You dont have javascript enabled! Please enable it! 1952 | ভাষার প্রশ্ন কিভাবে এল - সংগ্রামের নোটবুক

ভাষার প্রশ্ন কিভাবে এল

বিভাগপূর্বকালের রাজনীতি ও ভাষা পরিস্থিতি একাধিক ভাষা বা সম্প্রদায় অধ্যুষিত দেশে বিশেষ কোনাে সম্প্রদায়কে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক স্বার্থের অসম বিকাশ, তা যেকোনাে কারণেই হােক না কেন, অনুন্নত সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি না করে পারে না। আর সেই প্রতিক্রিয়ার টানে ঐ জাতি বা সম্প্রদায় সেই অসমতা দূর করার বা তাদের অবস্থা পরিবর্তনের ইচ্ছায় যেকোনাে রাজনৈতিক পন্থা গ্রহণ করতে পারে—সে পথ হতে পারে অন্ধ আবেগের বা যুক্তির একপিঠ অনুসরণের অথবা হতে পারে পুরােপুরি যুক্তিনিষ্ঠ। জ্ঞান-নির্ভরতার পথ। অর্থাৎ উল্লিখিত পরিস্থিতিতে সম্প্রদায় স্বার্থের একক স্বতন্ত্র পথের বিবেচনা ছাড়াও জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের মধ্যে একটি যুক্তিসঙ্গত রাজনৈতিক পথের সন্ধান মিলতে পারে। এখানে জাতিসত্তা বলতে ভাষাভিত্তিক নৃতাত্ত্বিক-জনতাত্ত্বিক অর্থে চিহ্নিত জনগােষ্ঠী বােঝানাে হয়েছে, সম্প্রদায়ভিত্তিক জনসংখ্যাকে নয়। _ বিভিন্ন ভাষা ও জাতিসত্তা অধ্যুষিত ভারতীয় উপমহাদেশের জন্য শেষােক্ত রাজনৈতিক সমাধানই ছিল সঠিক, কিন্তু নানা বিরােধী কারণের টানাপােড়েনে রাজনৈতিক পরিণতি সে পথ ধরে নি। সেখানে, বিশেষ করে অবিভক্ত বঙ্গদেশে নানা ঐতিহাসিক কারণে সামাজিক-অর্থনৈতিক দিক থেকে পশ্চাৎপদ মুসলমান সম্প্রদায় প্রথমােক্ত পথের অনুসারী হয়েছেন। ভাগ্য পরিবর্তনের ইচ্ছায় অস্থির। মুসলমান বাঙালির মধ্যে তাই সম্প্রদায়-চেতনা-নির্ভর রাজনীতির জন্ম এবং চল্লিশের দশকে এর দ্রুত বিকাশ ও শক্তি অর্জন। এই বিকাশ ঘটেছে গােটা উপমহাদেশের রাজনৈতিক স্রোতের প্রভাবে।।  উপমহাদেশের দুই প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায় হিন্দু-মুসলমানের আর্থ-সামাজিক স্বার্থের বৈষম্য ও দ্বন্দ্ব যেমন গােটা ভূখণ্ডব্যাপী এক সমন্বিত, অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক চেতনা গঠনে বাধা সৃষ্টি করেছিল, তেমনি অন্যদিকে একাধিক ভাষা ও জাতিসত্তার স্বতন্ত্রভাবে আত্মনিয়ন্ত্রণের ও রাষ্ট্রগঠনের চেতনাও। গড়ে উঠতে দেয় নি। এর পেছনে আরাে নানা কারণের সঙ্গে বিশেষভাবে সক্রিয় ছিল উপনিবেশবাদী ইংরেজ শাসনের বিভেদনীতি, যা সুস্থ জাতীয়তাবাদী শক্তির সমন্বিত বিকাশে বাধা সৃষ্টি করেছে। 

এ পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন বাম রাজনীতির ব্যর্থতা হলাে উল্লিখিত বিষয়ে সুস্পষ্ট ও সঠিক নীতি গ্রহণ করতে এবং একাধিক ভাষা ও জাতিসত্তা অধ্যুষিত এই উপমহাদেশে প্রতিটি ভাষাভিত্তিক জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের সমাজবিজ্ঞান-সম্মত অধিকারের বিষয়টি রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হিসেবে চিহ্নিত করতে না পারা। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, সেই সঙ্গে ঔপনিবেশিক শাসনের ছত্রচ্ছায়ায় গড়ে-ওঠা জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রেক্ষাপটে শ্রেণীসংগ্রামের সম্ভাবনা, বিকাশ ও সম্ভাব্য পরিণতির বাস্তব মূল্যায়নে মনোেযােগের অভাব। | তাই নিজস্ব দিকদর্শনে সুস্থিত না হয়ে বামশক্তি সম্প্রদায়-চেতনাসমৃদ্ধ তথাকথিত জাতীয়তাবাদী রাজনীতির দুই প্রধান সােতে সংশ্লিষ্ট হয়ে অবশেষে লীগ কংগ্রেস এক হও’ ধ্বনি তুলে এক ভ্রান্তনীতির শিকার হয়েছে। এই ভুলের ফসল তােলা হয়েছে সাতচল্লিশে উভয় সম্প্রদায়ের নিরীহ, অসহায় জনসাধারণের রক্তস্রোতে সম্প্রদায়ভিত্তিতে দেশবিভাগ সম্পন্ন করে। এমনকি প্রদেশ তথা জাতিসত্তা বিভাজনের কাজটিও নির্বিচারে শেষ করা হয়েছে এবং এসব ক্ষেত্রে ভাষা-নৃতত্ত্ব-জনতত্ত্ব ও সংস্কৃতিগত বৈশিষ্ট্যের বিজ্ঞানসম্মত বিচার অগ্রাহ্য করা হয়েছে। অবিভক্ত বঙ্গদেশে ভারতের অন্যান্য অংশের মতােই প্রবল রাজনৈতিক উত্তেজনার এবং পূর্বাবধি সঠিক নীতি গ্রহণে ব্যর্থতার কারণে বাঙালি হিন্দুমুসলমান এই উভয় সম্প্রদায়ের সিংহভাগ মানুষ তাদের রাজনৈতিক সমস্যার সুস্থ সমাধানের দিকে নজর ফেরান নি কিংবা বলা যায় নজর দেয়ার মতাে মানসিক অবস্থা তাদের ছিল না। কিন্তু রাজনীতির এই অস্থির উত্তেজনার টালমাটাল অবস্থায় উদ্ভূত ধর্মনির্ভর পাকিস্তানি জাতীয়তার প্রবল রাজনৈতিক প্রভাবের মধ্যেও ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনার কিছু উপাদান বাঙালি মুসলমান সমাজের অতি সংখ্যালঘু অংশে তথা তরুণ শিক্ষিত সমাজের ক্ষুদ্র একাংশে অসংগঠিত এবং বিক্ষিপ্তভাবে হলেও উপস্থিত ছিল।

এক্ষেত্রে অন্তত একটি উদাহরণ তুলে ধরা যেতে পারে। তৎকালীন রাজনৈতিক বিরােধের পটভূমিতে মীমাংসাসূত্র হিসেবে লেখ ওয়াজেদ আলী তার ভবিষ্যতের বাঙালি’ গ্রন্থে (১৯৪৩) ভাষা-জাতি-নৃতত্ত্ব । সংস্কৃতির স্বাতন্ত্রের ভিত্তিতে ভারতবর্ষে একাধিক স্বয়ংশাসিত রাষ্ট্রগঠনের প্রস্তাব রেখেছিলেন এই বলে যে : ভূগােল, ইতিহাস, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, ভাষাতত্ত্ব প্রভৃতি বিভিন্ন দৃষ্টিন্দ্রে থেকে বিচার করলে, ভারতবর্ষে স্বাভাবিক কয়েকটি ভৌগােলিক বিভাগ দেখতে পাওয়া যায় …এইসব ভূখন্সের প্রত্যেকেরই নিজস্ব ভাষা, নিজৰ কৃষ্টি, নিজস্ব ইতিহাস, নিজস্ব নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, নিজস্ব অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সমস্যা আছে। এই ভূখণ্ডগুলির নিজ নিজ বিশেষত্বের দিকে লক্ষ্য করলে, এদের প্রদেশ না বলে এক একটি রাষ্ট্র বা উপরাষ্ট্র বললেই সঙ্গত হয়। ভারতের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রতন্ত্রে এই বিভিন্ন উপরাষ্ট্রগুলির বিশেষত্বের দিকে লক্ষ্য রেখে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণশীল এক একটি রাজ্যের অধিকার দেওয়া দরকার। এই পরিপ্রেক্ষিতে মূলত বঙ্গদেশের ভৌগােলিক, নৃতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও ভাষাগত স্বাতন্ত্রের এবং বাঙালির গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী চেতনার ভিত্তিতে লেখক তৎকালীন বঙ্গদেশের রাষ্ট্রীয় জীবনের স্বাতন্ত্র’ এবং ‘নব্যতুকীর মত অখণ্ড এক আদর্শ জাতীয়তা’র প্রশ্ন তুলে ধরেছিলেন।  কিন্তু চল্লিশ থেকে ছেচল্লিশ—এই সাত বছরের রাজনৈতিক বিবাদ ও উত্তেজনা এবং সেই সঙ্গে বিশ্বযুদ্ধ, দাঙ্গা, সামাজিক অবক্ষয় এবং তেতাল্লিশের মন্বন্তরের মতাে নানা দুর্যোগ-দুর্ভোগ মানুষের মন থেকে সুস্থ চিন্তার অবকাশ কেড়ে নিয়েছিল।

হয়তাে তাই রাজনৈতিক ক্ষেত্রের কিছু তাৎপর্যময় ঘটনা কিছুটা উপপ্লবের পরিবেশ নিয়েও বড় একটা প্রভাব ফেলতে পারে নি এবং এর কারণ হিসেবে নীতি ও নেতৃত্বের ব্যর্থতাই ছিল প্রধান। আর সেসব কারণেই জাতীয়তাবাদী মুসলমান নামক ছােট্ট রাজনৈতিক গােষ্ঠী এবং দেশবিভাগের কিছুকাল পূর্বে আবুল হাশিম গ্রুপসহ মুসলিম লীগের ভেতরে শিক্ষিত তারুণ্যের একাংশে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনার উপস্থিতি সত্ত্বেও চল্লিশের দশকে উঠতি মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কাছে স্বতন্ত্রপথেই অর্থনৈতিক ভাগ্য উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন শ্রেয় মনে হয়েছিল। তাই সম্প্রদায়বাদী রাজনৈতিক নেতৃত্বের বাকচাতুর্যে অভিভূত জনমানসের। কথা ছেড়ে দিয়েই দেখা যায় যে বাঙালি মুসলমান সাহিত্যিক-সাংবাদিকবুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশই স্বতন্ত্রপথে তাদের সামাজিক অর্থনৈতিক বিকাশের পক্ষপাতী ছিলেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবেগের পাশাপাশি যুক্তির সাহায্যে এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের উক্তির সাহায্য নিতেও দ্বিধা করেন নি, যদিও এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের সমর্থন ছিল ভিন্ন তাৎপর্যে। রবীন্দ্রনাথ জাতীয় রাজনীতিতে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের সম্মিলিত পদক্ষেপের পূর্বশর্ত হিসেবে অনুন্নত বাঙালি মুসলমানের একক ধারায় সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নতির পক্ষে সােচ্চার হয়েছিলেন। দেশ, সমাজ ও জাতিসত্তা বিভাগের পক্ষপাতী ছিলেন না তিনি। সেই অর্থেই তিনি বলেছিলেন ; ‘আধুনিককালের শিক্ষার প্রতি সময় থাকিতে মনােযােগ না করায় মুসলমান  হিন্দুর চেয়ে অনেক বিষয়ে পিছাইয়া পড়িয়াছে। সেখানে তাহাকে সমান হইয়া লইতে হইবে।… পদমান শিক্ষায় তাহারা হিন্দুর সমান হইয়া উঠে ইহা হিন্দুৱই পক্ষে মঙ্গলকর।… আজ আমাদের দেশে মুসলমান স্বতন্ত্র থাকিয়া নিজের উন্নতিসাধনের চেষ্টা করিতেছে।

তাহা আমাদের যতই অপ্রিয় এবং তাহাতে আপাতত আমাদের যতই অসুবিধা হউক একদিন পরস্পরের মিলনসাধনের ইহাই প্রকৃত উপায়। মুসলমানের এই স্বাত্মবাদী পথে আত্মউন্নয়নের পক্ষে তার সমর্থনের পেছনে প্রত্যাশা ছিল যে, “একদিন হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে দেশহিত সাধনের একই রাষ্ট্রীয় আইডিয়াল যদি আমাদের রাষ্ট্রতন্ত্রে বাস্তব হইয়া উঠে তবে সেই অন্তরের যােগে বাহিরের সমস্ত পার্থক্য তুস্থ হইয়া যাইবে। কিন্তু তথাকথিত জাতীয়তাবাদী রাজনীতির অদূরদর্শী চিন্তায় ঐ যৌথ কল্যাণের আদর্শ ধরা দেয় নি। হিন্দু-মুসলমানের মিলন উপলক্ষে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রসঙ্গও রবীন্দ্রনাথের মনে এসেছে। বাংলাদেশে সৌভাগ্যক্রমে আমাদের একটা মিলনের ক্ষেত্র আছে।…সে। আমাদের ভাষা ও সাহিত্য। এইখানে আমাদের জাতিভেদের কোনাে ভাবনা নাই।” বাঙালি মুসলমানের জাতিসত্তার প্রয়ােজনে মাতৃভাষা বাংলার গুরুত্ব এবং সেক্ষেত্রে বাংলার পরিবর্তে অন্য কোনাে ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিষময়, পরিণতি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ চৌষট্টি বছর আগে স্পষ্ট ভাষায় হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন, অবশ্য একটু ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ; ‘বাংলাদেশের শতকরা নিরানব্বইয়েরও অধিকসংখ্যক মুসলমানের ভাষা বাংলা । সেই ভাষাটাকে কোণঠাসা করিয়া তাহাদের ওপর যদি উর্দু চাপানাে হয় তাহা হইলে তাহাদের জিহ্বার আধখানা কাটিয়া দেওয়ার মতাে হইবে না কি? চীন দেশে মুসলমানের সংখ্যা অল্প নহে, সেখানে কেহ বলে না যে চীনা ভাষা ত্যাগ না করিলে তাহাদের মুসলমানির খর্বতা ঘটিবে।” দেখা যাচ্ছে, বাংলা-উর্দু ঘিরে বাঙালি মুসলমানের ভাষা সমস্যার বিষয়টি, একটু ভিন্নভাবে হলেও দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্কিত বিষয় হিসেবে উপস্থিত এবং রবীন্দ্রনাথ সঙ্গত কারণেই এ সম্পর্কে তার সুচিন্তিত মতামত দিতে এগিয়ে এসেছিলেন। এর কারণ, সেসময় একদল আধা-বাঙালি, উর্দুভাষী বাঙালি ও রক্ষণশীল চিন্তার বাঙালি মুসলমান পরিকল্পিতভাবে গােটা মুসলমান সম্প্রদায়ের মাতৃভাষারূপে উর্দুর পক্ষে প্রচার চালাতে থাকেন।

সাহিত্য, সংস্কৃতি ও অন্যান্য অঙ্গনে এর প্রতিক্রিয়া ছিল বিপরীতমুখী। রবীন্দ্রনাথ এ সম্পর্কেই ওপরের কথাগুলাে বলেছিলেন। অবশ্য বাঙালি মুসলমানের শিক্ষিত সচেতন অংশ এই ঝোঁকের বিরুদ্ধে তখন থেকেই লড়াই করে এসেছেন, যদিও লড়াইটা প্রধানত ছিল সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনেই সীমাবদ্ধ। এ প্রসঙ্গে একটি ছােট ঘটনা : দিনটি ছিল ১৯৪০ সালে ৩১ মার্চ। কলকাতায় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে ইকবাল কিস পালিত হয়ে। সেখানে বাংলা ভাষায় বক্তৃতাদান সম্পর্কে অনুষ্ঠানের সভাপতি আবদুর রহমান সিদ্দিকীর বিরূপ মন্তব্যে উপস্থিত ছাত্র-যুবকদের মধ্যে এমনই উত্তেজনার সৃষ্টি হয় যে সভাপতিকে সভাকক্ষ ছেড়ে চলে যেতে হয়। বিক্ষুব্ধ শ্রোতাদের শান্ত করার উদ্দেশ্যে সমিতির সম্পাদক হাবিবুল্লাহ বাহারকে বলতে হয় : ‘বঙ্গভাষা আজ বিশ্বে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করিয়া আছে এবং বঙ্গভাষাই বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানের মাতৃভাষা (করতালি ও আনন্দধ্বনি) … সভায় বাংলাভাষায় বক্তৃতা করিতে দেওয়া হইবে না বলা এবং বাংলা ভাষাকে অপমান করা একই কথা। আমরা উর্দুকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু মাতৃভাষার ওপরে তাহাকে স্থান দিতে পারিব না।’ বাংলাভাষা ও সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ সত্ত্বেও দুর্বলচিত্ত জনাব বাহার পরবর্তীকালে মন্ত্রিত্বের টার্নে বাংলার পক্ষে অনুরূপ ভূমিকা পালন করতে পারেন নি, বরং পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুরই পক্ষ নিয়েছেন। যাই হােক সেদিনের ঐ সভায় বাংলার পক্ষে অন্য বক্তাদের মধ্যে মৌলভী মােহাম্মদ ইয়াসিন সাহিত্যরত্ন (৯২ বৎসর বয়স) বলেন : “বাঙালি আরবী, উর্দু, ইংরেজি যে ভাষাতেই পাণ্ডিত্য লাভ করুন না কেন, তাহারা চিরদিন স্বপ্ন দেখিবেন বাংলায়। মাতৃভাষাই মানুষের প্রাণের ভাষা।’ উল্লেখ্য, উর্দু সমর্থকদের আক্রমণে সমিতির যুগ্ম সম্পাদক যে তরুণটির কপাল ফেটে যায় তিনি হচ্ছেন আজকের স্বনামধন্য কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান।

এ তথ্য তার সূত্রেই পাওয়া। মাতৃভাষা : আত্ম-অন্বেষা বাংলাভাষার সাথে বাঙালি মুসলমানের শেকড়-ছোয়া সম্পর্কের বিষয়টি প্রাসঙ্গিকভাবেই এখানে বিবেচনায় আসে। আজকের পাঠকের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হলেও একথা সত্য যে, একদা বাঙালি মুসলমানের শিক্ষিত একাংশ বাংলাকে মাতৃভাষা হিসেবে মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। উর্দুকে তারা চেয়েছেন মাতৃভাষা। ও জাতীয় ভাষারূপে (জাতি বলতে তারা ধর্মীয় সম্প্রদায় বুঝতেন) এবং আরবিকে ধর্মীয় ভাষারূপে। আবার এদের কেউ কেউ জীবিকার জন্য প্রয়ােজনীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজির সমর্থক ছিলেন। অবশ্য পাশাপাশি বিপরীত চিন্তার সমর্থকগণও। সংখ্যায় কম ছিলেন না। সত্যি বলতে কি বাংলা-উর্দু-আরবির ত্রিধারা বিতর্কের মধ্য দিয়ে বাঙালি মুসলমানের আত্ম-অন্বেষার পালা শুরু হয় এবং সেই সঙ্গে জাতিসত্তার প্রতি কৌতূহলী দৃষ্টিপাতও শুরু হয় তখন থেকেই।  প্রধানত উর্দুর প্রতাপ প্রতিহত করার মানসিকতা নিয়েই বিশ শতকের। প্রথমদিক থেকে বাঙালি মুসলমানের আত্ম-অন্বেষার প্রথম পদক্ষেপ। মূলত সংস্কৃতি অঙ্গনের বিষয় হলেও ভাষার প্রশ্নটি একেবারে রাজনীতি-বিমুক্ত ছিল না। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এখানে কাজ করেছে বলে প্রথম থেকেই বাংলার বিরােধিতায় ধমীয় অজুহাত টেনে আনা হয়েছে। এমনকি মােহাম্মদ আকরাম খাঁর মতাে। 

ব্যক্তিগণও এ বিষয়ে যুক্তিসঙ্গত ও বিচক্ষণ ভূমিকা নিতে পারেন নি। পরবর্তীকালেও তার এই ভূমিকার বড় একটা পরিবর্তন ঘটতে দেখা যায় নি, মাঝে মাঝে অবস্থা বিশেষে সাময়িক দিকবদল ছাড়া। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে তিনি বলেন : আমাদের দলের চরমপন্থীরা এখন বলিতে আরম্ভ করিয়াছেন, বাঙ্গালা শুধু আমাদের মাতৃভা নহে, উহা আমাদের জাতীয় ভাষাও বটে। আমার বিবেচনায় এই মত একেবারে অযৌক্তিক এবং সমাজের পক্ষে অত্যন্ত ভয়াবহ …মুছলমানের জাতীয়তা সম্পূর্ণ ধর্মগত। কোন দেশের বা প্রদেশের মুসলমানদিগের দ্বারা কথিত ভাষা সেই সকল স্থানীয় মুসলমানদিগের জাতীয় ভাষা বলিয়া গৃহীত হইতে পারে না। মুসলমানদিগের জাতীয় ভাষা যে আরবী, একথা ভুলিলে মুছলমানের সর্বনাশ হইবে। ধর্মকে জাতীয়তার অবস্থানে টেনে এনে এইসব শিক্ষিত সাংবাদিকরাজনীতিক-সাহিত্যিক জাতিসত্তার তাৎপর্য অনুধাবনে বিন্দুমাত্র বিজ্ঞানমনস্কতার পরিচয় রাখতে পারেন নি। তবে আশার কথা যে এধরনের অযৌক্তিক বক্তব্যের প্রতিবাদ নেহাৎ কম ছিল না। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার ঐ সংখ্যার সম্পাদকীয় নিবন্ধে খাঁ সাহেবের বক্তব্যের জবাব এসেছে খুব স্পষ্টভাবে। সেখানে বলা হয়েছে : ‘জাতি শব্দ লইয়া একটা খটকা বাধিয়াছে।…জাতি অর্থ কোন বিশিষ্ট ধর্ণ সম্প্রদায় নহে।… এই হিসাবে বাঙ্গালা ভাষা বাঙ্গালা দেশের সমগ্র অধিবাসীর জাতীয় ভাষা ।…আমরা আরবী ভাষাকে আমাদের National language বলিতে কিছুতেই রাজী নহি।” | এই বাদপ্রতিবাদের কয়েক মাস পর চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত এক মুসলমান ছাত্রসম্মেলনে সভাপতির ভাষণে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ জাতীয়তা প্রসঙ্গে বলেন : “তােমরা কেবল ছাত্র নও, তােমরা বাঙালি। তােমরা বাঙালি মুসলমান। এক্ষেত্রে ধর্মকে স্বীকার করে নিয়েই বাঙালি জাতীয়তা স্বীকৃতি পেয়েছে। একই প্রসঙ্গে নুরুন্নেছা খাতুন বিদ্যাবিনােদিনী বলেন : “পুরুষানুক্রমে বাংলাদেশের গণ্ডীর মধ্যে বাস করে আর বাঙ্গালা ভাষাতে সর্বক্ষণ মনের ভাব ব্যক্ত করেও যদি বাঙ্গালী না হয়ে আমরা অপর কোনাে একটা জাতি সেজে বেঁচে থাকতে চাই, তাহলে আমাদের আর কোন উত্থান নাই-ই, অধিকন্তু চিরতমসা গহ্বর মধ্যে পতন অবশ্যৰী। সাহিত্য সংস্কৃতি অঙ্গনে উর্দু-বাংলার এই বিতর্ক উপলক্ষে এক সময় কয়েক। দশকের পরিসরে একাধিক বিশিষ্ট ব্যক্তি বাংলার পক্ষে কলম চালিয়েছেন। প্রখ্যাত রাজনীতিক কমরেড মােজাফফর আহমদও এতে অংশ নিয়েছিলেন। তার ভাষায় : যখন উর্দু ভাষা অনুগ্রহণ পর্যন্ত করে নাই, তখনাে বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা। বাংলা হিল ।… বাংলাদেশে আমরা উর্দুকে কখনাে প্রশ্রয় দিতে পারি না। 

এ প্রসঙ্গে সাহিত্যিক সৈয়দ এমদাদ আলী বলেন : কেহ উর্দুর স্বপ্নে বিভাের হইলেও বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা যে বাঙালা এ বিষয়ে কোন মতদ্বৈধ থাকা উচিত নহে।১১ এ বিষয়ে ‘নূর” পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধের তীব্র প্রতিবাদী উচ্চারণ তুলে ধরেই বাংলার পক্ষে মতামত উদ্ধারের দায় শেষ করছি ; বাঙ্গালার মাটি হইতে উর্দুকে নির্বাসিত করিতে না পারিলে বাঙ্গালা ভাষা বাঙ্গালী মুসলমান সমাজের মাথা উচু করিয়া দাঁড়াইতে পারিবে না। মাতৃভাষার বিপুল ও তুমুল চর্চা ব্যতীত কোনও জাতির মুক্তি ও কল্যাণ লাভ কদাপি সম্ভবপর নহে।১২ তাই দেখা যাচ্ছে বাংলার মাটিতে বাঙালি মুসলমানের ঘরে উর্দুকে প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র যেমন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অনেক আগেই শুরু হয়েছে, তেমনি ভাষা আন্দোলনের অনেক আগেই সাহিত্যিক-সাংবাদিক সমাজের একাংশকে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা ও অধিকার রক্ষার জন্য লড়াই চালাতে হয়েছে। এ লড়াই চলেছে শক্তিমান রক্ষণশীল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে, সাতচল্লিশ-আটচল্লিশ ও বাহান্নে এসে যা চলেছে ভিন্নরূপে, ভিন্ন পরিবেশে। এ কারণেই কথাটা আমরা বরাবরই বলে থাকি যে, ভাষা আন্দোলন বিচ্ছিন্ন কোনাে ঘটনা নয়। ভিন্ন চেহারায় হলেও এর সূচনা মূল আন্দোলন শুরু হওয়ার কয়েক দশক আগেই এবং বাঙালি মুসলমানের সেকুলার জাতীয়তাবােধ এর পেছনে কাজ করেছে। তবু অস্বীকার করা চলে না যে উল্লিখিত এই ভাষাচেতনা তথা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবােধের উপকরণ মুসলমান সম্প্রদায়ের উঠতি মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত শ্রেণীর একাংশে অনেকটা অন্তঃশীলা চরিত্র নিয়েই উপস্থিত ছিল এবং ধর্ম-নির্ভর রাজনীতি ও সম্প্রদায়-নির্ভর রাষ্ট্র গঠনের প্রবল স্রোতের বিরুদ্ধে ভাষাচেতনা সুস্পষ্ট রাজনৈতিক চরিত্র অর্জন করতে পারে নি। বিচ্ছিন্নভাবে তা জাতীয়তাবাদী মুসলমান ও মুসলিম লীগের ভাষানুরাগী গ্রুপের মধ্যে উপস্থিত ছিল। সাতচল্লিশে ভারত বিভাগ এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর সেখানকার রাষ্ট্রভাষা নির্বাচনের জল্পনা-কল্পনার মধ্যে উর্দু-বাংলা বিতর্ক আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, যদিও শুরুতে এই বিতর্ক সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনে এবং তরুণদের মধ্যেই প্রকাশ পেয়েছে। মাউন্টব্যাটেন রােয়েদাদের (৩ জুন, ১৯৪৭) পর রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কিত উর্দু-বাংলা বিতর্ক কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও সম্পাদকীয় রচনা ঘিরে প্রকাশ পেলেও নব্য ভুবন লাভের উত্তেজনায় এইসব প্রশ্ন। চাপা পড়ে যায়।  

কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই শাসক রাজনীতিকদের অর্বাচীন নীতি ও অপরিণামদর্শী পদক্ষেপের কারণে ভাষা সংক্রান্ত বিতর্ক ক্রমেই সামনে চলে আসে। ভাষার প্রশ্ন তখন শিক্ষিতমানসে আঘাত করতে থাকে এবং ভাষাচেতনার বিস্তার বিক্ষোভ ও আন্দোলনের ভিত্ গড়ে তােলার মধ্য দিয়ে কয়েক   মাসেই আন্দোলনের বাস্তব পটভূমি তৈরি করে ফেলে। ভাষা বিক্ষোভ ও ভাষা আন্দোলনের এই পটভূমি মনে রাখতে গিয়ে ভুলে গেলে চলবে না যে ভাষাচেতনার বিস্তার ঘটানাের কাজ বিরূপ ও বিপরীত আবহে মােটেই সহজ ছিল না। সেই অগ্রগতির কাজ এক পা দুই পা করে ধীরে-সুস্থে ঘটেছে এবং অনেক সময়ই সেখানে স্বতঃস্ফূর্ততার ভূমিকাই ছিল বড়। সাংগঠনিক শক্তির দুর্বলতা এবং বিপরীত স্রোতের টান প্রথমদিকে যথেষ্ট শক্তিমান হওয়ার কারণে বাংলাপন্থীদের উজান নৌকা বাইতে যথেষ্ট শক্তি ও শ্রমের প্রয়ােজন হয়েছে। বিস্তর বাধা অতিক্রম করে তবেই এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে। এমনি এক শ্রমসাধ্য পরিবেশ সঙ্গে নিয়ে আমাদের ভাষা বিক্ষোভের সূচনায় পৌঁছানাে ।। নব্য ভুবনে ভাষা বিতর্ক : আন্দোলনের সূচনা ভাষা আন্দোলন বলতে সাধারণভাবে আমরা ১৯৪৮ এবং ১৯৫২’র ভাষা সংক্রান্ত আন্দোলন বুঝে থাকি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ভাষা বিতর্কের সূচনা এবং ভাষার প্রশ্নে অসন্তোষ ও ক্ষোভের প্রকাশ দেশ বিভাগের বেশ আগে থেকেই, যেমনটি আমরা আগে উল্লেখ করেছি। “ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ নামক সুবিশাল গ্রন্থে লেখক বশীর আল হেলাল বলেছেন, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস-লেখক বদরুদ্দিন উমরের মতে এই আন্দোলনের ইতিহাসের সূত্রপাত ঢাকায় ১৯৪৭-এর জুলাই মাসে কমরুদ্দিন আহমদের উদ্যোগে গণআজাদী লীগ নামে একটি ছােট গণতান্ত্রিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে।১৩ কিন্তু প্রকৃতপক্ষে গণআজাদী লীগ তাদের গঠনতন্ত্রে বাংলা রাষ্ট্রভাষার দাবি উত্থাপন করেই ক্ষান্ত থেকেছে। গণআজাদী লীগ এ দেশে গণতান্ত্রিক চেতনা বিকাশের উদ্দেশ্যে গঠিত হলেও জনচেতনা বিকাশের জন্য গণআন্দোলন বা ভাষা বিষয়ক কোনাে আন্দোলন ঘটাতে পারে নি কিংবা ঘটাতে চেষ্টা করে নি। ছেচল্লিশের জুন মাসে ঢাকায় মুসলিম লীগের বামপন্থী যুবকদের নিয়ে এ সংগঠনের যাত্রা শুরু।

রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে তাদের দাবিটি ছিল অস্পষ্ট চরিত্রের; গােটা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবি তারা তুলে ধরেন নি। গণআজাদী লীগের ঘােষণাপত্রে বলা হয়েছিল : ‘মাতৃভাষার সাহায্যে শিক্ষাদান করিতে হইবে। বাংলা। আমাদের মাতৃভাষা ।… বাংলা হইবে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।১০ বস্তুত, রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি সুস্পষ্টভাবে উথাপিত হয়েছে জুন মাসে, গণআজাদী লীগ প্রতিষ্ঠার আগেই প্রধানত লেখক-সাংবাদিকদের রচনায়, ৩ জুন। মাউন্টব্যাটেনের ঘােষণার পরপরই এবং অনির্দিষ্টভাবে তারও আগে যেসব তথ্য। ইতােপূর্বে উল্লিখিত হয়েছে। সুনির্দিষ্ট উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৯৪৭ সালের জুন মাসে কলকাতার “ইত্তেহাদ’ পত্রিকার রবিবাসরীয় বিভাগে বাংলা ভাষা বিষয়ক প্রস্তাৰ এই  শিরােনামে লেখক-সাংবাদিক আবদুল হকের একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এই দীর্ঘ প্রবন্ধটির প্রথম অংশ ছাপা হয় বাইশে জুন (১৯৪৭) এবং দ্বিতীয় অংশ একই পত্রিকায় পরবর্তী সপ্তাহে। লেখকের বক্তব্য অনুযায়ী ইত্তেহাদের সাহিত্য সম্পাদক কবি আহসান হাবীব ঐ প্রবন্ধ প্রকাশে সহায়তা করেছিলেন। বাংলার ভাষাগত স্বাতন্ত্র্য ও বাঙালি জাতীয়তাবােধ সম্পর্কে মতামতসহ একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য ঐ প্রবন্ধের দ্বিতীয় অংশে পরিবেশিত হয়েছিল : বাঙালির জাতীয়তাবােধ এখনাে পরিপূর্ণভাবে স্ফুরিত হয় নি। তার জাতীয় মর্যাদাবােধ এখনাে অত্যন্ত কাঁচা, তার পূর্ণ জাতীয় ব্যক্তিত্ববােধ এখনাে অপ্রতিষ্ঠিত।১৪ কথাটা সত্যি যে নানা ঘটনাচক্রে বাঙালি মুসলমান দীর্ঘকাল নিজ বাসভূমে পরবাসীর মতােই বসবাস করেছেন। সে যাই হােক একই লেখকের পরবর্তী প্রবন্ধ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ প্রকাশিত হয় ৩০ জুন (১৯৪৭) দৈনিক আজাদ’ পত্রিকায়।

এতে উর্দুর সাথে তুলনায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার যােগ্যতার ওপর গুরুত্ব আরােপ করে একটি তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক বক্তব্য তুলে ধরা হয় : ‘যে স্বাধীনতা আসছে ভাষাগত স্বাধীনতা না পেলে তা হবে আংশিক এবং বদ্ধমুখ স্বাধীনতা।১৫ প্রবন্ধটিতে সুস্পষ্টভাবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার প্রস্তাব উপস্থাপন করে বলা হয় : “অতএব পাকিস্তানের—কেবল পূর্ব পাকিস্তানের নয়, পূর্ব এবং পশ্চিম উভয় পাকিস্তানকে নিয়ে সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবার যােগ্যতা সবচেয়ে বেশি বাংলা ভাষার।১৫ শুধু তত্ত্বগত যুক্তির দিক নয়, রাষ্ট্রভাষার অর্থনৈতিক দিকটিও এই প্রবন্ধে আলােচিত  “উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘােষণা করার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেকটি উর্দু-শিক্ষিতই চাকুরীর যােগ্যতা লাভ করবেন, এবং প্রত্যেকটি বাংলা ভাষীই চাকুরীর অনুপযুক্ত হয়ে পড়বেন।’১৫ পাকিস্তানের জন্মলগ্নেই রাষ্ট্রভাষার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দিকটি এমনি একাধিক গণতন্ত্রমনা লেখক-বুদ্ধিজীবীর চোখে ধরা পড়েছিল। আবদুল হকের জবানিতেই জানতে পারা যায় : ‘ভারত বিভাগ পরিকল্পনা ঘােষণার পর হিসেব করে দেখা গেল পাকিস্তান, রাষ্ট্রে বাঙালীরাই সংখ্যাগুরু হতে যাচ্ছে। ভাবী রাষ্ট্রের বিভিন্ন সম্ভাবনা নিয়ে অনেক রােমান্টিক জল্পনা।… সেই সময়ে কবি আবুল হােসেন একদিন বললেন, পশ্চিমারা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে যাচ্ছে, এই প্রয়াসের প্রতিরােধ দরকার। এই বিষয়ে দ্বিমতের অবকাশ ছিল না। সংবাদপত্রেও এই প্রয়াসের সংবাদ প্রকাশিত হলাে। বাঙালীদের দিক থেকে দেখতে গেলে, পাকিস্তানের রঙিন জল্পনার ওপর এই ছিল প্রথম আঘাত।১৬ এই আঘাতের বিরুদ্ধে ভাবী পাকিস্তানের স্বাপ্নিক মুগ্ধতার মধ্যেও যারা শাদা। চোখে সমস্যাটি দেখতে পেরেছেন এবং সাহসে ভর করে বাংলাভাষার পক্ষে বক্তব্য প্রকাশ করতে পেরেছেন তারা নিঃসন্দেহে সাধুবাদ পাওয়ার যােগ্য। অবাক হওয়ার কথা যে সাপ্তাহিক মিল্লাত’-এর মতাে পত্রিকাও ঐ বিতর্কে অংশ নিয়ে বাংলা ভাষার পক্ষে যে কড়া সম্পাদকীয় লেখে তা রাজনৈতিক অর্থে তাৎপর্যপূর্ণ : “একটি দেশকে পুরাপুরি দাসত্বে রূপান্তরিত করার জন্য সাম্রাজ্যবাদীর যত রকম অস্ত্র আছে তার মধ্যে সবচাইতে ঘৃণ্য ও মারাত্মক অস্ত্র হইতেছে সেই দেশের মাতৃভাষার পরিবর্তে একটি বিদেশীয় ভাষাকে রাষ্ট্রভাষারূপে প্রতিষ্ঠিত করা। মাতৃভাষার পরিবর্তে অন্য কোন ভাষাকে রাষ্ট্রভাষারূপে বরণ করার চাইতে বড় দাসত্ব আর কিছু থাকিতে পারে না।

পূর্ব পাকিস্তানবাসীকে এই ঘৃণ্য দাসত্বের শৃঙ্খলা বাধিতে যদি কেহ বাসনা করে তাহা হইলে সেই উদ্ভট বাসনা বাঙালীর প্রবল জনমতের ঝড়ের তােড়ে তৃণখণ্ডের মত ভাসিয়া যাইবে।”১৭ “মিল্লাত’ হয়তাে ভাবতে পারে নি যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাঙালি পরিচয়ধারী আইনসভা মুসলমান সদস্যরাই রাষ্ট্রভাষা বাংলার বিরােধিতায় মদদ যােগাবেন। এইসব যুক্তি ও তথ্য থেকে বিষয়টি স্পষ্ট যে গণআজাদী লীগ প্রতিষ্ঠার আগেই সম্ভাব্য উর্দু রাষ্ট্রভাষার বিরুদ্ধে শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানের ছােট্ট সচেতন অংশ বাংলার দাবি সম্পর্কে সােচ্চার হয়েছিলেন। আবার এরই পাশাপাশি কিছুসংখ্যক লেখক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী, যাদের বলা যেতে পারে মধ্যপন্থী, বাংলাকে কেবল পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি ভাষা ও শিক্ষার বাহনরূপে দেখতে চেয়ে প্রকারান্তরে লাগশাসকদের ভাষা-ষড়যন্ত্রের অংশীদার হয়েছেন। লেখক মােহাম্মদ ওয়াজেদ আলী থেকে কবি ফররুখ আহমদ প্রমুখ অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তির নাম এই তালিকায় দেখতে পাওয়া যায়। এরা ভাষা সম্বন্ধে খণ্ডিত চেতনা এবং জাতীয়তা সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা পােষণ করতেন। অন্যদিকে তৃতীয় আরেকটি দলের ছিল উর্দুর প্রতি অন্ধ সমর্থন। এদের বাংলা-বিরােধিতার পেছনে ছিল তাদের তীব্র সম্প্রদায়-চেতনা এবং প্রবল ধর্মান্ধ রাজনৈতিক বিশ্বাস। ঠিক এ সময়েই উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণের পক্ষে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিনের প্রকাশ্য বিবৃতি রাষ্ট্রভাষাবিতর্কে যথেষ্ট উত্তাপ সৃষ্টি করে। এর প্রতিবাদে ২১ জুলাই (১৯৪৭) দৈনিক আজাদে’ প্রকাশিত হয় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ‘পাকিস্তানের ভাষা সমস্যা” শীর্ষক প্ৰৰক। কিন তিনি বাংলার সঙ্গে আরবি ও ইংরেজি প্রশ্ন এনে বিষয়টিতে কিন্তু সংবাদ প্রকাশিত হলাে। বাঙালীদের দিক থেকে দেখতে গেলে, পাকিস্তানের রঙিন জল্পনার ওপর এই ছিল প্রথম আঘাত।১৬ এই আঘাতের বিরুদ্ধে ভাবী পাকিস্তানের স্বাপ্লিক মুগ্ধতার মধ্যেও যারা শাদা। চোখে সমস্যাটি দেখতে পেরেছেন এবং সাহসে ভর করে বাংলাভাষার পক্ষে বক্তব্য প্রকাশ করতে পেরেছেন তারা নিঃসন্দেহে সাধুবাদ পাওয়ার যােগ্য। অবাক হওয়ার কথা যে সাপ্তাহিক “মিল্লাত’-এর মতাে পত্রিকাও ঐ বিতর্কে অংশ নিয়ে বাংলা ভাষার পক্ষে যে কড়া সম্পাদকীয় লেখে তা রাজনৈতিক অর্থে তাৎপর্যপূর্ণ : “একটি দেশকে পুরাপুরি দাসত্বে রূপান্তরিত করার জন্য সাম্রাজ্যবাদীর যত রকম অস্ত্র আছে তার মধ্যে সবচাইতে ঘৃণ্য ও মারাত্মক অস্ত্র হইতেছে সেই দেশের মাতৃভাষার পরিবর্তে একটি বিদেশীয় ভাষাকে রাষ্ট্রভাষারূপে প্রতিষ্ঠিত করা।

মাতৃভাষার পরিবর্তে অন্য কোন ভাষাকে রাষ্ট্রভাষারূপে বরণ করার চাইতে বড় দাসত্ব আর কিছু থাকিতে পারে না। পূর্ব পাকিস্তানবাসীকে এই ঘৃণ্য দাসত্বের শৃঙ্খলা বাধিতে যদি কেহ বাসনা করে তাহা হইলে সেই উদ্ভট বাসনা বাঙালীর প্রবল জনমতের ঝড়ের তােড়ে তৃণখণ্ডের মত ভাসিয়া। যাইবে।’১৭। ‘মিল্লাত হয়তাে ভাবতে পারে নি যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাঙালি পরিচয়ধারী আইনসভা মুসলমান সদস্যরাই রাষ্ট্রভাষা বাংলার বিরােধিতায় মদদ যােগাবেন। এইসব যুক্তি ও তথ্য থেকে বিষয়টি স্পষ্ট যে গণআজাদী লীগ প্রতিষ্ঠার আগেই সম্ভাব্য উর্দু রাষ্ট্রভাষার বিরুদ্ধে শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানের ছােট্ট সচেতন অংশ বাংলার দাবি সম্পর্কে সােচ্চার হয়েছিলেন। আবার এরই পাশাপাশি কিছুসংখ্যক লেখক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী, যাদের বলা যেতে পারে মধ্যপন্থী, বাংলাকে কেবল পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি ভাষা ও শিক্ষার বাহনরূপে দেখতে চেয়ে প্রকারান্তরে লীগশাসকদের ভাষা-ষড়যন্ত্রের অংশীদার হয়েছেন। লেখক মােহাম্মদ ওয়াজেদ আলী থেকে কবি ফররুখ আহমদ প্রমুখ অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তির নাম এই তালিকায় দেখতে পাওয়া যায়। এরা ভাষা সম্বন্ধে খণ্ডিত চেতনা এবং জাতীয়তা। সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা পােষণ করতেন। অন্যদিকে তৃতীয় আরেকটি দলের ছিল। উর্দুর প্রতি অন্ধ সমর্থন। এদের বাংলা-বিরােধিতার পেছনে ছিল তাদের তীব্র সম্প্রদায়-চেতনা এবং প্রবল ধর্মান্ধ রাজনৈতিক বিশ্বাস। ঠিক এ সময়েই উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণের পক্ষে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিনের প্রকাশ্য বিবৃতি রাষ্ট্রভাষাবিতর্কে যথেষ্ট উত্তাপ সৃষ্টি করে। এর প্রতিবাদে ২৯ জুলাই (১৯৪৭) দৈনিক আজাদে’ প্রকাশিত হয় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ‘পাকিস্তানের ভাষ্য সমস্যাশীর্ষক প্ৰৰন্ধ। কিন্তু তিনি বাংলার সঙ্গে আৱৰি ও ইংরেজি প্রশ্ন এনে বিষয়টিতে কিন্তু জটিলতার সৃষ্টি করেন।১৮ স্বভাবতই রাষ্ট্রভাষা বিতর্কের বিষয়টি লেখক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী মহলের সচেতন অংশে কিছুটা উত্তেজনা সৃষ্টি করে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় যেমন লেখালেখি শুরু হয়, তেমনি ছাত্র-শিক্ষক-লেখক-সাংবাদিক মহলেও এ বিষয়ে ক্ষুব্ধ আলােচনার উত্তাপ প্রকাশ পেতে থাকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, ২০ জুলাই (১৯৪৭) দৈনিক ইত্তেহাদ’-এ প্রকাশিত মাহবুব জামাল জাহেদীর রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক প্রস্তাব’১৯ এবং ২৭ জুলাই (১৯৪৭) প্রকাশিত এ.কে. নুরুল হকের ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’২০ শীর্ষক প্রবন্ধ দুটির কথা । শেষােক্ত লেখাটিতে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার একক যােগ্যতা জোরালােভাবে তুলে ধরা হয়।

বিশিষ্ট মহিলা পত্রিকা ‘বেগম’ও তখন এ বিষয়ে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে। সে সময় ড. মুহম্মদ এনামুল হক, ড. কাজী মােতাহার হােসেন প্রমুখ ভাষাবিদ ও বিজ্ঞানিগণ বাংলা রাষ্ট্রভাষার পক্ষে যুক্তিগ্রাহ্য জোরালাে বক্তব্য তুলে ধরেন। নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রকাশিত মাসিকপত্র ‘কৃষ্টি’র কার্তিক সংখ্যায় (১৩৫৪) প্রকাশিত মুহম্মদ এনামুল হকের প্রবন্ধটিতে বাংলা রাষ্ট্রভাষার বিষয়টি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে আলােচিত হয়েছে। তার মতে : “উর্দু বাহিয়া আসিবে পূর্ব পাকিস্তানবাসীর মরণ,—রাজনৈতিক, রাষ্ট্রীয়, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মৃত্যু। এই রাষ্ট্রীয় ভাষার সূত্র ধরিয়া শাসন, ব্যবসাবাণিজ্য ইত্যাদি সর্ববিষয়ে পূর্ব পাকিস্তান হইবে উত্তর ভারতীয় এবং পশ্চিম পাকিস্তানী উর্দুওয়ালাদের শাসন ও শােষণের ক্ষেত্র, যেমন ভারত ছিল ইংরেলি রাষ্ট্রভাষার সূত্রে ইংরেজদের শাসন ও শােষণের ক্ষেত্র। ঐ সাতচল্লিশ সালেই সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রবন্ধে . কাজী মােতাহার হােসেন বলেন : যদি গায়ের জোরে উর্দুকে বাঙালি হিন্দু-মুসলমানদের ওপর রাষ্ট্রভাষারূপে চালাবার চেষ্টা হয়, তবে সে চেষ্টা ব্যর্থ হবে। কারণ ধূমায়িত অসন্তোষ বেশিদিন চাপা থাকতে পারে না। শীঘ্রই তাহলে পূর্ব-পশ্চিমের সম্বন্ধের অবসান হবার আশঙ্কা আছে।” পাকিস্তানের দুই অংশের সম্বন্ধ নিয়ে এমন রূঢ় সত্যের উচ্চারণ এর আগে কেউ করেছেন বলে জানি না। রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন ধারার বক্তব্য উচ্চারিত হয়েছে অনেক পরে। সংক্ষিপ্ত এই পর্যালােচনা থেকে দেখা যায় যে, বাংলা রাষ্ট্রভাষার পক্ষে গত কর্মতৎপরতার সূচনা বাঙালি জাতীয়তাবাবোধে বা প্রগতিবাদে বিশ্বাসী কিছুসংখ্যক রাজনীতিসচেতন বুদ্ধিজীবীর হাতে, শুরুটা তমদুন। মজলিসের হাতে নয় যেমনটি তারা আজকাল নানা উপলক্ষে দাবি করে থাকেন। অন্যদিকে ভাষা বিষয়ক সক্রিয় ও বাস্তব কর্মতৎপরতা তথা বিক্ষোভ, আন্দোলন ইত্যাদিও, পরবর্তী আলোচনায় দেখা যাবে যে, তমদুন মজলিস এককভাবে করেনি যদিও শেষ-সাতচল্লিশে এবং আটচল্লিশে আরাে অনেকের সাথে মজলিস বিক্ষোভে-আন্দোলনে বিশিষ্ট ভূমিকা নিয়েছিল। তাই ‘তমদ্দন মজলিস ভাষা আন্দোলনের জনক’, তাদের এমন দাবি নিতান্তই ভিত্তিহীন ও অযৌক্তিক। আর বাহান্নর ভাষা আন্দোলনে তাদের সংগঠনগত তৎপরতা যে প্রায় অনুপস্থিত সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তমদুন মজলিস গঠিত হয় ১৯৪৭-এর সেপ্টেম্বর মাসে, কিন্তু এর অনেক আগেই রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক বিতর্ক ও লেখালেখির কাজ শুরু হয়ে গেছে অন্যদের হাত দিয়ে। সংগঠন গড়ে তােলার কিছুকাল পর তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ এই শিরােনামে একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। এতে মজলিসের কর্মকর্তা অধ্যাপক আবুল কাসেমের প্রবন্ধ ছাড়াও কাজী মােতাহার হােসেন এবং আবুল মনসুর আহমদের মতাে মজলিস-বহির্ভূত স্বনামখ্যাত ব্যক্তিদের প্রবন্ধ সঙ্কলিত হয়। রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে এদের বক্তব্যের সাথে পুরােপুরি সঙ্গতি দেখা যায় মনের ভাষা প্রস্তাবে, যেখানে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা এবং উর্দু; অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানে। সরকারি ভাষা এবং শিক্ষার বাহন হবে বাংলা।২২ বিষয়টা রাষ্ট্রিক পটভূমিতে একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখেছিলেন গণ-আজাদী লীগের প্রতিষ্ঠাতা কামরুদ্দিন আহমদ। তারা ভাষায় “১৯৪৭ সনের জুন মাসে ঢাকায় এসে গণ-আজাদী লীগ গঠন করি। যার ভিত্তি সেই লাহাের প্রস্তাব পূর্বপাকিস্তান একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র এবং দুটো পাকিস্তান একত্র থাকতে হলে কি ভিত্তিতে থাকবে তা পরে নিরূপণ করবে দু’দেশের লােকেরা। তাই আমরা বললাম, বাংলা হবে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। কারণ পশ্চিম পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে তা তারাই স্থির করবেন। আবার যদি কেন্দ্র গঠিত হয় তবে দু’দেশের লােকেরা। তাই আমরা বললাম, বাংলা হবে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।

কারণ পশ্চিম পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে তা তারাই স্থির করবেন। আবার যদি কেন্দ্র গঠিত হয় তবে দু’দেশের রাষ্ট্রভাষাই কেন্দ্রের রাষ্ট্রভাষা হবে যেমন— বেলজিয়াম, ক্যানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশে রয়েছে।” অর্থাৎ ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাস দুই আগেই জনাব কামরুদ্দিন আহমদের উদ্যোগে তাজউদ্দিন আহমদ, মােহাম্মদ তােহা প্রমুখ প্ৰগতিপন্থী যুবকদের নিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ ও অর্থনৈতিক ভিত্তিতে একটি পার্টি গড়ার চেষ্টা হয়েছিল। তারা বাংলা রাষ্ট্রভাষার পক্ষে সিদ্ধান্ত নেন, এবং তা তমন্দুন মজলিস প্রতিষ্ঠার (সেপ্টেম্বর ১৯৪৭) আগেই (কামরুদ্দীন আহমদ, বাংলার মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশ’ ২য় খণ্ড, পৃ. ১০১, ১৭)। লক্ষ্য করার বিষয় যে হৰু পাকিস্তান বা সম্ভাব্য সার্বভৌম পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বলগ্ন থেকেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রশ্নটি যারা শুরুতে তাত্ত্বিকভাবে এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাস্তবে আন্দোলন সংগঠিত করার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক ‘ইস্যু’ হিসেবে তুলে ধরেন তাদের মূল অংশ ছিল সেকুলার রাজনীতিতে বিশ্বাসী। কাজেই এমন তত্ত্ব সঠিক নয় যে, ভাষা-আন্দোলনের সেকুলার হওয়ার কোনাে প্রয়ােজন ছিল না” (রণবীর সমাদ্দার, ‘প্যারাডক্সেস অব দ্য ন্যাশনালিস্ট টাইম’, ইউ.পি.এল, ২০০২)। তবে ইস্যুটা ভাষার মত সর্বজনীন বলেই একে কেন্দ্র করে একাধিক মতাদর্শের (সেকুলার নয় এমনও) বিশ্বাসী ব্যক্তি একত্র হয়েছিলেন। প্রসঙ্গত মনে রাখা দরকার যে, সে সময় আমাদের লেখক-বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ (যেমন কবি গােলাম মাক্টফা, সাংবাদিক মুজিবর রহমান খাঁ, আকরাম খাঁ, লেখক-সাংবাদিক মােহাম্মদ ওয়াজেদ আলী প্রমুখ ব্যক্তি বাদেও আরাে অনেকে) উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ও আন্তঃপ্রাদেশিক ভাষা হিসেবে গ্রহণের পক্ষপাতী ছিলেন। এর প্রধান কারণ তাদের মধ্যে বাঙালি জাতিসত্তা সম্পর্কে বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তার অভাব এবং সেই সঙ্গে প্রচণ্ড ধর্মীয় সংস্কৃতিপ্রীতি ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রভাব কাজ করেছে। এমনি বিভিন্নমুখী চিন্তাস্রোতের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত বিষয়টি এগিয়ে চলে এবং চলে তমদুন মজলিসের গঠন, তাদের ভাষা সংক্রান্ত বক্তব্য পরিবেশনার সময় এবং তার অব্যবহিত পরেও।

তাই এ সময় যেমন বাংলা রাষ্ট্রভাষার পক্ষে অব্যাহত ধারায় বিভিন্নজনের রচনা প্রকাশিত হতে থাকে, তেমনি পাশাপাশি বিপরীত স্রোতের ধারক, যেমন গােলাম মােস্তফা, মােহাম্মদ ওয়াজেদ আলী প্রমুখ লেখকের উর্দু রাষ্ট্রভাষার পক্ষে রচনাদিও প্রকাশ পেতে থাকে। কেউ কেউ এই কাজে তাদের সাংবাদিক পদমানের সুযােগ ব্যবহার করতেও দ্বিধা বােধ করেন নি। একটি উদাহরণ : “উর্দুকে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ও আন্তঃপ্রাদেশিক রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করা হইতেছে এবং সমগ্র পাকিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থায় বাধ্যতামূলক করা সঙ্গত হইবে। ইংরেজির স্থলে উর্দুই অদূর ভবিষ্যতে পাকিস্তানের সাধারণ ভাষা : (Lingua franca) হইবে এবং হওয়া উচিত।… উর্দুর বিশেষ সম্মান যেন আমরা ক্ষুন্ন করিতে অগ্রসর না হই।২৩ সওগাত’-এর মতাে প্রগতিশীল চরিত্রের পত্রিকায় এমন একটি বাংলাবিরােধী সম্পাদকীয় মােহাম্মদ ওয়াজেদ আলী কীভাবে প্রকাশ করতে পেরেছিলেন বুঝে ওঠা কঠিন। বাঙালিদের একটি অংশের তরফ থেকে উর্দু রাষ্ট্রভাষার প্রতি এ ধরনের নগ্ন সমর্থন উর্দুবাদী পাকিস্তানি শাসকদের (বাঙালি-অবাঙালি) উদ্দেশ্যসাধনে তৎপর হতে সাহায্য করেছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক বিচারে মধ্যপন্থী বা দুর্বলচিত্ত। শিক্ষিত বাঙালিদের মনে এমন একটি আপােসবাদী চিন্তা উপস্থিত ছিল যেসব হারানাের চেয়ে কিছু পেয়ে (পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি) সন্তুষ্ট থাকাই বােধহয় সঙ্গত। অর্থাৎ এরা পাকিস্তান অর্জনের পেছনে বাঙালির অন্যতম | প্রধান ভূমিকার কথা ভুলে গিয়েছিলেন। বাঙালি মুসলমান জনসংখ্যার শিক্ষিত একাংশের এই হীনম্মন্যতার কারণ মনে হয় গবেষণার বিষয় হওয়ার যােগ্য। 

ভাষার ব্যবহার নিয়ে প্রথম প্রতিক্রিয়া। ভাষা-বিতর্কের উল্লিখিত টানাপােড়েনের মধ্যে হঠাৎ করেই একটি বিস্ফোরক ঘটনা পাকিস্তান অর্জনের প্রবল আনন্দ-উল্লাসের মধ্যে আঘাতের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি। করে। শিক্ষিত বাঙালির একটি অংশ (বিশেষ করে ঢাকার সরকারি কর্মচারীদের একটি অংশই এদিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন) বিস্ময়, বেদনা ও অপমানবােধ নিয়ে লক্ষ্য করেন যে, পাকিস্তানে প্রথম প্রকাশিত এনভেলাপ, পােস্টকার্ড, ডাকটিকিট, মনিঅর্ডার ফরম, রেলটিকিট ইত্যাদিতে এবং সদ্য ছাপানাে টাকায় বাংলার বদলে শুধু ইংরেজি ও উর্দু ভাষাই ব্যবহৃত হয়েছে। এ দেশের শিক্ষিত জনগণ, বিশেষ করে ছাত্র-শিক্ষক-সরকারি কর্মচারী ও অন্যান্য চাকরিজীবী সবাই তাদের দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসে চিরচেনা মাতৃভাষার উপস্থিতি আশা করেছিলেন। এবং পাকিস্তান তথা স্বাধীনতালাভের ফলাফল হিসেবেই আশা করেছিলেন। পরিবর্তে স্বপ্নভঙ্গের প্রথম প্রতিক্রিয়ায় দেখা দেয় অসন্তোষ। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কয়েক মাস আগে কিছুসংখ্যক লেখক-সাংবাদিকবুদ্ধিজীবীর রচনা ও বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ভাষা সংক্রান্ত যেসব দাবির তত্ত্বগত প্রকাশ ঘটেছিল, পাকিস্তানি শাসকদের এই অর্বাচীন পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ায় সেই তত্ত্বগত দাবির বাস্তব রূপ দেখা দিল অসন্তুষ্টির বিক্ষুব্ধ প্রকাশে। শুধু ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল-কলেজের ছাত্র-শিক্ষকগণই নন, পলাশী ও নীলক্ষেত ব্যারাকে বসবাসরত সরকারি কর্মচারীদের একটি বিশাল অংশ নিজ নিজ প্রাঙ্গণে সমবেত হয়ে উল্লিখিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে এতটুকু দেরি করেন নি। স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনুষ্ঠিত এইসব জমায়েত ও খণ্ড মিছিলের প্রতিবাদ দেখা দিয়েছিল সাতচল্লিশ সালের নভেম্বর মাসের প্রথমদিকে। বাংলাকে সবকিছুতেই স্থান দিতে হবে’, বাংলা ভাষা ও বাঙালির সাথে বেইমানি চলবে না’, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, উর্দুর সাথে বিরােধ নাই’, উর্দু-বাংলা ভাই ভাই’ ইত্যাদি ধ্বনির মাধ্যমে এদের ক্ষুব্ধ বেদনা ও আশা-আকাক্ষার প্রকাশ ঘটেছিল। অবশ্য তাদের প্রধান দাবি ছিল উল্লিখিত ডাকটিকিট ফরম ইত্যাদিতে বাংলার উপস্থিতি ২৪

বাংলা ভাষার বাস্তব প্রয়ােগের বিষয় নিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আড়াই মাসের মধ্যেই সরকারি কর্মচারীদের এই স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভের বিবরণ ইতঃপূর্বে প্রকাশিত ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, স্মৃতিচারণ ও সংশ্লিষ্ট নিবন্ধাদিতে স্থান পায় নি। একমাত্র বশীর আল হেলালের বইটিতে এইসব টিকিট ফরম ছাপা সম্পর্কে পূর্ববঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের একটি প্রাসঙ্গিক উক্তির উল্লেখ রয়েছে মাত্র, অন্যত্র তাও নেই। মুখ্যমন্ত্রী পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের অধিবেশনে (৯ এপ্রিল, ১৯৪৮) উত্থাপিত এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন যে, “ভাষা সম্পর্কিত বিতর্ক আরম্ভ হওয়ার আগেই। এইসব ফরম্ ও মুদ্রা ছাপা হয়। প্রকৃতপক্ষে মুখ্যমন্ত্রীর এই যুক্তি মােটেই ধােপে টেকে না এই জন্য যে রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক বিতর্ক সাতচল্লিশের জুন মাস থেকেই অব্যাহত ধারায় চলেছিল। আসলে বাঙালি-অবাঙালি লীগ শাসকগণ গােড়াতেই ধরে নিয়েছিলেন যে সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা এবং সব রাষ্ট্রীয় কাজে ইংরেজির স্থান উর্দুই দখল করবে। লীগ রাজনীতিকদের এই সষত্নলালিত চিন্তার প্রকাশ ঘটেছে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্বেই তাদের বিচ্ছিন্ন উক্তিতে, যেমন ১৭ মে চৌধুরী খালিকুজ্জামানের বিবৃতিতে যে, “উর্দুই পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা হইবে” (দৈ. আজাদ, ১৯ মে, ১৯৪৭), আটচল্লিশের মার্চে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকাই বক্তৃতায় এবং বাহান্ন সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনের ঢাকায় প্রদত্ত বক্তৃতায় । এছাড়াও পাকিস্তানের লীগ শাসক ও লীগ রাজনীতিকগণের প্রায় সবাই বরাবর সুপরিকল্পিতভাবে প্রাদেশিকতার অজুহাত তুলে রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে বাংলার বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছেন, সভা-সমিতিতে ভাষণ দিয়েছেন এবং এ বিষয়ে সর্বশক্তি ও কৌশল প্রয়ােগ করেছেন। | সরকারি কর্মচারীদের ভাষা বিষয়ক বিক্ষোভের প্রশ্নটি বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হয়েছে এই জন্য যে, তখনকার অন্ধ আবেগময় পরিবেশে বহু আকাক্ষিত পাকিস্তান লাভের আড়াই মাসের মধ্যেই সরকারি কর্মচারীদের পক্ষে এ ধরনের প্রকাশ্য বিক্ষোভের কথা ভাবা যায় না। স্বপ্নভঙ্গের যে প্রক্রিয়া ঐ আঘাতে শুরু হয় তাই বাহান্নে এসে পরিপূর্ণ আবেগে উপচে পড়ে। ভাষা বিষয়ক সংগঠিত প্রতিক্রিয়া পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাংলা ভাষার দাবি ঘিরে সংঘটিত ছাত্র-শিক্ষককর্মচারীদের প্রতিবাদে বিক্ষোভ, জমায়েত ও মিছিল এবং পত্র-পত্রিকায় প্রবন্ধাদি প্রকাশের ঘটনাবলি অনেকাংশেই ছিল বিচ্ছিন্ন ও অসংগঠিত চরিত্রের। কিন্তু এর আনুষ্ঠানিক প্রকাশ, সংঘবদ্ধ প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবাদের সংগঠিত প্রতিফলন শুরু হয় ২৭ নভেম্বর (১৯৪৭) করাচিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনের এক পর্যায়ে। গৃহীত ভাষা বিষয়ক সিদ্ধান্তের ফলে। 

সরকারপক্ষে বাংলা বিরােধিতার বিষয়টি যে মােটেই আকস্মিক কোন ঘটনা ছিল না বরং তা বাংলা ও বাঙালিদের বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রেরই অংশ ছিল, টিকিট ফর্ম্ ইত্যাদিতে বাংলা ভাষার অনুপস্থিতি এবং শিক্ষা সম্মেলনে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর পক্ষে সুপারিশে তা প্রকাশ পায়। শিক্ষা সম্মেলনের- ভাষা সংক্রান্ত আলােচনার আভাস সংবাদপত্রে প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী সমাজের সচেতন অংশ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং ৫ ডিসেম্বর প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে উপস্থিত হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এরই মধ্যে উর্দুর পক্ষে শিক্ষা সম্মেলনে গৃহীত সুপারিশের কথা প্রকাশ পাওয়ার পর ৬ ডিসেম্বর সুসংগঠিত ছাত্রবিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। ঐ দিন দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ঢাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলাে থেকে আগত ছাত্রদের এক বিশাল সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন | অধ্যাপক আবুল কাসেম। সভায় বক্তৃতা করেন মুনীর চৌধুরী, কল্যাণ দাশগুপ্ত, এ.কে.এম, আহসান প্রমুখ। এ সভায় সুস্পষ্টভাবে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি ভাষা ও শিক্ষার বাহনরূপে গ্রহণ করার। দাবি জানানাে হয়। এই সঙ্গে মর্নিং নিউজ’ পত্রিকার বাংলা ও বাঙালি-বিরােধী। প্রচারণারও তীব্র নিন্দা জানানাে হয়।২৫ সবশেষে ছাত্রদের একটি উত্তেজিত মিছিল উর্দুর জুলুম চলবে না’, পাঞ্জাবি রাজ বরবাদ যাক ইত্যাদি ধ্বনি দিতে দিতে সেক্রেটারিয়েটের সামনে হাজির হয়। কৃষিমন্ত্রী জনাব আফজাল ছাত্রদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা চালান। কিন্তু বিক্ষুব্ধ ছাত্র মিছিল নুরুল আমিন ও হামিদুল হক চৌধুরীর বাসভবনে যায় এবং সেখান থেকে মুখ্যমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনের সাথে দেখা করতে গেলে মুখ্যমন্ত্রী অসুস্থতার | অজুহাতে ছাত্রদের মুখােমুখি হওয়ার ঝুঁকি এড়িয়ে যান। তার রাজনৈতিক সচিব | মফিজউদ্দিন আহমদ ছাত্রদের সাথে দেখা করে আশ্বাস দেন যে মুখ্যমন্ত্রী এ | বিষয়ে অবিলম্বে মন্ত্রীমণ্ডলী ও পরিষদ সদস্যদের সাথে আলােচনা করবেন। এরপর ছাত্রগণ মর্নিং নিউজ’ অফিসের সামনে উপস্থিত হয়ে উত্তেজিত ধ্বনিসহ প্রতিবাদ বিক্ষোভ জানাতে থাকে ।২৫

শিক্ষা সম্মেলনের সুপারিশের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারিগণও সভা ও মিছিলের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানাতে দ্বিধা করেন নি। ভাষার প্রশ্নে তাদের একাংশ বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। তাই দেখা যায়, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার চার মাসের মধ্যেই বাংলার সপক্ষে ছাত্রজনতার সংঘবদ্ধ বিক্ষোভ লীগ শাসকদের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে ওঠে। ভাষা সংক্রান্ত মূল বিষয় ছাড়াও ছাত্র-জনতার ক্ষোভের একটি কারণ ভাষার প্রশ্নে লীগ নেতা ও লীগ মন্ত্রীদের ছল-চাতুরির আশ্রয় গ্রহণ, নানা অজুহাতে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভাষা সমস্যার সমাধান ঘটানােয় অনিচ্ছা। এ কারণেই শাসক ও রাজনীতিকদের তরফ থেকে বিভিন্ন সময়ে ছাত্র-জনতাকে ভাষার প্রশ্নে মিথ্যা আশ্বাস দেয়া হয়েছে কিংবা প্রতিশ্রুতি ভেঙে বিপরীত ভূমিকা নেয়া হয়েছে অথবা নতুন করে আবার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। কেউ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ভয়ে, কেউবা রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে এ ধরনের কাজ করেছেন, বাংলা ভাষার দাবির বিরােধিতা করেছেন। শিক্ষা সম্মেলন উপলক্ষে বিভিন্ন নেতা ও মন্ত্রীর বিবৃতি ও বিতর্ক উত্তেজনা সৃষ্টি করায় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সভাপতি মৌলানা আকরাম খাঁ এক বিবৃতিতে বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা উপলক্ষে দেশে অহেতুক উত্তেজনা সৃষ্টি করা হবে এবং এই উত্তেজনার কোন সঙ্গত কারণ নেই। ২৬ তাঁর বক্তব্য পড়ে বুঝতে কষ্ট হয় না যে অহেতুক’ এবং ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা এই  কথা কয়টির ওপর উদ্দেশ্যমূলকভাবে গুরুত্ব আরােপ করে তিনি পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি সুকৌশলে এড়িয়ে গেছেন। এমনকি পূর্ববঙ্গের সরকারি ভাষা ও শিক্ষার বাহনরূপে বাংলা ভাষার দাবির পক্ষে দরদী ও সংগ্রামী সেজে সলিমুল্লাহ হলের ছাত্রসভায় (৭ ডিসেম্বর ‘৪৭) বক্তৃতা দিয়ে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটি ধামাচাপা দিয়েছিলেন।২৭

অথচ ছাত্র-জনতার দাবি ছিল বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে প্রতিষ্ঠিত করা, শুধু পূর্ববঙ্গের শিক্ষাঙ্গনে বা অফিস-আদালতেই নয়। সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট মতামত না দিয়ে তিনি কন্‌স্টিটুয়েন্ট এসেম্বলী’র বরাত দিয়ে বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। কিন্তু পূর্ববঙ্গে বাংলার পাশাপাশি উর্দুকে বাধ্যতামূলক দ্বিতীয় ভাষারূপে গ্রহণ এবং ধর্ম শিক্ষার প্রয়ােজনে সেই সঙ্গে আরবি ভাষা শিক্ষার পক্ষে সুপারিশ করতে ইতস্তত করেন নি।২৭

একটু ভিন্নভাবে হলেও কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে প্রায় অনুরূপ ঘােলাটে বক্তব্য রেখেছিলেন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান। তাঁর মতেও ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হইবে তাহা একমাত্র গণপরিষদই স্থির করিতে পারেন। তিনি জানান, শিক্ষা সম্মেলনের গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয় যে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা এবং বিভিন্ন প্রাদেশিক গভর্নমেন্টের কার্য চালাইবার মাধ্যম হিসাবে স্বীকার করিয়া লওয়া উচিত।… বাংলাদেশে বাংলা ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম করা উচিত।’ তিনি আরাে বলেন যে, পূর্ববঙ্গের প্রতিনিধিরা এই প্রস্তাব সমর্থন করেছেন। অর্থাৎ এবার ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে এল । শিক্ষা সম্মেলনে পূর্ববঙ্গের প্রতিনিধিদের যথার্থ ভূমিকা পরিস্ফুট হলাে ফজলুর রহমানের এই বক্তব্যে।২৮

পূর্ববঙ্গীয় প্রতিনিধিদের এইসব কার্যকলাপ থেকে বুঝতে কষ্ট হয় না যে, আকরাম খ, ফজলুর রহমান, তমিজুদ্দিন খান, খাজা নাজিমুদ্দিন, নুরুল আমিন এবং তাদের সহকর্মিগণ বরাবর গণপরিষদের দোহাই দিয়ে বাংলা রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটিকে এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন। কারণ, তারা ভালােভাবেই জানতেন, গণপরিষদে বাংলা কখনই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাবে না; পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্যদের তাে নয়ই, এমনকি পূর্ববঙ্গের লীগ দলীয় সদস্যদের সমর্থনও এতে মিলবে না। একমাত্র কয়েকজন ভিন্নমতাবলম্বী বাঙালি সদস্যের ভােটে বাংলা সেখানে দাঁড়াতে পারবে না। পরবর্তীকালে গণপরিষদের একাধিক অধিবেশনের কার্যক্রম এই অনুমানই সত্যে পরিণত করেছে। শিক্ষা কমিশনের সুপারিশের কল্যাণে এতদিনকার ভাষা বিতর্ক সুস্পষ্টভাবে সংগঠিত ভাষা বিক্ষোভে পরিণত হয় এবং এই উপলক্ষে উর্দু-বাংলা সমর্থকদের মধ্যে হাঙ্গামারও সূত্রপাত হয়। ঢাকার স্থানীয় লােকজনের অধিকাংশই তখন উর্দুর সমর্থক।

এদেরই একদল লােক ৯ ডিসেম্বর বাস ও ট্রাকে চড়ে উর্দুর পক্ষে ধ্বনি দিতে দিতে পলাশী ব্যারাক এবং পার্শ্ববর্তী মেডিকেল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং  কলেজ হােস্টেলে হামলা চালায়। প্রাথমিক পর্যায়ে পলাশী ব্যারাক নিবাসী মেডিকেল কলেজ ছাত্র এবং ইঞ্জিনিয়ারিং হােস্টেলের ছাত্রদের সাথে সংঘর্ষ শুরু হলে কিছুক্ষণের মধ্যে তা পলাশী ব্যারাকের সরকারি কর্মচারী ও সন্নিহিত এলাকার বাংলা সমর্থক এবং অন্য ছাত্রদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত উর্দু সমর্থক লােকজন রণে ভঙ্গ দিয়ে পালিয়ে যায়, কিন্তু যাওয়ার আগে ইঞ্জিনিয়ারিং হােস্টেলের যথেষ্ট ক্ষতিসাধন করে।২৯

সংঘর্ষের খবর দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে গেলে আশপাশের ছাত্র ও জনসাধারণ ইঞ্জিনিয়ারিং হােস্টেল প্রাঙ্গণে সমবেত হয়ে একটি প্রতিবাদ সভা আহ্বান করেন। সভা শেষে ছাত্র ও জনতার একটি নিছিল মেডিকেল কলেজ, কার্জন হল পার হয়ে প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রী আবদুল কামিদের বাসভবনে এসে পৌঁছায়। মন্ত্রীর নেমে আসতে দেরি হওয়ায় অস্থির ছাত্রদের মধ্য থেকে নেতৃস্থানীয় কয়েকজন ছাত্র দোতলায় উঠে গেলে তাদের সাথে মন্ত্রী আবদুল হামিদ লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরা অবস্থায়ই দ্রুত নিচে নেমে আসেন। ছাত্র-জনতার দাবি ছিল উর্দু সমর্থকদের গুণ্ডামির শাস্তিবিধান, ডাকটিকিট-ফরম্ ইত্যাদিতে বাংলা ব্যবহার এবং সর্বোপরি অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার নিশ্চয়তা বিধান, ব্যর্থ হলে মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ ।

এইসব নিয়ে তিক্ত তর্ক-বিতর্কের পর ছাত্র-জনতার চাপে মন্ত্রী মহােদয় মিছিলের সাথে নিকটবর্তী সেক্রেটারিয়েট ভবনে প্রবেশ করেন। ছাত্রদের একাংশ যখন কৃষিমন্ত্রী আফজল সাহেবের সঙ্গে তর্ক-বিতর্কে রত তখন কয়েকজন ছাত্র তাদের লিখে-আনা উল্লিখিত প্রতিশ্রুতিনামার কাগজে স্বাক্ষরের জন্য মন্ত্রী হামিদ সাহেবকে পীড়াপীড়ি করতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত অনেক ইতস্তত করে মন্ত্রী সাহেব প্রতিশ্রুতিপত্রে স্বাক্ষরের জন্য এদিক-ওদিক তাকাতেই পাশ থেকে খান আতাউর (স্বনামখ্যাত চিত্রপরিচালক) কলম কলম’ বলে চেঁচিয়ে ওঠায় আবদুল মতিন তার পার্কার কলমটি মন্ত্রীর দিকে এগিয়ে দেন এবং সেই কলম দিয়েই একটি ঐতিহাসিক (?) স্বাক্ষরদান পর্ব শেষ হয়। একটু পরে মন্ত্রী আফজল সাহেবের কাছ থেকেও ঐ কাগজে অনুরূপ স্বাক্ষর আদায় করা হয় । কিন্তু লীগ শাসকদের। কাছে এসব স্বাক্ষর বা প্রতিশ্রুতির যে কোন দাম ছিল না তাদের পরবর্তী কার্যকলাপে তার প্রমাণ মেলে। জনমানসে ভাষা নিয়ে এইসব প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও এ সম্পর্কে সরকারি নীতি বা কার্যক্রমের কোন পরিবর্তন ঘটে নি। সরকারি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে নিয়মমাফিক ঘটনার দোমড়ানাে-মােচড়ানাে চেহারা প্রকাশ পেতে থাকে। এমনি পরিবেশে দৈনিক আজাদ’ ‘অহেতুক উত্তেজনা, সংহতির আবেদন (১৯ ডিসেম্বর ‘৪৭). এবং কুচক্রীর হস্ত’ (২১ ডিসেম্বর ‘৪৭) শীর্ষক সম্পাদকীয় লিখে সরকারি হাত। শক্তিশালী করে। ভাষা সম্পর্কিত তাদের বক্তব্যে বিচক্ষণ চিন্তার প্রকাশ ঘটে না। শেষােক্ত সম্পাদকীয় নিবন্ধটিতে স্পষ্ট বলা হয় : আমরা কয়েকটি প্রবন্ধে এ সম্বন্ধে বিশদ আলােচনা করিয়া দেখাইয়াছি যে  পাকিস্তানের সাধারণ জন যে উর্দু হইবে এ বিষয়ে মতবিরােধের কোনাে অবকাশ নাই। উর্দু পন্থী ও বাঙ্গালাপন্থীদের প্রায় সকলেই এ ব্যাপারে একমত।… ‘স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার’ ধ্বজা লইয়া একদল পাগপস্থাকেও নৰ্ত্তন-কুর্শন করিতে দেখা গিয়াছিল।

তাদের কথা ছিল ভাষার ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠন ।… এরূপ কোন মতলববাজ দলের কুচক্রী হস্তের খেলাকে পূর্ব পাকিস্তানের সরকার ও জনসাধারণ যে সহ্য করিবে না তাহা বলাই বাহুল্য। আবুল হাশিম-সােহরাওয়ার্দি গ্রুপের বিরুদ্ধে আপত্তিকর মন্তব্যই উল্লিখিত সম্পাদকীয়ের একমাত্র লক্ষ্য নয়, রাজনৈতিক মতাদর্শের দিক থেকে বাংলা| বিরােধিতাই এখানে প্রধান, এমনকি ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের প্রতি নীতিগত বিরােধিতাও সুস্পষ্ট। এইসব বক্তব্য ও ঘটনাদির বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, মৌলানা আকরাম খা ও তার মুখপত্র ‘আজাদ’-এর ভূমিকা বরাবরই ছিল রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে বাংলাবিরােধী; হাওয়ার সাময়িক দিক পরিবর্তনে এবং রাজনৈতিক স্বার্থের গভীর কোন প্রয়ােজনে মাঝে মাঝে সাময়িক ভােল পাল্টাতে হয়েছে এই যা। যেমন একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম কয়েকটি দিনে ‘আজাদ’ আন্দোলনের সমর্থক, কিন্তু কয়েকদিন পরই তার সম্পূর্ণ বিপরীত ভূমিকা। উপরের উদ্ধৃতিতে বাংলাবিরােধী ভূমিকা এত স্পষ্ট যে এর ব্যাখ্যার প্রয়ােজন হয় না। যাই হােক শিক্ষা সম্মেলনের সুপারিশ সংক্রান্ত বিতর্ক ও বিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার তাদের বহু কথিত ‘শিশুরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে উস্কানি’র অজুহাত এনে ১৫ ডিসেম্বর থেকে ১৫ দিনের জন্য কলকাতার তিনটি দৈনিকপত্র ইত্তেহাদ”, স্বাধীনতা’ ও ‘আনন্দবাজার পত্রিকার পূর্ববঙ্গে প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘােষণা করেন। সেই সঙ্গে সরকার ও তাদের রাজনৈতিক সহযােগিগণ কি কেন্দ্রে কি পূর্ববঙ্গে প্রাদেশিক ভাষা, সাধারণ জবান তথা লিঙুয়া ফ্রাংকা, আন্তঃপ্রাদেশিক ভাষা, দেশের সংহতির পক্ষে এক রাষ্ট্রভাষার অপরিহার্যতা ইত্যাদি প্রশ্ন ও সমস্যার ধুয়া। তুলে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে এমনি ধোয়াটে অবস্থার সৃষ্টি করেছিলেন যাতে বাংলা সেখানে হালে পানি না পায়। আসলে তারা জাতিসত্তা-জাতীয়তা-জাতীয় স্বার্থ ও অর্থনীতির সম্পর্ক বুঝতে পারেন নি এবং বুঝতে চেষ্টাও করেন নি। বাঙালি জাতীয়তাবাদ বনাম মুসলমান বাঙালি স্বাতন্ত্র্যবাদ। আজকের বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকদের অনেকেই মনে করেন ভাষা সংক্রান্ত বিতর্কে, বিক্ষোভে ও আন্দোলনে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও প্রতিফলন ঘটেছে। এমনকি শেষ একাত্তরে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ঐ জাতীয়তাবাদের সব সম্ভাবনা পরিস্ফুট হয়ে পরিপূর্ণ মাত্রায় বিকাশ লাভ করেছে। এই চিন্তা অনেকাংশে বিচার-বিবেচনার দাবি রাখে। 

কারণ সূচনায় ভাষা বিষয়ক রচনা, চিন্তা-ভাবনা, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মতামত ও কার্যক্রম বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ভাষার দাবি-দাওয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট ভাষিক  জাতীয়তাবাদের পাশাপাশি মুসলমান বাঙালির অর্থনৈতিক স্বাতন্ত্র্যবােধের প্রেরণা ও প্রভাবই ছিল প্রধান উপাদান, যা ক্রমেই রাজনৈতিক ঘটনাবলির প্রভাবে প্রবল ও ব্যাপক হয়ে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার ক্রমবিকাশমান চেতনা আচ্ছন্ন করে তার স্বাভাবিক পরিবর্ধন ব্যাহত করেছিল। একটু আগে আমরা দেখেছি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার বিরুদ্ধে মৌলানা আকরাম খার তীব্র শ্লেষাত্মক উক্তি। গােটা চল্লিশ দশকের পত্র-পত্রিকা জুড়ে মুসলমান স্বাতন্ত্রবাদীদের ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার পক্ষে এ জাতীয় বক্তব্যের প্রচুর সন্ধান মিলবে। এ বিষয়ে তৎকালীন আজাদ-মােহাম্মদীর পৃষ্ঠাগুলাে বিস্তর উপাদান পরিবেশন করতে পারে। তত্ত্বের দিকে ফিরে তাকালে দেখতে পাই, শ্রেণী-বৈষম্যপীড়িত সমাজে জাতীয় সংস্কৃতি বিকাশের ক্ষেত্রে যেমন দুই বিপরীতধর্মী সাংস্কৃতিক উপাদানের অন্তর্দ্বন্দ সক্রিয় থাকে তেমনি আমাদের রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও জাতীয়তাবােধের প্রশ্নে দুই বিপরীত চেতনার দ্বন্দ্ব শুরু থেকেই উপস্থিত ছিল। কিন্তু বিশেষভাবে চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি থেকে বাঙালি মুসলমানের স্বাতন্ত্র চেতনা পাকিস্তান আন্দোলনের মাধ্যমে প্রবল হয়ে ওঠায় ভাষাভিত্তিক জাতিসত্তার জাতীয়তাবাদী উপাদান গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য বহন করা সত্ত্বেও ব্যাপক পরিসরে সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে নি; অতিশয় সংখ্যালঘু জাতীয়তাবাদী মুসলমান জনসংখ্যার মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ ছিল। তাই পাকিস্তান অর্জনের পূর্ব পর্যন্ত ভাষাবিতর্ক কাগজে-কলমে। উপস্থিত থাকলেও সে সময় তা মুসলমান সমাজে গভীর কোন প্রভাব রাখতে পারে নি। তবে পাকিস্তানে উর্দুর প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা (এবং সেই সূত্রে অবাঙালি শাসকদের তরফ থেকে বাঙালিদের শােষণ ও বঞ্চনার চেষ্টা) শুরু হওয়ার পর থেকে ভাষাকে কেন্দ্র করে অসন্তোষ ও বিক্ষোভ দেখা দিয়েছে এবং সময় ও সংশ্লিষ্ট ঘটনার তাপে ক্রমেই তা শক্তি অর্জন করেছে। বাঙালি মুসলমানের মধ্যে একদা যে সম্প্রদায়ভিত্তিক স্বাতন্ত্র্যবাদী চেতনা প্রতিবেশী হিন্দু সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রভাবের বিরুদ্ধে সম্প্রদায়-স্বার্থ সংরক্ষণের কারণে প্রকাশ পেয়েছিল, সাতচল্লিশ পেরিয়ে সেখানে বাংলা ভাষার অধিকার সংক্রান্ত জাতীয়তাবাদী চেতনার উপাদান উর্দুভিত্তিক রাজনৈতিকঅর্থনৈতিক প্রভুত্বের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাই বলে পূর্বোক্ত। সঙ্কীর্ণ চেতনা লােপ পেয়েছে এমন মনে করা সঠিক হবে না। বরং বলতে হয়, উল্লিখিত দুই বিপরীতধর্মী চেতনার অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে জাতিসত্তাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের নিরঙ্কুশ ও বাধাবন্ধনহীন বিকাশ পদে পদে ব্যাহত হয়েছে; এমনকি-একুশের দিগন্তবিস্তারী আন্দোলনেও তার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে নি। এই অঘটনের প্রমাণ, উর্দুবাদী অবাঙালি স্বার্থ ও প্রভুত্বের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়েও বাঙালি শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী ধর্মবাদী পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামাের মধ্যেই ভাষা সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান খুঁজেছেন এবং সেই পথেই বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদের অর্থনৈতিক সুযােগ-সুবিধা এবং সাংস্কৃতিক  অধিকার আদায়ের চেষ্টা করেছেন। চিন্তা করেন নি ভাষাভিত্তিক ও বাঙালি জাতিসত্তানির্ভর রাষ্ট্রের কথা, যা একই সঙ্গে সম্প্রদায়-নিরপেক্ষও বটে। এ বিষয়ে স্বল্পসংখ্যক ব্যতিক্রমী উদাহরণ নানা কারণে যথেষ্ট গুরুত্ব অর্জন করতে পারে নি।

প্রসঙ্গত স্মর্তব্য ২১-দফার ১৯ সংখ্যক দফায় পূর্ববঙ্গকে লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে সার্বভৌমিক করার দাবি। কারাে কারাে মতে সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শ না থাকার জন্যই ভাষার দাবিতে এত দ্রুত (মাত্র সাড়ে চার বছরের মধ্যে) এতটা ব্যাপক সমর্থন আদায় সম্ভব হয়েছিল। আমাদের মনে হয় এখানেই নিহিত ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্য দুর্বলতার উপাদান। আর এসব কারণে এবং জন্মলগ্নের স্বাতন্ত্রবাদী প্রভাব পুরােপুরি মুছে না ফেলতে পারার কারণে ভাষার দাবি সামনে আসা সত্ত্বেও জাতিসত্তার বিষয়টি পরিস্ফুট রূপ ও রাজনৈতিকভাবে তখনাে সামনে আসে নি। তাই জাতিসত্তানির্ভর জাতীয়তাবাদের পরিপূর্ণ বিকাশের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয় নি, ভাষাভিত্তিক স্বতন্ত্র রাষ্ট্রগঠনের দাবিও উচ্চারিত হয় নি। সে দাবি একাত্তরে হঠাৎ করেই স্বায়ত্তশাসনের ছয় দফাকে এক দফায় পৌছে দেয়। অথচ যুক্তি-বিচারে এর সূচনা বা অঙ্কুর দেখা দেয়ার কথা ভাষা আন্দোলনের সচেতন অভিব্যক্তির মধ্যে এবং এর পূর্ণাঙ্গ প্রতিফলন ঘটার কথা ঐতিহাসিক ছয় দফার মধ্যে। কিন্তু তা হয় নি।

তাই দেখা যায়, বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা প্রচ্ছন্নভাবে ভাষা আন্দোলনের মধ্যেও বিশুদ্ধ, পূর্ণাঙ্গ বা অবিমিশ্র চেহারায় নয়, বরং দুই বিপরীতধর্মী উপাদানের সাংকর্যে উপস্থিত ছিল। বিষয়টি কারাে কারাে লেখায় কিছুটা পরােক্ষভাবে হলেও ধরা পড়েছে। সাতচল্লিশে বাংলা রাষ্ট্রভাষা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে প্রবন্ধ রচয়িতা আবদুল হকের বাহাত্তর সালে লেখা প্রবন্ধে এই চিন্তা কিছুটা অন্যভাবে হলেও এসেছে। পূর্বেকার অবস্থা সম্পর্কে তার মন্তব্য : রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও পুস্তিকায় যেসব প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল তাতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের কয়েকটি লক্ষণ পরিস্ফুট … (কিন্তু) সাক্ষাৎভাবে উর্দু-উপনিবেশবাদের প্রতিপক্ষ হিসাবে এই ভাষা ও সংস্কৃতিগত জাতীয়তাবাদের উদ্ভব এরূপ তাৎক্ষণিক ছিল না ।… জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রের মতাে বাংলা সাহিত্যেও হিন্দু-মুসলিম ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িক স্বাতন্ত্র্যচেতনার অস্তিত্ব ছিল। ৩২ এই প্রবন্ধেরই অন্যত্র বলা হয়েছে : জাতীয়তাবাদের এইসব লক্ষণ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অন্তর্গত ছিল। অবশ্য এই জাতীয়তাবাদ খুব স্পষ্ট ছিল না এবং স্বতন্ত্র রাষ্ট্র কামনাও এর অন্তর্গত ছিল না।। পুরনাে সম্প্রদায়ভিত্তিক অনুভব থেকে এর উদ্ভব হলেও এই অনুভবের মধ্য দিয়ে বাঙালী মুসলমানদের অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদে উত্তরণ সম্ভব হয়েছে।”

আরাে একাধিক লেখকের বক্তব্যে এবং কোন কোন গবেষণাধর্মী রচনায়ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের পূর্ণাবয়ব প্রকাশের কথা বলা হয়েছে। সেক্ষেত্রে আমাদের প্রশ্ন, উল্লিখিত ‘উত্তরণ’ ও ‘পরিণতি’ বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশে ও ব্যবহারিক প্রকাশে কতটুকু উপস্থিত? একাত্তরে ভাষাভিত্তিক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পরও বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় অন্তর্ভুক্তি যেমন কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ তেমনি সংশ্লিষ্ট জাতিসত্তার বিষয়টিও আমাদের চেতনায় অনেকাংশে গৌণ। প্রসঙ্গত পুনরুক্তি সত্ত্বেও মনে করিয়ে দিতে চাই, একদা আমাদের শিক্ষিত সমাজে মুসলমান বাঙালি’ বনাম ‘বাঙালি মুসলমান’ তথা বাঙালি সমস্যা যথেষ্ট বিতর্কের উত্তাপ ছড়িয়েছে। এমনকি পাকিস্তান আমলেও মুসলিম স্বাতন্ত্রের বিষয়টি বহুল উচ্চারিত ছিল এবং আবুল মনসুর আহমদ, আতাউর রহমান খান প্রমুখ জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকের কণ্ঠেও ‘পাক বাংলা’, মুসলিম বাংলা অবস্থা বিশেষে বারবার উচ্চারিত হয়েছে। তখনকার সংবাদপত্র এর প্রমাণ দেবে। লাহাের প্রস্তাব ছিল তাদের শেষ লক্ষ্য। গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদে সম্প্রদায়-স্বাতন্ত্রের ধারণা স্বীকৃতি পেতে পারে না—এই সত্যের বাস্তবতা সত্ত্বেও সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের চিন্তা ঘুরেফিরে আমাদের রাজনীতিতে বারবার এসেছে। একুশে নিজে সেকুলার হয়েও রাজনীতিতে সেকুলার জাতীয়তাবাদ পুরােপুরি প্রতিষ্ঠা করতে পারে নি। এর দায় সবটুকুই কি রাজনীতিকদের? সমাজে বাঙালি জাতিসত্তা ও বাংলাভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের বিকাশ যদি পরিপূর্ণ হতাে তাহলে এই প্রক্রিয়ার শুরুতে ভাষা সমস্যার সমাধানে এবং ষাটের দশকে বহুখ্যাত ছয় দফায় ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাঠামােয় শুধু আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিই প্রধান হয়ে উঠতাে না, এই উভয় ক্ষেত্রেই ভাষাভিত্তিক ও জাতিসত্তার মর্মবস্তুসম্পন্ন বাঙালি জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দাবি উচ্চারিত হতাে, যেখানে মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান প্রভৃতি বাংলাভাষাভাষী সম্প্রদায়ই শুধু নয়, ব্যাপক রাষ্ট্রীয় কাঠামােয় আমাদের পার্বত্য অঞ্চলের একাধিক জাতিসত্তা ও সংস্কৃতিবিশিষ্ট আদিবাসী জনগােষ্ঠীও অন্তর্ভুক্ত হতে পারতাে এবং হওয়া উচিত কিন্তু আমরা এই সমাজবিজ্ঞানসম্মত চিন্তা নিয়ে অগ্রসর হই নি বলেই কী। আটচল্লিশে কী বাহান্নের ভাষা আন্দোলনে এর বিপরীত ধারার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াইয়ের কাজ সচেতনভাবে এবং জোরেশােরে করতে পারি নি। ভাষা আন্দোলনের এই অন্তর্নিহিত দুর্বলতা অস্বীকারের উপায় নেই। আর সেকথা মনে রেখেই ভাষা আন্দোলনে বাঙালি জাতীয়তার স্বরূপ ও চরিত্র রাজনৈতিক বিচারে কতখানি পরিস্ফুট তা নির্ধারণ করা জরুরি।

বিষয়গত এই পটভূমিতে শুধু ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য নির্ধারণের জন্যই নয়, আমাদের রাজনৈতিক যাত্রার দিকদর্শনের জন্যও এইসব তাত্ত্বিক প্রশ্নের  বিচার অত্যন্ত জরুরি যে, বাহান্ন-চুয়ান্ন-উনসত্তর – একাত্তরের আন্দোলনে ও লড়াইয়ে জাতীয়তাবাদী উপাদানের উপস্থিতি এবং প্রকাশ সত্ত্বেও সেখানে ভাষাভিত্তিক সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক তাৎপর্যসম্পন্ন প্রতিফলন কতখানি ঘটেছে? এ বিষয়ে আবেগে আপ্লুত না হয়ে যুক্তি ও ন্যায়ের ভিত্তিতে বিচার-বিবেচনা করে দেখে নেয়া বাঞ্ছনীয়। এ প্রশ্নের সূত্র ধরেই আমরা আরাে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সম্মুখীন হই। আমাদের উল্লিখিত এইসব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সর্বজনীন বাঙালি জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক চেতনার পরিপূর্ণ প্রকাশ সত্যই যদি ঘটে থাকে তাহলে এতসব আন্দোলন ও লড়াইয়ের পর, বিশেষ করে একাত্তরে ধর্মান্ধ। রাজনীতিক ও স্বৈরশাসকদের হাতে অনুষ্ঠিত গণহত্যা ও অমানুষিক বর্বরতার পটভূমিতে এবং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দীর্ঘকাল পরেও ধর্মভিত্তিক সঙ্কীর্ণ রাজনীতির উগ্র প্রতিক্রিয়ার ধারা সমাজে এতটা ব্যাপক পরিসরে পরিস্ফুট হবে কেন? কেন একাত্তরে বাংলাদেশ-বিরােধিতার রক্তাক্ত চিহ্ন ধারণ করেও এই বাংলাদেশের মাটিতেই জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পেরেছে এবং ক্রমাগত শক্তিবিস্তার করে চলেছে? কেন সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অস্তিত্ব পুরােপুরি মুছে যায় নি? কেন উগ্র ইসলামি রাজনীতির প্রকাশ নতুন করে দেখা যাচ্ছে? এর কারণ শুধুই কি আন্তঃরাষ্ট্রিক ধর্মীয় রাজনীতির শক্তিমান উপস্থিতি? এবং সেই সঙ্গে গণতন্ত্রের সুশাসনে ব্যর্থতা? | জামায়াতের রাজনৈতিক প্রভাব আমরা যতই গৌণ মনে করি না কেন, বাস্তবে তা ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না এবং এই উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা যে। রাজনৈতিকভাবে সঠিক নয় তার প্রমাণ গত দশকে কোন কোন রাজনৈতিক দলের জামায়াত-তােষণনীতিতে পরিস্ফুট। শুধু তাই নয়, বিগত সময়ে অনুষ্ঠিত স্বৈরাচারবিরােধী আন্দোলনের ক্ষেত্রে কোন কোন জাতীয়তাবাদী দলের জামায়াত প্রভৃতি সাম্প্রদায়িক শক্তির রাজনৈতিক সমর্থন অত্যাবশ্যক বিবেচনা করার মধ্যেও সেই প্রমাণ মেলে। সাম্প্রদায়িক শক্তির সাথে প্রচলিত গণতান্ত্রিক শক্তির অসম মিলনের রাজনৈতিক পরিণতি যে প্রগতিশীল গণতন্ত্রের জন্য সুফল বয়ে আনতে পারে না, বিশ্বে তেমন নজির থাকা সত্ত্বেও আমাদের গণতন্ত্রীদের চেতনায় এই সত্য মােটেই স্পষ্ট নয়। আর নয় বলেই এ দেশে ‘এথনিক’ জাতীয়তাবাদ, সম্প্রদায়ভিত্তিক স্বাতন্ত্র্যবাদ, ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতাবাদের রাজনৈতিক অবস্থান ও পারস্পরিক সম্পর্কের তাৎপর্য আমাদের গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা রাজনীতিকদের সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করে দেখা দরকার। যেমন তাদের জন্য, তেমনি দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি এবং রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য তা দরকার কিন্তু এ দেশের জাতীয় রাজনীতি এদিকটায় মােটেই গুরুত্ব দেয় নি। এবং দিচ্ছেনা। আমাদের বিবেচনায় উল্লিখিত প্রশ্নাদির জবাব পেতে ভাষাচেতনা, ভাষা। 

আন্দোলন ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বাস্তব উপাদান ও চরিত্র অন্তর্নিহিত দুর্বলতা-সবলতাসহ আবেগমুক্ত মন নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। আর এই পথেই গণতন্ত্রী জাতীয়তাবাদ বনাম মুসলমান বাঙালির স্বাতন্ত্র্যবাদী চেতনার অর্থাৎ জাতিসত্তাভিত্তিক স্বাতন্ত্র্যচেতনা বনাম সম্প্রদায়নির্ভর স্বাতন্ত্র্যচেতনার অন্তনিহিত রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের পরিণতি ও স্বরূপ অনুধাবন সহজ হতে পারে। আজকের দিনেও এই বিচার-বিবেচনা এই জন্য দরকার যাতে এ বিষয়ে আমরা ভাবাবেগ বা কল্পবাস্তবতাকে প্রধান করে সিদ্ধান্তে না পৌছাই। যাতে জাতীয়তাবাদে নিহিত সমস্যারও চরিত্র বুঝে নিতে পারি। রাজনৈতিক গবেষকদের হাতে উল্লিখিত সমস্যা বিশ্লেষণের দায় ছেড়ে দিয়েও আমাদের নিজস্ব বিবেচনা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সাহায্য করে যে, আমাদের রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে বাঙালি জাতিসত্তাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনার গুণগত বিকাশ ও প্রতিফলন এখনও সম্পূর্ণ হয় নি, এমনকি স্বাধীন স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরও হয় নি। আর হয় নি বলেই সংবিধানে স্বীকৃত রাষ্ট্রভাষা বাংলা জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে ব্যবহৃত হওয়ার বদলে ক্রমশ পিছু হটতে শুরু করেছে; বিদেশী ভাষা ইংরেজির মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থার ক্রমেই প্রসার ঘটছে; উচ্চশিক্ষা ও বিজ্ঞানশিক্ষার ক্ষেত্রেও নানা দুর্বল যুক্তির অজুহাতে ভর দিয়ে ইংরেজি মাধ্যম পাকাপােক্ত হচ্ছে। বেশ কিছুদিন আগে এক টিভি অনুষ্ঠানে জনৈক বামপন্থী। অধ্যাপক-সাহিত্যিক শিক্ষাব্যবস্থায় ইংরেজির বর্তমান অবস্থান এক ধরনের বাস্তব অবস্থা’ হিসেবে মেনে নেয়ার পক্ষে যুক্তি খাড়া করে দেন। ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্রে মাতৃভাষার এই অবাঞ্ছিত অবস্থান বুদ্ধিজীবীদের হাতেই তৈরি হয়েছে এবং নানাদিকে এর প্রসার ঘটছে। অথচ কথাটা সর্বজনস্বীকৃত যে মাতৃভাষার সর্বতােমুখী (শিক্ষাসহ) ব্যবহার ছাড়া জাতীয় উন্নতি সম্ভব হয়ে ওঠে না। প্রশ্নটা ইংরেজি বর্জনের নয়। ইংরেজি রেখেই মাতৃভাষার সর্বতােমুখী ব্যবহারের। ভাষার পর দ্বিতীয় বিবেচ্য বিষয়টি জাতিসত্তা তথা জাতীয়তার ব্যবহারিক অবস্থান ও মর্যাদার প্রশ্ন নিয়ে।

এক্ষেত্রেও উদ্দেশ্যমূলক জটিলতা অবস্থা ঘােলাটে, বিতর্কিত ও সমস্যাসঙ্কুল করে তুলেছে। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরের মধ্যেই জাতীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষার রাজনৈতিক চিন্তাকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বনাম বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দ্বন্দ্ব মাথা তুলে দাঁড়াল এবং বিষয়টি ঘিরে বিতর্কের উত্তাপ কম জমা হয় নি। কিন্তু দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির স্বার্থে এই বিতর্ক ও সমস্যার সমাধান প্রয়ােজন। তাই ভাষা আন্দোলনের আলােচনায় এই সমস্যা আপাতদৃষ্টিতে অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও এ দ্বন্দের সংক্ষিপ্ত স্বরূপ বিশ্লেষণ প্রয়ােজন।  বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তাদের বিশ্বাস, একাত্তরের যুদ্ধে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিপূর্ণ ও সার্বিক বিকাশ ঘটেছে এবং তা চরম ও পরম সার্থকতা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই এর অন্তর্নিহিত ব্যবহারিক  সমস্যা ও দুর্বলতার দিকগুলাে তাদের চেতনায় ধরা দেয় নি। আর দেয় নি বলেই ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্রে বাংলা ব্যবহারের ক্ষেত্রে পিছুটান, হীনম্মন্যতা এবং বিপরীত স্রোতের অস্তিত্ব স্ববিরােধী হওয়া সত্ত্বেও নির্বিবাদে মেনে নেয়া হয়েছে।

এছাড়াও বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারণায় জাতিসত্তার রাজনৈতিক বাস্তবতার দিক অবহেলিত হয়েছে। বাংলা ভাষাসহ বাঙালি জাতিসত্তার ব্যবহারিক বিকাশের নীতিগত প্রয়ােজনেই যে দেশের অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতিসত্তা ও তাদের ভাষার (যেমন আমাদের পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসী জনগােষ্ঠীর) রাজনৈতিক স্বীকৃতি ও বিকাশ ঘটানাে দরকার, এই সমাজতাত্ত্বিক সত্য বাঙালি জাত্যভিমানের কাছে গুরুত্ব পায় নি। তাই ঐসব জাতিসত্তার অস্তিত্ব যেমন আমাদের রাষ্ট্রীয় বৃত্তের স্বীকৃতি পায় নি তেমনি তাদের সমস্যার অনুধাবন ও সমাধানের দিকেও নজর দেয়া হয় নি। বাঙালি জাতীয়তাবাদের এ সঙ্কীর্ণতা অবশ্য এখন মননশীলদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এ বিষয়ে লেখা, আলােচনা কম হচ্ছে না। অন্যদিকে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসিগণ বাঙালি জাতীয়তাবাদের অন্তর্গত রাষ্ট্রীয় সমস্যার যুক্তিসঙ্গত সমাধানের জন্য বাংলাদেশের রাষ্ট্রিক জাতীয়তা (‘ন্যাশনালিটি’)কে বাংলাদেশী জাতীয়তা নামে চিহ্নিত করেছেন। এ পরিবর্তনের ফলে আদিবাসী জাতিসত্তাগুলাে বাঙালি হওয়ার জবরদস্তি থেকে রক্ষা পেয়েছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রিক জাতীয়তা তাদের নিজস্ব জাতিসত্তার প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়ায় নি। কিন্তু সমস্যা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের উগ্র, অতি-উৎসাহী সমর্থকদের নিয়ে যারা বাঙালি জাতিসত্তাকে নতুন করে বাংলাদেশী জাতি হিসেবে চিহ্নিত করে অনেক লেখালেখি করেছেন। এটা ইতিহাস-নৃতত্ত্ব জনতত্ত্ব-সঙ্গত চিন্তা নয়। রাষ্ট্রিক জাতীয়তা ও ‘এথনিক’ জাতীয়তা তথা জাতিসত্তা দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। রাষ্ট্রিক জাতীয়তা (‘ন্যাশনালিটি’) তথা নাগরিকত্ব পরিচয় পরিবর্তনশীল, রাষ্ট্রীয় পরিবর্তনের ওপর নির্ভরশীল, কিন্তু ভাষা-ভূখণ্ড-জাতিসত্তাভিত্তিক জাতীয়তা তা নয়। অনেকের ধারণা রাজনৈতিক স্বার্থ ও ধর্মীয় রক্ষণশীলতা জাতিসত্তা বিষয়ক বিভ্রান্তির কারণ। বিষয়টি নিয়ে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকট। এ সম্পর্কে বিস্তারিত পাঠের জন্য আহমদ রফিকের ‘জাতিসত্তার আত্মঅন্বেষা : বাঙালি বাংলাদেশী’ ও ‘বাংলাদেশ : জাতীয়তা ও জাতিরাষ্ট্রের সমস্যা দ্রষ্টব্য।

বর্তমানে এই রাজনৈতিক সমস্যার যুক্তিসঙ্গত ও গ্রহণযােগ্য সমাধান হলাে, আমরা জাতিসত্তা ও ভাষা বিচারে ঐতিহাসিকভাবে বাঙালি, কিন্তু বর্তমানে রাষ্ট্রীয় জাতীয়তা তথা নাগরিকত্বের পরিচয়ে বাংলাদেশের অধিবাসী বিধায় ‘বাংলাদেশী’, যেমন পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালিগণ নাগরিকত্ব-পরিচায়ক জাতীয়তায় ‘ভারতীয়’। ধর্মবিশ্বাসে যে কেউ মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান হতে পারেন, এমনকি হতে পারেন ধর্মবিশ্বাসহীন, কিন্তু তাতে জাতীয়তায় কোন হেরফের ঘটে না। তেমনি এ দেশের সংখ্যালঘু জাতিসত্তার (যেমন আদিবাসী জনগােষ্ঠী তাদের  জাতিসত্তামূলক পরিচয় (গারাে, সাঁওতাল, চাকমা, মারমা ইত্যাদি) অক্ষুন্ন রেখেই নাগরিক-জাতীয়তায় বাংলাদেশী, ধর্মবিশ্বাস যাই হােক না কেন। প্রসঙ্গত মনে রাখা দরকার যে, ভবিষ্যতে কোন ভৌগােলিক বা রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ’ নামের পরিবর্তন ঘটলে রাষ্ট্রীয় জাতীয়তা এবং তার পরিচিতিজ্ঞাপক নামের পরিবর্তন ঘটতে বাধ্য, ‘বাংলাদেশী’ শব্দটি সেক্ষেত্রে অর্থহীন হয়ে পড়বে; কিন্তু জাতিসত্তার ‘বাঙালি’ পরিচয় তখনও ঠিকই থেকে যাবে, অর্থাৎ জাতি হিসেবে বাঙালি তখনও বাঙালিই থেকে যাবে যেমন অক্ষুন্ন থাকবে অন্যান্য আদিবাসী জাতিসত্তার পরিচায়ক নাম যা পরিবর্তনের কোন প্রশ্ন আসবে না।

ভাষা আন্দোলনের তত্ত্বগত বাস্তবতা একাধিক ভাষিক-জাতিসত্তার স্বীকৃতির ইঙ্গিত (তখনকার অবস্থায় পাখতুন-বালুচ-সিন্ধি-পাঞ্জাবিদের প্রসঙ্গে) নিয়েই এক বিজ্ঞানসম্মত পথের নিশানা রেখেছিল। কিন্তু ঐ ইঙ্গিতেই শেষ । আমাদের চিন্তা ও বিচক্ষণতা সেই সম্ভাবনার বাস্তব ব্যবহার ঘটায় নি বলেই এতকাল পর বাঙালি জাতিসত্তার প্রশ্নে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে অহেতুক কৃত্রিম সমস্যা তৈরি হতে পেরেছে। আমরা তখন বাঙালি জাতিসত্তা বহির্ভূত এদেশীয় ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলাের কথা ভাবি নি। আমরা তাই মনে করি, দেশের সুস্থ ভবিষ্যৎ রাজনীতির প্রয়ােজনে সকল জাতিসত্তারই পরিপূর্ণরূপে বিকাশের অধিকার ও তাৎপর্য যথাযথ গুরুত্বসহ বিবেচিত হওয়া উচিত। শুধু তত্ত্বগত বিচার-বিশ্লেষণই নয়, ভাষা আন্দোলনে সূচিত এবং বিকাশমান জাতিসত্তাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের নানামুখী ও পরিপূর্ণ বিকাশ এখনও আমাদের জন্য এক তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক দায়িত্ব। বাংলাদেশে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশে এই পথ অপরিহার্য। প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বছরে বাকি সাড়ে চার মাসের সবটুকু সময়ই ভাষা সমস্যার তত্ত্বগত দিক নিয়ে লেখালেখিতে এবং সংশ্লিষ্ট কর্মতৎপরতায় শেষ হয়েছে। সাতচল্লিশ সালের জুন মাসে গঠিত গণআজাদী লীগ (দ্র. কামরুদ্দিন আহমদের সংশ্লিষ্ট গ্রন্থ), সেপ্টেম্বরে গঠিত তমদুন মজলিস বাংলা রাষ্ট্রভাষার বিষয়টি শিক্ষিত শ্রেণীর সামনে তুলে ধরে এবং এক্ষেত্রে মজলিসের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ভাষা সম্পর্কে শেষ পদক্ষেপ হলাে ডিসেম্বরের শেষদিকে তমন্দুন মজলিসের নুরুল হক ভূঁইয়াকে আহ্বায়ক মনােনীত করে একটি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠন। কমিটিতে ডান-বাম ও মধ্যপন্থী ব্যক্তিদের উপস্থিতি সত্ত্বেও মজলিসের প্রভাবই ছিল সবচাইতে বেশি। কিন্তু ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করার ক্ষেত্রে এই কমিটি কেন জানি কিছু রুটিন কাজের বাইরে কোন শক্তিমান ভূমিকা নিতে পারে নি। কমিটি গঠন সম্পর্কে অধ্যাপক নুরুল হক ভূঁইয়ার স্মৃতিচারণ স্মর্তব্য (একুশের সংকলন, ১৯৮০, বাংলা একাডেমী)। 

ভাষা আন্দোলনের সংগঠক জনাব আবদুল মতিন এই কমিটি ও তাদের কর্মতৎপরতার দুর্বলতা সম্পর্কে তাঁর যে নিজস্ব মূল্যায়ন উপস্থিত করেছেন তা “সংগ্রাম পরিষদীয় নেতৃত্বের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির দুর্বলতা ও বিভ্রান্তির কারণে আন্দোলন ক্রমেই স্তিমিত হয়ে আসে।… অথচ এরাই—অর্থাৎ তমদ্দন মজলিস, কমরুদ্দিন আহমদ ও তার সহযােগীগণ এবং শেখ মুজিবুর রহমান ও তার অনুসারীগণ একসময় পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট থাকার কারণে প্রথমদিকে ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বেও সংশ্লিষ্ট হন। “এই নেতৃত্বের রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত দুর্বলতার এবং দোদুল্যমানতার কারণে ছাত্র-বুদ্ধিজীবী ও জনগণের সমর্থন সত্ত্বেও ভাষা আন্দোলনকে তারা জাতিসত্তার আন্দোলনের চেতনায় সমৃদ্ধ করে তুলে বেশি দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন নি। এদের একাংশ বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষাগত পরিধির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে আগ্রহী ছিলেন। অন্যদিকে এ সময় নেতৃত্বে তমদুন মজলিসের প্রাধান্য আন্দোলন বিকাশের অন্তরায় হয়ে দেখা দিতে থাকে। কারণ তমদ্দুন মজলিসের লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানে একটি ইসলামী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা এবং এই উদ্দেশ্য সামনে থাকার কারণে ভাষার মত তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়কে এরা তাদের সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িক ধ্যান-ধারণার বাইরে নিয়ে যেতে পারেন নি।” তাই প্রথম থেকেই ভাষা বিষয়ক কার্যক্রম ও কর্মতৎপরতার পেছনে উপস্থিত নেতৃত্ব উল্লিখিত দুর্বলতা ও বিভিন্ন চিন্তার টানাপােড়েনের কারণে আন্দোলনের সম্ভাবনাটিকে জাতিসত্তাভিত্তিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগঠনের মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে আকাঙ্ক্ষিত স্তরে নিয়ে যেতে পারে নি। এমনকি প্রথম সংগ্রাম কমিটি গঠনের পরও কোন সুশৃঙ্খল সাংগঠনিক কাঠামাে গড়ে ওঠে নি। বিভিন্ন পরস্পরবিরােধী মতাদর্শের সমন্বয়ে গঠিত নেতৃত্বের দুর্বলতা ও নানামুখী টানে সংগ্রাম পরিষদ কোন সংগ্রামী ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে যেতে পারে নি। একপা এগিয়েছে তাে দুপা পিছিয়েছে। অথচ প্রাথমিক পর্যায়ে সাতচল্লিশ সালের জুন-জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলা রাষ্ট্রভাষার পক্ষে লেখালেখির পর ঐ বছরেরই অবশিষ্ট কয়েক মাসে ভাষা বিষয়ে ছাত্রবিক্ষোভ, ছাত্র ধর্মঘট, এমনকি সরকারি কর্মচারীদের বিক্ষোভের মতাে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাও দেখা গেছে।

কিন্তু এইসব ঘটনার রাজনৈতিক গুরুত্ব সংগ্রাম পরিষদ উপলব্ধি করতে পারে নি বলে বিষয়টিকে যেমন ছাত্র-শিক্ষকবুদ্ধিজীবীদের সঙ্কীর্ণ গণ্ডির বাইরে নিয়ে যাবার কথা ভাবে নি, তেমনি সম্ভাবনাময় একটি পরিস্থিতিকে আন্দোলনের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার মতাে সাংগঠনিক প্রস্তুতি গ্রহণের কথাও ওই নেতৃত্বের মনে আসে নি। অথচ বাস্তবে এমন সম্ভাবনা ছিল   বলেই প্রথম সংগ্রাম পরিষদ গঠনের তিন মাসের মধ্যেই ভাষা আন্দোলন পরিণতি লাভ করে। তমদুন মজলিস প্রভাবিত প্রথম সগ্রাম পরিষদ সেই আন্দোলন তুলে ধরতে সমর্থ ছিল না বলে বিভিন্ন ছাত্রাবাস ও দলের উদ্যোগে সর্বদলীয় চরিত্রের দ্বিতীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হয় (২ মার্চ, ১৯৪৮)।  অবশ্য এই সঙ্গে পাকিস্তানি মতাদর্শভিত্তিক সাম্প্রদায়িক চেতনা এবং নবগঠিত বার্তা প্রাপ্তিযােগের সম্ভাবনা জনমানসে সে সময় যে প্রভাব রেখে চলেছিল সে কথা মনে রাখা দরকার। জনসাধারণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশে পাকিস্তানের প্রতি অন্ধ মােহ ও আনুগত্যের কারণে অনেক যুক্তিসঙ্গত রাজনৈতিক বক্তব্য হালে পানি পায় নি। তখনকার এই বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় রেখে ভাষা সংক্রান্ত কার্যক্রম ও তৎপরতার সাফল্য, দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতার বিচার করতে হবে। 

সূত্র : ভাষা আন্দোলন-ইতিহাস ও তাৎপর্য – আবদুল মতিন, আহমদ রফিক