পঁচিশে ফেব্রুয়ারি অব্যাহত বিক্ষোভে সরকারি উদ্বেগ
বিক্ষোভ, প্রতিবাদ অব্যাহত ; দমননীতির সূচনা। চব্বিশে ফেব্রুয়ারি মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের বেতার বক্তৃতা এবং মুসলিম লীগ। ওয়ার্কিং কমিটির তিনদিনব্যাপী (২৩-২৫ ফেব্রুয়ারি) বৈঠকে আলােচনা শেষের সিদ্ধান্ত থেকে এটা স্পষ্ট যে, ভাষা আন্দোলনের ওপর অপ্রয়ােজনীয় দমননীতির ফলে যেমন লীগের মধ্যে ভাঙনের সূচনা, তেমনি কট্টরপন্থী লীগ মহল ও সংশ্লিষ্ট অবাঙালি প্রধান আমলাতন্ত্র অধিকতর কঠোর নীতি গ্রহণের পক্ষপাতী হয়ে ওঠেন এবং ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে এ সম্পর্কে কার্যক্রম গ্রহণের আভাস ও সূচনা দেখা যায়। এর কারণ, পাঁচদিনের অব্যাহত হরতাল-বিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের প্রশাসনিক ও নৈতিক কর্তৃত্ব ভেঙে পড়ায় সরকার খুবই অসহায় বােধ করতে থাকেন। জনসাধারণ তখন ছাত্র নেতৃত্বের অধীন। এই অবস্থায় সরকার মরিয়া হয়ে আঘাত হানতে চাইবেন এটাই স্বাভাবিক। পঁচিশে ফেব্রুয়ারি ঢাকার পরিস্থিতি সম্পর্কে ২৬ ফেব্রুয়ারি ‘আজাদ’ পত্রিকার বিবরণে একটি প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি ফুটে ওঠে ; গতকল্য (সােমবার) রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পঞ্চম দিবসে ঢাকা শহরে সর্বত্র পূর্ণ হরতাল প্রতিপালিত হয়। এইদিন সকল প্রকার যানবাহন, বাজার, দোকানপাট, ব্যাংক, সিনেমা ও খেলাধুলা বন্ধ থাকে এবং কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের অফিস ও আদালতসমূহ জনশূন্য বলিয়া প্রতীয়মান হয়। ‘সােমৰারে শহরে উত্তেজনাপূর্ণ আবহাওয়া বিরাজমান থাকিলেও কোনরূপ দুর্ঘটনার সংবাদ পাওয়া যায় নাই। ছাত্রদের মধ্যে কেহ গ্রেফতার হইয়াছে। বলিয়া শােনা যায় নাই। কিন্তু সরকার তাদের পরিকল্পনা মাফিক দৃঢ় এবং সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে শুরু করেন, বলা যায় কর্তৃত্ব রক্ষার তাগিদে। পূর্বোক্ত পত্রিকার ভাষ্যে বলা ‘বেলা প্রায় ১১টার সময় পুলিশ বাহিনী ও ই.পি.আর সলিমুল্লাহ মুসলিম হল হইতে মাইক ছিনাইয়া লইবার জন্য হল প্রাঙ্গণে প্রবেশ করিয়া হল ঘিরিয়া ফেলে। কিন্তু হলের ভিতরের গেট বন্ধ থাকায় পুলিশ বাহিনী ভিতরে প্রবেশ | করিতে সক্ষম হয় না। এ সময় হলের প্রভােস্ট ছাত্রদের সাথে আলােচনার পর কর্তৃপক্ষের হাতে মাইক তুলে দেবার ব্যবস্থা নেন। একই বিষয়ে ‘আজাদ’ প্রতিবেদন : তারপর অনুমান ৪ হাজার লােকের এক সভা হয়।
তাহাৱা শােভাযাত্রা করিয়া মেডিক্যাল কলেজ অবধি আসে। শহরের কয়েক স্থানে ছাত্রদল মাইকযােগে বক্তৃতা করেন। পুলিশ মাইকগুলি ছিনাইয়া লওয়ার চেষ্টা করিয়া ব্যর্থ হয়। দেখা যাচ্ছে পঁচিশে ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরের অবস্থা মােটেই শান্তিপূর্ণ ও নিরীহ ছিল না। অফিস-আদালত বন্ধ ছিল। আর পথে পথে মিছিল ও বিক্ষোভ চলেছে। সরকারও চুপচাপ বসে থাকে নি। সলিমুল্লাহ হলের পর তারা ফজলুল হক হল এবং জগন্নাথ কলেজে হামলা চালায়। ‘আজাদ’ পত্রিকার মতে, ‘গতকল্য পুলিশ বাহিনী জগন্নাথ কলেজ ও ফজলুল হক হলে প্রবেশ করিয়া মাইক ছিনাইয়া লয়।’ পুলিশ আন্দোলনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস যুবলীগ অফিসে হানা দেয়। অন্যদিকে পুলিশ কামরুদ্দিন আহমদের জিন্দাবাহার লেনের বাসভবনেও হামলা চালায়। চব্বিশে ফেব্রুয়ারি তারিখের ইনসাফ’-প্রতিবেদনে দেখা যায় সেদিন বেলা প্রায় ১টার দিকে কয়েক হাজার লােকের একটি মিছিল শহীদ মিনারের কাছে এসে সমবেত হয় এবং পরে সেখান থেকে পুরনাে ঢাকার দিকে চলে যায়। দেখা যাচ্ছে জনসাধারণের মন থেকে সরকারবিরােধী বিক্ষোভের আগ্রহ ও উত্তাপ তখনাে নিভে যায় নি। নেতৃত্বই বরং কিছুটা পিছিয়ে পড়েছিল বলে মনে হয়।
এই দিনই খুব ভােরে পুলিশ নিরাপত্তা আইনে মৌলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, খয়রাত হােসেন, আবুল হাশিম, মনােরঞ্জন ধর ও গােবিন্দলাল ব্যানার্জিকে গ্রেফতার করে। এরপর সুপরিকল্পিতভাবে এই ধরপাকড়ের ধারা অব্যাহত থাকে। বিরােধীদলীয় পরিষদ সদস্যগণ, নিজদলীয় প্রতিবাদী সদস্যগণ, শিক্ষক, অধ্যাপক, সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সদস্য এবং ছাত্র নেতাগণ ছিলেন পর্যায়ক্রমে এই হামলা ও গ্রেফতারের শিকার। ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারি তারিখের ‘আজাদ’ এবং কলকাতার ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় উল্লিখিত গ্রেফতারের সংবাদ পরিবেশিত হয়। প্রসঙ্গত ঐদিনের ‘স্টেটসম্যান পত্রিকায় আরাে বলা হয় যে, সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক আহত হরতাল সাফল্যজনকভাবে পালিত হয়েছে। দোকানপাট, স্কুল-কলেজ সব বন্ধ ছিল; রাস্তাঘাটে কোন যানবাহন চলাচল করে নি, সেক্রেটারিয়েটে কোন কর্মচারি উপস্থিত ছিল না। রাস্তায় কয়েকটি মিছিল দেখা যায়, কিন্তু সেগুলাের সংখ্যা ছিল কম।১৭১ শুধু ঢাকাই নয়, এইদিন নারায়ণগঞ্জ শিল্প এলাকায়ও পূর্ণ হরতাল পালিত হয়।
যানবাহন, দোকানপাট সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে। জনসাধারণ ছােট ছােট দলে বিভক্ত হয়ে বিক্ষোভে-মিছিলে অংশ নেয়। মেয়েরাও বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করে। ১৭৯ এ! সময়ের অবস্থা পর্যালােচনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলাে, আন্দোলনে ভাটার টান সত্ত্বেও সরকার ও সরকারি পরিষদ সদস্যদের প্রতি জনমানসের অনাস্থা এবং তাদের পদত্যাগের দাবিতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সভা, প্রস্তাব গ্রহণ ও সংবাদপত্রে বিবৃতি। ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারি ‘আজাদ’-এ বলা হয় । ঢাকাস্থ ত্রিপুরার ছাত্রবৃন্দের তরফ হইতে মহসিনুজ্জামান চৌধুরী, আনওয়ারুল হক চৌধুরী, আবদুল ওহাব ও গােলাম মুকিত প্রমুখ ২৫ জন ছাত্র প্রতিনিধি নিম্নলিখিত বিবৃতি দিয়াছেন। আমরা ত্রিপুরার মন্ত্রীদ্বয় ও এম.এল.এ-দের কাছে দৃঢ়কণ্ঠে এই দাবি জানাইতেছি, তাহাৱা নুরুল আমিন সরকারের মনুষ্যত্বহীন কার্যকলাপের প্রতিবাদে লীগ পার্লামেন্টারী পার্টি হইতে পদত্যাগ করুন এবং বিবৃতি মারফত জনসাধারণকে জানাইয়া দিন।’ চাঁদপুরে ও যশােরে অনুরূপভাবে এম.এল.এ-দের পদত্যাগ দাবি করা হয়। “নােয়খালী, খুলনা ও অন্যান্য স্থানের এম,এল, এদের পদত্যাগ দাবি করিয়া ছাত্রনেতাগণ বিবৃতি দেন। গণপরিষদ সদস্য এম.এ. হামিদ এক বিবৃতিতে (আজাদ, ২৬.২.৫২) জানান যে, গণপরিষদে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করানাে সম্ভব না হলে তিনি পদত্যাগ করবেন। ইতােমধ্যে সরকারি প্রচার-তৎপরতার অংশ হিসেবে এক প্রেসনােটে বলা হয়। যে, ‘পরদিন অর্থাৎ ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারি দোকানপাট ও যানবাহন চালু করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। উদ্দেশ্য, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আশ্বাস দান। অন্যদিকে সরকারি কার্যকলাপের সাথে সঙ্গতি রেখে লাহােরে গভর্নর জেনারেল গােলাম মােহাম্মদ আন্দোলনের প্রতি পরােক্ষ হুমকি দিয়ে বলেন : ‘প্রাদেশিকতা পাকিস্তানের সংহতির পক্ষে বিপদস্বরূপ। এ বিপদ সম্পর্কে বর্তমানে আমাদিগকে সজাগ থাকিতে হইবে।
এছলামে ভৌগােলিক সীমানা সম্পর্কিত বিধি-নিষেধের অনুমতি দেওয়া হয় নাই।১৭২ আমরা জানি, পাকিস্তানি নেতাগণ প্রাদেশিকতা’ শব্দটির সাহায্যে পূর্ববাংলার আঞ্চলিক দাবি, ভাষা ও জাতিসত্তা সংক্রান্ত দাবির প্রতি ইঙ্গিত করতেন এবং প্রাদেশিকতা প্রসঙ্গ কখনই পশ্চিম পাকিস্তানের কোন প্রদেশ সম্পর্কে প্রযােজ্য। হতাে না, যদিও সিন্ধুতে ও সীমান্ত প্রদেশে জাতীয়তা বিষয়ক কিছু কিছু দাবি মাঝেমধ্যে উচ্চারিত হয়েছে। সর্বদলীয় বৈঠক : ৯৬ ঘন্টার চরমপত্র টানা পাঁচদিন পূর্ণ হরতাল পালন। ঢাকার মানুষ স্মরণকালের মধ্যে এমন ঘটনা দেখেছেন বলে মনে করতে পারেন না। জীবনযাত্রা এক অর্থে অচল হলেও রাজপথে তা পূর্ণমাত্রায় সচল; এমনকি জনসাধারণ্যে এর জন্য কোন আক্ষেপ শােনা যাচ্ছে না। কিন্তু দীর্ঘ সময়ের লাগাতার হরতালের কারণে কিছু বাস্তব। অসুবিধা দেখা দিয়েছিল, যেমন দিনমজুরদের জীবিকা নির্বাহ। এ বিষয়ে এবং বিশেষ করে নদীর ওপার থেকে দুধ সরবরাহ বন্ধ থাকায় শিশুদের জন্য সমস্যা সৃষ্টির পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকাই সর্দারগণ সাময়িকভাবে হরতাল স্থগিত রাখার পরামর্শ দেন।১৭৩ এমন সব তাৎক্ষণিক সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে মেডিকেল হােস্টেলে ২৫ ফেব্রুয়ারি দুপুরে সর্বদলীয় কর্ম পরিষদ ও অন্যদের যে যৌথ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, নানা তর্কবিতর্কে এর মেয়াদ সন্ধ্যা পর্যন্ত গড়ায়। বলা বাহুল্য এই বৈঠক ছিল সর্বদলীয় পরিষদেরই সম্প্রসারিত রূপ।
দুই দফায় এই দীর্ঘ বৈঠক শেষ হয় এবং কেউ কেউ হােস্টেলেই দুপুরের খাওয়া শেষ করেন। মরহুম তাজউদ্দিনের ডায়েরি উদ্ধৃত করে বদরুদ্দিন উমর এই বৈঠকে উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে কামরুদ্দিন আহমদ, শামসুল হক, খন্দকার মুস্তাক আহমদ, তাজউদ্দিন আহমদ, শামসুদ্দিন আহমদ, এম.এল.এ প্রমুখের নাম উল্লেখ করেছেন। তার মতে বৈঠকের সভাপতি ছিলেন আতাউর রহমান খান।১৭৪ এই বৈঠকে তারা যে তিনটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন, তাহলাে (ক) ছাব্বিশ তারিখ থেকে সাধারণ ধর্মঘট স্থগিত কিন্তু ছাত্রধর্মঘট অব্যাহত রাখা, (খ) মুখ্যমন্ত্রীর কাছে নয় দফা চরমপত্র প্রদান এবং (গ) ৫ মার্চ শহীদ দিবস ও সাধারণ ধর্মঘট পালন।১৭ সর্বদলীয় পরিষদের তরফ থেকে এই সিদ্ধান্ত ও কর্মসূচি সংবাদপত্রে প্রচারিত হয়। ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারি ‘আজাদ’ পত্রিকায় এ সম্পর্কে প্রতিবেদন : ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কমিটির (কমিটি নয় ‘সংগ্রাম পরিষদ’ হবে— লেখকদ্বয়) সাধারণ ধর্মঘটের আহ্বানে জনগণ যে সাড়া দিয়াছেন তজ্জন্য। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করিয়া কমিটি পরবর্তী কর্মপন্থা ঘােষণা করিয়াছেন। ক্রমাগত ধৰ্ম্মঘট চলিতে থাকিলে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র ব্যক্তিদের আর্থিক সঙ্কটের আশঙ্কা থাকায় স্থির হইয়াছে যে, কেবলমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে ছাড়া অপর সব প্রতিষ্ঠানের ধর্মঘট স্থগিত রাখা হইল। কমিটির নয় দফা দাবি মানিয়া লওয়ার জন্য সরকারকে ৯৬ ঘণ্টার সময় দেওয়া হইতেছে এবং উক্ত সময়ের মধ্যে সরকার কর্তৃক দাবিসমূহ মানিয়া না লওয়া হইলে, কমিটি পরবর্তী কর্মপন্থা নির্ধারণ করিবে। ‘আগামী ৫ই মার্চ প্রদেশের সর্বত্র শহীদ দিবস ও শান্তিপূর্ণ ধর্মঘট পালিত হইবে। কমিটি পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থা পরিষদের অধিবেশন অকস্মাৎ স্থগিত রাখার এবং চারিজন এম,এল,এ ও অন্যান্য ব্যক্তির গ্রেফতারের তীব্র নিন্দা করিতেছে। কমিটি মনে করেন যে, জনাব নুরুল আমিন পার্টির আস্থা হারাইতেছেন বলিয়া এবং শাসনকার্য চালাইতে অক্ষম হইয়াছেন বলিয়াই উক্তরূপ ধরপাকড়ের ব্যবস্থা করিতেছেন।’ এখন প্রশ্ন, যে সর্বদলীয় পরিষদের সদস্যগণ সংগঠন হিসেবে আন্দোলন পরিচালনায় প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ না করে কখনও এককভাবে কখনও সংবাদপত্রে বিবৃতির মাধ্যমে অস্তিত্ব রক্ষা করে চলছিলেন, তারা হঠাৎ কেন এধরনের চরমপত্র দেয়ার মতাে চরম ব্যবস্থা নিতে গেলেন, বিশেষ করে যখন একদিকে আন্দোলনে।
কিছুটা ভাটার টান, অন্যদিকে সরকারপক্ষে কঠোর দমননীতি শুরু হয়েছে! কিন্তু এ প্রসঙ্গে আরাে একটি বিষয় অত্যন্ত অস্বাভাবিক মনে হয়। বিষয়টি হলাে এমনি একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের বৈঠকে অলি আহাদ, আবদুল মতিনের নাম দেখা যাচ্ছে না কেন এবং এ বিষয়ে অলি আহাদই-বা নীরব কেন? তার জাতীয় রাজনীতি” বইটিতে এই বৈঠকের ঘটনা স্থান পায়নি যদিও তুলনামূলক বিচারে এর চেয়ে অনেক গৌণ বিষয় সেখানে স্থান পেয়েছে। অথচ বৈঠক যে হয়েছে তার অন্তত একটি প্রমাণ ইমদাদ হােসেনের বক্তব্য। তকালীন আর্টস স্কুলের ছাত্রকর্মী। ইমদাদ ঐ সভায় উপস্থিত ছিলেন এবং কাজী গােলাম মাহবুব ও আনােয়ারা খাতুন সেখানে ছিলেন বলে তার মনে রয়েছে। তাছাড়া ঢাকাই সর্দারদের তরফ থেকে। একজন প্রতিনিধিও ঐ সভায় উপস্থিত ছিলেন বলে তার মনে পড়ে। তার কথায়, সম্ভবত অলি আহাদ এবং আবদুল মতিনও সেখানে ছিলেন।১৭৩ সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সভায় তার আহ্বায়ক ঐ সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে উপস্থিত থাকবেন এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু বদরুদ্দিন উমরের পরিবেশিত (তাজউদ্দিনের ডায়েরি-নির্ভর) বিরণে কাজী গােলাম মাহবুবের উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে না। আবার এ বিষয়ে বশীর আল হেলালও নীরব। এমনকি ঐ নামের তালিকাও তার বইতে নেই, যদিও বহু বিষয় ঐ বিশাল গ্রন্থে ব্যাপক বিস্তার নিয়ে স্থান পেয়েছে। এই বৈঠকের সমস্যা সম্পর্কে আমরাও কোন আলােকপাত করতে পারছি না এই জন্য যে, প্রথমত আন্দোলনের সক্রিয় ও প্রধান সংগঠকদের অন্যতম অলি আহাদ এ বিষয়ে একেবারে নীরব, দ্বিতীয় প্রধান আবদুল মতিনের স্মৃতি এ বিষয়ে যথেষ্ট স্পষ্ট নয়। তবু তার মনে হয়, ঐ বৈঠকে তিনি এবং অলি আহাদ কিছুক্ষণের জন্য উপস্থিত ছিলেন এবং অন্যদের সাথে ভিন্নমত পােষণ করেছিলেন। এ বিষয়ে তার বক্তব্য। নিম্নরূপ : আন্দোলন এ পর্যায়ে বন্ধ করা হলে পুনরায় শুরু করা কঠিন হবে এবং এ পর্যায়ে সৱকাৱকে চরমপত্র দান যুক্তিযুক্ত হবে না। বিৰাজমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বরং আন্দোলনের বিজয় ঘােষণা করে বিজয় সংহত করার ব্যবস্থা নিয়ে আন্দোলনে ইতি টানাই ভাল ।১৫
আবদুল মতিন বলেন, তখনকার পরিস্থিতিতে সঠিক করণীয় সম্পর্কে কারােরই। কোন স্পষ্ট ধারণা ছিল না। চূড়ান্ত কর্তব্য সম্পর্কে যেমন ছিল ভাসাভাসা ধারণা, তেমনি ছিল মতবিরােধ।১৭ অন্যদিকে হােস্টেলে উপস্থিত মেডিকেল কর্মীদের কেউ এই বৈঠকের উপস্থিতি সম্পর্কে কোন তথ্য মনে করতে পারেন নি, এমনকি সাধারণ সম্পাদক শরফুদ্দিন আহমদ কিংবা তৎপর ছাত্রকর্মী আবদুস সালামও পারেন নি।১৭ তারা এবং অস্থায়ী আহ্বায়ক গােলাম মাওলাও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না। কিন্তু কেন? সর্বদলীয় পরিষদের আহ্বায়ক কাজী গােলাম মাহবুব আমাদের জানিয়েছেন : তিনি ঐ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন, ছিলেন আনােয়ারা খাতুনও। তাকে বিশেষভাবে । ৯ দফা চরমপত্রের দফাগুলাে সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয় এবং হঠাৎ করে সেই সময়ে (হয়তাে-বা অসময়ে) চরমপত্রদানের কারণ এবং তাদের সুনির্দিষ্ট চিন্তাভাবনা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে কোন সুস্পষ্ট জবাব বা বিষয়টির প্রেক্ষাপট তিনি ব্যাখ্যা করতে পারেন নি। বিশ্বতি এর কারণ বলে জানান ।১৭৭ ভাবতে একটু অবাকই লাগে যে, এই গুরুত্বপূর্ণ দীর্ঘ ৯ দফার কোন উল্লেখ সম্ভবত সংবাদপত্রে নেই, নেই ইতিহাসের পাতায়ও। কী ছিল ঐ ৯ দফার চরমপত্রে যে সরকার ঐ চরমপত্রের জবাব দিলেন ইব্র দমনীতির মাধ্যমে? তা ছাড়াও প্রশ্ন ওঠে, বাইশে ফেব্রুয়ারি পরিষদ অধিবেশনে বাংলা রাষ্ট্রভাষার পক্ষে প্রস্তাব গ্রহণের পর তাৎক্ষণিক এমনকি গুরুত্বপূর্ণ দাবি থাকতে পারে যেজন্য সরকারকে ৯৬ ঘণ্টার চরমপত্র দেয়ার প্রয়ােজন হয়ে দাড়িয়েছিল? ঐসব দফা ও সংশ্লিষ্ট প্রশ্নের জবাব সম্পর্কে আমরা এখনও অন্ধকারেই রয়ে গেছি। ভাষা আন্দোলনের গবেষক বদরুদ্দিন উমর কিংবা বশীর আল হেলাল এ বিষয়ে আমাদের কোন সাহায্যে আসেন নি।
সরকারকে চরমপত্র (তাও ৯৬ ঘণ্টার) দানের প্রয়ােজন ও যথার্থতার বিষয়ে আমাদের মতামত ইতঃপূর্বে উল্লেখ করেছি। এ সম্পর্কে দৈনিক ইনসাফ’ একটি বাস্তব মূল্যায়ন উপস্থিত করে এই বলে যে : ইতিপূর্বে ব্যবস্থা পরিষদে জনাব নুরুল আমীন ঘােষণা করিতে বাধ্য হইয়াছেন। যে, পাক গণপরিষদের আগামী অধিবেশনে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘােষণার প্রস্তাব করিবেন।… এক্ষণে এই ৯৬ ঘণ্টার চরমপত্র ঘােষণা করিয়া সংগ্রাম পরিষদ বালকসুলভ মস্তিকের পরিচয় দিয়াছেন মাত্র। আমাদের মত এই যে, কোন সরকারই এইরূপ চরমপত্রের নিকট মাথা নােয়াইবে। ।”১৭৮ সত্যি, হঠাৎ করে সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে অন্ধকার থেকে আলােতে (অর্থাৎ মেডিকেল হােস্টেলে) নেমে এসে এ ধরনের চরমপত্র দানের বিষয়টি যেমন বিশ্বয়কর, তেমনি এর উদ্দেশ্যও রহস্যজনক। তাদের এই তৎপরতা ২০ ফেব্রুয়ারি রাতের বৈঠকে তাদের গৃহীত সিদ্ধান্তের সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের হওয়া। সত্ত্বেও প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী ব্যক্তিদের এই হঠকারী অতি-বিপ্লবী সিন্ধান্ত পরবর্তীকালে অনেকেই সন্দেহের চোখে দেখেছেন। এমনকি কেউ কেউ এই তৎপরতাকে আন্দোলন বিনষ্ট করার চেষ্টা বলে মনে করেছেন, বিশেষ করে এই বৈঠকে উপস্থিত সংখ্যাগরিষ্ঠ ব্যক্তিদের নাম বিবেচনায়। যাই হােক, এ। সম্পর্কে শেষ কথা বলা সম্ভবত কারাের পক্ষেই আজ আর সম্ভব নয়। তবে প্রায়। সবাই এখন এ বিষয়ে, এমনকি কাজী গােলাম মাহবুবও একমত যে, এই চরমপত্রদানের তৎপরতা ছিল হঠকারী ও অপরিণামদর্শী পদক্ষেপ, সুচিন্তিত ও বিচক্ষণ রাজনীতির প্রকাশ নয়। এতসব আলােচনার পরও ২৫ ফেব্রুয়ারির সর্বদলীয় পরিষদের বৈঠক সম্পর্কে একটি রহস্য এখনও স্পষ্ট নয় যে, আন্দোলনের প্রকৃত পরিচালকদের উপেক্ষা করে হঠাৎ করে সর্বদলীয় পরিষদ ও সিভিল লিবার্টি কমিটি কেমন করে আন্দোলন সম্পর্কে এমন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হলেন এবং তা কেমন করে সংবাদপত্রেও প্রকাশিত হলাে? অস্থায়ী সর্বদলীয় পরিষদ তখন এ বিষয়ে কি কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন, নাকি নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছিলেন— এইসব প্রশ্নের জবাব না পাওয়া পর্যন্ত রহস্যটি পরিষ্কার হবে না; অলি আহাদ কি এ সম্পর্কে কিছুই জানেন না?
পঁচিশে ফেব্রুয়ারি সংগ্রাম পরিষদের ঘােষণায় হরতাল (তথা আন্দোলনও, কারণ আন্দোলন ততদিনে হরতাল ও মিছিলে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে) স্থগিত রাখার বিষয়ে স্টেটসম্যান পত্রিকা জানায়,১৭৯ ‘সাধারণ ধর্মঘট পরবর্তী চারদিনের জন্য তুলে নেয়া হয়েছে, অবশ্য শিক্ষায়তনে ধর্মঘট অব্যাহত থাকবে। রাত ১০টা থেকে ভাের ৫টা পর্যন্ত কারফিউ এখনও বলবৎ রয়েছে। কংগ্রেস সংসদীয় দলের প্রধান বসন্ত কুমার দাস আকস্মিকভাবে সংসদ অধিবেশন স্থগিত করার বিষয়টিকে আন্দোলনের পটভূমিতে সরকারপক্ষের ‘বিমূঢ় চিন্তার প্রতিফলন বলে সমালােচনা করেন। করাচির ইভনিং টাইমস’ পত্রিকার সম্পাদক জেড. এ. সুলেরী এ সময় ঢাকায়। এসে সাংবাদিক-রাজনীতিক অনেকের সাথেই দেখা করেন; এমনকি দুই একজন ছাত্রনেতার সঙ্গেও, যেজন্য সলিমুল্লাহ হলে ২৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশী অভিযানের সময় তাকে ভুলক্রমে গ্রেফতার করে পরে ছেড়ে দেয়া হয়। সরেজমিনে অবস্থা দেখার পর চিরাচরিত সুর পাল্টে জনাৰ সুলেরী ভাষা আন্দোলন এবং বাংলা রাষ্ট্রভাষার দাবির সমর্থনে এক বিবৃতি দেন, যে সম্পর্কে আগেই বলা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বাহান্নর ভাষা আন্দোলন মাত্র পাঁচদিনের তৎপরতায় প্রবল জনসমর্থনের বলে এমন এক স্তরে উন্নীত হয়েছিল যে শাসক, তাদের সহযােগী এবং মুখপাত্র অনেকেই ভাষার দাবির বাস্তবতা পরােক্ষে হলেও স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। আর এ কারণেই পশ্চিম পাকিস্তানের এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীসাংবাদিক বাংলা রাষ্ট্রভাষা দাবি সম্পর্কে তাদের মতামত পরিবর্তন করেছিলেন; তবু মুসলিম লীগের কায়েমি স্বার্থবাদী মহল নানা কৌশলে যতক্ষণ সম্ভব ভাষা দাবির বিরােধিতা করে এসেছে। আর আন্দোলনের ওপর চালিয়েছে চরম চগুনীতি। এ নীতির বাস্তবায়ন রুখতে ঢাকার গণআন্দোলনের সঙ্গে প্রদেশের সর্বত্র। সংঘটিত গণআন্দোলনের একাত্মতা গড়ে তােলা দরকার ছিল। ছিল সে সূত্রে সরকার বিরােধী শক্তির ব্যাপক গণমঞ্চ গঠন। কিন্তু ঢাকার ছাত্রযুব নেতৃত্বের তেমন কোনাে চিন্তা মাথায় ছিল না। তাই আন্দোলন দমন সরকারের পক্ষে প্রাথমিক পরাজয়ের পরও সম্ভব হয়েছিল।
সূত্র : ভাষা আন্দোলন-ইতিহাস ও তাৎপর্য – আবদুল মতিন, আহমদ রফিক