বাংলার বাণী
ঢাকা : ২৩শে নভেম্বর, শনিবার, ১৯৭৪, ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ
বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বীচি
কথায় বলে বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বীচি। ভোগ্যপণ্য সংস্থাকে যদি কাঁকুড়ের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তাহলে সংস্থাটির বর্তমান হাল হকিকতকে তেরো হাত বীচির সঙ্গে অনায়াসে একই পাল্লায় রাখা যায়।
ভোগ্যপণ্য সংস্থাকে কেন্দ্র করে খবরাখবর এ যাবত কম প্রকাশিত হয়নি পত্র-পত্রিকায়। তাতে যে খুব একটা কাজ হয়েছে তেমনও নয়। খবর বেরুচ্ছে—সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও কানে তুলো গুঁজে দিয়ে নির্বিকার ও নিশ্চিন্তে বসে আছেন। তবে মাঝে মধ্যে যে তৎপর হন না তেমন কথা বলা যাবে না। এই তো গত সেপ্টেম্বর মাসে কর্তৃপক্ষ তৎপর হয়েছিলেন এবং তারই ফলশ্রুতিতে এই দুর্দিনের বাজারে মফঃস্বল এলাকায় ১৫ হাজার কর্মচারীর চাকুরী গেলো। বন্ধ হয়ে গেলো সাড়ে ৪ হাজার দোকানের মধ্যে পৌণে ৪ হাজার দোকান। কর্মচারী ছাঁটাইয়ের কারণ ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, আর্থিক দুরবস্থা ও ব্যবসায়ে সাংঘাতিকভাবে মন্দা দেখা দেয়াতে এ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।
কর্মচারী ছাঁটাই ও দোকান বন্ধ সম্পর্কে যাই বলা হোক না কেন, ভোগ্যপণ্য সরবরাহ সংস্থা যে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে অর্থাৎ ন্যায্যমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য গঠিত হলেও আমদানীকৃত ও দেশে উৎপাদিত মালামাল কিন্তু জনসাধারণের কাছে ঠিকমতো পৌঁছেনি। ইধার কা মাল উধার হয়েছে ঠিকই কিন্তু সেগুলো কোথায় গেছে তা কেউ জানে না এমন অভিযোগও পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। হিসাব নিয়ে দেখা গেছে এই সংস্থা গত ’৭২-৭৩ সালেই গচ্চা দিয়েছে ৩ কোটি ৪০ লাখ ৯৯ হাজার টাকা। সংস্থার মাসিক এস্টাব্লিশমেন্ট খরচ ৫০ লাখ টাকা। এর মধ্যে শুধু পরিবহন খরচই হচ্ছে ১৩ লাখ টাকা।
১৯৭২ সালের ১৯শে মে জনসাধারণের সেবা করার মহান আদর্শ নিয়ে বাংলাদেশ সরকার যে সংস্থা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন ১৯৭৪ সালের নভেম্বর মাসে এসে দেখা যাচ্ছে উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। ন্যায্যমূল্যের দোকানের নাম শুনলে মানুষ এখন আঁৎকে উঠে। অথচ অভিজ্ঞ মহলের ধারণা—ন্যায্যমূল্যের দোকানের সংখ্যা যত বৃদ্ধি পাবে এবং সরবরাহ ও বন্টন ব্যবস্থার মধ্যে যদি কোনো গাফিলতি এবং ক্রুটিবিচ্যুতি না থাকে তাহলে জনসাধারণের জন্য তা কল্যাণকর হতে বাধ্য। বিশেষতঃ দেশের বর্তমান অবস্থায় যেখানে চোরাচালানী, মওজুতদারী ও মুনাফাখোরীর মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে গেছে সেখানে তো জনসাধারণকে বাঁচাবার একমাত্র পথই হলো ন্যায্যমূল্যে জিনিসপত্র সরবরাহ করা। এতে করে একদিকে যেমন জনসাধারণ হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে অন্যদিকে অসামাজিক ও অসাধু তৎপরতা বন্ধ হবে। অথচ ভোগ্যপণ্য সরবরাহ সংস্থা সে দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। ব্যর্থতার কারণ সরকারী সাহায্য বা সহযোগিতার অভাব তা নয়। মূল কারণ হলো এ ধরনের একটি অত্যন্ত পরিশীলিত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য যে ধরনের অভিজ্ঞ ও উচ্চমানের ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন ভোগ্যপণ্য সরবরাহ সংস্থায় তার অভাব রয়েছে। তাই যদি না হয় তাহলে প্রায় ৭ কোটি টাকা ‘প্রযুক্ত মূলধন’ থাকা সত্ত্বেও সংস্থাটি এখনো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে কেন? ব্যাংকের কাছে ভোগ্যপণ্য সংস্থার ঋণের পরিমাণ ১০ কোটি টাকা। এজন্য শতকরা ১০ টাকা হারে সংস্থাকে আড়াই কোটি টাকা সুদ হিসেবে ব্যাংককে দিতে হয়েছে।
সামগ্রিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ সত্যই প্রতিফলিত হয়ে উঠেছে যে, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ভিত্তি হিসাবে যে ভোগ্যপণ্য সরবরাহ সংস্থার জন্ম হয়েছিল তা বর্তমানে সম্পূর্ণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। বিশেষ সংস্থাটির দুর্নামের আঁচ লাগছে সরকারের গায়েও। কাজেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব হলো হয় সংস্থাটির সুষ্ঠুভাবে চলার পথ প্রশস্ত করা নয়তো বন্ধ করে দেয়া। এছাড়া বিকল্প কোনো পথ আছে বলে আমাদের জানা নেই।
রপ্তানী বাণিজ্যে চিনি শিল্প
রপ্তানী বাণিজ্যের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বাংলাদেশের চিনি শিল্প দ্বিতীয় স্থান অধিকার করতে যাচ্ছে। বিশেষ সংবাদ সংস্থা সূত্র জানাচ্ছে যে, চলতি বছরে কমপক্ষে ৪০ হাজার টন চিনি রপ্তানী করা সম্ভব হবে। এর দ্বারা জাতীয় আয় হবে (আন্তর্জাতিক বাজার দর অনুযায়ী) প্রায় ৪৫ কোটি টাকা। এটা হচ্ছে দেশের মোট রপ্তানী আয়ের শতকরা ১৭ ভাগ। চিনির বিশ্ববাজারে প্রবেশের জন্য বাংলাদেশের এটাই হবে প্রথম পদক্ষেপ। তবে এই সঙ্গে এ কথাও বলা হয়েছে যে, রপ্তানীর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের উপরই এই আয় নির্ভর করছে।
চলতি মৌসুমে চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার টন। দেশের ১৫টি চিনি কলের মধ্যে ৮টি চিনি কলে এখন উৎপাদন চলছে। এ মাসের শেষদিকে আরো ছ’টি কলে উৎপাদন শুরু হবে বলে সংশ্লিষ্ট মহল জানিয়েছে। পঞ্চগড় চিনিকল এ বছর উৎপাদনে যাবে না। তার কারণস্বরূপ সংশ্লিষ্ট এলাকায় পর্যাপ্ত পরিমাণ আখ চাষের অভাব বলে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়েছে, চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের উপর সরকার যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এবং যে কোনো উপায়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য শিল্প মন্ত্রণালয় চিনি কল সংস্থাকে নির্দেশ দিয়েছেন। সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মিলসমূহে যাবে এবং উৎপাদন অব্যাহত রাখার জন্য প্রয়োজন বোধে যে কোনো ব্যাপারে ঘটনাস্থলেই সিদ্ধান্ত নেবেন। অপরদিকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে মিল অঞ্চলে গুঁড় উৎপাদনের ব্যাপারে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষকে কৃষকরা যাতে মিলে আখ বিক্রি করে সেদিকে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, চলতি বছর ইউরোপীয় দেশগুলোতে বীট উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় অনুমান করা হচ্ছে—আন্তর্জাতিক বাজারে আগামী বছর চিনির দর অত্যধিক বাড়বে। এটা শুধুই যে অনুমান নয় তার প্রমাণ লন্ডন বাজারে চিনির দর। এক সপ্তাহের মধ্যে সেখানে চিনির টন প্রতি দাম ৫শ’৫৯ পাউন্ড থেকে ৬শ’৫৯ পাউন্ডে এসে ঠেকেছে।
বিশেষ মহলের মতে, আন্তর্জাতিক বাজারের এই ঊর্ধ্বমূল্যের সুযোগ বাংলাদেশের নেয়া উচিত। এজন্য দেশে যতটা সম্ভব চিনির ব্যবহার কমাতে হবে। এই প্রসঙ্গে তাঁদের সুপারিশ আছে দু’টি। প্রথমতঃ চিনি রপ্তানী বৃদ্ধির জন্য মূল্যবান চিনি সম্পদ ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ রাখতে, দ্বিতীয়তঃ সীমান্তের ওপারে গুঁড়ের চোরাচালান বন্ধ করতেই হবে। এই মহল এক হিসেবের তালিকা দিয়ে আরো বলেন যে, মিল অঞ্চলের বাইরে প্রায় ২ লাখ একর জমিতে আখ উৎপন্ন হয়েছে, তা থেকে কমপক্ষে ৫ লাখ টন গুঁড় উৎপন্ন হওয়ার কথা। এ ছাড়া খেজুর ও তালের রস থেকে আরো তিন চার ট্ন গুঁড় উৎপাদন হওয়ার সম্ভাবনা থাকছে। অতএব সেই সব গুঁড় সম্পদ ব্যবহার করে যতটা সম্ভব চিনি বাঁচিয়ে রপ্তানী করতে হবে এবং বিশ্ববাজার থেকে লাভের অঙ্ক ছিনিয়ে আনতে হবে।
প্রস্তাবটি ভালো। হিসেবটি চমৎকার। কিন্তু কথা হচ্ছে—সবই যে কাগুজী হিসেব আর হাওয়ায় ভাসা কথা। চিনির পর্যাপ্ত ব্যবহার ধনী মহলে হয় এ কথা যেমন সত্য, গুঁড়ের পর্যাপ্ত চোরাচালান চলে এ কথাও সত্য। কিন্তু ঐ দু’টোর কোনোটিই রোধ করা সহজ কথা নয়। এবং সহজ কথা ও সাধারণ আবেদন-নিবেদনেও অবস্থার কিছু রদবদল হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি না। তাছাড়া চিনির ব্যবহার কমিয়ে ফেলতে হলে গুঁড়ের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকা চাই। সে দিকটি নিশ্চিত করতে হলে আবার চোরাচালান বন্ধ করা চাই-ই চাই। তা-ও ম্যানেজ করা সম্ভব কিনা—সে আশ্বাস সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ই দিতে পারবেন। সেখানেও আমরা গৌণ।
তবে আন্তর্জাতিক বাজার দরের সুবিধা লাভ করার এই সুযোগ যদি বাংলাদেশের চিনি শিল্প গ্রহণ করতে পারে তাহলে জাতীয় স্বার্থের প্রভূত কল্যাণ অবশ্যই আসবে। আর স্বনির্ভরতা অর্জন করা জাতীয় জীবনের জন্য অপরিহার্য কামনা। সেক্ষেত্রে পূর্ণভাবে না হলেও আংশিকভাবে যদি বাংলাদেশ কোনো কোনো ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে এবং তৎপরতার সাথে ব্যবসায়ী বুদ্ধির পরাকাষ্ঠা দেখাতে পারে তার চেয়ে আনন্দের কথা আর কি হতে পারে? সেজন্য চিনি কম খাওয়াটাকে কোনো কষ্ট বলেই হয়তো আমরা গণ্য করবো না। কারণ জাতীয় স্বার্থই সবার ঊর্ধ্বে থাকবে—এই তো আমাদের শপথ।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক