বাংলার বাণী
ঢাকা : ১১ই নভেম্বর, সোমবার, ১৯৭৪, ২৪শে কার্ত্তিক, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ
বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করা কি আদৌ প্রয়োজন?
সরকার চান আর না চান নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধির আর একটি অজুহাত সৃষ্টি হলো। শিল্পে ব্যবহার্য বিদ্যুতের মূল্য তিন শতাধিক ভাগ বৃদ্ধি করার পরও যে শিল্প সংস্থাসমূহের কর্মকর্তারা এবং বেসরকারী শিল্প মালিকেরা এটাকে উৎপাদিত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির একটা অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করবে না—তা অন্ততঃ গত তিন বছরের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা ভাবতেও পারি না। গৃহে ব্যবহার্য বিদ্যুতের মূল্য শতকরা পঁচিশ ভাগ হ্রাস করে জনসাধারণের পিঠে হাত বুলানোর একটা ব্যবস্থা নেয়া হলেও আমরা শিল্পে ব্যবহার্য বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আশঙ্কামুক্ত হতে পারছি না।
সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মন্ত্রী মহোদয় অবশ্য বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার স্বপক্ষে কিছু বক্তব্য রেখেছেন। তিনি বলেছেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনে কাঁচামাল, খুচরা যন্ত্রাংশের মূল্য এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যয় বেড়েছে। স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয় আগের চাইতে বেড়েছে অনেক বেশী। এমতাবস্থায় যদি বিদ্যুতের মূল্য পুনঃনির্ধারণ না করা হতো তবে সরকারকে দিনের পর দিন এ খাতে ক্ষতিই স্বীকার করতে হতো। তাঁর মতে, বিদ্যুতের এই মূল্য বৃদ্ধির ফলে ক্ষতির স্থলে সরকারের মুনাফা হবে চার কোটি টাকা।
অথচ বর্তমান মূল্য অনুসারে সরকারের বার্ষিক ঘাটতির পরিমাণ তেরো কোটি টাকা। এই তেরো কোটি টাকা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে সরকারের কাছ থেকে ঋণ হিসেবে নিতে হচ্ছে। ঋণ পরিশোধ এবং বোর্ডকে একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করানোর জন্য বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি ব্যতিরেকে অন্য কোনো পন্থা খুঁজে পাওয়া যায়নি।
পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন সময়ে বিদ্যুত চুরির নানা অভিযোগ সংক্রান্ত প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। গত পরশুর সাংবাদিক সম্মেলনে মন্ত্রী মহোদয় নিজেই স্বীকার করেছেন, এই বিদ্যুত চুরির পরিমাণ দেশে ব্যবহৃত বিদ্যুতের শতকরা বিশ ভাগ। স্বাধীনতা পরবর্তীকালেই বিদ্যুত চুরির এই ব্যাপকতা পরিলক্ষিত হয়। বাসা এবং অফিসে ছাড়াও শিল্পকারখানাসমূহে আজকাল অবৈধভাবে এন্তার বিদ্যুত ব্যবহৃত হচ্ছে। আর এ সবকিছুই যে বিদ্যুত বিভাগের কর্মকর্তাদের অগোচরে ঘটে চলেছে তা বিশ্বাস করা কষ্টকর বৈকি। বিদ্যুত চুরি রোধে যদি আন্তরিকতা নিয়ে দায়িত্বশীল কর্তাব্যক্তিরা এগিয়ে আসতেন তবে হয়তো মন্ত্রী মহোদয় বর্ণিত লোকসানের অনেকটাই পুষিয়ে নেয়া যেতো।
কিন্তু তা হয়নি। আজ পর্যন্ত বিদ্যুত চুরি রোধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। নেয়া হয়নি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যয় কমানোর কোনো প্রচেষ্টা। ব্যয় বলা হোক অথবা অপব্যয়ই বলা হোক প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে যে এর পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে তা নিশ্চয়ই কারো দৃষ্টি এড়িয়ে যাবার মতো নয়।
বিদ্যুত উৎপাদনে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির যে অজুহাত দেখানো হয়েছে তা সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করতে পারলে আমরাই খুশী হতাম সবচাইতে বেশী। কিন্তু আমাদের জানামতে, দেশের উৎপাদিত বিদ্যুতের অধিকাংশের উপকরণেরই প্রাচুর্য রয়েছে আমাদের দেশে। তেল চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং সে কেন্দ্র সমূহে উৎপাদিত বিদ্যুত এমন কিছু বেশী নয় যে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্যবৃদ্ধি আমাদের বিদ্যুত উৎপাদনের উপর মারাত্মক কোনো প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে। অস্বীকার করবার উপায় নেই যে যন্ত্রাংশের মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু তা কোনো অবস্থায়ই বিদ্যুতের মূল্য সাড়ে তিন গুণেরও বেশী বৃদ্ধি করার স্বপক্ষে যুক্তি হিসাবে গ্রহণ করা যায় না।
সব মিলিয়ে আমাদের মনে হয়েছে শুধু যন্ত্রাংশ এবং কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধিই নয় বরং প্রশাসনিক ব্যর্থতা, বিদ্যুত চুরি রোধে অপরাগতা এবং বিদ্যুত বিভাগের ব্যাপক দুর্নীতি চাপা দেয়ার জন্যই সরকারকে অবশেষে বিদ্যুতের এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। মন্ত্রী মহোদয় আশ্বাস দিয়েছেন বিদ্যুতের এই মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে কোনো শিল্পপণ্যের মূল্য যাতে বৃদ্ধি না পায় সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হবে। জনসাধারণ দুরু দুরু বক্ষে মন্ত্রী মহোদয়ের আশ্বাস কার্যকরী হবার অপেক্ষায় থাকবে ঠিকই কিন্তু সেই সঙ্গে আমরা মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে নিবেদন করবো, তিনি যেন সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনা করার কথা চিন্তা করেন।
হুমকির বর্বরতা এখন বাসি
বিশিষ্ট মার্কিন সাংবাদিক জ্যাক এন্ডারসন ও জোসেফ আলসন তাদের সাম্প্রতিক নিবন্ধে লিখেছেন, তেলের মূল্য হ্রাস করার ব্যাপারে তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর উপর চাপ সৃষ্টির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে আগামী এক বছরের মধ্যে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করতে পারে। কিভাবে এবং কোন্ কোন্ পন্থা অবলম্বন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামরিক শক্তি প্রয়োগ করবে নিবন্ধে তার বিস্তারিত কোনো ইঙ্গিত দেয়া হয়নি। তবে কলামিস্টদ্বয় লিখেছেন অর্থনৈতিক ধ্বংসের হাত থেকে পশ্চিমা দেশগুলোকে রক্ষার করার জন্য মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক শক্তি প্রয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে।
গত বছর অক্টোবর মাসে আরব-ইসরাইল যুদ্ধের সময় থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো প্রাথমিকভাবে তৈলাস্ত্র প্রয়োগ করে এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোকে ইসরাইলের পক্ষাবলম্বন থেকে কার্যতঃ বিরত রাখাই ছিল এ তৈলাস্ত্র প্রয়োগের একমাত্র উদ্দেশ্য। এরপর আরব-ইসরাইল যুদ্ধ শেষ হলো বটে; কিন্তু অতীত নিয়মের পথ ধরে মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সমস্যাবলী জট খুলবার পরিবর্তে শুধুমাত্র প্রতিশ্রুতির নব নব আবরণে ঢাকা পড়ে রইলো। প্যালেস্টাইনীদের নতুন বাসভূমির ব্যবস্থা সহ ইসরাইল অধিকৃত আরব এলাকাগুলো প্রত্যর্পণের কোনো বিহিত করা হলো না। সুতরাং সে প্রয়োজনে তৈলাস্ত্রের ব্যবহার তা অব্যাহত রাখাই স্বাভাবিক এবং আরব তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো সে সঠিক সিদ্ধান্ত থেকে বিচ্যুত হয়নি।
কিন্তু নাভিশ্বাস উঠলো তাদের, যারা একদিকে দীর্ঘদিন ধরে ইসরাইলের পরম হিতৈষীর ভূমিকা পালন করে এসেছে এবং অপরদিকে সহজ শর্তে আরবদের কাছ থেকে তেল পেয়ে আসছিল—সেই পশ্চিমা দেশগুলোও তাদের অকৃত্রিম মুরুব্বী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। তেলের রেশনিং, মুদ্রাস্ফীতি, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাকার দুর্বিপাকে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো সহ সারাবিশ্ব আজ বিপর্যস্ত। কিন্তু প্রশ্ন হলো অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মোকাবেলা কি সামরিক শক্তি প্রয়োগে সম্ভব? তা যে সম্ভব নয় তা বোধকরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভালো করেই জানে। এই তো কয়েক মাস আগেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে মধ্যপ্রাচ্যে খাদ্য অবরোধের হুমকি দেয়া হয়েছিল। আরব বিশ্ব কি সে হুমকির কাছে মাথা নত করেছে? মার্কিন কলামিস্টদ্বয় হয়তো পেন্টাগনের গোপন সূত্র থেকে এ রণনীতির আভাস পেয়েছেন। কিন্তু কিভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক শক্তি প্রয়োগের কথা ভাবছে? আরবরা বর্তমানে মোটামুটিভাবে ঐক্যবদ্ধ। তাহলে আমেরিকাকে ইসরাইলের মাধ্যমে রণক্ষেত্রে নামতে হবে। ইসরাইলের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্য সংগ্রামে আমেরিকার জড়িয়ে পড়ার ঘটনা নতুন নয়। কিন্তু সমস্যা বৃদ্ধি ছাড়া সমাধানের পথ কি বের করা গেছে অতীতে? সামরিক শক্তি প্রয়োগের মধ্যযুগীয় বর্বরতা দিয়ে যে কোনো স্থায়ী সমস্যার সমাধান সম্ভবপর নয় সে শিক্ষা ঐ মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লাভ করেছে বলে আমাদের বিশ্বাস। হোয়াইট হাউস থেকে অবশ্য কলামিস্টদের এ দাবীকে সম্পূর্ণ দায়িত্বহীন বলে অভিহিত করা হয়েছে। আমরা মনে করি, হোয়াইট হাউস মুখপাত্রের এ বক্তব্য সর্বাংশে সত্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতে তেমন কোনো ঝুঁকি নিতে যাবে না—যাতে করে সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে জটিলাবর্তে জড়িয়ে পড়তে পারে। ইসরাইলকে তুষ্টি নয়—আরবদের দীর্ঘদিনের সমস্যার বাস্তব সমাধানের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের তেল সহজলভ্য হতে পারে অন্যথায় নয়। এ বাস্তব বুদ্ধির উন্মেষ ঘটাতে হবে সামরিক তকমা আটা পেন্টাগন কর্মকর্তাদেরও!
সরকারী মাল দরিয়ামে ঢাল
যত মহৎ উদ্দেশ্য নিয়েই টিসিবি গঠন করা হোক না কেন সে উদ্দেশ্য পালনে প্রতিষ্ঠানটি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে এ কথা বললে মোটেই অত্যুক্তি হবে না। রোববারের ‘বাংলার বাণী’তে এই মর্মে এক খবর বের হয়েছে যে, জাপান বাংলাদেশকে যে বিপুল পরিমাণ কাপড় দিয়েছিল তার কিছু অংশ পোকায় কেটেছে, কিছু পঁচে গেছে, বেশ কিছু চুরি হয়েছে আর বাকীটা লাওয়ারিশ অবস্থায় গুদামে পড়ে আছে। কত কাপড় চুরি হয়েছে, কত কাপড় পোকায় কেটেছে, সর্বোপরি কত কাপড় গুদামে আছে এর কোনো প্রশ্নের জবাবই টিসিবি কর্তৃপক্ষ দিতে পারেননি। কোনো দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকে এ রকম লা-জবাব বক্তব্য শোনে সত্যি তাক লেগে যায়। আসলে এঁদের কোনো দায়িত্ববোধ আছে কি না সে সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। কিংবা ধরে নিতে হয় সম্পূর্ণ ব্যাপারটাই এদের ইচ্ছাকৃত বা বানোয়াট কিংবা এঁরা দেশের বিরুদ্ধে একটা বিরাট ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। বিনা এন্ট্রিতে কি করে বন্দর টিসিবি’র এজেন্ট মাল নিয়ে যায় এ কথা যে কোনো সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন লোকের পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন। আসলে টিসিবি’র গুদাম বা বন্দরের গুদামটা কি একটা ‘শকুনের ভাগাড়’ যে যার যেমন ইচ্ছা তেমন মাল নিয়ে যাবে, পোকা কাটবে, নষ্ট হয়ে যাবে অথচ কেউ কিছু বলারও নেই দেখারও নেই। বিনা এন্ট্রিতে কি করে বন্দর থেকে টিসিবি’র এজেন্ট মাল নিয়ে যায় সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন কোনো লোকের পক্ষেই এ কথা কল্পনা করাও দুরূহ।
কাপড়গুলো বিদেশী সাহায্য হিসেবে দিয়েছিল জাপান। সে প্রায় এক বছর আগের কথা। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরটিতে বলা হয় টিসিবি’র গুদামটিতে সেই সাহায্যলব্ধ যে কাপড় পড়ে আছে তা এখন আর ডিলারেরাও নিতে চায় না। কারণ বিপুল পরিমাণ কাপড়ই হয় পোকা কাটা নতুবা পঁচে যাওয়া। চট্টগ্রাম বন্দরের গুদাম আর টিসিবি’র গুদাম সম্পর্কে প্রতিদিন খবরের কাগজের পাতা খুললেই কিছু না কিছু অভিযোগমূলক খবর থাকেই। মাঝে মাঝে টিসিবি কর্তৃপক্ষের প্রতিবাদ লিপিও কাগজের পাতায় দেখা যায়। কিন্তু কথা হলো প্রতিবাদ লিপি ছাপিয়ে কি সব কিছুরই ধামাচাপা দেওয়া যায়? আমাদের বক্তব্য এ সম্পর্কে অবিলম্বে তদন্ত হোক এবং দোষী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে শাস্তি দেওয়া হোক।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক