You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ১৬ই সেপ্টেম্বর, সোমবার, ৩০শে ভাদ্র, ১৩৮১

বাংলাদেশ সরকারের কাছে আমাদের দাবী

চিলির জনপ্রিয় সালভেদর আলেন্দের সরকার উৎখাত করার জন্য মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (সি আই এ) এক কোটি দশ লাখ ডলার খরচ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ৮০ লাখ ডলার খরচ করার জন্য অনুমোদন দিয়েছিলেন। অতিরিক্ত ৩০ লাখ ডলার সি আই এর নিজস্ব বাজেট থেকে বরাদ্দ করা হয়। কংগ্রেসের বিশেষ কমিটির নিকট সি আই এ প্রধান উইলিয়াম কলবি এই তথ্য প্রকাশ করেন এবং জানান সি আই এ তার নিয়মিত দায়িত্ব পালন করেছে। তার মতে নৌবহর পাঠিয়ে কিংবা সাধারণ কুটনৈতিক কার্যাদি দ্বারা যে কার্য সম্পাদন করা সম্ভব। নয় গোয়েন্দা সংস্থার গোপন তৎপরতা সে কাজই করে থাকে। উল্লেখযোগ্য কিউবার বিপ্লবী বিজয়কে বানচাল করার জন্য নৌবহর পাঠানো হয়েছিল। পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারী এবং আইয়ুব খানকে ক্ষমতায় অভিষিক্ত করা, ইরানের মোসাদ্দেক সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা; দক্ষিণ ভিয়েতনামে দিয়েমের পতন ঘটান, কম্বোডিয়ায় গোপন বোমা বর্ষণ ইত্যাদি নানা ঘটনার সাথে সি আই এর নাম জড়িত।
চিলির দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার পশ্চাতে এই সংস্থাটি জড়িত ছিল বলে অভিযোগ করা হলে গোড়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তা অস্বীকার করে এবং বলে অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টির ব্যাপারে নিজস্ব ভূমিকা পালন ছাড়া এই সংস্থাটি চিলির অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কোন হস্তক্ষেপ করেনি। মিঃ কলবির এই স্বীকারোক্তি আজ শুধু আমেরিকার জনসাধারণকেই চঞ্চল করে তোলেনি সমগ্র বিশ্বকে চমকিত এবং উৎকণ্ঠিত করে তুলেছে। ভারতস্থ আমেরিকার রাষ্ট্রদূত মিঃ ড্যানিয়েল বি ময়নিহান ওয়াশিংটন একটি তারবার্তা পাঠিয়েছেন। উক্ত তারবার্তায় ময়নিহান জানান শ্রীমতি গান্ধী ভয়ানক রকমের উৎকণ্ঠিত এবং তিনি জানতে চান মার্কিন সরকার তাঁর সরকারকে মনে প্রাণে মেনে নিয়েছেন কিনা। তিনি মনে করেন যুক্তরাষ্ট্র একটি ভয়ানক রকমের স্বার্থপর এবং নীতি জ্ঞানহীন প্রতিবিপ্লবী শক্তি। মিসেস গান্ধীর এই উৎকণ্ঠা একটি স্বাভাবিক সাধারণ উৎকণ্ঠা। চিলির আলেন্দে সরকার যদি আমেরিকার মনঃপুতই না হয়ে থাকে এবং সে কারণেই যদি মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা অর্থ ব্যয় করে বিক্ষোভ ও বিদ্রোহ ঘটিয়ে আলেন্দেকে হত্যা করে তাঁর শাসনের অবসান ঘটিয়ে থাকে তাহলে পৃথিবীর প্রতিটি স্বাধীন দেশই আজ তার সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে উদ্বিগ্ন হবেন। কারণ জাতিসংঘের ভিতরে ও বাইরে ১৪০ এর মতো যে দেশগুলি রয়েছে সবগুলি দেশে আমেরিকার পছন্দ করা সরকার থাকার কথা নয়। একটি দেশের সরকার কাদের নিয়ে এবং কিভাবে গঠিত হবে সেটি সেই দেশের জনগণের সার্বভৌম অধিকার। তারা কি নীতি অনুসরণ করবেন তাও তাদের নিজস্ব শুধু অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। জাতিসংঘের সনদ আন্তর্জাতিক কুটনৈতিক নীতিমালা, দেশে দেশে দ্বিপাক্ষিক এবং বহুমুখী সম্পর্কের মূল ভিত্তি এই সার্বভৌমত্বের বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই। এর লংঘন বা এ থেকে বিচ্যুতি রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তোলপাড় ঘটিয়ে দেবেই। সুতরাং শ্রীমতি গান্ধী যদি কোন উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে থাকেন এবং চিলির অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে মার্কিন হস্তক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে যদি ভারতবর্ষের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে মার্কিন নীতি ও ভূমিকার ব্যাখ্যা দাবী করে থাকেন তবে তিনি যথার্থ কাজ করেছেন।
আমরা জানি বাংলাদেশ সরকার গঠিত ও প্রতিষ্টিত হবার প্রাক্কালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের সরকারকে পছন্দ করেননি। তারা এও চাননি পাকিস্তানের বিচ্ছেদের উপরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আর একটি রাষ্ট্রের জন্ম হোক এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই রাষ্ট্রের কর্ণধার হোন। এ কারণেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা আমেরিকার বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিলাম। পরবর্তীকালে বাংলাদেশের বাস্তবতাকে যুক্তরাষ্ট্র মেনে নিলেও সেই বিরোধিতার মনোভাব ও নীতি তারা প্রত্যাহার করেছেন কি না সে সম্পর্কে কোন ব্যাখা এখনো আমরা পাইনি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার আড়াই বছরের মধ্যে আমরা একটির পর একটি সংকটে নিক্ষিপ্ত হয়েছি। নাশকতামূলক কার্য বিস্তার লাভ করেছে। পাটের গুদামে আগুন, রাজনৈতিক কর্মীদের হত্যা, সার কারখানা ধ্বংস, রেল লাইন উপড়িয়ে ফেলা ইত্যাদি ঘটনা ঘটেই চলেছে। অনেক সময় এর কোন কার্যকারণ সুত্রও পাওয়া যায় না। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পরিমাণ স্বাভাবিক অর্থনৈতিক নিয়ম কানুন লঙ্ঘন করে অনবরত বেড়ে চলেছে। চিলির ঘটনাবলী ঠিক একইভাবে ঘটে চলেছিল। পশ্চিমা সংবাদপত্রগুলো যেভাবে আলেন্দের সরকারের প্রতি বিরূপ মন্তব্য প্রকাশ করত ঠিক একই রূপ আক্রমণের শিকার আমরাও হচ্ছি। অজ্ঞাত সূত্র থেকে প্রাপ্ত অর্থ নানা জনে নানাভাবে ব্যয় করছে। চিলিতে তামা সহ কতিপয় শিল্প ও বাণিজ্য জাতীয়করণ করা হয়েছিল। আমাদের দেশেও পাটসহ অনেক শিল্পবাণিজ্য জাতীয়করণ করা হয়েছে। আমরা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে অক্ষত রেখে সমাজতান্ত্রিক বিকাশের দিকে অগ্রসর হতে চেয়েছিলাম। চিলির জনগণও একই পথ অনুসরণ করেছিল। তাই আমাদেরকেও আজ উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে।
সম্প্রতি সরকারের মধ্যে কিছু লোক সাহায্যের জন্য ক্ষুধার্ত হয়ে উঠেছে । টাকার টোপ যেখানে সেখানেই তারা ছুটে যাচ্ছেন। তারা বিন্দুমাত্র ভেবে দেখছেন না। অর্থ সংগ্রহের এই দুরাশা দুঃস্বপ্নের মরীচিকা কি না। একটি জনপ্রিয় বিপ্লব নামতে নামতে আজকে কোথায় এসে দাড়িয়েছে সে কথা পর্যালোচনা করাও হচ্ছে না। আন্তর্জাতিক সাহায্য আমাদের দরকার। কিন্তু সাহায্য যদি সার্বভৌমত্বের উপর সর্বনাশের খড়গ হয়ে দাঁড়ায় এবং বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর গোপন তৎপরতা চালানোর সুড়ঙ্গ সৃষ্টি করে তাহলে সেই সাহায্য গ্রহণ করা কি সমীচীন?
চিলির অভ্যন্তরে মার্কিন হস্তক্ষেপ নিয়ে সেখানকার জনগণের একাংশ আজ বিক্ষিপ্ত। এ ব্যাপারে সিনেটে একটি সাবকমিটির গোপন শুনানী চলছে। সিনেটর কেনেডি বলেছেন আমি ডঃ কিসিঙ্গারের কাছে জানতে চাই এধরনের কার্যের আইনগত ভিত্তি কি ? এ কাজের কোন আইনগত অথবা নীতিগত ভিত্তি থাকতে পারে না। মার্কিন সংবিধানে বা আইনমালায় যদিও বা তেমন কোন ভিত্তি আবিষ্কার করাই হয় তাহলে সেটা হবে। পৃথিবীর প্রতিটি দেশের জনগণের জাতীয় সার্বভৌমত্বের প্রতি একটা হুমকীস্বরূপ। আমরা দাবী করব আমাদের সরকার যোগ্য স্থানে উপযুক্ত পাত্রে বিষয়টি তুলে ধরবেন। এবং বাংলাদেশের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কোন স্তরে রয়েছে সে সম্পর্কে জনসাধারণকে অবহিত করবেন।

দু’শো মাইল সমুদ্র এলাকা

স্বল্পায়তনে অধিক জনসংখ্যা সম্বলিত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো সুদৃঢ়করণ এবং স্বনির্ভরতার প্রয়োজনে আমাদের সকল সম্পদকে কাজে লাগানোর সময় সমুপস্থিত। দু’শো বছরের ইংরেজ শাসনামলে তো নয়ই, সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর এই চব্বিশ বছরের পাক শাসনামলেও আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যাপক অনুসন্ধান এবং তা ব্যবহারের কোন সুষ্ঠু পরিকল্পনা কার্যক্ষেত্রে দূরে থাকুক, খাতা কলমেও গ্রহণ করা হয়নি। অথচ খনিজ এবং প্রাকৃতিক সম্পদের স্বর্ণোজ্জ্বল ভবিষ্যতের পদধ্বনি আমরা শুনতে পাচ্ছি বর্তমানে এবং সে সম্পর্কে আমরা পরিপূর্ণ আশাবাদী। কথা উঠেছিল বাংলাদেশের আঞ্চলিক সমুদ্রসীমা সম্প্রসারণ করতে হবে। যে সুনির্দিষ্ট এলাকার উপর পূর্ণ কর্তৃত্ব থাকবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সরকার এবং জনগণের, যে নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে বহির্শক্তির অনধিকার অনুপ্রবেশ থাকবে না এবং মৎস্য থেকে শুরু করে খনিজেও অপরাপর সম্পদের উপর পূর্ণ কর্তৃত্ব থাকবে একমাত্র বাংলাদেশের। এই নীতির ভিত্তিতে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের আঞ্চলিক সমুদ্রসীমা বার নটিক্যাল মাইল নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা ছিল অপর্যাপ্ত।
বাংলাদেশ পররাষ্ট্র দফতরের এক নোটিশ বিজ্ঞপ্তির বরাত দিয়ে পত্রিকান্তরে পরিবেশিত এক খবরে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশ গভীর সমুদ্রে তার আঞ্চলিক জলসীমা দুইশত নটিক্যাল মাইল নির্ধারণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। অর্থনৈতিক এলাকা (ইকনমিক জোন) সম্বলিত এই জলসীমার মধ্যেকার সকল সম্পদের উপর একমাত্র কর্তৃত্ব থাকবে বাংলাদেশের এবং এই দুই শত নটিক্যাল মাইলের মধ্যে নৌ-চলাচলের ক্ষেত্রেও সকল কর্তৃত্বের অধিকারী হবে বাংলাদেশ।
বস্তুতঃপক্ষে এ দাবী আজকের নয়, স্বাধীনতার জন্মলগ্ন থেকে সকল মহল থেকেই এই দাবী উত্থাপিত হয়ে আসছে এবং বাংলাদেশ সরকার সঠিক সময়ে এই নির্ভুল পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন বলে আমরা একে অভিনন্দিত করছি মনেপ্রাণে। উন্নত দেশগুলো গভীর সমুদ্রের জলসম্পদ আহরণ করার অত্যাধুনিক কলাকৌশল রপ্ত করেছে বলে সকল সাগরীয় এলাকা তারা চষে বেড়াবে এটা হতে পারেনা এবং পারেনা বলেই প্রত্যেকটি দেশের নিজস্ব অঞ্চলিক সমুদ্রসীমা নিদিষ্ট থাকা প্রয়োজন। যে এলাকার উপর অপর কারো প্রবেশাধিকার থাকবে না এবং নির্দিষ্ট এলাকার সকল সম্পদের উপর কর্তৃত্ব থাকবে একমাত্র সংশ্লিষ্ট সেই দেশটির। বাংলাদেশ সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে সুনির্দিষ্ট এলাকার মধ্য থেকে মৎস্য, খনিজ ও অপরাপর যে সম্পদ আসবে তাতে শুধু দেশের চাহিদা পূরণ নয়, প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা লাভেরও সম্ভাবনা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে আমরা আইসল্যাণ্ডসহ স্ক্যাণ্ডিনেভীয় অঞ্চল এবং জাপানের উল্লেখ করতে পারি। যারা শুধুমাত্র মৎস্য সম্পদ দিয়ে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে প্রতিবছর। তবে শুধুমাত্র ঘোষণার মধ্যেই এই কর্তৃত্বকে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবেনা, সম্পূর্ণ এলাকাকে সংরক্ষিত রাখার ব্যাপারে কার্যকরী ব্যবস্থা অবলম্বন অবিলম্বে প্রয়োজন, যাতে করে বিদেশী ট্রলার এবং জাহাজের অনুপ্রবেশ সমম্পূর্ণরূপে বন্ধ হতে পারে। এবং আপন সামুদ্রিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার দ্বারা আমরা আমাদের অর্থনীতিকে মজবুত করতে পারি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!