একুশে ফেব্রুয়ারি সূর্য বিস্ফোরণের দিন
বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সভা : ১৪৪ ভাঙার সিদ্ধান্ত একুশে ফেব্রুয়ারি। সকাল থেকেই বিশ্ববিদ্যলয় সংলগ্ন ছাত্র এলাকায় আপাত শান্ত পরিবেশের মধ্যেই টগবগ করছিল উত্তেজনা। রােদ ওঠার পর থেকেই বিভিন্ন শিক্ষায়তনের ছাত্রকর্মিগণ তাদের গত রাতের সিদ্ধান্ত ও প্রস্তুতিমাফিক বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আসতে থাকেন। জগন্নাথ কলেজ এবং নবকুমার স্কুলের বেশকিছুসংখ্যক ছাত্রকর্মী সবার আগে মেডিকেল কলেজ হােস্টেলে এসে সমবেত হন এবং পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে গিয়ে জড়াে হতে থাকেন। কেউ কেউ পেছনের রেললাইন ধরে এগিয়ে গিয়েছেন, যাতে কোন প্রকার বাধার সম্মুখীন হতে না হয়। বেলা প্রায় দশটার মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ ছাত্রদের উপস্থিতিতে সরগরম। মধুর ক্যান্টিন ভর্তি হয়েও ছাত্র সমাগম উপচে পড়ছে আমতলার দিকে। উত্তেজিত আলােচনা এবং তর্কবিতর্কে প্রাঙ্গণ উত্তপ্ত। বাইরে রাস্তায় খাকি হাফপ্যান্ট পরা পুলিশ অবস্থান নিয়েছে; কিছু লাঠি হাতে, বাদ বাকি অস্ত্রধারী। পাশে দাঁড়ানাে শাদা পােশাক পরা কয়েকজন। একপাশে পুলিশের জিপ ও পিকআপ ট্রাক। আমতলার সভা শুরু হয় বেলা প্রায় এগারােটার দিকে। সভাপতিত্ব করেন গাজীউল হক। সর্বদলীয় সগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্তমাফিক শামসুল হক আসেন ছাত্রসভায় তাদের সিদ্ধান্ত (১৪৪ ধারা অমান্য না করা) সম্পর্কে ব্যাখ্যা-বক্তব্য রাখতে। এ সময় মধুর রেস্তরাঁর পাশে দাঁড়ানাে কিছুসংখ্যক ছাত্রকর্মী ও নেতার সমর্থন উচ্চারিত হচ্ছিল শামসুল হকের মতামতের প্রতি এদের মধ্যে খালেক নেওয়াজ খান, কাজী গােলাম মাহবুব, হেদায়েত হােসেন চৌধুরী, এস এম নুরুল আলম প্রমুখ অনেকেই ছিলেন। পরনে কালাে শেরওয়ানি, মাথায় জিন্নাহ-টুপি শামসুল হক বক্তৃতা করছিলেন আপােসপন্থার কারণ ও গুরুত্ব সম্পর্কে। কিছু ছাত্রদের উত্তেজিত প্রতিবাদে শেষ পর্যন্ত শামসুল হকের কণ্ঠস্বর তলিয়ে যায় ।
তার বক্তৃতা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। এরপর বক্তৃতা করেন বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আবদুল মতিন। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, ‘আজ ১৪৪ ধারা ভাঙা না হলে ভাষা আন্দোলন তাে বটেই, ভবিষ্যতে কোনাে আন্দোলনই ১৪৪ ধারার ভয়ে এগিয়ে নেয়া যাবে না। দীর্ঘপথ পার হয়ে আন্দোলন বর্তমান পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, এখন পিছিয়ে আসার কোন উপায় নেই।’ সমবেত ছাত্রদের উদ্দেশে তিনি প্রশ্ন রাখেন : “আমরা কি তাহলে ১৪৪ ধারার ভয়ে পিছিয়ে যাবাে?’ জবাবে সমস্বরে উত্তেজিত কষ্ঠের উচ্চারণ : ‘, না”। ঠিক কিভাবে ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে সে সম্পর্কে তিনি বলেন যে, দশজনের ছােট ছােট মিছিল করে সুশৃঙ্খলভাবে এগিয়ে যাওয়া চলে, তাতে ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে। শেষ পর্যন্ত ঐ দশজনী মিছিলের প্রস্তাবই গৃহীত হয়। পরে সভাপতির অতি সংক্ষিপ্ত দুই মিনিটের ভাষণে ঐ সিদ্ধান্ত ঘােষণার মধ্য দিয়ে সভার কাজ শেষ হলাে। তখন বেলা প্রায় বারােটা। দশজনী মিছিল সম্পর্কে আবদুল মতিন বলেছেন যে, ঐ মিছিলের পরিকল্পনা তার নিজস্ব চিন্তা নয়। মােহাম্মদ তােয়াহা এবং আবদুস সামাদকে এ বিষয়ে আলাপ করতে শুনে এই সম্ভাবনা তার কাছে কার্যকরী পরিকল্পনা বলে মনে হয়েছে, আর সেটাই তিনি সভায় প্রস্তাব আকারে উপস্থিত করেন। তার বক্তৃতার পর আরাে দু’একজন সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে। সবশেষে সভাপতির ভাষণ। সভা শেষ হওয়ার পর, অস্বীকার করা চলে না যে, কিছুক্ষণ একটা বিশৃঙ্খল। অবস্থা বিরাজ করতে দেখা গেছে। অর্থাৎ ঠিক কিভাবে কাজ শুরু করা হবে তাই নিয়ে কিছুটা অনিশ্চিত অবস্থা লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু হাবীবুর রহমান শেলী কয়েকজনের সাথে বেরিয়ে যাওয়ার পর আরাে কয়েকজন সারি বেঁধে দাড়িয়ে যান। স্লোগান দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য। এরপর আর কোন অসুবিধা হয় নি। তবু নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রথম ব্যাচ, দ্বিতীয় ব্যাচ, তৃতীয় ব্যাচ অমুক অমুকের নেতৃত্বে বেরিয়ে যাবে এমন সুশৃঙ্খল অবস্থা তখন ছিল না।
সবাই অস্থির কে কার আগে বেরিয়ে যাবে, এমনকি নেতৃস্থানীয় ছাত্রদেরও কেউ কেউ তখন এককভাবে এগিয়ে গেছেন ১৪৪ ধারা ভাঙার তাড়নায় এবং গ্রেফতার বরণ করেছেন। এই অবস্থার প্রমাণ মেলে নেয়ামাল বাসিরের বক্তব্যে তার ভাষায় : মনে আছে ঐদিন কে কার আগে যাবে তাই নিয়ে সাড়া পড়ে যায় ।…আমিও চেষ্টা করেছিলাম ১৪৪-ধারা ভঙ্গকারীদের প্রথম দলে থাকব। কিন্তু বহু চেষ্টা। করেও প্রথম দলের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারিনি।”১০৬ এমনি এক বিশৃঙ্খল টানাটানির পরিস্থিতিতে দেখা গেল যে অনেক পরিচিত। মুখ, যেমন আবদুস সামাদ, আলী আজমল, আনােয়ারুল হক খান এবং আরাে অনেকেই পুলিশের মুখােমুখি হয়ে পরে ধাক্কাধাক্তিতে পুলিশ ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন। এর মধ্যে এক সময়ে ছাত্রীদের ছােট্ট একটি দলকেও এগিয়ে যেতে দেখা গেল। এদের মধ্যে ছিলেন শাফিয়া খাতুন, রওশান আরা বাচ্চু, সুফিয়া ইব্রাহিম, নার্গিস বেগম প্রমুখ ছাত্রী। অবশ্য কোনাে ছাত্রী সেদিন গ্রেফতার হন নি। আন্দোলনের প্রক্রিয়া একবার শুরু হয়ে গেলে উদ্দীপনার বিদ্যুৎ চারদিকে ছড়িয়ে যায়। কারাে মনে তখন আর ভয়ভীতি থাকে না। একসঙ্গে অনেক ছাত্র সেদিন অনেকটা জেদ করেই রাস্তায় নেমে পড়েন, যে কারণে পুলিশের পক্ষে তাদের গ্রেফতার করে ট্রাকে তােলা সম্ভব ছিল না। তাই অব্যাহত ছাত্রস্রোত ঠেকাতে পুলিশ লাঠি হামলা, টিয়ার গ্যাস বর্ষণের অবিরাম তৎপরতা চালিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ তখন ক্রমেই ধুলা আর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে উঠছে। বাতাস কাঁদানে গ্যাসের অত্যাচারে ঝাঁঝালাে। আর সেজন্য ছাত্ররা বেলতলার ডোবায় রুমাল ভিজিয়ে চোখে চেপে ধরতে শুরু করেছে। | এরপর বিক্ষোভ ও সংঘাতের ঘটনা প্রধানত রাস্তায়ই ঘটেছে। ছাত্ররা চেয়েছে পুলিশের বাধা ডিঙিয়ে অন্ততপক্ষে মেডিকেল হােস্টেলে পৌছাতে, সেখান থেকে পরিষদ ভবনের সামনে। কিন্তু পুলিশের লাঠি তাড়নায় অনেকেই কাটাতারের বেড়ার জালে ক্ষতবিক্ষত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন, তা সত্ত্বেও অনেকে লাঠি চালনার ভেতর দিয়ে রাস্তা ধরে দ্রুত এগিয়ে গেছেন; আবার কেউ কেউ রেললাইনের হাঁটাপথে ব্যারাকে, কেউবা ভাঙা পাঁচিল ডিঙিয়ে হাসপাতাল প্রাঙ্গণে। সবারই লক্ষ্য পরিষদ ভবনে পৌছানাে। তাই মুখে মুখে স্লোগান : রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘চলাে চলাে এসেম্বলি চলাে’। খানিক পরে। দেখা গেল, বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ প্রায় ছাত্রশূন্য। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে কেউ কেউ অস্বাভাবিক আবেগ ঝরিয়েছেন, অতিরঞ্জনের চরম প্রকাশ ঘটিয়েছেন, যা বাস্তব অবস্থার সঠিক চিত্রণ নয় (যেমন, টিয়ার গ্যাসের জ্বালায় শত শত ছাত্রের পুকুরে ঝাপিয়ে পড়া ইত্যাদি)।
পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে পুলিশ যেমন লাঠি-টিয়ার গ্যাস চালনায় হিসাব-নিকাশ করে নি, তেমনি কম বয়সী ছাত্রেরা ঢিল-পাটকেল ছুঁড়ে পালটা জবাব দিতে কসুর করে নি। একটি কথা প্রসঙ্গক্রমে বলা দরকার যে, সেদিন ছােট ছােট মিছিল করে এগিয়ে যাওয়ার বিষয়টি মােটেই ‘সত্যাগ্রহের গ্রেফতার বরণের মতাে ঘটনা ছিল (যদিও কেউ কেউ ঐ ঘটনাকে সেভাবে দেখতে ও দেখাতে চেয়েছেন)। কারণ, ইচ্ছাকৃত গ্রেফতার বরণের কোন লক্ষ্য এতে ছিল না, বরং ছিল পুলিশের বাধা অতিক্রম করে পরিষদ ভবনের রাস্তায় হাজির হওয়ার চেষ্টা। গান্ধীবাদী সত্যাগ্রহের কোন চিন্তা বা দৃষ্টিভঙ্গি কারাে মাথায় সেদিন ছিল না। থাকলে কাটাতারের বেড়া ডিঙ্গিয়ে গ্রেফতার এড়ানাের চেষ্টা তারা করতাে না। অন্যদিকে দশজনী মিছিলের প্রথমদিকে নেতৃস্থানীয় কারাে কারাে গ্রেফতার বরণের উদ্দেশ্য ছিল উপস্থিত ছাত্রদের সংঘবদ্ধভাবে ১৪৪ ধারা ভেঙে বেরিয়ে আসতে উদ্দীপ্ত করা। এ উদ্দেশ্য ঠিকই সফল হয়েছিল। ছাত্ররা ছত্রভঙ্গ হয়েছিল পরিষদ ভবনের নিকটতম স্থান মেডিকেল কলেজ হােস্টেলে সংঘবদ্ধ হওয়ার ইচ্ছায়। প্রায় সবাই যেখানে পৌঁছে যাওয়ার পর পুলিশও তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে মেডিকেল হােস্টেলের সামনে ও পূর্বদিকের রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থায় প্রয়ােজন ছিল পরিস্থিতির প্রয়োজনে তাৎক্ষণিকভাবে একটি সংঘবদ্ধ নেতৃত্ব দাঁড় করাতে সচেষ্ট হওয়া। কিন্তু ঐ প্রয়ােজনে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের বা দলবিশেষের ছাত্র নেতাদের, যেমন কাজী গােলাম মাহবুব, খালেক নেওয়াজ খান, হেদায়েত হােসেন চৌধুরী। প্রমুখ কাউকে কাছে পাওয়া যায় নি। তেমনি পাওয়া যায় নি আমতলায় অনুষ্ঠিত ছাত্রসভার সভাপতিকেও। এ বিষয়ে দু’জনের বক্তব্য চিত্তাকর্ষক। অলি আহাদ লিখেছেন : “একজন ছাত্রকর্মীর মারফত জানিলাম যে, ছাত্রসভার সভাপতি জনাব গাজীউল হক কলাভনের দ্বিতলে হঠাৎ করিয়া জ্ঞানশূন্য হইয়া পড়িয়াছেন। তাহাকে দেখিতে যাওয়া প্রয়ােজন । আমি কালবিলম্ব না করিয়া রওয়ানা হইলাম। তাহাকে সাহস হারাইতে মানা করিলাম।
বলিলাম, আপনি এখন সুস্থ হইয়া উঠিয়াছেন। কিছু বিশ্রাম নিয়া মেডিক্যাল হােস্টেল প্রাঙ্গণে আসুন। এই বলিয়া মেডিক্যাল কলেজ হােস্টেলে চলিয়া আসি ।… তাহার উপস্থিতি সংগ্রামের মুহূর্তে এতাে কাম্য হওয়া সত্ত্বেও তিনি আন্দোলনের স্নায়ুকেন্দ্র মেডিকেল কলেজ হােস্টেল এলাকায় উপস্থিত হইতে পারেন নাই। এমন কি ৭ই মার্চ আমার গ্রেফতার হওয়া অবধি গাজীউল হকের সহিত আমাদের আর দেখা হয় নাই।১০৭ অনুরূপ অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেছেন আবদুল মতিন। তিনিও একই কারণে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ ছেড়ে আসার পূর্বে গাজীউল হকের খোঁজ করেন এবং আন্দোলন সংগঠিত করার জন্য তাকে না পেয়ে তিক্ত প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন। এমনকি এরপর আন্দোলনের কোন পর্যায়েই তার সাক্ষাৎ মেলেন নি বলে আবদুল মতিন ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এই প্রসঙ্গের সূত্র ধরে অলি আহাদ পূর্বোক্ত তৃতীয় পক্ষের প্রধান আরাে একজন সম্পর্কে লিখেছেন : ‘পরিতাপের বিষয় ২১শে ফেব্রুয়ারির আন্দোলনের দুর্যোগময় দিনগুলােতে এম,আর, আখতার মুকুল গা-ঢাকা দিয়াছিলেন। শুধু তাই নয়, ২৭শে ফেব্রুয়ারি তিনি কলিকাতায় পাড়ি জমান।১০৭ একথা আজ অস্বীকার করা ঠিক হবে না যে একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখে। ছাত্রদের মধ্যে জঙ্গি, বিস্ফোরক অবস্থা বিরাজ করা সত্ত্বেও আন্দোলন পরিচালনায় সংঘবদ্ধ নেতৃত্ব তথা সাংগঠনিক তৎপরতা যথেষ্ট দুর্বল ছিল। এর কারণ যেমন ১৪৪ ধারা অমান্যের বিষয়ে ছাত্রনেতৃত্বে মতভেদ, তেমনি ব্যক্তি পর্যায়ে কোন কোন ক্ষেত্রে পিছুটানের প্রবণতা কিংবা সাহসের অভাব, যে ইঙ্গিত ব্যক্তিবিশেষের ক্ষেত্রে অলি আহাদ এবং আবদুল মতিনের বক্তব্যে ফুটে উঠেছে। মেডিকেল হােস্টেল প্রাঙ্গণে ও রাস্তায় প্রতিবাদ বিক্ষোভ, গুলি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এবং সামনের রাস্তায় একদিকে পুলিশের লাঠি চালনা এবং টিয়ার গ্যাসের অবিরাম অত্যাচার, অন্যদিকে ছাত্রদের উত্তেজিত স্লোগান ও অগ্রযাত্রার পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে ছাত্র-পুলিশে যে খণ্ডযুদ্ধের সূচনা, বেলা একটার । পর তার আরাে বর্ধমান রূপ দেখা গেল মেডিকেল কলেজ হােস্টেল এবং সামনের। রাস্তা জুড়ে। বলা যায়, এটা ১৬৪ ধারা ভেঙে ফেলে খণ্ডযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্বের ।
পটভূমি তৈরি করে যা অল্প সময়ের মধ্যেই মূল পর্যায়ে পৌঁছেছিল ) _ সেদিন পূর্ববঙ্গ বিধান সভার অধিবেশন, বেলা তিনটায়। পরিষদ সদস্যদের অনেকে হােস্টেলের সামনের রাস্তা দিয়ে যাবেন এ ধারণা সঠিকই ছিল। মেডিকেল । কলেজের অতিতরুণ কিছু ছাত্র মানিকগঞ্জের এম,এল,এ আওলাদ হােসেন এবং সেই সঙ্গে রাজা মিঞাকেও হােস্টেলে ধরে নিয়ে আসে। উদ্দেশ্য, পরিষদের । অধিবেশনে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণের জন্য প্রস্তাব গ্রহণ এবং গণপরিষদে তা পাশ করানাের চেষ্টা, না পারলে সদস্যপদে ইস্তফা। কথাবার্তার ফাকে একসময়ে রাজা মিঞা সরে পড়েন, কিন্তু আওলাদ হােসেনকে ছাত্রদের সব দাবি মেনে নিয়ে মুক্তি অর্জন করতে হয়। অথচ এলিস কমিশনের রিপাের্ট এ বিষয়ে মিথ্যা বিবরণে পরিপূর্ণ। অন্য একদল ছাত্র মন্ত্রী হাসান আলীর গাড়ি আটক করে। অবশেষে পুলিশের সহায়তায় মন্ত্রী মুক্তি পান, কিন্তু কয়েকটি অল্পবয়সী ছেলের ঢিলে গাড়ির কাচ ভাঙে এবং মন্ত্রী আহত হন। আরাে কয়েকজন পরিষদ সদস্যকে ছাত্রদের কাছে বাংলা রাষ্ট্রভাষার জন্য প্রতিশ্রুতি দিতে হয়। এসব ঘটনার ফাঁকে ফাঁকে চলেছে পুলিশের লাঠি চালনা ও টিয়ার গ্যাস বর্ষণ এবং পালটা অল্পবয়সী ছাত্রদের ইট-পাটকেলের জবাব। হােস্টেল প্রাঙ্গণ থেকে ক্রমাগত ভেসে আসছে অবিরাম ধ্বনি রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘রাজবন্দীদের মুক্তি চাই’, ‘পুলিশী জুলুম চলবে না’ ইত্যাদি। দুপুর গড়িয়ে চলছে তবু সংঘাতের অবসান নেই। ছাত্রদের আপ্রাণ চেষ্টা দল বেঁধে রাস্তায় বেরিয়ে দ্রুত পরিষদ ভবনের সামনে সংঘবদ্ধ হওয়া। কিন্তু পুলিশের বাধা ও আক্রমণে তা সম্ভব হচ্ছে । হােস্টেলের ভেতরে ও বাইরে ছাত্রদের তৎপরতা যতই বাড়তে থাকে পুলিশের লাঠি চালনা ও কাঁদানে গ্যাসবর্ষণের ক্রমবর্ধমান তীব্রতার মধ্য দিয়ে তাদের ধৈর্যচ্যুতির লক্ষণও প্রকাশ পেতে থাকে একটি সত্য স্বীকার করতে হয় যে, সেই দুপুরের খণ্ডযুদ্ধে ছাত্রদের পক্ষে সুশৃঙ্খল ও সংঘবদ্ধ তৎপরতার অভাব ছিল। সংশ্লিষ্ট একজনের বক্তব্য ধার করে বলা যায় : উপস্থিত ছাত্রগণ বিশৃঙ্খলভাবে তাদের লক্ষ্য পরিষদ ভবনের দিকে এগিয়ে যাবার চেষ্টা চালিয়েছে এবং ঘণ্টা বেজে চলেছে, তবু সেই বিক্ষোর সময় কাজে লাগাবার মত নায়ক, কিংবা ছাত্র জনতাকে সংগঠিতভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবার মত কোন নেতাই তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন না।১০৮ এই বিশৃঙ্খল অবস্থা অন্তত ঘণ্টা দুই স্থায়ী হয়েছিল।
বেলা গড়ানাের সাথে । সাথে জনসমাগমও বাড়তে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে, মেডিকেল কলেজ গেটের। সামনে, বিশেষ করে পাম্প হাউস সংলগ্ন ত্রিকোণ স্থানটিতে এবং রাস্তা ও হােস্টেলে ছাত্র-জনতার অবস্থান ক্রমশ শক্তিশালী হতে থাকে। হাসপাতালের ওয়ার্ড বয় এবং রাস্তার ওপরে দাঁড়ানাে মেকো-পপুলার-নাজমা ইত্যাদি। হােটেলগুলাের বয়-বেয়ারা-বাবুর্চি থেকে শুরু করে আশপাশের নানা বয়সী। লােকের উপস্থিতি জনসংখ্যার আয়তন বাড়িয়ে দিচ্ছিল। মনে হয় চতুর্থ শ্রেণীর। কর্মচারীসহ সেক্রেটারিয়েটের রেশ কিছুসংখ্যক রাজনীতিসচেতন উৎসাহী কর্মচারীও এসে পড়েছিলেন অবিরাম টিয়ার গ্যাস শেল ফাটার আওয়াজ শুনে এবং ইতােমধ্যেই ঘটনার পল্লবিত বিস্তারের টানে। এই উপলক্ষে এখানে একটি কথা বলে রাখা দরকার যে ঢাকা শহরে স্কুলকলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এবং ছাত্র-এলাকার বাইরে সেদিন বড় একটা হরতাল পালিত হয় নি; কিন্তু মফস্বলে সর্বত্র, বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, পাবনা, যশাের, দিনাজপুর ইত্যাদি স্থানে পরিপূর্ণ হরতাল পালিত হয় এবং সভা-বিক্ষোভ-মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। অবাক হওয়ার মতাে হলেও সত্য যে সেদিন সুদূর দিনাজপুর থেকে বেশ কিছুসংখ্যক ছাত্র ঢাকায় আসেন একুশের বিক্ষোভে যােগ দিতে (আবদুল মতিন)। পুলিশের সাথে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষের এই পটভূমিতে বেলা তিনটার পর পুলিশ বেশ কয়েক রাউন্ড গুলিবর্ষণ করে রাস্তায় হাসপাতাল গেটের বিপরীত দিকে বিশ্ববিদ্যালয় মাঠের কোণায় সমবেত ছাত্র-জনতার দিকে এবং মেডিকেল কলেজ হােস্টেল প্রাঙ্গণে সমবেত ছাত্রদের দিকে লক্ষ্য করে। পুলিশ কত রাউন্ড শুলিবর্ষণ করেছিল তা যেমন বলা কঠিন, তেমনি পুলিশ হােস্টেল গেটের ভেতরে ঢুকে গুলি ছুঁড়েছিল কি না সেই বিষয়ক মতভেদ দূর করা আজকের দিনে আরাে কঠিন, যদিও এলিস কমিশনের মিথ্যা বিবরণে ভরা প্রতিবেদনে এই দুটি বিষয়েই যেসব তথ্য রয়েছে তা মূলত সরকার পক্ষের বক্তব্য। তবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, পুলিশ হােস্টেল-গেটের কিছুটা ভেতরে। ঢুকেই গুলি চালিয়েছিল। | এলিস কমিশনের রিপাের্টে স্বীকার করা হয় নি যে পুলিশ হােস্টেলের ভেতরে। ঢুকে গুলি চালিয়েছে।
কিন্তু তখনকার ব্যারাক ধরনের মেডিকেল কলেজ হােস্টেলের অবস্থান মনে রাখলে নিশ্চিতই প্রশ্ন ওঠে যে, পুলিশ সত্যই যদি কলেজ গেট এবং হােস্টেল গেটের মধ্যবর্তী রাস্তায় অবস্থান নিয়ে গুলি করে থাকে (যা এলিস কমিশনের রিপাের্টে বলা হয়েছে) তা হলে বিশ নম্বর শেডের সামনে দাঁড়ানাে আবদুল জব্বার কেমন করে গুলিবিদ্ধ হতে পারেন কিংবা বিশ নম্বর। শেডের কিছু কিছু স্থানে গুলির আঘাত চিহ্নই-বা কেমন করে আসে? এলিস কমিশনের রিপাের্টে বলা হয়েছে, পুলিশ একাধিকবার গুলিবর্ষণ করেছে। তাতে মনে হয়, পুলিশ প্রথম রাস্তা থেকে এবং পরে হােস্টেল গেটের মুখে বা সামান্য ভেতরে ঢুকে গুলি চালিয়েছে। ফলে গুলি হােস্টেলের অনেক ভেতরে লক্ষ্যবস্তুর ওপর আঘাত হানতে পেরেছে। এই ধারণা আরাে নিশ্চিত হয় এই জন্য যে এলিস কমিশনের রিপাের্ট এবং সরকারি বিবরণে দেখা যায় যে প্রথমবার গুলিবর্ষণের পরও ছাত্রদের নিরস্ত করা যায় নি, তারা ইট-পাটকেল হাতে পুলিশ বাহিনীকে আক্রমণের জন্য ছুটে এসেছে। এতে মনে হয় প্রথমবার বা প্রথম রাউন্ড গুলিবর্ষণে হােস্টেলের ভেতরে কেউ হতাহত হয় নি, হয়েছেন বাইরে মাঠের দিকে দাঁড়ানাে ছাত্র-জনতার কেউ (যা প্রত্যক্ষদর্শী কারাে কারাে স্মৃতিচারণে দেখা যায়) এবং ভেতরে হতাহত হওয়ার ঘটনা প্রধানত পরবর্তী পর্যায়ের গুলিবর্ষণে, যা গেটের ভেতরে ঢুকেই করা হয়েছিল বলে আমাদের বিশ্বাস। | গুলিবর্ষণের আগে পুলিশ অনেকক্ষণ ধরে যথেষ্ট কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়েছে, এমনকি হাসপাতাল প্রাঙ্গণও অব্যাহতি পায় নি। সেই লাগাতার শেল ফাটার ফটাস ফটাস শব্দে ছাত্ররা ভয় পেয়েছে বলে মনে হয় নি। বরং কয়েকজন সাহসী ছেলেকে টিয়ার গ্যাসের আ-ফাটা শেল তুলে নিয়ে দ্রুত পুলিশের দিকে ছুঁড়ে মারতে দেখা গেছে। তাছাড়া সত্যি বলতে কি ছাত্রদের কেউ ভাবতে পারে নি যে, পুলিশ গুলি চালাতে পারে। তাই সত্যিকার গুলির শব্দ শুনেও ভেবেছে ‘টিয়ার গ্যাসের শেল ফাটছে। কেউ কেউ তখন চিৎকার করে বলে উঠেছে ‘ফাকা আওয়াজ, ফাকা আওয়াজ ।) | তাই পুলিশ ছাত্রদের সতর্ক করে দেয়ার পর ফল না পেয়ে গুলি ছুঁড়েছে’ সরকারের এবং এলিস কমিশনের এই দাবি সঠিক নয়; অন্তত তখন অকুস্থলে উপস্থিত প্রত্যক্ষদর্শীদের হিসেবে তাে নয়ই।
সে যাই হােক, শব্দগুলাে যে কাদানে গ্যাসের শেল ফাটার আওয়াজ নয় তা বােঝা গেল সামনে কয়েকজনকে পড়ে যেতে এবং রক্তাক্ত হয়ে উঠতে দেখার পর। তখন বেলা তিনটার মতাে হবে। সেই উত্তেজিত বিস্ফোরক মুহূর্তে গুলি চালনার সঠিক সময় ধরে রাখার কথা নয়, কেউ ধরেও রাখেনু নি। সরকারি নথি ও এলিস কমিশনের রিপাের্ট মতে সময় তিনটা বিশ মিনিট / | পুলিশ যে সময় গুলি চালনার প্রস্তুতি নিচ্ছে, এদিকে সে সময় বিরাজমান। উত্তেজক পরিস্থিতিকে কিভাবে কাজে লাগানাে যায় এবং সহযােগীদের নিয়ে। একটি কার্যকরী পথ বের করা যায় সেই চিন্তায় অস্থির আবদুল মতিন তখনও মধুর ক্যান্টিনে দাঁড়ানাে; কয়েক মিনিট আগে অলি আহাদ ভাঙা পাঁচিল পথে মেডিকেল হােস্টেলের দিকে রওয়ানা হয়ে গেছেন; ঠিক সেই মুহূর্তে একজন ছাত্র ছুটে এসে তাকে খবর দেয় : মেডিকেল হােস্টেলে গুলি চলেছে, অনেক হতাহত হয়েছে। পরবর্তী ঘটনা, আবদুল মতিনের ভাষায় : ভাঙা পাঁচিল টপকে মেডিকেল হােস্টেলের দিকে ছুটে গেলাম। অলি আহাদও সেদিকে গেছে। পথে দেখি, একটি ছেলেকে কয়েকজন মিলে ধরাধরি করে ইমারজেন্সিতে নিয়ে আসছে, ওর প্যান্ট ডিজে রক্ত চুইয়ে পড়ছে। চারদিকে বড় বিশৃঙ্খল অবস্থা। | এই গুলিবর্ষণ এবং তার ফলে সঘটিত কয়েকটি মৃত্যু আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট নেতাদের ছােটবড় মাঝারি সব আয়তনের ছাত্র নেতার মনে গভীর ও উত্তাল আবেগের জন্ম দিয়েছিল। তাই তাদের অনেকেরই চোখে দেখা যায় পানি, কেউ কেউ কান্নায় উদ্বেল। এই আবেগ ছাত্র ও জনতার মনে সেতু বন্ধের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছিল। গুলিবর্ষণের প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি আমরা পরে আলােচনা করছি। হতাহতের খতিয়ান : নানাজনের ভুলভ্রান্তি সত্যি বলতে কি পুলিশের গুলি চালনা শহর ঢাকার মানুষের জন্য ছিল এক অভাবিত ঘটনা। তাৎক্ষণিকভাবে হতাহতের সংখ্যা লােকমুখে এক অস্বাভাবিক স্তরে পৌঁছেছিল। আর অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে গুলিতে নিহত শহীদদের বিবরণ দিতে গিয়ে তৎকালীন পত্র-পত্রিকা যেমন ভুল-ভ্রান্তির শিকার হয়েছে, তেমনি হয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও লেখকগণ । সব মিলিয়ে দেখা যায় যে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস রচনায় এবং স্মৃতিচারণে এই বিশেষ দিকটিতে বিস্তর ভুল তথ্যের সমাবেশ ঘটেছে। ইতিহাসের স্বার্থে এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের পাঠকের স্বার্থে এর সংশােধন প্রয়ােজন। এ ধরনের তথ্যগত ভুল কম-বেশি।
আন্দোলনের বেশ কিছু ঘটনাবলির ক্ষেত্রে সত্য। আশ্চর্য যে পরবর্তীকালের কথিত। গবেষকদের কারাে কারাে লেখায়ও তথ্য বিভ্রান্তি কম নয়। বিষয়টি আরাে গুরুতর হয়ে ওঠে যখন সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে সেই ভুলের ভূত আশ্রয় পায়। কারণ, সাধারণভাবে আমরা সংবাদপত্রে পরিবেশিত তথ্যাদি সত্য বলে ধরে নিই । তবে রক্ষা এইখানে যে সংবাদপত্রের তথ্যগত ভুলের সংখ্যা ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণের ভুলত্রুটির তুলনায় অনেক কম। স্বভাবতই আমরা ঐসব ভুলত্রুটি সংশােধনের চেষ্টার মধ্য দিয়ে ইতিহাস সঙ্কলনের কাজটি যথাসম্ভব। নির্ভুলভাবে সম্পাদনের চেষ্টা করেছি। বাইশে ফেব্রুয়ারি সংখ্যা দৈনিক আজাদ’-এর এক প্রতিবেদনে সালাহউদ্দিন নামক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রের কপালে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে নিহত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। সম্ভবত আজাদ’ পত্রিকার এই তথ্যের ওপর নির্ভর করে অনেকেই তাদের রচনায় ৰা স্মৃতিচারণে শহীদ সালাহউদ্দিনের নাম উল্লেখ । করেছেন। সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’ পত্রিকায়ও এই ভুল দেখা গেছে। অনেকেই মনে করেন এরও উৎস দৈনিক আজাদ’। এধরনের ভুলের পরিণতি যে কতখানি। গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে তার প্রমাণ আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত বেশ কয়েকজন। বিশিষ্ট ব্যক্তি তাদের লেখায় ও স্মৃতিচারণে এই ভুলের শিকার হয়েছেন। কিন্তু এ বিষয়ে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সংগঠক অলি আহাদ, অন্তত যার কাছ থেকে এধরনের ভুল আশা করা যায় না। অথচ তিনি যে পরিমাণ আস্থার সাথে ভুল বিবরণ পেশ করেছেন তা নিঃসন্দেহে ইতিহাসের জন্য বিপজ্জনক। কারণ তার জাতীয় রাজনীতি’ বইটি সচরাচর উদ্ধৃতির উৎস। উল্লিখিত বিষয়ে অলি আহাদ লিখেছেন :
‘হােস্টেল গেইট সংলগ্ন ১১নং ব্যারাকের পার্শ্বে অবস্থানরত আবুল বরকত বুলেট-বিদ্ধ হইয়া ভূতলে পতিত হন। আমরা সাদা সার্ট ও পায়জামা পরিহিত আবুল বরকতকে রক্তাপুত ও ভূলুণ্ঠিত অবস্থায় দেখিতে পাই। তাহাকে ধরাধরি করিয়া হাসপাতালের উত্তর দিক প্রবেশদ্বার পর্যন্ত পৌঁছাইয়া হােস্টেল অভিমুখে রওয়ানা দিতেই দেখিতে পাই যে সংগ্রামী বন্ধুরা আর একটি লাশ পাঁজাকোল করিয়া আনিতেছে। নিকটবর্তী হইয়া মাথার দিকের কাপড় তুলিতেই দেখিতে পাইলাম ছাত্রবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ. ক্লাসের ছাত্র সালাহউদ্দিনের মাথার খুলি নাই । কি হৃদয় বিদারক দৃশ্য!” । এই গুটিকয়েক ছাত্রের বক্তব্যে বিস্তর ভুলের উপস্থিতি নিতান্তই ইতিহাসের স্বার্থে আমরা উল্লেখ করতে চেয়েছি। কোন ব্যক্তিগত কারণের ভিত্তিতে নয় । আরাে কয়েকটি ক্ষেত্রে ব্যক্তির প্রশ্ন এসেছে এমনি সত্য ঘটনা বা সঠিক তথ্যাদি পরিবেশনের দায়ে, কোন ব্যক্তিস্বার্থে বা প্রতিযােগিতামূলক মনােভাবের কারণে নয়। প্রথমত, মেডিকেল কলেজ হােস্টেরের উত্তর-পূর্ব দিকের অর্থাৎ যাতায়াতের প্রধান গেট সংলগ্ন ব্যারাক তথা শেডের নম্বর ছিল বারাে, অলি আহাদ কথিত এগারাে নয়। হয়তাে-বা এটা ছাপার ভুলও হতে পারে; কিন্তু তাই বলে রঙিন হাফ শার্ট ও খাকি প্যান্ট পরিহিত আবুল বরকতকে তিনি কীভাবে শাদা শার্ট ও পায়জামা পরিহিতি অবস্থায় দেখতে পেলেন তা মােটেই স্পষ্ট নয়। এ সম্পর্কে। বরং শহীদ বরকতের পরিচিত মিঞা মােহনের বিবরণ আমাদের বিচারে অপেক্ষাকৃত সঠিক মনে হয় যদিও তিনি বারাে নম্বর শেডটিকে বিশ নম্বর বলে উল্লেখ করেছেন (হয়তাে অচেনা হওয়ার কারণে)। যাই হােক আমাদের মনে হয়। মিঞা মােহনের বিবরণই আবুল বৱকত সম্পর্কিত অলি আহাদের বক্তব্যের ভুলত্রুটি শনাক্ত করার পক্ষে যথেষ্ট হবে। মিঞা মােহনের ভাষায় : ‘২০নং ব্যারাকের মাঝামাঝি কামরায় দাড়িয়ে জিরােচ্ছিলাম । আমার দিকে এগিয়ে এলেন বরকত। কিন্তু পড়ে গেলেন সাথে সাথে আমার হাত খানেক দূরে। পুলিশ ঢুকে পূর্ব দিক থেকে সােজা গুলি ছুঁড়েছে। তল পেটে লেগেছে গুলি। গায়ে ছিল তার নীল রং-এর ফ্লাইং হাফসার্ট, পরনে খাকি প্যান্ট। তখন তার দুই ঠ্যাং শফিকুর রহমান কাঁধে তুলে নিলেন আর মাথা নিলাম আমার কাধে ।…হােস্টেলের পায়খানাগুলাের কাছ দিয়ে হাসপাতালে যাবার যে ছোট পেটটা ছিল তার কাছে আসতে দু’তিনজন এগিয়ে এলেন সাহায্য করতে।’১০৯
দেখা যাচ্ছে যে মিঞা মােহন ও মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র শফিকুর রহমান গুলিবিদ্ধ আবুল বরকতকে হােস্টেল থেকে হাসপাতালে যাওয়ার হােট গেট দিয়ে এমারজেন্সিতে নিয়ে গেছেন এবং গেটের কাছে আরাে দুই একজন (মেডিকেল কলেজের ছাত্র যা তাদের বক্তব্যে প্রকাশ পেয়েছে) এসে তাদের সাথে যােগ দিয়েছেন (অলি আহাদের মতাে সুপরিচিত ছাত্র-যুব নেতার উপস্থিতি মিঞা মােহনের ভুলে যাওয়ার কথা নয়)। হাসপাতালে যাওয়ার এই ছােট্ট সংক্ষিপ্ত পথ ব্যবহার করাটাই একাধিক কারণে স্বাভাবিক। কেননা, বাইরে রাস্তায় তখন অস্ত্রসজ্জিত পুলিশ প্রহরা; সেক্ষেত্রে আহত সঙ্গীকে নিয়ে অলি আহাদ কথিত উত্তরদিকস্থ হােস্টেলের প্রধান গেট দিয়ে পুলিশ বেষ্টিত রাস্তা পেরিয়ে কলেজ গেট (যা এখন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে) দিয়ে হাসপাতালে ঢােকার প্রশ্ন যেমন অবান্তর তেমনি অসম্ভব। তাছাড়া তখনকার হােস্টেলের ছাত্র সবাই হােস্টেল থেকে হাসপাতালে যেতে বড় রাস্তার বদলে বরাবরই এই ছােট্ট সরু পথই ব্যবহার করতেন। তাই অলি আহাদের বিবরণ একেবারেই গ্রহণযােগ্য নয়।
কিন্তু অলি আহাদের ঐ লেখায় এর চেয়েও মারাত্মক অসঙ্গতি ও ভুল দেখা যায় কল্পিত সালাহউদ্দিন নামক ছাত্রের শাহাদাত নিয়ে, যে সম্পর্কে অধিকাংশ লেখক একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করেছেন। সম্ভবত এই ভুলের উৎস ২২ ফেব্রুয়ারির দৈনিক আজাদ-এর প্রতিবেদন, যেখানে বলা হয়েছে : গতকাল (বৃহস্পতিবার) বিকাল ৪টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হােস্টেল প্রাঙ্গণে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বিক্ষোভরত ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলি চালনার ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ. ক্লাসের ছাত্র মােহাম্মদ সালাউদ্দিন (২৬) ঘটনাস্থলে নিহত এবং বহুসংখ্যক পথচারী আহত হয় ।…আহতদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল জব্বার (৩০), আবুল বরকত (৩৫) ও বাদামতলী কমার্সিয়াল প্রেসের মালিকের পুত্র রফিকুদ্দিন আহমদের (২৭) মৃত্যু হয়।’… আজাদ-এর ঐ একই প্রতিবেদনে কিছুটা বিশদভাবে বলা হয় যে : ‘গুলিবর্ষণের সঙ্গে সঙ্গে হােস্টেলের ভিতরে কয়েকটি শেডের বারান্দায় কয়েকজন ছাত্রকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়িয়া থাকিতে দেখা যায় । ১২নং শেডের বারান্দায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সালাহউদ্দিনকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। একটি বুলেট তাহার কপালে বিন্ধ হইয়া মাথার খুলি উড়াইয়া লইয়া গিয়াছিল। এমনকি ‘আজাদ’-এ প্রকাশিত নিহতদের তালিকায়ও চারজনের মধ্যে প্রথম নাম ‘সালাহউদ্দিন-এর। অথচ মাথায় গুলিবিদ্ধ শহীদ প্রকৃতপক্ষে রফিকুদ্দিন, মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজের ছাত্র এবং বাদামতলীর কমার্শিয়াল আর্ট প্রেসের মালিকের পুত্র। এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যে আমরা পরে আসছি। কিন্তু একজন পত্রিকা রিপাের্টারের কলমে কেমন করে যে রফিকুন্দিন সালাহউদ্দিন হয়ে যায় এবং পরে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পত্রিকায় কোন সংশােধনী বের হয় না, সে রহস্য বুঝে ওঠা দায়।
এই ভুল তথ্যই উল্লিখিত সব ভ্রান্তির কারণ। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম এ সম্পর্কে আজাদ’-এর প্রতিবেদন উদ্ধারের পরও নির্বিচারে আরাে কিছু বক্তব্য সংযােজন করেছেন এই বলে যে : শহীদ সালাউদ্দিনের লাশ মেডিকেল কলেজের এপ্রােনপরা পুরুষ নার্স ও ওয়ার্ডবয়রা এম্বুলেন্সে করে তুলে নিয়ে আসেন, তার লাশ নামান হয় মেডিকেল কলেজের মাঝখানের গেটের গাড়ি বারান্দায়। নার্স ও ওয়ার্ডবয়রা ক্রোধে চীকার করে শ্লোগান দিতে দিতে স্ট্রেচারে করে লাশটি গাড়ি থেকে বারান্দায় নামালে এক বীভৎস ও করুণ দৃশ্যের অবতারণা হয়। বুলেটে উড়ে যাওয়া সালাউদ্দিনের খুলি থেকে তখনও ধোঁয়া বেরুচ্ছে, গলিত মগজ বেয়ে পড়ছে।১০৯ আমরা কিছুতেই বুঝতে পারি না ওইসব তথ্য লেখক কোথায় পেলেন? কারণ কপালে গুলিবিদ্ধ শহীদের লাশ হােস্টেল প্রাঙ্গণ থেকে স্ট্রেচারে করে এমারজেন্সিতে নিয়ে যান কয়েকজন মেডিকেল ছাত্র ঐ ছােট্ট গেট দিয়ে। শুধু তাই নয়, বদরুদ্দিন উমরও একই বিষয়ে মােস্তফা রওশন আখতারের বিবরণ তার বইতে উদ্ধার করে পাদটীকায় বলেছেন : ‘এই মৃতদেহটি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সালাহুদ্দিনের’ (পৃ. ২৮৮) এবং বলেছেন ১৯৮৫ সালে পৌছে। অথচ অনেক আগেই রফিকুদ্দিনের মাথায় গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে; সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। | কিন্তু সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন অলি আহাদ তার “জাতীয় রাজনীতি’ গ্রন্থে। হয়তাে আজাদ-এর প্রতিবেদনই তার মনে ছিল। পরবর্তী সময়ে মাথায় গুলিবিদ্ধ ছাত্রটি রফিকুদ্দিন হিসাবে প্রতিপন্ন হওয়ার খবর তিনি রাখেন নি। কিন্তু তাই বলে।
খুলি-উড়ে যাওয়া রফিকুদ্দিনকে তিনি ছাত্রবন্ধু সালাউদ্দিন’ বলে চিনে নিলেন কেমন করে সে রহস্য মােটেই স্পষ্ট নয়। আসলে সালাহউদ্দিন নামে কোন ছাত্র আদৌ শহীদ হয়েছেন কি না সে বিষয়ে অনেক আগেই সন্দেহ দেখা দেয় এবং শহীদ রফিকুদ্দিনের মাথায় গুলিবিদ্ধ হওয়ার সত্যতা প্রমাণিত হবার পর সালাউদ্দিনের শাহাদত বরণের প্রশ্ন পরােক্ষে বাতিল হয়ে যায়। তবু অনেকেই পূর্বোক্ত ধারণা ধরে রাখেন। শুধু সালাহউদ্দিনই নন, আরাে দুই একজন সম্পর্কে মূলত ঐ প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করে, কিন্তু প্রত্যক্ষ দর্শনের বরাত দিয়ে, সঠিক তথ্য পরিবেশনের বদলে অলি আহাদ কাহিনী রচনা করেছেন যা আদৌ সঠিক ইতিহাস নয়। তাছাড়া সফিউর রহমানকেও তিনি ভুলক্রমে একুশ তারিখের শহীদ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন (পৃ. ১৫৭)। আশা করা যায় অলি আহাদের এ গ্রন্থটির পরবর্তী সংস্করণে এসব ভুলভ্রান্তি সংশােধিত হবে। | মাথায় গুলি লেগে খুলি উড়ে গিয়ে মগজ বেরিয়ে আসে যে ছাত্রটির তিনি যে সালাহউদ্দিন নন বরং রফিকুদ্দিন এ তথ্য অনেক আগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় তরুণ রফিকুদ্দিনের লাশ শনাক্ত করেছিলেন তারই। ভগ্নিপতি মােবারক আলী খান, কিন্তু সে পরিচয় তিনি তখন প্রকাশ করেন নি।
পরে তা জানাজানি হয়। কিন্তু আমাদের হাতে যে তথ্য রয়েছে তা ১৯৭২ সালে দৈনিক বাংলার বাণী’ কাগজে প্রকাশিত একটি সচিত্র প্রতিবেদন, যেখানে মােবারক আলী খান শহীদ রফিকুদ্দিনের মাথায় গুলি-লাগা লাশ শনাক্ত করার কাহিনী সবিস্তারে বলেছেন। কয়েক বছর পর সাংবাদিক আহমেদ নূরে আলম মােবারক আলী খানের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে উক্ত ঘটনার সত্যতা প্রতিপন্ন। সেই গুলিবিদ্ধ লাশ বহনের সাক্ষ্য মেলে মেডিকেল কলেজের একাধিক ছাত্ররুমীর জবানবন্দিতে। হুমায়ুন কবির হাই তখন মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র, আঠারাে নম্বর শেডের দশ নম্বর কক্ষে থাকেন। গুলিবিদ্ধ রফিকুদ্দিন সম্বন্ধে তার জবানবন্দি : “বিকেল তিনটার দিকে হােস্টেলের গেটের কাছে একজনকে গুলিবিদ্ধ হতে দেখেছি (সম্ভবত আবুল বরকত—লেখকদ্বয়)। আর মাথার খুলি উড়ে যাওয়া একজন শহীদের লাশ আমরা প্রথমে ইমারজেন্সিতে, পরে এনাটমি হলের পেছনে বারান্দায় নিয়ে আসি । তার একটা ফটো নেওয়া হয় এবং সে ফটোর কপি আমার কাছে ছিল। পরবর্তীকালে তা ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। অধুনা প্রখ্যাত আলােকচিত্রশিল্পী আমানুল হকও তুলেছিলেন রফিকের লাশের ছবি।১১০ এবার আঠারাে নম্বর শেডের নয় নম্বর কক্ষের অধিবাসী তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মশাররফুর রহমান খানের বক্তব্য : তখন বেলা ঠিক কয়টা মনে নেই, হঠাৎ কয়েকটা আওয়াজ। তাকিয়ে দেখি একটি তরুণ হস্টেলের মাঝখানের রাস্তার ওপর পড়ে গেছে, ওর পা-দুটো দক্ষিণ দিকে, মাথা উত্তরদিকে। ছুটে কাছে গিয়ে দেখি, ওর মাথায় গুলি লেগেছে। ব্রেইনটা ছিটকে পড়েছে। কয়েকজন ছুটে যায় স্ট্রেচার আনতে। দুই হাতে ‘ব্রেইন”টা তুলে ওর পাশে রাখি। আমি, হুমায়ুন হাই, মুর্শেদ এবং আরাে দুই একজন মিলে ওকে এমারজেন্সিতে নিয়ে যাই, পরে এনাটমি হলের। পেছনের বারান্দায়।”১১১ মাথায় গুলিবিদ্ধ শহীদ রফিকুদ্দিনের একটি ছবি (আলােকচিত্র) বর্তমান লেখক আহমদ রফিকের সংগ্রহেও ছিল, যা ১৯৫৪ সালের ৯২-ক ধারার রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার কারণে হারিয়ে যায়।
সালাহউদ্দিন বনাম রফিকুদ্দিন প্রসঙ্গে আর একটি তথ্য উদ্ধার করে এ প্রসঙ্গ শেষ করছি। বাংলা একাডেমীর গ্রন্থাগারিক মুহম্মদ আবদুর রাজ্জাকের জবানীতে জানা যায় যে ‘আজাদ’ পত্রিকার কল্যাণে সালাহউদ্দিনের শাহাদত বরণের খবর প্রকাশিত হওয়ার কয়েকদিন পর জনাব সালাহউদ্দিন সশরীরে তার কর্মস্থলে এসে সবার সাথে দেখা করেছিলেন।১১৯ মেডিকেল কলেজের একাধিক ছাত্রের উল্লিখিত বিবরণের পর কি বদরুদ্দীন উমরের গ্রন্থে (পূর্ববাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৮৭-৮৮) উদ্ধৃত এম,আর, আখতার মুকুলের সাক্ষাৎকার-বক্তব্য গ্রহণযােগ্য বলে মনে করা সম্ভব? জনাব মুকুলের ভাষ্যে বলা হয়েছে। “আমি যাকে carry করে নিয়ে গিয়েছিলাম তার কোন skull ছিলাে না। তাকে আমি মেডিকেল কলেজ হােস্টেলের লনে পেয়েছিলাম। মেডিকেল কলেজ হােস্টেলের menial রা বডিটা তুলেছিল। কোনাে রক্ত ছিল না, কিন্তু মগজটা আলাদা পড়েছিলাে। একজন ধাঙড় সেই মগজটা হাতে করে তুলে স্ট্রেচারে রেখেছিলাে। আমি আর একজন একদিকে, অন্যদিকে একজন ধাঙড়। এই বডিটা এমাকজেন্সিতে অনেকক্ষণ ছিল।” মাথায় গুলিবিদ্ধ শহীদ রফিকুদ্দিনকে এমারজেন্সিতে নিয়ে যাওয়ার কোন বিবরণ সঠিক বলে গ্রহণ করা যাবে। মেডিকেল কলেজের তকালীন একাধিক নেতৃস্থানীয় ছাত্রের সাক্ষ্য অবশ্য হুমায়ুন হাই, মশাররফ প্রমুখের পক্ষে। তবে এক্ষেত্রে অবিশ্বাস্য বিষয়টি হলাে ধাঙড় প্রসঙ্গ। হােস্টেলে প্রবল আন্দোলনের মধ্যে তাৎক্ষণিকভাবে ধাঙড় আসবে কোথেকে। মশাররফের একাধিক জবানিতে ছিটকে-পড়া মগজ দুহাতে স্ট্রেচারে তুলে রাখার শিহরণ জড়ানাে অনুভূতির কথা বলা হয়েছে যা অস্বীকার করা চলে না। ড. হুমায়ুন হাই এখনাে প্রসঙ্গত সে ঘটনার ভয়াবহতার কথা উল্লেখ করে থাকেন। আর স্ট্রেচার প্রসঙ্গেও জনাব মুকুলের অতিশয়ােক্তির উল্লেখ না করে পারা যায় । ঐ সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, এমারজেন্সিতে গিয়ে স্ট্রেচারের কথা বলার পর প্রায় ৪০টার মতাে স্ট্রেচার বের হয়েছিল। তখনকার যেকোনাে মেডিকেল ছাত্রের কাছে স্ট্রেচারের সংখ্যাটা অবিশ্বাস্য মনে হবে। এমারজেন্সি দূরে থাক সেকালের গােটা হাসপাতালে তল্লাশ করে চল্লিশটা স্ট্রেচার খুঁজে পাওয়া অসম্ভবই ছিল। আসলে আবেগ-উত্তেজনাই সম্ভবত শহীদদের নিয়ে একাধিক ক্ষেত্রে এ জাতীয় কল্পকাহিনী জন্ম দিয়েছিল। বলা যায় এখনাে দিচ্ছে।
তা না হলাে প্রথম আলাে’তে (২০,২.২০০৪) কাজী গােলাম মাহবুব কেমন করে ঐ একই মৃত্যু উপলক্ষে এক উদ্ভট বিবরণ লিখতে পারলেন! তার ভাষায় “আমার ঠিক পেছনে যে দাড়িয়ে ছিল দেখলাম হঠাৎ সে পড়ে গেলাে। তার মাথায় গুলি লেগেছিল। আমি হতবাক হয়ে গেলাম। সংহতি ফিরে পেতেই দেখলাম, আমি তাকে জড়িয়ে ধরে আছি। তাকে বাঁচানাের জন্য মেডিকেল কলেজে ছুটে চলেছি। কিন্তু জরুরি। বিভাগে নেয়ার আগেই সে মারা গেল।” এ উদ্ভট গল্পের বিশ্বাসযােগ্যতা পাঠকই বিচার করতে পারবেন। মাথায় শুলিলাগা মানুষ, যার মগজ মাটিতে ছিটকে পড়েছে তাকে কি বাঁচানাের কোনাে অবকাশ থাকে, কিংবা সে উদ্দেশ্যে তাকে জড়িয়ে ধরে এমারজেন্সিতে ছুটে যাওয়া সম্ভব? বাহান্ন বছর পর প্রবীণ আইনজীবী কাজী গােলাম মাহবুব এমন একটি গল্প লিখতে গেলেন কেন, সেটাই আমাদের প্রশ্ন এবং বিস্ময়! কিন্তু গল্প কখনাে ইতিহাস হতে পারে না। ইদানীং প্রতি ফেব্রুয়ারিতেই একুশের ঘটনাবলী নিয়ে এধরনের অদ্ভুত, অবিশ্বাস্য, অবাস্তব কাহিনী লেখা হচ্ছে এবং সম্পাদকগণও নির্বিচারে সেসব ছেপে চলেছেন। ভাবছেন না যে প্রকাশিত এসব বিভ্রান্তিকর কাহিনী ভাষাআন্দোলন বিষয়ক ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠছে। অবশ্য প্রথম আলাে’র ঐ একই সংখ্যায় রেজাউল করিম সাহেবের লেখায় গােড়ালিতে গুলিবিদ্ধ ছেলেটি সম্পর্কে যে শিহরণ জাগানাে ঘটনা উঠে এসেছে তা গল্পের মত মনে হলেও সম্ভবত বাস্তব ঘটনা। একুশে ফেব্রুয়ারি মেডিকেল হােস্টেলে গােড়ালিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন আবদুস সালাম, মারা যান ৭ এপ্রিল ঐ হাসপাতালেই। একমাত্র কোনাে জাদুকরী ক্ষমতাসম্পন্ন গবেষকই হয়তাে বলতে পারবেন, জনাব রেজাউল করিম কথিত গুলিবিদ্ধ মানুষটি আর শহীদ আবদুস সালাম একই ব্যক্তি। কিনা। কৌতূহলােদ্দীপক এ ঘটনাটির পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয় একুশের আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট সবাই যদি তাদের অভিজ্ঞতার সঠিক কাহিনী তুলে ধরতেন কাগজের পাতায় তাহলে একুশের যথার্থ ইতিহাস আরাে ব্যাপক হতে পারতাে।
বাইশে ফেব্রুয়ারি আজাদ’-এ প্রকাশিত এমনি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটি শহীদ জব্বারের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররূপে পরিচয়দান। শহীদ জব্বারের পরিচয়ও দীর্ঘদিন অজ্ঞাত ছিল প্রধানত লেখকদের সাথে মেডিকেল কলেজের তৎকালীন ছাত্রকর্মীদের যােগাযােগ না থাকার কারণে। একুশের ভাষা আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র। মেডিকেল কলেজ হােস্টেলে সেখানকার ছাত্রদের সার্বক্ষণিক উপস্থিতির কারণে বহু ঘটনা ও তথ্য তাদের জানা ছিল যা হয়তাে অনেকেই জানতে পারেন নি। শহীদ জব্বার সম্পর্কে মেডিকেল কলেজের তৎকালীন শেষবর্ষের ছাত্র হারিসুর বৃহমানের সাক্ষ্যে জানা যায় যে : ‘শহীদ আবদুল জব্বারের বাড়ি পাঁচুয়া, গফরগাঁও, ময়মনসিং। বয়স অনুমান ২৫ হতে ৩০ এর মধ্যে, পেশা গৃহস্থী হাসপাতালে ভর্তি মায়ের দেখাশােনার জন্য ঢাকায় আসে। ২১-২-৫২ তারিখে দুপুরের পর গুলিবিদ্ধ হয়। হাসপাতালে নেবার পর মারা যায় । লুঙ্গি রক্তে ভেজা ছিল।১১৩ ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁওয়ের অন্তর্গত পাঁচুয়া গ্রামের কৃষকযুবা আবদুল জব্বার বিশ নম্বর শেডের আট নম্বর কক্ষের গফরগাঁও নিবাসী তৃতীয় বর্ষের মেডিকেল ছাত্র হুরমত আলীর সঙ্গে পরিচয়ের সুবাদে এখানে এসেছিলেন। বাইরে গণ্ডগােল হচ্ছে শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে একটু এগিয়ে যেতেই গুলিবিদ্ধ হন। তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যান ঐ ব্যারাকেরই নয় নম্বর কক্ষের সিরাজুল হক এবং আঠারাের সাত নম্বর কক্ষের ফজলে রাব্বি। এরা দুজনেই মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র । ফজলে রাব্বির স্মৃতিচারণ : ‘পুলিশ রাস্তা থেকে ও হােস্টেল-গেটের ভিতরে ঢুকে গুলি চালায়। বিশ নম্বর ব্যারাকের সামনে রক্তাক্ত, লুঙ্গি পরিহিত এক ব্যক্তিকে (তাকে ছাত্র বলে মনে হয়নি) আমি এবং কয়েকজন ছাত্র হাসপাতালে নিয়ে যাই। কোন চিকিৎসা দেবার আগেই তার মৃত্যু ঘটে।১১৪
এ বিষয়ে সিরাজুল হকের বক্তব্য আরও চমকপ্রদ ; ছেলেটি ছিল গফরগায়ের। হাসপাতালে রােগী ভর্তি করতে এসেছিল। আমাদের ছাত্রবন্ধু গফরগা নিবাসী হুরমত আলীর রুমে উঠেছিল । রুম থেকে বেরিয়ে আসে বাইরে কি হচ্ছে দেখবার জন্য। গুলির আঘাতে পড়ে যেতেই আমরা কয়েকজন ছাত্র মিলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। ইমারজেন্সিতে নেবার পর তাকে মৃত ঘােষণা করা হয়। আমার কাপড়চোপড় রক্তে ভিজে যায়। রক্তাক্ত সার্ট পাজামা পরে বারান্দায় চালের খাতায় লুকিয়ে রাখি যাতে পুলিশ ওগুলাের সন্ধান না পায়।”১১৫ একুশে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিবর্ষণের ফলে ঠিক কতজন হতাহত, বিশেষ করে কয়জন শহীদ হয়েছিলেন তা এখনও স্পষ্ট নয়। সরকারি সংরক্ষিত তথ্য প্রকাশ পাওয়ার পর হয়তাে তা সঠিকভাবে জানা সম্ভব হবে। আপাত হিসাবে দেখা যায়, ঐদিনের গুলিতে তিনজন (রফিকুদ্দিন, আবুল বরকত ও আবদুল জব্বার) এবং পরে ৭ এপ্রিল আহত আবদুস সালাম হাসপাতালে মারা যান। “আজাদ’-এর হিসাব মতে গুলিতে আহতের সংখ্যা সতের, তবে কতখানি সঠিক বলা কঠিন। প্রকৃতপক্ষে একুশে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে আরাে দুই-একজনের মৃত্যুর সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ফুলার রােডে পুলিশের গুলিতে একজন কিশােরের মৃত্যু এবং তাকে পুলিশের তুলে নিয়ে যাওয়ার খবর দৈনিক আজাদ’এ পরিবেশিত হয়েছে। আরাে একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য পরিবেশন করেছেন তৎকালীন মাদ্রাসাছাত্র লােকমান আহমদ আমীমী। তার সাক্ষ্যে দেখা যায়, কলেজ গেট বরাবর খেলার মাঠের পাশে পাম্প হাউসের কাছে অন্তত একজন তাৎক্ষণিকভাবে শহীদ হয়েছিলেন। জনাব আমীমীর ভাষায় : ‘মেডিকেল হাসপাতালের সামনের চৌরাস্তার পূর্ব পার্শ্বে একটি পয়ঃপ্রণালী নিষ্কাশনের পাম্প মেশিন ছিল। তারই পাশে আমি ও অগণিত বিক্ষুব্ধ ছাত্র বিক্ষোভরত ছিলাম। তখন বেলা সাড়ে তিনটা থেকে চারটা। কুরাইশির নির্দেশে পুলিশ তিনবার গুলি ছােড়ে ।…হঠাৎ দেখি আমার বাম পার্শ্বে একজনের পর দাঁড়ান এক যুবকের পেটে গুলি লেগেছে। পেট চেপে ধরলেও দরদর করে রক্ত ঝরছিল। কয়েকজন ধরাধরি করে তাকে মাঠের পূর্ব দিকের গেট দিয়ে মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের দরুন সন্ধ্যার দিকে হাসপাতালে সে শাহাদাত বরণ করে। যুবকের বয়স ২০/২২ বৎসর হবে। দোহারা চেহারা, শরীরের রং শ্যামলা।
পরনে সাদা সার্ট ও পায়জামা ছিল। তার সঠিক পরিচয় জানতে পারিনি।’১১৬। লােকমান আহমদ আমীমীর বিবরণ অবিশ্বাস্য মনে হয় না এই কারণে যে মাঠের কোণে পাম্প হাউসের পাশে সেদিন বহুসংখ্যক ছাত্র-জনতার উপস্থিতি | লক্ষ্য করা গেছে এবং এলিস কমিশনের রিপাের্টে দেখা যায় যে ‘পুলিশের গুলিবর্ষণের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠের কোণায় একজন মারা যায়।’ এই। স্বীকারােক্তি তাৎপর্যপূর্ণ। এখন প্রশ্ন, এই শহীদের পরিচয় কেউ কি তুলে ধরেছেন? তার নাম-ধাম-পেশা সম্পর্কে আমরা কি কিছু জানি? আমাদের পরিচিত ইতিহাস এ সম্পর্কে নীরব। ভাষা আন্দোলনের এ যাবৎ লিখিত ইতিহাসের পাতায় কিংবা আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট কাব্যে রচনায় এই শহীদের আমরা দেখা পাই নি, পরিচয় পাই নি। অবশ্য বাইশে ফেব্রুয়ারি গণজাগরণের মুখে এধরনের ঘটনার সংখ্যা যে একাধিক তা আমরা পরে দেখতে পাবাে। কিন্তু আশ্চর্য যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভর্তি ও চিকিৎসা রেকর্ড ঘেঁটেও এ সম্পর্কে কোনাে সন্ধান মেলে নি। এ বিষয়ে ডা, সাঈদ হায়দার লিখেছেন : “ পরবর্তী সময়ে আমি ও ডাক্তার আহমদ রফিক মেডিকেল কলেজের পুরানাে রেকর্ডপত্তর থেকে সঠিক তথ্য পাওয়ার চেষ্টা চালাই। কিন্তু সে সময়ের রেকর্ডপত্তর সব নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। বলে আমরা ব্যর্থ হই” (একুশের স্মৃতিচারণ ৮১)। শুলিবর্ষণের কারণ ও তাৎপর্য একুশে ফেব্রুয়ারিতে সমবেত ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের গুলি চালনার প্রয়ােজন ছিল কিনা এবং তা সঙ্গত ছিল কিনা, এ প্রশ্ন সেদিন তাৎক্ষণিকভাবেই উঠেছিল। আর সেই দায় মেটাতে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন সরকার সমর্থক বিচারপতি এলিসকে দিয়ে তদন্ত কমিশনের যে প্রতিবেদন তৈরি করেন তা প্রায় সরকারি সংবাদ বিজ্ঞপ্তির অনুরূপ ছিল। এই প্রতিবেদনে বিচারপতি এলিস সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, একুশে ফেব্রুয়ারি বেলা ৩টা ২০ মিনিটের সময় পুলিশ মেডিকেল কলেজ হােস্টেল এবং বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠের পশ্চিম দিকের রাস্তায় সমবেত ছাত্র-জনতার (তার ভাষায় ‘দাঙ্গাকারীদের’) ওপর পুলিশ যে সাতাশ রাউন্ড গুলিবর্ষণ করে নিশ্চিতই তার প্রয়ােজন ছিল এবং পুলিশ সেক্ষেত্রে অতিরিক্ত বল। প্রয়ােগ করে নি এবং যৌক্তিক সীমা লঙ্ঘন করে নি।১১৭ এই রিপাের্ট সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনার অবকাশ এখানে নেই। তবে । প্রসঙ্গত এটুকু বলা প্রয়ােজন যে বিচারপতি এলিস তার সরকার-সেবার পুরস্কার। পেয়েছিলেন, পেয়েছিলেন বিচারকার্যের ন্যায় ও নীতি বিসর্জন দিতে পারার কারণে। কথাগুলাে বলতে হচ্ছে এইজন্য যে ভাষা আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রত্যক্ষদর্শী মাত্রেই তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতার সাথে এই প্রতিবেদনের বক্তব্য বিষয় মেলাতে পারবেন না। প্রতিবেদনে তথ্য বিকৃতি ঘটেছে বিস্তর, সিদ্ধান্ত। স্বাভাবিক নিয়মে সেই পথেই গিয়েছে। এখানে আমাদের উদ্দেশ্য এলিস কমিশনের সমালােচনা নয়, কারণ এলিস । কমিশনের সম্ভাব্য একদেশদর্শিতার বিষয়টি জানা ছিল বলেই ছাত্র-জনমত এই কমিশন প্রত্যাখ্যান করে এবং এর সাথে সহযােগিতা করতে অস্বীকৃতি জানায়।
আসলে এই প্রতিবেদন থেকে দুটো বিষয় বেরিয়ে আসে, যা একুশের ভাষা আন্দোলনের সাথে প্রাসঙ্গিক এবং রাজনৈতিক বিচারে তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমত, এই অল্পসংখ্যক ছাত্র সমাবেশের (পাঁচ হাজারের বেশি কিছুতেই নয়) ওপর গুলিবর্ষণের সত্যই কি জরুরি প্রয়ােজন ঘটেছিল? এ প্রসঙ্গে গুলিবর্ষণের সব দায়দায়িত্ব অবাঙালি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কোরাইশি, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাসুদ মাহমুদ এবং সর্বোপরি চিফ সেক্রেটারি আজিজ আহমদের ওপর ন্যস্ত করা হয়, ভুলে যাওয়া হয় বাঙালি ডি.আই.জি ওবায়দুল্লাহর কথা, যার দায় মােটেই কম ছিল না। এলিস কমিশনের প্রতিবেদনে একথা বলা হয় যে ম্যাজিস্ট্রেট, ডি.আই.জি এবং পুলিশ সুপার ঐকমত্যে পৌছানাের পরই গুলি চালনার সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়। তদুপরি রয়েছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন এবং তার মন্ত্রীমণ্ডলীর সদস্যগণ, যারা ছিলেন পুরােপুরি বাঙালি। আসলে রাজনৈতিক তাৎপর্য বিচারে বাঙালি-অবাঙালি নির্বিশেষে এদের শ্রেণীস্বার্থে সাত ছিল না বলেই মােটামুটিভাবে ঐ প্ররােচনাহীন সমাবেশে নুরুল আমিন প্রশাসন গুলি চালনার নির্দেশ দিতে পেরেছে। কারণ লড়াইয়ের বিষয়টি ছিল ভাষা এবং অঞ্চল বিচারে ভাষার বিজয় ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্রের সম্ভাবনা নিয়ে বহুদূর পর্যন্ত যেতে পারতাে, যেক্ষেত্রে এর পরিণতি রাজনৈতিক দিক থেকেও (শ্রেণী-বিচারে তাে বটেই) তাদের জন্য গ্রহণযােগ্য বিবেচিত হওয়ার কথা নয়। ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না যে, এই ভাষা আন্দোলনেরই বিশেষ একটি উৎস থেকে উচ্চারিত হয়েছিল পাকিস্তানের বিভিন্ন সংস্কৃতিভিত্তিক ভাষা-স্বাধীনতার স্লোগান, যেখানে বালুচ, পশতু, সিন্ধিও অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভাষা-রাজনীতির এই পার্শ্বমুখটি তারা সবাই আশঙ্কার দৃষ্টিতে দেখবেন এটাই স্বাভাবিক। পূর্ববঙ্গের ভাষিক জাতীয়তার চেতনা ও আন্দোলন পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যাপ্ত হলে তা শাসকশ্রেণীর জন্য বিপজ্জনক হওয়ার কথা। তাই কী বাঙালি, কী অবাঙালি উভয়ে একই রাজনৈতিক স্বার্থের টানে তাদের পদক্ষেপ নির্ধারণ করেছে এবং ভাষা আন্দোলনকে সজোরে ও সমূলে বিনষ্ট করতে চেয়েছে।
তা না হলে স্বাভাবিক নিয়মে বাঙালি নুরুল আমিন মন্ত্রীমণ্ডলীর এতটা তীব্র বাংলা বিরােধী হওয়ার কোন কারণ নেই। এমন নয় যে, প্রশাসনের কারসাজি ও চতুরতায় গুলি চালানাে হয়েছে। তাই যদি সত্যি হতাে, তাহলে পরিষদ ভবনে নুরুল আমিন এতটা কঠিন মনােভাব নিয়ে গুলিবর্ষণ সম্পর্কে কোন প্রকার সহানুভূতি প্রকাশে অস্বীকৃতি জানাতেন না, কিংবা অকুস্থল পরিদর্শনের জন্য মৌলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে অমন রূঢ়, অনমনীয় মনােভাব প্রদর্শন করতেন না। পরিষদ অধিবেশনে এ সম্পর্কে প্রশ্নোত্তর ও তর্কবিতর্ক একটু গভীরভাবে অনুধাবন করা হলে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, নুরুল আমিন যা করেছিলেন, গুলিবর্ষণ সম্পর্কে যে ভূমিকা নিয়েছিলেন, তা বেশ বুঝে শুনে ভেবে-চিন্তেই নিয়েছিলেন। বৃথাই কেউ কেউ তাকে মনের দিক থেকে বাংলা-অনুরাগী এবং অবাঙালি আমলা আজিজ আহমদের সুচতুর হাতের পুতুল, দুর্বলচিত্তের ব্যক্তিত্ব হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছেন। এটা সম্ভবত ঠিক নয় এবং এতে নুরুল আমিনের অযৌক্তিক অবমূল্যায়নই প্রকাশ পায়। দ্বিতীয় যে রাজনৈতিক সূত্রটি ঐ প্রতিবেদন থেকে বেরিয়ে আসে তা হলাে “কিছুসংখ্যক নেতৃস্থানীয় ছাত্রের আপসবাদী মনােভাব সত্ত্বেও ছাত্র-জনতার সুদৃঢ় লৌহকঠিন জঙ্গি মনােভাব, যা নেতৃত্বের দুর্বলতা সত্ত্বেও অন্তর্নিহিত দুর্জয় শক্তির প্রকাশ ঘটিয়েছে। ছাত্র-জনতার এই অনমনীয় শক্তির রূপ চিনে নিতে সুচতুর প্রশাসনের অসুবিধা হয় নি। আপাতদৃষ্টিতে বিশৃঙ্খল এবং সেনানায়কবিহীন এইসব ভাষাসৈনিক কোন না কোন বিশ্বাসে (হয়তাে-বা ভাষাচেতনার) উদ্দীপ্ত বলে মনে হয়েছে। তাই তারা দুর্জয় সাহসে ভর করে এগিয়ে যেতে চেয়েছেন, এমনকি এলিস কমিশনের প্রতিবেদন মতে প্রথম রাউন্ড গুলিবর্ষণের পরও তারা পিছু হটতে চান নি । আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও তাই বলে। আর পুলিশ প্রশাসন এইখানেই শঙ্কার কারণ অনুভব করেছে এবং একে নিশ্চল করে দিতে শুলিবর্ষণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গুলিবর্ষণের কারণ ও রাজনৈতিক তাৎপর্য এখানেই। নিহিত বলে আমরা মনে করি।
কিন্তু রাজনৈতিক বিচক্ষণতার অভাবে আমাদের নেতৃত্ব এই তাৎপর্যপূর্ণ শক্তির সম্ভাবনা দেখতে পায় নি, একে অনুধাবন করার মতাে দূরদৃষ্টি অর্জন করতে পারে নি। অসংগঠিত এবং রাজনৈতিক বিচারে অগভীর চেতনার ছাত্র-যুবা নেতৃত্ব এই সম্ভাবনা মূল্যায়নের কথা ভাবতেও পারে নি। অথচ সঠিক কর্মপন্থা নেয়া সম্ভব হলে সেদিনই এদের অগ্রযাত্রায় অঘটন ঘটানাে সম্ভব হতাে এবং সেক্ষেত্রে একদিকে বাইশে ফেব্রুয়ারির গণজাগরণের আগেই তার উৎসমুখ খুলে দেয়া যেতাে; অন্যদিকে বাইশের গণজাগরণ আরাে তীব্র, আরাে ব্যাপক হয়ে সত্যিকার অর্থে গণঅভ্যুত্থানের অন্যতর এক চরিত্র অর্জন করতে পারতাে। তার চেয়েও বড় কথা, এই শক্তির স্বরূপ চেনা সম্ভব হলে এবং এর সম্ভাবনা সম্পর্কে সচেতন হওয়া গেলে অদূর ভবিষ্যতে একে সংগঠিত করে তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচি ও নীতি গ্রহণ সম্ভব হতাে, যা ভবিষ্যতে ভিন্ন দিকে রাজনৈতিক বিজয়ের তথা ভাষিক রাষ্ট্রের পথ খুলে দিতে পারতাে। অন্ততপক্ষে বাম রাজনৈতিক সংগঠন সেদিকে তাদের কর্মতৎপরতা সংহত করার দূরদর্শী প্রয়াস গ্রহণ করতে পারতাে। কিন্তু নেতৃত্বের দুর্বলতা, সঠিক নীতি গ্রহণে অপারগতা অন্তর্নিহিত রাজনৈতিক সম্ভাবনাকে তাদের দৃষ্টির পরিসীমায় নিয়ে আসতে পারে নি। নেতৃত্বের এই দুর্বলতা যেমন সাংগঠনিক তেমনি অনভিজ্ঞতাজনিতও বটে। এতে দূরদর্শিতা ও বলিষ্ঠ চিন্তার অভাব স্পষ্ট। তাই একুশের সম্ভাবনা রাজনৈতিক লক্ষ্যে ব্যবহারের কথা নেতাদের মাথায় আসে নি।
ছাত্র-জনতার ঐক্যপ্রয়াসে কন্ট্রোল রুম। আমরা দেখেছি মেডিকেল কলেজ হােস্টেল প্রাঙ্গণে এবং সম্মুখস্থ রাজপথে ছাত্র’ জনতার সম্ভাবনাময় শক্তি যখন আপন গতিবেগে প্রসারিত হওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে, তখন ছাত্র-যুবা নেতৃত্বের ছােট একটি অংশ নিজেকে সঙ্গবদ্ধ ও সংহত করতে চেষ্টা করেছে, মধুর ক্যান্টিনে দাঁড়িয়ে কার্যকরী কর্মপন্থা নির্ধারণের কথা ভেবেছে এবং মতভেদগত কারণে অসহায় ক্ষোভ পােষণ করেছে, সে সময় নুরুল আমিন প্রশাসন ভাষা আন্দোলনকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য গুলিবর্ষণের সিদ্ধান্ত নেয়। বলাবাহুল্য এ সিদ্ধান্ত তাদের জন্য সঠিক ছিল না। এইজন্য যে, এতে করে ভাষা আন্দোলনের সীমাবদ্ধতাকে ভেঙে একে গণআন্দোলনের পথে এগিয়ে দেয়া হয়। অবশ্য গুলি চালনার পক্ষে প্রশাসন এলিস কমিশনের কাছে যে যুক্তি তুলে ধরেছে তা যেকোন প্রশাসনেরই বক্তব্য হতে পারতাে এবং তা গুলিবর্ষণের আসল কারণ নয় বলে আমরা মনে করি, যে। বিষয়টি ওপরে উল্লিখিত হয়েছে। | কিন্তু গুলিবর্ষণের পর ছাত্র-জনতার দিক থেকে অবস্থার গুণগত পরিবর্তন দেখা গেল। এ ঘটনার প্রতিক্রিয়া তাৎক্ষণিকভাবে হলেও ছাত্রসাধারণ ও জনসাধারণকে একই প্রতিবাদী বিন্দুতে নিয়ে আসে। এবার আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট নেতা, উপনেতাদের অনেককেই দেখা গেল হাসপাতালে এবং মেডিকেল হােস্টেল প্রাঙ্গণে। সবাই কমবেশি উত্তেজিত, আবেগে উদ্বেল, তাদের চোখে পানি। | অলি আহাদ, আবদুল মতিন, ইমাদুল্লাহ, মাহবুব জামাল জাহেদী, মােহাম্মদ সুলতান প্রমুখ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি যেমন ছুটে এসেছেন অকুস্থলে, তেমনি দেখা গেল কাজী গােলাম মাহবুব, নুরুল আলম, খালেক নেওয়াজ খান, এমনকি হেদায়েত হােসেন চৌধুরী প্রমুখ ব্যক্তিকেও যারা ১৪৪ ধারা ভাঙার বিরােধিতায় সােচ্চার ছিলেন। অন্যদিকে মেডিকেল কলেজের ছাত্রনেতা ও কর্মিগণতাে সেখানে সর্বদাই উপস্থিত; উপস্থিত দেখা গেল জগন্নাথ কলেজের পরিচিতমুখ কিছু ছাত্রনেতা, যুবলীগ নেতা এবং চেনা-অচেনা আরাে অনেককে।হাসপাতাল ও হােস্টেল প্রাঙ্গণে তখন কেবল অশ্রুসিক্ত চোখ আর কান্নার শব্দময় উচ্ছ্বাস।
মেডিকেল কলেজের ছাত্রকর্মিগণ এরি মধ্যে শহীদদের রক্তমাখা কাপড় ফেস্টুনের মতাে বাঁশের মাথায় করে তুলে ধরেছেন; শহীদের রক্ত হাতে মেখে | ব্যারাকের দেয়ালে দেয়ালে রক্তছাপ এঁকে দিয়েছেন; সেই সঙ্গে দেখা যাচ্ছে | বারাে, তেরাে, চৌদ্দ এবং বিশ নম্বর শেডের গায় বুলেটের সুস্পষ্ট আঘাত-চিহ্ন। | আর হাসপাতালে রয়েছেন পুলিশের গুলিতে হতাহত ছাত্র, অছাত্র অনেকে। | এইসব দেখে ছাত্র, জনসাধারণ আবেগে অভিভূত হয়ে পড়েন। গুলিবর্ষণের খবর অনেকটা অতিরঞ্জিত হয়েই অতি দ্রুত শহরময় ছড়িয়ে পড়ে। যে ১৪৪ ধারা অমান্যের কারণে (এলিস কমিশনের সামনে প্রশাসনের | সাক্ষ্যে পরিস্ফুট যে, সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য বরদাশত করা চলে না) গুলিবর্ষণ করে একাধিক মৃত্যু ঘটাতে হলাে, দেখা গেল যে, গুলিবর্ষণের পর সে নিষেধাজ্ঞা হাওয়ায় উড়ে গেছে। মানুষ দলে দলে ছুটে আসছে আহত ও নিহতদের একনজর দেখার জন্য। স্থানীয় জনসাধারণই শুধু নন; সরকারি, বেসরকারি অফিসআদালতের কর্মচারিগণও প্রায় দল বেঁধে বেরিয়ে এসেছেন, অবাক হয়ে দেখছেন আর শুনছেন। এমনি করে সেদিন ১৪৪ ধারার সমাধি রচিত হয়। মেডিকেল কলেজ ছাত্রদের প্রতিষ্ঠিত কন্ট্রোল রুম’ তথা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ (অবশ্য বহু-পরিচিতির কারণে আমরা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ’-এর বদলে সেকালে মুখে মুখে উচ্চারিত কন্ট্রোল রুম’ কথাটাই ব্যবহার করেছি।) তখন মাইকে আগুন ঝরিয়ে চলেছে। ছাত্র-জনতা এবং বিশেষ করে পলাশী ও নীলক্ষেত ব্যারাকগামী অফিসফেরত জনতা থমকে দাড়িয়ে মাইকের সে প্রচার শুনছেন, স্তব্ধ হয়ে শুনছেন এক অভাবিত ঘটনার বয়ান, অনেকেই আবার হােস্টেল ও হাসপাতালের দিকে এগিয়ে আসছেন অবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য। আন্দোলনের প্রচার কাজের সুবিধার জন্য একুশে ফেব্রুয়ারি মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের উদ্যোগে প্রথম কন্ট্রোল রুম’ স্থাপিত হয়।
তৎকালীন মেডিকেল কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক শরফুদ্দিন আহমদ ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন যে, ‘বিশে ফেব্রুয়ারি গভীর রাত অবধি ব্যস্ততার কারণে পরদিন অর্থাৎ একুশে ফেব্রুয়ারি সকালে ১৪৪ ধারা ভাঙা সংক্রান্ত প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ভি,পি গােলাম মাওলার সাথে তার আলােচনা হয় এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে হােস্টেলে একটি কন্ট্রোল রুম’ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হলাে। এই উদ্দেশ্যে সাঈদ হায়দার, আবুল হাশিম, আহমদ রফিক প্রমুখের সঙ্গে আলােচনার পর পরিষদ ভবনের নিকটতম বিশের এক নম্বর কক্ষে কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়। কলেজ ইউনিয়নের উদ্যোগে বেলা বারােটার মধ্যে বিশের এক নম্বর কক্ষে সব ব্যবস্থা করে ফেলেন আমাদেরই ছাত্রবন্ধু ইয়াহিয়া। স্পিকার লাগানাে হয় হােস্টেলের উত্তর-পশ্চিম কোণে অবস্থিত আমগাছের ডালে। একেবারে পরিষদ ভবনের নাকের ডগায়। ১১৮ এ সম্পর্কে হুমায়ুন কবির হাইয়ের বক্তব্যও অনুরূপ : ‘দুপুরে বেলা প্রায় একটার দিকে মাইক লাগানাে হয়। মনে হয় ওটা আমাদের। স্টুডেন্টস ইউনিয়নের’ মাইক ছিল। ইয়াহিয়া নামে একজন ছাত্র কন্ট্রোল রুম ও মাইকের দায়িত্বে ছিল। তা হতে অনেক উদ্দীপনামূলক গান ও রেকর্ডেড বক্তৃতা প্রচার করা হতে থাকে। মেডিকেল ছাত্র ফজলে রাব্বির মতে, কন্ট্রোল রুম খােলা হয় দুপুর বারােটার দিকে এবং মেডিকেল কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের মাইক ব্যবহার করা হয়। বেলা একটা থেকে মাইকে ১৪৪ ধারা ভেঙে পরিষদ ভবন ঘেরাওয়ের পক্ষে প্রচার কাজ শুরু হয়ে যায়। এই প্রচারে লাগাতার কণ্ঠ দিয়ে যাচ্ছিলেন মেডিকেল কলেজের ছাত্র সরফুল আলম (ভয়েস অব আমেরিকা, ওয়াশিংটনে ঘােষক-পাঠক), আবুল হাশিম (দীর্ঘকাল যাবৎ সউদি আরববাসী চিকিৎসক) এবং আরাে দুই একজন। প্রচারের বক্তব্য লেখা হচ্ছিল নানা হাতে। এ সম্পর্কে ডা. সাঈদ হায়দার বলেন : ‘পরিষদ ভবন লক্ষ্য করে লাউড স্পীকার লাগানাে হয়েছিল। আবুল হাশিম, সরফুল ও আরাে অনেকে উচ্চকণ্ঠে প্রতিবাদ জানাচ্ছিল পুলিশী জুলুমের। বক্তব্যের ক্রিপ্ট তৈরি করছিল জিয়া, আহমদ রফিক, কবির, কাদের ও আরাে অনেকে। ওদিকে পরিষদ ভবনে গমনেচ্ছু সদস্যদের দেখা পেলেই ধরে নিয়ে আসা হচ্ছিল ব্যারাকে, বােঝানাে হচ্ছিল পরিস্থিতির গুরুত্ব। জাহেদ, মাওলা, আহমদ রফিক সবাইকে দেখেছি সক্রিয় ব্যস্ততায় ছােটাছুটি করতে ।
মেডিকেল কলেজ ছাত্ররা যেমন একদিকে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিল, অপরদিকে আহতদের চিকিৎসা ও সেবাকার্যের তত্ত্বাবধান করছিল। ১১৯ গুলিবর্ষণের পর কন্ট্রোল রুম’-এর প্রচারে গুণগত পরিবর্তন দেখা দিল। এবার মাইকে প্রচারিত হতে থাকে সরকারের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী বক্তৃতা, প্রতিরােধ গ্রহণের শপথ ঘােষণা, পরবর্তী কর্মসূচির বিবরণ (যেমন পরদিন জানাজা ও মিছিলে অংশগ্রহণের আহ্বান, ঘরে ঘরে কালাে পতাকা উত্তোলন, প্রতিটি মানুষের কালাে ব্যাজ ধারণ, শােকদিবস পালন ইত্যাদি)। সেই মুহূর্তের উদ্দীপক স্লোগান ছিল : রক্তের বদলে রক্ত চাই’, ‘খুনী নুরুল আমিনের বিচার চাই’, ‘রাষ্ট্রভাষা। বাংলা প্রতিষ্ঠিত কর’, ‘ব্লাড ব্যাংকে অকাতরে রক্ত দিন’ এবং খুনী নুরুল আমিনের কল্লা চাই’ ইত্যাদি। আহতদের চিকিৎসার জন্য রক্তদানের উদাত্ত আহ্বানে বেশ সাড়া পাওয়া যায় । এরি মধ্যে মেডিকেল ছাত্র ও তরুণ চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে যে ব্লাড ব্যাংক স্থাপন করা হয়েছিল, সেখানে রক্ত। দেয়ার জন্য দেখা গেল লম্বা লাইন। কন্ট্রোল রুম থেকে প্রচার সম্পর্কে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম মেডিকেল হােস্টেল নিয়ন্ত্রণ কক্ষের মাইক্রোফোনে ছাত্রনেতাদের বিশেষ করে শহীদুল্লা কায়সারের বক্তৃতাদানের’১২০ কথা যা বলেছেন তা সঠিক নয়। মৌলানা তর্কবাগীশ ব্যতীত আর কোন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি এখান থেকে বক্তৃতা করেন নি। বদরুদ্দিন উমর তার বইতে রফিকুল ইসলামের এই বক্তব্যই উদ্ধৃত করেছেন। মাইকের প্রচারে এই সুবিধা হলাে যে গুলি চালনার খবর মুখে মুখে অতি দ্রুত শহরময় ছড়িয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে শহরের দোকানপাট-হােটেল-রেস্তরা সব বন্ধ হয়ে যায়। কাউকে বলতে হলাে না, আজ হরতাল। মানুষজন হাসপাতালের দিকে ছুটতে থাকে, উদ্দেশ্য শহীদদের একনজর দেখা। নানা শ্রেণীর, নানা পেশার মানুষ। হাসপাতালে জনতার ভিড় সামলাতে একতলায় এবং দোতলায় সিড়ির মুখে দাড়িয়ে গেল কয়েকজন বলিষ্ঠ দীর্ঘকায় মেডিকেল ছাত্র, দোতলায় ইমাদুল্লাহ দাঁড়ালেন একপাশে। তবু কি তাদের ঠেকানাে যায়।
অন্যদিকে ঢাকা বেতারের লেখক-শিল্পিগণ তাৎক্ষণিকভাবে কর্মবিরতি পালন করেন। গুলির খবরের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় আইন পরিষদের অধিবেশনে সত্যিকার অথেই ঝড় ওঠে এবং এর প্রধান উদ্যোক্তা লীগ দলীয় সদস্য মৌলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ। তিনি মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের ওপর গুলিবর্ষণ সম্পর্কে সরেজমিন তদন্তের জন্য চাপ দিতে থাকেন, কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী ঘটনাস্থল পরিদর্শন। এবং তদন্ত দূরে থাকে, এ সম্পর্কে পরিষদে বিবৃতি দিতেও অস্বীকার করেন। ফলে উত্তেজিত তর্কবাগীশ একটি আবেগপূর্ণ বক্তৃতা শেষ করে মুখ্যমন্ত্রীর আচরণের প্রতিবাদে পরিষদকক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। ধীরেন দত্ত, মনােরঞ্জন ধর প্রমুখ কংগ্রেস সদস্যও প্রতিবাদে পরিষদ বর্জন করেন। আর যেসব মুসলমান সদস্য অধিবেশন বর্জন করে বেরিয়ে আসেন তাদের মধ্যে আলী আহমদ খান, শামসুদ্দিন আহমদ, খয়রাত হােসেন ও আনােয়ারা খাতুন প্রমুখ উল্লেখযােগ্য। এরা সবাই মেডিকেল হােস্টেল ও হাসপাতালে হতাহতদের দেখতে যান। অলি আহাদ তার জাতীয় রাজনীতি’ গ্রন্থে ভুল করে পরিষদ সদস্য আবুল কালাম শামসুদ্দিনের একুশে ফেব্রুয়ারির অধিবেশন বর্জনের কথা বলেছেন। সেদিন শামসুদ্দিন সাহেব অধিবেশন চলাকালে আজাদ অফিসে কর্মরত ছিলেন। পরিষদ সদস্যদের অধিবেশন থেকে বেরিয়ে আসা এবং পরিষদে গুলি চালনা সম্পর্কে মুলতবি প্রস্তাব উত্থাপন ইত্যাদি প্রসঙ্গে অলি আহাদ, খন্দকার গােলাম মােস্তফা এবং আরাে দুই-একজন তাদের লেখায় যথেষ্ট ভুল তথ্য সরবরাহ করেছেন। এগুলাের সংশােধন প্রয়ােজন। উল্লিখিত তর্ক-বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে। ঘটনার যে বিবরণ দেন তা যেমন একতরফা তেমনি ভুল তথ্যাদিতে পরিপূর্ণ। এতে গুলিবর্ষণের ফলে হতাহতদের নাম নেই। বরং মুখ্যমন্ত্রী সমস্ত দায় ছাত্রদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করেছেন। অবশ্য তিনি ঘটনা সম্পর্কে তদন্ত অনুষ্ঠানের আশ্বাস দেন (দৈনিক আজাদ)।। কিন্তু বিষয়টি মােটেই ততটা সহজ ছিল না এবং ছাত্রদের ওপর বিনা প্ররােচনায় (কিছু ইট-পাটকেলের প্রতিবাদ বাদে) গুলি চালিয়ে রক্ত ঝরানাের ঘটনা ধামাচাপা দেয়া মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে মােটেই সম্ভব ছিল না।
বিশেষ করে তারই দলের কিছুসংখ্যক পরিষদ সদস্য যখন এ বিষয়ে ভিন্নমত পােষণ করছিলেন, তখন বাস্তবের মুখােমুখি হওয়া ছাড়া অন্য কোন পথ তার জন্য খােলা ছিল না। এদিকে মৌলানা তর্কবাগীশ মেডিকেল হােস্টেল প্রাঙ্গণে ঘুরে ঘুরে ইতস্তত রক্তের ছােপ, দেয়ালে বুলেটের আঘাত, টিয়ার গ্যাসের অবশিষ্ট গন্ধ এবং রক্তমাখা। জামা-কাপড় (যা পতাকার মতাে উড়ছিল) দেখতে দেখতে আবেগে অভিভূত হয়ে পড়েন। তাকে কন্ট্রোল রুমের মাইকে কিছু বলতে অনুরােধ করার সাথে সাথে তিনি রাজি হয়ে যান। মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির সদস্য মৌলানা তর্কবাগীশ মাইকে কথা বলতে বলতে ক্রুদ্ধ, আবেগরুদ্ধ কষ্ঠে তার সহকর্মীদের পরিষদ বর্জনের আহবান জানান। দাবি জানান, ‘জালিম সরকারের উদ্দেশ্যে পদত্যাগের।’ বলতে বলতে আবেগে, উত্তেজনায়, কান্নায় ভেঙে পড়েন মৌলানা তর্কবাগীশ। কয়েকজন ছাত্র তাকে ধরে রাখে।১২১ সরকারি দলের বিশিষ্ট সদস্য মৌলানা তর্কবাগীশের সরকার-বিরােধী ভূমিকা গ্রহণ এবং ভাষা আন্দোলনের সমর্থনে বিরােধী ক্যাম্পের মাইকে আবেগদৃপ্ত ভাষণদান নিঃসন্দেহে একটি তাৎপর্যময় ঐতিহাসিক ঘটনা। এর ফলে জনসাধারণের চোখে নুরুল আমিন সরকারের ভাবমূর্তি যে বেশ কিছুটা নষ্ট হয়েছিল তা ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না। | শুধু তর্কবাগীশের বক্তৃতাই নয়, মেডিকেল হােস্টেলের কন্ট্রোল রুমের মাইকে যেসব উত্তেজক বক্তৃতা এবং জনসাধারণের জন্য প্রাত্যহিক কর্মসূচি পরিবেশন করা হচ্ছিল (বিস্ময়ের হলেও সত্য যে ঢাকার জনসাধারণ সেই কর্মসূচি নির্দ্বিধায় গ্রহণ ও পালন করেছেন এবং সত্য বলতে কি ঢাকায় তখন সরকারি প্রশাসন অচল হয়ে পড়েছিল, যার অনুরূপ ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি একাত্তরের প্রায় প্রথম তিনটি মাস), তাতে সরকার বিচলিত না হয়ে পারে নি। তাই লাগাতার প্রচার কাজে নিয়ােজিত মেডিকেল হােস্টেলের কন্ট্রোল রুমের ওপর সরকারের নজর পড়ে। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর যৌথ হামলায় পরদিন বিকেলে কন্ট্রোল রুম তছনছ হয়ে যায়, ওরা মাইক্রোফোন ছিনিয়ে নেয়।
এ বিষয়ে ২৩ ফেব্রুয়ারি ‘আজাদ পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয় : ‘মেডিকেল হােস্টেলের মধ্যে বহু ছাত্র জমায়েত হয় এবং মাইকযােগে বক্তৃতা করিতে শােনা যায়। বৈকালে যখন তাহারা বক্তৃতা করিতেছিলেন, এমন সময় পুলিশ এবং সৈন্যগণ হােস্টেলের মধ্যে প্রবেশ করিয়া রুমের অধিকারী জনাব আবুল হাসেমকে বেয়নেটের খোঁচার ভয় দেখাইয়া মাইক কাড়িয়া লয়,… পুলিশ ও সৈনিক দলের এই জুলুমের প্রতিবাদে গতকল্য সার্জন জেনারেলের সভাপতিত্বে মেডিক্যাল কলেজে এক সভা হয়।… উক্ত সভায় সার্জন জেনারেল পুলিশ জুলুমের বিরুদ্ধে যথারীতি ব্যবস্থা অবলম্বন করা হইবে বলিয়া ছাত্রদিগকে আশ্বাস দেন। এখানেও ‘আজাদ’ পত্রিকার প্রতিবেদনে সামান্য ভুল রয়েছে। আবুল হাশিম নন, আবদুর রহিম চৌধুরী প্রমুখ কয়েকজন ছাত্র ছিলেন ঐ কন্ট্রোল রুমের। (বিশের এক নম্বর কক্ষের) বাসিন্দা। হাশিম থাকতেন উনিশ নম্বর শেডে। মাইকের প্রচার কাজে লাগাতার কণ্ঠ দেয়ার প্রয়ােজনে ঐ নির্দিষ্ট সময়ে কন্ট্রোল। রুমে থাকার কারণে আবুল হাশিম পুলিশ-সৈনিকদের হামলার শিকার হন। তৎকালীন সার্জন জেনারেল কর্নেল আফ্রিদি এ বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সাথে দেখা করেন এবং পরে কলেজ ইউনিয়নের মাইক ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করেন। মেডিকেল হােস্টেলে মাইকের অনুপস্থিতি পুষিয়ে দিয়েছিল প্রধানত সলিমুল্লাহ হলের অনুরূপ প্রচারযন্ত্রটি। সুরক্ষিত এই মাইক থেকে এরপর ঢাকাবাসীর উদ্দেশে। সকল কর্মসূচি এবং খবর-বার্তা জানানাে হয়েছে। এর সঙ্গে সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে ইনজিনিয়ারিং কলেজের এবং ফজলুল হক হলের মাই দুটো। কিন্তু লােকজন প্রধানত সলিমুল্লাহ হল এবং মেডিকেল হােস্টেলের সামনের রাস্তায়ই। ভিড় জমাতেন পরদিনের করণীয় জেনে নিতে। সত্যি বলতে কি এই কটা দিন অসংগঠিত ছাত্রশক্তিই ঢাকার জনপ্রশাসন পরিচালনা করেছে; জনগণ এক অর্থে সরকারের অস্তিত্ব অস্বীকার এবং ছাত্রদের নির্দেশই পালন করেছেন। গুলিবর্ষণােত্তর কর্মতৎপরতা একথা অস্বীকারের উপায় নেই যে গুলি চালনার অভাবনীয় ঘটনার পর ছাত্র-যুব নেতৃত্বের সক্রিয় অংশেও তাৎক্ষণিকভাবে এক ধরনের জড়তা এবং বিষন্ন হতাশা বিরাজ করেছে।
কিন্তু এই অবস্থার অবসান ঘটে সাধারণ ছাত্রদের জঙ্গি তৎপরতায়। জঙ্গীছাত্ররা নিশ্চল বসে থাকতে রাজি ছিলেন না। ঘটনার আকস্মিকতা ও অবাঞ্ছিত পরিণতিতে বিমর্ষ আবদুল মতিন যখন চুপচাপ হাসপাতালের লনে একাকী বসেছিলেন তখন কয়েকজন ছাত্র এসে তাকে পরদিনের কর্মসূচি সংবলিত একটি ইস্তাহার প্রকাশের কথা বলেন। এদের মধ্যে চট্টগ্রামের আবদুস সাত্তারের কথা আবদুল মতিনের বিশেষভাবে মনে রয়েছে। তিনি জনাব সাত্তারকে দ্রুত একটি খসড়া তৈরি করে আনার পরামর্শ দিলে সাত্তার দ্রুত পায়ে মেডিকেল হােস্টেলে চলে যান এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই শাদা ফুলস্কেপ কাগজে একটি খসড়া তৈরি করে এনে আবদুল মতিনের হাতে দেন। আবদুল মতিন এমারজেন্সিতে গিয়ে সর্বদলীয় পরিষদের আহ্বায়ক কাজী গােলাম মাহবুবকে সেই খসড়া ইস্তাহারে স্বাক্ষর দিতে অনুরােধ জানালে জনাব মাহবুব নীতিগত কারণে তাতে স্বাক্ষর দিতে অস্বীকৃতি জানান (সম্ভবত বিশে ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় বৈঠকের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে)। অগত্যা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক হিসেবে আবদুল মতিন ঐ খসড়া ইস্তাহারে সই করে অবিলম্বে তা ছাপার ব্যবস্থা করতে এবং সম্ভব হলে রাতের মধ্যেই তা সকল শিক্ষায়তন, হল-হােস্টেল এবং মসজিদগুলােতে বিতরণ করার অনুরােধ জানান। গুলিবর্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে পরদিনের কর্মসূচি নির্ধারণ এবং তা বাস্তবায়নের বিষয়টিই ছিল রাজনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, সম্ভাবনাময় অবস্থার পটভূমিতে সঠিক কর্মসূচি গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নের মাধ্যমেই আন্দোলন সফল পরিণতিতে পৌঁছাতে পারে। বাইশে ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতার সম্মিলিত পদক্ষেপ তেমনি এক সাফল্যের বিন্দুতে উপনীত হতে পেরেছিল। সে রাতে প্রধান প্রধান ছাত্রাবাসগুলাের প্রতিটিতেই উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনার জন্য ছাত্রগণ সভায় মিলিত হন। সলিমুল্লাহ হলের ছাত্রসভায় শহীদের রুহের মাগফেরাত কামনা এবং তাদের শােকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করা হয়। অন্য এক প্রস্তাবে ৪০ দিনের জন্য শােক পালন এবং সবাইকে কালাে ফিতা ধারণের অনুরােধ জানানাে হয়। সেই সঙ্গে হতাহতের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার ও শাস্তির দাবি করা হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে পরদিনের জন্য সুনির্দিষ্ট কোন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয় নি। ফজলুল হক হলের এবং জগন্নাথ কলেজের ছাত্রগণও প্রায়। অনুরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
কিন্তু মেডিকেল হােস্টেলে অবস্থানকারী ছাত্রনেতা ও কর্মীদের সিদ্ধান্ত ছিল। কর্মকেন্দ্রিক ও বাস্তবধর্মী। এ সম্পর্কে অলি আহাদ বলেন : ‘ছাত্র হত্যাজনিত বিশেষ পরিস্থিতিতে মেডিক্যাল কলেজ হােস্টেলটি আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হইয়াছিল। মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রাবাসের উত্তরদিকস্থ বটবৃক্ষে মাইকের হর্ণ বাধিয়া ২০নং ব্যারাক হইতে আন্দোলন সম্পর্কিত বিভিন্ন ঘােষণা ও আহ্বান জনতার উদ্দেশ্যে অবিরাম প্রচার করা হইতেছিল। মেডিক্যাল কলেজ ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং যুবলীগের নেতৃস্থানীয় সক্রিয় ব্যক্তিবর্গের যৌথ সভায় আমরা নিম্নলিখিত কর্মসূচি ঘােষণা করি : (ক), বাইশে ফেব্রুয়ারী ভাের সাতটায় মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রাবাস প্রাঙ্গণে গণগায়েবী জানাজা এবং (খ), গায়েবী জানাজা সমাপনের পর জনসভা ও জঙ্গী মিছিল।১২২ এখানে বলা দরকার যে, ‘গণ-গায়েবী জানাজা’ নয়, বিকেলেই ভি.পি গােলাম মাওলার কক্ষে অনুষ্ঠিত ছােট্ট বৈঠকে পরদিন জানাজা এবং শহীদের লাশ সহযােগে সভা ও মিছিলের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কারণ, লাশ তখনও ছাত্রদের হেফাজতে, তাই গায়েবী জানাজা অনুষ্ঠানের কোন প্রশ্নই সেখানে আসে না। আরাে একাধিক সিদ্ধান্ত সেখানে হয়, যেমন বাড়িতে বাড়িতে শােকের প্রতীক হিসেবে কালাে পতাকা তােলা এবং শােকচিহ্ন হিসেবে বুকে বা হাতে কালাে ফিতা বা ব্যাজ ধারণ। প্রসঙ্গত অলি আহাদের বক্তব্যের আরাে একটি ক্রটি উল্লেখ করা দরকার। মেডিকেল কলেজ হােস্টেলের কন্ট্রোল রুম থেকে সংযুক্ত মাইকের হর্ন। প্রধানত পশ্চিম দিকে পরিষদ ভবনের নিকটতম আমগাছে বাঁধা হয়েছিল, বটগাছে নয়। কলেজ ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক শরফুদ্দিনের মতে তিনটি হর্ন তিন। দিকে লক্ষ্য করে বাঁধা হয়েছিল, যেমন পরিষদ ভবন, ইনজিনিয়ারিং কলেজ ও বকশী বাজার এবং উত্তর-পূর্বে কলেজ গেট-খেলার মাঠ এবং রাস্তা।১১৮ একই। ভুল বদরুদ্দিন উমরও করেছেন অলি আহাদের বরাত দিয়ে (পৃ. ৩০৮)। জানাজা প্রসঙ্গে বশীর আল হেলাল যে সিদ্ধান্তমূলক উক্তি করেছেন তা মােটেই সঠিক নয়। তিনি লিখেছেন ‘২২শের সকালে মেডিক্যাল হােস্টেল প্রাঙ্গণে কোন জানাজারই সিদ্ধান্ত হয় নি বলে মনে হয়।
মােহাম্মদ সুলতানই এ বিষয়ে ঠিক বলেছেন। শহীদদের মৃতদেহ ও তাদের রক্তরঞ্জিত কাপড়ের পতাকা নিয়ে হােস্টেল থেকে মিছিল বের করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল’ (পৃ. ৩৫৮)। এমনকি তার বক্তব্য প্রমাণ করতে তিনি ২২ ফেব্রুয়ারি ইনসাফ’ পত্রিকায় প্রকাশিত কর্মসূচি উদ্ধার করেছেন, যেখানে বলা হয়েছে : অদ্য শহীদ ছাত্রগণের শবদেহগুলি লইয়া | ছাত্রদের একটি বিরাট শব শশাভাযাত্রা বাহির হইবে বলিয়া মেডিক্যাল কলেজ | ছাত্রাবাস হইতে মাইক লইয়া ঘোষণা করা হয়।’ প্রথমত মাইক লইয়া ঘােষণা’ কথাটি অত্যন্ত অস্পষ্ট; তদুপরি আমরা জানি, বিকেল থেকেই হােস্টেলের কন্ট্রোল রুমের মাইকে পরদিন সকালে হােস্টেল প্রাঙ্গণে জানাজায় অংশগ্রহণ করতে ছাত্র-জনতার প্রতি আহ্বান জনানাে হতে থাকে। সত্যি বলতে কি আবদুল মতিনের স্বাক্ষরিত ইস্তাহার ছাপাখানায় যাওয়ার পর থেকেই হােস্টেলের মাইকে এ প্রচার চলতে থাকে, যা আমরা ২২ ফেব্রুয়ারি ‘আজাদ’-এর প্রতিবেদনেও দেখতে পাই। সেখানে বলা হয়েছে যে, ‘বেলা ৪টার পর হােস্টেলের মধ্য হইতে মাইকযােগে নিহতদের জানাজায় শরিক হওয়ার জন্য ছাত্র ও জনসাধারণের প্রতি আবেদন জানানাে হয়। আমরা মনে করি, ইনসাফ’-এর প্রতিবেদন জানাজা প্রসঙ্গে ক্রটিপূর্ণ; এ ধরনের এবং এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ক্রটিপূর্ণ সংবাদ বা তথ্যাদি আমরা ইতঃপূর্বে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত হতে দেখেছি। এ সম্পর্কে আবদুল মতিনের একটি। বিশেষ বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ। জনাব মতিনের সাক্ষ্যে জানা যায়, ইস্তাহারে স্বাক্ষরদানে আপত্তি প্রসঙ্গে তিনি কাজী গােলাম মাহবুবকে এই বলে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, ‘ইস্তাহারে স্বাক্ষর দেওয়া না হলেও আন্দোলন এগিয়ে যাবে এবং পরদিনের জানাজা ও মিছিলের কর্মসূচি ঠিকই সফল হবে।’ আরাে একটি বিবেচনা এখানে সুস্পষ্ট যে, প্রকৃতপক্ষে জানাজার কর্মসূচি না থাকলে পরদিন জানাজায় যােগ দেয়ার জন্য এত লােক সমবেত হবেন কেন? এবং জানাজার কর্মসুচি কেনই-বা পালন করা হবে? হতে পারে তা লাশসহ কিংবা লাশবিহীন জানাজা।
আমাদের জানা মতে সে রাতে প্রায় প্রতিটি প্রধান প্রধান স্কুল এবং কলেজে ছাত্রদের বাইশে ফেব্রুয়ারির সকাল বেলা ১০টার মধ্যে উল্লিখিত জানাজায় অংশগ্রহণের জন্য যােগাযােগ করা হয়। প্রসঙ্গত ইস্তাহার সম্পর্কিত কিছু তথ্য স্পষ্ট করা দরকার। গুলি চলার পরপরই কবি হাসান হাফিজুর রহমান তার বন্ধু আমির আলীকে নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে নিজ দায়িত্বে একটি ইস্তাহার ছেপে এনে বিতরণের ব্যবস্থা করেন। ইস্তাহারের শিরােনাম মন্ত্রী মফিজউদ্দিন-এর আদেশে গুলি”। আরাে চমকপ্রদ যে ভুল তথ্যের এই ইস্তাহারটিতে হাসান নিজেদের নামের পরিবর্তে বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নাম ব্যবহার করেছিলেন। এটি ছাপা হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের উল্টো দিকের গলিতে অবস্থিত ক্যাপিটাল প্রিন্টিং প্রেস’ নামক ছােটখাট একটি ছাপাখানা থেকে।১২৩ ঐ প্রেসের মালিক সাভার নিবাসী জনাৰ দলিল খাঁ এবং তার ভাই শফি হােসেন বিনামূল্যে ভাষা আন্দোলনের বহু ইস্তাহার ছেপে দিয়েছেন যে জন্য তাদের বিস্তর খেসারত দিতে হয়েছিল। প্রেসটিতে পুলিশী হামলা চলে এবং মালিকদের যথেষ্ট হয়রানি করা হয়। প্রেসটি পরবর্তীকালে তার জৌলুসহীন অস্তিত্ব রক্ষা করে চলেছে বলে জানা যায় । অবশ্য বর্তমান অবস্থা আমরা জানি না।১২৪ স্বভাবতই মন্ত্রী মফিজুদ্দিন আহমদ (ত্রাণ ও পুনর্বাসনের দায়িত্বে নিয়ােজিত) অবিলম্বে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানান (দৈনিক আজাদ’, ২৪-২-৫২) : ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত প্রেসের নামহীন একটি প্রচারপত্র আমার হস্তগত হইয়াছে। প্রচারপত্রটিতে বলা হইয়াছে যে আমার আদেশেই পুলিশ গুলিবর্ষণ করে, ইহা সত্যের অপলাপ ছাড়া আর কিছুই নহে। গুলির হুকুম দেওয়া না দেওয়া আমার কাজ নয়। এমন কি ঘটনাস্থলেও আমি উপস্থিত ছিলাম না। এই বিবৃতির শিরােনাম ছিল ‘গুলি চালনার হুকুম আমি দেই নাই’। গুলির আদেশ সম্পর্কে অবাঙালি ম্যাজিস্ট্রেট কোরাইশী এবং পুলিশ সুপার মাসুদের নাম তখন এতই প্রচারিত হয়েছিল যে সে ক্ষেত্রে হাসানের এই ভুলের রহস্য খুঁজে পাওয়া কঠিন, বিশেষ করে পুনর্বাসন মন্ত্রীর পক্ষে গুলির আদেশ দেয়া একেবারেই অসম্ভব এবং অবাস্তব ঘটনা। উল্লিখিত দুইটি ইস্তাহার ছাড়াও একুশের ভাষা আন্দোলনে ব্যক্তিগত উদ্যোগে একাধিক প্রচারপত্র ছাপা ও বিলি হয়েছিল, এমনকি কমুনিস্ট পার্টির তরফ থেকেও অবস্থার মূল্যায়ন ও আশু কর্তব্য সম্পর্কে ইস্তাহার ছেপে বের করা হয়।
কথাটা আমরা আগেও উল্লেখ করেছি যে ১৪৪ ধারা অমান্য সংক্রান্ত কারণে আন্দোলন পরিচালনার দায়িত্বে নিয়ােজিত নেতৃত্বের মধ্যে সুস্পষ্ট মতভেদ দেখা দেয় যা নেতৃত্বের সঙ্কট না হলেও দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। অবশ্য গুলিবর্ষণের পর ১৪৪ ধারা ভাঙার বিরােধী সর্বদলীয় ও ছাত্রনেতাদের প্রায় সবাই হাসপাতালে ও মেডিকেল হােস্টেলে এসেছেন, এমনকি কেউ কেউ সংবাদপত্রে বিবৃতিও দিয়েছেন, তবু আন্দোলনের মূল কর্মকাণ্ডের সাথে এবং প্রত্যক্ষভাবে আন্দোলন পরিচালনার সাথে তাদের সম্পর্কে ছিল ক্ষীণ। তাই আন্দোলন পরিচালনার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে একটি অস্থায়ী নেতৃত্ব গড়ে তােলার চেষ্টা হয় এবং তার প্রয়ােজনও ছিল। এই ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণ তাদের খেয়ালখুশিমত বক্তব্য পরিবেশন করেছেন। যেমন মােহাম্মদ সুলতান তার স্মৃতিচারণে বলেছেন : সন্ধ্যা ছ’টায় নতুন করে আন্দোলনের উদ্যোক্তাদের সভা বসলাে মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রাবাসের ৩ অথবা ৪৯ নম্বর রুমে।…নতুন করে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠিত হলাে। জনাব অলি আহাদ আহ্বায়ক নির্বাচিত হলেন। …মেডিক্যাল কলেজ, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ফজলুল হক হল ও জগন্নাথ কলেজ থেকে ঘােষিত হলাে আগামীকাল সকল গৃহে কালাে পতাকা উত্তোলন করা হবে। শহীদ ভাইদের মৃতদেহ ও তাদের রক্তরঞ্জিত পতাকা শােভিত মিছিল বের হবে। রাত থেকে ভাের পর্যন্ত এ কর্মসূচি প্রচার হতে থাকলাে।১২৫
অন্যদিকে স্বয়ং অলি আহাদ একই বিষয়ে বলেছেন : | ‘এদিকে পরিস্থিতি মােকাবিলার তাগিদে আমাকেই উদ্যোগ গ্রহণ করিয়া একুশে ফেব্রুয়ারি রাত্রি নয় ঘটিকায় মেডিক্যাল কলেজ হােস্টেলস্থ ৪নং ব্যারাকের ৩নং রুমে সাহসী ও উৎসাহী কর্মীদের সভা আহ্বান করিতে হয়। উক্ত বৈঠকে মেডিক্যাল কলেজ ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি…জনাব গােলাম মাওলাকে অস্থায়ী আহ্বায়ক নিযুক্ত করিয়া আন্দোলনকে সঠিক নেতৃত্বদানের সিদ্ধান্ত নেওয়া। হয় ।…সর্বজনাব শামসুল হক, মাে. তােয়াহা, আবদুল মতিন, আবুল হাশিম, শামসুল আলম, মুজিবুল হক, হেদায়েত হােসেন চৌধুরী ও অন্যান্য সবাই গাঢাকা দিয়াছিলেন। ফলে ২১শে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার পর আন্দোলনের দারুণ সঙ্কটময় ও বিপজ্জনক মুহূর্তে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ নেতৃবর্গ ও সাধারণ কর্মীদের ওপর আন্দোলন পরিচালনার সমগ্র গুরুদায়িত্ব বর্তাইয়াছিল।…২১শে ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে ইহাই ছিল প্রকৃত পরিস্থিতি। বিভিন্ন মহল বিভিন্ন সময়ে ২১শে ফেব্রুয়ারির ঘটনাবলীকে এবং উহার সত্যকে বারবার বিকৃত করিয়াছে।’১২৬
এই দুই উদ্ধৃতিতে আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট দুই বিশিষ্ট ব্যক্তির বক্তব্য শুধু যে নয়ছয় ঘটিকার সংঘাত এবং নতুন অস্থায়ী পরিষদের আহ্বায়ক মনােনয়নে সম্পূর্ণ দুই বিপরীত তথ্য পরিবেশিত হয়েছে তাই নয়, দ্বিতীয় উদ্ধৃতিতে ভুল তথ্যনির্ভর আত্মপ্রচারের আলঙ্কারিক বক্তব্যই প্রাধান্য পেয়েছে। কিন্তু এই তথ্য সঠিক ধরে নিয়ে ইতিহাস রচনায় বশীর আল হেলাল নিশ্চিতই ভুল পথে পা রেখেছেন। তিনি লিখেছেন : ‘তবে আন্দোলনের নেতাদের এই সময় আর দেখতে পাওয়া যায় না, সাধারণভাবে এ-কথা ঠিক। তাদের অধিকাংশ গ্রেপ্তারি এড়াবার জন্যে। আত্মগােপন করেছিলেন ।…আন্দোলনের সকল দায়িত্ব তুলে নিতে হয়েছিল কয়েকটি হলের, বিশ্ববিদ্যালয়ের ও অন্যান্য ছাত্রদের এবং যুবলীগ ও তার নেতা অলি আহাদকে’ (পৃ. ৩৫৯)। উপরে উল্লিখিত কিছু কিছু তথ্য সঠিক নয় বলেই ইতিহাস লেখকের উদ্ধৃত সিদ্ধান্তও পুরােপুরি সঠিক হয় নি। একথা সত্য যে যুবলীগ এবং বিশেষ করে অলি আহাদ একুশের আন্দোলন পরিচালনায় বিশিষ্ট ভূমিকা রেখেছেন, কিন্তু তাই বলে অন্য সবাই গা ঢাকা। দিয়েছিলেন এমন অতিরঞ্জিত উক্তিতে আত্মপ্রচারের প্রবণতাই লক্ষ্য করা যায়। যেমন আবদুল মতিন, মােহাম্মদ তােয়াহা, ইমাদুল্লাহ, মাহবুব জামাল জাহেদী, মােহাম্মদ সুলতান প্রমুখ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি আন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। ছিলেন মেডিকেল কলেজ ও জগন্নাথ কলেজের নেতৃস্থানীয় ছাত্র ও। কর্মিগণ যাদের নাম অলি আহাদ উল্লেখ করেন নি। | এ বিষয় নিয়ে সামান্য আলােচনা প্রমাণ করবে যে এধরনের ঢালাও মন্তব্য। নিতান্তই মনগড়া ও আপত্তিকর এবং গ্রহণযােগ্য নয়। এ সম্পর্কে আবদুল মতিনের প্রতিক্রিয়া হলাে, ‘অলি আহাদের এই উক্তি সত্য নয়, কেননা ৭ মার্চ গ্রেফতারের পূর্ব পর্যন্ত আমি প্রত্যক্ষভাবে আন্দোলন সংগঠনের কাজে নিয়ােজিত ছিলাম। | এ বিষয়ে একটি সত্য মনে রাখা দরকার যে, একুশে ফেব্রুয়ারি গুলিবর্ষণের পর থেকেই উত্তেজিত জনতার ক্ষুব্ধ পদপাতে গােটা ছাত্রএলাকা মুক্ত এলাকায় পরিণত হয়েছিল, অবশ্য মাত্র কয়েকদিনের জন্য। রাস্তায় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর টহল এবং বাইশে ফেব্রুয়ারির রাত থেকে কার্টু সত্ত্বেও শহর ঢাকার প্রশাসন ভেঙে পড়ে, ছাত্রকেন্দ্রগুলাের নির্দেশেই জনজীবন পরিচালিত হতে থাকে।
তাই দেখা যায়, আত্মগােপনকারী কম্যুনিস্ট নেতা শহীদুল্লা কায়সার গ্রেফতারি পরােয়ানা উপেক্ষা করে দিনের আলােয় দিব্যি ব্যারাকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, ছােট ছােট ছাত্র গ্রুপের সাথে রাজনৈতিক আলােচনা করছেন, প্রাঙ্গণের সমাবেশে বক্তৃতা দিচ্ছেন। আসা-যাওয়া করছেন সর্বদলীয় পরিষদের অনেকেই, যারা একদিন আগে ১৪৪ ধারা ভাঙার পরিণতি নিয়ে ভীত, শঙ্কিত ছিলেন; যেমন আবুল হাশিম, কামরুদ্দিন আহমদ, কাজী গােলাম মাহবুব প্রমুখ নেতা। এমনি মুক্ত পরিবেশে আত্মগােপনের কোন প্রয়ােজন হয় না, আর সেকথা বুঝতে এতটুকু কষ্ট হওয়ার কথা নয়। প্রকৃত ঘটনা হলাে, উল্লিখিত বিরুদ্ধবাদী নেতাগণ সম্ভবত পূর্বোক্ত মতভেদের কারণে আন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট হন নি, পরিচালনায় ও সাংগঠনিক তৎপরতায় ঘনিষ্ঠভাবে অংশ নেন নি। হয়তাে এ কারণেই ক্ষুব্ধ অলি আহাদ উক্ত মন্তব্য করেছেন এবং হিসাব-নিকাশ না করে ঢালাওভাবে সবার উদ্দেশ্যেই তা করেছেন। তাই দেখা যায়, সর্বদলীয় নেতাদের কেউ তখনও আত্মগােপন করেন নি, করেছেন কয়েকদিন পর গ্রেফতারি পরােয়ানা জারি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে। এ সময় আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছিল একুশে ফেব্রুয়ারি রাতে গােলাম মাওলার কক্ষে অনুষ্ঠিত বৈঠকে গঠিত অস্থায়ী সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে। বলা প্রয়ােজন যে, ঐ বৈঠকে সেদিন লেখকদ্বয়ও উপস্থিত ছিলেন এবং ইমাদুল্লাহ, জাহেদী, সুলতানসহ আরাে অনেকেই এবং মেডিকেল কলেজের ছাত্রনেতাগণও উপস্থিত ছিলেন। সেখানে অলি আহাদের প্রস্তাবেই গােলাম মাওলাকে অস্থায়ী আহ্বায়ক মনােনীত করা হয় প্রধানত এই কারণে যে তখন আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র মেডিকেল কলেজ হােস্টেল এবং জনাব মাওলা ব্যারাকবাসী হওয়ার ফলে তার সার্বক্ষণিক উপস্থিতি সহজলভ্য হবে, যদিও আমরা জানি যে গােলাম মাওলা সে সময় রাজনীতিতে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না। কলেজ ইউনিয়নের ভি,পি, ছিলেন বলেই তাকে আন্দোলনের সঙ্গে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট হতে হয়েছে। |
কিন্তু তাতে কার্যত কোন অসুবিধা হয় নি, কেননা আন্দোলন যথাসম্ভব সমষ্টিগত নেতৃত্বেই পরিচালিত হয়েছে এবং অলি আহাদ, আবদুল মতিন, ইমাদুল্লাহ প্রমুখ নেতা তুলনামূলকভাবে বিশিষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এমনকি ৭ মার্চের গ্রেফতার পর্যন্ত এই অবস্থাই চলেছে। অন্যদিকে কমুনিষ্ট পার্টির ছাত্র ও যুব ফ্রন্টের নেতা ও কর্মীদের বরং একুশ তারিখের বিকেল থেকে উপস্থিত নেতৃত্বের সাথে এবং আন্দোলনের কর্মতৎপরতার সাথে ঘনিষ্ঠতর যােগাযােগ রেখে চলার চেষ্টা করতে দেখা গেছে। এধরনের যৌথ চেতনা কিছুটা উপস্থিত ছিল বলেই একুশ-পরবর্তী দিনগুলােতে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের নামে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, সংবাদপত্রে একতরফা বিবৃতি, নুরুল আমিনের অভিযােগের জবাবে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি ইত্যাদির বিরােধিতা করা হয় নি, যদিও আমরা জানি সিদ্ধাওমাফিক (বিশে রাত্রের) পর সর্বদলীয় পরিষদ বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার কথা। এমনকি সলিমুল্লাহ হলের একক পথ চলার নীতির সঙ্গত বিরােধিতা করে আন্দোলনে বিভাজন রেখা টানার চেষ্টাও করা হয় নি। চেষ্টা চলেছে যৌথ পদক্ষেপের, যদিও শেষ পর্যন্ত তা পুরােপুরি সম্ভব হয় নি। | তাই একুশের ইতিহাস বিকৃত করা প্রসঙ্গে অলি আহাদের উথাপিত। অভিযােগের জবাবে বলতে হয় বামপন্থী লেখকবৃন্দ’ নন, অতি-উৎসাহী ও আত্মপ্রচারমুখী ব্যক্তিগণই একুশের ইতিহাস বিকৃতির কারণ। এরাই ইতিহাসের নামে অনেক না-হক দাবি, বিস্তর মনগড়া তথ্য লিপিবদ্ধ করেছেন যা নিতান্তই উদ্দেশ্যপ্রণােদিত বলে মনে হয়। আমরা আগেই বলেছি, একুশের আন্দোলনকে ঘিরে ইচ্ছাকৃত, অনিচ্ছাকৃত ভুলত্রুটি ও মনগড়া তথ্যাদির পরিমাণ এতােই বেশি যে দীর্ঘদিনের শ্রমে গড়া বিশালকায় শুদ্ধিপত্র ছাড়া যথাযথ ইতিহাস প্রণয়ন প্রায় অসম্ভব। এক্ষেত্রে আমরা প্রধান ভুলত্রুটি ও অসঙ্গতিগুলােই হিসেবে এনেছি, গৌণ এবং ছােটখাটোগুলােকে নয় । আর একুশে ফেব্রুয়ারি এবং পরবর্তী কয়েকটি দিন নিয়েই অসঙ্গতি ও ইতিহাস-বিকৃতির মাত্রা সর্বাধিক।
উপরের অনুচ্ছেদে যে মনগড়া ইতিহাস রচনার কথা বলা হয়েছে সে সম্পর্কে আপাতত সংশ্লিষ্ট একজনের স্মৃতিচারণের সামান্য অংশ থেকেই বিস্তর ঐতিহাসিক ত্রুটি-বিকৃতির উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারি গুলিবর্ষণের পর মেডিকেল হােস্টেল প্রাঙ্গণের অবস্থা সম্পর্কে গাজীউল হক বলেন : সমস্ত মেডিকেল কলেজ ব্যারাক প্রাঙ্গণ ছাত্রে থৈ থৈ করছে। …মনে পড়ছে পার্টির (অর্থাৎ কমুনিস্ট পার্টির, লেখকদ্বয়) নেতৃস্থানীয় একজন বললেন, “আপনি ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার নির্দেশ দিয়ে চূড়ান্ত অন্যায় করেছেন এবং আগামীকাল যদি এ আন্দোলন ব্যর্থ হয় তাহলে আপনাকে দায়ী করা হবে। মেডিকেল কলেজ ব্যারাক থেকে সমবেত ছাত্রদের উদ্দেশে তখন বক্তৃতা দিচ্ছিলেন শহীদুল্লা কায়সার।১২৭ এধরনের বক্তব্য বিভিন্ন কারণে উদ্দেশ্যমূলক বলেই মনে হয়। প্রথমত, গুলি চালনার পর পার্টি তাদের নীতি ও কর্মপন্থামূলক সিদ্ধান্তগুলাে যে ঢেলে সাজায় তার প্রমাণ শুধু শহীদুল্লা কায়সারের ঐদিন বিকেল থেকে আন্দোলনের সমর্থনে কাজ করাই নয়; একুশ তারিখে প্রকাশিত পার্টির ইস্তাহারের বক্তব্যে সারা পূর্ববঙ্গব্যাপী তুমুল ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তােলার আহ্বান জানানাের মধ্যে তা প্রতিফলিত। ইস্তাহারের শিরােনাম ছিল অত্যাচারী নুরুল আমিন সরকারের বর্বর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সারা পূর্ববঙ্গব্যাপী তুমুল ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়িয়া তুলুন। পুলিশের হাতে ছাত্র-জনতার নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিবরণ শেষে ইস্তাহারের উপসংহারে বলা হয়েছে : | ‘জুলুমবাজ লীগ সরকারের অবসানের দাবিতে, হত্যাকারীর শাস্তির দাবিতে, নিজ মাতৃভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার দাবিতে সারা প্রদেশব্যাপী ধর্মঘট সভা শােভাযাত্রা করিয়া প্রবল আন্দোলন গড়িয়া তুলুন। শহীদদের অসমাপ্ত আন্দোলনকে আগাইয়া নিয়া যাওয়ার জন্য শহীদদের নামে শপথ লউন।’১২৮ | উপরের অনুচ্ছেদে উল্লিখিত বক্তব্যের সাথে গাজীউল হক বর্ণিত জনৈক পার্টি। নেতার মন্তব্যের মিল খুঁজে পাওয়া ভার এবং সেক্ষেত্রে তার বক্তব্য নিছক অপবাদের মতােই শােনায়।
কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, আন্দোলনে গাজীউল হকের উপস্থিতি-অনুপস্থিতি সম্পর্কে ইতােপূর্কে উদ্ধৃত অলি আহাদ ও আবদুল মতিনের বক্তব্য থেকে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, আমতলার সভার পর থেকে আন্দোলনের দামাল দিনগুলােতে হােস্টেল প্রাঙ্গণে কিংবা মিছিলে অথবা সার্বিক কর্মতৎপরতায় গাজীউল হক আদৌ উপস্থিত ছিলেন কিনা যাতে এধরনের অভিজ্ঞতা তার হতে পারে? এ অভিযােগ বহুজনার এবং ভাষা আন্দোলন সম্পর্কিত তার স্মৃতিচারণে বিস্তর তথ্যগত ভুলভ্রান্তি দেখে ঐ অভিযােগই সত্য মনে হয়। এখানে আমরা তার মাত্র কয়েকটি অসংলগ্ন বক্তব্য তুলে ধরেছি, যা তথ্যগত ভ্রান্তিতে পরিপূর্ণ। একুশে রাতের বৈঠক সম্বন্ধে তিনি বলেছেন : “সে রাতেই সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ নতুন করে গঠিত হলাে। সে পরিষদের নতুন আহ্বায়ক হলেন অলি আহাদ।১২৭। ইতােপূর্বে অলি আহাদের বক্তব্যে আমরা দেখেছি, নতুন পরিষদের অস্থায়ী আহ্বায়ক হয়েছিলেন গােলাম মাওলা। বাইশে ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে জনাব গাজীউল হকের বক্তব্য : | ২২শে ফেব্রুয়ারি সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হলাে। ছাত্ররা লাশ আনতে গেলাে। কিন্তু পুলিশ শহীদদের লাশ দিল না ।… শহীদদের গায়েবী জানাজা হলাে। মােনাজাত করলেন মওলানা ভাসানী ।…গায়েবী জানাজাতে মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগিশও উপস্থিত ছিলেন।… | বাইশে ফেব্রুয়ারি রাত। মেডিকেল কলেজ এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্ররা মিলে মেডিকেল কলেজের ব্যারাকের সামনে শহীদ মিনার গড়ে তুললেন। ‘৯২৭। | প্রথমত, এ তথ্য সংশ্লিষ্ট সবারই জানা যে একুশ তারিখ রাতেই পুলিশ মেডিকেল ছাত্রদের স্বল্পক্ষণের অনুপস্থিতির সুযােগে লাশ নিয়ে চলে যায় এবং গভীর রাতে আজিমপুর গােরস্তানে কবর দেয়, যে সম্পর্কে যথাস্থানে আমরা বিস্তারিত তথ্য।
পরিবেশন করবাে। তাই ছাত্ররা রাত থেকেই গায়েবি জানাজার জন্য তৈরি হয়েছে এবং সেক্ষেত্রে ছাত্রদের সকালবেলায় লাশ আনতে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।। দ্বিতীয়ত, হােস্টেল প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত গায়েবি জানাজায় মওলানা ভাসানী কিংবা মওলানা তর্কবাগীশ দুজনের কেউই উপস্থিত ছিলেন না। মােনাজাত করেছিলেন উপস্থিত জনতার মধ্য থেকে মওলবীগােছের একজন বয়স্ক ব্যক্তি। সাপ্তাহিক সৈনিকই সম্ভবত ভাসানীর উপস্থিতি সংক্রান্ত ভুল সংবাদ পরিবেশন করেছিল। আর তাতেই যত বিপত্তি। তৃতীয়ত, শহীদ মিনার তৈরির ঘটনাও এখন তর্কাতীত যে, একমাত্র মেডিকেল কলেজ ছাত্রদের পরিকল্পনায় এবং উদ্যোগে ২৩ ফেব্রুয়ারি (২২ তারিখ নয়) একরাতের শ্রমে প্রথম শহীদ মিনার ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রথম সূর্যের মুখ দেখে, সেখানে অন্য কোন কলেজ বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র উপস্থিত ছিলেন না। পঁচিশে ফেব্রুয়ারির ঘটনা সম্পর্কে গাজীউল হক বলেন :
২৫শে মার্চের (সম্ভবত ভুলে ফেব্রুয়ারির স্থলে মার্চ বলা হয়েছে—লেখকদ্বয়) বিকেলে পূর্ববঙ্গ সরকারের পুলিশ বাহিনী এবং সামরিক বাহিনী আবার হামলা চালালাে। সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ঘেরাও করলাে পুলিশ। ফজলুল হক মুসলিম হল ঘেরাও করে ।…২২শে ফেব্রুয়ারির রাতে যে শহীদ মিনারটি তৈরি করা হয়েছিল, সেটিকে পুলিশ বাহিনী ও সামরিক বাহিনী মাটির সাথে মিশিয়ে দিলাে ।… ২৫ শে ফেব্রুয়ারির বিকেলের হামলার পরে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ আবার প্রস্তুতির জন্য আত্মগােপন করলেন। এবং …আত্মগােপন অবস্থায় কমলাপুরের নিকটে এক বৈঠকে মিলিত হন। সেখান থেকেই জনাব অলি আহাদ, জনাব মােহাম্মদ তােয়াহা, জনাব আবদুল মতিন প্রমুখ নেতা গ্রেফতার হয়ে যান।১২৭ বিস্তরভুলের এ বিবরণ সম্পর্কে এক কথায় বলা যায়, সলিমুল্লাহ হলে তল্লাশি, শহীদ মিনার ভেঙে ফেলা ইত্যাদি ঘটনার তারিখ ২৫ নয়, ২৬ ফেব্রুয়ারি; আর নেতৃবৃন্দের গ্রেফতার হওয়ার স্থান কমলাপুর নয়, শান্তিনগর: তারিখ ৭ মার্চ। দেখা যাচ্ছে তার প্রতিটি বক্তব্য তথ্যগত বিচারে ইতিহাসের বিকৃতি বিধায় গ্রহণযােগ্য নয়। এবং সে কারণেও তার উপস্থিতি সংক্রান্ত অভিযােগের বাস্তব। ভিত্তি রয়েছে বলে মনে করা যেতে পারে। নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও ব্যক্তিবিশেষের প্রসঙ্গ আমাদের তুলে ধরতে হয়েছে এই কারণে যে, তা নাহলে এইসব লিপিবদ্ধ বক্তব্য ভবিষ্যতে ঐতিহাসিক সত্য হিসেবে পরিগণিত হবে, বিশেষ করে যদি এইসব ভুলত্রুটিসম্পন্ন মনগড়া বক্তব্যের প্রতিবাদ করা না হয়। সেক্ষেত্রে ভাষা আন্দোলনের মতাে জাতীয় রাজনীতিতে। গুরুত্বপূর্ণ একটি আন্দোলনের ইতিহাস ভুলত্রুটির অনাচারে পরিপূর্ণ হয়ে থাকবে। ইতিহাসের স্বার্থে, জাতীয় রাজনীতির স্বার্থে একটি অপ্রিয় কর্তব্য আমাদের হাতে নিতে হয়েছে।
ঢাকার বাইরে একুশে ফেব্রুয়ারি এমন একটি ধারণা এক সময় যথেষ্ট প্রচলিত ছিল যে ভাষা আন্দোলন প্রধানত শহর ঢাকার আন্দোলন। কিন্তু তথ্যাদি সঠিকভাবে সংগ্রহ করার পর দেখা গেছে যে ঢাকার বাইরে মফস্বল শহরগুলােতে এমনকি গ্রামাঞ্চলের স্কুল-কলেজেও ছাত্রদের বিপুল উদ্দীপনা একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলনকে সভায়-বিক্ষোভেমিছিলে তীব্র আবেগে গতিময় করে তুলেছিল। কোন কোন শহরে ছাত্রদের সাথে। জনতার সেতুবন্ধন আন্দোলনে গুণগত পরিবর্তন ঘটায়। ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জ শহরে পরিপূর্ণ হরতাল পালিত হয়। স্কুল-কলেজ, দোকানপাট, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত সব বন্ধ থাকে। ছাত্রদের আয়ােজিত সভা-শােভাযাত্রায় জনসাধারণ অংশগ্রহণ করেন। | চট্টগ্রামেও একইভাবে দিনভর হরতাল পালিত হয়। হরতালে বন্দরনগরীর জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়ে; লালদীঘি ময়দানের জনসভায় চল্লিশ হাজারেরও অধিক লােকের সমাবেশ স্লোগানে স্লোগানে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তােলে। জেলার অন্তর্গত মফস্বল অঞ্চলের স্কুলেও হরতাল পালিত হয়, সেই সঙ্গে সভা ও শশাভাযাত্রা। কুমিল্লা শহরে এবং জেলার অন্তর্গত গ্রামাঞ্চলের স্কুলে একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপিত হয় সভা-শােভাযাত্রা ও হরতালের মাধ্যমে। কুমিল্লা শহরের ছাত্রমিছিল মােহাজের কলােনির উর্দুভাষী একদল লােকের দ্বারা আক্রান্ত হয়। ফলে ১৫ জন আহত হয়। অনুরূপ ঘটনা যশােরেও ঘটে। সেখানেও ছাত্রমিছিল মােহাজের গুণ্ডাদের দ্বারা। আক্রান্ত হয়। খুলনায়ও সভা-শােভাযাত্রা -হরতাল সহকারে একুশে ফেব্রুয়ারি স্থানীয় জনসাধারণকে উত্তেজিত করে তােলে। রাজশাহীতে ব্যাপক ও পরিপূর্ণ হরতাল পালিত হয়। ছাত্রদের বিশাল মিছিলে জনসাধারণও যােগ দেন, যােগ দেন ভুবনমােহন পার্কের বিশাল জনসভায় । ছাত্রীরাও এখানে পৃথক মিছিল ও সভায় মিলিত হয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে শপথ গ্রহণ করেন। এছাড়াও পাবনা, বগুড়া, ময়মনসিংহ, জামালপুর, সিলেট, বরিশাল, ফরিদপুর, দিনাজপুর প্রভৃতি শহরে জনসভা, হরতাল, মিছিল ইত্যাদির মাধ্যমে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ বিস্ফোরিত হয়। এক কথায় দেশের সর্বত্র, সেই সুদূর দিনাজপুর থেকে দক্ষিণের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি স্কুল-কলেজে একুশের কর্মসূচি পালন | প্রমাণ করেছিল যে, ভাষার দাবিটি শিক্ষিত শ্রেণীর চৈতন্যে ও অস্তিত্বে সর্বজনীর চরিত্র নিয়ে উপস্থিত । ক্ষেত্রবিশেষে এই শ্রেণীর সাথে জনমানসের সংযোগ ঘটেছে এবং তাতে করে জনসাধারণ্যে গণতান্ত্রিক চেতনার ব্যাপ্তি ও প্রসার ঘটেছে। বলাই বাহুল্য যে, এখানে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন অঞ্চলে সংঘটিত ভাষা আন্দোলনের পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরা হয় নি।
এক যুগ আগে লেখা উপযুক্ত বিবরণের পর গত কয়েক বছরে গবেষকদের শ্রমে ঢাকার বাইরে ভাষা আন্দোলনের বিবরণ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। যেমন আবু মােহাম্মদ দেলােয়ার হােসেন সম্পাদিত ‘ভাষা আন্দোলনের আঞ্চলিক ইতিহাস’, তাজুল মােহাম্মদ প্রণীত ভাষা আন্দোলনে সিলেট’ তসিকুল ইসলাম রচিত ‘বরেন্দ্র অঞ্চলে ভাষা আন্দোলন এবং তাঁর সম্পাদিত ‘রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলন স্মারকপত্র’, রতন লাল চক্রবর্তী সম্পাদিত ‘ভাষা আন্দোলনের দলিলপত্র বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। সম্প্রতি মামুন সিদ্দিকীর ‘কুমিল্লায় ভাষা আন্দোলন” প্রকাশের অপেক্ষায়। সংবাদপত্রে একুশে ফেব্রুয়ারি জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, আন্দোলন, উপপুব ইত্যাদির চালচিত্র সংবাদপত্রই ধরে রাখে। ধরে রাখে জনসাধারণের অবগতির জন্য এবং ভবিষ্যৎ ইতিহাসের স্বার্থে। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস রচনায় আমরা যেমন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছি, তেমনি অধিকতর নির্ভর করেছি সংবাদপত্রের বিবরণের ওপর। তবু ‘সংবাদপত্রে একুশে ফেব্রুয়ারি’ এই শিরােনামে কিছু আলােচনার প্রয়ােজন হয়েছে আমাদের সংবাদপত্রগুলাের নানামুখী চরিত্র সম্পর্কে পাঠকের অবহিতির জন্য। তাছাড়া তখনকার সংবাদপত্র অঙ্গনের অবস্থা সম্পর্কে কিছুটা অনুধাবনও প্রয়ােজন বলে আমরা মনে করি। কারণ পত্রিকাগুলাে যতটা না সাংবাদিক নীতিনিষ্ঠা ও সততার দ্বারা পরিচালিত হয়েছে তার চেয়ে বেশি চালিত হয়েছে তাদের রাজনৈতিক নীতি ও উদ্দেশ্যের। প্রভাবে।। সংবাদপত্রে একুশে ফেব্রুয়ারির চালচিত্রের কথায় প্রথমেই বলতে হয়, বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের পর এ দেশের ওপর দিয়ে এত রাজনৈতিক ঝড়বাদল বয়ে গেছে, যার ফলে ভাষা আন্দোলনের ঘটনাচিত্র সংবলিত সংবাদপত্র প্রায়শ দুষ্প্রাপ্য। এমনিতেই সেসময় কাগজের সংখ্যা ছিল কম, তদুপরি একটি প্রধান ইংরেজি দৈনিক পাকিস্তান অবজার্ভার’ আন্দোলন শুরু হওয়ার কিছুদিন আগেই সরকারি রােষে বন্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে যেসব গুরুত্বপূর্ণ দৈনিক বা সাপ্তাহিক একুশের ঘটনাবলী ধারণ করেছিল তাদের মধ্যে একমাত্র দৈনিক আজাদ ব্যতীত একাধিক পত্রিকার ঐ সময়কার সংখ্যা রাজনৈতিক উপপ্লবে বিনষ্ট হয়েছে কিংবা পাকবাহিনীর বহঙ্গাৎসবে পুড়ে ছাই হয়েছে। অবশ্য ‘মর্নি নিউজ’-এর কথা আলাদা। গণবিরােধী এই পত্রিকাটি জনতার ক্ষুব্ধরােষে বিনষ্ট হয়। তাই একুশে ফেব্রুয়ারি এবং তার পরের দিনগুলাের সংবাদচিত্রের জন্য প্রধানত দৈনিক আজাদ’ এবং অংশত সাপ্তাহিক নওবেলাল’ ও কিছুটা সাপ্তাহিক ইত্তেফাক এবং দৈনিক ইনসাফ’-এর সাহায্য নিতে হয়েছে। সাপ্তাহিক সৈনিকও এদিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। জিন্দেগী’, ‘চাষী’ এগুলাের সংখ্যা বিশেষ মেলে না।
পশ্চিম পাকিস্তানি পত্রিকা “ডন”, “ইভনিং টাইমস’, ‘খাইবার মেইল ইত্যাদি পত্রিকায় একুশের প্রতিফলন অতি সামান্য। বিদেশী পত্রিকার মধ্যে কলকাতার ‘স্টেটসম্যান’ আমাদের কাজে এসেছে; কিন্তু সেখানকার অন্যান্য পত্রিকা শুরুতে আমাদের নাগালে ছিল না। দৈনিক আজাদ ছিল মুসলিম লীগ রাজনীতির পত্রিকা। কিন্তু লীগ পার্টি, বিশেষ করে প্রাদেশিক লীগ সরকারের সাথে এর অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বের কারণে আজাদ সাময়িকভাবে এবং উদ্দেশ্যমূলক কারণে আন্দোলনের কয়েকদিন যথাযথ সংবাদচিত্র তুলে ধরেছে, সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয় লিখে আন্দোলনের পক্ষে সুকৌশলী সমর্থন জানিয়েছে, যে ভূমিকা আবার কয়েকদিন পরেই পালটে যায় এবং শেষদিকে আজাদ স্বরূপে আন্দোলনবিরােধী ভূমিকায় আত্মপ্রকাশ করে। | সাপ্তাহিকের মধ্যে সৈনিক ছিল একুশের সংবাদ-সম্ভারে ভরপুর, কিন্তু এর তথ্য পরিবেশনে অতিরঞ্জন ও ভুলভ্রান্তি এত প্রকট এবং সম্পাদকীয় উপসম্পাদকীয় ইত্যাদিতে আবেগ-চপলতা এত বেশি যে সেখান থেকে ইতিহাসের প্রয়ােজন মেটানাে বেশ অসুবিধাজনক। সৈনিক’-এর ভুল তথ্য অনেক সময়ই অসুবিধার কারণ হয়ে উঠেছে, সে তুলনায় দৈনিক আজাদ-এ কিংবা সাপ্তাহিক ইত্তেফাক ও নওবেলাল’-এ ভুলের সংখ্যা সামান্য। তবে সাপ্তাহিক ‘নওবেলাল ও ইত্তেফাক-এর প্রতিবেদনেও আবেগ-বাহুল্য লক্ষ্য করার মতাে। আবার এই দুটো কাগজ সাপ্তাহিক বিধায় খবর ও ঘটনাবলী অনেক সময়ই ধার করেছে দৈনিক আজাদ’ থেকে, পাশাপাশি মিলিয়ে পড়লে বুঝতে কষ্ট হয় না। ইংরেজি দৈনিক স্টেটসম্যান-এর পাতায় ভাষা আন্দোলনের সংবাদ পরিবেশন সংক্ষিপ্ত হলেও সঠিক ও তথ্যনির্ভর ছিল। বাহান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারি মেডিকেল কলেজ হােস্টেল ও সামনের রাস্তায় পুলিশের গুলিবর্ষণ এবং পরিণামে কয়েকজনের মৃত্যু হয়ে উঠেছিল এক অভাবিত ঘটনা যা আজাদ’ যথাযথ গুরুত্ব ধরে রেখেছে। বাইশে ফেব্রুয়ারি ‘আজাদ-এর প্রথম পৃষ্ঠায় বড় বড় টাইপে ‘ঢাকা মেডিকেল কলেজ হােস্টেল প্রাঙ্গণে ছাত্র সমাবেশের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণ, নিচে অপেক্ষাকৃত ছােট টাইপে বিশ্ববিদ্যালয়ের তিজন ছাত্রসহ চার ব্যক্তি নিহত ও ১৭ ব্যক্তি আহত’ এবং তারও নিচে একই টাইপে ‘স্কুলের ছাত্রসহ ৬২জন গ্রেফতার : গুলীবর্ষণ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক তদন্তের আশ্বাস দান’ ইত্যাদি শিরােনাম সংবাদ পাঠকের জন্য আকর্ষণের কারণ হয়ে উঠেছিল। এরপর উপ-শিরােনামে ‘নিহতদের তালিকা’, ‘আহতদের তালিকা এবং অনুরূপ কিছু পরিবেশনা জনমনে যথেষ্ট প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল।
সালাহউদ্দিন ও আবদুল জব্বার সংক্রান্ত তথ্যগত ভুলের প্রশ্ন বাদ দিলে আজাদ প্রতিবেদনের আকর্ষণীয় দিক ছিল একুশের ঘটনাবলী বিস্তৃত ক্যানভাসে ধরে রাখার চেষ্টা। গ্রেফতারকৃত ছাত্র অনেককেই ট্রাকে তুলে তেজগাঁও নিয়ে ছেড়ে দেয়া (আসলে এদের ছেড়ে দেয়া হয়েছিল প্রধানত কুর্মিটোলা ও টঙ্গিতে | যাতে তারা দিনের মধ্যে শহরে পৌছাতে না পারে। আজকের দিনে হাস্যকর মনে হলেও তখনকার যাতায়াত ব্যবস্থার বিবেচনায় সরকারপক্ষের এই সিদ্ধান্ত মােটেই হাস্যকর ছিল না), পথচারী ও দোকান কর্মচারীদের নিঃশব্দে মিছিলে মিশে যাওয়া, ছাত্রদের লক্ষ্য করে পুলিশের পালটা ইট-পাটকেল ছুঁড়ে মারা, মেডিকেল হােস্টেলের কিছুটা ভেতরে ঢুকে পুলিশের গুলিবর্ষণ, বেলা চারটা থেকে মেডিকেল হােস্টেলের মাইকে পরদিন জানাজা ও শবমিছিলে যােগদানের আহ্বান, গুলিবর্ষণের পর ছাত্র এলাকায় সৈন্যবাহিনী মােতায়েন ইত্যাদি বিস্তারিত খবর পাঠকসাধারণের জন্য যথেষ্ট উত্তেজনার খােরাক যুগিয়েছিল। পাশাপাশি সরকারি প্রেসনােটের পূর্ণাঙ্গ বিবরণও আজাদ তুলে ধরেছিল। তাতে দেখা যায় প্রথম থেকেই সরকারি প্রচারের উদ্দেশ্য ছিল আন্দোলনের চরিত্র হনন করা, জনসাধারণের মধ্যে এই বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত করা যে এই আন্দোলন ‘অছাত্রদের মাধ্যমে পরিচালিত এবং আন্দোলনের প্ররােচনা ও সাহায্য বাইরে থেকে এসেছে। এ ধরনের মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা প্রেসনােটের সংশ্লিষ্ট অংশে পরিস্ফুট ; ‘সরকারের হাতে যে সকল সংবাদ আছে তাহাতে জানা যায়, যে বেআইনী কার্যকলাপের দরুন আজকের অবাঞ্ছনীয় ঘটনা ঘটিয়াছে তাহার জন্য এমন একদল লােক দায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় বা কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সহিত যাহাদের কোন সম্পর্ক নাই ।
এ সম্পর্কে জোর তদন্ত চলিতেছে।’ (আজাদ, ২২-২-৫২) আন্দোলনের শুরু থেকে এমনি এক মিথ্যার বেসাতি নিয়ে মুসলিম লীগ শাসকদের স্বার্থসিদ্ধির যাত্রা শুরু। শেষ পর্যন্ত আজাদও সেখানে এসে দাড়িয়েছিল এবং ঢাকাই জনতার একাংশের মন ভাঙাতে পেরেছিল ভাষা আন্দোলন রাষ্ট্রবিরােধী ষড়যন্ত্র, ভারতীয় ষড়যন্ত্ররূপে চিহ্নিত করে আন্দোলনের চরিত্র হননের মাধ্যমে। অবশ্য প্রথমদিকে ঘটনার সঠিক ও বিস্তারিত বিবরণ আজাদ সততার সাথেই পরিবেশন করেছে এবং সম্পাদকীয় বক্তব্যের মাধ্যমে আপন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের প্রচেষ্টার পাশাপাশি সেই প্রয়ােজনেই আন্দোলনের সমর্থনে এগিয়ে। গেছে। যেমন একুশে ফেব্রুয়ারি গুলি চালনার ওপর তদন্ত চাই’ সম্পাদকীয় নুরুল আমিন সরকারের বিরুদ্ধে চৌকস বয়ান হওয়া সত্ত্বেও প্রথম থেকেই এইসব রচনায় দুই বিপরীত বক্তব্যের ধারা লক্ষ্য করা যায়। জনসমর্থন তথা আন্দোলনের প্রতি সমর্থনের পাশাপাশি এর পরােক্ষ বিরােধিতা তথা লীগ রাজনীতির পরােক্ষ সমর্থনের সুচতুর ও সুকৌশলী গঙ্গা-যমুনা ধারার মিলন ঘটেছে এইসৰ সম্পাদকীয় নিবন্ধে, যেমন : আইন অমান্য, নিয়মতঙ্গ, উথলতা সমর্থনযােগ্য নয়, কিন্তু এই সঙ্গে একথাও সত্য যে আইন অমান্য হওয়ার মত ক্ষেত্র সৃষ্টি করাও কোন গণতান্ত্রিক সরকারের উচিৎ না।… ‘গুটিকতক বালক ও যুবক যদি নিয়মবিরােধী কার্য করিয়াই থাকে, এমনকি যদি তাহারা কর্তৃপক্ষকে উত্তেজনার কারণও দিয়া থাকে, তাহা হইলেও গুলি চালাইবার মত সঙ্কটাপন্ন অবস্থা হইয়াছিল কিনা তাহা বিশেষভাবে বিবেচ্য। (তদন্ত চাই’, আজাদ, ২২-২-৫২) বাইশে ফেব্রুয়ারি আজাদ-এর প্রথম সম্পাদকীয় (‘তদন্ত চাই’) থেকেই লক্ষ্য। করা যায় যে আজাদ সুকৌশলে দুই কূল রেখে চলার নীতি গ্রহণ করেছিল, যা একটু অভিনিবেশের সাথে না দেখলে বুঝে উঠা যায় না এবং ধীরে ধীরে আজাদ তার নিজস্ব কুল রক্ষা করে, সেই স্বার্থরক্ষা করেই চলেছে।
তাই গােটা সম্পাদকীয় | নিবন্ধে গুলি চালনার পরােক্ষ সমালােচনার মধ্য দিয়েও এক ফাঁকে বলা হয়েছে : ‘গতকল্য ছাত্র ধর্মঘট ও শােভাযাত্রা হইলে শান্তিভঙ্গের আশঙ্কা সম্পর্কে কর্তৃপক্ষ কতটা নির্ভরযােগ্য সংবাদ পাইয়াছিলেন বর্তমান মন্ত্রীসভা দেশবাসীকে তাহা জানাইতে বাধ্য বলিয়া আমরা মনে করি।’ নুরুল আমিন সরকার আজাদ-এর এই পরামর্শ সুচতুরভাবে নিজের মতাে করে কাজে লাগিয়েছিলেন এবং এই পথ ধরেই এগিয়েছিলেন। | অন্যদিকে অবাঙালি স্বার্থের প্রতিনিধি এবং মূলত পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর শ্রেণীস্বার্থের প্রতিনিধি মর্নিং নিউজ’ ভাষা আন্দোলনের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করা এবং তার চরিত্র হননের জন্য যত ধরনের সম্ভব মিথ্যা, মনগড়া সংবাদ পরিবেশন করেছিল এবং জঘন্য কুৎসামূলক সম্পাদকীয় নিবন্ধ লিখে বাংলা ও বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে বিষােদগার করেই কর্তব্য শেষ করেনি, সাম্প্রদায়িকতার উদ্দেশ্যমূলক উস্কানিও দিয়েছে। মর্নিং নিউজ’-এর প্রচারে, বক্তব্যে, নিবন্ধে সাংবাদিক সততার কোন মানদণ্ডই রক্ষা করা হয় নি। দিনের পর দিন মিথ্যা খবর ছাপিয়ে, বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে লাগাতার জেহাদ চালিয়ে মর্নিং নিউজ’ নিজস্ব পদ্ধতিতে তার জাতির কণ্ঠস্বর (ভয়েস অব নেশান’) পরিচয় ও চরিত্র বজায় রাখতে চেষ্টা করেছে। ভাষা আন্দোলন উপলক্ষে ‘মনিং নিউজ’-এর সেই কুখ্যাত ব্যানার ঢােটিস রােমিং ঢাকা স্ট্রিটস’ শুধু সম্প্রদায়-বিদ্বেষের প্রকাশই ছিল না, তার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যও ছিল স্পষ্ট যে কারণে মনিং নিউজ’ প্রতিটি রাজনীতিসচেতন বাঙালির ক্ষোভ ও ঘৃণার পাত্র হয়ে উঠেছিল। সেই ক্ষোভ মুক্তি পায় বাইশে ফেব্রুয়ারি এই পত্রিকার ছাপাখানা জুবিলি প্রেস’ পুড়িয়ে ছাই করার মধ্য দিয়ে, যে কাজে ছাত্রদের তুলনায় পুরনাে ঢাকার স্থানীয় যুবকরাই অংশ নিয়েছিলেন অধিক সংখ্যায়। এমনকি একুশে ফেব্রুয়ারির সেই আবছা ভােরে মেডিকেল কলেজের জনাদুই ছাত্র ইংরেজিতে ভয়েস অব নেশন’ লেখা মর্নিং নিউজ-এর দ্রুত ধাবমান অস্টিন ভ্যান গাড়িটিকে ফুলার রােডে পুড়িয়ে দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা চালায়। এসব থেকেই একুশে ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে মনিং নিউজ’-এর ভূমিকা অত্যন্ত স্পষ্ট।
ঢাকাই নবাববাড়ির পত্রিকা ‘মর্নিং নিউজ’-এর মতাে অতটা না হলেও দৈনিক “সংবাদ পত্রিকার কর্তাভজা নীতি পরােক্ষে হলেও এই আন্দোলনের বিরােধী ভূমিকা নিতে সাহায্য করে। প্রগতিবাদী সাংবাদিক হিসেবে বহু পরিচিত কিছুসংখ্যক ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি সত্ত্বেও ‘সংবাদ’ ভাষা আন্দোলনের সমর্থনে দাড়ানাে দূরে থাক, একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনাদি সম্পর্কে বিকৃত খবর ও তথ্য প্রকাশ করতে দ্বিধা করে নি। ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে এ ধরনের বিজাতীয় ভূমিকা গ্রহণের কারণে দৈনিক ‘সংবাদ’ শুধু ছাত্রদেরই নয়, বংশাল এবং আশপাশ এলাকার স্থানীয় ছাত্র ও যুবকদের তীব্র সমালােচনার সম্মুখীন হয়। আর এই কারণেই আন্দোলনের তুঙ্গ পর্যায়ে, বিশেষ করে বাইশে ফেব্রুয়ারি চলমান মিছিল থেকে একাধিকবার ‘সংবাদ অফিসে হামলা চালানাে হয়, কিন্তু পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সজাগ তৎপরতায় পত্রিকাটি কোন ক্ষতি হয় নি। সাংবাদিক আনিস চৌধুরীর ভাষায় সংবাদের ভূমিকা বরাবরই ছিল রাষ্ট্রভাষা-বিরােধী ।১২৯ | এমনি করে বাহান্নর দৈনিক ‘সংবাদ’ ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে পক্ষপাতদুষ্ট খবর ছেপে এবং সরকার-সমর্থনে চতুর সম্পাদকীয় নিবন্ধ লিখে যেমন বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতীয়তার বিরুদ্ধ ভূমিকা নিয়েছে তেমনি নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার নীতিধর্মও লঙ্ঘন করেছে। আজকের সংবাদকে দেখে একালের পাঠক সেকালের সংবাদ-এর বিজাতীয় ভূমিকা গ্রহণের কথা ভাবতেই পারবেন | অন্যদিকে ইনসাফ’ স্বল্প-প্রচারিত পত্রিকা হলেও ভাষা আন্দোলনের উপস্থাপনায় নিরপেক্ষ ও বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। তেমনি ছিল ‘জিন্দেগী’র ভূমিকা। কিন্তু এদের সংবাদ-প্রতিবেদকগণ যথেষ্ট চৌকস ও পারদর্শী না হওয়ার কারণে এদের সংবাদ-পরিবেশনে কিছুটা ভুলত্রুটি যেমন দেখা গেছে, তেমনি উপস্থাপনার মানগত উৎকর্ষেও কিছুটা ঘাটতি দেখা গেছে। তাছাড়া কিছু আবেগবাহুল্য ও অতিরঞ্জন তাে ছিলই।
পূর্ববাংলার দৈনিক পত্রিকার উল্লিখিত ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিত্তবান শ্রেণীর প্রতিভূ সেখানকার ইংরেজি দৈনিকগুলাের কোন কোনটিতে ভাষা আন্দোলন সংক্রান্ত বাস্তব অবস্থা মেনে নেয়ার প্রবণতা দেখা যায়। যে ‘ডন’ পত্রিকা দুই সপ্তাহ আগের (৬ ফেব্রুয়ারি) এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলে অভিহিত করতে দ্বিধা করে নি, সেই পত্রিকাই একুশে ফেব্রুয়ারির গুলি চালনা প্রসঙ্গে ‘ঢাকার মর্মান্তিক ঘটনা’ শীর্ষক সম্পাদকীয় লিখে কিছুটা সত্যদর্শন ও সত্য উপস্থাপন করতে পেরেছিল, যা পূর্ববঙ্গীয় মর্নিং নিউজ’ ও ‘সংবাদ’ পারে নি। যদিও তেইশে ফেব্রুয়ারি সংখ্যা ‘ডন’-এ আজাদ-এর মতােই দুই দিক রক্ষার চেষ্টা রয়েছে, তবু বাংলা রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি এখানে উল্লেখযােগ্য ঘটনা। ‘ডন-সম্পাদকীয়তে (দৈনিক আজাদ-এর ভাষান্তরে) বলা হয়েছে :১০০। বাংলা ভাষাকে উর্দুর সমমর্যাদা দেওয়া হইলেও পশ্চিম পাকিস্তানের জনসাধারণের মােটেই আপত্তি থাকিতে পারে না।… ‘ছাত্রসমাজের একটা বিরাট অংশ তাহাদের আন্তরিক বিশ্বাসের দ্বারা অনুপ্রাণিত হইয়া বিক্ষোভ প্রদর্শন করিয়াছে এবং সত্যকার পাকিস্তানি হিসাবে তাহারা আপনাদের ধারণা অনুযায়ী কর্মপন্থা অবলম্বন করিয়াছে। অবশ্য তাহাদের মধ্যে প্ররােচনাদানকারী হিসাবে কিছুসংখ্যক লােক থাকিতে পারে ।… পূর্ব পাকিস্তানে আমাদের আত্মীয়-স্বজনেরা ভাষাগত সমস্যাটিকে কিরূপ গভীরভাবে অনুভব করে, তাহার পরিচয় এই সকল ঘটনাবলীর মধ্য হইতে লক্ষ্য করিতেছি। উর্দুর ন্যায় বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দান সম্পর্কে একটি প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী ব্যবস্থা পরিষদে পাশ করাইয়া লইয়াছেন।…গণপরিষদও যথাসময়ে উহা অনুমােদন করিবেন এবং বাংলা ভাষাকে উর্দুর সমমর্যাদা দানের ব্যাপারে পশ্চিম পাকিস্তানেরও কোন ক্ষোভের কারণ থাকিবে না বলিয়া আমরা বিশ্বাস করি।’১৩০ এ বক্তব্য এত স্পষ্ট যে ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না। কিন্তু মনে রাখা দরকার যে, গণপরিষদের অনুমােদন সহজে মেলে নি। করাচির ‘ইভনিং স্টার’ এবং “ইভনিং টাইমস’ পত্রিকা দুটোতেও গুলিবর্ষণ সম্পর্কে তদন্ত অনুষ্ঠানের দাবি করে এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রতি সমর্থন জানিয়ে প্রবন্ধ লেখা হয়।১৩১ পরে ইভনিং টাইমস পত্রিকার ডাকসাইটে সম্পাদক জেড.এ. সুলেরী সরেজমিনে অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য (এবং পাকিস্তান অবজার্ভার-এর জন্যও বটে) ঢাকা এসে সব দেখেশুনে বিবৃতি দিয়েছিলেন এই বলে যে : বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকার করিয়া লওয়ার দ্বারা বাস্তবকেই স্বীকার করিয়া লওয়া হইবে। ইহা নিছক সুবিধাদানের ব্যাপার নহে। ইহাকে স্বীকার করিয়া লওয়ার ফলে জাতি হিসাবে আমাদের সংহতিই বৃদ্ধি পাইবে।”১৩২ | কিন্তু পাকিস্তান যে একক একটি জাতি তথা জাতিসত্তার প্রতিভূ নয়, বরং বহুজাতিক বহু-সংস্কৃতির সমন্বিত রূপ, এই সত্য তাদের পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব। ছিল না। তবু আন্দোলনের তীব্রতা ও গভীরতা বিবেচনায় হয়তাে তারা সর্বনাশের পরিপ্রেক্ষিতে অর্ধেকত্যাগের আপােসপন্থায় বিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন।
আমাদের দেশী দৈনিক পত্রিকার পাশাপাশি কলকাতার ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য টেসম্যান’-এ একুশের সব খবরের সারসংক্ষেপ ছাপা হয় অনাবেগ যুক্তিনিষ্ঠায়। একুশের গুলি ও অন্যান্য ঘটনা সম্পর্কে স্টেটসম্যান পত্রিকার শিরােনাম ছিল “ঢাকায় ছাত্রদের উপর পুলিশের গুলিবর্ষণ’ : ভাষার প্রশ্ন নিয়ে প্রতিবাদ মিছিল’ : এসেম্বলীতে প্রতিবাদ’১৩৩ ইত্যাদি। একুশের ফেব্রুয়ারির ঘটনাদি সম্পর্কে সেখানে সংক্ষেপে বলা হয়েছে : অন্ততপক্ষে একজন ছাত্রের তাৎক্ষণিক মৃত্যু এবং দুইজনের মারাত্মকভাবে আহত হওয়ার কথা, পুলিশের সাথে সংঘর্ষে আরাে ষাটজনের আহত হওয়ার ও প্রায় ১০০ জন ছাত্রের গ্রেফতার হওয়া, এমনকি ছাত্র-পুলিশে পরস্পরের প্রতি ইটপাটকেল ছুঁড়ে মারার চিত্তাকর্ষক বিবরণ। পরিষদ ভবনের ঘটনাবলীর সংক্ষিপ্ত বিবরণ যেমন আছে, তেমনি আছে কংগ্রেস এম.এল.এ এবং মৌলানা তর্কবাগীশশামসুদ্দিন প্রমুখ পরিষদ সদস্যের পরিষদ কক্ষ ত্যাগের ঘটনা, এমনকি মেডিকেল হােস্টেলে অবস্থিত মাইকে প্রচারের ঘটনাও বাদ পড়ে নি। পরবর্তী কয়েকদিনের ঘটনাও অনুরূপ সাংবাদিক সততার সাথে পরিবেশিত হয়েছে।১৩৩
দৈনিক পত্রিকাগুলাের পাশাপাশি সাপ্তাহিকগুলাে একই মানসিকতা নিয়ে একুশের সংবাদচিত্র তুলে ধরেছে। তবে সাপ্তাহিক পত্রিকা বিধায় এখানে বক্তব্যের জৌলুসই ছিল প্রধান। মজলুম জননেতা মৌলানা ভাসানী-প্রতিষ্ঠিত’ সাপ্তাহিক ইত্তেফাক আবেগদৃপ্ত ভাষায় একুশে ফেব্রুয়ারির দীপ্তচিত্র তুলে ধরেছে। এর সম্পাদকীয় শিরােনাম ছিল বিচার চাই’ (আজাদ-এর ‘তদন্ত চাই’-এর পরিবর্তে ) মৌলানা ভাসানীর বিবৃতির সুরে সুর মিলিয়ে বলা হয়: ‘দেশের অযুত কণ্ঠের সাথে কণ্ঠ মিলাইয়া আমাদের ঘােষণা শুধু ছাত্র-জনতাঘাতক সরকারি কর্মচারীদের নয়—এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের হােতা সরকারেরও বিচার চাই প্রকাশ্য গণআদালতে। সাপ্তাহিক ‘নওবেলাল’ শুধু ঢাকা শহরের সংবাদই নয়, সিলেট জেলা ও তার আশপাশ অঞ্চলের গ্রামীণ স্কুলগুলােতে ছড়িয়ে পড়া আন্দোলনের খুঁটিনাটি বিবরণও তুলে ধরেছিল, যেমন : | ‘ছাত্রকর্মী ও যুবকদের তৎপরতায় আন্দোলন আজ সাফল্যের সাথে দ্রুত অগ্রসর হইতেছে।…গ্রাম্য বিদ্যালয়গুলি ২২শে ফেব্রুয়ারি থেকে এক সপ্তাহকাল পূর্ণ ধর্মঘট পালন করে।১৩৫। এই পত্রিকায় ‘বুলেটের মুখে গেয়ে গেল যারা সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয় : ‘ঢাকার বুকে যাহারা জালিনওয়ালাবাগের পুনরাভিনয় করিল তাহাদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশের ভাষা আমাদের নাই। সমগ্র জাতির সহিত আমরাও এই রক্তখেকো নরদানবদের কুকর্মের প্রতিবাদ করিতেছি।…
জালিনওয়ালাবাগের রক্তক্ষরণ একদিন সাম্রাজ্যবাদীর আসনকে টলাইয়া দিয়াছিল। মাশরেকী পাকিস্তানের এই নব জালিনওয়ালাবাগ এই পাকিস্তানের নররাক্ষসদের রাজত্বের অবসান ঘনাইয়া আনিবে। ‘বুলেটের মুখে যারা জীবনের জয়গান গাহিয়া গেলেন তাদের আত্মা চিরশান্তি লাভ করুক—সমগ্র জাতির সহিত অশ্রুসিক্ত নয়নে ইহাই আমাদের প্রার্থনা।”১০৮ পাঠক এখানে ঘটনার বাস্তব বিবরণের চেয়ে, তথ্য পরিবেশনার চেয়ে আবেগউচ্ছাস ও আলঙ্কারিক বয়ানই দেখতে পাবেন বেশি; ইত্তেফাকও এর ব্যতিক্রম নয়। সত্যি বলতে কি তখনকার সাপ্তাহিকগুলাের চরিত্রই ছিল এরকম। এদিক থেকে সাপ্তাহিক সৈনিক’ অন্যগুলােকে ছাড়িয়ে গেছে যেমন আবেগ পরিবেশনে তেমনি ঘটনার অতিরঞ্জিত বয়ানে। ফলে ভুলত্রুটির মাত্রা এখানে যথেষ্ট লক্ষণীয়। একুশে ফেব্রুয়ারির গুলি চালনা সম্পর্কে ২৩ ফেব্রুয়ারি সৈনিক-এর প্রতিবেদনে শিরােনাম : শহীদ ছাত্রদের তাজা রক্তে রাজধানী ঢাকার রাজপথ রজিত।’ ‘মেডিকেল কলেজ হােস্টেলে ছাত্রসমাবেশে নির্বিচারে পুলিশের গুলীবর্ষণ। | ‘বৃহস্পতিবারেই ৭ জন নিহত : ৩ শতাধিক আহত : ৬২জন গ্রেপ্তার।’ ‘রক্তাক্ত ২১ ফেব্রুয়ারি।” | ‘ঐতিহাসিক এই দিন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে পূর্ববঙ্গ সরকারের পুলিশ বাহিনী নিরীহ ও নিরস্ত্র জনতাকে গুলীবর্ষণ করিয়া ঢাকার রাজপথ ও মেডিকেল ছাত্রাবাস প্রাঙ্গণ রক্তরঞ্জিত করে। অপরাহ চার ঘটিকায় ভয়াবহ পুলিশী। অভিযান শুরু হয়। গুলীর আওয়াজে রমনা এলাকা মুহুর্মুহু প্রকম্পিত হইয়া উঠে এবং কাঁদুনে বােমার গ্যাসে বিশ্ববিদ্যালয় হইতে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ পর্যন্ত বিস্তৃত বিরাট এলাকা ধূমাচ্ছন্ন হইয়া যায়। | ‘পুলিশ মেডিকেল কলেজ হােস্টেল প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে ও বেপরােয়াভাবে গুলিবর্ষণ করিতে থাকে। ফলে ১২নং শেডের বারান্দায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্র সালাহুদ্দিন গুলীবিদ্ধ হইয়া সঙ্গে সঙ্গেই মারা যায়। গুলীর আঘাতে তাহার মাথার খুলী উড়িয়া যায়। গুলীর আঘাতে হােস্টেলের অন্যান্য কয়েকটি শেডের বারান্দায়ও কয়েকজন ছাত্রকে আহত অবস্থায় পড়িয়া থাকিতে দেখা যায়।১৩৭ | এছাড়া একুশের পরের দিনগুলােতেও বিশেষ করে বাইশে ফেব্রুয়ারি মেডিকেল কলেজ হােস্টেলের প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত গায়েবি জানাজায় ও লক্ষাধিক জনতার মিছিলে মৌলানা ভাসানীর নেতৃত্বদান, আবুল বরকতের বুকে গুলিবিদ্ধ হওয়া ইত্যাদি বেশকিছু ভুল খবর সৈনিক’-এ প্রকাশিত হয়েছিল, যে সম্বন্ধে আমরা পরে আলােচনায় আসছি।
এছাড়া সরলানন্দ সেনের ঢাকা থেকে পাঠানাে একুশের সংবাদ ঢাকার চিঠি নামে কলকাতায় যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ঢাকার চিঠি পরে ঢাকায় গ্রন্থাকারে প্রকাশিত। ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক চাষী’ পত্রিকাটিও একুশের ঘটনা নিয়ে বিশেষ সংখ্যা বের করেছিল বাইশে ফেব্রুয়ারি। | এমনি করে নানারঙা রেখার টানে পক্ষপাত-অপক্ষপাতে মেশা একুশে ফেব্রুয়ারির সংবাদচিত্র দেশ-বিদেশের প্রধান সংবাদপত্রগুলােতে বিশেষ তাৎপর্য নিয়ে ধরা পড়েছিল, যা বিশদ বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে। কিন্তু ঐসব ঘটনাবলীর নির্ভুল চিত্র ও পরিচয় পেতে হলে আজকের গবেষকের পক্ষে নির্দিষ্ট দুই একটি পত্রিকার প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করলে চলবে না, সেই সঙ্গে প্রয়ােজন হবে বিদেশী পত্রপত্রিকার সাহায্য। আর আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সবার স্মৃতিচারণের ওপর নির্ভর করা যে ঠিক হবে না তেমন পরিচয় পাঠক ইতােমধ্যেই পেয়েছেন। একুশের পরবর্তী দিনগুলােৱ ঘটনাবলীর সংবাদচিত্র আমরা তাই বিভিন্ন পত্রপত্রিকা থেকে যাচাই করে তুলে ধরেছি যাতে পাঠক এই ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর যথাসম্ভব নির্ভুল ও প্রামাণ্য চিত্র পেতে পারেন। ইতিহাস পাঠকের জন্য কিছুটা হলেও সুসংবাদ যে বছর কয় আগে কলকাতার দুএকটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত ভাষাআন্দোলনের কিছু বিবরণ নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে সুকুমার বিশ্বাসের সংকলনগ্রন্থ বাংলাদেশের ভাষাআন্দোলন : কলকাতার সংবাদপত্র :’ (১৯৯৫)। অবশ্য এতে প্রধানত দৈনিক আনন্দবাজার-এর সংবাদই স্থান পেয়েছে। এখনাে প্রকাশের অপেক্ষায় তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি সংবাদপত্রের এবং পশ্চিমা সংবাদপত্রের ভাষাবিষয়ক আন্দোলনের বিবরণ।
সূত্র : ভাষা আন্দোলন-ইতিহাস ও তাৎপর্য – আবদুল মতিন, আহমদ রফিক