পরবর্তী কয়েকদিনের ঘটনা
২৯ ফেব্রুয়ারি : নারায়ণগঞ্জে ভাষা আন্দোলন নানা কারণে নারায়ণগঞ্জে একুশে সংক্রান্ত ঘটনাবলী বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতপক্ষে একুশে ফেব্রুয়ারির দিনটি থেকেই নারায়ণগঞ্জে শুরু হয়েছিল সভা, বিক্ষোভ, হরতাল। একথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। | এই বিক্ষোভ অব্যাহত থাকার মধ্যেই ২৯ ফেব্রুয়ারি মর্গান বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মমতাজ বেগমের গ্রেফতারকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি গণবিক্ষোভের আকার ধারণ করে। আজাদ’-এর প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, নারায়ণগঞ্জে ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক মমতাজ বেগমকে পুলিশ সকালবেলা গ্রেফতার করে আদালতে নিয়ে এলে ছাত্রজনতা তার নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে আদালত ঘেরাও করেন। এই পরিস্থিতিতে পুলিশ তাকে ভ্যানে তুলে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা হলে বিপুলসংখ্যক জনতা চাষাঢ়া স্টেশনের কাছে রাস্তায় গাছ কেটে ব্যারিকেড তৈরি করে পুলিশ ভ্যান আটক করে। অবস্থা আয়ত্তে আনার জন্য। পুলিশ লাঠিচার্জ করে; কিন্তু তাতে জনতা আরাে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি গুরুতর বিবেচনায় শেষ পর্যন্ত ঢাকা থেকে বিপুলসংখ্যক পুলিশ অকুস্থলে পৌঁছালে জনতা-পুলিশে সংঘর্ষ শুরু হয়। সন্ধ্যার দিকে পুলিশের বেদম লাঠিপ্রহারে জনতা কিছুক্ষণের জন্য ছত্রভঙ্গ হলে পুলিশ সেই সুযােগে মমতাজ বেগমকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসে। সংঘর্ষে প্রায় ৪৫ জন আহত হন। এদের মধ্যে নয়জনকে গুরুতর আঘাতসহ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পুলিশ নারায়ণগঞ্জের ব্যবস্থা পরিষদ সদস্য ওসমান আলীর বাড়িতে হানা দেয় এবং তাকে গ্রেফতার করে। সেই সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের আরাে কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ও কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। উল্লেখ্য, নারায়ণগঞ্জের এই ঘটনায় অংশ নিয়েছিলেন প্রধানত স্থানীয় জনসাধারণ, তুলনামূলক হিসেবে ছাত্রদের সংখ্যা কমই ছিল।
নারায়ণগঞ্জের এই গণবিক্ষোভ সম্পর্কে অলি আহাদ বলেন : ‘পুলিশ-জনতা সংঘর্ষে নারায়ণগঞ্জ মহকুমা পুলিশ অফিসার জনাৰ দেলওয়ার হােসেন আহত হন।… শুধু খান সাহেব ওসমান আলীকেই নহে, পুলিশ তাহার পুত্র মােস্তাফা সারওয়ারকেও গ্রেফতার করে। সেই আন্দোলনের মূল কর্ণধার যুবলীগ নেতা সফী হােসেন খান, মিস্ত্রী ইলা বকশী ও ছাত্র বেলুও গ্রেফতার হন। গ্রেফতাকৃত অপরবন্দী কামরুদ্দিন ও দবিরকে পুলিশ বেদম প্রহার করে । দিনকয়েকের মধ্যেই সামসুজ্জোহা, জামিল, সুর রহমান এবং সাত বৎসর বয়স্ক বালক মেসবাহউদ্দিন কারারুদ্ধ হন।”৮৫ পয়লা মার্চ : নারায়ণগঞ্জে নতুন ঘটনা। ঢাকা শহরে অবস্থা আয়ত্তে এলেও দেশের অন্যত্র আন্দোলনের তীব্রতা তখনও সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছিল। নারায়ণগঞ্জের গণবিক্ষোভ তার প্রমাণ। স্বভাবতই প্রত্যক্ষ আঘাত হানার পাশাপাশি বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা এবং ষড়যন্ত্রই সরকারি তৎপরতায় প্রাধান্য পেতে থাকে।
সম্ভবত এইসব চতুর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে নারায়ণগঞ্জে পয়লা মার্চ আরাে একটি ঘটনা স্থানীয় জনসাধারণকে অবাক করে দেয়। পয়লা মার্চ নারায়ণগঞ্জের কালিরবাজারে পাহারারত একজন পুলিশ কনস্টেবল অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ীর গুলিতে নিহত এবং একজন আনসার আহত হন। মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন অস্বাভাবিক দ্রুততায় ঘটনার মােকাবিলায় এগিয়ে আসেন। যে মুখ্যমন্ত্রী একুশে ফেব্রুয়ারি তার কর্মস্থল পরিষদ ভবনের কয়েকশ’ গজ দূরে গুলিতে নিহত ছাত্রদের দেখতে যেতে অস্বীকার করেছিলেন, এমনকি প্রথামাফিক সেদিন নিহতদের পরিবারবর্গের উদ্দেশে সমবেদনা জানানাের কাজটিও করেন নি, সেই তিনিই এবার ঘটনার রাতেই নিহত পুলিশের পরিবারবর্গের প্রতি এবং আহত আনসারের প্রতি সমবেদনা জানাতে এতটুকু দেরি করেন নি। এমনকি পরদিনই (২ মার্চ) কনস্টেবলের পরিবারের জন্য নগদ দশ হাজার টাকা এবং আনসারটিকে দুই হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দানের কথা ঘােষণা করেন।১৮৬ ঘটনার সব দায় খুৰ স্থূলভাবেই ভাষা আন্দোলনের সংগঠকদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয় এবং সেই সঙ্গে চলে সুকৌশলী প্রচারণা, যে ধরনের প্রচারণায় সাধারণ মানুষ সহজেই বিভ্রান্ত হতে পারেন। | কিন্তু যে ক্ষিপ্র তৎপরতায় সরকার কাজগুলাে করেন তাতে জনসাধারণের মনে সন্দেহ জাগে যে এই অবাঞ্ছিত ঘটনা সরকারি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই ঘটেছে। ব্যাপক সরকারি অপপ্রচারের মুখেও সাধারণ মানুষ ভাষা বিষয়ক রাজনৈতিক অর্জন সম্পর্কে এতই নিশ্চিত ছিলেন যে তারা এ ধরনের প্রচারে বিশেষ গুরুত্ব দেন নি। এই ঘটনা উপলক্ষে নারায়ণগঞ্জে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয় এবং সরকার ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টি করার সুযােগ কাজে লাগান। কালিরবাজারে শনিবার রাত। ১১টা থেকে সােমবার ভাের ৫টা পর্যন্ত একটানা কারফিউ এবং শহরের অন্যত্র রাত ১০টা থেকে ভাের ৫টা পর্যন্ত কারফিউ এবং অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা। জারি করা হয়। নিহত কনস্টেবল সৈয়দ জোবেদুল হকের লাশ যেভাবে প্রায় সামরিক মর্যাদায় মিছিল করে গােরস্তানে নিয়ে জি.ও.সি, ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, বিভাগীয় কমিশনার, পুলিশের আই.জি ও ডি.আই.জি, পুলিশ সুপার ও অন্যদের উপস্থিতিতে দাফন করা হয় তা মানুষের কাছে বিস্ময়কর ঠেকে এবং সেজন্যই অনেকে ঘটনাটিকে সরকারি চক্রান্ত বলেই ধরে নিয়েছিলেন। ‘আজাদ-এর নগ্ন অবস্থান ও মুখ্যমন্ত্রীর বেতার ভাষণ। দৈনিক আজাদ’-এর এবার স্বরূপে প্রকাশ আমাদের অবাক করে না। নুরুল আমিন সরকারের স্থিতাবস্থা ও আক্রমণাত্মক অবস্থান নিশ্চিত হতে দেখে আজাদ কর্তৃপক্ষও সম্ভবত তাদের অবস্থান ঠিক করে নিয়েছিলেন। নুরুল আমিন ঠিকই জানতেন এইসব অভিযােগ সত্য নয়।
তবু তিনি একের পর এক মিথ্যার মালা গেঁথে শেষ পর্যন্ত একথাও বললেন : নারায়ণগঞ্জের একটি মিছিলে প্রকাশ্যভাবে যুক্তবাংলা চাই’ এবং ‘জয়হিন্দ প্রভৃতি ধ্বনি করা হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তারা কোন সাহসে আজ এসব স্লোগান দিতে সাহস পাইল তাহা বিবেচনার বিষয়। মুখ্যমন্ত্রী এমন কথাও বলতে দ্বিধা করেন নি যে ভাষা আন্দোলনের মুখে। ইসলাম আজ এক মহাপরীক্ষার সম্মুখীন।’ গভর্নর জেনারেল গােলাম মােহাম্মদের বক্তৃতার অনুকরণে তিনিও জানালেন যে, ইসলাম কোন জাতিগত, ভাষাগত, অর্থনৈতিক ও ভৌগােলিক বৈষম্য বা বাধা স্বীকার করে না। এর অর্থ পূর্ব । পাকিস্তানের জাতিগত-ভাষাগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থ পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে ক্ষুণ হলেও তা ইসলামের স্বার্থ হিসেবেই গণ্য হবে। যেসব অযৌক্তিক বক্তব্য একজন উন্মাদের মুখে মানায় তা-ই বারবার উচ্চারিত হয়েছে পূর্ববাংলার মন্ত্রী ও মুসলিম লীগ রাজনীতিকদের মুখে, যারা এই মাটির সন্তান এবং যাদের বলা হতাে। বাঙালি। গােটা বক্তৃতাটি পড়ে মনে হয় এটি অবাঙালি আমলাদের চতুর খসড়া। আন্দোলনবিরােধী অপপ্রচার। এমনি চক্রান্তমূলক চাতুর্যে সরকারি প্রশাসনের হাতে আন্দোলনবিরােধী প্রচারণার কাজ চলতে থাকে। সেইসঙ্গে দেশময় চলে নেতা ও কর্মীদের ব্যাপক হারে ধরপাকড়। ঢাকার নবাববাড়িও এবার পথে নেমে এল। নবাব খাজা হাবীবুল্লাহর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ঢাকাই সর্দারদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হলাে ৫ মার্চের হরতালে যােগ না দেয়ার এবং কমিউনিষ্ট ও বিদেশী চরদের সম্বন্ধে হুঁশিয়ার থাকবার। আনসার বাহিনীর ডি.জি. জনাৰ দোহা ৪ মার্চ নারায়ণগঞ্জে আনসার-সমাবেশে।
পাকিস্তানকে দুশমন কমিউনিস্ট ও বিদেশী দালালদের হাত থেকে রক্ষার আবেদন জানান। সব মিলিয়ে ৫ মার্চের পূর্বে মুখ্যমন্ত্রী ও তার দলবল মিলে দেশে এমন এক ত্রাসের পরিবেশ ও পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন যে গণতান্ত্রিক অধিকারবােধে বিশ্বাসী প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতিকদের মধ্যেও আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। হয়তাে তাই গণতন্ত্রী রাজনীতিকগণ প্রমাণ করতে চেয়েছেন, তাদের সঙ্গে কমিউনিস্টদের সম্পর্ক নেই। যুবলীগের সভাপতি মাহমুদ আলী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বিবৃতির প্রতিবাদ প্রসঙ্গে বলেন : ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে আমার কোন সম্বন্ধ নাই। সুতরাং সে সম্বন্ধে আমি কিছু বলিতে চাই না।’১৮৮ আওয়ামী মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির এক প্রাসঙ্গিক প্রস্তাবে বলা হয়, ‘আওয়ামী লীগ আইন সভার ভিতরে ও বাহিরে একটি নিয়মতান্ত্রিক বিরােধী দল। আওয়ামী লীগ কমিউনিস্ট ও অন্যান্য রাষ্ট্রবিরােধী দলের সহিত হাত মিলাইয়াছে বলিয়া মুসলিম লীগ যে মন্তব্য করিয়াছে উহা সম্পূর্ণ মিথ্যা। ১৮৯ ২ মার্চ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক কর্মীদের উদ্দেশে বলেন : “এ আন্দোলনের সঙ্গে কমিউনিস্ট বা বিদেশীদের কোনাে সংযােগ বা সংশ্রব নেই।’১৯০ পয়লা মার্চের ‘আজাদ’-এ ‘আজিকার প্রশ্ন সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয় যে, ভাষা সংক্রান্ত আন্দোলনে উদ্ভূত কিছু সাম্প্রতিক পরিস্থিতি কিছু নয় বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া ঠিক নয়। কিন্তু ২ মার্চ নারায়ণগঞ্জের ঘটনা’ এবং ৩ মার্চ ‘শােচনীয় হত্যাকাণ্ড’ ‘আজাদ’-এর এই উভয় সম্পাদকীয় নিবন্ধে সরকার ও সরকারি কার্যকলাপের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন জানানাে হয়।
এর পরদিনের ‘আজাদ’ এ ‘ঘৃণ্য প্রচেষ্টা’ শিরােনামে যে সম্পাদকীয় লেখা হয় তা সরকার পক্ষের অপপ্রচার প্রয়াসের অংশ বলা যায়।১৮৭ | রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের চরিত্র হনন অর্থাৎ একে বিদেশী প্ররােচনায় পাকিস্তানের অস্তিত্ব নষ্ট করার ষড়যন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করার সরকারি প্রচারের পেছনে প্রধান একটি উদ্দেশ্য ছিল ৫ মার্চের দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান বানচাল করা। আজাদ এবার স্বেচ্ছায় এই কাজে সরকারের সাথে হাত মিলিয়ে একের পর এক সম্পাদকীয় লিখতে থাকে। এমন কি আরাে এক পা এগিয়ে পরিপূর্ণ সরকারি প্রচার-পত্রিকার ভূমিকা গ্রহণ করে। এর প্রমাণ ৪ মার্চের পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠায় জনসাধারণের উদ্দেশ্যে সরকারি প্রচার অভিযানের প্রতিফলন হিসেবে উৎকীর্ণ ছয় দফা সাবধান বাণী : গুজবে বিশ্বাস করিবেন না’, ‘রাষ্ট্রের শক্রর ফাঁদে পা দিবেন ‘, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখুন’, ‘দেশের শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা করায় একতা ও সংহতি অপরিহার্য’, ‘অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা শুধু দেশের অগ্রগতিকেই ব্যাহত করিবে না—আজাদীর মূলেও কুঠারাঘাত করিবে’, ‘স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও দৈনন্দিন কার্যকলাপ অব্যাহত রাখুন। আমরা জানি যুদ্ধাবস্থায় দেশের নিরাপত্তার প্রশ্নে পােস্টার এবং পত্র-পত্রিকায় এধরনের সতর্কবাণী প্রকাশিত হয়ে থাকে। যেমন গুজব ছড়াবেন না, দেয়ালেরও কান আছে’ ইত্যাদি। ‘আজাদ’ কর্তৃপক্ষ কি ধরে নিয়েছিলেন, সরকার ও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণ পরস্পরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত কিংবা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের উপস্থিতিতে দেশে এক ধরনের যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। দেখাই যাচ্ছে সে ক্ষেত্রে ‘আজাদ সরকারের প্রচার বিভাগের অন্যতম প্রতিনিধি। আসলে ঘটনা এ পর্যায়েই ছিল। নুরুল আমিন সম্ভাব্য ৫ মার্চের মােকাবিলায় নিজপক্ষের কর্মতৎপরতার প্রস্তুতি হিসেবে ৩ মার্চ যে দীর্ঘ বেতার ভাষণ প্রচার করেন তা ৪ মার্চ পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সুপরিকল্পিত এই বক্তৃতায় তিনি ভাষা আন্দোলনকে পূর্বেকার মতােই পাকিস্তান ধ্বংস করার জন্য কতিপয় কম্যুনিস্ট ও অন্যান্য বিদেশী দালাল এবং অসন্তুষ্ট রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তির সম্মিলিত ষড়যন্ত্ররূপে চিহ্নিত করেন, যে কথা ২৫ ফেব্রুয়ারি লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকেও উচ্চারিত হয়। নুরুল আমিন সরকারের দমননীতিমূলক পীড়নের ভয়ে সংসদীয় রাজনৈতিক দলগুলাে কমিউনিস্ট পার্টি সম্পর্কে মুসলিম লীগের তৈরি সমীকরণ মেনে নিয়ে।
স্বীকারােক্তি দিয়েছিল যে…’কমুনিস্টদের সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই’। দ্বিতীয়ত, কম্যুনিস্ট ও বিদেশী চর তথা রাষ্ট্রদ্রোহী একই সমীকরণে সিদ্ধ। ফলে দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে কম্যুনিস্ট পার্টিকে কী প্রতিকূলতার মধ্যে কাজ করতে হয়েছে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পরিস্থিতি তাদের গণতান্ত্রিক কাজকর্মের জন্যও ভয়ানক বিরূপ হয়ে ওঠে শাসকদের কল্যাণে। স্বভাবতই আমরা দেখতে পাই, ঢাকায় ৫ মার্চের হরতাল ও বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচি সফল হয় নি। এই ব্যর্থতার অন্যতম কারণ প্রসঙ্গে কেউ কেউ মনে করেন, বাইশে ফেব্রুয়ারি গণ-বিক্ষোভজনিত সাফল্যের পরিপ্রেক্ষিতে এবং পরে পাঁচদিন টানা পূর্ণ হরতাল পালনের মধ্য দিয়ে জনগণ তাদের রায় নিশ্চিত করেছিলেন; সেই বিজয়ের পর সর্বদলীয় পরিষদের আহূত ৫ মার্চের হরতালের কোন গুরুত্ব জনসাধারণের কাছে ছিল না। | এটাতাে ঢাকার ঘটনা। কিন্তু টাকার বাইরে দেশের প্রায় সর্বত্র সাপ্তাহিক ইত্তেফাক ও সাপ্তাহিক নওবেলাল’-এর মতে যথেষ্ট উদ্দীপনার মধ্যে ৫ মার্চের হরতাল সাফল্যের সাথে পালিত হয়; যদিও আজাদ’-এর মতে দেশের কোথাও ৫ মার্চের হরতাল পালিত হয় নি। আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলে, ঢাকার ব্যর্থ ধর্মঘট দেশের সর্বত্র সফল হরতালে পরিণত হয়। | ‘আজাদ’-এর ৪ মার্চ পর্যন্ত লেখা সম্পাদকীয় ধারার পথ বেয়ে ৫ মার্চ। ‘
আইন ও শৃঙ্খলা’ শিরােনাশের সম্পাদকীয় নিবন্ধে নীতিগতভাবে সরকারের সাথে একাত্মতা প্রকাশের মাধ্যমে আন্দোলকারীদের রাষ্ট্রবিরােধী আখ্যা দিয়ে। বলা হয় : নারায়ণগঞ্জের মিছিলে প্রকাশ্যভাবে যুক্ত বাংলা চাই’ ও ‘জয়হিন্দ’ ধ্বনি যে। রবিরােধীদের অস্তিত্ব ও দুক্রিয়ার প্রত্যক্ষ প্রমাণ একথা অস্বীকারের উপায় নাই। পাকিস্তানের জনসাধারণ যে রাষ্ট্রবিরােধীদের নির্মূল করিয়া দেওয়ার দায়িত্ব সম্বন্ধে সচেতন এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। | এটুকু বলেই ক্ষান্ত হয় নি ‘আজাদ’। ঢাকায় ৫ মার্চের অসফল হরতালের পরিপ্রেক্ষিতে সান্ধ্য আইন তুলে নেয়ার পর ৬ মার্চ আজাদ-এর ‘সরকারের কর্তব্য শীর্ষক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয় : জনসাধারণই যে সাগ্রহে রাজদ্রোহীদের চূর্ণ করার জন্য স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া সরকারের সহযােগিতায় আগাইয়া আসিয়াছে গতকল্যকার হরতালের ব্যর্থতাই তার প্রমাণ। হাওয়া এখন সরকারের পক্ষে বইছে মনে হওয়ায় যারা জনরােষের ভয়ে আন্দোলনের পক্ষে কথা বলেছেন বা এর সাথে সংশ্লিষ্ট হতে চেয়েছেন, কিংবা সরাসরি যুক্ত ছিলেন সেইসব ব্যক্তি ও দলের স্বরূপে অবতীর্ণ হওয়ার পক্ষে আর কোনাে বাধা রইল না। | বণিক সমিতির সভাপতি সাখাওয়াত হােসেন একুশের প্রতি পূর্ব সমর্থনের কথা ভুলে গিয়ে ৫ মার্চ এক বিবৃতিতে জনসাধারণকে স্বার্থান্বেষীদের সম্পর্কে হুশিয়ার হয়ে আন্দোলন থেকে দূরে থাকার আহ্বান জানান।১৯১ অন্যদিকে তফাজ্জল আলী আরাে এক ধাপ এগিয়ে তার ৭ মার্চের বেতার বক্তৃতায় রাষ্ট্রবিরােধিগণকে ধরাইয়া দেয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি অনুরােধ জানান।
কিন্তু পাঠকদের জন্য বিমূঢ় হওয়ার মতাে সংবাদ হলাে আন্দোলনের সাথে। সংশ্লিষ্ট সলিমুল্লাহ হলের ভি.পি ও জি.এস মুজিবুল হক ও হেদায়েত হােসেন চৌধুরী অন্যদের সাথে একসুরে যে বিবৃতি প্রকাশ করেন তা অবিশ্বাস্য হলেও তাতে তাদের রাজনৈতিক চরিত্র ফুটে উঠেছে। ৭ মার্চ ‘আজাদ’-এ প্রকাশিত এই বিবৃতিতে বলা হয় : “আমরা জেনে দুঃখিত হয়েছি যে স্বার্থান্বেষী লােক বা দলগুলি নিজেদের উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য ভাষা আন্দোলনকে অন্যপথে চালিত করার চেষ্টা করছে এবং নিজেদের রাজনৈতিক আশা-আকাক্সক্ষাকে চরিতার্থ করার জন্য এই আন্দোলনের সুযােগ গ্রহণ করছে। আমরা আরাে জানতে পেরেছি যে ভাষা। আন্দোলনকে বিপথে চালিত করে রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার জন্য ধ্বংসাত্মক কাজে। লিপ্ত রাষ্ট্রবিরােধী লােকেরা বিশেষ তৎপর হয়ে উঠেছে।…আমাদের কাছে পাকিস্তানের চেয়ে প্রিয় আর কিছুই নেই।’ ইত্যাদি। | এখন প্রশ্ন, আন্দোলনের শেষ মুহূর্তে এ বিবৃতি তারা দিতে গেলেন কেন? স্বার্থান্বেষী’ বলতে কাদের বােঝানাে হয়েছে এবং আন্দোলনের সাথে পাকিস্তান ধ্বংসের ষড়যন্ত্রের সম্পর্কের কথা কবে কার কাছ থেকে তারা জানতে পেরেছেন? | এইসব প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে আরাে যে তথ্য ইতিহাসের প্রয়ােজনে তুলে ধরতে হয় তা হলাে, সলিমুল্লাহ হলের এই দুই মুসলিম লীগ দলীয় প্রতিনিধি ১৪৪ ধারা ভাস্তার চুড়ান্ত বিরােধী ছিলেন, সাধারণ ছাত্রদের চাপেই আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট হতে বাধ্য হয়েছিলেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও আন্দোলনের রাশ বরাবরই টেনে রাখতে চেয়েছেন। এমনকি গুলিবর্ষণের পরও সলিমুল্লাহ হলের প্রতিনিধি হিসেবে তাদের ব্যক্তিগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও সক্রিয় ভূমিকা নিতে দেখা যায় নি। ভূমিকা রেখেছেন অন্যরা।
এসব থেকে মনে হতে পারে যে, সরকার তাদের প্রচার কুশলতায় ছাত্রঐক্যে ভাঙন ও বিভ্রান্তি সৃষ্টিতে সফল হয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে এমন ধারণা করা ঠিক হবে না এই জন্য যে তখনকার ছাত্রনেতৃত্বের মধ্যে ১৪৪ ধারা ভাঙা নিয়ে এবং আন্দোলনের চরিত্র নিয়ে মতভেদ আগাগােড়াই ছিল; কেউ কেউ আন্দোলনবিরােধীও ছিলেন, সাধারণ ছাত্রদের চাপেই বাধ্য হয়ে তারা আন্দোলনে যােগ দিয়েছিলেন। | সরকার এরপরও ‘মােজাহেদ বাহিনী এবং ঢাকার নাগরিকবৃন্দ’ এই নামে কুৎসামূলক ভাষা আন্দোলনবিরােধী প্রচারপত্র ছড়াতে দ্বিধা করেন নি। এতে বােঝা যায়, সরকার ভাষা আন্দোলনের ব্যাপকতায় কতটা ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু বড় কথা হলাে এইসব অপপ্রচারে ঢাকাই জনতার একাংশ। প্রভাবিত হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠদের মধ্যে আন্দোলন সম্পর্কে বিরূপতা দেখা যায় নি। | যাই হােক মার্চের প্রথম সপ্তাহের কয়েকটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা হলাে, সরকার কর্তৃক তারই এটর্নি জেনারেলের (জনাব ফজলুল হকের) বিরুদ্ধে ইংরেজি ও বাংলায় প্রচারপত্র বিতরণ এবং এর বিরুদ্ধে জনাব হকের সরকার-বিরােধী পাল্টা বিবৃতি, ৭ মার্চ সর্বদলীয় পরিষদের তরফে প্রকাশিত একটি বিবৃতিতে দেশব্যাপী ছাত্রধর্মঘট প্রত্যাহার এবং সরকারের উদ্দেশ্যে কয়েকটি দাবি পূরণের আহ্বান। একই দিনের আজাদ’-এ প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি হলাে, নতুন করে পাকিস্তানে আবার জননিরাপত্তা আইন জারি। সর্বদলীয় ও অন্য নেতাদের গ্রেফতার এমনি পরিস্থিতিতে ৫ মার্চের পরবর্তী অবস্থা বিশ্লেষণ ও কর্তব্য নির্ধারণের জন্য অবশেষে কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে ভাষা আন্দোলনের সংগঠক ও পরিচালকদের নিয়ে একটি বৈঠকের চেষ্টা চলে। আন্দোলনের গতি ও শক্তি তখন নিঃশেষিত। সরকার পূর্ণ শক্তিতে আক্রমণাত্মক ভূমিকায় অবতীর্ণ। এই অবস্থায় শান্তিনগরে মেডিকেল ছাত্র এম.এ. মােত্তালিবের ভাই আবদুল মালেকের বাসায় সন্ধ্যার পর একটি বৈঠকের ব্যবস্থা করা হয়। স্থান নির্ধারণ ও যােগাযােগের দায়িত্বে ছিলেন তখনকার কমিউনিস্ট পার্টির ঢাকা সাংগঠনিক কমিটির সদস্য সাদেক খান। |
কি শান্তিনগর বৈঠকে আলােচনার মধ্যেই পুলিশ সম্ভবত পূর্বসংবাদ অনুযায়া বাড়ি ঘিরে উপস্থিত সবাইকে গ্রেফতার করে; একমাত্র কাজী গােলাম মাহবুব সুকৌশলে গ্রেফতার এড়াতে সমর্থ হলেও পরে নিজেই পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। ‘আজাদ’-এর ১০ মার্চের একটি ছােট্ট সংবাদ বিবরণীতে প্রকাশ : শুক্রবার রাত্রে শান্তিনগর এলাকাস্থ একটি বাড়ি হইতে রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সদস্যসহ ৮ জন ছাত্র গ্রেফতার। তাহারা হইতেছেন মােহাম্মদ তােয়াহা, অলি আহাদ, আবদুল মতিন, সাদেক খান, আবদুল লতিফ চৌধুরী, হেদায়েত হােসেন চৌধুরী ও মুজিবুল হক। একজনের নাম এখনও জানা যায় নাই। প্রথমােক্ত তিনজনের নামে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি পরােয়ানা জারি করা হয়।’ চিত্তাকর্ষক বিষয় হলাে, ঢাকায় যখন ভাষা আন্দোলন সংক্রান্ত সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটে তখনও খবরে প্রকাশ, ‘প্রদেশের সর্বত্র সভা ও হরতাল অনুষ্ঠিত হচ্ছে।’ শান্তিনগরের বৈঠকে উপস্থিত সদস্যদের সম্পর্কেও কিছুটা মতভেদ রয়েছে। অলি আহাদ তার বইতে মীর্জা গােলাম হাফিজ ও জনৈক হাসান পারভেজের কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু আজাদ’-এর প্রতিবেদনে মীর্জা গােলাম হাফিজের নাম নেই, যদিও বলা হয়েছে একজনের নাম জানা যায় নাই।’ এ সম্পর্কে অলি আহাদ আরাে বলেন : “কোন এক অজ্ঞাত কারণে পুলিশ হাসান পারভেজকে গ্রেফতার করে নাই’ (প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮১-১৮২)। এই বৈঠক ও গ্রেফতার হওয়া সম্পর্কে মােহাম্মদ তােয়াহা বলেন :
‘শান্তিনগরে যে মিটিং হয় এ সিদ্ধান্ত আমাদের পার্টি থেকে নেওয়া হয় এবং মিটিং-এ সাবধানতা অবলম্বন করা হয়নি। …সাদেক খা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম যে মিটিং-এর খবর কাকে কাকে দেওয়া হয়েছে। তিনি কয়েকজন লােকের নাম বললেন; এদের মধ্যে দু’জনের নাম বলাতে আমি বলেছিলাম যে, তাহলে আমি মিটিং-এ যাব না। এ দু’জনের নাম আমি জানি। সে-সময়ে সলিমুল্লাহ হলের ডি.পি. ও জি.এস ছিলেন তারা। বশীর ইন্সপেক্টর কিন্তু আমার কাছে স্পষ্টভাবে বলেছিলেন যে, আপনাদের লােকজনই আমাদের এ খবর দিয়েছিল।১৯২ মােহাম্মদ তােয়াহার বক্তব্য অত্যন্ত স্পষ্ট হওয়া সত্ত্বেও অন্য দুই একটি বিষয়ে-যেমন বৈঠকে মােট কয়জন উপস্থিত ছিলেন, বিশেষ করে মীর্জা হাফিজ ও হাসান পারভেজ উপস্থিত ছিলেন কি না সে সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া যায় না। তেমনি জানা যায় না কোন্ সূত্রে পুলিশ খবর পেয়েছিল। | তবে একথা ঠিক যে, সাদেক খান পার্টির সদস্য হওয়া সত্ত্বেও বৈঠকের স্থান ও যােগদানকারীদের নাম নির্ধারণে বিচক্ষণতার পরিচয় রাখেন নি। কারণ কমিউনিস্ট পার্টির ব্যবস্থাধীন এ ধরনের বৈঠকে স্থান ও ব্যক্তি নির্বাচনে যে সতর্কতা নেয়া দরকার ছিল তার কোনটাই এক্ষেত্রে করা হয় নি। যাই হােক, এরপর কয়েকদিনের মধ্যেই আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট আরাে অনেকেই গ্রেফতার হন এবং আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে।
নতুন সর্বদলীয় পরিষদ এবং কয়েকটি ঘটনা আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় প্রায় সবাই গ্রেফতার হয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে মার্চ মাসের মাঝামাঝি কোন একসময় আতাউর রহমান খানকে আহ্বায়ক মনােনীত করে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠন করা হয়। সম্ভবত কামরুদ্দিন আহমদ প্রমুখ কেউ কেউ এ বিষয়ে উদ্যোগ নিয়ে থাকবেন। সাপ্তাহিক ইত্তেফাক’-এর ১৭ মার্চ সংখ্যায় এই খবর প্রকাশিত হয়। এই সময়ের কিছু উল্লেখযােগ্য ঘটনার মধ্যে রয়েছে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের এক শ্রেণীর সংবাদপত্রে এবং বুদ্ধিজীবীদের উদ্যোগে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে অপপ্রচার। বাবায়ে উর্দু’ ড. আবদুল হক করাচিতে উর্দুর পক্ষে এবং বাংলার বিরুদ্ধে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেন। তার মতে “উর্দুর ওপরই পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতি নির্ভর করছে।১৯৩ এর বিরুদ্ধে ঢাকার সাংবাদিকগণ এক যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করেন। | দ্বিতীয় উল্লেখযােগ্য ঘটনাটি হলাে, নিখিল চীন ছাত্র ফেডারেশন পূর্ব পাক ছাত্র ফেডারেশনের কাছে একটি তারবার্তা পাঠান, যা ১২ মার্চ ঢাকা পৌঁছে। শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এই তারবার্তায় বলা হয়, এশিয়ার ছাত্রসমাজ আপনাদের এই গণতান্ত্রিক জাতীয় সংগ্রামকে পূর্ণ সমর্থন করছে।’১৯৪
আবার গণপরিষদের অধিবেশন। ভাষাভিত্তিক গণতান্ত্রিক জাতীয় সংগ্রামের আদর্শগত বিজয় সত্ত্বেও পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকগােষ্ঠী এর ব্যবহারিক বিজয় নিশ্চিত করতে দেয় নি, বলা যায়, দিতে চায় নি। পাকিস্তান গণপরিষদ এই অধিবেশনেও বিষয়টি নিয়ে এক প্রহসন সৃষ্টি করে। আরাে চমৎকার যে চট্টগ্রামের গণপরিষদ সদস্য নূর আহমদ তার পূর্ব প্রতিশ্রুতিমতাে গণপরিষদে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণের প্রস্তাব উত্থাপনের পর পূর্ববঙ্গীয় মুসলিম লীগ সদস্যগণ এর সমর্থনে এগিয়ে আসেন না; বরং পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্য আবদুস সাত্তার পীরজাদার আনীত ‘যথাসময়ে বিষয়টি গণপরিষদে উত্থাপনের সংশােধনী প্রস্তাব সমর্থন করেন১৯৭৫ অথচ এরাই ঢাকায় গণবিক্ষোভের মুখে পূর্ববঙ্গ পরিষদে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে প্রস্তাব পাশ করেছিলেন এবং গণপরিষদে তা পাশ করানাের জন্য চেষ্টার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। কিন্তু গণপরিষদে তাদের মাধ্যমে সে প্রস্তাব উত্থাপিত হয় নি। অবশ্য নূর আহমদ তার প্রস্তাবের পক্ষে নােটিশ দিয়েই ক্ষান্ত ছিলেন না। তিনি ১৪ মার্চ করাচিতে এক সংবাদ-বিবৃতির মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানের ভ্রাতা ও ভগিনীদের প্রতি আবেদন জানান যাতে তারা পূর্ব পাকিস্তানের রাতাষা বাংলার প্রশ্নটি সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করেন। ১৯১৮ দ্বিতীয়ত মুসলিম লীগ সদস্য এম.এ. হামিদ বাংলার পক্ষে বক্তৃতা করেন (অবশ্য পূর্ব প্রতিশ্রুতিমতাে তিনি।
পদত্যাগ করেন নি)। গণপরিষদে সেবার বাংলা রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে এদিক থেকে তিনটি প্রস্তাব উঠেছিল; দুইটি মুসলিম লীগ সদস্যের এবং তৃতীয়টি একজন কংগ্রেস সদস্যের। কিন্তু পূর্ববঙ্গীয় লীগ সদস্যদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের কারণে পীরজাদার সংশােধনী গৃহীত হয় এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রশ্নটি আবার অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে যায় এবং বিস্ময়কর হলেও সত্য যে একমাত্র পাঞ্জাবি সদস্য শওকত হায়াত খান বাংলার দাবি সমর্থন করেন। ‘আজাদ’-এর ১২ এপ্রিল সংখ্যার এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রস্তাবটি মুলতবি হয়ে যাওয়ায় আজাদ’ প্রকারান্তরে সন্তোষ প্রকাশ করে। নুরুল আমিন সাহেব পীরজাদার প্রস্তাব সমর্থন করেই সন্তুষ্ট থাকেন না, তিনি এর পক্ষে বক্তৃতাও করেন।১৯৭ এই উপলক্ষে সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’-এর আক্ষেপ লক্ষ্য করার মততা : ‘এম,সি,এ’রা টু শব্দটি পর্যন্ত করিল না। অথচ এই এম.সি.এ’রা কতই না। প্রতিশ্রুতি দিয়াছিল, গণপরিষদের চলতি অধিবেশনে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করিতে পারিলে পদত্যাগ করার ওয়াদা দিয়াছিল। অথচ আজ কেহ পদত্যাগ করিল। , প্রতিবাদ করিল না।১৯৭ পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদে গৃহীত মুখ্যমন্ত্রীর বাংলা রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক প্রস্তাবের এভাবেই মৃত্যু ঘটে পক গণপরিষদে। এমনটাই তাদের পক্ষে স্বাভাবিক ছিল। | অবশ্য সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদে ১২ এপ্রিলের এক সভায় গণপরিষদের এই ভূমিকার নিন্দা করে আরাে বলা হয় যে পূর্ববঙ্গের সরকার ও প্রতিনিধিগণ। দেশবাসীর সঙ্গে প্রতারণা করেছেন।’ এরপরও যদি কোন ইতিহাসবিদ বলেন, নূরুল আমিন নাজিমুদ্দিনের মতাে বাংলা বিরােধী ছিলেন না, তা হলে সে বক্তব্যের জবাব ইতিহাসই দেবে এবং দিয়েছেও।
সূত্র : ভাষা আন্দোলন-ইতিহাস ও তাৎপর্য – আবদুল মতিন, আহমদ রফিক