বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ৯ই ডিসেম্বর, সোমবার, ২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৩৮১
ম্যাকরিয়সের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন
ম্যাকারিয়স আবার নতুন করে ঘর সাজাবেন। তার অনুপস্থিতিতে লঙ্কাকাণ্ড হয়ে গেছে দ্বীপদেশ সাইপ্রাসে। বহিঃশত্রুরা শকুনের মতো খুবলে খুবলে খেয়েছে সাইপ্রিয়টদের। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ উসকিয়ে একজনকে আরেকজনের রক্ততৃষ্ণায় মাতাল করে তুলেছে। বেশকিছু দিন চলেছে দাঙ্গা, ধর্ষণ, লুটতরাজ। তুর্কি সাইপ্রিয়টদের নিরাপত্তার অজুহাত তুলে দেশে নেমেছে ভিনদেশী ফৌজ। এখনও তাদের নিয়ন্ত্রণে সাইপ্রাসের একটা বিরাট অংশ। পশ্চিমের প্রাসাদে প্রাসাদে চলেছে ষড়যন্ত্র। ক্ষুদ্র দ্বীপদেশকে বিভক্ত করার নীল নকশা তৈরি।
এমনই রাজনৈতিক পটভূমিতে সাইপ্রাসের আইনগতভাবে প্রতিষ্ঠিত সরকারের প্রধান আর্চবিশপ মাকারিওস ফিরেছেন দেশে। দেশবাসীকে তিনি আহ্বান জানিয়েছেন সেখানে বসবাসকারী দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহযোগিতা করে দেশকে দ্বিখণ্ডিত করার চক্রান্ত রোধ করতে। এ ব্যাপারে বিরাজমান সমস্যা দূরীকরণে আলোচনা চলছে বলেও তিনি এ তথ্য প্রকাশ করেন। গ্রিক সামরিক জান্তা পরিচালিত এক ষড়যন্ত্রমূলক অভ্যুত্থানের ফলে আর্যবিশপ মাকারিওসকে দেশত্যাগ করতে হয়। সুতোর গোড়া ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। উদ্দেশ্য ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় সামরিক গুরুত্বপূর্ণ এই জোট নিরপেক্ষ রিজমের অবলুপ্তি। সে স্থলে ন্যাটোর আওতাধীন নয়া সাইপ্রাসের অভ্যুদয় ঘটানো। সে পরিকল্পনা তাদের সফল হয়নি। খুনে স্যামসনের নেতৃত্বাধীন লুটেরাদের বল্গাহীন অত্যাচার এবং নির্যাতন, তাদের সাম্প্রদায়িক নিষ্ঠুরতা তুর্কি সাইপ্রিয়টদের মধ্যে প্রতিরোধের মনোভাব জাগিয়ে তোলে। বিশ্বজনমত সোচ্চার প্রতিবাদ জানায় প্রশাসনের বিরুদ্ধে। নটের ওরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন নতুন ফন্দি আঁটে। ন্যাটোর সদস্য তুরস্ক তার সেনাবাহিনী প্রবেশ করায় সাইপ্রাসে। হোয়াইট হাউস নিরব। বিচারপ্রার্থী মাকারিওস আর বিশ্ববিবেক ঘুরছে তখন শক্তিমানদের দুয়ারে দুয়ারে।
স্যামসনের বদলে অস্থায়ী শাসনভার গ্রহণ করেছেন উদারপন্থী ক্লারিডাস। দুনিয়ার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত থেকে দাবি উঠেছে সাইপ্রিয়টদের হাতেই সাইপ্রাসের সমস্যা সমাধানের ভার দেয়া হোক। কিন্তু গোটা সাইপ্রাস গিলতে না পেরে ‘আধা সাইপ্রাসের মালিক’ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি প্রণয়ন করেছে সাইপ্রাস দ্বিখণ্ডিত করার নীলনকশা। প্রস্তাব আকারে তা উঠেছে আলোচনার টেবিলে।
বিশ্ব জনমতের চাপে অবশেষে মাকারিওস সক্ষম হয়েছেন সাইপ্রাস প্রত্যাবর্তনে। সামনের জটিল এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যত। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ভূমধ্যসাগরীয় এই দ্বীপটির সম্পূর্ণ সম্ভব না হলেও কোনো না কোনো অংশ তাদের তাবে রাখতে বদ্ধপরিকর। এমন অবস্থায় অত্যন্ত সতর্ক পদক্ষেপ অগ্রসর হতে হবে ম্যাকারিয়সকে। গ্রিক সাইপ্রিয়টদের নিয়ে তার ততটুকু ভাবনার কারন নেই যতটুকু তুর্কি সাইপ্রিয়টদের নিয়ে। সেখানে রয়েছে তুর্কি ফৌজ, রয়েছে তাঁর অনুপস্থিতিতে গড়ে ওঠা তার এবং গ্ৰীক বংশোদ্ভূতদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ। এর যেকোনো একটিকেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির যেকোনো সময় কাজে লাগাতে পারে।
সারা দুনিয়ার মানুষ আগ্রহে তাকিয়ে আছে ক্ষুদ্র এ দ্বীপ দেশটির দিকে। ম্যাকারিয়াস কিভাবে অগ্রসর হবেন, কিভাবে অনেকগুলি জটিল সমস্যার সমাধান তিনি দেবেন এসবের উপরে নির্ভর করবে সাইপ্রাসের ভবিষ্যত। আমরা সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে গণতান্ত্রিক এবং জোট-নিরপেক্ষ সাইপ্রাসের পূর্ণ অভ্যুদয়ের সোনালী দিনটির অপেক্ষায় আর্যবিশপ ম্যাকারিয়সের সম্ভাব্য বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণের আশা পোষণ করছি।
নয়া বিবাহ আইন
আধুনিক বিশ্বে শিক্ষা ও সভ্যতার সংজ্ঞা এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তাসহ বর্তমান সামাজিক মূল্যবোধের যথেষ্ট পরিবর্তন ঘটলেও ধর্মসম্মত বা আইনসঙ্গত বিবাহ এবং সুখী ও সচ্ছল একটি বিবাহোত্তর জীবন আজও সকল দেশের সভ্য সমাজেরই কাম্য। তাই বিবাহ সম্পৃক্ত বিধিনিষেধ বা বৈবাহিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য কল্যাণকর শর্তাবলী নিয়েও সভ্য সমাজের চিন্তা ভাবনার অন্ত নেই। এবং ঐ সকল মানবতা মুখী চিন্তাভাবনার ফলশ্রুতিতে জন্ম নিয়েছে বিবাহ আইন ও বিয়ের বয়ঃসীমাঘটিত যুক্তিতর্কের পটভূমি। যার আধুনিকতম প্রসার দেখা যাচ্ছে দম্পতির সন্তান সন্ততির সংখ্যা পর্যন্ত।
এর পেছনে অবশ্যই অনেক কারণ আছে। তার মধ্যে প্রধান কারণ হলো বিশ্বের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার। তাছাড়া আছে উন্নয়নশীল দেশের এবং অনুন্নত দেশের বেশুমার জনসংখ্যা বৃদ্ধির স্বতঃস্ফূর্ত প্রবাহ, বিশ্বব্যাপী খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা এবং বিশ্ব সম্পদের সীমাবদ্ধতা। বিশ্বের সীমাবদ্ধ সম্পদের প্রেক্ষিতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত প্রয়োজন আছে। আর সেই কারণেই সভ্য সমাজের সৃষ্টির উৎস তথা বিবাহ আইন সংশোধিত ও পরিশীলিত করার তাগিদ আসে। কারণ সুপরিকল্পনা ছাড়া সুপরিকল্পিত সুখ-সমৃদ্ধির লক্ষ্যে কখনোই পৌঁছানো যায় না। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই সম্প্রতি সংশ্লিষ্ট মহল সরকারের কাছে দেশের প্রচলিত বিবাহ আইন পরিবর্তন পরিবর্তন করার সুপারিশ করেছেন। আরো উল্লেখ করেন যে, বিয়ের বয়স মেয়েদের ক্ষেত্রেও পুরুষদের ক্ষেত্রে ১৮ থেকে ২০ বছর ২৬ থেকে ২৮ বছর বেঁধে দেয়া বাঞ্ছনীয়। তাহলে প্রতি বছরে দেশে সম্ভাব্য ৩৫ লাখ নবজাতক শিশুর জন্ম রোধ করা সম্ভব।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, ঘনবসতিপূর্ণ জনসংখ্যায় ভারাক্রান্ত বাংলাদেশের গড়ে প্রতি মিনিটে সাতটি শিশুর জন্ম নিচ্ছে। আশঙ্কার কথা এই যে, জন্মহার এভাবে অব্যাহত থাকলে আগামী পাঁচ বছরে দেশে আরও আড়াই কোটি মানুষ বৃদ্ধি পাবে যা আমাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি গভীরভাবে প্রভাবান্বিত করবেই। জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধে নতুন বিবাহ আইন প্রণয়ন করে বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলে অদ্যাবধি চালু বাল্যবিবাহ এবং অকাল বিবাহ কার্যকরীভাবে বন্ধ করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।
একথা সত্য যে, একটি নতুন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে উন্নয়ন ও সার্বিক প্রগতির স্বার্থে নিত্য বহুতর সমস্যার স্তূপ অতিক্রম করতে হচ্ছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাসের গুরুদায়িত্বও সেখানে রয়ে গেছে। এক্ষেত্রে দেশে প্রচলিত অর্বাচীন বিবাহ প্রথা অযাচিতভাবে অকালে দেশের জনসংখ্যার বোঝা বাড়িয়ে দেবে-এমনটা আর ভাবা যায় না। সেজন্যই চাই সরকারি পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ। এবং মানবিক কারণে এবং দেশের কল্যাণের স্বার্থে সেই পর্যায়ে সুখী মহলের নয়া চিন্তার বিন্যাসকে আমরা স্বাগতম জানাচ্ছি। আবার সামাজিক পটভূমি প্রেক্ষিতে বিচার করলেও বাল্যবিবাহের পরিণত শুভ ফল উৎপাদনে প্রায় ব্যর্থ। কারণ অপ্রাপ্তবয়স্ক জনক জনকীর সন্তান সাধারণতঃ স্বাস্থ্য ও পরিচর্যার নিপন সৌজন্যে থেকে যুগপৎ বঞ্চিত থাকে। তার সঙ্গে যুক্ত হয় অর্থনৈতিক অস্বাচ্ছন্দ্য তথা পরনির্ভরশীলতা। সে ক্ষেত্রে পরিণত বয়সের সমর্থ ও উপার্জনক্ষম দম্পতি অধিকতর যোগ্যতা ও সচেতন প্রয়াস এর মাধ্যমে দেশকে একটা সুস্থ ভবিষ্যৎ নাগরিক উপহার দেওয়ার অবকাশ রাখে সে কথা প্রায় স্বতঃসিদ্ধ। সেই দৃষ্টিকোণ থেকেও নয় বিবাহ আইন প্রণয়ন করে ছেলে ও মেয়ের বিয়ের বয়স নির্ধারণ করার একাশ যুক্তিসঙ্গত কারণ সৃষ্টি হয়েছে।
দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করতে হয় যে দেশে শিক্ষার নিম্নহার এককভাবেই বাংলাদেশের সামাজিক জীবনে অভিশাপের আবর্ত সৃষ্টি করে রেখেছে। সেখানে যুক্তি, বুদ্ধি ও মানবিক আবেদনের চেয়ে আইনের কাঠিন্য অধিক ফল উৎপাদনে সক্ষম হবে বলে আমরা মনে করি। তখন বলবৎ আইনের বিরোধিতা করে গ্ৰাম্য সমাজেও বাল্যবিবাহ দেয়ার প্রবণতা হ্রাস পাবে। এবং তার সুফল ও ধীরে ধীরে তারা অনুধাবন করতে শিখবে। তখন অর্থনৈতিক সংকট ও নয়া বিবাহ আইন তথা স্বাস্থ্য, সুখ ও জনসংখ্যার চাপ সবই যে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত এই চেতনায় দেশবাসী সচকিত হবে। অতএব আমরা চাইনা বিবাহ আইন আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সার্বিক রাষ্ট্রীয় জীবনে এনে দিক নব পথসংকেত!
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক