You dont have javascript enabled! Please enable it!

উপসংহার

ভাষা আন্দোলনের সূচনা যদিও আক্ষরিক অর্থে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে, তবু বলা চলে যে, ভাষা আন্দোলন তত্ত্বগত অর্থে শুরু হয় ভাষা-চেতনার ক্রমবিকাশের ধারায়। বিশ শতকের গােড়ার দিকে আধুনিক শিক্ষার পটভূমিতে বাংলা-উর্দু মাতৃভাষার বিতর্কের মধ্য দিয়ে শিক্ষিত শ্রেণীর একাংশে, বিশেষ করে সংস্কৃতি অঙ্গনের শিক্ষিতদের একাংশে এই চেতনার প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করে এই বিতর্কের মধ্য দিয়ে বাঙালি মুসলমানের শিক্ষিত শ্রেণীর সুনির্দিষ্ট অংশে আত্মঅন্বেষার লক্ষণ পরিস্ফুট। এই বিতর্ক, বলা যায় এক ধরনের ভাষা বিতর্ক, বেশ কয়েক দশক ধরেই চলে, যা চল্লিশের দশকে এসে পাকিস্তান আন্দোলনের পরাক্রান্ত প্রভাবে বিলুপ্ত না। হলেও চাপা পড়ে যায়। পাকিস্তান আন্দোলনের মূল উপকরণ অর্থনৈতিক চরিত্রের এবং এর চালিকাশক্তি এ দেশের দুই প্রধান সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক বৈষম্যমূলক ভিত্তির ওপর দাঁড়ানাে সত্ত্বেও দ্বিজাতিতত্ত্বের কাঠামােয় ধর্ম ও সম্প্রদায়ভিত্তি সে সময় জাতিসত্তার স্থান দখল করে নেয় এবং পূর্বোক্ত ভাষা-চেতনার উপস্থিতি, এমনকি প্রভাবও উপরিস্তরে দেখা যায় না। চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি থেকে। বাঙালি মুসলমান শিক্ষিত শ্রেণী ও জনচেতনা পাকিস্তান নামক স্বতন্ত্র ভুবনের স্বপ্ন। পুরােপুরি দখল করে নেয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর নতুন ভূখণ্ডের রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে বাংলার অবস্থান নিয়ে বাঙালি শিক্ষিত শ্রেণী, মূলত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একাংশে সন্দেহ, সংশয় ও অবিশ্বাস দেখা দিতে থাকে। মুসলিম লীগ রাজনীতির প্রভাবশালী নেতৃত্বে অবাঙালি প্রাধান্য ও তাদের অর্বাচীন চিন্তা এবং উক্তির কারণে। সন্দেহবাদীদের মনে অসন্তোষ আরাে গভীর হতে থাকে যদিও এর প্রকাশ প্রধানত সংস্কৃতি অঙ্গনে এবং লেখালেখিতেই সীমাবদ্ধ থাকে। তা সত্ত্বেও দেখা যায়, ধর্মীয়। রাজনীতি ও সংস্কৃতির প্রভাবে বাঙালি মুসলমানের অংশবিশেষে বাংলার পরিবর্তে  উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রহণযােগ্য বিবেচিত হয়।

উল্লিখিত ভাষাচেতনা একমাত্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরই শুধু তাত্ত্বিক পটভূমি এবং সংস্কৃতির অঙ্গন ছেড়ে অসন্তোষ এবং বিক্ষোভ প্রকাশের মাধ্যমে রাজপথে নেমে আসে এবং ক্রমশ রাজনৈতিক চরিত্র অর্জন করতে থাকে। এই বিক্ষোভের সূচনা, অস্বাভাবিক শােনালে সত্য, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে, যদিও সাধারণভাবে এদের মধ্যে গৃহপালিত মনােভাবের (অর্থাৎ ‘ঘরঅফিস-চাকরি-আবাস’ বৃত্তে আবদ্ধ থাকার মনােবৃত্তির) প্রাধান্য লক্ষণীয় এবং প্রতিবাদ-প্রতিরােধ আন্দোলনের বৃত্তে বাধ্যবাধকতা ছাড়া এরা সহজে প্রবেশ করে । কিন্তু এরাই অপ্রত্যাশিতভাবে গােড়াতেই বিক্ষোভের প্রকাশ ঘটায়, সম্ভবত এইজন্য যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পেছনে এই শ্রেণীর অবদান ছিল যথেষ্ট এবং স্বভাবতই প্রত্যাশাও ছিল অপরিসীম। সম্প্রদায়গত অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার। এই শ্রেণীর কাছে পাকিস্তান ছিল এক স্বাপ্নিকভূমি।  তাই সাতচল্লিশ সালের শেষদিকে নতুন ছাপানাে টাকা, ডাকটিকিট, মনিঅর্ডার। ফরম ইত্যাদিতে উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে বাংলার অনুপস্থিতি তাদের চেতনায় যে ক্ষত সৃষ্টি করে তার প্রতিক্রিয়াকে কি আমরা শুধুই ভাষা-চেতনা হিসেবে চিহ্নিত করবাে, নাকি এতে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবােধের উপস্থিতি মেনে নেবাে এবং তাদের জাত্যভিমান কিয়ৎপরিমাণে হলেও আহত হওয়ার ঘটনা স্বীকার করে। নেবাে? 

একই সঙ্গে শিক্ষিত শ্রেণীর তরুণ অংশ তথা ছাত্র-যুবসমাজের একটি অংশ অনুরূপ প্রতিক্রিয়ার শিকার হয় এবং ভাষার প্রশ্নটি তাদের ক্ষেত্রে ছিল আরাে প্রত্যক্ষ বিষয়। তাই বিষয়টি তাদের চেতনায় প্রথমােক্তদের চেয়ে আরাে জোরেশােরে আঘাত করে। এই ছাত্র-যুবসমাজও ছিল পাকিস্তান আন্দোলনের একটি প্রবল খুঁটি, এদের অপেক্ষাকৃত বয়স্ক অংশ অর্থাৎ যুবসমাজ সব ছেড়ে পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েছিল। তাই আঘাতের তীব্রতা এদের জন্যও কম ছিল না এবং তা এদের পক্ষেও হয়ে উঠেছিল এক রূঢ় বাস্তব ঘটনা। এক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গত বাস্তবতা ছিল রাষ্ট্রীয় পরিচালনা-কাজে বাংলার অবস্থানগত প্রয়ােজনীয়তা। বিষয়টি আপাতদৃষ্টে ছােট হলেও এর অভিঘাত ও প্রতিক্রিয়ার এলাকা ছিল ব্যাপক। তাই পাকিস্তান গণপরিষদে ব্যবহার্য। একাধিক ভাষার ক্ষেত্রে উর্দু-ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকে গ্রহণে অসম্মতি এই শ্রেণীর মনে এমন আশঙ্কাই জাগিয়ে তুলেছিল যে, কেন্দ্রীয় বৃত্তে বাংলা ভাষার অনুপস্থিতিতে তাদের অর্থনৈতিক সুযােগ-সুবিধা সঙ্কুচিত হতে বাধ্য। এখানে বিষয়-বাস্তবতা পূর্ববঙ্গের ইসলামপন্থী ও তাদের বিরােধীদের সমানভাবেই স্পর্শ করে। বাংলার পক্ষে তমদুন মজলিসের প্রতিক্রিয়া এর একটি উদাহরণ। তাই এই বিষয়-ক্ষেত্রে গণপরিষদের সিদ্ধান্তের সূত্র ধরে উল্লিখিত শিক্ষিত শ্রেণীর একটি বড় অংশ অর্থাৎ ছাত্র-যুবক এবং নিম্নমধ্যবিত্ত-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর।  

সরকারি কর্মচারীদের একাংশ বিক্ষোভে অংশ নেয়। অর্থাৎ বিকাশমান মধ্যবিত্ত শ্ৰেণী ভাষাকে কেন্দ্র করে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও শ্রেণীগত স্বার্থের কারণে বিক্ষোভে প্রতিবাদে প্রধান অংশগ্রহণকারী হয়ে ওঠে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কারণে উদীয়মান বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মনে যেমন তাদের আশা-আকাক্ষা ও অনৈতিক স্বার্থ কেন্দ্র করে ভাষা বিক্ষোভ ও ভাষা আন্দোলনের প্রকাশ, তেমনি। একথাও সত্য যে সেই ভাষা আন্দোলনই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশের গতি ত্বরান্বিত করেছে, অন্ততপক্ষে একথা বলা যায় যে ভাষা আন্দোলন ঐ বিকাশের প্রক্রিয়ায় গতিবেগ সঞ্চার করেছে। পাকিস্তানি অবাঙালি শাসকগণ তাদের ধর্মীয় ও সংস্কৃতি-চেতনা এবং ভাষাগত ভিন্নতার কারণে বাঙালিদের সম্পর্কে সৃষ্ট ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে এবং প্রধানত অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রশ্নে একের পর এক এমন সব অর্বাচীন পদক্ষেপ নিতে থাকেন যা শিক্ষিত বাঙালির ভাষা-চেতনা বারবার আহত করেছে এবং এই অব্যাহত আঘাত বিভিন্ন কারণের মধ্য দিয়ে তাদের ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবােধের উন্মেষ ঘটাতে সাহায্য করেছিল। অন্যদিকে এমন চিন্তা যথেষ্ট বাস্তবসম্মত যে, পাকিস্তানের জনসংখ্যা বিচারে সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববাংলার ভাষাকে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে অংশ নিতে দিলে সংখ্যালঘু অবাংলাভাষীদের অনেক বেশি প্রতিযােগিতার সম্মুখীন হতে হবে। তাই বাংলাবিরােধিতার বিষয়টি শাসকশ্রেণীর জন্য নিছক কিছু বিশ্বাস ও সংস্কৃতিগত চরিত্রেরই ছিল না, এর পেছনে তাৎপর্যপূর্ণ কারণটি ছিল অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক।

পরবর্তীকালে অর্থনৈতিক বৈষম্যের দিকটি ঠিকই প্রবল উপকরণ হিসেবে দেখা দিয়েছিল। অর্থনীতির এই সুবিধা-অসুবিধার বিষয়টি বাঙালির মগজে একেবারেই। ঢুকবে না, তাদের এতটা অর্বাচীন মনে করা সম্ভবত ঠিক ছিল না। পাকিস্তানকে বিশুদ্ধ ইসলামি রাষ্ট্রনীতিতে পরিচালিত করা হলে এই বৈষম্যমূলক আচরণ নাও ঘটতে পারতাে, এমন কথা কেউ কেউ বলে থাকেন। কিন্তু পাকিস্তানের দুই অংশে বিরাজমান ভৌগােলিক দূরত্ব, ভাষিক ও সাংস্কৃতিক প্রভেদ, নৃতাত্ত্বিক ও ঐতিহ্যগত বৈষম্য ইত্যাদি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। বৈষম্যমূলক উপাদান হিসেবে কাজ করতে পারে এবং সেক্ষেত্রে এইসব প্রভেদ অর্থনৈতিক স্বার্থের সাথে একাকার হয়ে যেতে পারে। শুধু ধর্মীয় ঐক্য সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক স্বার্থের পক্ষে কাজ করতে পারে না, যেমন করছে না বিশ্বের সংশ্লিষ্ট অনেক দেশেই। | তাই সবকিছু মিলে সংস্কৃতি অঙ্গনের চৌহদ্দি পেরিয়ে ভাষার বিষয়টি অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক স্বার্থের পটভূমিতে প্রধান বিষয় হয়ে উঠবে, এই সহজ অঙ্ক শিক্ষিত বাঙালির উচ্চাকাক্ষী অংশের পক্ষে বুঝতে না পারার কথা নয়। বিষয়টি তারা ঠিকই বুঝেছিল এবং জনসাধারণকেও বুঝতে সাহায্য করেছিল, । তৰে জনসাধারণকে বুঝতে দেয়নি তাদের শ্রেণীস্বার্থের দিকটি। 

ওদিকে গণপরিষদের ভাষাবিষয়ক আঘাত পুরনাে না-হতেই যখন শিক্ষা কমিশনের সুপারিশে বাংলার অন্তর্ভুক্তি খারিজ হয়ে গেল তখন শিক্ষিত বাঙালির চেতনায় সৃষ্ট প্রাথমিক বিক্ষোভে আরাে জ্বালানি সংযােজিত হলাে মাত্র। এমনি করে এক একটি বিন্দু অতিক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে আহত ক্ষতমুখের আয়তনিক বিস্তার ঘটেছে। শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ কেন্দ্র করে বাঙালি শিক্ষিত শ্রেণীর প্রতিবাদ প্রধানত ছাত্রসমাজের সক্রিয় পদক্ষেপে আটচল্লিশের ভাষা-বিক্ষোভ এবং আন্দোলনে পরিণত হয়। কিন্তু এর সীমাবদ্ধতা এবং কারণ আমরা সবাই জানি। জানি, ঢাকাবাসী জনতার প্রবল আন্দোলন-বিরােধিতার কথা। | আটচল্লিশ থেকে বাহান্ন । পরবর্তী এই চার বছরের ভাষা-চেতনা ও ভাষাবিক্ষোভের শিখাটি প্রতীকী অর্থে হলেও ধরে রাখে শিক্ষিত শ্রেণীর সক্রিয় প্রতিনিধি ছাত্র-যুব সমাজ। বিশেষভাবে বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতা ও কর্মিগণ। সেখান থেকে বাহান্নে পৌছে ছাত্র-যুব আন্দোলনের পরিধি ব্যাপক বিস্তার পেয়ে যায়। ছাত্র-যুব আন্দোলন পরিণত হয় গণআন্দোলনে। হয় জনতার ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণের ফলে; যেমন ঢাকা শহরে তেমনি প্রদেশের বিভিন্ন শহরে, শ্রমিক-অঞ্চলে, এমনকি কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে গ্রামাঞ্চলেও।

এই অংশগ্রহণ মুসলিম লীগের রাজনৈতিক ভিত্তি শিথিল করে দেয়, অর্থাৎ তাদের জনবিচ্ছিন্নতার সূচনা ঘটায় এবং তাতে গতিবেগ সঞ্চার করে; প্রমাণ চুয়ান্নর সাধারণ নির্বাচন। ভাষা আন্দোলনের এই রেখাচিত্রে গােটা আন্দোলনের যে চরিত্র-বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে তাতে দেখা যায়, ভাষা সংক্রান্ত আটচল্লিশ বা বাহান্নর কিংবা তারাে। আগেকার বিক্ষোভ-আন্দোলন হঠাৎ জেগে ওঠা কোন ঢেউ নয়, বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়, বরং তা এক দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়ার প্রতিফলন, যে প্রক্রিয়ার সূচনা বিশ শতকের গােড়ার দিকে মাতৃভাষার প্রশ্ন ঘিরে। দ্বিতীয়ত, বাহান্নর পূর্ববর্তী ভাষা বিষয়ক আন্দোলনে জনসাধারণ ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করে নি, যদিও ঢাকায় সরকারি কর্মচারীদের একটি অংশ শেষ-সাতচল্লিশে এবং অংশত আটচল্লিশে অংশ নিয়েছিল। বাহান্নে জনসাধারণের ব্যাপক অংশগ্রহণের ঘটনাটি ইতিহাসের বিষয় হয়ে আছে; কিন্তু কেন? | একটি সহজবােধ্য কারণ মুসলিম লীগ সরকারের অনাচার ও দুঃশাসন, কি কেন্দ্রে কি প্রদেশে (পূর্ব বাংলায়)। বিরােধীচিন্তার প্রতি এবং বিরােধী বক্তব্য, বিক্ষোভ ও আন্দোলনের প্রতি এদের স্বৈরাচারী নিপীড়ন-নির্যাতন তাে শুরু হয় সাতচল্লিশের পর থেকেই। তাই জেলখানায় অবধি গুলি চলেছে, কৃষক আন্দোলন গুলি ও বেয়নেটের মুখে স্তব্ধ করা হয়েছে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মাধ্যমে নিরীহ মানুষের রক্তস্রোতে প্রতিবাদী ধারা অন্য খাতে বইয়ে দেয়ার চেষ্টা চলেছে। | এছাড়াও রয়েছে অর্থনৈতিক কারণ যা মানুষকে সরকার-বিরােধী করে তুলেছিল, ভাষার মতাে একটি সর্বজনীন আবেদনসম্পন্ন বিষয় নিয়ে সংঘটিত 

আন্দোলন সেই ক্ষুব্ধ অসন্তোষ প্রকাশের সুযােগ এনে দিয়েছিল। সরকার-বিরােধী চেতনা পরিপক্ক হয়ে কানায় কানায় ভরে উঠেছিল। কিন্তু এই কি সব? কারণ, এগুলাে যেকোন সফল আন্দোলনের পেছনে নিহিত তাত্ত্বিক উপকরণ হিসেবে উপস্থিত থাকতে পারে এবং তা এক্ষেত্রে উপস্থাপন করা হয়েও থাকে। যে ঢাকা শহরে আটচল্লিশের ঢাকাই জনতা ভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে মারমুখী হয়েছিল তারাই সেখানে চার বছরের মধ্যে সম্পূর্ণ বিপরীত আচরণের প্রকাশ ঘটালাে কেন, এই পরিবর্তনের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে একটি গবেষণা-প্রবন্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শহুরে ছাত্রের তুলনায় তিনগুণ বেশি গ্রামীণ ছাত্রের উপস্থিতির কথা। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে। কিন্তু বিষয়টি এত সরল বলে মনে হয় না। কারণ মফস্বলে যখন একুশে এবং বাইশে ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের আগুন জ্বলে উঠেছে তখন এইসব ছাত্র ঢাকায় অবস্থান করছেন। এদের কেউ কেউ ছাত্রনেতাদের নির্দেশে নিজ নিজ এলাকায় গিয়েছেন ২৭ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘােষণার পর। বরং মফস্বলে আন্দোলন যে ঢাকার তুলনায় দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল সেক্ষেত্রে তাদের কিছুটা অবদান থাকতে পারে; কিন্তু তাও সব এলাকায় নয়। প্রসঙ্গত জনমানসে গুলিবর্ষণের প্রতিক্রিয়ার গুরুত্বও বিবেচনায় আসা উচিত। মুসলিম লীগের অনাচারী শাসনে জনচেতনার একাংশে অসন্তোষের যে বারুদ জমা হতে শুরু করেছিল পুলিশের গুলিবর্ষণ সেই শুকনাে বারুদে স্ফুলিঙ্গপাত ঘটায়। তাই ভুলে যাওয়া ঠিক নয় যে এই স্ফুলিঙ্গটিরও প্রয়ােজন ছিল। আর একথাও মনে রাখা দরকার যে বিশে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ঘােষণার পর রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলাের সাথে যােগাযােগ সত্ত্বেও ছাত্রসমাজ বাদে স্থানীয় জনমানসে ভাষা আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন সংগ্রহ সহজ হয় নি। একুশে ফেব্রুয়ারি সকালে পুরনাে ঢাকায় সাধারণ ধর্মঘট বড় একটা পালিত হয় নি। অথচ গুলিবর্ষণের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর স্বতঃস্ফূর্তভাবেই দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়, মানুষ মেডিকেল হােস্টেল ও হাসপাতালের দিকে ছুটতে থাকেন। পরদিনের (২২ ফেব্রুয়ারি) হরতাল ও ছিল একেবারে স্বতঃস্ফূর্ত ঘটনা, জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করার কোন প্রয়ােজন হয় নি। এরা ছিলেন প্রধানত স্থানীয় অধিবাসী, অধিকাংশই তরুণ এবং যুবক; দোকানি, ছােটোখাটো ব্যবসায়ী অথবা দোকান এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী। এই অবস্থার কারণে আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট কেউ কেউ এখনও বলে থাকেন, একুশে ফেব্রুয়ারি গুলি না চললে ছাত্র আন্দোলন। এত সহজে গণআন্দোলনে রূপান্তরিত হতাে না।

শুধু ঢাকায় নয়, মফস্বলেও গুলিবর্ষণের খবর আন্দোলনে দাবানলের ব্যাপ্তি সৃষ্টি করেছিল। অবশ্য দেশে এর আগে নানা উপলক্ষে গুলি চলেছে, কিন্তু সেসব ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় নি। সদ্যপ্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে তৎকালীন (১৯৪৮-এ) কমিউনিস্ট পার্টির হঠকারী নীতির কারণে সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনার আলােকে  সরকার-বিরােধী সব তৎপরতাই সরকার রাষ্ট্র-বিরােধী কমিউনিষ্ট প্রভাবিত কার্যক্রম বলে প্রচার করে গুলিচালনার যৌক্তিকতা প্রমাণের চেষ্টা করেছেন। আর জনসাধারণ সেসব প্রচার বিশ্বাসও করেছেন। তাই কমিউনিস্টদের সঙ্গত প্রতিবাদ বা কৃষক আন্দোলন দমন করতে নির্বিচার গুলি ব্যবহার ও নির্যাতন জনগণকে তখন বিচলিত করে নি। করেনি পাকিস্তানি মৌতাতের কারণে। আমরা দেখেছি আন্দোলনে জনতার ব্যাপক অংশগ্রহণ সত্ত্বেও ঢাকায় এবং অন্যত্র, বলা যায় সর্বত্রই আন্দোলনের নেতৃত্ব ছিল ছাত্র-যুবসমাজের হাতে; কোথাও কোথাও গণতন্ত্রমনা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এদের সঙ্গে ছিলেন। কিন্তু এই মধ্যপন্থী গণতন্ত্রীরা আন্দোলনের সঙ্কটে বা ক্রান্তিলগ্নে বরাবরই আপােসবাদিতার পথ ধরে চলেছেন, কখনাে দূরে কখনাে কাছে থেকেছেন—যখন কাছে তখন আন্দোলন স্থগিত করার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়েই এসেছেন।

এ প্রসঙ্গে নেতৃত্বের স্বরূপ তথা শ্রেণীচরিত্রের সম্পর্কে প্রশ্ন ওঠে। সম্ভবত । ভাষার সর্বজনীন চরিত্রের কারণে নেতৃত্বে বিভিন্ন পরস্পর-বিরােধী মতাদর্শের অর্থাৎ বাম, দক্ষিণ ও মধ্যপন্থীদের সমাবেশ ঘটেছিল। সাতচল্লিশ-আটচল্লিশে ছিল দক্ষিণ ও মধ্যপন্থীদের প্রাধান্য; বাহান্নে বামপন্থীদের প্রাধান্য। তাই দেখতে পাই বাহান্নে মধ্যপন্থী গণতন্ত্রী রাজনীতিক ও ছাত্রনেতৃত্বে সুবিধাবাদী অংশ আন্দোলনে পিছুটানের শক্তি হিসেবে দেখা দিয়েছিল। এরা ১৪৪ ধারা ভেঙে সরকারের সঙ্গে সংঘাতে যেতে রাজি ছিলেন না। পরস্পর-বিরােধী উপাদানের কারণে মতাদর্শগত বিরােধ আন্দোলনে বরাবরই সক্রিয় থেকেছে; বিশেষ করে নীতি ও কর্মপন্থা নির্ধারণের ক্ষেত্রে (যে মতবিরােধের চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটেছিল ১৪৪ ধারা ভাঙা না ভাঙার প্রশ্নে, যেখানে আওয়ামী মুসলিম লীগ, ছাত্রলীগ ও তাদের সহযােগিগণ ১৪৪ ধারা ভাঙার বিরােধিতায় তৎপর হয়ে ওঠেন)। অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে সৃষ্ট এই দুর্বলতা আন্দোলনে পূর্বাপর সক্রিয় ছিল। | নেতৃত্বের দ্বিতীয় দুর্বলতা ছিল এই উপলক্ষে ভাষাভিত্তিক গণতান্ত্রিক সরকার। প্রতিষ্ঠা বা অনুরূপ রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনা উপলব্ধি করে তা রাজনৈতিকভাবে। উপস্থিত করতে না পারা এবং আন্দোলনে ভাটার টান পরিস্ফুট হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলনের শরিক জনসাধারণের মৌলিক দাবি-দাওয়া বিষয়সূচিতে অন্তর্ভুক্ত করে আন্দোলনে নতুন মাত্রা সংযােজন ও গতিবেগ সঞ্চারে ব্যর্থতা।

শেষােক্ত বিষয়টি রাজনৈতিক বিচারে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ এর ফলে আন্দোলনে দেশব্যাপী জনসংশ্লিষ্টতা আরাে ব্যাপক হতে পারতাে, এর তীব্রতাও বৃদ্ধি পেতে এবং গােটা আন্দোলন রণকৌশলের দিক থেকে সমৃদ্ধ হয়ে গণতান্ত্রিক জাতীয়তার রাজনৈতিক অর্থে অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ লক্ষ্যে পৌঁছানাের পদক্ষেপ। নিতে পারতাে। সে ক্ষেত্রে মুসলিম লীগ প্রশাসনের পক্ষে এত তাড়াতাড়ি, এত সহজে এমন একটি শক্তিমান, ব্যাপকভিত্তিক আন্দোলন স্তব্ধ করে দেয়া সম্ভব  হতাে না। প্রকৃতপক্ষে এখানেই ছিল নেতৃত্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুর্বলতা।। _ এই দুর্বলতার সম্ভবত অন্যতম প্রধান কারণ ছিল ছাত্র-যুব নেতৃত্বের প্রধান। অংশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীচরিত্র ও শ্রেণীস্বার্থ। আন্দোলনে ব্যাপক জনসংশ্লিষ্টতার পরিপ্রেক্ষিতে এৱা জনস্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করেও সেই স্বার্থ অর্জনের পথে পা বাড়াতে আগ্রহী ছিলেন না, যদিও নেতৃত্বের অতি অল্পসংখ্যকের মধ্যে ভিন্ন চিন্তা উপস্থিত ছিল। তৎকালীন কম্যুনিস্ট পার্টি চেষ্টা করেও এ চেতনা আন্দোলনের মূল নেতৃত্বে সঞ্চারিত করতে পারে নি। আন্দোলনের চরিত্র বিচারেও একই কথা বলতে হয়। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নেতৃত্বাধীন এই আন্দোলনে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার উপাদান উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও জাতীয়তার বােধ জনসাধারণের সর্বজনীন স্তরে সঞ্চারিত হয় নি বা করার চেষ্টা হয় নি। বরং এর রাজনৈতিক চরিত্র বারবার নানা আপােসবাদিতার শিকার হয়েছে। যেমন স্বৈরাচারী শক্তির বিরােধিতা সত্ত্বেও তাদের অভিভাবক শক্তি সাম্রাজ্যবাদের বিরােধিতার প্রশ্নটি সামনে আসে নি। হয় নি শাসকশ্রেণীর উগ্ৰসাম্প্রদায়িক চরিত্র উন্মোচনের চেষ্টা। কিছু স্লোগানেই তা সীমাবদ্ধ থেকেছে। এই আন্দোলনের অসাম্প্রদায়িক চরিত্রও সাম্প্রদায়িক গােষ্ঠীর ওপর আঘাতের মাধ্যমে পরােক্ষে অর্জিত হয়েছে। হয়েছে চুয়ান্নর সাধারণ নির্বাচনে পূর্ববাংলায় সাম্প্রদায়িক লীগ সরকারকে উৎখাতের মাধ্যমে।

অথচ প্রত্যক্ষভাবে এই চরিত্র অর্জিত হতে পারতাে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র গঠনের চিন্তার মাধ্যমে, কিন্তু সেই লক্ষ্য আন্দোলনে উচ্চারিত হয় নি। বরং উচ্চারিত হয়েছে উপস্থিত রাষ্ট্রকাঠামােয় বাংলার যুক্তিসঙ্গত স্থান নিশ্চিত করার স্লোগান : “উর্দু-বাংলা ভাই ভাই’, “উর্দুর সাথে বিরােধ নাই।’ অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এই প্রবল উচ্চারণে উর্দুর সাথে সহ-অবস্থানের নীতিই প্রকাশ পেয়েছে, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার রাজনৈতিক প্রতিফলন সেখানে পরিস্ফুট হয় নি। অবশ্য তা সত্ত্বেও ভাষা আন্দোলনে ‘ধর্মনিরপেক্ষ ভাষাভিত্তিক জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটেছে’২০৭। সঙ্গত কারণে এমন ধারণা কেউ কেউ পােষণ করেন। তবে একথা ঠিক যে, রাষ্ট্রভাষা বাংলার অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির সম্ভাবনা নিশ্চিত হয়। এই পথ ধরেই গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবােধ তথা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশের পথ উন্মুক্ত হয়। সম্ভব হয় সাহিত্য সংস্কৃতিকে খণ্ডিত ও বিকৃত করার চেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আন্দোলন সংগঠিত করে তােলার শক্তি ও সাহস অর্জন (প্রসঙ্গত রবীন্দ্রনাথকে বর্জন এবং নজরুলকে খণ্ডিত করার প্রয়াস স্মর্তব্য)। এদিক থেকে ভাষা আন্দোলনের চরিত্রে রয়েছে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ঐতিহ্য রক্ষা করার এবং অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিচর্চার পরিবেশ সৃষ্টির গুণগত বৈশিষ্ট্য।

এই প্রসঙ্গে একটি কথা বলে রাখা দরকার যে, ভাষা আন্দোলনে বিশেষ। শ্রেণীনির্ভর জাতীয় চেতনার উপস্থিতি ও তাদের নেতৃত্ব সত্ত্বেও এই পথেই  জাতিসত্তাভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা পত্তনের নীতিগত সম্ভাবনা চিহ্নিত হয়েছে; কিন্তু পূর্বোক্ত শ্রেণী-নেতৃত্বের রাজনৈতিক কারণে ঐ সম্ভাবনা বাস্তবের দেখা পায় নি। ভাষা আন্দোলনের চরিত্র-ধর্মের জটিলতা এবং এর উপাদানগত বিষয়ের নানামুখী চরিত্র নিয়ে লেখক বুদ্ধিজীবীরা এখনও একমত হতে পারেন নি বলেই এ সম্পর্কে বেশ কিছু মূল্যায়ন অমীমাংসিত রয়ে গেছে এবং এর মধ্যে জাতীয়তাবাদ সংক্রান্ত প্রশ্নটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যা আশু মীমাংসার দাবি রাখে। কারণ, বিষয়টি নিয়ে রাজনীতি ক্ষেত্রে যথেষ্ট জটিলতার প্রকাশ ঘটেছে, যা মােটেই আকাঙ্ক্ষিত নয়। | এ সম্পর্কে বশীর আল হেলাল তার ইতিহাস গ্রন্থে স্পষ্টই বলেছেন যে, ভাষার। মতাে স্পর্শকাতর আন্দোলনেও বাঙালি জাতীয়তার চেতনার কোনাে উন্মেষ হয় নি।”২০৮ যুক্তি হিসেবে তার মতে এর পেছনে রয়েছে পাকিস্তানি আদর্শের প্রতি আনুগত্য। তাছাড়াও সুনির্দিষ্ট, স্বতন্ত্র ভাবাদর্শের অভাব।

অন্যদিকে বদরুদ্দিন উমর বিষয়টিকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন। তিনি পাকিস্তান আমলে শ্রমিক-কৃষকের ওপর নানামাত্রার নির্যাতনের প্রশ্ন তুলে জনসাধারণের শ্রেণীগত শােষণ ও নির্যাতনের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন। তার মতে “ভাষা আন্দোলন সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদকে বাতিল করলেও এমন এক ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটাতে থাকে যার নেতৃত্বে এসে যায় বুর্জোয়া শ্রেণী।২০৯ | বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ভাষা আন্দোলনের ওপরে পরিচালিত সমীক্ষায় এ প্রসঙ্গে লেখকগণ মাঝামাঝি একটি অবস্থান নিয়েছেন। তাদের মতে, সব মিলিয়ে ভাষা আন্দোলনের পেছনে গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। তবে এর বেশি নয়। প্রগতিশীলতাকে বাড়িয়ে দেখার কোন অবকাশ নেই।”২১০ তবে এতে জাতীয়তাবাদী চেতনার উপস্থিতির কথা তারা অস্বীকার করেন নি। | অবশেষে আরাে একটি বিষয়, ঠিক আলােচনার নয়, আপাতত উল্লেখের অপেক্ষা রাখে, আর তা হলাে ভাষা আন্দোলনে কৃষক-শ্রমিকের ব্যাপক অংশগ্রহণ। এ বিষয়টিতে বদরুদ্দিন উমর জোর দিয়েছেন সবচাইতে বেশি। তার মতে, ‘পূর্ববাংলার কৃষক-শ্রমিক ও বিভিন্ন পেশায় নিয়ােজিত মেহনতি জনগণের সকল অংশ যতখানি ব্যাপক ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসেছিলেন, ততখানি অন্য কোথাও নয়। প্রায় অনুরূপ মতামত প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট গবেষকগণ। তাদেরও মতে ব্যাপক কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ এতে যােগ দেয়। তবে অন্য লেখকদের অনেকেই এ সম্পর্কে ন্নি মত পােষণ করেন।

এ সম্পর্কে শেষ কথা উচ্চারণের পূর্বে ব্যাপকভিত্তিক পরিসংখ্যান সংগ্রহের প্রয়ােজন রয়েছে বলে আমাদের বিশ্বাস। কারণ স্নিমতের বাস্তবতাও একেবারে।  উড়িয়ে দেয়া যায় না। যেমন, ঢাকায় বাইশে ফেব্রুয়ারির গণআন্দোলনে বিক্ষোভরত অংশগ্রহণকারী জনতার অধিকাংশই ছিলেন বিভিন্ন ছােটোখাটো পেশার মানুষ, শ্রমিক-কৃষক নন। মফস্বলের বেশ কয়েকটি শহরেও অবস্থা প্রায় এরকমই ছিল, তবে সেসব স্থানে পেশাজীবীদের প্রাধান্য লক্ষণীয়। শ্রমিক অঞ্চলের কথা আলাদা, যেমন নারায়ণগঞ্জের শ্রমিক এলাকা। অন্যদিকে কৃষকদের ক্ষেত্রে সক্রিয় অংশগ্রহণের পরিবর্তে মূলত সমর্থনটাই ছিল প্রধান বিষয় এবং তা ছিল রাজনীতি-সচেতনতা নির্ভর। স্বভাবতই তা ব্যাপক ছিল না। সবশেষে বলতে হয়, ভাষা আন্দোলন মূলত বাংলাদেশের শিক্ষিত (মধ্যবিত্তপ্রধান) শ্রেণীর আন্দোলন, যেখানে ছাত্র-যুব গােষ্ঠী নেতৃত্ব দিয়েছে। আন্দোলনের বিশেষ পর্যায়ে জনসাধারণ ব্যাপকভাবে অংশ নিয়েছেন এবং ক্ষেত্র বিশেষে ছাত্র আন্দোলনকে গণআন্দোলনের চরিত্রে উন্নীত করেছেন। এখানে বাঙালি জাতিসত্তা ও জাতীয়তার সর্বজনীন আশা-আকাঙ্ক্ষার উপাদান নিহিত ছিল, কিন্তু পূর্ণচরিত্রে বিকাশ লাভ করে নি। এতে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমানসের আশা-আকাক্ষার সচেতন প্রতিফলন ঘটে নি; শ্রেণীবিশেষের অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক স্বার্থের পক্ষে জনসমর্থনের প্রকাশ ঘটেছে। অর্থাৎ জাতীয়তার বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে বুঝে নিয়ে তারা আন্দোলনে অংশ নেননি, স্বতঃস্ফূর্ত সরকার-বিরােধিতাই ছিল প্রধান ঘটনা। আন্দোলনের নানা দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে এতে যে গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনা নিহিত ছিল, পরবর্তী দশকে এই চেতনারই ক্রমবিকাশ ঘটেছে, যার ফলে একটি ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছে, যেখানে প্রধানত আমলা ও মুৎসুদ্দি বুর্জোয়ার শ্রেণীস্বার্থই প্রধান নিয়ন্ত্রক শক্তি। জাতিসত্তাভিত্তিক চেতনার পূর্ণ বিকাশ জনচেতনার স্তরে সংঘটিত হয়ে তার রাজনৈতিক বাস্তবায়ন ঘটায়নি বলেই সাতচল্লিশের ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ একাত্তরে এসে বাঙালি শিক্ষিত শ্রেণী ও আমলা-মুৎসুদ্দি ধনিকের জাতীয়তাবাদে পরিণত। এমন কি ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটি যে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা পেয়েছে তা নিয়ে গর্ব-অহংকার ঐ শিক্ষিত শ্রেণীরই। সাধারণ মানুষ এসব খবর রাখেন না। তাই জনমানসের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের প্রয়ােজনে জনগণের রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে জাতিসত্তার আন্দোলন শেষ করার প্রয়ােজন এখনও রয়ে গেছে। এর পূর্বচেতনারূপে ভাষা আন্দোলনের অস্তিত্ব অনস্বীকার্য। 

 

সূত্র : ভাষা আন্দোলন-ইতিহাস ও তাৎপর্য – আবদুল মতিন, আহমদ রফিক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!