২৪ ফেব্রুয়ারি আন্দোলন অব্যাহত
ছুটির দিনেও জনতা রাজপথে চব্বিশে ফেব্রুয়ারি রবিবার। সরকারি ছুটির দিন। স্বভাবতই আন্দোলনের টানটান-শরীরে কিছুটা শিথিলতা লক্ষ্য করা যায়। তবু সেদিন ঢাকা শহরে পূর্ণ। হরতাল পালিত হয়। দেয়ালে দেয়ালে হাতেলেখা পােস্টার আর ইস্তাহারের। মাধ্যমে জানান দেয়া হচ্ছিল আন্দোলনের অস্তিত্ব এবং বহু প্রচারিত কর্মসূচি তথা লাগাতার হরতাল আর বিক্ষোভ মিছিলের কথা। মিছিলের সংখ্যা সেদিন অপেক্ষাকৃত কম, তাদের জঙ্গি তীব্রতাও ছিল কিছুটা কম, অর্থাৎ আন্দোলনে ভাটার টান শুরু হয়েছে। অবশ্য, পরদিন সােমবার হরতাল-মিছিলে আবার অনেকখানি ধার লক্ষ্য করা গেছে। এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন শহরের সাথে যােগাযােগ পুরােপুরি সম্ভব না হওয়া সত্ত্বেও আন্দোলন সেসব অঞ্চলে পূর্ণ গতিবেগ ও তীব্রতা নিয়ে অক্ষুন্ন ছিল। বাইশে ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের জোয়ার শুরু হওয়ার পর এবং তেইশে ফেব্রুয়ারি সেই তরঙ্গাঘাত অক্ষুন্ন থাকার পর গুণগত অর্থে তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক সাফল্য লক্ষিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সেই একই বক্তব্য, একই কর্মসূচির পুনরাবৃত্তি চলেছে। নতুন কোন বক্তব্য উপস্থাপন করা এবং আন্দোলনের সাথে সাধারণ মানুষের কিছু ব্যাপকভিত্তিক দাবি-দাওয়া এবং জাতীয় স্বার্থনির্ভর রাজনৈতিক স্লোগান যুক্ত করা যায় নি বলেই বােধহয় আন্দোলনের অভ্যন্তরীণ চালিকাশক্তি কমে আসে। নতুন কোনাে সম্ভাবনাময় দিগন্ত মানুষের সামনে তুলে ধরা হয় নি। এমনকি সরকারের চরিত্র বদল এবং ভাষা ও জাতিসত্তাভিত্তিক। সরকার গঠনের সম্ভাবনার কথাও কারাে মনে আসে নি বা মনে এলেও তা তুলে | ধরার পক্ষে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক সমঝােতা ছিল না। এই পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষ থেকে নানা ধরনের মিথ্যা প্রচারের মাত্রা এবং _ ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতা বৃদ্ধির সাথে সাথে পাল্টা আঘাত হানার প্রস্তুতি চলতে থাকে। সরকারি আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য ছিল বিরােধী রাজনৈতিক দল এবং নিজ দলের গণতন্ত্রমনা প্রতিবাদী চরিত্রের রাজনীতিকগণ। আন্দোলনের চরিত্র ও তাৎপর্য বুঝতে না পারার কারণে অথবা বুঝেশুনে অস্বীকার করার প্রয়োজনে এই সঙ্কীর্ণ বলয়ে তাদের নজর পড়ে। তাদের ধারণা হয়েছিল আন্দোলনের সবটাই প্ররােচনা-প্রসূত এবং কতিপয় রাজনীতিকের স্বার্থপরতার বিষয়। তাই প্রথম আঘাত ঐ দিকেই পড়ে। শহরের পরিস্থিতি সম্পর্কে ২৪ ফেব্রুয়ারি ‘আজাদ’-এর নিজস্ব সংবাদদাতার প্রতিবেদনে বলা হয় ; রবিবারে শহরে অবস্থার উন্নতি দুই স্থানে পুলিশের মৃদু লাঠি চার্জ সান্ধ্য আইনের মেয়াদ হ্রাস” গতকল্য ঢাকার অবস্থা অপেক্ষাকৃত শান্ত থাকে। তবে এছলামপুর রােড ও ঢাকা রেল স্টেশনের আর.এম.এস অফিসের নিকট এক জনতার ওপর পুলিশ মৃদু লাঠি চার্জ করে। ফলে একাধিক ব্যক্তি আহত হয় ।…
শহরে সান্ধ্য আইন কিছুটা শিথিল করিয়া রাত্রি ৮টার বদলে ১০টা হইতে ভাের ৫টা করা হয়। সর্বত্র পুলিশ ও সামরিক পাহারা পূর্ণমাত্রায় বজায় থাকে। শহরের বিভিন্নস্থানে কুকুর, গরু ও ছাগলের গায়ে সরকারের সমালােচনামূলক নানা প্রকার পােস্টার লাগাইয়া ছাড়িয়া দেওয়া হয় ।… এইদিন শহীদানের স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য অনেকে রােজা রাখেন। “গত চারি দিবস ঢাকা বেতার কেন্দ্রে পূর্ণ হরতাল পালন করা হয়। গতকল্য সকাল হইতে সলিমুল্লাহ হলে মাইকযােগে বক্তৃতা দেওয়া হয়। এই বক্তৃতায় উর্দুভাষী ছাত্ররাও অংশগ্রহণ করেন। বাইশ তারিখ মেডিকেল হােস্টেলের মাইক ছিনিয়ে নেয়ার পর সলিমুল্লাহ হলের সুদৃঢ় প্রধান ফটক বন্ধ থাকায় সেখানকার মাইকে প্রচার কাজ অব্যাহত থাকে। জনসাধারণ তাই সেখানেই রাস্তায় ভিড় জমাতে থাকেন। রবিবার শহরের বিভিন্ন স্থানে সরকারবিরােধী প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। পাশাপাশি দেশের অন্যত্র মন্ত্রিসভার পদত্যাগ, দোষী অফিসারদের অপসারণ, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে প্রতিবাদসভা ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজিকিউটিভ কাউন্সিল এক সভায় মিলিত হয়ে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভা করার দাবি, গুলিবর্ষণের নিন্দা, নিহতদের পরিবারবর্গের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং সরকারি তৎপরতা ও পুলিশী জুলুমের প্রতিবাদে ২৫ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। অধ্যাপকদের পৃথক বৈঠকে অনুরূপ প্রস্তাবের পাশাপাশি ঘটনার জন্য দায়ী অফিসারদের অপসারণ, ১৪৪ ধারা ও পুলিশ-সামরিক পাহারা প্রত্যাহার ইত্যাদি দাবি জানিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারিগণও এক সভায় অনুরূপ প্রস্তাব গ্রহণ করে প্রতিবাদী তৎপরতায় শরিক হন। সর্বস্তরের জনগণের তরফে মন্ত্রিসভা তথা লীগ শাসনের প্রতি অনাস্থার প্রকাশ সত্ত্বেও মুসলিম লীগ সরকার ক্ষমতা ছেড়ে দিতে রাজি ছিলেন না। কূটকৌশল ও দমননীতি এই দুই ভিন্ন হাতিয়ারের সাহায্যে তারা ক্ষমতা ধরে রাখতে চেয়েছেন। সরকার ও লীগ দলের চতুর কূটনীতি। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির তিনদিনব্যাপী বৈঠকের প্রথমদিনে গৃহীত প্রস্তাবে পুলিশের গুলিবর্ষণে মৃতদের উদ্দেশ্যে গভীর শােক প্রকাশ করে অপরাধীদের শাস্তি বিধান ও বিচার বিভাগীয় তদন্ত অনুষ্ঠানের দাবি এবং সেইসঙ্গে দেশে আইন-শৃঙ্খলা ও শান্তির জন্য নাগরিকদের প্রতি আবেদন জানানাে হয়। প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক মােহন মিয়া ব্যক্তিগতভাবে অনুরূপ বিবৃতি প্রচার করেন।
অন্যদিকে একই দিনে মুসলিম লীগ সংসদীয় দলের বৈঠকে দলীয় নেতা নুরুল আমিনের প্রতি পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপন করা হয়, আবার একই সঙ্গে গুলিতে নিহতদের জন্য শােক প্রকাশ, একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন এবং দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি বিধানের জন্য প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। কয়েকদিনের বিস্ফোরক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে শুধু কট্টর সমর্থকদের নিয়েই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এসব চতুর কূটনৈতিক চালের পেছনে ছিল মােহন মিয়ার ব্যক্তিগত উদ্যোগ; এমনকি ২৫ ফেব্রুয়ারি ব্যবস্থা পরিষদ স্থগিত ঘােষণাও ছিল তারই চতুর কূটনীতির অংশ বিশেষ। | এর ফলে কয়েকজন নিরপেক্ষ চিন্তার সদস্য ক্ষুব্ধ হয়ে প্রকাশ্য বিবৃতির মাধ্যমে নুরুল আমিনের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করেন, কেউ কেউ পদত্যাগ করেন। যেমন গাইবান্ধার পরিষদ সদস্য আহমদ হােসেন গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে লীগ সংসদীয় দল এবং প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন। অন্যদিকে নওগার মনিরুদ্দিন আখন্দ নুরুল আমিনের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে যে বিবৃতি প্রচার করেন তা ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন : অদ্য ২৪ ফেব্রুয়ারী সংবাদপত্রে দেখিতে পাইলাম যে গতকল্য মােছলেম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির এক সভায় জনাব নুরুল আমিনের প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করা হইয়াছে। আমি লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির সদস্য। এই সভা সম্বন্ধে আমি কিছুই অবগত নহি। গত বৃহস্পতিবার ছাত্রদের প্রতি পুলিশী জুলুমের প্রতিবাদে আমি পরিষদ কক্ষ ত্যাগ করি। গত বৃহস্পতিবার ও শুক্রবারে নুরুল আমিন সরকারের যে নীতির পরিচয় পাইয়াছি তাহাতে লীগ পার্টির নেতা জনাব নুরুল আমিনের প্রতি আমার আস্থা নাই । জনসাধারণের মনে ভ্রান্ত ধারণা জন্মিতে পারে বলিয়া এই বিবৃতি দিতেছি।”১৬৭ এই বিবৃতি থেকে মনে হয় নুরুল আমিনের প্রতি অনাস্থার প্রশ্ন ছাড়াও এবং বৃহস্পতিবার (একুশে ফেব্রুয়ারি) শুধু পরিচিত মুখ কয়েকজন সদস্য ছাড়াও জনাব আখন্দের মতাে আরাে কিছুসংখ্যক লীগ সদস্য হয়তাে সরকারের কার্যকলাপের প্রতিবাদে পরিষদ অধিবেশন বর্জন করেছিলেন যাদের নাম ও সঠিক সংখ্যা আমরা জানি না। এতে করে একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলন নুরুল আমিনের নেতৃত্বাধীন লীগ সরকার ও লীগ পার্টির জন্য কী গুরুতর সঙ্কট ও সমস্যা তৈরি করেছিল তার কিছুটা আভাস মেলে। চব্বিশে ফেব্রুয়ারি ‘আজাদ’-এ প্রকাশিত মােহন মিয়ার বিবৃতিতেও এই অবস্থার ইঙ্গিত মেলে যেখানে তিনি পুলিশী জুলুমের বিরুদ্ধে বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করে অবশেষে বলেন : বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য মােছলেম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টি যে সুপারেশ করিয়াছেন, আমি তাহার সহিত একমত ।… আমি জনসাধারণ ও ছাত্রদের নিকট এই আবেদন জানাইতেছি যে, তাহারা যেন শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা করেন এবং বিশেষত রাষ্ট্রের বর্তমান সঙ্কট মুহূর্তে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখেন। বর্তমান সময় অপেক্ষা ইতিপূর্বে আর কখনও আমাদের এত বেশী ঐক্য ও সংহতির প্রয়ােজন হয় নাই।’ এইসব বিবৃতি, প্রস্তাব, বক্তব্য থেকে লীগ সরকার ও লীগ পার্টির মধ্যেকার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও দুর্বলতা এবং তাদের গণবিচ্ছিন্নতার ইঙ্গিত স্পষ্ট, যার পরিণাম প্রতিফলিত দুই বছর পর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে।।
এতসব সত্ত্বেও ক্ষমতালােভীদের প্রাসাদ ষড়যন্ত্র একাধিক নায়ক-উপনায়কদের মাধ্যমে ঠিকই অব্যাহত ছিল। সেই সঙ্গে ছিল আমলাতন্ত্রী প্রশাসনের সুকৌশলী কার্যকলাপ । তারই পরিণতি ২৪ ফেব্রুয়ারি রাতে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের বেতার বক্তৃতা যেখানে তিনি শুধু সরকার ও পুলিশের কার্যক্রম সমর্থন করেছেন তাই নয়, সবকিছু অঘটনের দায় আন্দোলনকারীদের ওপর চাপিয়ে দেন। পঁচিশে ফেব্রুয়ারি ‘আজাদ-এ প্রকাশিত এই বেতার ভাষণে তিনি এমন অভিযােগও আনেন যে, ‘সরকারের নিকট যে প্রমাণাদি রহিয়াছে তদৃষ্টে বুঝা যাইতেছে, যে-পরিকল্পনা করা হইয়াছে বহির্দিক অপেক্ষা তাহার ভিতরে আরও গূঢ় অর্থ রহিয়াছে এবং পরিকল্পনাকারীরা পাকিস্তানের বাহির হইতে প্রেরণা পাইতেছেন। এই সমস্ত ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করিবার জন্য এবং দেশের নিরাপত্তার প্রতি বিশ্বাসঘাতকের ন্যায় যে হুমকি দেওয়া হইয়াছে তাহা দমন করিবার জন্য। যখন যে ব্যবস্থা অবলম্বন করার প্রয়ােজন সরকার এই ব্যবস্থাই অবলম্বন করিবেন।’ মুখ্যমন্ত্রীর বেতার-ভাষণের প্রতিবাদে সর্বদলীয় পরিষদ | উল্লিখিত উপসংহার ছাড়াও বেতার ভাষণে ভাষা আন্দোলন, তথাকথিত স্বার্থান্বেষীদের কার্যকলাপ, আইন-শৃঙ্খলা নষ্ট ইত্যাদি নানা বিষয়ে তিনি যে উদ্ভট মিথ্যা অভিযােগ এনেছিলেন সে সম্পর্কে পরদিন সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়কের নামে দেয়া প্রতিবাদ-বিবৃতি ২৬ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদ-এ প্রকাশিত হয়। এর কিছু উল্লেখযোগ্য অংশ : ‘প্রধানমন্ত্রী বেতার বক্তৃতায় ভাষা আন্দোলন সম্বন্ধে যে কটাক্ষ করিয়াছেন তাহার তীব্র নিন্দা করি। প্রধানমন্ত্রী বলিয়াছেন যে ভাষা বা অপর কোন সমস্যা সম্পর্কে শাসনতন্ত্র মােতাবেক জনমত প্রকাশ করা হইলে তাহার কণ্ঠরােধ করার ইচ্ছা সরকারের নাই । তার কার্যকলাপ এবং ঢাকার বুকে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক হত্যা এবং পুলিশ ও মিলিটারীর আচারণই প্রমাণ করিতেছে যে এই উক্তি সর্বৈব মিথ্যা। আন্দোলনকারীরা পাকিস্তানের বাহির হইতে প্রেরণা পাইতেছেন, এই উক্তি প্রমাণ করিবার জন্য আমরা তাহাকে চ্যালেঞ্জ করিতেছি। ‘প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিন তাহার বক্তৃতায় মিলিটারীর কাজের সমর্থনে যে সমস্ত উক্তি করিয়াছেন তাহা জনসাধারণের তীব্র ঘৃণারই উদ্রেক করে। দুইটি বিষয়ে আমরা জনসাধারণকে সতর্ক করিয়া দেওয়ার প্রয়ােজন অনুভব করিতেছি প্রথমত জনাব এ.কে. ফজলুল হককে পূর্ববঙ্গের প্রধানমন্ত্রীর গদীতে বসাইবার আহ্বান জানাইয়া প্রকাশিত ইশতেহারের সহিত সংগ্রাম পরিষদের কোন সম্পর্ক নাই। আমরা সুস্পষ্টভাবে ঘােষণা করিতেছি যে আমাদের আন্দোলন।
কোন ব্যক্তিবিশেষ বা দলকে কেন্দ্র করিয়া নহে, আমাদের আন্দোলন সৰ্ব্বদলীয় । দ্বিতীয়ত প্রাদেশিক লীগ ও বিভিন্ন লীগ নেতৃবৃন্দ এখন কুম্ভিরাশ্রু বর্ষণ করিয়া জনসাধারণকে বুঝাইতে চাহিতেছেন যে তাহারা ভাষা আন্দোলনের সমর্থক। জনগণ লীগের এই চালে বিভ্রান্ত হইবে না।’ জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টায় সরকার ও লীগ দল শুধু মুখ্যমন্ত্রীর বেতার-বক্তৃতাই নয়, প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সমাপ্তি দিনের বক্তব্য এবং সিদ্ধান্ত গুলিবর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তাদের প্রথমদিনের প্রকাশিত বক্তব্যের সম্পূর্ণ বিপরীত এবং তা মুখ্যমন্ত্রীর বক্তৃতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এখানে পাকিস্তানি শাসকদের চিরাচরিত প্রচার পদ্ধতির সাহায্য নিয়ে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টায় বলা হয়েছে যে, ভাষা আন্দোলনের ফলে পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিপন্ন। ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারি ‘আজাদ-এ প্রকাশিত মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বক্তব্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয় যে, আইন ও শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্য জনসাধারণকে প্রকাশ্যে প্ররােচিত করা হইতেছে এবং আতঙ্ক ও হিংসাত্মক কাজ অবাধে চলিতেছে। ‘গভীর উৎকণ্ঠার সহিত কমিটি আরও লক্ষ্য করিতেছেন যে, কমুনিষ্ট এবং বিদেশী দালালগণ প্রচুর উপকরণ লইয়া পূর্ববঙ্গে অনুপ্রবেশ করিতেছে এবং আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও অসন্তুষ্ট রাজনৈতিক সুবিধাবাদীদের সহযােগিতায় নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য আন্দোলনের মােড় ঘুরাইবার চেষ্টা করিতেছে। তাহারা ট্রেন লাইন তুলিয়া ফেলিয়া, তার ও টেলিফোন যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন। করিয়া, বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা বানচাল করিয়া এবং জনসাধারণকে মৃত্যু অথবা মারপিটের ভয় দেখাইয়া সরকারকে অচল করিয়া ফেলার জন্য। পরিকল্পনা করিতেছে। দেশে আইন ও শৃঙ্খলা ভঙ্গ করিয়া পাকিস্তানকে ধ্বংস করিতে তাহারা ধ্বংসাত্মক অভিযান শুরু করিয়াছে ব্যাখ্যার প্রয়ােজন করে না যে মােহন মিয়া-নুরুল আমিন গােষ্ঠী ক্ষমতাসীন থাকার প্রয়ােজনে কী অবলীলাক্রমে রাশি রাশি বানানাে তথ্য হাজির করে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছে এবং চিরাচরিত পাকিস্তান রক্ষার আওয়াজ তুলে ভাষা আন্দোলনের মােকাবিলা করতে চেয়েছে। শাসক দলের পায়ের নিচের মাটি সরে যেতে থাকলে তাদের বক্তব্যে এধরনের যুক্তিহীনতা ও মিথ্যার অনুপ্রবেশ ঘটে, কার্যকলাপে অসঙ্গত অনাচার দেখা দেয়। তাদের অসহায়তা ও দুর্বলতার লক্ষণ ঐ বক্তব্যের শেষ আবেদনেও পরিস্ফুট : “ওয়ার্কিং কমিটি মনে করেন যে, পাকিস্তানের ইতিহাসে ঐক্য ও সংহতির | প্রয়ােজনীয়তা এত অপরিহার্য আর কখনাে ছিল না।
এই পরিস্থিতির মােকাবিলায় শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য তারা জনসাধারণকে। নয়, ‘লীগ কর্মীদের নিকট আবেদন জানান। এদের বক্তব্য-বিবৃতির সবচেয়ে বিস্ময়কর দিক হচ্ছে, কার্যত এদের বিচারে সবকিছুর মূলে কমিউনিষ্ট ও বিদেশী দালাল যাদের লক্ষ্য ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তান ধ্বংস করা। তাই শক্ত হাতে তাদের দমন করাই পাকিস্তান রক্ষার একমাত্র উপায় । অদ্ভুত বিষয় হলাে—এসব মিথ্যা। প্রচারে কেউ কেউ বিভ্রান্ত হয়েছে। পরিস্থিতি তখন এমনই ছিল। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও সােহরাওয়ার্দি প্রসঙ্গত প্রবীণ রাজনীতিবিদ শহীদ সােহরাওয়ার্দির ভূমিকা উল্লেখ করা প্রয়ােজন। কারণ, তার বিতর্কমূলক বক্তব্য পুঁজি করে আজাদ যথেষ্ট পানি ঘােলা করেছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের হায়দরাবাদ থেকে সংবাদপত্রে পাঠানাে বিবৃতিতে জনাব সােহরাওয়ার্দি বলেন : ‘ঘটনা বর্তমানে ঘটিলেও বহুপূৰ্বেই ভাষা সম্পর্কে পূর্ববঙ্গে বিতর্ক দেখা। দিয়াছে। আমি সেই সময় বলিয়াছিলাম, যে আদর্শের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে তদনুসারে উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা । কিন্তু বাংলা পাকিস্তানের জনসাধারণের একটি বিরাট অংশের মাতৃভাষা। …বাংলার বুকে। উর্দুকে জোর করিয়া চাপাইয়া দেওয়া হইবে না, তবে বিদ্যালয়ে আবশ্যিক। দ্বিতীয় ভাষা রূপে ইহা পড়ান হইবে এবং যথাসময়ে এই প্ৰদেশৰাসীগণ এই ভাষার সহিত পরিচিত হইয়া উঠিলে পূর্বপাকিস্তানিরাও দুই ভাষাভাষী হইৰে। ইহাই সমস্যা সমাধানের বাস্তব উপায়।১৫৮
বলা বাহুল্য, সােহরাওয়ার্দির এই উক্তি পূর্ববঙ্গের সর্বত্র বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। আওয়ামী মুসলিম লীগকে এই বিবৃতি প্রচণ্ড অসুবিধায় ফেলে দিয়েছিল। সিলেট আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি নুরুর রহমান ঐ বিবৃতির তীব্র প্রতিবাদ করে বলেন : “উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে ওকালতি করিয়া জনাব সােহরাওয়ার্দী সাহেব যে বিভ্রান্তিকর বিবৃতি দিয়াছেন তাহা পাঠ করিয়া আমি বিস্মিত হইয়াছি ।…যে সময় পশ্চিম পাকিস্তান হইতেও আমাদের দাবির পক্ষে জোরালাে সমর্থন আসিতেছে তখন সােহরাওয়াদী সাহেবের এইরূপ উদ্দেশ্যমূলক দম্ভোক্তি শুধু অবাঞ্ছিতই নয়, উপরন্তু ঘৃণাহ।… আমরা স্পষ্টাক্ষরে ঘােষণা করিতেছি, এইরূপ জনস্বার্থবিরােধী বিবৃতি ঝাড়িবার জন্য সােহরাওয়ার্দী সাহেবকে জাগ্রত জনমতের নিকট অবশ্যই জবাবদিহি করিতে হইবে।”১৬৯ ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদ সােহরাওয়ার্দির বিবৃতির ওপর একটি আক্রমণাত্মক সম্পাদকীয় প্রকাশ করে এবং ঐ বিবৃতিকে ঘােলাপানিতে মাছ শিকারের সাথে তুলনা করে মন্তব্য করা হয় যে জনাব সােহরাওয়ার্দি ভাষা। বিতর্কটিকে তার রাজনৈতিক গরজে জিইয়ে রাখতে চান। আন্দোলন সংক্রান্ত পরস্পরবিরােধী শক্তি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন দেশের একাধিক রাজনৈতিক সংগঠন এবং ব্যক্তি বিশেষের মধ্যে কী বিভিন্নমুখী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল এইসব বিবৃতি ও ক্রিয়াকলাপ একটু গভীরভাবে বিবেচনা করে দেখলে বােঝা যায়। রাজনৈতিক দিক থেকে এসবের তাৎপর্য মােটেই কম ছিল না। রাজনৈতিক শক্তির পরস্পরবিরােধী এইসব দড়িদড়ার টান ভাষা আন্দোলনের গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থানের সম্ভাবনার ওপর যথেষ্ট বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করেছিল এবং এতে নানাভাবে বিপরীত স্রোতের টান শক্তিমান হয়ে ওঠে। অবশ্য এক্ষেত্রে আন্দোলনে বহুমুখী দুর্বল নেতৃত্বের সমস্যাও কম। গুরুত্বপূর্ণ ছিল না যে সম্পর্কে আমরা ইতঃপূর্বে আলােচনা করেছি। বলা বাহুল্য সরকার আন্দোলনের গুরুতর বিস্তার প্রতিরােধে এইসব দুর্বলতার সুযােগ। ভালােভাবেই নিয়েছিলেন। | সত্যি বলতে কি এ সময় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সংগঠিত ও কার্যকরী অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল, যে কথা আগে উল্লেখ করা হয়েছে।
পরিষদের প্রভাবশালী সদস্যগণ ইচ্ছামত বিভিন্ন দিকে ছিটকে পড়েছিলেন। তাদের বিক্ষিপ্ত আচরণের আরাে একটি উদাহরণ, মেডিকেল হােস্টেলে গঠিত সক্রিয় কমিটিকে শক্তিশালী করার পরিবর্তে বিচ্ছিন্নভাবে ‘সিভিল লিবার্টি কমিটি গঠন, যার প্রধান পৃষ্ঠপােষক ছিলেন এ.কে ফজলুল হক এবং আহ্বায়ক কামরুদ্দিন আহমদ। এতে আন্দোলন শক্তিমান হওয়ার বদলে বিভাজিত ও দুর্বল হয়ে পড়ে। এ সম্পর্কে ইত্তেফাক’- এর প্রতিবেদন : . অদ্য ঢাকার বিশিষ্ট নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের এক সভায়…দেশব্যাপী যে গণবিক্ষোভের সৃষ্টি হইয়াছে তাহা শৃঙ্খলা ও শান্তিপূর্ণভাবে পরিচালিত করিবার জন্য… ব্যক্তিস্বাধীনতা কমিটি’ নামে একটি যথাসম্ভব প্রতিনিধিত্বমূলক কমিটি গঠন করা হইয়াছে। উক্ত কমিটির হেড অফিস জনাব এ.কে. ফজলুল হকের বাসভবনে স্থাপিত হইয়াছে।’১৭০। কমিটির অন্তর্ভুক্ত উল্লেখযােগ্য ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন এ.কে. ফজলুল হক, মৌলানা ভাসানী, আবুল হাশিম, আতাউর রহমান খান, হামিদুল হক চৌধুরী, কামরুদ্দিন আহমদ, শামসুদ্দিন আহমদ, আলী আহম্মদ খান, আনােয়ারা খাতুন, মীর্জা গােলাম হাফিজ প্রমুখ পরিষদ সদস্য এবং রাজনীতিক। কমিটির সাংগঠনিক চরিত্র প্রসঙ্গত লক্ষ্য করার মত। ২৫ ফেব্রুয়ারি এই কমিটির আহ্বায়ক জনাব কামরুদ্দিন আহমদ এক বিবৃতিতে বলেন : ‘সিভিল লিবার্টি কমিটি’ জানিতে পারিয়াছেন যে, বিগত কয়েকদিনের অমানুষিক হত্যাকাণ্ডের জন্যে যাহারা দায়ী তাহারা নিজেদের গা বাঁচাইবার জন্য চর-অনুচরদিগকে দিয়া বাঙালী ও অবাঙালীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির প্রয়াস পাইতেছে। এমনি করে আন্দোলনের ওপর বিভিন্ন দিক থেকে নেতিবাচক প্রভাব বেড়ে উঠতে থাকে, যে বিষয়টি অনেকেই বিবেচনার মধ্যে আনেন না।
অলি আহাদ সঙ্গত কারণেই এই কমিটি সম্পর্কে তিক্ত মন্তব্য করেছেন। কারণ এই কমিটি মেডিকেল কলেজ হােস্টেলে অবস্থিত আন্দোলন পরিচালনাকারী পরিষদের সাথে কোন কার্যকরী যােগাযােগ স্থাপন করেনি। অথচ ‘গণবিক্ষোভ পরিচালনার জন্য এ কমিটির জন্ম (যদিও শান্তিপূর্ণভাবে পরিচালনার জন্য)। তাই তাদের উচিত ছিল সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে নতুন দিকনির্দেশনা নির্ধারণে সাহায্য করা এবং কর্মসূচি বাস্তবায়নে তৎপর হওয়া। চব্বিশে ফেব্রুয়ারির দুটো ঘটনা উল্লেখযােগ্য। প্রথমত, কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা। সংগ্রাম পরিষদ সােমবার ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরে হরতাল পালনের আহ্বান। জানায়। দ্বিতীয়ত, ২৫ ফেব্রুয়ারি ‘আজাদ’ পত্রিকার নিজস্ব সংবাদদাতা প্রেরিত এক অসমর্থিত সংবাদে বলা হয়েছে যে : | ‘ঘটনার দ্বিতীয় দিনে অর্থাৎ গত শুক্রবারে পুলিশের গুলিতে আহত এক ব্যক্তি গত শনিবারে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ইন্তেকাল করিয়াছেন।’ | আমরা জানি একুশে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে আহত আবদুস সালাম ৭ এপ্রিল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। সরকারি কর্মচারী আবদুস সালামের নিবাস ফেনির লক্ষণপুর গ্রাম। আমাদের মনে হয় সম্প্রতি জনাব রেজাউল করিমের স্মৃতিচারণে (প্রথম আলাে’ ২০.২.২০০৪) উল্লিখিত অচেনা। যুবকই হয়তাে আবদুস সালাম যার পায়ের গােড়ালিতে গুলি লেগেছিল। জনাব করিমের ভাষায় “তার গােড়ালির দিকে তাকালাম—এক রক্তাক্ত মাংসপিণ্ড, কিছু কিছু ভাঙ্গা সাদা হাড় বেরিয়ে রয়েছে। এক ভয়াবহ দৃশ্য।” পাঁচ নম্বর ব্যারাকের পাশে কলে পানি খেতে উদ্যত করিম সাহেবকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে যে তৃষ্ণার্ত যুবক পানি খেতে গিয়ে গােড়ালিতে গুলিবিদ্ধ হয় তারই আবদুস সালাম হওয়ার সম্ভাবনা সর্বাধিক। কিন্তু প্রশ্ন থাকে ‘আজাদ’-এ উল্লিখিত মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রয়াত ব্যক্তিটির পরিচয় নিয়ে। শুক্রবারে অর্থাৎ ২২ ফেব্রুয়ারি গুলিবিদ্ধ শফিউর রহমান ততা ঐ রাতেই মারা যান। কাজেই ‘আজাদ’ প্রতিবেদনের (২৫ ফেব্রুয়ারি) মৃত ব্যক্তি শফিউর রহমান নন। নিশ্চিতই তিনি অন্য কেউ যিনি শুক্রবারে গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন এবং শনিবারে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। অর্থাৎ আরাে একজন শহীদের পরিচয় আমাদের কাছে অজ্ঞাত থেকে গেল। এ শহীদ কি হতে পারেন কলতাবাজারের নান্না মিয়া কথিত তাঁতীবাজারের সিরাজুদ্দিন যিনি শুক্রবার নিশাত সিনেমার কাছে নবাবপুরের রাজপথে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন? আমরা জানি না। এসব কারণেই বাহান্নর ভাষা আন্দোলনে শহীদদের সঠিক তালিকার জন্য সরকারি সহযােগিতার প্রয়ােজন। কথাটা আমরা আগেও বলেছি।
সূত্র : ভাষা আন্দোলন-ইতিহাস ও তাৎপর্য – আবদুল মতিন, আহমদ রফিক