You dont have javascript enabled! Please enable it! চুয়ান্ন থেকে ছাপ্পান্ন - সংগ্রামের নোটবুক

চুয়ান্ন থেকে ছাপ্পান্ন

চুয়ান্নর নির্বাচন : অভাবনীয় ফলাফল। বাহান্নর গণবিস্ফোরণের চেতনাসমৃদ্ধ প্রতিবাদী পদক্ষেপ যে পরিবর্তনের সম্ভাবনা তুলে ধরেছিল চুয়ান্ন তারই অবিশ্বাস্য বাস্তবায়ন সম্পন্ন করেছিল; কিন্তু এই পরিবর্তনের সুফল ধরে রাখতে পারা যায় নি। এবারও সেই মতাদর্শগত বিরােধ, সুস্পষ্ট অন্তর্দ্বন্দ্ব, যা বারবারই আন্দোলন পরিচালনার নেতৃত্বে দেখা দিয়েছে, তা সে জঙ্গি প্রতিবাদী আন্দোলনই হােক কিংবা সংসদীয় রাজনীতির স্বৈরাচারবিরােধিতাই হােক। | পাকিস্তানি রাজনীতির স্বৈরাচারী যাত্রায় নাটকীয় পরিবর্তনের পটভূমি ছিল ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচন। বাহান্নর ভাষা আন্দোলন স্বৈরাচারী শাসনের ভিত নড়বড়ে করে দিয়ে জনচেতনায় যে লীগ-বিরােধী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, হকভাসানী-সােহরাওয়ার্দির ত্রিমুখী নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্টের বিপুল নির্বাচনী বিজয় এবং মুসলিম লীগের অভাবনীয় ভরাডুবি সেই বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটিয়েছিল। এ সময়ের বিস্তারিত রাজনৈতিক আলােচনা আপাতত আমাদের উদ্দেশ্য নয়, ভাষা আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতায় চুয়ান্ন-ছাপ্পান্নর কয়েকটি সংশ্লিষ্ট রেখাচিত্রের পরিচয়ই শুধু আমরা এখানে তুলে ধরতে চেয়েছি। | সে বছরের (অর্থাৎ ১৯৫৪’র) একুশে ফেব্রুয়ারি তথা শহীদ দিবস ঐ রাজনৈতিক পরিবর্তনের সম্ভাবনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল, বলা যায় লক্ষ্য অর্জনের কাজ ত্বরান্বিত করেছিল। হয়তাে এমন একটি ভয় লীগ সরকারের মনেও ছিল, তাই অতিসাবধানতার প্রয়ােজনে তারা নির্বাচন পূর্ববর্তী শহীদ দিবসের ঘনঘটা বানচাল করার উদ্দেশ্যে ব্যাপক ধরপাকড় ও দমননীতির আশ্রয় নেন। বলাই বাহুল্য এই অর্বাচীন প্রক্রিয়া ও ভুল পদক্ষেপের ফল হয়েছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। জনমনে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া মুসলিম লীগের ভরাডুবির কাজটি সম্পূর্ণ করেছিল। 

সরকার পক্ষে এই নিপীড়নমূলক ত্রাসের পরিবেশ কায়েম করা সত্ত্বেও শহর ঢাকায় এবং দেশের অন্যত্র ব্যাপক উদ্দীপনায় শহীদ দিবস পালিত হয়। সে বছর একুশে ফেব্রুয়ারির বিশেষত্ব ছিল সুদূর গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত স্কুল-কলেজে তেপ্পান্নর চেয়েও অধিকতর উত্তাপ নিয়ে শহীদ দিবস পালন।২০২ আসন্ন নির্বাচনের কারণে এই উত্তাপ সহজেই জনমানস স্পর্শ করে। সে বছর তেপ্পান্নর তুলনায় অধিকহারে দেশের সর্বত্র শিক্ষায়তন ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলাে শহীদ মিনারের ‘মিনিয়েচার’-এ ছেয়ে যায়। বিজয়ের প্রতীক হিসেবেই এরা দাড়িয়েছিল, যেমন কখনও দাঁড়িয়েছে প্রতিবাদ বা সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে। একটি তথ্য এখানে মনে রাখা দরকার যে, নির্বাচন ছাত্রসমাজের প্রত্যক্ষ বিষয় হওয়া সত্ত্বেও জাতীয় প্রয়ােজনে স্বৈরাচারী গণদুশমনের পরাজয় নিশ্চিত করতে অনেক সময় ছাত্রসমাজ সক্রিয় ও অগ্রগামী ভূমিকা নিয়ে থাকে। বাহান্নর উত্তাপ চৈতন্যে ধারণা করে ছাত্র-যুবসমাজ জাতীয় প্রয়ােজনের এই আবশ্যিক লক্ষ্য পূরণে এগিয়ে এসেছিল। তাই দেখা যায়, নির্বাচনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাে বটেই, এমনকি নির্বাচনে সদাপ্রহরার জন্য গঠিত কর্মশিবিরেরও মূল চালিকাশক্তি ছিল প্রগতিশীল ছাত্র-যুবসমাজ। এদের একটি বড় অংশ ছিল যুবলীগের এবং কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সংশ্লিষ্ট ছাত্র-যুব কর্মীবৃন্দ। একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনাধৃত একুশ দফার প্রেক্ষাপট তাদের জন্য হয়ে উঠেছিল মতাদর্শগত লড়াইয়ের ক্ষেত্র। সত্যি বলতে চুয়ান্নর নির্বাচন ছাত্র-যুব কর্মীদের জন্য ছিল একুশ দফার লড়াই, যার মধ্যে ভাষা ও সংস্কৃতি বিশেষ স্থান দখল করে ছিল। হয়তাে এজন্যই ছাত্রদের সঙ্গে আলাপ প্রসঙ্গে মৌলানা ভাসানী কথাটা প্রায়ই বলতেন যে, একুশ দফার বিজয় ছাত্রদের বিজয়। তার মতে বিষমকোণী যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী বিজয়ের চালিকাশক্তিও ছিল ছাত্রসমাজ ।২০৩ এসব থেকেও বুঝে নিতে পারি, ভাষা আন্দোলন কীভাবে এ দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করেছিল এবং ছাত্র-যুবসমাজ কী তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকাই না নিয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তানে প্রতিক্রিয়া মার্চের নির্বাচন শেষে লীগ-বিরােধী যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠনের পর পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় প্রশাসনের টনক নড়েছিল বলে মনে হয়।

তারা ভাষার প্রশ্নটিকে নির্বাচনী পরাজয়ের কারণ মনে করে তড়িঘড়ি ব্যবস্থা নেয়ার উদ্দেশ্যে ১৯ এপ্রিল করাচিতে প্রধানমন্ত্রী মােহাম্মদ আলীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির সভায় উর্দুর সাথে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের সিন্ধান্ত নেন। কিন্তু সেইসঙ্গে আরাে একটি চমকপ্রদ সিদ্ধান্তও নেয়া হয় যে, উপরের সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও আগামী বিশ বছর ইংরেজিই সরকারি ভাষা হিসেবে চালু থাকবে।২০৪ কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি উচ্চম্মন্যতায় এত সহজ মীমাংসা সম্ভব ছিল না। তাই  ‘জং’, ‘আঞ্জাম’ ইত্যাদি সংবাদপত্র মহল এবং বাবায়ে উর্দু ড. আবদুল হকের। মতাে পরাক্রান্ত বুদ্ধিজীবীদের দাপটে বাংলা ভাষার প্রশ্ন আবার মুলতবির অন্ধ গহ্বরে ফিরে গেল। বাইশে এপ্রিল করাচিতে প্রচণ্ড বাংলা-বিরােধী বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। উর্দুকে একমাত্র জাতীয় ভাষা ঘােষণার দাবিতে ছাত্রছাত্রীরাও বিক্ষোভে অংশ নেয়। অবশ্য এই বিক্ষোভ ছিল উর্দুভাষী মােহাজের তথা “বিহারী’দের, স্থানীয় সিন্ধিদের নয়। বিক্ষোভকারিগণ স্থানীয় একটি সিন্ধি দৈনিক পত্রিকা অফিসে অগ্নিসংযােগের চেষ্টা চালায়, গণপরিষদ ভবনের দরজা-জানালা ভাঙে, বাসে অগ্নিসংযােগ করে।২০৫ | অন্যদিকে এপ্রিলের শেষদিকে করাচিতে আবদুল মজিদ সিন্ধির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সিন্ধিদের সভায় জঙ্গি উর্দুভাষীদের নিন্দা এবং পাকিস্তানের সবকটি প্রদেশের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা ঘােষণার দাবি করা হয় ।২০৬ এবারও তাই বাংলা রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন গণপরিষদ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। এরপর তাে ৩০ মে ৯২-ক ধারার আধা-মার্শালি আঘাতে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার অকাল সমাধি রচিত হয়। শুরু হয় পূর্ববঙ্গে ব্যাপক ধরপাকড়। কয়েক হাজার রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। তখন সেই স্বৈরাচারী সন্ত্রাসের পটভূমিতে কথাটা খুবই প্রচলিত হয়ে ওঠে যে, পূর্ববাংলার জাতীয়তাবাদী ধারা ও গণতন্ত্রমন্যতাকে ভয় পাইয়ে দিতেই কিছুটা অপ্রয়ােজনীয় কঠোরতা দেখানাে হয়েছিল আধা-সামরিক শাসনের পক্ষ থেকে। স্বৈরশাসনে শহীদ দিবস। ১৯৫৫ সালের স্বৈরশাসনামলে একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ দিবস পালন মােটেই সহজ ছিল না। মনে হয় বিগত দুই বছরের শহীদ দিবস পালনের উদ্দীপনা মুছে দিতে আধা-সামরিক শাসন সে বছর একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। ক্রুদ্ধ চিতার মতাে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তা সত্ত্বেও প্রতিটি ছাত্রাবাস প্রাঙ্গণে মাথা। তােলে শহীদ মিনার। ছাত্ররা এবার চূড়ান্ত সাহসের পরিচয় দেন। কুয়াশাঘেরা। ভােরে প্রতিটি ছাত্রাবাস থেকে আওয়াজ ভেসে আসে : রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। উড়তে থাকে কালাে পতাকা। | পুলিশ একে একে প্রতিটি ছাত্রাবাস ঘিরে ফেলে। ফজলুল হক হল, মেডিকেল কলেজ হােস্টেল, সলিমুল্লাহ হল, ইকবাল হল, জগন্নাথ কলেজ প্রতিটি ছাত্রাবাস ও কলেজে পুলিশের হামলা চলে। গ্রেফতার হন কর্মরত সংগ্রামী ছাত্রগণ। চলে। ছাত্রাবাসের কক্ষে কক্ষে তল্লাশি, লাঠিচার্জ, গ্রেফতার। তবু এক অনমনীয় জেদ ও আত্মবিশ্বাসে ভর করে স্লোগান ওঠে : ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘শহীদ স্মৃতি অমর হােক’। এই ছিল ১৯৫৫ সালে আধা-সামরিক শাসনামলে শহীদ দিবস উদযাপনের চেহাৱা। তবে এর মধ্যেই মেডিকেল হােস্টেলের রাজনীতিসচেতন ছাত্রকর্মীরা ২০ 

ফেব্রুয়ারি রাতে পরদিনের কর্মসূচির জন্য যে শহীদ মিনারে তৈরি করে, পুলিশ তা ভেঙে ফেলে। কিন্তু ছাত্ররা পূর্ব সিদ্ধান্ত মাফিক একুশ তারিখে আর্টস বিল্ডিং প্রাঙ্গণে আমতলার সভায় যােগ দিতে গেলে পুলিশের তৎপরতায় বেশ কিছু সংখ্যক ছাত্র গ্রেফতার হন। সভার অনুষ্ঠান সম্ভব হয়ে ওঠে না (শিশিরকুমার মজুমদার, তৎকালীন ছাত্র)। ভিন্ন পরিবেশে শহীদ দিবস : প্রতিবাদী চরিত্র অক্ষুন্ন। ১৯৫৬ সালে আধা-মাশালি শাসন প্রত্যাহারের পর রাজনীতি আবার ভিন্ন মােড় নেয়। চলে রাজনৈতিক আপােসবাদিতা ও সুবিধাবাদী প্রতিযােগিতার পালা। তা সত্ত্বেও সে বছর একুশের উদযাপন অন্য অর্থে তাৎপর্যপূর্ণ। যুক্তফ্রন্টের শরিক দল কৃষক শ্রমিক পার্টির আবু হােসেন সরকারের নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। | ঐ বছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে সরকারিভাবে শহীদ মিনারের ভিত্তি স্থাপন করা হয়। মেডিকেল কলেজ ছাত্রদের হাতেগড়া প্রথম শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের কাছাকাছি নতুন শহীদ মিনারের আনুষ্ঠানিক ভিত্তিপ্রস্তর সম্মিলিতভাবে স্থাপন করেন মুখ্যমন্ত্রী আবু হােসেন সরকার, মৌলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং শহীদ বরকতের মা হাসিনা বেগম। সেবার শহীদ দিবস উদ্যাপনের ছবিটি মােটামুটিভাবে এ ধরনের। একুশে ফেব্রুয়ারি ভােরে সেই চিরাচরিত খালি পায়ে প্রভাতফেরি, শহীদ মিনারের ভিত্তির সামনে একটুক্ষণ নিঃশব্দে দাড়িয়ে কয়েকটা ফুল রেখে দিয়ে আজিমপুরের দিকে যাত্রা, সেখানে শহীদদের কবরে বাকি ফুলগুলাে রেখে দিয়ে বিষমুখে সুশৃঙ্খল পদযাত্রায় ঘরে ফেরা। আবছা ভােরে ছাত্রদের সম্মিলিত কণ্ঠের গানে আর স্লোগানে ঘুম ভেঙে শহরবাসী উঠে পড়েছেন বিছানা থেকে, কেউ কেউ যােগ দিয়েছেন মিছিলে, অনেকেই কণ্ঠ মিলিয়েছেন ছাত্রছাত্রীদের কণ্ঠস্বরে।

বিকেলে দুটো সভা অনুষ্ঠিত হয় শহীদ দিবস উদযাপন উপলক্ষে। একটি আরমানিটোলা ময়দানে মৌলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে, দ্বিতীয়টি পল্টন ময়দানে মুখ্যমন্ত্রী আবু হােসেন সরকারের সভাপতিত্বে। বলা বাহুল্য সরকারি উদ্যোগে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সভায় জনসমাগম ছিল অপেক্ষাকৃত কম। আরমানিটোলা ময়দানের সভায় দুটো গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব নেয়া হয়। এক, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণ সম্পর্কে নতুন করে তদন্ত অনুষ্ঠান। দুই, মেডিক্যাল কলেজের সামনে চৌমাথার ‘শহীদ এভিন্য নামকরণ এবং চারপাশের রাস্তাগুলাে শহীদদের নামানুসারে রাখা। তাছাড়া পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসন, কালাকানুন বাতিল এবং সকল রাজবন্দির অবিলম্বে মুক্তির দাবিতে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। সভাশেষে বিশাল মিছিল শহর প্রদক্ষিণ করে, মিছিলের নেতৃত্ব দেন। মৌলানা ভাসানী। | প্রায় পাঁচ দশক আগেকার বিশাল জনসভায় গৃহীত প্রস্তাব (‘শহীদ এভি  নামকরণ) আজ হয়তাে অনেকেরই মনে নেই। কিন্তু যুক্তিসঙ্গত ঐ প্রস্তাব ভাষাআন্দোলন, শহীদ মিনার ও শহীদ দিবসের গুরুত্ব বিবেচনায় বাস্তবায়নে সরকারের এগিয়ে আসা উচিত। শহীদ মিনারের অবস্থান বিচারে এ নামকরণ খুবই যথাযথ হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। | ১৯৫৬ সালেও দেখা যায় শহীদ দিবস উদযাপনের ক্ষেত্রে ছাত্র-জনতার আগ্রহ কোনােদিক থেকেই কমে আসে নি। স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ঐ বিশেষ দিনটিতে স্কুলকলেজ, সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়। যানবাহন, সিনেমা হল সবকিছু বন্ধ। থাকে, কিন্তু ব্যতিক্রম ছিল ‘মর্নিং নিউজ’ এবং ‘আজাদ’ পত্রিকা অফিস। তারা নির্বিকার স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে যায়। মর্নিং নিউজ’-এর ক্ষেত্রে বিষয়টি স্বাভাবিক হলেও দৈনিক আজাদ-এর জন্য যে এ আচরণ অস্বাভাবিক ছিল তা বলাই বাহুল্য।

ভাষা আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক বিজয় সূচিত হয় পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে বাংলার স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে। পাকিস্তান গণপরিষদে বহু টালবাহানার পর ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি এক প্রস্তাবে বলা হয় : পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু ও বাংলা। লক্ষণীয় যে এই প্রস্তাবে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের ভাষাটিকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘােষণা করতে গিয়ে দ্বিতীয় স্থানে বসানাে হয়েছে, গণতান্ত্রিক রীতিনীতির প্রতি চরম অবহেলা দেখিয়ে । পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে এমনি করে শাসকশ্রেণীর হাতে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি। সর্বদাই লঙ্ঘিত হয়েছে। প্রথম থেকেই এক ধরনের একনায়কী ও স্বৈরতন্ত্রী মনােভাব শাসকদের মনে কাজ করেছে। তাদের রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মে সেই মনােভাবেরই প্রতিফলন ঘটেছে। পূর্ববাংলার প্রতি কেন্দ্রীয় শাসকগণ এক ধরনের বিজাতীয় মনােভাবই দেখিয়েছেন কী অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, কী সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে। আর পূর্ববঙ্গে অধিষ্ঠিত মুসলিম লীগ শাসকশ্রেণী কেন্দ্রীয় শাসকদের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে প্রদেশে তাদের কাজ চালিয়ে গেছেন তাদের গদি রক্ষার প্রয়ােজনে। সেক্ষেত্রে স্থানীয় স্বার্থ ও দাবিদাওয়া পূরণের প্রতি তাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। প্রাদেশিক পরিষদ থেকে গণপরিষদের মুসলিম লীগ দলীয় তাবৎ বাঙালি সদস্যের মধ্যে এ দিক থেকে কোনাে ফারাক ছিল না। এদের মধ্যে ভিন্নমতের ব্যতিক্রমী ধারা তথা গণতান্ত্রিক ধারা তৈরি হয় বাহান্নর ভাষাআন্দোলনের প্রভাবে। এখানে ভাষা আন্দোলনের অন্য এক বিজয়। 

সূত্র : ভাষা আন্দোলন-ইতিহাস ও তাৎপর্য – আবদুল মতিন, আহমদ রফিক