You dont have javascript enabled! Please enable it!

সীমান্ত থেকে ফিরে
সাগর বিশ্বাস

খলিলুর রহমান আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এই গাড়িতে আমি যেতে পারি কি? বাঙলাদেশগামী ট্রেনটি তখনও অধীর আগ্রহে ইঞ্জিনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরে কয়েক হাজার মানুষ আর মালপত্রে ঠাসাঠাসি। বাইরে লাইনের উপর বসে দাঁড়িয়ে কয়েকশ লােক এপারের এই আধাখানা বাঙলার শেষ প্রান্ত থেকে অনিমেষ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে বাঙলাদেশের দিকে। মুজিবুর রহমান একটি পরিচয়পত্র এগিয়ে দিলেন আমার দিকে। আমি দেখলাম ভার্টিক্যালি ভাঁজ করা একটি নীল রঙের পরিচয়পত্রের উপরেই ‘পাকিস্তান’ শব্দটি ইংরেজিতে লেখা রয়েছে। ভেতরে ভদ্রলােকের একটি পি পি সাইজের ছবি। পাশে হাতে লেখা সার্টিফিকেট সার্টিফায়েড দ্যাট নােন টু মি…মােরাল ক্যারেকটার…ইত্যাদি ইত্যাদি। তলায় দস্তখতটি স্পষ্ট : এ এন চৌধুরী, সেক্রেটারি, মুজিব বাহিনী দৌলতপুর, খুলনা।
কয়েকটি প্রশ্ন করে জানতে পারলাম মিঞাসাহেব এক বন্ধুকে নিয়ে ৩০ ডিসেম্বর কলকাতায় এসেছিলেন, ৪ঠা জানুয়ারি ফিরে যাচ্ছেন। কলকাতা দেখতে এসেছিলাম। পরিবারের সকলেই শিরােমণি (খুলনা) রয়েছে। বােমা আর গুলিবর্ষণে নাকি শিরােমণি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে সবাই মিলে সেখানে ছিলেন কী করে?
তখন তাে ছিলাম না।
কয়দিন হইল আবার আইছি।
তা কলকাতা কেমন লাগলাে?
বালাে, খুব বালাে লাগছে।
তা এত তাড়াতাড়ি আপনার কলকাতা দেখা হয়ে গেল?
হ। বালােই দেখছি। আবার আসাও যাবে।
তা বটে। আসতে আর বাধা কী? কিছুক্ষণ আগে খুলনার একজন ব্যবসাদার মােহাম্মদ মল্লিকের সাথে কথা বলেছিলাম। তিনিও নাকি দেখতে এসেছিলেন আগেরদিন। জর্দা আর লক্ষীবিলাস তেল নিয়ে বাড়ি যাচ্ছেন। একদিনও নয়, একবেলাতেই তার কলকাতা দেখা হয়ে গেছে। তার সঙ্গেও সম্ভবত একটি পরিচয়পত্র ছিল। তাঁর মুখেই আমি শুনেছিলাম ৪৫১ জন বাঙালির ঘাতক কুখ্যাত গফুর গুণ্ডা মুক্তিবাহিনীর হাতে বন্দি। গুণ্ড মতিউলের বড় ছেলে খতম। কিন্তু সে কথা থাক। আমি ভাবছিলাম অন্য কথা। ভাবছিলাম সেই কয়েকটি বঙ্গ-সন্তানের কথা যারা বাঙলাদেশ মুক্তি হবার সঙ্গে সঙ্গে অতি উৎসাহে ও আনন্দে কলকাতা থেকে যশাের গিয়েছিল, যারা সেখানে নিজেরা রান্না করে খেয়েছিল, যারা আমাদের মহান সেনাবাহিনীর লােক কর্তৃক ধৃত হয়েছিল এবং রক্তের বিনিময়ে অর্জিত’ বাঙলাদেশের পবিত্র মাটিতে রান্না করে খাবার (অথবা পিকনিক করার) অর্বাচীনতার জন্য যারা সৈনিকের ধিক্কার গলাধঃকরণ করেছিল। বাঙলাদেশে তাে অনেকেই গিয়েছিল। কিন্তু অমন উপদেশাবলী আর কারাে ভাগ্যে জুটেছে কিনা আমি জানি না।
যাহােক সেই বিশেষ শরণার্থী ট্রেনে খলিলুরের যাওয়া সম্ভব কিনা তা রেলের লােকদের নিকট জিজ্ঞেস করতে বলে আমি লাইনের দিকে পা বাড়ালাম।
না, পত্রিকায় ফটোগ্রাফারের মতাে গাড়ির প্রতিটি জানলায় হাসির বন্যা আমার চোখে পড়লাে না। কী জানি এটা দৃষ্টিবিভ্রম না আমার অন্ধতা? মানুষের মধ্যে কেবল পুঞ্জীভূত কান্নাই দেখে গেলাম। লাইনের উপরে দাঁড়িয়েছিল ফরিদপুর জেলার বােয়ালমারির নিত্যানন্দ বিশ্বাস। ছিল ২৪ পরগনার বেড়ী পাঁচপােতা শবিরে। বলল খুব বিপদে পড়েছে। একখানা কাগজ দেখালাে। দেখলাম ক্যাম্প থেকে ২১ থেকে ২৬ ডিসেম্বরের ডােল দিয়ে সমস্ত কাগজপত্র তার কাছ থেকে নিয়ে তাকে রিলিজ করা হয়েছে। কিন্তু তার দলের লােকদের নাকি চেক পােস্ট থেকে ফেরত পাঠানাে হয়েছে, তখন পর্যন্ত ফরিদপুরের লােক পাঠানাের নির্দেশ নেই বলে। সেদিন জানুয়ারির ৪ তারিখ । এদিকে যে এক সপ্তাহের ডােল পাওয়া গিয়েছিল তা খাওয়া হয়ে গেছে। অথচ ওর পাবার কথা দু সপ্তাহের খাদ্য। ক্যাম্পেও আর ঢুকতে দেবে না। ওর দু চোখের সামনে অন্ধকার। সেই অন্ধকারের মধ্যে আমি বােয়ালমারির নিত্যানন্দ বিশ্বাসের কান্না দেখলাম।
পরদিন যখন কয়েকটি ক্যাম্প পরিদর্শন করলাম তখন শুনলাম এ ধরনের ঘটনা অনেক ঘটেছে। ডােল দেওয়া নিয়ে শরণার্থীদের মনে অনেক বিক্ষোভ। শীতবস্ত্রের ব্যাপারেও কর্মচারীদের উদাসীনতা, পক্ষপাতিত্ব এবং দুর্নীতির অনেক অভিযােগ শুনতে পেলাম। চাদপাড়া ক্যাম্পে গিয়ে শুনলাম সেখানকার ৬০ শতাংশ শরণার্থীই কোন কম্বল পায়নি। অসংখ্য লােককে কর্তৃপক্ষ কম্বলের পরিবর্তে চট দিয়েছেন। অসংখ্য নারীপুরুষের হাতে আমি সেই চট দেখেছি। ক্যাম্প কমান্ডান্ট এবং স্থানীয় বি. ডি. ওর মুখে শুনলাম, ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ৬৭০০০ শরণার্থী অধ্যুষিত এই ক্যাম্পের ২৫০টি পরিবারকে বাঙলাদেশে পাঠানাে হয়েছে। এক্ষুনি তৈরি হয়ে আছে অন্তত ৫০০ পরিবার। কিন্তু পাঠাবার উপযুক্ত ব্যবস্থাপনার অভাবে দৈনিক ৫০টি করে পরিবার পাঠানাে হচ্ছে কেবলমাত্র যশােহরে।
সাম্প্রতি শরণার্থী শিবিরে কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে হিসাব পরীক্ষা (অডিট) শুরু হয়েছে। বহু শরণার্থী শিবিরের দুর্নীতির খবর পাওয়া যাচ্ছে। সীমান্তের শিবিরগুলাে পরিক্রমা করতে গিয়ে দেখলাম সর্বত্রই কেমন একটা কথা বলবাে না ভাব। কালুপুর ক্যাম্পের কমান্ডান্ট শ্রী সুকুমার বসু তাে স্পষ্টই বললেন ‘এস, ডি, ও-র সঙ্গে পরামর্শ করে দেখি আপনার সঙ্গে কথা বলা উচিত কিনা। আপনি পরে আসবেন।
বনগাঁর মাদ্রাসা ক্যাম্পের লােকসংখ্যা ছিল ১০০০ এর সঙ্গে হঁটখােলা ক্যাম্পের ২৪০০০ শরণার্থী যুক্ত হয়েছে। গত ২ জানুয়ারি ১০০ এবং ৪ জানুয়ারি ৪৪টি পরিবারকে যশাের পাঠানাে হয়েছে। ভারত সেবাশ্রম সঙ্রে স্বামীজী, বনগাঁয় থাকতে যার সম্পর্কে নানাপ্রকার অপ্রীতিকর কথা শুনেছিলাম, তিনি যশাের গিয়ে ত্রাণ শিবির খুলেছেন শুনলাম।
সীমান্তে অপেক্ষমান বাঙলাদেশগামী ট্রেনের পাশ দিয়ে আমি হেঁটে চলেছি। দেখলাম লাইনের উপর লুঙ্গি পরে বিরসবদনে বসে আছে একজন লােক। মােহাম্মদ গােলাম নবী। যশােরের চাঁচড়ার মােড়ে খানসেনাদের সঙ্গে ভারতীয় বাহিনীর প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়েছিল, যার ছবি এবং বিবরণ বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। সেই যুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠবার পূর্ব মুহর্তে গােলাম নবী স্ত্রী আর পাঁচটি ছেলে-মেয়েকে নিয়ে। কোনমতে বসিরহাটের শ্রীরামপুরে এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে এসে উঠেছিলেন। পরে এসেছেন বলে শরণার্থী শিবিরে জায়গা হয়নি। প্রায় দেড়মাস অসহনীয় কষ্টের পর আজ আবার নিজের গ্রামে ফিরছেন। গিয়ে কী হবে জানেন না। পকেটে মাত্র দুই টাকা আর কিছু খুচরাে পয়সা। জিজ্ঞেস করলাম আগের দিকে আসেননি কেন?
বিষন্ন চোখে তাকিয়ে গােলাম নবী বললেন,—ভাবছিলাম য্যাদ্দিন থাকা যায় থাকবাে। তাই আগে আসি নাই। কিন্তু গুলি-গােলার মধ্যে আর থাকা যায় ক্যামনে? তাই আসতে হলাে। পােলাপানগুলাে বাইচে আছে এই এখন শান্তি। ঘর বাড়ি আল্লায় দিলে আবার হবে।
রাস্তায় আসতে আসতে একজনকে দেখলাম যার পােলাপানগুলা বেঁচে আছে কিনা সে জানে না। রাস্ত র পাশে দু-খানা শাড়ি টাঙিয়ে তার মধ্যে বসে ভাত খাচ্ছে। চার দিকে প্রচণ্ড ভীড়। রােগীর লাইন পড়ে গেছে। নতুন কাপড়, ফলমূল, টাকা, সর্বোপরি বিরাট বিরাট মাটির জালা ভর্তি ভাত-মাছ-তরকারি চারিদিকে সাজানাে। রােগী দেখে কোন ওষুধ উনি দেন না। রােগীকে পাচসিকি, পাঁচ টাকা, বা সােয়া দশ
জরিমানা করেন। আর প্রতিদিননের আহার্য, ব্যস। খুব কৌতূহল হলাে। এমন বিচিত্র চিকিৎসা পদ্ধতি জীবনে দেখিনি। ভয়ে ভয়ে বললাম, খালাম্মা, একটু কথা বলব?
মহিলা রেগে গেলেন।—পুরুষ মানূসের সাথে আবার কিসের কথা কব?
না খালাম্মা, আমি আপনার দ্যাশের লােক। আপনি কবে আইছেন?
আইছি কয়মাস অইছে।
আপনার গেরাম ছিল কনে?
রামপাল থানায়।
দ্যাশে যাবেন না কি?
যাবাে না ত তােমাগে দ্যাশে থাইক্যা মরবাে নাকি?
তাইলে আপনার রুগীদের কি হবে?
তার আমি কি জানি?
খালাম্মা, আপনার নামটা বলবেন? কইলকাতা যাইয়া সগলরে কমু আপনার কথ?
নাম ক্যান্? মাইয়া লােকের নাম দিয়া তােমার কাম্ কি?
আমি পালালাম। ভাবতে ভাবতে এলাম এও সম্ভব? যারা লাইন দিয়েছে তারা কোন্ জগতের জীব ভেবে পেলাম না। প্রতিদিন এত টাকা আর আহার্য মহিলাটি কি করছেন কে জানে?
সীমান্ত অঞ্চলে আর একটা দৃশ্য অনেকবার নজরে পড়েছে। জনতার হাতে রাজাকার বলে কথিত ব্যক্তিদের নিগ্রহ। সত্যই রাজাকার কিনা তা প্রমাণ করবার ঝুঁকি এবং কষ্ট স্বীকার করতে প্রায়শঃই জনতাকে দেখিনি। গােবরডাঙ্গা স্টেশনেই একদিন একটি লােক ‘আমি এখান কার লােক বলে বারবার চীৎকার করলেও জনগণ স্তব্ধ হলাে না। গলায় মালার পেচিয়ে একদল যুবক তাকে উত্তম-মাধ্যম দিল । খানিক পরে ভিড়ের মধ্যে ধৃত লােকটির চীৎকার শােনা গেল আমার পকেট থেকে সব টাকা নিয়ে গেছে। এরপর সেই যুবক কটিকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না।
যতগুলাে শরণার্থী শিবির ঘুরেছি সর্বত্র দেখলাম প্রত্যেকে বাঙলাদেশে ফিরে যাবার জন্য উদগ্রীব। তবু প্রত্যেকর মনে একটুকরাে অজানা আশঙ্কা ! অনেক প্রশ্ন—আমরা ঘরবাড়ি পাব তাে? আবার আগের মতাে কাজ-কর্ম হবে তাে? হলে কতদিন হবে? ইত্যাদি। লবণ হ্রদের এক ভদ্রলােক বললেন, আমরা তাে যাবার জন্য তৈরি আছি। কিন্তু ডাক হচ্ছে না।
তবু কিছু লােক আছে যারা এক্ষুনি যেতে চায় না। যেমন গৃহহীন ভূমিহীন দিনমজুর যাদের মজুরি করেই পেট চালাতে হয় তারা ভাবছে ওখানে গেলেও মজুরি করতে হবে, এখানেও মজুরি করলে পেট চলবে। এদের মধ্যে আবার বেশি সংখ্যকের চিন্তা এইরকম : যা করব, নিজের দেশেই করব। যেতে চায় না এরকম আর কিছু লোেক আছে যারা এই দশ-এগারাে মাসের মধ্যে কোন ছােটখাট ব্যবসা বা চাকরি করে কিছুটা দাঁড়িয়ে গেছে, তারা পরিবারের অন্যান্যদের ওখানকার বাড়ি বা জমিজমা দেখার জন্য পাঠিয়ে দিয়ে নিজেরা এখানে থেকে দুদিকে দুটো এশটাব্লিশমেন্ট প্রতিষ্ঠা করতে ইচ্ছুক।
মাধ্যমগ্রাম থেকে এসেছিল চণ্ডীদাস বণিক আর সাঁজিরহাট ক্যাম্প থেকে সুশান্ত সেন। একজন ঢাকা, অন্যজন বাগেরহাট গেল পরিস্থিতি দেখতে। পরিবারের অন্যান্যরা সব এপাশে রয়ে গেল।
বনগাঁ প্লাটফর্মে গেছিলাম একদিন। সেই এপ্রিললের দৃশ্য দেখলাম আবার। তবে পালাটা অন্য। সেবার ছিল আসার, এবার ফেরার ভিড়ের মধ্যে অনেকে সঙ্গীহীন হয়ে পড়ছে। চান্দা ক্যাম্পের নির্মলা তার শাশুড়িকে খুঁজে পেলাে না। উল্টাডাঙ্গা থেকে নিশ্চয়ই ট্রেনে উঠতে পারেনি বলে মনে হলাে। নির্মলাকে ওর ক্যাম্পে পৌছাবার পথের নির্দেশ দিলাম।
বাঁকুড়া ক্যাম্প থেকে সপরিবারে এসেছে বরিশালের বিমল মিস্ত্রী। স্টেশনে মানা থেকে এসে পৌঁছেছে একটি শরণার্থী ট্রেন বাঙলাদেশে যাবে। কিন্তু এ ট্রেনে ওদের নাকি উঠতে মানা। অথচ ভিড় ছিল না বেশি। ওরা যেতে পারতাে।
দেখা হলাে নরেন সরকারের সঙ্গে। যাবে টুঙ্গিপাড়া—যে টুঙ্গিপাড়া বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের গ্রাম। নরেন বলল, মুজিব আমার বাবার ছাত্র ; বলে একটু হাসলাে। এবার আমি হাসি দেখলাম।

সূত্র: সপ্তাহ, ১৪ জানুয়ারি ১৯৭২

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!