বাংলা বাণী
ঢাকাঃ ১৬ই আগস্ট, শুক্রবার, ৩০শে শ্রাবণ, ১৩৮১
বন্যা দুর্গত এলাকায় চাষাবাদের পরিকল্পনা
কৃষি মন্ত্রণালয়ে গত পরশুদিন একটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের কৃষি, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের মধ্যে বৈঠকে সভাপতিত্ব করেছেন। মন্ত্রণালয়ের সচিব, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছাড়াও কৃষকলীগের সভাপতি উপস্থিত ছিলেন। সংবাদে প্রকাশ, বৈঠকে বন্যা দুর্গত এলাকায় কৃষি পুনর্বাসনের জরুরী ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বন্যার পানি সরে গেলে কৃষকরা যাতে দ্রুত চালু করতে পারেন সে জন্য জরুরিভিত্তিতে বীজ সরবরাহ, আমন ও বোরো ধানের ফলন বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে একটি সমন্বিত কর্মসূচি চালু করার ব্যাপারেও বৈঠকে আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও যে সমস্ত এলাকার আউশ এবং আমন ফসল পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে সেসব এলাকায় একটি পুনর্বাসন কর্মসূচি চালু করার বিষয়ে বৈঠকে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। অন্যান্য যে সকল প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে চাষীদের বিকল্প ফসল ফলানোর ব্যাপারে উৎসাহ দান, যেমন শীতকালে গম ফলানো, তৈলবীজ ফলানো, শাক-সবজি, আলু ইত্যাদির চাষাবাদ করা প্রভৃতি। কর্তৃপক্ষের দিক থেকে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ ও দ্রুত সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে বৈঠকের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। দুর্গত এলাকায় পুনর্বাসন কর্মসূচি ও সীমিত সম্পদের ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়ানোর ব্যাপারে পরীক্ষা করে দেখার জন্য পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যের জনৈক সদস্যের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। বন্যার কারণে কৃষির যে মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হয়েছে তা পূরণ করা অসম্ভব ব্যাপার। তবু সরকার কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের কথা ঘোষণা করেছেন। গৃহীত পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়িত হলে ভেঙ্গে পড়া কৃষি অর্থনীতির সার্বিক পুনর্গঠন করা হতো এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। তবে আংশিক উন্নতি করা সম্ভব। তবু যে করেই হোক, গোটাজাতি শক্তি নিয়োগ করে কৃষিব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস করতেই হবে। গত ৮ই আগস্ট এর সরকার বন্যার ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে সর্বশেষ তথ্য পরিবেশন করেছিলেন তাতে দেখা গেছে দেশের মোট এলাকার মধ্যে ৩২ হাজার ৫৩ বর্গমাইল সম্পূর্ণ প্লাবিত হয়ে গেছে এবং ৯০ লক্ষ ৫৮ হাজার একশত ৪৫ একর জমির ফসল বিনষ্ট হয়েছে। রাস্তাঘাট বিধ্বস্ত হয়েছে আটাশ হাজার দু’শ চুয়াল্লিশ মাইল এবং আঠারো হাজার চারশত একচল্লিশটি শিক্ষায়তন বন্যার পানিতে ডুবে গেছে। গবাদিপশুর প্রাণহানির সংখ্যা হচ্ছে বত্রিশ হাজার চারশত তিনটি। এছাড়া ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়েছে চার লক্ষ তিরিশ হাজার আটশত চব্বিশটি। সরকারি তথ্য নিঃসন্দেহে আরো বৃদ্ধি পেয়েছে এ কদিনে। বস্তুত এ বিরাট ক্ষতি পূরণ করা সম্পূর্ণভাবে সম্ভব না হলেও আমাদেরকে অবশ্যই এর মোকাবেলায় সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ রোধে আমাদের জাতীয় ঐক্য ও সুদৃঢ় রেখে কাজ করে যেতে হবে। কৃষি ব্যবস্থার পূনর্গঠনের জন্য যে বৈঠক হয়েছে এবং তাতে যে সকল সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে তাতে ফাইলের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে যাতে করে ওই সিদ্ধান্তসমূহ যথার্থ কার্যকরী হয় হয় তার বাস্তব ব্যবস্থা নিতে হবে। বহুপ্রকার সিদ্ধান্তেই মন্ত্রী ও সচিবরা এ পর্যন্ত গ্রহণ করেছেন কিন্তু তার বাস্তব প্রয়োগ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয়নি। এবার বন্যার কারণে যে ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছে বিশেষ করে কৃষিব্যবস্থা যেভাবে ভেঙে পড়েছে তাতে করে কোন প্রকার অজুহাত আর নয়-এবার সত্যিকার অর্থেই কর্তৃপক্ষকে কিছু করতে হবে। আমাদের বিষয়ে দেশের জনগণ সরকারকে অবশ্যই সহযোগিতা দান করবে।
সাইপ্রাসে আবার সংঘর্ষ
গত ১৩ই আগস্ট জেনেভায় সাইপ্রাস শান্তি আলোচনার বৈঠক বসেছিল। আলোচনা বৈঠক বসতে না বসতেই তা ভেঙে যায় এবং মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তুর্কি ট্যাংক ও গোলন্দাজ এবং বিমান বাহিনীর সাইপ্রাসে গ্রিক বাহিনীর বিরুদ্ধে আবার নতুন করে আক্রমণ চালায়। সংবাদে প্রকাশ, তুর্কি বাহিনী নিকোসিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও নিয়ন্ত্রিত নিকোসিয়া বেতার কেন্দ্র দখল করে নিয়েছে এবং রাজধানী নিকোসিয়া অবরুদ্ধ করে ফেলেছে।
আকস্মিক আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে তুর্কি প্রধানমন্ত্রীর জনাব এচিভিট বলেছেন, সাইপ্রাসে নতুন করে আক্রমণ ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ খোলা ছিলো না। আমরা যা চাই তা হল তুর্কি সাইপ্রিয়টদের ন্যায্য অংশ। আমরা এই ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র ধ্বংস করতে চাই না। আমরা চাই সাইপ্রাসের আঞ্চলিক অখন্ডতা অক্ষুন্ন রাখতে। আমরা চাই দ্বীপে শান্তি, স্বাধীনতা ও তুর্কি সাইপ্রিয়টদের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা বিধান করতে।
সাইপ্রাসের অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট মিঃ ক্লারিডাস গ্রিক সাইপ্রিয়টদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তুর্কি আগ্রাসন প্রতিরোধ করতে। সাইপ্রাসে তুর্কি আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়ার ঝড় লন্ডনেও প্রবাহিত হয়েছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসন অবসর বিনোদন সংক্ষিপ্ত করে দ্রুত লন্ডনে ফিরে এসে তাঁর মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠক আহ্বান করেছেন। প্রতিরক্ষা দপ্তরের মুখপাত্র জানিয়েছেন, সাইপ্রাসের অবস্থানরত ১০০০০ ব্রিটিশ সৈন্যের সঙ্গে যোগ দেবার জন্য আরও ৪০০ কমান্ডো সৈন্য ব্রিটিশ ঘাঁটি আকরোতিরি ও ঠেলকেলিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে। শুধু তাই নয়, ব্রিটিশ ঘাঁটিগুলোকে সতর্ক রাখা হয়েছে। অপরদিকে জাতিসংঘ বাহিনীকেও পূর্ণ সতর্কীকরণ অবস্থায় রাখা হয়েছে।
এদিকে আমেরিকা ন্যাটোর অপর সদস্য তুরস্কের পক্ষ নিচ্ছে এসব সন্দেহ করে গ্রিসে শক্তিশালী ন্যাটো জোট থেকে তার বাহিনী প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করেছে। এথেন্সের সরকারি ঘোষণায় বলা হয়েছে গ্রিস ন্যাটো জোটে তার বাহিনীকে আর রাখবে না। তবে ১৫ সদস্যের এই সামরিক জোটে সে রাজনৈতিক সদস্য হিসেবে থেকে যাবে। গ্রীক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিঃ মারভস জেনেভা ত্যাগের প্রাক্কালে সাংবাদিকদের বলেছেন, গ্রীস ন্যাটো থেকে তার বাহিনী তুলে নিয়েছে। তিনি বলেন, ন্যাটোর আর কোনো অস্তিত্বই নেই।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নয়া প্রেসিডেন্ট মিঃ জেরাল্ড ফোর্ডের কপাল মন্দ। ক্ষমতায় বসার সঙ্গে সঙ্গেই সাইপ্রাস সংকটের মুখোমুখি পড়তে হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা দাঁড়িয়েছে ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’র মত। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র বিবদমান দুই পক্ষকেই হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন এই বলে যে, যুদ্ধে লিপ্ত হলে গ্রিস ও তুরস্কে মার্কিন সামরিক সাহায্য বন্ধ করে দেওয়া হবে।
সাইপ্রাসের প্রেসিডেন্ট মেকারিয়াসের আকস্মিক পতনের নেপথ্যে কারা ছিলেন এটা আজ আর কারো অজানা নয়। এখন ব্যাপারটা বুমেরাংয়ের মতই হয়েছে। যাইহোক, এটা অতি সত্য কথা যে, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের এই দ্বীপটি সামরিক দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাবেক প্রেসিডেন্ট মিঃ মেকারিয়াস দীর্ঘদিন ধরেই একটা নিরপেক্ষ নীতি বজায় রেখেছিলেন। কিন্তু এটা পছন্দ হয়নি সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর। তাই গ্রিসের সামরিক জান্তাকে উস্কানি দিয়ে সংঘর্ষে নামানো হয়েছিল। বাঁধ সাধলো তুরস্ক। সাইপ্রাসের সর্বশেষ ঘটনাবলীর যেদিকে যাচ্ছে তাতে মনে হয় সংঘর্ষ আরো তীব্রতর হতে পারে। আর তাই যদি হয় তাহলে তা হবে বিশ্ব শান্তির পক্ষে বিরাট হুমকি স্বরূপ। আজকের দিনে কোন ঘটনাই বিচ্ছিন্ন নয়। একের সঙ্গে রয়েছে অন্যের সংযোগ। সুতরাং যারা নেপথ্য থেকে লড়াইয়ের ইন্ধন জুগিয়েছেন তাদেরই উচিত লড়াই বন্ধ করা এবং সাইপ্রাস সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করা।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক