You dont have javascript enabled! Please enable it! বাইশে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ গণবিক্ষোভের দিন - সংগ্রামের নোটবুক

বাইশে ফেব্রুয়ারি   গণবিক্ষোভের দিন

জনচেতনায় একুশের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া ঢাকার ছাত্রযুবাদের সমর্থনে উত্তেজিত জনতার রাজপথে নেমে আসা বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। দেশব্যাপী হরতাল-মিছিল-বিক্ষোভের ডাক সফল করে তুলতে সেদিন সাংগঠনিক তৎপরতার বড় একটা প্রয়ােজন হয়। নি, সবকিছু ঘটেছে অনেকটা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই। শহর ঢাকা সেদিন নিজেকে মিছিলের শহররূপে তুলে ধরেছিল। একদিকে পথে পথে রক্তলাল পােস্টারফেস্টুনের মিছিল, প্রায় প্রতিটি চলমান মানুষের বুকে কিংবা বাহুতে কালাে ফিতার। প্রতীকী উপস্থিতি, অন্যদিকে অসংখ্য বাড়িতে উড়ছে কালাে পতাকা। লালকালােয় মিশে ঢাকা সেদিন এক ক্ষোভের শহর, প্রতিবাদের শহর। আর সেই সঙ্গে শোষকের শহরও বটে।  একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনায় (মূলত ছাত্র-অছাত্র হত্যায়) হঠাৎ করেই যেন ঢাকাই জনতার চেতনা দুন্দুভির আঘাতে বেজে উঠল। গােটা শহর জুড়ে অসংখ্য খণ্ড মিছিল ক্রমাগত রাজপথ-সৰুপথ অতিক্রম করছে। স্বেচ্ছাপ্রণােদিত ক্রমবর্ধমান জনতার ব্যাপক সমাবেশ, ক্রুদ্ধপদযাত্রা শুধু ছাত্রদের তুলনায় বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণেই নয়, তাদের চারিত্র প্রকাশের কারণেও গণ-জাগরণের প্রতিবাদী প্রতিফলন ঘটিয়েছে। ছাত্রদের অনমনীয় রাজনৈতিক বিশ্বাস সেদিন বােধহয় অণুঘটক (‘ক্যাটালিস্ট’)-এর কর্তব্য সম্পন্ন করে এতবড় অঘটন ঘটিয়েছিল।  রাজপথে জঙ্গি জনতার সেই মিছিলে ছাত্রদের পাশে শুধু স্থানীয় জনসাধারণই ছিলেন না, ছিলেন বিপুলসংখ্যক সরকারি কর্মচারী, যারা অফিস খালি করে দিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। স্বভাবতই টনক নড়েছিল সরকারের। শঙ্কিত হয়ে উঠেন মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন এবং তার প্রশাসনযন্ত্র। জনতার ঢেউ রুখতে একদিকে দাঁড় করানাে হলাে সশস্ত্র পুলিশ-ই.পি.আর-সেনাবাহিনীর সারি, অন্যদিকে শুরু হলাে।  সুচতুর প্রচার অভিযান—বিবৃতি, বিজ্ঞপ্তি ও ইস্তাহার মারফত। সরকার পক্ষের এই আয়ােজনে শহর ঢাকা যেন একটি সামরিক ছাউনিতে পরিণত। তৎকালীন পূর্ববঙ্গের প্রকৃত শাসক উর্দুভাষী আমলাতন্ত্র এবং তাদের তাবেদার সহযাত্রী বাঙালি সরকার গুলি চালনার পরিপ্রেক্ষিত বিচারে ভুল করেছিল। তাদের বিশ্বাস ছিল, ধর্মনির্ভর পাকিস্তানি আদর্শের কাঠামােয় বামপন্থী ও গণতন্ত্রী ছাত্রযুবা ও তাদের সহযােগীদের ভাষা বিষয়ক বিক্ষোভ-আন্দোলন গুলির মুখে স্তব্ধ করে দেয়া কঠিন হবে না। কিন্তু লীগ শাসনের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অনাচারের প্রতিক্রিয়া ভাষার দাবির সাথে মিশে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দিতে পারে, এমন হিসাব তাদের ছিল না। তাই ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুটা চমকিত হয়ে সশস্ত্র বাহিনীর সাহায্য নিতে হলাে, প্রয়ােজন হলাে কারফিউর। কিন্তু তা সত্ত্বেও জনচেতনায় একুশে ফেব্রুয়ারির পুলিশী জুলুমের প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভের প্রকাশ স্তব্ধ করে দেয়ার কাজটি মােটেই সহজ হয় নি।

গায়েবানা জানাজা ও মিছিল

বাইশে ফেব্রুয়ারির গণআন্দোলনের চরিত্রসম্পন্ন দিনটির সূচনা শহীদদের জন্য অনুষ্ঠিত জানাজার শােকার্ত পটভূমিতে হলেও সঙ্গে ছিল ক্ষুব্ধ প্রতিবাদী আবেগ। ছিল শহীদদের মৃতদেহের অনুপস্থিতিতেও মিছিলের অনমনীয় সঙ্কল্প। রাতে মুহূর্তের অসতর্কতায় মেডিকেল ছাত্রদের প্রহরার ফাকে পুলিশ-ই.পি.আর, লাশ তুলে নিয়ে আজিমপুর গােরস্তানে দাফনের ব্যবস্থা করে, যেজন্য পূর্ব-ঘােষিত শহীদদের জানাজা গায়েবি জানাজায় রূপান্তরিত হয়। এতে করে জনতার ক্ষোভে আরাে তপ্ত উপকরণের সংযােজন ঘটে। তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই যে গায়েবি জানাজায় ছাত্রের চেয়ে অছাত্রের সংখ্যাই ছিল বেশি। বেলা প্রায় দশটার দিকে মেডিকেল হােস্টেল প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত গায়েবি জানাজায় কয়েক হাজার লােক যােগ দিয়েছিলেন। এদের মধ্যে প্রধানত ছিলেন পলাশী ও নীলক্ষেত ব্যারাকে বসবাসকারী সেক্রেটারিয়েটের কর্মচারীবৃন্দ এবং বেশ কিছুসংখ্যক স্থানীয় জনসাধারণ। এই সঙ্গে যােগ দেন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ার্ডবয়, পুরুষ নার্স, পাশের হােটেল-রেস্তরার কর্মচারিগণ। হােস্টেল প্রাঙ্গণ জনসমাগমে স্পন্দিত হয়ে ওঠে। এই উপলক্ষে ২৩ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদ-এর প্রতিবেদন উল্লেখযােগ্য : গতকল্য (শুক্রবার) সকাল অনুমান দশ ঘটিকার সময় মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে গত পরশুর নিহত ছাত্রদের গায়েবানা জানাজা সমাপন করা হয়। এই অনুষ্ঠানে জনাব এ.কে ফজলুল হক উপস্থিত ছিলেন। অতঃপর সেখান হইতে প্রায় পাঁচ হাজার ছাত্র ও স্থানীয় জনসাধারণের একটি মিলিত শােভাযাত্রা। বাহির করা হয়।” উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্য থেকে একজন মওলৰী গােছের বয়স্ক ব্যক্তিকে  জানাজায় ইমামতির জন্য মনােনীত করা হয় এবং সেই অপরিচিত ব্যক্তিটিই মােনাজাত পাঠ করেন। জানাজায় উপস্থিতি এবং ইমামতি সম্পর্কেও সংশ্লিষ্ট লেখকগণ তাদের খেয়ালখুশিমত বক্তব্য রেখেছেন।

এমন কি সাপ্তাহিক সৈনিক’ও এইসব বক্তব্য আমরা এক এক করে বিবেচনায় আনবাে। জানাজায় উপস্থিত জনসংখ্যা অনেকেই খুব বড় করে দেখিয়েছেন, বিশেষ করে অলি আহাদ, মােহাম্মদ সুলতান, এম.আর. আখতার, গাজীউল হক প্রমুখ, সম্ভবত উৎস সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’। এ সম্পর্কে অলি আহাদ তার প্রাগুক্ত গ্রন্থে (পৃ. ১৬১-৬২) বলেন : ২২ ফেব্রুয়ারি সকাল আট ঘটিকায় মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাস প্রাংগণে শহীদদের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত গায়েবী জানাজায় লক্ষাধিক লােক যােগদান করেন ।…এ্যাডভােকেট ইমাদুল্লাহর সভাপতিত্বে জনসভা অনুষ্ঠিত হয় ।…পূর্বঘােষিত কর্মসূচি অনুযায়ী লক্ষাধিক জনতার জঙ্গী মিছিলসহ রাজপথে বাহির হইয়া পড়ি।’ একই বিষয়ে এম,আর, আখতার মুকুল ; ‘মেডিকেল কলেজ হােস্টেল প্রাঙ্গণে মওলানা ভাসানীর ইমামতিতে লক্ষাধিক লােকের গায়েবানা জানাজা।১৩৮ আর গাজীউল হক বলেছেন, ‘প্রায় লক্ষাধিক জনতা মেডিকেল কলেজ ব্যারাকে জমায়েত হলাে।১৩৯ অন্যদিকে মােহাম্মদ সুলতানের কলমে এই সংখ্যা বেড়ে দুই লাখ লােকে’ পৌছায়।১৪০ প্রকৃতপক্ষে বহুল প্রচারিত সাপ্তাহিক সৈনিক-এর প্রতিবেদনে বলা হয় :১৪১ ২২শে ফেব্রুয়ারীর ঐতিহাসিক মিছিল ইনি (মৌলানা ভাসানী-লেখকদ্বয়) | পরিচালনা করেন ও মেডিকেল কলেজের সম্মুখে তিন লক্ষ লােকের একটি। গায়েবী জানাজায় নেতৃত্ব করেন। মনে হয় সংশ্লিষ্ট সবারই ভুলের উৎস ‘সৈনিক’। কিন্তু এই ‘সৈনিক’-এরই ২৩ ফেব্রুয়ারি বিশেষ শহীদ সংখ্যায় গায়েবি জানাজা ও মিছিল সম্পর্কে বলা হয় : “সেক্রেটারিয়েটের কর্মচারিগণ শশাভাযাত্রা সহকারে বিক্ষোভ প্রদর্শন করিয়া ভাের নয়টায় মেডিকেল কলেজ হােস্টেলে সমবেত হন।… প্রায় ৩০ হাজার লােকের এক জনসভায় অবিলম্বে নুরুল আমিনের পদত্যাগ দাবি করিয়া প্রস্তাব। গ্রহণ করা হয় ।… “অতঃপর সমবেত জনতা শহীদ আত্মাদের উদ্দেশ্যে গায়েবী জানাজা পাঠ জানাজার শেষে প্রায় ২৫ হাজার লােকের এক শােভাযাত্রা বাহির হয়।’ এবার পাঠক বিমূঢ় হয়ে লক্ষ্য করবেন কেমন করে লক্ষ জনতা প্রথমে ৩০ হাজারে এবং কিছুক্ষণ পর ২৫ হাজারে পরিণত হয়। বদরুদ্দিন উমর অবশ্য এই ত্রিশ হাজারী সংখ্যাতেই স্থির হয়েছেন এই বলে যে :১৪৩  ‘মেডিকেল কলেজ হােস্টেল প্রাঙ্গণ পাশ্ববর্তী রাস্তা এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। হােস্টেল প্রাঙ্গণের কাছাকাছি পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষ জানাজায় শরীক হন।। …সেই সমাবেশে মােট উপস্থিতির সংখ্যা ছিল তিরিশ হাজারের মতাে।… জানাজায় অনুপস্থিত মুহম্মদ সুলতান এবং গাজীউল হক…ভাসানীর উপস্থিতি এবং তার দ্বারা জানাজা পরিচালনার কথা ভুলবশতঃ উল্লেখ করেছেন। “অনেকে সেদিনকার এই সংখ্যা এক লক্ষ, দুই লক্ষ হিসাবে উল্লেখ করলেও উপস্থিতি তিরিশ হাজারের মতােই ছিল। বহুলােক একত্রিত হয়েছিলেন তাই সংখ্যা নির্দেশ করতে গিয়ে এধরনের কথা বলা স্মৃতিচারণের ক্ষেত্রে খুবই স্বাভাবিক। এদিক থেকে তৎকালীন দৈনিক সংবাদপত্র রিপাের্টই নিঃসন্দেহে অনেক বেশী নির্ভরযােগ্য। নওবেলাল’-এ এই সংখ্যাকে পাঁচ হাজার বলে।

ভুলবশতঃ উল্লেখ করা হয়।’ কিন্তু তিনি নিজের হিসেবের বেলায় দৈনিক সংবাদপত্রের রিপাের্টের (যেমন দৈনিক আজাদ’) ওপর নির্ভর না করে সাপ্তাহিক সৈনিক’-এ প্রদত্ত সংখ্যার ওপরই নির্ভর করেছেন। বলে মনে হয়। ‘নওবেলাল’-এ উল্লিখিত জনসংখ্যা একই তারিখে আজাদ-এ উল্লিখিত সংখ্যার সমান। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, ভুল কার? একথা সত্য যে প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণ খুবই কঠিন। কিন্তু মেডিকেল কলেজ হস্টেল প্রাঙ্গণের আয়তন-পরিসীমা বিশটি শেডের উপস্থিতিসহ বিচার করে দেখলে স্বভাবতই মনে হয় এখানে লক্ষাধিক লােকের সমাবেশ একেবারেই অসম্ভব; এমনকি ব্যারাক সংলগ্ন উত্তর ও পশ্চিমের রাস্তার কথা বিবেচনা করলেও। লক্ষাধিক লােকের একটি সমাবেশের বিস্তার ও আয়তন সম্পর্কে সঠিক ধারণা ও হিসাব থাকলে এধরনের চিন্তা অসম্ভবই মনে হবে, এমনকি ঐটুকু স্থান-পরিসরে ত্রিশ হাজারও অতিরঞ্জিত সংখ্যা বলে মনে হয়। আমাদের অভিজ্ঞতায় জানাজায় উপস্থিতির সংখ্যা দশ থেকে বারাে হাজারের বেশি বলে মনে হয় না। প্রসঙ্গত সেকালে ঢাকা শহরের জনসংখ্যা এবং সভা-সমিতিতে উপস্থিতির আনুমানিক হিসেবও মনে রাখা উচিত।

আমরা জানি, এই জানাজায় শুরুতে ছাত্রসংখ্যা খুবই কম ছিল যেকথা উমর তার বইতে উল্লেখ করেছেন। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন : সকাল থেকেই সলিমুল্লাহ হল, ফজলুল হক হল, মেডিকেল কলেজ হােস্টেল থেকে ছাত্রেরা গায়েবি জানাজায় শরীক হওয়ার জন্য মাইকে সকলের প্রতি আহবান জানাতে থাকেন। তবু জানাজা অনুষ্ঠানের নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত ছাত্রসংখ্যা খুব অল্প থাকায় অনেকেই গায়েবী জানাজার সাফল্য সম্পর্কে আশঙ্কান্বিত হয়ে পড়েন। কিন্তু একটু পরই দেখা গেলাে যে, সেক্রেটারিয়েটের দিক থেকে একটি বড়ো মিছিল মেডিকেল হােস্টেলের দিকে এগিয়ে আসছে।… সেক্রেটারিয়েটের কর্মচারীরা ধর্মঘট করে সেইসঙ্গে গায়েবি জানাজায় অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তও করেন এবং মিছিল করে বাইরে আসেন। এই সেক্রেটারিয়েট কর্মচারীদের অনেকেই তখন ছিলেন আইনের ছাত্র ধর্মঘট ও   মিছিল সংগঠিত করার ক্ষেত্রে তারা এক উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেন।১৪ এখন ভেবে দেখা দরকার, আইনের ছাত্র এই কর্মচারীদের সংখ্যা কতইবা হতে পারে? উপরের বক্তব্যটি খুঁটিয়ে বিচার করে দেখলে উমর-কথিত জনসংখ্যাও স্ফীতকায় বলেই মনে হবে। আসলে শুরুতে অর্থাৎ জানাজায় উপস্থিত লােকসংখ্যা ততটা বেশি না হলেও মিছিল বের হওয়ার সাথে সাথে সেই সংখ্যা পথে পথে ক্রমশ বাড়তে থাকে। তবু জানাজা এবং মিছিলের শুরুতে জনসংখ্যা দশ হাজারের বেশি নয় বলে উপস্থিত মেডিকেল ছাত্রকর্মীদের বিশ্বাস।১৮৫ আবার তাদেরই কারাে কারাে মতে এ সংখ্যা ৫ থেকে ১০ হাজারের মধ্যে। দ্বিতীয়ত, জানাজায় সৈনিক কথিত মৌলানা ভাসানীর উপস্থিতি বা ইমামতি এবং জানাজা-শেষে মিছিলে তার নেতৃত্বদানের ঘটনাও সঠিক নয়; কারণ তিনি তখনও ঢাকায় এসে পৌঁছাননি। যাই হােক, জানাজা শেষে উপস্থিত ছাত্র-জনতার মিছিল মেডিকেল হােস্টেলের কাঠ-কাঁটাতারের নড়বড়ে গেট পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠের পাশ দিয়ে কার্জন হল হাইকোর্টের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।

এই দিনের স্লোগানে বিশেষভাবে শােনা যায় নতুন একটি অনুভবের উৎসারণ : শহীদ স্মৃতি অমর হােক’। | এমনকি এরপর থেকে প্রতিদিনই মিছিলে-সভায় এই ধ্বনি উচ্চারিত হয়েছে, সেই সঙ্গে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘খুনী নুরুল আমিনের বিচার চাই’ ইত্যাদি। ধ্বনি। কিন্তু অলি আহাদ যে বলেছেন, ‘নারায়ে তকবীর আল্লা-হু আকবর ধ্বনি দিতে দিতে মিছিল হাইকোর্ট-কার্জন হল অতিক্রম করে, তা আদৌ সঠিক নয়। বাহান্নের ভাষা আন্দোলনের কোন মিছিলেই, এমনকি এরপর শহীদ দিবস। পালনের কোন মিছিলে এই ধ্বনি উচ্চারিত হতে শােনা যায় নি। এর কারণ, এই স্লোগান মুসলিম লীগ রাজনীতির ধ্বনি হিসেবেই পরিচিত ছিল। হয়তাে তাই লীগ। শাসন-বিরােধী জঙ্গি মিছিলে এই স্লোগান উচ্চারণের কোন প্রশ্নই ছিল না। অহেতুক প্রশ্নটি এনেছেন অলি আহাদ (সম্ভবত তার পরবর্তী রাজনীতির সুবাদে); এনেছেন বদরুদ্দিন উমরও, কিন্তু কি সুবাদে তা ঠিক বােঝা গেল না। অথচ মুসলিম লীগ রাজনীতির ধারক দৈনিক আজাদ-এর প্রতিবেদনে কোথাও এই “স্লোগানের উল্লেখ নেই। মিছিলে এই ধ্বনি উচ্চারিত হলে আজাদ-প্রতিবেদনে তা নিশ্চিতই প্রকাশ পাওয়ার কথা; বিশেষ করে ‘আজাদ’ যেখানে অন্যান্য ধ্বনির উল্লেখ করেছে। | যাই হােক, মিছিলের গতিপথ সম্পর্কে ‘আজাদ’-এর প্রতিবেদন মােটামুটি হিসেবে সঠিক ও প্রতিনিধি-স্থানীয় বলে মনে হয়। ‘আজাদ-এর বিবরণে প্রকাশ : “ছাত্র ও নাগরিকদের এই শােভাযাত্রাটি ক্রমশ কার্জন হলের পার্শ্ববর্তী রাস্তা ধরিয়া অগ্রসর হইতে থাকে। এই সময় শােভাযাত্রাকারীদের মধ্যে কোনরূপ উজ্জ্বলতা দেখা যায় নাই। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে এবং পুলিশের  গুলিবর্ষণের বিরুদ্ধে নানারূপ ধ্বনি করিতে করিতে শােভাযাত্রাকারীগণ হাইকোর্টের সম্মুখে উপস্থিত হইলে সেখানকার প্রহরারত সৈন্যবাহিনী তাহাদিগকে বাধা প্রদান করে। “এই শােভাযাত্রার সহিত বহু সরকারী কর্মচারীকে অংশগ্রহণ করিতে দেখা যায়। হাইকোর্টের নিকট পুলিশ ও সামরিক বাহিনী শােভাযাত্রার ওপর লাঠি ও গুলী চালায় এবং তাড়া করিয়া হাইকোর্টের ভিতর লইয়া যায়। এখানে কয়েকজন গুরুতরভাবে আঘাত পান। ইহা সত্ত্বেও শােভাযাত্রাটি শান্তিপূর্ণভাবে নওয়াবপুরের দিকে যাইবার চেষ্টা করে এবং শশাভাযাত্রাটির সম্মুখভাগ ফজলুল হক হলের পার্শ্ববর্তী রাস্তা ধরিয়া বেশ কিছুটা অগ্রসর হয়। এই সময়ে পুলিশ বাহিনী দৃঢ়তার সহিত বাধা প্রদান করে।।

“শােভাযাত্রাটির সম্মুখভাগে নিহত ও আহতদের রক্তমাখা জামাকাপড় ইত্যাদি দেখানাে হইতেছিল। “গতকল্যকার ঘটনার বিশেষত্ব হইল এই যে, সৈন্যগণকে অনেক ক্ষেত্রে সঙ্গীনের খোচায় বিক্ষোভকারিগণকে ঘায়েল করিতেও দেখা যায়। পরিষদ ভবনের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে সৈন্যগণকে দুইটি মেশিনগান পাতিয়া বসিয়া থাকিতে এবং অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্র লইয়া ঘােরাফেরা করিতে দেখা যায়। একদল সৈন্যকে একটি মেশিনগান, কতকগুলি করিয়া টমিগান, ব্রেনগান ও বেয়নেটসহ রাইফেল লইয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সম্মুখে টহল দিতে দেখা যায় । ‘শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের নিদর্শনস্বরূপ শহরের প্রতিটি ছাত্রাবাসে এমন কি কোনাে কোনাে গৃহেও পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয় এবং শহরবাসী কালাে ব্যাজ পরিধান করেন ।১৪৬ মিছিল পথে পথে ২২ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার। একুশের ঘটনাবলীর জনপ্রতিক্রিয়ার একটি দিক যেমন লক্ষ্য করার মতাে, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ যে কন্ট্রোল রুম থেকে মাইকে প্রচার এবং কয়েকটি ইস্তাহার বিলি ছাড়া আর কোনাে ব্যাপক সাংগঠনিক তৎপরতা নবগঠিত পরিষদ বা অন্যদের পক্ষে সম্ভব হয় নি। জগন্নাথ কলেজ, ঢাকা কলেজ মেস, নবকুমার ইনস্টিটিউশন এমনি কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বাদে ব্যাপক যােগাযােগও এত অল্প সময়ে সম্ভব ছিল না, ছিল না বিশেষ করে নেতৃত্বের অসংবদ্ধ অবস্থা এবং দুর্বলতার কারণে। তবু দেখা গেল প্রতিক্রিয়ার ব্যাপক বিস্তার; অনেকটা সেই শুকনাে খড়ের গাদায় ফুলিঙ্গপাতের মতাে ঘটনা। সকাল থেকেই লােজন, সরকারি-বেসরকারি কর্মচারী রাস্তায় নেমে আসেন। অর্থাৎ শুক্রবারের ব্যাপক। গণ-উপপ্লবের চরিত্রে স্বতঃস্ফূর্ততাই ছিল প্রধান বৈশিষ্ট্য। ঢাকার রাস্তাগুলােতে জনসমাগম সকাল থেকেই ক্রমশ বাড়তে থাকে। 

নওয়াবপুর রােডে ক্রমবর্ধমান জনতার জঙ্গি উপস্থিতি ছিল বিশেষভাবে লক্ষ্য করার মতাে। আজাদের বিবরণ মতে এই রাস্তায় সামরিক বাহিনীর অবস্থানও ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। এ সম্পর্কে আজাদ’ সুন্দর একটি ছবি এঁকেছে ; ১৪৬ “তাহারা (সামরিক বাহিনীর সশস্ত্র জওয়ান—লেখকদ্বয়) অস্ত্রশস্ত্রসহ পায়ে হাঁটিয়া এবং ট্রাকে করিয়া রাস্তায় টহল দিতে থাকে। রথখােলার মােড়ে এক ট্রাক সশস্ত্র রক্ষীকে মােতায়েন করা হয়। এদিকে নওয়াপুরের জনতা ছােট ছােট শশাভাযাত্রা করিয়া রক্তের বদলে রক্ত চাই’, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান দিয়া উত্তরদিকে অগ্রসর হইতে থাকে। তাহারা কাপ্তান বাজারের মােড়ে পৌছিলে ঐ স্থানে অপেক্ষারত সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী তাহাদের লক্ষ্য করিয়া গুলি ছোঁড়ে। ঐ গুলীবর্ষণের ফলে কেউ হতাহত হয় নাই। নওয়াবপুর রাস্তার উভয় দিকের সমস্ত দোকান সম্পূর্ণরূপে বন্ধ থাকে। … বেলা প্রায় ১২টার সময় রথখােলা ও নিশাত সিনেমা হলের মােড়ের মধ্যবর্তী স্থানে একটি চলতি সামরিক ট্রাক হইতে অপেক্ষমাণ নিরীহ পথচারীদের ওপর বেপরােয়াভাবে গুলী চালান হয় বলিয়া জানা গিয়াছে। ফলে একজন যুবক ঘটনাস্থলেই নিহত এবং দুইজন আহত হয়। আহতদের মধ্যে একটি বালককে বেয়নেট দ্বারা মাথায় আঘাত করা হয়। বলিয়া জানা গিয়াছে। আরও প্রকাশ, সামরিক ট্রাকে করিয়া তাহাদের লইয়া যাওয়া হয়। সকালের দিকে নওয়াবপুরের বিভিন্নস্থানে সামরিক লােকজন বিক্ষিপ্তভাবে গুলি চালায় । ‘গতকল্য (অর্থাৎ শুক্রবার—লেখকদ্বয়) সমগ্র ঢাকা শহরে উত্তেজনাময়। পরিস্থিতি বিরাজ করিতে থাকে। সারা শহরটি আপাতদৃষ্টিতে একটি সামরিক ছাউনি বলিয়া প্রতীয়মান হইতে থাকে। বিভিন্নস্থানে ছাত্র ও জনসাধারণের শােভাযাত্রার ওপর পুলিশ ও সৈন্যবাহিনী বারংবার লাঠিচার্জ ও গুলিবর্ষণ করে। সকাল হইতেই মৃত, আহত ও মুমূর্ষ ব্যক্তিগণকে লইয়া এম্বুলেন্স গাড়িগুলি মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে আসিতে থাকে। কয়েকটি স্থান হইতে মৃত ও গুরুতররূপে আহত কয়েকজনকে পুলিশ ভ্যানে তুলিয়া লইতে দেখা যায় বলিয়া প্রত্যক্ষদর্শীর নিকট হইতে জানা গিয়াছে। এইদিন সমগ্র শহরে সমস্ত দোকানপাট, বাজারঘাট সম্পূর্ণভাবে বন্ধ থাকে। অফিস-আদালত এমন কি সেক্রেটারিয়েটের কর্মচারিগণও স্বতঃস্ফুর্তভাবে কর্মে যােগদান হইতে বিরত থাকে এবং বিভিন্নস্থানে শােভাযাত্রা ও বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করে।’ 

এই বিবরণে যে ছবি পাওয়া যায় তার সাথে আমাদের অভিজ্ঞতার যথেষ্ট মিল রয়েছে। মনে রাখা উচিত যে, প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সভাপতির পত্রিকা এবং আধা-সরকারি পত্রিকা আজাদ-এর পক্ষে ঘটনার ওপর রঙ চড়িয়ে বিষয়টিকে অতিরঞ্জিত না করারই কথা। স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে জনতার বিপুল সংখ্যায় মিছিলে   বিক্ষোভে অংশগ্রহণের বিষয়টি এতে স্পষ্ট। পরিস্থিতির একটি সার্বিক ছবি এখানে পাওয়া যায়; স্বাভাবিক নিয়মেই বিস্তারিত ঘটনার কিছু বিবরণ বাদ পড়েছে, যেমন শফিউর রহমানের গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা এবং এমনি আরাে দুই একক্ষেত্রে গুলিবর্ষণের ঘটনা, যা আমরা পরে অন্যসূত্রে পরিবেশন করেছি। মেডিকেল হােস্টেল থেকে বেরিয়ে-আসা মিছিলের একাংশ সম্বন্ধে একই তারিখের আজাদএর বিবরণ নিম্নরূপ :ছত্রভঙ্গ ছাত্রগণ পুনরায় নাজিমুদ্দিন রােডে সমবেত হইয়া শােভাযাত্রা সহকারে চকবাজার, মিটফোর্ড, এসলামপুর হইয়া সদরঘাটে জগন্নাথ কলেজের নিকট পৌছিলে পুলিশ শােভাযাত্রার ওপর পর পর তিনবার লাঠিচার্জ করে। চকবাজার এলাকা দিয়া যাইবার সময় স্থানীয় দোকানদার ও জনসাধারণ দলে দলে যােগদান করায় শােভাযাত্রার কলেবর বহুগুণে বৃদ্ধি পায় (এখানেও জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্তভাবে মিছিলে যােগদানের বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয় লেখকদ্বয়)। “বেলা দুইটার দিকে একটি বিরাট শশাভাযাত্রা লালবাগের দিক হইতে ‘আজাদ” অফিসের সম্মুখ দিয়া মােছলেম হলের দিকে যাইবার সময় শােভাযাত্রাটির কিছুসংখ্যক লােক আজাদ অফিসের কর্মচারীদের ওপর প্রস্তর নিক্ষেপ করিয়া। শাসাইতে থাকে। ‘আজাদ’ কর্তৃপক্ষ ও কর্মচারিগণ কর্তৃক ছাত্রদের দাবি সম্পর্কে যথাসাধ্য চেষ্টা করা হইতেছে বলিয়া আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও প্রস্তর। নিক্ষেপকারিগণ বিক্ষোভ করিতে থাকে। অতঃপর শােভাযাত্রার কতিপয় ছাত্রীর হস্তক্ষেপের ফলে বিক্ষোভকারিগণ ক্ষান্ত হইয়া সম্মুখে অগ্রসর হয়। পলাশী লেভেল ক্রসিং-এর নিকট পৌছাইলে পুলিশ তাহাদের ওপর লাঠিচার্জ করে।” দেখা যাচ্ছে, বাইশে ফেব্রুয়ারি সারা ঢাকা শহরে বিভিন্ন দিক থেকে মিছিল বেরিয়ে আসে এবং পথ চলার সাথে সাথে মিছিলের আয়তনও বেড়েছে। এমনি এক মিছিলের বিবরণ দিয়েছেন কলতাবাজার মহল্লার জনৈক সেরাজুদ্দিন ওরফে নান্না।১০৭ তরুণ সেরাজুদ্দিন বাবুবাজার থেকে চলমান মিছিলে অংশ নিয়ে সদরঘাট পৌছান। একটু এগিয়ে জনসন রােডে মর্নিং নিউজ’-এর ছাপাখানার কাছাকাছি জমায়েত লােকজনকে দেখতে দেখতে এগিয়ে যান। তকালীন ভিক্টোরিয়া পার্ক (বাহাদুর শাহ পার্ক) পেরিয়ে পরিপুষ্ট চেহারা মিছিলের সাথে এগিয়ে যেতে যেতে দেখেন, রথখোেলার সামনে দাঁড়ানাে সেনাবাহিনীর ট্রাক। ওদের চকচকে আগ্নেয়াস্ত্রগুলাের দিকে একনজর তাকিয়ে নির্ভয়ে মিছিল এগিয়ে। যায় স্লোগানে স্লোগানে রাজপথ মুখরিত করে।

তিন চারজনের সারির বলিষ্ঠ মিছিল এগিয়ে চলে। দূরে দেখা যায় উত্তরদিক থেকে ছুটে আসা সৈন্য বােঝাই একটি ট্রাক চৌধুরী সাইকেল মার্ট’ বরাবর এসে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে। এদিকে মানসী’ সিনেমার গলি থেকে পুলিশ ও সৈন্যদের  একটি অংশ দ্রুত হেঁটে গলির মুখে এসে দাঁড়ায়। আর তখনি এগিয়ে আসা ট্রাক থেকে গুলি ছুটে আসে। মিছিলের কয়েকজন পড়ে যায়। তার মধ্যে একটি তরুণ তার ঠিক পাশেই আহত হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে, ঠিক কোমরের উপর গুলি লেগেছে। শাদা সার্ট, প্যান্ট পরা সেই আহত ছেলেটি ছিল তাঁতিবাজারের (বাসাবাড়ি লেন), নাম সিরাজুদ্দিন। ছেলেটিকে কয়েকজন মিলে ধরাধরি করে নিয়ে যায়। | এর খানিক আগেই ‘স্টুডিয়াে-এইচ’-এর সামনে গুলি চলেছে, একজন মারা যায় সেখানে। রাস্তায় দাঁড়ানাে লাইটপােস্টে গুলির ক্ষতচিহ্ন বহুদিন ছিল। নওয়াবপুর দিয়ে পরে যাওয়া-আসার পথে বুলেটের সেই চিহ্ন তাকে বহুদিন বাইশে ফেব্রুয়ারির কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। কয়েকবার গুলি ও পুলিশের লাঠিচার্জের ফলে ছত্রভঙ্গ মিছিলের একাংশের সাথে সেরাজুদ্দিন ‘মানসী’র গলিপথ ধরে বংশালের দিকে এগিয়ে যায়। দেখতে পায়, ‘সংবাদ পত্রিকা অফিস পুলিশ পাহারা দিচ্ছে।  এই মিছিল শেষ পর্যন্ত সাতরওজা, জেল গেট হয়ে উর্দু রােড ধরে ‘আজাদ অফিস পাশে রেখে পলাশী ব্যারাক হয়ে সলিমুল্লাহ হলের সামনে এসে দাঁড়ায়। পথে কিছু ছেলে ‘আজাদ’ অফিসে হামলা চালাতে চেষ্টা করে, কিন্তু অন্যদের তৎপরতায় পেরে উঠে না। সেরাজুদ্দিন সলিমুল্লাহ হলের সামনের রাস্তায় উপস্থিত জনতার সাথে তাদের মিছিলে মিশে যায়। পরিষদ ভবনের সামনে এগিয়ে আসার সাথে সাথে পুলিশ বেপরােয়া লাঠিচার্জ করে; স্লোগানের মুখে মিছিল এদিক-ওদিক ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ১৪৭ মনে হয় তেইশে ফেব্রুয়ারি ‘আজাদ’ এই মিছিলেরই বিবরণ দিয়েছে নিম্নোক্ত ভাষায় : মুসলিম হল হইতে এক বিরাট জনতা পরিষদ ভবনের দিকে নানা প্রকার ধ্বনি সহকারে শান্তিপূর্ণভাবে অগ্রসর হয় । তাহারা পরিষদ ভবনের নিকটবর্তী হইলে পুলিশ তীব্রভাবে তাহাদের ওপর লাঠিচার্জ করে। তাহারা তখন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ সীমানার মধ্যে প্রবেশ করে এবং তথা হইতে নুরুল আমিন মন্ত্রিসভার । বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করিতে থাকে। ‘মর্নিং নিউজ’ ছাপাখানা ‘জুবিলি প্রেস’ ভস্মীভূত এদিনের উল্লেখযােগ্য ঘটনা মর্নিং নিউজ’-এর ছাপাখানা “জুবিলি প্রেসে’র ওপর ছাত্র-জনতার হামলা। এ সম্পর্কে তেইশের দৈনিক আজাদ-এ বলা হয় ।

গতকল্য জনসন রােডস্থ জুবিলি প্রেসে অগ্নিসংযােগ করার দরুন উহা সম্পূর্ণ ভগীভূত হইয়া যায় ।… উক্ত প্রেস হইতে ‘মর্নিং নিউজ’ বাহির হইত।’ একই বিষয়ে সাপ্তাহিক সৈনিক’-এর বিবরণ নিম্নরূপ : ‘গতকল্যকার বিকৃত সংবাদ পরিবেশনের জন্য ঢাকার ইংরেজি দৈনিক মর্নিং নিউজ’ অফিস ও মর্নিং নিউজ’-এর ভ্যানে অগ্নিসংযােগ করা হয়। প্রকাশ, ফায়ার   সার্ভিস ব্রিগেড দুইবার আসিয়া জনতা কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হইয়া চলিয়া যায়। ঘটনা যাদের জানা তাদের পক্ষে তাে বটেই অন্য পাঠকদের পক্ষেও এ ধরনের ভিত্তিহীন সংবাদ পরিবেশনের কারণে সাপ্তাহিক সৈনিক’-এর ওপর নির্ভর করা মুশকিল হয়ে ওঠে। বাইশে ফেব্রুয়ারি হতাহতের সংখ্যা আমরা দেখেছি, একুশে ফেব্রুয়ারি সীমাবদ্ধ বৃত্তে গুলি চালনা সত্ত্বেও কমপক্ষে চারজন শহীদ হয়েছিলেন, এছাড়া অন্যদের সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যাচ্ছে । কিন্তু বাইশে ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতার ব্যাপক গণবিক্ষোভের মুখে টহলরত পুলিশ-ই.পি.আর ও সেনাবাহিনী একাধিক স্থানে গুলি চালনার ফলে ঠিক কতজন নিহত হয়েছেন তা বলা কঠিন। বিশেষ করে পুলিশ বা সেনাবাহিনীকে যেখানে সুযােগমত লাশ তুলে নিয়ে যেতে দেখা গেছে, সেক্ষেত্রে শহীদের সঠিক সংখ্যা কোনদিনই বলা সম্ভব হবে না। এবং এই তথ্য চিরকাল জনসাধারণের কাছে অজানা থেকে যাবে যদি সরকার কর্তৃক সংরক্ষিত গােপন তথ্যাদি জনসাধারণের অবগতির জন্য প্রকাশ করা না হয়। সাধারণত নির্দিষ্ট সময় পর এধরনের তথ্য জনস্বার্থে এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবােধ সংরক্ষণের দায়ে প্রকাশ করা হয়। আমাদের দেশে পাকিস্তানি শাসনের পর আশা করা গিয়েছিল সরকার বাহান্নর ভাষা আন্দোলন এবং অনুরূপ আন্দোলনের তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করবেন, কিংবা অন্ততপক্ষে গবেষকদের জন্য তা দেখার সুযােগ করে দেবেন, কিন্তু ভাষা আন্দোলনের পরােক্ষ ফসল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও এই গণতান্ত্রিক কাজটি সম্পন্ন হয় নি। এমনকি আমরা গত কয়েক বছর চেষ্টা করেও এ বিষয়ে। এতটুকু এগােতে পারিনি। অথচ ভাষা আন্দোলনের পঞ্চাশ বছর পর আজও এইসব তথ্য যেমন গােপন রয়ে গেছে তেমনি আজ পর্যন্ত এগুলাে সাধারণ্যে প্রকাশের জন্য সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গন থেকে কোন প্রকার দাবিও তােলা হয় নি। আমরা মনে করি, সরকার ইতিহাসের স্বার্থে এবং জনগণের ভাষা আন্দোলন সংক্রান্ত সঠিক তথ্য জানার অধিকারের পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট তথ্যাবলী প্রকাশ করবেন এবং গবেষকদের জন্য তা পরীক্ষা করে দেখার সুযােগ সৃষ্টি করবেন। বাইশে ফেব্রুয়ারি পুলিশ-সেনাবাহিনির গুলিতে হতাহতের সংখ্যা যে একুশে ফেব্রুয়ারির তুলনায় বেশি হবে সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ সম্পর্কে ‘আজাদ’-এর ভাষ্য নিম্নরূপ (২৩-২-৫২)।

বৃহস্পতিবারের শােচনীয় ও ভয়াবহ ঘটনা বিস্মৃত হইতে না হইতে গতকাল (শুক্রবার) জুমার দিন আর একবার ঢাকার মাটি শিশু ও ছাত্রদের রক্তে লাল হইয়া ওঠে। সেদিনকার ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা আপনার্থে। শান্তিপূর্ণ মিছিল বাহির করিয়া পুলিশ ও সৈন্যদের গুলির আঘাতে নাগরিকদের ৪ জনকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয় এবং শতাধিক আহত ব্যক্তি হাসপাতালে  নীত হয়। ইহাদের মধ্যে ৪৫ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাদের ১৫ | জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলিয়া জানা গিয়াছে। এ সম্পর্কে সাপ্তাহিক সৈনিক’-এর তেইশে ফেব্রুয়ারি বিশেষ শহীদ-সংখ্যায় বলা হয় : গতকল্য বেলা ১১টার সময় প্রায় ৩০ হাজার জনতার মিছিল কার্জন হলের পূর্বদিকে পৌছাইলে পুলিশ কাঁদুনে গ্যাস ও লাঠির সাহায্যে বাধা দেয়। জনতাকে সংযত করিতে না পারিয়া তাহারা বেপরােয়া গুলি খুঁড়িতে থাকে। ইতিমধ্যে প্রাপ্ত সংবাদে প্রকাশ, ইহাতে ৮ জন নিহত ও অসংখ্য আহত হইয়াছে। অনেকের অবস্থাই আশঙ্কাজনক ।… গতকল্য নবাবপুরে ৪জন, কার্জন হলে ২জন এবং রেলওয়ে কলােনীর সামনে ১জন পুলিশের গুলিতে নিহত হইয়াছেন।’ আমরা দেখেছি, কার্জন হলের সামনে গুলিতে কেউ নিহত হন নি বলে শুধু ‘আজাদ’ প্রতিবেদকই নন, সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলেছেন। সেক্ষেত্রে ‘সৈনিক’-এর বক্তব্য হিসেবে মেলানাে কষ্টকর। | দৈনিক বাংলার অনুসন্ধানী সাংবাদিক আহমদ নূরে আলম বাহান্নর ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে বেশকিছু নতুন তথ্য সংগ্রহ করা সত্ত্বেও এ সম্পর্কে নিশ্চিত কিছু বলতে পারেন নি। হতাহতের সংখ্যা সম্পর্কে তার সর্বশেষ প্রতিবেদনে তিনি। বলেন : ‘৫২’র ভাষা আন্দোলনে কতজন শহীদ হয়েছিলেন? আহত হয়েছিলেন কতজন? কেউ ঠিক করে বলতে পারে না।…সে সময়ের একজন। সংবাদপত্রসেবী বলেছেন, গুলিতে হতাহতের সংখ্যা কোন সংবাদপত্রেই ছিল।

 আজাদের সেসময়ের সংখ্যাগুলাে থেকে জানা যায় ২১ ও ২২ তারিখের | গুলিতে ৯ ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছিল। বহু লাশ গুম করে ফেলা হয়েছিল১৯৮ আসলে সেসময় সংবাদপত্রের সংখ্যা যেমন কম ছিল তেমনি সংবাদ সংগ্রাহক সাংবাদিকগণের সবাই আজকের মতাে পেশাগত উৎকর্ষে এতটা চৌকস ছিলেন। বলেই বাইশ তারিখে শহীদদের মধ্যে নিশ্চিতভাবে একমাত্র শফিউর রহমান। ছাড়া আর কারাে কথা সুস্পষ্টভাবে জানা যায় না। অথচ দেখা যাচ্ছে, নওয়াবপুরেই একাধিক স্থানে গুলি চলেছে, মারাও গেছেন কেউ কেউ; কিন্তু কোন সাংবাদিক বাইশের শহীদদের নাম (একমাত্র শফিউর রহমান বাদে) এবং অন্যান্য। তথ্য-সংগ্রহ করতে পারেন নি, এমনকি আজাদ সাংবাদিকও নন। শহীদ শফিউর রহমান সম্পর্কে দীর্ঘদিন ধরে বলা হয়েছে যে তিনি হাইকোর্টের সামনে গুলিতে মারা গেছেন। হাইকোর্টের কর্মচারী বলেই সম্ভবত এমন ধারণার সূত্রপাত। এ সম্পর্কে সৈনিক’-এর বক্তব্য : ২২শে ফেব্রুয়ারি। … রাজপথে পুলিশ ও মিলিটারী দিচ্ছিল টহল। যাচ্ছিলেন। একটি সাইকেল চড়ে হাইকোর্টের দিকে। … তখন সাড়ে দশ ঘটিকা। … 

হঠাৎ একটি রাইফেলের গুলী তার পৃষ্ঠদেশ ভেদ করে চলে গেল। পড়ে গেলেন মাটিতে। এম্বুলেন্স এল। তুলে নিল হাসপাতালে। একই বিষয়ে সাংবাদিক আহমদ নূরে আলম শহীদ শফিউর রহমানের হােট। ভাই তৈয়বুর রহমানের সাথে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে নির্ভরযােগ্য তথ্য উপস্থিত। করেছেন, যা শহীদের অন্য এক ভাই মফিজুর রহমানের বক্তব্যের সাথে মেলে। তৈয়বুর রহমানের প্রদত্ত বিবরণ : সকাল ১১টা কি সােয়া ১১টার দিকে তিনি বেরিয়েছিলেন। তখন একটা | বিরাট মিছিল যাচ্ছিল নবাবপুর রােড দিয়ে। মরণচাদের দোকানের সামনে যখন তিনি, তখন গুলি হয়। গুলি লাগে তার পিঠে। তবু সাইকেল চালিয়ে কিছুটা এগিয়ে যান, কিন্তু খােশমহল রেস্টুরেন্টের সামনে এসে পড়ে যান। তাকে ধরাধরি করে রেস্টুরেন্টের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। এখান থেকেই তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে পাঠানাে হয় এ্যাম্বুলেন্স করে। …পরে শুনেছিলাম, গুলিতে ভাইয়ের কলজে ছিড়ে গিয়েছিল। অপারেশন সফল হয় নি তাই ।… সেদিন রাত তিনটায় আজিমপুরে তাকে দাফন করা হয়।’ এ সম্পর্কে একই প্রতিবেদনে আরাে বলা হয়েছে : “আগের দিন (২১শে ফেব্রুয়ারি) পুলিশের গুলিতে মারা গেছে অনেকে। অফিস-আদালত সব বন্ধ। সবাই তাকে নিষেধ করলেন বাইরে বেরােতে, এমনকি স্ত্রীও। বললেন, ‘অফিসে একটু দরকার আছে। তা সেরে শাহনাজের (মেয়ের) কাপড় নিয়ে ফিরব।’ একথা বলে সাইকেলে চড়ে তিনি সেই যে বেরুলেন আর কখনাে ফিরলেন না ।১৪৯ সেই কলকাতার রামেশ্বর-সালামের শহীদ হওয়ার মতাে ঘটনা। একই বিষয়ে অলি আহাদ লিখেছেন : ‘ছত্রভঙ্গ শােভাযাত্রীরা পুনরায় সদরঘাটের পথে রওয়ানা দিলে নওয়াবপুর রােডে অবস্থিত অধুনালুপ্ত ‘খােশমহল রেস্টুরেন্টের সন্নিকটে পুনরায় সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর সহিত সংঘর্ষ ঘটে। এই সংঘর্ষেই হাইকোর্ট কর্মচারী শফিউর। রহমান পুলিশের গুলিতে গুরুতরভাবে আহত হন। এবং পরবর্তকিালে ঢাকা। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। (প্রাগুক্ত গ্রন্থ, পৃ. ১৬৫)।। এছাড়া সাপ্তাহিক ‘নতুন দিন’-এ (১৩৬২ সাল, ১১ই ফাল্গুন) নওয়াবপুর রােডে ‘খােশমহল’ রেস্টুরেন্টের সামনে মাথায় রাইফেলের গুলি লেগে জনৈক কিশাের।

অহিউল্লাহুর শহীদ হওয়ার কথা বলা হয়েছে। রাজমিস্ত্রি হাবীবুর রহমানের আটনয় বছর বয়সের ছেলে অহিউল্লাহর লাশ সঙ্গে সঙ্গে অপসারিত হয়। জনাৰ অলি আহাদ বাইশ তারিখে নওয়াবপুর রােডে সংবাদ অফিসের বিপরীত দিকে জনৈক রিকশাচালক আবদুস সালামের শাহাদাত বরণের কথা বলেছেন। এ সম্পর্কে অন্য কোন সূত্রের সংবাদ মেলে না। দৈনিক আজাদ’–এর সংবাদ মতে   একুশে ফেব্রুয়ারি গুলিতে আহত জনৈক আবদুস সালাম ৭ এপ্রিল (১৯৫২) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। তিনি ছিলেন পূর্ববঙ্গ সরকারের শিল্প অধিদপ্তরের একজন আজ্ঞাবাহক (পিওন)। থাকতেন নীলক্ষেত ব্যারাকে। প্রসঙ্গত একটি কথা উল্লেখ করা দরকার যে শহীদ আবুল বরকত এবং শহীদ শফিউর রহমান বাদে আর কোন শহীদের কবরই সংরক্ষণ যায় নি হয় নি বলে হারিয়ে গেছে। আমরা মনে করি বাংলাদেশ সরকার তাদের গােপন সংরক্ষিত তথ্য থেকে ভাষা আন্দোলনের শহীদদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা সাধারণ্যে প্রকাশ করবেন। আমাদের এই দাবির কারণ, একুশে ও বাইশে ফেব্রুয়ারি পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহতদের সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন সূত্রে বিস্তর মতভেদ। এ সম্পর্কে আমরা যতদূর সম্ভব উপরে উল্লেখ করেছি; বিশেষ করে বাইশে ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে। এমনকি একুশ তারিখের ঘটনা সম্পর্কেও দৈনিক আজাদ’-এ সন্দেহ প্রকাশ করে বলা হয় হয়, ‘১৫০ বৃহস্পতিবারের ঘটনা সম্পর্কে শহরে প্রবল গুজব যে, ঐ দিন ৪ জনেরও বেশি লােক নিহত হয়, কিন্তু ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই তাহাদের মৃতদেহ সরাইয়া ফেলা হয়। একটি কিশাের বয়স্ক বালক সম্বন্ধে অনুরূপ গুজব শুনিয়া বিশেষ অনুসন্ধানের পর জানা যায় যে বালকটি মেডিকেল কলেজ ও পরিষদ ভবনের মধ্যে ফুলার রােডে গুলীর আঘাতে নিহত হয় এবং তার লাশ তৎক্ষণাৎ অপসারিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় পােস্টগ্রাজুয়েট ছাত্রীর নিকট হইতেও ইহার সমর্থন পাওয়া গিয়াছে।’ তা হলে দেখা যাচ্ছে, এই দুই দিনে অন্ততপক্ষে দুই জন কিশাের প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু বাইশে ফেব্রুয়ারির হতাহত সম্পর্কে সরকারি প্রেসনােটে বলা হচ্ছে—দুইজন নিহত এবং ৪৫ জনের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কথা। দৈনিক ‘আজাদ’ ও ‘মিল্লাত’-এ প্রকাশিত একটি বিজ্ঞাপন থেকে জানা যায় যে, বাইশ তারিখে রিকশাওয়ালা আবদুল আউয়াল (লাইসেন্স নং ৩৪২) গুলিতে নিহত হন।

শহীদদের সংখ্যা নিয়ে পরস্পরবিরােধী বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, রাস্তা থেকে নিহতদের তুলে নিয়ে কোথায় কবর দেয়া হয়েছিল, বিশেষ করে বাইশ তারিখে? একুশ তারিখে পুলিশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে লাশ সরিয়ে নিয়ে আজিমপুর কবরখানায় দাফন করেছিল, সে তথ্য আমরা জেনেছি; কিন্তু ঐদিনের বাকি সবাইকে এবং পরদিনের শহীদ সবাইকে ঐখানেই কি দাফন করেছিল পুলিশ। এ বিষয়ে সাংবাদিক আহমদ নূরে আলম আজিমপুর গােরস্তানের তৎকালীন সার সুরুজ্জামান এবং মৌলৰী হাফেজ আবদুল গফুরের সাথে আলাপ করে। একুশের এবং বাইশের শহীদদের লাশ দাফন সম্পর্কে কিছু তথ্য সংগ্রহ করেন। এ এর অন্যতম লেখক আহমদ রফিকও তার সঙ্গে উক্ত ড্রেসার সুরুজ্জামানের সাথে কবরস্থানের পশ্চিমধারে নতুন পল্টন লাইনে তার বাড়িতে বসে আলাপ। করেন। দেখা যায়, এতকাল পরে তার স্মৃতি যথেষ্ট বিবর্ণ। তার বয়স তখন সত্তর বছর।১৫১ | তবু সুরুজ্জামানের বক্তব্যে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, ওদের মাঝরাতে ঘুম থেকে ডেকে তুলে কবর খুঁড়তে লাগানাে হয়েছিল। লাগানাে হয়েছিল লাশ ধােয়ানাের কাজে এবং অবাঙালি অফিসারটি তাদের বারবার ধমক দিচ্ছিল এই বলে যে, | জলদি লাশ দাফন করাে।’ সব মিলিয়ে ওরা আটজন দ্রুত কাজ সারতে চেষ্টা করেন। তার সঙ্গী রমজান, রেজ্জাক ওরা কেউ আর বেঁচে নেই। ঠিক কয়টি কবর দেয়া হয় তা ঠিক মনে নেই, তবে প্রথম রাতে অর্থাৎ একুশে ফেব্রুয়ারি রাতে মাথায় গুলি লাগা একজনকে তারা কবর দেয় এবং বুকে গুলি লাগা অন্য একজনকে। দুই দিনে সব মিলিয়ে ছয়-সাতটি লাশ আনা হয়েছিল। এর মধ্যে একটি কিশােরের লাশও ছিল। একই বক্তব্য রেখেছিলেন মৌলবী গফুর লাশের জানাজা পড়া সম্পর্কে। | এদের বিবরণ থেকে আরাে যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বেরিয়ে আসে তা হলাে, একুশের পরদিন ভােরে কয়েকজন ছাত্র এসে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে থাকা কিছু রক্তমাখা কাপড়-চোপড় সংগ্রহ করে নিয়ে চলে যায়।

এই ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে আমরাও জানি এই জন্য যে পরদিন কাকভােরে মেডিকেল কলেজের কয়েকজন ছাত্র আজিমপুর গােরস্তান থেকে কয়েকটি রক্তমাখা কাপড়-চোপড় হােস্টেলে এনেছিলেন এবং এগুলাে মিছিলের মুখে পতাকার মতাে ব্যবহার করা হয়েছিল। উক্ত ছাত্রদের মধ্যে মেডিকেল কলেজের তৎকালীন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র খােন্দকার মােহাম্মদ আলমগীর (এখন আমেরিকাবাসী) অন্যতম। তার মতে সঙ্গে ছিলাে তার সহপাঠী আমীর আহসান। অব্যাহত গণবিক্ষোভ : পরিস্থিতি ও প্রতিক্রিয়া বাইশে ফেব্রুয়ারি শুক্রবার, ছাত্র আন্দোলন গণ-আন্দোলনে পরিণত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিত ও ঘটনাদি আমরা প্রধানত সংবাদচিত্র থেকেই ইতঃপূর্বে তুলে ধরেছি। আন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্ত পরিণতি এইদিন গণ-অভ্যুত্থানের রূপ নিয়েছিল কিনা সেই তাত্ত্বিক বিতর্ক বা বিশ্লেষণে না গিয়েও দেখতে পাই, ঘটনার ব্যাপকতা ও তীব্রতায় বিমূঢ় নুরুল আমিন সরকার আমলাতান্ত্রিক নির্দেশই মাথায় তুলে নিয়েছিলেন, জারি করেছিলেন ১৪৪ ধারার ওপর নতুন এক নিষেধাজ্ঞা, সান্ধ্য আইন। রাত দশটা থেকে ভাের পাঁচটা পর্যন্ত। মােতায়েন করেছিলেন সেনাবাহিনী, যা ঢাকার মানুষের কাছে ছিল অভাবিত। মুসলিম লীগ দলের আকরাম খ গ্রুপ এই উপলক্ষে এক হাত নিয়েছিলেন নুরুল আমিন গ্রুপের ওপর।

এদিন ‘আজাদ’-এর প্রথম পৃষ্ঠায় শিরােনাম ছিল অনেকগুলাে, তবু সবার উপরে সবচেয়ে মােটা হরফে ছিল লীগ সরকারকে বাচিয়ে রাখার চেষ্টা (হয়তাে-বা নুরুল। আমিনকে নয়) প্রধানত এই বলে যে,  বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থা পরিষদের সুপারেশ’ অর্থাৎ এবার আন্দোলন থামানাে যেতে পারে। এর নিচে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যের শিরােনাম ছােট হরফে এবং এরপর নিহতের খবর আরাে ছােট হরফে : শুক্রবার শহরের অবস্থার আরও অবনতি : সরকার কর্তৃক সামরিক বাহিনী তলব ‘পুলিশ ও সেনাদের গুলিতে ৪ জন নিহত ও শতাধিক ব্যক্তি আহত : সাতঘন্টার জন্য কারফিউ জারী’ ‘শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনাৰ্থ শহরে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালন ‘পুলিশ জুলুমের প্রতিবাদে আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিনের | পরিষদ সদস্যপদে এস্তেফা শিরােনাম থেকে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য মােটামুটি বুঝতে পারা যায়। আকরাম খ গ্রুপ হয়তাে চেয়েছিলেন, নুরুল আমিন সরকারের পতন ঘটতে পারে, কিন্তু মুসলিম লীগ সরকারের নয়। তাই শিরােনামে রাষ্ট্রভাষার সুপারিশ সর্বাধিক গুরুত্ব বহন করেছে; ততটা করে নি সামরিক বাহিনী মােতায়েন ও তাদের গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনা। এই মনােভাবের পরিচয় আরাে স্পষ্ট হয়ে ওঠে সেদিনের সম্পাদকীয় নিবন্ধে, যা ‘পদত্যাগ করুন’ শিরােনামে নিহিত। আকাক্ষার প্রকাশ ঘটিয়েছে। অন্যদিকে একই বিষয়ে ২৪ ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক ইত্তেফাক’-এর শিরােনাম পাঠক পাশাপাশি তুলনা করে কৌতূহল মেটাতে পারেন : ‘দেশের কাছে লাল ফেব্রুয়ারীর শহীদদের ডাক আসিয়াছে’ বাংলা ভাষা সংগ্রামকে সফল করিয়া রক্তের প্রতিশােধ নাও নুরুল আমিনও প্রতিশ্রুতির পিচ্ছিল পথে পা বাড়াইয়াছে। ‘জনসাধারণ হইতে বিচ্ছিন্ন সরকার আজ মিলিটারীর জোরেই বাঁচিয়া আছে ইত্তেফাক’-এর শিরােনামে রাজনৈতিক দূরদর্শিতার কয়েকটি দিক ফুটে। উঠেছে। এক, নাজিমুদ্দিনের আটচল্লিশী পথ ধরে নুরুল আমিনের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের সম্ভাবনা। দুই, নুরুল আমিন সরকারের জনবিচ্ছিন্নতা, অন্তত সাময়িক। হলেও। একথাও সত্য যে জনবিচ্ছিন্ন সরকারকেই সামরিক শক্তির ওপর নির্ভর। করতে হয়, যেমনটি আমরা দেখেছি চুয়ান্ন সাল থেকে শুরু করে এই সেদিনও।

এছাড়া ভাষা সংগ্রাম-বিরােধী সংবাদপত্রগুলাে সম্পর্কেও ‘ইত্তেফাক’ পাঠকদের আনান দিয়েছিল এই বলে যে : ‘ঢাকার সংগ্রামী ছাত্র-জনতা ঘােষণা করিয়াছেমর্নিং নিউজ’ ও ‘সংবাদ’ বর্জন করিতে হইবে।”১৪২  এসব দিক থেকে, বিশেষ করে রাজনৈতিক তাৎপর্যের দিক থেকে ইত্তেফাক’এর ভূমিকা আজাদ’ থেকে যেমন স্বতন্ত্র, তেমনি স্পষ্ট। জনসাধারণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা সম্পর্কেও ‘ইত্তেফাক’ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে আন্দোলনের  স্বার্থে। কারণ, জনসাধারণের সংশ্লিষ্টতাই ছিল এই আন্দোলনের মূল শক্তি। শুক্রবার ঢাকার রাজপথে, মিছিলে অছাত্র জনতার বিপুল সমাবেশের দৃশ্য অনেকের চোখেই ছিল অভাবিত এবং বিস্ময়ের। সেদিনের ঢাকা একের পর এক এমন সব দৃশ্যের জন্ম দিয়েছে যা চিত্রশিল্পীর এক একটি ক্যানভাস বলে মনে হতে পারে। একদিকে রাজপথ যেমন জনারণ্যে পরিণত, অন্যদিকে তেমনি অফিসআদালত প্রায় জনশূন্য। ঢাকা রেল স্টেশনে গাড়ির চাকা বন্ধ, ঢাকা রেডিও শিল্পীর অভাবে রেকর্ড বাজিয়ে চলেছে। পুলিশ ও সৈন্যদের তাড়ায় কোনাে কোনাে ছাত্রের (যেমন মেডিকেল ছাত্র ফজলে রাব্বীর) কার্জন হলের লােহার রেলিং ডিঙাতে কষ্ট হচ্ছে না, অন্যদের ক্লান্তি লাগছে না মাইলের পর মাইল মিছিলপরিক্রমায় । রাজপথে প্রতিটি মানুষের বাহুতে বা বুকে কালাে ফিতার শােকচিহ্ন। সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা পুরনাে ঢাকার অনেক বাড়িতেই ছাদে বা বারান্দায় দাড়ানাে পরদানশিন ঢাকাই গৃহিণীদের মিছিলের প্রতি সস্নেহ দৃষ্টিপাত; তাদের সঙ্গে দাঁড়ানাে ছােট ছােট ছেলেমেয়েদের অবাক চাহনি। বাড়িতে বাড়িতে কালাে  পতাকা তাদের মনােভাবের প্রতীক হয়ে উড়ছে। দুপুরে শহরের প্রতিটি মসজিদে জুম্মার নামাজের পর শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনায় হাজার হাজার ব্যক্তির অংশগ্রহণ এবং বিকেলে তাদের আজিমপুর কবরস্থান হয়ে সলিমুল্লাহ হলের প্রাঙ্গণে সমবেত হওয়া এবং পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর গুলি চালনার প্রতিবাদে সােচ্চার হওয়া ইত্যাদি ঘটনা ছিল ঐদিনের বৈশিষ্ট্য। বাইশে ফেব্রুয়ারি রাজপথের চেহারা দেখেই ব্যাপক জনসমর্থনের বিষয়টি  স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মনে হয় যেন সবাই জেনে গেছেন আজ হরতাল, আজ চাকা বন্ধু, দোকানপাট, কাজকর্ম বন্ধ; যদিও সেই অনুপাতে ছাত্রদের সাংগঠনিক শক্তি ছিল অত্যন্ত দুর্বল; তাই যতদিন তারা চেয়েছেন আন্দোলন চলেছে এবং ক্ষুব্ধ জনতার পদভারে স্পন্দিত ঢাকার লাল-কালাে রাজপথ গণ-জাগরণের মহিমা অর্জন করেছে। কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয় যে, ছাত্র এলাকা বাদে এসব ঘটেছে প্রধানত পুরনাে ঢাকার পথে পথে এবং পলাশী, আজিমপুর এলাকায়, কিন্তু উত্তর। ঢাকায় ততটা নয়।

বাইশে ফেব্রুয়ারির এই স্বতঃস্ফূর্ত সরকার-বিরােধী এবং অগণতান্ত্রিক দুঃশাসন-বিরােধী সমাবেশের প্রতিবাদী চরিত্র অনুধাবন ও বিশ্লেষণ এবং সংশ্লিষ্ট সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনার পরিপ্রেক্ষিতে বুঝতে কষ্ট হয় না, কেন ঐ ক্রুদ্ধ। জমায়েত ও উৎক্ষেপ গণ-জাগরণের বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত হওয়ার যােগ্য। জনগণ সেদিন ধরেই নিয়েছিলেন, ভাষা আন্দোলনের ন্যায়সঙ্গত দাবির ওপর জুলুরে কোন নৈতিক অধিকার সরকারের নেই এবং এই অন্যায় জুলুমের কারণে শাসন। পরিচালনার অধিকার আর তাদের নেই। এই রাজনৈতিক বােধের অন্তর্নিহিত উপস্থিতি একটি ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবােধের অন্তঃশীলা অবস্থানের প্রমাণ দেয়। মনে হয় ভাষার মতাে একটি সর্বজনীন চরিত্রের রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে   গ্রেফতার, গুলি, হত্যা, সেনাবাহিনী মােতায়েন ইত্যাদি ঘটনা বিভিন্ন অর্থনৈতিক কারণে সৃষ্ট ক্ষোভ ও অসন্তোষের চাপা আগুনে ইন্ধন জুগিয়ে জনমানসে এক বেপরােয়া মনােভাব তৈরি করেছিল, সরকারের বিশ্বাসযােগ্যতার প্রতি অনাস্থা সৃষ্টি করেছিল যেজন্য তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিপুল সংখ্যায় রাজপথে নেমে আসতে দ্বিধা করেন নি। জনমতের এই ঢেউ, এই চরিত্র বুঝতে ‘আজাদ’ কর্তৃপক্ষের অসুবিধা হয় নি। বলেই তাদের ২৩ ফেব্রুয়ারির সম্পাদকীয় নিবন্ধে (পদত্যাগ করুন) মুখ্যমন্ত্রী পরিবর্তনের ইচ্ছা প্রতিফলিত হয়েছে। কিন্তু ঐ সম্পাদকীয় নিবন্ধে নুরুল আমিন মন্ত্রিসভার পদত্যাগ দাবি এবং ব্যবস্থা পরিষদের অধিবেশনে অংশগ্রহণকারী সদস্যদের উদ্দেশে বাংলা রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক কর্তব্য পালনের আহ্বান সত্ত্বেও ছাত্রদের বাংলা রাষ্ট্রভাষার দাবিতে জনমতের প্রতিফলন রয়েছে কিনা সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করে বলা হয়েছে : | ‘ছাত্রেরা বাংলাভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানাইয়াছে।

এ দাবি জানাইবার তাহাদের পূর্ণ অধিকার আছে। পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু। এ যদি এখানকার জনমতের দাবী হয় তবে পাকিস্তানকে তাহা মানিয়া লইতে হইবে।’ উপরের বক্তব্যে ‘যদি’ শব্দটির ব্যবহার ‘আজাদ” কর্তৃপক্ষের এমন সন্দেহ নিশ্চিত করে তােলে যে, ছাত্রদের বাংলা রাষ্ট্রভাষার দাবিতে জনমতের সমর্থন নাও থাকতে পারে। বাইশে ফেব্রুয়ারির বিশাল গণবিক্ষোভ এবং জনতার রক্তদানের মত ঘটনাও আজাদ কর্তৃপক্ষের মন থেকে সন্দেহ-সংশয় দূর করতে পারেনি। আর এ কারণেই আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে আজাদ আন্দোলনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে দ্বিধা করেনি। ছাত্র এলাকা এখন মুক্ত এলাকা : নেতৃত্বের দুর্বলতা। মেডিকেল কলেজ হােস্টেলে তখন নেতা ও কর্মীদের ভিড়, কেউ কেউ সেখানে স্থায়ী আস্তানা গেড়েছেন, যেমন অলি আহাদ, মাহবুব জামাল জাহেদী, সিলেটের মােহাম্মদ ইলিয়াস। তরুণ ছাত্র-কর্মীদের মধ্যে আসা-যাওয়া করছেন। আনিসুজ্জামান, আহম্মদ হােসেন, আমির আলীসহ অনেকে; এদেরই কয়েকজন। সহকর্মী (যেমন নেয়ামাল বাসির, জহীর রায়হান) একুশের দশজনী মিছিল থেকে গ্রেফতার হয়ে গেছেন। আসছেন ছাত্রকর্মী মৃণাল, দেবপ্রিয় (বড়ুয়া), আফসার সিদ্দিকী, মােশাররফ চৌধুরী এবং তাদের সহযােগী বন্ধুগণ। সংগঠক নেতাদের মধ্যে আছেন আবদুল মতিন, অলি আহাদ, ইমাদুল্লাহ, মােহাম্মদ সুলতান প্রমুখ। যে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ ১৪৪ ধারা ভাঙার আন্দোলন অস্বীকার করে নিজেদের বিলুপ্তি ঘােষণা করেছিলেন, পরিস্থিতির অভাবিত পরিবর্তনের কারণে। তাদেরও কেউ কেউ, যেমন শামসুল হক, আবুল হাশিম, খয়রাত হােসেন, খালেক। 

নেওয়াজ খান ব্যারাক প্রাঙ্গণে আসতে শুরু করেছেন; এমনকি মাঝে-মধ্যে কাজী গােলাম মাহবুবও উপস্থিতি জানাতে ভুল করছেন না। আর মেডিকেল কলেজের নেতৃস্থানীয় ও ছাত্রকর্মী সবাই নানাভাবে, নানা কাজে আন্দোলনের সাথে নিজেদের যুক্ত রাখছেন (যেমন গােলাম মাওলা, শরফুদ্দিন আহমদ, সাঈদ হায়দার, আবুল হাশিম, আলিম চৌধুরী, মঞ্জুর হােসেন, ফরিদুল হুদা, নওয়াব হােসেন, মােহাম্মদ জাহেদ, আলি আসগর, হুমায়ুন হাই, আবদুস সালাম প্রমুখ)। | বাইশের ব্যাপক গণজাগরণের পটভূমিতে ছাত্র এলাকা রাতারাতি মুক্ত। এলাকায় পরিণত হয়েছিল, এমনকি পুরনাে ঢাকার অলিগলিতেও ছাত্র-কমীদের। চলাফেরায় কোন বাধা নেই। দু-তিনটি ছত্রে এই অবস্থার একটি চমৎকার রেখাচিত্র এঁকেছেন মােহাম্মদ তােয়াহা : বাইশ-তেইশের ব্যাপক mass upsurge-এর পর পুলিশ হাল ছেড়ে দিয়েছে। আমরা এই সময় রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াই। কেউ ধরে না। মেডিকেল কলেজ গেটের সামনে একজন বড়াে পুলিশ অফিসার শামসুল হককে বলেছিলেন, | এখন আমরা কি বলবাে। আপনারাই তাে ক্ষমতায় এসে গেলেন। , এমন অসংগঠিত, অসংবদ্ধ নেতৃত্ব নিয়ে ক্ষমতায় আসা দূরে থাক, বড় ধরনের কোন পরিবর্তনও ঘটানাে যায় না। জনসাধারণ অবশ্য হঠাৎ করেই অনেকখানি এগিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু সে সুযােগ সদ্ব্যবহারের সাংগঠনিক শক্তি ও অবস্থা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা আমাদের ছিল না। এতদসত্ত্বেও ঐ নির্বিবাদে চলাফেরার মুক্তাঞ্চলীয় বাস্তবতা ছিল এক লক্ষণীয় পরিস্থিতি, আনন্দময় অভিজ্ঞতা। এমনি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বশীর আলহেলালের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ গ্রন্থে ২২শে ফেব্রুয়ারির পরিস্থিতি বর্ণনায় নেতাদের আত্মগােপন শীর্ষক যে অনুচ্ছেদটি পরিবেশিত হয়েছে, ঘটনার সার্বিক অনুধাবনে তা নিতান্তই অমূলক ও একদেশদর্শী মনে হয়। বশীর লিখেছেন (পৃ. ৪১৪) : ২১শে ফেব্রুয়ারির সন্ধ্যার দিক থেকেই ভাষা আন্দোলনের অধিকাংশ নেতা, কেন্দ্রীয় সর্বদলীয় কর্মপরিষদের নেতা ও ছাত্রনেতাদের অধিকাংশ আত্মগােপন করেন। …নেপথ্য থেকে আত্মগােপনকারী নেতারা আন্দোলনকে কী-পরিমাণে সাহায্য জুগিয়েছিলেন তা আজ আর বলা সম্ভব নয়। তবে তাদের কেউ-কেউ যে সক্রিয় ছিলেন তার ছিটেফোটা তথ্য পাওয়া যায়।’ বিষয়টি আমরা ইতঃপূর্বে আলােচনা করেছি, তবু প্রসঙ্গত এটুকু বলা দরকার যে, সম্ভবত আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সংগঠক অলি আহাদের সংশ্লিষ্ট বক্তব্যের নির্বিচার অনুসরণের ফলেই লেখক এক ঐতিহাসিক ভ্রান্তির শিকার হয়েছেন। ঘটনাবলীর যথাযথ অনুসরণ সম্ভব হলে তিনি দেখতে পেতেন যে, এ আন্দোলনে যেটুকু নেতৃত্ব বাইশ তারিখ বা তার পরে দেওয়া হয় তা ছিল মূলত হরতালেরমিছিলের-বিক্ষোভের ঘােষণা, ইস্তাহার ছেপে বিতরণ, নতুন কর্মসূচিদানে। 

অক্ষমতা, মফস্বলের সাথে যােগাযােগের চেষ্টা, সরকারি অপপ্রচারণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের চেষ্টা ইত্যাদি এবং তা উপস্থিত ছাত্র-যুব নেতাগণ যৌথভাবেই করেছেন মেডিকেল হােস্টেলে বসে, কখনও কখনও ছােটোখাটো বৈঠকের মাধ্যমে। কেউ এককভাবে আন্দোলন পরিচালনার দায়িত্ব বহন করেন নি, কিংবা করা সম্ভব ছিল না। | তাই এসব বিতর্কের অবসানকল্পে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস পাঠকদের কাছে বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া দরকার যে একুশের আন্দোলন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কোন একক ব্যক্তির বা সংগঠনের নির্দেশে পরিচালিত হয় নি; সংখ্যাগত দিক থেকে কম হলেও তা হয়েছে কয়েকজনের সমষ্টিগত নেতৃত্বে। এতে কারাে অবদান পরিমাণগতভাবে কিছুটা বেশি, কারাে কম । এবং এ বিষয়টি রাজনৈতিক বিচারে প্রধান নয় এইজন্য যে প্রথম থেকেই পদ্ধতিগত তথা কর্মপন্থাগত অনৈক্যের দুর্বলতা এবং দূরদর্শিতার অভাব (ব্যাপক জনস্বার্থকেন্দ্রিক কর্মসূচির অভাব) আন্দোলনের সবটুকু সম্ভাবনা সীমাবদ্ধ বৃত্তে স্থবির করে ফেলেছিল। এইজন্য জনগণের ব্যাপক জোয়ারী অসন্তোষ ও বিক্ষোভ সঠিকভাবে কাজে লাগানাে সম্ভব হয়নি। নেতৃত্বের দুর্বলতার মধ্যেই জনসাধারণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে এসেছেন, নেতৃত্বের নির্দেশের অপেক্ষা না করেই হরতাল ও বিক্ষোভে রাজপথে প্রতিবাদী চেতনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে বরং সামগ্রিক নেতৃত্বের যােগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। আসল কথা হলাে, আন্দোলন যেখানে ব্যাপক, জনগণই যেখানে বিজয়ীর ভূমিকায় এবং শাসক সাময়িকভাবে হলেও যেখানে পরাজিত, সেখানে আন্দোলনের নেতৃত্ব সাধারণত একক ব্যক্তির হাতে থাকে না এবং এখানেও ছিল না।

বিভিন্ন মহলের প্রতিক্রিয়া ও বিবৃতি বাইশে ফেব্রুয়ারির একাধিক উল্লেখযােগ্য ঘটনার মধ্যে রয়েছে ‘আজাদ’ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিনের পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদ থেকে পদত্যাগ, যা তেইশে ফেব্রুয়ারি ‘আজাদ’-এর প্রথম পাতায় শিরােনাম হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল। ভাষার ওপর সরকারি দমননীতির প্রতিবাদে লীগ পরিবারে ভাঙনের সূচনা দেখা দেয় একুশে ফেব্রুয়ারি বিকেলে আইন সভায় মৌলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশের প্রতিবাদী বক্তৃতা এবং পরিষদ কক্ষ ত্যাগের মধ্য দিয়ে। মৌলানা তর্কবাগীশের পথ আরাে কয়েকজন লীগ সদস্য অনুসরণ করেন, যা আগে উল্লেখ করা হয়েছে। | এই ভাঙন পরবর্তী দিনগুলােতে ক্রমেই বেড়ে যেতে থাকে এবং তা মুসলিম লীগের সদস্যপদ পর্যন্ত স্পর্শ করে। এরই পরিণতি হিসেবে দেখা যায় যে, সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘নওবেলাল’-এর সম্পাদক এবং সিলেট জেলা মুসলিম লীগের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব মাহমুদ আলী মুসলিম লীগ কাউন্সিল থেকে এবং লীগের   প্রাথমিক সদস্যপদ থেকে ইস্তফা দেন। ইস্তফা দেন সিলেট রাজনীতির আরাে কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, যেমন এ.জেড আবদুল্লাহ এবং মতছির আলী। | কিন্তু এদিনের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলাে, পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদে সরকার কর্তৃক রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে প্রস্তাব গ্রহণ। এ বিষয়ে তেইশে ফেব্রুয়ারি ‘আজাদ’-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় : গতকল্য (শুক্রবার) অপরারে ব্যবস্থা পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত এক প্রস্তাবে গণপরিষদের নিকট বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার। সুপাবেশ করা হয়। প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিন প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন। এই সম্পর্কে আনীত সমুদয় সংশােধনী প্রস্তাব বাতিল হয়। কিন্তু নুরুল আমিনের এই প্রস্তাব পরিষদে গৃহীত হওয়া সম্পর্কে বদরুদ্দিন উমর তার গ্রন্থে প্রস্তাবটি সংখ্যাগরিষ্ঠ ভােটে গৃহীত হয় বলে দাবি করেন’ (৩য় খণ্ড, পৃ. ৩৫৫)। | যাই হােক, নুরুল আমিনের প্রস্তাবের সাথে সংশ্লিষ্ট সংশােধনীগুলাে গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও পরিষদে গৃহীত হয় নি। মনােরঞ্জন ধরের সংশােধনীতে ছিল গণপরিষদের পূর্ব পাকিস্তানি সদস্যদের ওপর উক্ত প্রস্তাব সমর্থনের জন্য চাপ দেয়ার নির্দেশ। অন্যদিকে শামসুদ্দিন আহমদের সংশােধনীতে বলা হয় যে, ‘গণপরিষদ সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করলে পূর্ব পাকিস্তানের সদস্যদের পদত্যাগ করতে বলা হবে।’ আর আনােয়ারা খাতুনের সংশােধনীর বক্তব্য ছিল ‘গণপরিষদকে এর পরবর্তী অধিবেশনেই এই সুপারিশ প্রস্তাব গ্রহণ করতে হবে।” সংশােধনীগুলাের উদ্দেশ্য ছিল, গণপরিষদে উক্ত প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা।

কারণ, আটচল্লিশের প্রস্তাবের পরিণতি এবারও স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু বাঙালি সদস্যদের সেই সত্য অনুধাবনের বিচক্ষণতা ছিল না, অথবা তাদের নেতা নেহাৎ মুখ রক্ষার জন্যই প্রস্তাব এনেছিলেন, গণপরিষদে গৃহীত হওয়ার জন্য নয়। বাইশে ফেব্রুয়ারির আরাে যে দুই একটি ঘটনা লিপিবদ্ধ করার মতাে তা হলাে, মেডিকেল কলেজের তরুণ চিকিৎসক ও ছাত্রদের উদ্যোগে স্থাপিত ‘রাড ব্যাঙ্কে রক্তদানের জন্য বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আবেদন প্রচার। কারণ, আমরা আগেই জানিয়েছি যে, এইদিনই মেডিকেল হােস্টেলের প্রচারযন্ত্রটি পুলিশসেনাবাহিনী ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ায় রক্তদানের আহবান সংক্রান্ত প্রচারে বাধা পড়ে। দ্বিতীয় বিষয়টি হলাে, গুলিবর্ষণ, হত্যাকাণ্ড ও পুলিশী জুলুমের প্রতিবাদী নিন্দায় বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের সংবাদপত্রে বিবৃতি প্রচার। এর মধ্যে রয়েছেন এ.কে. ফজলুল হক, আবুল হাশিম, মৌলানা ভাসানী। হক সাহেবের বিবৃতি প্রকৃতপক্ষে হাইকোর্ট বার আসােসিয়েশনের জরুরি সভার সভাপতি হিসেবে প্রচারিত হয় যেখানে সংশ্লিষ্ট অফিসারদের অপসারণ, নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন। গঠন, লোেক প্রস্তাব এবং বাংলা রাষ্ট্রভাষার কথা বলা হয়েছে। আবুল হাশিমের  বিবৃতির উল্লেখযােগ্য দিক ছিল মর্নিং নিউজ’ পত্রিকায় আন্দোলনের ওপর সাম্প্রদায়িকতার লেবেল এটে দেয়ার বিরােধিতা এবং ইনসাফ’ ও ‘আজাদ পত্রিকা দুটোকে সঠিক খবর পরিবেশনের জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন। অন্যদিকে মৌলানা ভাসানী পুলিশী জুলুমের তীব্র নিন্দা করে ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তই শুধু নয়, সরকারের প্রকাশ্য বিচারের দাবিও জানান। এছাড়াও ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে আবদুল লতিফ বিশ্বাসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত এসােসিয়েশনের সভায় সংশ্লিষ্ট অফিসারদের অপসারণ, হত্যাকাণ্ডের নিন্দা, মন্ত্রিসভার পদত্যাগের দাবি জানিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।

আরাে অনেক সংগঠনের সভায় অনুরূপ প্রস্তাব নেয়া হয়, যেমন নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, পাকিস্তান তমদুন মজলিস ইত্যাদি ঢাকার বাইরে প্রতিবাদী আন্দোলন ঢাকার বাইরে একুশের হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া প্রতিবাদ বিক্ষোভ কম জোরালাে ছিল না। শুধু শহবগুলােতেই নয় গ্রামাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও সভা, হরতাল, মিছিল ও বিক্ষোভের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের ব্যাপক গণচরিত্র প্রকাশ পায়। প্রায় প্রতিটি সভায় নিরপেক্ষ তদন্ত ও সংশ্লিষ্ট অফিসারদের অপসারণ ও শাস্তি দাবি, মন্ত্রিসভার পদত্যাগ, ভাষার দাবিতে প্রয়ােজনে সদস্যদের পদত্যাগ, হতাহতদের পরিবারবর্গকে ক্ষতিপূরণদান ইত্যাদি দাবি সংবলিত প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। যেসব শহরে আন্দোলন তীব্র-ব্যাপকতা লাভ করে তার মধ্যে নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, সিলেট, কুমিল্লা, রাজশাহী, পাবনা, যশাের অন্যতম। তেইশে ফেব্রুয়ারি বিকেলে নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় বিশাল জনসমাবেশে নুরুল আমিন মন্ত্রিসভার অবিলম্বে পদত্যাগ দাবি করে প্রস্তাব নেয়া হয়। সভাপতিত্ব করেন শ্রমিক নেতা ফয়েজ আহমদ। বক্তাদের মধ্যে ছিলেন শফি হােসেন খান, সােলায়মান এফ. রহমান প্রমুখ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা।

ময়মনসিংহে এই আন্দোলন ব্যাপক তীব্রতায় সঘটিত হয়। রফিকুদ্দিন ভূঁইয়া, হাতেম আলী তালুকদার প্রমুখ ব্যক্তি সদর ও অন্যান্য অঞ্চলে ভাষাবিষয়ক প্রতিবাদী আন্দোলন সাফল্যের সাথে পরিচালনা করেন। স্মরণযােগ্য যে শহরে মুসলিম লীগের উদ্যোগে এবং মােনায়েম খার সভাপতিত্বে টাউন হল প্রাঙ্গণে উর্দুর পক্ষে সভা অনুষ্ঠানের চেষ্টা চলে; কিন্তু চারদিক থেকে এই সংবাদে হাজার হাজার লােক ছুটে আসার পরিপ্রেক্ষিতে লীগ-রাজনীতিকদের চেষ্টা পণ্ড হয়ে যায়। ভাষা আন্দোলনের পক্ষে অনুষ্ঠিত একাধিক সভায় যেসব সরকার-বিরােধী প্রস্তাব গৃহীত হয় তার মধ্যে ছিল আবেগের গভীর প্রকাশ। কুমিল্লায়ও অনুরূপ বিশাল সমাবেশ ও মিছিলে তীব্র সরকার-বিরোধী মনােভাব দেখা যায়। কুমিল্লার সংবাদে প্রকাশ, টাউন হলে পাঁচ হাজার লােকের সভা এবং  পরে এক মাইল দীর্ঘ মিছিল সেখানে স্মরণকালের মধ্যে বড় একটা দেয়া যায় নি। সভায় অধ্যাপক আবুল খায়ের, হাসান ইমাম প্রমুখ অনেকেই বক্তৃতা করেন। একাধিক প্রস্তাবের মধ্যে উল্লেখযােগ্য আজিজ আহমদ, কোরাইশী প্রমুখ। অফিসারের অপসারণ, মন্ত্রীমণ্ডলীর পদত্যাগ, পুলিশী জুলুমের নিন্দা ইত্যাদি। তাছাড়া শহরে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। | যশােরে, সিলেটে, টাঙ্গাইলে, চট্টগ্রামেও সভা মিছিল হরতালে শহর ও সংলগ্ন। এলাকা ক্ষুব্ধ ও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সর্বত্রই প্রধান দাবি ছিল অবিলম্বে নুরুল আমিন মন্ত্রিসভার পদত্যাগ। কিন্তু ভবী ভােলবার নয়। তারা চেয়েছেন নানা কৌশলে, ফন্দি-ফিকিরে, কূটষড়যন্ত্রে জনতাকে বিভ্রান্ত করে ক্ষমতায় থেকে যেতে। এবং তা থেকেছেন, কিন্তু বেশিদিন নয় ।

সূত্র : ভাষা আন্দোলন-ইতিহাস ও তাৎপর্য – আবদুল মতিন, আহমদ রফিক