You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.09.14 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | ইথিওপিয়ার রাজনীতিতে পট পরিবর্তন | উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে!! | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা: ১৪ই সেপ্টেম্বর, শনিবার, ২৮শে ভাদ্র, ১৩৮১

ইথিওপিয়ার রাজনীতিতে পট পরিবর্তন

ইথিওপিয়ার সম্রাট হাইলে সেলাসীকে গত পরশুদিন সেনাবাহিনীর সমন্বয় কমিটি চূড়ান্তভাবে সিংহাসনচ্যুত করেছে। নাইরোবী থেকে পরিবেশিত ও আদ্দিন আবাবা বেতার কেন্দ্রে খবর থেকে উদ্বৃত্ত সংবাদে বলা হয়েছে যে, সম্রাট হাইলে সেলাসীকে সেনাবাহিনী বিশেষ পাহারাধীনে একটি অজ্ঞাত বাড়িতে নিয়ে গেছে। প্রায় চুয়াল্লিশ বছর ধরে ক্ষমতাসীন সম্রাটের এই অপসারণে কোন প্রতিবাদ বা বাধার সৃষ্টি হয়নি। সম্রাট সেলাসীর বিরাশি বছর বয়সের সর্বশেষ ভাগ্যের খবর এ পর্যন্ত জানা যায়নি। এদিকে ব্রিটেনের সম্রাটের রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে রাজি হয়েছে বলে জানা গেছে। সেনাবাহিনীর সমন্বয় কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সুইজারল্যান্ডে চিকিৎসাধীন সম্রাট আটান্ন বছর বয়স্ক ছেলে আমকা উসেনকে সিংহাসন আহরণ করার জন্য ডেকে পাঠানো হয়েছে, তবে তিনি সম্রাট হবেন তিনি নিয়মতান্ত্রিক সম্রাট হিসেবে বহাল থাকবেন, কার্যকরী ক্ষমতা তার থাকবে না। বস্তুতপক্ষে, ইথিওপিয়ার রাজনীতিতে গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই একটি নতুন পরিবর্তন আসন্ন হয়ে উঠেছিল। এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর সম্রাটের ক্ষমতা সংকুচিত করার জন্য তৎপরতা শুরু করেছিল। সর্বশেষে ইথিওপিয়ার সেনাবাহিনী গত পঁচিশে আগস্ট রাজপথ দখল করে নেয় এবং সম্রাট হাইলে সেলাসিকে অনেকটা অন্তরীণ অবস্থায় রাখা হয়। রাজপ্রাসাদের সকল নথিপত্র সেনাবাহিনীর হেফাজতে নেয়া হয়। তখনই ঘোষণা করা হয়েছিল যে রাজপ্রাসাদ এখন থেকে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হিসেবে পরিণত হবে এবং আর তার নাম হবে ‘জনগণের প্রসাদ’। মূলত গত আগস্টে এই ঘোষণার মাধ্যমে এতকালের ইথিওপিয়ার রাজতন্ত্রের ভবিষ্যত নির্ধারিত হয়ে যায়। গত পরশুদিন এই সেই ঘটনারই পরিসমাপ্তি হয়েছে সম্রাট সেলাসীকে চূড়ান্তভাবে ক্ষমতাচ্যুত করার মাধ্যমে।
বলা হয়ে থাকে প্রায় তিন হাজার বছর ধরে ইথিওপিয়ায় রাজতন্ত্র চলছে। তবে মূলত বাইবেলের যুগ থেকে বিভিন্ন শাসকশ্রেণীর ইথিওপিয়ার রাজ ক্ষমতা দখল করে আনছে। ১৫২৮ থেকে ১৬৩৩ সাল পর্যন্ত পর্তুগিজ এবং ১৮৮২ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত ইটালি ইথিওপিয়ার রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। অবশ্য স্থায়ীভাবে কেউই ইথিওপিয়ার মন জয় করতে পারেনি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর মুসোলিনীর নেতৃত্বে পরিচালিত বাহিনী যখন ইথিওপিয়া আক্রমণ করে তখন হাইলে সেলাসি তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। মূলতঃ সেই থেকেই তিনি জনগণের সম্মান ও সমর্থন লাভ করেন। কিন্তু ক্ষমতায় আসীন হয়ে সম্রাট যেসকল প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছিলেন তা তিনি বাস্তবায়িত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ব্যর্থতার মূল ছিল ফিউডাল লর্ডদের তোষামোদি ও জন বিমুখ তৎপরতা, সম্রাটকে দিয়ে চাটুকারীর মাধ্যমে উদ্দেশ্য হাসিল করিয়ে নেওয়া, সমাজের পুঁজিপতি ও নব্য পুঁজিপতিদের দুর্নীতির দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি, পরিষদের বিভিন্ন প্রকার কার্যকলাপ, বিভিন্ন বিভাগের উপদেষ্টাদের আঁতাত ও প্রকৃত অবস্থান সম্রাটকে না জানানো ইত্যাদি। বস্তুত দারিদ্রতা জর্জরিত অথচ সম্ভাবনাময় ইথিওপিয়ার অর্থনীতি আজ সম্পূর্ণ পর্যদুস্ত হয়ে গেছে। রাজ পরিবার সহ সর্বত্র দুর্নীতি আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। শেষ পর্যন্ত যখন হাইলে সেলাসিকে চূড়ান্তভাবে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে তখন তার নিজের বিরুদ্ধে বিদেশি ব্যাংকে তের শতকোটি টাকা জমানোর এক চাঞ্চল্যকর অভিযোগ আনা হয়েছে। সম্রাট নিজেও স্বীকার করে বলেছেন যে, উক্ত টাকা নাকি তিনি তার সন্তানদের মধ্যে বন্টন করে দিয়েছেন। সম্রাটের মেয়ের বিরুদ্ধে অর্থ-সম্পদ অপহরণের অভিযোগ এনে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমরা জানি ইথিওপিয়া একটি দরিদ্র দেশ। চার লক্ষ সাতান্ন হাজার দুইশত ছাপ্পান্ন বর্গমাইলের এক বিরাট এলাকায় মাত্র দুই কোটি উনষাট লাখ লোক বাস করে। অর্থনীতির সত্তর ভাগ কৃষির উপর নির্ভরশীল। কৃষি ও শিল্প মিলিয়ে তাদের জাতীয় অর্থনৈতিক অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। এ বছর কোন ফসলই হয়নি এবং বহু মানুষ দারিদ্রতার কারণে মারা গেছে, কয়েকটি গ্রাম সম্পূর্ণ জনশূন্য হয়ে পড়েছে। এমনই অবস্থার একটি দেশের যারা এতোকাল কর্ণধার ছিলেন তারা বিদেশি ব্যাংকে টাকা জমিয়েছেন। আর ঠিক এমনই এক অবস্থার মধ্যে সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। আমরা জনমতে বিশ্বাসী মানুষ সেনাবাহিনীর কার্যক্রম সম্পর্কে কোনো সময়ই আশাবাদী নই। তবু তাদের গতিবিধি ও অন্যান্য কর্মসূচি গ্রহণের এবং তার কার্যকারিতা দিকে তাকিয়ে থাকব আর ইথিওপিয়ার মানুষের কল্যাণ কামনা করব।

উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে!!

দেশে যখন কাপড়ের অভাবে চট কাঁথা জড়ানোর মানব মূর্তি দেখা যায় তখন পত্রিকান্তরে সংবাদে জানা যায় বস্ত্র কর্পোরেশন এর গুদামে গাদা গাদা কাপড় ও সূতা পচছে। ‘বাংলার বাণী’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে সুষ্ঠ বন্টন ব্যবস্থার অভাবে বাংলাদেশ বস্ত্র শিল্প সংস্থার ৪৬টি বস্ত্র ও সুতা কলে এবং ব্যাংকের বিভিন্ন গুদামে ১ কোটি ৬৫ লাখ ৭৩ হাজার পাউন্ড সুতা ও ১ কোটি ৮০ লাখ ১৮ হাজার গজ কাপড় পড়ে আছে। এর মধ্যে শতকরা ৫ ভাগ কাপড় সুতা পচে গেছে বলেও প্রতিবেদন সূত্র জানাচ্ছে।
বস্ত্র শিল্প সংস্থার হিসবে অনুযায়ী মজুদ এই সুতা ও কাপড়ের দাম হচ্ছে ৩৯ কোটি ৫ লাখ ৯২ হাজার টাকা। কাপড় পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে সেটা একটা আর্থিক ক্ষতি। তার উপর ব্যাংকের গুদাম ভাড়া বাবদ বস্ত্রশিল্প সংস্থাকে মাসে ১ কোটি টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে। এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে বস্ত্র শিল্প সংস্থার একজন মুখপাত্র বক্তব্য অনুযায়ী আরো জানা গেছে যে, বস্ত্র শিল্প সংস্থা, বিতরনকারী সংস্থা যথা বাংলাদেশ ক্ষুদ্র শিল্প সংস্থা, সমবায় সমিতি ও ভোগ্য পণ্য সরবরাহ সংস্থা স্থানীয় প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিযুক্ত উঠিয়ে নেয়ার তাগদা দিয়ে আসছে। কিন্তু ওইসব সংস্থাগুলি নাকি মাল তুলে নেবার ব্যাপারে তৎপর নন।
অপরপক্ষে ঐসব সংস্থাগুলোর বস্ত্রশিল্প সংস্থাকে কাপড় বন্টনের ব্যাপারে পাল্টা দায়ী করেছেন। ভোগ্য পণ্য সরবরাহ সংস্থা বলেছেন যে, বস্ত্র শিল্প সংস্থার উৎপাদিত কাপড় এর শতকরা ৪৫ ভাগ তাদের বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও গত দু’মাসে তারা বস্ত্র শিল্প সংস্থার কাছে অপেক্ষাকৃত কম ও পচা কাপড় পেয়েছেন। ভোগ্যপণ্য সংস্থার চাহিদা ছিল ১ কোটি গজ কাপড়, তারা পেয়েছেন ৬০ লাখ গজ। ভোগ্যপণ্য সংস্থা ধারে আরো কাপড় নিতে চেয়েছিলেন এবং ধারের টাকা আগামী দুই মাসের মধ্যে পরিষদের প্রতিশ্রুতি দেয়া সত্ত্বেও তাদেরকে কাপড় দেয়া হয়নি।
উক্ত প্রতিবেদনে আরও জানানো হচ্ছে যে, কয়েকজন ডিলার প্রয়োজনীয় কাপড়ের জন্য টাকা জমা দেয়া সত্ত্বেও সময়মতো মিল থেকে কাপড় পায়নি। বিসিকের কর্মকর্তা জানিয়েছেন যে, তারাও প্রয়োজনানুগ সুতা পাননা। সমবায় সমিতি জানাচ্ছেন যে, চাহিদা অনুযায়ী ও সময় মত তাদেরকে সুতা বরাদ্দ করা হয়নি। তদুপরি ব্যাংকে জমা দেয়ার চেক যাচাই করতে গিয়ে দেরি হলেও ওই বিলম্বের জন্য তাদের সুবিধা পেতে বিঘ্ন ঘটে।
দোষ কার বা কে কতটা দোষী তা আমরা বলতে পারি না এবং কাপড় ও সূতা বন্টন ও বিতরণের ব্যাপারে কোনো পক্ষের ডিলার নিতে অধিক কার্যকর তাও জানিনা আমরা। তবে পারস্পরিক দোষারোপের দায়িত্ব অর্পণের ঠেলাঠেলি জন্য বস্ত্র সংস্থার গুদামের বিপুল পরিমাণ কাপড় পড়ে আছে ও পচে যাচ্ছে এই সত্য তথ্য অত্যন্ত মর্মান্তিক। সাধারণত মিলগুলো ব্যাংকের কাছ থেকে সুদের টাকা ঋণ নিয়ে কাপড় উৎপাদন করেন। এই কাপড় আটক থাকলে উৎপাদনের খরচ উঠে আসতে দেরি হয় এবং ব্যাংকের দেনা যথাসময়ে না দিতে পারায় সুদ বাড়তে থাকে। অতঃপর ওই বর্ধিত সুদের অংক পরিশোধের জন্য বস্ত্র শিল্প সংস্থা কাপড়ের দাম বাড়ান। কষ্ট বাড়ে নিরীহ জনসাধারণের এবং এই অ-বশ্য চক্রের সবটাই ঘোরে শুধু যথাযথভাবে ও ঠিক সময়ে উৎপাদিত কাপড় ও সূতা সুবন্টনের অভাবে।
আমরা মনে করি জীবনের মৌলিক চাহিদার মধ্যে খাদ্যের পরেই বস্ত্রের স্থান। বিলাসিতার কথা বাদ দিলেও মোটা সুতার কাপড়ের অভাবে মানবদেহে অনাবৃত অবস্থায় দাফন করার সংবাদ এদেশের লোক সেই পঞ্চাশের মন্বন্তরের একবার শুনে ছিল। কিন্তু আজও যদি শোনা যায় গুদামে কাপড় পচে, সময় মতো কাপড় বন্টন ও সরবরাহের অভাবে কাপড়ের দাম বাড়ে ও কৃত্রিম সংকটে গরিব জনসাধারণ চট ও কাঁথা দিয়ে অঙ্গ ঢাকে, তাহলে সান্তনা পাওয়ার অবকাশ থাকে না।
সামনে ঈদ আসছে। অতএব উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে পড়তে না গিয়ে এখন গুদামজাত কাপড় গুলো ও সুতা যেন অবিলম্বে বাজারজাত করা হয় সেদিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নেক নজর পড়ুক এবং সেইসঙ্গে কাপড়গুলোকে না পচিয়ে লাভের কথা বাদ দিয়ে এসব কাপড় বাজারে ছাড়ার কথা বিবেচনা করতে হবে শীঘ্রই। তাহলে দেশে চাহিদার তুলনায় ঘাটতি কাপড়ের অভাব কিছুটা হলেও কমবে এবং কাপড়ের দাম নিচে নামবে। কিছুটা দেশের জনসাধারণের মুখ চেয়ে এতটুকু অন্তত বিতরণ সংস্থাগুলো এবং ডিলাররা যেন করেন। আর এইসব নৈতিক আবেদনে যদি কাজ না হয় তাহলে বজ্রকঠোর ন্যায়দন্ডের ব্যবহার যেন জনসাধারণ দেখতে পায়।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন