You dont have javascript enabled! Please enable it! আটচল্লিশের আন্দোলন  সাফল্য ও ব্যর্থতা - সংগ্রামের নোটবুক

আটচল্লিশের আন্দোলন  সাফল্য ও ব্যর্থতা

আন্দোলনের পটভূমি ও প্রস্তুতি। সাতচল্লিশের ডিসেম্বর থেকে আটচল্লিশের মার্চ। এই অল্প সময়ের মধ্যেই ভাষার প্রশ্নটি বেশ জোর পায়ে তার নিজস্ব ধারায় এগিয়ে চলে। আমরা দেখেছি, সাতচল্লিশ সালের শেষদিকে শিক্ষা সম্মেলন উপলক্ষে ঢাকায় সভা, বিক্ষোভ ও মিছিলের মধ্য দিয়ে কেমন করে প্রতিবাদী আন্দোলন শুরু হয়েছে এবং সেই ক্ষুব্ধ পটভূমিতে একের পর এক ঘটনা ক্রমাগতই প্রতিবাদী মাত্রা সংযােজন করে গেছে। পাকিস্তানের তৎকালীন যােগাযােগ মন্ত্রী আবদুর রব নিশতার ১১ জানুয়ারি (১৯৪৮) সিলেট সফরে এলে সিলেট মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি আবদুস সামাদের নেতৃত্বে একদল ছাত্রপ্রতিনিধি মন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, তার কাছে পূর্ববঙ্গের অফিস-আদালতে সরকারি ভাষা এবং শিক্ষার বাহনরূপে বাংলার দাবি পেশ করা।৩৩  ঐ বছরই পয়লা ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্যগণ ঢাকায় কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের সাথে বাংলাভাষার দাবি নিয়ে আলােচনা করেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও মন্ত্রী ২ ফেব্রুয়ারি ভিক্টোরিয়া পার্কে এক জনসভা শেষে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে তাদের চিরাচরিত সুকৌশলী নীতির প্রকাশ ঘটিয়ে মন্তব্য করেন যে ইহা গণপরিষদের বিবেচনার বিষয়।’৩৪  এই পরিস্থিতিতে সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে বাংলা রাষ্ট্রভাষার পক্ষে স্বাক্ষর সংগ্রহের কাজ হাতে নেয়া হয়। অন্যদিকে সভা-সমিতি করিয়া বাংলা ভাষার দাবিকে জোরালাে করে তােলার জন্য দেশবাসীর প্রতি আবেদনমূলক বিবৃতিও প্রচার করা হয়। এর কারণ বাংলা ভাষার প্রশ্নে সাধারণ জনমত তখনও সুস্পষ্টভাবে গড়ে ওঠে নি। এ অবস্থায় ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ইংরেজি ও উর্দুর সাথে বাংলাকেও গণপরিষদের ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি তুলে যে সংশােধনী প্রস্তাব আনেন লীগ সদস্যদের সম্মিলিত বিরােধিতায় তা বাতিল হয়ে যায়।

প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ও পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন থেকে শুরু করে পূর্ববঙ্গীয় সদস্য তমিজুদ্দিন খান এবং পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্য গজনফর আলী প্রমুখ এই প্রস্তাবের বিরােধিতা করে যে বক্তব্য উপস্থিত করেন তার মর্মার্থ হলাে মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে এবং দেশের সংহতি রক্ষার জন্য পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে মাত্র একটি এবং তা হবে  গণপরিষদের এই সিদ্ধান্তে ঢাকার ছাত্রসমাজে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, জগন্নাথ কলেজ, এমনকি কোন কোন স্কুলের ছাত্রগণও তাৎক্ষণিকভাবে ধর্মঘট পালন করেন। তারা মিছিলে যােগ দিয়ে ছাত্র এলাকা ঘুরে এসে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্রসভায় মিলিত হয়ে গণপরিষদের সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করেন। এই অবস্থায় শাসকদের ভাষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন সুসংহত করে তুলতে প্রয়োজন ছিল বিচক্ষণ ও সংঘবদ্ধ নেতৃত্ব এবং সুস্পষ্ট বক্তব্য ও কার্যক্রম পরিবেশন। কিন্তু বহুমুখী নেতৃত্বের কারণে ও সাংগঠনিক সংহতির অভাবে কাজটি সহজ হয় নি। সে সময় কলকাতায় অনুষ্ঠিত দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় যুব সম্মেলনে যােগদানকারী এদেশীয় প্রতিনিধিদল গণপরিষদে নাজিমুদ্দিনের ভূমিকার প্রতিবাদে এবং বাংলার পক্ষে প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য ধীরেন দত্তকে ধন্যবাদ জানিয়ে ২৮ ফেব্রুয়ারি একটি বিবৃতি প্রচার করেন। অন্যদিকে কলকাতা থেকেই এই উপলক্ষে প্রচারিত জনাব সােহরাওয়ার্দির বিবৃতিটি ছিল অস্পষ্ট, ঘােলাটে ও নির্দিষ্ট বক্তব্যহীন। উল্লেখ করা দরকার যে, শুধু ঢাকা শহরেই নয়, গণপরিষদের এই অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সারাদেশে প্রতিবাদ বিক্ষোভ সংঘটিত হয়েছিল; কিন্তু প্রতিবাদের মূল জনগােষ্ঠী ছিল ছাত্র ও শিক্ষক সমাজ। প্রসঙ্গত একথা ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না যে শিক্ষিত শ্রেণীর একটি বড় অংশ তখনও বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ও শিক্ষার বাহন হিসেবে দাবি করেই সন্তুষ্ট ছিল। আর এই সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা সংগ্রাম পরিষদের একাংশেও দেখতে পাওয়া যায়।

উল্লিখিত ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারির ছাত্রসভায় সরকারি ভাষানীতির বিরুদ্ধে দেশব্যাপী হরতাল, সভা ও মিছিলের মাধ্যমে প্রতিবাদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সাধারণ ছাত্রসভার এই সুপারিশ অনুযায়ী ২৮ ফেব্রুয়ারি তমদুন মজলিস ও পূর্ব পাক মুসলিম ছাত্রলীগের এক যৌথ বৈঠকে ১১ মার্চ উল্লিখিত প্রতিবাদ দিবস হিসেবে ধার্য করা হয়। স্বভাবতই প্রতিবাদ দিবসের কর্মসূচি সফল করে তােলার জন্য প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ব্যর্থতা ও বিলুপ্তির পরিপ্রেক্ষিতে নতুন করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন জরুরি হয়ে ওঠে।  আন্দোলনের আশু তাগিদে ২ মার্চ (১৯৪৮) ফজলুল হক হলে বিভিন্ন চিন্তার সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের এক সভায় (যেমন কামরুদ্দিন আহমদ, শামসুল হক, অলি আহাদ, মােহাম্মদ তােয়াহা, কাজী গােলাম মাহবুবসহ অনেকের উপস্থিতিতে) আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বিতীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এবারও তমদুন মজলিসের সামসুল আলমকে আহ্বায়ক মনােনীত করে এবং গণআজাগী লীগ, যুব লীগ, তমদুন মজলিস, পূর্ব পাক মুসলিম ছাত্রলীগ, ইনসাফ, জিন্দেগী, যুগের দাবি পত্রিকা এবং বিভিন্ন ছাত্রাবাস থেকে প্রতিনিধি নিয়ে বহুদলীয় চরিত্রের সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় (কামরুদ্দিন আহমদ)। কিন্তু বিপরীতমুখী মতাদর্শ এবং মতাদর্শগত দ্বন্দ্বের কারণে এই পরিষদেরও ভিত শক্ত ছিল না এবং আপােসবাদী চিন্তাই এর কার্যকলাপে প্রতিফলিত হয়েছে। এর প্রমাণ তুঙ্গ পর্যায়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ৮ দফা চুক্তির মাধ্যমে আন্দোলনের সমাপ্তি ঘােষণা। এর দায় নেতৃত্বেরই ।  সগ্রাম পরিষদ গঠিত হওয়ার পর মার্চের চার ও পাঁচ তারিখে এগারােই মার্চের কর্মসূচি নিয়ে আলােচনার জন্য পরিষদের বৈঠক বসে এবং ১০ মার্চ রাতে ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত বৈঠকে কর্মসূচি ও কর্মতৎপরতা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মার্চের ভাষা আন্দোলনে ছাত্রাবাসগুলাের মধ্য থেকে ফজলুল হক হল, ঢাকা হল, মেডিকেল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হােস্টেলের ছাত্ররাই প্রধান ভূমিকা পালন করেন।৩৭ সলিমুল্লাহ হল থেকে সেখানকার ভি.পি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এই আন্দোলনের সাথে যােগাযােগ রক্ষা করে চলেন। গণপরিষদের বাংলা বিষয়ক বিতর্কের খবরাদি পত্রপত্রিকায় ছাপা হওয়ার পর থেকে ১১ মার্চের আন্দোলন শুরুর পূর্ব পর্যন্ত ছাত্রদের প্রতিবাদী বিক্ষোভ, সমাবেশ, মিছিল নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে ওঠে।

মার্চের আন্দোলন আন্দোলন সফল করে তুলতে আগের দিন রাতেই এক বৈঠকে ঠিক করে নেয়া হয়। সেক্রেটারিয়েটের আশপাশে কে, কোথায়, কিভাবে অবস্থান নেবেন। তাতে দেখা যায়, আবদুল গনি রােডে অর্থাৎ সেক্রেটারিয়েটের প্রথম গেটের সামনে শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ এবং দ্বিতীয় গেটের সামনে কাজী গােলাম মাহবুব, শওকত আলী প্রমুখ নেতা অবরােধ কর্মসূচির দায়িত্বে ছিলেন। এছাড়াও পলাশী ও নীলক্ষেত ব্যারাক, রেলওয়ে ওয়ার্কশপ, রমনা পােস্ট অফিস ইত্যাদি কেন্দ্রেও অবরােধের কর্মসূচি নেয়া হয়েছিল। মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের একটি অংশ অলি আহাদ প্রমুখ নেতার সঙ্গে আবদুল গনি রােডে বিক্ষোভে অংশ নেন, অন্য অংশ ছিলেন পলাশী ও নীলক্ষেত ব্যারাক অঞ্চলে। | ঘটনার বিশদ বিবরণে না যেয়েও বলা চলে যে ছাত্রদের নিরস্ত্র বিক্ষোভের মুখে যথেচ্ছ লাঠিতাড়না ও পুলিশি জুলুমের প্রতিবাদ জানাতে বেলা আড়াইটার দিকে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নঈমুদ্দিনের সভাপতিত্বে ছাত্রদের প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত  হয়। সভাশেষে ছাত্র মিছিল আবার কার্জন হল, হাইকোর্ট এবং সেক্রেটারিয়েটের সামনের রাস্তায় প্রতিবাদ বিক্ষোভ জানাতে থাকলে পুলিশ বেপরােয়া বুট-ব্যাটনলাঠির সদ্ব্যবহার করতে থাকে—সেই সঙ্গে সরকারি গুণ্ডাবাহিনী শুধু ছাত্র-যুব সমাবেশে হামলা চালিয়েই ক্ষান্ত হয় না, কমুনিষ্ট পার্টির অফিস ও বইয়ের দোকান তছনছ করে পুড়িয়ে দেয়। এইসব হট্টগােলের মুখে ফজলুল হক সাহেবও সামান্য আহত হন এবং ছাত্রদের পক্ষে পরদিন তার বিবৃতি প্রকাশ পায়। যুবনেতা তােয়াহা আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। এগারােই মার্চের প্রতিবাদ দিবস রাজশাহী, বগুড়া, যশাের, চাদপুর, জামালপুর, ভৈরব, ময়মনসিংহ, পাবনা, খুলনা, দৌলতপুর, রংপুর, দিনাজপুর, নােয়াখালি, চট্টগ্রামসহ বহু স্থানে পালিত | এইদিন বহু ছাত্র পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন, অনেকে গ্রেফতার হন ঢাকা মেডিকেল কলেজের বেশকিছু ছাত্র (আলী আছগর, এম.আই. চৌধুরী, জসিমুদ্দিন, এস,এ,বারী, ফরিদুল হুদাসহ অনেকে) গ্রেফতার হন। পরদিন পুলিশি জুলুম, নির্যাতন ও গ্রেফতারের প্রতিবাদে শহরের বিভিন্ন ছাত্র এলাকায় সভা ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় এবং ১৩ মার্চ শহরের সকল শিক্ষায়তনে ধর্মঘট পালিত হয়।

এরপর অনেকটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিক্ষোভের বিস্তার ঘটে এবং ১৪ মার্চ সারাদেশে হরতাল পালিত হয়, সেই সঙ্গে সভা-সমাবেশ ও মিছিল। ঢাকায় মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনে লীগ সংসদীয় দলের বৈঠক চলাকালে ছাত্রগণ সামনের রাস্তায় দীর্ঘ সময় ধরে বিক্ষোভ অব্যাহত রাখেন। ঐদিনই সংগ্রাম পরিষদের বৈঠকে ১৫ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কারণ ঐ দিন থেকেই পূর্ববঙ্গ আইনসভার অধিবেশন শুরু হওয়ার কথা। কামরুদ্দিন সাহেবের মতে যারা আন্দোলন পরিচালনা করছিলেন তাদের মধ্যে সর্বজনাব মােহাম্মদ তােয়াহা, তাজউদ্দিন এবং ডা. করিম উল্লেখযােগ্য। অন্য নেতারা হলের ছাত্রদের বিক্ষোভে সংগঠিত করতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। পরদিন পরিষদ ভবনের সামনে অব্যাহত তুমুল বিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে দুর্বলচিত্ত মুখ্যমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন ছাত্রদের সাথে আপােস-মীমাংসার প্রস্তাব পাঠান। সংগ্রাম পরিষদ সঙ্গে সঙ্গেই সে প্রস্তাব লুফে নেয় এবং ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত তাদের সভায় কামরুদ্দিন আহমদের তৈরি খসড়া আলােচ্যসূচি কিছু পরিবর্তনসহ গৃহীত হয়। সংগ্রাম পরিষদের সদস্যদের মধ্যে আবুল কাসেম, কামরুদ্দিন আহমদ, নঈমুদ্দিন আহমদ, মােহাম্মদ তােয়াহা, আবদুর রহমান চৌধুরী প্রমুখ। কয়েকজন মুখ্যমন্ত্রীর সাথে আলােচনায় বসেন এবং তুমুল বিতর্কের পর আট দফা। চুক্তিনামা (অবশ্য জেলে আটক শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, কাজী গােলাম মাহবুব প্রমুখের সম্মতিসাপেক্ষে) স্বাক্ষরিত হয়। সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে স্বাক্ষর দেন কামরুদ্দিন আহমদ এবং সরকার পক্ষে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন। স্বাক্ষরিত চুক্তির ধারাগুলাে ছিল প্রধানত ভাষা আন্দোলনে ধৃত বন্দিদের অবিলম্বে মুক্তি পুলিশি অত্যাচার সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রী কর্তৃক তদন্ত অনুষ্ঠান, এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে পূর্ববঙ্গ আইনসভার অধিবেশনে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা বাংলা সম্পর্কে প্রস্তাব উত্থাপন, প্রদেশে সর্বস্তরে ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে বাংলার পক্ষে প্রস্তাব উথাপন, আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে কোনরূপ ব্যবস্থা না নেয়া, সংবাদপত্রের (কলকাতা থেকে আসা ইত্তেহাদ, স্বাধীনতা ও অন্য কাগজের) ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, কোন কোন স্থানে জারিকৃত ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার এবং আন্দোলনকারিগণ রাষ্ট্রের দুশমন নন এই স্বীকৃতি। | মুখ্যমন্ত্রীর সাথে সম্পাদিত এই আট দফা চুক্তি তমদুন মজলিসপ্রধান আবুল কাসেম ‘বিরাট সাফল্য হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

কিন্তু আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য রাষ্ট্রভাষা বাংলা অনুমােদনের ধারাটিই সেখানে ছিল অস্পষ্ট ও অনির্দিষ্ট। বন্দিমুক্তি ও অন্য শর্তগুলাে তাে ছিল আনুষঙ্গিক এবং সেই আনুষঙ্গিক গৌণ বিষয়গুলােকেই সগ্রাম পরিষদ প্রধান শর্ত হিসেবে গণ্য করে তাদের বিজয়ের মানদণ্ড ঠিক করে নিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, সেদিনই (১৫ মার্চ, ‘৪৮) জেল-প্রত্যাগত নেতাদের ট্রাকে চড়িয়ে শহর ঘুরিয়ে সন্ধ্যায় ফজলুল হক হলে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিজয় উৎসব সম্পূর্ণ করা হয়; কিন্তু কিসের বিজয়? সম্ভবত চিন্তার অগভীরতা ও অস্পষ্টতার জন্য সংগ্রাম পরিষদ বুঝতে পারে নি। যে এ চুক্তি সম্পাদন শাসকদের পক্ষে ছিল তাদের রাজনৈতিক কৌশলের অংশমাত্র এবং সেই সঙ্গে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর পূর্ববঙ্গ সফর নির্বিবাদ ও নিরুদ্রব করে তােলা। অর্থাৎ এক ঢিলে দুই পাখি শিকারের ব্যবস্থা।  কিন্তু সচেতন ছাত্র সমাজ উল্লিখিত চুক্তির দুর্বলতা বুঝতে পেরে এ ধরনের আপােসবাদী চুক্তি সম্পাদনের জন্য অধ্যাপক কাসেমকে অভিযুক্ত করতে থাকেন। পরিস্থিতি ক্রমেই গুরুতর হয়ে উঠছে দেখে মােহাম্মদ তােয়াহা প্রমুখ কয়েকজন নেতা ছাত্রদের সাথে বিস্তারিত আলাপ করে তাদের শান্ত করতে চেষ্টা করেন; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের চাপের মুখে পরদিন অর্থাৎ ১৬ মার্চ সাধারণ হরতাল আহ্বানের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এই ঘটনায় তমদুন নেতাগণ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন এবং আন্দোলনের তৎপরতা থেকে কিছুটা সরে দাড়ান। শুধু তাই নয়, এই ঘটনাটিকে তারা নানা ক্ষেত্রে তাদের রাজনৈতিক প্রয়ােজনে ব্যবহার করতে দ্বিধা করেন নি, বিশেষ করে বামপন্থীদের অভিযুক্ত করে। – আগেই বলেছি, জঙ্গী ছাত্র সমাজ এই আপােস-রফার বিরােধী ছিলেন।

তাদের দাবি ছিল বাংলা রাষ্ট্রভাষা ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নাজিমুদ্দিনের কাছ থেকে সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি ও বিবৃতি  অন্যথায় আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া। পাশাপাশি বামপন্থীরাও একই নীতি অনুসরণ করে আপােস-রফার ভিত্তিতে আন্দোলন স্থগিত করাকে “বিশ্বাসঘাতকতা’ হিসেবে চিহ্নিত করেন, তাদেরও দাবি ছিল আন্দোলন অব্যাহত  রাখা। এর প্রমাণ মেলে উদার গণতন্ত্রী হিসেবে পরিচিত কামরুদ্দিন সাহেবের বক্তব্যে। মার্চের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৫ মার্চ (১৯৪৮) পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। খাজা নাজিমুদ্দীনের দূত বগুড়ার মােহাম্মদ আলী ও খাজা নসরুল্লাহর সঙ্গে আলােচনার পর ফজলুল হক হলে সংগ্রাম পরিষদের অন্য নেতাদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে কামরুদ্দীন সাহেব ঐ প্রস্তাব পেশ করেন। এ সম্পর্কে উপস্থিত সদস্যদের প্রতিক্রিয়া ছিল পরস্পর-বিরােধী। তার ভাষায় : “কাসেম সাহেব বললেন যে, আমরা আন্দোলনের জন্যই আন্দোলন করছি না—আমরা আমাদের দাবি-দাওয়ার ভিত্তিতে আলাপ করতে রাজী আছি : পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কথাও তাইএকমাত্র তােহা সাহেব বললেন, আন্দোলন ক্রমাগতই জোরদার হচ্ছে—এমনি সময়ে আন্দোলন বন্ধ হয়ে গেলে কর্মীদের ওপর সুবিচার করা হবে না—কারণ আন্দোলন এখন কেবল ঢাকায় সীমাবদ্ধ নয়—সব মফস্বল শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। তাছাড়া ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-মুন্সীগঞ্জের কর্মীরা সেদিন আসবে” (প্রাগুক্ত গ্রন্থ, পৃ. ১১৫)। | উদ্ধৃত বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে ছাত্রসাধারণের ভাষাবিষয়ক আবেগ, আগ্রহ ও আন্দোলন প্রবণতার বিষয়াদি মনে রেখে মােহাম্মদ তােয়াহা আন্দোলন বন্ধ করে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আপােসে রাজি ছিলেন না। কামরুদ্দিন সাহেবের ভাষ্যে দেখা যায় তাজউদ্দিন আহমদও এ প্রস্তাবের খুব একটা পক্ষপাতী ছিলেন না। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতেই তারা শেষ পর্যন্ত মীমাংসায় রাজি হন। এর ফলাফল যে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে যায় নি, পরবর্তী ঘটনাবলি তার প্রমাণ। আসলে আন্দোলন অব্যাহত রাখায় ইচ্ছুক ছাত্রদের পদক্ষেপই ছিল সঠিক।

এমন কি পরিস্থিতি বিচারে মীমাংসার পদক্ষেপ অপরিহার্য মনে হলে মীমাংসার শর্ত বাস্তবায়ন হওয়া উচিত ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে। কারণ জিন্নাহ। সাহেবের পূর্ববঙ্গ সফর উপলক্ষে সরকার তখন এক সঙ্কটে নিমজ্জিত। কিন্তু সংগ্রাম পরিষদের প্রধান অংশ (তমন্দুন মজলিস) এই আপােস-রফার চুক্তিকে ছাত্রদের “বিজয়” হিসেবে অভিহিত করে আন্দোলন প্রত্যাহারের জন্য ছাত্রদের প্রতি আহ্বান জানায়। এখানে একটি বিষয় লক্ষ্য করার মতাে যে আন্দোলনের প্রধান নেতৃত্বের অন্তর্নিহিত দুর্বলতা এবং লক্ষ্য সম্পর্কে নীতিগত অস্পষ্টতার কারণে কোন কোন রাজনৈতিক ব্যক্তি বা সংগঠন এই আন্দোলন থেকে সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করতে। থাকেন। যেমন মােহাম্মদ আলী, তােফাজ্জল আলী প্রমুখ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় লীগ নেতা আন্দোলনের সাথে কিছুটা সম্পর্ক রেখে সেই সুবাদে নাজিমুদ্দিনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে মন্ত্রিত্ব লাভের চেষ্টা চালান। আবার এমনও দেখা গেছে যে, সংগ্রাম পরিষদ যখন এই চুক্তিপত্র মেনে নেয়ার জন্য ছাত্রদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে তখন সদ্য কারামুক্ত শেখ মুজিবুর রহমান ও শওকত আলী ছাত্রদের একাংশকে নিয়ে চুক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভার আয়ােজন করেন ফলে।  

বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত ছাত্রসভায় আট দফা চুক্তিনামায় কিছুটা সংশােধন করা হয়, অবশ্য সংগ্রাম পরিষদের সম্মতিক্রমেই। কিন্তু এই সংশােধনীতেও আকাক্ষিত পরিবর্তন আসে নি। এখানে বলা হয়, ‘পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদে রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত প্রস্তাব গ্রহণের জন্য একটি নির্দিষ্ট দিন নির্ধারণ না করা হলে মন্ত্রিসভাকে পদত্যাগ করতে হবে।’ যাই হােক সংশােধিত প্রস্তাব ছাত্রসভায় অনুমােদিত হওয়ার পর অলি আহাদের মাধ্যমে নাজিমুদ্দিনের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ইতােমধ্যে ঐ সভায় বক্তৃতাশেষে শেখ মুজিবুর রহমান সংগ্রাম পরিষদের সাথে আলােচনা ছাড়াই কিছুসংখ্যক ছাত্রের একটি মিছিল নিয়ে সরকার-বিরােধী ধ্বনি দিতে দিতে পরিষদ ভবনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। পুলিশ সেখানে যথারীতি তাদের বাধা দেয়। তাদের স্লোগানে আকৃষ্ট হয়ে আরাে বহু ছাত্র সেখানে সমবেত হন এবং এই সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকে। পুলিশের লাঠি চালনা সত্ত্বেও ছাত্রদের বিক্ষোভ সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে এবং মন্ত্রী ও পরিষদ সদস্যগণ পরিষদ ভবন থেকে বেরােতে পারেন না। অবশেষে পুলিশের লাঠি, কাঁদানে গ্যাস এবং ফাঁকা গুলির চাপে ছাত্রদের অবরােধ ছেড়ে চলে যেতে হয়। | সে রাতে সংগ্রাম পরিষদের বৈঠকে পুলিশি জুলুমের প্রতিবাদে ১৭ মার্চ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ও সভা অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, তবে মিছিলের কর্মসূচি বাতিল করা হয়। পরদিন (১৭ মার্চ) দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত ছাত্রসভায় জিন্নাহ সাহেবের আসন্ন ঢাকা সফরের কারণে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ধর্মঘট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।  এমনি করে আন্দোলনের মাঝপথে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নের পুরােপুরি ফয়সালা না করেই সংগ্রাম পরিষদ সব কর্মতৎপরতা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেন ও আন্দোলন থেকে সরে আসেন, কিন্তু এখানেই শেষ নয়। সেদিন রাতে এবং পরদিন সকালে অনুষ্ঠিত সগ্রাম পরিষদের দীর্ঘ বৈঠকের রাজনৈতিক পরিণতি হলাে ভাষা আন্দোলনের ওপর একটি খসড়া বিবৃতি রচনা এবং জিন্নাহ সাহেবের জন্য একটি ছাত্রসংবর্ধনা কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ।

এই সংগ্রাম পরিষদের ভাষা বিষয়ক কর্মকাণ্ডের এখানেই ইতি; আর এই ছিল তাদের সংগ্রামী কর্মতৎপরতার ইতিকথা। স্বল্পকাল স্থায়ী আটচল্লিশের ভাষা আন্দোলনের মূল্যায়নে দেখা যায়, এতে সাফল্যের চেয়ে ব্যর্থতার দায়ভাগই প্রধান। এক কথায় এর কারণ নেতৃত্বের দুর্বল। আপােসবাদী নীতি। সংগ্রাম পরিষদ এই রাজনৈতিক সত্য অনুধাবন করতে পারে নি যেকোন গূঢ় অভিসন্ধি ছাড়া শাসকগােষ্ঠী সাধারণত নিজ উদ্যোগে আপােসপ্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে আসে না। তাই সংগ্রাম পরিষদ বুঝতে পারে নি যে মুখ্যমন্ত্রীর আপােস-চুক্তি সম্পাদনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর পূর্ববঙ্গ সফর প্রতিবাদহীন ও নিরুপদ্রব করে তােলা এবং সেই সূত্রে চুক্তিপত্রটি অকেজো   করে ফেলা। জিন্নাহ সাহেব যে বাংলাকে ঝেড়ে ফেলে উর্দু রাষ্ট্রভাষা বাঙালিদের কাঁধে চাপিয়ে দিতে পারেন এই হিসাব সংগ্রাম পরিষদের ছিল না। কিন্তু সেই হিসাব-নিকাশ করেই নাজিমুদ্দিন সরকার আপােস-রফার পথে নেমেছিলেন বলে মনে হয়। তাই তিনি জিন্নাহর সফর শেষে কায়েদে আজমের বক্তব্যের অজুহাত টেনে নিশ্চিন্ত মনে চুক্তিপত্র বাতিল করে দিতে পেরেছেন।  এখানে একটি বিষয় লক্ষ্য করার মতাে যে চুক্তিপত্রের প্রধান ধারা অর্থাৎ কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক শর্তটি মােটেই সুনির্দিষ্ট, সুলিখিত ও সুচিন্তিত ছিল না। এবং এই ধারাটির অস্পষ্টতার সুযােগ নিয়েও নাজিমুদ্দিন সাহেব নিরাপদ অবস্থান। গ্রহণ করতে পারতেন। তাছাড়াও সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে অনৈক্য, দুর্বলতা ও নানামুখী টানাপােড়েন তাে ছিলই। | আসলে সংগ্রাম পরিষদের প্রধান অংশের উদ্দেশ্য ছিল আন্দোলন তাদের নিজস্ব স্বার্থের ধারায় চালিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং আন্দোলন-তৎপরতার রাশ বামপন্থীদের হাত থেকে দূরে সরিয়ে রাখা। এমনকি মধ্যপন্থীদের হাতেও ছেড়ে -দেয়া। তাদের লক্ষ্য ছিল ধর্মীয় আদর্শের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট করে বাংলা রাষ্ট্রভাষার দাবি বিচ্ছিন্নভাবে আদায়ের চেষ্টা।

পরবর্তী সময়ে তমদ্নপন্থীদের একাধিক বিবৃতি ও বক্তব্যে এই দিকগুলাে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, এমনকি আন্দোলনের অংশীদার বামপন্থীদের সরাসরি সমালােচনায় অন্তর্বিরােধ ও সংগ্রামী ঐক্যের অভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ অবস্থায় আন্দোলন স্বাভাবিক নিয়মেই লক্ষ্য অর্জনে বেশিদূর এগিয়ে যেতে পারে না। প্রাসঙ্গিকভাবে প্রচারিত শাহেদ আলীর বিবৃতিতেও (৩১ মার্চ, ১৯৪৮)৩৯ দেখা যায়, তারা আন্দোলনকে আপােস-রফার মাধ্যমে শুধু রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চেয়েছেন এবং তাও রাজনৈতিক স্পর্শ বাচিয়ে এবং কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের যথাসম্ভব আন্দোলন থেকে দূরে রেখে। এই চেষ্টায় আন্দোলন নিঃসন্দেহে দুর্বল হয়েছে। তাই বুঝতে কষ্ট হয় না যে আন্দোলনে বিভিন্ন বিপরীতমুখী চিন্তার সক্রিয় উপস্থিতি (যেমন তমন-লীগ-বাম-মধ্যম ইত্যাদি) আন্দোলনগত বিচারে দুর্বলতার উপাদান বহন করে ব্যর্থতার অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই সূত্রে আন্দোলনে তমদুন মজলিসের ভূমিকা দেখে নেয়া দরকার প্রধানত এই জন্য যে মজলিসের বিশ্বাস, আটচল্লিশের আন্দোলন ও তার বিজয়ের(?) পুরস্কার তাদেরই প্রাপ্য। ৬ তমদুন মজলিসের ভূমিকা তমন্দুন মজলিসের কর্মকর্তা তাে বটেই, এর বাইরেও কারাে কারাে ধারণা ভাষা। আন্দোলন তমদুন মজলিসেরই অবদান। এমন কি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস রচয়িতা বশীর আল হেলালও যখন লেখেন ‘তমদুন মজলিসের প্রাথমিক উদ্যোগেই ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন বিশেষ গতি লাভ করেছিল’ (পৃ. । ১৮৩), তখন বুঝতে কষ্ট হয় না উল্লিখিত চিন্তার শিকড় কতদূর বিস্তার লাভ। 

করেছে। এর প্রমাণ, দীর্ঘকাল ধরেই বিভিন্ন মাধ্যমে তমদ্নপন্থী নেতা, লেখক ও সাংবাদিকদের কেউ কেউ বলে চলেছেন যে তমদুন মজলিসই ভাষা আন্দোলনের জনক। তাই ঘটনাবলির যথাযথ বিশ্লেষণে এইসব দাবির যৌক্তিকতা দেখে নেয়া দরকার।  তমদুন মজলিসের প্রকাশিত পুস্তিকাদি এবং এর প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবুল কাসেম ও তার সহযােগীদের বিভিন্ন সময়ে প্রচারিত বক্তব্যে দেখা যায়, তাদের লক্ষ্য ছিল দেশে ইসলামি সমাজব্যবস্থা কায়েম করার চেষ্টা চালানাে। এরা রাজনৈতিক চিন্তায় প্রগতিশীল সমাজব্যবস্থার ঘাের-বিরােধী ছিলেন। সম্ভবত বাংলা রাষ্ট্রভাষার বিষয়টিকে তাদের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রয়ােজনের অংশ হিসেবেই তারা দেখতে চেয়েছিলেন, অবশ্যই বাঙালি জাতিসত্তার সাথে সমন্বিত করে নয়। মতাদর্শগত এই বৈশিষ্ট্যের কারণে তারা ভাষা আন্দোলনকে একটি সঙ্কীর্ণ দৃষ্টির পরিসীমায় ধরে রাখতে চেয়েছিলেন এবং এই জন্য তারা আন্দোলনে আপােসপন্থা গ্রহণে দ্বিধা করেন নি। এর প্রমাণ, মার্চে জিন্নাহ সাহেবের পূর্ববঙ্গ সফল উপলক্ষে ভাষা বিষয়ক লক্ষ্য অর্জনে তাদের আনন্দ ও প্রত্যাশা এতই স্পষ্ট ছিল যে কোন দূরদর্শিতার পরিচয় না রেখেই লীগ শাসনের সাথে সমঝােতার ভিত্তিতে তারা মাঝপথে আন্দোলন স্থগিত করে দিতে এতটুকু দ্বিধা করেন নি। এমনকি জিন্নাহ সাহেব চলে যাবার পর লক্ষ্য অর্জনে চূড়ান্ত ব্যর্থতা সত্ত্বেও সেই স্থগিত আন্দোলন শুরু করার কোন উদ্যোগ তারা গ্রহণ করেন নি; এ বিষয়ে সংগ্রাম পরিষদকে উজ্জীবিত করার কোন চেষ্টাও তারা করেন নি। | মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকা ত্যাগের পর সংগ্রাম পরিষদের যে শেষ বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় সেখানে নঈমুদ্দিনের ছাত্রলীগ ও তমদুন মজলিস নিজ নিজ দলীয় কৃতিত্ব দাবি করে পরিবেশ দূষিত করে তােলেন এবং সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক মজলিস কর্মী শামসুল আলম অক্ষমতার দায়ে পদত্যাগ করে মােহাম্মদ তােয়াহাকে অফিসের কাগজপত্র বুঝিয়ে দেন। | তমদুন মজলিসের তৎকালীন (১৯৪৮) চিন্তা ও বক্তব্য ছিল একইসঙ্গে আত্মতুষ্টির ও আক্ষেপের, যা প্রকৃতপক্ষে হতাশা ও ব্যর্থতাবােধের নামান্তর।

তমন-প্রধান আবুল কাসেমের লেখায় তা প্রতিফলিত । তার ভাষায় : “কায়েদে আজমের নিকট যদি সরাসরি ভাষা সম্পর্কিত বিভিন্ন দাবিদাওয়া পেশের সুযােগ লাভ করিতাম, তাহা হইলে আমাদের স্থির বিশ্বাস, আমরা তাহাকে স্পষ্টত: বুঝাইতে সমর্থ হইতাম যে পাকিস্তানে মােছলেম লীগের সংগঠনই এই আন্দোলনের মূল উদ্যোক্তা এবং ইহার প্রকৃত উদ্দেশ্য হইতেছে পাকিস্তানের সংহতি আরও দৃঢ় ও শক্তিশালী করা, দুর্বল করা নহে। খােদার আশীর্বাদে, শেষ পর্যন্ত সত্যের জয় অনিবার্য। “বস্তুত: কমুনিষ্টরা এই আন্দোলনের জন্য কোনাে চেষ্টাই করে নাই।…এই সুবিধাবাদীগণই নাজিম-মন্ত্রিসভাকে কায়েদে আজমের সম্মুখে আমাদের আন্দোলন।   ও উদ্দেশ্যের অপব্যাখ্যার সুযােগ দান করিয়াছে এবং আমাদের এই আন্দোলনের সমগ্র উদ্দেশ্য বানচাল করিয়া দিয়াছে।” ১ এর অর্থ “আমরাই (তমন্দুন মজলিস) সব করেছি। আর এই ধারণার বশবর্তী হয়ে তাদের সাফল্যের বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন : ‘চুক্তি অনুযায়ী ১টি ছাড়া বাকি সব দফা পালিত হওয়ায় আন্দোলনের তেজ কমিয়া যায়। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের লক্ষ্যই ছিল এক দফা অর্থাৎ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি, যা আদৌ অর্জিত হয় নি; তবু তাৎক্ষণিক কিছু দাবি আদায় করে নিয়ে মজলিসের আত্মতুষ্টির শেষ ছিল না। তাদের সমগ্র বক্তব্যই ছিল এ ধরনের একদেশদর্শী ও স্ববিরােধী বক্তব্যে পরিপূর্ণ। তাই আন্দোলন ‘পুনরায় শুরু করা প্রসঙ্গে জনাব “ইহার পর সংগ্রাম পরিষদ ও মজলিস কেন্দ্রেও যাহাতে বাংলা ভাষা স্বীকৃতি পায় তজ্জন্য আন্দোলন করার আহ্বান জানায়। কিন্তু এবার আন্দোলনে অনেকে আগাইয়া আসিতে রাজী হইল না। ইহার কারণ হইল—কায়েদে আজমের আগমনের পর তাহার বক্তৃতায় ও ব্যক্তিত্বে ছাত্রদের অনেকে এবং জনসাধারণ। আন্দোলনের বিরােধী হইয়া পড়ে।…মন্ত্রিত্ব শিকারী, সরকারি গােয়েন্দা ও অতিপ্রগতিশীল ছাত্রদের মধ্যে দলাদলি সৃষ্টি করিয়া ছাত্রদের ঐক্যের মূলে কুঠারাঘাত করিয়া নৈরাশ্যের মধ্যে ফেলিয়া দেয়।” 

প্রকৃতপক্ষে মজলিস আন্দোলন থেকে অব্যাহতি পেতেই এইসব ভিত্তিহীন ও স্ববিরােধী বক্তব্য পেশ করেছে। আর এদিক থেকে তাদের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল বামশক্তি, যেজন্য তারা মিথ্যা ভাষণের আশ্রয় নিতেও দ্বিধা করেন নি। এই প্রসঙ্গে প্রবণ কমুনিস্ট নেতা মােজাফফর আহমদ সম্পর্কে আবুল কাসেম বলেন : “সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ হইতে আমি কয়েকজন কর্মসিহ তাঁহার (মােজাফফর আহমদ—লেখকদ্বয়) নিকট উপস্থিত হইলে তিনি পার্টির তরফ হইতে আমাকে জানাইয়া দেন : এই আন্দোলনকে সমর্থন করা তাহাদের পক্ষে সম্ভব হইবে না। শুধু তাই নয়, তিনি মেমােরেণ্ডামে দস্তখত করিতেও অস্বীকার করেন। ছাত্র ফেডাৱেশনও ইহাতে যােগদান করিতে অস্বীকার করে। | এই অভিযােগের জবাবে মােজাফফর আহমদ লেখেন : “খুৰ বিনয়ের সঙ্গে আমাকে বলতে হচ্ছে যে এই বক্তব্যে কিঞ্চিৎ সত্যের অপলাপ আছে। একথা সত্য যে বাংলাদেশ বিভক্ত হওয়ার পর ১৯৪৮ সালে আমি ঢাকায় গিয়েছিলাম, ঢাকায় আমাদের পার্টি অফিসে কয়েক ব্যক্তি একটা মেমােরেণ্ড্যমে আমার দস্তখত নিতে এসেছিলেন এবং আমি তাতে দস্তখত দিইনি। তবে ভাষা আন্দোলনকে সাহায্য করা কমুনিষ্ট পার্টির পক্ষে সম্ভব হবে না এমন কথা আমি। কখনাে বলিনি। এটা একেবারেই বানানাে কথা। যারা আমার দস্তখত নিতে এসেছিলেন তাদের আমি বুঝিয়ে বলেছিলাম তাদের মেমােরোমে আমার দস্তখত। দেওয়া উচিত হবে না। আমি স্থায়ীভাবে কলিকাতার বাসিন্দা। পাকিস্তান হওয়ার  পরও আমি ভারতের নাগরিকত্ব ছেড়ে দিইনি। আমার ধারণা হয়েছিল যে ভাষার দাবীর মেমােরেণ্ডামে আমি সই করলে পূর্ববঙ্গ সরকার একথা বলার সুযােগ পাবে। যে ভাষা আন্দোলনের প্ররােচনা বাইরে থেকে এসেছে। পরে প্রমাণিত হয়েছে যে আমার ধারণা ভুল ছিল না।”৪৪ দেখা যাচ্ছে, অধ্যাপক কাসেম ইচ্ছাকৃতভাবেই মােজাফফর আহমদের বক্তব্য কিছুটা বিকৃতভাবে পরিবেশন করেছেন। এই তথ্য-বিকৃতির উদ্দেশ্য বুঝতে কষ্ট হয় না। এমনি অসঙ্গতি বা বিকৃত তথ্য পরিবেশন মজলিসের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অনেকেই করেছেন। এ প্রসঙ্গে শাহেদ আলীর বিবৃতিটিও খুবই চমকপ্রদ : “বঙ্গভাষা আন্দোলনটি সর্বদা একটি বিশেষ ভিত্তির উপর পরিচালিত হইতেছিল।

পার্লামেন্ট সংক্রান্ত রাজনীতির সহিত ইহার কোনই সংস্পর্শ ছিল না। দুর্ভাগ্যবশত কতিপয় তথাকথিত কমুনিষ্ট ও মন্ত্রিসভা-বিরােধী যুবক একদল নির্দোষ ও সরলমতি ছাত্রকে ভ্রান্ত পথে চালিত করিয়া বিগত ১৬ই মার্চ তারিখে পরিষদ গৃহে উপস্থিত করেন। আমাদের এই সুষ্ঠু আন্দোলনকে তাহাদের স্বীয় স্বার্থসিদ্ধির নিমিত্ত বানচাল করাই ছিল তাহাদের মুখ্য উদ্দেশ্য।”৪৫ এখন প্রশ্ন, শাহেদ আলী কথিত “বিশেষ ভিত্তিটি কি? আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, মজলিস বরাবরই ইসলামি সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ভাষা আন্দোলনকে ব্যবহার করতে চেয়েছে। আর সেজন্য তারা সরকারি ভাষ্যের সাথে সুর মিলিয়ে মজলিস-বহির্ভূত আন্দোলন-সংশ্লিষ্ট সংগঠক, বিশেষ করে বামশক্তির বিরুদ্ধে বিষােদগার করতে, এমনকি অসত্য ভাষণেও ইতস্তত করেন নি। শাহেদ আলীর উপযুক্ত বক্তব্যের সাথে আন্দোলনের বিরুদ্ধে সরকারি বিজ্ঞপ্তির একটুও তফাৎ মিলবে না। অথচ এরাই নাকি ভাষা আন্দোলনের জনক, সংগঠক এবং মুখপাত্র। প্রসঙ্গত বলা দরকার যে সরকারের সাথে আপােসের কারণে উত্তেজিত ছাত্রসাধারণের একাংশকে ১৬ মার্চ পরিষদ ভবনের দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, কোন কমুনিস্ট বা ফেডারেশন কমী নন, যে তথ্য আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। | বিশেষ উদ্দেশ্যতাড়িত হওয়ার কারণে তমদুন মজলিস আন্দোলনে উপস্থিত থেকেও এবং সংগ্রাম পরিষদে তাদের প্রাধান্য বজায় রেখেও বাম বিরােধিতায় এতটাই সােচ্চার ছিলেন যে এর ফলে আন্দোলনের সংহতি নষ্ট হওয়া এবং আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ার সম্ভাবনা মােটেই বিবেচনা করেন নি।

তাই তাদের সাপ্তাহিক মুখপত্র ‘সৈনিক’-এ যথেচ্ছ বাম-বিরােধী প্রচার চালানাে হয়েছে। অভিযােগ আনা হয়েছে যে বামপন্থী ছাত্রগণ আন্দোলন ‘স্যাবােটেজ’ করছেন। অধ্যাপক কাসেমও একই ভাষায় বলেছেন : “তৃতীয় আর এক দল এই আন্দোলনকে সেবােটেজ করার চেষ্টা করেন। ইহাৱা কমবেশী ছাত্র ফেডারেশনের সভ্য ছিলেন।… আন্দোলন যখন বেশ জমিয়া উঠিয়াছে তখন ইহারা গােপনে পাকিস্তান-বিরােধী ও ধ্বংসাত্মক কয়েকটি হ্যান্ডবিল। ও পােস্টার দিয়া জনগণকে আন্দোলন-বিরােধী করিয়া তােলে। জনসাধারণ তখন। সন্দেহ করিতে শুরু করে যে, এ আন্দোলন নিশ্চয়ই ভারতের প্ররােচিত।”  এমনি করে তমদুন মজলিস নেতৃবন্দ একদিকে নানা অবাঞ্ছিত প্রচার এবং সেই সঙ্গে মূলত আপােসপস্থার মাধ্যমে আন্দোলন নিজেদের হাতে রাখার চেষ্টা চালিয়েছেন, অন্যদিকে বাম-বিরােধী ভূমিকা পালন করতে গিয়ে আন্দোলনের। সংহতি নষ্ট করে সেই আন্দোলনের স্বার্থের ওপরই আঘাত করেছেন। অনৈক্য সৃষ্টির এই চেষ্টা এবং দলীয় শক্তি বৃদ্ধিই প্রধান উদ্দেশ্য হয়ে ওঠার ফলে আটচল্লিশের আন্দোলন লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে এবং সেই সঙ্গে সচেতন ছাত্রযুব সমাজের কাছে মজলিসের জনপ্রিয়তা ও তার দলগত শক্তি ক্রমশ হ্রাস পেয়েছে। তাই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে তারা দলীয় স্বার্থসিদ্ধির সঙ্কীর্ণ রক্ষণশীল খাতে টেনে নিয়ে যেতে পারেন নি। বরং আন্দোলনের চরিত্র ক্রমশ পরিস্ফুট হওয়ার প্রক্রিয়ায় নিজেরাই সেই প্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন। তাই পরবর্তী প্রস্তুতি প্রক্রিয়ায় এবং বাহানের আন্দোলনে মজলিস বিশেষ কোন ভূমিকাই রাখতে পারে | এমনি সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি তমদুন প্রভাবিত সংগ্রাম পরিষদেও উপস্থিত ছিল বলেই তথাকথিত সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের কার্যকলাপে সর্বদলীয় গণতান্ত্রিকতার প্রতিফলন অনেক সময়ই ঘটে নি এবং মজলিসের প্রভাবে আন্দোলন সঠিক ধারা বেয়ে লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে নি। অথচ প্রগতিবাদী ছাত্র-যুব নেতৃত্ব চেষ্টা করেছে যৌথ উদ্যোগের শক্তিশালী পথে আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যেতে। এই নীতির প্রকাশ ঘটেছে ১৬ ফেব্রুয়ারি (১৯৪৮) প্রকাশিত একটি বিবৃতি ও ইশতেহারে, যেখানে অলি আহাদ ও সরদার ফজলুল করিম থেকে নঈমুদ্দিন আহমদ, আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী এবং আবুল কাসেম ও নুরুল হক ভুইয়ার স্বাক্ষর রয়েছে। ইশতেহারটিতে ভাষা আন্দোলন গড়ে তােলার পক্ষে রয়েছে এক সর্বজনীন আহ্বান : আমরা পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের নিকট আবেদন জানাইতেছি, তারা যেন বাংলা ভাষার স্বীকৃতির জন্য আগাইয়া আসেন।

আমাদের মাতৃভাষাকে কোণঠাসা করিবার জন্য যে ষড়যন্ত্র চলিতেছে তার বিরুদ্ধে আমাদের এখন হইতেই তৎপর হওয়া অবশ্য-কর্তব্য হইয়া পড়িয়াছে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, এখানকার সংবাদপত্র ও শিক্ষিত সমাজ এখনাে এ ব্যাপারে সম্যক অবহিত বলিয়া মনে হয় না। আমরা এদিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি। মনে রাখা উচিত বাংলাব্যাপী এক আন্দোলন গড়িয়া তােলা ছাড়া বাংলাভাষা যথাযােগ্য স্থান পাইবে না।” | কিন্তু মজলিসের সঙ্কীর্ণ ও বামবিরােধী একদেশদর্শী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে আন্দোলনের ও সংগ্রাম পরিষদের সর্বদলীয় চরিত্র বজায় রাখা কঠিন হয়েছে। অন্যদিকে ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান অর্জনের অসাধারণ রাজনৈতিক সাফল্যে উদ্দীপ্ত মজলিসের লক্ষ্য ছিল জাতিসত্তার বদলে শুধু ভাষার দাবি ধর্মাদশের সঙ্গে   যুক্ত করে নতুন রাজনৈতিক শক্তির প্রকাশ ঘটানাে। তাই ভাষার সাথে সর্বজনীন বাঙালি জাতিসত্তাকে যুক্ত করে এগিয়ে চলার পথ মজলিসের কাছে গ্রহণযােগ্য ছিল না। তাছাড়া রাষ্ট্রভাষার দাবি জাতিসত্তার সাথে সংযুক্ত করা হলে পাকিস্তানের ধর্মীয় রাষ্ট্রের ভিত্তি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় ভিত্তিতে পরিণত হয় । কিন্তু সেই ভাষিক জাতীয়তার রাষ্ট্র তাদের কাম্য ছিল না বলেই বাংলার বিরুদ্ধে জনাব জিন্নাহর অগণতান্ত্রিক স্পর্ধিত উক্তি তমদ্নপন্থী বাংলা-দরদিগণ নীরবে মেনে নিলেন এবং সে বিষয়ে একটি প্রতিবাদ-উক্তি তাদের মুখ থেকে বেরােয় নি, সামান্যতম কর্মতৎপরতার উদ্যোগ নিতে তারা এগিয়ে আসেননি। এমনকি বাহান্নর আন্দোলনেও তাদের ভূমিকা ছিল দু’একজনের নিতান্ত ব্যক্তিগত পর্যায়ের। তাই তাদের মূল্যায়নে আটচল্লিশের ব্যর্থতা বিজয়রূপে ধরা দিয়েছে। অধ্যাপক আবুল কাসেমের ভাষায় ‘১৯৪৮ সালের আন্দোলন ছিল সীমাবদ্ধ, কিন্তু তাহার সাফল্য ছিল অসাধারণ।’৪৭ এই তথাকথিত সাফল্যের (?) ধারণা থেকেই মজলিসের ভাষানীতি ও তদসংক্রান্ত রাজনৈতিক চিন্তার পরিচয় মেলে।

ভাষা-আন্দোলনে, বিশেষ করে বাহান্নর আন্দোলনে তমদুন মজলিসের বিশিষ্ট ভূমিকা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা তাদের গােড়া থেকেই ছিল। সে চেষ্টা বরাবর চলেছে, মাঝে মধ্যে ঢিমাতালে চললেও এখন বেশ জোর কদমে চলছে, এমন কি চলছে ২০০৪ ফেব্রুয়ারিতে পৌছেও। প্রথম আলাে’ ও ‘জনকণ্ঠ’-এর মত প্রথম সারির কয়েকটি কাগজে প্রকাশিত ভাষা-আন্দোলন বিষয়ক কোনাে কোনাে লেখা থেকে তা বােঝা যায়। | প্রতি ফেব্রুয়ারিতেই একুশে বিষয়ক লেখায় কিছু না কিছু তথ্যগত ভুল-ভ্রান্তি। দেখা যায় এবং সেগুলাে অধিকাংশই মনে হয় বিস্মৃতির কারণে। তবে কখনাে ঐ সব ইতিহাস বিকৃতির পেছনে উদ্দেশ্যের আভাস মেলে। অবস্থা এখন এ পর্যায়ে দাড়িয়েছে যে ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাস-বিষয়ক তথ্যের ভুল সংশােধনের জন্য বিশালতায়ন একটি শুদ্ধিপত্র গ্রন্থের প্রয়ােজন অনিবার্য মনে হয়। কোনাে না। কোনাে গবেষকের এ কাজে হাত দেয়া উচিত। | পুরনাে ভুলভ্রান্তির জের না টেনে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দু’একটি উদাহরণ তুলে ধরাই যথেষ্ট হবে বলে মনে হয়। প্রথম আলাে’র ১৪ ফেব্রুয়ারি (২০০৪) সংখ্যায় জনাব এম.এ. বার্ণিক প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণ প্রসঙ্গে পরােক্ষে তমদুন মজলিসের বিশেষ ভূমিকা নিয়ে যেসব তথ্য দিয়েছেন তা অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক নয়। প্রসঙ্গ শহীদ মিনারের নকশা আঁকা। তাঁর বক্তব্যে প্রকাশ পেয়েছে যে স্মৃতিস্তম্ভের নকশা তৈরির কাজে লিপ্ত ডাক্তার মীর্জা মাজহারুল ইসলাম, ছাত্র সর্বজনাব বদরুল আলম ও সাঈদ হায়দার যথাক্রমে তমদুন মজলিসের কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির দপ্তর সম্পাদক এবং মজলিসের ঢাকা মেডিকেল কলেজ শাখার | নেতা যিনি তাদের ছাত্রফ্রন্ট ছাত্রশক্তির সংগঠনের বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। প্রথমত ডা. মাজহারুল ইসলাম যে নকশা আঁকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না তা  তথ্যসহ ‘শহীদ মিনার অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে। মীর্জা সাহেব তখন সদ্য নিয়ােগপ্রাপ্ত মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সরকারি চিকিৎসক। তখনকার কোনাে সরকারি চিকিৎসককেই ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হতে দেখা যায় নি, চাপ এতটাই প্রবল ছিল।

নকশা আঁকার সঙ্গে তিনি যে যুক্ত ছিলেন না তা সাঈদ হায়দারসহ সংশ্লিষ্ট মেডিকেল ছাত্রদের সাক্ষ্যে প্রমাণিত। আর সংশ্লিষ্টদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলা চলে যে ছাত্র মাজহারুল ইসলামকে কলেজ টিমের একজন কৃতী খেলােয়াড় (ক্রিকেট ও ফুটবল) হিসেবেই তৎকালীন ছাত্ররা দেখেছেন, রাজনীতিতে তার কোনাে সংশ্লিষ্টতা দেখা যায় নি। চিন্তায় তিনি পরবর্তীকালে তমদ্ন সমর্থক হতে পারেন তাতে আপত্তির কারণ দেখি না। একই সমস্যা বদরুল আলমকে নিয়ে। তাকেও কখনাে তমদুন-রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে বা মত প্রকাশ করতে দেখা যায় নি। সবচেয়ে বড়াে কথা, মেডিকেল কলেজের একজন ছাত্রের পক্ষে তার বিপুল পাঠভার নিয়ে মজলিসের দপ্তর সম্পাদকের মতাে একটি সার্বক্ষণিক গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল থাকা কতটা বাস্তব তা ভেবে দেখার বিষয়। আর বদরুল আলম যে এমন একটি পদে আসীন তা তার সহপাঠী ছাত্র কেউ জানবে না বা বদরুল মজলিসের আদর্শ নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলবেন না এমনটা অবিশ্বাস্যই মনে হয়। হয়তাে তাই ডা. সাঈদ হায়দার তাকে মজলিসের নেতা হিসেবে চিহ্নিত করায় ক্ষুব্ধ হয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানিয়েছেন (১৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৪ প্রথম আলাে’) এক কথায় এই বলে যে, “আমি তমদ্দুন মজলিসের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। প্রকৃত তথ্য হলাে ওই সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজে তমদুন মজলিশের বা ছাত্রশক্তির কোনাে ইউনিট ছিল না।… তাছাড়া আমার বিশিষ্ট বন্ধু হিসেবে জনাব বদরুল কোনাে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই যুক্ত ছিল না। তিনি আরাে লিখেছেন, “আমার রাজনৈতিক বিশ্বাসের চরিত্র হননে ক্ষুব্ধ হয়েছি।” ঢাকা মেডিকেল কলেজের সেসময়কার ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক শরফুদ্দিন আহমদ মজলিস সদস্য বিষয়ক তথ্য (২৪.২.০৪) “উদ্ভট ও অসত্য” বলে উল্লেখ করে মন্তব্য করেছেন, বদরুল আলম ও সাঈদ হায়দার সাহেবদের তমন্দুন মজলিসের সঙ্গে যুক্ত করে জনাৰ বার্ণিক ইতিহাসের তথ্য বিকৃতি ঘটিয়েছেন। এর সংশােধনী প্রকাশিত হওয়া দরকার এবং তা ইতিহাসের প্রয়ােজনে।” মজলিস বিষয়ক তথ্যাদি সম্পর্কে তকালীন একাধিক ছাত্রের সঙ্গে আলাপের ভিত্তিতে আমাদের অভিজ্ঞতাও একই কথা বলে।

অবশ্য প্রবন্ধ লেখক ঐসব প্রতিবাদের ‘কৈফিয়ত’ হিসেবে লিখেছেন যে এসব তথ্য বদরুল আলমের সঙ্গে কয়েক দফা আলােচনার (১৯৭৯-৮০) ভিত্তিতে সংগৃহীত এবং সাপ্তাহিক সৈনিক-এ প্রকাশিত (৩১.১০.৫২) সংবাদের (বদরুল আলম দফতর সম্পাদক) ওপর নির্ভর করে লেখা। প্রথমত, মুশকিল যে মৃত ব্যক্তিকে তাে সাক্ষ্য দিতে হাজির করানাে যায় না। আর সৈনিক-এর সব খবরের  ওপর যে সব সময় নির্ভর করা চলে না তা এ বইতে একাধিক (সৈনিক পরিবেশিত) সংবাদ থেকে পাঠক বুঝে নিতে পারবেন। দেখা যাবে যে আবেগ, অতিরঞ্জন ও অতিশয়ােক্তি ছিল সৈনিক-সংবাদের বৈশিষ্ট্য। | তমদুন মজলিস-এর ভূমিকা সম্পর্কিত বিষয়টি আমাদের কাছে বিশেষ উদ্দেশ্যমূলক প্রচার বলে মনে হয়েছে আরাে এ কারণে যে মজলিসের পক্ষে অনুরূপ তথ্যবিকৃতি ‘জনকণ্ঠে-এ প্রকাশিত (২৭,২.০৪) জনাৰ বার্ণিকের অন্য একটি লেখায়ও লক্ষ্য করা গেছে। বাহান্ন সালের ২৩ ফেব্রুয়ারির ঘটনাবলির বিবরণ দিতে গিয়ে জনাব বার্ণিক জনাব বদরুদ্দীন উমরের বই থেকে (ভাষাআন্দোলন গ্রন্থ ৩য় খণ্ড) তথ্য উদ্ধার করেছেন এভাবে : “২৩ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৩টায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হােস্টেলে ভাষা-আন্দোলনের কারারুদ্ধ কম। আজমল হােসেনের কামরায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক কাজী গােলাম মাহবুব একটি বৈঠক ডাকেন। উক্ত বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন তমদুন মজলিসের রাজনৈতিক ফ্রন্টের আহ্বায়ক আবুল হাশিম।”  এবার দেখা যাক মূল লেখায় কথাগুলাে কীভাবে রয়েছে। জনাৰ উমরের বক্তব্য : “কাজী গােলাম মাহবুব ২৩ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৩টায় মেডিকেল কলেজ হােস্টেলে কারারুদ্ধ কর্মী আজমল হােসেনের কামরায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির একটি বৈঠক আহ্বান করেন। বৈঠকটিতে সভাপতিত্ব করেন আবুল হাশিম।” এ দুই উদ্ধৃতির মধ্যে ফারাক মাত্র একজায়গায়।

জনাব বার্ণিকের লেখায় হাশিম সাহেবের নামের পূর্বে “তমদুন মজলিসের রাজনৈতিক ফ্রন্টের আহ্বায়ক” শব্দগুলাে বসানাে হয়েছে যা জনাব উমরের বইতে নেই, এমন কি নেই মূল উৎস অলি আহাদের বক্তব্যে (জাতীয় রাজনীতি, পৃ. ১৭২) যেখান থেকে উমর সাহেব কথাগুলাে উদ্ধৃত করেছেন। স্বভাবতই প্রশ্ন, খুশিমতাে তথ্য পরিবেশনের (তথ্য বিকৃতির) মাধ্যমে মজলিসের পক্ষে এ ধরনের প্রচার কি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রসূত? জবাব পাঠকের বুঝে নিতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। ঢাকায় মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ : বাংলা বনাম উর্দু জিন্নাহ সাহেবের ঢাকা সফর নিতান্তই সফর ছিল না, এতে ছিল সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। ঢাকায় প্রদত্ত তার বক্তৃতার সারাৎসার বিচার করলে দেখা যায়, পূর্ববঙ্গে সঙ্কটাপন্ন লীগ শাসনকে উদ্ধার করতে এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রতন্ত্রে অগণতান্ত্রিক আধিপত্যবাদ নিশ্চিত করতেই তার ঢাকা আগমন। জাতির পিতা হিসেবে জনগণের আস্থার পূর্ণ সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে তিনি সেই উদ্দেশ্যসিদ্ধির চেষ্টা চালিয়েছিলেন; কিন্তু পূর্ববঙ্গের মাটিতে এ কাজ ততটা সহজ ছিল না। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসেন ১৯ মার্চ (১৯৪৮) তমদুন-প্রভাবিত সংগ্রাম পরিষদের কল্যাণে ভাষা আন্দোলন স্থগিত হয়ে যাওয়ার দুই দিন পর। এসে বক্তৃতা দিলেন ঢাকা রেসকোর্সের জনসমুদে (২১  মার্চ), বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে (২৪ মার্চ) এবং ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে তার তিনটি বক্তৃতায়ই ছিল তিনটি কথা, ছিল যুক্তিহীন রূঢ়তায়। এক, উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে; দুই, কমুনিষ্ট ও বিদেশী চরদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রক্ষার প্রয়ােজনে সতর্কতা গ্রহণ; তিন, মুসলিম লীগ দলে যােগ দিয়ে জাতির খেদমত সম্পন্ন করা। প্রসঙ্গত তিনি জানালেন, রাষ্ট্রবিরােধী শত্রুদের শক্ত হাতে (এক্ষেত্রে রুথলেসলি’ শব্দটির ব্যবহার লক্ষণীয়) দমন করা হবে। লীগবিরােধী মাত্রেই তার চোখে হয়ে ওঠে রাষ্ট্রবিরােধী এবং সরকারের সমালােচকগণ হয়ে দাড়ায় ‘কুইসলিং’, ‘পঞ্চমবাহিনী’ ইত্যাদি। এমনি করে গণতন্ত্রের কবর দিয়ে তিনি ঢাকা থেকে ফিরে গেলেন। তার রেসকোর্সের প্রথম বক্তৃতায় দীর্ঘ সময়ের সবটুকুই জুড়ে ছিল ঐ তিনটি সূত্রের ওপর বাগবিস্তার। রাষ্ট্রভাষা বাংলার বিরুদ্ধে এবং উর্দুর পক্ষে কথাগুলাে তিনি বেশ জোরেশােরেই বলেছিলেন। কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর মতে ভাষার প্রশ্নে তার মতামত সেই জনসমুদ্রের একাংশে, সম্ভবত উপস্থিত ছাত্রদের একাংশে মৃদু আলােড়ন সৃষ্টি করেছিল, যা ঐ পরিবেশে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করা সম্ভব ছিল না।

রেসকোর্সে প্রদত্ত বক্তৃতার প্রতিক্রিয়া ছাত্রসমাজে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যাপক ছিল ; তার প্রমাণ তকালীন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম প্রধান নেতা ও তমন মজলিসের অধ্যাপক কাসেম এবং মজলিসের দ্বিতীয় নেতা শাহেদ আলীর ২২ মার্চের বিবৃতি, যা ইতােপূর্বে উল্লিখিত হয়েছে। এরা সেখানে তাদের কায়েদে আজমের প্রতি প্রশস্তিবাচনে এবং কম্যুনিস্টদের প্রতি বিষােদগারের মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রতি কর্তব্য সম্পন্ন করেছেন। ব্যতিক্রম জনাব ফজলুল হক যিনি জিন্নাহ সাহেবের রেসকোর্সের বক্তৃতার সমালােচনা করে ২৩ মার্চ বিবৃতি প্রচার করেন। তার সমালােচনার সুর ছিল তীব্র এবং পুরােপুরি রাজনৈতিক, যেজন্য দৈনিক আজাদ তার চিরাচরিত নিয়মে হক সাহেবের বিবৃতি তির্যক শিরােনামে (‘হক ছাহেবের হুঙ্কার/কায়েদে আজমের প্রতি জঘন্য আক্রমণ’) প্রকাশ করে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। তবে ছাত্রদের প্রতিক্রিয়ার তাৎক্ষণিক প্রকাশ ব্যাপক না হলেও ক্রমশ তা সচেতন ছাত্রসমাজে ঘনীভূত হতে থাকে। তবু কার্জন হলে জিন্নাহ সাহেবের বক্তৃতার প্রতিবাদ সহজ ছিল না। জনাব আবদুল মতিনের জবানিতে জানা যায়, ফজলুল হক হলের কিছুসংখ্যক রাজনীতিসচেতন ছাত্র কার্জন হলে আসন্ন সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ভাষা সম্পর্কে জিন্নাহর পূর্বোক্ত বক্তব্যের পুনরাবৃত্তির পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবাদের ইচ্ছা প্রকাশ করায় ফজলুল হক হলের তৎকালীন ছাত্রনেতা মােয়াজ্জেম হােসেন এই বলে জবাব দেন যে ‘সেক্ষেত্রে প্রতিবাদকারীর লাশ হয়ে ফিরবে।’ ইতােপূর্বে জিন্নাহ সাহেবের ভাষাবিষয়ক বক্তব্যে তমব্দুন মজলিসের প্রতিক্রিয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে করে বৃহত্তর ছাত্রসমাজে বিরাজমান পরিস্থিতি এবং সেই সঙ্গে  পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর প্রতি অন্ধ ভক্তিরও পরিচয় মেলে। এ অবস্থায়ও ২৪ মার্চ কার্জন হলে সমাবর্তন বক্তৃতায় জিন্নাহ সাহেব যখন রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে সেই পুরনাে সুরেই কথা বলেন তখন ঠিকই উপস্থিত ছাত্রদের মধ্য থেকে ‘না-না’ (অবশ্য ইংরেজিতে ‘নাে-নাে’) ধ্বনির প্রতিবাদ উচ্চারিত হয় এবং জাতির পিতা’ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে কিছু তাড়াতাড়ি হলেও শান্তভাবে তার বক্তব্য শেষ করেন।

তবু বিদায়ের প্রাক্কালে প্রদত্ত বেতার ভাষণে তিনি উর্দু রাষ্ট্রভাষার বিষয়টি আবারও বেশ জোরের সাথেই উল্লেখ করেন। কার্জন হলে ঐ ‘না-না প্রতিবাদে অংশ নিয়েছিলেন আবদুল মতিন ও তার সহকর্মী ছাত্রগণ। বদরুদ্দিন উমর তার বইতে এ প্রসঙ্গে এ.কে. এম আহসানের নাম উল্লেখ করেছেন, কিন্তু আহসান সাহেব তা সঠিক মনে করেন না।৪৯ সেইদিন সন্ধ্যায় জিন্নাহ সাহেব সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধিদের (শামসুল হক, কামরুদ্দিন আহমদ, আবুল কাসেম, মােহাম্মদ তােয়াহা, অলি আহাদ প্রমুখের) সাথে যে বৈঠকে মিলিত হন তা উত্তপ্ত বাক্য-বিনিময়ে শেষ হয়। অবশ্য প্রতিনিধিদল তাদের সঙ্গে নিয়ে আসা স্মারকলিপিটি পেশ করতে ভুলে যায় নি। এখানে তমদুন মজলিসের আবুল কাসেম ও শাহেদ আলীর আক্ষেপােক্তিসূচক ২২ মার্চের বিবৃতিটি স্মরণ করা যেতে পারে। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল একবার কায়েদে আজমের সাথে সাক্ষাতের সুযােগ হলেই তারা তাকে বুঝাইতে সমর্থ হতেন এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি আদায় করে নিতে পারতেন। কিন্তু সাক্ষাৎকার ও আলােচনার ব্যর্থতার পরও দেখা গেল, তারা জিন্নাহর অগণতান্ত্রিক বক্তব্যের কোন প্রতিবাদ করেন নি কিংবা আন্দোলন শুরু করার কথা ভাবতে পারেন নি। বরং তাদের পরবর্তী বক্তব্যে ও কার্যকলাপে জাতির পিতার প্রতি অন্ধভক্তি তার ভাষা বিষয়ক অবাঞ্ছিত ভূমিকা সত্ত্বেও এতটুকু হ্রাস পাওয়ার লক্ষণ দেখা যায় নি; অন্যদিকে তারা রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত ব্যর্থতার পুরাে দায়ভাগ বামপন্থীদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে নিশ্চিত হয়েছিলেন। এরপর জিন্নাহ সাহেব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র প্রতিনিধিদের সাথে সাক্ষাতের ইচ্ছা প্রকাশ করায় বিভিন্ন হল ও ডাকসুর প্রতিনিধিসহ মােহাম্মদ তােয়াহা তার সাথে দেখা করতে যান; কিন্তু সেখানে তাদের আলােচনার পরিবেশ ছিল অত্যন্ত শীতল। আসলে জিন্নাহ শুধু মুসলমান ছাত্রদের সাথেই আলাপ করতে চেয়েছিলেন, অন্যদের সাথে নয়। তাই বিশ্ববিদ্যালয় ও হলের নির্বাচিত অমুসলমান ছাত্রনেতাদের উপস্থিতিতে তিনি মুখ খুলতে রাজি হন নি। ঘটনাটি জনাব জিন্নাহর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় তুলে ধরে। দেখা গেল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে (১১ আগস্ট, ১৯৪৭) সম্ভাব্য রাষ্ট্রের রূপরেখা প্রণয়নে যে গণতান্ত্রিক-অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের চেহারা তিনি তুলে ধরেছিলেন (‘এখন থেকে কেউ আর মুসলমান বা হিন্দু নন, সবাই পাকিস্তানি’), সেখান থেকে সরে এসে নবগঠিত রাষ্ট্রের পরিচয় রাখলেন পৃথিবীর অন্যতম সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র’রূপে।

এর অর্থ পাকিস্তানে অমুসলমানদের রাষ্ট্রীয় অধিকার ক্ষুন্ন করা। পাকিস্তানের একনায়ক সেই চরম অগণতান্ত্রিক কাজটি করেছিলেন যে হঠকারী নীতির মাধ্যমে, সেই নীতিরই প্রকাশ ঘটেছিল বাংলাকে অস্বীকার করে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে উর্দুর একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ঘােষণায়। এ নীতি তার উত্তরসূরি শাসকশ্রেণী ভালােভাবেই গ্রহণ করে, যেজন্য গণপরিষদে পাক প্রধানমন্ত্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে স্মরণ করিয়ে দিতে দ্বিধা করেন না যে পাকিস্তান একটি মুসলিম রাষ্ট্র, এর সাধারণ ভাষা মুসলমান জাতির ভাষাই হতে হবে। আটচল্লিশের মার্চে জিন্নাহর রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক ঘােষণা বহুসংখ্যক গণতন্ত্রমনা, রাজনীতিক হিসেবে মধ্যপন্থী মানুষকে আহত করেছিল, কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলার সাহস তাদের অনেকেরই ছিল না। | অন্যদিকে লাহাের প্রস্তাবভিত্তিক পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম প্রধান পরিচালিকাশক্তি ছাত্র-যুব সমাজের গণতান্ত্রিক অংশের চোখে পাকিস্তানের স্বাপ্নিক ছবিটি ছিল গণতন্ত্রের রূপরেখায় খচিত। তাই লীগ শাসকদের সাম্প্রদায়িক, অগণতান্ত্রিক ও উগ্র হঠকারী অবস্থান সত্ত্বেও পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতার কণ্ঠে ভাষা সম্পর্কিত সঙ্কীর্ণচেতনার উচ্চারণ তাদের কাছে কিছুটা অপ্রত্যাশিতই ছিল। হয়তাে তেমনই অপ্রত্যাশিত ছিল সম্প্রদায় সম্পর্কিত তার সঙ্কীর্ণ মানসিকতা, যা পূর্বোক্ত সাক্ষাৎকার ঘটনায় প্রকাশ পায়। তাই জিন্নাহর সাথে দ্বিতীয় দফার সাক্ষাৎকারেও ছাত্র-যুব নেতাদের পক্ষ থেকে স্মারকলিপি পেশ করাই একমাত্র শেষ কথা হয়ে ওঠে।

কথাটা আমরা আগেও বলেছি যে, বাঙালিদের মধ্যে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তায় বিশ্বাসিগণ (সাহিত্যিক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী, এমনকি ছাত্র-যুবাদের মধ্যেও এদের সংখ্যা সে সময় একেবারে নগণ্য ছিল না) কেন্দ্রে বাংলার পরিবর্তে উর্দু রাষ্ট্রভাষার সমর্থক ছিলেন। জিন্নাহর বক্তৃতায় তারা আরাে উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠেন। এরই প্রমাণ মেলে ২২ মার্চ ঢাকায় জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম’ এবং ২৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মুসলিম ছাত্র সভা’র উর্দু রাষ্ট্রভাষার পক্ষে জিন্নাহকে সমর্থন জ্ঞাপনে। দ্বিতীয়টিতে বক্তা ছিলেন শামসুল হুদা, মােয়াজ্জেম হােসেন প্রমুখ। ছাত্র ।৫০ প্রতিটি আন্দোলনেরই কমবেশি প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ ফলাফল থাকে, যেখানে সাফল্য ও ব্যর্থতার কিছু না কিছু পরিচয় ধরা পড়ে। আটচল্লিশি আন্দোলনের ব্যর্থতার পাশাপাশি কিছু ইতিবাচক ফলাফলও তাই লক্ষ্য করা যায়। জিন্নাহর। সফর শেষে অনুষ্ঠিত পূর্ববঙ্গ আইনসভার বাজেট অধিবেশনে কয়েকজন মন্ত্রী (হাবীবুল্লাহ বাহার, মােহাম্মদ আফজল, হাসান আলী) বাংলায় বক্তৃতা করেন।৫০ শুধু তাই নয় ৬ এপ্রিলের (১৯৪৮) অধিবেশনে পূর্ববঙ্গে যথাশীঘ্র সম্ভব ইংরেজির স্থলে বাংলাকে সরকারি ভাষা এবং শিক্ষার বাহনরূপে যথাসম্ভব বাংলাকে গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এখানে যথাশীঘ্র সম্ভব’ কথাগুলাের তাৎপর্য লক্ষ্য করার মতাে। কিন্তু যাইহােক, আন্দোলনের মূল দাৰি কেন্দ্ৰীয় রাষ্ট্রভাষা  হিসেবে বাংলার পক্ষে একটি শব্দও উচ্চারিত হয় না। এমনকি এ বিষয়ে কংগ্রেস সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত আনীত বাংলা রাষ্ট্রভাষার প্রস্তাব লাগ সদস্যদের একাট্টা বিরােধিতায় বাতিল হয়ে যায় । তথাকথিত বাংলা-অনুরাগী হাবীবুল্লাহ বাহার এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ মন্ত্রী ও সদস্যগণও এই সংশােধনী প্রস্তাবের বিরােধিতা করেন। মনে হয়, অবাঙালি শাসকদের ভয় এদের এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল যে সত্য ভাষণের সৎসাহসও এদের অবশিষ্ট ছিল না। আইনসভায় বাংলা রাষ্ট্রভাষার এই দুর্গতির পরও মজলিস কথিত ‘বিরাট সাফল্য ও বিজয় কিভাবে অর্জিত হয়েছিল তা নিঃসন্দেহে গবেষণার বিষয়। প্রসঙ্গত বাংলাবিরােধীদের ভূমিকা নিঃসংশয় করে তােলার পরিপ্রেক্ষিতে মৌলানা আকরাম খাঁর সাথে স্টার অব ইন্ডিয়া’র প্রতিনিধির সাক্ষাৎকারের ঘটনাটি উল্লেখ করা দরকার।

আটচল্লিশের আন্দোলন শেষে আইন পরিষদের উল্লিখিত অধিবেশন চলাকালেই (৫ এপ্রিল, ‘৪৮) ওই প্রসঙ্গে মৌলানা সাহেব বলেন যে, “তিনি ভাষা সমস্যা ও রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে কায়েদে আজমের অভিমত সম্পূর্ণ সমর্থন করেন। তার মতে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা উর্দুই হওয়া উচিত।’ কথা প্রসঙ্গে তিনি ভাষা আন্দোলনে পশ্চিমবঙ্গের চক্রান্তকারী মহলের অর্থ সাহায্যের প্রতিশ্রুতির কথা উল্লেখ করেন।৫১ | বাংলা রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে এই-ই ছিল মুসলিম লীগ দলের রাজনীতিক ও মন্ত্রিপরিষদ এবং তাদের সমর্থক সাহিত্যিক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ঘটনায় তাদের প্রতিক্রিয়া, তাদের বক্তৃতা ও বিবৃতি থেকে বিষয়টি এতই স্পষ্ট যে এ সম্পর্কে বিতর্কের কোন অবকাশ নেই। দ্বিজাতিতত্ত্বসমৃদ্ধ পাকিস্তানি রাজনীতির নৈতিক প্রভাব এদের বাংলা-বিরােধিতার পেছনে কাজ করেছে এবং বাঙালি জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারচেতনার বিকাশেও বাধা সৃষ্টি করেছে বলে মনে হয়। ভাষা আন্দোলনের পর্যালােচনায় এদের ভূমিকা সম্বন্ধে লেখক-ইতিহাসবিদের কোন মােহ থাকা যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয় না। অন্যদিকে এদের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিও খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। প্রসঙ্গত একটি কথা বলা দরকার যে ভাষা-আন্দোলনে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পাশাপাশি ভাষিক জাতীয়তাভিত্তিক গণতন্ত্রী রাষ্ট্রের দাবি অন্তর্ভুক্ত হওয়া দরকার ছিল বলে আজকাল কেউ কেউ মত প্রকাশ করে থাকেন। কিন্তু তখনকার বাস্তব পরিস্থিতিতে তা বরং এক জনসমর্থ হীন দাবি হয়ে উঠে ভাষার দাবিকে পিছে ঠেলে দিতে পারতাে। পাকিস্তানি মৌতাত তখন জনস্তরে এতই প্রবল যে সরকারি লীগের দাপটে বিভাগপূর্বকালের নন্দিত লীগ-নেতা আবুল হাশিম, শহীদ সােহরাওয়ার্দি, এমনকি ঢাকাই নেতা কামরুদ্দীন সাহেবদের কারােরই পায়ের নিচে মাটি ছিল না। প্রগতিবাদী ও উদার গণতন্ত্রী ছাত্রযুবা বাদে তাদের পক্ষে জনসমর্থন ছিল সামান্যই।

পরিস্থিতি তখন স্বৈরশাসনে এমন হয়ে উঠেছিল বলেই দৈনিক আজাদ’-এর  সম্পাদকীয় ভাষ্যে বলা সম্ভব হয় : …“পাকিস্তানের সাধারণ জবান যে উর্দু হইবে, এ সম্পর্কে মতবিরােধের কোনাে অবকাশ নাই।… পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পথে প্রবল বাধা সৃষ্টি করিয়া কয়েক মাস আগেই স্বাধীন এবং সার্বভৌম বাংলার’ ধ্বজা লইয়া। একদল লীগপন্থীকেও নন-কুর্দন করিতে দেখা গিয়াছিল, তাদের কথা ছিল ভাষার ভিত্তিতে রাষ্ট্রগঠন।…এরূপ কোনাে মতলববাজ দলের কুচক্রী হস্তের। খেলাকে পূর্ব-পাকিস্তানের সরকার ও জনসাধারণ যে সহ্য করিবে না, তা বলাই বাহুল্য” (২১.১২.১৯৪৭)। ‘ভাষা-ভিত্তিক রাষ্ট্রগঠন উপলক্ষে আজাদ’ সম্পাদক তথা সরকারি লীগের এ আক্রমণ যে মূলত গণআজাদী লীগের প্রতিষ্ঠাতা কামরুদ্দিন আহমদ ও পূর্বাক্ত দুই রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে তা বুঝতে কষ্ট হয় না।  তাই আটচল্লিশের ফেব্রুয়ারিতে পাক গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কর্তৃক ব্যবহারিক বাংলার দাবি উত্থাপন, তা নিয়ে বিতর্ক এবং ঢাকায় এর প্রতিক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ‘গােয়েন্দা পুলিশ যে সাপ্তাহিক ফরিয়াদ’, ইত্তেহাদ, ইনসাফ কার্যালয় এবং কমিউনিস্ট পার্টির সবগুলাে কার্যালয় ও সংশ্লিষ্ট চাবুক প্রিন্টিং প্রেসে ব্যাপক হামলা চালাবে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই (সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা, ৫ মার্চ, ১৯৪৮)। ঘটনার প্রতিবাদে অবশ্য ৬ মার্চ অনুষ্ঠিত ছাত্রসভায় পুলিশ-হামলার নিন্দা এবং ১১ মার্চের আন্দোলন সফল করার জন্য ছাত্র-যুবা ও জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানানাে হয় (ঐ, ৮ মার্চ, ১৯৪৮)। বলা বাহুল্য, একদিকে অবাঙালি প্রশাসন দ্বারা প্রভাবিত প্রাদেশিক লীগ সরকারের স্বৈরাচার ও প্রতিপক্ষ নির্যাতন, অন্যদিকে উগ্র ধর্মীয় রাজনীতির অসহিষ্ণু বৈরী পরিবেশের মধ্য দিয়ে শেষ হয় আটচল্লিশ মার্চের অসম্পূর্ণ অসফল ভাষা-আন্দোলন। তা সত্ত্বেও চলে আন্দোলনের ধারাবাহিকতা ধরে রেখে একে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা। 

সূত্র : ভাষা আন্দোলন-ইতিহাস ও তাৎপর্য – আবদুল মতিন, আহমদ রফিক