You dont have javascript enabled! Please enable it!

আক্রমণে আত্মরক্ষার চেষ্টা কোণঠাসা মুখ্যমন্ত্রীর

২১, ২২, ২৩ ফেব্রুয়ারি গােটা ঢাকা শহর রাষ্ট্রভাষার দাবি নিয়ে আন্দোলনে সরগরম। এ কদিনে অনেক হতাহত। ২৪ ফেব্রুয়ারি রােববার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। অফিস-আদালত সব বন্ধ । স্বভাবতই মিছিলের তৎপরতায় কিছুটা ঢিলেঢালা ভাব। এর মধ্যেই নতুন উত্তেজনার খােরাক মেডিকেল হােস্টেল প্রাঙ্গণে শহদি মিনার, শহীদদের স্মৃতি রক্ষার জন্য তৈরি। শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে নানা বয়সী মানুষের শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ দেখতে আসার মধ্য দিয়ে জনচেতনায় সরকারবিরােধী ক্ষোভের নয়া প্রকাশ। ঢাকার বাইরেও একইভাবে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। একুশের ইতিহাস পাঠক জেনে অবাক হবেন যে ঢাকার কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে যােগাযােগ ছাড়াই জেলা ও মহকুমা শহরগুলােতে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের যে সূচনা, তখনাে তা যথেষ্ট তীব্রতা নিয়ে সরকারের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে ওঠে। ছাত্র-জনতার সঙ্গে পুলিশের সংঘাত অনেকটা নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাড়িয়েছে। তবু ছাত্র-জনতা নিজ লক্ষ্যে অটল। একুশের একটি আকর্ষণীয় দিক ছিল লাল-কালাে বর্ণমালায় সাজানাে পােস্টারে। স্লোগানের উজ্জ্বলতা। মেডিকেলছাত্র থেকে চারুকলার শিক্ষার্থী, এমনকি স্কুলকলেজের আঁকিয়ে ছাত্রও সে সময় পােস্টার লেখার উৎসবে যােগ দিয়েছিল। অনভ্যস্তদের আঙুলে ফোসকা । সুদর্শন পােস্টারে ছেয়ে যায় শহর ঢাকার দেয়াল। আর মিছিলে ছাত্রদের হাতে ধরা ফেস্টুন। আশপাশের বাড়ির জানালা থেকে। কৌতূহলী দৃষ্টি মিছিল-ফেস্টুনের দিকে নিবদ্ধ। | ঢাকাই জনতা যে একুশে নিয়ে তখনাে উদ্বেল, তার প্রমাণ যেমন মিছিলে উপস্থিতি, তেমনি সরকারের প্রতি তাদের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ভরা রসিকতা। দৈনিক আজাদ-এ তেমন ঘটনা ছাপাও হয়েছে।

চৌকস বয়ানের সরস রসিকতায় ঢাকাই জবানের খ্যাতি তাে তুলনাহীন। একুশে উপলক্ষে দেখা গেছে তেমন কিছু কিছু প্রকাশ। কে বলে আন্দোলনে তখন ভাটার টান? পুলিশ ও প্রশাসনের রক্তচক্ষু  উপেক্ষা করে ছােট-বড় যেসব ছাপাখানা একুশের লিফলেট-ইশতেহার সরবরাহ করেছিল, তাদের ভাষিক প্রেম ভােলার কথা নয়। সেসব দলিল কমই সংরক্ষিত হয়েছে। এমনই আমাদের ইতিহাস-সচেতনতা। আন্দোলন যে তখনাে আপন শক্তিতে সক্রিয়, তার আরেক প্রমাণ সরকারি প্রতিষ্ঠান ঢাকা বেতার কেন্দ্রে চার দিনব্যাপী পূর্ণ হরতাল। সেদিনও শহরের নানা স্থানে সরকারবিরােধী সভা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও প্রতিবাদে শামিল এবং ২৫ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত। অন্যদিকে অধ্যাপকদের সভায়। গুলিবর্ষণের নিন্দা, দায়ী ব্যক্তিদের অপসারণ, ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার এবং অবিলম্বে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে প্রস্তাব নেওয়া হয়। কাজেই আন্দোলনে ভাটার টান লেগেছে, আন্দোলন বন্ধের সময় হয়েছে’—দু-একজন নেতার এজাতীয় উক্তির কোনাে ভিত্তি নেই। চলমান আন্দোলনের চিত্ৰচরিত্রের দিকে তাকালে এবং বিশ্লেষণ করে দেখলে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেকোনাে গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনে নেতৃত্বের আপসবাদী অংশ এ ধরনের ভূমিকাই নিয়ে থাকে, পরিস্থিতির সুযােগ তারা নিতে চায় না। এমন ঘটনা এ দেশের আন্দোলনে একাধিকবার দেখা গেছে। সত্যই আন্দোলনের ওই পর্যায়ে নানা আদর্শ ও ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্বে বিভক্ত নেতৃত্ব পরিস্থিতির সদ্ব্যবহার করতে পারেনি। একমাত্রিক দাবির দুর্বলতা বুঝে নিয়ে বহুমাত্রিক জনস্বার্থনির্ভর কর্মসূচি গ্রহণের বিচক্ষণতা দেখাতে পারেনি তারা। দুএকজন নেতার অনুরূপ ভাবনা আমলে আনেনি নেতৃত্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। আইন পরিষদে যখন রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে সুপারিশ প্রস্তাব হয়েছে, তখন এই একক দাবি নিয়ে বেশিদূর যাওয়া সম্ভব ছিল না। এ সহজ সত্য ও আন্দোলনের দুর্বলতা সরকার বুঝলেও আমাদের নেতৃত্ব বুঝতে পারেনি অথবা বুঝতে চায়নি। হয়তাে দূর-গন্তব্যে পৌছানাের ইচ্ছা তাদের ছিল না।

কিন্তু সরকার সুযােগের সদ্ব্যবহার ঠিকই করেছিল এবং তা ষড়যন্ত্র, মিথ্যাচার ও অপপ্রচারের মাধ্যমে। জনমানসের পাকিস্তানপ্রীতির দুর্বলতা তারা পুরােপুরি। কাজে লাগাতে চেষ্টা করেছে। মুখ্যমন্ত্রীর এদিনকার বেতার-বক্তৃতায় এসব অপতৎপরতার সূচনা। পাকিস্তানি শাসকদের চিরাচরিত পথ ধরে মুখ্যমন্ত্রী। অভিযােগ তােলেন, আন্দোলনের কারণে পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিপন্ন। তাঁর মতে, পাকিস্তান ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে রয়েছে দেশি-বিদেশি রাষ্ট্রদ্রোহী চক্র, রয়েছে তাদের অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ। তারা ব্যবহার করছে ভাষা আন্দোলনকে। তাদের পেছনে রয়েছে ক্ষমতাবঞ্চিত সুবিধাবাদী রাজনীতিক গােষ্ঠী। রয়েছে ভারতীয় মদদ। এ-জাতীয় মিথ্যাচারে ভরা লাখ লাখ কপি প্রচারপত্র সরকারি প্রেস থেকে ছাপিয়ে জনসাধারণের কাছে পৌছে দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য পাকিস্তান-অনুরাগী জনতার মগজ ধােলাই।  জনগণের অর্থ খরচ করে দলীয় স্বার্থে এমন কাজ সরকার করতে পারে কি , তা নিয়ে প্রশ্ন তােলা যায়। চারদিকে আটঘাট বেঁধে একুশের মােকাবিলায় মাঠে নামেন মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন। এ কাজে তার সহায়ক চতুর প্রশাসন। সম্ভবত তাদের পরামর্শে হঠাৎ আইনসভার অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করার ব্যবস্থা নেন তিনি। ভাষাবিষয়ক ঘটনাবলি ও বিরাজমান বিস্ফোরক পরিস্থিতির দায়ে তিনি তখন খলনায়কের ভূমিকায়। আইনসভার সদস্যদের নানামুখী প্রশ্নে তীরবিদ্ধ মুখ্যমন্ত্রী জবাবদিহির দায় এড়াতে ওই ব্যবস্থা নেন। একটা ফ্রন্ট তাে বন্ধ হলাে। এরপর তার পাল্টা আক্রমণ। একদিকে সে আক্রমণের লক্ষ্য ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী ও বিরােধী রাজনীতিক, অন্যদিকে পরােক্ষ আক্রমণ কূটকৌশলী প্রচারের চালে একুশে ও তার কারিগরদের চরিত্র হননের চেষ্টায়। একুশের নেতৃত্বে বিরাজমান বিভেদ ও অন্তর্দ্বন্দ্বের দুর্বলতা। মুখ্যমন্ত্রীর দুরভিসন্ধিমূলক কাজে সাহায্য করেছে। সরকারি দল মুসলিম লীগও একইভাবে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ২৪ ফেব্রুয়ারি। থেকে আন্দোলনের চাপে কোণঠাসা সরকার আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে প্রতিপক্ষের ওপর আক্রমণের নীতি গ্রহণ করে। শুরু হয় সর্বাত্মক প্রস্তুতি। তাদের পরবর্তী প্রতিটি পদক্ষেপে তা বুঝতে পারা যায়। 

সূত্র : ভাষা আন্দোলন – আহমদ রফিক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!