একুশের চিত্র রচনায় দেশি-বিদেশি সংবাদপত্র
বর্তমান সময়ে সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেল সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতি ঘিরে জাতীয় জীবনে এক বিশাল তাৎপর্যময় ভূমিকা পালন করে চলেছে। পাল্টে দিচ্ছে অনেক কিছু। আর সে পরিবর্তন নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। কিন্তু পঞ্চাশের দশকে এ দেশে প্রচারমাধ্যম হিসেবে বেতার, গুটিকয় দৈনিক ও সাপ্তাহিক সংবাদপত্রই ছিল। একমাত্র সম্বল। বেতার তাে সরকারের নিয়ন্ত্রণে, সেখানে সরকারবিরােধী কোনাে কিছুর প্রবেশ সম্ভব ছিল না। প্রধান দুটি দৈনিক সরকার-সমর্থক আর পাকিস্তান অবজারভার যুক্তিহীন কারণে নিষিদ্ধ। এমন পরিস্থিতিতে তৈরি হয়েছে স্বদেশি সংবাদপত্রে একুশের চালচিত্র। বায়ান্নতে ভাষা আন্দোলনের সংবাদচিত্র পক্ষে বা বিপক্ষে যেসব কাগজে প্রকাশ পেয়েছিল, তার মধ্যে আজাদ, সংবাদ, মর্নিং নিউজ, ইনসাফ, ইত্তেফাক, নওবেলাল ও সৈনিক উল্লেখযােগ্য। এ ছাড়া ছিল ইত্তেহাদ, চাষী ও জিন্দেগীর মতাে গুটিকয়। কাগজ। এগুলাে ভাষা আন্দোলনকে নিজ নিজ নীতি অনুযায়ী চিত্রিত করেছে। তবে এ আন্দোলন পশ্চিম পাকিস্তান ও কলকাতার সংবাদপত্রগুলােকেও স্পর্শ করেছিল। দৈনিক আজাদ মওলানা আকরম খাঁ পরিচালিত মুসলিম লীগ রাজনীতির কট্টর মুখপত্র হওয়া সত্ত্বেও দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে আন্দোলনের প্রথম দিকে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। কিন্তু আন্দোলনে ভাটার টান লাগার সঙ্গে সঙ্গে সম্পাদকীয় নীতির ভােল পাল্টে যায়। তবে সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষই ছিল আজাদ। শুরুতে ‘তদন্ত চাই’, ‘পদত্যাগ করুন’ শীর্ষক সম্পাদকীয় লিখে চমক লাগায় পত্রিকাটি। ইংরেজি দৈনিক মর্নিং নিউজ ভাষাবিষয়ক সংবাদ পরিবেশনের কুখ্যাতির জন্য বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়ে ওঠে। খাজা পরিবারের এই পত্রিকা ‘ভয়েস অব নেশন’ (জাতির কণ্ঠস্বর) পরিচয় নিয়ে একদেশদর্শিতায় সাংবাদিকতার সব নীতিনৈতিকতা বিসর্জন দিয়েছিল। তাই একুশের আন্দোলন নিয়ে এমন মিথ্যাচারও সম্ভব হয় : ঢেটিস রােমিং ঢাকা স্ট্রিটস’ (ধুতিপরা লােকেরা ঢাকার রাজপথে ঘুরছে)। ক্ষুব্ধ স্থানীয় তারুণ্য এ পত্রিকার ছাপাখানা জুবিলি প্রেস পুড়িয়ে দেয়।
একই সঙ্গে সরকার-সমর্থক দৈনিক সংবাদ এতটা না হলেও বাংলাবিরােধিতার জন্য ছাত্রদের ক্ষুব্ধ করে তােলে। অথচ কবির সাহেবদের এ পত্রিকায় কাজ করতেন কিছুসংখ্যক স্বনামখ্যাত গণতন্ত্রী ও বামপন্থী সাংবাদিক। তবু একদেশদর্শী ভূমিকার কারণে একুশের তুঙ্গপর্যায়ে সংবাদ অফিসে কয়েক দফা হামলা চালায় বংশালের স্থানীয় যুবারা। কিন্তু পুলিশের তৎপরতায় সংবাদ অফিস রক্ষা পায়। পাকিস্তান অবজারভার মুসলিম লীগের রাজনীতিক হামিদুল হক চৌধুরীর পত্রিকা হওয়া সত্ত্বেও সম্ভবত দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে ভাষা আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তবে আজাদ-এর মতাে ভােল পাল্টায়নি। What East Bengal Thinks’ বা “Make Protest Day A Success’-এর মতাে সংবাদ পরিবেশন করে অবজারভার তেমন প্রমাণ রেখেছে। দুঃখজনক যে একুশের উত্তেজক দিনগুলােতে বাংলা ভাষার পক্ষে দাঁড়ানাের সুযােগ পায়নি অবজারভার। খাজা নাজিমুদ্দিনের স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে সম্পাদকীয় (ছদ্ম ফ্যাসিজম) লেখার দায়ে ১২ ফেব্রুয়ারির পর অবজারভার সরকারি নির্দেশে বন্ধ হয়ে যায়। | দৈনিক ইনসাফ তার সীমিত শক্তি-সামর্থ্য নিয়েই একুশের পক্ষে বলিষ্ঠ ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। সংবাদ পরিবেশনে কিছু ভুলত্রুটি সত্ত্বেও এর সম্পাদকীয় ছিল বিশ্লেষণধর্মী, যুক্তিনিষ্ঠ। যেমন—সরকারকে কাজী গােলাম মাহবুবের ৯৬ ঘন্টার চরমপত্র দেওয়ার বিরুদ্ধে ইনসাফ-এর বক্তব্য ছিল যুক্তিনির্ভর ও আন্দোলনের স্বার্থনির্ভর। তেমনি ২২ ফেব্রুয়ারি আজাদ সম্পাদকীয় কলামের শিরােনাম যেখানে তদন্ত চাই’, ইনসাফ সেখানে লেখে ‘বিচার চাই’—যা ভাষায় ও বক্তব্যে প্রতিবাদী চরিত্রসম্পন্ন। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর প্রতিষ্ঠিত সাপ্তাহিক ইত্তেফাক সম্পাদকীয় লেখে ‘বিচার চাই’। ভাসানীর চড়া সুরের বিবৃতির সঙ্গে সংগতি রেখে এতে বলা হয় : “দেশের অযুত কণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মিলাইয়া আমাদের ঘােষণা শুধু ছাত্র-জনতার ঘাতক সরকারী কর্মচারীদের নয়, এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের হােতা। সরকারের বিচার চাই প্রকাশ্য গণ-আদালতে।’ একই দাবি ছিল ‘ফায়ার ঈটার মুলানা ভাসানীরও। সাপ্তাহিক নওবেলাল-এর ভাষাও ছিল শাণিত ও কাব্যিক। এর সম্পাদকীয় ‘বুলেটের মুখে গেয়ে গেল যারা’ তেমন প্রমাণ রেখেছে। ঢাকার বুকে যাহারা। জালিনওয়ালাবাগের পুনরভিনয় করিল তাহাদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশের ভাষা আমাদের নাই। সমগ্র জাতির সহিত আমরাও এই রক্তখেকো নরদানবদের কুকর্মের প্রতিবাদ করিতেছি’ ইত্যাদি। এরপর কিছু কাব্যময় পঙক্তি। সাপ্তাহিক সৈনিক-এর ভাষায়ও ছিল প্রবল আবেগ। যেমন সম্পাদকীয় নিবন্ধে, তেমনি সংবাদ পরিবেশনে। একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনা সম্পর্কে ২৩ ফেব্রুয়ারি সৈনিক-এ লেখা হয় : ‘শহীদের তাজা রক্তে রাজধানী ঢাকার রাজপথ রনজিত।’ ভাষা এরপর যথেষ্ট আবেগবহুল। কিন্তু
তথ্যগত কিছু ত্রুটি সৈনিক-এ প্রায়ই দেখা গেছে। দেখা গেছে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ক্ষেত্রে। তবু সৈনিক যথেষ্ট আবেগ নিয়ে একুশের ঘটনাবলি জনসমক্ষে প্রচারের চেষ্টা করেছে। অবাক হওয়ার মতাে ঘটনা যে পূর্ববিরােধিতা ভুলে পশ্চিম পাকিস্তানি পত্রিকা দৈনিক ডন একুশে নিয়ে ঢাকার মর্মান্তিক ঘটনা’ শীর্ষক সম্পাদকীয়তে লেখে; বাংলা ভাষাকে উর্দুর সমমর্যাদা দেওয়া হইলেও পশ্চিম পাকিস্তানের জনসাধারণের মােটেই আপত্তির কারণ থাকিতে পারে না। অন্যদিকে করাচির ইভনিং টাইমস ও ইভনিং স্টার ঢাকায় গুলিবর্ষণ সম্পর্কে তদন্তের দাবি করে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। ডাকসাইটে সাংবাদিক-সম্পাদক জেড এ সুলেরির এ সময় ঢাকা সফর। হয়তাে এর কারণ। তিনি এ সময় এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা। হিসেবে স্বীকার করা বাস্তবতাকে মেনে নেওয়ার মতাে। এটা কোনাে সুবিধাদানের বিষয় নয়।
পেশােয়ার থেকে প্রকাশিত খাইবার মেইল-এ ছিল একই সুর। ওই পত্রিকায়। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদানের জন্য আহ্বান জানানাে হয়। কলকাতার বিশিষ্ট দৈনিক পত্রিকা আনন্দবাজার একুশের ভাষা আন্দোলনের ঘটনাবলি যথারীতি ছেপেছে। পুলিশের গুলিবর্ষণ সম্পর্কে তাৎক্ষণিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ওই পত্রিকায় ২২ তারিখের শিরােনাম : ‘ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকারী ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণ। ১ জন নিহত ও ১৬ জন আহত : ৮ জনের। অবস্থা গুরুতর’। সম্ভবত রফিকউদ্দিনের তাৎক্ষণিক মৃত্যুর খবরই প্রতিবেদক পত্রিকা অফিসে পাঠিয়েছিলেন। অবশ্য পরদিনের শিরােনামে তা সংশােধিত হয়ে মােটামুটি ঠিকভাবেই এসেছে। শিরােনাম : ‘ঢাকায় ছাত্রদের ওপর পুনরায় গুলিবর্ষণ/বৃহস্পতি ও শুক্রবার মােট ৯ জন নিহত’ । বিস্তারিত সংবাদ পরিবেশনের পর ২২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত জানাজায় ‘অবিভক্ত বাঙ্গলার ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী জনাব এ কে ফজলুল হক এবং বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের ভূতপূর্ব সম্পাদক জনাব আবুল হাসেম’-এর যােগদানের খবর দেওয়া হয়েছে। ২৩ ফেব্রুয়ারি আনন্দবাজার-এ সম্পাদকীয় শিরােনাম ‘ভাষা দমনে গুলি”। ঘটনার বিশদ আলােচনা শেষে বলা হয়েছে : পূর্ববঙ্গের মাতৃভাষার দাবিকে এবং জনসাধারণের একটি গণতন্ত্রসম্মত দাবিকে প্রথমে পুলিশের সাহায্যে তাহার পর। সশস্ত্র বাহিনীর সাহায্যে স্তব্ধ করার পন্থা পাকিস্তান সরকার গ্রহণ করিলেন, এই দম্ভ, অবিবেচনা ও নিষ্ঠুরতার পরিণাম কল্পনা করিয়া আমরা দুঃখবােধ করিতেছি’ (উদ্ধৃতি, সুকুমার বিশ্বাস, বাংলাদেশের ভাষা-আন্দোলনে কলকাতার সংবাদপত্র’ থেকে)। এ ছাড়া যুগান্তর, মতামত, এমনকি স্বাধীনতায়ও তথ্যনির্ভর সংবাদ ও বাংলা রাষ্ট্রভাষার পক্ষে সম্পাদকীয় মতামত ছাপা হয়েছে। দৈনিক স্টেটসম্যান পত্রিকায়ও একুশে ও পরবর্তী কয়েক দিনের ঘটনার বিবরণ যথাযথভাবে ছাপা হয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের ওপর পুলিশের।
গুলিবর্ষণ সম্পর্কে ২২ ফেব্রুয়ারি স্টেটসম্যান-এ শিরােনাম : *POLICE FIRES ON STUDENTS IN DACCA: DEMONSTRATION OVER LANGUAGE QUESTION: PROTEST IN ASSEMBLY’. বিস্তারিত প্রতিবেদনে একজনের মৃত্যু ও দুজনের গুরুতর আহত হওয়ার তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে ৬০ জন আহত ও প্রায় ১০০ জন ছাত্রের গ্রেপ্তার হওয়ার খবর। এ ছাড়া ছাত্র-পুলিশের ইটপাটকেল ছােড়াছুড়ি, তর্কবাগীশসহ কয়েকজন এমএলএর পরিষদ কক্ষ ত্যাগ, এমনকি মেডিকেল হােষ্টেল থেকে মাইকে প্রচারের ঘটনাও বাদ যায়নি। ২২ ফেব্রুয়ারি গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনাও খবরে স্থান পেয়েছে। ২৪ ফেব্রুয়ারি সম্পাদকীয় কলামে ঘটনার জন্য সরকারের অদূরদর্শিতাকে দায়ী করে বলা হয়েছে, এ ধরনের রক্তপাত দুঃখজনক এবং এর কোনাে প্রয়ােজন ছিল না (নিজস্ব সংগ্রহ থেকে)। এভাবে দেশি-বিদেশি পত্রপত্রিকায় একুশের ঘটনাবলি প্রকাশ পেয়েছে । অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংবাদচিত্র তথ্যনিষ্ঠ। সেখানে রয়েছে ভাষার দাবির প্রতি সমর্থন। এবং গুলিবর্ষণ ও সরকারি আতিশয্যের বিরােধিতা। স্বদেশে সরকার-সমর্থক। কাগজই শুধু আন্দোলনের বিরােধিতা করেছে এবং এ বিষয়ে মর্নিং নিউজ রীতিমতাে কুখ্যাতি অর্জন করেছিল। বাঙালি-বিরােধিতার জন্য মর্নিং নিউজ তাই বিভিন্ন সময়ে আক্রান্ত হয়েছে। তাতে প্রকাশ পেয়েছে ছাত্র-জনতার ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ।
সূত্র : ভাষা আন্দোলন – আহমদ রফিক