বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২৩শে আগস্ট, শুক্রবার ৬ই ভাদ্র, ১৩৮১
গভীর জলের ধান
গত বুধবার দুপুরে গভীর জলের ধান সম্পর্কিত ৬ দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সেমিনার শুরু হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট, ফোর্ড ফাউন্ডেশন এবং ‘ফাও’এর সহযোগিতায় বাংলাদেশ ধান গবেষণা কেন্দ্র ও কৃষি মন্ত্রণালয় এই সেমিনারের আয়োজন করেন। সেমিনারে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা ছাড়াও ভারত-জাপান, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন এবং তাইওয়ানের বিজ্ঞানীরা যোগদান করেছেন। সেমিনার উদ্বোধনকালে কৃষি মন্ত্রী জনাব সামাদ বলেন যে, বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশ এই গভীর জলের ধান উৎপাদনে কতিপয় অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে। প্রধান সমস্যা হলো এর ফলন কম এবং চাষাবাদে অসুবিধা রয়েছে। মিলিত কর্মপ্রচেষ্টা ও গবেষণার মাধ্যমে এ ধান চাষ সম্পর্কিত সমস্যাবলি উত্তরণ সম্ভব বলে সেমিনারে যোগদানকারী বিজ্ঞানীদের প্রতি কৃষিমন্ত্রী আহ্বান জানিয়েছেন। তথ্যমূলক উদ্বোধনী ভাষণে জনাব সামাদ বলেন যে, গভীর জলের ধান উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে উৎপাদন মাত্রা দিক দিয়ে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ প্রতিফলনের পরিমাণ হলো মাত্র ৯শ পাউন্ড। তবুও গোটা বাংলাদেশের ১ কোটি ৮০ লক্ষ কৃষক প্রায় ৫০ লাখ একর জমিতে ধানের চাষ করে থাকে।
‘গভীর জলের ধান’ ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ডিব ওয়াটার রাইস’। এ ধানের চাষ বাংলাদেশে কোন কৃষক আলাদাভাবে করেনা। চৈত্র-বৈশাখ মাসে জমিতে সাধারণ বপনের সময় কৃষক তার সাথে গভীর জলের ধান লাগায়। বর্ষাকালে পেকে যাওয়া ধান কাটবার সময় দেখা যায় গভীর জলের ধানের ফলন তখনও ফলেনি এবং জমি থেকে প্রথমোক্তটি উঠে যাওয়ার পর খোলা হাওয়ায় শেষোক্তটি বৃদ্ধি পেয়ে অগ্রহায়ন মাসের দিকে কৃষক জমিতে কাস্তে চালায়। ফলন কম হলেও লাভের দিক দিয়ে এর জুড়ি নেই। কারণ কৃষকের জন্য আলাদাভাবে জমি চাষ বা সার দিতে হয় না। তাছাড়া সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো জমিতে পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে এর গাছগুলো ও পানির সাথে সমতা রেখে বড় হতে থাকে এবং বাংলাদেশের ধান সাধারণতঃ তিন থেকে ১৫ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। অন্যান্য বছরের মত সাম্প্রতিক বন্যা বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে ধানের ফলন নষ্ট করে দিয়ে গেছে। তার একমাত্র কারণ হল হঠাৎ করে পানি বৃদ্ধি। বন্যার পানি যদি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায় এ ধানের কোনো ক্ষতি হয় না তাতে।
গভীর জলের ধান সম্পর্কে আরেকটি প্রধান সমস্যা হলো ফলনের দীর্ঘসূত্রিতা। চৈত্র বৈশাখ মাসের লাগান ধান চাষের হাতে আসে অঘ্রাণ মাসে। নদ-নদীতে ভরা বৈচিত্র্যময় বাংলাদেশকে বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মোকাবেলা করতে হয় প্রতিবছর এবং এর ফলনে এই ধরনের বিলম্বের কারণে প্রতিবছর এই লক্ষ লক্ষ মণ ধান নষ্ট হচ্ছে। ফলনে বিলম্ব না হলে এবং অন্যান্য ধানের মত তাড়াতাড়ি এর ফলন হলে খাদ্য সমস্যা সমাধানে এ ধান একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারতো আমাদের দেশে।
জয়দেবপুরে ছয়দিন ব্যাপী ‘গভীর জলের ধান’ সম্পর্কে যে আন্তর্জাতিক সেমিনার বসেছে, তার উদ্যোক্তা ও তাতে যোগদানকারী বিজ্ঞানীরা চাল উৎপাদনকারী দেশগুলোর ধানের ফলন কিভাবে বৃদ্ধি করা যায় ফলে দীর্ঘ সময় রোধ করে স্বল্প সময়ে কোন উপায়ে এর ফলন ঘটান যায়, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন সম্ভবতঃ। এবং আমরা মনে করি আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে কোন কাজেই আর মানুষের অসাধ্য নেই। তদুপরি যে সমস্ত দেশের চাউল উৎপাদিত হয় এশিয়ার সেই দেশগুলোতেই খাদ্য সমস্যা ভয়াবহ। সুতরাং যে ধান প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে অধিক ফলন দিতে পারে এ দেশগুলোর সে দিক দিয়ে গবেষণার কাজ উন্মুক্ত করা উচিত। বর্ধমান সেমিনারটিতে যে দেশগুলো অংশগ্রহণ করেছে সবাইকে খাদ্য সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে এবং আমরা মনে করি যৌথ মিলিত গবেষণার মাধ্যমে কিভাবে উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি করা যেতে পারে সেমিনারে অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধিরা সে পথ উদ্ভাবনে সক্ষম হবেন।
খাদ্যশস্য চুরি
সংবাদে প্রকাশ, গত ১১ই আগস্ট চাটগাঁ বন্দর থেকে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন সংস্থার একটি কোষ্টার নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশে যাত্রা করে। উক্ত কোষ্টারটি চলন্ত অবস্থায় একটি চরের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ডুবে যায়। ডুবন্ত কোষ্টারটিতে ছিল ৭৫০ টন গম। ১১ই আগস্টে চাটগাঁ থেকে যাত্রা করে ২০ শে আগস্ট পর্যন্ত এই ন’দিনে কোষ্টারটি সন্দীপের কাছাকাছি পৌঁছে এবং সেখানেই দুর্ঘটনা ঘটে। অথচ এই সময়ের মধ্যে কোষ্টারটির অর্ধেক পথ অতিক্রম করার কথা ছিল। এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য নয় জন নাবিকের সাত জনকে আটক করা হয়েছে।
ঘটনা কিন্তু এটি না। আরো একটি ঘটনা ইতিমধ্যেই ঘটেছে। গতকালই স্থানীয় একটি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে আইডব্লিউইসি ‘বেগবতী’ নামে একটি জাহাজ ৫শত ৬০ টন খাদ্যশস্য নিয়ে চাটগাঁ থেকে ঢাকা আসছিল কিন্তু পথের মাঝে খাদ্য লোপাট করার চেষ্টা চলে। অবশ্য নৌবাহিনী, জাহাজের নাবিক ও অফিসাররা মিলে এ চেষ্টা বানচাল করে দেয়।
ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, ১৬ই আগস্ট চাটগাঁ থেকে ‘বেগবতী’ নামে জাহাজটি ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করে। ১৭ই আগস্ট জাহাজটি বরিশালের হিজলার নিকটবর্তী স্থানে পৌঁছলে ২০/২৫টি দেশীয় নৌকা জাহাজ এর কাছে এসে থামে। নৌকার লোকজন জাহাজে আরোহন করে এবং গম ও চাল কেনার জন্য জাহাজের নাবিকদের অর্থ প্রদান করে। কিন্তু এতে বাধ সাধে নৌবাহিনীর একটি জাহাজ। যে জাহাজে আগে থেকেই ‘বেগবতী’ কে অনুসরণ করেছিল। নৌবাহিনীর লোকজন ‘বেগবতী’ জাহাজের নাবিকদের কাছ থেকে ৩৫ হাজার সাতশত টাকা উদ্ধার করে এবং ২৩ জন নাবিক ও ১৭ জন চোরাকারবারীকে আটক করে।
ঘটনা দুটোকে একসঙ্গে সাজালে যা দাঁড়ায় তার নাম হলো খাদ্যশস্য চুরি। বাংলাদেশের খাদ্যশস্য চুরি বা খাদ্যশস্যের চোরাকারবারধারটা এমন কিছু নতুন ঘটনা নয়। জলে-স্থলে সর্বত্রই খাদ্যশস্য চুরি হচ্ছে। সরকার চুরি বন্ধ করার জন্য যে চেষ্টা করছে না এমন নয়। কিন্তু তবু যেন রাক্ষসের মত এদের বংশ বৃদ্ধি হচ্ছে। এটা কোন অবস্থাতেই শুভ লক্ষণ নয়। তাছাড়া বন্যা দুর্গতদের সাহায্য করার জন্য বিদেশ থেকে ত্রাণ সামগ্রী ও খাদ্যশস্য আসছে। অথচ খাদ্যের চোরাকারবারীদের নির্মূল করতে না পারলে তো তুলেমূলে সবই যাবে। এমতাবস্থায় আমরা এ কথাই বলতে পারি যে খাদ্যশস্য চুরি, মজুদদারী, মুনাফাখোরী ইত্যাদি সমাজ বিরোধী তৎপরতা বন্ধ করার জন্য সরকার ফায়ারিং স্কোয়াডের ব্যবস্থা করেছেন। যারা এগুলো করছে তাদেরও ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করানোই তো যুক্তিসঙ্গত। এতে অসুবিধাটা কোথায় তা তো আমরা বুঝে উঠতে পারছিনা। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান না করলে এ ধরনের সমাজবিরোধী আলামত কমবে বলে তো মনে হয় না।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক