২৬ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনে ভাটা এবং সরকারি চণ্ডনীতি
অবশেষে সর্বদলীয় পরিষদের সিদ্ধান্তমাফিক শিক্ষায়তন বাদে সর্বত্র সাধারণ ধর্মঘট তথা হরতাল স্থগিত ঘােষণা করা হলাে। আন্দোলনের ঐ বিশেষ পর্যায়ে হরতাল স্থগিত করার অর্থ যে হরতাল তুলে নেয়া সে কথা বুঝতে কারাে বাকি থাকে নি। তুলে নেয়া হরতাল যে সরকারি দমননীতির মুখে এবং পরিস্থিতিগত কারণে আবার বহাল করা সহজ হবে না সে কথা অনেকেই জানতেন। আর হরতাল প্রত্যাহারের অর্থ যে প্রকৃতপক্ষে আন্দোলন প্রত্যাহার (ইতিবাচক বিকল্প কর্মসূচি দিতে না পারা অবধি) করার শামিল সে কথা কি কেউ উপলব্ধি করেন নি? আদি সর্বদলীয় পরিষদ কিংবা অস্থায়ী পরিষদ এবং তার সংশ্লিষ্ট নেতৃত্ব? এখানেই পরিস্ফুট হলাে আন্দোলনের দুর্বল বিন্দুগুলাে থেকে উদ্ভূত অবাঞ্ছিত পরিণাম। এ আন্দোলনে যদি কোথাও কোনাে বিন্দুতে হার ঘটে থাকে, তাহলে তা এইখানে। ছাত্রাবাসে হামলা : যত্রতত্র গ্রেফতার ইতােমধ্যে নুরুল আমিন-মােহন মিঞা চক্র এবং তাদের অবাঙালি-প্রধান আমলতিন্ত্রী প্রশাসনের সিদ্ধান্তমাফিক আন্দোলনের সংগঠক ও সংশ্লিষ্টদের ওপর আঘাত হানার কর্মসূচি বাস্তবায়নের তৎপরতা শুরু হয়ে যায় । ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারির প্রধান ঘটনা তাই পথে পথে মিছিল নয়, বরং সরকার পক্ষ থেকে একের পর এক হামলা ও গ্রেফতার । এইদিন অর্থাৎ মঙ্গলবারের ঘটনাবলীর সারসংক্ষেপ ছিল সলিমুল্লাহ। হলে পুলিশের ঘেরাও-তল্লাশি, একজন এম.এল.এ-সহ চারজন অধ্যাপক ও বহু ছাত্র গ্রেফতার এবং মেডিকেল হােস্টেলে দাঁড়ানাে শহীদ মিনার ধ্বংস। ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারি ভােরে পুলিশ জননিরাপত্তা আইনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. পি.সি, চক্রবর্তী, মােজাফফর আহমদ, মুনীর চৌধুরী এবং জগন্নাথ কলেজের অধ্যাপক অজিত গুহকে গ্রেফতার করে। আরাে গ্রেফতার হন।
বরিশালের কংগ্রেস দলীয় এম.এল.এ সতীন্দ্রনাথ সেন ।১৭৯ এরপর দুপুরের দিকে পুলিশ সলিমুল্লাহ হল ঘেরাও করে। এ সম্পর্কে ২৭ ফেব্রুয়ারি ‘আজাদ’-এর প্রতিবেদন : ‘বেলা প্রায় আড়াই ঘটিকায় সলিমুল্লাহ হলে খানাতল্লাশী হয় …. পুলিশ মােছলেম হলের গেটের তালা ভাঙ্গিয়া ভিতরে প্রবেশ করে এবং প্রতিটি কামরা তন্ন তন্ন করিয়া খানাতল্লাশী করে …এই তল্লাশী প্রায় দুই ঘণ্টা চলে।…পরে অনুমান ৩০ জন ছাত্রকে পুলিশ গ্রেফতার করে। মােছলেম হলের হাউস টিউটর ডাঃ মফিজউদ্দিন আহমদকেও পুলিশ গ্রেফতার করে। তল্লাশীর সময় ভাইস-চ্যান্সেলর, মােছলেম হলের প্রভােষ্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারকে গেটের সামনে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখা যায়। প্রকাশ, পুলিশ তাহাদিগকে ভিতরে প্রবেশ করার অনুমতি দেয় নাই। দৈনিক স্টেটসম্যান’-এর মতে ‘টুপস’ অর্থাৎ সেনাবাহিনী পুলিশের সাথে হলের চারপাশে অবস্থান নেয়। পুলিশ কক্ষে কক্ষে তল্লাশি চালায় এবং আটাশজনকে গ্রেফতার করে। এইদিনও রাত দশটা থেকে ভাের পাঁচটা পর্যন্ত কারফিউ বলবৎ করা হয় (২৭.২.১৯৫২)। স্টেটসম্যানের খবর অনুযায়ী পরিস্থিতি বিবেচনার জন্য ২৭ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের জরুরি সভা আহ্বান করা হয়। ছাব্বিশ ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় উল্লেখযােগ্য ঘটনা মেডিকেল কলেজ হােস্টেল প্রাঙ্গণে পুলিশ কর্তৃক শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের ধ্বংস সাধন। এ সম্পর্কে আগেই বিস্তারিত বলা হয়েছে। শহরের পরিস্থিতি ইতােমধ্যে শহরের অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে আসে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাদে অফিসআদালত, দোকানপাট, ব্যাঙ্ক, সিনেমা হল, খেলার মাঠ সর্বত্র স্বাভাবিক কর্মতৎপরতা দেখা যায়। কথাটা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, হরতাল প্রত্যাহারের বাস্তব অর্থ আন্দোলন প্রত্যাহার। তাই এইদিন কোন মিছিল বেরুতে দেখা যায় না। একমাত্র ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা পুলিশী জুলুমের প্রতিবাদে মহিলাদের বিক্ষোভ সভা। এই সংবাদ দৈনিক আজাদ’-এ বড় করেই ছাপা হয় : ‘ঢাকার নিরীহ ছাত্র ও জনসাধারণের ওপর পুলিশের গুলীবর্ষণের প্রতিবাদে ১২নং অভয়দাস লেনে মহিলাদের এক বিরাট সভা হয়। সভার বিশেষত্ব ছিল এই যে, শহরের রিকশা ও ঘােড়ার গাড়ী না থাকা সত্ত্বেও বহুদূর হইতে পায়ে হাটিয়া বৃদ্ধা ও বর্ষিয়সী মহিলারা পর্যন্ত এই সভায় যােগদান করেন।… সভায় বাংলা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ঘােষিত না হওয়া পর্যন্ত গণতান্ত্রিক সংগ্রাম চালাইয়া যাওয়ার দাবি এবং মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রকাশ করা হয়।
বর্তমান আন্দোলনকে যাহাৱা বাঙ্গালী-অবাঙ্গালী ও হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির অপচেষ্টা বলিয়া প্রচার করিতেছে, সভায় তাহাদের প্রতি তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়। সভায় শহীদদের লাশের ঠিকানা, তাহাদের দাফনের ব্যবস্থাদি সংক্রান্ত সঠিক সংবাদ দাবি করা হয়। পরিশেষে ‘সর্বদলীয় ঢাকা মহিলা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম | পরিষদ’ নামে একটি পরিষদ গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। ১৮০ এই সভা সত্যিকার অর্থেই ছিল ব্যতিক্রমধর্মী; যদিও অনেক পরে অনুষ্ঠিত। যে একটি বিষয় সংগ্রাম পরিষদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বিশেষ কারাে নজরে আসে নি, সরকারের কাছে শহীদদের সম্পর্কে সঠিক তথ্য পরিবেশনার সেই দাবি একমাত্র মহিলাদের এই সভায়ই করা হয়েছিল, অন্য কোথাও নয়। আর তারাই দৃঢ় প্রত্যয়ে দাবি করেছিলেন, বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত রাখার, কিন্তু ইতােমধ্যে সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্র যুব নেতৃত্ব প্রকারান্তরে আন্দোলনের মৃত্যুঘােষণা করেছিলেন। একইভাবে তাদের একাংশ ২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা না-ভাঙার সিদ্ধান্ত নিয়ে আন্দোলনের সব সম্ভাবনা শেষ করে দেবার চেষ্টা করেছিলেন। মুসলিম লীগে অন্তৰ্ক : পদত্যাগ, প্রতিবাদী বিবৃতি আন্দোলনের অন্তরশক্তি শেষ হয়ে যাওয়া এবং সরকারের পক্ষে চণ্ডনীতির অনুসরণ সত্ত্বেও মুসলিম লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের নিরসন ঘটে নি। বরং ক্রমেই তা বেড়ে চলে। এটা যেমন তাদের অন্তর্দলীয় ক্ষমতার দ্বন্দ্বের কারণে, তেমনি ভাষা সম্পর্কে অনুসৃত নীতির কারণেও বটে। আমাদের এই সিদ্ধান্তের পক্ষে সমর্থন মেলে বিক্ষোভের উত্তাপ শেষ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও বেশ কিছুসংখ্যক মুসলিম লীগ রাজনীতিকের প্রতিবাদ বা দল থেকে পদত্যাগের পালা অব্যাহত থাকার ঘটনায়। তাই দেখা যায়, চট্টগ্রামের গণপরিষদ সদস্য নুর আহমদ ২০ মার্চ গণপরিষদের আসন্ন অধিবেশনে উর্দুর সাথে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের জন্য ব্যক্তিগতভাবে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং সেই কারণে গণপরিষদের সভাপতির নিকট এক নােটিশ পাঠান (‘আজাদ, ২৭.২.৫২)।
বরিশালের শামসুদ্দিন শিকদার মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টি থেকে সরকারি নীতির প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন। এই সঙ্গে আরাে যে দুইজন পরিষদ সদস্য পদত্যাগ করেন, তারা হলেন নুরুজ্জামান ও আবদুর রহমান। সিলেট জেলার মাহমুদ আলীসহ চারজন লীগ রাজনীতিকের পদত্যাগের কথা আমরা আগেই। উল্লেখ করেছি। ময়মনসিংহের মুসলিম লীগ সহ-সভাপতি মােসাহেব আলী খান এবং গণপরিষদ সদস্য এ.এম.আবদুল হামিদ পদত্যাগ করেন। অন্যদিকে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির সদস্য খুলনার আবদুস সবুর খান সরকারি কার্যকলাপের প্রতি তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করে এক বিবৃতি প্রকাশ করেন। অবিভক্ত বাংলার প্রাক্তন শিক্ষাসচিব সৈয়দ মােয়াজ্জেমউদ্দিন হােসেন মুখ্যমন্ত্রীর বেতার বক্তৃতার তীব্র সমালােচনা করে এক দীর্ঘ বিবৃতি প্রকাশ করেন। তিনি ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণ ‘নিতান্ত বিকৃত মস্তিষ্কের কাজ’ বলে আখ্যায়িত করেন। পরিষদ সদস্য ইউসুফ চৌধুরী একই কারণে প্রতিবাদ-বিবৃতি প্রচার করেন। তিনি মনে করেন, পাকিস্তান গণপরিষদ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের আংশিক প্রতিকার করতে পারে। ঢাকা সিটি মুসলিম লীগ সভাপতি সৈয়দ সাহেব আলম, পরিষদ সদস্য ওসমান আলী, নারায়ণগঞ্জ সিটি লীগ সভাপতি নজিবউদ্দিন আহমদ, মাওলানা আতাহার আলী ও পীর বাদশা মিয়া ঢাকায় পুলিশী জুলুমের তীব্র নিন্দা ও নুরুল আমিনের বেতার ভাষণের তীব্র সমালােচনা করেন (আজাদ, ২৭.২.৫২)। এছাড়াও এ.কে. ফজলুল হক এবং আতাউর রহমান খান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সরকারি কার্যকলাপের তীব্র নিন্দা করে সংবাদপত্রে বিবৃতি প্রকাশ করেন। হক সাহেবের বিবৃতিটি ছিল সলিমুল্লাহ হলে হামলা এবং তাকে ভেতরে ঢুকতে না দেয়ার ওপর জোর দিয়ে তার রাজনৈতিক স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে লেখা।
সূত্র : ভাষা আন্দোলন-ইতিহাস ও তাৎপর্য – আবদুল মতিন, আহমদ রফিক