You dont have javascript enabled! Please enable it!

২৭ ফেব্রুয়ারি  চণ্ডনীতির নানামুখী প্রকাশ

বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘােষণা সাতাশে ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের সপ্তাহপূর্তির দিন। কিন্তু এবার নুরুল আমিন সরকারের অগ্রযাত্রার পালা। সুপরিকল্পিত, কঠোর দমননীতির পরিচয় পাওয়া গেল এইদিন অকস্মাৎ অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘােষণা এবং ছাত্রছাত্রীদের অবিলম্বে ছাত্রাবাস ত্যাগের নির্দেশদানের মধ্যে। পরিষদ অধিবেশন বন্ধ করে দেয়ার দুদিনের মধ্যেই শুরু হয় প্রধান ছাত্র কেন্দ্রগুলাের ওপর পরােক্ষ আঘাত। একের পর এক কড়া তাস খেলে চলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। এবার তিনি খুশি। আটাশের দৈনিক আজাদ এবার সরকারি তৎপরতা যথাযথ শিরােনামে তুলে ধরেছে। ‘অনির্দিষ্ট কালের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ‘একজিকিউটিভ কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত ঘােষণা।’ ছাত্রদের প্রতি হােস্টেল ত্যাগের নির্দেশ শহরের অবস্থা সম্পূর্ণ শান্ত ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারির স্টেটসম্যান বিশ্ববিদ্যালয় এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের জরুরি সভা অনুষ্ঠানের যে ইঙ্গিত আগে দিয়েছিল তাতেই কিছু একটা ঘটার আশঙ্কা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল  সম্ভৰত নুরুল আমিন সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধানদের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলেন, যে কারণে তারা যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেন। দৈনিক আজাদ’ সুত্রে। প্রকাশ, ‘বুধবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) মােট তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং শহর এখন শান্ত।’ কিন্তু তা সত্ত্বেও শহরে ১৪৪ ধারা এবং সান্ধ্য আইন দুই-ই বলবৎ ছিল। চাঞ্চল্যকর এই সংবাদ ‘স্টেটসম্যান” ধরেছিল এই বলে যে, ‘আজ (২৭ ফেব্রুয়ারি) থেকে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘােষণা বিশ্ববিদ্যালয়  একজিকিউটিভ কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের মােট ২৩০০ ছাত্রের মধ্যে ৯০০ আবাসিক ছাত্রকে অবিলম্বে হল ত্যাগ করে চলে যেতে বলা হয়।  ‘জগন্নাথ কলেজ হােস্টেলের দুইজন ছাত্রসহ মােট তিনজন ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়। সরকারি প্রেসনােটে বলা হয়, সলিমুল্লাহ হল থেকে প্রচুর আপত্তিকর ইস্তাহার ও অন্যান্য উপাদান পাওয়া গিয়েছে। আজ শহরের চেহারা স্বাভাবিক।১৮১ জনসাধারণকে আশ্বস্ত করার উদ্দেশ্যে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি মৌলানা আবদুল্লাহ-হেল-বাকী, সম্পাদক ইউসুফ আলী চৌধুরী, সহ-সভাপতি খাজা হাবীবুল্লাহ, পাকিস্তান মুসলিম লীগের যুগ্ম-সম্পাদক গিয়াসুদ্দিন পাঠান এবং প্রাদেশিক লীগের যুগ্ম-সম্পাদক শাহ আজীজুর রহমান এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন যে, বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রাদেশিক প্রস্তাব গণপরিষদে গৃহীত হওয়ার জন্য ওয়ার্কিং কমিটি সবরকম চেষ্টা চালাবেন। হাইকোর্টের কোন বিচারপতির মাধ্যমে তদন্ত কমিটি গঠন, দোষী ব্যক্তিদের শাস্তিদান এবং নিহতদের পরিবারবর্গকে ক্ষতিপূরণের দাবিরও তারা উল্লেখ করেন।

কিন্তু সেই সঙ্গে সন্ত্রাসবাদী, কম্যুনিস্ট ও রাষ্ট্রদ্রোহীদের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে দেশবাসীদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানানাে হয়। এদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি দিতেও সরকার কসুর করে না। অর্থাৎ ঘুরে ঘুরে ফিরে কমিউনিস্ট ও কল্পিত রাষ্ট্রদ্রোহীদের সম্পর্কে সরকারের বাধাবুলি উচ্চারণ। দমননীতি ও মিথ্যা প্রচারের মুখেও অন্যত্র আন্দোলন অব্যাহত মজার কথা হলাে, প্রাদেশিক লীগ ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাব, ব্যবস্থা পরিষদের প্রস্তাব এবং উল্লিখিত পাঁচ নেতার বিবৃতিসহ চার পৃষ্ঠার এক প্রচারপত্র সরকারি প্রেস থেকে ছাপা হয়, এর সংখ্যা পাঁচ লক্ষ। এর আগে নুরুল আমিনের বেতার বক্তৃতাও একই প্রেস থেকে এক লক্ষ কপি ছাপা হয়েছিল। প্রচারপত্রের নাম : ‘ঢাকার গােলযােগ সম্পর্কে মুসলিম লীগ। দলীয় কাজে সরকারি জিনিসপত্রের ব্যবহার করতে তারা বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন নি। সরকারি তহবিলের এই অপচয় সত্ত্বেও মুসলিম লীগ, বিশেষ করে নুরুল আমিন তাদের পক্ষে জনমানসের আস্থা পুরােপুরি ফিরিয়ে আনতে পারেন নি।। ঢাকায় আন্দোলনের স্থবিরতা সত্ত্বেও কয়েকদিন পূর্বের প্রাণচাঞ্চল্যের প্রভাব তখনও একেবারে মুছে যায় নি। এর প্রমাণ আমরা দেখেছি যেমন বিভিন্ন রাজনীতিকদের আন্দোলনের সমর্থনে বক্তৃতা ও বিবৃতিতে, তেমনি মুসলিম লীগ। দলীয় একাধিক রাজনীতিকের বিবৃতিতে; শুধু ঢাকা নয়, ঢাকার বাইরেও। তেমনি এক বিবৃতিতে ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী মফিজউদ্দিন এই আশ্বাস প্রচার করেন যে, গণপরিষদের আসন্ন অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে। অন্তর্ভুক্তির জন্য তিনি পূর্ণ সমর্থন জানাবেন। 

মুসলিম লীগ শাসকদের এধরনের বক্তব্য ও বিবৃতিতে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে একথাই মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, বাংলা রাষ্ট্রভাষার প্রয়ােজন নিতান্তই এ দেশের ছাত্রসমাজের, লীগ রাজনীতিকদের বা দেশের আপামর জনসাধারণের নয়। এর অর্থ, তাদের চেতনায় সত্যি বলতে কি ভাষা আন্দোলনের এতসব রক্তক্ষয়ী ঘটনার পরও বাঙালি জাতিসত্তানির্ভর জাতীয়তার রাজনৈতিক তাৎপর্য তখন ও এতটুকু রেখাপাত করে নি। প্রকৃতপক্ষে আন্দোলনের ব্যাপক জনসংশ্লিষ্টতাই তাদের বাধ্য করেছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে কথা বলতে। ঢাকায় আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে এলেও দেশের অন্যত্র তখনও আন্দোলনের আগুন | জলছে। নারায়ণগঞ্জ তার সবচেয়ে জ্বলন্ত প্রমাণ। নারায়ণগঞ্জের বিষ্কোরক পরিস্থিতি নিয়ে তাই পৃথকভাবে আলােচনা করা হয়েছে। এছাড়াও বগুড়া, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, কুমিল্লা, নােয়াখালি, বরিশাল, পাবনা, রাজশাহী ইত্যাদি প্রায় প্রতিটি শহরে একুশের আন্দোলন ব্যাপকতা ও তীব্রতা নিয়ে তখনও নিজকে ধরে রেখেছে; নিতান্তই যােগাযােগের অভাবে ঢাকার নেতৃত্ব তাদের সাথে রাজনৈতিক একাত্মতা তৈরি করতে পারে নি। সে চেষ্টা সামান্যই করা হয়েছে। হল-হােস্টেলের ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র রাজনৈতিক কর্মীদের ইস্তাহার ও মৌখিক বক্তব্যে সজ্জিত করে পরামর্শ দেয়া হলাে নিজ নিজ এলাকায় আন্দোলন গড়ে তুলতে  কিন্তু একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য সম্পন্ন আন্দোলন এভাবে গড়ে তােলা যায় না, বিশেষ করে অসংহত অন্তর্দ্বন্দ্বের উপস্থিতিতে।

যাই হােক, এইদিন আন্দোলনের পক্ষে আরাে কিছু বক্তব্য ও বিবৃতির বিবরণ প্রকাশ করেছে দৈনিক স্টেটসম্যান ২৮ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায়। এতে বলা হয়েছে, পাকিস্তান জমিয়ত-ই-ওলামায়ে ইসলাম-এর সভাপতি মৌলানা জাফর আহমদ ওসমানি আগের দিন করাচি থেকে ঢাকায় এসে গুলিতে নিহতদের প্রতি সমবেদনাই নয়, ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবিও জানান। শ্রমিক নেতা। ফয়েজ আহমদ পুলিশী কার্যকলাপের নিন্দা করে ঘটনা সম্পর্কে তদন্তের দাবি জানান। মফস্বলের প্রায় প্রতিটি শহরে সভা, মিছিল ও বিক্ষোভের মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ এবং বাংলার দাবি প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রত্যয় প্রকাশ করা হয়েছে। এমনি এক পরিস্থিতিতে দৈনিক আজাদ’-এর সম্পাদকীয় কষ্ঠে ভিন্ন সুর। ধ্বনিত হয়ে ওঠে, পরিবর্তন ঘটে তার আন্দোলন সম্পর্কিত পুরনাে ভূমিকার। কর্তৃপক্ষের সাথে সুর মিলিয়ে আজাদ-সম্পাদকীয়তে ভিন্ন চিন্তার প্রকাশ। রাজনৈতিকভাবে নিশ্চিতই তাৎপর্যপূর্ণ। অর্থাৎ আজাদ তার চিরাচরিত অবস্থানেই। ফিরে যেতে শুরু করে। পরবর্তী কয়েকদিনের সম্পাদকীয়তে এই পদক্ষেপ আরাে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই পরিবর্তনের সুর এবং সরকারি বক্তব্যের প্রতি কিছুটা। সমর্থনের সুর ২৭ ফেব্রুয়ারির সমস্যা ও কর্তব্য সম্পাদকীয় স্তরে ধরা পড়ে। মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি ও নুরুল আমিনের বক্তৃতায় উল্লিখিত ‘কমনিট ও বিদেশী চরদের প্রচুর মালমসলাসহ পূর্ব পাকিস্তানে উপস্থিতির সত্যতা আর  যেই হােক ‘আজাদ’ কর্তৃপক্ষের অজানা থাকার কথা নয়। সরকারি প্রচার মহিমার স্বরূপও তাদের অজানা ছিল না।

তা সত্ত্বেও ইঙ্গিতে কবুল করে নেয়ার ভঙ্গিতে উল্লিখিত সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়েছে যে, ব্যাপার এতদূর গড়াইয়া থাকিলে স্বীকার করিতেই হয় যে, দেশের এক সঙ্কটকাল উপস্থিত হইয়াছে।’ এধরনের বক্তব্য পরের দিনগুলােতে সরকারি দমননীতি ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পটভূমিতে আরাে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এবং নিশ্চিতই আন্দোলন-বিরােধী চরিত্র অর্জন করেছে, যথাস্থানে আমরা তা দেখতে পাব। রাষ্ট্রভাষা তহবিল। এইদিন সর্বদলীয় পরিষদের পক্ষ থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় যে, নানা ধরনের লােক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের নামে ব্যক্তিগতভাবে চাদা তুলতে শুরু করেছে, জনসাধারণ যেন সর্বদলীয় পরিষদের আহ্বায়কের দস্তখতবিহীন রসিদের বিনিময়ে বা সিলবিহীন বাক্সে চাঁদা না দেন। এই বিজ্ঞপ্তির অবশ্য প্রয়ােজন ছিল, কিন্তু বিজ্ঞপ্তি এসেছিল অনেক দেরিতে। আর আন্দোলনের অন্যান্য দিকের মতাে এই তহবিল বিষয়েও সর্বদলীয় বা অন্যান্য নেতৃত্বের কোন নিয়ন্ত্রণ বা প্রভাব ছিল না। সত্যি বলতে কি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের আবেগধর্মী দিকটির জন্যই তহবিল গঠনের কাজে জনসাধারণের কাছ থেকে অভাবিত সাড়া পাওয়া যায়। যেমন শহীদ মিনার তলে, তেমনি ব্যক্তিগত পর্যায়েও যথেষ্ট টাকাপয়সা এমনকি সােনার অলঙ্কারও পাওয়া যায়। কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদ, বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ এবং হল-হােস্টেলগুলাে। থেকে তহবিলের জন্য চাঁদা তােলা হয়; কিন্তু কাজটি কোন কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণে। সুশৃঙ্খলভাবে করা হয় নি বলে জনসাধারণের কাছ থেকে সংগৃহীত এই তহবিলের সঠিক হিসেব মেলে নি। সম্ভবত এর ব্যবহারেও ত্রুটি ছিল। আন্দোলনের কেন্দ্রগুলাের মধ্যে (বিশেষত মেডিকেল হােস্টেল ও সলিমুল্লাহ হল) অনৈক্য ও মতাদর্শগত বিরােধ আন্দোলনের যেমন ক্ষতি করেছিল, তেমনি সেই প্রভাব রাষ্ট্রভাষা তহবিলের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। | বিষয়টি আজকের দিনেও স্পর্শকাতর ও নীতিগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিধায় ঐতিহাসিক সত্যের প্রয়ােজনে এ সম্পর্কে কিছুটা বিস্তারিত আলােচনা করা হয়েছে। তহবিলের প্রয়ােজন তন্ত্রভাবে দেখা দেয় আন্দোলন শুরুর দুই একদিন। পরেই, মফস্বলের সাথে যােগাযােগের জন্য ছাত্রকর্মীদের বাইরে পাঠানাের ব্যয়। সঙ্কুলানের জন্য এবং ইস্তাহার ছাপার প্রয়ােজনে।

আমরা দেখেছি, শহীদ মিনারের পাশে পােস্টারে রাষ্ট্রভাষা তহবিলে মুক্তহস্তে দান করুন’ জাতীয় স্লোগান। এমনকি কন্ট্রোল রুমের মাইক থেকেও বারবার এই প্রচার চলেছে। তরুণ ছাত্রকর্মিগণ হল-হােস্টেল থেকে চাঁদার বাক্স হাতে তহবিল সংগ্রহের জন্য সর্বত্র ঘুরে বেড়িয়েছেন। শহীদ মিনারের পাশে বিছানাে চাদরেও  যথেষ্ট টাকাপয়সা, এমনকি সােনার অলঙ্কারের আবেগসিক্ত দানও লক্ষ্য করা এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আবদুল মতিনের বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ : আন্দোলন দেশময় ছড়িয়ে দেবার জন্য টাকার খুবই প্রয়ােজন ছিল। কিন্তু আমাদের হাতে শুরুতে কিছুই ছিল না। ছাত্রাবাসগুলাে থেকে চাঁদা তােলা হচ্ছিল। কিন্তু তাদের কাছে আবেদন করেও তেমন সাড়া। মেলেনি। ফজলুল হক হলের অধীনে সংগৃহীত তহবিল খুব বড় ছিল ।  সলিমুল্লাহ হলের ভি,পি,, জি.এস. (মুজিবুল হক ও হেদায়েত হােসেন চৌধুরী) তাে তহবিল সম্পর্কে আমার সাথে কোন কথা বলতেই রাজি হয়নি। “অবস্থাদৃষ্টে চামেলী হাউস’ অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীদের হােস্টেলে রােকেয়া নামে বগুড়ার এক ছাত্রীকে পূর্ব পরিচয়ের সুবাদে আন্দোলনের জন্য কিছু অর্থ সংগ্রহের অনুরােধ জানাই। ওরা কয়েকজন ছাত্রী চাঁদা তুলতে কলােনীতে গিয়ে আশাতীত সাড়া পেয়েছিল। “দুইদিন পর সন্ধ্যায় কথা বলতে গিয়ে আমিও অবাক হই। প্রায় দশ হাজার টাকা ওরা সগ্রহ করে এনেছে। সে টাকা খুব কাজে লেগেছিল। মফস্বলে ছাত্রকর্মীদের পাঠাতে, ইস্তাহার ছাপতে আরাে নানা কাজে বেশ পরিমাণ টাকা খরচ হয়। ফজলুল হক হলের টাকা ওদের হাত দিয়েই খরচ হয়, এবং তা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির তহবিলে আসেনি। “গ্রেফতার হবার আগে অবশিষ্ট কয়েক হাজার টাকা একজন বিশ্বস্ত কর্মীর কাছে রেখে দেই। সে টাকা পরে নতুন সংগ্রাম পরিষদের আহবায়কের হাতে তুলে দেওয়া হয়, এবং জেলে থাকাকালেই সে খবর পাই। সলিমুল্লাহ হল ও অন্যান্য তহবিল সম্পর্কে জেলে থাকাকালেই খবর পাই যে সংগৃহীত টাকার সদ্ব্যবহার হয় নি। সলিমুল্লাহ হলের জি.এস এবং আখতারউদ্দিন সম্পর্কে নানা কথা কানে আসে। এসব ঘটনা খুবই দুঃখজনক, বিশেষ করে এমন একটি মহান আন্দোলনের ক্ষেত্রে।১৮২ সত্যি বলতে কি সলিমুল্লাহ হলে সংগৃহীত তহবিল নিয়ে খুবই মন কষাকষি চলেছিল। মেডিকেল হােস্টেল নেতৃত্বের ইচ্ছা ছিল, সব টাকাই কেন্দ্রীয় তহবিলে জমা হােক।

কিন্তু কোন হল-ই এ বিষয়ে সাড়া দেয় নি। সলিমুল্লাহ হল সম্পর্কে প্রচার বেশি হওয়ার কারণ সবারই এরকম ধারণা ছিল যে ওদের সংগ্রহের অঙ্কটা খুবই বড়। বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি ও মেডিকেল হােস্টেলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাথে সলিমুল্লাহ হলের এই নিয়ে বেশ তিক্ততা সৃষ্টি হয়েছিল। আর এদিকে মেডিকেলে কলেজের তরুণ ছাত্রকর্মীদের এবং শহীদ মিনারের সংগ্রহ জমা রাখা হয়েছিল মাহবুব জামাল জাহেদীর কাছে; কারণ জাহেদী তার ভগ্নিপতি ডা. আবদুল মান্নানের বাসস্থান ‘ডক্টরস ব্যারাকে পাকা আস্তানা করে নিয়েছিলেন। তিনি গ্রেফতার হওয়ার পর শােনা যায়, ঐ টাকা তার আত্মীয় ডাক্তারের কাছে গচ্ছিত ছিল। পরে তার হদিস জানা যায় নি। অন্যদিকে সলিমুল্লাহ হলের তহবিল সম্পর্কে হল ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হেদায়েত হােসেন চৌধুরী বলেন : টাকাকড়ি প্রথমদিকে খালেক নেওয়াজের কাছে জমা থাকতাে। তিনি তখন ইকবাল হলে থাকতেন। তার কাছ থেকে পরে টাকা হাউস টিউটর ভূইয়া সাহেবের কাছে রাখা হয়। এবং পরবর্তী পর্যায়ে টাকা জমা থাকে আখতারউদ্দিনের কাছে। তারপর টাকাকড়ির কি অবস্থা হয় আমি জানি না ।১৮৩ এ বিষয়ে হাসান হাফিজুর রহমান বলেন : সে সময় সাধারণ ছাত্রদের তরফ থেকে প্রচুর টাকা সংগ্রহ করা হয়েছিল।

সে সময় এস.এম. হলের রাষ্ট্রভাষা তহবিলের ট্রেজারার ছিলেন আখতারউদ্দিন। ভাষা আন্দোলনের জন্য সংগৃহীত টাকা তার কাছেই গচ্ছিত ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে এসব টাকাপয়সার ঠিকঠাক হিসেব পাওয়া যায়নি বলে শুনেছি। আখতারউদ্দিন পরে ব্যারিষ্টারী পড়তে লন্ডন চলে গিয়েছিলেন ।১৮৪ নেতাদের বিরুদ্ধে পরােয়ানা ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারি থেকেই শুরু হয়েছিল সরকারপক্ষ থেকে দমননীতির নানামুখী চাপ; ছাত্র এলাকার নিরাপত্তা ততদিনে শেষ হয়ে গেছে। স্বভাবতই ছাত্রনেতৃত্বের পক্ষে সম্ভাব্য গ্রেফতার এড়াতে সতর্ক চলাফেরা, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে আত্মগােপনের প্রয়ােজন হয়ে পড়েছে। মেডিকেল ব্যারাকের বহুখ্যাত “নিরাপদ আস্তানা’ তখন আর পুরােপুরি নিরাপদ থাকে নি, বিশেষ করে রাতে। তাই নেতাদের নানা কৌশলে এখানে-সেখানে বা কক্ষ পরিবর্তন করে কিংবা হাসপাতালে রাত কাটাতে হচ্ছে। তাই পদে পদে আন্দোলনের কাজ বিঘ্নিত হয়ে চলেছে।  এমনি পরিস্থিতিতে গ্রেফতারি পরােয়ানার প্রশ্ন ছাড়াই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হয়েছে নেতাদের। তবে ২৮ ফেব্রুয়ারি জননিরাপত্তা আইনের আওতায় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের যেসব সদস্যের (তারা আন্দোলনের সাথে জড়িত থাকুন আর না-ই থাকুন) এবং আরাে কয়েকজন ছাত্রযুব নেতার বিরুদ্ধে ঢাকা গেজেটের বিশেষ ঘােষণার মাধ্যমে গ্রেফতারি পরােয়ানা জারি করা হয় তাদের মধ্যে শামসুল হক, কাজী গােলাম মাহবুব, খালেক নেওয়াজ খান, অলি আহাদ, আবদুল মতিন, সৈয়দ নুরুল আলম, মােহাম্মদ তােয়াহা অন্যতম। | অবশ্য প্রদেশব্যাপী ভাষা আন্দোলনের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। একইভাবে গ্রেফতারের জন্য হামলা চলেছে এবং চলেছে আন্দোলনের শেষ সক্রিয় দিনটি পর্যন্ত ।

সূত্র : ভাষা আন্দোলন-ইতিহাস ও তাৎপর্য – আবদুল মতিন, আহমদ রফিক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!