You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাহান্নর মার্চ-পরবর্তী ঘটনাবলী

পুনর্গঠিত সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের তৎপরতা একুশের ভাষা আন্দোলনে বিরতি ঘটে অধিকাংশ নেতার গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে। আন্দোলনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে আতাউর রহমান খানকে আহ্বায়ক করে নতুন সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে বাহান্ন সালের সাতাশে এপ্রিল নবগঠিত সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে এক ভাষা সম্মেলন অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হয়। এই সম্মেলনে ভাষা আন্দোলন বিষয়ক একটি পর্যালােচনামূলক প্রতিবেদন প্রতিনিধিদের কাছে উপস্থাপন করা হয়। সম্মেলনে দেশের বিভিন্ন জেলা ও মহকুমা এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে কয়েকশ’ প্রতিনিধি যােগ দেন। ঢাকার প্রধান শিক্ষায়তন ও ছাত্রাবাসগুলাে থেকে যথাসম্ভব ছাত্রকর্মিগণও উপস্থিত হন। প্রবল উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে নবগঠিত সংগ্রাম পরিষদ তার যাত্রা শুরু করে। পরিষদের আহ্বায়ক আতাউর রহমান খান সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। সভাপতির ভাষণ পাঠের মাঝখানে আবেগ-বিহ্বল আতাউর রহমান হঠাৎ করেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যান। উপস্থিত মেডিকেল স্কুলের ছাত্র আবু জাফর ও আরাে কয়েকজনের শুশ্রুষায় তার জ্ঞান ফিরে আসে। কিছুক্ষণ বিরতির পর সভার কাজ শুরু হয় এবং কামরুদ্দিন আহমদ ভাষণের অবশিষ্ট অংশটুকু পাঠ করেন। ভাষণে বাংলা রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে নাজিমুদ্দিন-নুরুল আমিনের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের কথা বলা হয়, তুলে ধরা হয় সরকারি অপপ্রচারের সংক্ষিপ্ত চিত্র এবং গণপরিষদে তাদের নির্লজ্জ ভূমিকার কথা। আরাে বলা হয়, রাষ্ট্রভাষা সমস্যার পাশাপাশি অন্যান্য ছােটবড় সমস্যার কথা। কমিউনিস্টদের বিষয়ে সরকারি এলার্জির প্রসঙ্গও বক্তব্যে স্থান পায়। ভাষণে সাধারণভাবে রাজবন্দিদের মুক্তিদানের কথা বলা হলেও মৌলানা ভাসানীসহ জেলে আটক ভাষা আন্দোলনের মূল নেতৃত্বের অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তিদানের দাবি যথাযথ গুরুত্ব সহকারে উল্লিখিত হয় নি বলে  অনেকের ধারণা। সবশেষে দেশের সর্বত্র সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তােলার আহ্বান জানানাে হয়।

মফস্বলের প্রতিনিধিদের বক্তব্যে ঢাকার বাইরে আন্দোলনের এক আশ্চর্য সজীব। ছবি ফুটে ওঠে, যা ঢাকায় বসে জানা সম্ভব ছিল না। সমাবেশে শেখ মুজিবুর রহমানও বক্তৃতা করেন। তার বক্তব্য আমরা ইতােপূর্বে উল্লেখ করেছি। শেখ মুজিব রাষ্ট্রভাষার ওপর গণভােটের দাবি জানান। | এই সম্মেলনে উপস্থিত মফস্বলের, বিশেষ করে রাজশাহী, খুলনা, রংপুর, পাবনা, দিনাজপুর, বগুড়া, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও নােয়াখালি অঞ্চলের প্রতিনিধিদের বক্তব্য বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। এর অর্থ একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও সংশ্লিষ্ট দাবিগুলােকে দেশব্যাপী এক সজীৰ ইস্যুতে পরিণত করেছিল। আর ঐ সূত্রেই প্রশ্ন ওঠে যে নবগঠিত সংগ্রাম পরিষদের মূল রাজনৈতিক নেতাগণ কি ২৫ ফেব্রুয়ারি তাদের অধিকার বহির্ভূত হঠকারী সিদ্ধান্ত (সরকারকে চরমপত্র দান) নিয়েছিলেন সংগ্রাম পরিষদে তাদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে? যুক্তি তথ্য ও বিচার বিশ্লেষণ তাই বলে। সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাব সম্মেলনে দীর্ঘ বাইশ দফা প্রস্তাব গৃহীত হয়। তার মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ। প্রস্তাব নিম্নরূপ :১৯৮

এই সম্মেলন জনসাধারণকে এই মর্মে আশ্বাস প্রদান করিতেছে যে শহীদানের লােহু বৃথাই প্রবাহিত হয় নাই এবং যতদিন পর্যন্ত না বাংলা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে তাহার ন্যায্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়, ততদিন পর্যন্ত। দেশের কোন প্রকৃত দেশভক্ত লােকই নিশ্চেষ্ট থাকিবে না। ‘গণপরিষদে কতিপয় ভুয়া যুক্তি সৃষ্টি করিয়া রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণ স্থগিত রাখার বিষয় বিবেচনা করিয়া সম্মেলন এই মত পােষণ করিতেছে যে ইহা গড়িমসি নীতির দ্বারা জনগণের দাবিকে পাশ কাটাইয়া যাইবার জন্য গদীতে আসীন দলের আর একটি প্রচেষ্টা মাত্র। ‘ভাষার দাবিতে সমগ্র জনমত জাগরিত হওয়ায় এবং কতিপয় যুবা শাহাদৎ বরণ করিবার পরও রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গ জরুরি নয়’ বলিয়া সরকার যে হাস্যস্পদ যুক্তির অবতারণা করিয়াছে এই সম্মেলন তাহার তীব্র প্রতিবাদ করিতেছে। সর্বপ্রকার বাস্তব প্রয়ােজনের জন্য ইংরেজি অন্তত আরও ২০ বৎসরকাল পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার আসনে অধিষ্ঠিত থাকিবে বলিয়া মুসলিম লীগ নেতৃবর্গ ও তাহাদের সরকার যে মন্তব্য করিয়াছেন, এই সম্মেলন তাহাতে গভীর আশঙ্কা প্রকাশ করিতেছে। এই সম্মেলন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করিতেছে যে রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গ পাশ কাটাইয়া যাইবার জন্য জনগণের দাবিকে বলি দিবার ইহা আর একটি অসদুদ্দেশ্যপ্রণােদিত প্রচেষ্টা। 

‘এই সম্মেলন মনে করে যে দীর্ঘ পাঁচ বৎসর সময়কালের মধ্যে গণপরিষদ যে কেবলমাত্র একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়নেই শােচনীয়ভাবে ব্যর্থ হইয়াছেন তাহা নহে, জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ও অতিপ্রয়ােজনীয় সমস্যাবলীর একটিরও সমাধান করিতে পারে নাই। সুতরাং এই সম্মেলন অবিলম্বে এই গণপরিষদ ভাঙ্গিয়া দিয়া তাহার স্থলে বয়স্কদের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচনের দ্বারা নতুন একটি পরিষদ গঠনের দাবী জানাইতেছে। “রাষ্ট্রেভাষা আন্দোলনের বহুকমী ও নেতাকে বিনা বিচারে আটক রাখার জন্য এই সম্মেলন পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সরকারের মনােভাবের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা করিতেছে এবং অবিলম্বে তাহাদের বিনা শর্তে মুক্তি দাবি করিতেছে। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সরকার যেভাবে জননিরাপত্তা বা ‘সিকিউরিটি আইনের বলে শাসনকার্য চালাইতেছেন এবং জনগণের অধিকারসমূহকে পদদলিত করিতেছেন তাহাতে গভীর উদ্বেগ ও ঘৃণা প্রকাশ করিয়া এই সম্মেলন সকল অগণতান্ত্রিক, অমানবিক ও গণবিরােধী আইনসমূহ অবিলম্বে প্রত্যাহার এবং এই সকল কালাকানুনে ধৃত সকল বন্দীদের অবিলম্বে মুক্তি দাবি করিতেছে। এই সম্মেলন নারায়ণগঞ্জে রাইফেলের গুলিতে নিহত কনস্টেবলের মৃত্যুতে দুঃখ প্রকাশ করিয়া সরকারের নিকট দাবী জানাইতেছে যে গুলির আঘাতসংশ্লিষ্ট ঘটনা রহস্যাবৃত থাকিয়া যাওয়ায় দুইজন হাইকোর্টের বিচারপতি ও দুইজন জনপ্রতিনিধি কর্তৃক উক্ত ঘটনার বিস্তৃত ও প্রকাশ্য তদন্ত করা হউক। “এই সম্মেলন মুসলিম লীগ সরকার কর্তৃক সংবাদপত্রসমূহের স্বাধীনতা হরণের তীব্র নিন্দা করিতেছে।

‘এই সম্মেলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক অবিলম্বে বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করিতে এবং বিভিন্ন ভাষায় লিখিত পুস্তকাবলী বাংলা ভাষায় অনুবাদ করিতে একটি ব্যুরাে স্থাপনের জন্য এবং তজ্জন্য অন্তত সাড়ে চার লক্ষ টাকা মঞ্জুর করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে অনুরােধ করিতেছে। ‘এই সম্মেলন প্রস্তাব করিতেছে যে অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী একটি প্রতিবাদ দিবস ঘােষণা করা হউক।’ এছাড়াও এই সম্মেলনে ‘পাকিস্তান অবজার্ভার’-এর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, ‘মর্নিং নিউজ’-এর মিথ্যা প্রচারণার নিন্দা, আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মচারীদের হয়রানি অবসান, গুলিবর্ষণে নিহত ও আহতদের জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা, পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের জন্য প্রীতি ও সৌহার্দ্যভাবের উপযােগী ব্যবস্থা গ্রহণ ইত্যাদি দাবির ভিত্তিতে প্রস্তাব গৃহীত হয়। দেখা যাচ্ছে যে এই সম্মেলনে রাষ্ট্রভাষা বাংলার বিষয়টিই শুধু নয়, একাধিক রাজনৈতিক গুরুত্বের বিষয় প্রস্তাব হিসেবে এসেছে, যা সর্বদলীয় পরিষদ তথা   ভাষা আন্দোলনের সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক চরিত্র প্রকাশ করছে। ইতােমধ্যে ষােলই এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার ক্লাস শুরু হয়। সেইসঙ্গে শুরু হয় নির্বাপিত ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য কর্মতৎপরতার উত্তেজনা। সেইদিনই দুপুরে সংক্ষিপ্ত ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয় এবং সভায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবির পাশাপাশি রাজবন্দিদের মুক্তির দাবি জানানাে হয়। তিনদিন পর ছাত্রদের আরও একটি সভায় কারাগার থেকে ছাত্র-শিক্ষকদের মুক্ত করার জন্য ‘বিশ্ববিদ্যালয় লিগ্যাল ডিফেন্স কমিটি গঠন করা হয় । এরপর ২৬ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের সাধারণ সভায় বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আবদুল মতিন এবং কোন কোন সদস্যের জেলে থাকার কারণে পরিষদটি নতুন করে গঠন করা হয়। সম্ভবত ২৭ এপ্রিল সর্বদলীয় ভাষা সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য এই পুনর্গঠনের কাজটি অগ্রিম সম্পন্ন। করা হয়। পুনর্গঠিত সংগ্রাম পরিষদের এক সভায় পশ্চিম পাকিস্তানে শুভেচ্ছা মিশন প্রেরণ এবং ভাষা সম্পর্কে স্বাক্ষর অভিযান চালানাের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

সর্বদলীয় পরিষদের অন্তর্নিহিত দুর্বলতা। বিপুল উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে এপ্রিলের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সম্মেলন শেষ হওয়া সত্ত্বেও এর সিদ্ধান্তগুলাে বাস্তবায়িত করার জন্য এবং ভবিষ্যতে আন্দোলন পরিচালনার জন্য প্রয়ােজনীয় সাংগঠনিক কাঠামাে তৈরির দিকে এবারও নজর দেয়া হলাে না। এমনকি গত আন্দোলনের প্রধান দুর্বলতা যে এই সাংগঠনিক কাঠামাে, যেজন্য সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দেশব্যাপী আন্দোলন সুসংহত করা যায়। নি, সেইসব বিশ্লেষণও এই সম্মেলনের আলােচনায় স্থান পায় নি। অথচ এই বিষয়ের আলােচনাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ছাত্রপ্রতিনিধিদের উপস্থিতি সত্ত্বেও এই সম্মেলনে রাজনীতিকদের প্রাধান্যের কারণেই বােধহয় এইসব আলােচনা গুরুত্ব পায় নি এবং সংগঠন গড়ে তােলার দিকে মােটেই নজর দেওয়া হয় নি। রাজনৈতিক দলগুলাের নিজস্ব সাংগঠনিক কাঠামাের উপস্থিতিতে রাষ্ট্রভাষা। আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নতুন কাঠামাে তৈরিতে সম্ভবত রাজনীতিকদের আগ্রহ ছিল না। তাদের নিজ নিজ রাজনৈতিক লক্ষ্য ও আকাক্ষাই বরাবর প্রাধান্য পেয়েছে। হয়তাে এমন অভিযোেগ একেবারে অযৌক্তিক এবং অন্যায় হবে না যে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দল তাদের প্রয়ােজনে ভাষা আন্দোলনকে ব্যবহার করতেই চেয়েছে, এর রাজনৈতিক প্রসার ঘটাতে নয়। এইসব কারণে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি উদযাপিত হয়েছে, একে কেন্দ্র করে শিক্ষা ও সংস্কৃতি অঙ্গনে নতুন আন্দোলন জেগে উঠেছে, কিন্তু ভাষা আন্দোলনের মূল দাবি অপূর্ণ থাকা সত্ত্বেও ঐ সময় নতুন করে আন্দোলন আর জ্বলে ওঠেনি। ঐতিহাসিকভাবে বাহান্নেই ভাষা আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। এপ্রিল সম্মেলনের এই দুর্বলতার প্রধান কারণ মনে হয় এখানে জঙ্গী ছাত্র-যুব । 

নেতৃত্বের অনুপস্থিতি, যাৱা তখনও কারাগারে আটক। অথচ গােটা পূর্ববঙ্গের প্রতিনিধিত্বকারী এই রাষ্ট্রভাষা সম্মেলনে তাদের মুক্তির জন্য তেমন কোন জঙ্গী। আওয়াজ ওঠে নি, যা সভাপতির ভাষণে আসা উচিত ছিল। একমাত্র শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তব্যে ভাসানী ও আবুল হাশিমের কথা উচ্চারিত হয়েছে মাত্র। বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির গৃহীত স্বাক্ষর অভিযান শুরু করার প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে এই সম্মেলনেও বন্দিমুক্তি, সকল প্রকার কালাকানুন প্রত্যাহার এবং অবিলম্বে ইংরেজির পরিবর্তে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষাসমূহ। প্রচলনের ও বাংলা রাষ্ট্রভাষা প্রবর্তনের দাবি সংবলিত স্বাক্ষর গ্রহণ অভিযান পরিচালনার প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। পরে ১৫ মে (১৯৫২) থেকে সারাদেশে স্বাক্ষর গ্রহণ অভিযান শুরু করা হয়। এছাড়াও সর্বদলীয় পরিষদ ৫ ডিসেম্বর (১৯৫২) দেশের সর্বত্র ব্যাপকভাবে বন্দিমুক্তি দিবস পালনের আহ্বান জানায়। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, ‘বন্দিমুক্তি দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নিতে আট মাস সময় ব্যয় হলাে অন্যান্য ঘটনা বাহান্ন সালের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রাসঙ্গিক ঘটনা হলাে, ২০ নভেম্বর ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানের আওয়ামী লীগের বিরাট জনসভা। এই সভায় জনাব সােহরাওয়ার্দি তিন ঘণ্টাব্যাপী এক বক্তৃতায় বাংলা রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে তার আগেকার মত সংশােধন করে পাকিস্তানে বাংলা ও উর্দু রাষ্ট্রভাষা এবং ভাবের আদান-প্রদানের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে উর্দু ও পশ্চিম পাকিস্তানে বাংলা শিক্ষার দাবি জানান।১৯৯ এপ্রিল মাসেই ইব্রাহিম তাহা ভাষা আন্দোলনের ডাক জনগণের দরজায় পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যে পত্রিকা প্রকাশের প্রস্তাব রাখেন, কিন্তু কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদ এই প্রস্তাবে সাড়া দেয় নি। ১৯৫১ সালের শেষদিকে প্রতিষ্ঠিত ইসলামিক ব্রাদারহুডের পক্ষ থেকে বাহান্নর এপ্রিল মাসে প্রকাশিত একটি বুলেটিনে দেখা যায়, প্রধানত ইসলামি মতাদর্শের সফল প্রচার এবং সেই মতাদর্শভিত্তিক সমাজ গড়ে তােলার প্রয়ােজনে তারা রাষ্ট্রভাষা বাংলার সমর্থনে এগিয়ে আসেন। ইশতিয়াক আহমদ ছিলেন এ সময় ব্রাদারহুডের সাধারণ সম্পাদক ।২০০

সমাজনৈতিক চিন্তায় এরা অনেকাংশে তমদুন মজলিসের মতােই ছিলেন। এর পর সর্বদলীয় পরিষদের বন্দিমুক্তি দিবস উপলক্ষে ৫ ডিসেম্বর আরমানিটোলা ময়দানে আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই উপলক্ষে ৭ ডিসেম্বর সাপ্তাহিক ইত্তেফাক’-এ সভাপতির ভাষণ উদ্ধৃত করে বলা হয় যে, রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও বন্দিমুক্তির দাবিতে স্বাক্ষর অভিযান ফরমে এক কোটি লােক স্বাক্ষর দিয়েছেন। বন্দিমুক্তি প্রসঙ্গে ঐ সভায় শেখ মুজিবুর রহমান এক উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলেন যে, রাজবন্দিদের মুক্তি না দেয়া হলে দেশব্যাপী গণআন্দোলনের সৃষ্টি হবে। এবারও তিনি জেলে আটক মৌলানা ভাসানী ও তার সহকর্মীদের কথা উল্লেখ করেন। সভায় অন্যান্য বক্তাও অনুরূপ বক্তৃতা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য কলেজেও এই দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় বন্দিদের আশু মুক্তি দাবি করা হয়। বন্দীমুক্তির বিষয়টি এভাবেই আন্দোলনের উত্তর-প্রভাব হিসেবে নতুন করে রাজনৈতিক দাবিতে পরিণত হয়। মনে রাখা দরকার যে বাহান্নর ভাষাআন্দোলনে উচ্চারিত অন্যতম প্রধান স্লোগান ছিল রাজবন্দীদের মুক্তি চাই’। তখন রাজবন্ধী বলতে মূলত কমিউনিস্ট পার্টির ও কৃষক আন্দোলনের নেতা কর্মী, বামপন্থী ছাত্র যুবা ও প্রগতিবাদী বুদ্ধিজীবীরাই চিহ্নিত হয়েছেন। কিন্তু একুশে-উত্তর পর্বে রাজবন্দীর সংজ্ঞা বহুদলীয় ও সর্বজনীন চরিত্র অর্জন করে। সরকারের পক্ষে তখন আর বলা সম্ভব হয় নি যে কমিউনিস্ট ও রাষ্ট্রদ্রোহী ছাড়া জেলে কোনাে রাজবন্দী নেই।’ বন্দীমুক্তি আন্দোলনের চাপেই সরকারের পক্ষে ভাষাআন্দোলন উপলক্ষে ধৃত রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও ছাত্রদের বেশি দিন জেলে আটক রাখা সম্ভব হয় নি। বলা বাহুল্য বন্দীমুক্তি আন্দোলনের ক্ষেত্রে শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা ছিল। বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।

সূত্র : ভাষা আন্দোলন-ইতিহাস ও তাৎপর্য – আবদুল মতিন, আহমদ রফিক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!