You dont have javascript enabled! Please enable it!

কঠোর দমননীতি সত্ত্বেও ভাষা আন্দোলন চলছে

একুশের আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিমাত্রেরই জানার কথা যে ২৫ ফেব্রুয়ারি সােমবারও শহর ঢাকায় হরতাল-বিক্ষোভ অব্যাহত ছিল। মিছিলে মিছিলে স্লোগান অব্যাহত, বাড়িতে বাড়িতে কালাে পতাকা উড়ছে। সত্যি বলতে কি, সরকার তখনাে তাদের প্রশাসনিক ও নৈতিক কর্তৃত্ব উদ্ধার করতে পারেনি। সংবাদপত্রের ভাষ্যে দেখা যায়, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের অফিস-আদালত জনশূন্য। বাজার, দোকানপাট, ব্যাংক, সিনেমা ও খেলাধুলা সব বন্ধ।’ অর্থাৎ পূর্ণ হরতালের সব আলামত উপস্থিত। স্বভাবতই কর্তৃত্ব উদ্ধারে সরকারের মরিয়া হয়ে ওঠার কথা। সে উদ্দেশ্যে সর্বাত্মক আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নামে কথিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কিন্তু এ কথাও সত্য যে আন্দোলন তখনাে শান্তিপূর্ণ এবং তা মিছিলেস্লোগানে সীমাবদ্ধ। হিংসাত্মক ঘটনার কোনাে প্রকাশ নেই। সংবাদপত্রের প্রতিবেদনেও তা স্পষ্ট। আন্দোলনের কারণে পাকিস্তান ধ্বংস হওয়ার কোনাে লক্ষণই দেখা যায়নি। তবু তেমন প্রচার ঠিকই চলেছে। চলেছে সরকার ও সরকারি দলের পক্ষ থেকে। এ অবস্থায় সরকারের আক্রমণাত্মক পদক্ষেপের সূচনা সলিমুল্লাহ হলে পুলিশইপিআর সেনাদের যৌথ হামলায় । উদ্দেশ্য মাইক ছিনতাই। হামলা ব্যর্থ হওয়ার পর হলের প্রভােস্ট ড. ওসমান গনির মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত যৌথ বাহিনী মাইক হাতে পেয়ে যায়। তারা ফজলুল হক হল ও জগন্নাথ কলেজে হামলা চালিয়ে ছাত্রদের প্রচারযন্ত্র ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়। মাইকের ওপর হামলার কারণ, এগুলাে থেকে প্রাত্যহিক কর্মসূচি প্রচার ছাত্র-জনতার মধ্যে যােগসূত্র তৈরি করে এবং মানুষ ওই কর্মসূচি অনুযায়ী তাদের কর্তব্য নির্ধারণ করেছে। সে ক্ষেত্রে সরকার ছিল অসহায় দর্শক।  এ পর্যায়ে সরকারি আক্রমণ দ্বিমুখী নয়, ছিল বহুমুখী । তারা আন্দোলনের সম্ভাব্য সব উৎসেই হামলা চালায় এবং ব্যাপক গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে ছাত্র-জনতার। মনে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা চালায় । যুবলীগ অফিসে হামলাও একই কারণে। এ ছাড়া  আইনশৃঙ্খলা নষ্ট ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রতি হুমকির অজুহাত তুলে নিরাপত্তা আইনে সরকারবিরােধী লেখক, অধ্যাপক, রাজনীতিক অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়। এমনকি চেষ্টা চলে ছােটখাটো মিছিল থেকে নেতৃস্থানীয় ছাত্র-যুবাদের গ্রেপ্তারের।  মুখ্যমন্ত্রীকে সংকট থেকে উদ্ধারের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের মাথাব্যথা কম ছিল না। এর সঙ্গে সংগতি রেখে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গােলাম মােহাম্মদ এক বিবৃতিতে বলেন, প্রাদেশিকতা পাকিস্তানের সংহতির পক্ষে বিপজ্জনক।…এছলামে ভৌগােলিক সীমানা-সম্পর্কিত বিধিনিষেধের অনুমতি দেওয়া হয় নাই।’

পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে পাকিস্তানি নেতাদের সবাই কমবেশি একই সুরে কথা বলেছেন। পাকিস্তান বিপন্ন, ইসলাম বিপন্ন, বিদেশি ষড়যন্ত্র’ ইত্যাদি শব্দ তাদের মুখে হরহামেশা শােনা গেছে। সরকারবিরােধিতা তাদের চোখে হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রবিরােধিতা। সরকারি দমননীতির কঠোরতার মধ্যেই টানা পাঁচ দিন সর্বাত্মক হরতালের পর মূলত ঢাকাই সরদারদের অনুরােধে এবং দিনমজুর ও দিনকর্মীদের কথা ভেবে হরতাল সাময়িক স্থগিত করা হয়। তা ছাড়া একটানা হরতাল-মিছিল এবং নতুন। কর্মসূচির অভাব ও সরকারি দমননীতির পরিপ্রেক্ষিতে একুশের নেতৃত্বের জন্যও প্রয়ােজন ছিল পরিস্থিতির মূল্যায়ন ও নতুন কর্মসূচি দানের চিন্তাভাবনা। কিন্তু সে দায় পালনে ছাত্র-যুব নেতৃত্ব সফল হয়নি। অন্যদিকে ‘গাঁয়ে মানে না আপনি মােড়ল’ প্রবাদ সত্য প্রতিপন্ন করে বিলুপ্ত সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ সক্রিয় নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ ছাড়াই ২৫ ফেব্রুয়ারি দুপুরে মেডিকেল হােস্টেলে এক বৈঠকে বসে। অনেক তর্কবিতর্কের পর সন্ধ্যায় মুখ্যমন্ত্রীকে ৯৬ ঘন্টার চরমপত্র দেওয়ার প্রস্তাব নেওয়া হয়। অথচ এমন হঠকারী সিদ্ধান্তের পক্ষে কোনাে যুক্তি ছিল না। এ ধরনের একতরফা সিদ্ধান্ত কেন নিলেন’—পরবর্তীকালে এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি। কাজী গােলাম মাহবুব। এখন আর কিছু মনে নেই’—জবাবে এ কথাই বলেছিলেন তিনি। প্রশ্নকর্তা আবদুল মতিন ও লেখক। মুখ্যমন্ত্রী এ অদূরদর্শী পদক্ষেপের জবাব দিতে দেরি করেননি। দমননীতি আরও কঠোর হয়। ২৬ ফেব্রুয়ারির প্রধান ঘটনা তাই কয়েকজন স্বনামখ্যাত অধ্যাপককে গ্রেপ্তার, সলিমুল্লাহ হলে হামলা ও গ্রেপ্তার, শেষ বিকেলে মেডিকেল হােস্টেল ঘেরাও করে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ ধ্বংস এবং যত্রতত্র হামলা ও গ্রেপ্তারে সরকারি চণ্ডনীতির প্রকাশ। ওই চণ্ডনীতি যে কতটা বেসামাল মানসিকতার প্রতীক, তার প্রমাণ সলিমুল্লাহ হলে পুলিশি অভিযানের সময় পশ্চিম।

পাকিস্তানি সাংবাদিক, পত্রিকা সম্পাদক সুলেরি সাহেবকে গ্রেপ্তার । পরে অবশ্য তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। সুলেরি ঠিকই বুঝে নেন পূর্ববঙ্গে কী ঘটছে। এদিনের বিশেষ ঘটনা সরকারি উগ্রতার মুখেও গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে ১২ নম্বর অভয় দাস লেনে মহিলাদের এক সভায় আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া, শহীদদের  সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য প্রকাশের দাবি জানানাে এবং সর্বদলীয় মহিলা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ। উল্লেখ্য, বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন কলেজ, মিটফোর্ডসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ছাত্রীদের এ আন্দোলনে ছিল বিশেষ ভূমিকা। অথচ বিষয়টি অপেক্ষাকৃত কম আলােচিত। মুখ্যমন্ত্রী তার বেতার বক্তৃতা নিয়ে আত্মপ্রসাদে ভুগলেও ভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে তার ভূমিকা নিজের দলেও সমালােচনার সম্মুখীন হয়। একদিকে প্রথম সারির নেতাদের সমালােচনা, অন্যদিকে বরিশাল, সিলেট, ময়মনসিংহসহ একাধিক জেলায় মুসলিম লীগ সদস্যদের পদত্যাগ তাঁকে আরও জবাবদিহিতার মুখে ফেলে দেয়। তা সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রী দমননীতির পথ থেকে সরে আসেননি। পাকিস্তানি স্টাইলে ষড়যন্ত্র ও মিথ্যাচারের নীতি নিয়েই চলতে থাকেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘােষণা এবং ছাত্রদের হলত্যাগের নির্দেশ (২৭ ফেব্রুয়ারি) সম্ভবত তার জিহাদি মনােভাবের সর্বশেষ প্রকাশ ঘটায়। এর মধ্যে আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট নেতাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরােয়ানা জারি হওয়ায় সবাই তখন আত্মগােপনে। এ অবস্থায় আন্দোলন চলতে পারে না। ঢাকাই আন্দোলন তাই স্তিমিত হয়ে আসে মূলত ২৭ ফেব্রুয়ারির পর থেকে চলে খুব ধীরপায়ে ৫ মার্চের হরতাল পর্যন্ত। এরপর ৯ মার্চ শান্তিনগরের বৈঠক থেকে সংগ্রাম পরিষদের মূল নেতাদের গ্রেপ্তারের পর ঢাকায় আন্দোলন শেষ হয়ে আসে। কারণ, তারাই ছিলেন আন্দোলন পরিচালনার প্রধান কারিগর । কিন্তু ঢাকার বাইরে আন্দোলন এর পরও পূর্ণ উদ্যমে চলেছে এবং কোথাও কোথাও যথেষ্ট তীব্রতায়। 

সূত্র : ভাষা আন্দোলন – আহমদ রফিক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!