাক্ত সামরিক শাসন পুনর্বহালের পর অবশ্য ঐ প্রধান বিচারপতিই টিক্কা খানের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন বা বলা যায় করতে বাধ্য হন। টিক্কা খান ঢাকার মাটিতে পা রাখেন ৭ মার্চ নানা কারণে ৭ মার্চ ঐ উপপ্লবের বছরটিতে তাৎপর্যপূর্ণ দিন হিসাবে চিহ্নিত। শুধু রেসকোর্স ময়দানে শেখ সাহেবের।
ভাষণের জন্যই নয়, ঐদিনই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগ প্রধানকে বার্তা পাঠান এমন প্রতিশ্রুতিসহ যে তিনি অতিসত্বর ঢাকা এসে তার সঙ্গে আলােচনায় বসবেন এবং জনগণের কাছে জননেতার দেওয়া অঙ্গীকার রক্ষার ব্যবস্থা করবেন। কাজেই তিনি যেন কোনাে অপরিণামদর্শী হঠাৎ সিদ্ধান্ত না নেন, তেমন কোনাে প্রকাশ্য ঘােষণা না দেন। অন্য ঘটনাটি ছিল আরাে গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানে কর্মরত স্বনামখ্যাত(!) মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ড ঢাকায় এসে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন যে পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা যুক্তরাষ্ট্রের কাম্য নয়। বিচ্ছিন্ন পূর্ব-পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের কোনাে প্রকার সাহায্য-সহায়তা পাবে না (জিডব্লিউ চৌধুরী)। এমনি একাধিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জনমতের প্রবল চাপ সত্ত্বেও ৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতা ঘােষণা সম্ভব ছিল না। কিন্তু কথা রাখেন নি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ৬ মার্চ টেলিফোন সংলাপের বা পরদিন তারবার্তায় পাঠানাে অঙ্গীকার রক্ষার ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সততার পরিচয় দেন নি। অবশ্য ঢাকায় তিনি এসেছেন ঠিকই, আলােচনা তথা সংলাপের আয়ােজনও করেছেন। কিন্তু সে সবই ছিল তার উদ্দেশ্য পূরণের ফান, পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে আঘাতের জন্য সময় নেওয়া। বাঙালি রজনীতিকগণ, এমন কি বিদেশী সাংবাদিক অনেকেই তা বুঝতে পারেন নি। আবার ঐ গার্ডিয়ান পত্রিকার পাতায়ই মার্টিন অ্যাডনি সম্পূর্ণ ভিন্নসুরে ভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেছেন। পূর্ব-পাকিস্তানের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালােচনা করে মার্টিনের মনে এমন ধারণা তৈরি হয় যে ‘গত কয়েক সপ্তাহে জেগে-ওঠা বাঙালি জাতীয়তাবাদী জয় বাংলা স্লোগানের রাষ্ট্রিক সম্ভাবনার ভবিষ্যৎবাস্তবে মেঘাবৃত । অন্যদিকে শেখ মুজিব স্বায়ত্তশাসনের কতটা পেয়ে সন্তুষ্ট হবেন তা যেমন স্পষ্ট নয় তেমনি সামরিক বাহিনী কতটা স্বায়ত্তশাসন দিতে পারে তাও স্পষ্ট নয়। কাজেই সমস্যা সব দিক থেকেই যথেষ্ট জটিল’ (১২.৩.৭১)।
এ বিচার বাস্তবভিত্তিক হলেও একথা সত্য যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ একেবারে তাৎক্ষণিক ছিল না। এর সূচনা ঘাটের দশকে। (“Over the past few weeks, new kind of Bengali nationalism has begun, though its prospects look cloudy. It is difficult to know what extent of autonomy, Mujib would settle for…. It is thought here (Dacca) that Yahya is coming to make some concessions to the Sheikh, but there is a wide variation on the extent to which he can.” The Guardian, 12 march, 1971) | ফ্রান্সিস হােপ ‘নিউ স্টেটসম্যান’-এ (১২.৩.৭১) তার নিবন্ধের শিরােনামই দিয়েছেন ‘বিভক্ত পাকিস্তান’ (Divided Pakistan) যদিও মূল বক্তব্যে কিছুটা ভিন্ন কথাই বলেছেন। হয়তাে পাকিস্তানের দুই ভৌগােলিক দূরত্বটাকে গুরুত্ব দেওয়ার কারণে। পূর্ব-পাকিস্তানকে উত্তর আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে তুলনা করে তার কাছে অবাকই লেগেছে যে এতদিন এ অবস্থায় শান্তি বজায় রয়েছে কিভাবে? তার হিসাবে বর্তমান অবস্থায় জুলফিকার আলী ভুট্টোকে মাঝখানে রেখেও শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মধ্যে সমঝােতা হয়তােবা সম্ভব। অথবা এমন সম্ভাবনাও রয়েছে, যে পূর্ব-পাকিস্তান বাজির সর্বোচ্চ দানে খেলতে বাধ্য হয়ে হারতে পারে এবং সেক্ষেত্রে দুই-এক বছর পার হয়ে তার অবস্থা দাঁড়াবে কুর্দিস্তান বা বায়াফ্রার মতাে, যে-সমস্যা বিশ্ববাসীর নজর কাড়ে না। তবে দুই পাকিস্তানের মধ্যকার দূরত্বটা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। (“It is just conceivable that some compromise may be worked out between Sheikh Mujibur Rahman and President Yahya with Zulfikar Ali Bhutto contributing a rare flash of silence. It is also possible that East Pakistan will be driven to play for the highest stakes and lose; that in one or two years it will join the expensive limbo which already houses Kurdistan or Biafra. What is not possible is that the world should ignore the huge gap between Pakistan’s two halves,” New Statesman, 12 March, 1971)। সত্যই এ দূরত্বের গুরুত্ব তাৎপর্যপূর্ণ। এ দূরত্ব যেমন দুই অংশে বৈষম্য সৃষ্টিতে সাহায্য করেছে তেমনি তা পূর্বাঞ্চলকে স্বশাসনে পৌছাতেও সাহায্য করেছে।
ফ্রান্সিসের এ হিসাব যথেষ্ট যুক্তিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও অবশেষ বিচারে মেলে নি, কেন। মেলে নি তা আলােচনার অবশেষ পর্যায়ে স্পষ্ট হবে। ফ্রান্সিস অবশ্য উল্লিখিত মন্তব্যের পরও তার দীর্ঘ প্রতিবেদনে সমস্যার স্থানিক-আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বিচার করে এক দেশে দুই অর্থনৈতিক অবস্থা, পূর্ব ও পশ্চিমের পরিপ্রেক্ষিতে চীন ও কাশির রাজনীতির বাস্তবতা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলােচনা শেষে সঙ্কট সমাধানের সম্ভাবনা উজ্জ্বল বলে মনে করতে পারেন নি। তার ধারণা মূল ৬-দফায় উল্লেখিত স্বতন্ত্র মুদ্রা ব্যবস্থার দাবি (প্রদেশের অধীনে) ছাড় দেওয়া অর্থাৎ কেন্দ্রের হাতে তুলে দেওয়া সত্ত্বেও ইয়াহিয়া খানের পক্ষে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্র (ইউনাইটেড স্টেটস অব পাকিস্তান)-এর মতাে একটি ফেডারেল ব্যবস্থা মেনে নেওয়া সহজ হবে না। বিশেষ করে এ ব্যবস্থায় যখন বাংলা, সিন্ধু, পাঞ্জাব, পাখতুনিস্তান ও বালুচিস্তান প্রদেশগুলাের শক্তিমান হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। সামরিক শাসকদের জন্য এটা হবে বড় বেশি ছাড় দেওয়া। এদিকে যত দিন যাচ্ছে পূর্ব-পাকিস্তানি জনতা ততই অস্থির, ততই জেদি হয়ে উঠছে, কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ অগ্রাহ্য করে চলেছে। পাশাপাশি বেশি বেশি অর্জনের আকাক্ষা উভয় পক্ষেই ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় অধিকতর শক্তি প্রদর্শনের সম্ভাবনা এড়ানাে খুবই কষ্টকর হয়ে উঠবে। আর কোনাে না কোনাে পক্ষ বেশ কিছুটা ছাড় না দিলে সংঘাত-রক্তপাত-মৃত্যু ক্রমাগত বেড়েই চলবে। | এ পর্যায়ে বিদেশী কাগজগুলাে উল্লিখিত সমস্যার সমাধান খুঁজে পেতে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেও খুব একটা ইতিবাচক সম্ভাবনায় পৌছাতে পারে নি। ‘দ্য গার্ডিয়ান (১৩,৩,৭১) জানাচ্ছে যে ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এ প্রকাশিত মূল নিবন্ধ থেকে উদ্ধার করে সেখানকারই একটি কাগজে যুক্তিসহকারে বলা হয়েছে, ‘পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী। রান্ত্রিক অখণ্ডতার অজুহাতে পূর্ব-পাকিস্তানের ওপর বল প্রয়ােগ করতে চাইলে ভুল করবে। (“Large extracts from a leading article in the ‘Daily Telegraph’ arguing against military force to preserve the integrity of Pakistan were featured prominantly in a newspaper here this morning.” The Guardian, 13 March, 1971)। কিন্তু সংবাদপত্রের এসব সদুপদেশ সাধারণত সামরিক শাসকদের বিচারবুদ্ধি স্পর্শ করে না। পাকিস্তানের শাসকশ্রেণীও এর ব্যতিক্রম হতে যাবে কেন।
‘দ্য ইকনমিস্ট’-এর শিরােনাম ছিল বেশ চমকপ্রদ। বাংলায় সরসভাবে বলা যায়। ‘কার্নিসের ধারে দাঁড়ানাে’। সত্যই অখণ্ড পাকিস্তানের অবস্থা তেমনি হয়ে উঠেছিল। নিবন্ধের শুরুতে গৌরচন্দ্রিকার মতাে করে বলা হয়েছে যে সামরিক শাসন শেখ মুজিবকে স্বায়ত্তশাসনের সারাৎসারটুকু দিতে না চাইলে পূর্ব-পাকিস্তানকে স্বাধীনতার দিকেই ঠেলে দেবে।’ পত্রিকাটির মতে আপাতদৃষ্টিতে ঢাকা শান্ত মনে হলেও দলে দলে মােহাজিরদের দেশত্যাগ, বিদেশী নাগরিকদের ঢাকা থেকে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা মােটেই শুভলক্ষণ নয়। (“Martial law is pushing East Pakistan towards declaring independence unless Sheikh Mujib gets the substance of full autonomy.” The Economist, 13 March, 1971) | তবে কিছুটা আশার কথা যে এবার জুলফিকার আলী ভুট্টো কোনাে পূর্বশর্ত ছাড়াই ২৫ মার্চ সংসদ অধিবেশনে যােগ দিতে ইচ্ছুক। কেননা তার মতে সামরিক শাসনের চাপ শেখ মুজিবুরকে পূর্ব-অবস্থান থেকে সরে আসতে বাধ্য করেছে। এবার তার দলের ভেতরকার উগ্রপন্থীদের মােকাবেলা তাকেই করতে হবে।’ কিন্তু পরিস্থিতি তখন সামরিক শক্তি প্রয়ােগের দিকেই যাচ্ছে। একদিকে সংলাপের সম্ভাব্য আবহ অন্যদিকে সাধারণ পরিবহন বিমানযােগে নিয়মিত পশ্চিম থেকে পূর্ব-পাকিস্তানে সৈন্য আনা হচ্ছে, ট্যাংকগুলােকে ব্যবহারের উপযােগী করে তােলা হচ্ছে। অর্থাৎ সংঘাতের জন্য প্রস্তুতি। (“Mr. Zulfikar Ali Bhutto says he is now willing to attend the March 25th meeting without preconditions. For, the effect of martial law in East Pakistan has moved Sheikh Mujib on to fresh ground…. (“At the moment President Yahya still seems determined to maintain the fiction of martial law. Transport planes have flown army reinforcement, and tanks are reported to have had their tracks replaced by wheels in preparation for possible street fighting.” The Economist, 13 March, 1971)। এরপর তাে নির্বোধেরও বুঝতে বাকি থাকে না যে বাইরে আলােচনার জন্য যতই টেবিল পাতা হােক পাক শাসকদের আসল উদ্দেশ্য সামরিক অভিযানের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান ঘটানাে। বাঙালি রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীদের কি তখন এসব প্রতিবেদন নজরে পড়ে নি? | ‘কিন্তু শেখ মুজিবের পেছনে অভাবিত জনসমর্থনের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে শক্তি প্রয়ােগের মাধ্যমে সরিয়ে দেওয়া যাবে বলে মনে হয় না। সেক্ষেত্রে স্বাধীনতার ঘােষণা ঠেকাতে হলে ইয়াহিয়ার উচিত হবে মুজিবকে সহায়তা দেওয়া। তা না হলে পূর্বপাকিস্তানের জন্য স্বাধীনতাই একমাত্র বিকল্প। কিন্তু মুজিবের দাবি অনুযায়ী সামরিক শাসন তুলে নিতে হলে বিকল্প সরকারের উপস্থিতি দরকার।
একমাত্র সংসদ অধিবেশনে সরকার গঠনের মাধ্যমেই তা সম্ভব। অথচ ছয়-দফার সরকার প্রেসিডেন্টের কাম্য নয়, কারণ ইয়াহিয়ার বিচারে তাতে পাকিস্তানের সংহতি বজায় থাকে না। স্বভাবতই সংকট এড়াতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সম্ভবত শক্তি প্রয়ােগের দিকেই যাচ্ছেন। কিন্তু এর অর্থ হবে অনিবার্য গৃহযুদ্ধ, এবং তাতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সফল হতে পারবেন বলে মনে হয় না। কমনওয়েলথভুক্ত দেশ পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ ব্রিটিশ সরকারের জন্য বিশেষ সমস্যাই তৈরি করবে। কেননা পাকিস্তানের সঙ্গে এখনাে ব্রিটেনের যথেষ্ট অর্থনৈতিক ও অন্যান্য সম্পর্ক রয়েছে। ব্রিটেন বায়াফ্রার গৃহযুদ্ধে নাইজেরিয়া সরকারকে অস্ত্র সাহায্য ও সার্বিক সমর্থন দিয়েছিল, এ ক্ষেত্রে অবস্থা ভিন্ন। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভৌগােলিক দূরত্ব এবং অন্যান্য কারণে ব্রিটেন এ গৃহযুদ্ধে সংশ্লিষ্ট হতে চাইবে না। তাছাড়া ব্রিটেন এখন আর পাকিস্তানে প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ নয়।’ (“If the President were to embark on the forcible subjection of East Pakistan, he would have little chance of success. But his public statements still implied that he might. If he does, a new civil war in a Commonwealth country could pose particular problems for Britain, which still has extensive economic and other ties with Pakistan.
(“In the Biafran war Britain chose to supply the Nigerian government with arms to crush the secession. In the event of a Pakistani civil war there are reasons why Britain might have to view the situation differently. …No British government would wish to get involved in a civil war-and Britain is no longer Pakistan’s main supplier of arms.” The Economist, 13 March, 1971)। একেই বলে ইংরেজের বেনিয়া বুদ্ধি। ‘ইকোনমিস্ট’-এর উপযুক্ত বিশ্লেষণ থেকে স্পষ্টই মনে হতে পারে যে সংঘাতের নিয়তিই বুঝি পাকিস্তানের জন্য অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। গােটা মার্চ মাসটাই ছিল বাঙালি জীবনের জন্য এবং পাকিস্তানি রাজনীতির জন্য অনিশ্চয়তায় ভরা এবং দুর্যোগের ছায়া ঘেরা। প্রতিটি দিন পাশার ছকে দান ফেলে অপেক্ষা করা, পরদিন কি হতে পারে তা না জেনে। আর তাই নিয়ে সংশ্লিষ্ট সবার হিসাব-নিকাশের পালা। কে হারে কে জেতে এ প্রতিযােগিতায় সেটাই একমাত্র বিচারের বিষয়, দেখার বিষয়। সমস্যা-সংকটের ব্যাখ্যাবিশ্লেষণের ক্ষেত্রে দেশী প্রেসের চেয়ে বিদেশী প্রেসের আগ্রহ কোনাে অংশে কম নয়। বিশদ বিশ্লেষণ সত্ত্বেও বিদেশী প্রতিবেদনে কথাটা উচ্চারিত হয় নি যে সংসদীয় গণতন্ত্র তথা পশ্চিমা গণতন্ত্রের রীতিমাফিক নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলেরই সরকার গঠন করা যুক্তিসম্মত। সম্ভবত পাকিস্তানের ভৌগােলিক বৈশিষ্ট্যের কারণে অথবা সেই সঙ্গে অন্য কোনাে কারণে তারা এদিকটাতে একেবারে নজর দেয় নি। তাই ঘুরে ফিরে বিভিন্ন জনের লেখায় প্রায় একই ধরনের বক্তব্য উচ্চারিত হয়েছে। করাচি থেকে এস,আর, ঘােরি (১৫ মার্চ) সেই বহু উচ্চারিত কথাই আবার বলেছেন যে ‘রাজনৈতিক সংলাপের বদলে পূর্ব-পাকিস্তানে সামরিক শক্তি প্রয়ােগ করা হলে সেখানে স্বাধীনতার ঘােষণা ত্বরান্বিত করে দেওয়া হবে এবং পরিণামে গৃহযুদ্ধ দেখা দেবে।’ আর এমন ধারণাই যে পশ্চিম পাকিস্তানে দ্রুত গড়ে উঠছে সে কথাও ঘােরি বলেছেন। পূর্ব-পাকিস্তানে যে কেন্দ্রীয় শাসন অচল হয়ে পড়েছে সে কথাও উল্লেখিত হয়েছে ঐ প্রতিবেদনে।
ঘােরি মনে করেন যে পাকিস্তানের অখণ্ডতা নষ্ট করার দায়ে তার নাম ইতিহাসের খাতায় লেখা হােক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তা চান না। তেমনি সামরিক বাহিনীও নিজদেশে দখলদার বাহিনী হিসাবে চিহ্নিত হতে রাজি নয়। তাই সবার দৃষ্টি এখন ঢাকায় ইয়াহিয়া মুজিব সংলাপের ওপর। তাদের ব্যর্থতা হয়ে দাঁড়াবে পাকিস্তানি সৌভ্রাতৃত্বের ব্যর্থতা (দ্য গার্ডিয়ান, ১৬ মার্চ, ১৯৭১)। (“President Yahya Khan has no intention of going down in history as a man who presided over the liquidation of Pakistan nor do the armed forces visualise for themselves the role of occupation troops in their own country. All eyes therefore are fixed on the outcome of the Yahya-Mujib parleys in Dacca. Their failure would mean the failure of Pakistan’s brotherhood.” The Guardian, 16 March, 1971) 1 c a galico পারেন নি যে পূর্ববঙ্গে দখলদার বাহিনীর ভূমিকা পালনে কোনাে অরুচি ছিল না পাকবাহিনীর, বরং সানন্দে তারা এ কাজটা করেছে। ভাবতে অবাকই লাগে যে পূর্বপশ্চিমের সৌভ্রাতৃত্বে আস্থাশীল সাংবাদিক কি করাচিতে বসেও ভুট্টো এবং জঙ্গি সেনানায়কদের ষড়যতের কথা জানতে পারেন নি, সামান্য আভাসও পান নি?
হয়তাে পান নি। তাই তার সদিচ্ছা ও শুভেচ্ছা ঘটনার গতি, ইতিহাসের অনিবার্য পরিণাম রুখতে পারে নি। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ঠিকই পূর্ব-পাকিস্তানে দখলদার বাহিনীর ভূমিকা পালন করেছে। করেছে তথাকথিত স্বদেশে হত্যা, পীড়ন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোেগ— এক কথায় গণহত্যার বিচারযােগ্য অপরাধ সংঘটিত করে। আর ইয়াহিয়ার সভাপতিত্বে (শাসনে)ই পাকিস্তান বিভক্ত হয়েছে, ইতিহাসের পাতায় সে হিসাবে তার নাম লিপিবদ্ধ হয়েছে। | কিন্তু সাংবাদিক ঘােরির সদিচ্ছার প্রমাণ তার সম্ভাব্য প্রস্তাবগুলাে থেকে বােঝা যায়। তার মতে ‘সমস্যার জট খুলতে চাইলে প্রেসিডেন্ট জাতীয় সংসদকে সার্বভৌম সংস্থা হিসাবে ঘােষণা দিতে পারেন। সার্বভৌম সংসদ শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করার পর সামরিক আইন তুলে নেওয়ার কাজ সহজ হয়ে যাবে। এর পর সংখ্যাগরিষ্ঠ দল। প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণক্রমে সরকার গঠন করবে। কিন্তু বিষয়টা যদি এত সহজেই হতে পারে তাহলে তাে প্রেসিডেন্টের পক্ষে সমস্যার এত জট তৈরির দরকার ছিল না। সদিচ্ছা থাকলে সবই হয়। কিন্তু সে সদিচ্ছারই অভাব ছিল। অবশ্য তার এই সহজ সমাধানের সম্ভাব্যতা নিয়ে জনাব ঘোরি নিজেই পরে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। করেছেন মি, ভুট্টোকে নিয়ে। কারণ কেন্দ্রীয় সরকারে ভাগ বসাতে না। বলে বিবৃতি দিয়েছেন কিন্তু ঘােরি জানাচ্ছেন, ভুট্টো করাচিতে এক সম্মেলনে স্পষ্টই। বলেছেন যে দেশের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের কারণে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের দুই প্রধান পার্টি মিলে কেন্দ্রে কোয়ালিশন সরকার গঠন করাই যুক্তিসঙ্গত পদক্ষেপ। জনাব ঘােরির বিবেচনায় এ ব্যবস্থা অসম্ভব। কারণ ভুট্টো ও শেখ মুজিব এই দুই নেতার পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস ও বিরূপতা যৌথ সরকার গঠনের অনুকূল নয়। শেখ মুজিব যেমন পরাক্রান্ত পাঞ্জাব প্রদেশে গ্রহণযােগ্য নন তেমনি পূর্ব-পাকিস্তানে জনাব ভুয়োর কোনাে স্থান নেই। সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ভূট্টো-বলয়ের বহির্ভূত দলগুলােকে। (পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসাবে) এবং স্বতন্ত্র সাংসদদের নিয়ে কোয়ালিশন সরকার। গঠন করতে পারেন। তাতে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব বজায় রইল (দ্য গার্ডিয়ান, ১৬ মার্চ, ১৯৭১)।
(“Mr. Bhutto’s People’s Party can throw a spanner in the works by insisting on sharing power with the Awami League in the Central Government. At a conference in Karachi he said the country’s geography demanded that the two major parties of East and West Pakistan should form a coalition at the centre. This looks an impossible arrangement for various reasons. The most important of them is that Sheikh Mujib and Mr. Bhutto have come to dislike and distrust each other intensely. While Sheikh Mujib is not acceptable in the powerful province of Punjab, Mr. Bhutto is persona nongrata in East Pakistan.
(“Coalition can work only if the parties are more or less of like mind… I think Sheikh Mujib would rather enter a coalition with other parties-say the Council Muslim League, the National Awami Party and Independents from Sind rather than have Mr. Bhutto in his paradise.” The Guardian, 16 March, 1971)। | কিন্তু সমস্যা যেমন ভুট্টো সাহেবকে নিয়ে তেমনি খােদ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে নিয়েও। তিনি তার নিজস্ব হিসাবের বাইরে কোনাে প্রস্তাব বা ব্যবস্থায় সম্মত নন। অর্থাৎ সর্ষের মধ্যে ভূত। কাজেই এ সর্ষের সাহায্যে সমস্যার ভূত তাড়ানাে সম্ভব নয়। তাছাড়া সমস্যা সম্পর্কে আরাে একটি বিষয় বিবেচ্য আর তা হলাে পশ্চিম-পাকিস্তানি মানসিকতা। এর অর্থ পূর্বাঞ্চলের প্রতি পশ্চিমের সন্দেহ ও অবিশ্বাস। যেজন্য জনাব ঘােরিও মনে করেন যে আওয়ামী লীগ সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তানে কোনাে আসন না পাওয়ার কারণে কেন্দ্রীয় সরকার যে কোনাে ধরনের কোয়ালিশনের ভিত্তিতেই গঠিত হওয়া উচিত। কেন্দ্রীয় সরকারে কোনাে না কোনাে ভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব চাই, সংখ্যালঘু দল হওয়া সত্ত্বেও চাই। | সত্যি বলতে কি সমস্যার মূলে শুধু ভুয়ো বা ইয়াহিয়া বা সামরিক বাহিনীই নয়, গােটা পশ্চিম-পাকিস্তানি মানসিকতার সংকীর্ণতা ও প্রভুত্বপ্রিয়তাই প্রধান কারণ হিসাবে কাজ করেছে, যেজন্য সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রচলিত রীতিনীতি তাদের কাছে স্বীকৃতি পায় নি, গ্রহণযােগ্য মনে হওয়া তাে দূরের কথা। সে জন্যই ভুঠোর পক্ষে মােট ৩০০ আসনের মধ্যে মাত্র ৮৩ আসন নিয়ে সম্ভব হয়েছে গভীর এক রাজনৈতিক সঙ্কট তৈরি করা। সেই সঙ্গে পর্দার আড়ালের অন্ধকার কারণগুলাে তাে ছিলই। সব মিলেই এমন এক সঙ্কট যা সহজ সমাধানের পথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। | ঢাকা থেকে ঐ একই দিনের (১৫ মার্চ) বার্তায় গার্ডিয়ান পত্রিকায় মার্টিন অ্যাডনি জানান, ‘সশস্ত্র পাহারায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ঢাকায় প্রেসিডেন্ট ভবনে পৌছানাের কথা। পূর্ব-পাকিস্তানে তখন প্রকৃতপক্ষে শেখ মুজিবুর রহমানের শাসন চলছে, তার নির্দেশে সব কিছু হচ্ছে। তা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্টের ঢাকায় আগমন স্বস্তির পরিবেশ তৈরি করেছে। কারণ ঢাকায় এমন ধারণা তৈরি হয়েছিল যে প্রেসিডেন্টের অনুপস্থিতি ইচ্ছাকৃত যাতে করে অবস্থার অবনতি ঘটে। এখন মানুষ অপেক্ষা করছে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া অচলাবস্থার অবসান ঘটাতে কি পদক্ষেপ নেন তাই দেখার জন্য।
“কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যদি তার আগেকার (দশ দিন আগেকার ভাষণে প্রতিফলিত) মনােভাব পরিবর্তন না করে থাকেন তাহলে সমঝােতার সম্ভাবনা সামান্যই বলা চলে। ইতােমধ্যে আওয়ামী লীগের সদস্যদের মধ্যে এমন কথা আলােচিত হচ্ছে যে ৭ মার্চের ভাষণে শেখ সাহেব প্রকারান্তরে মুক্তির নামে স্বাধীনতার ঘােষণাই দিয়েছেন। এ অবস্থায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যদি সদিচ্ছা ও রাজনৈতিক সমঝোতার মনােভাব প্রকাশ করেন এবং শেখ মুজিব তার দলের জঙ্গি অংশকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন তাহলেই সম্ভাবনার পথ তৈরি হবে। অন্যথায় প্রেসিডেন্টের আগমনে সৃষ্ট প্রত্যাশা ঐতিহাসিক তিক্ততায় পরিণত হবে।’ (দ্য গার্ডিয়ান, ১৬ মার্চ, ১৯৭১)।
(“If President Yahya sticks to the… attitude he adopted in his broadcast 10 days ago, there can be little hope of a settlement. Already, members of the Awami League are claiming that Sheikh Mujib declared independence on March 7 though he used the words like ‘freedom’ and ‘liberty’. Either the President shows much more good grace and political understanding than he has displayed in the last few weeks, and Sheikh Mujib decides how to deal with the strident voices within his ranks or the hopes that arrived with today’s armed convoy will turn into historic bitterness.” (As above)
অন্যদিকে করাচি থেকে কেনেথ ক্লার্ক জানিয়েছেন যে প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফর করাচিতে আশার সঞ্চার করেছে এবং এটা পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার শেষ সুযােগ হিসাবে বিবেচিত হবে। মনে করা হচ্ছে যে প্রেসিডেন্ট জাতীয় সংসদের অধিবেশন শুরু হওয়া পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমানকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করতে আহ্বান জানাবেন। এতে ক্ষমতা হস্তান্তর বিষয়ক আওয়ামী লীগের দাবি মেনে নেওয়া হবে এবং তাদের পক্ষে সংসদে যােগ দেবার পক্ষে আর কোনাে বাধা থাকবে না।’
কেনেথ তার প্রতিবেদনে স্পষ্টভাষায়ই বলেছেন যে ‘পশ্চিম পাকিস্তানের অগ্রগণ্য। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব জুলফিকার আলী ভুট্টোর আবির্ভাব সম্ভবত পাকিস্তানের ঐক্যসংহতি বিনষ্ট করার জন্যেই। গত রবিবার করাচির এক সমাবেশে তার বক্তৃতায় জাতিকে বিভক্ত করার ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তার মতে পূর্ব-পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের হাতে এবং পশ্চিমাঞ্চলে পিপিপি’র হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হওয়া উচিত। পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদলের নেতাদের মধ্যে এ বক্তব্য ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। তারা বলেছেন যে জনাব ভুট্টো সীমান্ত প্রদেশ ও বালুচিস্তানের প্রতিনিধি নন, সে হিসাবে গােটা পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে কথা বলার অধিকার তার নেই, প্রতিনিধিত্ব তাে নয়ই’ (দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ, ১৭.৩,৭১)।
(“A leading political figure in West Pakistan Mr. Zulfikar Ali Bhutto is emerging as the man most likely to destroy Pakistan’s unity. The effect of his speech to a rally here was a proposed division of the nation, with power going to the Awami League in the East, and his People’s Party in the West. Minor political leaders were angered pointing out that Mr. Bhutto does not speak for tw
o of West Pakistan’s provinces, Baluchistan and North-West Frontier.” The Daily Telegraph, 17 March, 1971)
কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যে ভুট্টোকে কোনােভাবেই মাঠের বাইরে রাখতে চান। না, পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যালঘু দলের নেতাদের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও প্রেসিডেন্টের
আলােচনায় তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মি, ভুট্টোর দ্বিপাক্ষিক ক্ষমতা হস্তান্তর বিষয়ক প্রস্তাবের বিরুদ্ধ প্রতিবাদ জানাতে ভুট্টো-বিরােধী নেতাদের প্রায় সবাই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে দেখা করেছেন। যেমন বালুচ নেতা নওয়াব আকবর খান বুগতি, মেজর জেনারেল (অব.) সরফরাজ খান (পিডিপি নেতা) থেকে মিয়া তােফায়েল মােহাম্মদ (জামায়াত নেতা), মাহমুদুল হক উসমানি (ওয়ালি ন্যাপ), এয়ার মার্শাল আসগর খান, পাখতুন নেতা ওয়ালি খান (ন্যাপ) প্রমুখ নেতা ভুট্টোর ভূমিকার নিন্দা করেই ক্ষান্ত হন। নি, এরা সবাই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে অনুরােধ করেছেন সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে, সার্বভৌম গণপরিষদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে। এমন কি কাউন্সিল মুসলিম লীগের মিয়া মমতাজ দৌলতানাও ভুট্টোর নয়া প্রস্তাবের বিরােধিতা করে বলেন যে পাকিস্তান একক রাষ্ট্র, এখানে দুই প্রধান দলের হাতে দুই অঞ্চলের জন্য ক্ষমতা। হস্তান্তরের কোনাে প্রশ্ন ওঠে না, বরং সব পার্টি মিলে ঐকমত্যের সরকার গঠন। করতে পারে (ডন, করাচি, ১৫-১৭ মার্চ, ৭১)। | এতসব সত্ত্বেও সবার দৃষ্টি যখন ঢাকায় ইয়াহিয়া-মুজিব সংলাপের সুফলের দিকে তখন করাচি থেকে ১৯ মার্চ পিটার হ্যাজেলহা জানাচ্ছেন যে “আলােচনার সুবিধার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া একাধিক প্রস্তাব সামনে রেখেছেন। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য দুই অঞ্চলের নেতাদের নিয়ে সামরিক শাসনের তত্ত্বাবধানে সংবিধান রচিত না হওয়া পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকার গঠন। এ ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টের ইচ্ছা দুই নেতা মিলে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করবেন, এবং এরপরই প্রদেশগুলােতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে।’ | ‘শেখ মুজিবুর রহমান তার দেওয়া চার পূর্বশর্ত মেনে নেওয়া সাপেক্ষে প্রেসিডেন্টের প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়েও ভুট্টোর বদলে পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যালঘু দলগুলােকে সঙ্গে নিয়ে সরকার গঠনে অধিকতর আগ্রহী বলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে জানিয়েছেন। কিন্তু ভুয়ো শেষােক্ত প্রস্তাব বাতিল করে দিয়েছেন এই বলে যে দুই অঞ্চলের দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ দল মিলে সরকার গঠন করবে এমনটাই যুক্তিসঙ্গত (দ্য টাইমস, ২০ মার্চ, ১৯৭১)। C…in any event the Sheikh is adamant that he will request an interim government with the support of the minority parties in the Western wing who support his party’s policies. In other words, there would be no place for Mr. Bhutto and his People’s Party. …Mr. Bhutto has rejected such a proposal and is insisting on a formula under which the two majority parties of both wings would form the interim government.” The Times, 20 March, 1971)। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াও এ বিষয়ে ভুঠোর মতামতকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন পশ্চিমের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধান হিসাবে। | ‘ঢাকা সংলাপে সঙ্কট মােচনের সর্বসম্মত ফর্মুলা খুঁজে না-পাওয়ার কারণে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আবারও সংসদ অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত ঘােষণা করেছেন। ভুয়ো, শেখ মুজিব ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এই ত্রিপক্ষীয় আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতেই অধিবেশন স্থগিত করার ঘােষণা’- জানিয়েছেন করাচি থেকে পিটার হ্যাজেলহাস্ট, ‘টাইমস’ পত্রিকায়। উদ্দেশ্য যাতে দুই নেতার মতপার্থক্য আরাে আলোচনার মাধ্যমে কমে আসার মতাে সুযােগ তৈরি হয়। কিন্তু এ মতভেদ যে দূর হবার নয় এটা না বােঝার মতাে ছিল না। তা সত্ত্বেও চলেছে সংলাপের অভিনয়।
‘পরদিন ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস। এক ধরনের অনিশ্চয়তা ও সংশয়ের মধ্যে পাকিস্তান দিবস পালিত হতে যাচ্ছে পাকিস্তানের দুই অংশে দুই ভাবে। পূর্ব-পাকিস্তানে বাঙালিরা দিনটিকে ৩১তম লাহাের প্রস্তাব দিবস হিসাবে পালনের পরিকল্পনা নিয়েছে যে-প্রস্তাবের মূল কথা ছিল দুটো স্বাধীন মুসলমান রাষ্ট্রের ফেডারেশন হিসাবে পাকিস্তান গঠন। কিন্তু পশ্চিম-পাকিস্তানিরা এ দিনটিকে শক্তিশালী কেন্দ্রভিত্তিক পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র দিবস হিসাবে পালন করছে। এ উপলক্ষে ঢাকায় শেখ মুজিবুর রহমান লাহোর প্রস্তাবের দাবি উল্লেখ করে বলেছেন যে ‘বুলেট বেয়নেট গুলি দিয়ে ৭ কোটি বাঙালিকে স্তব্ধ করে রাখা যাবে না, আমাদের ন্যায্য দাবির জয় হবেই। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেছেন যে বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কট থেকে উদ্ধারের একটা পথ খুঁজে পাওয়া যাবেই। অনেক অবাঞ্ছিত ঘটনা ইতােমধ্যে ঘটেছে, তবু সব শেষ হয়ে যায় নি। | দু’দিন পর মধ্যরাতে আক্রমণের পরিকল্পনা যেখানে সম্পূর্ণ সে ক্ষেত্রে এ ধরনের আশার বাণী শােনানাে রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষে নিশ্চয়ই শঠতা ও আত্মপ্রতারণার শামিল। পঁচিশে মার্চ মধ্যরাতের পরিকল্পনা শুধু প্রেসিডেন্টেরই নয়, সম্ভাৰত জানা ছিল জুলফিকার আলী ভুট্টোরও। তবু তারা সংলাপের মাধ্যমে সঙ্কট থেকে উত্তরণের ফর্মুলা ৰোজার ভান করেছেন। আর সেই মঞ্চ-অভিনয়ের সঙ্গী হয়েছেন বাঙালি নেতারা। ঢাকা থেকে একই প্রতিবেদনে প্রকাশ, “আওয়ামী লীগের জঙ্গি সমর্থকদের জন্য ২৩ মার্চ হবে প্রতিবাদ দিবস এবং সেদিন বাড়িতে বাড়িতে নতুন বাংলাদেশের পতাকা উড়বে এটাই তাদের দাবি’ (দ্য টাইমস, ২৩ মার্চ, ১৯৭১)। এরপর কি পরিস্থিতি বুঝে নিতে কারাে বাকি থাকার কথা? বাঙালি রাজনীতিকরা আশার ঘােরে, স্বপ্নের ঘােরে থাকলেও সাদাচোখের বিদেশী সাংবাদিকদের চেতনায় কিভাবে ইয়াহিয়ার কথাবার্তায় ঘাের লাগতে পারে সেটাই ভেবে পাওয়া যায় না। তবে তাদের মধ্যে কেউ কেউ এর মধ্যেও ভিন্ন ছবি তুলে এনেছেন। সেখানেও ঐ বাস্তবতারহিত স্বাপ্নিক আদর্শবাদের ঘাের। সাংবাদিক মার্টিন অ্যাডনি তেমন একটা ছবি এঁকেছেন গার্ডিয়ান পত্রিকার পাতায় বাংলা বয়েজ’ শিরােনামে (২৩ মার্চ, ১৯৭১)।
ছবিটা গ্রামীণ। ঢাকা থেকে ২০ মাইল দূরে (ফেরি পার হয়ে যেতে হয়) প্রায় ৫০টি গ্রাম নিয়ে আমিনপুর ইউনিয়নে ছাত্র ও গ্রামবাসীদের চেষ্টায় তৈরি স্বাধীন বাংলার মডেল এলাকা, তাদের ভাষায় মুক্ত এলাকা। তারা সেখানে সংগ্রাম কমিটি তৈরি করেছে। প্রতিরােধ সংগ্রামের জন্য। প্রদেশব্যাপী এ ধরনের সংগ্রাম কমিটি গড়ে তােলার ইচ্ছা রয়েছে তাদের। তাদের লক্ষ্য স্বাধীন বাংলাদেশ। ছাত্রদের কাছে এর প্রয়ােজন বাস্তবভিত্তিক অর্থাৎ চাকরি, ব্যবসা ইত্যাদি ঘিরে জীবিকার জন্য যা এখন খুবই সংকুচিত। তাদের স্লোগান সহজ সরল বাঙালি জাতীয়তাবাদের হলেও এর বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা, যে-সমাজতন্ত্র পূর্ববাংলার আবহাওয়ায় তৈরি। ছাত্র ও গ্রামবাসীরা তাদের দেশী অন্ত্র অর্থাৎ লাঠি তীর ধনুক বর্শা বল্লম দিয়েই পাকিস্তানি সেনাদের মােকাবেলা করার কথা ভেবে রেখেছে। ভেবে দেখে নি যে পাক-বাহিনী কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তাদের দু
ধ্বংস স্তুপে পরিণত করতে পারে (দ্য গার্ডিয়ান, ২৩.৩,৭১)। আমাদেরও জানা নেই। একাত্তরে পাক-বাহিনীর আক্রমণে আমিনপুরের কী অবস্থা হয়েছিল।
মাটিনের আঁকা ছবিটা ছিল প্রতীকী অর্থে তাৎপর্যপূর্ণ। বাঙালি আবেগ ও আকীক্ষার সঙ্গে অপরিণামদর্শী রাজনৈতিক বিচার-বিবেচনার প্রতীক এ ছবি। বাঁশের লাঠি দিয়ে মেশিনগানের আক্রমণ ঠেকানাের চিন্তা। এ যেন বাঁশের কেল্লা গড়ে বিদেশী কামানের আক্রমণ ঠেকানাের চেষ্টা। স্বাধীনতার জন্য রাজনৈতিক ও বাস্তবিক প্রস্তুতি না থাকা। সত্ত্বেও পাকিস্তানি শাসনের টানাপােড়েনে তাদের কথা ও কাজের বৈষম্যে জনমনে যে। হতাশা ও ক্ষোভের সৃষ্টি, তারই পরিণতি স্বাধীনতার এক দফা স্লোগান। নেতার পক্ষে কঠিন হয়ে উঠেছিল সে স্রোত ধরে রাখা বা তা নির্ধারিত পথে টেনে নিয়ে যাওয়া। মার্চ মাসের সপ্তাহ তিন ধরে পরিস্থিতি এমনই টানটান ছিল। অনিশ্চয়তা সংশয়, হতাশা আর আকাক্ষা নিয়ে। পরিস্থিতি সম্পর্কে ঢাকা থেকে ‘টাইমস’ পত্রিকায় বিশেষ সংবাদদাতার পাঠানাে ভাষ্য। নিবন্ধের শিরােনাম ‘বাঙালিরা যে কোনাে উপায়ে স্বাধীনতালাভের জন্য প্রস্তুত।’ সঙ্কটে আক্রান্ত, দুর্যোগের ছায়ায় আচ্ছন্ন তখনকার অবস্থা সম্পর্কে পল মার্টিন লিখেছেন : ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জঙ্গি ছাত্রদের তত্ত্বাবধানে ছাত্রদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ চলছে। কোনাে কোনাে গ্রামে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তোলা হচ্ছে— উদ্দেশ্য এরই ভিত্তিতে ভবিষ্যতে গণবাহিনী সংগঠিত করা যাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মােকাবেলা করা যায়।’
(“In the grounds of Dacca University radical groups have started training students in the use of fire arms.” The Times, 25 March, 1971) ছবিটা আপাতবিচারে উদ্ভটই ঠেকবে যেমন ঠেকেছে বিদেশী সাংবাদিকের চোখে। কারণ আর কিছু নয়, শেষ মুহূর্তে এ ধরনের চেষ্টা অপরিণত চিন্তার পরিচায়ক। কথাটা বলেছেনও ঢাকা থেকে ‘টাইমস’ পত্রিকার বিশেষ সংবাদদাতা পল মার্টিন তার প্রতিবেদনের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে। | পল ঠিকই বলেছেন: গত কয়েক সপ্তাহের রাজনৈতিক তৎপরতার ফলে রাতারাতি তৈরি পরিকল্পনা অপরিণত হওয়াই স্বাভাবিক, সেনাবাহিনীর সুশৃঙ্খল তৎপরতা সে। ক্ষেত্রে আশা করা যায় না। তবু ঘটনাই এ অবস্থা সৃষ্টি করেছে। দেশের বিচার বিভাগ, প্রশাসন এবং জনগণের একাট্টা সমর্থন সত্ত্বেও শেখ মুজিবুর রহমান যদিও স্বাধীনতা শব্দটির বদলে মুক্তিসংগ্রামের কথা বলেছেন এবং (ঘরে বাইরে) বলছেন, তবু গত কয়েক সপ্তাহের ঘটনা অনিবার্যভাবে প্রদেশটিকে স্বাধীনতার পথে দৃঢ়ভাবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। শেখ মুজিবের আন্দোলন যদিও পূর্ব-পশ্চিমের বৈষম্য নিরসনের উদ্দেশ্যে সংগঠিত তবু এর অবশেষ পরিণাম ‘বাংলাদেশ’ অর্জনের পথ ধরেছে। জনৈক স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার বক্তব্যে বিষয়টি স্পষ্ট। তার ভাষায় ‘ছয় দফার লক্ষ্য ছিল ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তান-কাঠামােয় পূর্ববাংলার ন্যায্য অধিকার আদায় । কিন্তু গত তিন সপ্তাহের ঘটনা পূর্ব-পশ্চিমের জন্য স্থায়ী বিচ্ছেদের পথই তৈরি করে দিয়েছে।’ (“That such ideas remain half-baked is the result of the movement in East Pakistan having matured overnight from a protest strike to a fully pledged and well-disciplined civil disobedience campaign bordering on a unilateral declaration of independence. …Although Sheikh Mujibur has at all times carefully avoided the word ‘independence’ stopping short at ’emancipation of Bengal’ in both his public and private utterances, there is no doubt that the events of the past weeks have set the province firmly and irreversibly on the path of independence. Indeed, if Sheikh Mujibur’s movement had aimed at the correction of the imbalance in the two wings of Pakistan, its offspring has been the realisation of Bangladesh.
(“The six-point programme was a formula for getting our due while remaining united within the context of Pakistan’, one Bengali political leader told me. However, the past three weeks have faced the east and west wings with the problem of how best to get out of each other’s hair once and for all.” ‘Bengalis prepare to get independence by Any Means’, The Times 25 March, 1971) | ঐ বক্তব্যের সূত্র ধরে পল মার্টিন উল্লিখিত মনােভাবের পেছনে নিহিত আর্থসামাজিক কারণ ঠিকই শনাক্ত করেছেন। তার চোখেও দুই পাকিস্তানের আর্থ-সামাজিক বৈষম্য খুবই প্রকট। একদিকে সমৃদ্ধি সচ্ছলতা অন্যদিকে জীর্ণদশা ও দারিদ্র। শিক্ষিত শ্রেণীর জন্য জীবিকার উপায় যথেষ্ট নয়। শিল্প ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এ প্রদেশ পশ্চিমের তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছে। স্থানীয় অর্থনীতিবিদগণের মতে এ পিছিয়েপড়া ৬০ শতাংশেরও বেশি। সর্বশেষ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বৈষম্য কমিয়ে আনার চেষ্টা সত্ত্বেও পূর্ববর্তী উন্নয়ন খাতের বৈষম্যের জের (৭০:৩০ অনুপাত) কাটতে এখনাে অনেক পথ। হাঁটতে হবে। | বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এসব কারণেই স্বাধীন বাংলাদেশ-এর ধারণা জন্ম নিয়েছে। পল মার্টিনের ধারণা, যদি ছয় দফা বা স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের আলােচনায় কোনাে ফলপ্রসূ সমঝােতা দেখা দেয় তবু গত তিন সপ্তাহে উচ্চারিত স্বাধীনতার আহবান তাতে সন্তুষ্ট হওয়ার কথা নয়। (দ্য টাইমস, ২৫ মার্চ, ১৯৭১)। এ বিচার-বিবেচনা সাংবাদিকের পরিণত মানসিকতার প্রমাণ দেয়। | কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইয়াহিয়া-মুজিব আলোচনা ভেঙেই গেল, এবং সেটা বােঝা গেল ২৫ মার্চ রাতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার গােপনে ঢাকা ত্যাগ করার ঘটনায়। ভুট্টো সাহেব অবশ্য ঢাকা ছেড়েছেন পরদিন অর্থাৎ ২৬ মার্চ সকালে, সামরিক বাহিনীর সফল অপারেশন দেখে নিয়ে। আসলে সঙ্কট নিরসনের সংলাপ ছিল নামেই সংলাপ। শেষমুহূর্ত পর্যন্ত ভুট্টো সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলে গেছেন আলােচনা সন্তোষজনক, আলােচনায় অগ্রগতি হচ্ছে’ ইত্যাদি। তবে তার অভিযােগ, আওয়ামী লীগ সরাসরি তাদের সঙ্গে আলােচনায় বসছে না, তাদের আগ্রহ সত্ত্বেও বসছে না। আলােচনা চলছে প্রেসিডেন্টের মাধ্যমে ত্রিপাক্ষিক ধারায় । তার ভাষায় : ‘আওয়ামী লীগের চার দফা শর্ত মেনে নিয়েই ছয় দফার কাছাকাছি যেতে চেষ্টা করছি’ (দ্য পাকিস্তান টাইমস, লাহাের, ২৬ মার্চ, ১৯৭১)।
ভুট্টো কথাগুলাে বলেছেন ২৫ মার্চ দিনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে। আর সেদিনই মধ্যরাতে বাঙালি ছাত্র-জনতার ওপর পাক-সেনাবাহিনীর সুসংবদ্ধ আক্রমণ। সামরিক বাহিনীর তরফ থেকে এ ধরনের আক্রমণের জন্য সময়সাপেক্ষ প্রস্তুতির দরকার পড়ে। হুট করে আক্রমণ পরিচালনা করা যায় না। কাজেই যুক্তিসঙ্গত ভাবেই বলা চলে যে ২৫ মার্চ সারাদিনভর আলােচনা চালিয়ে যাবার পেছনে কোনাে সদিচ্ছা ছিল না, ছিল জনসমক্ষে বিশ্ববাসীর কাছে সদিচ্ছার পরিচয় তুলে ধরা এবং সেই সঙ্গে তাদের সমরসজ্জা সম্পূর্ণ করা। কিন্তু আওয়ামী লীগ সঙ্কট নিরসনের প্রত্যাশা নিয়েই শেষমুহূর্ত পর্যন্ত আলােচনা চালিয়ে গেছে। | রাজনীতিতে অনেক সময় চাতুর্য ও বিচক্ষণতার সঙ্গে শঠতার মিলন ঘটতে দেখা যায়। এ ক্ষেত্রেও অর্থাৎ ঢাকা-সংলাপেও তাই ঘটেছে। দুই যুগেরও কিছু আগে পরিণতবুদ্ধির অভিজ্ঞ বাঙালি রাজনীতিক গুজরাতি চাতুর্যের কাছে হেরে গিয়েছিলেন, একাত্তরেও অনুরূপ ঘটনার প্রকাশ। এবার অবশ্য সিন্ধি-চতুরতার কাছে বুদ্ধির খেলায় বাঙালি রাজনীতির পরাজয়। চল্লিশের দশক পেরিয়ে সত্তরের দশকের শুরুতে পৌছে সংঘটিত বিপর্যয় প্রমাণ করে যে আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতে অভ্যস্ত নই। তাই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ভিন্ন পরিবেশে, সময়ের ভিন্নতায়। | ইয়াহিয়া-মুজিব-ভুট্টো আলােচনা যখন সমঝােতায় পৌছাতে পারছে না (পারার কোনাে কারণ ছিল না) তখন ক্ষুব্ধ, হতাশ বাঙালি জননেতার সামনে তুলে ধরা হল আইনি মারপ্যাচের জটিলতায়ভরা এক রাজনৈতিক প্রস্তাব যা দুই দিকে কাটতে পারে। এর ভিত তৈরি করেছিলেন ভুয়ো প্রকাশ্যে তার অবশেষ বিবৃতিতে। ‘ডন’ পত্রিকায় ১৫ ও ১৬ মার্চ প্রকাশিত ঐ বিবৃতিতে জনাব ভুট্টো স্পষ্টই সঙ্কট নিরসনের উপায় হিসাবে প্রস্তাব করেছিলেন পূর্বে ও পশ্চিমে একই সঙ্গে সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে আলাদা আলাদাভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য।
ভুট্টোর ঐ বিবৃতির এবং পরে উত্থাপিত ইয়াহিয়া-ভুট্টো প্রস্তাবের ঘাের বিরােধিতা করেন ওয়ালি খান থেকে আসগর খান-এর মতাে পশ্চিম পাকিস্তানের একাধিক দলের নেতা। তাদের দাবি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের (অর্থাৎ আওয়ামী লীগের) হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং গণপরিষদের অবিভাজিত অধিবেশন আহ্বানের । এককথায় গণতন্ত্রের রীতিনীতি মেনে ক্ষমতা হস্তান্তর । কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তাদের কথায় কান দেন নি। শেষপর্যন্ত সংলাপের টানাপােড়েনে ক্লান্ত, অনিশ্চয়তায় বিরক্ত এবং বিভ্রান্ত আওয়ামী লীগ বলা যায় হতাশায় আক্রান্ত হয়েই সঙ্কট নিরসনের শেষ উপায় হিসাবে ডুটো-ইয়াহিয়ার দ্বিমুখী প্রস্তাব মেনে নেয়। কারাে কারাে মতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ঐ প্রস্তাব গ্রহণ। ভেবে দেখেনি। এ প্রস্তাবের ভালোমন্দ ও অন্তর্নিহিত তাৎপর্য। এভাবেই আওয়ামী লীগ ভুট্টো-ইয়াহিয়ার পাতা ফাঁদে পা দেয়। (রেহমান সােবহান) সত্যি বলতে কি সিন্ধি বুদ্ধির কাছে বাঙালি বুদ্ধি হার মানে।
রাজনৈতিক চাতুর্য ও বুদ্ধির খেলায় বাঙালির হার এই প্রথম নয়। উপমহাদেশের ইতিহাস পাঠকের মনে পড়তে পারে ১৯৪৬ সালে শব্দ নিয়ে অক্ষর নিয়ে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ্র রাজনৈতিক ছল-চাতুরির কথা। ছােট্ট একটি ‘এস’ (‘s’) অক্ষর অথচ কী তফাৎই না করে দিল গােটা বিষয়টার! লাহাের প্রস্তাবে বর্ণিত পাকিস্তানের দুই অঞ্চলে দুই স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের (States) বহুবচনাত্মক ‘এস’ অক্ষরটি জনাব জিন্নাহর কল্যাণে উঠে গিয়ে (‘State’ হিসাবে) অখণ্ড পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। এ গল্পের, গল্প নয় ঘটনার বিস্তারিত অনেকেই জানেন। | সেই থেকে পাকিস্তানে ক্রমান্বয়ী পাঞ্জাবি প্রাধান্যের টানে স্বৈরশাসন হয়ে পূর্বপশ্চিমের মধ্যে সৃষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বৈষম্য ও ব্যবধানই বাঙালি জাতীয়তার প্রেক্ষাপটে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি ৬-দফার উদ্ভব ঘটায়। সেখান থেকে আরাে টানাপােড়েনের ফলে এক-দফার দাবি, বিচ্ছিন্নতার দাবি। এ হলাে জিন্নাহ সাহেবের গুজরাতি চালে লাহাের প্রস্তাবের স্টেটস (States) থেকে ৪’ ছাটাই করে নিয়ে এক গণপরিষদ ও এক পাকিস্তান নিশ্চিত করার অবশেষ পরিণাম । মাঝখানে মাত্র দুই যুগ সময়।
কিন্তু সেই ট্র্যাডিশন, সেই রাজনৈতিক চাতুরির ধারাবাহিকতা সচল। তবে দুই যুগ পরে তার চিত্র বিপরীত। এক পাকিস্তানেরই দুই অঞ্চলে দুই দলীয় শাসনের প্রস্তাব আর সেই সূত্রে গণপরিষদের দ্বিধাবিভক্তি, দুই শাসনতান্ত্রিক কমিটি। মুখে অবশ্য বলা হয়। এক পাকিস্তান কাঠামাের কথা। গােটা প্রস্তাবটাই ছিল ষড়যন্ত্রমূলক যাতে পরে বিচ্ছিন্নতার অভিযােগ আনা যায়। আওয়ামী লীগ তাকে নিয়ে বােনা ঐ যড়যন্ত্রের হদিস পায় নি। তাই ক্ষমতা হস্তান্তরে প্রেসিডেন্ট রাজি হয়েছেন ভেবেই আওয়ামী লীগ মহলে বিস্ময়ের বদলে উল্লাসের প্রকাশ ঘটে (জ্যাকসন)।
কাজেই অঘটন যা ঘটার ঘটে গেল। ভুট্টো-ইয়াহিয়া মহাখুশিতে বাঙালি নেতাদের মাথায় কাঠাল ভাঙার জন্য তৈরি হলেন। আর ঘটনায় অঘটনের তাৎপর্য বুঝতে না পেরে আপাত-প্রাপ্তিতে খুশি আওয়ামী লীগ তার পশ্চিম-পাকিস্তানি সমর্থক বন্ধুদের ভুয়ো পিপিপি নামক নেকড়ের খাঁচায় ফেলে দেয়। ঠিক যেমন করে একদা ভারতীয় কংগ্রেস উপমহাদেশে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়ায় বেসামাল হয়ে সীমান্ত গান্ধিসহ লালকুর্তা পাখতুনদের জিন্নাহ-মুসলিম লীগের নেকড়ের খাঁচায় ফেলে দিয়েছিল। এর ফলে পরে অনেক ভােগান্তি সইতে হয়েছিল পাখতুনদের। আর খান আবদুল গফফার খান তার ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে আলােচনায় ঐ ‘নেকড়ে’ শব্দটাই ব্যবহার করেছিলেন। তবে এবার পাখতুন-বালুচদের কপাল ভালাে যে শেষপর্যন্ত ইয়াহিয়া-চক্রান্তের কারণে তারা বেঁচে গেলেন, আঘাতটা পুরােপুরি পড়ল পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালিদের ওপর। পশ্চিম-পাকিস্তান যথারীতি ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেল। তবু পূর্ব ঘটনার সঙ্গে এখানে প্রভেদ যে আপাত বিল সত্ত্বেও শেষ হাসিটা পশ্চিমা শাসকদের ছিল না।
সূত্র : একাত্তরে পাকবর্বরতার সংবাদভাষ্য – আহমদ রফিক