You dont have javascript enabled! Please enable it!

আটচল্লিশ থেকে একান্ন  আন্দোলনের প্রস্তুতিপর্ব

ভাষাবিতর্ক ও ষড়যন্ত্রের নয়া পর্যায়ঃ

সংগ্রাম পরিষদের ভেতরে এবং আন্দোলনের বৃহত্তর নেতৃত্বে মতাদর্শগত অন্তর্দ্বন্দ্ব, জাতীয়তার ভ্রান্ত ধারণা এবং পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতার ভাষাবিষয়ক চরম অগণতান্ত্রিক ও স্বেচ্ছাচারী উক্তি সম্পর্কে নেতৃত্বের প্রধান অংশের (মূলত তমদুন মজলিস) বিস্ময়কর নীরবতা এবং তাতে অন্য কারাে কারাে সমর্থন আন্দোলনের পরিস্থিতি পেছন দিকে ঠেলে দেয়। তা সত্ত্বেও বিভিন্ন কারণে অনুষ্ঠিত রাজনৈতিক বিক্ষোভ এবং ছাত্র আন্দোলন আকাঙ্ক্ষিত পটভূমি সৃষ্টি করতে থাকে। কিন্তু প্রথম বছর অর্থাৎ ১৯৪৯ সালে ১১ মার্চের আন্দোলন দিবস পালনে তমদুন মজলিস বা পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ কেউ কোন উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসে নি। মজলিস ও তাদের কোন কোন সহযােগী মনে করতেন, পূর্ববঙ্গে বাংলাভাষার ব্যবহার সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত আইন পরিষদে গৃহীত হওয়ার ফলে ভাষাবিষয়ক ‘বিজয়’ প্রায় সবটুকুই অর্জিত হয়ে গেছে। অধ্যাপক কাসেমসহ তাদের কারাে কারাে লেখায় এই বক্তব্য ফুটে ওঠে। ছাত্র-যুব নেতৃত্বের একাংশে এ ধরনের দুর্বলতা ও সংগ্রামে অনীহার কারণে লীগ-শাসকদের পক্ষে বাংলাভাষার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দিক থেকে (যেমন ভাষা সংস্কার, আরবি হরফে বাংলা প্রচলন ইত্যাদি) আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা সহজ হয়। কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান্য ছিলেন এইসব ষড়যন্ত্রের হােতা। এ পরিস্থিতিতে ১৯৪৯ সালের ১১ মার্চ পালন উপলক্ষে অন্য কেউ এগিয়ে না আসা। সত্ত্বেও ছাত্র ফেডারেশন নাদেরা বেগম, তকিউল্লাহ, নাসির আহমদ প্রমুখের নেতৃত্বে সাধ্যমতাে একটি বিক্ষোভের আয়ােজন করে। তারা একটি ছােটোখাটো মিছিল নিয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘আরবি হরফে বাংলা লেখা চলবে না’ ইত্যাদি ধ্বনি দিতে দিতে পরিষদ ভবনের দিকে এগােতে থাকেন। পুলিশ লাঠি-চালনা করে মিছিল ভেঙে দেয় এবং মিছিল পরিচালনাকারী কয়েকজন  ছাত্রকে গ্রেফতার করে। অবশ্য পরে তাদের জামিনে ছেড়ে দেয়া হয়। গ্রেফতার হওয়া ছাত্রদের মধ্যে সৈয়দ আফজাল হােসেন, মৃণালকান্তি বাড়রী, বাহাউদ্দিন। চৌধুরী, ইকবাল আনসারী খান (হেনরী) ও আবদুস সালাম অন্যতম। ৭৩

আটচল্লিশের আন্দোলনের পর থেকে গােটা উনপঞ্চাশ সাল জুড়ে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে যেসব ষড়যন্ত্রমূলক কার্যকলাপ চলতে থাকে তাতে যেমন অবাঙালি রাজনীতিকদের অংশ নিতে দেখা যায়, তেমনি দেখা যায় বাঙালি লীগ রাজনীতিকদেরও এদের মধ্যে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান ছিলেন সবচেয়ে সক্রিয়; তার সঙ্গে নাজিমুদ্দিন-তমিজুদ্দিন প্রমুখ অনেকেই এ কাজে বিশেষ ভূমিকা নেন। এ সময়কার বহু ঘটনার মধ্যে বিশেষভাবে ১৯৪৯ সালে বর্ণমালা নিয়ে বিতর্ক (কেন্দ্রীয় শিক্ষা উপদেষ্টা বাের্ডের আরবি হরফে বাংলা লেখার সুপারিশও স্মর্তব্য), ‘বাবায়ে উর্দু’ ড. আবদুল হকের উর্দু শিক্ষার সর্বজনীন প্রয়ােজন সম্পর্কে বক্তৃতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. সাদানির বাংলা সম্পর্কে আপত্তিকর বেতার বক্তৃতা উল্লেখযােগ্য। ড. সাদানির বক্তৃতার প্রতিবাদে ঢাকা মেডিকেল কলেজে অনুষ্ঠিত ছাত্রসভায় তার পদচ্যুতির দাবি জানানাে হয় ।৫৫ বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে পাকিস্তানি শাসক ও অবাঙালি বুদ্ধিজীবীদের একাংশের এ ধরনের অভিযান এ সময়ে অব্যাহত ধারায় চলেছে। তাই ঢাকা ক্লাবের সংবর্ধনা সভার মতাে পরিবেশেও ড, আবদুল হক বলতে দ্বিধা করেন না যে পূর্ববঙ্গের প্রায় সকলেই উর্দুর পক্ষে।৫৬ সঙ্গে সুর মিলিয়ে কথা বলেন ড. সাদানি।৫৭ ফলে বাংলা-উর্দু বিতর্ক নতুন করে পত্র-পত্রিকায় এবং সভা-সম্মেলনের বক্তৃতায় দেখা দিতে থাকে অনেকটা সাতচল্লিশ সালের মতােই, তবে এবার একটি নতুন মাত্রা বর্ণমালা বিতর্ক’ এই সঙ্গে যুক্ত হয়। পূর্ববঙ্গ সরকারের অপশাসন বিভিন্ন মাত্রায় সমাজে যে অস্থিরতা সৃষ্টি করে তারই পরিপ্রেক্ষিতে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে গণতান্ত্রিক কর্মসূচি নিয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম (২৩.৬.৪৯)। এর রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল অসামান্য। 

মার্চের আন্দোলনকে সঠিক পরিণতিতে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা এবং ভাষাবিতর্কে উর্দুর পক্ষে জিন্নাহর সরাসরি হস্তক্ষেপ উর্দুবাদীদের শক্তি সঞ্চয়ে সাহায্য করে। এই সঙ্গে বাংলা রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটিকে মূল দাবি থেকে সরিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে মন্ত্রী ফজলুর রহমান প্রমুখ রাজনীতিকগণ হরফ ষড়যন্ত্রের সুকৌশলী জাল বুনতে থাকেন। স্বভাবতই বাংলা রাষ্ট্রভাষার বিষয়টি সমস্যাসঙ্কুল জটিলতায় পাক খেতে থাকে। তাই আন্দোলন-পরবর্তী আটচল্লিশ-উনপঞ্চাশ সাল প্রকৃতপক্ষে ভাষার প্রশ্ন। ঘিরে দ্বিতীয়বার সংগঠিত হওয়ার তথা ঘর গুছিয়ে নেয়ার কাল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। একদিকে উর্দু সমর্থক শাসকগােষ্ঠীর বিভিন্ন ধরনের তাত্ত্বিক বক্তব্য, অন্যদিকে বাঙালি ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীর একাংশের প্রতিবাদী উচ্চারণ ভাষা বিষয়ক পরিবেশ যথেষ্ট উত্তপ্ত করে তুলেছিল। এ বিষয়ে উভয়পক্ষের কয়েকটি উদাহরণই যথেষ্ট হবে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান করাচিতে এক পাঠাগার উদ্বোধনকালে বলেন : ‘একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা।”৫৮ বাঙালি আমলা মীজানুর রহমান পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার নাম’ প্রবন্ধে৫৯ বলেন, “উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। আবার ভাষা ও সংস্কৃতিকে ঘিরে পাকিস্তানি আবহাওয়ায় ধর্মভিত্তিক চেতনা গড়ে তােলার চেষ্টা শুরু হয় গােলাম মােস্তফা, সৈয়দ সাজ্জাদ হােসেন, সৈয়দ আলী আহসান, আবুল কাসেম প্রমুখের মাধ্যমে এবং সেখানে পরােক্ষভাবে হলেও বাংলা-বাঙালি বিরােধিতার উদ্দেশ্য অস্পষ্ট থাকে না। তাই দেখা যায় জনৈক আবদুল বারী মাসিক মােহাম্মদীতে বাংলার জন্য আরবি হরফ গ্রহণের সুপারিশ করে সেই সঙ্গে বলেন : “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু।৬০ আর সৈয়দ সাজ্জাদ হােসেন মাশরেকি পাকিস্তানের ভাষা বাংলাকে ইসলামী বাংলায় রূপান্তরের পরামর্শ দেন ।৬১  এ বিষয়ে একটি চিত্তাকর্ষক বিতর্ক উদ্ধার করা যেতে পারে, যদিও এর প্রকাশ ১৩৫৯ বঙ্গাব্দে।

আবুল কাসেম তার একটি প্রবন্ধে বস্তুবাদের নানা ত্রুটি প্রমাণের চেষ্টা করেন।৬২ জবাবে জনৈক সায়ীদ জামিল আবুল কাসেমের মতামত খণ্ডন করে দেখান যে ‘মানবধর্মই বস্তুবাদের নৈতিক ভিত্তি ।৬৩ আবার বদরুদ্দিন উমর দ্বিতীয় মতামতের বিরােধিতায় আবুল কাসেমের সাথে ঐকমত্য প্রকাশ করে মার্কসবাদের উল্লিখিত ভিত্তি অস্বীকার করে বলেন : ‘মার্কসবাদ মানুষের শাশ্বত প্রকৃতিতে বিশ্বাস করে না, পরকালেও বিশ্বাস করে না। মার্কসবাদ তথা বস্তুবাদ আত্মত্যাগের কোন সার্থক ব্যাখ্যা দিতে পারে না। নাস্তিকদের মহৎ কাজ যুগ যুগের ধর্মীয় চিন্তার ফল। ‘৬৪

এমনি করে উর্দুবাদীদের নানা পদ্ধতিতে বাংলা বিরােধিতার কাজ এগিয়ে চলে, এমনকি চলে সংস্কৃতি ক্ষেত্রেও। অন্যদিকে বাংলাভাষায় আরবি হরফ প্রবর্তনের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের প্রস্তাব৬৫, বাংলায় আরবি হরফের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মহলের প্রতিবাদ এবং বাংলাপন্থীদের বিভিন্ন লেখার মাধ্যমে ভাষা ও হরফ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তৎপরতা পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। মনে রাখা দরকার যে এ সময় দেশে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সঙ্কটের অভিক্ষেপ নিতান্ত কম ছিল না। অসন্তোষ ও হতাশা তখন জনমনে ক্রমেই বেড়ে চলেছে। জনগণের চিন্তাভাবনার মােড় ফেরাতে আটচল্লিশ থেকে পঞ্চাশ সালের মধ্যে ঘটানাে হয়েছে একাধিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, যা ছিল একতরফাভাবে সংখ্যালঘু হত্যা। তাতে উর্দুভাষী প্রশাসন ও বিহারিদের ভূমিকা ছিল লক্ষ্য করার মতাে। তৎকালীন প্রশাসন হিন্দুদের বাড়িঘর, দোকানপাট, ব্যবসাবাণিজ্য, বিষয়সম্পত্তি দরাজ হাতে যেভাবে বিহারিদের মধ্যে বিতরণ করে তাতে শেষােক্তদের মধ্যে দাঙ্গা প্রবণতা বেড়ে যায়। সে প্রভাব ছিল গ্রামাঞ্চলের টাউট মােড়লদের মধ্যেও। এর ফল শুভ হয় নি (কামরুদ্দিন, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪২)। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ বাংলা রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে এ সময় ছাত্রসমাজে বিরাজমান হতাশার মধ্যেই ১৯৫০ সালের ১১ মার্চ উদযাপিত হয়। এবং এই উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আয়ােজিত ছাত্রসভায় আবদুল মতিনের প্রস্তাবের ওপর ভিত্তি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ নতুন করে গঠিত হয়। সাধারণ ছাত্রদের উৎসাহ-উদ্দীপনায় ভাষার রাজনৈতিক বিষয়টি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের সুযােগ এসে যায়। বলা যায়, এই সংগঠন তৈরির মধ্য দিয়ে শুরু হলাে সম্ভাব্য আন্দোলনের প্রস্তুতিপর্ব। এই সভায় উপস্থিত ছাত্রদের কয়েকজনের প্রস্তাবের ভিত্তিতে আবদুল মতিন সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক মনােনীত হন। দলমত নির্বিশেষে বাংলা সমর্থক প্রতিটি সংগঠন থেকে দুইজন করে প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত এই পরিষদের ধীরপদি কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয়পর্বের যাত্রা শুরু। তবে সাধারণ ছাত্রদের যথেষ্ট আগ্রহ সত্ত্বেও সংগঠনগুলাে থেকে, এদের মনােনীত প্রতিনিধিদের কাছ থেকে আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায় নি ।৬৭

ভাষা আন্দোলনের অন্যতম ইতিহাস-প্রণেতা বদরুদ্দিন উমরের মতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় ১১ মার্চ, ১৯৫১। প্রসঙ্গত তিনি লিখেছেন : নবগঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের প্রথম বৈঠক হয় ১৩ মার্চ, ১৯৫১ তারিখে। … এই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে, ভাষা আন্দোলনের তহবিল সংগ্রহের জন্য পতাকা দিবস পালন করা হবে। ৩৮ কিন্তু বদরুদ্দিন উমর প্রদত্ত উল্লিখিত তারিখ সঠিক নয়। এ সম্পর্কে সংগ্রাম কমিটি কর্তৃক প্রচারিত একটি ইশতেহার (বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১১ মার্চে ধর্মঘট পালন করুন) পর্যালােচনা করে দেখলে বুঝতে কষ্ট হয় না যে সংগ্রাম পরিষদ ১৯৫০ সালের মার্চে গঠিত হয়েছিল, ১৯৫১ সালে নয়। এ সম্পর্কে আরাে একটি ইশতেহার এবং একটি স্মারকলিপির সাহায্য নিয়ে আবদুল মতিন বলেন : ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির এই তিনটি দলিল বিশ্লেষণ করলেই বােঝা যায় ঐ কমিটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৫০ সালের ১১ই মার্চ, ১৯৫১ সালের ১১ই মার্চে নয় । ১৯৫১ সালের ১১ই মার্চ সংগ্রাম কমিটি প্রতিষ্ঠিত হলে ঐ কমিটি ১৯৫১ সালের ১১ই মার্চ ধর্মঘট পালনের আহ্বান জানাতে পারে না। …উপরােক্ত প্রচারপত্রে বলা আছে, ‘তিন বৎসর পূর্বে ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ ঐতিহাসিক ৰাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করি। সুতরাং প্রচারপত্রটির রচনাকাল ১৯৫১ সাল।

সংগ্রাম পরিষদ গঠনের কিছুদিন পর প্রয়ােজনীয় অর্থ সগ্রহের জন্য (সম্ভবত এপ্রিল-মে মাসের দিকে) পতাকা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সংগ্রাম পরিষদের আহূত বৈঠকে সদস্যগণ অনুপস্থিত থাকায় আহ্বায়কের একক  সিদ্ধান্তেই দশ-বারােজন ছাত্রকর্মীর সহায়তায় প্রধানত সেক্রেটারিয়েটের দুই গেট এবং আশপাশ এলাকায় সংগ্রহ অভিযান চালানাে হয়। এতে ৯১৮ টাকা সংগৃহীত হয়।  যাইহােক এই ছােট্ট ঘটনা থেকেই প্রমাণ মেলে যে ছাত্র-জনসাধারণ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সম্পর্কে উদাসীন কিংবা বিরােধী হয়ে ওঠে’—আবুল কাসেম তথা তমদুন মজলিসের এই ধারণা সঠিক ছিল না। বরং ভাষা আন্দোলনের চেতনা এ সময় ছাত্র-জনতার মধ্যে ক্রমশ উজ্জীবিত হতে থাকে। আগেকার মতাে একটি আন্দোলন গড়ে তােলা না গেলেও ইশতেহার, পােস্টার, সভা, ছােটোখাটো মিছিল ইত্যাদির মাধ্যমে সংগ্রাম পরিষদ ভাষার দাবিতে ক্রমেই কিছুটা গতি সঞ্চারে সমর্থ হয়। গােটা পঞ্চাশ সাল এই ধরনের কর্মতৎপরতার মাধ্যমে অতিবাহিত হয় এবং অপেক্ষাকৃত অধিক উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে সংগ্রাম পরিষদ ও সংশ্লিষ্ট ছাত্রসমাজ একান্ন সালের ১১ মার্চ উদযাপনের কর্মসূচি গ্রহণ করে।  কিন্তু সার্বিক বিচারে রাজনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদ জনচেতনায় আটচল্লিশের ভাষা আন্দোলনের প্রভাব সামান্যই পড়েছিল। তা না হলে আটচল্লিশ থেকে পঞ্চাশে পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর সহযােগিতায় এতগুলাে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বর্বরতা অনুষ্ঠিত হবে কেন? আসলে দাঙ্গার পেছনে সক্রিয় শাসকগােষ্ঠীর রাজনৈতিক স্বার্থ বুঝে ওঠার মতাে মানসিকতা তথা রাজনৈতিক বােধ যেমন তখনও গড়ে ওঠে নি, তেমনি দেখা দেয় নি ব্যাপকভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনা। তাই সেই নরহত্যার কলুষিত স্রোতের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ সংঘবদ্ধভাবে দাঁড়াতে পারে নি। বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা মানবধর্মের অস্তিত্ব প্রমাণ করেছে। আর বাম আন্দোলন ও বামপন্থার বিরুদ্ধে সরকারি বর্বরতা যে ফ্যাসিস্ট চরিত্র অর্জন করেছিল তার দু’একটা উদাহরণ নাচোল ও রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে সংঘটিত ঘটনাবলি সংক্ষেপে বলতে গেলে, ভাষা আন্দোলনের মতাে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার রাজনৈতিক প্রভাব পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর ইচ্ছা ও উদ্দেশ্যের চাকায় যাতে আঘাত দিতে না পারে সেই লক্ষ্যে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শুরু হয়েছিল ভাষা ও হরফ নিয়ে ষড়যন্ত্র।

অন্যদিকে দেশজোড়া অর্থনৈতিক মন্দা ও দুরবস্থার মুখে মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাই সহজলভ্য ও ফলপ্রসূ উপায় হিসেবে কার্যকরী করে তােলার চেষ্টা চলে। সরকারি তরফে সবরকম ব্যবস্থাই নেয়া হয় যাতে পরিস্থিতি তাদের মুঠোয় থেকে যায়। ফলে এই ক’বছরে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার সুবাদে শহরে-বন্দরে দোকানপাট ব্যবসা-বাণিজ্য ও বাড়িঘরের সহজ অধিকার প্রধানত আসে তথাকথিত মােহাজের নামীয় অবাঙালির হাতে (সামান্যই এসেছে স্থানীয়দের হাতে)। অন্যদিকে উদ্ৰত গ্রামাঞ্চলে পরিত্যক্ত বাড়িঘর ও জমিজমার অধিকার আসে স্থানীয় টাউট শ্রেণীর বাঙালি মুসলমানের হাতে। এই  লােভের আগুন উসকে দিয়ে শাসকদের পক্ষে কাজ হাসিল করা মােটেই কঠিন ছিল না। আরাে একটি তুরুপের তাস শাসকগােষ্ঠীর হাতে বরাবর রক্ষিত ছিল; আর তা হলাে বাঙালি-অবাঙালির মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি, এমনকি শ্রমিক অঞ্চলে পাকিস্তানি শাসকদের এতসব চেষ্টা সত্ত্বেও ভাষাচেতনার অগ্রযাত্রা পুরােপুরি নিশ্চল হয়ে যায় নি। ছাত্রসমাজের সচেতন অংশ ভাষার প্রশ্নটি জিইয়ে রাখতে এবং এই বারুদ উত্তপ্ত করে তুলতে চেষ্টা করেছে।

ভাষাদাবির অগ্রযাত্রা।

পঞ্চাশের কর্মতৎপরতার আরাে একটি দিক ছিল পাকিস্তান গণপরিষদ কর্তৃক গঠিত মূলনীতি কমিটির উর্দু রাষ্ট্রভাষা সুপারিশের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ। এই উপলক্ষে গঠিত সংগ্রাম কমিটি নভেম্বরের (১৯৫০) চার ও পাঁচ তারিখে এক সম্মেলনের আয়ােজন করে এবং ১২ নভেম্বর (১৯৫০) সারাদেশে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। পুরনাে আওয়াজ আবার নতুন করে উচ্চারিত হতে থাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’ ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত মূলনীতি কমিটির সুপারিশ সংক্রান্ত আলােচনা স্থগিত রাখেন।

পঞ্চাশ থেকে একান্নে পৌছে ভাষার দাবি ঘিরে উত্তাপ আরাে বাড়তে থাকে এবং ২৩ ফেব্রুয়ারি (১৯৫১) শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং নানা পেশার বুদ্ধিজীবী এমনকি সরকারি কর্মচারীদেরও একাংশের তরফ থেকে অবিলম্বে পূর্ববঙ্গে সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের দাবি জানিয়ে একটি স্মারকলিপি তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিনের কাছে পাঠানাে হয় । ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. কাজী মােতাহার হােসেন থেকে শুরু করে দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অনেকেই এই স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর দেন। এতে বলা হয় যে, ১৯৪৮ সালে মুখ্যমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনের শাসনকালে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে এই প্রদেশের জন্য বাংলাকে সরকারি ভাষারূপে গ্রহণের সিদ্ধান্ত গত তিন বছরেও বাস্তবায়নের কোনাে লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আর সে কারণেই বর্তমানে ১৯৫১ সালের এপ্রিল মাস থেকে সকল সরকারি কাজকর্ম বাংলায় শুরু করা হােক। এরপরই আসে এগারােই মার্চের আন্দোলন দিবস। এই উপলক্ষে ১৯৫১ সালে সংগ্রাম পরিষদ নতুন করে কর্মসূচি ঘােষণা করে এবং তা বাস্তবায়নের জন্য ব্যাপক কর্মতৎপরতা শুরু হয়। সে বছরই প্রথম রাষ্ট্রভাষা দিবস উপলক্ষে ছাত্রসমাজে যথেষ্ট উৎসাহ-উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যায়। এইসব কর্মতৎপরতার অংশ হিসেবে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ সকল শিক্ষায়তনে ধর্মঘটের আহ্বান জানিয়ে একটি ইশতেহার প্রকাশ করে। এই ইশতেহারে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১১ মার্চ ধর্মঘট পালনের আহবান জানানাে হয়। এখানে আরাে বলা হয় : বন্ধুগণ, যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা কর্তৃপক্ষের এই ফ্যাসিস্ট মনোেভাবকে সমূলে। বিনষ্ট করে আমাদের বাংলার দাবি প্রতিষ্ঠিত করতে না পারি ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম ক্ষান্ত হতে পারে না। অতএব আসুন—আমরা ১১ মার্চ নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ও সভা করে আমাদের ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে স্মরণ করে পুনরায় লৌহদৃঢ় প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে ঘােষণা করতে কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করি।৭৩ প্রকৃতপক্ষে সে বছর ঢাকায় ১১ই মার্চ খুবই উদ্দীপনার সাথে পালিত হয়।

সকল শিক্ষায়তনে ধর্মঘট ও সভা অনুষ্ঠিত হয়। নারায়ণগঞ্জের ছাত্ররাও হরতাল ও মিছিল করে বাংলা রাষ্ট্রভাষার পক্ষে বিশাল সভার আয়ােজন করেন। অলি আহাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেই সভায় মােহাম্মদ তােয়াহা, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ বক্তৃতা করেন। ঢাকা মেডিক্যাল স্কুলের ছাত্রগণও প্রতিবাদ সভার আয়ােজন করেন। সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ৫ এপ্রিল (১৯৫১) ঢাকায় ‘পতাকা দিবস’ পালিত হয় এবং এতে বেশ উৎসাহব্যঞ্জক সাড়া পাওয়া যায়। ৭৪ উর্দুবাদীদের ক্রমবর্ধমান প্রচার ও চাপের মুখে ভাষাচেতনার কার্যকরী প্রকাশ ক্রমেই বেড়ে যেতে থাকে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতাে ধীরস্থির ব্যক্তিও ১৬ মার্চ (১৯৫১) কুমিল্লায় অনুষ্ঠিত অধ্যাপক সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে বলেন : বাংলা ভাষা অবহেলিত হইলে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিদ্রোহ করিব।৭৫ বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ও তৎপরতায় ছাত্র-জনতা ভাষার দাবিতে ক্রমেই সােচ্চার হতে থাকে এবং সাধারণ মানুষের একটি অংশও ছাত্রদের পাশে এসে দাঁড়ায়। গােটা একান্ন সাল ভাষা সংক্রান্ত তৎপরতায় পরিপূর্ণ। এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলাে সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্যদের নিকট বাংলা রাষ্ট্রভাষার পক্ষে স্মারকলিপি পেশ। উল্লিখিত স্মারকলিপি রচনা সম্পর্কে বদরুদ্দিন উমর লিখেছেন যে, ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্তমাফিক হাবিবুর রহমান শেলী, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী প্রমুখকে নিয়ে স্মারকলিপি খসড়া কমিটি’ গঠিত হয় । ৭৬ কিন্তু সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক এবং স্মারকলিপির স্বাক্ষরদাতা আবদুল মতিনের বক্তব্য এ সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভিন্নরূপ : ‘আমি জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ও সামসুর রহমান (জনসন) ও আরাে দু’একজনের কাছে স্মারকলিপি লেখার জন্য অনুরােধ করেছিলাম। কারাে কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে অবশেষে আমিই স্মারকলিপিটি লিখেছিলাম?’৭৭ আরকলিপিটি নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক দলিল। গুরুত্বপূর্ণ এই  স্বারকলিপির একটি ফটো কপি আবদুল মতিন ‘ফসল’ পত্রিকার সম্পাদক এরশাদ মজুমদারের কাছ থেকে সংগ্রহ করেন। গণপরিষদের অধিকাংশ সদস্য অবাঙালি বিধায় স্মারকলিপি ইংরেজিতে লেখা হয়।

এটি স্বাক্ষরের তারিখ ১১ এপ্রিল, ১৯৫১ (পরিশিষ্টে সংযােজিত)। দীর্ঘ এই স্মারকলিপি তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে যথেষ্ট আলােড়ন সৃষ্টি করেছিল। এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশের বাংলা অনুবাদ নিচে দেয়া হলাে : সবশেষে আমরা সে কথারই পুনরাবৃত্তি করব যে কথা আমরা বারবার দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে আসছি। যদি পাকিস্তানে একটিমাত্র রাষ্ট্রভাষা হয়, তাহলে সেটা অবশ্যই হবে বাংলা। আর যদি তা একাধিক হয় তাহলে বাংলাকে হতে হবে তার মধ্যে অন্যতম।… আমরা কখনই উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেব না। আমরা পূর্ব বাংলাকে উপনিবেশে পরিণত করার ষড়যন্ত্র উদঘাটন করে দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা তাদের এবং রাষ্ট্র পরিচালনার শীর্ষে অধিষ্ঠিত জনপ্রতিনিধিদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, যতদিন বাংলা ভাষার ন্যায়সঙ্গত দাবি প্রদেশে এবং কেন্দ্রে পুরােপুরি প্রতিষ্ঠিত না হচ্ছে ততদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ শান্ত হবে না।’

পেশােয়ার থেকে পাঞ্জাব পর্যন্ত সংবাদপত্র মহলে এই স্মারকলিপির প্রভাব ছিল লক্ষ্য করার মতাে। সীমান্ত প্রদেশের প্রভাবশালী দৈনিক খাইবার মেইল’ ২০ এপ্রিল (১৯৫১) সম্পাদকীয় নিবন্ধে বাংলা রাষ্ট্রভাষার সমর্থনে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য পরিবেশন করে : বাংলা ভাষার দাবি অবহেলা করা যায় না। পাকিস্তানের জনসংখ্যার অধিকাংশ পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসী এবং বাংলা ভাষার নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাহিত্য রহিয়াছে। উর্দুকে কাহারও ওপর চাপাইয়া দেওয়া চলে না।…অতএব আমরা মনে করি যে, বাংলা এবং উর্দু উভয় ভাষাকেই পাকিস্তানের সরকারি ভাষারূপে স্বীকার করা উচিত।”৭৯ ঢাকার দৈনিক পাকিস্তান অবজার্ভার’ পত্রিকায় ৫ মে (১৯৫১) এবং সিলেটের সাপ্তাহিক নওবেলাল’ পত্রিকায় ১০ মে (১৯৫১) এই সম্পাদকীয় নিবন্ধ পুনরায় প্রকাশিত হয়। এছাড়া লাহােরের দৈনিক পাকিস্তান টাইমস’ পত্রিকায় এ বিষয়ে। প্রতিবেদন ছাপা হয়।৭৯ স্মারকলিপিটি পাঠিয়ে দেয়ার পর ১২ এপ্রিল (১৯৫১) ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত সংগ্রাম পরিষদের বৈঠকে গণপরিষদের পূর্ববঙ্গীয় সদস্যদের কাছে টেলিগ্রাম পাঠানাের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। উদ্দেশ্য যাতে তারা এ বিষয়ে পার্লামেন্টে সংক্ষিপ্ত নােটিশ উত্থাপন করেন।

বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক এইসব তৎপরতা সত্ত্বেও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার অবস্থার  তেমন কোন উন্নতি দেখা যায় না। বরং বাঙালি সদস্যদের মধ্যে কেউ কেউ উর্দুর পক্ষে তৎপর হয়ে ওঠেন। যেমন ১৫ এপ্রিল (১৯৫১) করাচিতে অনুষ্ঠিত নিখিল পাকিস্তান উর্দু সম্মেলনে মৌলানা আকরাম খা সভাপতির ভাষণে উর্দুর পক্ষে বাংলা-বিরােধিতায় সােচ্চার হয়ে ওঠেন। কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানও সম্মেলনে উর্দুর পক্ষে বক্তব্য রাখেন।

এবার পাকিস্তান অবজার্ভার বাংলার পক্ষে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করে। মৌলানা আকরাম খাঁর বক্তব্যের প্রতিবাদে ১৮ এপ্রিল (১৯৫১) এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে (জাতীয় ভাষা’) বলা হয় : “রিপাের্ট অনুযায়ী মওলানা আকরাম খাঁ উর্দু সম্মেলনে বলেছেন যে, পূর্ব বাংলায় যারা উর্দুর বিরােধিতা করে তারা ইসলামের শত্রু। ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, তিনি এই শক্রদের মধ্যে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতাে যারা উর্দুর পরিবর্তে আরবিকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষপাতী তাদেরকেও অন্তর্ভুক্ত কৱেন… ‘আমাদের একথা মনে করারও কোন দরকার নেই যে, উর্দু-প্রেমিকদের সম্মেলনে উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে মওলানা আকরাম খাঁ যা বলেছেন এ প্রদেশে ফিরে এসে তিনি তার পুনরুক্তি করবেন।’ উর্দু সম্মেলনে আকরাম খাঁ প্রমুখ কয়েকজন রাজনীতিকের উর্দুর পক্ষে তথা বাংলার বিরুদ্ধে বক্তব্যের প্রতিবাদ জানান দেশের ছাত্র-বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ এবং সেই সূত্রে পাকিস্তান অবজার্ভার মে মাসের (১৯৫১) সাত এবং আট তারিখে দুই দফায় রাষ্ট্রভাষা’ শীর্ষক প্রতিবাদী সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। প্রথমটিতে বলা হয় : রাষ্ট্রভাষার ওপর এই দুঃখজনক বিতর্ক ইতােমধ্যেই যথেষ্ট তিক্ততার সৃষ্টি করেছে।…যদি বাংলা এবং উর্দু উভয়কেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয় তাহলে পাকিস্তানের দুই অংশের জনগণের মধ্যে পারস্পরিক বােঝাবুঝি সহজতর, অধিকতর স্বাস্থ্যকর ও সুখকর হবে। যদিও দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্বই ‘অবজার্ভার’-এর এধরনের ভূমিকা গ্রহণের কারণ তবু এর ফলে বঙ্গীয় সদস্যদের উর্দুর পক্ষে ষড়যন্ত্রমূলক মনােভাবের পরিচয় প্রচারিত হয়।  সেই অর্থে পত্রিকাটির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক যেমনটি আমরা দেখতে পাই বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের প্রথম কয়েকদিন দৈনিক আজাদ পত্রিকার বাংলাসমর্থক ভূমিকা গ্রহণের ক্ষেত্রে। এই বাদ-প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদও সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়, তবে বদরুদ্দিন উমর যেভাবে বলেছেন ঠিক সেভাবে নয়। উমর বলেছেন : … … ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কমিটি ৮ই সেপ্টেম্বর তারিখে অনুষ্ঠিত তাদের সভায় কয়েকটি প্রস্তাব গ্রহণ করেন। এই প্রস্তাবের একটিতে তারা বলেন, ‘আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিতে আমরা পাকিস্তান আন্দোলন করেছিলাম’ ইত্যাদি (ব, উ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৪১)। 

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ সে সময় এ বিষয়ে একটি ইশতেহার প্রকাশ করে উল্লিখিত বক্তব্য হজসাধারণের উদ্দেশে পরিবেশন। করে। এতে বাঙালি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সংক্রান্ত দাবিই প্রাধান্য পায় ৯ ইশতেহারটির শিরােনাম ছিল : স্থানীয় রাষ্ট্রভাষা কমিটি গঠন করা এবং বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করুন। আবদুল মতিন : বছর দুই আগে আমার সে সময়কার ইকবাল হলের রুমমেট এবং বর্তমানে ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তনের পরিচালক জনাব আসাদুজ্জামান খান (সম্প্রতি স্থানীয় রাষ্ট্রভাষা কমিটি গঠন করুন এবং শােকে পাকিন্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করুন’ শীর্ষক একটা প্ৰচাৰপত্র দেন। আমি প্রচারপত্রটা ওমর সাহেবকে দেই সেটা তার বইয়ের তৃতীয় খণ্ডে দ্রষ্টব্য (৯ অতিযত্নে রাখা সেই দুপ ইশতেহারে যে কি কপিটি জনাব খান তার বন্ধু আবদুল মতিনকে দিয়েছিলেন তাতেই জাতীয় আনিয়ন্ত্রণের অধিকার সম্পর্কে বদরুদ্দিন উমর উল্লিখিত বক্তব্য অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইশতেহারটির তারিখ ছিল ৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৫১)।

ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ে বিশ্ববলয় ভবনে এক ছাত্রসভায় দেশের গ্রামাঞ্চলে বাংলা রাষ্ট্রভাষাৰ পক্ষে জনমত তৈরির উদ্দেশ্যে এক পরিকল্পনা নেয়া হয়। সরলানন্দ সেনের ‘ঢাকার চির হতিবেদনে আরাে বলা হয় যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষনে অস্বায়ক জনাব আব্দুল মতিন এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে, তাঁর বিরুদ্ধ তাদের কোন অভিযোগ নেই। উর্দুর সাথে বাংলাও রাষ্ট্রভাষা হােক এই তলে দৰি । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভাষা জন মিট গঠিত হওয়ার পর, বিশেষ করে গােটা ১৯৫১ সালে বাংলা ভাষার পক্ষে যে কােন মতৎপরতা পরিচালিত হয়, তা আন্দোলনের পর্যায়ে না খেলেও এই মনে ভাষা আন্দোলনের মরাগাকে আবার জোর দেখা নে যে ৰি সৰে ঢেউয়ের উপস্থিতিও দেখা যায়, শােনা যায় তার জঙ্গি নি। এখানে কিন্তু সঞ্চয় পরিষদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। পাশাপাশি রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও ঘটেছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ, যুবলীগ ইত্যাদির মতো কয়েকটি সংগঠনের উপস্থিতি এবং তাদের গণতান্ত্রিক কর্মতৎপৰত। লক্ষ্য করার মতো যে বিভিন্ন শ্রেণীর সরকারি কর্মচারীদের অসন্তোষ, ক্ষোভ এবং সার্বিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক মন্দা এবং পূর্বাপর সরকারি নির্যাতন ও দমননীতির পটভূমিতে একুশে ফেব্রুয়ারির আত্মপ্রকাশ। সংস্কৃতিক্ষেত্রের পটভূমিতে ছিল ইতােমধ্যে অনুষ্ঠিত কয়েকটি প্রাদেশিক সাংস্কৃতিক সম্মেলনের সুস্থ থকাৰ এৰং এভাৰৎ সংঘটিত ভাষা বিক্ষোভ ও আন্দোলনের ধারা।

সূত্র : ভাষা আন্দোলন-ইতিহাস ও তাৎপর্য – আবদুল মতিন, আহমদ রফিক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!